You dont have javascript enabled! Please enable it!
জল্লাদখানা বধ্যভূমি : স্মৃতিপীঠ-ভাবনা
 
মীরপুরের নূরী মসজিদ সম্প্রসারণের কাজ করবার জন্য খোঁড়াখুড়ি চললে মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে কিছু হাড়গােড় এরপর খনন অব্যাহত থাকলে অস্থি-খুলি মিলিয়ে একাকার অবস্থার পরিচয় ফুটে উঠতে থাকে, পত্রপত্রিকায় খবর বের হয় এবং স্থানীয় জনগণ আর কোথাও না গিয়ে ছুটে আসেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে, এইসব অস্থি যে ইঙ্গিত দিচ্ছে মাটিচাপাপড়া একাত্তরের গণকবরের সেটার সম্মানজনক সুরাহা তাদের কাম্য। সাল ১৯৯৯, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তখন সবে যাত্রাশুরুর পর্ব, আপন অস্তিত্ব নিয়ে টালমাটাল পায়ে চলছে পথচলা, শক্তি ও সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা প্রবল, সেই সময় বধ্যভূমি পুনরুদ্ধারের এই জটিল কঠিন কাজে ঝাপ দিতে আকু চৌধুরীর উদ্যোগে জাদুঘরের কোনাে দ্বিধা ছিল না। মসজিদের সম্প্রসারণ কাজ বন্ধ করে আরম্ভ হলাে বধ্যভূমির পরিচয় উদঘাটনের পালা। ভিন্ন উদ্দেশ্যের এই খোঁড়াখুড়ি শুরু হতেই ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতার প্রমাণ হিসেবে যেন জেগে উঠতে লাগলেন মাটিচাপা শহীদেরা, তাদের ছিন্নভিন্ন দেহাস্থি ও মাথার খুলি সাজিয়ে রাখা হ’লে শূন্য আঁখি কোটর যেন অনেক কথা বলতে শুরু করলাে, মেলে ধরলাে অনেক প্রশ্ন  নূরী মসজিদ বধ্যভূমি খোড়াখুড়ি শেষ হতে না হতেই স্থানীয় মানুষেরা জল্লাদখানা বধ্যভূমির সন্ধান জানিয়ে সেখানে কিছু একটা করবার জন্য প্রবল তাগিদ সৃষ্টি করতে থাকেন ইতিমধ্যে নূরী মসজিদ বধ্যভূমির খনন কাজ দেশব্যাপী প্রবল আলােড়ন জাগিয়েছিল প্রতিদিন শত শত মানুষ এসে ভিড় জমাতাে খননস্থলে, কাজ পরিচালনার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত অর্থ সাহায্য করেন অনেকে, প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্রে রিপাের্ট প্রকাশিত হতে থাকে এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় অধিবাসীদের অনুরােধে মীরপুরের আরেক বধ্যভূমি জল্লাদখানার স্বরূপ উদঘাটনের কাজ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ততােদিনে এই কাজে বিশেষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে এবং জল্লাদখানার খননকাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও সম্পৃক্ত হয়। নূরী মসজিদ বধ্যভূমি যেমন ঘনবসতি দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল জল্লাদখানা ছিল সেই তুলনায় অনেকটা ফাকা।
 

একাত্তরের প্রায় বিরান এই অঞ্চলে ওয়াসার পরিত্যক্ত যে পাম্পহাউজ ছিল সেটাকে ঘাতকেরা পরিণত করেছিল আদর্শ এক বধ্যভূমিতে। কেননা হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করবার পর লাশের গতি করাটা ঘাতকদের জন্য সব দেশে সব কালেই একটা বড় সমস্যা। বাংলাদেশে অধিকাংশ গণহত্যা যে ঘটেছে নদী বা খাল-বিলের ধারে তার কারণ সেই বিশেষ অবস্থান জলগ্রাস প্রক্রিয়ায় লাশের বিলীন হওয়া সম্ভব করে তােলে এবং শবদেহের চিহ্ন মুছে ফেলবার জন্য নদী বা খালে ফেলে দেয়া বিবেচিত হয়েছিল সর্বোত্তম পন্থা হিসেবে। একাত্তরের নয় মাস এমনিভাবে নানা স্থানে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররা এবং তাদের এক প্রধান লক্ষ্য ছিল কীভাবে গণহত্যার চিহ্ন মাটির বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলা যায়।

 
গণহত্যাকারীদের লক্ষ্য তাই স্মৃতিকে বিস্মৃতি দিয়ে ঢেকে দেয়া, স্মৃতিচিহ্নগুলাে যেন আবৃত হয়ে যায়। জীবনের ঘটনাধারায়, তারা হয়ে পড়ে নির্বাক, নিপ, বাকহারা এবং তাদের কাছ থেকে উথিত কোনাে বাণী যেন কালের বাধা অতিক্রম করে এসে পৌছাতে না পারে সমকালে, অনুরণন তুলতে না পারে মহাকালে জল্লাদখানা বধ্যভূমি তাদের জন্য ছিল বড় এক সুযােগ, হত্যার পর লাশ ঢুকিয়ে দেয়া হতাে পাম্পহাউজের জলভরা প্রকাণ্ড গহ্বরে, তাহলেই কেল্লা ফতে, বাইরে থেকে আর কিছু বােঝার উপায় থাকতাে না। বিস্মৃতির অতলে গাদাগাদি করে চাপাদেয়া এই লাশগুলাে পাম্পহাউজ থেকে বের হয়ে আসতে থাকে ২৮ বছর পর, ১৯৯৯ সালে সংগঠিত খনন কাজে ১৯৯৯ সালের শেষাশেষি বধ্যভূমির খননকাজের অভিজ্ঞতা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্যও নানাভাবে শিক্ষণীয় হয়েছে। তার একটি দিক হলাে বধ্যভূমি খননের ক্ষেত্রে বিশ্বসমাজের অর্জিত পেশাদারিত্বের পরিচয় লাভ। এই কাজে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি সংস্থা হলাে ফিজিসিয়ান্স ফর হিউম্যান রাইটস মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আমন্ত্রণে এর প্রধান মার্কিন ফরেনসিক অ্যানথ্রপােলজিস্ট ডা, উইলিয়াম হাগল্যান্ড ঝটিকা সফরে এসেছিলেন ঢাকায় এবং সরেজমিনে ঘুরে দেখেছিলেন মীরপুরের বধ্যভূমি এবং উদ্ধারকৃত দেহাস্থি ও অন্যান্য নিদর্শন।
 
বধ্যভূমি পরিদর্শন ও বিশ্লেষণ শেষে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন তিনি জাদুঘর মিলনায়তনে। সেব্রেনিকায় আট হাজার মুসলিম নিধনের বিভিন্ন গণকবর খননে ডা. হাগল্যান্ডের ছিল নেতৃভূমিকা বিপুল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই বিশেষজ্ঞের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, বধ্যভূমি খনন একটি বড় ধরনের বৈজ্ঞানিক সামাজিক উদ্যোগ হতে হবে এর সঙ্গে জড়িত থাকবেন ডাক্তার, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, অপরাধ তদন্তকারী, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, গবেষক, আইনজীবী, স্থানীয় অধিবাসী ইত্যাদি বিভিন্ন গােষ্ঠীর প্রতিনিধি। প্রাথমিক গবেষণার পর দীর্ঘ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে চলবে খনন এবং এর প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিহ্ন উদ্ধারের জন্য চাই। সযত্ন পরিচর্যা, চাই সেসবের চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ এবং সবকিছুকে বৃহত্তর পটভূমিকায় স্থাপন। কেননা বধ্যভূমি খনন কেবল ইতিহাসের পুনরুদ্ধারের বিষয়  নয়, এই বর্বরতার জন্য যারা দায়ী তাদেরকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য আর তাই বধ্যভূমি যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ বহন করে তা উদ্ধার, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত যত্ন ও ব্যাপক উদ্যোগ দাবি করে ডা. হাগল্যান্ডের বিশেষজ্ঞ অভিমতের পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আর কোনাে বধ্যভূমি খননের কাজে হাত দেয় নি, কেননা অপরিকল্পিত খননে ইতিহাসের সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে; তবে একই সাথে বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও ইতিহাস উদঘাটন জাদুঘরের জন্য হয়ে দাঁড়ায় বড় চ্যালেঞ্জ নূরী মসজিদের স্থানটি ভূমি-আগ্রাসীদের কবল থেকে বাচানাে যায় নি, মসজিদ সম্প্রসারণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তবে মুসল্লিরা সৃজনশীল সিদ্ধান্ত নিয়ে বধ্যভূমির ওপরকার খামগুলাে কালাে রঙ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন, যেন এই কৃষ্ণবস্তম্ভগুলাে নামাজিদের কাছে ইতিহাসের কৃষ্ণ অধ্যায় সম্পর্কে জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়।
 
অপরদিকে সীমানা প্রাচীর তুলে জল্লাদখানার ত্রিকোণ একখন্ড জমি রক্ষা করা যায় এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব শেষাবধি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওপর বর্তায় ফলে এখানে একটি মেমােরিয়েল সাইট বা স্মৃতিপীঠ নির্মাণ করার সুযােগ সৃষ্টি হয় ঐতিহাসিকভাবেই জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে কোন্ ধরনের স্মৃতি-স্মারক নির্মাণ করা হবে সেটা জাদুঘরের জন্য ছিল বড় এক প্রশ্ন স্মৃতিস্থাপনার নকশা প্রণয়নের আগে ভাবতে হয়েছে কোন্ চিন্তা এখানে তুলে ধরা হবে আমরা কি কেবল ইতিহাসের একটি রক্তাক্ত অধ্যায় স্মরণ করবাে, এখানে একাত্তরে কোন বর্বরতা সংঘটিত হয়েছিল তার পরিচয় মেলে ধরবাে, নাকি ইতিহাসের সঙ্গে মানবতার বােঝাপড়া ও ভাববিনিময়ের একটি স্থান হিসেবে বধ্যভূমিকে দেখতে চাইবে এক্ষেত্রে সুবিধার দিক ছিল ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব হিস্টোরিক সাইটস্ অব কনশান্সের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংশ্লিষ্টতা বস্তুত বিশ্বের আরাে আটটি ছােট জাদুঘরের সঙ্গে মিলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সংশ্লিষ্ট সব জাদুঘর একই অভিন্ন ভাবনা দ্বারা আলােড়িত, কীভাবে তাদের ইতিহাস সংরক্ষণ প্রচেষ্টাকে সমকালের প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন জরুরি মানবিক প্রশ্নের সঙ্গে অর্থপূর্ণভাবে জড়িত করা যায় এবং অনাগতকালের জন্য এই প্রয়াসকে অর্থবহ করে তােলা যায় কাজটি দাবি করে সৃজনশীল চিন্তা, কোয়ালিশন কেবল প্রশ্ন তুলেছে, এর সমাধান সবাইকে নিজেদের মতাে খুঁজে ফিরতে হবে আমাদের ক্ষেত্রে এই ভাবনাগুলাে সূত্রবদ্ধ করার চেষ্টায় আমরা বুঝেছিলাম জল্লাদখানা বধ্যভূমি দেশের পাঁচশতাধিক বধ্যভূমির একটিমাত্র এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সৌভাগ্য যে তারা এখানে স্মৃতিস্মারক গড়ে তুলতে পারবে সেই চিন্তা থেকে আমরা জল্লাদখানা বধ্যভূমির নির্মম ইতিহাসকে বড় পরিসরে বিবেচনার প্রয়ােজন অনুভব করেছিলাম। এখানে যে নৃশংসতা ঘটেছে কেবল তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ না রেখে এই স্থানটিকে একটি  স্মৃতি-উদ্যান/স্মৃতিপীঠ বা মেমােরিয়াল সাইট হিসেবে দেখবার তাগিদ আমাদের ছিল। আর তাই স্থানটিকে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বৃহত্তর পটভূমিতে স্থাপন করা ছিল একান্ত জরুরি সেই ভাবনা থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নবীন গবেষকরা বই-পত্রপত্রিকা ঘেঁটে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমির তালিকা প্রণয়ন করেছেন এবং সেইসব নাম জল্লাদখানা বধ্যভূমির দুই প্রান্ত জুড়ে সাদা পাথরে খােদিত হয়েছে।
 
বধ্যভূমিতে প্রবেশের পর ত্রিভূজের এই দুটি বাহুপথ হেঁটে অতিক্রম করতে করতে দর্শনার্থী প্রতিটি বধ্যভূমির নামের ওপর চোখ বুলাতে পারবেন। সমাধিফলকের আকারে শ্বেতপাথরে কালাে অক্ষরে খােদিত নামগুলাে পড়তে পড়তে দর্শনার্থী কোনাে না কোনােভাবে বিশেষ কোনাে বধ্যভূমির সঙ্গে একাত্মবােধ করতেও পারেন। নানাভাবে এটা ঘটতে পারে, যেমন বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষ এখনও নিজেদের জেলাওয়ারি সত্তায় আস্থা রাখেন এবং তা নিয়ে গর্ববােধ করেন, ফলে অনেকে হয়তাে তালিকায় নিজ অঞ্চল বা জেলার বধ্যভূমিগুলাের নাম আলাদা অনুভব নিয়ে পড়বেন। কিংবা এমনও হতে পারে এর কোনাে কোনােটির নাম তিনি শুনেছেন, স্থানটি কোনাে একসময় প্রত্যক্ষ করেছেন। তিরিশ লক্ষ শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে যে দেশের স্বাধীনতা সেখানকার নাগরিক বধ্যভূমির তালিকাকে নিছক একটি তালিকা হিসেবে দেখবে , এই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে। এই আস্থা আরাে প্রবল হয়েছে যখন নির্মাণকাজের তত্ত্বাবধায়ক নাসির আহমেদ একদিন জানালেন নাম-খােদিত শ্বেতপাথরগুলাে লাগানাের পর অনেকেই আসছেন স্থানটি দেখতে এবং এক বৃদ্ধ এসে তালিকা পড়তে পড়তে ‘তাজ সিনেমা হল বধ্যভূমি, নওগাঁ’ কথাটি পড়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছিলেন, আর চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়েছিল অশ্রুবিন্দু।
কে জানে কেন বৃদ্ধের এমন প্রতিক্রিয়া, হয়তাে তার কোনাে নিকটজন শহীদ হয়েছেন এই বধ্যভূমিতে, এখানে তিনি সেই শশাকের একটা স্বীকৃতি যেন খুঁজে পেলেন শ্বেতপাথরে খােদিত এই তালিকার একেবারে শেষে লেখা রয়েছে ‘অসম্পূর্ণ, কেননা এই তালিকা এখনও পূর্ণাঙ্গ নয় সব বধ্যভূমির নাম আগে কখনাে এমন ধারাবাহিকভাবে একত্র করা হয় নি, ফলে অনেক নাম বাদ পড়ে থাকতে পারে, কোনাে বধ্যভূমির পরিচয় নতুনভাবে উদঘাটিত হতে পারে, যেমন ঘটেছিল নূরী মসজিদের ক্ষেত্রে তাই তালিকায় নতুন নাম সংযােজনের জন্য স্থান বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে সর্বোপরি যেটা বলতে হয়, স্থপতি রবিউল হুসাইনের চমৎকার নকশায় স্মৃতি-উদ্যানের দেয়াল ঘেঁষে চলতে চলতে বধ্যভূমির তালিকা-পাঠ দর্শনার্থীদের একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপকতা সম্পর্কে একটি ধারণা নিঃসন্দেহে যােগাবে বধ্যভূমির এই তালিকার মধ্যভাগে রয়েছে উঁচু দেয়াল জুড়ে নির্মিত মুরাল, দেশি ঝামা ইট ও সাদামাটা উপকরণ দিয়ে নির্মিত এই মুর্যাল স্মরণ করিয়ে দেবে বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী রায়েরবাজারের ইটের ভাটিতে পড়ে থাকা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লাশের কথা, প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর পত্রিকার পাতায় ছাপা যেসব ছবি দেশবাসীর অন্তরদ্বারে নিশ্চিত করাঘাত করে।
 
জল্লাদখানার পরিত্যক্ত কূপে যেসব লাশ গাদাগাদি করে চাপা দেয়া হয়েছিল, যে-ছবি কেউ কখনাে দেখেনি, এই মুরাল সেই বাস্তবতার পরিচয়ও তুলে ধরে। রফিকুন নবীর এই মুর্যালের পর সীমানা দেয়ালের নিচ বরাবর বধ্যভূমির অব্যাহত তালিকার পাশাপাশি উপরাংশ জুড়ে বিশ শতকের প্রধান কতক গণহত্যার উল্লেখ রয়েছে। আর্মেনীয় গণহত্যা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালের নাৎসি গণহত্যা, কাম্বােডিয়ার গণহত্যা, সাবেক যুগােস্লাভিয়ার গণহত্যা, পূর্ব তিমুর গণহত্যা এমনি সারি সারি নামের পাশাপাশি উল্লিখিত হয়েছে ঐসব গণহত্যায় নিহতজনের সংখ্যা বিশ শতকের সর্বশেষ গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ হয়েছে সুদানের নাম এবং তালিকার নিচে লেখা হয়েছে চলছে’, অর্থাৎ বিশ শতক পাড়ি দিয়েও মানুষ গণহত্যাকে পেছনে ফেলে আসতে পারেনি, তা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের বধ্যভূমির তালিকার পটভূমিকায় বিশ শতকের প্রধান সব গণহত্যার উল্লেখ আমাদের একাত্তরের ইতিহাসকে বিশ্ব ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেখবার অবকাশ যােগায় বিশ শতকে নাৎসি জার্মানি পরিচালিত গণহত্যায় নিহতদের সংখ্যার পাশাপাশি রয়েছে কতক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের নাম শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাস। সম্পর্কে যারাই কিছুটা ওয়াকিবহাল তারা মানবপীড়নের বর্বর কেন্দ্র এইসব কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বাস্তব পরিচয় জানেন, আর তাই আশা করা যায় অসউজ, বুখেনভাল্ড, ট্রেবলিংকা, ডাকাউ এমনি সারি সারি নাম ভিন্নতর অনুরণন তুলতে সমর্থ হবে এবং বাংলাদেশের গণহত্যাকে মানবের ইতিহাসের অন্যসব কৃষ্ণ অধ্যায়ের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ নেয়ার সুযােগ সৃষ্টি করবে।
 
একাদিক্রম নামের প্রবাহের মধ্যে বিমূর্ততার যে উপাদান থাকে তা কাটিয়ে মূর্ত জীবনের পরশ নিয়ে আসার জন্য হাঁটাপায়ের পথে ছয়টি সমদূরত্ব স্থানে রাখা হয়েছে ছয়টি বধ্যভূমির মাটি দেশের মাটিতে মাথা ঠেকানাে বাঙালি সংস্কৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য, আর সেই চেতনা থেকেই নির্বাচিত কতক বধ্যভূমির মাটি এনে রাখা হয়েছে প্রতিটি বধ্যভূমির গুরুত্ব ও পবিত্রতার স্বীকৃতিস্বরূপ। বাংলাদেশের বধ্যভূমির তালিকা এবং বিশ শতকের প্রধান গণহত্যার উল্লেখ সংবলিত যে তালিকা তার শেষে কী লেখা যেতে পারে সেটা ছিল বড় ভাবনার বিষয় শেষ পর্যন্ত ছােট কিন্তু বহুমাত্রিক একটি আহ্বান জানাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিক্রমণের শেষ পর্যায়ে বধ্যভূমির তালিকা সম্বলিত সারি সারি শ্বেতপাথরের উপান্তে কালাে গ্রানাইট পাথরে লাল হরফে লেখা হয়েছে। “STOP GENOCIDE’, ‘গণহত্যা বন্ধ করাে’ বড় বড় হরফে এই লেখা। দর্শনার্থীর অন্তরের আকুতির প্রতিধ্বনি যেমন করছে তেমনি তার এক আলাদা। তাৎপর্যও রয়েছে। স্টপ জেনােসাইড’ ছিল একাত্তরে জহির রায়হান নির্মিত। অসাধারণ তথ্যচিত্রের নাম এবং ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি শহীদ অগ্রজ শহিদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে এই মিরপুরে এসেই চিরতরে হারিয়ে যান জহির রায়হান। কালাে পাথরে ছােট হরফে ইতিহাসের সে-ই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ স্টপ জেনােসাইড’ আহ্বানটি যেমন সার্বজনীন, তেমনি তা একাত্তরের বিশিষ্ট শৈল্পিক প্রতিবাদের সঙ্গেও জড়িত এবং সেই প্রতিবাদী মানুষটির নিষ্ঠুর জীবনাবসান আবার এই মীরপুরের সঙ্গেই যুক্ত এরপর দর্শনার্থী এসে দাঁড়াবেন জল্লাদখানা নামে চিহ্নিত পাম্পহাউজের ছােট ঘরটির সামনে বাঙালিদের ধরে এনে এই ঘরের ভেতরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৯৯ সালে খননকাজের সময় ঘরের ভেতরকার ভূগর্ভস্থ চৌবাচ্চা থেকে ৭০টি মাথার খুলি ও চার সহস্রাধিক অস্থিখণ্ড পাওয়া গিয়েছিল। মানুষজনকে হত্যা করে কাপড়-জামা পরা অবস্থাতেই জলভরা গহ্বরে ঢুকিয়ে দেয়া হতাে। ২৮ বছর পর যখন ঘন কালাে কাদার তাল পরিষ্কার করে অস্থি-কঙ্কাল তােলা হলাে তখন ছিন্নভিন্ন জামা-কাপড়, সস্তা প্লাস্টিকের জুতাে, তসবি, মালা, চুলের কাটা, মানিব্যাগ ইত্যাদি নানাকিছু পাওয়া গিয়েছিল।
 
এই কক্ষে প্রবেশের আগে দর্শনার্থীর মধ্যে যে মানসিক ভাবের সঞ্চার হয় তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রবেশ দ্বারের ওপর ঝােলানাে হয়েছে একটি ঘণ্টা। এই ঘণ্টা বাজিয়ে মৃদুমধুর ধ্বনি তুলে দর্শনার্থী প্রবেশ করবেন ভেতরে, ঘণ্টার অনুরণন তখনাে যেন ভেসে থাকে বাতাসে, স্মরণ করিয়ে দেয় কোনাে মানুষ নয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, ঘণ্টাধ্বনি তাে বাজে সবার জন্য, তােমারই জন্য দরজার ঠিক ওপরে লেখা রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব হিস্টোরিক সাইট মিউজিয়ামের বাণী : কী ঘটেছিল এখানে?’ তামার পাতের উপর পৃথিবীর ছয়টি বিভিন্ন ভাষায় খােদিত হয়েছে এই একটি কথা, যা জল্লাদখানাকে বিশেষ থেকে সার্বজনীন করতে সহায়ক হবে। জল্লাদখানার কক্ষ সাজানাে হয়েছে স্বল্পতম উপাদানের মাধ্যমে মানবিক কাহিনী মেলে ধরায় অভিপ্রায় থেকে খননকাজ এবং খননকালে উদ্ধারকৃত অস্থি-খুলি ইত্যাদির কয়েকটি ছবি কক্ষের অতীত বাস্তবতা মেলে ধরে, তবে প্রদর্শনীতে মূলত স্থান পেয়েছে উদ্ধারকৃত জামাকাপড়, ওড়নার টুকরাে কিংবা অন্য সামগ্রী যা হত্যার শিকার মানুষদের একদা সজীব জীবনকে প্রকাশ করে জাদুঘরে খুলি ও কঙ্কাল প্রদর্শনের ধারণা নিয়ে জাদুঘরবিশারদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে জল্লাদখানার ক্ষেত্রে এখানে সংঘটিত নৃশংসতাকে চিত্তে কাঁপুনি-ধরানাে বা শকিং পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা হয়নি। তাই খুব অল্প উপস্থাপনায় অনেক কথা বলবার চেষ্টা নেয়া হয়েছে জল্লাদখানার হত্যাকক্ষে বলা হয়েছে কম, কেননা সবিস্তার বলবার পরও অনুক্ত রয়ে যাবে আরাে অনেক কথা। দর্শনার্থীর মনে জানার আগ্রহ ও প্রয়ােজনীয়তা উশকে দেয়াটা এখানে মূল উদ্দেশ্য, তিনি যেন ভাবনা-তাড়িত হন এবং বধ্যভূমির তথ্য উদঘাটনের পথের অভিযাত্রী হয়ে ওঠেন। জল্লাদখানার রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত হননকক্ষ থেকে যখন বের হয়ে আসবেন দর্শনার্থী তখন তার কিছু অবকাশ দরকার হবে, তিনি নিশ্চয় ভাবতে চাইবেন, বুঝতে চাইবেন, নিজের সঙ্গে তাঁর কিছু বােঝাপড়া করার থাকবে, যা প্রত্যেক দর্শনার্থী আপনকার মতাে করে করবেন। দর্শকের আলােড়িত চিত্তে উপলব্ধির অবলম্বন যােগাবার জন্য ভাবনা ও বিবেচনার পরিসর হিসেবে নির্মিত হয়েছে দেশি ইটে তৈরি ছােট কক্ষ, যার সবটাই খােলামেলা, যেন সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছে ভেতরে প্রবেশের জন্য এই পরিসরটি গড়ে তােলা হয়েছে দর্শনার্থীর সঙ্গে। স্মৃতিপীঠের ভাববিনিময়ের উদ্দেশে।
 
এটা লক্ষ্য করা গেছে, প্রবেশের পর থেকে দর্শনার্থীর সঙ্গে স্মৃতি-উদ্যান বা স্মৃতিপীঠ স্বয়ং যেন কথা বলে চলে, যেমন কথা। বলে কোনাে সমাধির ফলক, এখানে অবশ্য বলবার রয়েছে তার চেয়েও বেশি এটাও ভাবা হয়েছে জল্লাদখানা স্থানটি হবে এমন এক স্মৃতিপীঠ যেখানে কোনাে গাইড বা ব্যাখ্যাদাতা থাকবে না, স্থানটিতে বলবার অনেক বিষয় স্বাভাবিকভাবে সন্নিবেশিত থাকবে, চলতে চলতে দর্শনার্থী সেইসব বার্তা আহরণ করবেন। স্মৃতিপীঠের বলবার কথাটুকুর মধ্য দিয়ে পরিক্রমণ শেষে দর্শনার্থী এসে পৌছবেন ভাববিনিময়ের পরিসরে। এখানে আছে বসবার স্থান, মন্তব্য লেখার খাতা ও ভাবনার অবকাশ। খােলা ঘরের চার কোণে থাকছে চার ধরনের কাগজপত্র, দলিল, ছবি ইত্যাদি, খুব চুম্বকাকারে। আলােকপাতের এই চার ক্ষেত্র হচ্ছে, প্রথমত জল্লাদখানা বধ্যভূমি সংক্রান্ত তথ্য- এর খননের সচিত্র বিবরণ, সংবাদ প্রতিবেদন ইত্যাদি ছাড়াও থাকছে স্থানটির একাত্তর সালের অবস্থার তথ্যাদি দ্বিতীয়ত থাকছে জল্লাদখানায় খননকাজের শুরুতে প্রাপ্ত ১৭ জন শহীদের নামের সঙ্গে পরে উদ্ধারকৃত আরাে নাম, তাদের পরিচয় ইতােমধ্যে যেটুকু জানা গেছে ইত্যাদি। থাকছে জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে শহীদ ও তাঁদের পরিবারের বিবরণী, যা হালফিল সময় পর্যন্ত অনুসরণ করা হচ্ছে লক্ষণীয় বধ্যভূমিতে স্মৃতিপীঠ নির্মাণের কাজ শুরুর পর থেকে স্থানীয় জনগণ এগিয়ে এসে বিভিন্ন তথ্যের যােগান দিচ্ছেন যা পরিকল্পনা বিকাশে বিশেষ উদ্দীপনামূলক ও সহায়ক হয়েছে। তৃতীয়ত থাকছে দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমি সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের বিবরণ এবং সেখানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন দর্শনার্থী প্রদত্ত তথ্যাদি।
 

এটি ক্রমবিকশিত হয়ে চলছে, সেটাই ছিল উদ্দিষ্ট। আর চতুর্থত থাকছে জেনােসাইড বা জাতি-নিধন অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উদ্যোগের বিবরণ ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ গৃহীত জেনােসাইড কনভেনশন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন ও বিভিন্ন দেশে গণহত্যার বিচার সংক্রান্ত আইনি দলিলের কপি থাকছে এখানে, যেন দর্শনার্থী গণহত্যার বিচারের প্রশ্ন বৃহত্তর পরিসরে বিবেচনা করতে পারেন, জল্লাদখানায় কৃত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের প্রশ্ন বুকে ধারণ করে যেন তিনি বের হতে পারেন। আগাগােড়াই আমাদের লক্ষ্য ছিল এই স্মৃতিস্থানটি নিছক একটি ঐতিহাসিক ঘটনাস্থল হিসেবে না দেখে এর সঙ্গে দর্শকদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা সেই লক্ষ্যে দর্শকদের কাছে আহ্বান জানানাে হচ্ছে কোনাে বধ্যভূমি সম্পর্কে  তিনি যদি কোনাে তথ্য জানেন, জানেন বধ্যভূমির কোনাে শহীদের পরিচয়, তবে সেটা লিখে এখানে জমা দিতে কোনাে দর্শনার্থী চাইলে ডাকযােগেও বিস্তারিত তথ্য জানাতে পারবেন। আমাদের প্রত্যাশা, ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণে যেভাবে। ভিকিপিডিয়া গড়ে উঠছে একইভাবে বাংলাদেশের বধ্যভূমি সম্পর্কিত বিশালস তথ্যভাণ্ডার বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিপীঠ নির্মাণে কাজের সূত্রে ক্রমে বিকশিত হবে তাই এ-কথা বলা যায়, জল্লাদখানা বধ্যভূমির মধ্য দিয়ে আমরা ঐতিহাসিক স্থানের বিপুল ক্ষমতার পরিচয় নিতে চেয়েছি, আমাদের বাস্তব ইতিহাসের সঙ্গে মানবতার অভিন্ন সাধনার মিল রচনা করে। এই কাজে জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠের। ধারণা বিকাশ একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র, তবে আশা করা যায় ব্যাপক জনমানুষের অংশগ্রহণে স্মৃতির এই সগ্রাম অর্জন করবে সার্থকতা আমরা স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই, নিছক স্মৃতিতে আটক থাকতে চাই না, স্মৃতির সজাগতা আমাদের শক্তি যােগাবে ভবিষ্যতের দিকে দৃঢ়ভাবে এগােবার, মানবতার বিরুদ্ধে যে ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার ক্ষত উপশম করে সমাজে সমন্বয় আনবার জন্য চাই  সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ন্যায়প্রতিষ্ঠার পথ কণ্টকিত করছে বিস্মৃতির জাল, স্মৃতির উদ্ভাসন আমাদের পথ দেখাবে সেই ন্যায়ের দিকে অভিযাত্রার।

(বার্ষিক প্রতিবেদন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, মার্চ ২০০৭)।
 
বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ উদ্বোধনী-লগ্ন
 

বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠের দ্বার উন্মােচন অর্থ নতুন এক যাত্রার সূচনা। স্থানীয় জনগণ, শহীদ পরিবার, গবেষক ও নবীন প্রজন্ম মিলে এখন নির্মাণ করে চলবে স্মৃতির। ভাণ্ডার, আশা করা যায়, প্রত্যেক শহীদ আর কোনাে সংখ্যা হয়ে থাকবে না, তাদের সম্পর্কিত যত কথা আছে, আছে যত তথ্য সব সংরক্ষিত হবে, জমা হবে এবং এভাবে  সংখ্যা পাবে অব্যব, অবয়ব পাবে প্রাণ আমরা জানবাে অতীব গৌরব ও বেদনা, জানবাে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের গভীরতা, কী ঘটেছিল এখানে, কেন ঘটেছিল, কারা ঘটিয়েছিল এবং এভাবেই আমরা এগােতে পারবাে সত্য ও ন্যায়বিচার। প্রতিষ্ঠার দিকে জল্লাদখানা বধ্যভূমি এখন থেকে যে কাজ সূচনা করবে তা হলাে এই বধ্যভূমিসহ  বাংলাদেশের সকল বধ্যভূমির ইতিহাস ও তথ্যের ভাণ্ডার গড়ে তােলা এই কাজ

কোনাে একক প্রতিষ্ঠান বা গােষ্ঠীর পক্ষে সম্পাদন সম্ভব নয়, কিন্তু গােটা দেশের মানুষ মিলে ক্রমান্বয়ে এই কাজটি সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করে তুলতে পারে তাই আমরা আবেদন জানিয়েছি জল্লাদখানার সকল দর্শনার্থীর কাছে, যে যেই তথ্য জানেন, শহীদদের সম্পর্কে, বধ্যভূমি সম্পর্কে, তা লিখিতভাবে জমা দিন। এই সমস্ত তথ্য সংরক্ষণ করবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, তা সকলের বিবেচনার জন্য মেলে ধরবে এই কাজে।
আমরা বিশেষ করে চাই নবীন প্রজন্মের সম্পৃক্তি, তারা তাদের অগ্রজদের কাছ থেকে জেনে মুক্তিযুদ্ধের তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করবার কাজে দৃঢ়ভাবে যুক্ত হবে, সে বিশ্বাস আমাদের রয়েছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির যে সংগ্রাম তাতে আমরা বিজয়ী হতে পিরবাে সর্বজনের অংশগ্রহণের শক্তিতে জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ উদ্বোধনকালে আমরা দুটি বিষয়ের দিকে গােটা জাতির সমর্থনপুষ্ট বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই প্রথমত, জল্লাদখানা বধ্যভূমিসহ বাংলাদেশ জুড়ে ছড়ানাে প্রায় পাঁচশত বধ্যভূমি একাত্তরে এদেশের মাটিতে সংঘটিত বিশ শতকের নৃশংসতম এক গণহত্যা তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বাস্তবতা তুলে ধরছে বধ্যভূমি ঘিরে যেসব তথ্য ও সত্যপরিচয় উদঘাটিত হয়েছে এবং হবে তা মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের সাক্ষ্য নানাভাবে উদঘাটন করে চলবে এই বাস্তবতা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার-অনুষ্ঠানের প্রয়ােজনীয়তা আরাে তীব্রভাবে তুলে ধরছে আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে-ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বর্তমান নেতৃত্ব গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের প্রতি তাদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বর্তমানে বিশ্বের নানা স্থানে শান্তিরক্ষায় কাজ করছে, গণহত্যার শিকার সাধারণ মানুষের পাশে দাড়িয়েছে বর্তমান সরকার দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়-প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ তাই আমরা মনে করি গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের জন্য জাতিসংঘের আওতায় গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের সঙ্গে সমন্বিত করে বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটনের বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। এই উদ্দেশ্যে সরকারের কাছে আমাদের বিশেষ আবেদন, গণহত্যার বাইশ বছর পর কাম্বােডিয়ার সরকার-প্রধান ২১ জুন ১৯৯৭ জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে এক পত্রে তাদের মাটিতে সংঘটিত গণহত্যার বিচার চেয়ে চার প্যারার ছােট কিন্তু তাৎপর্যময় এক পত্র দিয়েছিল।
 
সেই  পত্রে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন কোয়ালিশন সরকারের দুই পক্ষ বর্তমানে বাংলাদেশে দেশবাসীর সমর্থনে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে সেই সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সার্বিক সমর্থন অর্জন করেছে। এই সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে কাম্বােডিয়ার অনুরূপ একটি পত্র প্রেরণ করে জাতিসংঘের আওতায় গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য আমরা আহ্বান জানাই। সেইসঙ্গে আমরা স্মরণ করি কাম্বােডিয়ার সরকার প্রেরিত সেই ঐতিহাসিক পত্রের শেষ লাইনগুলাে যে-পত্রের ভিত্তিতে বর্তমানে কাম্বােডিয়ায় গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পত্রে লেখা হয়েছিল : “We believe that crimes of this magnitude are of concern to all persons in the world, as they greatly diminish respect for the most basic human right, the right to life. We hope that the United Nations and international community can assist the Cambodian people in establishing the truth about this period and bring those responsible to justice. Only in this way this tragedy can be brought to full and final conclusion.”
“আমরা বিশ্বাস করি এই মাত্রার অপরাধ বিশ্বের সকল মানুষের জন্য উদ্বেগের বিষয় কেননা তা সবচেয়ে মৌল মানবাধিকার, জীবনের অধিকারকে ক্ষুন্ন করে। আমরা আশা করি এই পর্ব বিষয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা এবং ঘটনার জন্য দায়ীদের ন্যায়বিচার সম্পন্ন করতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কাঘােডীয় জনগণকে সহায়তা করবে। কেবল এভাবেই এই ট্রাজেডির পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত সমাধান হতে পারে।” সবশেষে আমরা বলতে চাই, একাত্তরের স্মৃতি আমরা জাগরুক রাখতে চাই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বহন করে শান্তি ও সম্প্রীতির সুন্দর স্বদেশ নির্মাণের জন্য। এই লড়াইটি ছিল স্বার্থবাদী ও ধর্মান্ধ এক শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে গােটা জাতির লড়াই, পশুশক্তির বিরুদ্ধে মানবতার এই লড়াই কোনাে বিশেষ জাতিগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল জাতিগােষ্ঠীর সেইসব সদস্যদের বিরুদ্ধে যারা মানবতার বিরুদ্ধে নৃশংস অপরাধে মেতে উঠেছিল। ১৯৭১ সালে মিরপুর অঞ্চলের অবাঙালি অধিবাসীদের যুদ্ধাপরাধের কাজে ব্যবহার করবার জন্য পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠি ছিল বিশেষ তৎপর। তাদের এই অমানবিক কাজে শরিক হয়ে যারা নৃশংস অপরাধে যুক্ত হয়েছিল তারা অবশ্যই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী এবং তাদের চিহ্নিত করা দরকার। সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত অপরাধীদের ন্যায়বিচারের মুখােমুখি করে আমরা তুলে ধরতে পারি মানবতার শক্তির ব্যাপকতা এবং মানবতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সম্প্রীতির সমাজ গড়বার প্রয়ােজনীয়তা। তাই বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠের উদ্বোধনী লগ্নে জোর গলায় ঘােষণা করতে চাই : জয়, মানবতার জয়
জয়, বাংলার জয়।
(জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ উদ্বোধন-অনুষ্ঠানের বক্তব্য, জুন ২০০৭)
 

সূত্রঃ  জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক

 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!