You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২০শে জানুয়ারী, ১৯৭৩, শনিবার, ৬ই মাঘ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

সারা অঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কিসে!

বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি রয়েছে এটা বাস্তব সত্য। এ সত্যকে মেনে নিয়েই আমাদেরকে এগুতে হবে। বাহাত্তর সন কেটে গেলেও তিয়াত্তর সনে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতির সমস্যা বাংলাদেশেও যে পড়বে না এমন কথা আওয়ামী লীগ সরকার সেদিকে সামনে রেখেই সাধ্যমত চেষ্টা করছেন খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য। জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের কাছে বঙ্গবন্ধু বিশেষ আবেদন করেছেন। সেক্রেটারী জেনারেল ১৪ লক্ষ টন খাদ্য সরবরাহ করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে অনুরোধও করেছেন। কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও ১১ লক্ষ টন চাল কেনার জন্য ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
সড়ক চলাচল সমস্যা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চালের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও সরকার দেশের আভ্যন্তরীণ খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাঁধা-বিঘ্ন সত্ত্বেও খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা হবে। সরকারী সূত্র থেকে বলা হয়েছে যে, বার্মা থেকে ২২ হাজার টন এবং থাইল্যান্ড থেকে আমদানী করা ৩০ হাজার টন চাল সরবরাহ হাতে রয়েছে। এ চালের কিছু খাদ্য ইতিমধ্যেই বিতরণ করা হয়েছে এবং বাকী অংশও আসার পথে রয়েছে। এতদ্ব্যতীত এ বছরের মে মাসের মধ্যে ১ লাখ টন চাল সরবরাহের উদ্দেশ্যে সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কন্টিনেন্টাল গ্রেন কোম্পানীর সাথে একটি চুক্তি করেছেন।
সরকারী সূত্র হতে আরো জানানো হয়েছে যে, ‘যে কোন মুহূর্তে জাহাজযোগে সরবরাহ করা যেতে পারে’ এ রকম অবস্থায় জাপান সরকার ১২ হাজার ৫০০ টন খাদ্যশস্য সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছেন।’
দেশে সামগ্রিক খাদ্য পরিস্থিতির এই হলো বাস্তব অবস্থা। অথচ দুঃখের সঙ্গেই আমাদের বলতে হচ্ছে যে, সাময়িক বিঘ্নিত সরবরাহের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর লোক রেশন ডিলারদের সহায়তায় শহরে খাদ্য সংকট সৃষ্টির অপচেষ্টায় মেতে উঠেছে। এদেরই অপচেষ্টার ফলে রেশন দোকানে চাল না পাওয়া গেলেও খোলা বাজারে ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে। এই অসাধু ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ সরকারী কর্মচারীদের বদৌলতেই চালের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। রেশনের দোকানে চাল নেই, চাল দেওয়া হচ্ছে না বলে ধুয়ো তুলে নেপথ্যে মুনাফা লুটবার ফন্দি ফিকিরে ব্যস্ত রয়েছে সেই সব অসাধু ব্যক্তিরা। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হলো একশ্রেণীর রেশন ডিলার গত দুই সপ্তাহে সরবরাহ ও অন্যান্য কারণে চালের স্বল্পতার বিষয়টি জনসাধারণকে না জানিয়ে ‘চাল নেই’ বলে জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে এবং উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাবার জন্য তড়িঘড়ি কতিপয় রেশন ডিলার এক সাংবাদিক সম্মেলনেও বিবৃতি-বক্তৃতা দেয়। সংবাদে দেয়, গত ৭ই জানুয়ারী থেকে ১৩ই জানুয়ারী পর্যন্ত শহরের ৬ শতটি রেশন দোকানে প্রায় ৪০ হাজার মণ চাল সরবরাহ করা হয়। ঢাকা শহরে প্রতি সপ্তাহে ৭৮ হাজার মণ চাল প্রয়োজন রেশনের দোকানের জন্য। অথচ প্রায় অর্ধেকেরও বেশী চাল রেশন দোকানে সরবরাহ করা সত্ত্বেও ‘চাল নেই’ এ রব উঠলো কেন তার একটা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। শুধু তাই নয় ১৪ই জানুয়ারীর পরেও ৩১ হাজার মণ চাল সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এমতাবস্থায় গত দুই সপ্তাহে পরিস্থিতি শান্ত ও ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলার করার পরিবর্তে জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি কেন করা হলো এবং তারই ফলশ্রুতিতে খোলাবাজারে চালের দাম কেন আকাশচুম্বী হলো এবং এ সব ন্যক্কারজনক সমাজবিরোধী তৎপরতার পেছনে কারা রয়েছে সে সম্পর্কে যথাযথ তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। শুধু তাই নয়, রেশনের দোকানে চাল নেই বলার পরও খোলাবাজারে রেশনের চাল বিক্রি হচ্ছে কি করে, এ প্রশ্নেরও একটা মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, খোলাবাজারে রেশনের চাল বিক্রি নতুন কোন ঘটনা নয়। রেশনের দ্রব্য খোলাবাজারে বিক্রি সম্পর্কে কতিপয় ডিলার একশ্রেণীর সরকারী কর্মচারীর দুর্নীতির কথা বলেন। তারা জানান যে, রেশন দোকানের লাইসেন্সের প্রাপ্তি থেকে আরম্ভ করে সরকারী গুদাম থেকে চাল-চিনি আনতে দারোয়ানকে পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। ফলে রেশন ডিলারদের ঘুষের জন্য প্রদত্ত অর্থের ঘাটতি রেশন কার্ডধারীদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মাধ্যমে পূরণ করতে হয়।
স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে যে, খাদ্য পরিস্থিতির ব্যাপারটি ‘সারা অঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কিসের’ মতই একটা মারাত্মক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এ ব্যাধি দূর করতে না পারলে সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যে খাদ্য পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
০০০

এ সম্মেলনের গুরুত্ব অসীম

ঢাকায় পাঁচদিন ব্যাপী আন্তঃরাষ্ট্রীয় পাট সম্মেলন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এম. আর. সিদ্দিকী এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন। সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বাণী প্রদান করেছেন। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউ.এন.ডি.বি) এ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। পাট উৎপাদক দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও, ভারত, থাইল্যান্ড ও নেপালের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, পশ্চিম জার্মানী, ফ্রান্স, জাপান, বৃটেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ড, আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্রের বহু সংখ্যক প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগদান করেছেন। সম্মেলনের উদ্যোক্তা জাতিসংঘের (ইউ.এন.ডি.বি) ছাড়াও জাতিসংঘের গ্যাট, আন্তর্জাতিক ব্যবসা কেন্দ্র, ইউনিডিও, ফাও, ইকাফ ও আনকটাড-এর বহু প্রতিনিধি উপস্থিতি রয়েছেন। এ কারণে নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, পাট গবেষণা সম্পর্কিত সম্মেলন হিসেবে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন—‘বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ পাট। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী সংস্থার উদ্যোগে পাটি তথ্যানুসন্ধান মিশন বর্তমান পাট পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্প্রতি যে বিবরণ পেশ করেছেন এবং ভবিষ্যতে পাট কিভাবে রক্ষা করা যায় তার যে সুপারিশ করেছেন বঙ্গবন্ধু সে সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী।’ এই সম্মেলনের আলোচনার ফলে বিশ্বের বাজারে পাটের প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। এই সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এম. আর. সিদ্দিকী বলেছেন—বাংলাদেশে পাটের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে—মূল্য উঠানামা করছে এবং তাকে কৃত্রিম পাটের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে—এর ফলে বাংলাদেশের পাটের ভবিষ্যত অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পাটের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন—দেশের শতকরা পঁচাত্তর থেকে আশি ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা এই পাট থেকেই আয় হয়। তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে বাংলাদেশের প্রায় পঞ্চাশ লাখ পরিবার পাট চাষের সঙ্গে এবং প্রায় পঁচাত্তর হাজার লোক পাট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলো। ঐ সময় প্রায় দুই লাখ পঁচিশ হাজার লোক চটকলে কাজ করতো। স্বাধীনতার পর অন্যান্য ক্ষেত্রে চাকরীর সুযোগ কমহেতু পাটের উপর জনগণের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বস্তুতঃপক্ষে বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক মেরুদন্ড পাট। দেশের এক বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন ধারণের নিশ্চয়তা রয়েছে পাটের উপর। আমাদের দেশের অন্যান্য এমন কোন উৎপাদিত ফসল বা কারিগরি কোন জিনিস আজও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্যে যথেষ্ট হয়নি। পাটই একমাত্র ফসল যা দিয়ে আয়কৃত মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় আশি ভাগ আসে দেশের মূল আর্থিক স্তম্ভ যে কারণেই পাটের উপর নির্ভরশীল। পাট তাই আমাদের জাতীয় জীবনের সোনার আঁশ।
জাতিসংঘের উদ্যোগে ঢাকায় পাঁচদিন ব্যাপী যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় পাট সম্মেলন শুরু হয়েছে আমরা তার গুরুত্ব অনুধাবন করি। বিশ্বের বাজারে পাটের চাহিদা, কৃত্রিম পাটকে ডিঙ্গিয়ে আসল পাটের গুরুত্ব স্থাপন, আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের ন্যায্যমূল্য নির্দিষ্টকরণ ইত্যাদি ব্যাপারে একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যাবে এ সম্মেলন থেকে। বিশ্বের বেশ কিছু দেশে কৃত্রিম আঁশ তৈরী করে পাট উৎপাদনকারী দেশসমূহের প্রতি হুমকি প্রদর্শন করা হচ্ছে। এ হুমকির মোকাবেলার জন্যে পাট উৎপাদনকারী দেশসমূহের মধ্যে একটি সমঝোতা একান্ত আবশ্যক। পাট উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড ও নেপালের মধ্যে একটি সমঝোতা অবিলম্বে প্রয়োজন। একটি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই বিশ্বের বাজারে হ্রাসকৃত পাটের চাহিদার মোকাবেল করতে হবে। এই সম্মেলন এ ব্যাপারে একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরী করবেন বলে আমরা আশা করি। দেশের মূল আর্থিক কাঠামো পাটের উপর নির্ভরশীল সেই সঙ্গে দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষের জীবনধারণও প্রত্যক্ষভাবে পাটের উপর নির্ভর করছে। দেশবাসীর সাথে আমরাও সর্বান্তঃকরণে এ সম্মেলনের সাফল্য কামনা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!