You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুজিব হত্যাকাহিনী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট অতি প্রত্যুষে  এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় কতিপয় জুনিয়র সেনাকর্মকর্তাদের দ্বারা এ হত্যাকাণ্ডকে গুপ্তহত্যা কিংবা পুরােপুরি সামরিক অভ্যুত্থানজনিত ব্যাপারও বলা যায় না। এটা ছিল এক বিচিত্র ঘটনা। সামরিক বাহিনীর কজন বিপথগামী সদস্য মিলে ইতিহাসের জঘন্যতম এ কাণ্ডটি ঘটিয়েছিল। বলা হয়, কার্যকারণ ছাড়া কোনাে ঘটনা ঘটে না। মুজিব হত্যার পশ্চাতেও কার্যকারণ ছিল। তবে সেই কার্যকারণে এতােটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটা কিছুতেই সঙ্গত ছিল না। এবার পূর্বাপর ঘটনাবলি আলােচনা করে দেখা যাক ১৯৭২-এর ১০ই জানুয়ারি শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অবশ্য তার জন্য রাখা হয়েছিল রাষ্ট্রপতির পদ। রাষ্ট্রপতির পদে আসেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ‘৭১-এর যুদ্ধকালীন সময়টা গেছে আতংক উৎকণ্ঠায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্য দিয়ে। আর, ‘৭২-এর শান্ত পরিবেশ ছিল না। অরাজকতা, চুরি-ডাকাতি, বিভিন্নমুখী সংঘাত, সমস্যা, খাদ্যাভাব চারদিক থেকে ঘিরে ধরলাে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে। সরকার কোনদিক সামলাবেন?
তখনও মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে অস্ত্র রয়েছে। সরকারের আহ্বানে অস্ত্র জমা হলেও, সকল অস্ত্র জমা হয়েছিল কিনা, তা জানার সুযােগ ছিল না  কেননা, ৭১-এ জনসাধারণের হাতে অস্ত্র এসেছে বিভিন্নভাবে সকল অস্ত্রের লিখিত হিসেব রাখার সুযােগও তখন ছিল না।তাই মনে করা যেতে পারে যে, অস্ত্র জমা হবার পরেও কিছু অস্ত্র রয়ে গেছে সাধারণ জনগণের হাতে। যারা অস্ত্র জমা দিয়েছে তাদের দাবী কর্মসংস্থানের আর যারা অস্ত্র জমা দেয়নি তারা শুরু করেছে সশস্ত্র ডাকাতি আবার রাজাকাররা বঙ্গবন্ধুর ঘােষণার মাধ্যমে পেয়ে যায় সাধারণ ক্ষমা  তারাও কি এ-সময়ে দেশের মঙ্গল চেয়েছে? তাওকি কখনও হয়? সুযােগে তারাও স্বমূর্তিধারণ করেছে। 
 
জলিল মুক্তি লাভ করে তিনি জাসদ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ছাত্রনেতা আ, স, ম, আব্দুর রব এবং আরাে অনেকে জাসদভুক্ত হলেন। বঙ্গবন্ধুর গােটা শাসনামলে জাসদ সরকার বিরােধী আন্দোলন চালিয়ে গেছে। তাতে দেশে বিশৃংখলা বেড়েছে। তারপরও ছিল কমরেড সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির তৎপরতা। এ পার্টি ছিল অননুমােদিত আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি। ইতােমধ্যে ড. কামাল হােসেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। দেশের নামকরণ করা হয়- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি স্থির করা হয়- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের প্রায় ৯০% অধিবাসী মুসলমান তন্মধ্যে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সংখ্যা একেবারে অল্প ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতা আদর্শকে তারা সুনজরে দেখেননি। অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে কোনাে প্রতিবাদ করেননি। বিশৃংখলার মধ্যেই ১৯৭৩-এর মার্চ মাসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ২৪শে ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি পদে মনােনীত হন মুহম্মদ উল্লাহ তিনি ১৯৭৫-এর ২০শে জানুয়ারি পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। ইতােমধ্যে সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটে। পার্লামেন্টারী থেকে প্রেসিডেন্সিয়াল। শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২১শে জানুয়ারি  প্রধানমন্ত্রী হলেন এম. মনসুর আলী।  শেখ মুজিবুর রহমান একবার তাঁর ভাষণে বলেছিলেন : “লােকে পায় সােনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। তাঁর উক্তিটি তৎকালীন প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ সঠিক ছিল  কিন্তু তিনি তা প্রতিরােধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন । তিনি রক্ষীবাহিনী নামে একটি পৃথক সামরিক বাহিনী গঠন করেন। সে-কারণে সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। বস্তুত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক দেশের শৃংখলা ফিরিয়ে আনা কিংবা যাবতীয় দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হয়নি। বরঞ্চ রক্ষীবাহিনী কখনাে কখনাে অত্যাচারীর ভূমিকা পালন করেছে। সব কারণ মিলিয়ে জনমনে অসন্তোষ বৃদ্ধির কারণ ঘটিয়েছে ।
 
দেশে বহু রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটেছে। তাতে দেশে বিশৃংখলা আরাে বেশি বেড়েছে। বিশেষত জাসদ এবং সর্বহারা পার্টির তৎপরতা সরকারকে অস্থির করে তুলেছে আবার দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ অবস্থা। সংবাদপত্রে লেখালেখি চলছিল, যাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার সকল বেসরকারি সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। ঘােষিত হয় ‘বাকশাল’— বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘােষিত হলাে সরকারি-বেসরকারি সর্বস্তরের মানুষকে বাকশালে যােগদানের জন্য আহ্বান জানানাে হলাে অনেকেই তখন বাকশালে যােগদান করেন অবশ্য বাকশাল বিরােধী লােকও ছিল কিছু কিছু  তারা গণতন্ত্রের দেশে একদলীয় রাজনীতি পছন্দ করেননি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ৬১টি মহকুমাকে জিলায় উন্নীত করা হয় মহকুমা বিলুপ্ত হলাে প্রতিটি জিলার জন্য একজন প্রধান কর্মকর্তা থাকবেন। তার পদবি হবে গভর্নর ১৯৭৫-এর ১লা সেপ্টেম্বর শুরু হবে জিলা গভর্নরদের কার্যক্রম  কিন্তু তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সেনাবাহিনীর অসন্তোষ ছিল রক্ষীবাহিনীকে অধিক গুরুত্ব প্রদান তার অন্যতম কারণ সেনা কর্মকর্তাদের কারাে কারাে অসন্তোষ ছিল পদ-পদোন্নতির কারণেও  কেউ আশানুরূপ পদোন্নতি না পেয়ে অখুশি, কেউবা অন্যের পদোন্নতিতে ঈর্ষাপরায়ণ  কিন্তু মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনাে উর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়নি। এ কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন মেজর ফারুক তার প্রধান সহকারী ছিলেন মেজর রশীদ।
এরা দুজন শুধু সমবয়সী এবং বন্ধুই ছিল না, এরা ছিল ভায়রাভাই  ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় একে অপরের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল ছিল তাই দু’জনে মিলে ষড়যন্ত্রের জালবিস্তার তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়েছে। এদের সঙ্গে আরও যারা ছিলেন, তারা হলেন- মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর বজলুল হুদা, মেজর পদমর্যাদার উপরের কেউ ছিলেন না। এদের মধ্যে মেজর ডালিম, মেজর নূরকে কিছুদিন পূর্বে বরখাস্ত করা হয়েছিল। অবসরপ্রাপ্তও ছিলেন ২/৩ জন। কর্মরতরা সবাই ছিলেন ঢাকা ক্যানটনমেন্টের চিফ কর্নেল শাফায়াত জামিলের অধীনে  প্রশ্ন উঠতে পারে, সাধারণ ক’জন মে র দেশের রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার অভিযান চালায় কোন সাহসে? প্রশ্নটি খুবই স্বাভাবিক অথচ এই ভয়ংকর ঘটনাটি তারা ঘটিয়েছিল। সে-কারণে সন্দেহ করা হয় যে, উর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তারা কেউ কেউ ঘটনা জানতেন  তারা এতে সক্রিয় ভূমিকা নেননি। 
 
আবার প্রতিরােধের চেষ্টা করেছেন বলেও জানা যায় না। মেজর জেনারেল জিয়া ছিলেন এ-সময়ে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ । চিফ অফ স্টাফ ছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহ। মুজিব হত্যার পর মােস্তাক আহম্মদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে এলে জিয়াউর রহমান হন সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ । এ-কারণেও তিনি সন্দেহের বাইরে থাকতে পারেননি। সন্দেহের মধ্যে ছিলেন খন্দকার মােস্তাক আহমদও  কারণ তিনি যুদ্ধের সময় থেকে অসন্তুষ্ট ছিলেন। ‘৭১-এর বিপ্লবী সরকারের তিনি প্রধানমন্ত্রী হবার আশা পােষণ করতেন। কিন্তু পদটি তিনি পাননি একজন প্রবীণ আওয়ামী লীগার হয়েও। পরেও শেখ সাহেবের শাসনামলেও তিনি প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতির পদ পাননি। তাই তার অসন্তোষ থাকা অসম্ভব ছিল  অবশ্য এ-সবই ধারণা এ-ধারণাটি সত্যের কাছাকাছি আসে যখন তিনি মুজিব হত্যার পর রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। অবশ্য এরা এবং তিন সেনাবাহিনী প্রধান মােস্তাকের আনুগত্য স্বীকার করলেও, তারা সন্দেহভাজন হননি এ-কারণে যে, তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই আনুগত্য স্বীকার করেন। কিন্তু আনুগত্য স্বীকার করেননি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, তােফায়েল আহমদ, জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ এ জন্য তাদেরকে কারাগারে আটক করা হয়। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরবের সমর্থনে শেখ মুজিব মিশরে চা উপহার পাঠান। কেননা, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের পক্ষে অর্থ এবং অস্ত্র পাঠাবার উপায় ছিল না। বাংলাদেশ থেকে শুভেচ্ছা হিসেবে চা উপহার পেয়ে মিশর খুব খুশি হয়। বিনিময়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত বাংলাদেশকে ৩০টি ট্যাংক এবং ৪০০ রাউন্ড গােলা পাঠিয়ে দেন। শেখ মুজিব এ-গুলাে গ্রহণে ইচ্ছুক ছিলেন না কিন্তু মন্ত্রীবর্গ এবং ফরেন অফিসের পরামর্শে তিনি তা গ্রহণে সম্মত হন ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের পক্ষে এই ট্যাংকগুলাে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন মেজর ফারুক রহমান। অবশ্য তিনি তখন রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড  কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা থাকায় এগুলাে তারই নিয়ন্ত্রণে থাকে। মেজর ফারুকের হত্যা অভিযানের প্রধান প্লাসপয়েন্ট ছিল এই ট্যাংকগুলােই। মেজর ফারুক তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭৫ সালের মার্চ মাস থেকেই ভাবছিলেন। এই অভিযান পরিচালনার জন্য তার অন্তত ৮০০ শত সেনা আবশ্যক ছিল এই মুহূর্তে কর্নেল শাফায়াত জামিলের সহায়তায় মেজর রশীদ ঢাকাস্থ ২-ফিল্ড আর্টিলারীর প্রধানের দায়িত্ব পান ফারুকের সাহস বেড়ে গেল ।

 

২-ফিল্ড আর্টিলারীর সৈন্য সংখ্যা ছিল ৬০০ আর ফারুকের ল্যান্সারের সৈন্য সংখ্যা ৮০০ এবং ট্যাংকগুলােও ছিল তার অধিকারে। আর্মি হেড কোয়ার্টারের নিয়ম অনুসারে বেঙ্গল ল্যান্সার মাসে দু’বার রাতে ট্রেনিং এক্সারসাইজ করতে পারতাে। তাই ট্যাংকের আওয়াজ ক্যান্টনমেন্টে স্বাভাবিক ছিল। সুতরাং তাকে সন্দেহজনক ভাববার অবকাশ ছিল না। রশীদ সুযােগ সৃষ্টি করে নিলেন আরেকটি, তা হলাে ফারুকের ল্যান্সারদের সঙ্গে একত্রে ট্রেনিং-এর অনুমতি অনুমতি পাওয়া গেল। এভাবেই একই রাতে ফারুক-রশীদের অধীন সৈন্যদের একত্র হবার সুযোেগ সৃষ্টি হলাে। অতঃপর রশীদ ২রা আগস্ট খন্দকার মােস্তাকের সঙ্গে দেখা করেন তার আগামসিহ রােডের বাড়িতে তিনি অতি সুকৌশলে আলাপ চালিয়ে বুঝতে সক্ষম হলেন যে, খন্দকার মােস্তাক শেখ মুজিবের অপসারণের পক্ষপাতী। তাকে অপসারণ করা সম্ভব হলে, সেখানে কাকে বসানাে যায়, মােস্তাক তা জানতে চাইলে তিনি বুঝিয়ে দেন ইঙ্গীতে যে, সে পদে মােস্তাকই উপযুক্ত মােস্তাক সম্ভবত বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন মন্ত্রিসভার কারাে কারাে সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। কিন্তু ফারুক-রশীদ অন্যকারাে কাছে যাননি। উল্লেখ্য যে, আন্ধা হাফিজ নামে এক অন্ধ পীরের ভক্ত ছিলেন ফারুক এ-পীরের আস্তানা চট্টগ্রামের হালি শহরে তিনি তার পরিকল্পনার কথা পীরকে বলে দোয়া চেয়েছিলেন। পীর সাহেব তাকে ভরসা দিয়েছিলেন। তবে খুব সাবধানে এগােতে বলেন। ১৪ই আগস্টের দিবাগত রাত ১০টা। গতানুগতিক মহড়ার তারিখ আর্টিলারী রেজিমেন্টের তিন কোম্পানি সৈন্য প্রস্তুত অস্ত্র-শস্ত্রসহ। সবাই যাচ্ছে মহড়ার স্থানের দিকে ওদিকে ফারুকের ২৮টি ট্যাংক প্রস্তুত। অবশ্য তাতে গােলা ছিল না। যথাসময়ে মেজর ডালিম, নূর, শাহরিয়ার এসে উপস্থিত হলেন। সাধারণ সৈন্যরা তখনও জানতাে না, তারা কী ভয়ংকর কাজ করতে যাচ্ছে। তাদেরকে চলতে হচ্ছে তাদের কমান্ডিং অফিসারদের নির্দেশক্রমে। রাত সাড়ে বারােটা।
 
মেজর ফারুক অফিসারদের এয়ারপাের্টের পার্শ্বে অবস্থিত হেড কোয়ার্টার স্কোয়াড্রন অফিসে সববেত করে এই অভিযানের আসল উদ্দেশ্য তাদের কাছে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর প্লান তৈরি হলাে আক্রমণের। প্রধান টার্গেট ধানমন্ডির শেখ মুজিবের বাড়ি। এই আক্রমণের নেতৃত্বে থাকবে ফারুকের ইউনিট  এটি পরিচালনা করবেন মেজর মহিউদ্দীন। বাড়ি ঘেরাও করা হয় দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে  এক ভাগ থাকবে বাড়ি আক্রমণের  দায়িত্বে, অন্যভাগ থাকবে বাইরের দায়িত্বে। যদি কোনাে প্রতিআক্রমণ আসে তা তারা সামাল দেবে এ ভাগ পরিচালনা করবেন মেজর নূর এবং মেজর বজলুল হুদা। শেখ মুজিবের বাড়ি আক্রমণের সাথে সাথে ধানমন্ডিতে অবস্থিত শেখ মণি এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও আক্রমণ চলবে। শেখ মণির বাড়ি আক্রমণের দলটির নেতৃত্বে থাকবেন ডালিম এবং শেখ মণির বাড়ি আক্রমণকারী দলের নেতৃত্বে থাকবেন রিসালদার মােসলেম উদ্দীন। মেজর শাহরিয়ার বিডিআর আক্রমণ ঠেকাবেন যদি প্রয়ােজন হয় এবং রেডিও স্টেশন দখলের দায়িত্বেও থাকবেন তার গ্রুপ নিয়ে। প্রতিআক্রমণের অধিক সম্ভাবনা ছিল সাভার ও শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে ট্যাংক নিয়ে তা প্রতিহত করার দায়িত্ব নিলেন মেজর ফারুক স্বয়ং মেজর রশীদের দায়িত্ব ছিল অপারেশন পরবর্তী অবস্থা সামলানাে ১৫ই আগস্টের সকাল প্রায় পৌনে পাঁচটা ফারুকের ট্যাংক বাহিনী কামান তাক করে দাঁড়িয়ে গেল সাভারের রক্ষীবাহিনীর আস্তানার সামনে রক্ষীবাহিনী ঘাবড়ে গেল। তারাতাে জানতাে না যে, কামানে কোনাে গােলা নেই। এ-ভাবে শেরে বাংলা নগরেও অনুরূপ অবস্থা রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারের কমান্ডার কর্নেল হাসানকে জানানাে হলাে যে, সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এখন থেকে রক্ষীবাহিনীও আর্মির অন্তর্ভুক্ত ভীত রক্ষীবাহিনী এ্যাকশনে গেল না। বিনা রক্তপাতে রক্ষীবাহিনী বশ হয়ে গেল ভাের পাঁচটায় শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি আক্রান্ত হলাে প্রহরারত পুলিশেরা অস্ত্র সজ্জিত সৈন্যদের দেখে ভীত হয়ে পড়লাে। তারা গেট ছেড়ে . দিল। বিনা বাধায় ঘাতকেরা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলাে। বাড়ির ভিতরে শেখ সাহেবের ব্যক্তিগত প্রহরীরা অস্ত্রধারীদের প্রতি গুলি চালালাে। আর্টিলারীর শামসুল হক প্রহরীদের গুলিতে নিহত হলাে। ঘাতক বাহিনী অতঃপর এলােপাথারী গুলি চালাতে শুরু করলাে। শেখ মুজিব বুঝলেন যে, তিনি আক্রান্ত।
 

তিনি বিভিন্ন স্থানে ফোন করলেন এবং মিলিটারী সেক্রেটারী কর্নেল জামিল উদ্দীনকে ফোনে পেয়ে বললেন : ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি এসাে। আমি আমার বাসা আক্রমণ করেছে। শফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলাে।’ জামিল তৎক্ষণাৎ তার প্রাইভেট কারে শেখ সাহেবের বাড়ির দিকে ছুটে আসছিলেন। ঘাতক আর্মির গুলিতে তিনি বাড়ির কাছাকাছি এসে নিহত হন গাড়ির মধ্যেই। প্রচণ্ড গােলাগুলি চলছিল। শেখ সাহেবের দুই পুত্র কামাল এবং জামাল স্টেনগান দিয়ে গুলি ছুঁড়ে প্রতিরােধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ঘরের ভিতরে থেকেই কিন্তু ঘাতকদের ঠেকানাে সম্ভব হচ্ছিল না। শেখ সাহেব জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোনে পেয়ে জানালেন : শফিউল্লাহ, আমার বাসা তােমার সৈন্যরা আক্রমণ করেছে। তুমি তাড়াতাড়ি ফোর্স পাঠাও।’ শফিউল্লাহ সাফায়াত জামিলকে শেখ সাহেবের বাড়িতে ফোর্স পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু শাফায়াত জামিল প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। অতঃপর তিনি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে ফোন করেন  কিন্তু শেখ সাহেবের বাড়িতে ফোর্স পাঠানাে সম্ভব হয়নি। শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির প্রহরীদের খতম করে ঘাতক বাহিনী ভিতরে প্রবেশ করলাে। মেজর মহিউদ্দীন শেখ সাহেবকে দেখে বললেন : ‘স্যার, আপনি আসুন।’ শেখ সাহেব আবার বললেন : “তােমরা কি চাও? তােমরা কি আমাকে খুন করতে এসেছাে?’ মহিউদ্দীন আবার বললেন : ‘স্যার, আপনি আসুন।’ শেখ সাহেব শুধু তাকে ধমকাচ্ছিলেন। মেজর মহিউদ্দীন ঘাবড়ে গেল। এমন সময়ে মেজর নূর এসে উপস্থিত হলেন। সম্ভবত এ-সময়ে শেখ মণিকে হত্যা করেই মােসলেম উদ্দীন এখানে ছুটে এলেন তিনি বুঝে গেলেন যে, মহিউদ্দীনের পক্ষে শেখ সাহেবকে গুলি করবার সাহস হবে না। অতঃপর শেখ সাহেবকে গুলি করা হলাে। তিনি সিড়ির ধাপে লুটিয়ে পড়লেন। গুলিতে তার বুক ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল । রক্তে ভেসে গেল সিঁড়ি। শেখ সাহেবকে কে আগে গুলি করেছে কিংবা একাধিক ব্যক্তি গুলি করেছে কি না, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে মেজর হুদা, মেজর নূর এবং রিসালদার মােসলেম উদ্দীন এই তিনজনের নাম আসে। এদের মধ্যে কেউ একজন কিংবা দু’জনে গুলি করে থাকবে।

শেখ মুজিব পরিবারের যারা ঘাতক কর্তৃক নিহত হলেন :
১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
২। বেগম ফজিলাতুননেসা রেনু-শেখ সাহেবের স্ত্রী।
৩। শেখ কামাল-বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র।
৪। শেখ জামাল-বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র।
৫। শেখ রাসেল বঙ্গবন্ধুর দশবছর বয়সী বালকপুত্র।
৬। শেখ নাসের বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা। তিনি বেড়াতে এসেছিলেন।
৭। সুলতানা আহমদ খুকী-শেখ কামালের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী।
৮। পারভীন হােসেন রােজী- শেখ জামালের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় রেহাই পেয়ে যান।
ঘাতকরা শিশু রাসেলকে পর্যন্ত রেহাই দেয়নি। বলা-ই চলে যে, তারাও এখানে উপস্থিত থাকলে রেহাই পেতেন না। বাসার পুলিশ-প্রহরী, ঝি-চাকর সকলেই সেখানে মৃত্যুবরণ করে। শেখ সাহেবকে গুলি করা হয় সম্ভবত ভাের ছ’টার
দিকে। শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নীপতি এবং মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে যারা নিহত হলেন ;
১। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত।
২। তার পনরাে বছর বয়সী মেয়ে।
৩। তার দশ বছর বয়সী মেয়ে ।।
৪। তার এগারাে বছর বয়সী ছেলে।
৫। তার ভাইয়ের ছেলে শহীদুল ইসলাম সেরনিয়াবাত।
৭। তার পাঁচ বছর বয়সী নাতি, হাসানাত আবদুলাহর ছেলে। এছাড়াও ঝি-চাকর এবং হাসানাতের এক বন্ধু নিহত হয়।
হাসানাত আব্দুলাহ সেই সময়ে বাসায় ছিলেন। তিনি অভাবনীয়ভাবে পালিয়ে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন।
ভাের সােয়া পাঁচটা। শেখ মুজিবের ভাগ্নে এবং যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি নিত্যকার অভ্যেস মতাে ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িং রুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। এমন সময়ে সশস্ত্র ঘাতকবাহিনী সেখানে এসে উপস্থিত হয়। কিছু বুঝে উঠবার আগেই তিনি আক্রান্ত হলেন। তার সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী তার সাহায্যার্থে ছুটে আসেন। ঘাতকের ব্রাশফায়ারে তারা উভয়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সকাল ছ’টায় রেডিওতে মেজর ডালিম (শরিফুল হক)-এর কণ্ঠে শােনা গেল; “আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে । মেজর রশীদ খন্দকার মােস্তাক আহমদের বাসায়। তাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যাবার কথা বলা হলাে। তিনি কিছুটা সংশয়ে পড়লেন। তবু রশীদের সঙ্গে না গিয়ে পারলেন না।  আর্মি চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল শফিউলাহর অফিস কক্ষ। এখানে ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়া, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, কর্নেল নাসিমও উপস্থিত ছিলেন। এখানে উদ্যত স্টেনগান হাতে প্রবেশ করেন মেজর ডালিম। তিনি আর্মি চিফকে লক্ষ্য করে বলেন : স্যার, প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। আপনি আসুন।’ আর্মি চিফ শফিউলাহ বললেন : ‘আমি ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল সাফায়াত জামিলের সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত কোথায় যাবাে না।
 
জেনারেল শফিউলাহ অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন। তার পেছনে স্টেনগান হাতে মেজর ডালিম। বেরিয়ে এলেন জেনারেল জিয়া। তাদের গাড়ি ছুটে চললাে। আর্মি চিফ এসে পৌছলেন ৪৬ ব্রিগেডে  এখানে এসে তিনি মেজর রশীদকে দেখতে পান। কিন্তু কর্নেল শাফায়াত জামিলকে তার অফিসে পাওয়া যায়নি। মেজর রশীদ তাকে বিনীতভাবে অনুরােধ জানালেন : ‘স্যার, রেডিও স্টেশনে চলুন। সবাই ওখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আর্মি চিফ শফিউলাহ, জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ-এর নিষ্ক্রিয়তা এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলের গা-ঢাকা দিয়ে থাকা অবস্থা দেখে বুঝতে সক্ষম হলেন যে, এখন তার কিছুই করার নেই। তাকে এই ঘাতক মেজরদের ইঙ্গিতেই চলতে হবে। নতুবা তারও নিস্তার নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি রেডিও স্টেশনে গেলেন। অভ্যুত্থানকারী মেজরদের চেষ্টায় নৌবাহিনী প্রধান এবং বিমান বাহিনী। প্রধানকেও রেডিও স্টেশনে আসতে হলাে। তিন বাহিনী প্রধান মােস্তাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন নিরুপায় হয়েই। মেজর ফারুক-রশীদের অভ্যুত্থান পুরােমাত্রায় সফল হলাে। সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, কোনাে তরফ থেকেই প্রতিবাদ উঠলাে না। শাফায়াত জামিলের ৪৬ ব্রিগেডের সেনারা সবাই উল্লাসে মেতে উঠলাে এই সাফল্যের কারণে  অতঃপর দুপুরবেলা মােস্তাক আহমদ বিরাট মিছিল সহকারে বঙ্গভবনে ফিরে এলেন। তখনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তিন বাড়ির লাশগুলাে তেমনি পড়ে ছিল রক্তশয্যায়। আর, এদিকে ঘাতকেরা উল্লাসে উন্মাদ। বিকেলে নিমােক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় :
১। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
২। অধ্যাপক মােহাম্মদ ইউসুফ আলী।
৩। শ্ৰী ফণীভূষণ মজুমদার।
৪। মােহাম্মদ সােহরাব হােসেন।
৫। মােহাম্মদ আব্দুল মান্নান।
৬। শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর।
৭। মােহাম্মদ আব্দুল মােমিন।
৮। মােহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান।
৯। ডকটর আজিজুর রহমান মল্লিক। 
১০। ডকটর মােজাফফর আহমেদ চৌধুরী।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাহমুদ উলাহর নাম ঘােষণা করা হয়। এরা সবাই বঙ্গবন্ধুর সরকারে মন্ত্রী ছিলেন। এই সঙ্গে আরও ছয়জন প্রতিমন্ত্রী নেওয়া হয়, পরে সংখ্যা বেড়ে দশজন হয়। তাদের নাম :
১। তাহের উদ্দীন ঠাকুর।
২। শাহ মােয়াজ্জম হােসেন।
৩। মােঃ নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ।
৪। মােঃ ওবায়দুর রহমান।
৫। রিয়াজুদ্দীন আহমেদ ভােলা মিয়া।
৬। সৈয়দ আলতাফ হােসেন।
৭। দেওয়ান ফরিদ গাজী।
৮। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী।
৯। মােমেন উদ্দীন।
১০। ডাক্তার ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল।
বলাবাহুল্য, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি-উপরাষ্ট্রপতি সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় ।  প্রেসিডেন্ট হিসেবে খন্দকার মােস্তাক আহমদ বেতারে যে ভাষণ দেন, তা নিমে উদ্ধৃত হলাে :
বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম। প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বােনেরা, আচ্ছালামু আলাইকুম । এক ঐতিহাসিক প্রয়ােজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের পুতপবিত্র দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার ওপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব আমার উপরে অর্পিত হয়েছে। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বজ্রকঠিন দায়িত্ব সম্পাদনের পথ সুগম করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। সত্যিকারের বীরের মতাে অকুতােভয় চিত্তে এগিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেল্স, রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য ও আস্থা প্রকাশ করেছেন। এরা সবাই একযােগে কাজ করে যাচ্ছেন।
 
 ত্রিশলাখ বীর শহীদানের পুতপবিত্র রক্ত এবং দুই লাখ মা-বোেনর পবিত্র ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বাংলার সংগ্রামী মানুষকে নতুন জীবনের আস্বাদ ও সন্ধান দেবে এবং স্বাধীন সার্বভৌম দেশে সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে আমরা মাথা উচিয়ে দাড়াবাে। এই ছিল আমাদের লক্ষ্য ও কামনা। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বন্ধুদেশের অনেককেও আত্মাহুতি দিতে হয়েছে । কিন্তু বিগত দীর্ঘকাল ভাগ্যোন্নয়নের কোনাে চেষ্টা না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা এবং সেই ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে আঁকড়ে রাখার ষড়যন্ত্রের জাল রচনা করা হয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দাবার চাল হয়েছে এবং দেশবাসীর ভাগ্য উন্নয়নকে উপেক্ষা করে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অন্যকে বঞ্চিত করে এক শ্রেণির পৃষ্ঠপােষকদের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত করা হয়েছে। কতিপয় ভাগ্যবানের স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টায় জনগণের জীবনে দৈনন্দিন প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান অগ্নিমূল্য অসহনীয় হয়ে পড়ে। দেশের শিল্প বিশেষ করে পাটশিল্প ধ্বংসের মুখে অর্থনৈতিক অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌছায়, যেখানে বাংলার সর্বশ্রেণির মানুষ দারিদ্র, ক্ষুধা ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের অসহায় শিকারে পরিণত হয়।  একটি বিশেষ শাসকচক্র গড়ে তােলার লােলুপ আকাক্ষায় প্রচলিত মূল্যবােধের বিকাশ ও মানুষের অভাব-অভিযোেগ প্রকাশের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। এই অবস্থায় দেশবাসী এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে অব্যক্ত বেদনায় তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। দেশের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন। সকল মহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সশস্ত্রবাহিনী পরম নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে সামনের সম্ভাবনার এক স্বর্ণদ্বার উন্মােচন করেছে।
 
এখন দেশবাসী সকল শ্রেণির মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্রুত নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোরতর পরিশ্রম করতে হবে। সর্বপ্রকার কলুষ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। দেশে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং মানুষ মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সেজন্য সমাজে মূল্যবােধ প্রতিষ্ঠিত করতে দেশপ্রিয় সকল মানুষকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সর্ব অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতি ও সম্প্রীতি অটুট রাখতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরের প্রতি, মানুষের নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে সেই অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। শান্তি ও শৃংখলার সহিত স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু রাখতে হবে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সমতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবােধ ও প্রত্যেক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং একে অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার নীতি অব্যাহত থাকবে। সরকার জোটনিরপেক্ষ নীতি সক্রিয়ভাবে অনুসরণ করে যাবেন। আমাদের সরকার জাতিসংঘ সনদ ও নীতিমালার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। দ্বিপক্ষীয় বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের সম্পর্ক নির্ধারণকারী সকল চুক্তি ও দায় সম্পর্কে সরকার মর্যাদাশীল থাকবেন। বর্ণবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং নয়া উপনিবেশবাদ বিরােধী আমাদের নীতি অব্যাহত থাকবে  ইসলামী সম্মেলন সংস্থা কমনওয়েলথ ও জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অটুট থাকবে। এই সব মাের্চার সর্বপ্রকার তৎপরতার সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সহযােগিতা ও শরিকানা অব্যাহত থাকবে।
বিশ্বশান্তি ও আন্তর্জাতিক সহযােগিতা দৃঢ়তর করার প্রচেষ্টাও আমরা অব্যাহত রাখবাে। এখনাে পর্যন্ত যাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়নি, সেসব দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও ইনশাআলাহ আমরা সচেষ্ট থাকবাে  সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারুর প্রতি বিদ্বেষ নয়- এ নীতির রূপরেখার মধ্য দিয়ে শান্তি ও প্রগতির সাথে আমাদের অগ্রযাত্রা আমরা অব্যাহত রাখবাে। সরকার বিশেষভাবে উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা নিচ্ছেন। ইসলামী সম্মেলন সংস্থা, কমনওয়েলথ রাষ্ট্রসমূহ, জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন এবং বৃহৎ শক্তিসমূহের সঙ্গে এই সরকার ঘনিষ্ঠতর এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী । সরকার ইসরায়েলের কবল থেকে আরবভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য আরব ভাইদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম ও ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাচ্ছেন। 
প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বােনেরা, আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দিতে চাই যে, কোনাে প্রকার দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা সামাজিক কলুষতার সঙ্গে এই সরকারের কোনাে আপােষ নেই । আপনাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন এক অভূতপূর্ব সুযােগ সেই জন্যে আপনাদের সামনে রয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জ প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বােনেরা, আসুন আমরা পরম করুণাময় আল্লাহ। তায়ালার কাছে কায়মনাে একবাক্যে এই মােনাজাত করি, তিনি যেন আমাদের সহায় হন এবং তাঁর অপার করুণায় আমাদের সঠিক পথে চালনা করেন। খােদা হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। ১৫ই আগস্ট দিবাগত রাত। রাতের অন্ধকারে শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় পড়ে থাকা লাশগুলাে সরানাে এবং দাফনের ব্যবস্থা করলাে ঘাতকসেনারা। শেখ সাহেবের পরিবারের ৭ জনকে দাফন করা হয় বনানীতে। বনানীতে মােট ১৮টি কবর। অন্যান্যগুলােতে সেরনিয়াবাত ও ফজলুল হক মণির বাড়িতে যারা নিহত, তাদেরকে দাফন করা হয়েছে। ১৬ আগস্ট শেখ মুজিবের লাশ নিয়ে হেলিকপটার যােগে টুঙ্গিপাড়া যায় ঘাতক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে। মেজর মহিউদ্দীন এই কাজের নেতৃত্বে ছিলেন। পুলিশের সহায়তায় ১৫/২০ জন লােক জড়াে করে শেখ সাহেবের গােসল ও জানাজা সমাপ্ত করা হয়। সন্ধ্যার পূর্বেই। দাফন সমাপ্ত করে লাশ বহনকারীরা ঢাকার দিকে যাত্রা করে। স্বাধীনতার স্থপতি, বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তার জন্মভূমি টঙ্গীপাড়ায় নিজবাড়িতে পিতার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন ।

হলাে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশির ভিড়। ফেললাে না কেউ দুফোটা চোখের পানি কেননা, ছিল না তেমন পরিবেশ যে, মানুষজন ছুটে এসে জাতির প্রিয় নেতাকে একবার শেষ দেখা দেখতে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!  খন্দকার মােস্তাক আহমদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন মাত্র ৮২ দিন তাও ঘাতক মেজরদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে বলতে গেলে ফারুকরশীদদের মর্জি-মেজাজের ওপর নির্ভর করেই তাকে চলতে হয়েছে। তাদেরকে বঙ্গভবন থেকে তিনি সরাতে পারেননি। তিনি জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ পদে বহাল করেন। এম. এ. জি. ওসমানীকে তিনি তার সামরিক উপদেষ্টা নিয়ােগ করেন। জিয়াকে সেনাবাহিনী প্রধান করা হয়েছিল ফারুক-রশীদের চাপের মুখে  মােস্তাক অবশ্য জিয়াকে পছন্দ করতেন না। কিন্তু ফারুক-রশীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাধ্যও তার ছিল না।  মােস্তাক দেশে আরও যা-যা পরিবর্তন ঘটান, সেগুলাে হলাে :

১। “জয় বাংলা’ স্থলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ এবং বাংলাদেশ বেতার’ স্থলে  ‘রেডিও বাংলাদেশ’ বলা।
২। রাষ্ট্রীয় কাজে ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া ।
৩। ৬১টি জেলা বাতিল করে সাবেক উনিশ জেলা বহাল। জেলা-গভর্নর নিয়ােগ বাতিল।
৪। রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধকরণ।
৫। বেসামরিক প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি।
৬। কতিপয় ব্যক্তির নাগরিকত্ব যা পূর্বে বাতিল করা হয়েছিল, তা পুনর্বহাল ।
৭। কট্টর বামপন্থি এবং স্বাধীনতা বিরােধীদের পুনর্বাসনের সূচনা।
৮। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি, যাতে বলা হয়েছে- শেখ মুজিব হত্যার
বিচার করা যাবে না । (এই অর্ডিনান্স জারির ফলে ঘাতক বাহিনী নিরাপত্তা পেয়ে গেল।)

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড – মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান

 
 
 
 
 
 
 
 

 

 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!