বাঘ কীভাবে বিড়াল হলাে
পাকিস্তানি জেনারেলরা বই লিখেছেন বিস্তর, সে-সব বই বাংলাদেশে বেশ সহজেই লভ্য। পাকিস্তানি জেনারেলদের সাক্ষাঙ্কার নিয়েও সবিস্তার পুস্তক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের গবেষকরা। তাতেও স্বঘােষিত বীরপুঙ্গবেরা নিজেদের সাফাই গাইবার যথেষ্ট সুযোেগ পেয়েছে। অথচ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যে অজস্র পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে, অংশগ্রহণকারীর যুদ্ধাভিজ্ঞতা এবং পাকিদের নারকীয় নির্যাতনের প্রত্যক্ষ বিবরণ—সেসবের কোনােটি উর্দুতে অনূদিত হয়েছে বলে শােনা যায় নি। এমন কি জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’র ইংরেজি অনুবাদ যখন প্রকাশ করে দিল্লির এক প্রকাশক, তখন গ্রন্থজগতে বহুল প্রচলিত রীতি অনুযায়ী পাকিস্তানে এর সহ-প্রকাশনায় তারা আগ্রহী হয়েছিল। স্টার্লিং পাবলিশার্স-এর অনেক বইয়ের পাকিস্তানি সহ-প্রকাশনা ঘটলেও জাহানারা ইমামের ‘অব ব্লড অ্যান্ড ফায়ার সেদেশে প্রকাশিত হতে পারে নি। ফল দাড়িয়েছে এই, পাকিস্তানিরা তাদের সাফাই গাইবার, মিথ্যাচার প্রচার ও বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিষােদগার করার এন্তার সুযােগ পেয়ে যাচ্ছে, আর আমরা ইতিহাসের সত্যরূপ প্রকাশের সামান্য অবকাশও লাভ করছি না। পাকিস্তানি ভণ্ডামির বড় নিদর্শন হচ্ছে তাদের জেনারেলদের লেখা বইগুলাে, যেখানে একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের পাপস্খলন ও বাহাদুরি প্রকাশের চেষ্টা বেশ প্রকট। অতি সম্প্রতি, ডিসেম্বরের শুরুতেই, পাকিস্তানি ইন্টার্ন কম্যান্ডের প্রধান লে.জেনারেল এ.এ.কে, নিয়াজির বক্তব্য আমাদের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ৯০,০০০ সৈনিক নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে কোনাে বড় রকম সমুখ-যুদ্ধ ছাড়াই, এমন বাহাদুর জেনারেল ইতিহাসে বিশেষ নেই, এবং সেরকমই এক বীরপুরুষ নিয়াজি দম্ভভরে বলেছেন যে, একাত্তরের যুদ্ধে তিনি কখনােই আত্মসমর্পণ করতে চান নি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা ইয়াহিয়া ও ইসলামাবাদের সেনাসদর থেকে তাকে বাধ্য করা হয়েছে আত্মসমর্পণে।
নিয়াজির এই দাবি কতােটা সত্যসিদ্ধ সেটা বিবেচনার আগে আমরা পাকবাহিনীর যােদ্ধা ইমেজ কিছুটা তলিয়ে দেখতে চাই। নিয়াজি নিজেকে ‘টাইগার নিয়াজি’ হিসেবে পরিচিত করতে ভালােবাসেন। ১৯৪৫ সালে বার্মায় এক কোম্পানি জাপানি সৈনিকের বিরুদ্ধে তার দলবল সাহসী লড়াই করলে সেই সুবাদে তিনি নাকি ‘বাঘ’ হয়ে উঠেছিলেন। তার স্মৃতিগ্রন্থের সূচনাতে নিয়াজি এই টাইগার হওয়ার কাহিনী শুনিয়েছেন। তাতে অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে আমরা নিয়াজির জবানিতেই জানতে পারি, “এক ঘণ্টার মধ্যে অধিকাংশ জাপানি নিশ্চিহ্ন হলাে। হয় তারা নিজেরাই নিজেদের জীবন নিয়েছে কিংবা তাদের হত্যা করতে হয়েছে। জাপানিরা কখনাে আত্মসমর্পণ করে না।জাপানিরা যে আত্মসমর্পণ করে না সেটা স্বচক্ষে দেখেও সেই শিক্ষার কোনাে প্রতিফলন এই ‘বীর’ একাত্তরে দেখাতে পারেন নি। ১৯৫৭ সালের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কমান্ডার হিসেবে ঢাকায় ছিলেন নিয়াজি। সে-সময় ক্যান্টনমেন্টের টাইগার রােড নামে রাস্তা দেখে নিয়াজির ধারণা হয়েছে তার নামেই এমনি নামকরণ ঘটেছে। বইয়ের দু-জায়গায় এর উল্লেখ রয়েছে। ভাগ্যিস তিনি বলেন নি যে, সুন্দরবনের বাঘের নামও তার অনুসরণে রাখা হয়েছে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাঘ্র প্রতীক যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের রাস্তার স্বাভাবিক নাম হতে পারে, তার মােটা মাথায় এসব ঢুকবে । সে যাই হােক, নিয়াজি যে সারেণ্ডার করতে চান নি, তিনি যে সত্যিই খুব বাহাদুর জেনারেল, সেটা এখন জোরের সঙ্গেই বলতে চাচ্ছেন। আগে তার বইয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে সে-কথা বলেছেন। এখন বুড়াে বয়সে সাংবাদিকদের কাছে একই কথা গলা ফাটিয়ে বলছেন। প্রকৃত ঘটনা তাই কিছুটা তলিয়ে দেখা দরকার।
কেননা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার খেলা জোরদার হওয়ার লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাক যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতা অর্জন করতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যােগ দেয় ভারতীয় বাহিনী এবং জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। এই সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিরােধে নিয়াজির যুদ্ধ-পরিকল্পনা ছিল খুবই দুর্বল। পাকিস্তানিরা অস্থির হয়ে ছিল মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের ভয়ে। কোনাে বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী সংহতি আরাে বাড়বে এবং প্রবাসে গঠিত বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত সত্য হয়ে উঠবে—এটা ছিল পাকিস্তানিদের আশঙ্কা। তাই তারা ছড়িয়ে ছিল গােটা সীমান্ত জুড়ে। আর ছড়ানাে-ছিটানাে এইসব পাকবাহিনীকে পাশ কাটিয়ে তাদের বিচ্ছিন্ন করে এগােবার পন্থা অবলম্বন করেছিল ভারতীয় বাহিনী। পরিকল্পনায় দুর্বলতা যাই থাকুক না কেন, নিয়াজির বাগাড়ম্বরে কোনাে কমতি ছিল না। ২১ নভেম্বর যখন সীমান্ত জুড়ে ভারতীয় বাহিনী সীমিতভাবে। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিতে এগিয়ে এলাে তখন সৈন্যদলের কাছে প্রেরিত বার্তায় জেনারেল নিয়াজি বলেছিলেন : “ভারতীয়দের ঘাঁটি প্রসারিত হতে দেবে না। সাহসী পাকিস্তানি সৈন্যরা গােটা সীমান্ত জুড়ে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করেছে। আল-বদর, আল-শামসের সদস্যদের ভারতের গভীরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পাঠাও। তাদের ট্যাংক সমাবেশ, গােলন্দাজ ঘাটি ও যােগাযােগ পথের ওপর আমাদের কম্যাণ্ডো ও স্থানীয় গেরিলাদের নিয়ে আক্রমণ করাে।” মজার ব্যাপার হলাে এরকম সাহসী কোনাে আক্রমণ রচনার ক্ষমতা ও যযাগ্যতা পাকিস্তানিদের ছিল না। নিয়াজিও সেটা ভালােভাবে জানতেন তবু কথার ফুলঝুরি তৈরিতে তার প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না। ৩০ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধানের বার্তার জবাবে নিয়াজি জানান : “আমাদের ওপর যে বিপুল আস্থা ন্যস্ত করা হয়েছে ইনশাআল্লাহ আমরা তার মর্যাদা রক্ষা করবাে এবং আমাদের মহান পিতৃভূমি রক্ষায় কোনাে আত্মদানই অসম্ভব বিবেচিত হবে না। সর্বশক্তিমান আল্লার দয়ায় প্রাথমিক ভারতীয় আক্রমণ বানচাল করা গেছে। খােদা চাহে তাে, যুদ্ধ আমরা ভারতের মাটিতে নিয়ে যাব এবং অবিশ্বাসীদের মনােবল চূর্ণবিচূর্ণ করে ইসলামের শ্রেষ্ঠ শক্তির প্রকাশ ঘটাব।” এটা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রেরিত কোনাে সমরনায়কের বার্তা নয়, বরং নিজের গায়ের চামড়া বাঁচাতে ব্যতিব্যস্ত কূটবুদ্ধি জেনারেলই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এমন বার্তা মুসাবিদা করতে পারে।
প্রতিরক্ষাই ছিল ইস্টার্ন কম্যান্ডের মূল স্ট্র্যাটেজি ভারতের মাটিতে যুদ্ধ করার আক্রমণাত্মক শক্তি তাদের মােটেই ছিল না। নিয়াজিও সেটা বুঝতেন এবং বুঝে শুনেই এমন কথা বলেছিলেন। অন্যদিকে ইসলামের কথা পাক জেনারেলরা অহরহ উচ্চারণ করলেও নিজেরা ছিল ধর্মাচার থেকে সহস্র যােজন দূরে। ইয়াহিয়ার নারীলিপ্সা ও সুরাপ্রীতি তাে সুবিদিত নিয়াজি স্বয়ং ১৫ ডিসেম্বরের অবস্থা বর্ণনাকালে লিখেছেন, “আমি (ফোনে) প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলতে চাইলে জেনারেল হামিদ জানান, তিনি বাথরুমে আছেন। আসলে তিনি বাথরুমে ছিলেন না। অতিরিক্ত মদ্যপানে একেবারে অচেতন ছিলেন। এরপর এয়ার মার্শাল রহিম খান আমার সঙ্গে কথা বললেন। তাকেও মাতাল মনে হচ্ছিল।” এই হচ্ছে ইসলাম রক্ষকদের চেহারা, তাদের নিজেদেরই জবানিতে। বাংলাদেশ যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের খেলাটি জমে উঠলাে ৩ ডিসেম্বরের পর থেকে একে একে পাকবাহিনীর ঘাঁটিগুলাের পতন হতে থাকে এবং পশ্চাদপসরণরত পাকবাহিনী সাধারণ নিরস্ত্র বাঙালিদের ঘৃণা ও প্রতিরােধের মুখােমুখি হতে থাকে ৬ ডিসেম্বর যশাের মুক্ত হলাে মধুপুর থেকে কালিয়াকৈর সরে আসা পাকবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাদিরের দুর্গতির কথা জানা যায় সিদ্দিক সালিকের বই ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’-এ কোনাে বাঙালি তাদের কাছে খাবার বিক্রি করতে রাজি ছিল না। চুরি-করা শাকসবজি আর পুকুরের পানি খেয়ে তাদের জীবন বাঁচাতে হয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে গভর্নর এ.এম. মালেক সামরিক পরিস্থিতি বােঝার জন্য ৭ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজিকে ডেকেছিলেন গভর্নর ভবনে এক বৈঠকে গভর্নর মালেক, নিয়াজি এবং আরাে দুই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন সেই সভায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বিবরণ দিয়েছেন সভার সিদ্দিক সালিকের বইয়েও এর বর্ণনা মেলে। গভর্নর মালিক কথা শুরু করেছিলেন। কিন্তু বেশি কিছু বলার ছিল না তার সবাই বুঝতে পেরেছিল পরিস্থিতি, তবে কেউ সেটা বলতে বা প্রকাশ্যে মানতে রাজি ছিল না। জেনারেল নিয়াজির কাছ থেকে পরিস্থিতির রিপাের্টিং পাওয়ার আগে দার্শনিক ভাব নিয়ে মালিক বলছিলেন যে, যুদ্ধে জয়-পরাজয় থাকে, থাকে উত্থান-পতন। জেনারেলদের ভাগ্য কখনাে একরকম থাকে না, ভালাে পরিস্থিতির স্থলে দেখা দেয় মন্দভাগ্য, আবার সেটা পালটেও যায়। একথা বলতে না বলতেই একটা আর্ত চীৎকার ভেসে ওঠে এবং দেখা যায় বাঘের বাচ্চা দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার সব বাগাড়ম্বর যে ছিল মিথ্যা এবং অন্য অভিসন্ধি থেকে জাত, সেটা এই ঘটনায় ভালােভাবে প্রকাশ পায়।
মালিক তখন জানায়, পরিস্থিতি যখন এতােই খারাপ তাহলে প্রেসিডেন্টকে তারবার্তা পাঠানাে যাক অস্ত্র-সংবরণের ব্যবস্থা নিতে। নিয়াজি মৌনভাবে ঘাড় নেড়ে এতে সম্মতি জানায়। সেই মােতাবেকই ৭ ডিসেম্বর অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে গভর্নর মালিক তার প্রভুকে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে সিজফায়ারের ব্যবস্থা নিতে আবেদন জানায়। ৮ ডিসেম্বর এর জবাবে ইয়াহিয়ার দপ্তর থেকে জানানাে হলাে যে, লড়াই যেন চালিয়ে যাওয়া হয়, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল যাচ্ছে জাতিসংঘে যথাবিহিত ব্যবস্থা নিতে। ৭ ডিসেম্বরের ঐ বার্তা তার অজ্ঞাতসারে পাঠানাে হয়েছিল বলে বেমালুম মিথ্যাচার করছেন নিয়াজি তার বাইরে। ৭ ডিসেম্বর থেকে তিনদিনের জন্য জেনারেল নিয়াজি প্রায় লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, তার আর রক্ষা নেই। খুব কম লােকের সঙ্গেই তিনি দেখা করলেন। বসে থাকতেন মদের গ্লাস হাতে চুপচাপ সিদ্দিক সালিককে একবার বলেছিলেন, “সালিক, তােমার গ্রহের ফের ভালাে, যে তুমি কোনাে জেনারেল নও। ৯ ডিসেম্বর নিয়াজি এক বার্তা পাঠালেন হেডকোয়ার্টারে এবং প্রথমবারের মতাে আস্ফালন কমিয়ে সত্যপ্রকাশ করলেন। তিনি লিখলেন, “পুনঃসংগঠন সম্ভব। হচ্ছে না আকাশে শত্রুপক্ষের কর্তৃত্বের জন্য। জনসাধারণ চরম শত্রুতামূলক হয়ে উঠছে এবং শত্রুপক্ষকে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করছে। বিদ্রোহীদের (অর্থাৎ মুক্তিযােদ্ধাদের) অ্যাম্বুশের জন্য রাতে চলাচল সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্রোহীরা বিভিন্ন ফাঁক-ফোকড় ও পেছন দিক দিয়ে শত্রুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। বিদ্রোহীরা সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে।
সৈন্যরা লড়ছে খুব ভালাে কিন্তু শ্রান্তি ও চাপ এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। ২০ দিন যাবৎ ঘুম নেই।” এমনিভাবে যে পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন নিয়াজি তাতে বাংলার জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার পরােক্ষ কিন্তু স্পষ্ট স্বীকারােক্তি রয়েছে, যে-স্বীকারােক্তি ফাদ থেকে বেরােবার পর আর তারা করে নি। বার্তার শেষে নিয়াজির আকুল আবেদন বেশ কৌতুকবহ। তিনি লিখেছেন, “অনুরােধ নিম্নোক্ত : এই যুদ্ধ অঞ্চল ঘিরে অবস্থিত শক্রর সকল বিমান ঘাঁটিতে অবিলম্বে বিমান হামলা করা হােক এবং সম্ভব হলে ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য ছত্রীসেনা পাঠানাে হােক।” জেনারেল হিসেবে নিয়াজি খুব ভালােভাবে জানতেন ১০০০ মাইল দূর থেকে বিমান হামলা পরিচালনা করা যায় না এবং ছত্রীসেনা পাঠাবারও কোনাে উপায় নেই। তাহলে তিনি এই আবেদন কেন করেছিলেন? বইয়ে নিয়াজি লিখেছেন, তিনি এটা দ্বারা প্রত্যাশিত চৈনিক সহায়তা কামনা করেছিলেন। আসলে নিয়াজি একটা ক্ষেত্র তৈরি করে রাখছিলেন। তিনি বিনাযুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করবেন, কিন্তু তার দায়ভার অন্যের ওপর চাপাবার নানা পন্থা তিনি প্রস্তুত করে রাখছিলেন। বস্তুত, ৭ ডিসেম্বর থেকে এটাই ছিল পাকসামরিক নেতাদের ধ্যানজ্ঞান। যুদ্ধ করতে তারা নারাজ, যুদ্ধ করার মতাে সাহস ও চরিত্রবল তাদের নেই, তাই কীভাবে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দ্রুত ভারতীয় সৈন্যদের কোলে গিয়ে বসা যায়, ভারতীয় সমরনায়কদের আনুকূল্য লাভ করা যায় এবং এভাবে মুক্তিবাহিনী ও বাঙালিদের ক্রোধ থেকে বাঁচা যায়, সেটাই ছিল তাদের চিন্তা। ১০ ডিসেম্বর থেকে যেসব বার্তা চালাচালি হয়েছিল তাতে এটা স্পষ্ট যে, সারেন্ডার করতে সবাই আগ্রহী কিন্তু কেউ এর দায় নিতে চাইছিল না। ১০ ডিসেম্বর সকালে নিয়াজি প্রেরিত বার্তায় করুণ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে তিনি হেডকোয়ার্টারের উপদেশ কামনা করেন। তিনি জানান, অস্ত্র গােলাবারুদ ফুরিয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যেই স্থানীয় জনগণ ও বিদ্রোহীরা কেবল শত্রুতামূলক নয়, তারা গােটা এলাকায় আমাদের সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধপরিকর সবরকম যােগাযােগ ও নদীপথ বন্ধ।
শেষ মানুষ ও শেষ গুলিটি থাকা পর্যন্ত লড়াই চালাবার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেটা আসতে হয়তাে আর দেরি নেই। এসব বর্ণনার পর সঙ্গতভাবে সারেন্ডারের অনুমতি প্রার্থনা করার কথা নিয়াজির। কিন্তু সেটা না করে তিনি লিখলেন, সাবমিটেড ফর ইনফরমেশন অ্যান্ড অ্যাডভাইস। অর্থাৎ ভাদ্দর বৌয়ের মতাে সারেন্ডার শব্দটা তিনি নিজমুখে উচ্চারণ করতে নারাজ, এটা হেডকোয়ার্টারই বলুক। ত্রিপক্ষীয় একটা খেলা চলছিল পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ নিয়ে। সবাই বুঝেছিল পরাজয় এখন সময়ের ব্যাপার ইসলামাবাদের সেনাসদর চাইছিল সিদ্ধান্তটা গভর্নর ও ইন্টার্ন কম্যান্ড মিলে নিক। সেনাসদর থেকে তারা কখনােই আনুষ্ঠানিকভাবে সারেন্ডার করতে বলবে না। অপরদিকে গভর্নর মালিক ও তার স্টাফ অফিসার রাও ফরমান আলী চাইছিল ইস্টার্ন কম্যান্ডের প্রধান হিসেবে জেনারেল নিয়াজি এই সিদ্ধান্ত নিক। অপরদিকে নিয়াজি চাইছিল কাগজে-কলমে যে প্রাদেশিক সরকার রয়েছে তার প্রধান হিসেবে গভর্নর মালিকই সিদ্ধান্ত নিক তাই এরা প্রত্যেকে দাবি করতে পারে যে, তারা আত্মসমর্পণ করতে চান নি। ১০ ডিসেম্বর সকালে প্রেরিত নিয়াজির বার্তা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, পাকবাহিনীর লড়বার আর কোনাে ক্ষমতা নেই। সেদিনই ইসলামাবাদ থেকে এর জবাব দেয়া হয় এবং নিয়াজিকে বলা হয়,“এটা বােঝা যাচ্ছে যে সংখ্যা ও সরঞ্জামে বিশাল শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে এবং বিদ্রোহীদের সক্রিয় সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানে শক্রর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার কেবল সময়ের ব্যাপার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সার্থকতা আপনাকে বিচার করে দেখতে হবে এবং এর ভিত্তিতে খােলাখুলি উপদেশ দেবেন গভর্নরকে, যিনি প্রেসিডেন্ট প্রদত্ত প্রাধিকার-বলে এ-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন এরপর বার্তায় বেশ রাখঢাক করে সারেন্ডারের কথাই বলা হয় এমনভাবে, যাতে প্রয়ােজনে আবরণ দাড় করিয়ে এটা অস্বীকার করা যায়। বার্তায় বলা হয়, “যখনই আপনি মনে করবেন যে এমনটা করা দরকার তখন চেষ্টা নেবেন সামরিক সরঞ্জাম যথাসম্ভব ধ্বংস করে ফেলতে, যাতে সেসব শক্রর হাতে পড়ে।
এই বার্তায় ফারমান ও নিয়াজি উভয়েই অস্বস্তিতে পড়েছিল। অস্বস্তি সারেন্ডার নিয়ে নয়, বরং সারেন্ডারের কথা স্পষ্টভাবে না বলে এমনটা করা দরকার’ উল্লেখ করা নিয়ে। যে এমনটা করতে হলে অস্ত্রপাতি ধ্বংস করতে হয় একজন সৈনিকের কাছে তার মানে খুব স্পষ্ট কিন্তু ইসলামাবাদ কথাটা খুলে না বলাতে ফারমান অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। আর নিয়াজি বুঝেছিলেন সিদ্ধান্তটা এখন আরাে বেশি করে তার ওপর চাপানাে হলাে, কেননা তার পরামর্শেই গভর্নর সিদ্ধান্ত নেবেন। ১২ ডিসেম্বর ঢাকা শহরে বসে অগ্রসরমান যৌথবাহিনীর কামানের গর্জন শুনতে পেলেন রাও ফারমান আলী। স্পষ্টতই তাদের চারপাশ ক্রমে সঙ্কুচিত হয়ে এসেছিল চাদপুর থেকে সৈন্য সামন্ত রেখে পালিয়ে আসার সময় মেজর জেনারেল রহিম আহত হয়েছিলেন এবং তিনি গভর্নর ভবনস্থ ফারমান আলীর কোয়ার্টারে অবস্থান করছিলেন। সেখানে চার জেনারেল রহিম, ফারমান, নিয়াজি ও জামশেদের এক বৈঠক হয় এবং সবাই একমত হয় সারেন্ডার করা ছাড়া তাদের আর উপায় নেই। তবে প্রেসিডেন্টের কাছে এই প্রস্তাব পাঠাবার সময় আমার জরুরি কাজ রয়েছে। আপনারা পাঠিয়ে দিন’, বলে তড়িঘড়ি চলে গেলেন নিয়াজি অবস্থা বুঝে ফারমানও আর বার্তাটা পাঠালেন না। অস্ত্র-সংবরণের যােগাযােগগুলাে আনুষ্ঠানিকভাবে করা হচ্ছিল গভর্নর ভবন থেকে সেটাও নিয়াজিকে আবরণ যুগিয়েছিল তার বাহাদুরি প্রদর্শনে ১৩ ডিসেম্বর যখন গভর্নর হাউজে বােমাবর্ষণ করলাে ভারতীয় জঙ্গী বিমান এবং গভর্নর মালিক পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন পাকবাহিনীর সময় নিশ্চিতভাবে ফুরিয়ে এসেছিল। নিয়াজি অবস্থা বুঝে আবার বাগাড়ম্বরে ফিরে গেলেন। কেননা তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন হেডকোয়ার্টার তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সারেন্ডার করতে বলবে না, গভর্নর পদত্যাগ করাতে ইস্টার্ন কম্যান্ডের মাথার ওপর আনুষ্ঠানিকভাবে আর কেউ রইলাে না, অপ্রিয় কাজটি তাকেই করতে হবে। তাই তিনি বার্তা পাঠালেন, “ঢাকা দুর্গের প্রতিরক্ষা সংগঠিত করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত লড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।” এবার আর কোনাে উপদেশ প্রার্থনা নয়, নিছকই আস্ফালন। ঢাকাতে এবার তিনি বললেন ‘দুর্গ’, অথচ প্রতিরক্ষার কোনাে আয়ােজনই তার নেই, অর্থাৎ যুদ্ধ করার সাহস ও ইচ্ছা কিছুই তাদের নেই।
অথচ এর আগের দিনই আত্মসমর্পণ করে চামড়া বাঁচাবার সিদ্ধান্ত চার জেনারেল একত্রে বসে নিয়ে রেখেছিলেন। সেদিন রাতেই নিয়াজি বার্তা পেলেন প্রেসিডেন্টের ” “আপনি এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন যখন আর প্রতিরােধ করাটা মানুষ হিসেবে সাধ্যের অতীত এবং সেটা কোনাে প্রয়ােজনীয়। উদ্দেশ্য সাধনও করবে না। এর ফলে কেবল ধ্বংস ও অধিকতর জীবনক্ষয় ঘটবে আপনাকে তাই এখন যুদ্ধ বন্ধ করা এবং সেনাসদস্য, যারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছে ও যারা আমাদের অনুগত—তাদের প্রাণরক্ষায় সকল প্রয়ােজনী ব্যবস্থা নিতে হবে।” খেলা এখন শেষ। ১৪ ডিসেম্বর বিকালে নিয়াজি ও ফারমান আলী ঢাকাস্থ মার্কিন কন্সাল জেনারেল হার্বাট স্পিভাকের সঙ্গে দেখা করে। আত্মসমর্পণে সম্মতি প্রকাশ করে স্পিভাক বার্তাটি সরাসরি ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে পাঠায় ওয়াশিংটনে মার্কিন বিদেশ মন্ত্রী হেনরি কিসিঙ্গারের কাছে কিসিঙ্গার ভারতীয়দের এ-খবর জানাতে একদিন বিলম্ব করেন। তাঁর আশা ছিল এই সময়ে পশ্চিম রণাঙ্গণে পাকিস্তানিরা কিছু ভূমি পুনর্দখল করতে পারলে সেটা পরে আলােচনাকালে কাজে আসবে ১৫ ডিসেম্বর জেনারেল মানেকশ’ বার্তাটি পান এবং ১৬ ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আয়ােজন করেন। ১৬ ডিসেম্বর অতি প্রত্যুষে কয়েকটি হেলিকপ্টারে করে জেনারেল রহিম ও অন্যদের বার্মা পাঠাবার ব্যবস্থা করেন জেনারেল নিয়াজি, অথবা হতে পারে তারা নিজেরাই এভাবে পালিয়েছিলেন। যাই হােক, নিয়াজি তার বইয়ে লিখেছেন যে, ফারমান আলী এই হেলিকপ্টারের যাত্রী হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিল। “কেননা বাঙালি ও বুদ্ধিজীবীদের পাইকারি হত্যার অভিযােগে মুক্তিবাহিনী তাকে খুন করে ফেলবে তাকে মলিন এবং বিপর্যস্ত হয়ে প্রায় ভেঙে পড়ার দশায় দেখে করুণা হচ্ছিল। আমি তাকে আমার দৃঢ় ভরসা যােগালাম যে, নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও আমি তাকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয়দের হাত থেকে রক্ষা করবাে।” ১৬ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় ছত্রীবাহিনীর জেনারেল নাগরা এসে পৌঁছেছিলেন ঢাকায়। ক্যান্টনমেন্টে নিয়াজির সঙ্গে নাগরার বৈঠকের বর্ণনা দিয়ে।
রাও ফরমান আলী লিখেছিলেন, “শুনতে পেলাম নিয়াজি নাগরাকে বলছে তিনি উর্দু কবিতা বােঝেন কিনা। জবাবে নাগরা জানালেন যে, তিনি লাহাের সরকারি কলেজ থেকে ফার্সিতে এম, এ করেছেন। যেহেতু নিয়াজির চেয়ে তিনি অধিকতর যােগ্য ছিলেন, নিয়াজি এবার তাই পাঞ্জাবি জোক বলতে শুরু করলেন। আমার মতে তিনি (নিয়াজি) খুব লজ্জাজনক আচরণ করছিলেন। শক্রর সঙ্গে সারেন্ডারের শর্ত যখন আলােচিত হচ্ছে তখন তার উচিত ছিল গম্ভীর ও মর্যাদাবান ভাবে থাকা অথচ উল্টোভাবে তিনি আমুদে ভাব দেখাচ্ছিলেন, ভারতীয়দের শােনাচ্ছিলেন অশ্লীল রসিকতা, যেন তারা পুরনাে বন্ধু।” যে অবিশ্বাসী বা কাফেরদের ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছিলেন টাইগার নিয়াজি অনধিক তিন সপ্তাহ আগে, এখন তাদের সামনে বিড়াল হয়ে মিউ মিউ করছিলেন তিনি ফারমান-নিয়াজি সশস্ত্র যুদ্ধ করতে অক্ষম হলেও বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে অশেষ পারঙ্গমতা দেখিয়েছিল মানুষ হিসেবে তাদের নীচতা ও হিংস্রতার চরম প্রকাশ ঘটেছে ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে এই বর্বরতম পাশবিকতা তারা করেছে নিশ্চিত পরাজয়ের কিনারে দাড়িয়ে ভারতবাংলাদেশ বাহিনীর মােকাবিলা করার আত্মবল তাদের ছিল না। কিন্তু নিরস্ত্র বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে তুলে এনে নদীতীরের ইটের ভাটায় মেরে স্তুপীকৃত করে রাখতে তাদের বাধে নি। এইে ঘৃণ্য নরকের কীটদ্বয় বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্যও এক অপরকে দায়ী করে গেছেন। কিন্তু ইতিহাস তাদের উভয়কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে মানবতার স্বার্থে সেই কাজটি যতাে শীঘ্র হয় ততটা মঙ্গল। নিজের গ্লানি ঢাকতে অসদাচরণ নিয়াজি শেষ পর্যন্ত করে গেছেন সারেন্ডারের সময় প্রতীক হিসেবে তরবারি জমা দেয়ার কথা বলা হলে নিয়াজি জানান যে, তার কোনাে তরবারি নেই। তখন কথা হলাে নিয়াজি তার ব্যক্তিগত পিস্তল জমা দেবেন পরে এই পিস্তলটি সুভেনির হিসেবে নিয়েছিলেন লে.জে, জ্যাকব। এবার জ্যাকব অবাক হয়ে দেখলেন নিয়াজি তার নিজস্ব পিস্তল জমা দেন নি, তার ব্যক্তিগত মিলিটারি পুলিশের মামুলি .৩৮ পিস্তল ছিল এটি, অযত্নে অব্যবহারে এর নলে ময়লা জমে আছে। সেটাই প্রতীক হিসেবে নিয়াজি সারেন্ডার করেছিলেন। এবার তাই নিয়াজি আরাে বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন, তিনি যে সারেন্ডার করতে চাননি শুধু তা নয়, তিনি তার নিজস্ব পিস্তলটিও সারেন্ডার করে নি।
(ডিসেম্বর, ১৯৯৯)
জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক