বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৪ঠা মে, শনিবার, ২০শে বৈশাখ, ১৩৮১
আবার পাটে আগুন
দৌলতপুরে পাটের গুদামে গত পহেলা মে আবার আগুন লাগে। এবারের আগুনে গুদামসহ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক কোটি টাকা। এ নিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে এ যাবৎ একমাত্র দৌলতপুর এলাকাতেই প্রায় ১১ কোটি টাকার পাট পুড়লো। জেলা প্রশাসক এই অগ্নিকাণ্ডকে ‘সাবোটাস’ বলে উল্লেখ করেছেন। পরিস্থিতি জানার জন্য পাট বিভাগীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব মোসলেহ উদ্দিনের ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন বলেও জানা গেছে।
সংবাদ সূত্র থেকে আরো জানা যায়, বুধবার বেলা প্রায় সাড়ে তিনটায় খুলনার দৌলতপুর জুট ট্রেডিং কর্পোরেশন এর দুটি গুদামের এবং কাজী ব্রাদার্সের একটি গুদামে আগুন লাগে। ফলে জুট ট্রেডিং কর্পোরেশন এর গুদামের ৩৫ হাজার মণ এবং কাজী ব্রাদার্সের গুদামের ৪০ হাজার মণ পাট ভশ্মীভূত হয়।
গত বুধবার মে দিবস উপলক্ষে ছুটির দিন ছিল। তার সাথে ওই দিন গুদাম সুপারভাইজার এর তত্ত্বাবধানে ১১ জন শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছিল। তারা যথাক্রমে ৩ ও ৪ নম্বর গুদামে কাজ করছিল। আগুন লাগে প্রথমে ৮ নম্বর গুদামে। ৮ নং গুদাম ওই দুটি গুদামের প্রায় সংলগ্ন। ফলে ওখানকার আগুন অচিরেই অন্যান্য গুদামে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে বিভিন্ন সময় পাট পুড়েছে এন্তার। গত ২৬ মাসে বিভিন্ন জুটমিলে ৩৬টি এবং গুদামে ৪৪টি মোট ৮০টি বড় রকমের অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব অগ্নিকাণ্ডে ১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা এবং ছোটখাটো আরো শতাধিক ঘটনায় ইন্সিউরেন্স ছাড়া ৭৫ লাখ টাকার পাট সম্পদ ভস্মীভূত হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে আরও বলা যায়, গত ২৪ এপ্রিল রাতে জেডিসির একটি গুদাম থেকে রাতের আধারে প্রায় ১০ মণ পাট নদীতে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। বিভিন্ন পত্রিকায় পাটের আগুন সম্পর্কিত যে সংবাদ বেড়েছে তাতে দেখা যায় ওই অভিযোগের সূত্র ধরে পুলিশ ম্যানেজার জনাব এন্তার উদ্দিনকে গ্রেফতার করে। তিনি অগ্নিকাণ্ডের দুইদিন পূর্বে জামিনে ছাড়া পান। এবং ৩০ শে এপ্রিল মঙ্গলবার কাজে যোগ দেন। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই কাজে তার কাজে যোগদান এবং পাটের গুদামে আগুন লাগার মধ্যে কোন রহস্য আছে বলে বিশেষ মহল অনুমান করছেন।
আমরা জানি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ডই হল পাট। সে ক্ষেত্রে রপ্তানিযোগ্য পাট এবং সংরক্ষিত পাট বার বার কোন অদৃশ্য সংকেতে এমন ব্যাপকভাবে পুড়ছে তা আদৌ জানা যায় না। কখনো বা রপ্তানির জন্য বোঝাইকৃত পাট পচা বলে বিদেশীরা নিতে সম্মত হননি। যখন পাট কে কেন্দ্র করে আমরা একটা বিশ্ববাজার পেতে এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি, তখন এহেন রহস্যজনক পাটলীলার তাৎপর্য কী–এ প্রশ্ন জনমনে না এসে পারেনা।
প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরই ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। তবে আমাদের জানামতে এ পর্যন্ত কোনো একটি ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি বা আগুন লাগার প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। অপরদিকে অগ্নিকাণ্ডের সমগ্র ক্ষতিপূরণের দায় চাপানো হয় বিমা সংস্থার উপর। অথচ বিমা সংস্থার কোন প্রতিনিধিকে তদন্ত কমিটিতে রাখার প্রস্তাবও ছিল না। ফলে তদন্তের মূলেই একটা কেমন গোলমেলে অবস্থার উদ্ভব হয়েছে।
এসকল অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করলে যে কারণগুলি জানা যাবে, তাহলো রপ্তানি বাণিজ্যে মন্থর গতির জন্য মাসের পর মাস ধরে পাট জমিয়ে রাখা হয়। ফলে আগুন লাগলে স্তূপীকৃত সহপাটই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে গুদামগুলি বেশিরভাগই একটার সঙ্গে অন্যটি লাগানোর। ফলে এক গুদামের আগুন সহজে অন্য গুদামে ছড়িয়ে পড়ে। এবং গুদামঘরেরও প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। সর্বোপরি পাটের গুদাম এলাকায় কোন অগ্নিনির্বাপক বা অগ্নিনিরোধক ব্যবস্থা নেই। যার ফলে অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই তা নিয়ে ফেলার চেষ্টা করা যায় এবং বিপুল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
শুধু তাই নয়–এবারের অগ্নিকান্ডের সঙ্গে সঙ্গে দূরালাপনী ব্যবস্থাও বিকল হয়ে পড়ে। ফলে দমকল বাহিনীকে ও যথাযথ সময় আগুন নেভানোর কাজে ঢাকা সম্ভব হয়নি। অতঃপর আগুনের লেলিহান শিখা যখন সাধারন চেষ্টার আয়ত্বের বাইরে চলে যায় তখন ভৌতিক ভাবে দূরালাপনী যন্ত্র ভালো হয়ে ওঠে অর্থাৎ সকল পরিস্থিতিতেই যেন কেমন করে তখন অগ্নিকাণ্ড ক্ষতির পক্ষে চলে যায়।
বিশেষ মহলের ধারণা–পাটের অগ্নিকাণ্ডের সঠিক তদন্ত করতে গেলে এমন অনেক তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়বে যার দরুন গুদামের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেকে জড়িয়ে পড়তে পারেন। হয়তো প্রচুর পরিমাণ পাট গোপনে পাচার করে মজুদ ঘাটতির হিসাবে ফাঁকি দেবার জন্য আগুন লাগে। তবে সবই অনুমান।
এ প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষক মহলের মত হলো–পাট গুদামে অগ্নিকাণ্ড বন্ধ করতে হলে প্রথমতঃ রপ্তানি বাণিজ্যে ঢিলা নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। সে ব্যাপারে একটা সুষ্ঠু ও কার্যকরী নীতি মেনে চলতেই হবে। দ্বিতীয়তঃ গুদামগুলির সংস্কার সাধন করতে হবে এবং যদি সম্ভব হয় তাহলে রপ্তানীযোগ্য পাটকে বন্দরের কাছাকাছি অথবা অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে মজুদ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষভাবে নির্মিত অগ্নিনিরোধক গুদামগুলোতে যদি পাটগুলো মজুদ করা যায় তাহলে হয়তো সমস্যার সমাধান হতে পারে অনেকটা।
তৃতীয়তঃ অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা সুবন্দোবস্ত আয়ত্ত সীমার মধ্যে রাখতে হবে। কোন দমকল বাহিনীর অজুহাত না দেখানো যায়। সর্বোপরি পাট নিয়ে যেসব কীর্তিকলাপ অর্থাৎ পাচার ইত্যাদি চলে সে ব্যাপারে একটা নির্দিষ্ট দিনের ব্যবধানে পরীক্ষা করে দেখার জন্য স্থায়ী কমিটি গঠন করতে হবে।
দুঃখের কথা এই যে, প্রতিবার পাট পোড়ার পর অত্যন্ত তাৎক্ষণিকের জন্য একটা উচ্চপর্যায়ের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু তারপর তথৈবচঃ। কিন্তু দেশের স্বার্থেই আজ এই সর্বনাশা ঔদাসীন্য নীতির অবসান চাই।
উৎপাদন বৃদ্ধির আহবান
আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর ঐতিহাসিক দিবস ১লা মে। এবার বাংলাদেশে এটি একটি বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উদযাপিত হয়েছে। বিশ্বের সকল শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশই শুধু নয়–করে-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্যও এবার শপথ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও মে দিবসে শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। বিভিন্ন শ্রমিক সংস্থার পক্ষ থেকে উৎপাদন বৃদ্ধির ডাক দেওয়া হয়েছে। দেশের সংকটময় অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে কোলে কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি করা যে কত বেশি প্রয়োজন তা এই ঐতিহাসিক দিবসে শ্রমিকরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়–পঙ্গু প্রায় অর্থনীতিকে যে তারা তাদের শ্রম দিয়ে ওর অনেকাংশে পূরণ করতে পারে–এটাও শ্রমিকদের কাছে বোধগম্য হয়েছে। তেজগাঁও আঞ্চলিক শ্রমিকলীগ, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন প্রভৃতি শ্রমিক সংস্থা থেকে মে দিবসের গুরুত্ব অনুধাবন এর সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সহ অন্য কয়েকটি রাজনৈতিক দল উৎপাদন বৃদ্ধি করার আহ্বান জানিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে একাত্মতা স্থাপন করেছে। কৃষক লীগ ও সাংবাদিক ইউনিয়নও মেহনতী শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ কৃষকলীগ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে কৃষক ও শ্রমিকের সংহতির উপর। তাদের মতে দেশের শতকরা প্রায় ৮৫ জন মানুষ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। তাই এরাও শ্রমজীবী মানুষ। পক্ষান্তরে শিল্পের উৎপাদনের সঙ্গে যারা জড়িত তারা হল শিল্প শ্রমিক। শিল্প শ্রমিক ও কৃষি শ্রমিকদের সংহতি স্থাপনের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। শুধু শিল্পের নয়, কৃষির উৎপাদনই আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মূল মেরুদন্ড। বস্তুতপক্ষে এবারের মে দিবস জাতির সামনে নতুন প্রত্যয় নিয়ে দেখা দিয়েছিল। দুর্ভিক্ষে পদধ্বনি চারিদিকে যখন শোনা যাচ্ছিল, তখন দেশের জাতীয়করণকৃত শতশত মিল কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল, যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে তখনই আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস এর ডাক সর্বোপরি উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। দেশের বহু বড় বড় কারখানা-মিল আজ উৎপাদনের কাজের যথাযথ ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। মিলগুলোর জন্য বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশ প্রয়োজন নিয়মিত কাঁচামালের সরবরাহ করা আজ সরকারের প্রাথমিক কাজ। যুদ্ধের কালে যে সমস্ত মিল কারখানা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল সেগুলোকে উৎপাদনক্ষম করতে হলে দ্রুত ওই সকল মিলের আবশ্যকীয় যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল সরবরাহ করা দরকার। এ ব্যাপারে যত বিলম্ব হবে তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে গোটা জাতি। যে সকল মেইল বা কারখানা বর্তমানে চালু রয়েছে তাকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ করে যথার্থ অধিক উৎপাদনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ক’দিন পরে বন্ধ হয় না যাবার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এছাড়া কিছু কিছু কারখানা ধ্বংস প্রাপ্ত বা লুটপাট হয়ে গিয়েছিল,–সে গুলোকে উৎপাদনক্ষম করে তুলবার জন্য আবশ্যকীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঐতিহাসিক মে দিবস ও উৎপাদন বৃদ্ধির এসেছে তাকে কার্যকর করতে হলে নিয়মিত কাঁচামাল সরবরাহের নিশ্চয়তা কতৃপক্ষকে অবশ্যই প্রদান করতে হবে। শ্রমিক শ্রেণী নিঃসন্দেহে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যেতে প্রস্তুত কিন্তু তাদের চেতনাকে যথার্থ ব্যবহার করতে হলে সরকারের সমন্বিত ও আবশ্যকীয় উদ্যোগ দরকার। শুধু মে দিবসের উৎপাদন বৃদ্ধির ডাক দিয়ে কতৃপক্ষ ক্ষান্ত হবেন না। বরং কাঁচামাল ও অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিসের সরবরাহও তারা নিশ্চিত করবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক