You dont have javascript enabled! Please enable it! একাত্তরের গণহত্যা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - সংগ্রামের নোটবুক
একাত্তরের গণহত্যা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ছিল ১৭ই ডিসেম্বর।উভয় নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ‘৭১-এর মার্চে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন উর্দুভাষী সরকার বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সম্মত ছিল না। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া স্থগিত ঘােষণা করেন। পূর্ব পাকিস্তানে গণঅসন্তোষ চরমে ওঠে। ৭ই মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখ লাখ জনতার উপস্থিতিতে এক ঐতিহাসিক ভাষণে অসহযােগের ঘােষণা দিলেন। অতঃপর সমগ্র দেশব্যাপী শুরু হয়ে গেল অভূতপূর্ব অসহযােগ আন্দোলন সমগ্র দেশের স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল ইয়াহিয়া খান এলেন ঢাকায় এলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ আরাে অনেক পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা। শেখ মুজিবের সঙ্গে তারা বৈঠক করলেন। ভেতরে ভেতরে ছিল ষড়যন্ত্র । বৈঠক চলাকালীন সময়ের মধ্যে পাক-সরকার পূর্ব বাংলায় পশ্চিমা সেনাবাহিনী মােতায়েন এবং অস্ত্র-শস্ত্র আমদানীর কাজ চালাতে লাগলাে অতি গোপনে তাদের টার্গেট পুরাে হতেই তারা একে একে পাড়ি জমালাে পশ্চিম পাকিস্তানে। সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ছাড়লেন ২৫ মার্চ বিকালে ফিরে গিয়েই রাতের বেতার ভাষণে তিনি সামরিক শাসন জারি করলেন।
আর, সেদিনই মধ্যরাতে পাকবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লাে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর  শুরু হয়ে গেল জঘন্যতম বর্বর গণহত্যা । ঐ একরাতে ঢাকাতেই তারা কতাে মানুষ হত্যা করেছিল, তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ আজও সম্ভবপর হয় নি।  ঢাকায় তিনটি লক্ষ্যস্থলে পাকসেনারা একই সঙ্গে আঘাত হানে। রাজারবাগের পুলিশ বাহিনী এবং পীলখানার ইপিআর (বর্তমান নাম বিডিআর)এর হেড কোয়ার্টারে তারা আক্রমণ চালায়। পুলিশ-ইপিআররা প্রতিরােধের চেষ্টা চালিয়ে যায় প্রাণপণ। কিন্তু পাকসেনাদের আধুনিক এবং ভারী অস্ত্রের সামনে তারা অধিকক্ষণ টিকে থাকতে পারে নি। পাকসেনাদের মেশিনগানের গুলিতে তারা অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কেউ কেউ পালাবার চেষ্টা করে  অবশিষ্টরা পাকসেনাদের হাতে বন্দী হয়। পরবর্তীতে বন্দী পুলিশ-ইপিআরের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানাে হয় এবং কতককে বিভিন্ন সময়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পঁচিশে মার্চের মধ্যরাতের তৃতীয় টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল) পাকসেনাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এজন্য যে, তারা ভাবতাে হলের ছাত্রদের কাছে অস্ত্র রয়েছে। তাই এ হল দুটি সে-রাতে পাকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। প্রচণ্ড আওয়াজে হলের ছাত্র এবং ক্যাম্পাসে বসবাসরত শিক্ষকদের ঘুম ভেঙে গেল ইকবাল হলের ছাত্ররা প্রতিরােধে ব্যর্থ চেষ্টা চালালাে কিছুক্ষণ । কিন্তু সাঁজোয়া সেনাবাহিনীকে রাইফেল দিয়ে কতক্ষণ ঠেকানাে যায় হানাদার সেনারা ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লাে হল থেকে ছাত্রদেরকে টেনে হিচড়ে বাইরে এনে গুলি করে হত্যা করতে থাকলাে সে রাতে কতাে ছাত্ররা প্রাণ হারালাে, তার সঠিক হিসেব জানার উপায় থাকলাে না। হত্যা করার পর লাশগুলাে সরিয়ে নেওয়া হলাে বিভিন্ন স্থানে গর্ত খুঁড়ে তার ভেতরে মাটি চাপা দিয়ে রাখলাে  লাশ সরানাের কাজে লাগানাে হলাে মালী, সুইপার, ডােম যাকে পেয়েছে, তাকেই। আবার যাদেরকে লাশ সরাবার কাজে লাগিয়েছে তাদের অনেককে কাজের শেষে গুলি করে হত্যা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বসবাস করতেন ডকটর গােবিন্দদেব তিনি দর্শন বিভাগের প্রধান ছিলেন। এই চিরকুমার প্রৌঢ় অধ্যাপক ছিলেন মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক। তিনি একটি মুসলমান মেয়েকে পালন করতেন। তার নাম রােকেয়া সুলতানা  মেয়েটিকে তিনি মােহাম্মদ আলী নামের এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। রাবেয়া নামের একটি শিশুকন্যা ছিল রােকেয়ার  এদেরকে নিয়ে গােবিন্দদেবের সংসার সারারাত গােলাগুলির তাণ্ডবলীলার মধ্যেও তিনি অতি প্রত্যুষে পূজায় বসেছিলেন। এমন সময়ে পাকসেনারা তার কোয়ার্টারের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকলাে। তার জামাতা দরােজা খুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে। লুটিয়ে পড়ে তার প্রাণহীন দেহ  অতঃপর ডকটর দেবকে হত্যা করা হয় । তার লাশও তারা সরিয়ে নিয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ডকটর জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতাকে সে-রাতে তার কোয়ার্টার থেকে টেনে বের করে নিয়ে গুলি করা হয়।
 

তিনি তৎক্ষণাৎ মারা যান নি। সময়মতাে তার চিকিৎসা করাবার সুযােগও হয় নি কারফিউর কারণে ২৭শে মার্চ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় কিন্তু তবুও চিকিৎসা করানাে যায় নি। হাসপাতালে তখন একজনও ডাক্তার ছিল না। বিনা চিকিৎসায় প্রচুর রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয় । পাক মিলিটারীরা হাসপাতাল ঘেরাও করে রাখার কারণে তার লাশ ফেরত আনা যায় নি। তার লাশের অবস্থা কি হয়েছে, জানা যায় নি। সে-রাতে অধ্যাপকদের মধ্যে আরও যাদেরকে হত্যা করা হয়, তারা হলেন- অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, অধ্যাপক আতাউর রহমান খান, ডকটর ফজলুর রহমান খান, অধ্যাপক আবদুল মুকতাদির, অধ্যাপক শরাফত আলী, মােহাম্মদ সাদেক, অধ্যাপক আ. ন. ম. মুনিরুজ্জামান প্রমুখ সেই ভয়াল রাত্রীতে রাজারবাগের পুলিশ, পীলখানার ইপিআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ছাত্ররাই শুধু প্রাণ হারায় নি। অন্যান্য বহু কর্মচারী, যারা এ-স্থানে বসবাস করতাে, কিংবা কর্মরত ছিল, তারাও অনেকে পাকসেনাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকারে পরিণত হয়। অসহযােগ আন্দোলনের মধ্যে পাকবাহিনী অতর্কিতে মধ্যরাতে হামলা চালিয়ে নিরীহ নিরপরাধ মানুষ গুলি করে হত্যা করে বাঙালিদেরকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে যেতে বাধ্য করে। জেনারেল টিক্কা খান আসে পূর্ব বাংলায় সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে। ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডীর বাসা থেকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ২৬শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয়। অতঃপর আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গ, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবর্গ এবং সর্বস্তরের মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। চট্টগ্রামে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে কিছু বাঙালি সৈন্য ছিল । তারাও ভারতে চলে যান। এবার পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করছি । বাদলকান্তি দাস তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকেন জগন্নাথ হলে ।

 
তিনি সে-রাতে আসন্ন মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক-এর পরিসংখ্যান বিভাগের সহপরিচালক। তার কথা শােনা যাক— অনেকগুলাে আঘাতের পর হঠাৎ করে দরােজাটা ভেঙে পড়ল, হঠাৎ করে তীব্র, তীক্ষ্ণ আলাের ঝলকানি দিয়ে ঘরে ঢুকল মিলিটারী  আমরা দু’জন যে দুটো চৌকির নিচে শুয়েছিলাম সে দুটো চৌকির মাঝখানে কিঞ্চিৎ ফাক ছিল লােক চলাচলের  সে ফাক দিয়ে হেঁটে গেল মিলিটারী, আমি শুধু তাদের জুতাে দেখতে পেলাম  আমার শুধুই মনে হতে লাগল মিলিটারী যদি মাথা নিচু করে  একটু তাকায় চৌকির নিচে, তবেই আমাদের আর কোনাে কথাই বলতে হবে না কোনােদিনও। কৃষ্ণের কৃপায় মিলিটারী আর চৌকির তলার দিকে দেখল না, একজন অপরজনকে বলল এখানে কোনাে আদমী নেই । তারপর তারা চলে গেল  অন্যান্য রুমে তখনও তাণ্ডবলীলা চলছে তার শব্দ পাচ্ছিলাম মিলিটারী বের হয়ে যাবার পর আমার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়েও কম ছিল। যদিও মিলিটারী চলে গেছে আমাদের রুম থেকে কিন্তু তবুও মৃত্যুভয় আমার তখনও কাটেনি।  আমি যখন দৌড়ে গেটের কাছে যাই, তখন হলে কাজ করতাে যে দুটো অনাথ ছেলে তাদেরকে বসে থাকতে দেখেছিলাম। মিলিটারীরা সেই ছেলে দুটোকেও ধরে নিয়ে আসে তাদের সাথে । এতে অবশ্য তাদের সুবিধাই হয়েছিল, হলের ছেলেরা কোথায় বসে বা থাকে এগুলাে মিলিটারীর পক্ষে চেনা বা জানা সম্ভব নয়। এদের ধরে নিয়ে এসেছিল সেসব জায়গা চিনিয়ে দিতে। আমাদের ছাদের উপর কিছু ছেলে লুকিয়ে ছিল। আমার মনে হয় ছেলে দুটোকে তারা ছাদে যাবার সিড়ি দেখিয়ে দিতে বলেছিল, তা না হলে মিলিটারীর পক্ষে ছাদে ওঠা সম্ভব ছিল না। কারণ ছাদে যাবার সে সিড়িটা ছিল একটা স্টোর রুমের ভিতরে যা তাদের জানার কথা নয় । ছাদে আমাদের অনেক বন্ধুকে তারা খুঁজে বের করে গুলি করে। প্রায় সবাই মারা যায়। তবে তাদের মধ্যে আহত অবস্থায় বেঁচে যায় একজন  আমার মনে হয় মিলিটারীদের মস্তিষ্কের সুস্থতা ছিল কিংবা তারা মদ খেয়ে এসেছিল। এজন্য তারা বারবার চেক করছে এবং কোথায় কোথায় চেক করেছে তা তারা ভুলে যাচ্ছিল। আমরা যে ঘরে লুকিয়ে ছিলাম প্রথমবার আমাদের না পেলেও আরও কয়েকবার তারা সেঘরে পদচারণা করে, কিন্তু তখনও পায়নি। ধীরে ধীরে দিনের আলাে ফুটে উঠল। আস্তে আস্তে আলােকিত হয়ে উঠল ঘরের সবকিছু।
 
তখন ভয় আমার আরও বেড়ে গেল। ভাবলাম, রাতের বেলা আমাদের দেখেনি ঠিকই কিন্তু এখনতাে দিন, এখন নিশ্চয়ই আমাদের দেখে ফেলবে। তার মানে এযাত্রা বাঁচার আশা এখানেই। ইতি । যেখানে যে অবস্থায় ছিলাম এখনও ঠিক সে অবস্থাতেই আছি। একটুও নড়াচড়া করার উপায় নেই – কারণ তাহলেই ব্যাগ এবং বিভিন্ন জিনিসপত্রও নড়ে, শব্দ ওঠে কড়কড় করে। সকালবেলা মিলিটারী আবার এলাে  আবার সােজাই চলে গেল, চৌকির নীচে দেখেনি। আশপাশের দামী জিনিস তারা নিয়ে গেছে, বাকী জিনিসপত্র দুই চৌকির মাঝে রেখে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুন যে জ্বলছে তা আমি বুঝতে পারছিলাম, ধােয়া উড়ছে, নিচে একটা গরম গরম ভাব  যখন দেখি ঘরের সমস্ত কিছুই পুড়ে গেছে এবং পােড়া জিনিস সব পড়ে পড়ে ভাব তখন আমি আমার সাথের লােকটাকে জিজ্ঞেস করি এখন আর কিভাবে থাকা যায়? এরপর আমি আস্তে আস্তে উঠে দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে কান পেতে থাকি। কিন্তু কোনাে শব্দই পাই না তৎক্ষণাৎ চিন্তা করে ফেলি কি করলে আমি সহজে বাঁচতে পারি। চিন্তা করলাম মেডিকেলের দিকে দৌড় দিলে মিলিটারী দেখে ফেলতে পারে, এস, এম, হলের দিকেও মিলিটারী থাকা বিচিত্র কিছু নয়। আমাদের হল থেকে সবচেয়ে কম দূরত্বে হলাে রােকেয়া হলের হাউস টিউটরের বাসা। কোনােমতে সেই রাস্তাটা পার হতে পারলেই আমি বেঁচে যাব। যেই ভাবা, সেই কাজ, আমি এক দৌড়ে হলের দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে চলে গেলাম । উত্তর দিকে যেয়ে দেখি পাঁচ-ছয় সিটের একটা রুম ছিল, সেখানে অনেক ছেলেরা থাকত, সেখানে ৪/৫টা লাশ পড়ে আছে, চারদিকেই রক্তের গঙ্গা। আমি আর চাইতে পারি না, এই বীভৎস দৃশ্য দেখে আমার চোখে জল এসে গেল। আমার মনটা এমন বিমর্ষ হয়ে গেল যে আমি আর কিছু চিনতে পারি না, আর কিছু বুঝতে পারি না। আমি যখন দৌড়ে গেছি, তখন নিচে থেকে শুনতে পেলাম একটা জুতার আওয়াজ। আমি ভাবলাম মিলিটারী আসছে। তখন দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম এবং একটা পায়খানার মধ্যে ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা আটকে দিলাম। পায়খানার জানালা ছিল ভাঙ্গা, সেই ভাঙ্গা জানালার ভেতর গলে জলের পাইপ বেয়ে আমি নিচে নেমে এলাম । নিচে নেমে প্রথমেই আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম কোনাে মিলিটারী দেখা যায় কিনা কোনাে মিলিটারী না দেখে হামাগুড়ি দিয়ে হলের ঐ দেয়াল টপকে রাস্তা পার হলাম। শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখি রক্ত আমার বিভিন্ন জায়গায় জমাট বেঁধে গেছে, আর জল পিপাসায় জীবন যায় যায় অবস্থা।
 
রাস্তা ঘাটে একটা কাক পক্ষীও নেই। তখন ধীরে ধীরে আমি স্টাফ কোয়ার্টারে গিয়ে নক করলাম জল খাবার জন্য, কিন্তু কোনাে শব্দ নেই। দরজা-জানালা সব বন্ধ। কেউই দরজা খুললাে  না। তখন আমার মনে পড়ল উদয়ন স্কুলের কাছে স্টাফ কোয়ার্টারে কেমিস্ট্রির প্রফেসর আলী মােহাম্মদের ছেলে হালিম নামের এক ছাত্রের কথা। সে আমার সঙ্গে পরিচিত  দরজায় নক করার পর তারা দরজা খুলে দিল। আমার কাছ থেকে তারা সমস্ত ঘটনা শুনল। এত কাছে থাকা সত্ত্বেও শুধুই তারা টের পেয়েছে গণ্ডগােল হয়েছে। কিন্তু ছাত্রদের মারছে, একেবারেই মেরে ফেলেছে তা তারা ধারণাই করতে পারেনি। আমার কাছ থেকে সমস্ত কথা শুনে তারা বুঝতে পারল জগন্নাথ হলের সব ছাত্রকে মেরে ফেলেছে। ২/৪ জন বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলাে, কজন বেঁচে আছে। আমি  বললাম, ক’জন বেঁচে আছে তা আমি বলতে পারব না, তবে আমি অনেক কষ্ট করে বেঁচে আছি এটুকু শুধু বলতে পারি। তারপর তাদের বাথরুমে গিয়ে শরীরের সমস্ত জমাট বাঁধা রক্ত পরিষ্কার করে হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিলাম  ওদের ঘর থেকে জামা-পাজামা দিল, সেগুলাে পরে বিকেল বেলা বাইরে চলে গেলাম। উদয়ন স্কুলের কাছে আমার এক বন্ধু ছিল, আমার সাথে পড়ত, নাম ভুলে গেছি ওদের ওখানে গেলাম, দরজা নক করলাম, দরজা খুললাে। আমার কাছ থেকে সমস্ত শুনলাে  কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমি জগন্নাথ হলের ছাত্র, আমি থাকলে তাদের বিপদ হতে পারে এই ভয়ে আমি আশ্রয় চাওয়া সত্ত্বেও তারা আমাকে আশ্রয় দিল না তারা আমাকে সেখান থেকে চলে যেতে বললাে। যেহেতু আমি হিন্দু মানুষ, মিলিটারী যদি জানতে পারে আমি সেখানে তবে যদি আবার তাদের উপর আক্রমণ করে এই ভয়েই তারা আমাকে আশ্রয় দিল না। যা-ই হােক, আমাকে যখন বের করে দিল তখন আমি ২৬ তারিখ সন্ধ্যার দিকে উদয়ন স্কুলের গেটটা ক্রস করে ভিতরে গেলাম। আমাদের চট্টগ্রামের দীপক নামে একজন ছাত্র, জগন্নাথ হলের ভি. পি. ছিলেন, তার কাছে গেলাম উনি তখন বাণিজ্য বিভাগের একজন শিক্ষক উনি ব্যাচেলর ছিলেন। তার ওখানে গেলাম। গিয়ে দেখি উনি নেই, বাসা থেকে বললাে তিনি চলে গেছেন। তখন আমি আর কি করব? সমস্ত বাড়ি-ঘরের দরজা বন্ধ । উদয়ন স্কুলের পশ্চিম পাশে যে প্রফেসর কোয়ার্টারগুলাে ছিল তার মাঝখানে একটা লাল বিল্ডিং ছিল। আমি যখন বুঝতে পারছিলাম কোথাও আর আমার পক্ষে থাকা সম্ভবপর নয়, তখন আমি আর কাউকে ডিস্টার্ব করব না।
 
ঐ লাল বিল্ডিং-এর বারান্দাটা খুব বড় ছিল, সেই বারান্দাটায় গিয়ে দরজার সামনে শুয়ে রইলাম। রাত ১০টার দিকে প্রফেসর সাহেবের স্ত্রী দরজা খুলে বাইরে বের হলেন এবং হঠাৎই আমাকে দেখে আর্তস্বরে চিৎকার করে উঠলেন, আরে একি? তখন সবাই একটা ভয়ের মধ্যে ছিল, এদিকে জগন্নাথ হল, ওদিকে ইকবাল হল ইকবাল হলে তখনও আওয়াজ হচ্ছিল। স্যারের স্ত্রীর চিৎকারে স্যারও বেরিয়ে এলেন কোন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক ছিলেন তিনি, এখন আমার মনে নেই- ফার্মেসীর অথবা এপ্লাইড কেমিস্ট্রির । আমি তাকে বললাম, ‘স্যার, আমি জগন্নাথ হলের ছাত্র  কোনােমতে বেঁচে আছি। আমি আপনাদের কোনাে ডিস্টার্ব করছি না। রাতটা আমি এখানে কোনােমতে কাটাতে চাই। আপনাদের এখানে তাে বারান্দা আছে, আর কোথাও তাে বারান্দা নেই। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তােমার বাড়ি কোথায়?’ আমি বললাম, আমার বাড়ি চট্টগ্রামে তিনি বললেন, ‘আমার বাড়িও চট্টগ্রামে। এসাে এসাে, ভিতরে এসাে। তার বাড়ি ছিল সম্ভবতঃ মীরেশ্বরাই  উনি আমাকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে বসালেন। ওনার কাছে বসে আমার সমস্ত ঘটনাই খুলে বললাম  ওনার ঘরে ঢুকে দেখলাম মানুষ কেমন ভয় পেয়েছে। ওনার স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের মুখ ভয়ে শুকিয়ে পাংশুবর্ণ হয়ে গেছে  তিনি আমাকে সামান্য কিছু খাবার দিলেন  সবাই বসে সমস্ত রাত কাটালাম  ঘুমালে আরও বিপদ বেশি হবে। ঘুমও এলাে না সারারাত রাত কাটিয়ে দেওয়ার পরে সকালে উঠে আমরা টেলিভিশনের কাছে বসলাম দেখলাম জেনারেল টিক্কা খান একটার পর একটা কি যেন ঘােষণা দিচ্ছেন এইসব ঘােষণা দিতে তিনি কারফিউ-এর ঘােষণাও দিলেন । কারফিউ দেওয়াতে সমস্ত লােকজন আটকা পড়ে গেল  ২৭শে মার্চ সকাল ৯টার দিকে কারফিউ উঠিয়ে নেওয়া হলাে  তখন স্যার বললেন, ‘এখানে থাকা আর সম্ভব হবে না আমি ধানমন্ডি চলে যাব আমার শ্বশুরের বাড়িতে কারফিউ এখন নেই, যেখানে পারাে, পালাও ঢাকা শহরে আর থেকো না বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তুমি, শহর ছেড়ে একেবারে চলে যাও ‘রাস্তায় একটা রিকশাও নেই। শহীদ মিনারের কাছে গিয়ে দেখলাম শহীদ মিনার ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। অনেক জায়গায় রক্তের দাগ, মনে হয় প্রচুর মানুষ মেরেছে  আরেকটু এগিয়ে দেখি মেডিক্যাল-এর সামনে হাজার হাজার মানুষের জটলা আমি সেখানে ঢুকলাম ওয়ারীতে আর, এন, দত্ত মশায়ের কাছে চলে গেলাম যাবার পথে একটা বীভৎস দৃশ্য দেখলাম- গভর্নর ভবনের পাশে যে বস্তিটা ছিল তা পুড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে এখন আর কিছুই নেই। লােকমুখে শুনলাম, বস্তির সব লােক পুড়ে মরেছে। চান্দদেব রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের মালী। ডকটর গােবিন্দ দেবকে ২৬শে মার্চ প্রত্যুষে মিলিটারীর গুলিতে নিহত হলে তার লাশ ক্যাম্পাসের গণকবরে রাখা হয় মিলিটারীর আদেশে চান্দদেবকে তার লাশ বহন করানাে হয়।
 
বহন কাজ সমাপ্তির পর মিলিটারীর গুলিতে সে আহত হলেও মেডিকেল হাসপাতালের চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে যায়। তার বিবরণী এখানে তুলে ধরা হচ্ছে :  জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার বাড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি যেতাম ওনার সাথে আমার খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল  তার সঙ্গে এমন ভাব হবার কারণ তিনি। ফুল খুব ভালবাসতেন আর ফুলের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ভাবতেন। তার সবচেয়ে প্রিয় ফুল ছিল রজনীগন্ধা ২৫ তারিখে বিকেলে যখন আমি তার কাছে যাই, তখন ৫টা বাজে। তখন তার মনটা ছিল খুব গম্ভীর । আমাকে তিনি বললেন যে, কালকে আমাকে একটা রজনীগন্ধার চারা এনে দিতে হবে। আমি বললাম, আজতাে লাগবে না, লাগবে কাল, ঠিক আছে আমি এনে দেবাে আগামীকাল  উনি তখন আমাকে বললেন যে, দেখ চতুর্দিকে কি রকম সমস্যা দেখা যাচ্ছে, অবস্থা বিশেষ ভালাে মনে হচ্ছে না। আমি তার কথায় সায় দিয়ে বললাম, হ্যা, ঠিক তাই  তখন বশী বাজারের দিক থেকে একটা মিছিল এলাে লাঠীসােটা নিয়ে, শ্লোগান দিয়ে  উনি আমাকে বললেন যে, চল দেখে আসি আমরা হেঁটে মেডিক্যালের দিকে বকশী বাজারের মােড় পর্যন্ত এলাম। উনি আমাকে বললেন, চান্দু, অবস্থাটা কেমন যেন খারাপ দেখা যাচ্ছে আমি বললাম, সত্যিই ভালাে মনে হচ্ছে না। তিনি বললেন, তাহলে চলাে, বাড়িতে ফিরে যাই। আমরা আবার বাড়িতে ফিরে এলাম উনি পুনরায় আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, কালকে যেন মনে থাকে আমার রজনীগন্ধা নিয়ে আসা চাই আমি বললাম, হ্যা আনব তিনি আমাকে বললেন, রাত্রে তােমরা একটু সাবধানে থাকবে  সম্ভবত রােড কারফিউ হতে পারে তােমরা ঘর থেকে বের হবে না, নিরাপদে থাকবে বাসায়  এরপর আমি আমার বাসায় চলে আসি কয়েকদিন পর্যন্ত সন্ধ্যায় ব্লাক আউট থাকত সময় সময় বােমা ফাটার শব্দ হত, বিভিন্ন জায়গা থেকে। আমরা বাসার সকলে রাত ১০টার দিকে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম রাত এগারােটার দিকে কয়েকজন ছাত্র কুড়াল চাইতে এলাে, তারা রাস্তায় বেরিকেড তৈরি করবে। সেই সময় রাতের অন্ধকারের জন্য কোনাে ছাত্রকে চিনতে পারলাম না। কুড়াল আমাদের না থাকায় হাত-দা দিতে চাইলাম। তারা বললেন, না কুড়ালই প্রয়ােজন অবস্থা ভীষণ খারাপ, আপনাদের থাকলে দেন, দেরি করবেন না।
 
ওনারা কুড়াল না। পেয়ে চলে গেলেন। চারদিক তখন নিরব, কোনাে শব্দ আর পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে রাত বারােটার সময় বা বারােটা বাজেনি তখনও, ব্রাশফায়ারের শব্দ ভেসে এলাে রেসকোর্সের দিক থেকে। আমরা ভাবলাম হয়তাে রােড কারফিউ দিয়েছে তাই এ ভাবে শব্দ হচ্ছে। সামরিক বাহিনী অথবা নিয়মিত বাহিনী হয়তাে গুলি করছে। আমরা চুপ করে থাকলাম। সম্ভবত পাবলিক লাইব্রেরির দিক থেকে তারা এলাে, এসে এই এলাকাটি ঘিরে ফেললাে তখন তারা কি যেন একটা কথা বললাে খুব জোরে, মাইকে নয়। তারপর তিনটি বিকট শব্দ হলাে এবং সমস্ত এলাকাটি লাল হয়ে উঠলাে শব্দে মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠলাে এর সাথে সাথেই ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হলাে। গুলির শব্দ শুনে আমরা ভয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লাম  রাত তখন তিনটা বাজে, তখন এই হলে (জগন্নাথ হল) তারা ঢুকলাে। গয়ানাথের ছেলে শিবু ছিল তখন হল গেটের দারােয়ান, তাকে গেট থেকে ডেকে নিলাে  শিবুকে নিয়ে পাঞ্জাবি সৈন্যরা মারধর করলাে। তখন তারা বললাে উর্দুতে, শালে তােমকো মুজিবর বাপকে বােলাও  শালে কিধারছে। যৈনা সবলেড়কা, সব জানতা, বালাও। তখন শিবু বললাে, নেহি ও লােকতাে এক মাহিনা আগে সব চলা গিয়া। সব বাড়িমে চলা গিয়া । সৈন্যরা জিজ্ঞেস করলাে, ইধারছে কৌন হ্যায়? শিবু বললাে, উসবতাে কর্মচারী আছে । সৈন্যরা বললাে, বােলাও সব । শিবু তখন বিহারীদাসের বড় ছেলেকে ডেকে নিয়ে এলাে। ওকে ধরে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ মারধর করলাে। উত্তর বাড়ির দিকে গােলাগুলি ছুড়তে শুরু করলাে। তবে ওরা তখনও উত্তর বাড়িতে ঢােকেনি আমি গরুর ঘর থেকে এসব দেখছিলাম। আর খুব অসহায় বােধ করছিলাম । মাকে ডেকে বললাম, মা, অবস্থা খুব খারাপ দেখা যাচ্ছে, তােমরা বাড়িতেই থাকো, আমি দেখি কি করা যায় । আমার একটা কালাে চাদর ছিল, ওটা গায়ে জড়িয়ে বের হলাম, দেখতে লাগলাম সব। দেখলাম, বিরাজদার ঘরের পেছনে কাকে যেন খুব মারধর করছে। আমি দক্ষিণ বাড়ির টিনশেড ডাইনিং হলের দিক দিয়ে বের হতে গিয়েও গেলাম না ভাবলাম যে, হয়তাে অসুবিধা হবে। আমি তখন দক্ষিণ বাড়ির দিক থেকে এসে পড়লাম ঠিক তখনই আমাকে দুজনে দেখে ফেললাে। আমি বুঝলাম যে, আমাকে ওরা দেখে ফেলেছে। তাই হেড দারােয়ান মাখনের ঘরের হাঁস-মুরগির খোয়াড় ছিল, ওখানেই পিছন দিকে একটু উবু হয়ে একটা ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। তখন ওরা আমাকে খুঁজছে আর বলছে, আবে, উহু কারে এক আদমী কো দেখা, ও কিধার গিয়া? ওশালা কিধার ভাগ গিয়া?
 
আমার সামনেই আমাকে খুঁজছে । যখন দেখলাম যে, ওরা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে অনেক দূরে চলে গেল, তখন আমি মাখনের হাঁসের ঘর থেকে বেরিয়ে গােয়াল ঘরে ঢুকলাম ওরা আমাকে খুঁজতে ” খুঁজতে সামনের দিকে চলে গেল। সামনের দিকে গিয়ে যাকে সামনে পাচ্ছিল, তাকেই মারধর করছিল। মারধর শেষ করে এই ব্যাচটা চলে গেল, তারপরই নতুন একটা ব্যাচ এলাে।  নতুন গ্রুপটা এসেই ডাইনিং হলে আগুন ধরিয়ে দিল । পুরানাে ডাইনিং হল অর্থাৎ টিনশেডের ক্যানটিনের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুন ধরানাের পর ঐ আর্মিরা বলতে থাকলাে, তুম লােক ইধারসে নিকাল যাও। ইস আদমী, তুম লোেক সব আলগা আগার সাম চলা যাও। কি দিয়ে যে তারা আগুন ধরালাে আমি তা বলতে পারবাে না। সম্ভবত কোনাে কেমিক্যাল পাউডার দিয়ে ধরিয়েছিল সে আগুন। সেই সময় চারজন সৈন্য এসে বুদ্ধ নামের এক লােককে ধরে তার পেটের মধ্যে বেয়নেট ঢুকিয়ে দিল। বুদ্ধ বারবার বলছিল, দেখ হাম লােকতাে এক ভাঙ্গী হ্যায়  সৈন্যরা বললাে, শালে তুম ভাঙ্গী হ্যায়? ছছাড়দে, ছােড়দে, এ শালাতাে ভাঙ্গী হ্যায়। উশালাকো মারতা কিয়া ফায়দা হােতা? চল দোসরা তরফ চল  এই বলে ওরা চলে গেল। আমি তখনও গােয়াল ঘরে লুকিয়ে আছি এবং দেখছি। ওরা সম্ভবত বুঝতে পারলাে যে, ঘরের ভেতর লােক আছে, আগুন ধরিয়ে দিলেই সব বেরিয়ে পড়বে। তখন তাই তারা আগুন ধরিয়ে দিল ঘরে ঘরে। আমি ভাবলাম, এখানে থাকলে জ্বলেপুড়ে মরবাে, তাই সেই মুহূর্তেই নিজের ঘরে এসে ঢুকলাম । আমার মাকে বললাম, মা অবস্থা ভীষণ খারাপ, তুমি এক কাজ কর, দরজা খুলে দাও  তুমি বুড়ো মানুষ, তােমাকে দেখলে কিছু বলবে না । তুমি দরজার কাছে বসে থাকো, তােমাকে দেখলে আর ঘরের ভিতরও আসবে না দরজা খােলার শব্দ শুনে সৈন্যরা এসে আমার মাকে জিজ্ঞেস করলাে, কৈ হ্যায় ঘরকা অন্দর। মা বললাে, নেহি সাহাব। সব নিকাল গিয়া । সব পাহাল গিয়া । সৈন্যরা ওদের ভাষায় যা বললাে তার অর্থ দাঁড়ায় । ‘তােমরা সব চলে যাও, সরকার তােমাদের সাহায্য করবে। তােমরা সব চলে যাও।’ এই বলে তারা মাঠের দিকে চলে এলাে তখন আমরা দেখলাম যে, ঘরের মধ্যে থাকলে আমরা জ্বলেপুড়ে মরবাে। আমাদের বাঁচার আর কোনাে উপায় নেই। তাই এ অবস্থায় আমরা ঘর ছেড়ে বের হয়ে এলাম বাইরে। পাঁচটার দিকে যখন পুবের আকাশ একটু একটু ফরসা হয়ে এলাে, তখনই সৈন্যরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেললাে আমাদের এবং আমরা যারা বয়সে একটু তরুণ ছিলাম তাদেরকে ধরলাে।
 
মাঠের দিকে খগেন এবং শ্যামলালের গােয়াল ঘরটা সেখানে আমাদের দাঁড় করালাে আমরা সংখ্যায় কতজন ছিলাম তা অবশ্য এখন মনে নেই, তবে কিছু ছাত্র আমাদের সাথে ছিল। তাদেরকে ধরে আনা হয়েছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুখচেনা থাকলেও এখন আর তাদের নাম মনে নেই। তারা ছেড়া জামা-লুঙ্গি পরে আমাদের মধ্যে বসে থাকলাে। পাকসেনাদের মধ্যে একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী, সম্ভবত মেজর হবেন, আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন  হালকা মেশিনগান আমাদের সামনে তাক করা । আমরা তখন বুঝলাম যে সেখানেই আমাদেরকে ব্রাশ ফায়ার করে শেষ করে দেবে। তখন লক্ষ্য করে দেখলাম, ওরা যেন কি বলছে  ওদের মুখ থেকে যা খুশি তাই। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ওদের কাছে প্রার্থনা করছে কাতর স্বরে, আর সৈন্যরাও সাথে সাথে গালিগালাজ করছে। পাকসৈন্যরা বললাে, “তুমলােক সব ইসকো আন্দ র আও।’ গােয়াল ঘরটা বেশ বড় ছিল, সবাইকে গােয়ালঘরে ঢুকালাে আমি তখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে মেশিন গান ঠিক করা হচ্ছে একটু পরেই আমাদের শেষ করে দেবে। ছাত্ররাও আমাদের সাথে চুপচাপ বসে আছে। সৈন্যরা আবার আমাদের সবাইকে বের হয়ে আসতে বললাে, “তােমলােক সব বাহার নিকাল যাও, শালা কৈ ধীরসে ভাগনা নেহি। ইধারছে।’ তখন আমি গােয়াল ঘরের ভিতর থেকে দেখি সামনে মােড়ে একটা ট্যাংক রয়েছে- শিববাড়ির রাস্তার মােড়ে, টি, এস, সি’র মােড়েও ট্যাংক, একটা ট্যাংক জনগন্নাথ হলের দিকে মুখ করে আছে। একজন হানাদার সৈন্য এসে বললাে যে, ‘ক্যাপটেন সাহাব বােলাতা হ্যায়’  কি একটা অর্ডার আনার জন্য যেন ডাকছে কালাে-কালাে লম্বা মিলিটারী আসলাে চার-পাঁচজন। আমাদের সবাইকে বললাে লাইন ধরতে। আমরা সবাই লাইন ধরলে পর আমাদের বললাে হাঁটতে  আমরা হাঁটতে শুরু করলাম ।
 

পাকসেনারা আমাদের গায়ে স্টেন ঠেকিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললাে ঐ মাঠের দিকে যে দিকটায় সুধীরদার কেন্টিন এবং ন্যাশনাল ব্যাংক ছিল সেখানে দেখলাম একটা মৃতদেহ পড়ে আছে আমাদের গােয়াল ঘর থেকে নিয়ে এলাে মাঠের দিকে। পােস্ট অফিস এবং শ্রমিক ইউনিয়নের অফিসের দিকে নিয়ে এসে বসতে বললাে আমাদের। আমরা সবাই বসলাম এবং তারা মেশিনগান ঠিকঠাক করতে লাগলাে। আমি ভাবছিলাম, সম্ভবত এখানেই আমাদের ব্রাশফায়ার করবে। আমাদের ভেতর থেকে একজন বললাে, “দেখেন আমরাতাে নিরীহ কর্মচারী। আমাদেরকে মেরে আপনাদের কি লাভ হবে? তখন পাকসেনাদের মধ্য থেকে একজন বললাে যে, ‘বােল শালা, জয় বাংলা বােল  শালে, তােমলােককো জয় বাংলা বােল তুমহারা মুজিবর বাপকো বােলাও, উ বাঁচায়েগা । তুম লােককো সব শালেকো খতম করদিয়া। ক্যাপটেনের ওখানে কি যেন ওয়্যারলেস এলাে, তখনই বললাে- চল। আমাদের মাঝে ছাত্ররা সকলেই তখন চুপচাপ  আমাদের কর্মচারীদের মধ্যেই একজন শুধু কথা বলছিল। পাকবাহিনীর ওরা বললাে যে, ‘চল্‌ হামরা ক্যাপটেন সাব বােলাতা হ্যায়  যাে অর্ডার দেগা, উই হােগা।’ ওয়্যারলেসে আলাপআলােচনা হয়ে গেছে মৃত লাশগুলাে বিভিন্ন জায়গায় যে রয়েছে ওগুলাে আমাদের দিয়ে তুলবে। ড, মতিন চৌধুরীর বাসার দিকে যে দেয়াল ভাঙ্গা আছে আমাদেরকে ওখানে নিয়ে গেল। রাস্তার অপর পাড়ে কতকগুলাে পাথরের টুকরাও স্তুপ ছিল । পাথরের টুকরােগুলাের স্তুপের উপর ক্যাপটেন বসে আছে। চেয়ারে । তখন তিনি আমাদের দেখে হাসলেন এবং জোরে বললেন, ‘শালে বাঙ্গালী, শালে মাদার চোদ, শালে জয় বাংলা বােল । তুমকো মুজিবর বাপকো। বােলাও, উই তােমকো বাঁচায়েগা আমাদের মধ্যে একজন বললাে, আমরা সব কর্মচারী স্যার, ইউনিভার্সিটিকো কর্মচারী হ্যায়। ছাত্রতাে কোই নেহি হ্যায়। হামারা সব ইউনিভার্সিটিতে কর্মচারী আছে।’ ক্যাপটেন তখন খুব হাসলাে এবং

বললাে, কর্মচারী, বাইনচোদ শালা, সব শালা ঝুটা বলতা হ্যায়, শালা কর্মচারী হ্যায়। ইনকো শালাকো সব চেক করাে। আমাদের সবাইকে হাঁটু পর্যন্ত চেক করলাে এবং একজন সিপাহী বললাে, ‘তুম লােগ উচ কাম করনা পারে গা আমাদের মধ্যে একজন বললাে, কেয়া কাম? পাকসেনা বললাে, কাম করেগা, তােম লােগকো ছােড় দেগা।’ ছাড়ার কথা শুনে আমাদের মনের মধ্যে কেমন করলাে তখন আমরা ঠিক করলাম যে, কাজ করলে যখন ছেড়ে দেবে, যে। কাজই হােক না কেন আমরা করতে প্রস্তুত। আমাদের সকলকে দুইজনের এক একটা গ্রুপ করে ভাগ করলাে। তখন সকাল হয়ে গেছে। আমাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় যে লাশগুলাে পড়ে ছিল সেগুলাে এক জায়গায় তুলে আনার জন্য। আদেশ করলাে। দু’জন করে এক একটা যে গ্রুপ ছিল তাদের মধ্যে আমার। গ্রুপে ছিল শ্যামলাল  শ্যামলাল ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে কাজ করতাে। অন্য গ্রুপের মধ্যে ছিল মিস্ত্রী  ইলেকট্রিক কাজ করতাে এবং তার সাথে ছিল দাসু।দাসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে কাজ করতাে। শিবু গয়া নাথের ছেলে এবং আমার ভাই মুন্নিলাল, যিনি পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিংএ কাজ করতেন। আমার বড়ভাই বুধিরাম একজন ড্রাইভার ছিলেন এবং সাথে জহর ছিল, বেলিয়ার বাবা  জহর বােটানী বিভাগে কাজ করতাে। আমাদের মধ্যে যে ছাত্ররা ছিল, যাদের পাকসেনারা জানতাে কর্মচারী হিসেবে তাদেরও আমাদের কর্মচারীদের সাথে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক গ্রুপের জন্য দুইজন করে পাকসেনা ছিল। আমাদের কাজগুলাে মৃতদেহ টেনে আনা  আমাদের গ্রুপের ঐ দুইজন যারা আমাদের তত্ত্বাবধানে ছিল তারা আমাদের পিঠে স্টেনগান ঠেকিয়ে নিয়ে যেত এবং নিয়ে আসতাে সবাই দেখছিল এই নাটকীয় দৃশ্যাবলী এবং লক্ষ্য করছিল এই অচিন্তনীয় ঘটনা। মৃতদেহগুলাের মধ্যে যারযার মৃতদেহ এনেছি তারা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত অধ্যাপক এবং অন্যান্য । শিববাড়ির রাস্তার ধারে সিএন্ডবি-এর একটা গােডাউন ছিল। সেখানে প্রথম নিয়ে যায় আমাদের। এবং সেখানে ১০/১২ জনের মৃতদেহ দেখলাম। তাদের সবাই আমার অচেনা, হয়তাে তাদেরকে ধরে এনে ব্রাশফায়ার করা হয়েছে গোডাউনের মধ্যে পা দেয়ার সাথে সাথে দেখলাম রক্তে একদম সমস্ত গােডাউন ঘরটা ভিজে গেছে। আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হলাে একটি একটি করে নিতে  তখন আমি এবং শ্যামলাল দু জনে একটা লাশ নিয়ে হলের বর্তমান শহীদ মিনার চত্বরে এনে রাখলাম হলের বাইরের সমস্ত লাশগুলােকেও আমাদের গ্রুপের সকলে এনে এনে ঐ জায়গায় রাখছে । সব মাথা একদিকে করে লাশগুলাে সাজিয়ে রাখা হলাে। এর আগের একটা ঘটনা, সকাল বেলায়ই। উত্তরবাড়ির ছাদের উপরে পানির ট্যাংকে সম্ভবতঃ ৫/৬ জন ছাত্র ছিল।
 
তাদেরকে পানির ট্যাংক থেকে উঠিয়ে এনে ছাদের কার্নিশে দাঁড় করিয়ে গুলি করে নীচে ফেলে দিল। আমি তখন হল-শহীদ মিনারে ছিলাম। সিএন্ডবি গােডাউন থেকে ১০টা লাশ নিয়ে এলাম  আমি মিশরী এবং শিবু ড. জি সি দেবের লাশ বয়ে নিয়ে এলাম । শিবু এবং মিশরী কেউই এখন বেঁচে নেই । এরপর শ্যামলাল এবং আমাকে বললাে, ‘চল্ উধার যানা হায়।’ আমরা বললাম, কাহা যায়েগা?’ তখন পাকসেনারা বললাে, ‘হাম লােক ইচ্ছা, খুশি।’ আমরা গেলাম শিরবাড়ি’ প্রথম দালানটাতে মধুদা’র গর্ভবতী স্ত্রী মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। তার ছােটমেয়ের বুকে বুলেট বা বেয়নেটের আঘাতে রক্ত ঝরছে, আর বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদছে। মধুদার (কেন্টিন পরিচালক) দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন, রক্ত ঝরছে। তখন আমাদের তত্ত্বাবধায়ক পাকসেনারা বলল, শালে দেরী কিউ করতা? উঠযাও। দেরী নেই আমরা চোখের সামনে যা দেখলাম তাতে আমাদের হতভম্ব অবস্থা আমাদেরকেও চেনা যায় না, সমস্ত গায়ে রক্ত লেগে ছিল তখন আমি বললাম, ‘মধুদা চলেন।’ মধুদা আমাকে। বললেন, কোথায় নেবে? আমি বলতে পারলাম না। তখন মধুদা’র ছােট মেয়ে। বলছে, ‘আমার বাবাকে এখান থেকে নেবে না।’ তখন পাকসেনারা বলে উঠল, ‘এই লেড়কী চুপ কর, নয়তাে গুলি কর দেগা।’ আমি এবং শ্যামলাল মধুদাকে। ধরে তার দুইহাতের ডানা দুটিকে আমাদের কাঁধে ফেলে মধুদাকে হটিয়ে নিয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে যখন হাঁটিয়ে আনছি তখন দেখলাম মধুদার বুকে রক্ত, তার বুকে গুলি লেগেছিল। তিনি কোনাে কথাই আর জিজ্ঞেস করেননি বা কথা বলেননি। পাকসেনারা সকলেই রাস্তার উপরে, কেউ চা গরম করছে, কেউ বােতল থেকে মদ ঢেলে খাচ্ছে। তাদের মুখে এই একটি কথা আমাদের গালাগালি করা। তারা বলছে, ‘শালা জয় বাংলা বােল । তােমহারা মুজিবুর বাপকো বােলাও, উতুম লােককো বাঁচায়ে গা।’ এই ভাবে অশ্রাব্যভাষায় গালাগাল দিচ্ছে ।
 
ওদের গায়ে কোনাে রক্তের দাগ ছিল না। মধুদাকে বর্তমান হল-শহীদ মিনারের যেখানে সমস্ত লাশগুলােকে এনে রাখা হয়েছিল সেখানে এনে বললাম, মধুদা এখানে আপনি শুয়ে পড়ন।’ তখন মধুদা আমাকে বলেন, ‘ওরা কারা, এগুলি কি সবই মৃত?’ তখন আমি মধুদাকে বললাম, এগুলাে কারা আপনি জানেন না? এরা সবাই মৃত আর কিছুক্ষণ পরে আমাদেরও ঐ একই। অবস্থা হবে। আপনি এক কাজ করেন, শুয়ে পড়ুন। রক্ত ঝরতে ঝরতে তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলেন। দেখলাম শিববাড়ির শিবমন্দির থেকে চারজন সাধুকে ধরে আনলাে  আমি তাদের মধ্যে একজনকে চিনতাম। তার নাম ছিল ব্ৰজানন্দ সাধু । ব্ৰজানন্দ সাধুর প্রিয় ভক্ত ছিল মুকুন্দসাধু। তার সাথে আমার খুব ভালাে আলাপ ছিল  কিন্তু এ অবস্থায় তার সাথে আলাপ করার কোনাে সুযােগ পেলাম  তখন কাকে কি বলবাে সে ভাষা খুঁজে পেলাম না আমরা সবাই তখন মৃত্যু পথযাত্রী । আমরা এখন থেকে কেউই বাঁচবাে না তা জানি । আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে তাও জানি আমি তখন স্থির নিশ্চিত যে আমি মরবাে তাই ভাবছিলামও না আমরা কি করে বাঁচবাে। এতাে লাশ দেখে কোনাে কিছু আর চিন্তা করার সুযােগ পাচ্ছিলাম না। আমরা কেউই আর কোনাে ভাবে পালাবার চেষ্টা করিনি। আমি ভাবলাম যে, আমার মা রয়েছে, বােন রয়েছে, আমি একা প্রাণ নিয়ে যাবাে কোথায়? মেরে যদি ফেলেই আমাদের সবাইকে মেরে ফেলুক। এক সঙ্গে মরে যাবাে। তখন শিববাড়ির সাধু চারজনকে এনে দাঁড় করিয়েছে এবং পাকসেনারা বললাে, “তােমরা ঠায়রাে ইয়া পর।’ এভাবে চারদিক থেকে মৃত দেহগুলাে আনা হলাে। কোথাও আর মৃতদেহ নেই, আশপাশে যা ছিল সব আনা হয়েছে বর্তমান শহীদ মিনারের চত্বরে ড. জি, সি, দেবের সমস্ত গায়ে গুলি করে ঝাঝরা করে দেওয়া হয়েছে । ড. দেবের পরনে তখন ছিল ধুতি আর গেঞ্জি। তার নাকে মুখে কোনাে গুলি না লাগায় আমি তাকে চিনতে পেরেছিলাম। তার প্রাণের স্পন্দন পুরােপুরি থেমে গেছে, তিনি। তখন সম্পূর্ণ মৃত । মােটা মানুষ ছিলেন ড. দেব  তাই এই অবস্থায় তাকে অদ্ভুত ভীষণ অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। বুলেটের প্রতিক্রিয়ায় তার শরীর ফুলে গেছে। যখন সকাল সাড়ে আটটা কি নয়টা বাজে তখন আমার জানামতে সম্ভবত বিশজনের লাশ টেনেছিলাম শ্যামলাল এবং আরাে দুজনে। শ্যামলাল আর আমার মধ্যে আর কোনাে কথা হয়নি। আমি শ্যামলালের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি কিন্তু সে কোনাে শব্দ করেনি। আমি তাকে বললাম, আমাদের কোনাে উপায় নেই, এখন মরে যেতে হবে।
 
কাজেই তােমার যদি কোনাে কথা থাকে তাে বলল, আমরা কিছু আলাপ করে নেই। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনাে সাড়া পেলাম না। তখন। আমি বুঝলাম ভয়ে সে সন্ত্রস্ত, হতবাক ভয়ে তার কণ্ঠনালী শুকিয়ে কোনাে স্বরই বেরুচ্ছে না। যখন সবার লাশ আনা হলাে তখন দেখলাম মেয়ে লােকের কোনাে লাশ নেই। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে শুয়ে আছে সবাই  হিন্দু-মুসলমান বুঝলাম এইভাবে যে, আমি একজন মৌলানা সাহেবকে তার মধ্যে দেখতে পেলাম যার মাথায় টুপি ছিল, মুখে দাড়ি ছিল, তিনি তখনও জীবিত, কলেমা পড়ছেন। আমাদেরকে দিয়ে যারা লাশ টানিয়েছিল তারা এ সময়ে চলে গেল এবং অন্য ছয়জন পাকসেনা এলাে। তখন আমি ভাবলাম যে ওরা চলে যাচ্ছে কেন? তখন দেখলাম যে ওরা গালাগালি করছে, কিন্তু কথাগুলাে ঠিক মতাে বের। হচ্ছে না। আমি বুঝলাম যে, ওরা খুব মদ খেয়েছে এবং এ অবস্থায় ওদের ভাষায় আমাদের বললাে যে, ‘তুমলােক সব লাইন হাে যাও । লাইন হও শালে সব, শালে বাইনচোদ, সব শালে লাইন হাে যাও। দেরীমাত করে লাইন হাে।’ তখন লাইন করার কথা শুনে আমাদের মধ্যে কি একরকম অবস্থা হয়েছিল তা আমি ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবাে না। কেউ হাত জোড় করছে, কেউ বলছেআমার ছেলে-মেয়ে আছে, আমার মা আছে, বােন আছে, আমাদেরকে একবার দেখা করতে দিন আপনারা এইরকম করুণ আর্জি শুনতে পাচ্ছি আমি, কিন্তু যারা এ রকম বলছে তাদেরকে লাথী মেরে ফেলে দিচ্ছে। সামনে যারা আছে তাদেরকে গুলি করে ফেলে দিচ্ছে। এ সমস্ত দেখে আমি ভাবলাম যে, এদের কাছে আবেদন-নিবেদন, কোনাে কথাই কাজে আসবে না। তাই পশুদের কাছে আমি কোনাে কথাই বলবাে না। আমি তখন লাইনেই দাঁড়িয়ে আছি। আমি লাইনে কয়েকজনের পাশে ছিলাম । ৩/৪ জনের পিছনেই ছিলাম আমি, আমার পাশেই ছিলেন আমার বড় দাদা। এর পরে ছিলেন একজন বাইরের লােক, তাকে আমি চিনতে পারিনি। এর পরে ছিলেন ঐ মৌলানা সাহেব তিনি যখন দাড়িয়ে ছিলেন, তখন তিনি ভালাে মানুষ  তখন অপরদিক থেকে গুলি করছে । গুলি করা দেখে মৌলানা সাহেব কলেমা পড়তে লাগলেন এবং কোরান-হাদিসের বিভিন্ন আয়াত পড়তে লাগলেন। মৌলানা সাহেব হয়তাে কিছুদূর এগিয়ে যখন ওদের কাছে গিয়েছিলেন তখনই তাকে গুলি করে পরপর তিনটা গুলি করলাে তাকে। এরপর আমারদিকে পজিশান নিল দেখলাম। যখন একটা গুলি এসে আমার ডান উরুতে লাগলাে তখন আমি মৃতদেহের পাশে পড়ে গেলাম।
 
আমার বড়দাকে দেখলাম গুলি খেয়ে পড়ে গেলেন। কেউ কেউ একে অপরের কাছে গুলি খেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। আমি তখনও সম্পূর্ণভাবে লক্ষ্য করতে পারছি, গুলি খেলেও আমার জ্ঞান ছিল সজাগ গুলি খেয়ে একে অপরের কাছে যাচ্ছে আর হাতজোড় করছে কেউ কেউ কেউ বলছে, মেরাে না আমাদের এভাবে  আমার বড়দা যখন গুলি খেলেন তখন উনি উঠে যেতে চাইলে আমি তাকে ডান হাত দিয়ে চেপে রাখি  রক্ত ঝরার শব্দ যা কোনাে দিন সােনা সম্ভব নয় তাও আমি শুনেছি। ফিনকি রক্ত এক সাথে বের হবার শব্দ হচ্ছিল। শব্দটা পানির ট্যাপ খুললে যদি খুব জোরে পানির চাপ আসে তাহলে যে শব্দ হয় তাই হচ্ছিল। কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, যা কারুর পক্ষে কোনােদিনই শােনা সম্ভব হয়নি তখন দেখলাম যে পাকসেনারা হালকামেশিনগান ঘুরিয়ে যারা ওদিক-এদিক করছে বা নড়ছে তাদের উপর পুনরায় গুলি করছে আমার ভীষণ চিন্তা হয়ে গেল, আমার উপর আবার গুলি করে কিনা। যখন দেখলাম যে, আবার আমার ওপর গুলি করার পদক্ষেপ নিচ্ছে তখনও বড়দাকে আমি চেপে রেখেছি তিনি উঠতে চাইছেন, আমি তাকে বললাম, তুমি একটু ক্ষান্ত হও, উঠতে যেয়াে না।’ এই বলে আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরলাম কিন্তু রাখতে পারিনি। যতক্ষণ তাকে আমি চেপে ধরে রেখেছি তাতে আমি দেখেছি যে, আমার হাত আর তার শরীর থেকে উঠছে না। মনে হলাে যেন চুম্বকের মতাে আমার হাতটা আটকে গেছে। এঅবস্থায় দাদা বলছেন, ‘আমার মেয়ে আছে। আমার স্ত্রী আছে, আমি কিভাবে তাদের কাছে যাবাে। আমার স্ত্রী আর মেয়েটাকে একটু দেখতে চাই।’ তখন আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম যে, একটু পরেই তুমি দেখতে পাবে এরপর দেখলাম পাকসেনারা গাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছে যখন পাকসেনারা চলে গেল তখন বড়দা আমাকে বললেন, ‘আমাকে ছাড়াে তুমি, আমি যাবাে আমি দেখলাম যে, পাকসেনারা গাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছে। তখন বড়দা উঠে দৌড় দিলেন। কিন্তু কিছুদূর যাবার পর তিনি মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। তখন এই হল এলাকায় কোনাে সৈন্যই ছিল । অর্থাৎ শিববাড়ির এলাকা দিয়ে যারা প্রবেশ করেছিল তারা সকলেই চলে গেল তখন আমি দেখলাম যে, ছেলে মেয়ে-স্ত্রী সবাই জল নিয়ে দৌড়ে আসছে ঘটির মধ্যে জল নিয়ে আসছে কারণ যারা গুলি খেয়ে পড়েছিল তারা জল দাও জল দাও’ বলে চিৎকার করছিল। জল নিয়ে যারা দৌড়ে আসছিল তাদের মধ্যে বিন্দুর মা ছিলেন। দাসুরামের স্ত্রী ছিলেন দাসুরাম ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে মালীর কাজ করতাে, এখন তার স্ত্রী ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে মালীর কাজ করেন তখন আর কেউ আসছিলেন কিনা বলতে পারবাে না, কারণ তখন আমার চোখ নিস্তেজ হয়ে আসছিল, শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছিল, চোখে লাল রক্তের মত রং দেখছিলাম তখনই উপস্থিত হলাে আমার মা, বােন এবং বৌদি তারা আমাকে একটু জল খাওয়ালাে। আমি তাদেরকে বললাম, আমাকে জল দিও না । আমাকে তুলে নিয়ে চলাে এখান থেকে  তখন তারা আমাকে নিয়ে এলাে কিন্তু বড়দা তখন জীবিত থাকলেও তার খবর কেউ করতে পারেনি বিধায়, তাকে তুলে আনা সম্ভব হয়নি।
 
অনেক লাশের মধ্যে তাকে আর খুঁজে আনা সম্ভব হয়নি বিন্দুর মা আর কয়েকজন ছেলে মিলে তার স্বামীকে তুলে নিয়ে আসছে। তখনও ওনার স্বামী জীবিত ছিল। হয়তাে বাঁচবে কিছুক্ষণ পরই মারা যাবেন এই অবস্থা আমাদের জগন্নাথ হলের বল খেলার মাঠে বর্তমান যে গ্যালারি আছে সেখানে নিয়ে এলাে তখন দেখলাম হলের ইলেকট্রিশিয়ান চিত্তল্লী একদম পাগলের মতাে ছুটাছুটি করছে। ওদিকে কান্নাকাটির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, আমি শুনতে পাচ্ছি। আমাকে সবাই ধরে ঘরে নিয়ে এলাে। আমার শরীরে রক্ত দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল, দেখলাে যে রক্তে ঘর ভিজে যাচ্ছে। আমি দেখলাম যে একটা পানির গামলা নিয়ে ঘরের মধ্যে যে রক্ত পড়ছে তা মাটি থেকে গামলায় তুলছে আমার মা আমি ভাবলাম যে আমি যখন জীবিত আছি তখন এ ভাবে এই অবস্থায় আর অপেক্ষা করলে আমাকে মরতে হবে। তাই প্রথমেই ভাবলাম রক্ত যে ঝরছে তা কিভাবে বন্ধ করা যায়।  আমার শরীরে দুর্বলতা এসে যাচ্ছিলাে এবং শরীর শিথীল হয়ে আসছিল তখন মাকে বললাম, ‘মা তােমরা কেঁদো না সবাই এখান থেকে চলে যাও। তােমরা এখানে থাকলে মারা পড়বে।’ মা বললেন, “তােমাকে ছেড়ে আমি যাবাে না, সবাইতাে মরে গেছে কে আমাদের দেখবে, কে আমাদের খাওয়াবে?’ আমি। বললাম, “বােন এবং বৌদিকে নিয়ে তােমরা এক্ষুণি চলে যাও আর আমার জন্য এক জগ পানি এখানে রেখে দাও, যদি আমি জীবিত থাকি তাহলে তােমরা আমায় দেখতে পাবে। আর যদি মরে যাই এই ঘরে আমর কংকাল পাবে এবং এখানেই আমার স্মৃতিটা করে দিও তােমরা চলে যাও।’ সকলেই তখন গাঁট বেঁধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে । মা যেতে চান না, তাকে অনেক বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলাম । আমি তখন একদম একা, আর কারাে কোনাে শব্দ পাচ্ছি না। ভাবলাম যে সত্যিই সকলে চলে গেছে। পানির জগটা তুলে পানি খাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সে শক্তিটুকুও নেই যে পানির জগটা তুলে পানি খাবাে  সমস্ত শরীর আমার ছেড়ে দিয়েছে, আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে আমার যখন এ অবস্থা তখন আমার মা, কয়েকজন লােক নিয়ে ঘরে উপস্থিত। মা সবাইকে বললেন, ‘আমার ছেলেকে তােমরা বাঁচাও, তােমাদের যতাে টাকাপয়সা লাগে আমি দেবাে, তবুও ওকে একটু মেডিক্যাল নিয়ে যাও।’ তখন তারা তাড়াতাড়ি করে আমাকে ধরে বাঁশের বেড়ার উপর তুললাে  হয়তাে কারাে ঘরের দরােজা ছিল, এই বেড়াটাকে নিয়ে আমাকে তার উপরে তুললাে এবং আমার উপর কাপড় ঢাকা দিয়ে তারা ছুটলাে। বকশীবাজার যাবার পথে মেডিক্যালের পিছনের গেট দিয়ে মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে এলাে। আর তখনই কর্তৃপক্ষ আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল মেডিক্যালের ডাক্তাররা আমাকে ঘিরে থাকলেন এবং আমাকে বহুকথা জিজ্ঞেসা করতে থাকলেন তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ছাত্র না অন্য কিছু?
 
আমি বললাম, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বােটানী বিভাগের একজন কর্মচারী। আমি হলেই থাকি। ডাক্তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওখানে সবাইকে কি মেরেছে।’ আমি তাদেরকে তকালীন কিছু অবস্থা বর্ণনা বললাম। তখন প্রফেসর সাহেব সবাইকে বললেন, ‘একে জলদি করে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাও  ওকে আর বেশী কথা জিজ্ঞেস করার সময় নেই। আমার শরীরের যেখানেই আঙুল দেয় সেখানেই আঙুল দেবে যায় এই অবস্থায় আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেল। এরপর আমার চিকিৎসা হতে লাগলাে। পরে শুনেছি গুলি করে। মেরে যাবার ঘণ্টা খানেক পরে ট্রাকটর, রােলার ইত্যাদি এনেছিল এবং  মৃতদেহগুলাে যতদূর সম্ভব নিয়েছে ট্রাকে তুলে, আর যেগুলাে নিতে পারেনি। সেগুলাে সব ট্রাকটর দিয়ে পুঁতে রেখেছিল। শ্যামলালের কোনাে গুলি লাগেনি, সে ওখান থেকে পাকসেনারা চলে যাবার পরই চলে এসেছে। রেনু বালাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলের কর্মচারী খগেনদের স্ত্রী তার স্বামী-পুত্রকে পাকসেনারা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে, তিনি  প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি সেই ভয়ালরাত্রীর স্মৃতিচারণ করেছেন। এখানে তা লিপিবদ্ধ করা হলাে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে আমি, আমার ছেলে-মেয়েরা, ছেলের বাবা সবাই খাওয়া দাওয়ার করে রাত এগারােটা সাড়ে এগারােটার দিকে শুয়ে পড়ি । আমার শরীটা বেশি ভালাে ছিল না, তাই একটু ঘুম এসে গিয়েছিল, কিন্তু ছেলেদের বাবা তখনও ঘুমায়নি যখন বাইরে প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছিল, তখন সে আমাকে ঘুম থেকে তুলে বললাে তুমিতাে ঘুমিয়েছে, যদি বেশী রকম শব্দ হয়, তবে আমাকে জাগিয়ে আমি এখন একটু ঘুমাই, তুমি জেগে থাকো আমি জেগে থাকি আমার শিবু তখন ছােট শিবু খাওয়ার জন্য জেগে উঠলাে ওকে। দুধের বােতল খাওয়ালাম। কিছুক্ষণ পর ভীষণ শব্দ হচ্ছিল, মনে হয় শব্দগুলাে মুসলিম হলের দিকে বাইরে শুনি লােকজনের শব্দ আমি তখন লাইট জ্বেলে দরােজা খুলে বাইরে আসি। বাইরে লাইট জ্বলছে, সবাই কথাবার্তা বলছে, কোথায় কি যেন ঘটছে বিয়ের বাজি ফুটছে, না কি ফায়ার হচ্ছে কিছুই বুঝা। যায় না। একবার আমি ঘরে যাই, একবার বাইরে আসি। যখন শব্দ আরও প্রচণ্ডবেগে হচ্ছিল তখন ওর বাবাকে আমি জাগাই বললাম, “উঠো, চারিদিকের অবস্থা বেশি ভালাে না। সে উঠে বললাে, এগুলাে বাজি নয়, ফায়ারের শব্দ, আমি উঠে কি করবাে ফায়ার হলেও এগুলাে আমাদের এদিকে নয়, অনেক দূরে, তখন আমি বাইরে এসে দেখি বিন্দুর মা, আরও অনেকে দরােজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে  মুহূর্তের মধ্যে লাইট চলে গেল। যখন লাইট চলে গেল তখন আমি ঘরে এলাম। শুনলাম জগন্নাথ হলের পাশ দিয়ে শব্দ ভেসে আসছে। তখন ওর বাবাকে বললাম, লাইটতাে নেই, তুমি উঠো।’ আমি বিছানা চৌকির ওপর থেকে নীচে নামিয়ে দিলাম । মতি এবং আমার ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা সবাই আবার শুয়ে পড়লাে ।
 
ওর বাবাও শুয়ে পড়লাে  আমি আর শুইনি আবার বের হলাম  শিবু নামে যে ছেলেটি ছিল, সে দৌড়ে এলাে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘শিবু কি ব্যাপার?সে বললাে, “বৌদি তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন, মিলিটারী আমাদের হল এ্যাটাক করেছে। আমাদের বাঁচারতাে কোনাে উপায় নেই, ছাত্রততা নেই। সব বিপদ আমাদের উপর পড়বে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন ফায়ার করলে উপর দিয়ে যাবে, অন্তত একহাত উপর দিয়ে যাবে, শুয়ে পড়ুন এইকথা বলতে বলতে শিবু চলে গেলে আমিও ঘরে ঢুকলাম। এ সময়ে বাইরে আরও প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছিল। আমি আমার স্বামীকে বললাম, ‘মনে হয় বিহারী এসেছে, রায়ট লেগে গেছে, এবার সব শেষ করে ফেলবে।’ আবার স্বামী বলে, কিছুই না।’ জগন্নাথ হলের সামনে প্রচণ্ড একটা আওয়াজ হলাে সেই আওয়াজের সাথে সাথে আমাদের ঘরের সবাই জেগে ওঠে। আমার বড় ছেলে বলে, ‘বাবা, আমি বারবার আপনাকে বলেছিলাম বাড়ি যেতে, আপনি গেলেন না আর আমাকেও যেতে দিলেন না মাকে নিয়ে যেতে চাইলাম, তাও আপনি দিলেন না কাউকে যেতে দিলেন না । আজকে আর কারােরই বাঁচার উপায় নেই, আজ এখানেই মরণ। তখন ছেলের বাবা তাকে ধমকে বলে চুপ থাক  যদি পরমায়ু থাকে তবে তা কেউ কোনাে দিন নিতে পারে নাকতাে যুদ্ধ গেল কতাে রায়ট গেল, আমার তাে কিছুই হলাে না। আমি সেই একই রকম আছি  এ কথা বলতে না বলতেই পাকসেনারা এসে দরােজায় ধাক্কা দিল  ভাগ্য ভালাে, আমাদের ঘরে প্রথমে ধাক্কা দেয়নি। যে ঘরে ধাক্কা দিল, সে ঘরে লােক পেলাে। সেটা ছিল মাখনের ঘর। সারারাত আর আমাদের ঘরে ধাক্কা দেয়নি। আমাদের ঘরের পিছনে একটা টিনশেও ছিল, তাতে আগুন দিল  আগুন দেবার সঙ্গে সঙ্গে তা তীব্রভাবে জ্বলে উঠলাে। আমি তখন শিবুকে কোলে করে বাসনার হাত ধরে বের হলাম বাইরে, দেখি আমাদের দরােজার সামনে দুইজন পাকসৈন্য দাঁড়ানাে। আমি তাদের দেখে খুব ভয় পেলাম  তারা জিজ্ঞেস করলাে, ‘ঘরে কোই ছাত্র লােক হ্যায়?’ আমি বললাম, “ছাত্রলােক কোই নেহি হ্যায় । তখন তারা বললাে, “তােমলােককো হামলােক কুছ নেহি করেগা। তুম কোন লােক হ্যায়?’ আমি বললাম, ‘হামলােক ম্যাথরমে হ্যায়।’ এই কথা ওর বাবা চৌকির নীচে বসে শুনলাে ।
 
মিলিটারী যখন বলছে আমাদের কিছু হবে না, মারবে না, তখন সে বের হয়ে এলাে। পাক আর্মি আমাদের পাশে পাশে ঘুরতে লাগলাে কিন্তু কিছুই বললাে না। তবে ঘরের জিনিস পত্র অর্ধেক পর্যন্ত বের করলাে এবং মাঠে নিয়ে গিয়ে জমা করলাে আর অর্ধেকে আগুন ধরিয়ে দিল  মােহনের ঘরের সামনে আমাদের গােয়ালঘর। সেখানে বসে আমি শিবুকে দুধ দিতে শুরু করেছি, তখন মতি গিয়ে আমার পাশে বসলাে, আর ওর বাবা গরুর রশি বাঁধছে, ঠিক তখনই মিলটারী ওর বাবার হাত চেপে ধরলাে আমার পাশে  বসা ছিল মতি, তাকেও ধরলাে দুইজনকে ধরে ঐ গােয়ালঘরের মধ্যে বসালাে। আমাদের পাড়ার কিছু ছাত্র আর যত পুরুষ লােক ছিল তাদের সবাইকে নিয়ে ঐ গােয়ালঘরে ঢােকালাে তাদের বসানাের পর আমরা মেয়ে লােক বসে আছি দরােজার সামনে গােয়ালঘর ভর্তি পুরুষ সামনে বন্দুক উঁচিয়ে ধরে মিলিটারীরা বললাে, সুয়ারকে বাচ্চে, জয় বাংলা বল, উল্টা নেহিকহে  বল জয় বাংলা। তােমকো বাপ শেখ মুজিব কাহা হ্যায়, বল।’ ওরা যখন এরকম করছে, আমরা তখন ভাবছি এখনই গুলি করবে আমরা সবাই হাউমাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম  গরুর ঘর থেকে সবাইকে বের করে তখন লাইন করে নিয়ে গেল সুধীরের ক্যানটিনের দিকে কিছুক্ষণ পর দেখি তিন চার জনে ধরে ধরে এক একটা লাশ এনে রাখছে জগন্নাথ হলের মাঠের মধ্যে আমরা দেখেতাে অবাক যে এগুলি কি আনে দেখতে দেখতে ভেঙ্গে পড়লাম দেখলাম বাসনার বাবা মানে আমার স্বামী আর ছেলে মতি কতজনের লাশ নিয়ে এলাে ধরে ধরে  এনে রাখলাে মাঠের মধ্যে যাদের দম একেবারে বের হয়নি, তাদের ফায়ার করছে পিছনের দিক থেকে তারা শুয়ে পড়েছে সাথে সাথেই তারপর যারা লাশ টেনে আনলাে তাদের বললাে লাইন ধরে দাঁড়াতে  লাইন করানাের পর তাদের কি বললাে তা আমি জানিনা। যারা লাইনে ছিল তারা আর যারা লাইন থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে তারা জানে তারপর লাইনে দাঁড়ানাে সবাইকে গুলি করলাে আমরা মাঠের কোণায় বসে দেখছি তাদের গুলি করেছে তারা একবার উঠে বসছে আবার শুয়ে পড়ছে বিন্দুর মা বিন্দুর বাবাকে নিয়ে এলাে সে জলজল করছিল। আমি একটু জল খাওয়ালাম সঙ্গে সঙ্গে তার দম বন্ধ হয়ে গেল। আমার স্বামীকে আনবার তাে কেউ নেই । আমার বাচ্চা ছয়মাসের শিশু আমি গেলাম, বাসনা গেল, বাসনার কোলে শিবুকে দিলাম আমি স্বামীকে বললাম, উঠো আমি তােমাকে নিয়ে যাবাে। আমি তখন তার হাতের নিচে দিয়ে হাত দিলাম, মাথা লাশের উপরে, পা লাশের উপরে।
 

আমি দেখলাম তার পায়ে জুতা, হাতের কিছু অংশ নেই। আমাকে সে বললাে, ‘আমাকে জল খাওয়াও।’ আমি বল্লাম, “আগে ঘরে চলাে তােমাকে আমি নিয়ে যাবাে। তিনি তখন বললেন, নিতে তাে পারবে, কিন্তু আমারতাে সব শেষ ঠিক সেই সময়ে হলের গেট দিয়ে একটি জিপ ঢুকলাে আমিতাে দেখে ভয় পেয়ে গেছি  স্বামীর কাছ থেকে চলে এলাম ছেলের কাছে। বললাম, ‘চল, তাের বাবাকে তাে নিতে পারলাম না। ছেলে বলল, ‘মা, নেওয়ার তাে কিছুই নেই । তুমি মনে কোনাে কষ্ট নিয়াে না। আমি তােমার এক ছেলে, মরে গেলেই কি? তােমার তাে লাখ লাখ ছেলে রইলাে, দুঃখ করাে না  বলেছি বাবাকে বারে।

বারে। বাবা তখন শশানেননি। এ যে হবে আমি জানতাম। বাবা তখন বােঝেননি, বুঝতে পারেননি। জল, মাগাে, জল দাও।’ আমি বাসনাকে জল খাওয়াতে বললাম। আমি আবার মাঠের পাশে চলে এলাম। বাসনা ওর বাবাকে মতিকে জল খাইয়ে এলাে। এসব দেখে আমার পেটের ভেতর থেকে মােচড় দিয়ে রক্তবমি শুরু হলাে এমন তীব্রভাবে যে আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না । আমি যে আবার যাবাে সে শক্তি আমার আর নেই। বাসনাকে আবার পাঠালাম। বাসনা আবার গেল, আবার জল খাওয়ালাে। মতি বাসনাকে বললাে, বাসনা, মাকে চিন্তা করতে মানা করিস । আমি শেষ, আমাকে আর নিতে পারবি না। তুই যা, ঐ এসে পড়লাে। অমনি আবার পাক-আর্মির মিনিটে মিনিটে রাউন্ড দেওয়া শুরু হলাে। তখন মতি কিংবা মতির বাবা কাউকেই আমরা আর আনতে পারিনি। কিছুক্ষণ পর হােসেনী দালান থেকে একটা ছেলে এলাে। বটতলার লাইব্রেরিতে থাকতাে ছেলেটা। ঐ ছেলেটা এসে আমাদের সবাইকে নিয়ে গেল। আমি বললাম, ‘আমি যাবাে না। এখানে লাশ পড়ে আছে দুজনের। তাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবাে না। তখন সে বললাে, ‘চলুন, আপনাদের রেখে এসে যদি সময় পাই তবে যতটুকু শক্তিতে কুলায় এদের নিয়ে মেডিক্যালে রেখে আসবাে। একবার আপনারা চলুন, আপনাদের হােসেনী দালানে রেখে আসি। তখন সে আমাদেরকে জোর করে হােসেনী দালানে নিয়ে গেল। হােসেনী দালানে যাবার পথে আমাদের গেটের সামনে দেখি এক ভদ্রলােক পড়ে আছেন সাদা হাফপ্যান্ট পরা। তারপর চলে গেলাম হােসেনী দালানে এবং সেখানেই থাকলাম। ঐ ছেলেটি জল-খাবার যা পারলে তা দিয়ে দিল আমাদের। আমরাতাে সারারাত কান্নাকাটি করলাম।
 
ছেলেটি আবার সকালে এলাে আমাদের দেখতে। সে বললাে, “মিলিটারী আবার ঢুকেছে হলে। আমি তাই আর এগােতে পারিনি লাশের সামনে। তারপর দিন-রাত্রী যে কিভাবে গেল তা এখন আর বলতে পারি না। ২৭ তারিখে আমি শিব বাড়িতে এলাম। কয়েক ঘণ্টার জন্য আমি শিব বাড়িতে ছিলাম । শিববাড়ি থেকে ৫/৬ জনকে যে ধরে নিয়ে । মেরে ফেলেছে তা শিববাড়ির বাবা জানে না। আমার কাছে সব শুনে বলে, ‘মা, তােমার এই অবস্থা তাহলে, আমাদের শিববাড়ির যে পাঁচ-ছয় জন ধরে নিয়ে গেছে তাদের কি অবস্থা?’ আমি বললাম, আমিতাে দেখেছি আমার সামনে তাদের গুলি করে মেরে ফেলেছে।’ বাবা তখন জিজ্ঞেস করলেন, তারা কি মিস্ত্রী না সাধু?’ আমি বললাম, “মিস্ত্রী ছিল একজন নাম মুকুন্দ। আর একজন লােক, সে ছিল শিববাড়ির ব্রাহ্মণ পুরােহিত। বাড়ি মানিকগঞ্জে। আরও ছিল তিনজন কি চারজন, মােট পাঁচজন। বাবা এসব কথা শুনেতাে অবাক। শিববাড়িতে একদিন ছিলাম। তারপর ঢাকা ত্যাগ করলাম রাজকুমারী দেবী (বিন্দুর মা) তার স্বামী মনভরনকে গুলি করতে দেখেছে। তিনি তাকে বাসায় এনেছিলেন কিন্তু বাঁচতে পারেননি। ২৫ মার্চ রাতের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। এবার তার কথা শােনা যাক।
 
২৫শে মার্চ ১৯৭১। এমনিতেই শুনেছিলাম চারিদিকে, গােলমাল হবে। আবার শুনলাম যে, সকাল বেলা জল থাকবে না । তিনদিন এমন অবস্থা চলবে। কেন জল থাকবে না তার কিছুই জানি না । দুই তিনদিন জল থাকবে না তাই সন্ধ্যার দিকে জল তুলে রেখে ঘরের কাজ সেরে শুয়ে পড়েছি । রাত তখন ১১টা হবে। দুই-তিনজন ছাত্র এসে ডাকাডাকি করতে লাগলাে, বস্তিওয়ালা কেউ জেগে আছে?’ কেউ তখন কোনাে শব্দ করলাে না। তখন কে যেন বললাে, মরা ঘুম ঘুমাও বাপু, বুঝবা।’ ছাত্রদের মধ্য থেকেই কেউ বললাে কথাটা। আরও বললাে, “ঘুমাও বাপু বুঝবা কুড়ালটা চাইতে এসেছিলাম, দিলে না। রাস্তা ব্লক। করতে হবে, তা আর হলাে না। এই কথা বলেই তারা চলে গেল। ঐ কথা শুনে। আমার স্বামীকে ডেকে বল্লাম, এই শুনছাে, ঘুমিয়াে না বাইরে কি বলে গেলে শুনেছাে তাে? তখন আমার স্বামী আমাকে বললাে, “চুপ করাে। মরলে শুধু আমরা একা মরবাে না। সবাই মরলে আমরাও মরবাে  এরপর প্রায় ১৫/২০ মিনিট পর শ্রীচাদ রাজভর-এর বড় ভাই আমার স্বামীকে নাম ধরে ডেকে বললাে। তুই কি করিসরে, দেখতাে নিউমার্কেটের দিকে আগুন দেখা যায়। এ ভাবে আরও মিনিট দশেক পরে আমাদের জগন্নাথ হলের মাঠে কিসের যেন একটা জোরে আওয়াজ শুনলাম । মাঠের গ্যালারীর সামনে যেন বজ্রাঘাত হলাে। কে কোথায় যাবাে কি করবাে ভেবে পেলাম না। সবারই তাড়াতাড়ি লাইট নিভানাে, দরােজা বন্ধ করা, এমন একটা হুড়াহুড়ি পড়ে গেল। তখন বুঝলাম যে একটা কিছু ঘটছে। তখনই শুরু হলাে ঝক ঝক গুলির শব্দ। আমার স্বামী আমাকে বললাে, দাড়িয়ে থেকো না, তাড়াতাড়ি মাটিতে শুয়ে পড়।’ বাচ্চা তিনটাকে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে মাটিতে শােয়ালাম। বাচ্চারা বলছে, মাগাে ভীষণ শব্দ হচ্ছে। আমি বললাম, বাবা শুয়ে থাকো উঠো না, উঠলে বাঁচবে না, আমরা সবাই মরবাে।’ বাচ্চাদের সাথে কথা বলার সময়ে আমার স্বামী বললাে, ‘তুমি। চুপ করাে  মিলিটারী ঢুকছে পিছন দিকে থেকে, দরােজা ভাঙছে, টেরপাও?” আমি বললাম, আমার টের পাওয়ার দরকার নেই। মরণতাে একদিন হবেই। তাতে আর কি। চারদিকে তখন ধােয়া আর গুলির শব্দ বারুদের গন্ধ।
আমরা সবাই শংকিত  কারাে কোনাে হুঁশ নেই। শরীর কাঁপছিল আমাদের সবার  গুলির শব্দ ভীষণ আধঘণ্টা পর্যন্ত যেন কামান দাগছে  বুঝতে পারলাম যে  ছাত্রবাবুরা জানালা খুলে লাফিয়ে মাটিতে পড়ছে এবং বস্তির দিকে দৌড়ে আসছে উত্তরবাড়ির দিক থেকে সুধীর বাবুর বর্তমান ক্যানটিনের ওখানে কয়েকজন ছাত্র বাবু কম্বল গায়ে, কেউ কেউ চাদর গায়ে কেবল পালাবার চেষ্টা। করছে। কিছুক্ষণ পর মিলিটারী আমাদের দরােজার সামনে এসে বললাে, ‘কইহ্যায়? দরােজা খুলদো, তােম লােকজো শুট করনে হােগা।’ তখন আমার বুড়ি কাকী বললাে, “ঠেরীয়ে সাহাব, দরােজা এখন খুলনেহি হ্যায়, মাত লেজিয়ে।’ তখন ১০/১২ জন মিলিটারী এক সাথে তেড়ে এলাে আমাদের দিকে। আমরা ভয়ে আরও চুপসে গেলাম । আমার স্বামী তার বড় চেহারার শরীরটা নিয়ে আমাদের একটা বড় কাঠের আলমারির পিছনে লুকালাে  সেখান থেকে সে বলতে লাগলাে, বলবে না যে আমি এখানে আছি।’ ঘরের ভিতর আমরা রইলাম বুড়ি কাকি, আমি, বাচ্চা দুটো ভাসুরপাে আর শাশুড়ি। তখন। মিলিটারীরা ওদের ভাষায় বললাে, এই তুমলােক আদমী কিধার হায়?’ তখন বুড়ি কাকি বললাে, সামনে হােতা হ্যায়।’ পাকসেনারা বলল, মাদারচোদ, আদমী লােক কি ধার গিয়া? আমি বললাম, সাহাব, এইতাে ঘরা হ্যায়।’ আমরা আসলে বুঝতে পারছিনা  কি ওরা বলতে চায় ওরা আবার বললাে, ‘ইসকো কাহা মিলাে, দাওয়া? বুড়ি কাকি বললাে, কালকে আমাদের জল থাকবাে না তাই তুলে রেখেছি। আমি বললাম, কাহা বােলনা সাহাব হামলােক সামান্তো নেহি।’ তখন পাকসেনারা বললাে, “জহর নেহি মিলায়া?’ আমি বললাম, নেহি সাব, জহর নেতি মিলায়া, জহর মে হাম নেহি জানতাহাে কিধার মিলতা।’ পরে আমাকে বললাে, ‘দু গ্লাস পানি পিলাও।’ আমি দুটো কাচের গ্লাসে পানি দিলাম ওদের হাতে। ওরা আবার বললাে, “মিলায়া নেহিতাে?’
আমি বললাম, “নেহি সাহাব মিলায়া নেহি, জহর হাম নেহি চিনতা ওরা জল খেয়ে একটা গ্লাস আমার হাতে দিল, আরেকটা ফেলে দিল। এবার বললাে, “তােমহারা চলাে। প্রথমে আমাকে পিছনে বুড়ি কাকিকে আর ওরা সামনেপিছনে দুটো মেশিনগান নিয়ে আমাদেরকে বললাে ‘হামলােককো পিছে চলাে, তুম লােককো মেজর সাহাব বােলাতা হ্যায়  তুম লােক চলাে।’ আমি বললাম, ‘আপলােক কিয়া কর দিয়া সাহাব? হামার তিন বাচ্চা হ্যায়।’ তখন আমাকে বললাে, উঠ যাও’ আমি তখন পাগলের মতাে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার এই বাচ্চা তিনটাকে কি করবাে? তখন পাকসেনারা বললাে, ‘উধার নে চলাে, সামাস্তা হ্যায়, ও বাচ্চা, তুমলােক চুপচাপ উধারমে ঠাইরাে আমার সাথে বুড়ি কাকিকেও নিয়ে চললাে ভাসুরপােকে বললাে, তুমভি চলাে।’ আমরা অনেকে যাচ্ছি দেখে আমার মনে একটু সাহস হলাে। কিন্তু তবুও আমি বুড়ি কাকিকে বললাম, তুমি যেয়াে না। আমাকে দেখে হয়তাে ওদের মতলব খারাপ হয়েছে  তুমি যেয়াে না, তাহলে তাহলে আমিও না গিয়ে পারবাে আমি পুনরায় তাদেরকে বললাম, দেখিয়ে সাহাব, আপনােক হামারা ভাই হ্যায়, বাপ হ্যায়, সাহাব, আপলােক কিধার লিয়ে যাতা হামকো? আপলােক জুলুম নেহি করাে’ তখন ওরা বুড়ি কাকির হাত ধরে জোরে টান দিয়ে বললাে, ‘চল্ চল, উধারছে চল।’ এ সময় দুজন মেজর গােছের পাঞ্জাবি এলাে, তারা বললাে, ইসকো কিয়া হােতা হ্যা? ওদের ভাষায় আরও অনেক কিছু বলতে লাগলাে এক সময়ে মেজর গােছের একজন বললাে, “লিয়ে যাও কাহা? ঘরমে ছােড়দো।’ তখন তারা আমাদেরকে ছেড়ে দিল এবং আমি ছাড়া পেয়ে বুড়ি কাকিকে বললাম, কাকি এখানে থাকা নিরাপদ নয়, চলাে, আমরা অন্য কোথাও যাই।’ বুড়ি কাকি যেতে চাইলেন না। আমি আমার তিন বাচ্চাকে নিয়ে মঞ্জুদের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিই যাবার সময় আমার স্বামী বললেন, “তােমার জামা-কাপড় ছেড়ে মেথরদের জামা-কাপড় পরাে, নইলে রক্ষা পাবে না। আমি মঞ্জুদের বাসায় ওদের দেওয়া কাপড় তাড়াতাড়ি করে পরে নিলাম এ সময়ে দেখলাম মিলিটারীরা ঐ বাড়িতে ঢুকলাে আমি দেখলাম যে, মেথরদের বাড়ির অনেক সুন্দর সুন্দর বউদের নিয়ে ওরা কাড়াকাড়ি করতে লাগলাে আমি তখন অন্ধকারে একটা পায়খানার পাশে বাচ্চাদের নিয়ে চুপ করে লুকিয়ে থাকলাম আমি ভাবছিলাম, এ বাঁচাই আমার শেষ বাঁচা তখনও আমার স্বামী ঘরে আলমারির পেছনে নিরাপদে আছেন ইতােমধ্যে সুধীর বাবুর ক্যানটিনে ওরা আগুন ধরালাে তখন আমার স্বামীর সাথে আমার দেখা হলাে আমি তাকে বললাম, তুমি সাবধানে থেকো রাতটা যে কিভাবে কেটে গেল, বলতে পারবাে না। পরের দিন ভােরে যখন সবাই লাশ টানছে, তখন আবার আমার স্বামীর সাথে দেখা হলাে সকালে লাশ টানছে চান্দু আর শ্যামলাল, সাথে কয়েকজন মিলিটারী দেখলাম ওরা মধুদাকে নিয়ে আসছে।
শুধুমাত্র আমার স্বামীকে দেখার জন্যই আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম ঐ পায়খানার কাছে ওদিকে যখন বাইরের থেকে লাশগুলাে আনছে, তখনই যেন কেমন করে আমার স্বামীকে পায়খানার কাছে পিছন দিক থেকে থাবা দিয়ে ধরলাে এবং এ বহুলােক, যাদেরকে ধরে এনেছে, তাদের সাথে মিশিয়ে দিল আমার তখনই মনটায় কু-ডাক ডেকে উঠলা আমি আমার স্বামীকে বললাম, তুমি কোথায় যাচ্ছাে? ওদের সাথে যেয়াে না’ তখন। মিলিটারী আমার স্বামীকে বললাে, “এই তুমলােক চলাে, হামকো কাম কর দেগা। আমার স্বামী বললেন, সাহাব, হাম কাম কর দেগা তাে হামকো ছােড় দেগা?’ ওরা বললাে, হুম, কাম কর দেগাতাে তুমলােককো হাম ছেড়ে গা এ সময়ে দেখলাম এই ব্যাংকের কাছ থেকে প্রিয়নাথের লাশ তুলে নিয়ে গেল প্রিয়নাথ এই হলের দারােয়ান ছিল পরে দুজন দুজন করে ভাগ করে লাশ টানার কাজে লাগিয়ে দিল। লাশের পর লাশ, একের পর এক আসছেই লাশের স্তুপ হয়ে গেল। আগে যখন মধুদাকে নিয়ে এসেছিল তখন মধুদা কি যেন বলতে চাইছিল আমি আমার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছি আর ভাবছি যে, যদি ছাড়া পেতাে। তাহলে আমি বাঁচতাম হঠাৎ দেখি লাশ টানার ওখানে আমার স্বামী নেই। তখন আমি চান্দুকে জিজ্ঞেস করলাম তার কথা চান্দু বললাে, আছে হয়তাে। কোথাও তুমি দেখছাে না, কিন্তু সে তােমাকে ঠিকই দেখছে, লাশ টানছে।’ এ সময়ে দেখলাম শিববাড়ির এক সাধুকে নিয়ে এলাে দুজনে সাধুকে সম্পূর্ণ সুস্থই দেখলাম। তাকে নিয়ে এলাে মাধবদা আর মনীন্দ্র দা দেখলাম খগেন দা আর তার ছেলেটাকে ধরে এনে লাশ টানার কাজে লাগালাে। খগেনদা ছিলেন আর্টস বিল্ডিং-এর (দর্শন বিভাগ) পিয়ন মাথায় চুল ছিল খগেনদার তিনি পুরা সুস্থ । তিনি লাশ টানেননি কিন্তু লাশ যারা টানছিল তাদের সাথে সাথে থাকছেন। কিছুক্ষণ পর দেখলাম যারা লাশ টানছিল তাদেরকে লাশের মধ্যে তিন লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিল লাইনে দাঁড়ানাে লােকগুলাের মধ্যে কেউ কেউ হাতজোড় করে কিছু বলতে চাইছে।আমি তখন ছিলাম মাঠের মধ্যে দূরত্বটা হবে বর্তমান জগন্নাথ হল আর মাঠের মধ্যে যতটুকু দূরত্ব ততটুকু। আমার তখন কোনাে ভয়-ভীতি ছিল না, কোনাে জ্ঞানও ছিল না।
এ সময়ে দেখলাম দক্ষিণ বাড়ির গেটের কাছে সৈন্যভর্তি একটা গাড়ি। এলাে। আমি ওদের কাছ গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। তখনই চান্দুর বড় বৌদি কাছে এসে দাঁড়ালাে। দেখলাম চান্দুর বড় ভাই আর কে যেন একটা লাশ নিয়ে এলাে ইতােমধ্যে তিনজন মিলিটারী ত্রিকোণে দাঁড়িয়ে লাইনের। লােকগুলােকে মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি কি করে দেখবাে এই দৃশ্য! আর কোনাে দিশা না পেয়ে পুনরায় মেথরদের বাড়িতে এসে পড়ে গেলাম। এইখানে এখানে পড়ে যাবার ঠিক ২/৩ মিনিটের মধ্যেই একটা বিরাট শব্দ হলাে। তখনও আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। রাধে বলে একটা লােক ছিল, সে হঠাৎ বলে উঠলাে, ‘আহা, বিন্দুকা বাপ বাপকো সব খতম করদিয়া।’ যখনই সে বললাে, ‘সব  খতম কর দিয়া’ সাথে সাথে আমি একদৌড়ে আবার সেই মাঠের কাছে গেলাম। দেখলাম যে পুতুলের মতাে সমস্ত লাইন দিয়ে লােকগুলাে পড়ে আছে খগেনদা গুলি খেয়ে একবার উঠতে চান আবার পড়ে যান। এইভাবে বারবার উঠতে চেষ্টা করেছেন তিনি মিলিটারীরা পিছন ফিরে গিয়ে আবার তিন দিক থেকে আগের মতন গুলি করতে লাগলাে। শুধু ধূলায় ধূলায় ভর্তি হয়ে গেল সব যখন দ্বিতীয়বার আবার গুলি করে তখন ঐ লাশগুলাে থেকে মাত্র ২০/২৫ হাত দূরে থেকে সব দেখতে লাগলাম। খগেনদার তখনও একটা হাত নড়ছে  কি যেন বলতে চাইছেন তিনি। এদিকে দেখলাম আমার স্বামীর কোনাে দেখা নেই, ভাবলাম নিশ্চয়ই মেরে ফেলা হয়েছে । আমি তখন আমার বাসা থেকে দশহাত দূরে জগন্নাথ হলের মাঠের মধ্যে বর্তমান শহীদ মিনারের ১২/১৪ গজের মধ্যে থেকে সবই দেখছি। কেউ আর নড়ে না। গুলি করে মিলিটারী চলে গেলে সবাই ঐ লাশের দিকে ছুটছে। এই সময়ে বকশী বাজারের মােড়ের মসজিদের ওখানকার ইদু নামে একজন লােক এসে বললাে, ‘এই তােমরা কি করছাে? এখনই সরে যাও যদি বাঁচতে চাও তখন আমি কোনাে চিন্তা না করেই লাশের কাছে যাবার জন্য ব্যাকুল হলাম । বুড়াে কাকা বললাে আমার স্বামীর কথা, ‘চলাে দেখে আসি ও বেঁচে আছে কিনা। কাকা আর আমি তখন লাশের কাছে গেলাম।
সেখানে তখন বিভিন্ন জায়গা থেকে লােকজন এসে দেখছে তাদের পরিচিত লােকজন বেঁচে আছে কিনা। আমি আমার স্বামীকে পেয়ে লাশের মধ্য থেকে তাকে পা ধরে টেনে বের করলাম। ঘরে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করলাম আরাে দেখলাম চান্দুর বড় ভাই গােঙাচ্ছে। তার পেটে গুলি লেগেছে। এবং সমস্ত নাড়িভুড়ি বাইরে বেরিয়ে আসছে। তার বউ জল নিয়ে দৌড়ে আসছে  কিন্তু সে তাকে বারণ করে বলছে, ‘আসিস না আসিস না, তােরা সব ফিরে যা।’ এইভাবে বলতে বলতে সে রােকেয়া হলের দেয়াল টপকে চলে গেল। এদিকে চান্দুর ছােট ভাই মুন্নীলাল বহু কষ্টে উঠতে চেষ্টা করছে কিন্তু উঠে আবার পড়ে গিয়ে একেবারে নিস্তেজ। এখন ছাত্রবাবুরা যেখানে রিং’ ঝােলে সেখানেই সবাই পড়ে ছিল যাহােক আমি এবং আরও কয়েকজনে মিলে আমার স্বামীকে বাসায় নিয়ে এলাম। তখনও আমি বুঝতে পরিনি যে তার কতটুকু ক্ষতি হয়েছে। মনে হচ্ছিল বাসায় এলেই তিনি দাঁড়াতে পারবেন, কিন্তু বাসায় এনে দেখি যে সমস্ত শরীরটা বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আমি তখন প্রায় পাগলের মতাে। তাকে ঘরে নিয়ে আসতে কেউ কেউ বলেছে যে, দ্যাখাে এই লাশের জন্য আবার এই বস্তিতে হামলা না চালায়। যাই হােক, আমার স্বামী আমাকে বললাে, আমার মাথায় বালিশটা দাও, আমার মাথায় জল দাও, আমার যেন কেমন কেমন লাগছে। তখনও তিনি আমার সাথে সচেতনভাবে কথা বলছেন। তার শরীরের রক্তে আমার সমস্ত শরীর ভেসে গেছে। বুড়া বাসু নামের একজনের রক্তও আমার শরীরে লেগেছে। এই বুড়ার তিনটি গুলি লেগেছিল, তবুও সে তখনও বেঁচে ছিল। আমার স্বামী আমাকে বললাে, আমার যেন কেমন লাগছে, আমি আর বাঁচবাে না। আমি মরে গেলাম। আমি বললাম, তােমাকে আমি মরতে দেবাে না। মিলিটারী একটু পরে গেলেই তােমাকে আমি মেডিক্যালে নিয়ে যাবে। তখন তিনি আমাকে আবার বললেন, “দেখ আমার পা দুটো নেই, আমার পিঠটা খুলে দেখ। তখন আমি আমার শাশুড়ীকে ডেকে দেখতে বললাম তিনি দেখে বললেন, ‘বড় ভাইকে ডাকো। বড়ভাইকে ডেকে তিনি বললেন, আমার বাচ্চা-কাচ্চা সব রেখে গেলাম, তুই দেখিস আমাকে বললেন, “তুমি হলে থেকো না। নারায়ণগঞ্জে তােমার বােন-জামাইয়ের কাছে। যাবে। উনি একটা ব্যবস্থা করে দেবেন আমার শাশুড়ী বললেন, ‘একি হলাে! তুই চলে গেলে আমার কি হবে, তাের বাচ্চা-কাচ্চার কি হবে?’ তিনি বললেন, বড় ভাইতাে আছে, ও দেখবে। তুমি আর কি করবে, ভগবানকে ডাকো যেন আমার আত্মাটা তাড়াতাড়ি বের হয়ে যায় । আমি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি।

আমার মেয়েটার বয়স সাড়ে পাচ বছর, ও এসব দেখে চোখ বুজে আছে, আর খােলে কেবল বলে, লাশ ফেলাে।’ তখন আমি শাশুড়ীকে দিয়ে মেয়েটাকে মাঠে পাঠিয়ে দিতে গেলাম ভাবলাম এসে ক্ষতস্থান বেঁধে দেবাে এবং মেডিক্যালে নিয়ে যাবাে মেয়েটাকে রেখে এসে দেখি, ওর বাবা কোনাে কথা বলছে না। আমি খুব ডাকাডাকি করলাম  কিন্তু কোনাে সাড়া নেই। ভাবলাম এইমাত্র এতাে কথা বললাে, এখন নেই? আমি দিশেহারা হয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম  সমস্ত লােক যারা ছিল তাড়া সবাই ছুটে এলাে। আমাকে কেউ কেউ বললাে, তুমি চিৎকার করাে না। আর কিছুতাে করার নেই, এখন চুপ করে থাকো  তােমার চিৎকার শুনলে মিলিটারী এসে আমাদের সবাইকে শেষ করে ফেলবে।’ তখন আমার বড় ভাসুর আমার স্বামীর লাশটাকে মাঠের মধ্যে রেখে এলাে আমি  ভীষণ কান্নাকাটি করছি দেখে মঞ্জুর বাবা আমাকে ধরে দূরে নিয়ে শান্ত্বনা দিতে লাগলাে ইতােমধ্যে সবাই হল ছাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়লাে। আমি মাখনের বউকে বললাম, সবাইতাে চলে যাচ্ছে আমি বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবাে? চলাে না একবার ওদের বাবাকে দেখে আসি।’ তখন মাখনের বউকে সাথে নিয়ে আমি লাশের পাশে এলাম লাশের পাশে বসে নমস্কার করে চলে এলাম আবার বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও যাবার জন্য বাইরে বের হলাম  পূর্বদিকের গেটের কাছে দেখলাম গলায় কাপড় দিয়ে টেনে আনছে ছাত্রদের লাশ সবাই মিলে আমি তখন একা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আমি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছি, রাস্তাও পার হতে পারছি না। কয়েকজন ধােপা আমাকে রাস্তা পার করে দিল আমি বাচ্চাদের নিয়ে হল ত্যাগ করে কিছুদূর গিয়ে রাস্তায় সবার সাথে মিলিত হলাম  চলে গেলাম সবাই মিলে হােসেনী দালানে হােসেনী দালান থেকে প্রায় চারদিন পর বেলীর মাকে সাথে নিয়ে মেডিক্যালে এলাম সেখানে এসেই শুনলাম জ্যোতিবাবু স্যার এইমাত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বেলীর মাকে সঙ্গে নিয়ে আমি স্যারকে দেখতে গেলাম।  মিলিটারী অপারেশনের এই প্রথম দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র এবং কর্মচারীদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এখানে কতাে লােক নিহত হয়েছে, তার সঠিক হিসেব কেউ জানে না।  

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড – মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান