দিঘিরজান ক্যাম্পের অধিনায়ক ছিলেন সরােয়ার হােসেন, তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। আমার ছাত্র জিলবুনিয়ার প্রফুল্ল কুমার এদবর দিঘিরজান ক্যাম্পে ছিল। সে ছিল নাওটানা হাই স্কুলের শিক্ষক ডিসেম্বরে কলার দোয়ানিয়া গ্রামের বাসিন্দা এবং প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নুরুদ্দীনের নেতৃত্বে কলার দোয়ানিয়া হাইস্কুলে একটি মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প বসে আরেকটি ক্যাম্প বসে জানুয়ারি মাসে (১৯৭২ সালে) যুদ্ধ শেষ হবার পর দীর্ঘা। ইউনিয়ন পরিষদে। কলার দোয়ানিয়া ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকারলুঠকারীদের উপর কিছু টর্চার করা ব্যতিরেকে আর কিছু করতে পারেনি। দীর্ঘা। ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধাদের সে সুযােগও ছিল না। লেবুজিলবুনিয়ার ছেলে রুহুল আমিন ছিল ‘৭১-এর এস, এস, সি, পরীক্ষার্থী সে চেয়েছিল একটি মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে । তার দলে কয়েকজন কিশাের-তরুণ অংশগ্রহণ করে। তার অস্ত্র ছিল, ছােরা, রামদা এবং কাঠের বন্দুক এইসব অস্ত্র নিয়ে এলাকার বিশেষ-বিশেষ বাড়িতে হামলা চালিয়ে টাকা-পয়সা আদায় করতে চাইতাে। তার ইচ্ছা ছিল টাকা-পয়সা যােগাড় করতে পারলে অস্ত্র-শস্ত্র যােগাড় করবে। তার আশা পূর্ণ হয়নি। বিল ডুমুরিয়ায় হামলা করতে গিয়ে সে জনতার হাতে ধরা পড়ে। তাকে বৈঠাকাটা বাজারের মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে সােপর্দ করা হয়। বৈঠাকাটার মুক্তিবাহিনী তাকে হত্যা করে একটা পরিত্যক্ত ভিটায় গলায় রশি বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখে তার পিতা আলী আজম খবর পেয়েও তার লাশ আনেনি। দীর্ঘা ইউনিয়নের উত্তর দিকে, দেউলবাড়ি ইউনিয়নে মিলিটারী অপারেশন হয়নি। একবার বৈঠাকাটা বাজারের মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে মােকাবিলা করার জন্য কতিপয় মিলিটারী রাজাকার লম্বা নৌকায় বৈঠাকাটার দিকে যায় ফেরার পথে বিকেল বেলা গাঁওখালী হাটে অবতরণ করে। আমি তখন হাটেই ছিলাম। এখানে তারা কাউকে হত্যা করেনি। হালকা মারধাের করেছে কাউকে কাউকে। বৈঠাকাটায় মিলিটারী যাবার কারণ, এখানকার ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারা আবদুস সত্তারকে (দেউলবাড়ি ইউনিয়নের দফাদার) হত্যা করে, সেই সংবাদ শুনেই নাকি তাদের যাওয়া। শুনেছি যে, বৈঠাকাটা বাজারে চায়ের দোকানে বসে দফাদার নাকি মুক্তিবাহিনীকে কটাক্ষ করে কথা বলে।
তাই শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে তারা তাকে ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করে আব্দুস সত্তার (ভদ্দর) দফাদার লুঠকারী কিংবা দালাল ছিলেন না, তা সত্য দীর্ঘা ইউনিয়নের লেবুজিল বুনিয়া গ্রামের এস্কান্দার আলী মিয়া গ্রামের মাতুব্বর এবং এক সময়কার ইউ. পি. মেম্বর ছিলেন। তাকে রাতে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে ফেলে দেয় নদীতে নদীতে তার ভাসমান লাশ পাওয়া যায় । এটানাকি মুক্তিযােদ্ধাদের কাজ কিন্তু কোন মুক্তিযােদ্ধারা এটা করেছে, তা জানা যায়নি। তবে অনুমান করা হয়েছে যে, এটা পূর্বশত্রুতার কারণে ঘটেছে। কেননা তিনি লুঠকারী কিংবা দালাল ছিলেন না। ডুমুরিয়ার আব্দুল গণী হাওলাদার। সাবেক বাড়ি ছিল লেবুজিল বুনিয়া গ্রামে তার ছেলে আমির হােসেন মুক্তিযােদ্ধা ছিল। গণী হাওলাদারও একরাতে আততায়ী কর্তৃক নিহত হন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু কিছু অপঘাত মৃত্যুও ঘটেছে। এ সব হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যার শামিল করা যেতে পারে। মিলিটারীদের একটি হিংস্রতার কাহিনী এবার বলবাে। নাজিরপুর থানার কলার দোয়ানিয়া গ্রামের জহিরুদ্দীন এবং তার প্রতিবেশী মহিউদ্দীন, এরা দুজনই যুবক । এরা মুক্তিযােদ্ধা ছিল না। জহিরুদ্দীন ছিল বেশকিছু জমি-জমার মালিক মহিউদ্দীন ঢাকার একটি হাইস্কুলের বি. এস. সি পাশ শিক্ষক যুদ্ধের সময়ে বাড়িতে থাকতাে একদিন তারা একত্রে কোনাে কার্যোপলক্ষে থানায় গিয়েছিল। থানার মিলিটারীরা তাদের আটক করে সন্দেহ করা হয় কলার দোয়ানিয়ার রাজাকার আবদুর রাজ্জাক ক্বারীর ইংগীতে তাদের আটক করা হয় । তাদের আত্মীয়-স্বজন থানায় গিয়ে আবদুর রাজ্জাক কারীকে খুবই অনুরােধ করেন মিলিটারীদের কাছে তাদেরকে ছেড়ে দেবার জন্য সুপারিশ করতে। কিন্তু কারী সাহেব সুপারিশ করতে সম্মত হননি।
তিনি বলেছেন – মিলিটারীরা আটক করেছে, সেখানে আমার সুপারিশে কোনাে কাজে হবে না। পরবর্তীতে তাদেরকে ধৃত মুক্তিযােদ্ধা পরিচয়ে পিরােজপুরে চালান দেওয়া হয়। ওদেরকে যখন হুলারহাট স্টেশনে নামানাে হয়, তখন স্টেশনে পিরােজপুর ক্যাম্পের মিলিটারীর জীপ উপস্থিত ছিল। জীপের পাকসেনাদের হাতে তাদেরকে তুলে দেওয়া হলে তারা ওদের দুজনের পা দড়ি দিয়ে জীপের পেছনে বেঁধে জীপ। চালিয়ে দিল পিরােজপুর শহরের দিকে। জীপ যখন পিরােজপুরে পৌছালাে, তখন আর তাদের শরীরে প্রাণের স্পন্দন ছিল না। একেবারেই বিনাদোষে তারা মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করে। কলার দোয়ানিয়ার সুলতান মাহমুদ ছিল আমার আত্মীয় এবং ছাত্র । ৭১-এ সে দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল।
সে ভারতে চলে যাবে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে, এই ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে সে বাড়ি থেকে একদিন যাত্রা করে। সে আর ফিরে আসেনি। ধারণা করা হয়, পথে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে সে নিহত হয়েছে পিরােজপুর থেকে নাজিরপুর থানা এলাকায় নদীপথে যেখানে শ্রীরামকাঠী বন্দর, যেখানে নদীর নাম কালীগঙ্গা এর পশ্চিমপাড়ে বন্দর। এখান থেকে বেশ খানিক উত্তরে এসে দীর্ঘাবাজার, তারও উত্তরে চাঁদকাঠীবাজার। এগুলাে নদীর তীরেই এ নদী দিয়ে প্রায়শ গানবােট টহল দিতাে বিভিন্ন এলাকায়। কখনও কখনাে গানবােট থেকে তীরের দিকে গুলিও ছোঁড়া হতাে চাঁদকাঠীবাজারে কখনাে গুলি ছোড়েনি। চাঁদকাঠীরবাজার থেকে উত্তরদিকে গাঁওখালী বাজার দূরত্ব মাইল চারেকের এই চার মাইলের মধ্যে হিন্দু অধিবাসী রয়েছে যথেষ্ট সম্ভবত মুসলমানদের চাইতে অধিক কিন্তু এই এলাকায় আশংকা থাকলেও মিলিটারী অপারেশন হয়নি অন্যান্য এলাকায় যেমন ব্যাপক লুঠপাট এবং বাড়িঘর পােড়ানাে হয়েছে, এসব এলাকায় তাও হয়নি। কোনাে কোনাে এলাকায় মুসলমানরা হিন্দুদের বাড়িতে লুঠ করেছে, তাদের ঘরে আগুন দিয়েছে। দীর্ঘা ইউনিয়নের উত্তর এলাকায় সেরূপ ঘটেনি এ ইউনিয়নের পিস কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ মিয়ার ঐ সব কাজের তৎপরতা দেখা যায়নি। তবে নাওটানা এবং তার নিকটবর্তী কিছু কিছু বাড়িতে এক মজাদার লুঠপাট এবং ঘর পােড়ানাের ঘটনা ঘটেছে আমি তার কিছুটা স্বচক্ষে দেখেছি ঘটনাটা বলতে গেলে একটু পেছন থেকে শুরু করতে হয় । শ্রীরামকাঠী বন্দরের দক্ষিণ দিকে কলাখালি গ্রাম এই গ্রামের জালাল মিয়া প্রথমে পুলিশে না ইপিআর-এ চাকুরি করতেন এক সময়ে চাকুরি ছেড়ে কন্ট্রাকটরী শুরু করেন বরিশাল শহরে থেকে তার শ্বশুরবাড়ি ছিল থানার কলার দোয়ানিয়া গ্রামে নাওটানাতে তার ভায়রার বাড়ি যুদ্ধের সময় তিনি শহর ছেড়ে নাওটানা ভায়রাবাড়িতে আশ্রিত হন। এ-সময়ে তিনি এলাকার হিন্দুদের সঙ্গে খুব খাতির জমিয়ে ফেলেন। তিনি এলাকার হিন্দুদেরকে বােঝালেন যে, এক সময়ে মিলিটারী এসে সব হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে এবং লুঠপাট করবে। সুতরাং তার পূর্বে যদি আপােষে কাজটা সমাধা করা যায়, তাহলে আর কোনাে সমস্যা হবে না। হিন্দুরা জানতে চাইলেন কিভাবে তা করা যেতে পারে ।
জালাল মিয়া বােঝালেন যে, এলাকার মুসলমানেরা যদি ঘরের সব মালপত্র লিস্ট করে নিয়ে নেয় আর টিনশেড ঘরের ছাউনির টিনগুলাে তাহলে লুঠ এবং ঘর জ্বালার জন্য মিলিটারী এসে কী করবে? তবে ঘরপােড়ার একটা রেকর্ডও থাকা চাই । সে জন্য নাড়া এবং গােলপাতার রান্নাঘর কিংবা গরুরঘর একটা কিছুপপাড়ালেই হবে। যুদ্ধের পরে মালামাল অবশ্যই মালিক ফেরৎ পাবে। মিলিটারীর ভয়ে কাতর হিন্দুরা জালাল মিয়ার যুক্তি মেনে নিলেন। অতঃপর সংঘটিত হলাে এই এলাকার শান্তিপূর্ণ লুঠপাট হিন্দুরা চেয়ে চেয়ে দেখলেন আর ভাবলেন, এতেও যদি প্রাণে বাঁচা যায়, তাইই ভালাে এলাকার কিছু কিছু মুসলমান এ লুঠপাটে অংশ গ্রহণ করে। পাকবাহিনী বেকায়দায় পড়ে যায় ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দেবার পর থেকে। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণের সামনে পাকসেনারা পর্যদস্তু হয়ে পড়ে ২/৪ দিনের মধ্যেই। তারা আত্মসমর্পণ করবার কথা ভাবতে থাকে, ঠিক সেই মুহূর্তেও তারা গণহত্যা কার্যক্রম বন্ধ করেনি। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত রাজাকার আলবদর সদস্যদের মধ্যে কিছুসংখ্যক তালিকাভুক্ত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিকে বাসা থেকে ভাগিয়ে এনে হত্যা করেছে।
১৬ই ডিসেম্বর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি ৯৩০০০ পাকসেনাসহ আত্মসমর্পণ করে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার কাছে। আত্মসমর্পণের পূর্বে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানরত পাকসেনারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এসে জড়াে হয়েছিল। তাই বেঁচে গেল পাকসেনারা। মুক্তবাহিনীর হাতে পড়লে সবাই যে প্রাণে বেঁচে যেতাে, তা বলা যায় না। সম্ভবত পাকসেনারা তা বুঝতে পেরেছিল। তাই মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। আমাদের এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে খুব তৎপর হয়েছিল লুণ্ঠনকারীদের শাস্তি বিধানে। তারা তালিকা করে কিছুলােককে হত্যা করেছে রাতের অন্ধকারে বাড়িতে হানা দিয়ে । কাউকে বাড়িতেই হত্যা করেছে, কাউকে বাড়ি থেকে ধরে আনবার পর আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি ধৃত ব্যক্তির আমাদের নাজিরপুরের যুগিয়া গ্রামের মাতুব্বর শ্রেণির লােক ছিলেন উমেদ গাজী তিনি লুঠপাটে যুক্ত ছিলেন না। বরং যুদ্ধের সময় হিন্দুদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। তার এক ভ্রাতুস্পুত্র এলাকায় এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে সেই অরাজক সময়ে । উমেদ গাজীকে সেজন্য দায়ী করা যায় না ।
অথচ একদিন রাতে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় পাকুরিয়া গ্রামের আব্দুল গণীকে এভাবেই । আমাদের লেবুজিলবুনিয়া গ্রামের সেকান্দার আলীকেও একদিন রাতে বাড়ি থেকে ধরে আনে। সে আর বাড়ি ফেরেনি। এরা হত্যাযযাগ্য অপরাধী ছিল না। এদেরকে প্রকাশ্যে মারা হয়নি। যারা মেরেছে; তাদের পরিচয়ও জানা যায়নি। বলা যায় – গুপ্তঘাতকের গুপ্তহত্যা। ‘৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে এরূপ গুপ্তহত্যা চলছিল সারাদেশে, কোথাও বা প্রকাশ্যে। সেই সময়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি ঘােষণা : “বিচারের দায়িত্ব নিজ-হাতে নেবেন না। আমাদের কলার দোয়ানিয়া ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারা লুণ্ঠনকারীদের একটা তালিকা প্রস্তুত করে প্রকাশ্যে ধর-পাকড় শুরু করেছিল। অবশ্য তাদের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল না। আর এ ধরনের ধর-পাকড়ের সরকারী নির্দেশও ছিল না । জিলা প্রশাসন থেকে একটা প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছিল লুঠের মাল ফেরৎ দেবার নির্দেশ দিয়ে। এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমি আমার এলাকা থেকে অনেক লুঠের মাল ফেরতের ব্যবস্থা করে দিয়েছি । অবশ্য কেউ কেউ দিতে চায়নি। সেক্ষেত্রে শালিস বৈঠকের ব্যবস্থা করে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সময়ে আমি কলার দোয়ানিয়া ক্যাম্পের প্রধান নুরুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লুণ্ঠনকারী ধর-পাকড়ের বিষয়টি জানতে চাই। তখন আমাকে আমার এলাকার ৪৪ জনের একটা তালিকা দেওয়া হয় । আমাকে বলা হলাে যদি তারা মালামাল ফেরৎ দিয়েও থাকে তবুও তাদের কিছুটা শাস্তি হওয়া উচিত। আপনি এদের দ্বারা স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকার মেরামত যােগ্য রাস্তা মেরামত করিয়ে নেবেন। বলা বাহুল্য আমি তাদের দ্বারা একটি মেরামতযােগ্য রাস্তা মেরামত করিয়ে দিয়েছিলাম। অতঃপর কলার দোয়ানিয়া ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারা এলাকায় কোনাে ধর-পাকড় করেনি। | স্বরূপকাঠী পিরােজপুরের একটি অভিজাত থানা। এলাকাটি কাঠ ব্যবসায়ের জন্য বিখ্যাত। সন্ধ্যানদীর দু’পাড়ে অবস্থিত এ থানাটি। পূর্বপারে স্বরূপকাঠী বন্দর। এখানেও কাঠ ব্যবসায়সহ অন্যান্য ব্যবসা রয়েছে। সরকারি অফিস, পুলিশ স্টেশন থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রও এপারে । এপারেই থানা হেড-কোয়ার্টার থেকে অর্ধমাইল উত্তরে শর্ষিনার পীর সাহেবের বাড়ি। এখানে অবস্থিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আলীয়া মাদরাসা । নদীর পশ্চিম পাড়ে ইন্দুরহাট বন্দর । ইন্দুরহাটের উত্তর পাশে একটি ছােট নদী। এ নদীর উত্তর পাড়ের নাম মিয়ার হাট বন্দর।
ইন্দুরহাটের পশ্চিম পাকে বলা হয় বরছাকাঠী । এখানেই এ অঞ্চলের কাঠ ব্যবসায়ের প্রাণকেন্দ্র । ইন্দুরহাটের সংলগ্ন দক্ষিণপার্শ্বে ইন্দুবাড়ি মাঠ। এখানেই স্বরূপকাঠী কলেজ অবস্থিত। স্বাধীনতার পর এটি সরকারি হয় । ইন্দুরহাটে ‘৭১-এর একটি সিনেমা হল ছিল, যা আজও বর্তমান। মিয়ার হাটে ছিল তিনটি ব্যাংকের শাখা এবং সংলগ্ন কৌরিখাড়ায় বিসিক শিল্পনগরী, সব মিলিয়ে এখানে শহুরে পরিবেশ বর্তমান ছিল। | ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সন্ধ্যা নদীর পশ্চিম পারে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প গড়ে উঠে ছিল। সােহাগদল গ্রামে জাহাঙ্গীর বাহাদুর নামের এক সাহসী যুবক নিজের চেষ্টায় একটা বড় রকমের মুক্তিবাহিনী গড়তে সক্ষম হন। তার একটি ক্যাম্প ছিল উত্ত-পশ্চিম সােহাগদল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, অন্যটি বলদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। নাজিরপুর থানার বৈঠাকাটা বাজারেও তার ক্যাম্প ছিল । তিনি স্বরূপকাঠী, নাজিরপুর এবং বানারীপাড়া এই তিন থানার মুক্তিযােদ্ধা বাহিনীর অধিনায়ক বলে দাবি করতেন। তিনি নিজের চেষ্টায় এলাকা থেকে বন্দুক সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময়ে বাংলা আমার নামে একটি সংবাদ বুলেটিন প্রকাশিত হতাে তার পরিচালনায় । ছাপা হতাে কৌরিখাড়ার বিভিন্ন শিল্প নগরীতে অবস্থিত শাহ প্রিন্টিং ওয়ার্ক থেকে । প্রেসটির মালিক ছিলেন শাহ মােজাহার উদ্দিন। তিনি ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনােনয়ন পেয়ে অত্র এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংবাদ বুলেটিন বাংলা আমার বেশি দিন প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা থাকার কারণে স্বরূপকাঠী, ইন্দুরহাট, মিয়ার হাট বন্দরে মিলিটারী এবং রাজাকারের হামলা ছিল প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রায়শ বন্দরে এসে মিলিটারীরা উড্ডীয়মান স্বাধীন বাংলার পতাকা প্রত্যেক ভবন থেকে নামিয়ে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিত । নির্দেশ না মেনেও তখন উপায় ছিল না । মিলিটারী চলে গেল মুক্তিযােদ্ধারা এসে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলনের হুকুম দিত। এ হুকুমও না মানার সাধ্য ছিল না।
তখন যেন এ এলাকায় দ্বৈত শাসন চলছিল। ইন্দুরহাট মিয়ারহাট এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঘনঘন এবং ব্যাপক মিলিটারী হামলা চলেছে এ-সব কারণেও।শর্ষিনার পীর সাহেবের বাড়ির মাদরাসায় যুদ্ধের সময়ে একটি রাজাকার ক্যাম্প বসেছিল। ধারণা করা হয়, তৎকালীন পীর সাহেব মাওলানা শাহ মােঃ আবু জাফর ছালেহ এর পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। সেকারণে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর তাকে মুক্তিবাহিনী আটক করে এবং বরিশালে পাঠানাে হয়। তিনি কিছুকাল হাজতবাসের পর মুক্তিপান। পীর সাহেবের বাড়ির রাজাকার বাহিনীতে কারা ছিল সে সম্পর্কে পরবর্তীতে তেমন লেখালেখি হয়নি। তাই । সেবিষয়ে সবিশেষ লেখা গেল না। ইন্দুরহাট-মিয়ারহাট এবং তার পার্শ্ববর্তী গ্রাম সােহাগদল, বরছাকাঠী, কৌরিখাড়া, সুটিয়াকাঠীতে বারবার মিলিটারী এসেছে মানুষ হত্যা করেছে । এখানে হিন্দু মুসলমানের বাছ-বিচার করা হয়নি। এখানে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। থাকার কারণেই বারংবার মিলিটারী এসেছে। মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের অত্যাচার প্রতিরােধ করতে পারেনি। পাকসেনার আগমন টের পেলেই তারা পালিয়েছে। মিলিটারী চলে যাবার পরে তারা এলাকায় এসেছে। কখনও মিলিটারীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ তারা করেনি। এ কারণে এলাকার জনসাধারণ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না। একবার বিভিন্ন স্থান থেকে লােক ধরে এনে একদড়িতে উনিশ জনকে বেঁধে ব্রাশফায়ারে হত্যা করেছে ইন্দুবাড়ি মাঠে। ইন্দুবাড়ির মাঠ ছিল মিলিটারীদের একটি বধ্যভূমি । অপর বধ্যভূমি বরছাকাঠীর কাঠপট্টিতে। এখানেও বহুলােক ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার বহুপরে এ-দুটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। একবার মিয়ারহাটের সাধনা ঔষধালয়ের মালিক গােপালবাবুকে দোকান থেকে রাস্তায় বের করে হত্যা। করেছে। ইন্দুরহাট-মিয়ারহাটের একটি মিলিটারী অপারেশন ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ এ অপারেশনটি সংঘটিত হয় নভেম্বর মাসের ১০ তারিখে। সেদিন অত্র এলাকার নিহতের সংখ্যা আজও নিরূপণ করা যায়নি। তবে সংখ্যাটি একশাে ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আক্রমণটি ছিল ত্রিমুখী । ইন্দুরহাট থেকে মাইল তিনেক দক্ষিণে মুনিনাগ গ্রাম। গানবােট থেকে একদল মিলিটারী এখানে অবতরণ করে তারপর রাস্তা ধরে ইন্দুরহাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সামনে যাকে পেয়েছে হত্যা করেছে। আগুন ধরিয়ে কিছু কিছু ঘর বাড়িও পুড়িয়েছে।
অন্যদল ইন্দুরহাটের পশ্চিমে মাইল চারেক দূরবর্তী গ্রাম। জিলবাড়িতে অবতরণ করে জিলবাড়ি থানার শেষ সীমানা বেলুয়া নদীর তীর ঘেঁষে এ গ্রাম নদীর পশ্চিম পাড়ে কলার দোয়ানিয়া বাজার থেকে নাজিরপুর থানা শুরু এই নদী পথে আসে মিলিটারীর গানবােট এবং অবতরণ করে জিলবাড়িতে এখান থেকে অগ্রসর হতে থাকে পথের পার্শ্ববর্তী বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। সামনে যাকে পাওয়া গেছে তাকেই হত্যা করেছে এ ভাবে তারা এসে পৌছে ইন্দুরহাটে অন্য দলটি ইন্দুরহাট থেকে মাইল খানেক উত্তরে সুটিয়াকাঠী গ্রামের মধ্যবর্তী তারাবুনিয়া খালের মুখে নামে গানবােট থেকে। তারা মানুষ মেরে এবং ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে ইন্দুরহাটের দিকে এগােয় তিনদল মিলিটারি এখানে মিলিত হবার পর শুরু হয় আরেক তাণ্ডব লীলা। এই দুটি বন্দরে লুঠপাটের পর সকল ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত করে ফেলে মাত্র দুটি দালান ছাড়া ইন্দুরহাট-মিয়ারহাট বন্দরে ঘর-দোরের অস্তিত্ব ছিল না আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ অনির্ধারিত থেকে গেছে এ দিন বরছাকাঠীতে একই বাড়িতে হত্যা করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে তন্মধ্যে সাত ব্যক্তিকে এককবরে সমাহিত করা হয়েছে। তাদের সমাধিটি পাকা করে চিহ্নিত অবস্থায় রয়েছে। এ অপারেশনে হাজার হাজার লােক মারা পড়তাে পূর্বে হয়তাে সন্দেহ করা হয়েছিল যে, একটা বড় ধরনের অপারেশন এখানে সংঘটিত হতে পারে । হয়তাে এ কারণে এলাকার লােকজন পূর্ব থেকে সতর্ক ছিল।
তাই অধিকাংশ লােক এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। দুই ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারাও কেউ সেদিন এলাকায় ছিল না। স্বরূপকাঠীর হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা আটঘর, কুড়িয়ানা, সমদেকাঠী, কামার কাঠী ইত্যাদি এলাকায় মিলিটারীরা ব্যাপক হামলা চালিয়েছে, লােকজন হত্যা করেছে। কুড়িয়ানায় প্রচুর পেয়ারা বাগান রয়েছে এখানকার পেয়ারা বিখ্যাত এবং অর্থকরী ফসল এখানে পেয়ারা বাগানে নিরাপদে থাকা যাবে ভেবে দূরদূরান্তের লােকজনও এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকসেনারা এ-সংবাদ জানতে পেরে একবার অপারেশনে এসে এ-বাগান ঘিরে ফেলে। আত্মগােপন কারীদের পালাবার আর সুযােগ হয়নি। মিলিটারীদের গুলিতে সবাই মৃত্যুবরণ করে। এখানে সেদিন কতাে লােক নিহত হয়েছে তার সংখ্যা জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, শতাধিক লােকের মৃত্যু ঘটেছে কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয়মাসে হত্যা করা হয়েছে অসংখ্য মানুষ একটা সম্ভাব্য সংখ্যা স্বীকৃত— তা হলাে ত্রিশ লাখ সম্ভবত ইতিহাসে বাংলাদেশের গণহত্যাই সবার শীর্ষে।
সূত্রঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড – মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান