যেকোনাে ঘটনার পেছনে একটা কার্যকারণ থাকে কার্যকারণ ছাড়া কিছুই সংঘটিত হয় না। এটা চিরন্তন সত্য। তাই বলতেই হয় যে, মুজিব হত্যার পেছনে কার্যকারণ ছিল তবে সেই কার্যকারণে কাউকে হত্যা করা সঠিক কিনা সেটাই বিবেচ্য আর সত্যতা, বৈধতার প্রশ্নততা রয়েছেই বাংলা মায়ের এই বীর সন্তানের দেশপ্রেম ছিল তর্কাতীত। বাঙালির সর্বাধিক প্রিয় পাত্র হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন আর কেউই এমন করে দেখেননি তিনিই ঘােষণা দেন এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ’ তার একথা বাস্তবায়িত হয়েছে। যদিও মুক্তিসংগ্রামে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারে নি, কেননা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি বন্দী ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। তিনি বন্দী থাকলেও তার মিশন থমকে থাকেনি। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এলাে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের চির কাংক্ষিত স্বাধীনতা ভাবতে অবাক লাগে, দুরাচার বর্বর পাকসরকার শেখ মুজিবকে নাগালের মধ্যে পেয়েও হত্যা করতে সাহসী হয়নি। অথচ তাঁর প্রিয় দেশবাসী বাঙালি তাকে নির্মমভাবে হত্যা করলাে সপরিবারে ঘটনাটি নির্জল্য সত্য হলেও একেবারেই অবিশ্বাস্য তিনি আজীবন বাংলার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে ভেবেছিলেন। স্বাধীন পাকিস্তানে পাকিস্তানি উর্দুভাষীরা স্বাধীন হলেও, বাংলা অঞ্চলের মানুষ ছিল পরাধীন, পশ্চিম পাকিস্তানি, উর্দুভাষীদের অধীন তারা ছিল তাদের শােষিত নির্যাতিত এক জনগােষ্ঠী তিনি এই অবহেলিত জাতিকে মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য আজীবন আন্দোলন করে গেছে তার ফলে তিনি জীবনের একটা সিংহভাগ সময় অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে। তিনি ব্যক্তি সুখ চাইলে এই সব জেলযুলুমের শিকার হতেন না ঢাকার খাজা নাজিম উদ্দিন, নূরুল আমীন, মােনায়েম খা বাঙালি হয়েও পাকিস্তানের উর্দুভাষী শাসকদের তল্পীবাহক হয়ে শাসন ক্ষমতার বখরা ভােগ করেছেন। তারা বাংলাদেশে ও বাঙালির স্বপ্ন দেখেননি তাই তারা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের পছন্দের লােক তারা নিজেদের বাঙালিত্ব বিসর্জন দিয়ে অধীনতামূলক মিত্রতার পথ বেছে নিয়েছেন সে কারণেই খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও নূরুল আমীন পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাঙালির সর্বস্তরের জনগণের অত্যন্ত আপনজন শেখ মুজিবুর রহমান আততায়ী কর্তৃক নির্মমভাবে প্রাণ হারাবেন, একেবারে সপরিবারে, তা ছিল একান্তই অকল্পনীয়, অসম্ভব। অথচ এই বাংলার বুকে তা সম্ভব হয়েছে। ভেবে পাওয়া মুশকিল, কেন এ-জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড? কী ছিল এর কার্যকারণ? অবশ্য কার্যকারণ নিয়ে অনেকে লিখেছেন লিখেছেন রাজনীতিবিদেরা, লিখেছেন তৎকালীন সেনা কর্মকর্তারা, দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা, লিখেছেন দেশের কোনাে কোনাে সাহিত্য কর্মীরাও আর এ-ও লক্ষ্য করা গেছে যে, সবাইর লেখা হুবহু একরূপ হয়নি। আমরা সাত অন্ধের হাতি দেখা’ নামে একটি গল্প পড়েছি ছেলেবেলায় অন্ধরা দৃষ্টিশক্তি রহিত। তারা যা দেখে তা তাদের হস্তস্পর্শের মাধ্যমে । What is the thing called light, they can never enjoy. অতএব স্পর্শ দ্বারা তারা যা উপলব্ধি করে, তা কখনও সঠিক হয় না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী ঘটনাবলির বিবরণ যারা লিখেছেন, তারাও অনেকেই সাত অন্ধের হাতি দর্শনের কায়দায়ই লিখেছেন। অনুরূপভাবে কেউ দেখছেন মূলাে, কেউ দেখছেন কুলাে, দেখেছেন হাতির পাঁচ পা ইত্যাদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী ঘটনাবলির বিবরণও লেখকভেদে বিভিন্ন রকমের হয়েছে। বলা হয়, আমাদের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। কথাটা অসত্য নয় এখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে— বিকৃতির মধ্য থেকে আসল তথ্য খুঁজে বের করা। অবশ্য কাজটি সহজও নয়। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে দলমত এবং ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সঠিক তথ্য উদঘাটন করা। তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে সক্ষম হবে। মুক্তিযুদ্ধের এতােকাল পরে সঠিক তত্ত্ব উদঘাটন করা দুরূহ হলেও একেবারেই অসম্ভব নয়। এতদবিষয়ে রাজনীতিবিদ, সেনাসদস্য, ইতিহাসগবেষক প্রত্যক্ষদর্শী কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা কাহিনী লিখেছেন। আমার মনে হয়, তার মধ্য থেকেই সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে তবে যিনি এসব নিয়ে গবেষণা করবেন তাকে অবশ্যই সত্যনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ থাকতে হবে। নতুবা আসল জিনিস পাওয়া যাবে না বিভিন্ন লেখকের গ্রন্থ পাঠে জানা যায়
(ক) কতিপয় সেনা কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করায় তারা অসন্তুষ্ট ছিল।
(খ) সবাই কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি না পাওয়ায় পদোন্নতি প্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি ঈর্ষা পরায়ণ ছিল। আর, সেই অসন্তোষ বর্তায় গিয়ে শেখ মুজিবের ওপর।
(গ) জাসদ এবং আন্ডার গ্রাউন্ড সর্বহারা পার্টি (কমরেড সিরাজ সিকদারের দল) দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে রেখেছিল, যার দায়ভার অনেকটা শেখ মুজিব সরকারের ওপর বর্তায়।
(ঘ) সংসদীয় গণতন্ত্র বাতিল করে এক দলীয় বাকশালের প্রেসিডেন্সিয়াল শাসনব্যবস্থার প্রচলনে অনেকের মনে চাপা ক্ষোভ ছিল। অথচ শেখ মুজিবকে সরাসরি কেউ কিছু বলেন নি। প্রকারান্তে এই নতুন শাসন ব্যবস্থা প্রায় সবাই মেনে নিয়েছিলেন। (ঙ) শেখ সাহেবের রক্ষীবাহিনী গড়ায় সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ছিল । বলা হয়, সেনাবাহিনীর চাইতে রক্ষীবাহিনী অধিক সুযােগ-সুবিধা ভােগ করতাে। এটা সেনাবাহিনীর নাখােশের কারণ। (চ) ব্যক্তিগত কারণে মেজর ফারুক, মেজর শরিফুল হক ডালিম এবং আরাে কজন কর্মরত এবং বরখাস্তকৃত মেজররা ব্যক্তিগত অসন্তোষের কারণে ১৯৭৫-এর শুরু থেকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এদের সঙ্গে ছিলেন ফারুকের সহপাঠী এবং ভায়রা মেজর রশীদ। (ছ) বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী এবং মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, স্বাধীন এবং প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােস্তাক আহমদ ছিলেন উচ্চাভিলাষী। তিনি সরকারের কোনাে উচ্চপদ না পেয়ে না খােশ ছিলেন। শােনা যায়, তিনি বিদ্রোহী। মেজরদের পশ্চাতের নাটের গুরু।
(জ) সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীপ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, সি, জি, এস, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিল প্রমুখ ‘৭৫-এর সেনাঅভ্যুত্থানের সঠিক তারিখ না জানলেও, একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে, এ খবরটুকু জানতেন। অবশ্য তারা নেতৃত্বে ছিলেন না। আবার ১৫ই আগস্টের মুজিব হত্যাকাণ্ড এবং সেই সঙ্গে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে, তারা ছিল কর্নেল শাফায়াত জামিলের অধীনস্থ জিয়া, খালেদ, শাফায়াত জামিলকে সেনা পাঠাতে বলার পরও তারা নিষ্ক্রিয় থাকেন। এতে বােঝা যায় যে, তারাও ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন এবং সমর্থনও করতেন, শুধু নেতৃত্বের ঝুঁকি নেননি। (ঝ) অভ্যুত্থান সফল হবার পরপরই খন্দকার মােস্তাক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব। গ্রহণ করে এক মন্ত্রিসভা গঠন করেন সেই মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের সদস্য তথা শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভার অনেকেই অংশগ্রহণ করেন। প্রতীয়মান হয় যে তারা ক্ষমতার মােহে মত্ত ছিলেন হয়তাে কেউ কেউ পূর্বাহ্নেই জানতেন এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। বিভিন্ন লেখকের লেখা পড়ে আমার যা ধারণা হয়েছে, এখানে তাই লিপিবদ্ধ করলাম বিবেকবান পাঠক বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
যা-ই হােক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালির সর্বাধিক প্রিয় নেতা তিনি বাংলাদেশের স্বার্থ এবং বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন আজীবন এ-কারণে তিনি ব্যক্তিগত পারিবারিক সুখের কথা কখনও ভাবেননি বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি জীবনভর বহুবার জেলের অন্তরালে কাটিয়েছেন। ‘৭১-এ তিনি পাকিস্তানের শাসকবর্গের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করতে অবশ্যই পারতেন তাতে বাঙালি জাতির স্বার্থ আদায় হতাে না। তাই তিনি আপােষে না গিয়ে প্রথমে অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দিলেন অতঃপর স্বাধীনতার কথা বলেন। তারও পূর্বে ১৯৬৬ সালে ছয়দফা দাবি ঘােষণা করেন বাঙালিদের স্বার্থে। তারই ফলশ্রুতিতে তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলে যান হয়তাে বিচারে তাঁর কঠোর শাস্তি হতাে। এমনকি প্রাণদণ্ডও হতে পারতাে। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে তিনি জেল থেকে নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করেন ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ সেখানেও তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয় বিচার কার্য সমাপ্ত হতে পারলে হয়তাে তার প্রাণদণ্ড হতাে কিন্তু পাকিস্তান সরকার এতাে বড় মাপের গােটা বাঙালি জাতির প্রিয় নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে সাহসী হয়নি।
তিনি দেশ স্বাধীনের পর সশরীরে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাগমন করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বাঙালির কাছে কী অপরাধ করেছিলেন যার ফলে তাকে সপরিবারে নির্মম মৃত্যুবরণ করতে হলাে? অথচ তা কিছুতেই স্বাভাবিক ছিল না। একজন মানুষের সকল কাজ সকলেরই মনঃপূত হবে, এমন কথা নয়। আর যিনি কোনাে কাজ করেন, তা ভেবে-চিন্তেই করেন তথাপি কাজের মধ্যে ভুল হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কথায় বলে ‘মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম’তা বলে হিতৈষীরা তাকে পরামর্শ দিতে পারেন সংশােধনের সহায়ক হতে পারেন। তাই বলে সপরিবারে হত্যা করা জঘন্যতম অপরাধ এন্থনী মাসকারেন হাস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, লেঃ কর্নেল এম. এ. হামিদ (অব.) প্রমুখের লেখা থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হন। তাকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রও বলা যেতে পারে।
সূত্রঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড – মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান