স্পেনের গৃহযুদ্ধ মাতিয়ে তুলেছিল তৎকালীন বিশ্বের কবি সাহিত্যিকদের এবং একটি স্মরণীয় কবিতা লিখেছিলেন তরুণ “ইংরেজ কবি ডব্লিউ. এইচ. অডেন। প্রাজ্ঞ অডেন পরে এই কবিতাকে অস্বীকার করতে চাইলেও সাহিত্যের ইতিহাসে এর আসন স্থায়ী হয়ে রয়েছে। অডেন বলেছিলেন কীভাবে স্পেনে ফ্যাসিবাদের নখদন্ত বিস্তারের প্রয়াসকে রুখবার জন্য স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রচেষ্টা আমূল পাল্টে দিয়েছিল তৎকালীন নাগরিক জীবনধারা জীবনের যেসব ছােট ছােট বাস্তবতা, আনন্দগান, হাসিকান্না গতকালও ছিল অর্থময় হঠাৎ রাতারাতি যেন তা পাল্টে গেল। অসাধারণ কাব্য-ভাষায় অডেন লিখেছিলেন :
“গতকাল বসানাে হলাে ডায়নামাে ও টারবাইন/ উপনিবেশ মরুর বুকে পাতা হলাে রেললাইন গতকাল মানবের উৎপত্তি বিষয়ে সারগর্ভ ভাষণ/ কিন্তু আজ লড়াই গতকাল গ্রিক সভ্যতায় অপার আস্থা/ নায়কের মৃত্যুদৃশ্যে যবনিকা-পতন/গতকাল অস্তগামী সূর্যের স্তব/ এবং উন্মাদ-বন্দনা/ কিন্তু আজ লড়াই।” আমাদের জীবনে গতকাল থেকে আজকের আমূল পাল্টে যাওয়ার সার্থক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকাল ব্যক্তিজীবনে এই পরিবর্তনটি একেকজনের ক্ষেত্রে ঘটেছে একেকভাবে। আর এই পাল্টে যাওয়ার এক মহীয়ান রূপ আমরা দেখি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মধ্যে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ সােমবার দুপুরে রেডিও পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ভাষণ প্রচারের আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত যেজীবনে অভ্যস্ত ও সমর্পিত ছিলেন জাহানারা ইমাম, অডেনের কবিতার মতােই, তারপর থেকে গতকাল আর আজ সহস্ৰযােজন ফারাক হয়ে গেল তাঁর জীবনে গতকাল ছিল সুখী সুন্দর আনন্দোচ্ছল পরিবারের অনুপম দৃষ্টান্ত গতকাল ছিল নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর সফল জীবন। অনধিক ১০ লাখ মানুষ অধ্যুষিত ঢাকা তখনও কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে ওঠেনি। হাইরাইজের ধারণা বহন করছিল কেবল ডিআইটির ঘড়ি ও শীর্ষদেশ, অনেকটা জোর করেই যেন তার বাড়বাড়ন্ত, উঁচু হওয়ার ব্যর্থতা ঢাকতে গলা বাড়িয়ে দেয়ার মতাে। এলিফ্যান্ট রােডে তখনও এঁদো পুকুর কিংবা ডােবা দুর্নিরীক্ষ্য ছিল না এবং ঘন বর্ষায় মত্ত দাদুরিও অক্ষত থাকতাে না। ১৯৬৮ সালের এক সরকারি হিসেবে দেখা যায়, গােটা পূর্ব পাকিস্তানে তখন গাড়ির সংখ্যা ছিল ৬০,৩৫২।
আর তখনই বাড়ি-গাড়ি-স্বামী-পুত্র নিয়ে সুখী সুন্দর পরিতৃপ্ত সংসার গড়ে তুলেছিলেন জাহানারা ইমাম। অনুন্নয়নের অভিশাপ-পীড়িত শশাষণ-জর্জরিত পূর্ববঙ্গের গ্লানি তার পরিবারকে বিশেষ স্পর্শ করতে পারে নি। বরং বাঙালি সমাজে ক্ষুদ্র একটি বিত্তবান গােষ্ঠীর যে অঙ্কুরােদ্গম লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, ইমাম পরিবার ছিল তারই অংশ।
এলিফ্যান্ট রােডের কোনে তাদের ছােট্ট সুন্দর দ্বিতল গৃহ কণিকা’। গুলশানে নতুন বাড়ি নির্মাণের কাজও শেষ দুই পুত্র রুমি ও জামি বেড়ে উঠছে তরতরিয়ে। এক সময়ে স্কুলে শিক্ষকতার কাজ করলেও এখন অব্যাহতি নিয়ে গৃহিণী হয়েছেন জাহানারা ইমাম সাহিত্যপ্রীতি অবশ্য তার আগের মতােই তীব্র, ছােটদের জন্য গল্প লিখছেন, অনুবাদের কাজও করছেন কিছু স্বামী শরীফ ইমাম বন্ধুজনদের সঙ্গে মিলে গড়ে তুলেছেন বাঙালি প্রকৌশলী সমবায়ে দক্ষ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘দি ইনজিনিয়ার্স’ রাস্তা ও সেতু নির্মাণের বড় ধরনের কাজও তারা পাচ্ছেন। ক্ষুদ্র ও অগ্রণী বাঙালি পেশাদারী গােষ্ঠীর তিনি এক উজ্জ্বল সদস্য নবনির্মিত ঢাকা-আরিচা সড়কে বেশ কতক সেতু পাতার কাজ তখন চলছে, অনেক নতুন রাস্তাও নির্মিত হচ্ছে। ফলে নির্মাতাদের জন্য সুদিন চলে আসছে হাতের মুঠোয়। আইয়ুবী শাসনের শেষদিকে দুই প্রদেশের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য নিয়ে সােচ্চার পূর্ববঙ্গবাসীদের শান্ত করতে কিছু কিছু সুযােগ-সুবিধা দিচ্ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এই সুবাদে আবার এক বশংবদ উচ্ছিষ্টভােগী অংশও দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, বাঙালির অধিকারটুকু যারা ব্যক্তিগত শ্রীবৃদ্ধির স্বার্থে বেচাকেনা করছিল।
নিয়ম হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে কতকখাতে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পারমিট দেয়া হবে কেবল বাঙালিদের, এই সূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতিদের এজেন্ট বা দালাল হয়ে উঠলাে কোনাে কোনাে বাঙালি তাদের নিজেদের নামে পারমিট বের করা হবে, কাগজেকলমে এই শিল্পের মালিক হবে তারা, তবে অন্তরালের লেনদেনে প্রকৃত মালিক থাকবেন পশ্চিম পাকিস্তানি বড় ভাইজানেরা এক প্রখ্যাত চিত্র সমালােচক ও বাম বুদ্ধিজীবী তৎকালীন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে সুইট ভাড়া করে থাকতে আরম্ভ করলেন, যার গােপন রহস্য ছিল এমনি এক আধুনিক চামড়া শিল্প স্থাপনের জন্য আপন বাঙালি নামে অবাঙালির হয়ে সরকারি পারমিট বাগানাে তবে শরীফ ইমাম ছিলেন প্রকৃত উদ্যোক্তা শ্রেণীর মানুষ। নিজ দক্ষতা ও যােগ্যতা বলেই তিনি ছিনিয়ে আনছিলেন সাফল্য আর
জাহানারা ইমাম ছিলেন ঢাকার বিত্তবান বাঙালি সমাজের এক ঈর্ষণীয় সদস্যা। সুশ্রী লাবণ্যময়ী এই নারী নিজে গাড়ি ড্রাইভ করেন, মিশতে পারেন সবার সঙ্গে সহজে, ঢাকার সংস্কৃতিমহলে সুপরিচিত এবং বিদগ্ধ ব্যতিক্রমী নাট্যপ্রয়াসে অভিনয়ও করেছেন মাঝে-মধ্যে। ইতােমধ্যে স্বামীর সঙ্গে ঘুরে এসেছেন আমেরিকা বড় ছেলে রুমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করে স্টেটস-এ যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছে।
১ মার্চ সােমবার সকালের কথা দিয়ে শুরু হয়েছে জাহানারা ইমামের স্মৃতিচারণ গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি। রুমি সবান্ধব গেছে ঢাকা, স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা দেখতে খেলা শেষে বন্ধুদের নিয়ে ঘরে ফিরবে সে খেলার গল্পে মেতে-ওঠা বন্ধুরা হৈচৈ করে মাতিয়ে তুলবে বাসা। স্নেহপ্রবণ মা তাই বের হয়ে গুলিস্তানের কাছাকাছি পূর্ণিমা স্ন্যাকবার থেকে কিনে আনলেন দু’ডজন ডিনার-রােল এই সহজ বয়ানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হালফিল ঢাকার জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত মানুষদের বােঝানাে শক্ত হবে হ্যামবার্গার বস্তুটি কি সেটা তখন ঢাকাবাসীর প্রায় অজানা কোনাে ফাস্ট ফুডের দোকান ছিল না এই মহানগরীতে, যদি একে তখন মহানগর বলা যেত ডিনার-রােল পাওয়ার জায়গাও ছিল মাত্র দু-তিনটি আর সেই রােল দিয়ে কীভাবে হ্যামবার্গার বানানাে যায় সেটা খুব কম গৃহিণীরই ছিল জানা দেশের লাখ মানুষের থেকে অনেক আলাদাই ছিল জাহানারা ইমামের জীবন কিন্তু ১ মার্চ ১৯৭১ দিন না পােহাতেই লক্ষ মানুষের সঙ্গে মিলে গেল জাহানারা ইমামের জীবন। তার এতােদিনের স্বপ্নঘেরা সাজানাে জীবন হয়ে উঠলাে গতকাল এবং আজ শুরু হলাে লড়াইয়ের আরেক জীবন কীভাবে জাহানারা ইমাম জড়িয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে, মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে, কীভাবে যােদ্ধা রুমি শহীদ হলাে, প্রাণ হারালাে স্বামী শরীফ, যুদ্ধের নয় মাসের সেই বিভীষিকাময় দিনলিপি নতুন করে বর্ণনার অবকাশ রাখে না। তাঁর ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা ও পারিবারিক অভিজ্ঞতা অনেক আগেই জাতির গৌরবগাথার অংশী হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ভেতর দিয়ে জন্ম নিয়েছিল নতুন বাংলাদেশ এবং নতুন এক জাহানারা ইমাম পারিবারিক জীবনের করুণ ট্র্যাজেডিতে বিধ্বস্ত মানুষটি যুদ্ধঅভিজ্ঞতার অগ্নিপরীক্ষায় পােড় খেয়ে এখন অনেক স্থিতধী ও লৌহকঠিনও বটে কথাটি লেখা যতাে সহজ বাস্তব জীবনে সেটা তেমন সরল অর্জন ছিল না। এজন্য জাহানারা ইমামকেও সময় নিতে হয়েছিল অনেক। ১৯৯০ সালের দিকে প্রকাশিত এক কিশাের উপন্যাসের নাম রেখেছিলেন তিনি বুকের ভেতর আগুন। তার বুকের ভেতরে জ্বলছিল যে আগুন বাইরের কারাে পক্ষে সেটা অনুভব করা গেলেও দেখা সম্ভব ছিল।
১৯৮২ সালে ধরা পড়লাে মুখের ভেতর কর্কট রােগের দানা অপারেশন শেষে যখন দেশে ফিরলেন তখন অল্প অল্প করে আবার মনােনিবেশ করলেন লেখালেখিতে ভরাট সংসার ততােদিনে শূন্য ঘরে পরিণত হয়েছে। নিঃসঙ্গতার পীড়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৃত্যুচিন্তা এবং এই আপাত স্বাভাবিক জীবনের গভীরে অন্তঃসলিলা এক প্রবাহ লালন করে চলছিলেন তিনি আগুনে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে উঠলেন যখন তিনি তখনই লিখলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক শ্রেষ্ঠ দিনলিপি ‘একাত্তরের দিনগুলি রক্তাক্ত পীড়িত চিত্তের কথা বললেন আশ্চর্য প্রশান্ত ভঙ্গিতে এবং এই প্রশান্ত রূপ অমােঘ করে তুললাে মুক্তিযুদ্ধের বাণীরূপ এই একটি বইয়ের সুবাদে চিরনমস্য ও স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন জাহানারা ইমাম কিন্তু ততােদিনে তার ভিন্ন এক ব্যক্তিগত লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিল নিজেরই বিরুদ্ধে নিজের লড়াই সহজিয়া ভাষায় আটপৌরে ভঙ্গিতে তিনি একে বলেছেন, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস একই নামের গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন, কোথায় যেন পড়েছিলাম, মনের ক্ষমতা অসীম কেবল আমরা সেটা জানি না।
আমাদের সচেতন মনের সীমাবদ্ধতার পেছনে একটা দরজা আছে সেটা বন্ধ অধিকাংশ মানুষই সারা জীবনে ঐ বন্ধ দরজা খুলতে পারে না। তারও বেশিসংখ্যক মানুষ জানেই না যে, দরজা একটা আছে।” সকলে পারেন না, তবে কেউ কেউ পারেন মনের সেই বদ্ধ কুঠুরির কপাট খুলতে। আর অশেষ যন্ত্রণায়, শারীরিক মানসিক দুই-ই, দগ্ধ হতে হতে সেই অলৌকিক দরজা খুলতে সক্ষম হয়েছিলেন জাহানারা ইমাম। তাই প্রচলিত মাপে তাকে আমরা বুঝতে সক্ষম হবাে না এবং প্রচলিত মাপে তিনি আবদ্ধও রইলেন না। এমনি পটভূমিকায় সমাজ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ক্রম-অপসৃয়মান দুঃসময়ে আশ্চর্য সাহসের মন্ত্র শশানালেন তিনি সমাজকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ও সামাজিকভাবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ঘাতকেরা যখন সমাজের বুকে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সব আয়ােজন প্রায় সম্পন্ন করে এনেছিল তখন তিনি ডাক দিলেন নৈতিকতার শক্তিতে জাগরণের। তাঁর নেতৃত্বে এবং তার একক জেদী অনমনীয় মনােভাবের জোরে এই আন্দোলন ১৯৯২ সালের গণ-আদালত সংঘটনে অভূতপূর্ব সামাজিক জাগরণের রূপ লাভ করেছিল।
যুদ্ধাপরাধী গােলাম আজম গংদের প্রকৃত শাস্তিবিধান হয়তাে করা যায় নি; কিন্তু নরঘাতকদের প্রতি নৈতিক রায় সুপ্রতিষ্ঠ করা সম্ভব হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর সাধারণ নাগরিকজনের জন্য সবচেয়ে বড় বিজয় এভাবে জাহানারা ইমামের মাধ্যমেই অর্জিত হলাে জাহানারা ইমামের শেষ লড়াই ছিল অমানবিকতার বিরুদ্ধে মানবতা ও নৈতিকতার উত্থান এই জাগরণের কাজ তিনি সম্পন্ন করে গেছেন, মুক্তিযুদ্ধের মহৎ বাণী পৌঁছে দিয়েছেন অগণিত তরুণ-কিশাের-নবীনের কাছে সত্যিকার অর্থেই তিনি অসংখ্য বুকের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে গেছেন এই আগুন কাকে কোন উত্তরণে পৌছে দেবে সেটা আজই বলা সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী প্রােজ্জ্বল তারকা হিসেবে জাহানারা ইমাম জেগে রইবেন চিরকাল ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে এক মানববন্ধনের কর্মসূচি পালন করেছিলেন তিনি রমনা উদ্যানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, হাতে হাত ধরে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছিল আরাে অসংখ্য কিশাের-কিশােরী তিনি আজ নেই, কিন্তু সেই মানববন্ধনের স্পর্শটুকু রয়ে গেছে অযুত হাতে। আর সেখানেই আমাদের ভরসা।