একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ
বাঙালি জাতির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিসংগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাদের এই সংগ্রামী চেতনা হঠাৎ করে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে নি। আজকের বাংলাদেশ সেদিনের পূর্ববঙ্গ। পূর্ববঙ্গের জনগােষ্ঠী প্রথম আন্দোলনমুখর হয়েছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে ঘিরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালি মুসলমান প্রধান পূর্ববঙ্গ ছিল দরিদ্র, অনুন্নত এবং কৃষিপ্রধান দেশ। ব্রিটিশ বিরােধী কৃষক আন্দোলন এদেশবাসীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন নিঃসন্দেহে। এ আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য ব্রিটিশ শাসকগােষ্ঠী হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ভারত শাসনের পথ আরও সুগম করে নিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হয়, সেই ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতেই। তার আগে অবশ্য পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা এ. কে. ফজলুল হক নিখিল বঙ্গ কৃষকপ্রজা পার্টি শীর্ষক একটি দল গঠন করেন। আর তিনিই ছিলেন পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তাঁর ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি মাইলফলক। কিন্তু ১৯৪৬ সালের ৯ই এপ্রিল মুসলিম লীগের কনভেনশনে লাহাের প্রস্তাব নাকচ করা হয় এবং একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বানচাল হয়ে যায়। শুরু হয় এদেশের মানুষের মধ্যে মুসলিম লীগের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস। তাই ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে এসে গেল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস।
তাইতাে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রগতিশীল মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এবং বামপন্থী নেতারা পাকিস্তান সরকারের রােষানলে পড়ে। তাদের প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা, ভাষার পরিবর্তে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের বিপরীতমুখী অবস্থান, তদুপরি বাঙালি পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি পাক সরকারের বিমাতাসুলভ ব্যবহার বাঙালিদেরকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। আর তারা কেবল তাদের আত্মমর্যাদা, আত্মনিয়ন্ত্রণ আর স্বাধিকার আদায়ের দুরন্ত আবেগে তড়পাচ্ছিল। তারই একটি বিস্ফোরণ ঘটে ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ফলে বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী কঠোর অবস্থান নিতে শুরু করল। অর্থনৈতিক শোষণের সাথে সাথে তারা রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিশেষ করে কমিউনিস্ট নেতা এবং প্রগতিশীল মুসলিম লীগ নেতা-কর্মীদের উপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে দিল। এ সময়ের তেভাগা আন্দোলন, নাচোল, হাজং ইত্যাদি অঞ্চলের কৃষক আন্দোলন বাঙালির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছিল।
পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা বাঙালিদের স্বাধিকার আদায়ের সনদ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এ দল পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের অবদান একক ও অনন্য। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শাসকগােষ্ঠী পূর্ব বাংলার প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসতেছিল। আর এ নিপীড়ন অবশ্য পাকিস্তান সৃষ্টি হবার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল; যে কথা আগেই বলা হয়েছে। তবে পাকিস্তানি শাসনামলে তা আরও তীব্রতর ও প্রকট আকার ধারণ করে। একদিকে যেমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে অবদমিত করে রাখার সূক্ষ্ম পায়তারা চলছিল, সঙ্গে সঙ্গে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতির উপরেও খবরদারি করতে শুরু করে দিয়েছিল। যার ধারাবাহিকতার উলঙ্গ ও বর্বরােচিত প্রকাশ পাই একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের সময়। শুরু হয় এদেশের বুদ্ধিজীবী নিধন, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন। তারপর আরও একটু এগিয়ে আসলে দেখা যাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরােধীরাই আজকে বাংলাদেশের রাজপাটে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে, ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার নামে জঙ্গিদেরকে শিখণ্ডী করে রাজপাটকে টেকসই করে রাখার হীন, নগ্ন আর কুচক্রের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তাহলে কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এখনও অনেক বাকি? পূর্ব বাংলার এই ইতিহাস-ঐতিহ্য আর ভাষার লড়াই থেকেই জন্ম নিয়েছে এদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই, স্বাধিকার আন্দোলনের লড়াই, আর রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায়; যার পরিচয় ড. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর লেখার মধ্যে ফুটে উঠেছে, “ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি ইসলাম ধর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়— প্রধানত এই হীন মনােবৃত্তি ও যুক্তি থেকে বৈরিতার সূত্রপাত ঘটে। বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণ, সংস্কৃতি ও আদি বাংলা শব্দমালাকে বাতিল করে আরবি ও ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটানাে, মূল বাংলা বর্ণমালা বাতিল, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাে ভেঙে দেওয়া, উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার নামে চাপিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষার সামাজিক ভিত্তির উপর আঘাত প্রভৃতি ছিল পাকিস্তানি শাসকদের মূল উদ্দেশ্য।”
বাংলা ভাষার সামাজিক ভিত্তির উপর আঘাতের অপর নাম বাঙালিদের স্বাধিকার আদায়ের ভিত্তির উপর আঘাত। তাই বাঙালি গর্জে উঠল তাদের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে। এই ভাষা-আন্দোলনই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চালিকাশক্তি। ওখান থেকেই আপামর বাঙালি তাদের স্বাধিকার আদায়ের বীজমন্ত্র পেয়েছিল। তার পরবর্তী ঘটনাপুঞ্জ কেবল সেই মন্ত্রকে আরাে ক্ষুরধার ও শানিত করে তুলেছিল। স্বাধিকার আদায়ের এই নিম্নচাপটি ক্রমশ ঘনিভূত হতে হতে একাত্তরে এসে আঘাত হানল পাকিস্তানি শাসকদের উপর । স্বাধিকার আদায়ের এই ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস যেমন ঝঞাবহুল তেমনি ঘটনাবহুলও। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানিদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে বিরােধী রাজনীতিকদের অসন্তোষ এবং পাঞ্জাবে আন্দোলনের মুখে তা বাতিল হয়ে যায় । সেই সময় এই মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যালট যুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। পাক সরকারের দমননীতি আরও জোরদার হয় ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে। তাইতাে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল। পর্যন্ত বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা পায়। এর শুরু যেমন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন ও তার স্বৈরশাসন থেকে, তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ভাষা ও সংস্কৃতির সংগ্রাম, রবীন্দ্র বিতর্ক, ছাত্র আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাক-ভারত যুদ্ধ এবং ছয়দফা আন্দোলন। আর এ আন্দোলনের মূলে ছিল হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।
তবে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সময়কালটি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে তাৎপর্যপূর্ণ গুরুত্ব বহন করে। এ সময়েই আওয়ামী লীগের ছয়দফা আন্দোলনের স্রোতধারা আরও কার্যকর ও বেগবান হয়। এই আন্দোলনের ধারাটিকে গণআন্দোলনে পরিণত করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলাে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী তাকে প্রতিহত করার জন্য কঠোর ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী ও এদেশের দোসরদের ষড়যন্ত্র নতুন নতুন রন্ধ্রপথ খুঁজতে থাকে। শুরু হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। সঙ্গে সঙ্গে আরও উত্তপ্ত হয় রাজনৈতিক অঙ্গন। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী কারাবরণ করে। শেষটায় গণআন্দোলনের মুখে ১৯৬৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ ট্রাইবুনাল অধ্যাদেশ বাতিল করার মাধ্যমে মামলা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু গণআন্দোলনের ধারাটি অব্যাহত গতিতে আরও গভীরভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে এই গণআন্দোলন এক অভূতপূর্ব সাফল্য আনয়ন করে । ফলে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ বিশেষ করে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং ডাকসুর এ গণআন্দোলন বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এমনকি সরকারি মদদপুষ্ট ছাত্র সংগঠন এন এস এফও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী সকল ছাত্র সংগঠন এই আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে ছাত্রনেতাদের এগার দফা’ ও সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়েছিল।
তাদের একমাত্র লড়াই ছিল শেখ মুজিবের ছয় দফা এবং ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের এগার দফা বাস্তবায়ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। শুরু হয় ছাত্রদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ। বিকেলে ইপিআর বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলােতে ঢুকে তাদেরকে প্রহার করে এবং অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে। এমনি একটি মিছিল। যখন মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন একজন পুলিশ অফিসারের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হন। এমনি আর একটি ঘটনা ঘটে রাজশাহীতে ১৯৬৯ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অকারণে, ইচ্ছাকৃতভাবে এবং বিদ্বেষমূলকভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয় । এই গণআন্দোলনের মুখে ২২শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ অন্যান্য রাজবন্দি মুক্তিপান। শেখ মুজিব এগার দফার প্রতি সমর্থন দেন এবং তাকে রেসকোর্সের ময়দানে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয় । ১৯৬৯ সালে পাকসরকার একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি বলে ঘােষণা করে। এরপর দফায় দফায় গােলটেবিল বৈঠক শুরু হয় । ১০ই মার্চ গােলটেবিল বৈঠকে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সমাধানের প্রস্তাব পেশ করা হয় । ১৫ই মার্চ জেনারেল আইয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের উপর দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণ করেন এবং জাতির উদ্দেশ্যে বলেন— ‘আমাদের দেশের ধ্বংসস্তুপের উপর সভাপতিত্ব করা আমার পক্ষে অসম্ভব। ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর এদেশের অবস্থা আরও টালমাটাল হয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৮শে নভেম্বর ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে মৌলিক গণতন্ত্র বাতিল করে এক ব্যক্তির এক ভােটের ভিত্তিতে ১৯৭০ সালে নির্বাচনের ঘােষণা দেন।
তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে নীরব থাকেন। তিনি ১৯৭০-এর ১লা জানুয়ারির ভাষণে রাজনৈতিক তৎপরতার উপর বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের কথা ঘােষণা করেন। তাই শেখ মুজিবুর রহমান জানুয়ারি মাস থেকেই নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেন। সেই প্রচারাভিযানের মুখে ১৭ই মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্রলীগ জয়লাভ করে। ফলে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের পালে জোর বাতাস বইতে শুরু করে। পালে আরও বাতাস বইয়ে দিল ১২ই নভেম্বর এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের উপর থেকে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় । ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এদেশের হাহাকারের প্রতি পাক সরকারের অবহেলা, ঔদাসিন্য জনমনকে ক্রুদ্ধ ও বিক্ষুব্ধ করে তােলে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড, এ. ভুট্টো নির্বাচনের পর পরই খামখেয়ালীভাবে লাহােরে ঘােষণা দেন, তার পার্টির সহযােগিতা ছাড়া কোনাে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা চলবে না এবং তার দল বিরােধী দলের আসনেও বসতে সম্মত নয় ।
এই বেপরােয়া আর অগণতান্ত্রিক আস্ফালনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য হতে রাজি নয়। অন্যদিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টি হিসেবে আওয়ামী লীগ অর্থাৎ বাঙালিরা কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবে তা পাকিস্তানি শাসক শ্রেণি মেনে নিতে চায় না। সরকারের এই মনােভাব ভুট্টোর মুখ দিয়েই বলিয়েছে। এদিকে শেখ মুজিবও তার অবস্থানে অচল আর অটল। সরকার যখন দেখল দেশ এক মহা সঙ্কটের মুখােমুখি তখনই তারা পূর্ব। পাকিস্তানে সৈন্য সমাবেশ করতে শুরু করে দিল। ১লা মার্চ বেতার ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা। বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত আসামি আহমদ ফজলুর রহমানের স্ত্রী হাসিনা রহমান। কাপড় কেটে মানচিত্রখচিত পতাকা তৈরি করে দেন।
এরপর অনুষ্ঠিত হল ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের মহাসমাবেশ বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ধ্বনিত হল- “তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করাে” “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের। সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ।” “রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।” এই বক্তৃতা স্বাধীনতাকামী প্রতিটি বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করল, বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করল। এ যেন সেই কথারই প্রতিধ্বনি— ‘Man is born free, but everywhere he is in chain’— মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সে সর্বত্রই শৃঙ্খলিত। দেশে তখন টালমাটাল অবস্থা। একদিকে শেখ মুজিব অন্যদিকে জেড. এ. ভুট্টো। কেউ কারও অবস্থান থেকে এতটুকু নড়েচড়ে বসতে রাজি নয় । এদেশ বিশেষ করে ঢাকা শহর কী এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল শুরু হয়ে যায় শেখ মুজিবের ডাকে দেশব্যাপী অসহযােগ আন্দোলন। এ সময় প্রতিরােধী ছাত্রজনতার উপর সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থানে গুলি চালায়। ১৬ই মার্চ থেকে ১৯ ও ২০শে মার্চ পর্যন্ত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবের দফায় দফায় বৈঠক হয়। ২১শে মার্চ হয় ভুট্টোর সাথে প্রেসিডেন্টের বৈঠক। কিন্তু বৈঠকের কোনাে অগ্রগতি ছিল না। শুধু অগ্রগতি ছিল বৈঠকের সুযােগ নিয়ে সামরিক বাহিনীকে পরামর্শ দিয়ে জোরদার করার ।
২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান গােপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। তারপর শুরু হয় সেই কালাে রাত্রি’র নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সেই হত্যাযজ্ঞের প্রথম শিকার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আর রাত ১: ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু বন্দি হলেন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। তারপর শুরু হল। দেশব্যাপী নির্বিচারে গণহত্যা যে যেভাবে পারছে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শিক্ষিতঅশিক্ষিত যুবসম্প্রদায়, হিন্দু সম্প্রদায় আর বুদ্ধিজীবীরাই ছিল তাদের হত্যাকাণ্ডের প্রধান শিকার। ফলে তারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হল। ২৬শে মার্চ কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র (পরবর্তীতে যা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। পরবর্তীতে ১০ই এপ্রিল ‘৭১ তারিখে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদ যথাক্রমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার ভবের পাড়ার (বৈদ্যনাথতলা) আমবাগানে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। ঐ স্থানটি পরবর্তীতে মুজিবনগর নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে । একদিকে চলছে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার তাণ্ডবলীলা, অন্যদিকে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ।
জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জে. টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স ‘৭১ জারি করেন। এদিকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে বেসামরিক লােকজন ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিসংগ্রামে যােগ দেয়। শুরু হয় জনযুদ্ধ। জুলাই মাসের শেষ দিকে মেজর জিয়ার জেড ফোর্স গঠিত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন এম. এ. জি. ওসমানি । ইতােমধ্যে ১লা আগস্ট লন্ডনস্থ পাকিস্তান মিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি জনাব মহিউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। ইয়াহিয়া খানের পক্ষে এটি একটি বিরাট কূটনৈতিক পরাজয়। ২০শে আগস্ট পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অন্যতম ইনস্ট্রাকটর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান একটি যুদ্ধ বিমান নিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আগমনের সময় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে দিল্লীস্থ পাকিস্তানি হাইকমিশনের বাঙালি কাউন্সিলর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে দিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতােমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একের পর এক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। এই অক্টোবর মাসে মুক্তিযুদ্ধ আরও জোরদার হয়। ১১ নং সেক্টরে নভেম্বরের শেষ দিকে পাকিস্ত যনি বাহিনীর সাথে কমান্ডার আবু তাহেরের মুখােমুখি সংঘর্ষ হয়। আবু তাহের আহত হন। অপরদিকে ২ কোম্পানি পাকিস্তানি সৈন্যসহ একজন মেজর নিহত হন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২১শে নভেম্বর একটি স্মরণীয় দিন। বাংলাদেশের স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী সম্মিলিতভাবে অভিযান চালায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। শেষ পর্যন্ত ভারতও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে এবং ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনীর সমর নায়ক লে. জেনারেল নিয়াজি ৯৩ হাজার সৈন্য ও অফিসারসহ আত্মসমর্পণ করেন। আনন্দ-উল্লাস আর উচ্ছ্বাসে ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষের মন স্বাধীনতা। লাভের উজ্জ্বলতায় ভরপুর হয়ে ওঠে। অবশ্য তাকে অনেকটা ম্লান করে দিয়েছিল অসংখ্য বুদ্ধিজীবীসহ শত শত মানুষের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, অসহায় মা-বােনের ইজ্জত হনন ও নিহত মুক্তিযোেদ্ধাদের আত্মত্যাগের হৃদয়স্পর্শী কাহিনী। তারপর সারাদেশে পতপত করে উড়তে থাকল বাংলাদেশের পতাকা এই আনন্দের পরিপূর্ণতা লাভ করল ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ। প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তাই আজ বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে অন্যতম স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ।
সূত্রঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড – মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান