You dont have javascript enabled! Please enable it!

সিলেটে গণহত্যা

বই আছে অনেক, তবে বেশির ভাগ বই জন্ম নেয় আর দশটা বই মিলে বই থেকে বইয়ের জন্ম আর জীবন থেকেও জন্ম নেয় বই, ব্যক্তি মানুষের ‘অভিজ্ঞতা রচিত ও মুদ্রিত হয়ে পুস্তকের রূপ নেয়। কিন্তু সহস্ৰজন মিলে বই, হাজারাে মানুষ যারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তারা কি জন্ম দিতে পারেন বইয়ের? পারেন বৈকি, তবে সেই পারাটা হয়ে উঠতে চাই অন্যরকম আয়ােজন, চাই দীর্ঘদিনের নিরন্তর সাধনার মধ্য দিয়ে মৃতদের কাছে পৌছে যাওয়া এবং পরম মমতায় প্রতিজন মৃতকে, শহীদকে, বুকে তুলে তাদেরকে পুনরায় ইতিহাসের শয্যায় শুইয়ে দেয়া। এমন কাজ যদি কোনাে দেশে করবার থাকে, তবে ধিক সেই দেশ, কিন্তু এমন কাজকে যদি কোনাে দেশ অবহেলা করে তবে তাকে শতবার ধিকৃত করবার ভাষা আমাদের জানা নেই। ব্রেশটের ‘গ্যালিলিও’ নাটকে উচ্চারিত হয়েছিল সংলাপ- অভাগা সেই দেশ যার বীরপুত্র নেই। জবাবে গ্যালিলিও বলেছিলেন, অভাগা সেই দেশ যার বীরপুত্র প্রয়ােজন হয়। আমরা সেই দুর্ভাগা দেশ যার অযুত সন্তানকে অসহায়ভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে চরম বর্বর এক সামরিক বাহিনীর হাতে এবং তার চেয়েও বড় দুর্ভাগ্য এই অযুত মৃত্যুর দুঃখ-বেদনানির্মমতা চাপা পড়ে গেছে বিস্মৃতির আড়ালে, তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সর্বজনের জন্য মেলে ধরবার শ্রমসাধ্য কাজে আমাদের অনীহা, অনাগ্রহ ও ব্যর্থতার কারণে একাত্তর-উত্তর বাংলাদেশের প্রয়ােজন ছিল অনেক নিষ্ঠাবান, দরদি, পরিশ্রমী সুপুত্রের যারা দেশমাতার দুঃখকথার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সংগ্রহ করবেন। একাত্তরের গণহত্যা বিষয়ে অনেক কাজ জরুরি হয়ে ছিল এবং এই কাজ সম্পাদনে দরকার ছিল জাতীয় উদ্যোগ আমরা যখন বলি জাতীয় উদ্যোগ তখন সচরাচর ভাবি সরকারের কথা, কিন্তু সরকার ছাড়াও দেশে থাকে অনেক প্রতিষ্ঠান, যেমন আছে বিশ্ববিদ্যালয় ও তার সাথে যুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কিংবা নাগরিকজনেরা মিলে গড়ে তুলতে পারে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রবীন্দ্রনাথের চির-আকাঙ্ক্ষিত সামাজিক শক্তির যা প্রকাশ ঘটাবে এবং এইসব সরকারি অথবা প্রাতিষ্ঠানিক অথবা সামাজিক উদ্যোগ দিয়ে সম্পন্ন হতে পারে অনেক কাজ। এই কাজ যে হয় নি তা’ বলার অপেক্ষা রাখে না।

যারা কর্তৃত্ববান শ্রেণী, যাদের হাতে ছিল ক্ষমতা কিংবা হেজিমনি, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন নি। গবেষণা কিংবা সমাজবিশ্লেষণে সক্ষম প্রতিষ্ঠানও তাে দেশে কম নেই। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। কিন্তু এইসব ব্যর্থতার পরিণামে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে সেটা মেনে নিতে কেউ কেউ তাে রাজি ছিলেন না। তাদের কোনাে ক্ষমতা ছিল না, পেশাগত যােগ্যতা বলতে প্রচলিত যেসব ধারণা আমরা বহন করি সেই বিচারেও তারা দুর্বল, কিন্তু তাঁদের আছে সমাজ ও মানুষের প্রতি প্রবল ভালােবাসা এবং সেই ভালােবাসা সঞ্জাত অঙ্গীকার ফলে তারা বসে থাকেন নি, যা হয় নি তা নিয়ে আক্ষেপ করে শক্তিক্ষয় করেন নি, তারা নিজেদের তাগিদ থেকে কাজ বেছে নিয়েছেন এবং পরম নিষ্ঠা ও একাগ্রতা নিয়ে প্রায় এককভাবে ভরিয়ে তুলেছেন আমাদের অভাব ও শূন্যতার অনেক দিক এমনি কাজের তাৎপর্য বহুমাত্রিক এবং এর তুলনা খুব বেশি মেলে  গােটা সমাজের ব্যর্থতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এমনি একক সাধনার অতুলনীয় উদাহরণ হিসেবে আমরা পেয়েছি তাজুল মােহাম্মদের গ্রন্থ “সিলেটে গণহত্যা, একাত্তরে বৃহত্তর সিলেট জেলায় পাকবাহিনী পরিচালিত প্রতিটি গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ গ্রথিত করে যে গ্রন্থ বাস্তব রূপ গ্রহণ করেছে। একক মানুষও ধারণ করে অনেক ক্ষমতা, যখন সেই মানুষ সমষ্টির পক্ষের শপথে ও কর্মে দৃঢ়চেতা হন। এমন উদাহরণ আমরা ইতিহাসে কিছু কিছু খুঁজে পাবাে। একেবারে সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমনি এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমরা পেয়েছি সাইমন ভিজেনথালকে, যিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে বের করতে সর্বস্ব পণ করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কাজ করে চলেছেন। পলাতক প্রত্যেক নাৎসি নেতা ও কম্যান্ডারদের বিষয়ে যাবতীয় তথ্য-সম্বলিত ফাইল তৈরি করে তিনি তাদের সম্ভাব্য গােপন আশ্রয় খুঁজে বের কল্পতে সচেষ্ট হয়েছেন।

তারই অনুসন্ধিৎসার ফল হিসেবে আর্জেন্টিনা থেকে ধরা পড়ে নাস ঘাতক অ্যাডলফ আইখম্যান। ধরা পড়ে আরাে অনেক যুদ্ধাপরাধী, অনেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণিত হয় ভিজেনথালের কাজের সূত্র ধরে। একথা মনে করার কারণ নেই যে আমি তাজুল মােহাম্মদের সঙ্গে সাইমন ভিজেনথালের তুলনা করতে চাচ্ছি। উভয়ের ব্যক্তিত্ব, যােগ্যতা ও কাজের কোনাে তুল্যবিচার চলে না। তবে আমি এ-কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি তাজুল মােহাম্মদ সেই একই ঘরানার সদস্য যে-ঘরানার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ তৈরি করেছেন সাইমন ভিজেনথাল। উভয়ে আলােড়িত হয়েছেন মানুষের প্রতি মানুষ পরিচালিত চরম পাশবিকতা দ্বারা এবং সেই নির্মমতার সাক্ষ্য সন্ধান ও তা মেলে ধরবার লক্ষ্যে একাগ্র সাধনায় মগ্ন হয়েছেন। এই মিল ছাড়া বাস্তব জীবনে অমিলের অনেক প্রকাশ তাদের মধ্যে রয়েছে। সাইমন ভিজেনথাল সহযােগিতা করেছিলেন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ফ্রেডারিক ফরসাইথের সঙ্গে এবং ফরসাইথ প্রণীত থ্রিলার ‘দা ওডেসা ফাইল’-এ নাৎসি ঘাতক এডােয়ার্ড রােশম্যানের চরিত্র চিত্রণে ভিজেনথাল বাস্তব বহু তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। ফলে আসল রােশম্যান আর বেশি দিন লুকিয়ে থাকতে পারে নি। অচিরেই সে ধরা পড়ে। তাজুল মােহাম্মদ সহায়তা করেছিলেন বৃটিশ তথ্যচিত্র নির্মাতা ডেভিড বার্গম্যানকে তাঁর ‘ওয়ার ক্রাইমস্ ফাইল ছবি নির্মাণের কাজে। তথাকথিত মাওলানা লুত্যর রহমান, মাওলানা আবু সায়ীদ-সহ পাকবাহিনীর দালাল জামাত নেতাদের মানবতা-বিরােধী নিষ্ঠুর ভূমিকা উন্মোচনে তিনি সহায়তা করেন। এরপর যা হয়েছে, ‘ওয়ার ক্রাইমস্ ফাইল বাংলাদেশে বিশেষ প্রদর্শিত হতে পারে নি, দালালরা আছে বহাল তবিয়তে এবং প্রাণনাশী হুমকির মুখে সপরিবারে দেশত্যাগ করতে হয়েছে তাজুল মােহাম্মদকে  তাজুল মােহাম্মদ মুক্তিযুদ্ধে সমর্পিত প্রাণ, যাঁরা তাঁকে চেনেন তারা এটা বােঝেন, আর তার বইয়ের সঙ্গে যাদের পরিচয় রয়েছে তারা সবাই এটা মানবেন তিনি রাজনীতি ও পেশার সূত্রে ঘুরেছেন সিলেটের বিস্তীর্ণ জনপদ, আর নেশার মতাে সগ্রহ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের তথ্য, বিশেষভাবে পাকবাহিনীর নারকীয় হত্যালীলার সবিস্তার বিবরণী।

তার তথ্যভিত্তিক রিপাের্ট প্রকাশিত হয়েছে স্থানীয় পত্রিকায়, কমিউনিস্ট পার্টির সেই সময়কার প্রভাবসম্পন্ন সাপ্তাহিক একতায় এবং সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি-বিষয়ক রুচিশীল সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে পরে ১৯৮৯ সালে এইসব লেখা একত্র করে প্রকাশিত হয় তাজুল মােহাম্মদের প্রথম গ্রন্থ ‘সিলেটে গণহত্যা, এরই পরিবর্ধিত পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এই গ্রন্থকে এককথায় বলা যায় “মিনার’, পাকবাহিনী ও তার এদেশীয় দোসরদের কৃত গণহত্যার চিহ্ন সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা ও সেই চেষ্টায় অনেক সাফল্যের বিপরীতে দাঁড় হয়েছে এই মিনার। ইতিহাস নিয়ে অনেক খেলাই ক্ষমতাবানরা খেলতে পারেন, কিন্তু স্মৃতির মিনারকে টলানাে তাদের পক্ষে কষ্টকর।  জনপদ থেকে জনপদ, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে সংগৃহীত হয়েছে। সিলেটে গণহত্যা বইয়ের তথ্য। লেখকের হাতের কাছে কোনাে তথ্যভাণ্ডার মজুত  ছিল না, হাতল-অলা চেয়ারে বসা গবেষকদের মতাে তিনি পাঠকক্ষের শীতলতায় বসে নিভৃতে কাজ সম্পাদন করতে পারেন নি।

তাকে ধুলি-ধূসরিত পথ উজিয়ে হাজির হতে হয়েছে গণহত্যার প্রতিটি ক্ষেত্রে, হাওর-বাওর পেরিয়ে পৌঁছতে হয়েছে দূরবর্তী ও বিচ্ছিন্ন প্রতিটি গ্রামে, উনিশ শ’ একাত্তরের কোনাে এক দিনে পাকবাহিনী সেখানে পৌঁছে হয়তাে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল সব ঘরের মানুষের জীবন। এই যে দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে, সংবাদপত্রীয় ভাষায় অকুস্থলে গিয়ে, প্রত্যক্ষদর্শী মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে তাজুল বৃহত্তর সিলেটের জনপদে মৃত্যুর হােলি খেলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণী দাঁড় করিয়েছেন তা পড়তে পড়তে মনে হবে গ্রন্থ নয়, এ-যেন এক নরমুণ্ডমালিনী, যে নরমুণ্ডের মালা পরে দানবীয় রূপ গ্রহণ করেছিল ইসলামের স্ব-ঘােষিত রক্ষক পাকিস্তান নামক পরাক্রমী রাষ্ট্রব্যবস্থা তবে তাজুল মােহাম্মদের বইয়ের বড় বৈশিষ্ট্য, নিছক তথ্য নয়, নিছক সংখ্যা নয়, তিনি গণহত্যাযজ্ঞের শিকার প্রতিটি মানুষের হদিশ করতে চেয়েছেন, তাদের নাম-পরিচয় জানার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং গণহত্যার প্রতিটি বিবরণীর সঙ্গে হত্যার শিকার মানুষটির নাম যুক্ত করতে সচেষ্ট হয়েছেন।

অসম্ভব দুরূহ এই কাজ, সময়ের প্রবাহ মুছে দিয়েছে অতীত বাস্তবতার বিভিন্ন পরিচয়। স্মৃতিও অনেক সময় বিভ্রান্ত করে প্রত্যক্ষদর্শীকে, তদুপরি পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ যে পথে ধাবিত হয়েছে সেক্ষেত্রে তাে ক্ষমতাবানরা সদা সক্রিয় থেকেছে ইতিহাসকে মুছে দিতে, ইতিহাসের পরিচয়কে ভিন্ন পথে চালিত করতে এই বিপুল শক্তির মুখােমুখি হয়ে একক মানুষের সাধনা ইতিহাসের সত্য উদঘাটনের কাজ করে জীবনসত্যকে কীভাবে অক্ষয় করে তুলতে পারে সেই নজির রেখেছেন তাজুল মােহাম্মদ তিনি যখন গণহত্যার পরিচয় দিতে কেবল ঘটনার বিবরণী নয়, নির্মমতার শিকার মানুষদের নাম-পরিচয় দাখিল করেন, তখন এই বিবরণী তথ্যের সমাহার ছাপিয়ে আমাদের কাছে রক্তমাংসের সজীব মানুষের চেহারা নিয়ে হাজির হয় মৃতেরা যেন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে উদগ্রিব হয়ে ওঠে। তাঁদের ঠোটে ভাষা নেই, কিন্তু সেই ঠোট থেকে যেন এক অব্যক্ত বাণী উঠে এসে বইয়ের পাতায় পাতায় গুমড়ে গুমড়ে ফেরে তারা কী বলতে চায় সেটা। নির্ভর করে আমাদের শােনবার শক্তির ওপর, কিন্তু তাজুল মােহাম্মদ গণহত্যার বধ্যভূমিতে মাটি চাপা পড়া লাশগুলােকে তুলে এনে আমাদের মুখােমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন এবং বইয়ের পাতায় বাঙময় হয়ে আছে সেই শহীদেরা এই লাশ।আবার মাটিচাপা দেবে এমন ক্ষমতা পৃথিবীর আর কোনাে সামরিক শক্তির নেই।

অজস্র উদাহরণ টানা যায় এই গ্রন্থ থেকে, এতাে রক্তপাত এতাে মৃত্যুর ঘটনা বিশ শতকের ইতিহাসে তাে খুব বেশি ঘটেনি এখানে একটি বিবরণীর উল্লেখ করা যায়, হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ্গ ইতিহাস-বিখ্যাত স্থান ময়মনসিংহ গীতিকার আলালদুলালের কাহিনীতে রয়েছে বানিয়াচঙ্গের রাজার উল্লেখ। বানিয়াচঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন হাওরের মধ্যে বিচ্ছিন্ন গ্রাম মাকালকান্দি দাস সম্প্রদায় অধ্যুষিত এই গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে সুটা নদী। বনেদী গ্রামে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অনেক, স্বচ্ছলতার পরিচয়ও রয়েছে বিভিন্ন গৃহে ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট ভােরে চল্লিশটি ছইওয়ালা নৌকা নিয়ে মেজর দুররানির নেতৃত্বে পাকবাহিনীর আগমনের বর্ণনা দিয়েছেন তাজুল মােহাম্মদ। তিনি লিখেছেন : ‘বিষহরি পূজার আয়ােজন শেষ হয় নি তখনও। অনেক মা শিশুকে কোলে নিয়ে তাড়াহুড়াে করে সমাপন করছে পূজার আয়ােজন। গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় শতাব্দীকাল আগে নির্মিত চণ্ডীমণ্ডপে স্থাপিত পিতলের মূর্তিকে ঘােয়া-মাজা করছেন তাঁরা। ফুলের তােড়া হাতে চণ্ডীমণ্ডপের দিকে এগিয়ে আসছেন যুবতী আর বালক-বালিকারা বৃদ্ধরা করছেন তদারকি।’এমনি সময় ঘটেছিল পাকবাহিনীর আক্রমণ। চন্ডীমণ্ডপ ভাঙচুর, মূর্তি লুট, বাড়িঘরে আগুন এবং যথেচ্ছ গােলাগুলি ও হত্যা, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়া মানুষজনকে তাক করে গুলি- এইসব পাশবিকতা শেষে বিদায় নিল পাকবাহিনী। তারপর সুটা নদী দিয়ে ভেসে গেছে অনেক লাশ, মুছে গেছে রক্তের ধারা, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল মাকালকান্দি গ্রাম একটি সফল অপারেশনের কৃতিত্ব নিয়ে বিদায় নিল।

পাকবাহিনী কিন্তু ইতিহাসে কি কোনাে চিহ্নই পড়ে থাকবে না মাকালকান্দি গণহত্যার? গণহত্যার অনেককাল পর, বাংলাদেশের ইতিহাসের রক্তাক্ত আরাে। কিছু পথ পেরিয়ে, মাকালকান্দি এসে হাজির হয়েছিলেন তাজুল মােহাম্মদ তিনি লিখেছেন : নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল ঐতিহ্যবাহী মাকালকান্দি গ্রামে। মৃত্যুর হিমশীতল। কোলে আশ্রয় নিলেন যে মানুষ, তাদের সংখ্যা নিরূপণ এবং লাশের সকার বা আহতদের চিকিৎসা করার মতাে কোনাে লােকই অবশিষ্ট থাকলেন না গ্রামে। তাই এখানে যারা নিহত হয়েছিলেন, তাদের সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারেন নি।

কেউ বললেন ৮২ জন, কেউ ৮৭, আবার কেউ বললেন ৭২ জন চণ্ডীমণ্ডপের সামনে যাদেরকে লাইন করে হত্যা করেছিল পাকবাহিনী, তাদের লাশ পড়ে থাকলে সেখানেই আর অনেকের লাশ সুটা নদী বেয়ে তলিয়ে গেল হাওরের অগাধ জলে ৪০ জনেরও বেশি। আহত নারী-পুরুষ-শিশুকে নিয়ে জীবিত গ্রামবাসীরা চলে গেলেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতে আহতদের অনেকেই দেহত্যাগ করলেন গুরুত   আহত হয়েও যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা হলেন- কংসমমাহন চৌধুরী, বিজিত ভূষণ চৌধুরী, নান্টু লাল দাশ, সঞ্চয় দাশ, স্বপ্না রানী দাশ প্রমুখ পাকবাহিনীর উদ্যত অস্ত্রের মুখ থেকে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেছিলেন প্রদীপ দাস ও পান্না রানী দাসসহ অনেকেই এখানে পাকবাহিনীর হাতে নিহত যেসব ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হলাে, তারা হলেন : মাকালকান্দি : অভিনয় দাস, সূর্য কুমার দাস, তরণী কান্ত দাস, মনােরঞ্জন দাস, গণেন্দ্র কুমার দাস, কহর কুমার দাস, কর্ণ সরকার, কৃপেন্দ্র সরকার, নকুল চন্দ্র দাস, অন্নদাচরণ দাস, প্রমােদরঞ্জন দাস, গিরিন্দ্র কুমার দাস, ধীরেন্দ্র কুমার। দাস, জহরলাল দাস, সুহৃদ দাস, দীনেশ চন্দ্র দাস (ধাইপুর), সুরেন্দ্র দাস। (মাকালকান্দি), আট বছরের মেয়ে সুভাষিণী দাস, গৃহবধূ সরলা রানী দাস, খুশি রানী দাস, সুভা রানী দাস ও তার কন্যা সন্তান, যুবতী অমরি রাণী দাস শৈবালিনী দাস,তমাল রানী দাস, প্রবাসিনী দাস, কণ্ঠরী রানী দাস, কুমুদিনী দাস, সরলা রানী দাস, হেমাঙ্গিনী দাস, প্রমীলা বালা দাস, ব্রহ্মময়ী দাস, সত্যবালা দাস,ঔজ্জ্বল্য বালা দাস, স্বপ্না রানী দাস ও তার দুই মেয়ে, অলি রানী দাস, ডলি রানী দাস, মানদা বালা দাস, ছানু রানী। দাস, ছানু রানীর এক দিনের কন্যা সন্তান, মান্না রানী দাস, সুশীলা রানী দাস, নিত্যবালা দাস, লক্ষ্মী রানী দাস, সুশীলা রানী দাস , খুশী রানী দাসের এক মাসের ছেলে সন্তান, কানু লাল দাস, নৃপেন্দ্র দাস, ঠাকুর চান্দ দাস, আশা রানী দাস, ক্ষেমঙ্গ বালা দাস, ক্ষীরেন্দ্র চন্দ্র দাস, ঈশ্বরিণী দাস, সােমেশ্বরী দাস, কুমুদ রঞ্জন দাস, জ্যোতিষ চন্দ্র দাস, গিরীশ সরকার, বিধান চন্দ্র দাস (মিরা), বিধানের স্ত্রী বিপদতারিণী দাস, শ্যামলী বালা দাস, শ্যামলীর বৃদ্ধা মাতা (ধল), হরেন্দ্র কুমার দাস, তরঙ্গময়ী দাস ও চিত্রময়ী তালুকদার (ধল)।” এই যে নামােল্লেখ, এ তাে নিছক নাম নয়, একেকটি নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। একেকটি জীবন, একেকটি গােটা পরিবার এই নাম হয়তাে এতােকাল ছিল। ব্যক্তিস্মৃতিতে, একটি একটি করে ফুল তুলে মালা গাঁথার মতাে করে শহীদদের নামের মালিকা গেঁথে তুললেন তাজুল মােহাম্মদ। পাকিস্তানি সমরনেতারা পড়েছে। নরমুন্ডমালিকা, আর বাংলাদেশের লােকসমাজকে শহীদের নামগাঁথা মালা পরিয়ে দিলেন তাজুল- এই হয়ে রইলাে ইতিহাসের রায়।

যুদ্ধাপরাধের হয়তাে বিচার হয় নি, পার পেয়ে গেছে নরঘাতকরা, কিন্তু হত্যাযজ্ঞের শিকার নামগুলাে তাে আর কোনােদিন মুছে যাবে না। আমরা দূর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি এই নামগুলাে সুটা নদী দিয়ে ভেসে হাওর-বাওর পেরিয়ে, বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর পাড়ি দিয়ে পৌছে যাবে মেজর দুররানির গ্রামে। সেখানকার নতুন প্রজন্মের নিস্পাপ বালক-বালিকারা জানবে তাদের মধ্য থেকে উথিত এক নরপশু দূর বাংলাদেশের মাকালকান্দি গ্রামে কি নৃশংসতার অবতারণা করেছিল- সাল ১৯৭১, দিনটি ছিল আগস্টের ১৭, সকালবেলায় চলছিল বিষহরি পূজার আয়ােজন। পৃথিবীর মানুষকে যদি মানবিক হয়ে উঠতে হয় তবে ইতিহাসের এই রায় সকলকে শুনতেই হবে, আজ হােক কিংবা কাল কয়েক শতক আগে ইংরেজ কবি জন ডান (১৫৭২-১৬৩১) লিখেছিলেন : “কোনাে মানুষ নয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, নিজেতেই নিজে পরিপূর্ণ; প্রত্যেক মানুষ হচ্ছে মহাদেশের অংশী, মূলভূমির এক খণ্ড। যে- কোনাে মানুষের মৃত্যু আমার জন্য একটি ক্ষয়, কেননা আমি তাে মানবতার অংশী; আর তাই কখনাে ভেব না ঘণ্টাধ্বনি কার জন্য বাজছে, ঐ ঘণ্টা বাজছে তােমারই জন্য।” প্রতিটি মৃত্যু আমার জন্য একটি লয়, ঘণ্টা বাজছে আমারই জন্য এই ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন বলেই তাজুল মােহাম্মদ উদভ্রান্তের মতাে ঘুরে বেরিয়েছেন। সিলেটের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, খুঁজে ফিরেছেন প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের হদিশ। এই কাজটি তাে কোনাে একক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তিনি মহৎ সূচনাটি করে পথ দেখিয়েছেন মাত্র, এই পথ বেয়ে আরাে দীর্ঘকাল চলতে হবে আমাদের, প্রয়ােজন এই প্রয়াসকে ব্যাপক সামাজিক উদ্যোগের রূপ দেয়ার।

এই জায়গাতেও বড় ফারাক রয়েছে সাইমন ভিজেনথালের সঙ্গে তাঁরই ঘরানার কনিষ্ঠ অনুসারী তাজুল মােহাম্মদের সাইমন ভিজেনথালের উদ্যোগের প্রতি সমর্থন এগিয়ে এসেছে নানা দিক থেকে ১৯৮৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ তাকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রদান করে ‘মিউজিয়াম অব টলারেন্স’ নির্মাণ করার জন্য সেই জাদুঘর এখন বিপুল দর্শক আকর্ষণ করছে ভিজেনথাল বলেছেন, এটা তাে আসলে মিউজিয়াম অব ইনটলারেন্স, মানুষের অসহিষ্ণুতার বিভিন্ন পরিচয় এখানে রয়েছে, মানবতার চরম অবনতি থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্যই এই জাদুঘর তাজুল মােহাম্মদের গ্রন্থ পাঠে মনে হয় সিলেটেও একটি জাদুঘর নির্মিত হওয়া উচিত, মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর কেননা যতাে মানুষের যতাে বেদনা ও বীরত্বের কথকতা মিশে আছে বাংলার জনপদে একটি জাদুঘরের পক্ষে তা ধারণ করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে লেনিনগ্রাদে অবরােধে প্রাণ বিসর্জন দেয়া লক্ষ মানুষের সমাধিস্থল পিসকারেৎস্কায়া সেমিটারির দেয়ালে লেখা রয়েছে, কাউকে আমরা। ভুলব না, কিছুই আমরা ভুলব না’। সেই একই অঙ্গীকার হােক বাংলাদেশের মানুষের সেই অঙ্গীকারের পরিচয় বহন করে তাজুল মােহাম্মদের গ্রন্থ, আর সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আমাদের দরকার স্মৃতির জাদুঘর- সিলেটে, চট্টগ্রামে, খুলনায়, রাজশাহীতে আমাদের দুর্ভাগা দেশ বর্তমান হতদ্দশায় চিরকাল আটকে থাকতে পারে না, সেখান থেকে উদ্ধারের জন্য সূচিত হতে হবে নতুন সামাজিক জাগরণের সেই লক্ষ্যে সমাজের শক্তি সংহত হয়ে অনেক কাজ করতে পারে সেই তাগিদ থেকে আমরা স্বপ্ন দেখব সিলেটবাসী ও বাংলাদেশের প্রবাসী নাগরিকদের সহায়তায় তাজুল মােহাম্মদ ও তাঁর মতাে মানুষদের পৌরহিত্যে যাত্রা করেছে সিলেটে মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও প্রতিরােধের জাদুঘর- কিছুই আমরা ভুলব না, কাউকে আমরা ভুলব না, কেননা নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার স্মৃতি-বিস্মৃত হলে মানবিকতা। ও সম্প্রীতির পথে আমরা পা বাড়াতে পারবাে না।

সূত্রঃ  জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!