You dont have javascript enabled! Please enable it! যুদ্ধাপরাধীর বিচার : নতুন আন্তর্জাতিক মাত্রা - সংগ্রামের নোটবুক
যুদ্ধাপরাধীর বিচার : নতুন আন্তর্জাতিক মাত্রা
স্বর্গীয়া জাহানারা ইমামের কল্যাণে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ছাইচাপা প্রশ্নের র গভীরে নিরন্তর ধিকি ধিকি-জ্বলা আগুন আবার উস্কে উঠেছিল এবং তার অবর্তমানে আন্দোলনের বেহাল অবস্থা হলেও যে নৈতিক পুনরুত্থান তিনি সম্ভব করে তুলেছিলেন সেই শক্তিময়তা ফুরিয়ে যায় নি। অন্তত একটি বড় কাজ তিনি করে গিয়েছিলেন, ক্যান্সারপীড়িত মৃত্যুপথযাত্রী এক শহীদ-জননীর নির্ভীক বলিষ্ঠ প্রত্যয়ী উচ্চারণে নবীন প্রজন্মের অগণিত মানব-মানবীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল তার বাণী। রাজনীতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে, এমন কি রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হাজারাে নবীন-নবীনা জেনেছিল ইতিহাসের কাছ থেকে পাওয়া তাদের দায়, বিশ শতকের অন্যতম ঘৃণ্যতম নরহত্যাযজ্ঞ যারা ঘটিয়েছে এই শ্যামল বাংলার মাটিতে তাদের কোনাে নিস্তার না দেয়ার আহ্বান তারা শুনতে পেয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল মানবতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে কৃতকর্মের পরিণাম অপরাধীদের বুঝিয়ে দিতে হবে এবং এই দায়িত্ব বড়ভাবে বর্তায় নতুন প্রজন্মের ওপর যাদের জন্ম একাত্তরের পর এবং অপাপবিদ্ধ সেই তরুণ-তরুণীরা সংখ্যায় সমাজে ক্রমে গরিষ্ঠ হয়ে উঠছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে বাংলার তরুণসমাজকে এই যে উত্তাল করে তুলেছিলেন জাহানারা ইমাম, সঙ্গতভাবেই আশা করা যায় সেই পতাকা বহন করার মতাে শক্তি ও যােগ্যতা ধারণ করে পূর্বপ্রজন্মের ব্যর্থতার গ্লানি তারা মােচন করবেন। তবে এই ব্যর্থতার সবটুকু একাত্তরের প্রজন্মের কাধে ন্যস্ত করলে ভুল করা হবে।
কেননা সত্তরের দশকে যে আন্তর্জাতিক আবহে বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্ভব হয়েছিল, স্নায়ুযুদ্ধ-পীড়িত বিভক্ত ও বিদ্বেষমূলক সেই বিশ্বে বাংলাদেশে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য কোনাে সম্মিলিত আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব ছিল না। তবে এটাও স্বীকার করে নেয়া উচিত, আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও অন্তত জাতীয় উদ্যোগ জিইয়ে রাখা দরকার ছিল এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকার ওপর নিরশীল না থেকে নাগরিক  উদ্যোগেও অনেক কিছু সম্পন্ন হওয়ার ছিল। দীর্ঘ বিলম্বের পর, অন্য সকল উদ্যোগের অনুপস্থিতিতে, জাহানারা ইমাম সেই দায়মােচনে বিস্ময়কর সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নটি বিবেচনাকালে সাম্প্রতিক কতক বিকাশ আমাদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গঠিত নুরেমবার্গ বিচারশালা ও টোকিও ট্রাইবুনালে সর্বপ্রথম যুদ্ধাপরাধ চিহ্নিত হয় “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে এবং প্রচলিত হত্যা বা খুনের বিচারার্থ আদালতের বাইরে গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানাের অপরাধকে শাস্তিযােগ্য করে তােলা হয়। কিন্তু এরপর থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে কোনাে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্ন উত্থাপিত হয় নি। মধ্যবর্তী এই সময়ে জগৎ যে সুসভ্য হয়ে উঠেছিল তা তাে নয়। বরং ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন সাক্ষ্য দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে যে শীতল যুদ্ধ। শুরু হয় তা গােটা দুনিয়াকে দুই বিরােধী শিবিরে ভাগ করে দিয়েছিল।
এর মধ্যে নেহেরু-নাসের-টিটো-সুকর্ণের উদ্যোগে জোট-নিরপেক্ষতার একটা জায়গা তৈরির চেষ্টা হয়েছিল বটে, তবে কি রাশিয়া কি আমেরিকা উভয়েই তাবৎ বিষয়কে বিবেচনা করেছিল নিজস্ব প্রভাব বলয়ের স্বার্থকোণ থেকে, এমন কি জোট-নিরপেক্ষতাকেও। অপরদিকে জাতিসংঘে কি ভিন্ন কোনাে আন্তর্জাতিক ফোরামে যুদ্ধাপরাধের প্রশ্ন বিচার করতে হলে প্রয়ােজন ছিল বিশ্বজনীন ঐকমত্য। শিবির বিভাজিত বিশ্বে সেই ঐক্যের দেখা পাওয়া অকল্পনীয় ছিল বলেই যুদ্ধাপরাধ ঘটলেও অপরাধীদের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠার কোনাে মিলিত প্রচেষ্টার কথা ভাবা ছিল দুষ্কর কিন্তু পরিস্থিতি যতােই দুষ্কর হােক, বিবেকবান মানুষেরা যে নিশ্চেষ্ট বসে থাকেন না, তার প্রমাণ রেখে ভিয়েতনামে মার্কিন অপরাধ বিচারের জন্য দার্শনিক বাড্ৰাণ্ড রাসেল গঠন করেছিলেন বেসরকারি ট্রাইবুন্যাল বা গণ-আদালত সেই ষাটের দশকেই। একাত্তরে যখন পাকিস্তানিদের বর্বর হত্যালীলায় রঞ্জিত হয়ে অকুতােভয় বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলাে তখন যুদ্ধাপরাধ বিচারের মতাে সর্বসম্মত আন্তর্জাতিক আবহ একেবারেই ছিল না। তদুপরি বাংলাদেশের অ্যুদয়কে সােভিয়েত বলয়ের প্রভাববৃদ্ধির উদাহরণ হিসেবে গণ্য করে মুখ ফিরিয়ে ছিল আমেরিকা ও চীন। মার্কিন বিদেশ মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে গালে চপেটাঘাতের মতাে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৭২ সালের এপ্রিলের আগে নয়, এবং আরব দেশগুলাের স্বীকৃতি শুরু হয়েছিল ১৯৭৩-এর শেষাশেষি। সর্বোপরি চীন এবং সৌদি আরবসহ আরাে কতক মার্কিন প্রভাবিত আরব দেশ বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বপর্যন্ত বাংলাদেশকে বাস্তব স্বীকৃতিটুকুও প্রদান করে নি।
এমনি বৈরী আন্তর্জাতিক পরিবেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারানুষ্ঠান সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে আমাদের স্মরণে রাখা দরকার, যুদ্ধাপরাধের বিচার জাতীয় আইন প্রণয়ন করে সম্ভব হলেও এর প্রকৃত আদালতকে চরিত্রগতভাব আন্তর্জাতিক হতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বৈরিতার কারণে সেই স্বীকৃত আন্তর্জাতিক আদালত গঠন ছিল প্রশ্নাতীত ব্যাপার। স্নায়ুযুদ্ধ, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অবসিত হলাে সােভিয়েত সাম্রাজ্যের আকস্মিক পতনে। এর ফলাফলের ভালােমন্দ দিক যাই থাকুক না কেন, একটি সম্ভাবনা ক্রমেই মূর্ত হয়ে উঠছে, মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধকারী এখন আর স্নায়ুযুদ্ধের কোনাে এক পক্ষের আশ্রয় নিয়ে পার পেতে পারছে না আগের মতাে, যুদ্ধাপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানাের পক্ষে রাষ্ট্রীয় মত ক্রমেই জোরদার হয়ে আন্তর্জাতিক অবকাঠামাে খুঁজে ফিরছে স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর এই নতুন লক্ষণগুলাে প্রথম প্রকাশ পেল বলকান যুদ্ধাপরাধী সার্ব জেনারেলদের বিচারের প্রয়াসে। এর পর সাবেক যুগােশ্লাভিয়া ও রুয়ান্ডায় জাতিগত নিধনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য দি হেগে প্রতিষ্ঠিত হয় দুই পৃথক আন্তর্জাতিক আদালত যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে। অপরাধের শাস্তি বিধানের জন্য দীর্ঘ আলাপ-আলােচনার পর ১৯৯৮ সালে রােমে ১২০টি দেশের সমর্থনে আই.সি.সি বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সাতটি দেশ রােম বিধানে স্বাক্ষরদান করে নি, এদের মধ্যে রয়েছে আমেরিকা, চীন, ভারত ও ইজরায়েল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত স্বীয় প্রতিষ্ঠাকালের আগে সংঘটিত অপরাধের বিচার করবে না ঘােষণা করলেও এমনি আদালতের প্রতিষ্ঠা আমাদের জন্য বিশেষ ইতিবাচক ঘটনা। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের চিহ্নিত করার দিকে বিশ্বের এমনি মােড় ফেরায় আরেক ইতিবাচক ঘটনা চিলির প্রাক্তন সামরিক শাসক জেনারেল পিননাশের বর্তমান পরিণতি।
১৯৭৩ সালে চিলিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বামপন্থী প্রেসিডেন্ট আলেন্দের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতায় আরােহণ করেন জেনারেল অগাস্টো পিননাশে তার ক্ষমতা দখলের পেছনে কিসিঞ্জার ও মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা বিশেষ প্রচ্ছন্ন থাকে নি। এই আমেরিকান বশংবদের উত্থানে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৫,০০০ চিলিবাসী, দেশের এক-দশমাংশ মানুষ বাধ্য হয়েছিল দেশান্তরী হতে পশ্চিমা প্রশ্রয়প্রাপ্ত নির্মম নিষ্ঠুর সামরিক শাসক তৃতীয় দুনিয়ায় অনেক মেলে। এদের উত্থান, লুণ্ঠন ও নির্দয় শাসনের কাহিনী রয়েছে অজস্র কৃতকর্মের জন্য তাদের কখনাে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় নি। ১৯৮৯ সালে পিননাশে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তার তাবেদার রাজনীতিক নেতার কাছে এবং এর আগে নিজেকে চিলির সিনেটের আজীবন সদস্য ঘােষণা করেন সাংবিধানিকভাবে। তদুপরি চিলির আইনে কখনাে তাকে বিচার করা যাবে বলেও বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা নেন। দশ বছর পর ১৯৯৯ সালে পূর্বের আরাে অনেক বিদেশ ভ্রমণের মতাে জেনারেল পিননাশে সেযাত্রা এসেছিলেন লণ্ডনে, তাঁর বিশেষ বন্ধু প্রাক্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে দেখা করবেন, আর মেরুদণ্ডের হাড়ের ব্যথার চিকিৎসাও করাবেন। কিন্তু বিশ্ব যে ইতিমধ্যে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে সেটা বুঝতে হাড়ে হাড়ে বজ্জাত পিননাশে কিছুটা ভুল করেছিলে ফলে তার হাতে নিহতদের পরিজনদের উত্থাপিত অভিযােগের ভিত্তিতে ১৬ মাস বৃটেনে অন্তরীণাবদ্ধ থাকতে হয় পিননাশেকে। স্পেন একই প্রকার অভিযােগে পিনােশের বিচারানুষ্ঠানের জন্য তাকে পেতে চায় মাদ্রিদে শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্যের কারণে বৃটিশ সরকার বৃদ্ধ পিননাশের বিচার স্থগিত রেখে তাকে পাঠিয়ে দেয় চিলিতে চিলির আদালতে এবার অভিযুক্ত হয়েছেন পিনােশে। মানবাধিকার লংঘনের দায়ে ১৪১টি অভিযােগ দায়ের করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। দশ বছর আগেও যে-ঘটনা ছিল অলীক সেটাই এখন বাস্তব রূপ নিতে চলছে। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের গণহত্যার মতােই নৃশংস গণহত্যা ঘটেছিল কাম্বােডিয়ায়।
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত খেমার রুজদের শাসনকালে তাদের বর্বরতার শিকার হয়েছিল ১৭ লক্ষ স্বদেশবাসী। পলপট, খিউ সাম্পান ও অন্য চীনাপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন খেমার রুজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচারানুষ্ঠানের দাবি অনেক দিন থেকেই উত্থাপিত হচ্ছে। খেমার রুজদের পরাজয় ঘটলেও তারা এখনও দূরান্তের বেশ কিছু এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। অধিকৃত এমনি এলাকায় বৃদ্ধ পল পটের মৃত্যু তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াবার শঙ্কা থেকে মুক্ত করেছে। কাম্বােডিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের নাজুক অবস্থানও বিচার বিলম্বিত করছে। কাম্বােডিয়ায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠানে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সপ্তাহকাল আগে এবং আশা করা যায় সাবেক যুগােশ্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার মতাে কাম্বােডিয়ার গণহত্যার বিচারের জন্যও আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল অচিরে গঠিত হবে। কাম্বােডিয়ায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারানুষ্ঠান বিষয়ে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ বাংলাদেশে সরকারের বিদেশ মন্ত্রণালয় ও নাগরিকজনের প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ জরুরি। কাম্বােডিয়ার ক্ষেত্রে একটি সুবিধা হলাে এই অপরাধে অভিযুক্তরা বামপন্থী কমিউনিস্ট, আর তাই বিচারের প্রশ্নে আমেরিকা অনাগ্রহী তাে নয়ই, বরং তাদের উৎসাহই রয়েছে। সে-কারণে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রশ্নটি নিয়ে তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় এবং জাতিসংঘ প্রতিনিধি ও কাম্বােডীয় সরকারের মধ্যে দীর্ঘ আলােচনার পর স্মারক সমঝােতা সম্প্রতি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এই সমঝােতার ভিত্তিতে অচিরে  কাম্বােডীয় সংসদ যুদ্ধাপরাধ বিচারের ট্রাইবুন্যাল গঠনের আইন অনুমােদন করবে। এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আগামী অধিবেশনে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। কাম্বােডিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল বিধায় মানবতার প্রতিষ্ঠা ঘটাতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণেও তাদের সম্পৃক্তি স্বাভাবিকভাবে রূপায়িত হয়েছে। এক্ষেত্রে কাম্বােডিয়ার সরকারের উদ্যোগের অভাব জাতিসংঘ অনেকটা পূরণ।করতে পেরেছে।
১৯৭৫-৭৯ সালে কাম্বােডিয়ায় সংঘটিত গণহত্যাকারীদের বিচারানুষ্ঠান এর চার বছর আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নির্মম নৃশংসভাবে যথেচ্ছ হত্যাকাণ্ড চালিয়ে প্রায় ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যার বিচারের প্রশ্নকে আন্তর্জাতিক এজেণ্ডায় পরিণত করার সুযােগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের সুবিধা হলাে ১৯৭৩ সালেই জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠন সংক্রান্ত আইন গৃহীত হয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত আন্তর্জাতিক আবহের অভাবে সেই আইন। কার্যকর করার সুযােগ বাংলাদেশ পায় নি। তবে এই আইনে গণহত্যার বাংলাদেশী দোসরদের বিচার জাতীয়ভাবে সম্পাদন খুবই সম্ভব। বন্দি পাকিস্তানি জেনারেল ও সৈন্যদের মধ্যে প্রায় ২০০ জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেও এদের বিচারের কোনােরকম আন্তর্জাতিক উদ্যোগ বাংলাদেশ কার্যকর করতে পারে নি। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি সেই বাস্তবতা পাল্টে দেয়ার সুযােগ আমাদের সামনে উপস্থিত করেছে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে প্রধান যুদ্ধাপরাধী হচ্ছে গণহত্যার হােতা পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা, তাদের সঙ্গে অপরাধী তালিকায় আরাে আছে মাঠপর্যায়ে বাঙালি নিধন নীতি কার্যকর করতে সােৎসাহী সামরিক কমান্ডার এবং তাদের এদেশীয় সহযােগী জামাত নেতা, আলবদর আল শামস কমান্ডাররা এদের কারাে কারাে বিচার দেশীয় আইনে সম্ভব, কিন্তু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকর্মের জন্য দায়ী প্রকৃত ঘাতকদের বিচার হওয়া উচিত আন্তর্জাতিক আদালতে, আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালে, যে ট্রাইবুন্যাল পাকিস্তানি অভিযুক্তদের তলব করার ক্ষমতা রাখবে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি এমনি ট্রাইবুন্যাল গঠন সম্ভব করে তােলার নানা ইঙ্গিত প্রদান করছে। আমরা চাইবাে সরকার ও দেশবাসী মিলে এই মানবিক দাবি বাস্তবায়ন করার চাহিদা জাতিসংঘ ও বিভিন্ন বিশ্ব ফোরামে যথাযথভাবে তুলে ধরবে।

সেই লক্ষ্যে আমরা চাইবাে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল গঠনের দাবিতে সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল সােচ্চার হবে মানবিকতার প্রতিষ্ঠা ঘটানাের এই দাবি কেবল বাংলাদেশের নয়, বিশ শতকের জঘন্যতম নরমেধযজ্ঞ পরিচালনাকারীদের শাস্তি দিয়ে বিশ্ববিবেকও তাদের গ্লানি মােচন করতে পারবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনের দাবি যেসব রাজনৈতিক দল করেন তাদের সবার এজেন্ডায় যুদ্ধাপরাধীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের দাবি সন্নিবেশ করা তাই একান্ত প্রয়ােজন অপরাধ পুরনাে হলেও তার দায় থেকে কারাে মুক্তি নেই, কাম্বােডিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনা সেটা মেলে ধরেছে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি এই বিচারানুষ্ঠান জরুরি করে তুলেছে দলমতনির্বিশেষে তরুণ সমাজও নিশ্চয় ন্যায় প্রতিষ্ঠার পতাকা হাতে তুলে নিয়ে আমাদের সবার দায় মােচনে সােচ্চার ও সক্রিয় হয়ে উঠবে। 

সূত্রঃ  জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক