You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.10.31 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | উন্নয়নকামী দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা | রাবাত শীর্ষ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত | ‘পুরনো মিষ্টি’ আর কত দিন? | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩১শে অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ১৩ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

উন্নয়নকামী দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা

বর্তমানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জটিলা জর্জরিত বিশ্বে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা একান্ত কাম্য। কেননা উন্নতশীল দেশগুলোর কাছ থেকে পেতে গেলেই কোনো না কোনো রকম বাঁধনে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সব সময়েই বিদ্যমান থাকে। নির্ভেজাল বা স্বার্থমুক্ত সাহায্য আশা করা একেবারে বাতুলতা মাত্র। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপের সম্মুখীন হতেই হবে। অন্ততঃ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু শিক্ষা আমরা পেয়ে আসছি। তাই বলে কি অনুন্নত দেশগুলোতে শিল্পোন্নয়ন সম্ভব নয়? আমরা কি চিরকালই উন্নত দেশগুলোর কাঁচামালের যোগানদার থেকে যাবো? এ প্রশ্নের হয়তো একাধিক উত্তর আছে। এ কথা ঠিক যে, আজ কোনো দেশের পক্ষে অষ্টাদশ বা ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো এককভাবে শিল্প বা কল-কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কারণ সে যুগ ছিল আবিষ্কারের যুগ, সাম্রাজ্যবাদীদের লুন্ঠনের যুগ তথা একচেটিয়া কারবারের যুগ। বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে যুগ পাল্টাতে শুরু করেছে। এশিয়া-আফ্রিকার বহু দেশই স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু শূন্য ঝোলা। কারণ সাম্রাজ্যবাদীরা শুষে চেটে আর কিছুই রাখেনি শুধু দারিদ্র্য ছাড়া। তাই নতুন কাঁচামাল আহরণ ও শিল্প গঠনে নিজেরা তৎপর না হলে সাম্রাজ্যবাদী উন্নত দেশগুলো কোনোক্রমেই আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। এ প্রসঙ্গে আমরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক প্রতিনিধিদলের নেতা ডঃ হাসান আব্বাস জাকীর প্রস্তাবকে অভিনন্দন না জানিয়ে পারছি না। ডঃ জাকী মঙ্গলবার ঢাকা আগমনের পর আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ ও কর্মকর্তাদের সাথে প্রতিনিধিদলের আলোচনার ভিত্তিতে দু’দেশের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ডঃ জাকী আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের সকল সুযোগ-সুবিধা পর্যালোচনা করবেন বলে জানান। যৌথ উদ্যোগে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তাঁর দেশ বিশেষ উৎসুক বলেও ডঃ জাকী উল্লেখ করেন। তিনি জয়পুরহাট সিমেন্ট কারখানা ও চট্টগ্রামে ইউরিয়া সার কারখানার কথা বলেন। বাংলাদেশের সহযোগিতায় আবুধাবীতে পাটকল, কার্পেটিং ও চা প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনাও পর্যালোচনা করতে হবে বলে তিনি ঘোষণা করেন।
জয়পুরহাট সিমেন্ট কারখানার কথা বলতে গেলে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় ১৯৬৯ সালে জরিপ কাজ শেষ হওয়ার পর প্রায় চৌদ্দ বছর অতীত হয়ে গেল আজও এ প্রকল্পের সুরাহা হলো না। পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীরা এই সিমেন্ট কারখানা নিয়ে কত খেলাই না এদেশবাসীকে দেখালেন। কারণ এই সিমেন্ট প্রকল্পটি চালু তাদের বাজার নষ্ট হয়ে যেতো হয়তো এই ভয়েই তাঁরা এই গড়িমসি করেছেন। অবশেষে তাঁদের চক্রান্তেরেই বিজয় হয়েছিল—কারখানাটি আর দিনের আলো দেখলোনা। সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদীদের এক চক্রান্ত কাটিয়ে উঠলে আরেক চক্রান্তের ফাঁদে পড়তে হয়। স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ী ও কলকারখানা নির্মাণ অর্থাৎ অর্থনৈতিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈয়ার করতে প্রচুর পরিমাণ সিমেন্টের দরকার হয়ে পড়লো, কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতার অভাবের দরুণ প্রতিটি উৎপাদিত দ্রব্যের দাম এত বেড়ে গেলে আমাদের পক্ষে কোনো উন্নয়ন কর্মে হাত দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। এমতাবস্থায় ডঃ জাকীর এ প্রস্তাব অত্যন্ত অভিনন্দনযোগ্য। সিমেন্ট সম্পর্কে যে কথা সারের সম্পর্কেও সে একই কথা প্রযোজ্য। দ্বিতীয়তঃ আমাদের এখানকার ঐতিহ্যবাহী কাঁচামাল দিয়ে আবুধাবীতে কারখানা স্থাপনের বিষয়টিও কম লোভনীয় নয়। আমাদের পাট, চায়ের বাজার এমন কোণঠাসা হয়েছে যে, পরিশেষে এসব কাঁচামাল উৎপাদনটাই আমাদের পক্ষে বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ালো। মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকায় হয়তো এমন বহু দেশ আছে যেখানে আমরা সরাসরি কাঁচামাল রপ্তানী না করে আবুধাবীর মতো কারখানা স্থাপন করে সেই কাঁচামাল কাজে লাগাতে পারি। ফল হবে এই যে, এতে উভয় দেশই লাভবান হবে। আমাদের কাঁচামালের রপ্তানীর নিশ্চয়তাও আমরা পেলাম—অধিকন্তু যেদেশে কারখানা স্থাপন করা হলো তারাও উপকৃত হলো। এভাবে কেবলমাত্র পারস্পরিক সাহায্যের মারফতই উন্নয়নকামী দেশগুলো শিল্পায়িত হতে পারে। কেবলমাত্র ঐতিহ্যবাহী উন্নত দেশগুলোর উপর নির্ভর করে থাকলে আমাদের শিল্পোন্নয়ন কোনো কালে তো হবেই না বরং আমরা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে থাকবো। পরিশেষে আমাদের বক্তব্য এই যে, উন্নয়নকামী অন্যান্য দেশগুলোর সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত।

রাবাত শীর্ষ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত

বিজয় তোরণ আর বেশী দূরে নয়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম, সাধনা ও রক্তপাতের বিনিময়ে প্যালেস্টাইনী জনগণ নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এসে পৌঁছেছে। চুয়াত্তরের অক্টোবর মাসটি প্যালেস্টাইনী জনগণের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ মাসেই প্রবাসী প্যালেস্টাইনী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ মাসেই প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থা বা পি.এল.ও’র প্রতিনিধি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বিতর্কে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন। জাতিসংঘের ১৩৮টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১০৫টি দেশ এই আমন্ত্রণ জ্ঞাপনের প্রস্তাবের স্বপক্ষে রায় দিয়েছেন। সর্বশেষ রাবাত শীর্ষ সম্মেলনের আরব নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত প্যালেস্টাইনী জনগণের বিজয় পতাকাকেই নীল আকাশে পত পত করে উড়বার পক্ষে শক্তি যুগিয়েছে।
এটা তো দিবালোকের মতোই স্পষ্ট যে, প্যালেস্টাইনী সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চিরস্থায়ী শান্তির চিন্তা করাটা আকাশ-কুসুম কল্পনা মাত্র। অথচ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সেই পথই ধরেছেন। প্যালেস্টাইনের নিপীড়িত-নির্যাতিত জনগণ আলাদা রাষ্ট্র গঠন করুক—তারা সুখে শান্তিতে বাস করুক এটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাম্য নয়। তাই দীর্ঘদিন ধরেই প্যালেস্টাইনীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে আসা হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাবাত শীর্ষ সম্মেলনে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থাকে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার দেওয়ার প্রস্তাবটিকেও তারা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। বলা হয়েছে, স্বতন্ত্র প্যালেস্টাইনী রাষ্ট্র গঠিত হলে আরব-ইসরাইল সম্পর্কের উন্নতি হবে না। অথচ এটা যে ঠুনকো যুক্তি তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না।
যে কোনো কারণেই হোক না কেন অতীত জর্ডান প্যালেস্টাইনী রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতা করে এসেছে। এমনকি জর্ডান নদীর পশ্চিমাঞ্চলে হামলাও চালিয়েছে। সুখের বিষয় রাবাত শীর্ষ সম্মেলনে অতীত তিক্ততার যবনিকাপাত হয়েছে। আর এ মহান দায়িত্বটি পালন করেছেন আরব নেতৃবৃন্দ।
রাবাত শীর্ষ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ও বিশ্ব জনমতের গতি প্রকৃতি দেখে এ কথা আজ অনায়াসে বলা যায় যে, আজ হোক কাল হোক প্যালেস্টাইনী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃতি লাভ করবেই। স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেস্টাইনী রাষ্ট্র গঠিত হবেই। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে অন্ধ হয়ে আজ যারা এর বিরোধিতা করছে তাদের পরাজয় অবধারিত। ইতিহাস সে কথাই বলে এবং তারই প্রমাণ হলো বারাত শীর্ষ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত।

‘পুরনো মিষ্টি’ আর কত দিন?

সরকার দুগ্ধজাত মিষ্টি তৈরীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। গোপনে গোপনে মিষ্টি তৈরীর কাজ চলছে। মিষ্টি বিক্রিরও বিরতি ঘটেনি। দোকানে দোকানে শোভিত হয়ে আছে হরেক রকম মিষ্টি। তবে একটা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং সেটা হচ্ছে পঞ্চাশ পয়সার মিষ্টি এক টাকায় উঠেছে। সরকারী নিষেধাদেশ সত্ত্বেও কেন দুগ্ধজাত মিষ্টি তৈরী হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে মিষ্টির দোকানীরা বলছে : পুরনো মিষ্টি। কিন্তু জিজ্ঞাসা, ‘পুরনো মিষ্টি’ আর কতদিন দোকানের শোভা বর্ধন করবে? শুধু যে মিষ্টি তৈরী অব্যাহত রয়েছে, তা-ই নয়; মিষ্টির দোকানের মালিকরা দুধ দিয়ে ঘি তৈরী করে তা চড়া দামে বিক্রি করছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, মিষ্টির দোকানীরা নাকি আগের চেয়ে বেশী পরিমাণ দুধ কিনছে এবং তারা মুনাফার অংক বাড়িয়ে চলেছে।
শিশুদের বাঁচানোর জন্যই সরকার মিষ্টি তৈরী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সরকারী নির্দেশ মিষ্টি না বানিয়ে ভালো করছে বলে তো কোনো রকম আলামত দেখা যাচ্ছে না। সরকার তো নিষেধাজ্ঞা জারী করেই খালাস। মিষ্টি ব্যবসায়ীরা নির্দেশানুযায়ী কাজ করছে কিনা, তা কিন্তু তলিয়ে দেখার কেউ নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, ব্যবসায়ীদের নামে বরাদ্দকৃত চিনি ও ময়দার পরিমাণও কমানো হয়নি। সুযোগ পেয়ে ব্যবসায়ীরা চিনি এবং ময়দার কালোবাজারী করতে ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে।
আমরা ভাবছি দুগ্ধজাত মিষ্টি তৈরী নিষিদ্ধ হওয়ার পর সুলভে দুধ পাওয়া যাবে না কেন? ব্যবসায়ীরা মিষ্টির বদলে ঘি কিংবা গোপনে গোপনে মিষ্টি তৈরী করে কেমন করে? এই সব কারসাজিগুলো খতিয়ে দেখার জন্য কি কোনো ব্যবস্থা সরকার নেননি? আমাদের বিশ্বাস, মিষ্টি তৈরীর উপর নিষেধাজ্ঞা সেদিনই কার্যকর হবে, যেদিন সম্পূর্ণতঃ মিষ্টি তৈরী বন্ধ হবে। দুধ থেকে মিষ্টি কিংবা ঘি তৈরীর প্রবণতা বন্ধ না হলে এই সরকারী নির্দেশ কোনোদিন ফলপ্রসূ হবে না এবং শিশুদের দুধ সমস্যাও যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যাবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন