You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.11.02 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বিশ্ব-বিবেক রুখে দাঁড়াও | সরষের ভূত তাড়াতে হবে | পতিত জমি আবাদের উদ্যোগ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২রা নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৭৩, ১৬ই কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

বিশ্ব-বিবেক রুখে দাঁড়াও

খবরে প্রকাশ, ভূ-মধ্যসাগরে অবস্থানরত মার্কিন সপ্তম নৌবহরের একটি অংশ এক অজ্ঞাত, আকস্মিক কর্তব্য পালনের নিবিড় তাগিদে একটি বিমানবাহী জাহাজ, পাঁচটি ডেস্ট্রয়ার ও একটি তেলবাহী জাহাজ নিয়ে ইউ. এস. এস. হ্যানকফের নেতৃত্বে সম্প্রতি মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের উভয় পাশে এখন মার্কিন নৌবহরের পাঁয়তারার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বর্তমানে কোনো যুদ্ধবিগ্রহ চলছে না। এমনকি ভারত মহাসাগরেও এমন কোনো অশান্তির তরঙ্গ সৃষ্টি হয়নি। তা’ সত্ত্বেও এমন কোনো বিশেষ কর্তব্য পালনের তাগিদে ভারত মহাসাগরে এই মার্কিন পাঁয়তারার প্রয়োজন দেখা দিলো তা’ আমাদের সাধারণ শান্তিপ্রিয় বুদ্ধিতে মোটেই কুলাচ্ছে না।
তবুও এটুকু আমরা অনায়াসে এবং নিশ্চিন্তে ভাবতে পারছি যে, এর পেছনে উদ্দেশ্য আর যাই হোক অন্ততঃ সৎ নিশ্চয়ই নয়, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিশেষ করে, মার্কিনী আগ্রাসী ও ইন্ধন যোগানী চরিত্রের সাধারণ রূপরেখার সঙ্গে আমাদের অনেকেরই পূর্ব পরিচিতি আছে। এবং শুধুমাত্র হানিমুন, বিলাস ভ্রমণ বা সমুদ্র গভীরতা পরিমাপের মতো সাধারণ উদ্দেশ্য নিয়ে যে এ মার্কিন নৌবহর প্রবেশ করেনি, তা আশে পাশের অবস্থাকে একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়।
বিশেষ করে, আমরা যারা ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর অধিবাসী তাদের পক্ষে মার্কিন রণতরীর এই আকস্মিক আগমনে ‘বেড়ালের গন্ধ’ পাওয়া নিশ্চয় অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিম্বা মার্কিন রণতরীর আসল মতিগতি জানতে চাওয়ার আগ্রহটা নিশ্চয়ই কোনোক্রমে অনধিকার চর্চা নয়। কারণ, এর সমাধান খুঁজে পাবার মধ্যে আমাদের স্থানীয় শান্তি-অশান্তির প্রশ্নটা একান্তই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
আমরা এখনো ভুলিনি সেই ১৯৭১ সালের কথা যখন সাড়ে সাত কোটি মৃত্যুমুখী বাঙালীর ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তের অঞ্জন মাখতে এই রণতরী দখলদার পাকিস্তানী হারমাদদের সাহায্য করতে আর একবার হানা দিয়েছিলো এই ভারত মহাসাগরে। সেবারও এই মালাক্কা প্রণালী দিয়ে পাঁয়তারা কষেছিলো।
কিন্তু চিরজাগ্রত ও মহা সংগ্রামী বাঙালীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে সেদিনের সব মার্কিন প্রচেষ্টা সম্পূর্ণই ভেস্তে যায় এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ভারত মহাসাগরে মার্কিন রণতরীর এই আকস্মিক মহড়ার কয়েকটি দিক একটু বিবেচনা করা যাক।
প্রথমতঃ ভারত মহাসাগর যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কোনো জলাশয় নয়, কিম্বা তার পেছন বাগানের লাগোয়া কোনো পুকুরও নয়। এখানে মার্কিন রণতরীর পাঁয়তারা কষণ রীতিমতো স্পর্ধামূলক। কারণ এ জলাশয়ের উপর কর্তৃত্ব করার একমাত্র মালিক এরই তীরবর্তী দেশগুলো মাত্র। সুতরাং এখানে বিনা অনুমতিতে সপ্তম নৌবহরের মতো একটি ভয়ংকর ও শান্তি ভঙ্গকারী রণতরী পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্র রীতিমতো পর অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের অপরাধে অভিযুক্ত হবার যোগ্য।
সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া এই উভয় দেশই আইনতঃ মালাক্কা প্রণালীকে তাদের নিজস্ব জলসীমার অন্তর্গত বলে মনে করতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের আন্তর্জাতিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পথকে আরো কন্টকময় করে তুলছে।
আসলে যুক্তরাষ্ট্র তার বাহুবলের দম্ভেই উন্মত্ত। কারণ, তার কাছে আছে এয়ার ক্রাফট কেরিয়ার, ডেস্ট্রয়ার, মিসাইল কেরিয়ার, সাবমেরিন আরো কতো চাই। এই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এই ন্যক্কারজনক স্পর্ধার মূল ইন্ধন। তাই তারা সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া বা বিশ্ব-বিবেকের তোয়াক্কা রাখেনা।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই অবিবেচক স্পর্ধার ফলে ভারত মহাসাগরস্থ তীরবর্তী দেশগুলোতে এখন শান্তি কপোত ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন, প্রকম্পিত।
আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ষষ্ঠ নৌবহরের ভূমিকা থেকে একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব-বলয়গুলোকে অক্ষুন্ন রাখার জন্যে তার নৌবহর যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করতে সদা প্রস্তুত। কারণ, আমরা আগেও দেখেছি যে, ইসরাইল যখনি বেকায়দায় পড়েছে, তখনি ভূমধ্যসাগরে টহলরত ষষ্ঠ নৌবহর থেকে ইসরাইলকে দেওয়া হয়েছে অমিত সমর সম্ভার। নিক্সন সরকার এও হুমকি দিয়েছেন যে, প্রয়োজন পড়লে ইসরাইলের সীমান্ত রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেও সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে তেল সরবরাহ বন্ধ করার জন্যে সম্প্রতি আরব দেশগুলো যে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র দারুণ এক হোঁচট খেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। তার নৌবহরের এই মহড়ার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, প্রয়োজন হলে সে বাহুবল খাটিয়েও তেল সরবরাহ নিশ্চিত রাখবে। ভারত মহাসাগরে মার্কিন রণতরী পাঠানোর আর একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে এই সমুদ্রের উপর তাদের অধিকার নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করা।
সত্যিই বেচারা যেখানেই হাত দেয়, সেখানেই মার খায়। ভিয়েতনামে লক্ষ্য লক্ষ্য সৈন্য পাঠিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। লাওসে তাকে কম্যুনিস্ট সমবায় কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হয়েছে। কম্বোডিয়ায় মার্কিন সমর্থক সরকার রীতিমতো ‘ইয়া নফসি, ইয়া নফসি’ করছে। ফরমোজায় নিশ্চিত নেই, থাইল্যান্ডে মার্কিন সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণ দারুণ প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছে। জাপান ক্রমশঃই জাতীয়তাবাদী নীতি গ্রহণ করছে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আগের মতো সুরে আর কথা বলছে না। ফিলিপাইনেও মার্কিনবিরোধী মনোভাব দানা বেঁধে উঠেছে। সিটো জোটের একেবারে অপমৃত্যু হয়েছে বললেও ভুল হয় না। বার্মা, ভারত, বাংলাদেশ, সিংহল প্রভৃতি সব দেশেই সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী নীতি অনুসৃত হচ্ছে।
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রে তেল সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মোটের উপর, সব স্থলভাগে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে মার্কিন ক্ষ্যাপা (কি তা’ আর বললাম না) এখন জলভাগে তার নতুন কর্তৃত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করে ঘোলের স্বাদে দুধের পিপাসা মেটানোর চেষ্টা করছে।
কিন্তু বিশ্বের জাগ্রত বিবেক কখনোই তার এ কুটিল চক্রান্তকে পূর্ণ হতে দেবে না। আমরা স্পষ্ট ভাষায় জানাতে চাই যে, ভারত মহাসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের এ উপস্থিতি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পক্ষে অত্যন্ত অশুভ সংকেতবাহী। ভারত মহাসাগরে এ ধরনের অশুভ মার্কিনী পাঁয়তারা চলতে থাকলে এর তীরবর্তী দেশগুলো নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক ভয়াবহ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়তে বাধ্য হবে। আমরা আশা করি বিশ্ব-বিবেক জাগ্রত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনী পাঁয়তারা প্রতিরোধ করবে।

সরষের ভূত তাড়াতে হবে

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে কাগজের কলে গচ্চার পরিমাণ হলো দৈনিক গড়ে প্রায় ১ লক্ষ ৯৬ হাজার টাকা। কাগজের কলটির নাম হলো কর্ণফুলী কাগজ কল।
তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করছেন দৈনিক এ হারে ঘাটতি ও অপচয় চলতে থাকলে বৎসরে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭ কোটি টাকা।
লোকসানের কারণস্বরূপ যা বলা হয়েছে তা হলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতা, কতিপয় আমলার দুর্নীতিপরায়ণতা এবং কর্তব্যকর্মে অবহেলা।
দৈনিক প্রায় দু’লাখ টাকা গচ্চা যাচ্ছে দেখে সরকারের পক্ষ থেকে একটি তথ্যানুসন্ধান টিম পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু তাঁরা নাকি তথ্যানুসন্ধানের পরিবর্তে প্রমোদ ভ্রমণই করছেন। অনুসন্ধান টিমের কর্মকর্তারা সাতটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন ভি.আই.পি. গেস্ট হাউজকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করার জন্যে।
সংবাদটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তার যোগ ফল হলো শূন্য। অর্থাৎ সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, কাগজের উৎপাদন হ্রাস ও অসাধু ব্যবসায়ীদের বদৌলতে কাগজের দাম আকাশচুম্বী হলেও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। মাথা ব্যথা হলো সরকারের। সরকার মাথার উপর বসে আছেন সুতরাং লোকসান হলেও বেতন তো ঠিক মতোই পাওয়া যাচ্ছে। অসুবিধা তো হচ্ছে না। এতে চিন্তার কি আছে। চলুক না যেভাবে চলছে। কিন্তু মুশকিল হলো এভাবে চলবে কিনা সেটাই হলো আসল কথা। আশা করি সরকার বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে দেখবেন। অন্ততঃ সরষের মধ্যে যে ভূত রয়েছে তা তাড়াবার ব্যবস্থা করবেন যথা শীঘ্র সম্ভব।

পতিত জমি আবাদের উদ্যোগ

দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পরিকল্পনায় অনবাদী জমি আবাদ করে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্যে অতি সত্বর জমি কাজে লাগাবার ব্যাপারে সরকার কড়া বিধি-ব্যবস্থা প্রণয়ন করবেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। এই সূত্রে আরো জানা গেছে যে, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা অনুযায়ীই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং এ ‍উদ্দেশ্যে শীঘ্রই একটি আইন প্রণয়ন করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই পরিকল্পনায় নগর ও গ্রামভিত্তিক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে। গ্রামভিত্তিক ব্যবস্থায় দেশের সর্বত্র যে সমস্ত অনাবাদী জমি পতিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে তাতে ফলের চারা ও বিভিন্ন গাছ-গাছালি বা উপযোগিতা অনুসারে ফসলের চাষের ব্যবস্থা করতে হবে।
শহর ও নগরভিত্তিক ব্যবস্থায়ও কোনো এলাকায় পতিত জমি ফেলে রাখা যাবে না। গৃহনির্মাণের উপযোগী জমিগুলোতে হয় গৃহনির্মাণ নয়তো ফলমূলের বা সবজির চাষ করতে হবে। অন্যথায় পতিত জমির উপর কড়া কর ধার্য করা হবে বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, এই পরিল্পনার একটা সুদূরপ্রসারী ফল আশা করা যায়। প্রথমতঃ পতিত জমিতে গৃহনির্মাণ করলে নগর-বন্দর ও শহরকেন্দ্রিক জীবনে বাসস্থান সংকট কিছুটা হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়তঃ পতিত জমিগুলোতে ফলমূলের চাষ করলে তা জনসাধারণের কাজে আসবে এবং ক্রমে দেশীয় অর্থনীতিতে তার একটা ভূমিকা গড়ে উঠবে। অর্থাৎ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটা বিরাট অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা দেখা দেবে এবং তা দিয়ে দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার পথ প্রশস্ত হবে।
উল্লেখিত পটভূমির প্রেক্ষিতে দেশের সর্বত্র পতিত ও অনাবাদী জমি কাজে লাগাবার বিধি আরোপ করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট মহল প্রশংসার দাবী করতে পারেন। তবে শেষ কথা এই যে, এই উদ্যোগ যেন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ না থেকে যায়। দেশবাসী আশ্বাস পায় এমন কর্মের দ্বারা এই পরিকল্পনার কাজ বাস্তবায়িত হচ্ছে—তাই দেখতে চাই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন