You dont have javascript enabled! Please enable it!
হামুদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট ও যুদ্ধাপরাধের বিচার
একাত্তরে পাকিস্তানের পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান ও (তাদের দৃষ্টিতে) এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী সামরিক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য গঠিত ‘বিচারপতি হামুদুর রহমান কমিশন রিপাের্টের একাংশ আগস্ট মাসে দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকা প্রকাশ করে। এটা সবার জানা, এই কমিশন বাংলাদেশে পাকবাহিনীর যুদ্ধাপরাধ তদন্তের জন্য গঠিত হয় নি। ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য সকল ধরনের ষড়যন্ত্রে পারদর্শী জুলফিকার আলী ভুট্টো। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজনৈতিক চাল হিসেবে এই কমিশন গঠন করেছিলেন এক ঢিলে অনেকগুলাে পাখি মারতে চেয়েছিলেন ভুট্টো। বিচারপতি হামুদুর রহমান ছিলেন একজন বাঙালি, কমিশন প্রধান হিসেবে তাকে নিয়ােগ করে ভুট্টো একটা ধোকাবাজির আবহ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তবে বিচারপতি হামুদুর রহমানের অতীত ভূমিকা ও আপােষকামিতা তাকে বশংবদ বিচারক হিসেবে কুখ্যাত করেছিল তাই ভুট্টোর এই চাল কোনাে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে নি। অবশ্য ভুট্টোর প্রধান লক্ষ্য ছিল বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেনানায়কদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তার তাবেদারদের রক্ষা করা ও সম্ভাব্য প্রতিপক্ষদের দমন করা। প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর এই রাজনৈতিক হুকুম ভালােভাবে পালন করেছিলেন আজ্ঞাবহ বিচারক তাই দেখা যায় হামুদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট রেহাই দিয়েছে জেনারেল টিক্কা খান ও জেনারেল রাও ফারমান আলীর মতাে নরঘাতক জেনারেলদের জেনারেল নিয়াজি এবং ইয়াহিয়া-আবদুল হামিদ-গুল হাসান-মিঠঠা চক্রকে দোষী চিহ্নিত করে কমিশন কাজ সেরেছে এই সুযােগ গ্রহণ করে ভুট্টো আর্মির নেতৃত্বে তার পছন্দসই লােক বসাতে সমর্থ হয়  এমনি এক সীমিত ও অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হামুদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট প্রকাশের সৎসাহসও পাকিস্তান সরকার এখনাে দেখাতে পারে নি।
এমন কি ভুট্টোর ঘাের বিরােধী, ভুট্টোকে ফাঁসিকাঠে ঝােলানাে জেনারেল জিয়াউল হকও  হামুদুর রহমান কমিশন রিপোের্ট গােপন করে রাখেন। পরবর্তী কতাে সরকারই তাে এলাে গেল, কোনাে সরকারই এই বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপাের্ট প্রকাশে সমর্থ হলাে না। হামিদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছাপিয়ে গণহত্যাকারী এবং গণহত্যার সাফাইকারী পাকিস্তানি শাসকদের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছিল বড় অদ্ভুতভাবে কমিশন রিপাের্ট নানাভাবে ও ন্যাক্কারজনকভাবে গণহত্যার সাফাই গেয়েছিল। তারপরও, যেহেতু রক্তাক্ত ও বর্বরতম এক নিষ্ঠুরতার সঙ্গে জড়িত সামরিক ব্যক্তি ও পদক্ষেপ নিয়ে রাজনৈতিক খেলায় অবতীর্ণ হয়েছিল এই কমিশন, দেখা গেছে পরােক্ষে ও প্রকারান্তরে পরিস্থিতির ভয়ংকরতা ও ব্যাপ্তি তাদের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। এমনই সাফাই গেয়েছে রিপোের্ট যে, একাত্তরে পাক সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত বাঙালির সংখ্যা তারা বলেছে ২৬,০০০।
 
হামিদুর রহমান কমিশন বর্বর ভাষায় লিখেছে যে, ইস্টার্ন কম্যান্ড থেকে বিভিন্ন সময় জেনারেল হেড কোয়ার্টারে যে রিপাের্ট পাঠানাে হয়েছে তার ভিত্তিতে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। একজন বিচারপতি খুনিদের প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে নিহতের সংখ্যায় উপনীত হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বােধ করলেন না! উপরন্তু রিপাের্টে লেখা হয়েছে, “হতে পারে এই সংখ্যাতেও স্ফীতির উপাদান রয়ে গেছে, যেহেতু নিম্নস্থ দলগুলাে বিদ্রোহ দমনে তাদের সাফল্য বড় করে দেখাতে এমনটা করে থাকতে পারে। তবে আর কোনাে নির্ভরযােগ্য তথ্যের অনুপস্থিতিতে কমিশন মনে করে জেনারেল হেডকোয়ার্টার সরবরাহকৃত এই সর্বশেষ তথ্যকে মেনে নেয়া উচিত।” নির্যাতিতা নারীদের প্রসঙ্গে কমিশনের বক্তব্য রােমহর্ষক সাফাই গাওয়ার জন্য কমিশন উদ্যোগী হয়ে বলেছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান দুই লক্ষ বাঙালি বালিকা ধর্ষিত হওয়ার কথা বারবার বললেও সেটা খণ্ডনের প্রমাণ মেলে যখন ১৯৭২ সালের গােড়ায় গর্ভপাত ঘটানাের জন্য আগত বৃটিশ টিম একশত বা ততােধিক কাজের বেশি পায় নি। একজন প্রাজ্ঞ বিচারপতি ভালােভাবেই জানেন প্রাচ্য সমাজে নির্যাতিতা নারীর খুব কম অংশই ঘােষিতভাবে গর্ভপাতের জন্য এগিয়ে আসেন তদুপরি নয় মাসব্যাপী তান্ডবে নির্যাতীত সবার ১৯৭২-এর গােড়ায় গর্ভপাত ঘটানাের অবস্থায় থাকার প্রশ্ন ওঠে না। সারা দেশের অগণিত নারী আগত একটি মাত্র বৃটিশ টিমের কাছে ছুটে আসবে না গর্ভপাত করানাের জন্য সর্বোপরি এই তথ্যটি কমিশন কোথা থেকে কীভাবে পেলেন তারও কোনাে উল্লেখ করা হয় নি।
 
কিন্তু যে-ভাষায় যে-দৃষ্টিভঙ্গিতে হামিদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট নির্যাতীতা বাঙালি বালিকাদের প্রসঙ্গের অবতারণা করেছে তা স্বয়ং এক নিষ্ঠুর বর্বরতা পাশাপাশি এই সাফাইকারী রিপাের্টেও নানা পরােক্ষ সূত্রে গণহত্যার চকিত উদ্ভাসন ঘটেছে। পাপ যে কখনাে গােপন থাকে না তার পরিচয় মেলে এতে স্থানীয় বা আঞ্চলিক সংঘাত অব্যাহত থাকে, চলে নানা ধরনের পীড়ন, তবে সবকিছুকেই বিচার করা হয় রুশ-মার্কিন পক্ষ-বিপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিতে, মানবতার মাপকাঠি প্রয়ােগের অবকাশ মােটেই থাকে না। চরম প্রতিকূলতার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র হিসেবে সকলের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেতে দেশটিকে প্রায় তিন বছ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এরপরও গণচীনের স্বীকৃতি মেলে নি এবং চীন তার বিশ্বস্ত বন্ধু পাক-সামরিক চক্রের পক্ষে প্রবলভাবে দাড়িয়েছিল ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বিদ্বেষ থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে চীন ঘৃণাভরে অস্বীকার করতে চেয়েছিল। অত্যন্ত কলঙ্কজনকভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপর চীন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। এই তথ্য আমাদের প্রদর্শন করে কী চরম বিদ্বেষ ও তিক্ততা বিরাজ করছিল সত্তরের দশকের গােড়ার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এহেন বিশ্ব পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারানুষ্ঠানে সমর্থ হয় নি। নিঃসঙ্গ বাংলাদেশ।

বিচারের জন্য ২০০ যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করেও বাংলাদেশ তাদের প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য হয়। গণহত্যার জন্য দায়ী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার কোনাে প্রশ্ন নেই। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ তাদের বিচারানুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দীর্ঘকাল পর নব্বই দশকে এসে বিশ্বসমাজ আবারাে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের তাগিদ অনুভব করছে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিবাদবিসস্বাদ যাই থাকুক, পূর্বের সেই তিক্ততা ও উত্তেজনা আর নেই। রাষ্ট্রসমূহ মিলিতভাবে বলকান অঞ্চল ও রুয়াণ্ডায় গণহত্যার বিচারের জন্য দুই পৃথক আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল গঠন করেছে। ১৯৭৫ সালে কাম্পুচিয়ায় সংঘটিত গণহত্যার বিচারের জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে আলােচনা চলছে। সময় তাই উপযুক্ত হয়েছে বাংলাদেশে সংঘটিত নারকীয়তার জন্য অপরাধীদের আন্তর্জাতিক সভায় বিচারের ব্যবস্থা করার। যুদ্ধাপরাধ তাে সাধারণ অপরাধ নয়, এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং এর বিচারের দায় গােটা বিশ্বসমাজের বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ উদ্যোগী হয়ে বিশ শতকের ইতিহাসের এই কলঙ্কমােচনে বিশ্বসভাকে সক্রিয় করে তুলতে পারবে—সেই। আস্থা ক্রমে জোরদার হচ্ছে। আজ তাই সময় হয়েছে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে আরাে সােচ্চার হওয়ার, আরাে সক্রিয় হওয়ার আজ হােক কাল হােক, মানবতার বিজয় অবশ্যম্ভাবী।

(বুলেটিন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ডিসেম্বর, ২০০০)
 
প্রকাশ করে। সামরিক শক্তি ব্যবহারের তাগিদ যতাে প্রবল হয়, সামাজিক বাস্তবতা অনুধাবনের ক্ষমতা ততাে দুর্বল হয়। অপারেশন সার্চলাইট’ নামক এই নির্দেশনামায় বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র নারীপুরুষ সাধারণ মানুষকে যথেচ্ছ হত্যা তথা জাতিহত্যা অভিযান শুরুর সঙ্কেত। যেহেতু অন্ত্রের বলে সামরিক সমাধানই ছিল উদ্দিষ্ট তাই নির্দেশনামার ভাষায় নিজেদের বর্বর ও বিশ্বাসহন্তারক আচরণকে ঢেকে দেয়া হয়েছে সামরিক কৌশলের আবরণ দিয়ে, তবে রাখঢাক খুব একটা থাকেনি এবং এভাবে একটি রাষ্ট্রীয় গােষ্ঠী নিজেদের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হিসেবে উলঙ্গ করে ফেলেছে হত্যাভিযান গুরুর বেশ আগেই। প্রকাশ্যভাবে পাকিস্তান বলতে চেয়েছিল তাদের দেশের এক অংশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দাঁড় করিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সূচনা করেছে এবং সামরিক শক্তি প্রয়ােগ করে এই প্রচেষ্টা নস্যাৎ করা ছাড়া তাদের আর কোনাে উপায় ছিল না। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান স্বয়ং ঢাকায় এসে বিরােধী পক্ষের সঙ্গে আলােচনায় মিলিত হয়েছিলেন, তবুও সমাধান সূত্র না পাওয়াতে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। এই বক্তব্যের সঙ্গে আমরা মিলিয়ে নিতে পারি গােপন নির্দেশনামা ‘অপারেশন সার্চলাইটের বক্তব্য সামরিক এই পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল ডি-ডে বা অভিযান শুরুর বেশ কিছুদিন আগেই এবং সেখানে শক্রকে চিহ্নিত করা হয়েছে মােটা দাগে, নির্দেশনামার সূচনায় লেখা হয়েছে : “এ, এল, (আওয়ামী লীগ)-এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং যারা এর সমর্থক অথবা এম, এল, (মার্শাল ল) অস্বীকার করবে তাদের শত্রুপক্ষীয় বিবেচনা করে মােকাবিলা করা হবে।” লক্ষণীয় যে, মার্চের গােড়ায় বা মধ্যভাগে যখন অসহযােগ আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিল, যা ছিল শান্তিপূর্ণ গণপ্রতিরােধ, তখন প্রণীত এই সামরিক অভিযানের নির্দেশনামার কোথাও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনাে সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোেগ পাকবাহিনীও আনতে পারে নি।
 
সামরিক আইন অমান্যের যে অভিযোেগ করা হয়েছে সেটা তাে ছিল ইতিহাসের মহত্তম এক শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন এবং এই আন্দোলনে শরিক জনগােষ্ঠীকে ‘শত্রুপক্ষীয় বিবেচনা করে সেনাবাহিনীকে যখন আদেশ প্রদান করা হয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের তখন ঘটে বিশ শতকের নৃশংসতম এক গণহত্যা। সর্বোপরি একটি বিশেষ রাজনৈতিক চিন্তার অনুসারী সবাইকে শত্রুপক্ষীয়’ ঘােষণা করবার মধ্যে রয়েছে জাতিগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে যথেচ্ছাচারের অনুমােদন। সামরিক পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধারায় যা বলা হয়েছে তা পাকসামরিক নেতৃত্বের চরম হঠকারিতার নিদর্শন এবং সকল প্রকার নৈতিক বােধ এমনকি সামরিক নৈতিকতারও পদদলন প্রকাশ করে। এই নির্দেশনামা দেখিয়ে দেয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রের ও নাগরিকের হেফাজতকারী বাহিনী থেকে বিচ্যুত হয়ে ঘৃণা ও আক্রোশে পরিপূর্ণ এক নৃশংস ঘাতকদলে পরিণত হয়েছিল যাদের অন্তরে বিবেকবােধ তাে দূরের কথা, সামান্যতম নৈতিকতারও স্থান ছিল না। এই নির্দেশনামায় লেখা হয়েছিল : “যেহেতু সেনাবাহিনীর মধ্যকার পূর্ব পাকিস্তানীয়দের মধ্যেও আওয়ামী লীগের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে তাই অপারেশন সূচনা করতে হবে অত্যন্ত ধূর্ততা, আকস্মিকতা, ধােকাবাজি ও দ্রুতগতির সমন্বয়ে এক ঝটিকা আঘাত হিসেবে। যে শব্দসমূহ এখানে ব্যবহৃত হয়েছে, কানিংনেস, সারপ্রাইজ, ডিসেপশন অ্যান্ড স্পিড’, তা প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। তবে পাক-সেনাবাহিনী যে পরিণত হয়েছিল হত্যাদানবে তার উৎস হিসেবে যখন আমরা এই দলিল বিবেচনায় নেই তখন সেটা আর অবিশ্বাস্য ঠেকে না।
ধূর্ততার মাত্রা যে কত চরম হতে পারে তার পরিচয় বহন করে এর ব্যাখ্যায়, সর্বোচ্চ পর্যায়ে এই নীতির প্রয়ােগ সম্পর্কে নবম ধারায় বলা হয়েছে, “অনুরােধ করা হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট যেন সংলাপ অব্যাহত রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নেন- এমন কি মিস্টার ভুট্টো হয়তাে সম্মত হবেন না তবুও মুজিবকে ধোকা দিতে তিনি (প্রেসিডেন্ট) যেন ২৫ মার্চ এ. এলের দাবি মেনে নেয়ার ঘােষণা দেন।” দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে ধোকাবাজির অংশ করে তুলতে যে সামরিক পরিকল্পকদের বাধে না সেটা বুঝিয়ে দেয় কোন্ অতল অসভ্যতায় পতিত হয়েছিল জেনারেলদের পরিচালিত এই রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং বােঝা যায় পাকিস্তান আর রাষ্ট্র ছিল না, হয়ে উঠেছিল ঘাতকদের আস্তানা।
 
অপারেশনের সফলতার জন্য কি করা প্রয়ােজন সেখানে সাত-দফা নির্দেশ উল্লিখিত হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে সারা দেশে একযােগে পরিচালিত হবে। অভিযান এবং এর পরপরই বলা হয়েছে : “গ্রেপ্তার করতে হবে সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্রনেতা এবং শিক্ষক সম্প্রদায় ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যকার চরমপন্থীদের।” এখানে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও বিশেষভাবে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ছাত্র-শিক্ষক সম্প্রদায় ও সাংস্কৃতিক বৃত্তের মানুষেরা। এভাবে কোনাে গােটা গােষ্ঠী বা সম্প্রদায়, জাতি বা ধর্মসত্তার মানুষকে শত্রুপক্ষীয় হিসেবে চিহ্নিত করে সামরিক শক্তির প্রয়ােগ থেকেই গণহত্যা সংঘটিত হয়। ‘অপারেশন সার্চলাইটের ছত্রে ছত্রে এমনি আরাে অনেক প্রতিফলন মিলবে। যেমন অভিযান পদ্ধতি সম্পর্কে পরের দিনের কাজ হিসেবে বলা হয়েছে, এই অভিযানে “ধানমণ্ডিতে সন্দেহভাজন বাড়িসমূহে তল্লাশি করতে হবে, সেই সাথে পুরনাে  ঢাকার হিন্দু বাড়িসমূহে।” হিন্দুদের ক্ষেত্রে আর সন্দেহভাজন বাড়ির প্রশ্ন নেই, সকল হিন্দু বাড়ি, কিংবা বলা যায় হিন্দু বাড়ি মাত্রই আর্মির তল্লাশির টার্গেট। নির্দেশে আরাে বলা হয়েছে, “ঢাকায় শতকরা একশ’ ভাগ সফলতা নিশ্চিত করতে হবে।

এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই দখল করে তল্লাশি চালাতে হবে।”  এই নির্দেশের ফল তাে আমরা জানি, তল্লাশি বা সার্চ বলতে যে আসলে সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় বােঝানাে হয়েছে সেই পরিচয় আরেক পাকিস্তানি রেকর্ড থেকে তাদের নিজেদের জবানিতে আমরা পেয়েছি। ২৫ মার্চের কালরাত্রে ট্যাংক ও ভারি। কামান নিয়ে যে বহরটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল তাদের  সঙ্গে কম্যান্ড হেডকোয়ার্টারে ওয়ারলেস যােগাযােগের কিছু অডিও রেকর্ড পাওয়া যায়। ১৮ পাঞ্জাব, ২২ বালুচ এবং ৩২ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের যে সদস্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করেছিল তাদের কম্যাণ্ডার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যে কথােপকথন পরিচালনা করেছিল তাতে দেখা যায় ৮৮ শীর্ষক সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত ইউনিটকে কনট্রোল রুম থেকে বলা হচ্ছে : “বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিকার হলাে কত? চোখে যা দেখছে তাতে কত আন্দাজ হয়? কত খতম, জখম বা বন্দি? ওভার।” জবাব আসে, “মনে হয় শ’ তিনেক। ওভার।” আবারও কণ্ঠ ভেসে আসে, “বাঃ বেশ তা তিনশ খতম? না বন্দি? জখম? ওভার।” এবার শীতল কণ্ঠে জবাব আসে, “না, না, একেবারে সাফ। খতম ওভার।” রক্ত হিমকরা এমনি বার্তা শােনার পর প্রধান সমরকর্তা, সম্ভবত জেনারেল টিক্কা খান স্বয়ং, বলে ওঠেন, “খাসা, খাসা। খুব ভালাে কাজ। চালিয়ে যাও, কোনাে পরােয়া করাে না। তােমার কাছে কৈফিয়ৎ চাওয়ার কেউ নেই। আবারও বলছি, যা করছে জবাব নেই। সাবাশ, বড় খােশ খবর ওভার।”

 
‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর ছিল দুই কমাণ্ড মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিলেন ঢাকা শহরের অপারেশনের দায়িত্বে তার অধীনে ব্রিগেডিয়ার জেহানজেব আরবাবের ৫৭ পদাতিক ব্রিগেড শহরের বিভিন্ন স্থানে হত্যাভিযান পরিচালনা করে। অপর মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা ছিলেন দেশের অন্য সব অঞ্চলে পরিচালিত অপারেশনের দায়িত্বে এই রাও ফরমান আলী পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক সচিব হিসেবে কাজ করেন এবং শান্তি কমিটি গঠন ও ঘাতক দল আলবদর গঠনে নেতৃভূমিকা পালন করেন। বিজয়ের পর গভর্নর হাউসে তার টেবিলে যে ডেস্ক ক্যালেণ্ডার পাওয়া যায় সেখানে লেখা ছিল, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের সবুজকে লাল রঙ দিয়ে রাঙিয়ে দেব।’ এই ডেস্ক ক্যালেণ্ডারে আরাে দেখা যায় কতিপয় বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা রয়েছে, যাদের শবদেহ পরে রায়েরবাজারের ইটখােলায় পাওয়া যায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পক ফারমান আলী ছিল অপারেশন সার্চলাইট’ নীতির অন্যতম প্রণেতা।
তিনি বাঙালিদের কোন্ চোখে দেখতেন সেটা তাঁর স্মৃতিকথায় প্রকাশ পেয়েছে। তার গ্রন্থের শুরুর বাক্য হলাে : “ছােটবেলায় আমরা শুনেছি বাঙালি আছে তিনরকম- বাবু বাঙালি, জাদু বাঙালি আর ভুখা বাঙালি।” ব্যাখ্যা করে বলেছেন বাঙালিরা হচ্ছে কেরানির জাত অর্থাৎ বাবু বাঙালি, বাঙালি মেয়েরা জানে পুরুষ বশীকরণের মন্ত্র, তাই জাদু বাঙালি, আর বাংলা হচ্ছে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চল, সেজন্য ভুখা বাঙালি একটি জাতিগােষ্ঠী সম্পর্কে কী পরিমাণ অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা থাকলে কেউ এমন কথা লিখতে পারে সেটা ভাবাও দুঃসাধ্য। এমনি মানসিকতাই এইসব মানুষকে পরিণত করেছিল বাঙালি জাতির নিষ্ঠুর ঘাতকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ দলিলটি মনােযােগ দিয়ে পড়লে বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা কোনাে সামরিক অভিযানের দলিল নয়, বরং একটি বিশাল জনগােষ্ঠীকে  চিরতরে দমাবার জন্য এক দখলদার বাহিনীর করণীয় এখানে নির্ধারিত হয়েছে। এই সামরিক পরিকল্পনা কারা প্রণয়ন করেছিল সেটা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ইয়াহিয়া খান ও তার জেনারেলরা যে অনেক আগে থেকেই সামরিক অভিযান পরিচালনার বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলেন তা বােঝা যায় যখন ইস্টার্ন কম্যান্ডের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান বেসামরিক মানুষদের হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে পদত্যাগ করেন।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির লেখা থেকে জানা যায় ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খান বিভিন্ন প্রদেশের কম্যান্ডারদের যে সভা কক্লেন সেখানেই সামরিক অভিযানের অনুমােদন দেয়া হয়। কিন্তু সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের জন্য কাজটি হয়ে উঠেছিল বিশেষ অস্বস্তিকর। ইতিমধ্যে ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া সাংবিধানিক পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করলে রাজনৈতিক সঙ্কট মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসান পদত্যাগ করলে সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে একই সঙ্গে গর্ভনরের দায়িত্বও দেয়া হয়। চারদিনের মাথায় তিনি পদত্যাগ করলে সরকার ব্রিত বােধ করে, তবে স্বীয় পরিকল্পনা থেকে সরে আসে না। এটা বােঝা যায় বেলুচিস্তানের কসাই’ জেনারেল টিক্কা খানকে ঢাকায় জিওসি-র দায়িত্ব দেয়ার মধ্যে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ কারা মিলে প্রণয়ন কব্লেছিল সেটা ভালােভাবে জানা যায় না। এই পরিকল্পনার সঙ্গে সংস্রব রাখতে কেউ আর এখন আগ্রহী নন। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রধান অরাধী, অপারেশন সার্চলাইট প্রণয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। তার ভাষ্যে, জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা এর মূল পরিকল্পনাকারী তিনিও খাদিম হােসেন রাজার সঙ্গে কাজ করেছেন, তবে তিনি ও খাদিম নাকি সামরিক অভিযান বিষয়ে সংশয়ী ছিলেন। তাদের দুর্বলতা ঢাকতেই নাকি পিণ্ডি থেকে পাঠানাে হয়েছিল মেজর জেনারেল মিঠঠা ও মেজর জেনারেল ইফতিখার জানজুয়াকে পরিকল্পনা প্রণয়ন সভায় আরাে থাকতেন মেজর জেনারেল ওমর এবং মেজর জেনারেল খুদাদাদ, পরে সার্বিক পরিকল্পনা অনুমােদন করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান।

তাই বলা যায়, ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে যে বাহিনী বিপুল সমরাস্ত্রে বলীয়ান হয়ে বাঙালি জাতির ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিল তারা কোনাে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে নি, এই শ্বাপদবাহিনী পরিচালনা করেছিল জাতিহত্যা বা জেনােসাইড, তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, তারা সবরকম সামরিক নৈতিকতা ভঙ্গ করে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এমনিভাবে সূচিত হয়েছিল যে কালরাত্রির তা দীর্ঘ এক তমসা বয়ে এনেছিল গাঙ্গেয় বদ্বীপের নদীপ্লাবিত মানুষদের জীবনে, এমন বর্বরতা ইতিহাসে ছিল বিরল এবং এই মৃত্যুদানবদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাতিহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার  বিরুদ্ধে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে যেসব মানুষ তারা সবসময়ে সভ্যতার কাছে দায়ী হয়ে রইবে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের আনুষ্ঠানিক বিচার হউক বা হউক। ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে যে আন্ত র্জাতিক অপরাধ আদালত বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্ট প্রতিষ্ঠা করে সেখানে গণহত্যার সংজ্ঞা প্রদান করে বলা হয়েছে : “গণহত্যা, বলতে কোনাে জাতি, নৃতাত্ত্বিক গােষ্ঠী, বর্ণ বা ধর্মগােষ্ঠীর সার্বিক বা আংশিক ধ্বংসসাধনের লক্ষ্যে পরিচালিত নিমধরনের কর্মকাণ্ড বােঝাবে;

ক, গােষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা;
খ. গােষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর শারীরিক অথবা মানসিক ক্ষতিসাধন;
গ, সুপরিকল্পিতভাবে গােষ্ঠীর জীবনে এমন অবস্থা তৈরি করা যা তাদের জীবনকাঠামাের সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংস ডেকে আনবে।” একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতের অন্ধকারে পাকবাহিনী যে সামরিক অভিযান শুরু করে তা ছিল বাঙালি জাতিসত্তাকে ধ্বংস করবার সামরিক অভিযান। এর বড় লক্ষ্য ছিল স্বাধীন জাতিসত্তা রক্ষা ও বিকাশে আস্থাবান সকল বাঙালি, বিশেষ লক্ষ্য ছিল এই জাতিগােষ্ঠীর শিক্ষিত সম্প্রদায়, সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এটা কোনাে সিভিল ওয়ার ছিল না, ছিল জাতিহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নয় মাসের গণহত্যায় তাই অগণিত মানুষ প্রাণ হারায় নির্বিচারে, হিন্দু ও বুদ্ধিজীবীরা হয়ে ওঠে বিশেষ টার্গেট, পরাজয়ের প্রাক্কালে দেশীয় আল বদর সদস্যদের সহযােগিতায় পাকবাহিনী পরিচালনা করে বুদ্ধিজীবীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড  কিন্তু বিপুল সামরিক শক্তিতে পুষ্ট হয়েও মুক্তিকামী মানুষের বিজয় অভিযানকে রুদ্ধ করতে পারেনি পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রায় লক্ষ বাহিনী নিয়ে লজ্জাজনক আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় তারা। আকাশে উড্ডীন হয় সবুজের বুকে লাল রক্তের ছােপ-আঁকা বাংলাদেশের পতাকা। 
 

সূত্রঃ  জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক

 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!