বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৭ই এপ্রিল, বৃহস্পতিবার, ৪ঠা বৈশাখ, ১৩৮১
নতুন পঞ্চাশটি শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ
বাংলাদেশ শিল্প সংস্থার অধীনে পঞ্চাশটি শিল্প ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হবে বলে খবর বেরিয়েছে। এ বাবদে বিসিক পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। খাদ্য, কৃষি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বয়ন শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই টাকা বিনিয়োগ করা হবে। বেসরকারি খাতে এই শিল্প ইউনিট গুলি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের ত্রিশ ভাগ ব্যয় করবেন। বাকি সত্তুর ভাগ বাংলাদেশ ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা ঋণ হিসেবে উদ্যোক্তাদের প্রদান করবে।
স্বাধীনতাত্তোর কাল থেকেই শিল্পক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগের ব্যাপারে যে সাধারণ অনীহা এবং তৎপরতাহীনতা পরিলক্ষিত হয়ে আসছিল এই উদ্যোগ সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বেসরকারি উদ্যোগে ভারী এবং বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠার কোন অবকাশ আমাদের শিল্প তফসিলে নেই। তাছাড়া শিল্প তফসিল ঘোষিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের হাতে সামান্য পুঁজিও ছিল তারাও তা শিল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ছিলেন না। পুঁজির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিরাপত্তাহীনতায় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাদের অনাগ্রহের কারণ হতে পারে।
পঞ্চাশটি শিল্প ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত এবং এতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অংশীদারিত্ব স্বাভাবিকভাবেই শিল্পোদ্যোগের নতুন চিত্র তুলে ধরে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ভাবে বেশ কিছু লোকের হাতে অর্থ এসেছে। এই অর্থ উৎপাদন খাতে ব্যবহৃত না হওয়ায় তা দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে, সরকারের শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ নীতি প্রতি লক্ষ্য রেখে বেসরকারি খাতে নয়া শিল্পসমূহ যাতে রপ্তানিমুখী হয় এবং বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে আমদানি বিকল্প শর্তাবলী পূরণ করে, তা নিশ্চিত করতে বিসিক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
বিসিকের এই সিদ্ধান্ত অভিনন্দনযোগ্য। শিল্প স্থাপনে সাথে আরো অধিক সংখ্যক লোক আগ্রহী হয়ে ওঠে সে ব্যাপারে বিসিক তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। পুঁজির স্বল্পতা এবং বিপুল জনসংখ্যার আমাদের দেশের ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বের দিক এই দিক নির্দেশ করে। সরকারও ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানে তাদের আগ্রহের কথা বারবার ঘোষণা করেছেন। ভারী এবং বৃহৎ শিল্প যেহেতু সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এটা যেহেতু যন্ত্রের উপর সামাজিক মালিকানা চালু রাখার রাষ্ট্রীয় আদর্শ প্রতিফলস্বরূপ সেইহেতু বেসরকারি খাতে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠায় বিসিক এর গুরুত্ব সর্বাধিক আর বুঝিয়ে বলতে হয় না।
বেসরকারিখাতে এই পঞ্চাশটি শিল্প স্থাপন শুধু শিল্পোদ্যোগের পথেই একটা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নয়, এই কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে আমরা আমাদের আমদানির ওপর আমাদের নির্ভরতা কমিয়ে আনতে এবং উৎপাদন ও চাহিদা একটা সমন্বয় বিধান করতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস। লক্ষ রাখতে হবে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য অথবা বিসিকের আনুকূল্যে পাওয়া শিল্প কিছু মুনাফার বিনিময় হস্তান্তরিত করার কোন চক্রান্ত যাতে এই উদ্যোগকে ভেস্তে না পাঠায়।
খাদ্যশস্য চুরি
সরকারী খাদ্য গুদাম থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে রেলযোগে যে খাদ্যশস্য প্রেরণ করা হয়ে থাকে তার প্রায় এক-চতুর্থাংশ খাদ্য রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায় বলে পত্রিকার খবরে প্রকাশ। জানা গেছে যে, পরিবহনকালে খাদ্যশস্য অপসারণ সম্পর্কিত প্রায় ছয় হাজার দাবি ইতিমধ্যে খাদ্য বিভাগ রেল বিভাগের কাছে পেশ করেছে।
উল্লেখযোগ্য যে, দেশের ১২টি সিএসডি এবং তিন শতাধিক এলএসডিল মধ্যে প্রধান রেল যোগাযোগই এই খাদ্য আনা-নেয়া করা হয়। আশ্চর্যের কথা রেলওয় ওয়াগণ থাকা অবস্থায় চুড়িগুলো সংঘটিত হয়। বদ্ধ ওয়াগণ এর ভেতর থেকে চাল, ডাল ইত্যাদি নিপুণভাবে সরানো হয়।
সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী সিএসডি গুদাম এর ১৯৭৪৬ নম্বর ওয়াগনের ১০টি বস্তা সম্পুর্ণ খালি এবং ২৪টি চালের বস্তায় মাত্র ৩২ মণ চাল পাওয়া যায় বলা হয়েছে অন্যান্য ওয়াগনের অবস্থাও প্রায় এই পর্যায়ের এবং কোন কোন ওয়াগনে (২৪৪০৯) আসল সিল থাকেও না।
এই সংবাদের প্রেক্ষিতে বলা যায় গত ৩০শে মার্চের বাংলার বাণী সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় এমনই ধরনের খাদ্য চুরির চাঞ্চল্যকর অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। খুলনা থেকে সিরাজগঞ্জে খাদ্য প্রেরণের সময় এই চুরি ঘটে এগারটি ওয়াগনে দুইশো তিরিশটি বস্তায় উল্লেখিত পরিমাণ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সিরাজগঞ্জে পৌঁছার পর খুলে একশো বত্রিশটি বস্তা খালি পাওয়া যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় দরজার তালা, সিলমোহর সবই ঠিক ছিল এবং কোথাও কোন ছিদ্রপথ ছিল না।
সংবাদ গুলির প্রেক্ষিতে এ কথা পরিষ্কার কে বা কারা সুপরিকল্পিত উপায়ে এই পুকুর চুরি করছে। এবং এই চোরেরা ওয়াগণ খুলতে ও সীল করতে সিদ্ধহস্ত। যেকোনো পদ্ধতিতেই হোক তদন্ত সফলতার সঙ্গে এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য চুরি হচ্ছে এটাই সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর।
আমরা জানি দুর্নীতি আজ তার গতি পরিধির সীমা ব্যাপকহারে বাড়িয়েছে। শিশুখাদ্য নিয়ে কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে প্রাণ রক্ষাকারী ওষুধ পত্র নিয়ে নির্মম কালোবাজারি দেখতে দেখতে আমরা প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছি। এবার সরকারি গুদামে রেল ওয়াগন পরিবহনেও চুরি!
এছাড়াও রেলওয়ে খামখেয়ালীপনার জন্য বিভিন্ন সময়ে খাদ্য বোঝাই ওয়াগণ মিসিং হয়ে থাকে। এসব ব্যাপারে রেলওয়ে নিকট ক্ষতিপূরণের দাবি জানালে তারা নানা অজুহাতে তা এড়িয়ে যায়। এবং এ ব্যাপারে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ সূত্রে জানা যায় এই খাদ্য পাচারের পরিমান অত্যাধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। একদিকে খাদ্য বিভাগ হিসেবে কম খাদ্য পেলে রেল বিভাগের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন, অপরদিকে রেল কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। মাঝখানে পড়ে যাচ্ছে অসহায় জনসাধারণ। খাদ্য সমস্যায় দেশ যখন আজ সংকটাপন্ন তখন উচ্চপর্যায়ের এই আত্মপক্ষ সমর্থন ও ক্ষতিপূরণ দাবি টানা হেচরা বড় বেমানান ও অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়। তবে খাদ্য যে চুরি হচ্ছে সেটাই হলো প্রধান কথা।
এরই প্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে কোন এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি এর পেছনে প্রিয়া করছে। তাদেরকে দেশের সং খাদ্য সংকট মোকাবিলায় প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। সাধারণ মানুষ উচ্চপর্যায়ের ভাগ-বাটোয়ারা ও জবাবদিহি নিয়ে মাথা ঘামায় না, গতর খাটিয়ে দু’মুঠো অন্নের প্রশ্নে তাদের কাছে বড় কথা। এই নিরীহ জনগণের মুখের গ্রাস নিয়ে অবিলম্বে যারা ছিনিমিনি খেলে তারা খুনিদের পর্যায়ে পড়ে। অতএব সেই মোতাবেক এই তাদের শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
জাতীয় গ্রন্থ মেলা
গত পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে অষ্টম জাতীয় গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করলেন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী। সপ্তাহ ধরে এই মেলা চলবে। অধ্যাপক ইউসুফ আলী এ প্রসঙ্গে ভাষণদানকালে বলেছেন যে, দেশের মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে কোন প্রচেষ্টাকে সরকার স্বাগতম জানাবে। নিরক্ষরতাই সকল জাতীয় সমস্যা সমাধানে প্রধান অন্তরায়। সরকার দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণে বদ্ধপরিকর। অনুষ্ঠানের সভাপতি ডঃ এনামুল হক বিদেশী বই আমদানি ও দেশীয় বই বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকেই উদ্যোগী হতে বলেন। তিনি দেশের লেখকদের মৌলিক রচনা অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে বলেন। এই মেলায় ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি স্টল খোলা হয়।
বস্তুতঃ বই হচ্ছে মানুষের মননশীলতা বিকাশের প্রধান অবলম্বন। বই পড়া মানুষের হৃদয়ের শক্তিগুলোর অন্যতম। বই পড়তে হবে এবং জানতে হবে এই আনন্দ আজকের বিশ্বের নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর প্রধান দেশগুলোর প্রাথমিক আন্দোলন হওয়া উচিত-আমাদের দেশে তো বটেই। সে ক্ষেত্রে আমাদের সরকার এযাবৎকাল খুব বেশি একটা যুক্তি দিয়েছেন এ কথা যেমন নিশ্চিত করে বলা চলে না, তেমনি ভাবে বলা চলে না অতিমাত্রায় সীমিত গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ জাতীয় গ্রন্থ মেলা এ ব্যাপারে খুব ভালো একটা উদ্যোগ নিতে পেরেছেন। আমরা ডঃ এনামুল হকের সাথে ঐক্যমত পোষণ করি এবং বিশ্বাস করি বহির্বিশ্বের সাথে বইয়ের আদান-প্রদানের সাথে সাথে ভাবের আদান-প্রদান ও উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক