You dont have javascript enabled! Please enable it! জেনােসাইড কনভেনশনের ষাট বছর ও বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক
জেনােসাইড কনভেনশনের ষাট বছর ও বাংলাদেশ
২০০৮ সালে গােটা বিশ্ব পালন করেছে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণার ষাটতম বার্ষিকী ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক মানবাধিকার ঘােষণা গ্রহণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি মানুষের মৌলিক কতক অধিকারের বিশ্বজনীন স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বিপ্লব ও আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ রাষ্ট্রের নিরিখে ব্যক্তিমানবের অধিকার ঘােষণা করেছিল; কিন্তু রাষ্ট্রনিরপেক্ষভাবে সকল ব্যক্তির, তিনি যে রাষ্ট্র বা অঞ্চলের অধিবাসী হন না কেন, রয়েছে যে কতক মৌলিক অধিকার সেই উপলব্ধি তখনাে দেখা যায় নি। এই স্বীকৃতি জোরালাে ও সম্মতভাবে ঘােষিত হলাে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে এবং নাগরিক অধিকারের ধারণায় যােগ করে এক নৈতিক মাত্রা বিধান নয়, নৈতিকতা হয়ে ওঠে এর শক্তি সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘােষণা কথাটার মধ্যেও নৈতিক বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। এই ঘােষণার প্রণেতাদের অন্যতম এলিনর রুজভেল্ট বলেছিলেন, “এটা কোনাে চুক্তি নয়, কোনাে আন্তর্জাতিক সমঝােতাও নয়, এর লক্ষ্য আইনী বিধান হয়ে ওঠা নয়, এর কোনাে আইনগত বাধ্যবাধকতাও নেই।” তারপরও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন, “এই ঘােষণা হয়ে উঠতে পারে মানবসমাজের আন্তর্জাতিক ম্যাগনাকার্টা। বস্তুত, এখানেই নিহিত রয়েছে প্রতিটি মানবসত্তার জীবন বিকশিত করার পরিবেশ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে তার মৌলিক অধিকারগুলাের স্বীকৃতির তাৎপর্য এই ঘােষণা মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনার বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি যুগিয়েছে যা রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী ও শক্তিশালী ভূমিকার বিপরীতে অধিকার নিয়ে দাঁড়াবার প্রেরণা ও পরিসর ব্যক্তিমানুষকে প্রদান করে। এই প্রেরণায় মানবাধিকারের আন্দোলন পায় নতুন গতিবেগ।
রাষ্ট্র ও পীড়নমূলক নানা সংস্থার চাপে কুণ্ঠিত হয়ে, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সর্বোপরি অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়ে শেষতক নাগরিক তার অধিকার কতােটুকু রক্ষা করতে পারলাে সেটা এক জটিল প্রশ্ন। ঘােষণার উচ্চ আদর্শ ও বাস্তবের নির্মমতার মধ্যকার গভীর ফারাকের অতলে মানবাধিকারের প্রশ্ন নানাভাবে হারিয়ে গেলেও এর তাৎপর্য তাতে ক্ষুন্ন হয় না। বরং আমরা দেখি সার্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণার পরবর্তী দশকগুলােতে এর ধারাবাহিকতায় অনেক ধরনের অর্জন সম্ভব হয়েছে, যার একটি বড় দিক উপনিবেশবাদ মােচনের প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের ভূমিকা এবং আরেক বিশেষ উপাদান বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার আন্দোলনের বিকাশ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণার পিঠাপিঠি জড়িয়ে আছে বিশ্বসমাজের গৃহীত আরেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, প্যারিসের শ্যালাে প্রাসাদে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সার্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণা গৃহীত হওয়ার পরদিন ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ গ্রহণ করে জেনেসাইড কনভেনশন’ শীর্ষক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, যা গণহত্যার নিষ্ঠুরতা-দংশিত বাংলাদেশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ তাে বটেই, বিশ্বসমাজের জন্য যার গুরুত্বও কোনােভাবে খাটো করে দেখার উপায় নেই। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণা ও জেনােসাইড কনভেনশন যে প্রায় একত্রে আত্মপ্রকাশ করলাে সেটা নিছক কাকতালীয় ছিল না। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণা ছিল ডিক্লারেশন অব ইনটেন্ট বা ইচ্ছার অভিব্যক্তি, এর মধ্যে কোনাে বাধ্যবাধকতা ছিল না।
 
পক্ষান্তরে জেনােসাইড কনভেনশনের মধ্যে নির্ধারিত হয়েছিল রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের করণীয়ের রূপরেখা, মানবাধিকারের চরম লংঘন তথা গণহত্যার অপরাধের মােকাবিলায় রাষ্ট্রের কর্তব্য নির্ধারণের চেষ্টা সেখানে নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী এই ধরনের চরম অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক কোনাে সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা সে-বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের আহ্বান জানানাে হয়েছে কনভেনশনে।  পরবর্তী ঘটনাধারায় আমরা দেখি নানা বাধা ও চড়াই-উতরাই সত্ত্বেও সার্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণা ঘিরে বিশ্বসমাজের বহুমুখী তৎপরতা ছিল অব্যাহত মানবাধিকারের বিষয়টি কখনােই আলােচনার বাইরে থাকে নি, ঘােষণা ঘিরে তর্ক-বিতর্ক, সমালােচনা পাল্টা-সমালােচনার কোনাে অন্ত ছিল না। মানবাধিকারের চেতনা প্রসার, এর মান্যতা এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করার জন্য বহু ধরনের সংস্থা ও উদ্যোগ জন্ম নিয়েছে। সার্বজনীন মানবাধিকারের ধারণার উপজাত হিসেবে নারীর অধিকার, শিশু অধিকার, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও সংখ্যালঘুর অধিকার ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের অধিকারের দাবি ক্রমে সরব হয়ে উঠেছে এবং এর প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পথরেখা তৈরি করেছে। পাশাপাশি দেখা যায় জেনােসাইড কনভেনশনের স্থান হলাে একেবারেই হিমঘরে, স্নায়ুযুদ্ধ তথা দুই পরাশক্তির লড়াইয়ের শিকার হয়ে গণহত্যার প্রশ্ন মােকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণের উপায় হারিয়ে ফেললাে বিশ্বসমাজ। তাই ১৯৪৮ সালের জেনােসাইড কনভেনশনের পর এ-নিয়ে আর কোনাে অগ্রগতি রচনা করতে পারলাে না জাতিসংঘ। তবে অগ্রগতির পথে জটিলতা যাই থাকুক সেটা জেনােসাইড কনভেনশনের যুগান্তকারী তাৎপর্য কোনােভাবে ক্ষুন্ন করে না। জেনােসাইড কনভেনশন অনেক দিক দিয়েই নতুন এক বিশ্ব গড়বার দিক-নির্দেশনা যুগিয়েছিল।
 
হিংসা ও বর্বরতার অতলে তলিয়ে যাওয়া পৃথিবীর দুঃসহ অভিজ্ঞতা পর্যালােচনা করে তা থেকে উদ্ধারের পথরেখা মেলে ধরেছিল এই কনভেনশন। কোনাে জাতি, জনগােষ্ঠী, ধর্মসম্প্রদায় তথা গােটা সমাজকে আক্রমণের লক্ষ্য করে সবরকম ন্যায়-নীতি ও আইনের পদদলন করে পীড়ন ও হত্যার যে বর্বর অভিযান সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির পক্ষ থেকে পরিচালিত হয় তা সুচিহ্নিত করে এর প্রতিবিধানের রূপরেখা | মেলে ধরা হয় জেনােসাইড কনভেনশনে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে ইহুদি-নিধন এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে নাৎসী জার্মানি যে বর্বর হত্যা-অভিযান পরিচালনা করে সেইসবের পরিচয় পেয়ে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ বিশ্বসমাজ প্রণয়ন করেছিল ‘জেনােসাইড কনভেনশন’, এর পেছনে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন রাফায়েল লেমকিন, পােল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী এই ইহুদি আইনবিশারদ আর্মেনীয় গণহত্যা দ্বারা পীড়িত বােধ করেছিলেন এবং পরে নিজেই হয়েছিলেন জার্মান নিগ্রহের শিকার। জেনােসাইড সুপ্রাচীনকাল থেকে সংঘটিত হয়ে এলেও “জেনােসাইড’ অভিধাটি একান্তই হাল আমলের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের করাল সময়ে জাতি বা নৃগােষ্ঠী উৎসাদনের প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করতে রাফায়েল লেমকিন প্রথম এই অভিধা ব্যবহার করেন। গ্রিক শব্দ জেনােস (জাতি, উপজাতি) এবং ল্যাটিন শব্দ সাইড (তথা হত্যা, যেমন হােমিসাইড, ফ্রাট্রিসাইড ইত্যাদি) যুক্ত করে ‘জেনােসাইড’ শব্দবন্ধ তিনি তৈরি করলেন। এক পর্যায়ে তিনি গ্রিক শব্দ ইথনাে’ বা ‘জাতি’ ব্যবহার করে এই নিধন প্রক্রিয়া বােঝাতে ‘ইথনােসাইড’ শব্দবন্ধও ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। জেনােসাইড বলতে কি বােঝায় সেটা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে জেনােসাইড কনভেনশনের দ্বিতীয় বিধানে, বলা হয়েছে,
“জেনােসাইড বলতে একটি জাতি, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণগত কিংবা ধর্মীয় গােষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নিয়ে নিম্নবর্ণিত যে কোনাে কর্মসাধনকে বােঝাবে :
ক. গােষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা;
খ. গােষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন;
গ. উদ্দ্যেমূলকভাবে গােষ্ঠীর জীবনযাত্রায় এমন কিছু আরােপ যা আংশিক | বা সম্পূর্ণভাবে এর কাঠামােগত ধ্বংস বয়ে আনবে; ঘ, গােষ্ঠীর মধ্যে জন্মধারা রােধ করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা আরােপ;

ঙ. গােষ্ঠীর শিশুদের বলপূর্বক অন্য গােষ্ঠীতে চালান দেয়া।” জেনােসাইড শব্দবন্ধ প্রণয়নের পটভূমি এবং জেনােসাইড কনভেনশনের পাঠ। নিলে আমরা বুঝতে পারি এর বাংলা হিসেবে ‘গণহত্যা’ বহুল ব্যবহৃত হলেও মােটেই যথাযথ নয়। ব্যাপক হত্যাকাণ্ড কিংবা যথেচ্ছ হত্যাকাণ্ডকে আমরা গণহত্যা বলতে পারি; কিন্তু গ্রিক ও ল্যাটিন শব্দ মিলে যে-বাস্তবতা বােঝাতে ‘জেনােসাইড’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে সেই তাৎপর্য ‘গণহত্যা’ শব্দবন্ধ বহন করে না। এক্ষেত্রে আমাদের প্রয়ােজন একজন রাফায়েল লেমকিন, যিনি জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখােমুখি দাঁড়িয়ে আইন ও ন্যায়ের শক্তিতে তা মােকাবিলার জন্য মানবের শব্দভাণ্ডারকেও সমৃদ্ধ করে তােলেন। জেনােসাইডের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে গণহত্যার বিকল্পে জাতিহত্যা, নৃ-হত্যা, জাতিবিনাশন ইত্যাদি শব্দবন্ধ আমরা ব্যবহার করতে পারি। উপযুক্ত বিকল্প না পাওয়া গেলে গ্রিক ও ল্যাটিনের মিশ্রণে উদ্ভূত ‘জেনােসাইড’ শব্দবন্ধ আপাতভাবে বাংলায় গ্রহণ করা চলে। অর্থবহ প্রতিশব্দ হিসেবে জাতিবিনাশ্যজ্ঞ’ আমার কাছে অনেক গ্রহণযােগ্য মনে হয়, কেননা জেনােসাইড বলতে যথেচ্ছ হত্যা, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে হত্যা, গােষ্ঠীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকার পদপিষ্ট করা ও এমত আরাে অনেক কর্ম বােঝায় সব মিলিয়ে যা এক নারকীয় যজ্ঞ বটে। জেনােসাইড-এর সবিস্তার পরিচয়দানের পর কনভেনশনের তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছে :

“নিম্নবর্ণিত কর্মগুলাে শাস্তিযােগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে :
ক. জেনােসাইড,
খ, জেনােসাইড সংঘটনে ষড়যন্ত্র করা,
গ. জেনােসাইড সংঘটনে সরাসরি ও প্রকাশ্যে উস্কানিদান,
ঘ. জেনােসাইড সংঘটনে সচেষ্ট হওয়া এবং উ. জেনােসাইডে সহযােগিতা করা।” কনভেনশনের এই বিধানটি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য, কেননা উল্লিখিত বিধান দুটি থেকে আমরা বুঝতে পারি জেনােসাইড কোনাে প্রচলিত ধরনের অপরাধ নয় এবং এই চরম অপরাধের শাস্তি কেবল প্রত্যক্ষভাবে জেনােসাইডের কর্তাদের প্রাপ্য নয়, এই শাস্তি মদদদাতা, উস্কানিদাতা ও সহায়তাকারীদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযােজ্য।  বিশ্বসমাজের জন্য এটা খুব দুঃখজনক হয়েছে যে, জেনােসাইড কনভেনশন তার আদর্শিক শক্তিময়তা সত্ত্বেও কার্যকর কোনাে ভূমিকা রাখতে পারলাে না বিশ্ব রাজনীতির বিভাজন ও পরাশক্তির পারস্পরিক বিরােধিতার কারণে। তবে জাতিসংঘ অক্ষম হয়ে পড়লেও গণহত্যা যে বন্ধ ছিল সেটাও তাে নয় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপােষকতা ও মদদে অনেক ধরনের বর্বরতা সংঘটিত হয়েছে যা জেনােসাইড হিসেবে গণ্য হওয়ার দাবি রাখে। সর্বোপরি দুটি বড় গণহত্যার ঘটনা বিশ্ববাসীকে আলােড়িত করেছিল, এর একটি ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্ট দমনের নামে সুহার্তোর সামরিক সরকার পরিচালিত যথেচ্ছ হত্যাকাণ্ড এবং অপরটি ছিল ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনী ও তাদের তাবেদার সরকার পরিচালিত সামরিক অভিযান। প্রথমটির উদগাতারা গণহত্যাকাণ্ড অনেকাংশে লােকচক্ষুর আড়ালে রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং দ্বিতীয়টি পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম ও টেলিভিশনের কল্যাণে অনেক বেশি হাজির ছিল পাদপ্রদীপের আলাের সামনে এবং বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। তবে এসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা বিশেষ ছিল না এবং সেই ব্যর্থতা মােচনে দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল গঠন করেছিলেন ভিয়েতনামে যুদ্ধাপরাধ বিচারের গণ-আদালত’ যেখানে জা পল সার্জেসহ বিশ্বের অনেক খ্যাতনামা লেখক-শিল্পী যােগ দিয়েছিলেন।
 
গণহত্যার বিচার করার দায়ভার, জেনােসাইড কনভেনশনের বিবেচনায়, বর্তায় জাতীয় সরকার বা রাষ্ট্রের ওপর এবং সেই সাথে জাতিসংঘের ওপরও, কিন্তু এই সময়ে কোনাে রাষ্ট্রকে এগিয়ে এসে গণহত্যার বিচারের জন্য জাতীয়ভাবে আইন প্রণয়ন করতেও দেখা যায় নি। পরাশক্তির পক্ষ-বিপক্ষে বিশ্ব যখন বিভাজিত সেই পটভূমিকায় ১৯৭১ সালে গণতান্ত্রিক রায়কে অস্বীকার করে পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীর নৃশংস হত্যাভিযান শুরু হয়। বেসামরিক নাগরিকদের অবস্থানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান পরিচালনা এবং জাতিনিধনের অঘােষিত নীতি বাস্তবায়ন প্রচেষ্টা বাংলাদেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যার অবতারণা ঘটায়। নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ প্রাণ এবং তিন লাখ মা-বােনের সম্রমহানীর পটভূমিকায় উদিত হয় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। পাকবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও এই রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও জাতিসংঘে আসন খুব সহজে পায় নি। ফলে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার জন্য যারা দায়ী আন্তর্জাতিক মহলের সহযােগিতায় তাদের বিচার অনুষ্ঠানের কাজটি সহজসাধ্য ছিল না। যে ১৯১ জন পাকিস্তানি সমরবাহিনী সদস্যকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদের ভারতীয় আটকখানায় বন্দি করে রাখলেও শেষ পর্যন্ত মুক্তি দিতে হয়। সিমলা চুক্তির আলােকে এই মুক্তি প্রকৃত অর্থে ছিল পাকিস্তানে আটক বেসামরিক বাঙালি নাগরিকদের সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক যুদ্ধবন্দিদের বিনিময়। মুজিব-ভুট্টো আলােচনার ভিত্তিতে এই বিনিময় বিষয়ে যে সমঝােতা হয় সেখানে ভূট্টো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি করবেন; কিন্তু সেই ওয়াদা তিনি পূরণ করেন নি। 
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে থাকলেও ১৯৭২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে অগ্রসর হয় এবং সংসদে দালাল (বিশেষ ট্রাইবুন্যাল) আইন গৃহীত হয়। মামলার সংখ্যাধিক্য এবং অন্যান্য বিবিধ কারণে পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, দালাল আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযােগে অভিযুক্ত ছাড়া বাদবাকিদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করেন। এই সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে, তবে এটা বিশেষভাবে লক্ষ্যযােগ্য যে এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের কোনােভাবে ক্ষমা করা হয় নি। বরং তাদের বিচার অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া চালু ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল দীর্ঘায়ত হওয়ার কোনাে সুযােগ ঘটে না, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন এবং সেই বছরের ২০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশ-বলে দালাল (বিশেষ ট্রাইবুন্যাল) আইনটি বাতিল করা হয়।
 
তবে অলক্ষ্যে থেকে যায় আরেকটি আইন যা গৃহীত হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১৬ জুলাই, যে-আইনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তাৎপর্য অপরিসীম এবং যা হতে বিচার করার দায়ভার, জেনােসাইড কনভেনশনের বিবেচনায়, বর্তায় জাতীয় সরকার বা রাষ্ট্রের ওপর এবং সেই সাথে জাতিসংঘের ওপরও, কিন্তু এই সময়ে কোনাে রাষ্ট্রকে এগিয়ে এসে গণহত্যার বিচারের জন্য জাতীয়ভাবে আইন প্রণয়ন করতেও দেখা যায় নি। পরাশক্তির পক্ষ-বিপক্ষে বিশ্ব যখন বিভাজিত সেই পটভূমিকায় ১৯৭১ সালে গণতান্ত্রিক রায়কে অস্বীকার করে পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীর নৃশংস হত্যাভিযান শুরু হয়। বেসামরিক নাগরিকদের অবস্থানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান পরিচালনা এবং জাতিনিধনের অঘােষিত নীতি বাস্তবায়ন প্রচেষ্টা বাংলাদেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যার অবতারণা ঘটায়। নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ প্রাণ এবং তিন লাখ মা-বােনের সম্রমহানীর পটভূমিকায় উদিত হয় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। পাকবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও এই রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও জাতিসংঘে আসন খুব সহজে পায় নি।
ফলে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার জন্য যারা দায়ী আন্তর্জাতিক মহলের সহযােগিতায় তাদের বিচার অনুষ্ঠানের কাজটি সহজসাধ্য ছিল না। যে ১৯১ জন পাকিস্তানি সমরবাহিনী সদস্যকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদের ভারতীয় আটকখানায় বন্দি করে রাখলেও শেষ পর্যন্ত মুক্তি দিতে হয়। সিমলা চুক্তির আলােকে এই মুক্তি প্রকৃত অর্থে ছিল পাকিস্তানে আটক বেসামরিক বাঙালি নাগরিকদের সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক যুদ্ধবন্দিদের বিনিময়। মুজিব-ভুট্টো আলােচনার ভিত্তিতে এই বিনিময় বিষয়ে যে সমঝােতা হয় সেখানে ভূট্টো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি করবেন; কিন্তু সেই ওয়াদা তিনি পূরণ করেন নি। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে থাকলেও ১৯৭২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে অগ্রসর হয় এবং সংসদে দালাল (বিশেষ ট্রাইবুন্যাল) আইন গৃহীত হয়। মামলার সংখ্যাধিক্য এবং অন্যান্য বিবিধ কারণে পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, দালাল আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযােগে অভিযুক্ত ছাড়া বাদবাকিদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করেন। এই সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে, তবে এটা বিশেষভাবে লক্ষ্যযােগ্য যে এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের কোনােভাবে ক্ষমা করা হয় নি। বরং তাদের বিচার অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া চালু ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল দীর্ঘায়ত হওয়ার কোনাে সুযােগ ঘটে না, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন এবং সেই বছরের ২০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশ-বলে দালাল (বিশেষ ট্রাইবুন্যাল) আইনটি বাতিল করা হয়।
 
তবে অলক্ষ্যে থেকে যায় আরেকটি আইন যা গৃহীত হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১৬ জুলাই, যে-আইনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তাৎপর্য অপরিসীম এবং যা হতে ক্ষুন্ন হওয়ার নয়। বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস অ্যাক্টের সঙ্গে বিশ্বসমাজের যােগসূত্রের ওপর আমরা এখানে কিছুটা আলােকপাত করতে পারি। বাংলাদেশের আইনের তৃতীয় ধারায় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তিনশ্রেণীর অপরাধের বিচারের কথা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে ক, মানবসত্তার বিরুদ্ধে অপরাধ, খ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গ, জেনােসাইড। লক্ষণীয় মানবসত্তার বিরুদ্ধে অপরাধ বা ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটির ধারণাটি সঞ্জাত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের নাৎসি জার্মানি পরিচালিত জাতিনিধন তথা জেনােসাইডের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে। জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত নুরেমবার্গ আদালত ১৯৪৬ সালে যখন স্থির করে নুরেমবার্গ নীতিমালা তখন তারা বুঝতে পেরেছিল অপরাধের প্রচলিত ধারণা ও আইন দিয়ে জনগােষ্ঠী নিধনের নিষ্ঠুরতার পরিমাপ গ্রহণ বা বিচার সম্ভব নয়। সেই বিবেচনা থেকে জন্ম নেয় দুটি নতুন অভিধা- ক্রাইমস্ অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি এবং ক্রাইমস্ অ্যাগেইনস্ট পিস। মানবসত্তার বিরুদ্ধে। অপরাধের এই ধারণা পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের বীজমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে এবং যুদ্ধাপরাধের ধারণার সঙ্গে এই দুটি বিষয় যােগ করে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন প্রতিষ্ঠাকারীরা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, জেনােসাইড বা জাতিহত্যার ভয়াবহ অপরাধ রােধে চাই অনেক প্রসারিত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আইনের সেই মতাে সম্প্রসারণ।
 
বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইন প্রণেতারা নুরেমবার্গ নীতিমালা থেকে গ্রহণ করেছিলেন উপাদন এবং তা কেবল হুবহু উপস্থাপন করেন নি, তার একটি ঘাটতির দিকও পূরণ করেছিলেন। কোন্ কোন্ কর্ম মানবসত্তার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হবে তা উল্লেখকালে নুরেমবার্গ নীতিমালায় বলা হয়েছিল, “হত্যা, নিশ্চিহ্নকরণ, দাসকরণ, উৎখাতকরণ এবং এই ধরনের অমানবিক কাজ যা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে। বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে এই বাক্যের সঙ্গে আরাে কয়েক ধরনের অপরাধ কর্মের যােগ ঘটেছে, যেমন নির্যাতন, আটককরণ ও ধর্ষণ। বাংলাদেশের আইনের ভাষ্য নুরেমবার্গ। নীতিমালার প্রায় হুবহু অনুসরণ হলেও এই সংযুক্তির রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। নুরেমবার্গ নীতিমালার একটি ঘাটতির দিক ছিল সহিংস জাতিনিধন প্রক্রিয়া বা জেনােসাইডের সময় নারীর বিশেষভাবে নির্যাতিত নিগৃহীত হওয়ার দিকটি যথাযথ বিবেচনায় না নেয়া। তৎকালীন বিশ্বসমাজে নারীর প্রান্তিক অবস্থানের কারণেই বােধ করি পুরুষ-প্রাধান্যময় আইনবিশারদদের বিবেচনায় ধর্ষণের মতাে মানবতার চরম অবমাননাকর বিষয়টি আলাদাভাবে গুরুত্ব পায় নি। এর প্রতিফলন ১৯৪৮ সালের জেনােসাইড কনভেনশনেও লক্ষিত হয়, সেখানেও অপরাধ হিসেবে ধর্ষণ উল্লিখিত হয় নি, অথচ দেখা যায় সংঘাতকালে নিপীড়ক গােষ্ঠী সবসময় পদানত জাতির নারীদের বিশেষ আক্রোশ নিয়ে ধর্ষণ করেছে। অন্যদিকে ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশের আইন সেই ঘাটতি পূরণ করেছে এবং ১৯৯৮ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্টের সংবিধি মানবসত্তার বিরুদ্ধে অপরাধ-কর্মের তালিকা আরাে প্রসারিত করেছে এবং সেখানে ধর্ষণ ও নির্যাতন পৃথকভাবে বিশদ স্থান পেয়েছে।
 
লক্ষণীয় যে, অপরাধ কর্ম হিসেবে জেনােসাইডের যে সংজ্ঞা বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে দেয়া হয়েছে তা ১৯৪৮ সালের জেনােসাইড কনভেনশন প্রদত্ত সংজ্ঞার হুবহু অনুকরণ এবং এক্ষেত্রে বাক্য তাে দূরে থাকুক একটি শব্দেরও হেরফের ঘটে নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আরাে লক্ষণীয় যে, ১৯৯৮ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্টের সংবিধি ৬ ধারায় জেনােসাইডের যে সংজ্ঞা প্রদত্ত হয়েছে সেটাও ১৯৪৮ সালের জেনেসাইড কনভেনশন এবং ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশ আইনের একেবারেই অনুরূপ। | আজ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের যে-দাবি সর্বমহল থেকে। উত্থাপিত হয়েছে তা হয়তাে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন আলােড়ন ও ঢেউ সঞ্চার করছে কিন্তু এর বাস্তব ভিত্তি অনেক গভীরে প্রােথিত। এই শেকড় বিশ শতকের ইতিহাসের সেই গভীরে যখন আর্মেনীয় গণহত্যায় বিচলিত বােধ করেছিল বিশ্বসমাজ এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে জাতিনিধন প্রয়াসে নারীপুরুষ-শিশু তথা সাধারণজনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে প্রবলভাবে নাড়া খেয়ে তার মােকাবিলায় মানবতা ও আইনের শক্তিতে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিরােধ রচনায় হয়েছিল সচেষ্ট। এই প্রচেষ্টার প্রথম সংঘবদ্ধ রূপ প্রকাশ পায় ১৯৪৮ সালে গৃহীত জেনােসাইড কনভেনশনে, যে ঘােষণা ও বিধির ষাটতম বার্ষিকী পালন সূচিত হবে। ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ এই ষাটতম বার্ষিকী পালনে শরিক হবে তার নিজস্ব মাত্রা ও সংযােজন নিয়ে। আমরা আশা করবাে জেনােসাইড কনভেনশনের ষাটতম বার্ষিকী আমাদের উপলব্ধি ও চেতনায় গভীরতা বয়ে আনতে সহায়ক হবে, জেনােসাইড ও মানবসত্তার বিরুদ্ধে অপরাধ বিষয়ে সচেতনতা এবং এই অপরাধের শাস্তি বিধানে বিশ্বসমাজের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের অসমাপ্ত ঐতিহাসিক দায় মােচনের বড় সুযােগ মেলে ধরেছে। জেনােসাইড কনভেনশন (১৯৪৮) এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্ট (১৯৯৮)-এর মধ্যস্থানে সেতুবন্ধনের মতাে রয়েছে বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট (১৯৭৩)। এই তিনের মালিকা গেঁথে জেনােসাইড কনভেনশনের ষাটতম বার্ষিকী উদযাপনে সূচিত হউক আলােচনা, পর্যালােচনা ও বিশ্লেষণ।
 
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানাের লক্ষ্যে সেক্টর কম্যান্ডারস্ ফোরাম যে আহ্বান জানিয়েছে তা ব্যাপকতর ও গভীরতর করার জন্য জেনােসাইড কনভেনশন বার্ষিকী হয়ে উঠুক বড় অবলম্বন। সেক্টর কম্যান্ডারস্ ফোরামের আবেদনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার সারাৎসার প্রকাশ করে যে-কথাগুলাে বলা হয়েছে তা এখানে পুনরুল্লেখের দাবি রাখে। ফোরাম সরকারের নিকট দাবি উত্থাপন করে বলেছে, “সংবিধানের ৪৭-এর ৩ অনুচ্ছেদের মর্ম অনুযায়ী ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরােধী অপরাধ ও গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের বিচারের বিষয়টি নিশ্চিত করবার জন্য তদন্ত কমিশন গঠন এবং কমিশনের কার্যাবলীকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে স্থান দেবার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন অনুযায়ী terms of reference ঘােষণা। এ কাজটি সহজ ও ত্বরান্বিত করবার জন্য এখনই। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বরাবর সরকারের আবেদন উপস্থাপন এবং কতিপয় আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞকে (jurist) কমিশনের কাজে সম্পৃকরণ। International Crimes (Tribunal) Act XIX/73 অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন। করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ এবং ট্রাইব্যুনালের সাথে কমিশনের কাজকে সম্পৃক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংঘটিত অপরাধ (হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ এবং পরিকল্পিত গণহত্যা) সমূহের বিচারের ব্যাপারে অধ্যাদেশ জারি।”
একাত্তরের গণহত্যা ও জাতিনিধনযজ্ঞের জন্য যারা দায়ী, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা, তাদের আদেশদানকারী কর্তৃপক্ষ, ফিল্ড কম্যান্ডার এবং তাদের এ দেশীয় সহযােগীদের বিচারের আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট এবং এতে জোননাসাইডের জন্য দায়ীদের বিচারের পক্ষে উপযুক্ত সাক্ষ্য আইনের ভাষ্য যুক্ত রয়েছে আইনের ধারায় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পদ্ধতিও বিশ্লেষিত হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে এক বা একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রসিকিউটর নিয়ােগের নির্দেশ আইনে রয়েছে। তাছাড়া বলা হয়েছে যে, অপরাধ কর্মের তদন্তের জন্য সরকার। একটা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে সর্বোপরি জেনােসাইড ও মানবসত্তার বিরুদ্ধে। অপরাধের বিশেষ প্রকৃতি বিবেচনা করে রুলস অব এভিডেন্স সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সাক্ষ্যপ্রমাণের টেকনিক্যাল দিক নিয়ে ট্রাইব্যুনাল কোনাে বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ থাকবে না এবং যতােদূর সম্ভব কার্যোপযােগী ও নন-টেকনিক্যাল পদ্ধতি। গ্রহণ ও ব্যবহার করতে পারবে এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপাের্ট ও ছবিসহ যে কোনাে সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারবে। আরাে বলা হয়েছে যে, সাধারণভাবে যেসব। তথ্য অনেকের জানা তার জন্য কোনাে প্রমাণ হাজির করতে হবে না, তবে ট্রাইব্যুনাল সুবিচারিক দৃষ্টিতে এসব বিবেচনা করবে। রুলস অব এভিডেন্স ছাড়াও অন্য বিধানের ক্ষেত্রেও এই আইন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি সহজে, দ্রুত ও ন্যায়সঙ্গতভাবে সম্পন্ন করবার পথ মেলে ধরেছে।

সার্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণার ষাটতম বার্ষিকী বহু কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে পালিত হচ্ছে। জেনােসাইডের নির্মমতার শিকার। বাংলাদেশে মানবাধিকার ঘােষণার বার্ষিকী পালনের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে। আছে জেনােসাইড কনভেনশনের ষাটতম বার্ষিকী। তাই আমরা সঙ্গতভাবেই আশা। করবাে মানবাধিকার সংস্থা ও কর্মীবৃন্দ একে যুগল-বার্ষিকী হিসেবে পালন করবে। সেইসাথে আমরা প্রত্যাশা করি এই উপলক্ষে জেনােসাইড কনভেনশন পাবলিক । ডিসকোর্স বা ব্যাপক আলােচনার আওতায় আসুক, বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতার সঙ্গে জাতীয় অভিজ্ঞতা মিলিয়ে ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস্ অ্যাক্টও মানবাধিকার কর্মী ও সর্বমহলের বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত হউক। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনের পথে জাতির যে অভিযান তা গণহত্যাকারী, মানবসত্তার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাংলার মাটিতে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে অচিরেই, সেই আশাবাদ ও প্রত্যয় নিয়ে হাজির হয়েছে জেনােসাইড কনভেনশনের ষাট বছর। এই উপলক্ষ হয়ে উঠুক গভীরভাবে জেনােসাইড অনুধাবন ও অনুভবের। বছর, একই সাথে জেনােসাইডের অপরাধকর্মের জন্য দায়ীদের শাস্তিবিধানের বছর।

(মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়ােজিত অনুষ্ঠানে পঠিত, ১০ ডিসেম্বর ২০০৮)

সূত্রঃ  জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক