মিথ্যাচারের মধ্য থেকেও যে সত্য বের হয়ে পড়ে তার এক অনুপম প্রকাশ মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বই। জেনারেল নিয়াজির মতাে তার স্মৃতিকথায়ও তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রায় সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু হামুদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট প্রসঙ্গে তিনি বইয়ের শেষে যে পরিশিষ্ট যােগ করেন সেখানে বিষয়টির অবতারণা না করে পারেন নি। বঙ্গবন্ধু যে হামুদুর রহমান কমিশনকে গণহত্যা বিষয়ক প্রচুর তথ্য-প্রমাণ দিয়েছিলেন সেটা নিয়াজির বয়ান থেকে জানা যায়। এইসব কাগজপত্রের মধ্যে দ্রুত হাতে লেখা হত্যার জন্য চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের নাম ফরমান আলীর ডেস্ক ক্যালেণ্ডারও যে লিপিবদ্ধ ছিল, সেটা তার লেখাতে সুস্পষ্ট। তবে ফরমান আলী ক্যালেন্ডারের এই পাতাগুলাের কথা বেমালুম চেপে গিয়ে তার নিজ হাতে লেখা আরেকটি মন্তব্যের সাফাই গেয়েছেন। তার ডেস্ক ক্যালেন্ডারে লেখা ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সবুজকে লাল রং করে দেয়া হবে।’ এই বাক্যে পাকিস্তানি জেনারেলের চরম বর্বর মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছিল। কুখ্যাত এই জেনারেল বইয়ে লিখেছেন যে, বাক্যটি তার হাতের লেখা বটে তবে উক্তিটি নাকি তার নয়। ১৯৭০ সালে ভাসানীপন্থী ন্যাপ আয়ােজিত পল্টনের জনসভায় তােয়াহা নাকি এই উক্তি করেছিলেন এবং এ বিষয়ে সেনা-গােয়েন্দা দলের রিপাের্টের বক্তব্য তিনি ডেস্ক ক্যালেন্ডারে লিখে রেখেছিলেন। তবে ফরমান আলীর সবিস্তার ব্যাখ্যায় অবশ্য এটা উল্লিখিত হয়নি যে, ১৯৭১ সালের ডেস্ক ক্যালেন্ডারে ১৯৭০ সালের বক্তব্য কীভাবে লেখা হলাে! দৈনন্দিন কাজের উল্লেখ বা চটজলদি চিন্তার দ্রুত-ভাষ্য ডেস্ক ক্যালেন্ডারে লিপিবদ্ধ করার যে রীতি সেখানে পূর্ববর্তী বছরের ঘটনা সেম্পর্কিত কোনাে নােট রাখার কথা বলাটা যে মূর্খের যুক্তি সেটা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কোনােরকম জেরা কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া নিজের কথা নিজে বলার সুবিধা হলাে এর বিষয় নির্বাচনে যথেচ্ছ স্বাধীনতা। তাই ফরমান আলী বেমালুম চেপে গেছেন তার ডেস্ক ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে রােমহর্ষক পাতাগুলাের কথা, যেখানে হত্যার জন্য নির্বাচিত বুদ্ধিজীবীদের নামের আদ্যাক্ষরগুলাে পরপর লেখা ছিল। হত্যার জন্য বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করার কাজটি যে তার দফতরে বসেই করা হয়েছিল সেটা বুঝতে কোনাে অসুবিধা হওয়ার নয়। যেটা বােঝা কষ্টকর তা হলাে, একজন মানুষ সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা পরিপূর্ণভাবে নির্দোষ মানুষদের ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা এঁটে কীভাবে হত্যা করতে পারে! এটা তখনই সম্ভব যখন তার মনে জাতিঘৃণা অথবা শ্রেণীঘৃণা তীব্র হয়ে ওঠে।
ফরমান আলীর তীব্র বাঙালি ঘৃণার সাক্ষ্য রয়ে আছে তার গ্রন্থের বিভিন্ন বয়ান। একজন মানুষ কী করে জল্লাদ হয়ে ওঠে সেই মানস প্রক্রিয়ার দলিল হিসেবে ফরমান আলীর বইয়ের পাঠ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযােগ একেবারে এড়িয়ে যেতে পারেন নি ফরমান আলী। যেটুকু বিবরণ তিনি দিয়েছেন সেখানে তার বক্তব্যের স্ববিরােধিতা কোনােভাবেই দূর করতে পারেন নি এবং এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে পাকবাহিনীর সম্পৃক্ততার স্পষ্ট স্বীকারােক্তি অজান্তেই তিনি রেখে গেছেন। তার ভাষ্যে দেখা যায়, তিনি কবুল করেছেন পাকবাহিনীর নৃশংস ভূমিকা কিন্তু দোষ চাপাতে চাইছেন নিয়াজির ওপর, কখনাে বা আলবদরদের ওপর, আবার কখনাে খুব আশ্চর্যজনকভাবে, ভারতীয় বাহিনীর ওপর, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য ভারতীয়রাই নাকি এই কাণ্ড করেছিল! তবে ফরমান ফরমান আলীর অজস্র মিথ্যাচারের মধ্যে একখণ্ড সত্যভাষণ গােটা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা মেলে ধরেছে। তিনি লিখেছেন যে, ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর ঢাকার কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদ পিলখানায় তার দফতরে আসার জন্য বলেন। কম্যান্ড পােস্টে ঢােকার পথে তিনি বেশ কিছু গাড়ি দেখতে পান। জামশেদের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি নাকি ফরমানকে জবাব দিয়েছিলেন, বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতারের জন্য তিনি নিয়াজির হুকুম তামিল করতে। এই ব্যবস্থা নিয়েছেন। ৭ ডিসেম্বর থেকেই পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিরােধে ধস নামতে শুরু করে এবং সব রকম প্রতিরােধ চূর্ণ করে এগােতে থাকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। ৬ ডিসেম্বর গভর্নর হাউজের সভায় বীরপুঙ্গব নিয়াজি নাকি ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন। তার পরিণতির কথা ভেবে- এমন ভাষ্য দেন ফরমান নিজেই। ৭ ডিসেম্বর অপর এই বীরপুঙ্গব ফরমানই গভর্নরের সঙ্গে মিলে জাতিসংঘকে তাদের আত্মসমর্পণের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। ফলে নিজেদের পরাজয় বিষয়ে এই দুই বাহাদুর জেনারেলের কারাে মনে কোনাে সংশয় ছিল না। এমনি পটভূমিকায় ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পিলখানায় ঢাকা কম্যান্ডের সদর দফতরে নিয়াজি, ফরমান ও জামশেদ উচ্চ পর্যায়ের সভা করেছিলেন এবং এর সত্যতা ফরমান আলীর সাক্ষ্য থেকে মেলে। সভার আগে থেকেই গাড়ির বহর প্রস্তুত ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে আনার জন্য, এটাও ফরমান আলীর ভাষ্যে মিলে।
ফরমান এরপর বলেছেন, বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতার করার কথা নাকি সভায় তাকে জানানাে হয় এবং তিনি প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে তিন পাকিস্তানি জেনারেল জরুরি সভা করছেন আলােচ্য বিষয় বাঙালি বুদ্ধিজীবী, যা-কিনা কোনাে সামরিক বিবেচনার বিষয়ই নয় এবং এ-থেকেই পাপীদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। আর যে গ্রেফতারের কথা বলা হচ্ছে সেটা যে আসলে ছিল গ্রেফতার ও হত্যার পরিকল্পনা তা বুঝতে না পারার কোনাে কারণ নেই, কেননা তখন পরাজয় কেবল দিন বা ঘণ্টার ব্যবধান, এ-সময়ে কে কাকে গ্রেফতার করবে, কোথায় আটক রাখবে, সব ব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ছে তখন সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এমনি জরুরি সভা কেন ডাকা হয়েছিল, তা গ্রেফতারের পরিণতি থেকে বুঝতে বাকি থাকে না। ফরমান-কথিত সেই গাড়িগুলাে যে মাটিলেপা মাইক্রোবাস সেটা পরের ঘটনাধারায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের কাছ থেকে খুব স্পষ্টভাবে জানা যায়। তাছাড়া কম্যান্ড অফিসের সামনে সামরিক যানের বহর মােতায়েন থাকলে সেটা জেনারেল ফরমানের চোখে আলাদাভাবে পড়বার কোনাে কারণ থাকতে পারে না। নির্দেশ মােতাবেক যে প্রস্তুত ছিল বেসরকারি যান সেটা ফরমানের বয়ানে পরােক্ষভাবে স্বীকৃত হয়েছে। আসন্ন পরাজয়ের মুখে বাঙালি জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ থেকে ইতিহাসের যে বর্বরােচিত কাপুরুষােচিত হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল তার প্রাগ-মুহূর্তগুলাে ফরমানের শীতল বর্ণনায় রােমহর্ষকভাবে ফুটে উঠেছিল। এই পাপিষ্ঠ যুদ্ধাপরাধীদের আন্তর্জাতিক সভায় বিচারের জন্য জোরদার আন্দোলন সূচিত হওয়া দরকার আজকের বিশ্বে দাবিটি আরাে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে কারণ সত্তরের পৃথিবী থেকে অনেক আলাদা একবিংশ শতকের মুখখামুখি পৃথিবী।
আজ বসনিয়া ও রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত গঠিত হয়েছে এবং জেনারেল পিননাশে মৃত্যুশয্যাতেও আইনের নিরপেক্ষ অপিচ মানবিক কাঠগড়ায় হাজির হওয়ার তলব লাভ করেছেন। পাকিস্তানি জেনারেলদের জানােয়ার-সুলভ চেহারার একটি দিক তাদের নির্দয়তা ও নিষ্ঠুরতা এবং আরেকটি দিক তাদের কাপুরুষতা। সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে অমর্যাদাকার কাজ, নিজের বাহিনী ফেলে সেনাপতির পলায়ন, সেটা করতেও পাকিস্তানি জেনারেল পিছ-পা হন নি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাকবাহিনীর এই কলঙ্কিত কাহিনী খুব বেশি আলােচিত হয় নি। নিজেদের ইমেজ বহাল রাখতে পাকিস্তানি সেনাকর্তৃপক্ষও এই জেনারেলের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেয়নি। লাঙল গুটানাে এই বাহাদুর হচ্ছেন মেজর জেনারেল এম রহিম খান হিলাল-ই-জুরাত । ১৮ অক্টোবর গঠিত ৩৯তম ডিভিশনের তিনি ছিলেন প্রধান সেনাপতি।
মেঘনার পূর্ব তীর থেকে সালদা নদী হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ফ্রন্ট ছিল তার দায়িত্বাধীন। তার অধীনে ছিল দুটি আর্টিলারি রেজিমেন্ট, এছাড়া ছিল চারটি ব্রিগেড। এদের মধ্যে ছিল কুমিল্লায় ঘাটি করে ১১৭ ব্রিগেড (ব্রিগেডিয়ার আতিফের অধীনে), ফেনিতে ঘাটি করে ৫৩ ব্রিগেড (ব্রিগেডিয়ার আসলাম নিয়াজির অধীনে), রামগড়ে ঘাঁটি করে ৯১ ব্রিগেড (ব্রিগেডিয়ার তাকসিদউদ্দিনের অধীনে) এবং চট্টগ্রামে ঘাঁটি করে ৯৭ ব্রিগেড (ব্রিগেডিয়ার আতা মালিকের অধীনে)। ৩৯ ডিভিশনের এই বাহিনীর মুখােমুখি হয়েছিল মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ৪ ডিসেম্বর প্রত্যুষ থেকে। জেনারেল রহিম খান তার হেড কোয়ার্টার করেছিলেন চাদপুর। যুদ্ধের প্রথম ধাক্কাতেই ৫৩ ব্রিগেড অগ্রসর অবস্থান থেকে পিছু হটে ঘাটি স্থাপন করে লাকসামে। সেখানে আগে থেকে কংক্রিটের শক্ত প্রতিরােধ ব্যবস্থা তৈরি করা ছিল। পাকবাহিনীর এইসব কংক্রিট বাংকারের চিহ্ন এখনাে লাকসামে রয়ে গেছে। মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খান তার পাকিস্তান ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ গ্রন্থে জানাচ্ছেন যে, লাকসামে ৫৩ ব্রিগেড শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। আর ৩৯ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল এম রহিম খান তার এডিসি ও তিনজন মিলিটারি পুলিশসহ লাকসাম যাওয়ার পথে আকস্মিক গােলাগুলির মধ্যে পড়ে যান। জেনারেল রহিম তখন মনে করেছিলেন ৫৩ ব্রিগেড ঘাটিতে পৌছতে পারে নি এবং ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনী এখন চাঁদপুরের দিকে ধেয়ে আসছে। ৬ ডিসেম্বরের এই ঘটনার পর আর বেশি দেরি করেন নি রহিম খান। তার সমস্ত বাহিনীকে পেছন ফেলে ৮ ডিসেম্বর তিনি চাঁদপুর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ঢাকার পথে রওনা হন। মুক্তিযােদ্ধাদের সুবাদে ঘটনাক্রম সবই জানা ছিল মিত্রবাহিনীর এবং নদীপথে জেনারেলের গানবোেট ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আহত হয় জেনারেল রহিম।
পরবর্তী সময়ে এই ঘটনার বর্ণনাদানকালে জেনারেল রহিম, পাক জেনারেলদের স্বভাবানুযায়ী যুদ্ধে বিপর্যয়ের দোষ চাপিয়েছেন অপরের ঘাড়ে এবং এই কাজ করতে গিয়ে পাকবাহিনীর স্বরূপও উন্মােচন করেছেন। তিনি লিখেছিলেন : ‘অনেক অফিসার, যাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিন্যাল আচরণের অভিযোেগ ছিল, তাদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেয়া হয়েছিল। এসব অপরাধের মধ্যে ছিল একাত্তরের মার্চে ধর্ষণ এবং সরকারি ব্যাংক ও ট্রেজারি লুট।’ নিজের পলায়নের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রহিম খান বলেছেন, চাঁদপুরের ঘটি কোনাে হেডকোয়ার্টার ছিল না এবং ইস্টার্ন কম্যান্ড অতিশয় কঁচাভাবে শক্রকে বিভ্রান্ত করার আকাঙ্ক্ষায় একে হেডকোয়ার্টার আখ্যায়িত করেছিল। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে তিনি সবকিছুকে কিছুটা বাড়িয়েই দেখিয়েছেন এবং বিপর্যয় দেখতে পেয়েছেন সম্মুখ যুদ্ধের একেবারে সূচনাতে। তিনি লিখেছেন, : ৪ ডিসেম্বর ট্যাঙ্ক ও বিমান বাহিনী নিয়ে শত্রু আক্রমণ শুরু করে এবং ৫৩ ব্রিগেড তখনও ফেনি থেকে পিছিয়ে আসছিল মুদাফফরগঞ্জের শক্ত অবস্থানে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দুটো ব্যাটালিয়নের প্রতিরােধই অপ্রত্যাশিতভাবে ভেঙে পড়ে এবং ৫৩ ব্রিগেড মুদাফফরগঞ্জ পৌছবার আগেই শত্রু সেখানে পৌছে যায়। তাই চাদপুর, যেখানে ডিভিশনের হেড কোয়ার্টার অবস্থিত এবং অগ্রসরমান শত্রু, এর মাঝখানে আর কিছু ছিল না।’ জেনারেল রহিমের এই ভাষ্য যে তার পলায়নের সাফাই সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে যঃ পলায়তি সঃ জীবতী নীতির প্রয়ােগ জেনারেল রহিম এখানেই সাঙ্গ করেন নি। পরের ঘটনা আরাে চমকপ্রদ। তিনি কতােটা আহত হয়েছিলেন সেটা কখনাে খুলে বলেন নি, আর কেউ সেটা জানায়ও নি। ফরমান আলীর ভাষ্যে দেখা যায় জেনারেল পুঙ্গব দু-দিন সিএমএইচে পড়ে ছিলেন একটা ঘােরের মধ্যে। বােধকরি শীতলক্ষ্যায় সলিল সমাধি অর্জনের ভীতি এই বীরের সব বােধশক্তি লােপ করেছিল। পরে তিনি এসে উঠেছিলেন গভর্নর হাউস সংলগ্ন ফরমান আলীর বাসায়। ক্যান্টনমেন্টের চেয়ে সেটা বােধকরি অধিকতর নিরাপদ মনে হয়েছিল।
এরপর ১৫ ডিসেম্বর নার্সদের জন্য রাখা একটি হেলিকপ্টার নিয়ে তিনি চুপিসারে কেটে পড়েন বার্মায় এবং ভারতের কজামুক্ত জেনারেল হিসেবে পাকিস্তানে নিজেকে বীরের মতাে জাহির করেন। প্রায় এক লক্ষ পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসার যখন বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করে বন্দিত্ব বরণ করেছে তখন জ্বলজ্যান্ত এক জেনারেলকে ফিরে পেয়ে পাকিরা মহাখুশি হয়েছিল, হােক না সে পলাতক জেনারেল পরাজয়ের গ্লানি এড়াতে ভুট্টো তাকে বীর হিসেবে বরণ করেন এবং পাকবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ নিয়ােগ করেন। উভয়ের এই মধুচন্দ্রিমা অবশ্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। এই হচ্ছে তথাকথিত মার্শাল রেস বা বীর বাহিনীর জেনারেলদের কাহিনী। পুরাকালের রীতিতে সব কাহিনীর শেষে একটি শিক্ষণমূলক নীতিবাক্য থাকে। এ যুগের কাহিনীতে সেই পরিশিষ্ট আর যুক্ত হয় না। তবু একাত্তরের পাকবাহিনীর নির্দয়তা কাপুরুষতা থেকে এটা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, মার্শাল রেস বা যােদ্ধা জাতি বলে কিছু নেই। আদর্শের ন্যায়পরায়ণতাই একটি জাতিকে বিক্রমশালী করে তুলতে পারে, যেমন বাঙালি হয়ে উঠেছিল একাত্তরে এবং সৃষ্টি করেছিল অনেক বীরগাথা। আর আমাদের এই উপমহাদেশে মার্শাল রেসের মিথটি একান্তভাবেই ব্রিটিশদের দান এবং ব্রিটিশ আর্মি রিক্রুটমেন্ট ম্যানুয়াল অধ্যয়ন করলে এর স্বরূপটি বােঝা যাবে। খুব আশ্চর্যজনকভাবে এই কাজটি করেছিলেন রােগা দুবলা সাহিত্যরসভাণ্ডারি বাঙালি নীরদ সি. চৌধুরী।
তিনি দেখিয়েছিলেন যে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বাংলা ও বিহার থেকে লোেক নিয়োেগ সর্বাংশে বন্ধ করে অনুগতপ্রবণ গােষ্ঠীর খোঁজ নেয়া শুরু হয় এবং এভাবেই পাঞ্জাবে ও উত্তর ভারতে প্রান্তিক গােষ্ঠীর স্বল্পশিক্ষিত রাজানুগত প্রজাদের খুঁজে বের করা হয় এবং সেই রিক্রুটমেন্টের ধারাবাহিকতায় কালক্রমে পাঞ্জাবিরা ও শিখরা যােদ্ধাজাতির তিলক কপালে ধারণ করে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম তাই কেবল রাজনীতিক ইতিহাসেই নয়, সামরিক ইতিহাসেও একটি বড় ধরনের আলােড়ন বয়ে এনেছে। অনেক প্রচলিত ধারণা ভেঙে দিয়েছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এবং এক্ষেত্রেও সামরিক বিশেষজ্ঞ নীরদ চৌধুরী স্মর্তব্য একাত্তরের মে মাসে বিলেতবাসী নীরদ চৌধুরী পত্রিকায় চিঠি লিখে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয়ের কোনাে সম্ভাবনা নেই, একটি সংগঠিত সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলারা কিছুই করতে পারবে না। নীরদ চৌধুরীর এই মূল্যায়নও অলীক করে তুলেছিল শৌর্যে-বীর্যে জেগে-ওঠা বাঙালি তবে সেটা তাে আরেক কাহিনী।