You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.09.27 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সিয়ামের সাধনা | ভৈরবে বঙ্গবন্ধু | সিমেন্টের সংকট | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৭শে সেপ্টেম্বর, শনিবার, ১২ই আশ্বিন, ১৩৮০

সিয়ামের সাধনা

আজ থেকে পবিত্র মাহে রমজান শুরু হচ্ছে। বিশ্বের মুসলিম সমাজ আজ থেকে আগামী এক মাস তাদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুশাসন পালন করবেন -রোজা রাখবেন। পুরো একটি মাস সিয়ামের সাধনায়, আত্মসংযমের সাধনায় তথা কৃচ্ছতার সাধনায় আত্মনিয়োগ করবেন। রমজান মাস মুসলমানদের জন্য বড়ো পবিত্র মাস। ধর্মের বিধান অনুযায়ী এই একটি মাস দিবাভাগে উপবাসব্রত পালন ছাড়াও যেকোনো পাপকার্য এমনকি পাপ চিন্তাও ইসলাম ধর্মবিশ্বাসীদের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। অপরের অনিষ্ট সাধন অথবা মানব সমাজ ও মানবেতর সমাজের কারো আত্মার উপর দুঃখ-যাতনা সামান্যতম ছাপ পড়তে পারে এমন কোন কাজ থেকে বিরত থাকাই সিয়ামের নির্দেশ, লোভ, ক্রোধ ও মননশীলতার কৃচ্ছসাধনায় আত্মনিয়োগ করাটাই সিয়ামের সাধনায় অঙ্গীভূত।
বছরের বাকি এগারটি মাস মানব সমাজ যখন পরস্পর হানাহানি, স্বার্থসিদ্ধি আর লোভ, মোহ, কাম, ক্রোধের শিকারে পরিণত হয়ে আত্মানুসন্ধানের পথ থেকে কুরআনে বর্ণিত সিরাতুল মুস্তাকীমের পথ থেকে দূরে সরে যায়, রমজান মাস তখন তার সকল পুতপবিত্র তা নিয়ে আবির্ভূত হয় মানুষকে আর আত্মশুদ্ধির সময় দান ও দিক নির্দেশের বাণী নিয়ে। সেই বাণী চিরন্তন। সেই বানী শাশ্বত। সেই বানী শান্তির এবং সৌহার্দের, সৌভ্রাতৃত্বের। সে অমীয় বাণীকে স্মরণ করে নতুন পথ চলা শুরু হয় বিশ্ব মুসলিম মানবতার। ‘বস্তুতঃ রমজানের স্মৃতি- পূর্ণ- পবিত্র-পরশে হাসিছে জগত অমিও হাসি।’
বিশ্ব মুসলিম জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান অংশ বাংলাদেশের মুসলমান সমাজও আজ থেকে আগামী একটি মাস সিয়ামের সাধনায় আত্মনিয়োগ করবেন। সেই প্রস্তুতি আজ প্রতিটি বাঙালি মুসলমানের মনেপ্রাণে, ঘরে ঘরে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কিছু কিছু প্রশ্ন এসে যে এই মুহূর্তে মানুষের মনকে বিচলিত তথা বিপর্যস্ত করছে না তা নয়। সারাদিন ধর্মীয় নির্দেশ মোতাবেক উপবাসব্রত পালনের পর দিনান্তে একটু স্বস্তি নিয়ে ইফতার করতে পারা বা দু’মুঠো ভাত খেতে পারাটাই আজ তাদের বড় প্রশ্ন। এ প্রশ্নটি সবসময়ই ছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর তার পরিধি আরও বেড়েছে। বেড়েছে খাদ্য সহ সকল প্রকারের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশচুম্বী দামের প্রেক্ষিতে। বেড়েছে রেশন দোকানে নিয়মিতভাবে অনিয়মিত সরবরাহের ফলে। তাছাড়া প্রতিবছর এই রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য একধাপ করে বাড়ছে। বাজারে এবারও সে লক্ষণটা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। এমতাবস্থায় পবিত্র রমজান মাসে রেশন দোকানে সরবরাহ নিয়মিতকরণ এবং মাথাপিছু বরাদ্দের হার বর্ধিতকরণ অপরিহার্য তো বটেই, তার সাথে সাথে ব্যবসায়ী মহলকেও আমরা আহবান জানাবো দ্রব্যমূল্য আর না বাড়িয়ে বরং আরো কমিয়ে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনুন, যাতে করে অন্তত এই একটি মাস দেশের মানুষ একটু স্বস্তিতে ইফতার করতে পারেন। রাতের খাবার আর সেহরির জোগাড়ের জন্য রোজা মুখে সারাদিন উদভ্রান্তের মতো কাল কাটাতে বাধ্য না হন।

ভৈরবে বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল ভৈরব সেতুর উদ্বোধন করেছেন। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পলায়নরত পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ভৈরব সেতু ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল। মাত্র চৌদ্দমাসের কঠোর পরিশ্রমের ফলে ভৈরব সেতু নির্মাণের কাজ সম্ভব হয়েছে। বন্ধু ভারতের কারিগর ও বাংলাদেশের কারিগরের যৌথ প্রচেষ্টায় এর কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে। উল্লেখযোগ্য, যুদ্ধকালীন সময় বিধ্বস্ত সকল পুল ও সেতুর পুনঃনির্মাণের কাজ শেষ হলে ভৈরব সেতুর পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে। গত পরশুদিন ভৈরব সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভৈরবের ও আশুগঞ্জের দুটি বিরাট জনসভায় ভাষণ দান করেছেন। সেতুটির উদ্বোধন উপলক্ষে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন -“দেশের জন্য কোন ভালো কাজ করতে পারলে আমিও আমার কর্মীরা খুশি হই।” তার মতে “ভৈরব সেতু দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে।” ভৈরবের লক্ষ লক্ষ জনতার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু সেদিন যে ভাষণ দিয়েছেন তা জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বলতে গিয়ে তিনি বন্ধু দেশগুলোর প্রতি তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা দানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। বিশেষ করে দেশের ধ্বংসপ্রাপ্ত স্মৃতিগুলো পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারতের সরকার ও কারিগর উদারতা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু বারবার তাদের কথা স্মরণ করেছেন।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু কতগুলো মূল্যবান বক্তব্য জাতির সামনে উপস্থিত করেছেন। দেশকে গড়তে হলে অবশ্যই সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ক্ষেতে-খামারে, কল-কারখানায় উৎপাদন বাড়াতে হবে। জাতির দুর্দিনের কথা স্মরণ করে সবাইকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। নতুন জাতি- গঠনের সংগ্রামে দেশের প্রতিটি মানুষের নিঃস্বার্থ অংশগ্রহণ অপরিহার্য তুমি অপরিহার্য প্রগতিশীল শক্তিসমূহের নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসা। তিনি দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরের স্বাধীনতা নস্যাৎকারি শক্তিসমূহের উদ্দেশ্যে কঠোর হুঁশিয়ার বানী উচ্চারণ করেছেন। তার মতে – “স্বাধীনতার শত্রু, সমাজবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহের অনেককে আমরা ক্ষমা করেছিলাম, আজ দেখছি সেই ক্ষমাকে তারা দুর্বলতা ভেবে নিয়েছে। তাই আমি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আঘাত হানতে চাই আর আপনাদের সহযোগিতা চাই। বঙ্গবন্ধুর এই উদাত্ত আহবানে লক্ষ লক্ষ জনতা হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছে। দেশের আভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ছাড়াও রয়েছে মুনাফাখোর, মজুমদার, রাজাকার-আলবদর প্রভৃতি স্বাধীনতার শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আঘাত হানার সময় এটাই। আর দেরি করা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয় বলে আমরা মনে করি। বঙ্গবন্ধু অনতিবিলম্বে তার এই বক্তব্যের বাস্তবতার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে আমরা বিশ্বাসী। বাংলার আপামর মানুষের মুক্তিদূত বঙ্গবন্ধুর কন্ঠ থেকে সেদিন ভৈরবে যে বাণী উচ্চারিত হয়েছে আমরা জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে তার বাস্তবতা কামনা করি। বাঁচার সেই সংগ্রামে আমরাও হতে চাই সর্বাত্মক সহযোগী।

সিমেন্টের সংকট

শেষ পর্যন্ত সিমেন্টও সের দরে বিক্রি শুরু হলো। গতকালকের স্থানীয় একটি দৈনিকের খবর অনুসারে সিমেন্ট পাঁচ টাকা সের দরে বিক্রি হচ্ছে। এর আগে খবর বেরিয়েছিল সিমেন্টের বস্তা একশ’ টাকা। কিন্তু তাই বলে সে সিমেন্ট খাটি নয়, ভেজাল মিশ্রিত। ক্রেতারা জেনেশুনেই ভেজাল সিমেন্ট এমন চড়া দামে কিনছেন, কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশেষ একটি নির্ভরযোগ্য মহলের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে আরও জানা যায়, আগামী মাসে প্রচুর সিমেন্ট পাওয়া যাবে। সিমেন্ট বোঝাই একটি জাহাজে এ সপ্তাহের মধ্যেই চট্টগ্রামে এসে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইউএস এইড-এর অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দফায় দেয় লাখ টন সিমেন্ট দেবার চুক্তি সম্পাদন করেছে এবং বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ অনুরোধে তারা আরো এক লাখ টন সিমেন্ট দেবার কথা স্বীকার করেছে বলেও উক্ত নির্ভরযোগ্য মহল জানিয়েছেন। দীর্ঘদিন থেকে সিমেন্টের সংকট বিরাজ করছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নতুন করে নির্মাণ কাজ দূরে থাক ক্ষতিগ্রস্থ কাজের পুনঃনির্মাণের ব্যবস্থা করাই সম্ভব হয়নি। ফলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে সিমেন্টের অভাবে সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে। গত একুশ মাসে যেখানে দেশের সিমেন্টের প্রয়োজন ছিল তের লক্ষ টন, সে স্থলে মাত্র সাড়ে চার লক্ষ টন সিমেন্টের যোগান দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
দেশে মাত্র একটি সিমেন্ট কারখানা। সেটিও প্রায়শঃই বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও অন্যান্য কারণে বন্ধ থাকছে। ফলে সে মিলেও উৎপাদন হচ্ছে না। অপরদিকে আন্তর্জাতিক বাজারেও সিমেন্টের স্বল্পতা দেখা দেওয়ায় সেখানেও সিমেন্ট এর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং এই জন্য ইতিপূর্বে সম্পাদনকৃত কোন কোন চুক্তি অনুসারে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো পূর্বতন মূল্যে সিমেন্ট সরবরাহ করতে অনীহা প্রকাশ করছে। প্রসঙ্গতঃ বলা দরকার যে ইতিপূর্বে বেশ ক’বার সিমেন্ট কেলেঙ্কারির খবর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। অথচ সেসব কেলেঙ্কারীর ব্যাপারে কি কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে আমরা জানি না।
সিমেন্ট নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি সকল স্তরের লোকের প্রয়োজন পড়ে না। সুতরাং সিমেন্ট কেলেঙ্কারির সঙ্গে এক শ্রেণীর অসাধুও বিত্তবান ব্যবসায়ী জড়িত সে বিষয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। আরো উল্লেখ্য যে, সিমেন্ট কেলেঙ্কারি দমন করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খোলাবাজারে সিমেন্ট বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। এক্ষণে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে সরকার যেখানে ডিলারদের মাধ্যমে ২১ টাকা ৩৫পয়সা দরে সিমেন্ট বিক্রির নির্দেশ জারী করেছেন সে প্রতি বস্তা একশ’ টাকা বা প্রতি পাঁচ টাকা মূল্যে কি করে বিক্রি হচ্ছে তা আমরা ভেবে পাচ্ছিনা।
অতএব বিষয়টির প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সিমেন্ট সংকট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক বলে আমরা মনে করি। সেই সঙ্গে আরও বলি, আগামীতে যেসব সিমেন্ট বিদেশ থেকে আসার সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলোর সুষ্ঠু বন্টন ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করতে হবে। নইলে পুনঃনির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে থাকার ফলে নতুন নতুন সমস্যা দেখা দেবারও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন