বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৯শে এপ্রিল, শনিবার, ৬ই বৈশাখ, ১৩৮১
রাষ্ট্রায়ত্ত মিলের উৎপাদন
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ। কাঁচামালের অভাব, শিল্পে ব্যবহৃত খুচরা যন্ত্রপাতির প্রাদুর্ভাব, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, বোনাস, জাতীয় অর্থ দান ইত্যাদি সত্ত্বেও গত নয় মাসে নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে উল্লেখযোগ্যহারে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সংবাদ বলা হয়েছে। গত পরশুদিন শিল্পমন্ত্রীর সভাপতিত্বে শিল্প সংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির এই তথ্য বৈঠক থেকে জানানো হয়েছে। যেসব শিল্প উৎপাদন বেড়েছে তার পরিমাণ ১৯৬৯-৭০ সনের চাইতেও বেশি। এমনকি পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচামাল এবং প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রপাতি সুষ্ঠুভাবে সরবরাহ করা হলে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব। ন’মাসে যেসব শিল্প উৎপাদন বেড়েছে তা হল কাপড়, ইউরিয়া, কাঁচা রাবার, কাঠ, হার্ডবোর্ড, চিংড়ি মাছ বরফ জাতকরণ, বনস্পতি ঘি, ভোজ্য তেল, রুটি ও বিস্কুট এবং কতিপয় কারিগরি দ্রব্য। গত পরশুদিন শিল্প সংক্রান্ত বিষয়ের উপর যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে নয়টি শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এ শিল্পগুলো হলো বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ ইস্পাত শিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ ফুড ও এলাইড সংস্থা, বাংলাদেশ চিনি শিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ কারিগরি ও জাহাজ নির্মাণ সংস্থা, বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থা, কাগজ শিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ রাসায়নিক ও কার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা ও বাংলাদেশ চর্ম শিল্প। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের উৎপাদন বেড়েছে-একথা সার্বিক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়। কিছু কিছু শিল্প সংস্থায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করা হলে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। বস্তুতপক্ষে দেশের বহু মিল পরিত্যক্ত হওয়ায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই সরকার চেষ্টা করে আসছেন মিল কারখানাগুলো চালু রাখার জন্য কিন্তু নানা প্রতিকূল কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। কিছু কিছু মিল চালু করা হলেও পরে তা আবার কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। যদি প্রথম থেকে কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ নিশ্চিত করা যেত তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেত জাতীয় অর্থনীতিতে মিল-কারখানা তাদের অবদান রাখতে পারতো। কিন্তু সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থার নানা দূর্বলতার দরুণই দেশের অসংখ্য মিল-কারখানা আজও অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। সরকার যে তালিকা দিয়ে জানিয়েছেন যে, নয় মাসে নয়টি মিলের উৎপাদন বেড়েছে তা আসলে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত মিল-কারখানার তুলনায় নিতান্তই স্বল্প। তবু উৎপাদন বাড়ার এই লক্ষণ অত্যন্ত শুভ বলে আমরা মনে করি। এক শ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল মহল ও পুরাতন মালিক পক্ষীয়রা বিভিন্ন কায়দায় রাষ্ট্রায়ত্ত মিল-কারখানা যাতে করে পুরাতন মালিক বা ব্যক্তি মালিকানায় ফিরিয়ে দেওয়া হয় তার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে তারা স্যাবটাজ করছে। এর মোকাবেলা করা আজ আমাদের জাতীয় কর্তব্য। আর এই মোকাবেলা করা সম্ভব একমাত্র মিলগুলো কে চালু করে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করে। মালিক পক্ষীয়রা বিভিন্ন ভাবে লোক নিয়োগ করে উৎপাদনে এমনকি মিল চালু যাতে করে না হয় তারজন্যে ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি এখনো এর বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন তাহলে রাষ্ট্রায়াত্ত মিলের ভবিষ্যৎ একদিন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত এর মধ্যে নিমজ্জিত হবে। শুধু নয়টি মিল নয় জাতি সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত মিল-কারখানার দায়িত্ব সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য। অতএব দেশের সকল মিল-কারখানা যাতে করে কাঁচামাল খুচরা যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য আবশ্যকীয় অভাবে বন্ধ হয়ে না থাকে তার নিশ্চয়তা প্রদান করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব। তাই আমরা আশা করি নয়টি উৎপাদন বেড়েছে এর জন্য উচ্ছ্বসিত না হয়ে সকল মিল-কারখানায় যাতে করে উৎপাদন হয় এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় তার সকল আবশ্যকীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
উন্নয়নশীল বিশ্বের সংকট
বিশ্বের সর্বত্র উন্নয়নশীল দেশগুলো ইদানিং সর্বকালের বৃহত্তম অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। খাদ্য, জ্বালানি আর নিজস্ব সম্পদের সঠিক উত্তরাধিকারত্ব লাভ ও সুষম বন্টনে অব্যবস্থা তাদের এই সংকটকে আরো তীব্র করে তুলেছে দিনকে দিন। অন্যদিকে উন্নতিশীল ও ধনী দেশগুলোর একদিকে সমরাস্ত্রে ব্যাপক উৎপাদন, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অশুভ প্রতিযোগিতা এবং সর্বোপরি উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদ শোষণের অমানবিক স্পৃহা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। তার সাথে সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি উন্নতিশীল দেশগুলোর মানবিক নয়, পরন্ত ব্যবসায়ী সুলভ মনোভাব এর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী। গত সতেরই এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে তাতে একথা আরো সঠিকভাবে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, জরুরী ভিত্তিতে আর্থিক সাহায্য না পেলে চলতি বছর বহু উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্তব্ধ হয়ে যাবে। অধিক উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক মন্দা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অধিবেশনে বাণিজ্য ও অর্থনীতি প্রশ্নে যে আলোচনা চলছে তাতে অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে তেমন কোনো সাফল্য নাও আসতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান বিপর্যয় ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা নিরসনের পরিবর্তে জটিল হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, চলতি দশক শেষ হবার আগে যদি উন্নত দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আশু পর্যায়ে বিপর্যয় রোধ কল্পে কোনো কর্মসূচি প্রণয়ন না করে তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করতেন নয়া একটি বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থাও কোন কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারবে না।
বস্তুতঃ আজিকার বিশ্বের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে কাঠামো রয়েছে, তা বিশ্বের গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তেমন কোনো সুযোগ দান করছে না। এতে একদিকে বিশ্বের ধনী দেশগুলো যেমন ক্রমাগত ধনীই হবার সুযোগ পাচ্ছে তেমনি গরিব দেশগুলোর ক্রমাগত গরিবই হচ্ছে। এমতাবস্থায় ধনী ও উন্নত দেশগুলো যদি তাদের অর্জিত সম্পদ একমাত্র নিজেদের কুক্ষিগত না করে রাখে এবং অপরের ওপর চাপ প্রয়োগে কাজে ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে উন্নয়নশীল ও গরীব দেশগুলোর স্বার্থেও কাজে লাগায়, তবে সমগ্র বিশ্বের সামগ্রিক মানব সমাজের কল্যাণ সাধন সম্ভব হবে-অন্যথায় নয়।
মাল খালাস প্রসঙ্গে
বন্দর অথবা গুদাম থেকে যাতে দ্রুত ও সময়মতো আমদানি পণ্য খালাস করে ড্যামেজ, ডেমারেজ ইত্যাদি সমূহ ক্ষতি ও অন্যান্য সমস্যা এড়ানো যায়, সেজন্য সরকার এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবং এ সিদ্ধান্ত যাতে পুরোপুরি কার্যকর করা যায় তার জন্য টিসিবি, ভোগ্যপণ্য সংস্থা ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রচলিত আইন-কানুন ইত্যাদির আমূল সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে।
বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে, যদি একথা ধরা পরে এবং প্রমাণিত হয় যে এসব প্রতিষ্ঠান যে কেউর কারণে আমদানি পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা, অবস্থা বা কোনো রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাহলে তার বিরুদ্ধে বা দোষী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
আমদানি রপ্তানি প্রধান কন্ট্রোলারকেও এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি তাদের আমদানি লাইসেন্স এর আওতা বহির্ভূত কোন দ্রব্য আমদানি করেন অথবা তাদের যদি কোনো আমদানি মাল তাদের খামখেয়ালির দরুন ডেমারেজ দেয়ার উপক্রমে উপনীত হয়, তবে তাদের আমদানি রেজিস্ট্রেশন যেন বাতিল করে দেয়া হয়।
তাছাড়া যেসব ইন্ডেন্টিং প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কাজে জড়িত তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু ইন্ডেন্টিং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।
বিদেশ থেকে যে সব মালামাল আমদানি করা হচ্ছে সেগুলো তদন্ত করে দেখার জন্য সরকার শিগগিরই একটা তদন্ত দল গঠন করবেন বলে জানা গেছে। তদন্তদল যেকোনো সময় মালামাল পরীক্ষা করে দেখার ক্ষমতা পাবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
যাহোক, নিঃসন্দেহে সরকারের শুভবুদ্ধি ও সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সবারই প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ, অবহেলা, অব্যবস্থা ও অন্যান্য স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তে দেশের বিভিন্ন গুদাম বন্দরে মাল নষ্ট হয়ে জাতীয় লোকসানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই অত্যন্ত সোচ্চার ছিল। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও বেশ কয়েক জায়গায় আকস্মিক পরিদর্শনে লক্ষ লক্ষ টাকার মাল মাটিতে বা গুদামে পচতে দেখেছেন। আমদানি করা পণ্য সময়মতো খালাস না করার জন্য তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক দ্রব্য দ্রব্যমূল্য বাজারের বহুদিন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে এখন থেকে দ্রুত মাল খালাস সম্পর্কে সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে আগের অভিশাপ আর মানুষকে পোহাতে হবে না বলেই সবাই আশা করছেন।
আমরা মনে করি, একটু দেরিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও এ ব্যবস্থার ফলে দেশের সম্পদ ও মানুষের প্রভূত উপকার হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক