বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। ক্ষমতায় আসেন খন্দকার মােস্তাক আহমদ। তার ৮১ দিনের ক্ষমতার প্রহরায় থেকেছেন হত্যাকারীরাই হত্যাকাণ্ডের পর তিনমাসও অতিক্রম করেনি, ইতােমধ্যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ এক ব্যর্থ। অ্যুত্থান ঘটালেন, যার ফলে মােস্তাকের ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে। হত্যাকারীরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, তাদের আর দেশে থাকা নিরাপদ নয় অবশ্য মােস্তাক তাদেরকে বাঁচাতে এক অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। যার নাম ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ । তাতে বলা হয় যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে না । তবুও তারা শংকামুক্ত হতে পারেননি। ২রা নভেম্বর অই হত্যাকারীদের নেতৃত্বে জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম, মনসুর আলী, এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান, মােস্তাকের নির্দেশে বন্দী হয়ে যারা। কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণে ছিলেন, তাদেরকে হত্যা করা হলাে। এই হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরেই হত্যাকারীরা দেশ ত্যাগ করেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। অতঃপর তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানভুক্ত করে নেন। ১৯৭৮ সালে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ১২ জন সেনাসদস্যকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরিতে নিয়ােজিত করেন। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিদ্রোহী সেনাসদস্যের হাতে নিহত হলে মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন। এর পরেও বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা বহাল তবিয়তে বিদেশের দূতাবাসে কর্মরত। তবে ফারুক-রশীদ প্রমুখেরা দেশে ফিরে ফ্রিডম পার্টি নামে একটা রাজনৈতিক দলও গঠন করেছিলেন। এ দলটি একবার নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করে। জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন চলে দীর্ঘ নয় বছরব্যাপী ১৯৯০-এর ৬ই ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর করেন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে। তিনি হলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। ১৯৯১ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বাদশ সংশােধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারকে সংসদীয় সরকারে পরিণত করা হয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করে। এ নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার দল বিজয়ী হলেও বিরােধী দলের দাবির মুখে পুননির্বাচন দিতে বাধ্য হন। জুন মাসে পুনঃ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলেন। দীর্ঘ একুশ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। এবার সুযােগ এলাে। বাতিল করা হলাে ইনডেমনিটি আইন। অতঃপর হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে আর কোনাে বাধা থাকলাে না। রুজু হলাে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা বিশেষ ক্ষমতা আইনে ফারুক, শাহরিয়ার রশীদ খান এবং মহিউদ্দীন আহমদকে গ্রেফতার করা হয় ১৯৯৬ সালের ১২ই আগস্ট। অতঃপর তাদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় । ১৯৯৬ সালের ২রা অক্টোবর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার এজাহার হয় ধানমন্ডি থানায়। ১২ই নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল পাশ হয় । ১৯৯৭ সালের ১৫ই জানুয়ারি ফৌজদারি কার্যবিধির ১২০(বি), ৩০২/৩৪ এবং ২০১ ধারায় চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২০শে জানুয়ারি গ্রেফতারকৃত আসামীদের আদালতে হাজির করা হয়। ২৮শে জানুয়ারি ইনডেমনিটি বাতিল আইন বাতিলের চ্যালেঞ্জ মামলায় হাইকোর্ট থেকে বাতিলের আইনটি বৈধতা পায়। ৩রা ফেব্রুয়ারি পলাতক আসামীদের নামে গেজেট নােটিশ জারি করা হয় । ১লা মার্চ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে বিশেষ এজলাস গঠন করে বিচারক করা হয় কাজী গােলাম রসুলকে। রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ পি. পি. নিযুক্ত হন সিরাজুল হক । ১২ই মার্চ বিচারকার্য শুরু হয়। ৭ই এপ্রিল মামলার অভিযোেগ গঠন এবং ৬ই জুলাই সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু। ২০শে জুলাই ১৯৯৮ সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্ত হয়।
১২ই আগস্ট সওয়াল জওয়াব শুরু এবং ১৩ই অক্টোবর শেষ ঐদিনই রায়ের তারিখ ঘােষণা হত্যাকারী বজলুল হুদাকে ব্যাংকক থেকে দেশে ফেরৎ আনা হয় ৮ই নভেম্বর ঐ দিনই মামলার রায় ঘােষণা করা হয়। বিচারে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। ১১ই নভেম্বর মামলাটি ডেথ রেফারেন্সের জন্য হাইকোর্টে যায় । ২০০০ সালের ৯ই মার্চ মামলাটির ডেথ রেফারেন্স এবং আপিল হাইকোর্টে শুনানীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় ১০ই এপ্রিল বেঞ্চের বিচারক আমীরুল ইসলাম মামলা শুনতে ব্রিত বােধ করেন। ১৮ই এপ্রিল এ কারণে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে লাঠি মিছিল করে আওয়ামী লীগ। ২৪শে এপ্রিল অন্য একটি বেঞ্চের বিচারপতি এম. এম. রুহুল আমিন ও বিচারপতি আব্দুল মতিন ব্রিত বােধ করেন। ২রা মে পলাতক আসামীদের পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়ােগ । ২রা মে সংশােধিত পেপার বুক তৈরির আবেদন নাকচ করে সম্পূরক পেপার বুকের নির্দেশ। ২৮শে জুন হাইকোর্টে শুনানি শুরু। ১০ই জুন। সম্পূরক পেপার বুক আদালতে দাখিল করা হয়। ১৮ই জুলাই সওয়াল জওয়াব শুরু। ২২শে অক্টোবর আসামীপক্ষের বক্তব্য শেষ এবং সরকারপক্ষের যুক্তি শুরু ২৮শে নভেম্বর শুনানি শেষ ১৪ই ডিসেম্বর হাইকোর্ট থেকে দ্বিধাবিভক্ত | রায় ঘােষণা করা হয়। ২০০১ সালের ১৪ই জানুয়ারি ডেথ রেফারেন্সের বিভক্ত রায় নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে প্রেরণ ১৫ই জানুয়ারি বিচারপতি। ফজলুল করিমকে তৃতীয় বিচারপতি নিযুক্ত করে হাইকোর্ট পর্যায়ে ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৭ই জানুয়ারি তৃতীয় বিচারপতির আদালতে শুধু দ্বিমত থাকা আসামীদের বিষয়ে শুনানি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।
২৪শে জানুয়ারি লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন (আর্টিলারি)-এর স্ত্রী শাহিদা মহিউদ্দীন ডিমান্ড অফ জাস্টিস নােটিশ পাঠান ১২ই ফেব্রুয়ারি তৃতীয় বিচারপতির আদালতে শুনানি শুরু হয়। ১৯শে এপ্রিল শুনানি শেষ তৃতীয় বিচারপতি ১৫ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্য থেকে তিনজনকে বেকসুর। খালাস দেন এবং ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন—১. সৈয়দ ফারুক রহমান, ২. শাহরিয়ার রশীদ খান, ৩. এ. কে. এম. মহিউদ্দীন আহমেদ, ৪. বজলুল হুদা, ৫. মহিউদ্দীন আহমদ (ল্যান্সার), ৬. খন্দকার আব্দুর রশীদ, ৭. শরিফুল হক ডালিম, ৮. নূর চৌধুরী, ৯. এম. এ. রাশেদ চৌধুরী, ১০, আব্দুল মাজেদ, ১১. মােসলেমউদ্দীন, ১২. আব্দুল আজিজ পাশা। এদের প্রথম তিনজনকে প্রথমেই বিশেষ আইনে গ্রেফতার করা হয় । বজলুল হুদা এবং মহিউদ্দীন আহমদ (ল্যান্সার)-কে পরবর্তীকালে বিদেশ থেকে গ্রেফতার করে দেশে আনা হয়েছিল অন্য ৭ জনের মধ্যে আব্দুল আজিজ পাশা বিদেশে মৃত্যুবরণ করেন। অন্যান্য ৬ জন এখনও পলাতক। ২০০১ সালেই কারাবন্দী চার আসামি আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল | দাখিল করে। ২০০১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত | হয়। এ নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি বিজয়ী হয়। প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। অতঃপর ২০০২ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি গােলাম রব্বানী, বিচারপতি জে আর, মােদাচ্ছির হােসেন, বিচারপতি কে, এম, হাসান ও বিচারপতি আবু সাঈদ আপিলের শুনানিতে বিব্রত বােধ করেন। এক পর্যায়ে মামলাটি কার্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ১৩ই মার্চ ২০০৭ তারিখে ল্যান্সার এ. কে. এম. মহিউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার হন। ১৮ই জুন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় । এবার কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামি। ২৪শে জুন ল্যান্সার মহিউদ্দীনের পক্ষে আপিল দাখিল করা হয়। ২রা আগস্ট হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামীদের দায়ের করা লিভ টু আপিলের উপর শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করা হয় ।
৭ই আগস্ট বিচারপতি তােফাজ্জল ইসলাম, বিচারপতি জয়নাল আবেদীন ও বিচারপতি মােঃ হাসান আমিনের আপিল বিভাগের বেঞ্চ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার লিভ টু আপিলের শুনানির জন্য গঠন করা হয়। ২৩শে সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ ২৬ দিবস শুনানি গ্রহণ করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামীর আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। ৩০শে অক্টোবর পেপার বুক তৈরি করে জমা দিতে আসামীপক্ষের শেষ সময়। তারা পেপার বুক ও যুক্তির সংক্ষিপ্তসার আপিল বিভাগে জমা দেন। ২৩শে আগস্ট ২০০৯ রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি সংক্ষিপ্তসার আপিল বিভাগে জমা দেওয়া হয়। ২৪শে আগস্ট আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মােঃ মােজাম্মেল হােসেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানির জন্য ৫ই অক্টোবর তারিখ ধার্য করেন। ৪ঠা অক্টোবর মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতিকে নিয়ে একটি বেঞ্চ গঠন। বিচারপতিরা হলেন- মােঃ তােফাজ্জল ইসলাম, মােঃ আব্দুল আজিজ, বিজন কুমার দাস, মােজাম্মেল হােসেন, সুখেন্দ্রকুমার সিনহা।
৫ই অক্টোবর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি শুরু ১২ই নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ২৯ কার্যদিবসে শেষ হলাে। ১৯শে নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়ের তারিখ ঘােষণা। ১৭ই ডিসেম্বর ২০০৯ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে ৫ বিচারপতির স্বাক্ষর ১০ই জানুয়ারি ২০১০ তারিখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী মেজর (অব.) বজলুল হুদা এবং মেজর (অব.) এ. কে. এম. মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার)-এর রিভিউ পিটিশন দায়ের । ১২ই জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশীদের রিভিউ পিটিশন দায়ের ১৯শে জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং মেজর (অব.) মহিউদ্দীন আহমদ (আর্টিলারী)-এর রিভিউ পিটিশন দায়ের । ২৭শে জানুয়ারি ২০১০ তারিখে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে তিন রিভিউ পিটিশন শুনানি শেষে দণ্ডাদেশ ঘােষণা ।… প্রকাশ থাকে যে, ২০০৬ সালের অক্টোবরে বেগম খালেদা জিয়ার মেয়াদ শেষ । তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে দুর্নীতি ও অরাজকতার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে নেয় প্রায় ২ বছর ২৯.১২.২০০৯ তারিখের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিজয়ী হয় তৎপূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল কার্যক্রম চলেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি। কারণ খুনীরা পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছিল একদল সুবিধাবাদী সেনা কর্মকর্তা এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের। হত্যাকারীরা সবাই ছিল সেনাবাহিনীর নিমতম অফিসার। তাদের মধ্যে ২/৩ জন ছিলেন বরখাস্তকৃত । অন্যরা ছিলেন কর্মরত । আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভার সদস্য খােন্দকার মােস্তাক আহমদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ। করেন। কতিপয় আওয়ামী লীগের মন্ত্রী মােস্তাকের মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণ করেন। অবশ্য জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম.। মনসুর আলী এবং এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান খুনী ষড়যন্ত্রকারীদের মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাদেরকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় । তাছাড়াও আরও কয়েকজন আওয়ামী মন্ত্রী ও নেতাকে বন্দী করে জেলে পাঠানাে হয়। তৎকালীন সেনাবাহিনীর চীফ অফ স্টাফ জেনারেল শফিউল্লাহকে বরখাস্ত করে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে চিফ অফ স্টাফের দায়িত্ব দেওয়া হয় । ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ এবং ৪৬ ব্রিগেডের কর্মকর্তা কর্নেল শাফায়াত জামিলও ঘাতক দলে ভিড়ে যান প্রথম দিকে। অগত্যা তিন বাহিনী প্রধান, বিডিআর প্রধান, রক্ষীবাহিনী প্রধান, পুলিশ বাহিনী প্রধান প্রমুখ সবাই নিরুপায় হয়ে মােস্তাকের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য হন। এভাবে ঘাতক ষড়যন্ত্রকারীরা দ্রুতগতিতে আটঘাট বেঁধে ফেলে।
তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করবার পরিবেশ তখন আর ছিল না। দীর্ঘ একুশ বছর পর প্রতিবাদের সুযােগ সৃষ্টি হলাে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার ফলে। তাই ১৯৯৬ সালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভবপর হয়েছিল। ইত্যাবসরে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা দেশে ও বিদেশে বহাল তবিয়তে কালকাটাবার সুযােগ পেয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ একুশ বছর পরে পাঁচ হত্যাকারী সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, এ. কে. এম. মহিউদ্দীন খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দীন আহমদ কারাকক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। অবশ্য মহিউদ্দীন আহমদ (ল্যান্সার)-কে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর বহু পূর্বে ২০০৭ সালে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানাে হয়। কারাগারে আটক ৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড (ফাসি) কার্যকর করা হয় ২৭শে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে পর্যায়ক্রমে । ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এই মৃত্যুদণ্ড একই ফাঁসির মঞ্চে কার্যকর করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ ৩৪ বছর পরে ৫ ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলাে। পূরণ হলাে দেশবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা।
২৭শে ফেব্রুয়ারি (২০১০ সাল) বুধবার ৫ ঘাতকের রিভিউ পিটিশন সুপ্রিমকোর্ট খারিজ করে দেয়। অতঃপর দণ্ডাদেশ কার্যকর। ঐদিন গত হয়ে রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে পর্যায়ক্রমে ৫ ঘাতকের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। প্রথম মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় মেজর (অব.) বজলুল হুদা এবং মেজর (অব.) মহিউদ্দীনের (আর্টিলারী)। দ্বিতীয় দফায় ল্যান্সার এ. কে. এম. মহিউদ্দীনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। অতঃপর কর্নেল ফারুক এবং সুলতান শাহরিয়ার রশীদকে ফাঁসিতে ঝুলানাে হয় । এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য কাশিমপুর কারাগার থেকে ৪ জল্লাদকে আনা হয়। রাত দশটায় ঢাকার সিভিল সার্জন মুশফিকুর রহমান কারাগারে আসেন। রাত এগারােটায় আই. জি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলাম খান, ঢাকার জেলা প্রশাসক জিলুর রহমান এবং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অমিতাভ সরকার প্রমুখের নেতৃত্বে চারজন ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারে প্রবেশ করেন। অতঃপর আসেন স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুস সােবহান সিকদার এবং ডিএমপি কমিশনার এ, কে, এম, শহীদুল হক। | ধর্মীয় নিয়ম ও আচার অনুযায়ী ৫ আসামিকে গােসল করানাে হয়। তারপর তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। ফাঁসি কার্যকর করা জল্লাদের নাম, যথাক্রমে- শাহজাহান, মােখলেসউদ্দীন, সানােয়ার, ফারুক এবং হাফিজ। এরা সকলেই দীর্ঘকালীন দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদী এবং ফাঁসি কার্যকর করার পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৭ আসামি এখন পলাতক তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ডদানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এবার খুনীদের দেশে ফেরৎ আনার কাজটি এককভাবে করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। খুনীদের অবস্থান নিশ্চিত করতে এবং দেশে ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের সবগুলাে বৈদেশিক মিশনকে নির্দেশ দিয়েছে। তাছাড়া খুনীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ইন্টারপােলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। একটি সূত্রমতে জানা যায়। যে, খুনীরা ঘনঘন স্থান পরিবর্তন করছেন এবং নাম-পরিচয় গােপন রাখার প্রচেষ্টা পাচ্ছেন। খুনীদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ ও রিসালদার মােসলেম উদ্দীন কোনাে দূতাবাসে চাকুরি গ্রহণ করেনি। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, কর্নেল রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল নূর চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ পাশা এবং ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ একাধিকবার বাংলাদেশ মিশনে কাজ করেছেন। ২০০২ সালে আজিজ পাশা জিম্বাবুয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
কূটনৈতিক সূত্রমতে জানা যায় যে, পলাতক খুনীরা যুক্তরাষ্ট্র, লিবিয়া এবং কানাডায় অবস্থান করছেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশেদ চৌধুরী এখন যুক্তরাষ্ট্রের লসএঞ্জেলস্-এ রয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে চাচ্ছেন কানাডায়। নূর চৌধুরী কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। অবশিষ্ট চারজন কে কোথায় আছেন তা সুনির্দিষ্ট নয়। তবে বিভিন্ন সূত্রমতে জানা যায়, তারা লিবিয়া এবং পাকিস্তানে অবস্থান করছেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম কেনিয়ায় ব্যবসা করলেও লিবিয়া এবং ইউরােপে যাতায়াত রয়েছে। তারা যে সকল রাষ্ট্রে অবস্থান করছে, তারা সহায়তা করলে খুনীদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড প্রদানে বাধা থাকবে না। দেশবাসী এখন সেইদিনের প্রতীক্ষায় রয়েছে।
চার বঙ্গবন্ধু হত্যার দণ্ডপ্রাপ্ত ৫ হত্যাকারীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমানের বাড়ি নওগাঁর মল্লিকপুর গ্রামে। তার পিতার নাম মেজর (অব.) আতাউর রহমান। মেজর (অব.) বজলুল হুদার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা গ্রামে। তার পিতার নাম ডা. রিয়াজউদ্দীন। জন্ম তারিখ : ৩রা নভেম্বর ১৯৪৯ সাল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান (লেফটেন্যান্ট কর্নেল অব.) জন্মগ্রহণ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গােপীনাথপুর গ্রামে। তার পিতার নাম হারুন-আল-রশীদ। এ. কে. এম. মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) -এর বাড়ি পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালি (থানা-গলাচিপা) গ্রামে। তার পিতার নাম আবুল হােসেন তালুকদার। জন্ম তারিখ : ৩১শে ডিসেম্বর ১৯৪৬ সাল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মহিউদ্দীন আহমদ-এর বাড়ি পটুয়াখালী জেলার কাজীকান্দা গ্রামে (গলাচিপা থানায়) । পিতার নাম আব্দুর রহমান হাওলাদার। পাঁচ হত্যাকারীর ফাঁসি কার্যকর হবার পর পােস্টমর্টেম ও অন্যান্য নিয়ম মাফিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাদের লাশ আত্মীয়-স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের সেই ভয়াল রাতে বিদ্রোহী সেনা-সদস্যদের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী কেউ ছিলেন কিনা, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে শেখ আব্দুর রহমান ওরফে রমা নামের একটি কাজের ছেলের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়, যে লােক সে রাতে অই বাসাতে ছিল। সেই রাতে সে ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা পায়। তার দেওয়া বিবরণ অনুসারে জানা যায় যে, সে রাতে বঙ্গবন্ধু এবং বেগম মুজিব শিশুপুত্র রাসেল দোতলার বেডরুমে ঘুমিয়েছিলেন। তিনতলায় শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রােজি জামাল এবং বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের ঘুমিয়েছিলেন। নীচের তলায় ছিল নিরাপত্তা রক্ষী, কাজের লােকজন খুনীদের প্রধান টার্গেট ছিল বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ ৩২ নং বাড়ি। বাড়ি আক্রান্ত হলে নিরাপত্তা রক্ষীরা গােলাগুলি চালায়। মেজর মহিউদ্দীন, মেজর বজলুল হুদা, মেজর নূর, মেজর আজিজ পাশা প্রমুখের নেতৃত্বে বাড়িটি ঘেরাও করা হয়। খুনীরা যাতে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ না করতে পারে, সেজন্য নিরাপত্তা বাহিনী গুলি ছুঁড়তে থাকে। খুনীরাও গুলি চালাতে থাকে। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এসে নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি চালাতে নিষেধ করেন। ফলে খুনীরা সহজেই বাড়ির ভিতরে প্রবেশের সুযােগ পেয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু এ সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করেন। তাঁর মিলিটারী সেক্রেটারি কর্নেল জামিল উদ্দীনকে ফোনে বলেন : “জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসাে। আর্মির লোেক আমার বাসায় আক্রমণ করেছে। শফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলাে।’ কর্নেল জামিল ফোন পেয়ে তখনই তার প্রাইভেট গাড়িতে ঘটনাস্থলের দিকে আসতে থাকেন।
বাড়ির কাছাকাছি এসে তিনি বিদ্রোহী সেনাদের গুলিতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোনে বলেন : ‘শফিউল্লাহ আমার বাসা তােমার ফোর্স এ্যাটাক করেছে। কামালকে হয়তাে মেরেই ফেলেছে। তুমি তাড়াতাড়ি ফোর্স পাঠাও।’ জবাবে শফিউল্লাহ বলেন, “Sir, Can you get out? I am doing something’ অতঃপর ফোনে তাকে আর পাওয়া যায়নি। | বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনা আদালতের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে শেখ আবদুর রহমান রমা ঘটনা বর্ণনা করে। তার বক্তব্য : ১৫ই আগস্ট ভাের ৫টায় আমি ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিলাম। ঘটনার দিন রাতে কাজের ছেলে সেলিমসহ আমি দোতলায় বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের সামনে বারান্দায় ঘুমিয়েছিলাম । আনুমানিক ভাের ৫টার দিকে হঠাৎ বেগম মুজিব দরজা খুলে বাইরে আসেন এবং বলেন যে, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুকৃিতিকারীরা আক্রমণ করেছে। বেগম মুজিবের কথা শুনে তাড়াতাড়ি লেকের পাড়ে গিয়ে দেখি কিছু আর্মি গুলি করতে করতে ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে আসছে। বাসায় ঢুকে দেখি রিসেপশন রুমে পি. এ. মহিতুলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কথা বলছেন। দোতলায় গিয়ে দেখি বেগম মুজিব ছােটাছুটি করছেন। তিনতলায় গিয়ে কামাল ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। কামাল ভাই তাড়াতাড়ি শার্টপ্যান্ট পরে নীচে নেমে যান। জামাল ভাইকেও ঘুম থেকে জাগানাে হয়। তিনি শার্ট-প্যান্ট পরে দোতলায় যান। তখন প্রচণ্ড গােলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে কামাল ভাইয়ের আর্তচিৎকার শুনলাম। একসময়ে গােলাগুলি থেমে যায় ।
এক সময়ে আর্মিরা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফেলে। তিনি তাদেরকে বলেন— ‘তােরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে? তিনি সিঁড়ির কাছে ছিলেন। সেখানেই তাকে গুলি করা হয়। তিনি সিঁড়িতেই লুটিয়ে পড়েন। আমি বাথরুমে আশ্রয় নেই । শেখ নাসের বাথরুমে আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন। তার পূর্বেই তিনি গুলিবিদ্ধ হন। এভাবে বাড়ির সবাইকে হত্যা করা হয়। শিশু রাসেল বলেছিল ‘আমি মার কাছে যাবাে।’ তাকে পাষণ্ডরা নিহত বেগম মুজিবের কাছে এনে হত্যা করে। নিস্পাপ শিশুটিও সেদিন পাষণ্ডদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি। [বিঃ দ্রঃ আমি এক রমাকে চিনতাম । তার আসল নাম শেখ রহমত আলী। তাকে তার এলাকার লােক রমা বলে ডাকতাে। তার বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাড়ির পাশেই। তারা তিনভাই মুজিব পরিবারের আশ্রিত হিসেবে অই পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত। শেখ রহমত আমার প্রতিবেশি বাড়ির মেয়ে বিবাহ করে। এ কারণে তাকে চিনতাম। যখন সে আমাদের এলাকায় বিবাহ করে, তখন আমাদের এদিকের কেউ জানতাে না যে, তার মাথায় গােলমাল আছে। এক সময়ে সে বদ্ধ পাগলে পরিণত হয়। তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতাে। অবশ্য সময় সময় সে সুস্থ থাকতাে এবং কথাবার্তা ঠিকমতাে বলতে পারতাে। কোনাে কোনাে গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু হত্যা বিষয়ক লেখায় রমা নামটির উল্লেখ পাওয়া যায় পনরােই আগস্ট রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে। তাতে রমার আসল নাম আব্দুর রহমান বলা হয়। আসলে সে এই শেখ রহমত আলী কিনা, তা এখন প্রমাণ করা আমার পক্ষে মুশকিল। কেননা, শেখ রহমত ক’বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছে। আমি যখন বঙ্গবন্ধু হত্যা বিষয়ক লেখায় রমা নামটি পাই, তার পূর্বেই রহমত আলীর মৃত্যু হয়েছে। আর বেঁচে থাকলেও সে হয়তাে এখন সঠিকভাবে সেদিনের ঘটনাবলী বলতে পারতাে না। তবে আমার মনে হয় এই রহমতই সেই রমা, যে ১৫ই আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিল ।
– গ্রন্থকার । ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ির ঘাতক কর্তৃক নিহত ১৮টি লাশ বাড়ি ও হাসপাতালের মর্গ থেকে সংগ্রহ করে দাফন করার অভিজ্ঞতার মুখােমুখি হয়েছিলেন তৎকালীন সেনাবাহিনীর মেজর আলাউদ্দীন আহমেদ পিএসসি। হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরে তিনি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে যান। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং শেখ মণির বাড়িতেও যান। লাশগুলি দাফনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে তিনি তখন ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন হেড কোয়ার্টারে কর্মরত স্টাফ অফিসার তিনি এক সময়ে উক্ত ঘটনার স্মৃতিচারণ বিষয়ক একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন দৈনিক পত্রিকায় ১৯৯১ সালের ২২শে জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন মেজর আলাউদ্দীন আহমেদের বর্ণনা তার জবানীতে নিমরূপ : ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাত তিনটায় ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডারের আদেশে আমি প্রয়াত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে যাই স্টেশন কমান্ডার আগেই সেখানে পৌছে ছিলেন। মেজর বজলুল হুদা এবং তার লােকজন পাহারা দিচ্ছিলেন হুদা আমাকে প্রথমে বাধা দিলেও পরে বাড়িতে ঢােকার অনুমতি দেন। সড়ক নং৩২, শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি। সবগুলাে লাশ সিড়ির গােড়ায় আনা হয় রাখা হলাে কাঠের কফিনে বরফ আনা হয়েছিল রক্ত, মগজ, হাড়ের গুঁড়াগুলাে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল প্রথম তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে বাড়ির সব বাসিন্দাকেই খুব কাছে থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দেয়ালগুলােও গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় খােসাগুলাে মেঝেতে পড়ে ছিল। কয়েকটি জানালার কাচ ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায়। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র, গিফট বক্স ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিয়েগুলাের উপহারের প্যাকেট।
পবিত্র কোরান শরীফও মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলাম। শেখ মুজিবের বাড়িতে নয়জনকে হত্যা করা হয়েছিল। লাশগুলােকে যে অবস্থায় দেখা যায় : ১. শেখ মুজিব- প্রথমতলার সিঁড়ির মাঝখানটায় যে সমতল অংশটি তার তিনচার ধাপ উপরে চশমার ভাঙা কাঁচ ও একটি পাইপ সিঁড়িতে পড়ে ছিল। ২. শেখ কামাল অভ্যর্থনা কক্ষে। ৩, টেলিফোন অপারেটর অভ্যর্থনা কক্ষে। ৪, শেখ নাসের নিচতলায় সিড়ি সংলগ্ন বাথরুমে। ৫. বেগম মুজিব মূল বেডরুমের সামনে। ৬. সুলতানা কামাল মূল বেডরুমে। ৭, শেখ জামালমূল বেডরুমে। ৮. রােজী কামাল- মূল বেডরুমে। ৯. শেখ রাসেল-মূল বেডরুমে, তার দুই ভাবীর মাঝখানে। শেখ মুজিব : প্রথম তলায় সিড়ির মাঝখানে যে সমতল জায়গাটা তার তিনচার ধাপ উপরে একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয় তার তলপেটে ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। যিনি সব সময় চশমা পরতেন এবং ধূমপানের অভ্যেস ছিল তার চশমা ও তামাকের পাইপ সিঁড়িতে পড়ে ছিল পরনে চেক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। চশমার একটি কাঁচ ভাঙা রক্তে পাঞ্জাবির রং ছিল। গাঢ় লাল। একটি বুলেট তার ডান হাতের তর্জনীতে গিয়ে লাগে এবং আঙ্গুলটি। প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
শেখ কামাল : কামালের বুকে ও তলপেটে তিন থেকে চারটি বুলেট বিদ্ধ হয়। তার পরনে ছিল ট্রাউজার । নীচতলায় তাকে খুন করা হয়। শেখ নাসের : শেখ নাসেরকে খুন করা হয় বাথরুমের কাছে তার হাত উড়ে গিয়েছিল গুলিতে তার দেহের বেশ কিছু স্থান ছিল ক্ষতবিক্ষত তার গায়ে কোনাে পােশাক ছিল না এবং লাশ বিছানার চাদরে মােড়ানাে ছিল বেগম মুজিব : বেগম মুজিবের বুকে ও মুখমণ্ডলে গুলি করা হয় তার পরনে ছিল সুতি শাড়ি এবং কালাে রঙের ব্লাউজ গলায় মাধুলি বাঁধা একটি সােনার নেকলেস কনিষ্ঠ আঙ্গুলে ছােট্ট একটি আংটি তখনও তার পায়ে ছিল বাথরুম স্লিপার।
সুলতানা কামাল : সুলতানা কামালের বুকে ও তলপেটে গুলি লাগে পরনে ছিল শাড়ি ও রাউজ শেখ জামাল : শেখ জামালের মাথা চিবুকের নিচ থেকে উড়ে গিয়েছিল পরনে ট্রাউজার ডান হাতের মধ্যমায় ছিল একটি মুক্তার আংটি। সম্ভবত এটি। ছিল তার বিয়ের আংটি রােজী কামাল : তার মুখটি দেখাচ্ছিল বিবর্ণ, মলিন। মুখের একাংশ উড়ে গিয়েছিল। তার তলপেট, বুক ও মাথায় গুলি করা হয় পরনে ছিল শাড়ি ও রাউজ।
শেখ রাসেল : সম্ভবত আগুনে তার পা ঝলসে যায় মাথা উড়ে গিয়েছিল পরনে ছিল হাফপ্যান্ট লাশ একটি লুঙ্গিতে মােড়ানাে ছিল। তিনটি মেঝেতে ছড়ানাে-ছিটানাে ছিল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কামাল-জামালের বিয়ের অনেক উপহার সামগ্রী এবং গিফট প্যাকেট কিছু বাক্স ছিল ফাকা কামালের কক্ষে রূপার তৈরি অনেক জিনিসপত্র দেখা যায় সিড়িতে ছিল আলপনা আঁকা অভ্যর্থনা কক্ষটি ছিল নােংরা আমি উপরতলা থেকে শুনলাম হুদা চিৎকার করছেন তিনি এ বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র চুরি করায় কয়েকজন সিপাহীকে গালাগালি দিচ্ছিলেন। সড়ক নম্বর ১৩/১, ধানমন্ডি, শেখ মণির বাড়ি মণি ও তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে তাদের এই বাড়িতে খুন করা হয়। তাদের বাড়ির দিকে সেনাবাহিনীর গাড়ি আসতে দেখে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব ছেড়ে চলে যান বাড়িটি ছিল আংশিক তছনছ করা মেঝেতে স্পষ্ট রক্তের দাগ মাঝের টেবিলে একটি এলুমিনিয়ামের বাটিতে কিছু ভিজানাে চিড়া ছিল।
৩৭, মিন্টো রােড আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি। মন্ত্রীর বাড়িটি ছিল ফাকা ড্রয়িংরুম জুড়ে দেখা গেল জমাট বাঁধা রক্ত। বাড়ির নিরাপত্তা পুলিশ আগেই পালিয়েছিল। সেরনিয়াবাত ও শেখ মণি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে সংগ্রহ করা হয়। লাশগুলাে ছিল বিকৃত তাপ ও আর্দ্রতা লাশের ক্ষতি করে। লাশ থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। বনানী গােরস্থানে দাফনের জন্য আমরা লাশগুলাে সেনানিবাসে নিয়ে এলাম। বনানীর গােরস্তানে লাশগুলি দাফন করা হয় । শেখ মুজিবের লাশ মেজর মহিউদ্দীনের নেতৃত্বে হেলিকপ্টারযােগে টুঙ্গীপাড়া পাঠানাে হয় ১৬ই আগস্ট। সেখানে তার গােসল, জানাজা এবং দাফন সম্পন্ন করা হয় তার পারিবারিক গােরস্তানে। [এই বিবরণী মেজর আলাউদ্দীন আহমদের ১৯৭৫-এর ১৮ই আগস্ট তারিখের ।]
১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের কালাে রাত্রিতে নিহতদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, রাষ্ট্রপতি। বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গােপালগঞ্জ মহকুমায় (বর্তমান জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান গােপালগঞ্জ আদালতে চাকুরি করতেন। ১৯৪২ সালে গােপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি বি. এ পাশ করেন। ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীসহ কতিপয় খ্যাতিমান রাজনীতিকের সংস্পর্শে আসেন ছাত্রজীবনেই । পাকিস্তান কায়েমের পর (১৯৪৭ সালে) তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ক্লাশে ভর্তি হন। তিনি ভাষা আন্দোলনে যযাগদান করেন। রাজনৈতিক কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টে যোেগ দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন। তিনি যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী পরিষদে যােগদান করেন। রাজনৈতিক কারণে তিনি বহুবার জেল খেটেছেন, সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হন । ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রণয়ন করেন। সত্তর-এর নির্বাচনে প্রদেশে ও কেন্দ্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ তার নেতৃত্বে। ১৯৭১এর ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (ঢাকা) অসহযােগ ঘােষণা। ২৫শে মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে পাকবাহিনী কর্তৃক বন্দী হন এবং পরে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আটক রাখা হয়। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয় । ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে (তার অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম) প্রবাসী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার শপথগ্রহণ করে। সেদিনই কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যদের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
শেখ মুজিবের ছােট ভাই শেখ নাসের ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি পারিবারিককর্মে ব্যস্ত ছিলেন। খুলনা শহরে ব্যবসায় উপলক্ষে বসবাস করতেন। তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। ১৯৭৫-এর সেই কালাে রাতে তিনি বড় ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাড়িতে (ঢাকায়) অবস্থান করছিলেন বেড়াতে এসে, এখানে তিনি ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।
শেখ জহুরুল হক ছিলেন শেখ লুর রহমানের চাচাতাে ভাই। তার কনিষ্ঠা কন্যা শেখ ফজিলাতুননেসার জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ই আগস্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে তার বিবাহ হয় ১৯৪২ সালে। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, ধৈর্যশীলা মহিলা ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে শেখ মুজিব বহুবার এবং দীর্ঘ সময় জেলে কাটালেও, তিনি ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার কাজ এবং রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে সুনিপুণভাবে সমাধা করেছেন। ১৫ই আগস্ট তিনি ঘাতক বাহিনীর গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন।
শেখ কামাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জ্যেষ্ঠপুত্র। জন্ম ৫ই আগস্ট ১৯৪৯ সালে। শাহীন স্কুল থেকে মেট্রিক ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচ. এস. সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখান থেকে সমাজ বিজ্ঞানে বি, এ
(অনার্স) পাশ করেন। অতঃপর ১৯৭৫ সালে এম. এ. পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ছায়ানটে সেতার বিভাগে ছাত্র ছিলেন। তিনি নাটকেও অভিনয় করতেন। ১৯৭৫-এর ১৪ই জুলাই সুলতানা খুকুকে বিয়ে করেন । ১৫ই আগস্ট ঘাতকের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন।
শেখ জামাল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র। ১৯৫৪ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। একটি সংগীত শিক্ষালয়ে গীটার বাজানাে শিখতেন। লন্ডনে স্যান্ডহার্ট আর্মি একাডেমী থেকে সেনা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫-এর ১৭ই জুলাই ফুফাতাে বােন রােজীকে বিয়ে করেন। ১৫ই আগস্ট ঘাতক কর্তৃক নিহত হন।
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেল ১৯৬৪ সালের ১৬ই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে অধ্যয়ন করতাে। ১৫ই আগস্ট তাকে তার মায়ের লাশ দেখানাে হয়। সে ঘাতকদের কাছে। বলেছিল- “আমাকে হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দিন। নিষ্ঠুর ঘাতকেরা এই শিশুর করুণ আকুতিতে কর্ণপাত না করে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী দবিরউদ্দীন আহমেদের কনিষ্ঠা কন্যা সুলতানা । জন্ম ঢাকায় ১৯৫১ সালে। ১৯৭৫ সালে সমাজবিজ্ঞানে এম. এ. পরীক্ষা দেন । খেলাধুলায় প্রতিভাময়ী । ১৯৬৮ সালে ঢাকার মাঠে পাকিস্তান অলিম্পিকে লং জাম্প-এ (১৬ ফিট দূরত্বে রেকর্ড স্থাপন করে স্বর্ণপদক পান। ১৯৭০ সালে নিখিল পাকিস্তান মহিলা এথলেটিকস প্রতিযােগিতায় স্বর্ণপদক অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের সঙ্গে তার বিয়ে হয় । ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ঘাতক কর্তৃক নিহত হন।
পারভীন রােজীর জন্ম সিলেটে ১৯৫৬ সালে। বঙ্গবন্ধুর ছােটবােন খােদেজা হােসেনের কন্যা পারভীন রােজীর পিতার নাম সৈয়দ হােসেন। তিনি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। রােজী ধানমন্ডি গার্লস হাইস্কুল থেকে এস. এস. সি. পাশ করে বদরুন্নেসা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে এইচ. এস. সি. ফাইনাল ইয়ারে পাঠরতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ঘাতকের গুলিত প্রাণ হারান।
সেরনিয়াবাতের জন্ম বরিশালের কাশীপুরে বাংলা ১৩২৭ সালের ১৪ চৈত্র । তিনি কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেজ বােন আমেনা বেগমকে তিনি বিয়ে করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আই. এ. পাশ করে বরিশালে আইন ব্যবসায় শুরু করেন। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে খ্যাতিমান হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য। নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের কৃষিমন্ত্রী হন। ১৯৭৩ সালে সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী হয়েছিলেন। ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ঘাতক কর্তৃক নিহত হন।
বেবী সেরনিয়াবাত বেবী সেরনিয়াবাত আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কনিষ্ঠা কন্যা। জন্ম ১৯৬০ সালের ২০শে মে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে অধ্যয়ন করছিল । ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে ঘাতক কর্তৃক নিহত হয়।
আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কনিষ্ঠ পুত্র । জন্ম ২৭শে মার্চ ১৯৬৪ সালে। ঢাকা ল্যাবরেটরী হাইস্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিল। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ঘাতক কর্তৃক নিহত হয়।
আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের নাতী সুকান্ত আব্দুল্লাহর পিতার নাম হাসানাত আব্দুল্লাহ হাসানাত আব্দুল্লাহ আব্দুল রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠপুত্র ১৫ই আগস্ট সুকান্ত দাদার বাসায় ছিল । ঘাতকের গুলিতে এই চার বছরের শিশুটি সে রাতে প্রাণ হারায়। তার জন্ম ১৯৭১ সালের ২২শে জুন।
আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ভ্রাতুস্পুত্র। জন্ম ২৬শে মার্চ ১৯৪০ সালে। ঢাকা থেকে আইন পাশ করে বরিশাল কোর্টে প্রাকটিস করছিলেন। চাচার বাসায় বেড়াতে এসে ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ঘাতক কর্তৃক নিহত হন।
আব্দুল নঈম খান রাজনৈতিক নেতা আমির হােসেন আমুর খালাতাে ভাই । জন্ম বরিশালে ১৯৫৭ সালের ১লা ডিসেম্বর। একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে ঢাকায় এসে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় অবস্থান করছিলেন। ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের সেই ভয়াল রাত্রীতে ঘাতকের গুলিতে নিহত হন।
কর্নেল জামিলের জন্ম গােপালগঞ্জে ১৯৩৩ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি । তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার ছিলেন। ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবের বাড়িতে আসার পথে ঘাতকের গুলিতে নিহত হন।
শেখ ফলজুল হক মণি শেখ মুজিবুর রহমানের মেজো বােনের জ্যেষ্ঠপুত্র তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের চাচাতাে ভাই এবং ভগ্নীপতি। মণির জন্ম টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৩৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর। তিনি ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউট | থেকে মেট্রিক পাশ করেন। বরিশাল বি. এম. কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে বি. এ. পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি এম. এ. পাশ করেন ১৯৬২ সালে। পরবর্তীতে আইন পাশ করেন। তিনি দৈনিক বাংলার বাণী নামে সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। একাত্তরে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মুজিব বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন তিনি। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ মণি সাংবাদিক ও চিন্তাবিদ হিসেবেও খ্যাতিমান ছিলেন। তিনি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কন্যা আরজু সেরনিয়াবাতকে বিয়ে করেন। ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বিদ্রোহী সেনাদের গুলিতে তিনি নিহত হন। তার দু’খানা গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, যথাক্রমে ‘বৃত্ত এবং “গীতারায় নামে।
আরজু মণির জন্ম ১৫ই মার্চ ১৯৪৭ সালে। তিনি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠা কন্যা । তিনি বি, এম, কলেজ (বরিশাল) থেকে বি. এ. পাশ করেন। ১৯৭০ সালে খালাতাে ভাই শেখ মণির সঙ্গে তার বিবাহ হয়। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম. এ. পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ১৫ই আগস্ট ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
সূত্রঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড – মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান