You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড-রাজশাহী-খুলনা-সিলেটে-পিরােজপুর - সংগ্রামের নোটবুক
গণহত্যা : রাজশাহীতে
একাত্তরে পাক-হানাদার বাহিনী রাজশাহীতে বেপরােয়া হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। রাজশাহীর রেলওয়ে স্টেশনের পার্শ্বে নরকংকালপূর্ণ বহু গর্তের সন্ধান মিলেছে। দৈনিক আজাদের প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মােঃ আবু সাঈদকে ২৮শে জুন ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাকবাহিনীর সঙ্গে রাজাকার-আলবদর বাহিনীও এখানে নরহত্যা-উল্লাসে উন্মত্ত হয়। আমার গ্রামের যুবক আলমগীর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম. বি. বিএস কোর্স সদ্যসমাপ্ত করে রাজশাহীতেই অবস্থান করছিল। আলবদর বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে কোথায় কিভাবে হত্যা করেছে, জানা যায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ জন শিক্ষক-কর্মচারী পাকসেনাদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছে বলে জানা যায়। নিহত সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছিলেন গণিত বিভাগের প্রফেসর তাকে বাসা থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। এখানকার জনৈক অধ্যাপককে হত্যা করে তার যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় একজন মিলিটারী অফিসার তাকে তার সঙ্গে বসবাস করতে বাধ্য করে। এখানে শহর এবং শহরতলীতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ এবং লুটতরাজ চালিয়েছে পাক হানাদার বাহিনী সেই সঙ্গে রাজাকার আলবদর বাহিনীর হত্যা তৎপরতা ছিল উল্লেখযােগ্য এখানে অগণিত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। 
 
গণহত্যা : খুলনায়
শহরের কেন্দ্রস্থলে রেলস্টেশন ও রেললাইনে পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় বাঙালি নিধনের উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। এখানে নিয়মিত রেলযাত্রী ও বাসযাত্রীদের উপর হামলা চালানাে হতাে। যাত্রীদের মালামাল লুটপাট করা হতাে। কাউকে বা ধরে এনে হত্যা করা হতাে। নদীর তীরবর্তী এলাকায় নিয়ে যাদেরকে হত্যা করা হতাে, বেয়নেট দিয়ে তাদের পেট চিড়ে নদীতে ফেলে দিত এ-ভাবে অগণিত মানুষের লাশ ভেসে গেছে পানির স্রোতে খুলনার খালিশপুর-দৌলতপুরের জুটমিল এলাকায় বিহারীদের হাতে মৃত্যুবরণ করেছে বহু বাঙালি খুলনার কাসেম নামের এক দারােগাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শিল্প ও কলকারখানা এলাকা, রেল-বাস স্টেশন, জলযান স্টেশন ইত্যাদি স্থানই ছিল পাকসেনাদের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। এ-সব স্থানে লােক যাতায়াত ছিল, নিয়মিত। এখান থেকে যাত্রীদের ধরে ধরে এনে হত্যা করা হতাে বাংলাদেশের প্রায় সকল শিল্প-কারখানা এলাকা এবং শহর-বন্দরে বিহারীরা বসবাস করতাে এরা শিল্প-কারখানার শ্রমিকের কাজ করতে বেশির ভাগ লােক কিছু লােক কসাইয়ের পেশায়ও ছিল। এরা পাকিস্তানি সেনাদের চাইতে কম হিংস্র ছিল না বরং হিংস্রতায় অনেক সময় পাঞ্জাবিদেরকেও হার মানাতাে যে-সকল এলাকায় বিহারীরা থাকতাে, সেইসব এলাকায় বাঙালি নির্যাতন হয়েছে অধিক, বিহারীরা বরাবরই বাঙালিদের সঙ্গে শত্রুতা করে এসেছে শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়েই নয়, তার পূর্বেও বহুবার মিল-কারখানায়, বিহারীরা বাঙালিদের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করেছে। আগে তাদের সুযোেগ এতােটা ছিল না। ঝড়ের সময় যেমন আম কুড়াবার ধূম লেগে যায়, যুদ্ধের সময়ে বিহারীদের তেমনি সুযােগ এসেছিল। এ-সময়ে তারা বাঙালি উচ্ছেদে খুব তৎপর হয়ে ওঠে হত্যা, লুণ্ঠন, বাড়িঘর দখল ইত্যাদি সর্ব প্রকারের সুযােগ তারা নিয়েছে এ-সময়ে। খুলনাতেও তারা এ-ধরনের সুযােগ পেয়েছে তারা পাকসেনাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অগণিত মানুষ হত্যা করেছে। 
 
গণহত্যা : সিলেটে
সিলেট সীমান্ত এলাক। এর সীমানায় রয়েছে ভারতের আসামরাজ্য। এখানে পাকবাহিনীর হামলায় বহু সিলেটবাসীকে পালিয়ে গিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে আশ্রয় নিতে হয়েছে। দেশত্যাগের সহজ সুযােগ থাকা সত্ত্বেও এখানে অসংখ্য মানুষ পাকবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে। ২৬শে মার্চ সকালেই সিলেট শহরে কাফু জারি করা হয় । কাফুর সময়ে পাকসেনারা বিভিন্ন বাড়িতে প্রবেশ করে যুবক-যুবতীদেরকে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। পাকসেনারা অনেক সময় লােকজন ধরে এনে এক স্থানে জড়াে করে। তারপর তাদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। সুপাতলা নামের গ্রামে এক ব্যক্তির নাম ছিল মনােরঞ্জন। তার পরিবারে লােকসংখ্যা ছিল ১৩ জন। তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়। শােক করবার মতাে কেউ আর বেঁচে থাকলাে পাকসেনারা শুধু সিলেটে নয়, অন্যত্রও এ-রকম মর্মান্তিক ঘটনা ঘটিয়েছে। ডা, শামসুদ্দিন সিলেট মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত ছিলেন। তিনি হাসপাতাল ছেড়ে কোথায়ও যাননি। পাকবাহিনী কর্তৃক আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। ৯ এপ্রিল মেডিক্যাল কলেজের কাছে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। ফলে পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করে। তারপর এখানে কর্মরত ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য কর্মচারীদেরকে ধরে নিয়ে প্রাঙ্গণে জমায়েত করে । লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। ডা. শামসুদ্দিন আহমদ, ডা. শ্যামল কান্তি এবং কতিপয় কর্মচারী নিহত হন। হত্যা করা হয় হাসপাতালে রােগীদের দেখতে আসা কিছু আত্মীয়স্বজনকেও। | ডা. শামসুদ্দীন আহমদ বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা করতেন। তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য পরবর্তীতে মেডিক্যাল ছাত্রাবাসটির নামকরণ করা হয় ডাক্তার শামসুদ্দিন হল’ । ১৯৯৮ সালে তার কতিপয় ছাত্রের প্রচেষ্টায় এবং সাবেক স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সহযােগিতায় শেখ হাসিনার সরকার সিলেটের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালটির নামকরণ শহীদ ডা. শামসুদ্দিন হাসপাতাল করার অনুমােদন দেয়। | সিলেট শহরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর হামলা শুরু হয়ে যায় এক সময়ে। তাতে অগণিত মানুষ নিহত হয়। ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয় ঘর-বাড়ির । হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর পদধূলিতে ধন্য এই পবিত্র ভূমিকে বর্বর পাকসেনারা প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে ফেলে। 
 
গণহত্যা : পিরােজপুরে
 
১৯৭১-এ বৃহত্তর বরিশালের একটি মহকুমা এই পিরােজপুর। আমি এই পিরােজপুরের নাজিরপুর থানার অধিবাসী। ‘৭১-এ আমাদের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন এক পাঞ্জাবি যুবক। তার নাম শাকিল আহম্মদ। অসহযােগের সময়ে তিনি একবার নাজিরপুর থানায় এসেছিলেন। সেদিন আমি থানায় উপস্থিত ছিলাম। তার কথা-বার্তা শুনেছি। তাকে দেখে তার কথা শুনে মনে হয়েছে তিনি। বিশেষ শান্তশিষ্ট ভদ্রলােক। পরবর্তীতে পাঞ্জাবি সেনারা যে নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে, তাতে পাঞ্জাবিদেরকে অমানুষ বলাই সঙ্গত। সেই অমানুষদের মধ্যেও দু’একজন মানুষ থাকতেই পারে, তার প্রমাণ এই শাকিল আহম্মদ। ২৫শে মার্চের গভীর রাতে পাকবাহিনী কর্তৃক ঢাকায় অপারেশন তথা গণহত্যা শুরু এবং ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণার পরপরই মুক্তিযােদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে। পিরােজপুরেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই সময়ের সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসারের নামটা ভুলে গেছি। তিনি ছিলেন বর্তমান সময়ের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক, টিভিনাটক এবং চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদের পিতা । পিরােজপুরে পাকসেনাদের ক্যাম্প বসার পূর্বেই তিনি বাঙালি যুবকদের হাতে রাইফেল তুলে দিয়েছিলেন। মহকুমা প্রশাসনের সেকেন্ড অফিসারেরও (নাম মনে নেই) সমর্থন ছিল তাতে । পিরােজপুরে মিলিটারী এলে এই অপরাধে তাদের দু’জনকে হত্যা করা হয়। সম্ভবত পিরােজপুরের গণহত্যার সূত্রপাত এখান থেকেই। মহকুমা প্রশাসক শাকিল আহম্মদ ভালাে মানুষ ছিলেন বলেই স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তাকে পরামর্শ দেন যে, অসহযােগের উত্তপ্ত পরিবেশে বাংলাদেশে সিভিল লাইনে থাকা তার পক্ষে নিরাপদ নয় বলে তার চলে যাওয়া উচিত। তিনি সেই পরামর্শ অনুসারেই এখান থেকে চলে গিয়েছিলেন। সম্ভবত তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিলেন।
 
পিরােজপুরে ক্যাম্প হবার সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় মিলিটারী অপারেশন শুরু হয়ে যায়। পিরােজপুর থানার কদমতলা গ্রামে পাকসেনারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই গ্রামে ভাগীরথী নামে এক বিধবা যুবতী বাস করতাে। সে ছিল আকর্ষণীয় স্বাস্থ্যবতী বিয়ের বছর খানেক পরেই এক পুত্র সন্তান কোলে নিয়ে সে বিধবা হয়। কদমতলার অপারেশন ছিল সে মাসে সেদিন ভাগীরথীকে পাকসেনারা হত্যা করেনি। তাকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। বুদ্ধিমতী ভাগীরথী বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে অতঃপর কি ঘটতে পারে সে পাকবাহিনীর গণধর্ষণ এড়াবার জন্য ক্যাম্প প্রধানের বাধ্যগত হয়ে গেল। স্বেচ্ছায় সে তাকে দেহদান করতে থাকায় তার প্রিয়পাত্রী হতে সক্ষম হলাে অতঃপর ক্যাম্পের বাইরে যেতেও কোনাে বাধা ছিল না। এক সময়ে বাড়িতেও ফিরে আসতাে আবার ক্যাম্পে চলে যেতাে সে পাকসেনাদের আস্থা অর্জন। করতে সক্ষম হলাে ভাগীরথী মিলিটারীকে স্বেচ্ছায় দেহদান করতে বেপরােয়া অত্যাচার এড়াবার জন্য কিন্তু মনে মনে সে প্রতিশােধ নেবার সুযােগ খুঁজছিল  জুন মাসে আবার কদমতলায় মিলিটারী অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিল পাকসেনারা সে আগেই তারিখটা জানতে পেরে গ্রামে ফিরে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে। সে মুক্তিবাহিনীকে অপারেশনের সম্ভাব্য তারিখটা জানিয়ে দেয় এবং তাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে। জুন মাসের সেই অপারেশনে ৪৫ জন পাকসেনা গিয়েছিল কদমতলায়। মুক্তিযােদ্ধারা ভাগীরথীর দেওয়া সংবাদ অনুসারে প্রস্তুত হয়েই ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদে অবস্থানে থেকে পাকসেনাদের উপর গুলি বর্ষণ করতে থাকলাে গেরিলা আক্রমণ এবং আকস্মিকতায় পাকসেনারা সুবিধা করে উঠতে পারলাে না মাত্র জন পাঁচেক ক্যাম্পে ফিরতে সক্ষম হয়েছিল। অন্যান্যরা কদমতলাতেই নিহত হলাে। 

এই ঘটনার পর ভাগীরথী ক্যাম্পে যেতে সাহস পায়নি তার মনে দুর্বলতা ছিল। আর পাকসেনারাও বুঝে নিয়েছিল যে, এই সর্বনাশের জন্য ভাগীরথীই দায়ী। কিন্তু তাকে কোথায় পাওয়া যাবে? রাজাকারদের উপর পাকবাহিনীর নির্দেশ থাকলে তাকে ধরবার। সে জন্য এক হাজার টাকা পুরস্কারও ঘােষণা করা হয়। দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছিল ভাগীরথীর জন্য। সে রাজকারের হাতে ধরা পড়ে গেল একদিন। ভাগীরথীকে ধরে এনে হাজির করা হলাে পিরােজপুরের মিলিটারী ক্যাম্পে। তারপর তাকে আনা হলাে জনবহুল রাস্তায়। তাকে উলঙ্গ করা হলাে। তার দু’পায়ে দু’গাছি রশি বেঁধে লটকে দেওয়া হলাে দু’পা দুটি জীপের সঙ্গে। তারপর জীপ দুটি চলতে থাকলাে দু’দিকে ভাগীরথীর দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল । এ-ভাবে টানা-হ্যাচড়ায় তার দেহের মাংস ছড়িয়ে গেল রাস্তায়। তারপর তার অবশিষ্ট কংকাল ফেলে রেখে গেল রাস্তায়।

 
ভাগীরথী মুক্তিযােদ্ধা ছিল না। তবুও স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। এই নাম, কালের কপােলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে। মহাদেবের জটা থেকে নেমে এসেছিল গঙ্গা এ মর্ত্যভূমিতে ভগীরথের তপস্যার বলে তাই তার এক নাম ভাগীরথী আর, আমাদের সেই রক্ত মাংসের ভাগীরথী সতী শরীর দিয়ে করেছিল সুকঠিন তপস্যা তার সেই অবমানকর তপস্যার ফলে তারই দু’উরু বিদীর্ণ হয়ে জন্ম নিয়েছিল আমাদের প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশ! অতঃপর তার প্রসবিত প্রিয় বাংলার রাজপথে পড়ে থাকে খণ্ডিতা ভাগীরথীর লাশ শেয়ালে-শকুনে তারপরও টানাটানি সে কী বীভৎস সকরুণ উল্লাস! এই মতাে আরাে কতাে ভাগীরথী ভয়াল রাত্রী-দিনে স্বীকার করেছে হেন অপরূপ ত্যাগ তাইতাে এখানে দধীচি মেনেছে হার! বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার পর জিলা, মহকুমা, থানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে বিপ্লবী সরকারের নির্দেশে কমিটি গঠন করা হল, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের জন্যে বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়তা দানের প্রয়ােজনে। নাজিরপুর থানার দীর্ঘার ইউনিয়ন উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি আমার সহপাঠী গৌরপদ কবিরাজের কথিত মতে আমিও একজন সদস্য হলাম  তখনও স্কুল বন্ধ ছিল প্রত্যহ উপজিলা পরিষদ মিলনায়তনে আমরা সমবেত হতাম খোঁজ খবর নিতাম চারদিকের  ইউনিয়নে প্রাপ্ত রিলিফের গম বণ্টনের দায়িত্বও আমরা পালন করতাম  তাছাড়া স্থানীয় হাট-বাজার থেকে চাঁদা আদায় করে মুক্তিযােদ্ধাদেরকে দিতাম। আমরা হাটের দোকানিদেরকে ইজারাদারের খাজনা দিতে নিষেধ করতাম কখনও অসাধু ব্যবসায়ীদের পণ্যের বেশি দাম নেবার খবর পেলে বাধা দিতাম এবং ন্যায্যমূল্যে বিক্রয় করতে বাধ্য করতাম। ইতােমধ্যে দেশত্যাগ বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের শুরু হয়ে গিয়েছিল। এসে গেল মে মাস। মে মাসের ১৩ তারিখে থানার শিক্ষা অফিসে যাবার নির্দেশ পেলাম  গেলাম থানায় । সেখানে এক জনসভার মতাে অনুষ্ঠান চলতে দেখলাম। এ মিটিং-এ শেখ মাটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মঈনুদ্দীন মিয়া, নাজিরপুরের সিরাজুল হক মিয়া এবং আরও কতিপয় নেতৃস্থানীয় লােক উপস্থিত ছিলেন। বুইচাকাঠীর সুশিক্ষিত (ইংরেজিতে অনার্স) কিছুটা বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যক্তি খেয়ালউদ্দিন সাহেব বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে এক বক্তৃতা করেছিলেন এ-সভায় । যতদূর মনে পড়ে, তার বক্তৃতায় মুসলমানদের স্বার্থের কথা থাকলেও কোনাে উগ্রতা ছিল না। চেয়ারম্যান মঈনুদ্দীন, সিরাজুল হক মিয়া প্রমুখ পাকিস্তানের কট্টর সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন তাদের কথায় । মঈনুদ্দীন এবং সিরাজুল হক পরবর্তীতে দালাল হিসেবে চিহ্নিত হন ।
 
শিক্ষা অফিস থেকে নির্দেশ পাওয়া গেল যে, ১৫ই মে স্কুল খুলতে হবে। পরম্পরায় জানা গেল যে, শিগগীরই নাজিরপুরে মিলিটারী এসে পড়বে  ১৪ই মে আমি দীর্ঘা গেলাম সকালেই । আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের সম্পাদক মুকুন্দ হালদারের বাড়িতে গেলাম সর্বপ্রথম  তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না। তার স্ত্রীকে বলে এলাম যে, থানায় শিগগীর মিলিটারী এসে পড়তে পারে। তার কাছে ইউনিয়ন উপদেষ্টা পরিষদের যে-সকল কাগজপত্র আছে, তা যেন তিনি সরিয়ে ফেলেন তারপর এলাম দীর্ঘা হাইস্কুলের হেড মাস্টার কোয়ার্টারে  গৌরপদ কবিরাজ তখন দীর্ঘা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং সপরিবারে কোয়ার্টারে থাকে। এখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিলাম  বিকাল ৪টা পর্যন্ত এখানে থেকে বাড়িতে ফিরি আসি আমার জানানাে সংবাদকে হয়তাে গৌরপদ তেমন গুরুত্ব দেয়নি  সাবধানতা অবলম্বন করেনি। পনেরাে তারিখ দশটার দিকে স্কুলে রওনা দিলাম। স্কুলের দূরত্ব বাড়ি থেকে মাইল খানেক স্কুলে ঘণ্টা দুয়েক অবস্থান করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম স্কুলটা ছিল আমার বাড়ির উত্তর দিকে। স্কুল থেকে আমি দক্ষিণ দিকে আসছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল আমার সহকর্মী মনিশংকর মল্লিক জনবসতি ছেড়ে যেইমাত্র নির্জন রাস্তায় এসেছি, তখন আকাশের দিকে চোখ পড়লাে  আকাশের দক্ষিণ দিকে ধােয়ার কুণ্ডলী দেখতে পেলাম। আরও খানিকটা সামনে এগিয়ে দেখতে পেলাম দক্ষিণ দিক থেকে মাঠের মধ্যদিয়ে এদিকে দৌড়ে আসছে বহুলােক তাদের মাথায়-ঘাড়ে কিছু বােচকা-বুচকিও ছিল কাছে  আসায় অনেককে জিজ্ঞেস করেছি দৌড়াবার কারণ  জানতে পারলাম যে দীর্ঘাবাজার থেকে মিলিটারী অপারেশন শুরু হয়ে গেছে  লােকজন গুলি করে হত্যা করছে । মূল্যবান জিনিসপত্র লুঠ হচ্ছে । ঘরে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। সংবাদ শুনে খুবই ঘাবড়ে গেলাম । মনিশংকরতাে রাস্তায় আছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাে। উত্তর দিকে আসছে লােকজন। ভাবছিলাম— দক্ষিণ দিকে যাওয়া ঠিক হবে কিনা । কিন্তু বাড়ির লােকদের কথা  ভেবে বাড়ির দিকেই অগ্রসর হতে থাকলাম।
 
বাড়িতে পৌছেও অস্থিরতা কাটলাে অল্প সময়ের মধ্যে চাঁদকাঠী বাজার, জিলবুনিয়া, দীর্ঘা ইত্যাদি স্থান থেকে আগত কতিপয় নারী-পুরুষ আমাদের বাড়িতেই অবস্থান নিয়েছিল। আমাদের লেবুজিলবুনিয়া একটি বড় গ্রাম। এর দক্ষিণ দিকে প্রায় সবটাই হিন্দুবাড়ি  সেখানকার লােকজনও আমাদের বাড়িতে ঠাই নিলাে কেউ কেউ এ-ভাবে কাটলাে দুই-আড়াই ঘণ্টা। আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখছিলাম আর মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজও শুনতে পাচ্ছিলাম। ভয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সময় কাটাচ্ছিলাম ক্রমে ক্রমে গুলির আওয়াজ দূরবর্তী মনে হচ্ছিল লােকজনের দৌড়াদৌড়ি বন্ধ প্রায় তিনটা-সাড়ে তিনটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম অবস্থা জানবার জন্য আমার সঙ্গে স্থানীয় আরাে ৬/৭ জন যুবক ছিল। প্রথমেই পৌছলাম আমাদের বাড়ি থেকে আধা মাইল দক্ষিণে গণেশ মণ্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখি বাড়ির সবগুলাে ঘর আগুনে পুড়ছে  আগুনের তাপে বাড়ির মধ্যে থাকা যায় না। লােকজন কোথায়ও দেখলাম না। কিছুক্ষণ পরেই লােকজন বাড়ির মধ্যে এলাে শরীরে কাদা মাখা চেনাই যায় না। এরা জমির মধ্যে শুয়েছিল। জমিতে তখন কাদা-পানি ছিল  তাই এ অবস্থা লােকজন বাড়ির ফেরার পর অনুপস্থিত লােকদের সন্ধানে লেগে গেল  গণেশ মণ্ডলের বাড়ির শরিকদার যােগেশ হালদারের একমাত্র পুত্র মনীন্দ্র হালদার (প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক) গুলিতে নিহত  গণেশ মণ্ডলের বাড়ির পূর্ব পার্শ্বে ভিটার আলে ঠেস্ দিয়ে বসা অবস্থায় দেখতে পেলাম একজনকে তার কাঁধে গুলি লেগেছিল। বছর দশেক বয়সের একটি মেয়ের হাত জখম অবস্থায়। দেখতে পেলাম। যুবকটি জীবিত কথাও বলতে পারে মেয়েটির জখম সামান্যই  ভূপেন মণ্ডল দীর্ঘার মণ্ডলবাড়ির যদুমণ্ডলের ছেলে তার বড় ভাই সুনির্মল আমার সহপাঠী ছিল। ভূপেন বি. এ. পরীক্ষা দিয়ে বিকৃতমস্তিষ্ক হয়ে যায় তা’ আর সারেনি। শুনতে পেলাম, সে নাকি মিলিটারীদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথাবার্তা বলেছে এবং বন্দুক নিয়ে টানাটানিও করেছে। যদুবাবু জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন ভূপেনকে যখন মিলিটারীরা বেঁধে ফেললাে, তখন তিনি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেন। যদুবাবু পােস্টমাস্টার জেনে তাকে কিছু বলেনি। মিলিটারীরা কিন্তু ভূপেনকে ছাড়েনি। তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে মেরেছে খুব ফুর্তি করে। পরপর চারটা গুলি করেছে তার চার হাত-পায়ে  তারপর বুকে গুলি করে মেরে ফেলে এই অপারেশনে দীর্ঘা গ্রাম থেকেই মানুষ মেরেছে ১৪ জন। দীর্ঘার যদুমণ্ডলের বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বের ছােট্ট নদীতে পুল ছিল। পুলের নীচ থেকে গানবােট যাওয়া সম্ভব ছিল না বলেই সেদিন। মিলিটারীরা আরাে উত্তর দিকে যেতে পারেনি । এখান থেকেই তারা ফিরে যায় ।
 
যদুমণ্ডলের বাড়িসংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বে খালের দক্ষিণ পাড়ে দীর্ঘা হাইস্কুল। সেখানে গেলাম । গৌরপদের কোয়ার্টার ভস্মিভূত অবস্থায় ছিল। দেখলাম, তার রেডিও, হারমােনিয়াম ইত্যাদি সব পুড়ে গেছে কিছুই রক্ষা করতে পারেনি। সেই সময়ে গৌরপদ এবং তার পরিবারের কোনাে সন্ধান পাইনি। কোথাও ঝোপে-ঝাড়ে লুকিয়ে থেকে প্রাণরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। কদিন পরে। তাকে যদুমণ্ডলের বাড়িতে পেলাম সপরিবারে । তাকে একবার আমাদের বাড়িতে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলাম তােক পাঠিয়ে সে আসেনি  সম্ভবত তখন মুসলমান এলাকায় আসা তার ভয়ের কারণ ছিল। অথচ চাঁদকাঠী বাজারের মনিশংকরের ভাই সুবােধ একবার গানবােট দেখে ভয়ে চলে আসে আমাদের বাড়িতে একনাগাড়ে ৪/৫ দিন সে আমাদের বাড়িতেই থাকে। সে এখানে নিজেকে নিরাপদ মনে করেছিল  ১৫ই মে তারিখের মিলিটারী অপারেশনে দীর্ঘা ইউনিয়নের মােট ত্রিশজন নিহত হয়। তন্মধ্যে কোনাে মহিলা ও শিশু ছিল না। বাড়ি-ঘরে লুটপাট এবং অগ্নিসংযােগ হয়েছিল সর্বত্র। এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই নাজিরপুরে মিলিটারী ক্যাম্প বসে। সেই সঙ্গে তাদের সঙ্গে মিলিত হয় রাজাকার বাহিনী  নাজিরপুর থানা ক্যাম্পের রাজাকারের মধ্যে আবু বকর খাঁ (আপন খা), রজু শেখ, মােতালেব প্রভৃতিরা ছিল আমার পরিচিত। এরা সবাই যুগিয়া গ্রামের বাসিন্দা কলার দোয়ানিয়ার ক্বারী আব্দুর রাজ্জাক এবং আব্দুল হালিম (প্রাইমারি শিক্ষক) রাজাকার বাহিনীতে ছিল।
এরাও আমার পরিচিত থানায় ক্যাম্প বসার পরে আমি মাত্র দু’বার থানায় গিয়েছি পরে আর যেতে সাহস করিনি। একবার এক শিক্ষক-সভায় মিলিটারী ক্যাপটেন এসে বক্তৃতা দেয় উর্দুতে তার কথা কিছু কিছু বুঝতে পেরেছিলাম। তার বক্তব্যের সারমর্ম ছিল : সবাইকে সরকারের অনুগত থাকা উচিত। বিচ্ছিন্নতাবাদ দেশের জন্য অমঙ্গলজনক ঠিকমতাে সরকারি কাজ করা কর্তব্য হিন্দুরা মুসলমানদের দুশমন, দেশের দুশমন আমরা লক্ষ্য করেছি যে, হিন্দু অধ্যুষিত পিরােজপুরের বিভিন্ন এলাকায় মিলিটারী অপারেশন চলেছে এসব এলাকায় গণহত্যা, লুণ্ঠন এবং বাড়িঘর পােড়ানাে হয়েছে। মুসলমান এলাকাতে মিলিটারী অপারেশন হয়নি বলা চলে। তবে ব্যতিক্রম ছিল স্বরূপকাঠী থানা  হয়তাে এ-রকম আরও কোথায়ও থাকতে। পারে। নাজিরপুরের শ্রীরামকাঠী ইউনিয়ন হিন্দু অধ্যুষিত, দীর্ঘার মতােই  শ্রীরামকাঠীতে বারংবার মিলিটারীরা হামলা করেছে, মানুষ মেরেছে, লুঠ করেছে, বাড়িঘর পুড়িয়েছে দেহারী ইউনিয়ন স্বরূপকাঠী থানার অন্তর্ভুক্ত এবং দীর্ঘা ইউনিয়নের দক্ষিণ সীমানায় অবস্থিত  দেহারী হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। এখানকার একটি মিলিটারী অপারেশনের কথা বলছি। তারিখটা ছিল ২৪ মে বাংলা ৯ জ্যৈষ্ঠ এখানকার মিলিটারী অপারেশন বিষয়ক তথ্য আমি সংগ্রহ করি ২০০৫ সালের ২৪শে মে তারিখে দেহারী শহীদ স্মৃতি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিঃ নির্মল চন্দ্র ঢালীর চিঠি পেলাম ।
 
২৪শে মে তাদের বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠান এখানে আমাকে প্রধান অতিথি মনােনীত করা হয়েছে। আমি এলাম নির্ধারিত তারিখে যথাসময়ে। স্কুলটি দেখে আমি শুধু মুগ্ধ হইনি, রীতিমতাে বিস্মিত হয়েছি  প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এমন পরিবেশে এ-রকম একটি স্কুল থাকতে পারে, তা ভাবতেই পারিনি। কিন্তু স্বচক্ষে দেখবার সুযােগ হলাে স্কুল এরিয়া পাকা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। সামনের দরজায় তালা লাগাবার ব্যবস্থা আছে স্কুলের সামনে কোনাে খােলা মাঠ নেই। সমস্ত মাটে লাইন দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ফুলের গাছ লাগানাে চারদিকে নানাবিধ ফলের গাছ লাগানাে হয়েছে। স্কুলটি আবাসিক অনাবাসিক । বাের্ডিং-এ মাত্র ২৪টি মেয়ে থাকে জায়গার অভাবে সংখ্যা বাড়ানাে যাচ্ছে না। পড়াশুনার মান ভালাে বলেই দূরবর্তী এলাকার মেয়েরাও এখানে ভর্তি হতে আগ্রহী  কিন্তু প্রশস্ত বাের্ডিং ঘর না থাকায় ভর্তি করা যাচ্ছে না। বাের্ডিং-এ ৪/৫টি মুসলমান মেয়েও থাকে যাই হােক। অনুষ্ঠানের ফাকে ৭১-এর ২৪শে মে তারিখের অপারেশন সম্পর্কে জানবার চেষ্টা করলাম  বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি নিরােদ বিহারী সিকদার কিছুকাল পূর্বে এইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার কাছ থেকে শােনা গেল সেদিনের ঘটনাবলি এখন যেখানে বালিকা বিদ্যালয়টি অবস্থিত সেদিন এ-জায়গাটি ছিল গাছপালা এবং ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ।

এখানেই মিলিটারীর গুলিতে সেদিন নিহত হয় কিছুসংখ্যক লােক  সঠিক সংখ্যাটি বলতে পারেননি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন নিরােদ বাবুর বাবা কার্তিক চন্দ্র সিকদার, ইন্দুরহাটের রূপালী ব্যাংকের অফিসার মৃণাল মজুমদারের পিতামহ হরিদাস মজুমদার এবং শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক ব্রাহ্মণ পুরােহিত স্বাধীনতা লাভের পর সরকার এদের জন্য ক্ষতিপূরণের যে অনুদান দিয়েছিল তা থেকেই সেই বধ্যভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় এ-বিদ্যালয়টি শহীদ স্মৃতি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে ১৯৭৩ সালে। দেরীতে আরও অপারেশন হয়েছে তবে এটাই গণহত্যায় শীর্ষে ছিল। নাজিরপুরের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা শেখ মাটিয়া, বাকশী, খেজুরতলা, রামভদ্রা, শ্রীরামকাঠী, ভীমকাঠী, জয়পুর, মালিখালী, সাঁচিয়া, সিংখালী, তারাবুনিয়া, শাখারীকাঠী, গীলাতলা, কারখানা বাড়ি, বেকার খাল, বাইনকাঠী ইত্যাদি গ্রামে বারংবার মিলিটারী, রাজাকারদের হামলা হয়েছে। খেজুরতলার সাধু রাধা পাগলের কনিষ্ঠপুত্র সদানন্দ পাগলকে পাকসেনারা হত্যা করেছে  হত্যা করেছে আরও বহুলােককে যাদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করা এখন আর সম্ভব নয়। পাকসেনা এবং রাজাকার মিলে নাজিরপুরের নিকটবর্তী সাতকাছিমা বাজারে হামলা চলাকালে মুক্তিবাহিনী প্রতিরােধ করে। উভয়পক্ষে বন্দুকযুদ্ধ চলাকালে দিঘিরজান ক্যাম্পের অধিনায়ক মুক্তিযােদ্ধা সরােয়ার হােসেন নিহত হয়। নাজিরপুরে প্রথমদিকে দুটি মুক্তিবাহিনীর খবর জানি। একটি মাটিভাঙায়, তার অধিনায়ক ছিলেন তারা খান।

 
দিঘিরজান ক্যাম্পের অধিনায়ক ছিলেন সরােয়ার হােসেন, তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। আমার ছাত্র জিলবুনিয়ার প্রফুল্ল কুমার এদবর দিঘিরজান ক্যাম্পে ছিল। সে ছিল নাওটানা হাই স্কুলের শিক্ষক ডিসেম্বরে কলার দোয়ানিয়া গ্রামের বাসিন্দা এবং প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নুরুদ্দীনের নেতৃত্বে কলার দোয়ানিয়া হাইস্কুলে একটি মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প বসে আরেকটি ক্যাম্প বসে জানুয়ারি মাসে (১৯৭২ সালে) যুদ্ধ শেষ হবার পর দীর্ঘা। ইউনিয়ন পরিষদে। কলার দোয়ানিয়া ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকারলুঠকারীদের উপর কিছু টর্চার করা ব্যতিরেকে আর কিছু করতে পারেনি। দীর্ঘা। ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধাদের সে সুযােগও ছিল না। লেবুজিলবুনিয়ার ছেলে রুহুল আমিন ছিল ‘৭১-এর এস, এস, সি, পরীক্ষার্থী সে চেয়েছিল একটি মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে । তার দলে কয়েকজন কিশাের-তরুণ অংশগ্রহণ করে। তার অস্ত্র ছিল, ছােরা, রামদা এবং কাঠের বন্দুক এইসব অস্ত্র নিয়ে এলাকার বিশেষ-বিশেষ বাড়িতে হামলা চালিয়ে টাকা-পয়সা আদায় করতে চাইতাে। তার ইচ্ছা ছিল টাকা-পয়সা যােগাড় করতে পারলে অস্ত্র-শস্ত্র যােগাড় করবে। তার আশা পূর্ণ হয়নি। বিল ডুমুরিয়ায় হামলা করতে গিয়ে সে জনতার হাতে ধরা পড়ে। তাকে বৈঠাকাটা বাজারের মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে সােপর্দ করা হয়। বৈঠাকাটার মুক্তিবাহিনী তাকে হত্যা করে একটা পরিত্যক্ত ভিটায় গলায় রশি বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখে তার পিতা আলী আজম খবর পেয়েও তার লাশ আনেনি।  দীর্ঘা ইউনিয়নের উত্তর দিকে, দেউলবাড়ি ইউনিয়নে মিলিটারী অপারেশন হয়নি। একবার বৈঠাকাটা বাজারের মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে মােকাবিলা করার জন্য কতিপয় মিলিটারী রাজাকার লম্বা নৌকায় বৈঠাকাটার দিকে যায় ফেরার পথে বিকেল বেলা গাঁওখালী হাটে অবতরণ করে। আমি তখন হাটেই ছিলাম। এখানে তারা কাউকে হত্যা করেনি। হালকা মারধাের করেছে কাউকে কাউকে। বৈঠাকাটায় মিলিটারী যাবার কারণ, এখানকার ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারা আবদুস সত্তারকে (দেউলবাড়ি ইউনিয়নের দফাদার) হত্যা করে, সেই সংবাদ শুনেই নাকি তাদের যাওয়া। শুনেছি যে, বৈঠাকাটা বাজারে চায়ের দোকানে বসে দফাদার নাকি মুক্তিবাহিনীকে কটাক্ষ করে কথা বলে।
 
তাই শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে তারা তাকে ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করে  আব্দুস সত্তার (ভদ্দর) দফাদার লুঠকারী কিংবা দালাল ছিলেন না, তা সত্য দীর্ঘা ইউনিয়নের লেবুজিল বুনিয়া গ্রামের এস্কান্দার আলী মিয়া গ্রামের মাতুব্বর এবং এক সময়কার ইউ. পি. মেম্বর ছিলেন। তাকে রাতে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে ফেলে দেয় নদীতে নদীতে তার ভাসমান লাশ পাওয়া যায় । এটানাকি মুক্তিযােদ্ধাদের কাজ কিন্তু কোন মুক্তিযােদ্ধারা এটা করেছে, তা জানা যায়নি। তবে অনুমান করা হয়েছে যে, এটা পূর্বশত্রুতার কারণে ঘটেছে। কেননা তিনি লুঠকারী কিংবা দালাল ছিলেন না।  ডুমুরিয়ার আব্দুল গণী হাওলাদার। সাবেক বাড়ি ছিল লেবুজিল বুনিয়া গ্রামে তার ছেলে আমির হােসেন মুক্তিযােদ্ধা ছিল। গণী হাওলাদারও একরাতে আততায়ী কর্তৃক নিহত হন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু কিছু অপঘাত মৃত্যুও ঘটেছে। এ সব হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যার শামিল করা যেতে পারে। মিলিটারীদের একটি হিংস্রতার কাহিনী এবার বলবাে। নাজিরপুর থানার কলার দোয়ানিয়া গ্রামের জহিরুদ্দীন এবং তার প্রতিবেশী মহিউদ্দীন, এরা দুজনই যুবক । এরা মুক্তিযােদ্ধা ছিল না। জহিরুদ্দীন ছিল বেশকিছু জমি-জমার মালিক মহিউদ্দীন ঢাকার একটি হাইস্কুলের বি. এস. সি পাশ শিক্ষক  যুদ্ধের সময়ে বাড়িতে থাকতাে একদিন তারা একত্রে কোনাে কার্যোপলক্ষে থানায় গিয়েছিল। থানার মিলিটারীরা তাদের আটক করে সন্দেহ করা হয় কলার দোয়ানিয়ার রাজাকার আবদুর রাজ্জাক ক্বারীর ইংগীতে তাদের আটক করা হয় । তাদের আত্মীয়-স্বজন থানায় গিয়ে আবদুর রাজ্জাক কারীকে খুবই অনুরােধ করেন মিলিটারীদের কাছে তাদেরকে ছেড়ে দেবার জন্য সুপারিশ করতে। কিন্তু কারী সাহেব সুপারিশ করতে সম্মত হননি।
তিনি বলেছেন – মিলিটারীরা আটক করেছে, সেখানে আমার সুপারিশে কোনাে কাজে হবে না। পরবর্তীতে তাদেরকে ধৃত মুক্তিযােদ্ধা পরিচয়ে পিরােজপুরে চালান দেওয়া হয়। ওদেরকে যখন হুলারহাট স্টেশনে নামানাে হয়, তখন স্টেশনে পিরােজপুর ক্যাম্পের মিলিটারীর জীপ উপস্থিত ছিল। জীপের পাকসেনাদের হাতে তাদেরকে তুলে দেওয়া হলে তারা ওদের দুজনের পা দড়ি দিয়ে জীপের পেছনে বেঁধে জীপ। চালিয়ে দিল পিরােজপুর শহরের দিকে। জীপ যখন পিরােজপুরে পৌছালাে, তখন আর তাদের শরীরে প্রাণের স্পন্দন ছিল না। একেবারেই বিনাদোষে তারা মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করে। কলার দোয়ানিয়ার সুলতান মাহমুদ ছিল আমার আত্মীয় এবং ছাত্র । ৭১-এ সে দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল।
 
সে ভারতে চলে যাবে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে, এই ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে সে বাড়ি থেকে একদিন যাত্রা করে। সে আর ফিরে আসেনি। ধারণা করা হয়, পথে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে সে নিহত হয়েছে পিরােজপুর থেকে নাজিরপুর থানা এলাকায় নদীপথে যেখানে শ্রীরামকাঠী বন্দর, যেখানে নদীর নাম কালীগঙ্গা এর পশ্চিমপাড়ে বন্দর। এখান থেকে বেশ খানিক উত্তরে এসে দীর্ঘাবাজার, তারও উত্তরে চাঁদকাঠীবাজার। এগুলাে নদীর তীরেই এ নদী দিয়ে প্রায়শ গানবােট টহল দিতাে বিভিন্ন এলাকায়। কখনও কখনাে গানবােট থেকে তীরের দিকে গুলিও ছোঁড়া হতাে চাঁদকাঠীবাজারে কখনাে গুলি ছোড়েনি। চাঁদকাঠীরবাজার থেকে উত্তরদিকে গাঁওখালী বাজার দূরত্ব মাইল চারেকের এই চার মাইলের মধ্যে হিন্দু অধিবাসী রয়েছে যথেষ্ট সম্ভবত মুসলমানদের চাইতে অধিক  কিন্তু এই এলাকায় আশংকা থাকলেও মিলিটারী অপারেশন হয়নি অন্যান্য এলাকায় যেমন ব্যাপক লুঠপাট এবং বাড়িঘর পােড়ানাে হয়েছে, এসব এলাকায় তাও হয়নি। কোনাে কোনাে এলাকায় মুসলমানরা হিন্দুদের বাড়িতে লুঠ করেছে, তাদের ঘরে আগুন দিয়েছে। দীর্ঘা ইউনিয়নের উত্তর এলাকায় সেরূপ ঘটেনি এ ইউনিয়নের পিস কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ মিয়ার ঐ সব কাজের তৎপরতা দেখা যায়নি। তবে নাওটানা এবং তার নিকটবর্তী কিছু কিছু বাড়িতে এক মজাদার লুঠপাট এবং ঘর পােড়ানাের ঘটনা ঘটেছে আমি তার কিছুটা স্বচক্ষে দেখেছি  ঘটনাটা বলতে গেলে একটু পেছন থেকে শুরু করতে হয় ।  শ্রীরামকাঠী বন্দরের দক্ষিণ দিকে কলাখালি গ্রাম এই গ্রামের জালাল মিয়া প্রথমে পুলিশে না ইপিআর-এ চাকুরি করতেন এক সময়ে চাকুরি ছেড়ে কন্ট্রাকটরী শুরু করেন বরিশাল শহরে থেকে তার শ্বশুরবাড়ি ছিল থানার কলার দোয়ানিয়া গ্রামে নাওটানাতে তার ভায়রার বাড়ি যুদ্ধের সময় তিনি শহর ছেড়ে নাওটানা ভায়রাবাড়িতে আশ্রিত হন। এ-সময়ে তিনি এলাকার হিন্দুদের সঙ্গে খুব খাতির জমিয়ে ফেলেন। তিনি এলাকার হিন্দুদেরকে বােঝালেন যে, এক সময়ে মিলিটারী এসে সব হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে এবং লুঠপাট করবে। সুতরাং তার পূর্বে যদি আপােষে কাজটা সমাধা করা যায়, তাহলে আর কোনাে সমস্যা হবে না। হিন্দুরা জানতে চাইলেন কিভাবে তা করা যেতে পারে ।
 
জালাল মিয়া বােঝালেন যে, এলাকার মুসলমানেরা যদি ঘরের সব মালপত্র লিস্ট করে নিয়ে নেয় আর টিনশেড ঘরের ছাউনির টিনগুলাে তাহলে লুঠ এবং ঘর জ্বালার জন্য মিলিটারী এসে কী করবে? তবে ঘরপােড়ার একটা রেকর্ডও থাকা চাই । সে জন্য নাড়া এবং গােলপাতার রান্নাঘর কিংবা গরুরঘর একটা কিছুপপাড়ালেই হবে। যুদ্ধের পরে মালামাল অবশ্যই মালিক ফেরৎ পাবে। মিলিটারীর ভয়ে কাতর হিন্দুরা জালাল মিয়ার যুক্তি মেনে নিলেন। অতঃপর সংঘটিত হলাে এই এলাকার শান্তিপূর্ণ লুঠপাট হিন্দুরা চেয়ে চেয়ে দেখলেন আর ভাবলেন, এতেও যদি প্রাণে বাঁচা যায়, তাইই ভালাে এলাকার কিছু কিছু মুসলমান এ লুঠপাটে অংশ গ্রহণ করে। পাকবাহিনী বেকায়দায় পড়ে যায় ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দেবার পর থেকে। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণের সামনে পাকসেনারা পর্যদস্তু হয়ে পড়ে ২/৪ দিনের মধ্যেই। তারা আত্মসমর্পণ করবার কথা ভাবতে থাকে, ঠিক সেই মুহূর্তেও তারা গণহত্যা কার্যক্রম বন্ধ করেনি। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত রাজাকার আলবদর সদস্যদের মধ্যে কিছুসংখ্যক তালিকাভুক্ত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিকে বাসা থেকে ভাগিয়ে এনে হত্যা করেছে।
১৬ই ডিসেম্বর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি ৯৩০০০ পাকসেনাসহ আত্মসমর্পণ করে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার কাছে। আত্মসমর্পণের পূর্বে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানরত পাকসেনারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এসে জড়াে হয়েছিল। তাই বেঁচে গেল পাকসেনারা। মুক্তবাহিনীর হাতে পড়লে সবাই যে প্রাণে বেঁচে যেতাে, তা বলা যায় না। সম্ভবত পাকসেনারা তা বুঝতে পেরেছিল। তাই মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। আমাদের এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে খুব তৎপর হয়েছিল লুণ্ঠনকারীদের শাস্তি বিধানে। তারা তালিকা করে কিছুলােককে হত্যা করেছে রাতের অন্ধকারে বাড়িতে হানা দিয়ে । কাউকে বাড়িতেই হত্যা করেছে, কাউকে বাড়ি থেকে ধরে আনবার পর আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি ধৃত ব্যক্তির আমাদের নাজিরপুরের যুগিয়া গ্রামের মাতুব্বর শ্রেণির লােক ছিলেন উমেদ গাজী  তিনি লুঠপাটে যুক্ত ছিলেন না। বরং যুদ্ধের সময় হিন্দুদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। তার এক ভ্রাতুস্পুত্র এলাকায় এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে সেই অরাজক সময়ে । উমেদ গাজীকে সেজন্য দায়ী করা যায় না ।
 
অথচ একদিন রাতে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় পাকুরিয়া গ্রামের আব্দুল গণীকে এভাবেই । আমাদের লেবুজিলবুনিয়া গ্রামের সেকান্দার আলীকেও একদিন রাতে বাড়ি থেকে ধরে আনে। সে আর বাড়ি ফেরেনি। এরা হত্যাযযাগ্য অপরাধী ছিল না। এদেরকে প্রকাশ্যে মারা হয়নি। যারা মেরেছে; তাদের পরিচয়ও জানা যায়নি। বলা যায় – গুপ্তঘাতকের গুপ্তহত্যা। ‘৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে এরূপ গুপ্তহত্যা চলছিল সারাদেশে, কোথাও বা প্রকাশ্যে। সেই সময়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি ঘােষণা : “বিচারের দায়িত্ব নিজ-হাতে নেবেন না। আমাদের কলার দোয়ানিয়া ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারা লুণ্ঠনকারীদের একটা তালিকা প্রস্তুত করে প্রকাশ্যে ধর-পাকড় শুরু করেছিল। অবশ্য তাদের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল না। আর এ ধরনের ধর-পাকড়ের সরকারী নির্দেশও ছিল না । জিলা প্রশাসন থেকে একটা প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছিল লুঠের মাল ফেরৎ দেবার নির্দেশ দিয়ে। এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমি আমার এলাকা থেকে অনেক লুঠের মাল ফেরতের ব্যবস্থা করে দিয়েছি । অবশ্য কেউ কেউ দিতে চায়নি। সেক্ষেত্রে শালিস বৈঠকের ব্যবস্থা করে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সময়ে আমি কলার দোয়ানিয়া ক্যাম্পের প্রধান নুরুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লুণ্ঠনকারী ধর-পাকড়ের বিষয়টি জানতে চাই। তখন আমাকে আমার এলাকার ৪৪ জনের একটা তালিকা দেওয়া হয় । আমাকে বলা হলাে যদি তারা মালামাল ফেরৎ দিয়েও থাকে তবুও তাদের কিছুটা শাস্তি হওয়া উচিত। আপনি এদের দ্বারা স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকার মেরামত যােগ্য রাস্তা মেরামত করিয়ে নেবেন। বলা বাহুল্য আমি তাদের দ্বারা একটি মেরামতযােগ্য রাস্তা মেরামত করিয়ে দিয়েছিলাম। অতঃপর কলার দোয়ানিয়া ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারা এলাকায় কোনাে ধর-পাকড় করেনি। | স্বরূপকাঠী পিরােজপুরের একটি অভিজাত থানা। এলাকাটি কাঠ ব্যবসায়ের জন্য বিখ্যাত। সন্ধ্যানদীর দু’পাড়ে অবস্থিত এ থানাটি। পূর্বপারে স্বরূপকাঠী বন্দর। এখানেও কাঠ ব্যবসায়সহ অন্যান্য ব্যবসা রয়েছে। সরকারি অফিস, পুলিশ স্টেশন থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রও এপারে । এপারেই থানা হেড-কোয়ার্টার থেকে অর্ধমাইল উত্তরে শর্ষিনার পীর সাহেবের বাড়ি। এখানে অবস্থিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আলীয়া মাদরাসা । নদীর পশ্চিম পাড়ে ইন্দুরহাট বন্দর । ইন্দুরহাটের উত্তর পাশে একটি ছােট নদী। এ নদীর উত্তর পাড়ের নাম মিয়ার হাট বন্দর।
 

ইন্দুরহাটের পশ্চিম পাকে বলা হয় বরছাকাঠী । এখানেই এ অঞ্চলের কাঠ ব্যবসায়ের প্রাণকেন্দ্র । ইন্দুরহাটের সংলগ্ন দক্ষিণপার্শ্বে ইন্দুবাড়ি মাঠ। এখানেই স্বরূপকাঠী কলেজ অবস্থিত। স্বাধীনতার পর এটি সরকারি হয় । ইন্দুরহাটে ‘৭১-এর একটি সিনেমা হল ছিল, যা আজও বর্তমান। মিয়ার হাটে ছিল তিনটি ব্যাংকের শাখা এবং সংলগ্ন কৌরিখাড়ায় বিসিক শিল্পনগরী, সব মিলিয়ে এখানে শহুরে পরিবেশ বর্তমান ছিল। | ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সন্ধ্যা নদীর পশ্চিম পারে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প গড়ে উঠে ছিল। সােহাগদল গ্রামে জাহাঙ্গীর বাহাদুর নামের এক সাহসী যুবক নিজের চেষ্টায় একটা বড় রকমের মুক্তিবাহিনী গড়তে সক্ষম হন। তার একটি ক্যাম্প ছিল উত্ত-পশ্চিম সােহাগদল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, অন্যটি বলদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। নাজিরপুর থানার বৈঠাকাটা বাজারেও তার ক্যাম্প ছিল । তিনি স্বরূপকাঠী, নাজিরপুর এবং বানারীপাড়া এই তিন থানার মুক্তিযােদ্ধা বাহিনীর অধিনায়ক বলে দাবি করতেন। তিনি নিজের চেষ্টায় এলাকা থেকে বন্দুক সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময়ে বাংলা আমার নামে একটি সংবাদ বুলেটিন প্রকাশিত হতাে তার পরিচালনায় । ছাপা হতাে কৌরিখাড়ার বিভিন্ন শিল্প নগরীতে অবস্থিত শাহ প্রিন্টিং ওয়ার্ক থেকে । প্রেসটির মালিক ছিলেন শাহ মােজাহার উদ্দিন। তিনি ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনােনয়ন পেয়ে অত্র এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংবাদ বুলেটিন বাংলা আমার বেশি দিন প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা থাকার কারণে স্বরূপকাঠী, ইন্দুরহাট, মিয়ার হাট বন্দরে মিলিটারী এবং রাজাকারের হামলা ছিল প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রায়শ বন্দরে এসে মিলিটারীরা উড্ডীয়মান স্বাধীন বাংলার পতাকা প্রত্যেক ভবন থেকে নামিয়ে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিত । নির্দেশ না মেনেও তখন উপায় ছিল না । মিলিটারী চলে গেল মুক্তিযােদ্ধারা এসে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলনের হুকুম দিত। এ হুকুমও না মানার সাধ্য ছিল না।

 
তখন যেন এ এলাকায় দ্বৈত শাসন চলছিল। ইন্দুরহাট মিয়ারহাট এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঘনঘন এবং ব্যাপক মিলিটারী হামলা চলেছে এ-সব কারণেও।শর্ষিনার পীর সাহেবের বাড়ির মাদরাসায় যুদ্ধের সময়ে একটি রাজাকার ক্যাম্প বসেছিল। ধারণা করা হয়, তৎকালীন পীর সাহেব মাওলানা শাহ মােঃ আবু জাফর ছালেহ এর পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। সেকারণে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর তাকে মুক্তিবাহিনী আটক করে এবং বরিশালে পাঠানাে হয়। তিনি কিছুকাল হাজতবাসের পর মুক্তিপান। পীর সাহেবের বাড়ির রাজাকার বাহিনীতে কারা ছিল সে সম্পর্কে পরবর্তীতে তেমন লেখালেখি হয়নি। তাই । সেবিষয়ে সবিশেষ লেখা গেল না। ইন্দুরহাট-মিয়ারহাট এবং তার পার্শ্ববর্তী গ্রাম সােহাগদল, বরছাকাঠী, কৌরিখাড়া, সুটিয়াকাঠীতে বারবার মিলিটারী এসেছে মানুষ হত্যা করেছে । এখানে হিন্দু মুসলমানের বাছ-বিচার করা হয়নি। এখানে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। থাকার কারণেই বারংবার মিলিটারী এসেছে। মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের অত্যাচার প্রতিরােধ করতে পারেনি। পাকসেনার আগমন টের পেলেই তারা পালিয়েছে। মিলিটারী চলে যাবার পরে তারা এলাকায় এসেছে। কখনও মিলিটারীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ তারা করেনি। এ কারণে এলাকার জনসাধারণ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না। একবার বিভিন্ন স্থান থেকে লােক ধরে এনে একদড়িতে উনিশ জনকে বেঁধে ব্রাশফায়ারে হত্যা করেছে ইন্দুবাড়ি মাঠে। ইন্দুবাড়ির মাঠ ছিল মিলিটারীদের একটি বধ্যভূমি । অপর বধ্যভূমি বরছাকাঠীর কাঠপট্টিতে। এখানেও বহুলােক ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার বহুপরে এ-দুটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। একবার মিয়ারহাটের সাধনা ঔষধালয়ের মালিক গােপালবাবুকে দোকান থেকে রাস্তায় বের করে হত্যা। করেছে। ইন্দুরহাট-মিয়ারহাটের একটি মিলিটারী অপারেশন ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ  এ অপারেশনটি সংঘটিত হয় নভেম্বর মাসের ১০ তারিখে। সেদিন অত্র এলাকার নিহতের সংখ্যা আজও নিরূপণ করা যায়নি। তবে সংখ্যাটি একশাে ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আক্রমণটি ছিল ত্রিমুখী । ইন্দুরহাট থেকে মাইল তিনেক দক্ষিণে মুনিনাগ গ্রাম। গানবােট থেকে একদল মিলিটারী এখানে অবতরণ করে তারপর রাস্তা ধরে ইন্দুরহাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সামনে যাকে পেয়েছে হত্যা করেছে। আগুন ধরিয়ে কিছু কিছু ঘর বাড়িও পুড়িয়েছে।
অন্যদল ইন্দুরহাটের পশ্চিমে মাইল চারেক দূরবর্তী গ্রাম। জিলবাড়িতে অবতরণ করে জিলবাড়ি থানার শেষ সীমানা বেলুয়া নদীর তীর ঘেঁষে এ গ্রাম নদীর পশ্চিম পাড়ে কলার দোয়ানিয়া বাজার থেকে নাজিরপুর থানা শুরু  এই নদী পথে আসে মিলিটারীর গানবােট এবং অবতরণ করে জিলবাড়িতে এখান থেকে অগ্রসর হতে থাকে পথের পার্শ্ববর্তী বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। সামনে যাকে পাওয়া গেছে তাকেই হত্যা করেছে এ ভাবে তারা এসে পৌছে ইন্দুরহাটে  অন্য দলটি ইন্দুরহাট থেকে মাইল খানেক উত্তরে সুটিয়াকাঠী গ্রামের মধ্যবর্তী তারাবুনিয়া খালের মুখে নামে গানবােট থেকে। তারা মানুষ মেরে এবং ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে ইন্দুরহাটের দিকে এগােয়  তিনদল মিলিটারি এখানে মিলিত হবার পর শুরু হয় আরেক তাণ্ডব লীলা। এই দুটি বন্দরে লুঠপাটের পর সকল ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত করে ফেলে মাত্র দুটি দালান ছাড়া ইন্দুরহাট-মিয়ারহাট বন্দরে ঘর-দোরের অস্তিত্ব ছিল না আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ অনির্ধারিত থেকে গেছে এ দিন বরছাকাঠীতে একই বাড়িতে হত্যা করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে তন্মধ্যে সাত ব্যক্তিকে এককবরে সমাহিত করা হয়েছে। তাদের সমাধিটি পাকা করে চিহ্নিত অবস্থায় রয়েছে। এ অপারেশনে হাজার হাজার লােক মারা পড়তাে পূর্বে হয়তাে সন্দেহ করা হয়েছিল যে, একটা বড় ধরনের অপারেশন এখানে সংঘটিত হতে পারে । হয়তাে এ কারণে এলাকার লােকজন পূর্ব থেকে সতর্ক ছিল।

তাই অধিকাংশ লােক এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। দুই ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারাও কেউ সেদিন এলাকায় ছিল না। স্বরূপকাঠীর হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা আটঘর, কুড়িয়ানা, সমদেকাঠী, কামার কাঠী ইত্যাদি এলাকায় মিলিটারীরা ব্যাপক হামলা চালিয়েছে, লােকজন হত্যা করেছে। কুড়িয়ানায় প্রচুর পেয়ারা বাগান রয়েছে এখানকার পেয়ারা বিখ্যাত এবং অর্থকরী ফসল এখানে পেয়ারা বাগানে নিরাপদে থাকা যাবে ভেবে দূরদূরান্তের লােকজনও এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকসেনারা এ-সংবাদ জানতে পেরে একবার অপারেশনে এসে এ-বাগান ঘিরে ফেলে। আত্মগােপন কারীদের পালাবার আর সুযােগ হয়নি। মিলিটারীদের গুলিতে সবাই মৃত্যুবরণ করে। এখানে সেদিন কতাে লােক নিহত হয়েছে তার সংখ্যা জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, শতাধিক লােকের মৃত্যু ঘটেছে কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয়মাসে হত্যা করা হয়েছে অসংখ্য মানুষ একটা সম্ভাব্য সংখ্যা স্বীকৃত— তা হলাে ত্রিশ লাখ  সম্ভবত ইতিহাসে বাংলাদেশের গণহত্যাই সবার শীর্ষে। 

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড – মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান