যুদ্ধাপরাধের বিচার : কাম্বােডিয়ার অভিযাত্রা
এশীয় দেশগুলাে কিংবা বলা যায়, উন্নয়নশীল বিশ্বের সব অঞ্চলই, পশ্চিম দুনিয়ার খবর অনেক পায়, তবে পরস্পরের সংবাদ বিশেষ জানতে পারে । এর একটি বড় উদাহরণ আমাদের ঘরের কাছের দেশ কাম্বােডিয়ায় সম্প্রতি সূচিত এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যা বিশেষ গুরুত্ববহ সংবাদ তাে বটেই, তদুপরি দুনিয়ার অন্যসব দেশের চেয়ে এটা আরাে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য কিন্তু সেইসব খবর আমাদের সংবাদপত্রে প্রতিফলিত হওয়ার সুযােগ বিশেষ থাকছে না, যারা সংবাদের যােগানদাতা তারা করে নিচ্ছে নিজস্ব ঝাড়াই-বাছাই বিশ শতকের সত্তরের দশকে দুটি ব্যাপক আকারের গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই দেশ বাংলাদেশ ও কাম্পুচিয়া বা কাম্বােডিয়ায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যায় নিহত হয়েছিল ত্রিশ লক্ষ মানুষ আর ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত কাম্বােডিয়ায় পরিচালিত বর্বর খেমার রুজ শাসনাধীনে সেদেশের এক-চতুর্থাংশ তথা সতেরাে লক্ষ মানুষ জীবন বিসর্জন দিয়েছিল। এই দুই গণহত্যারই এযাবৎ কোনাে বিচার হয়নি, তার একটি বড় কারণ ছিল গণহত্যাকারীদের পেছনে বিশ্বের দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও চীনের যােগসাজশ। তারা উভয়ে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিবেচনা থেকে, দাঁড়িয়েছিল ঘাতকদের সমর্থনে, আমেরিকা ছিল পাকিস্তানি সামরিক গােষ্ঠীর প্রধান মদদদাতা। আর অন্ধ ভারত-বিরােধিতা থেকে চীনও বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত সগ্রামের বিরুদ্ধাচারণ করে পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল কাম্বােডিয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ছিল একই ধরনের, হেরফের কেবল ছিল মুখ্য ও পরােক্ষ ভূমিকার সেখানে চীন। ছিল খেমার রুজ সরকারের প্রধান মদদদাতা আর ভিয়েতনাম তথা কমিউনিজম বিরােধিতার অন্ধত্ব থেকে আমেরিকা দাড়িয়েছিল খেমার রুজ বা পলপট শাসনের পেছনে গণহত্যাকারী খেমার রুজ কিংবা পাকিস্তানি বাহিনী কারােরই পরাজয়ে বিলম্ব ঘটেনি; কিন্তু বিজয় সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বন্দ্বের শিকার হওয়া থেকে দেশ দুটি রক্ষা পায়নি।
বাংলাদেশকে তাে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেতে বিপুল কাঠখড় পােড়াতে হয়েছে। একাত্তরের মােল ডিসেম্বরের এই বিজয়কে আমেরিকা শেষাবধি না মেনে পারেনি; কিন্তু সুলতান ও রাজন্যশাসিত আরব দেশগুলাে অনেক বিলম্বে দিয়েছিল স্বীকৃতি সউদি আরব ও চীনের স্বীকৃতি এলাে আরাে দেরিতে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরপর ভিয়েতনাম বাহিনীর সঙ্গে মিলে কাম্বােডিয়ার প্রতিরােধ আন্দোলন যখন খেমার রুজ বাহিনীর পরাজয় ঘটাল এবং পলপট, ইয়েং সারি, খিউ সাম্পান অবশিষ্ট দলবল নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন থাইল্যান্ডের জঙ্গলে তখন আমেরিকা জাতিসংঘে পলপটের প্রতিনিধিত্বের জোরদার সমর্থক হয়ে উঠলাে মুক্তিসংগ্রামে। বিজয় পরবর্তী বাংলাদেশ সরকার কিংবা বিজয়ী কাঘােডীয় সরকার কারাে যাত্রাপথই স্বাভাবিক ছিল না, ফলে মানবতাবাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের বিচারের জন্য যে আর্ন্তজাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন প্রয়ােজন সে-কাজে উভয় দেশই। বিশেষ অগ্রসর হতে পারেনি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চাপ আরাে বাড়তি সমস্যা তৈরি করেছিল, নব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আসল অর্থেই লড়াই করছিল একটি ভিন্ দেশে, তাদের নিজভূমি থেকে হাজার মাইল দূরে। ফলে যুদ্ধে পরাজিত পাকবাহিনী পশ্চাদপসরণ করতে পারেনি, দৌড়ে নিজের ডেরায় পালাতে পারেনি, পালাবার মতাে পশ্চাদভূমি তাদের ছিল না। জেনারেল থেকে সৈনিক, মায় বাবুর্চি মশালচি সবাইকে নিয়ে তাদের আত্মসমর্পণ করতে হয় এর মধ্যে ছিল সেইসব ঘাতকেরা, সংখ্যায় যারা প্রায় দুইশত, যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের বিচার করার মতাে অভিযােগ তৈরি করা হয়েছিল; কিন্তু এমনি বিচারের জন্য যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল প্রয়ােজন তা গঠনের কোনাে বাস্তব পরিস্থিতি তখন ছিল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গঠিত নাৎসী ও জাপানি যুদ্ধাপরাধী বিচারের ট্রাইব্যুনাল ছিল দূর অতীতের নজির। এরপর থেকে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার নেতৃত্বাধীন দুই পরাশক্তির যে দ্বন্দ্ব সেই নিরিখে বিচার করা হতাে সবকিছু। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশ ও কাম্বােডিয়ায় যারা নিহত হয়েছিলেন তারা ছিলেন সােভিয়েত বলয়ের ছাপমারা, তাই মানুষ হিসেবে বিবেচিত হলেন না।
অন্যপক্ষের কাছে সেই পটভূমিকার বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিচারের কোনাে প্রয়ােজন আছে এমনটা কারাে উপলব্ধিতে বিশেষ ছিল না। তদুপরি ছিল। পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ পাকিস্তান যুদ্ধের নিয়মনীতির কোনাে তােয়াক্কা না করে পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি সেনাসদস্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পাইকারিভাবে আটক করে ক্যাম্পে বন্দি করে। কোনাে ধরনের আন্তর্জাতিক আইনে এই আটককে যুক্তিসঙ্গত দেখানাে যায় না; কিন্তু এই নিয়ে পশ্চিমী মহল ও মুসলিম দুনিয়ায় কোনাে মাথাব্যথা ছিল না, তাদের যতাে দুশ্চিন্তা ছিল জেনেভা সনদ অনুযায়ী যুদ্ধবন্দিদের পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা। করা এবং ব্যাপক চাপ প্রয়ােগ করে তারা যুদ্ধাপরাধীসহ সব পাকযুদ্ধবন্দিদের দেশে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কাম্বােডিয়ার ক্ষেত্রে ছিল আরেক ধরনের জটিল পরিস্থিতি। খেমার রুজ বাহিনী পরাভূত হলেও, জঘন্য গণহত্যাকারীরা নিরাপদ আশ্রয় পায় থাইল্যান্ডে। যেহেতু কাম্বােডীয় প্রতিরােধসংগ্রামীরা ভিয়েতনাম বাহিনীর সহায়তায় স্বদেশকে মুক্ত করেছিল এবং ভিয়েতনামী বাহিনী কাম্বােডিয়ার ভূমিতে অবস্থান করছিল তাই আমেরিকা ও চীন দখলিকৃত দেশ হিসেবে গণ্য করে কাম্বােডিয়ার বৈধ সরকারকে প্রতি স্বীকৃতি না দিয়ে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম নরহত্যাকারীদের জাতিসংঘে সেদেশের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করে। থাইল্যান্ডের জঙ্গল ও জাতিসংঘের আসন এই দুই জায়গা ছাড়া পলপট সরকারের আর কোনাে অস্তিত্ব ছিল না। সরকার হিসেবে স্বীকৃতি না পেয়ে মুক্তি সংগ্রামীরা জাতিসংঘের সবরকম সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়। উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তন, স্বাস্থ্য সহায়তা, শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণেও জাতিসংঘ এগিয়ে আসে না এমনি পরিস্থিতিতে কাম্বােডিয়ায় গণহত্যা সংঘটনের বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের কোনাে প্রশ্ন তােলার অবকাশ ছিল না ইতােমধ্যে বিশ্বসভ্যতা মুখােমুখি হয়েছিল কতক নিদারুণ অভিজ্ঞতার, রুয়ান্ডাতে হুটু ও টুটসিদের মধ্যকার সংঘাত পর্যবসিত হয় নিষ্ঠুর গণহত্যায় সমাজতন্ত্রের পতনের জের ধরে বলকান অঞ্চলের সার্ব সৈন্যবাহিনী কসেভাে ও বসনিয়ায় বর্বর গণহত্যা পরিচালনা করে।
খােদ ইউরােপের বুকে জাতিগত বৈরিতা থেকে সৃষ্ট গণহত্যা হতচকিত করে দেয় বিশ্ববিবেককে। এই পটভূমিকায় একে একে প্রতিষ্ঠিত হয় রুয়ান্ডায় যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল এবং পূর্বতন যুগােশ্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য আরেকটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের চল্লিশ বছরেরও পর আবারও গঠিত হলাে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনাল এরপর ১৯৯৮ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি। এর পাশাপাশি কাঘােডিয়ার রাজনীতিতেও বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ও ঐক্যগঠনের চেষ্টা চলতে থাকে, যার পরিণতিতে ১৯৯২ সালে স্বাক্ষরিত হয় প্যারিস শান্তি চুক্তি এবং ভিয়েতনামী বাহিনী সেদেশ ত্যাগ করে, রাজতন্ত্রী দল ও মুক্তিসগ্রামী দল মিলে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যের সরকার। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর কিছুটা রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলেও জাতীয় ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। সেই প্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালের ২১ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স নরােদম রানারিধ এবং দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হান সেনের যৌথ স্বাক্ষরে কাম্বােডিয় সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য জাতিসংঘের সহায়তা ও সমর্থন কামনা করে। ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব এক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দেন। এরপর কাম্বােডিয়ার রাজকীয় সরকার এবং জাতিসংঘের মধ্যে বেশ কয়েক দফা আলােচনা চলে কাম্বােডীয়ার পক্ষে আলােচনায় নেতৃত্ব দেন তাদের এক প্রবীণ মন্ত্রী সােক আন এবং জাতিসংঘের পক্ষে প্রধান আইনসংক্রান্ত উপদেষ্টা ও আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল হানস কোরেল। এখন দীর্ঘ আলােচনা শেষে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল এবং প্রায় তিরিশ বছর পরে হলেও কাম্বােডীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হতে চলেছে।
২০ মে ২০০৬ যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুসংবাদটি দেশবাসীকে শুনিয়েছেন রাজা নরােদম সিহানুমি। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষণা করেছেন নবগঠিত ট্রাইব্যুনালের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সদস্যদের নাম ২০ মে দিনটি কাম্বােডিয়াবাসী উদযাপন করে ক্রোধ দিবস’ হিসেবে, এদিন দেশের সর্বত্র গণহত্যা থেকে রক্ষা পাওয়া ব্যক্তিরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে স্ব স্ব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এবং বিশেষত নবীন প্রজন্মের কাছে তারা তা তুলে ধরতে চান। এবার এই দিবস উদযাপন পেয়েছিল নতুন তাৎপর্য ট্রাইব্যুনালের দফতর হিসেবে নির্দিষ্ট হয়েছে রাজকীয় কাম্বােডীয় সেনাবাহিনীর নবনির্মিত সদর দফতর ইতােমধ্যে বিচারক ও কৌসুলী নিয়ােগ সম্পন্ন হয়েছে এবং ৩ জুলাই ২০০৬ তাঁরা শপথ গ্রহণ করেন। জাতিসংঘের কৌসুলী নিযুক্ত হয়েছেন ৪৫ বছর বয়সী কানাডিয়ান আইনজীবী রবার্ট পেতিত তিনি এই বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এবং ইতিপূর্বে কাজ করেছিলেন রুয়ান্ডা, পূর্ব তিমুর, সিয়েরা লিয় ও কোসােভেতে তিনি ও তাঁর কাম্বােডীয় সহকারী চিয়া লিয়ং অভিযােগনামা তৈরি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন এখন একথা ঠিক বিলম্ব হয়ে গেছে অনেক, পেতিত নিজেও বলেছেন, “ঘটনা সংঘটন ও তার জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মাঝে সময়ের এতাে ফারাক আর কখনাে ঘটেনি। এর ফলে স্মৃতির ধার এবং তথ্যপ্রমাণের হাল একটা সমস্যা হয়ে উঠেছে। অপরাধীদের বয়সও একটা সমস্যা।” সত্যিকারভাবেই বয়স একটা গুরুতর সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে প্রধান আসামী খেমার রুজ নেতা পলপটের মৃত্যু হয়েছে ১৯৯৮ সালে, তিনি পরিচিত ছিলেন ব্রাদার নাম্বার ওয়ান হিসেবে ব্রাদার নাম্বার টু গুয়ান চিয়ার বয়স এখন ৭৮, সাবেক প্রেসিডেন্ট খিউ সাম্পানের বয়স ৭৪ চলছে ইতােমধ্যে সাবেক যুগােশ্লাভিয়ায় যুদ্ধপরাধে অভিযুক্ত স্লোভােদান মিলােসেভিচের অন্তরীণ অবস্থায় প্রয়াণ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ফলে কাম্বােডীয় বিচার চলাকালেও হয়তাে অভিযুক্ত কারাে কারাে তিরােধান ঘটে যেতে পারে। বিচার নিয়ে আরাে নানা জটিলতা রয়েছে, অর্থের সংস্থান একটি বড় প্রশ্ন জাতিসংঘ যে বরাদ্দ দিয়েছে তার পাশাপাশি কাম্বােডিয়াকে দিতে হবে ১৩ মিলিয়ন ডলার কাম্বােডীয় সরকার মাত্র দেড় মিলিয়ন ডলার দেয়ার পর বাকি অর্থ প্রদানে অপারগতা জানিয়েছে তবে এই সমস্যা মােচনে আরাে কিছু দেশ এগিয়ে এসেছে, এদের মধ্যে ভারত দিয়েছে এক মিলিয়ন ডলার। কাম্বােডিয়াকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও নাগরিক উন্নয়নের বিচারে একেবারে শূন্যের পর্যায়ে নিয়ে আসতে সচেষ্ট হয়েছিল খেমার রুজ বাহিনী, নির্মাণ করতে চেয়েছিল কৃষিভিত্তিক তথাকথিত এক সাম্যের সমাজ।
সহিংস উপায়ে সাম্য প্রতিষ্ঠার নিষ্ঠুর প্রয়াসে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ১৮,০০০ শিক্ষক এবং ১০০০ আইনজীবী খেমার রুজদের হাতে প্রাণ হারান জাতিসংঘের একটি দুশ্চিন্তা ছিল ট্রাইব্যুনাল পরিচালনায় যথাযথ ভূমিকা পালনের মতাে যােগ্য বিচারক, বিশেষভাবে। আইনজীবী, কাম্বােডিয়ায় পাওয়া যাবে কিনা জাতিসংঘ নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের পূর্ণ সুযােগ। শেষ পর্যন্ত এসব প্রশ্নেরও সুরাহা হয়েছে এবং কাম্বােডিয়ায় যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের বিচারকাজ শুরু হতে পেরেছে কাম্বােডিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পেছনে সেদেশের বিভিন্ন নাগরিক গােষ্ঠী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবি উত্থাপনকালে এর পেছনকার যৌক্তিকতা ও তথ্যপ্রমাণের যথাযথ ভাণ্ডার তৈরির প্রশ্নটি ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ এই কাজে অসাধারণ নিষ্ঠা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে চলেছে তরুণ কাম্বােডীয়দের সংগঠন ডকুমেন্টেশন সেন্টার অব কাম্বােডিয়া বা ডিসি-ক্যাম এর পরিচালক ইয়ুক চ্যাং আমেরিকায় আইন বিষয়ে শিক্ষা সমাপন করে সেখানে কিছুকাল প্রসিকিউটরের কাজ করেন। ১৯৯০ সালে কাম্বােডিয়ায় ফিরে আপন বােনের নিহত হওয়ার বিবরণ সংগ্রহ করতে গিয়ে গণহত্যা ও সংশ্লিষ্ট তথ্য বিষয়ে গভীরভাবে আগ্রহী হন এবং প্রতিষ্ঠা করেন ডকুমেন্টেশন সেন্টার কাঘােডীয় আবেগ ও মার্কিনী দক্ষতা মিশিয়ে তিনি এই কাজে এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের সংগৃহীত তথ্যভাণ্ডার ট্রাইব্যুনাল গঠনের পথ মসৃণ করেছে। ইয়ুক চ্যাংয়ের বিশ্বাস, তথ্যভাণ্ডার গড়ে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের স্মৃতি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ সম্ভব হবে এবং এর ধারাবাহিকতায় যখন বিচার সম্পন্ন হবে ও অভিযুক্তদের শাস্তি বিধান ঘটবে, তখন মানুষ স্মৃতির জ্বালা থেকে মুক্তি পাবে এবং অতীতের ক্ষতের সত্যিকার উপশম হবে ইয়ুক চ্যাং নিজ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখেছেন, “আমরা যারা গণহত্যার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বের হয়ে এসেছি তারা জানি যা ঘটেছে তার ক্ষতিপূরণ কেউ বা কোনাে কিছু দিতে পারবে না। গণহত্যা একটি দেশকে নানাভাবে বিধ্বস্ত করে দেয়।
কাম্বােডিয়ায় এই ক্ষত উপশমের পথ অতি দীর্ঘ। পঁচিশ বছর পরও কাম্বােডিয়া আজ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলাের একটি। সামনের দিকে এগােনাের আগে আমাদের দরকার অতীতের ক্ষতের উপশম। আমাদের যৌথ অভিজ্ঞতার সবিস্তার তথ্যভুক্তি ও অনুধাবন সেই অভিমুখে একটি ছােট পদক্ষেপ।” ইয়ুক চ্যাং এই কর্মকাণ্ডকে ছােট পদক্ষেপ বললেও এর তাৎপর্য বিশাল এবং এরই এক প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখি কাম্বােডিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার সূচনা। প্রায় তিরিশ বছর পরে হলেও কাম্বােডিয়ায় গণহত্যা সংঘটনের দায়ে । অভিযুক্তদের বিচার শুরু হয়েছে। এই বিচার আমাদের জন্য আন্তর্জাতিক আইন ও গণহত্যাকারীদের শাস্তিবিধান প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিপুল অভিজ্ঞতার যােগান দেবে। বাংলাদেশ সাগ্রহে তাকিয়ে থাকবে নমপেনের অদূরে খেমার স্থাপত্যের আদলে নির্মিত কাম্বােডীয় সেনাবাহিনীর চারতলা সদর দফতরের দিকে যেখানে ট্রাইব্যুনালের কাজ চলবে, বিশ্বমানবের স্বীকৃত ও অনুমােদিত বৈধ আইন।
সূত্রঃ জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক