বাংলাদেশে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ শহীদ হয়েছিলেন সেটা আরাে চুলচেরাভাবে পর্যালােচনা করা যেতে পারে। তবে একাত্তরের বাংলাদেশে যে মানবতার বিরুদ্ধে বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল সেটা নিয়ে কোনাে বিতর্কের অবকাশ নেই। এমনি জঘন্য অপরাধের জন্য দায়ী কারা সেই প্রশ্ন তােলা হলে আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে আমরা জবাব বিশেষ খুঁজে না। বিশ শতকের ইতিহাসের প্রধান গণহত্যার একটি সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশে। কিন্তু নানকিং গণহত্যার মতাে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত এই বিশাল অপরাধকেও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার প্রবল প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। মুছে ফেলার এই অপচেষ্টায় সহায়ক হিসেবে কাজ করে সেই সামাজিক অবস্থান যা ঘটনাকে দেখতে চায়। অনেক দূরের ব্যাপার হিসেবে, বর্তমানের সঙ্গে যার কোনাে যােগ দেখতে পারগ। নয়। নানকিং গণহত্যা যে বিস্মৃত গণহত্যা হয়ে উঠেছিল তার কারণ খুঁজতে গিয়ে অধিকতর বিস্মিত হয়েছেন আইরিশ চ্যাং। তার মনে হয়েছিল, “দৃশ্যত মানুষের প্রকৃতিতে এমন কতক দিক রয়েছে যা অকথ্য অত্যাচারের ঘটনাকেও দ্রুত মামুলি ব্যাপার করে ফেলে, তবে সেটা করতে হলে ঘটনাটিকে ঘটতে হবে অনেক দূরে এবং এর থেকে ব্যক্তিগতভাবে কোনাে হুমকি দেখা দেয়ার করেন থাকবে না।” বিশ্ববাসীর জন্য বাংলাদেশের ঘটনা ছিল ভৌগােলিকভাবে অনেক দূরের, অর্থনৈতিক বা সামাজিকভাবেও বাংলাদেশ প্রান্তিক দেশ, বিশ্বসভায় জায়গা করে নেয়ার ক্ষমতাহীন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালির দুর্গতি ও প্রতিরােধ স্পৃহা পশ্চিমী গণমাধ্যমের সুবাদে বিশ্ববাসীর নজর কাড়লেও রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার জন্য দায়ীদের বিচার করা নিয়ে বিশ্বের সরকারসমূহের কোনাে মাথাব্যথা ছিল না।
আর আমাদের দেশের একশ্রেণীর দ্রগােষ্ঠীর জন্য সময়বিচারেও এটা হয়ে পড়েছে। অনেক দূরের, তিরিশ বছর আগের ঘটনা। এর থেকে উদ্ভূত ব্যক্তিগত হুমকি আর নেই, বরং এই দুঃখস্মৃতি জাগিয়ে তুললেই বর্তমান বিত্ত ও সাফল্য অর্জনের পথে দেখা দিতে পারে অনেক ধরনের কাঁটা। তাই গণহত্যা বিস্মৃত অধ্যায় করে তুলতে সামাজিক সমর্থন মিলছে নানাভাবে তদুপরি বাংলাদেশের গণহত্যা তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণের শিকার হয়েছিল। একাত্তরের বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ ছিল তুঙ্গে দুনিয়াজোড়া প্রভাব বিস্তারের জন্য মস্কো ও ওয়াশিংটন চেষ্টা চালাচ্ছিল প্রায় মরীয়াভাবে। তাই বাংলাদেশের সঙ্কট বিশ্ব রাজনীতিতে নৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয় নি, এটা প্রতিভাত হয়েছিল উপমহাদেশে মার্কিনী আধিপত্য দুর্বল করে সােভিয়েত-ভারত প্রভাব বৃদ্ধির। প্রয়াস হিসেবে ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবনদান পশ্চিমী রাজনৈতিক বলয়ে মানবিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার বদলে এমনি ধরনের রাজনীতিক প্রশ্নই সেখানে। মুখ্য হয়ে উঠেছিল একাত্তরের মুসলিম বিশ্বও ছিল পশ্চিমের একান্ত অনুগত এবং বিশ শতকের বৃহত্তম মুসলিম নিধনের ঘটনায় তারা মােটেই বিচলিত বােধ করে। নি, বরং পাকিস্তানি শাসকচক্রের ইসলামী বুলি তাদের সুপ্তিভাবকে আরাে গভীর করে তুলেছিল |কিন্তু তারপর থেকে অনেক জল বয়ে গেছে পদ্মা-ভলগা-মিসিসিপি নদী দিয়ে।
একাত্তরের পরও বিশ্বে গণহত্যা সংঘটন অব্যাহত রয়েছে। তবে নব্বইয়ের শুরুতে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ধস নামায় বিশ্বের অতীত বিভাজন লােপ পেলে গণহত্যা মােকাবিলায় বিশ্বসমাজকে সম্মিলিতভাবে অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা। যায়। একাত্তরের বাংলাদেশের পর সংঘটিত তিনটি প্রধান গণহত্যার মােকাবিলায় রাজনীতি ছাপিয়ে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ তাই অনেক সহজ হয়েছে কাম্পুচিয়া, সাবেক যুগােশ্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার গণহত্যা বিষয়ে বিশ্বসমাজের প্রতিক্রিয়া অতীত। গ্লানি মােচনের প্রয়াসী হয়েছে। ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘােষণা গ্রহণের পর থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর জাতিসংঘ মানবতার বিরুদ্ধে কোনাে অপরাধ বিষয়ে ন্যায়প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয় নি। একটি ব্যতিক্রম বােধ করি বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা, আন্তর্জাতিক জনমত এবং এশিয়া-আফ্রিকার দেশসমূহের প্রবল চাপে অবশেষে ১৯৭৬ সালে নিরাপত্তা পরিষদ বর্ণবাদকে শান্তির প্রতি হুমকি’ হিসেবে ঘােষণা করে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবরােধ জারি করে তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল একেবারেই ব্যতিক্রমী রাষ্ট্র এবং স্বাধীন আফ্রিকার বুকে তার চরম অমানবিক শাসনের সাফাই গাওয়া কোনাে দেশের পক্ষেই সম্ভব ছিল না।
কিন্তু মানবতার বিরুদ্ধে কোনাে অপরাধীকে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে দেখতে বিশ্ববাসীকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক দীর্ঘকাল ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতভাবে সাবেক যুগােশ্লাভিয়ায় ১৯৯১ সাল থেকে সংঘটিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারার্থে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। একাত্তর সালের বাস্তবতা থেকে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৯৩-তে এসে পৌঁছেছিল বিশ্বসমাজ, এবং তারই প্রকাশ ঘটলাে এই সিদ্ধান্তে ধীরগতি হলেও সেই সিদ্ধান্তের বাস্তব রূপায়ন। শুরু হয়ে গঠিত হয় হেগ ট্রাইবুন্যাল এবং ১৯৯৫ সালে সেখানে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রথম অভিযুক্ত হন ডুসকো তাদিক। ১৯৯৭ সালে মানবতার বিরুদ্ধে এগারােটি বিভিন্ন অপরাধের জন্য তাদিকের কুড়ি বছরের কারাদণ্ডাদেশ ঘােষিত হয়। হেগ ট্রাইবুন্যাল যখন সাবেক যুগােশ্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধের জন্য শাস্তি বিধানে উদ্যোগ নিয়েছে তখনও বসনিয়ায় অব্যাহত ছিল গণহত্যা ও পীড়ন। পাশাপাশি ১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে রুয়ান্ডায় টুটসি জনগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যায় নিহত হয় আট লক্ষ মানুষ ১৯৯৫ সালে রুয়ান্ডায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত হয় আরুশা ট্রাইবুন্যাল জাতিসংঘের সামনে এখন বড় এজেন্ডা হয়ে আছে কাম্পুচিয়া গণহত্যা সংঘটনকারীদের বিচারের ব্যবস্থা।
কাম্পুচিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জটিলতার কারণে এক্ষেত্রে অগ্রগতি খুব দ্রুত না হলেও, আমরা আশা করতে পারি, এইসব নারকীয় হত্যালীলার জন্য যারা দায়ী আন্তর্জাতিক উদ্যোগে তাদের শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা হবে। মানবতার চেতনা রক্ষায় আন্তর্জাতিক উদ্যোগে বড় ধরনের মােড় ফেরা আমরা লক্ষ্য করি নব্বইয়ের দশকে, যার বাস্তবায়ন ঘটেছে পূর্বোল্লিখিত দুটি ট্রাইবুন্যালে। এই সব অভিজ্ঞতার জের ধরে ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে রােম সম্মেলনে বিশ্বের ১২০টি দেশ সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্ট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সম্মেলনের তিন মাস পর লন্ডনে গ্রেফতার হলেন চিলির সাবেক শাসক অগাস্টো পিননাশে তার দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে হত্যা ও পীড়নের কারণে পিননাশে নিজ দেশের সিনেটে আইন পাশ করে তাকে এমনি ধরনের বিচারের ঊর্ধ্বে ঘােষণা করেছিলেন, অনেকটা বাংলাদেশের সংসদে অনুমােদিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের আদলে। ক্ষমতা ছাড়ার পর তিনি অনেকবারই লন্ডনে এসেছেন গেছেন, কেউ তার গাত্ৰস্পর্শ করার কথাও ভাবতে পারে নি।
কিন্তু ১৯৯৮ সালে তাকে যে গ্রেফতার করা হলাে, পরবর্তী ভাগ্য যাই হােক, সেটা আন্তর্জাতিক আবহে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কার্যকারিতা শুরু হতে এখনও ঢের বাকি প্রাথমিকভাবে প্রবল বিরােধিতার পর বিদায়কালে ক্লিনটন প্রশাসন এর অনুমােদন প্রকাশ করে গেছে। তবে মার্কিন কংগ্রেসে সেই প্রস্তাব গৃহীত হবে কি না সে-বিষয়ে অভিজ্ঞজনদের সন্দেহ রয়েছে। বাংলাদেশ রােম কনভেনশনের স্বাক্ষরদাতা হিসেবে গণহত্যার শিকার জাতি হিসেবে আপন সহমর্মিতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। বােধগম্য কারণে পাকিস্তান এখন পর্যন্ত স্বাক্ষরদান থেকে বিরত রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নীতিমালায় অবশ্য আদালত প্রতিষ্ঠা পূর্ববর্তী অভিযােগ বিবেচনার বাইরে থাকবে বলা হয়েছে। তাই আমরা বুঝতে পারি, আইসিসি গঠিত হলেও তা একাত্তরের গণহত্যার বিচার করতে সক্ষম হবে না। আইসিসি যদি পেছনে তাকাতে সম্মত নাও হয় তবু এর গঠন পেছনের প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসবে নিশ্চয় আর সেটা হবে এক বড় অগ্রগতি বাংলাদেশে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচার আজ না হােক, কোনাে একদিন হতেই হবে-সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলাে সেই আশাবাদ নানাভাবে জোরদার করছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কথাটা একাত্তর সালের জাতিসংঘে কখনাে শােনা যায় নি, কেননা সেটা তখন ছিল এতােটাই ফাকা বুলি যে তা উচ্চারণেও কেউ আগ্রহী ছিলেন না আজ এই ধরনের অপরাধের বিচারের প্রশ্ন বাস্তব অবয়ব লাভ করছে, অপরাধের ক্ষেত্রগুলাে আরাে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হচ্ছে।
অপরাধ সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে এমনি একটি নতুন ধারণা হচ্ছে ধর্ষণজনিত অপরাধ নুরেমবার্গ কিংবা টোকিও বিচারশালায় ধর্ষণের অভিযোেগ কখনাে বিবেচনায় নেয়া হয় নি। কিন্তু হেগ ট্রাইবুন্যাল প্রথমবারের মতাে ধর্ষণকে একটি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ট্রাইবুন্যাল দেখেছে নারী এখানে নিছক একক ব্যক্তি হিসেবে ধর্ষিত হন নি, অধিকন্তু হয়েছেন জাতিগত বৈরিতার শিকার। একাত্তরেও পাকবাহিনীর নারী ধর্ষণের লক্ষ্য ছিল পাইকারিভাবে বাঙালি নারী ধর্ষণ এবং এভাবে বাঙালি জাতিকে সমুচিত শিক্ষা দেয়া এই অপরাধ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে এখন আন্তর্জাতিকভাবে আইনগত স্বীকৃতি অর্জন করেছে। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় একই সূত্রে গাঁথা একাত্তর সালের তিনটি পৃথক ঘটনা মুক্তিযুদ্ধকালের পাকিস্তানি পীড়নের চিত্র তুলে ধরে বিলেতের সানডে টাইমস লিখেছিল : “নিরুদ্দিষ্ট লােকজনের আত্মীয়-স্বজন মনে করেন রাজাকার ও অধস্তন সেনা অফিসাররা অবাঙালিদের সঙ্গে যােগসাজশে স্বাধীনভাবে কাজ করছে রাজাকাররা এখন খুন, জবরদস্তি অর্থ আদায় থেকে পতিতা-ব্যবসা পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটিয়েছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে তারা তরুণীদের নিয়ে ক্যাম্প করেছে, সিনিয়র অফিসারদের ভােগের জন্য রাতে সেসব মেয়েদের পাঠানাে হয়।
নিজেদের পার্টির আয়ােজনের জন্য তারা মেয়ে অপহরণের কাজও করছে।” এই রিপাের্টের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র সপ্তম খণ্ডে দেখতে পাই ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ জামাতে ইসলামী নেতা গােলাম আজম বলেছেন, “বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করার জন্য একমনা ও দেশপ্রেমিক লােকেরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছেন সেই খবরে আরাে উল্লেখ করা হয়, “রাজাকাররা খুবই ভালাে কাজ করছেন বলে তিনি গােলাম আজম] উল্লেখ করেন।” একই খণ্ডে ২১ আগস্ট ১৯৭১ পশ্চিম পাকিস্তানের লতিফাবাদ থেকে যশােরে কর্মরত বন্ধু মেজর মােহাম্মদ ইকরাম খানকে লেখা মেজর সাকিবের পত্র ছাপা হয়েছে। সাকিব তার বন্ধু মেজরকে লিখেছেন, “রশিদ যে বাঙালি বাঘিনীকে পােষ মানাচ্ছে সে-খবরে আমি অবাক হই নি। ওদের বাঙালিদের পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথে আনতে এটা একান্ত আবশ্যক।” এই মেজর চিঠিতে তার পারিবারিক বিভিন্ন খবরাখবর জানিয়েছেন। ছেলেরা হাসপাতাল থেকে ফিরেছে, ক্ষেতে আখ বড় হয়েছে, অভিন্ন এক বন্ধু সিনেমা প্রজেক্ট চালু করেছে ইত্যাদি জানিয়ে আবার এক নিশ্বাসে লিখেছেন, “ইতিমধ্যে তুমিও সেখানে বাংলাদেশে কতক বন্য কুকুরী পােষ মানানাের সযত্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করাে।” বাঙালি নারী এই পাকিস্তানি। মেজরের কাছে কুকুর ছাড়া আর কিছু নয়, এদের ধর্ষণে কোনাে মানবিক পীড়ন বা বিকার তাই তাদের মনে ঘটে না, সেটা ঘরে কুকুরী পােষারই সমতুল্য।
এই চিঠি প্রকাশ করেছে আপাত-ভদ্র মানুষদের পশুবৎ মানসিক গড়ন, যেই গড়নের কারণে তারা যথেচ্ছ হত্যা ও ধর্ষণে মেতে উঠে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হিসেবে গণ্য হয়। বিলেতের সম্রান্ত আইনজীবী কুইন্স কাউন্সিলার জিওফ্রে রবার্টসন তার ক্রাইমস এগেইনস্ট হিউম্যানিটি : দি স্ট্রাগল ফর গ্লোবাল জাস্টিস গ্রন্থে লিখেছেন যে, সার্বরা বসনীয় মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করেছিল ইথনিক ক্লিনজিং-এর উপায় হিসেবে একাত্তরে বাঙালি মুসলিম নারী ধর্ষণকারী পাকিস্তানি মেজরের মানসিকতা এর থেকে যে পৃথক ছিল না তা’ ওপরের পত্রে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। জিওফ্রে রবার্টসন দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, “দি সিস্টেমেটিক রেইপ অব এন এস্টিমেন্টেড টু হান্ড্রেড থাউজ্যান্ড বেঙ্গলি উইমেন বাই পাকিস্তানি সােলজার্স ইন নাইন্টিন সেভেন্টি-ওয়ান ওয়েন্ট এনটায়ারলি আনপানিশড়।” ধর্ষণকারী সার্ব নেতাদের দাড়াতে হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায়, কিন্তু ধর্ষণকারী পাক মেজর অব্যাহতি পাবেন, কারণ আমাদের আধুনিক দৃষ্টিতে তিনি তাে ভালাে মুসলমান রাজাকাররা খুব ভালাে কাজ করেছে, বাঙালি মেয়েদের তারা তুলে দিয়েছে। অফিসারদের হাতে, কুকুরীসম বাঙালি নারীদের ধর্ষণ তথা পােষ মানানাের কাজে মন দিয়েছিলেন মেজর সাহেবরা, তাদের কাজ আরাে দ্বিগুণ ভালাে, এভাবে তারা বাঙালি জাতিকে কাক্ষিত ধর্মচেতনায় উর্বর করবেন, এজন্যই বলেছেন অধ্যাপক গােলাম আজম, ঐ একই বক্তৃতায় উল্লেখ মেলে, “কোনাে ভালাে মুসলমানই তথাকথিত ‘বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না। তাই ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত মিশে গেছে বাংলার কাদামাটির সঙ্গে, বাতাসে মিলিয়ে গেছে দুই লক্ষ ধর্ষিত মা-বােনের হাহাকার, কোথাও কোনাে ক্ৰন্দন নেই, এই তাে সময় জাতীয় ঐক্য গড়ার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বলে কোনাে কিছু থাকবে না, সমস্ত পাপাচার এখন ঢাকা পড়ে যাবে বিস্মৃতির গভীরে কিন্তু তারপরও তাে বেজে ওঠে ঘণ্টাধ্বনি, কোনাে মানুষ নয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, সময়ের স্রোতধারা থেকেও সে-তাে পৃথক কিছু নয় বিশ্বসমাজের মানবিক হয়ে ওঠার সংগ্রাম ও সাধনার তাে অন্ত নেই।
ফিরে ফিরে উঠে আসছে বিশ শতকের গণহত্যার সঙ্গে মানবসমাজের বােঝাপড়ার প্রশ্ন পরবর্তী বাঙালি প্রজন্মকে সঠিক পথে আনতে তাদের নারীদের ধর্ষণ করার যে বক্তব্য পাকিস্তানি মেজরের, যার নাম-ঠিকানা পত্রে রয়েছে, যশােরে নারী ধর্ষণে লিপ্ত তার বন্ধু যে মেজর, তার বিস্তারিত ঠিকানাও পত্রে রয়েছে, এরা বর্তমান আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী। নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধাপরাধী এবং এদের ভালাে মুসলমান হিসেবে অভিহিত করেন। যিনি তিনিও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে ইন্ধন যােগাবার জন্য যুদ্ধাপরাধে নিজেকে শরীক করেন। সময় যতাে যাবে বাংলাদেশ ততােই তীরে চিৎকার করে চলবে : একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছিল কারা? কারা? যদি তারা হয়ে থাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী, ক্রাইমস্ এগেইনস্ট হিউম্যানিটির জন্য তাদের কি বিচার হবে না? পৃথিবী একাত্তরে আটকে নেই, প্রবেশ করেছে একবিংশ শতকে আর সেইসঙ্গে বয়ে আনছে নতুন ও উন্নততর মানবিক চেতনাবােধ, যে-বােধ দ্বারা তাড়িত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিভিন্ন ট্রাইবুন্যাল, গঠিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আর তাই, অশেষ বিলম্বে হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার ইতিহাসের মানবিক পরিণতি হিসেবে। আন্তর্জাতিক রীতি ও বিধান অনুসারে যুদ্ধাপরাধের বিচার সুনিশ্চিতভাবেই ঘটবে সেটা কাঠগড়ায় মূর্ত হওয়ার আগে বাংলার জনমানস বিশেষভাবে নবীনের চেতনায় যুদ্ধাপরাধের প্রতি ধিক্কার সরব হয়ে উঠতে হবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নিষ্ঠুরতা থেকে জেগে-ওঠা বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে শান্তির চেতনা জোরদার করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ইউনেস্কোর ঘােষণার শুরুতে লেখা হয়েছিল, যুদ্ধ সূচিত হয় মানুষের মনে, তাই মানুষের মন থেকে যুদ্ধের ধারণা লােপ করতে হবে। সেইভাবে আমরা বলতে পারি, যুদ্ধাপরাধের বিচারের সূচনা ঘটে মানুষের মনে। এবং মানুষের মনের রায় কোনাে একদিন পরিণতি খুঁজে পাবে আন্তর্জাতিক বিচারসভার কাঠগড়ায় ।
সূত্রঃ জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক