You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৯শে নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

সম্ভাবনাময় প্রথম যোজনা

গত পরশু দিন মঙ্গলবার বাংলাদেশের প্রথম পাঁচসালা উন্নয়ন পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। এতে মোট বরাদ্দ টাকার পরিমাণ ৪৪৫৫ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে মোট জাতীয় উৎপাদন প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে এবং আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বার্ষিক বৃদ্ধির হার হবে শতকরা সাড়ে পাঁচ ভাগ। মাথাপিছু আয় বাড়বে শতকরা প্রায় আড়াই ভাগ এবং প্রায় ৪১ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
সম্পূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়বে ১৭৫৭ কোটি টাকা। এ মোট বরাদ্দের শতকরা প্রায় ৩৯ ভাগ।
রূপকারদের মতে, চারটি রাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তিতে দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রেক্ষাপটেই এই পরিকল্পনা বিরচিত হয়েছে।
এছাড়াও দ্রব্যমূল্যের স্থিতিকরণ, বৈদেশিক নির্ভরতা হ্রাস, খাদ্য আমদানী কমানো, রপ্তানী বৃদ্ধি ইত্যাদি কয়েকটি লক্ষ্যে পৌঁছুনো যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
পরিকল্পনায় মোট বরাদ্দের মধ্যে সরকারী খাতে ধার্য হয়েছে মোট ৩৯৫২ কোটি টাকা। গত ১৯৬৫-৭০ সালের পর্যায়ের চেয়ে এবার বরাদ্দ শতকরা প্রায় ১০ থেকে ১৫ ভাগ বেশী।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে আভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে সরকারী খাতে ২৬৯৮ কোটি টাকা এবং ৫৮৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।
পরিকল্পনায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি উন্নয়ন সহ কৃষিখাতে সর্বোচ্চ পরিমাণ বরাদ্দ নির্দিষ্ট হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দ ১০৬৭ কোটি টাকা যা’ মোট বরাদ্দের প্রায় শতকরা ২৬ ভাগ।
শিল্পখাতে বরাদ্দ ৮৭৭ কোটি টাকা এবং এ মোট বরাদ্দের প্রায় ১৯ দশকি ৭ ভাগ।
বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক সম্পদ খাতে বরাদ্দ হয়েছে ৫২২ কোটি টাকা। এছাড়া, পরিবেশ উন্নয়ন ও গৃহ নির্মাণ খাতে ৪৫১ কোটি টাকা, পরিবহন খাতে ৫৯৪ কোটি টাকা, যোগাযোগ খাতে ১১৪ কোটি টাকা, শিক্ষা ও জনশক্তি খাতে ৩১৬ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ খাতে ২২০ কোটি টাকা, পরিবার পরিকল্পনা খাতে ৭০ কোটি টাকা, সরকারী প্রশাসন খাতে ২৬ কোটি টাকা, বাণিজ্য খাতে ১৭০ কোটি টাকা ও বিবিধ সার্ভিস খাতে ২৮ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ দেখানো হয়েছে।
এ পরিকল্পনায় ঋণের সুদের পরিমাণ ৩৫০ কোটি টাকা, আমদানী ব্যয় ৩৫৭৮ কোটি টাকা, রপ্তানী আয় ২১২৯ কোটি টাকা, ঘাটতি ১৪৪৯ কোটি টাকা এবং নতুন কর ৬২৫ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে।
রূপকারেরা মোট ১২টি উন্নয়ন লক্ষ্যে পৌঁছুনোর প্রস্তাব দিয়েছেন তবে তার মধ্যে দারিদ্র লাঘব সহ খাদ্য আমদানী হ্রাস, আমদানীর বিকল্প উদ্ভাবন ও রপ্তানী বৃদ্ধি করে দায় পরিশোধের অবস্থা উন্নত করাই প্রধান।
যাহোক, এই হচ্ছে আমাদের প্রথম পাঁচসালা উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি মোটামুটি চিত্র। এখন এর কয়েকটি দিক নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
প্রথমেই ধন্যবাদ জানাতে হয় পরিকল্পনা কমিশনের যে সব রূপকারেরা এতো পরিশ্রম স্বীকার করে আমাদের জাতীয় উন্নয়নের জন্যে এমন একটি কল্যাণমূলক পরিকল্পনা বিরচন করেছেন তাদের।
কারণ, স্বাধীনতার পর মাত্র দেড় বছরের মধ্যে এমন একটি জটিল ও দুরূহ কাজ সমাধা করা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। বিশেষ করে, অন্যান্য দিকের চেয়ে কমিশনের রূপকারেরা কৃষি উন্নয়নের দিকে যে সমধিক নজর দিয়েছেন তাতে তাদের দূরদর্শিতারই পরিচয় পাওয়া যায়।
তবুও, বর্তমান কৃষি বরাদ্দ আরো একটু বেশী হলে তা’ আমাদের আরো উপকারে আসতো বলে আমাদের মনে হচ্ছে। কারণ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের দেশের শতকরা ৯০ জন লোকই কৃষি-নির্ভরশীল। সুতরাং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি গঠনের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় উন্নয়নের যে কোনো পরিকল্পনায় কৃষি বরাদ্দ পর্যাপ্ত হওয়া উচিত। তাই বর্তমানের শতকরা ২৬ ভাগ বরাদ্দ আমাদের কাছে অপর্যাপ্ত মনে হচ্ছে।
আগে শিল্প, পানি, শিক্ষা, জনশক্তি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যে দীর্ঘ অবহেলা আমরা গত ২৪ বছর ধরে পাক আমলে লক্ষ্য করে এসেছি, তা’ এ পরিকল্পনায় সম্পূর্ণ হটিয়ে দিয়েছে বলে আমরা অত্যন্ত আশান্বিত।
তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রথমেই উৎপাদনের দিকে সবচেয়ে বেশী দৃষ্টি দিতে হবে। বিশেষ করে, শিল্প ও কৃষি উৎপাদনের সবচেয়ে বেশী নজর দিতে হবে।
কারণ, উৎপাদন না হলে রপ্তানী বাড়বে না বা আভ্যন্তরীণ চাহিদাও মেটানো সম্ভব হবে না। আবার রপ্তানী না বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব হবে না কিম্বা দেশের বৃহৎ প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
আবার, উৎপাদন বৃদ্ধির যে কোনো উদ্যোগ সফল করতে হলে প্রথমেই আইন শৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ বিধান করতে হবে। তা’ না হলে উৎপাদন সর্ব সময়েই ব্যাহত হতে থাকবে এবং উৎপাদন ব্যাহত হলে কোনো লক্ষ্যে পৌঁছুনোই সম্ভব হবে না।
এ প্রসঙ্গে আমরা আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের উপদেশকে সশ্রদ্ধ স্মরণ করতে চাই।
তিনি বলেছেন যে, প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা আগামী ৫ বছরের জন্যে জাতির পথ নির্দেশিত করে দিয়েছে। সুতরাং এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে কঠোর পরিশ্রম ও প্রয়োজনীয় আত্মত্যাগ একান্ত অপরিহার্য। কারণ, দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকারে অকুন্ঠ না হলে পরিকল্পনা যতোই সুসংঘবদ্ধ হোক না কেন তা কোনো দিনও প্রকৃত সফলতা অর্জন করতে পারে না।

বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক আদমজী মিল পরিদর্শন প্রসঙ্গ

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরা গণভবনে তিনদিন অবস্থান করার পর ঢাকায় ফিরে আসার পরের দিনই আকস্মিকভাবে আদমজী মিল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। উত্তরা গণভবনে অবস্থানকালেও তিনি আকস্মিকভাবে কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করতে বেরিয়েছিলেন। মাঝে মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন স্থান এভাবে পরিদর্শন করে থাকেন। এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম বলে আমাদের অভিমত।
বঙ্গবন্ধু আদমজী মিল সরেজমিনে দেখতে যাবার সময় তার সঙ্গে শিল্পমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী সহ অন্যান্য কয়েকজন মন্ত্রীকেও নিয়েছিলেন। আদমজী মিলের প্রশাসনিক ও উৎপাদনের অব্যবস্থাজনিত তথ্যসমূহকে স্বয়ং সরেজমিনে তদন্ত করার জন্যেই বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক এ পরিদর্শন। সংবাদে প্রকাশ, মিলের জেনারেল ম্যানেজার ও চারজন ম্যানেজারকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আটচল্লিশ ঘন্টার জন্যে মিল বন্ধ রেখে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির দ্বারা তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পূর্বাহ্নেই মিলের সকল নথিপত্র আটক করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদমজী মিল পরিদর্শন ও তার অব্যবহিত কারণ ও প্রতিক্রিয়া দেশব্যাপী একটি বিশেষ প্রভাব বিস্তার করবে বলে আমাদের ধারণা। জানা গেছে যে, বর্তমানে মিলে পচা পাট ব্যবহৃত হচ্ছিলো এবং তার দরুণ মিলের উৎপাদন কাজে ব্যাঘাত ঘটছিলো। এছাড়াও পাট ও পাটজাত দ্রব্যের অপচয় হচ্ছিলো বলেও অভিযোগ এসেছে। সরেজমিনে এ সকল অব্যবস্থা দেখবার জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে আদমজী মিলে যেতে হয়েছিলো। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসার তাড়নায়ই বঙ্গবন্ধুকে সবগুলো মন্ত্রণালয়ের প্রতি সচেতন দৃষ্টি রাখতে হয়। আদমজী মিলের উৎপাদন নিয়ে অনেকদিন ধরে নানা প্রকার ঘাপলা চলে আসছে। এ নিয়ে আমরা বহুবার আমাদের মতামত জানিয়েছি। আদমজী দেশের সবচেয়ে বড় মিল। দেশের অর্থনীতির উপর আদমজী মিলের প্রভাব অনেকখানি। স্বাধীনতার পর থেকেই চেষ্টা করা হয়েছে এই মিলটিকে উৎপাদনক্ষম করে তোলার জন্যে। কিন্তু নানা প্রতিকূল কারণ অবিরাম চালু রাখা সম্ভব হয়নি। কখনও প্রশাসনিক অক্ষমতা কখনও শ্রমিক অসন্তোষের দরুণ মিলটি কখন চালু কখনও উৎপাদন ব্যাহত হয়ে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ও আদমজী মিলের সকল অব্যবস্থা কাটিয়ে অবিরাম চালু রাখতে উল্লেখযোগ্য কোনো যোগ্যতার নিদর্শন জনসমক্ষে দেখাতে পারেননি। সর্বোপরি গোটা শিল্পখাতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের তেমন উল্লেখযোগ্য কৃতকার্যতার নিদর্শন দেশবাসী দেখতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু আদমজী মিলের ব্যাপারে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, সে কাজটি ইতিপূর্বে শিল্প মন্ত্রণালয়ও গ্রহণ করতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুকে যদি সবগুলো মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে কোনো কাজে উদ্যোগী হতে হয় তাহলে ঐ মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মতৎপরতা প্রকাশ পায়না। বহুদিন পূর্বেই আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে সচিবালয়ে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজ পরিদর্শন করতে। তখনও কয়েকজন কর্মকর্তাকে তাদের আসনে না দেখে সাসপেন্ড করেছিলেন তিনি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো মন্ত্রীকেই আমরা তাদের স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের ফাঁকিবাজ কর্মকর্তাদের কাজকাম পরিদর্শন করে দেখতে শুনিনি। অথচ আমরা জানি, সচিবালয়ের অধিকাংশ সচিব সাহেবরা কি পরিমাণ কাজ করেন আর কি পরিমাণ ফাঁকি দিয়ে থাকেন। আমাদের বিশ্বাস, বিভাগীয় মন্ত্রীরা যদি নিজেদের যোগ্যতা আরো বেশী প্রমাণ করতে পারতেন তাহলে তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রের বহু জঞ্জাল পরিষ্কার হয়ে যেতো। বঙ্গবন্ধু সব দেখছেন—এটা কোনো মতেই হতে পারেনা। তবু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের একমাত্র আশাভরসা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁর শারীরিক সুবিধা-অসুবিধার ঊর্ধ্বে মানুষের সকল দাবী তার কাছেই। বঙ্গবন্ধুর এই আকস্মিক সফরের পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য মন্ত্রীরাও তাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে তৎপর হবেন বলে আমরা আশা করছি। আদমজী মিলের প্রশাসন ব্যবস্থা কলুষমুক্ত করে একে পরিপূর্ণভাবে চালু করার জন্যে সরকারের সকল শক্তি ও কৌশল নিয়োগ করবেন বলেও আমরা বিশ্বাস পোষণ করছি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!