You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড : গণহত্যা -ঢাকা-চট্টগ্রামে - সংগ্রামের নোটবুক
গণহত্যা : ঢাকায় এবং আশেপাশে
একাত্তরে পাকবাহিনী ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাত থেকে তাদের প্রথম টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলাে, বিশেষ করে জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, (বর্তমান জহুরুল হক হল) এবং সেই সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পীলখানার ইপিআর (বর্তমান বিডিআর) হেড কোয়ার্টার  অবশ্য আশপাশের বস্তি এলাকাতেও অপারেশন চালায়। ২৫শে মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৬শে মার্চ সকাল পর্যন্ত তারা অসংখ্য লােক হত্যা করেছে। সেই হত্যাকাহিনীর প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে আমাদের কিছু কিছু ঘটনা জানবার সুযােগ হয়েছে। সেই ভয়াল রাত্রি-দিনের সকল ঘটনা ভালাে করে কেউ দেখার সুযােগ পেয়েছেন বলে মনে হয় না। তাই বলা-ই চলে যে, ঘটনা ছিল তাদের বর্ণনা থেকেও আরও ভয়ংকর। অতঃপর গণহত্যা কার্যক্রম চলতে থাকে সারা বাংলাদেশে। শহর-বন্দর, শহরতলি কোনাে এলাকাই বাদ যায়নি। যদিও অল্পকাল পরেই মুক্তিবাহিনী গঠিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তথাপি পাকসেনাদের গণহত্যা অব্যাহত থাকে। আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের যেমন ভারী অস্ত্র ছিল না, তেমন দেশের অভ্যন্তরে নিরাপদ ঘাঁটিও তারা গড়তে পারেনি । তাই তাদেরকে থাকতে হয়েছে বন-বাদাড়ে লুকিয়ে যুদ্ধ যা করেছে তাকে সম্মুখ যুদ্ধ বলা যায় না। গেরিলা পদ্ধতিতে সুযােগ বুঝে পাকবাহিনীর আগ্রাসন ঠেকানাে আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধ করেছে এ-ভাবেই তাই পাকসেনাদের গণহত্যা, ধর্ষণ, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযােগ প্রায় অবাধই ছিল। পঁচিশে রাতের অপারেশনের পর ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর-বন্দরের মানুষ গ্রামের দিকে পালিয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা প্রায় সকলেই ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সাধারণ মানুষও প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে  পালাবার পথেও অনেকে প্রাণ হারিয়েছে পাকসেনাদের হাতে। বাংলাদেশের কিছু লােক তখন পাক-সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে দালালী করেছে দালালদের সহযােগিতায় দেশে গঠিত হয়েছে রাজাকার, আলবদর, আল শামস নামের বাহিনী। এদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে।
 
বিভিন্ন সেনা ক্যাম্পে এরা পাকসেনাদের অধীনে কাজ করেছে। শহর ছেড়ে মানুষ যখন প্রাণের ভয়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে, তখন পাকবাহিনীর নজর গেছে গ্রামের দিকে বিভিন্ন থানায় গড়ে উঠেছে রাজাকার ক্যাম্প সেই ক্যাম্পে কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিশিয়া থাকতাে রাজাকারদের নেতৃত্বে রাজাকার এবং পাকসেনা বা পাকমিলিশিয়া মিলে গ্রামের হাট-বাজারে, এমনকি কখনও-কখনও গ্রামের অভ্যন্তরেও হামলা চালিয়েছে করেছে হত্যা, লুঠতরাজ এবং দিয়েছে মানুষের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে মেয়েদেরকে ধরে এনেছে ক্যাম্পে তাদের উপর চালিয়েছে পাশবিক অত্যাচার এমনকি কখনও কখনও যুবকদেরও ধরে এনেছে ক্যাম্পে চালিয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। তারপর করেছে হত্যা।এভাবে চলেছে দীর্ঘ নয় মাস বলা হয় মানুষ মেরেছে ত্রিশ লাখ। এটা যে সঠিক হিসেব, তা বলা যাবে না। কেননা সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে কে তার সংখ্যাতত্ত্ব লিখে রাখতে পেরেছে। তবু যাহােক আমরা গণহত্যার এ-সংখ্যাতত্ত্বটি মেনে নিয়েছি কেননা, গণহত্যার পুংখানুপুংখ হিসেব রাখা তখন আদৌ সম্ভব ছিল না যা-ই হােক, পাকসেনারা বাংলাদেশে সেদিন বেপরােয়া গণহত্যা চালিয়েছে, তা বিশ্ববিদিত ঘটনা। পূর্ব বাংলার প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে এসেছিলেন জেনারেল টিক্কা খান। টিক্কা খান ছিলেন একজন নিষ্ঠুর জেনারেল তিনি চেয়েছিলেন বেপরােয়া গণহত্যা চালিয়ে বাঙালিদেরকে একদম ঠাণ্ডা করে দিতে পাক সরকার বাংলাদেশের মানুষ চায়নি। শুধু এদেশের উর্বর মাটির প্রতি ছিল লােভ। তাই এই বর্বরােচিত গণহত্যা চালাতে তাদের বিবেকে বাঁধেনি তারা হত্যা করেছে নারী-পুরুষ, শিশু-যুবা-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষকে তাদের এ গণহত্যায় কোনাে বাছ-বিচার করা হয়নি ঢাকার মিরপুরের বিহারীরা পাকসেনাদের সঙ্গে মিশে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে ৪৭-এর ভারত, বিভক্তির পরপরই ভারতের বিহাররাজ্য থেকে বিহারী মুসলমানরা পাকিস্তানে আসে। তারা উর্দুভাষী হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের জায়গা হয়নি তারা বাংলায় আশ্রয় নিলেও এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে কখনও সুসম্পর্ক রাখেনি। এবারে পাকসেনাদের মদদ পেয়ে তারা ভয়ংকর হিংস্র হয়ে ওঠে ঢাকা এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় তারা হত্যা, ধর্ষণ এবং লুঠতরাজ কাজে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। তারা বাঙালিদের ধরে-ধরে এনে জবাই করে হত্যা করেছে। বাঙালিনিধনে তারা ছিল পাঞ্জাবিদের চাইতেও হিংস্র  ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকসেনাদের বধ্যভূমি। তন্মধ্যে রায়ের বাজার বধ্যভূমি সর্বাধিক কুখ্যাত। এই বধ্যভূমির পার্শ্ববর্তী জলাভূমিতে লাশ ফেলতে সুবিধা থাকায় পাকসেনারা এ-জায়গাটিকেই অধিক ব্যবহার করেছে। এখানে কতাে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আর, ছিল সদরঘাটের বুড়ি গঙ্গার তীর।
 
এখানেও অসংখ্য মানুষ ধরে এনে গুলি করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। মিরপুরে ছিল অধিকাংশ বিহারীদের বসবাস। এ-জায়গাটা ছিল তাদের কলােনী। এখানে তারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে কসাইয়ের মতাে মানুষ জবাই করে এখানে পুঁতে রেখেছে ঢাকার বিভিন্ন বস্তি এলাকা ওরা জনশূন্য করে ফেলেছে  পুড়িয়ে দিয়েছে ঘরদোর সবই  একদিকে পাকসেনা, অন্যদিকে বিহারী জল্লাদ বাহিনী– এদের অত্যাচারে ঢাকাবাসীরা ছিল সদা সন্ত্রস্ত। ঢাকার কেরানীগঞ্জ, জিনজিরা ইত্যাদি স্থানকে ভাবা হতাে নিরাপদ এলাকা। এই ভাবনার বশবর্তী হয়ে, ঢাকা নগরীর বহু পরিবার এই সব এলাকায় আশ্রয় নেয়। তাদের ধারণা ছিল শহর ছেড়ে পাকবাহিনী এ-সব এলাকায় আসবে কিন্তু রক্তপিপাসু পাকসেনারা এ-সব এলাকায় অতর্কিতে হামলা চালিয়েছে। হত্যা করেছে অগণিত নারী-পুরুষ, শিশু-যুবক বৃদ্ধকে। শহরতলী এলাকাও তখন আদৌ নিরাপদ ছিল না। পাকসেনারা তাদের স্থানীয় দোসরদের মাধ্যমে যথাসময়ে খবর পেয়ে গেছে শহরের মানুষেরা কোন কোন জায়গায় লুকিয়েছে। দালালদের দেওয়া সংবাদের ভিত্তিতে তারা অইসব এলাকায় অপারেশন চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। এই দালালদের কারণেই ডিসেম্বরের আত্মসমর্পণ প্রস্তুতি লগ্নেও বহু বুদ্ধিজীবী সাহিত্যিকসাংবাদিকদের বাসা থেকে ডেকে এনে হত্যা করা হয়েছে। কীভাবে, কোথায় তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, আজও তার হদিস মেলেনি। এভাবেই হারিয়ে গেছেন শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান এবং এরূপ আরাে অনেক গুণীজ্ঞানী ব্যক্তিরা। 
 
গণহত্যা : চট্টগ্রামে
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। ঢাকার পরে তার স্থান। এখানকার কালুরঘাট বেতার  কেন্দ্র থেকে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয় । অতঃপর কোলকাতায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন, মুক্তিবাহিনী সংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু। চট্টগ্রামে পাকবাহিনী চালিয়েছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড এখানকার সাতকানিয়া, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, পটিয়া, বােয়ালখালী, পাহাড়তলী এলাকায় ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। চট্টগ্রামে ২০টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে অনুমান করা হয়, চট্টগ্রাম শহরেই পাকবাহিনী কর্তৃক লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। এবার পাহাড়তলীর গণহত্যার কাহিনী। শােনা যাক এ. কে. এম. আফছার উদ্দীনের বর্ণনা থেকে ১০ই নভেম্বর ১৯৭১, বুধবার পবিত্র রমজান মাসের ২০ তারিখ । সকাল পাঁচটায় ফজরের নামাজ আকবরশাহ মসজিদে জামাত পড়ে যেইমাত্র মসজিদ থেকে বের হয়ে সিঁড়িতে পা রেখেছি, একজন অবাঙালি অর্থাৎ বিহারী এসে অভিযােগ করে যে, মসজিদের পূর্বদিকে পাহাড়ের কিনারে সমতল জায়গায় চারজন বিহারীকে বাঙালিরা মেরে রেখে গেছে। সে উর্দু ভাষায় বললাে, কলােনীকা হালত খারাপ হাে যায়ে গা।’ লােকটা অপরিচিত  সে আমাকে লাশ দেখতে বললাে আমি, আকবর হােসেন এবং আরও চারজন মুসল্লী ঘটনা দেখার জন্য সেদিকে চললাম  দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী রাস্তা পার হয়ে যখন। খােলা জায়গায় গেলাম তখন অগণিত অবাঙালি নানা রকমের মারণাস্ত্র নিয়ে। লাশগুলাের পাশে দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেলাম অসংখ্য জনতা পূর্বদিক থেকে শােরগােল করে এদিকে আসছিল  জনতার গতিবিধি দেখে আমি এবং আমার সঙ্গী ভীষণ ভয় পেলাম দূরে আওয়াজ শুনলাম ‘খতম কর।
জনতার মধ্যে কয়েকজন বন্দুকধারীকে আমি চিনতাম  তারা অধিকাংশই রেলওয়ে স্টাফ। কয়েকজনের নাম ও অন্যান্য বিবরণ নিমে প্রদত্ত হলাে   বন্দুকধারীদের মধ্যে মােঃ আকবর খান বিশেষ উল্লেখযােগ্য আকবর খান পাহাড়তলী লােকো শেডের একজন বয়লার মেকার  ঐ সময়ে সে পাহাড়তলী ডি. এস, অফিসে মােহাম্মদ ইসরাইল ডিভিশন পারসােনাল অফিসার গােলাম ইউসুফের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্টের দেহরক্ষী হিসেবে অফিসে বন্দুক নিয়ে পাহারা দিত এবং বাঙালিদেরকে ভয় দেখাতাে কোনাে লােক অফিসের দরজায় গেলে তাড়া করতাে  আরেকটি পরিচিত মুখ ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ইউসুফ আমাদের অফিসের উইং সেকশনের ইফতিখার উদ্দিন, জিয়াউল হক। এবং রিটায়ার্ড অফিস সুপারিনটেনডেন্ট হামিদ হােসেন। এরা সবাই অবাঙালি এদের হাতে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ছিল। দূর থেকে আমাদেরকে দেখে আকবর। আমাদেরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বললাে, ইহাছে ভাগাে শালা বাঙালি লােক।’ তার এই কথার সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ আসলাে, ভাগনে মাত্ পাও। খতম করাে। আমরা এক পা-দু’পা করে ফিরে আসতে লাগলাম ।
পাশের পাহাড়ের কিনারে কয়েকটা বাড়িতে বাঙালি বাস করতাে। তাদেরকে সাবধান করে দিয়ে বললাম যে, বিহারীরা আসছে, সাবধান। আমরা পুলিশ ফাঁড়িতে এলাম। ফাড়িতে তখন মাত্র তিনজন কনস্ট্যাবল। ছিল। তাদের কাছে ঘটনা বললাম এবং সাহায্য চাইলাম। কিন্তু তারা কোনাে সাহায্য করতে পারলাে না । ডবল মুরিং থানায় ফোন করলাম। সেখান থেকেও সাহায্য পাওয়া গেল না। আমার সাথী আকবর হােসেন তার পরিবার এবং ছেলেমেয়েদের জন্য চিন্তিত হয়ে তার বাসার দিকে রওনা হলাে। কিছুদূর যাবার পর রাস্তায় কয়েকজন বিহারী তাকে ঘিরে ফেললাে। তারা তাকে লাশগুলাের কাছে টেনে। নিয়ে গেল। তারপর তার আর ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। সকাল আনুমানিক সাড়ে সাতটা আমি পুলিশ ফাঁড়িতে অস্থিরভাবে পায়চারী করছিলাম আর কলােনীর দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। লােকজন দৌড়াদৌড়ি করছিল । বিহারীরা দলে দলে এসে প্রত্যেক বাঙালির ঘরে ঢুকছে। আর যাকে ধরেছে তাকেই বলছে, চলিয়ে, চেয়ারম্যান সাব আয়া, সবকো বােলায়া, স্টেটমেন্ট দেনা হােগা।’ কাউকে বলেছে, এস, পি, আয়া, স্টেটমেন্ট দেনা হােগা আবার কাউকে বলেছে, মিলিটারী অফিসার আয়া, আপ লােককো বােলায়া। না গিয়ে উপায় ছিল না। যেতে না চাইলে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। বাঙালিরা সেদিন জল্লাদখানায় না গিয়ে পারেনি। লুঠতরাজ করেছে। একদলে। এ-দলে রাজকারও ছিল  পুলিশ ফাঁড়িতে বসে খবর পেলাম যে, বিহারীরা এগারাে জনকে ধরে নিয়ে গেছে। ফাড়ির কোনাে সাহায্য না পেয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ সাহেবের বাড়িতে গেলাম তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে তার গাড়িতে করে ডবল মুরিং থানায় নিয়ে গেলেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীর নিকট জানতে পারলাম যে, ও, সি, সাহেব পাঞ্জাবি লাইনের দিকে গিয়েছেন। ডবল মুরিং থানা থেকে আবার পাহাড়তলী পুলিশ ফাঁড়িতে গেলাম। তখন সকাল সাড়ে নয়টা। ও, সি’র দেখা পেলাম । সংক্ষেপে তাকে বিহারীদের কার্যকলাপের কথা জানালাম। তার কাছে সাহায্য চাইলাম।
ইতােমধ্যে ধরে নেওয়া লােকদের  আত্মীয়-স্বজন এসে কান্নাকাটি শুরু করলাে। এই সময়ে একটা বেবী টেক্সী এবং একটা প্রাইভেট কারে তিনজন লােক এসে পুলিশ ফাড়ির সামনে নামলাে। তারা উর্দুভাষী  শান্তি কমিটির সদস্য বলে পরিচয় দিল। তারা ও. সি-র সঙ্গে আলাপ করলাে। তাদের আলাপ শুনে মনে হলাে যে, এ-ঘটনাকে তারা কোনাে গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমি ও. সি-কে কলােনীর দিকে যেতে অনুরােধ করলাম বিহারী তিনজন নিজেদেরকে শান্তি কমিটির সদস্য বলে পরিচয় দিয়েছিল। তারা বললাে, “সব ঝুটা হ্যায় । কলােনীমে কুছ নেহি হুয়া। নিরুপায় হয়ে আবার ডবল মুরিং থানার দিকে চললাম। একজন পশ্চিমা এস, পি-কে থানায় পেলাম । ঘটনা ব্যক্ত করে সাহায্য চাইলাম। এস, পি সিটি-ডি. এ. পি মিঃ বশিরকে পুলিশ ফোর্স নিয়ে ঘটনা স্থলে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলেন। কিন্তু সাথে সাথে বললেন, ‘মামুলী চিজ হ্যায়।’ ইতােমধ্যে ডি. সি. এসে থানায় হাজির হলেন। তাকেও ঘটনা জানালাে হলাে। তিনি এস, পি-র সঙ্গে কথা বলে চলে গেলেন। বেলা সাড়ে দশটার সময় ডি. এস. পি. মিঃ বশির কিছু পুলিশ ও রাজাকার নিয়ে পাহাড়তলী পুলিশ ফাড়িতে এলেন। আমিও সঙ্গে ছিলাম। যে চারজন বিহারীর লাশ আকবরশাহ মসজিদের পিছনে পাহাড়ের পূর্বদিকে রেখেছিল তা আনার জন্য পুলিশ সেখানে গেল। অনেকক্ষণ পরে সেই লাশ চারটি পুলিশ ফাঁড়িতে আনা হলাে। লাশগুলির চেহারা বিকৃত। এ-লাশগুলােকে কোনাে বিহারী সনাক্ত করলাে না। সকাল ৬টা থেকে বিকাল ২টা পর্যন্ত বিহারীদের ধর-পাকড়, লুঠতরাজ অব্যাহত গতিতে চলেছে। পুলিশ কোনাে প্রতিরােধ করেনি। আকবরশাহ মসজিদের ইমাম মাওলানা আমির হােসেন সাহেবকে দুই-দুইবার মসজিদ থেকে টেনে রাস্তায় বের করেছে। কিছু লােকের হস্তক্ষেপে তিনি বেঁচে গেছেন। ৭০ বছর বয়সী মােয়াজ্জম হােসেন এবং ৬৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ মসজিদে এতেকাফে ছিলেন। বিহারীরা তাদেরকেও ধরে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে। মােতাহার কন্ট্রাকটর, তার ভাই এবং আরও চারজনকে হত্যা করা হয়। আরাে বহু লােককে বিহারীরা হত্যা করে।  বেলা ১টায়, আবার ডবল মুরিং থানায় গেলাম। গিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারকে জানালাম যে, বিহারীরা রেলওয়ে কলােনী, পাঞ্জাবি লাইন থেকে বাঙালিদেরকে ধরে নিয়ে হত্যা করছে। কিন্তু কোনাে ফলােদয় হয়নি।
বিকালের দিকে আবদুল গােফরান নামক এক দোকানদারের সঙ্গে দেখা হলাে। তাকেও বিহারীরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তাকে হত্যা করতে উদ্যত হবার প্রাক্কালে সে লাফিয়ে ঝিলের পানিতে পড়ে সাঁতরিয়ে অপর পাড়ে উঠে ঝোপের ভিতরে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচায়। এই ঝিলের পাড়ে এনে বহু বাঙালিকে জবাই করা হয়। পাহাড়তলী বাজারে এলাম। রাত আনুমানিক ৭টা। তারপর আমি আজাদী। পত্রিকার অফিসে গেলাম। এরপর ইত্তেফাকের রিপাের্টারের কাছে যাই। আমার দেখা এই লােমহর্ষক ঘটনার কথা বললাম তাদের কাছে । এই নারকীয়। হত্যাকাণ্ডের অনেকটা আমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি। ১১ই নভেম্বর বিকাল ৬টায় ফয়েজ লেকের বিপরীত দিকে পাহাড়ের উপর অনেক লাশ দেখতে পেলাম। এখানে সবগুলাে লাশই ছিল মেয়েদের। অধিকাংশই যুবতী। সব মৃতদেহগুলাে গণনা করলাম। লাশের সংখ্যা ছিল ১০৮২টি। এগুলাে ১০ তারিখের লাশ নয় । তারও ২/১ দিন পূর্বের। পরে অনুসন্ধানে জানা গেল যে, এই মেয়েগুলােকে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে মিলিটারী ক্যানটনমেন্টে আটক রাখা হয়েছিল ভােগ করার জন্য। এদের অনেকেই শিক্ষিতা এবং দ্রঘরের মেয়ে বলে মনে হয়েছে। দীর্ঘকাল আটক রেখে ধর্ষণ করার ফলে অনেকেই ছিল গর্ভবতী । তাদের পেটের আকৃতি দেখে তা বােঝা গেছে। গর্ভবতী হওয়ায় ব্যবহারের অযােগ্য হয়েছিল বলেই হয়তাে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে ।  পাকবাহিনী এবং রাজাকার ও বিহারীরা এ-ভাবে বাঙালিদের উপর নৃশংস । অত্যাচার চালিয়েছে, হত্যা করেছে। এক চট্টগ্রামেই যা ঘটেছে তাতেই হতবাক হয়ে যেতে হয়। আসলে তাদের অত্যাচারের কতটুকুই বা দেখতে পেয়েছে লােকে? যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বর্বর পাকসেনাদের বিচার করা গেল না। ১৬ই। ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের পর তাদেরকে পাকিস্তানে ফেরৎ যাবার সুযােগ দেওয়া হলাে। বিচার হলাে না দেশীয় দালাল-রাজাকারদেরও। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উঠলেও, তাদেরকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। এবং তাদের অপরাধের পরিমাণ নিরূপণ করা দুরূহ বলে মনে হয়। অবশ্য বিহারীরা বাংলাদেশে আটকা পড়ে বিচারের সম্মুখীন না হয়েও অভাব-অনটনে। ভুগে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যাচ্ছে।

পাহাড়তলীতে নিহত : যাদের নাম জানা গেছে।
১। মােঃ ফজরুল ইসলাম – রেলওয়ে ড্রাইভার।
২। রমণী কুমার দত্ত – জমাদার।
৩। এম. আর. খান – এ. সি. ও. এস।
৪ । জাহিদ – ছাত্র।
৫। এম, এ. চৌধুরী – ডি, ই, ই।
৬। মােঃ শফি – রেলওয়ে কর্মচারী।
৭। মােঃ ইউসুফ — ঐ।
৮। আবুল কালাম — ছাত্র।
৯। আব্দুল আলিম মিন্টু —ঐ।
১০। আব্দুস সামাদ মিয়া – রেলওয়ে কর্মচারী ।
১১। সৈয়দ মাহবুব আলী – ঐ।
১২। আব্দুস সামাদ – টেলিঃ ইন্সপেক্টর ।
১৩। হাসিনুর রহমান – ফোরম্যান।
১৪। নূরুল আমিন – ঐ।
১৫। আব্দুল গফুর – রেলওয়ে কর্মচারী।
১৬। এ. বড়ুয়া – ঐ।
১৭। আহমদ শাহ – ব্যবসায়ী।
১৮। ফখরুল আলম রেলওয়ে কর্মচারী।
১৯। মােঃ কদম আলী — ওয়ার্কশপ কর্মী।
২০। মােঃ কাসেম – রেলওয়ে ড্রাইভার।
২১। রওশন আলী খান – কেরানী।
২২। আমানত আলী খান – একাউন্ট্যান্ট।
২৩। দেলােয়ার হােসেন খান -কেরানী।
২৪। গােফরান আলী – ঐ।
২৫। মােঃ আব্দুল হাই – একাউন্টস্ কর্মচারী।
২৬। শেখ মােঃ আব্দুল আজিজ – রেলওয়ে কর্মচারী।
২৭। শেখ মােঃ আলী রেজা — ছাত্র ।
২৮। মােঃ মাজেদ আলী – ঐ।
২৯। মাখন – চাকুরীজীবী।
৩০। সৈয়দা লায়লা বেগম – ছাত্রী।
৩১। আবু মিয়া – চাকুরীজীবী।
৩২। মােঃ হাফেজ উল্লাহ –পিয়ন।
৩৩। মােঃ সুজা উদ্দিন – এস, কে, পি।
৩৪। মােঃ ইসহাক – রেলওয়ে ড্রাইভার ।
৩৫। ছাবেদ আলী রেলওয়ে কর্মচারী।
৩৬। হামিদুর রহমান – ঐ।
৩৭। বাহার মিয়া – ঐ।
৩৮। মওদুদুর রহমান – ছাত্র।
৩৯। মােহাম্মদ মিয়া চৌধুরী –ও, এস, (ডি. সি, অফিস)।
৪০। বজল আহমদ — পেশা জানা যায়নি।
৪১। মােস্তাফিজুর রহমান – ফোরম্যান।
৪২। আব্দুল মিয়া – চাকুরীজীবী।
৪৩। এস, এম. কামাল উদ্দিন – পেশা জানা যায়নি।
৪৪। সালেহ আহম্মেদ — ঐ।
৪৫। ইদ্রিস মিয়া —শ্রমিক।
৪৬। হাবিবুর রহমান – ঐ।
৪৭। বাদশাহ মিয়া — ঐ।
৪৮। আবুল হােসেন ঐ।
৪৯। মােঃ ইসহাক – ছাত্র।
৫০। মােহাম্মদ আলী – ঐ।
৫১। রওশন আলী খান – রেলওয়ে কর্মচারী।
৫২। এম. এ. খান — ঐ ।
৫৩। মােঃ ইউসুফ – ঐ।
৫৪। আলী আজম – ঐ।
৫৫। আবদুল গফুর — ইঞ্জিনিয়ার।
৫৬। নিরঞ্জন বিকাশ বড়ুয়া — রেলওয়ে গার্ড।
৫৭। বুলু -রেলওয়ে স্কুলের ছাত্র।
৫৮। গােলাম ইয়াজদানী – সহকারী কন্ট্রোলার অফ স্টোরস্ ।।
৫৯। গােলাম হােসেন চৌধুরী -কন্ট্রোলার অফ স্টোর কর্মচারী।
৬০। মােসলেম আলী তালুকদার একাউন্ট অফিসের কর্মচারী।
৬১। আলী আজম মুন্সী – কেরানী। ৬২। আনছার আলী – ঐ।
৬৩। আব্দুল খালেক – ঐ। ৬৪। হামেদ আলী মােড়ল – ঐ।
৬৫। আলী করিম – ঐ। ৬৬। হায়দার আলী —শ্রমিক।
৬৭। জনাব আলী —ঐ। ৬৮। ফজল মিয়া — ঐ।
৬৯। জয়নাল আবেদীন —ঐ।
৭০। সিরাজ — ঐ।
৭১। আলী নওয়াব – ঐ।
৭২। আরাফত আলী — ঐ।
৭৩। কাজী মাহবুব ইয়াজদানী – ছাত্র (এস, এস, সি, পরীক্ষার্থী) ।
৭৪। মােঃ ফসিউল আলম – ঐ।
৭৫। কাজী নজরুল ইসলাম ব্যবসায়ী।
৭৬। আলী নওয়াব শ্রমিক।
৭৭। নুরুল হক – ঐ।
৭৮। আবদুল মান্নান শ্রমিক।
৭৯। আবদুল হামিদ – ঐ।
৮০। মমতাজ মিয়া — ঐ।
৮১। ওয়ালি উল্লাহ — ঐ।
৮২। কফিল উদ্দিন ঐ।
৮৩। মােঃ আকবর হােসেন – চাকুরীজীবী।
৮৪। আব্দুল মজিদ – ব্যবসায়ী ।
৮৫। মােঃ সফিকুল ইসলাম – ঐ।
৮৬। মৌ, নজিব আহমদ – ঐ।
৮৭। সৈয়দ আমির আলী বীমা কর্মচারী।
৮৮। আব্দুল মান্নান শ্রমিক।
৮৯। আলী হােসেন – ঐ।
৯০। আবদুল গােফরান – ঐ।
৯১। সৈয়দুর রহমান – ঐ।
৯২। আব্দুল আজিজ – ঐ।
৯৩। শামসুল হক – ঐ।
৯৪। আব্দুল করিম – ঐ।
৯৫। আব্দুল ওহাব – ঐ।
৯৬। মহরম আলী – ঐ।
৯৭। মােঃ ইসহাক — ঐ।
৯৮। আলী হােসেন —ঐ।
৯৯। গােফরান মিয়া — ঐ।
১০০। আব্দুল মান্নান – ঐ।
১০১। সােহরাব আলী – ঐ।
১০২। আব্দুল গফুর – ঐ।
১০৩। আমিনুল ইসলাম – কনট্রাকটর।
১০৪। আবুল কাশেম — ব্যবসায়ী।
১০৫। নােয়ব আলী পিয়ন।
১০৬। বাদশা মিয়া – কৃষক।
১০৭। সুলতান আলম – চাকুরীজীবী।
১০৮। মােজাম্মেল হক — ওয়ার্কশপ কর্মী।

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড – মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান