You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুক্তিযুদ্ধ দেশে-বিদেশে
১৯৭০-এর ডিসেম্বরে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ঘটে। মােটকথা, আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে বাংলাদেশের অন্যান্য অর্থনীতিবিদের সঙ্গে আমি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বঞ্চনার বিস্তার চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে বাঙালি অর্থনীতিবিদেরাই ছিলেন পুরােভাগে। এই বঞ্চনার মূলে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবৃন্দ। ১৯৬০ সালে প্রায় পুরাে বছর ধরেই আমি অর্থনীতির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক অসমতা বিষয়ে আমার দর্শন বিভিন্ন সমাবেশে এবং বিভিন্ন জার্নাল ও জনপ্রিয় প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করতে থাকি। আমি সােচ্চার ছিলাম এটি দেখাতে যে এক পাকিস্তান রাষ্ট্রে ছিল দুটো পৃথক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। আমার এসব দর্শন ব্যাপক প্রচার লাভ করে এবং আমি আমার অন্যান্য সহকর্মীর মতােই পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠীর কুনজরে পড়ি বাঙালি অর্থনীতিবিদদের এসব দর্শন পাকিস্তানের রাষ্ট্রনিয়ন্তাদের দারুণভাবে আঘাত করে। এর মূল কারণ ছিল বিভিন্ন কমিটি ও সেমিনারে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক দর্শন প্রচার করতাম। ১৯৬০ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার জন্য আয়ােজিত সেমিনারে আমি অধ্যাপক নূরুল ইসলামসহ যােগ দিই। একই বছর দ্বিতীয় পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদদের প্যানেলে অধ্যাপক আখলাকুর রহমান, মােশাররফ হােসেন ও আমি জড়িত ছিলাম।
১৯৬১ সালের অর্থ কমিশনে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ছিলেন সদস্য এবং আমি ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের উপদেষ্টা। ১৯৬৫ সালের তৃতীয় পরিকল্পনায় অর্থনীতিবিদদের প্যানেলে মােশাররফ হােসেন ও আমি ছিলাম সদস্য। ১৯৭০ সালের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অধ্যাপক মাযহারুল হক, নূরুল ইসলাম, আখলাকুর রহমান, আনিসুর রহমান ও আমি ছিলাম সদস্য। ফলে এসব অনুষ্ঠানে অর্থনৈতিক নীতি ও কৌশল নিয়ে পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে পাকিস্তানের পরিকল্পনাবিদ ও শাসকগােষ্ঠীর স্পষ্ট মতবিরােধ ও তিক্ততার সৃষ্টি হয়। ১৯৬৯-৭০ সালে যেহেতু আমি ছিলাম সাপ্তাহিক ফোরাম-এর নির্বাহী সম্পাদক, ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বঞ্চনার বিষয়টি নিয়ে আমার দর্শন জনসমক্ষে প্রকাশ করতে শুরু করি। শুধু তা-ই নয়, প্রকাশিত এসব রচনায় আমি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া এবং তার প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমেদকেও জড়িত করি। বাংলাদেশের অধিকার আদায়ে জনগণের অবস্থান তৈরিতে বাঙালি অর্থনীতিবিদদের কর্মকাণ্ড বা গবেষণা অবিলম্বে তাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক আন্দোলনে আরও সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ফেলে। আমাদের কেউ কেউ অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে আলাপ-আলােচনাও চালিয়ে যেতে শুরু করেন।
 
বলা দরকার, আওয়ামী লীগের ছয় দফা আমাদের বিভিন্ন রচনার দ্বারা ছিল দারুণভাবে প্রভাবিত। যদিও আমি যতটুকু জানি, ছয় দফা রচনায় কোনাে অর্থনীতিবিদ অংশ নেননি। ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে পিন্ডিতে গােলটেবিল বৈঠকের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমােরেন্ডাম প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে তাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুর রহমান ও অধ্যাপক ওয়াহিদুল হককে দায়িত্ব দেন। এই বৈঠকেই তিনি মেমােরেন্ডামটি উপস্থাপন করেন। ১৯৭০ সালের গ্রীষ্মকালে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, ড. এ আর খান, ড, স্বদেশ বসু, ড. হাসান ইমাম ও আমি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টো রচনার উদ্দেশ্যে ড. কামাল হােসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এই মেনিফেস্টোটির মৌলিকত্ব ও বিশ্লেষণযােগ্য বিষয়গুলাের জন্য কিছুটা হলেও এই গােষ্ঠীর অবদান রয়েছে। যা-ই হােক, ১৯৭০-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের অংশগ্রহণ ছিল চরম আবেগপূর্ণ। ‘৭০ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়ের পরপরই বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও উপযােগী একটি সংবিধানের খসড়া তৈরির কাজকে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ, এই ছয় দফা দাবি নিয়েই আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারে নেমেছিল। তিনি সংবিধান ও শাসনকার্যে এর ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করতে চাইছিলেন, যাতে নির্বাচনী বাগাড়ম্বরের বাইরে ছয় দফা কর্মসূচিকে রাখা যায় এবং একে সমঝােতার আলােচনায় ও জাতীয় সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন করা যায় । বঙ্গবন্ধু প্রকৃতপক্ষে দেশের জন্য একটি সুচিন্তিত ও কার্যকর সাংবিধানিক কর্মসূচিই প্রদান করতে চাইছিলেন।
 
নির্বাচনের পরবর্তী মাসগুলােতে সংবিধান নিয়ে আলােচনার জন্য অনেক বৈঠকে বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু । এই বৈঠকগুলােয় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। তাঁদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ ও ড. কামাল হােসেন ছাড়াও ছিলেন অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক সারওয়ার মাের্শেদ, অধ্যাপক আনিসুর রহমান ও আমি। এই বৈঠকগুলাে সাধারণত অনুষ্ঠিত হতাে বুড়িগঙ্গা নদীর কাছাকাছি একটি বাড়িতে। প্রায় দিনব্যাপী এসব গভীর আলােচনায় অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক আলােচক ছাড়াও ড. কামাল হােসেন খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। যা-ই হােক, তাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন শান্ত, কিন্তু সহযােগিতার ক্ষেত্রে সৃজনশীল । জটিল টেকনিক্যাল বিষয়গুলাে ধারণ করার ক্ষেত্রে তার ছিল অসাধারণ ক্ষমতা, দ্বান্দ্বিক দক্ষতা ও গভীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। বঙ্গবন্ধু নিজেও। ছিলেন খুবই সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তার আলােচনায় আমাদের যে লাভটি হতাে তা হচ্ছে, তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং প্রখর কমনসেন্স। একসময় দলটি তার আলােচনা ও চর্চায় সমাপ্তি টানল। আওয়ামী লীগ সংবিধানের একটি খসড়া দাড় করিয়ে ফেলল এবং তার সমঝােতার অবস্থানও পুরােপুরি তৈরি করে ফেলল। যাতে ভবিষ্যতে প্রয়ােজনে রাজনৈতিক আলােচনায় ব্যবহার করা যায়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের অনুরােধে এক আকস্মিক ভ্রমণে আমি পশ্চিম পাকিস্তানে যাই। সেখানে যাওয়ার মূল কারণ ছিল। এটা নিশ্চিত হওয়া যে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল সংবিধান বিষয়ে সত্যি সত্যি কিছু ভাবছে কি না বা ছয় দফা কর্মসূচিকে গ্রহণ করার ব্যাপারে কোনাে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না। লাহােরে এই ভ্রমণে আমি আলাদা আলাদাভাবে পিপিপির ড. মুবাশের হাসান ও মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরির সঙ্গে দেখা করি। তারাই বলতে গেলে ছিলেন দলের মাথা।
 
কিন্তু তারা এমন কোনাে ইঙ্গিত দিলেন না যে তারা সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে গভীরভাবে কিছু ভাবছেন। বরং তারা জাতীয় ঐক্যের বিষয়েই কিছু বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তা আমাকে শুনিয়ে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর আমি বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে পারি যে তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় উচ্চারিত আমার কিছু মন্তব্য কাসুরির মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক গােয়েন্দাদের কাছে পৌছায় এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ড. কামাল হােসেন যখন তাদের কাস্টডিতে ছিলেন, তখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় সামরিক | গােয়েন্দারা এগুলাে কাজে লাগায়। যা-ই হােক, এরপর আমি লাহাের থেকে করাচি যাই। সেখানে আমি ব্যারিস্টার রফি রাজার সঙ্গে বিস্তারিত আলােচনা করি। তিনি তখন ভুট্টোর সংবিধানবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিলেন। রাজার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম যে আগামী সংসদ অধিবেশনের জন্য সংবিধানের খসড়া তৈরির কাজে ভুট্টো তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি এই বিশাল কাজটির খুব সামান্যই তখন সম্পাদন করেছেন। কারণ, ভুট্টো নিজে সংবিধান রচনার সূক্ষ্ম বিষয়গুলাের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নন। ভুট্টোর একজন প্রিন্সিপাল লেফটেন্যান্ট আবদুল হাফিজ পীরজাদার সঙ্গে আলােচনার পর আমি বিষয়টি সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হলাম। ঢাকায় ফিরে এসে আমি বঙ্গবন্ধুকে জানালাম যে পিপিপি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক আলােচনার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছে।

 
বিষয়টি সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হওয়া গেল যখন ১৯৭১ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে পিপিপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে ভুট্টো ঢাকায় এলেন। তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে আমি এসব কথাও জানতে পারলাম যে পিপিপি ছয় দফার ভিত্তিতে গঠিত সংবিধানের ব্যবহার ও কার্যকারিতা নিয়ে আলাপ-আলােচনার চেয়ে তাদের ক্ষমতার ভাগ নিয়ে আলােচনা করতে বেশি উৎসাহী। পিপিপি নেতারা যখন ঢাকায় ভ্রমণ করছেন, তখন আমি রফি রাজা ও মুবাশের হাসান ছাড়াও সংস্কারপন্থী পিপিপি নেতা, যেমন মেহরাজ মােহাম্মদ খান—তাঁদের সঙ্গে আলােচনায় বসি। কিন্তু আমাদের আলােচনা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগােনাের বদলে আপাতদার্শনিক বিষয়গুলােতেই ঘুরপাক খেল। পিপিপি-আওয়ামী লীগের আলােচনা প্রসঙ্গে বিস্তারিত তথ্য আমার চেয়ে অন্যরাই ভালাে দিতে পারবেন, যদিও ঘটনার প্রধান নায়কদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। যা-ই হােক, আমার নিজের ধারণা, পিপিপি বা ইয়াহিয়া খানের কেউই একাত্তরের ১ মার্চের আগে ছয় দফা বিষয়ে সমঝােতামূলক অবস্থান তৈরির ব্যাপারে কোনাে প্রচেষ্টা নেয়নি। আমি যত দূর জানি, ছয় দফা কার্যকর করার ক্ষেত্রে উদ্ভুত সংকট নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি কোনাে রাজনৈতিক নেতা ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনাে বৈঠকই অনুষ্ঠিত হয়নি। অথচ ‘৭১-এর মার্চের মধ্যরাতে যখন এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা হলাে, সাংবিধানিক ব্যাপারটি তখন ছয় দফার বাইরেই থাকল। জেনারেলরা ততক্ষণে রক্তপাত ও বুলেটের মাধ্যমেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
 
মার্চের আগের উত্তেজনাপূর্ণ সময়গুলােতে ফোরাম-এ আমার লেখাগুলাে প্রকাশ করি, এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এগুলােতে আমি এটাই বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি যে কীভাবে ছয় দফা দাবিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায় এবং কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতাদের জন্য এই দাবিগুলাে কার্যকর না হয়ে মুখথুবড়ে পড়ে আছে। ফোরাম এর কলামে আমার লেখাগুলাের শাশ্বত বাণী যেটি ছিল, সেটি হচ্ছে ছয় দফা দাবিই পাকিস্তানি  সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সর্বশেষ সুযােগ। এটি ছাড়াও ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণ-আন্দোলনের দিকনির্দেশনা। খুব কম বাঙালিই সে সময় মানসিকভাবে পাকিস্তানি ধ্যানধারণা আঁকড়ে ছিল। তাদের সামনে একটিই প্রশ্ন ছিল, কীভাবে ঘটবে এই ভিভক্তি—সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায়, নাকি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে? ১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘােষণা দিলেন, তখনই আমার মনে হয়েছিল যে এটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণ। ঠিক সেদিনই সারা বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দিলেন, সেটা ছিল প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ অংশে পাকিস্তান সরকারের ক্ষমতাকে অস্বীকার করা। এরপর সেই রাজনৈতিক ক্ষমতা তারা আর কখনােই ফিরে পায়নি। একাত্তরের ২৬ মার্চের পর পাকিস্তান সরকার তার ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। বলে বাংলাদেশের জনগণ দেখেছিল, তার সবটাই তারা দেখেছে বিদেশি সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া হিসেবে।
 
অসহযােগ আন্দোলনের যে ডাক দেওয়া হয়, তার পুরাে সাফল্যই অতিদ্রুত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এক সংকটের সৃষ্টি করে। একবার যখনই বেসামরিক প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও আইন প্রয়ােগকারী সংস্থাগুলাে বঙ্গবন্ধুর অসহযােগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিল, ঠিক তখনই ব্যাপারটা এমন দাড়াল যে বাংলাদেশে পাকিস্তান সরকার আক্ষরিক অর্থেই সেনানিবাসগুলাের বাইরে প্রশাসনিকভাবে একেবারে অকেজো হয়ে পড়ল। এই শূন্যতা পূরণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ল, যদিও দেশের সামাজিক জীবনপ্রক্রিয়া পুরােপুরি ভেঙে পড়েনি তখনাে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুই যেন হয়ে পড়লেন সারা দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ। কেননা, তিনি। একাত্তরের ৬ মার্চ বরং ইয়াহিয়া খানকেই নির্দেশ দিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। ১৭৫৭ সালের যুদ্ধের পর সেদিনই ছিল সম্ভবত প্রথম দিন, যেদিন বাঙালিরা নিজেরাই এ অঞ্চলের শাসনভার হাতে তুলে নিল। এ সময় বাংলাদেশের কিছু অর্থনীতিবিদ দেশের অর্থনীতি সচল রাখার ক্ষেত্রে যে সমস্যার সৃষ্টি হলাে, তাতে খুব বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়লেন। আর এ সমস্যাগুলাের মধ্যে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রদত্ত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের নিয়ন্ত্রণ, পাকিস্তানের টাকশাল থেকে পাকিস্তানি মুদ্রার সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে স্টকের পরিমাণ, রপ্তানিনীতি, অর্থ পরিশােধের নীতিমালা, কাঁচামালসহ প্রয়ােজনীয় পণ্য আমদানি ইত্যাদি ঠিক রাখা।
 
ধানমন্ডিতে অবস্থিত অধ্যাপক নূরুল ইসলামের বাসভবন রীতিমতাে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের অর্থ সচিবালয়ে পরিণত হলাে। আর ড. কামাল হােসেনের সার্কিট হাউসের বাসভবন হয়ে উঠল প্রশাসনের তৃতীয় কেন্দ্র। আমাদের অনেকে প্রতিদিনই অধ্যাপক নূরুল ইসলামের বাড়িতে নির্দিষ্ট সমস্যাবলি বিশ্লেষণের জন্য মিলিত হতেন। সেখানে তাদের সঙ্গে থাকতেন বেশ কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যাংকার। তাদের অনেকে ছিলেন সরকারি কর্মচারী ও ব্যাংক কর্মচারীদের কাছে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ পৌছানাের দায়িত্বে নিয়ােজিত। আর ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে বা কামাল হােসেনের বাড়িতে তাজউদ্দীন ও কামাল হােসেন প্রতি সন্ধ্যায় মিলিত হতেন প্রচারসংক্রান্ত আলাপ-আলােচনার জন্য। স্থানীয় অর্থনীতি বিশ্লেষণ ও তার সমাধানের চেষ্টা ছাড়াও আমাদের আরেকটি দায়িত্ব ছিল আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলােকে আমাদের ইস্যুগুলাে জানানাে। প্রতিদিনই বিদেশি সংবাদ সংস্থাগুলাের বাঘা বাঘা সাংবাদিক আসতেন এসব বৈঠকে তাদের মধ্যে ছিলেন দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর টিলমান ও পেজি, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর আরেক সাংবাদিক সিডনি স্যানবার্গ, যিনি মুক্তিযুদ্ধের কাভারেজ দেওয়ার কারণে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঢাকা থেকে। বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, এখন এই পত্রিকার সম্পাদক; গার্ডিয়ান-এর মার্টিন এডেনি, টাইমসূএর পিটার হ্যাজেলহা, ওয়াশিংটন পােস্ট-এর সেলিং হ্যারিসন এবং ওয়াশিংটন স্টার-এর হেনরি ব্রাডশার। এসব অভিজ্ঞ সাংবাদিকের সবাই প্রতিদিন ঢাকা থেকে তাঁদের নিজ নিজ পত্রিকাগুলােয় নিয়মিত খবর পাঠাতেন, যাতে তাদের পাঠকেরা বাংলাদেশে ক্রমশ প্রকাশ্য হয়ে উঠছে যে নাটক, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন।  পিটার হ্যাজেলহা আমাকে জানিয়েছিলেন যে তিনি কিছুদিন আগে লারকানায় ভুট্টোর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এই সাক্ষাৎকারে ভুট্টো তাকে বলেছেন যে বাংলাদেশে কিছু শহরে রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে যে বিক্ষোভ সংঘটিত হচ্ছে, তা আসলে চায়ের কাপের ঝড়মাত্র। ঢাকার বিক্ষোভকারীদের ওপর সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে যে হত্যা ও সন্ত্রাস চালানাে হচ্ছে এবং নেতাদের অনেককে জেলে নেওয়া হচ্ছে, তা বিক্ষোভের মাত্রাকে কমিয়ে আনবে এবং আরও যুক্তিসংগত আপস-মীমাংসার আবহাওয়া সৃষ্টি করবে। বুদ্ধিদীপ্ত এই কথাগুলাে যেন বেদবাক্য, যা ভুট্টো সম্ভবত ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যােগসাজশ করেই বলেছেন।
 
আর এই পুরাে ধারণাটিই মিথ্যে প্রমাণিত হয় যখন ‘৭১ সালের ২৫ মার্চ তারা রাস্তায় সেনাবাহিনী নামিয়ে দেয় সামরিক অভিযান চালানাের উদ্দেশ্যে। এ সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল ইয়াসিন এবং টিঅ্যান্ডটির এস হুদা—যারা উভয়েই ছিলেন পরস্পরের ভায়রা, নিয়মিত অধ্যাপক নূরুল ইসলামের বাসায় আসা-যাওয়া করতেন। কর্নেল ইয়াসিন ঢাকায় পাকিস্তানি। সেনাদের সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন। কাজেই তিনি এ রকম একটি অবস্থানে ছিলেন যে তিনি ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহকারীদের তালিকা পাঠাতে পারতেন। খাদ্য সরবরাহকারীদের এই তালিকা রাজনৈতিক দলের স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়, যারা পরে এই সরবরাহকারীদের সঙ্গে দেখা করে এবং ক্যান্টনমেন্টে খাদ্য সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রভাবিত করে। ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানের পর এসব কর্মকাণ্ডের জন্যই তাদের ওপর চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। কর্নেল ইয়াসিন ও হুদাকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে নিয়ে যায়। হুদাকে আটক করা হয় ঢাকায় এবং এখানে তাকে ভয়ংকর নির্যাতন করা হয় জিজ্ঞাসাবাদের সময় । প্রচণ্ড নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তাকে এই স্বীকারােক্তি দিতে বাধ্য করা হয় যে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম এবং আমার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তিনি আওয়ামী লীগের জন্য ভারতের সঙ্গে একটি টেলিযােগাযোেগ-ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা চালচ্ছিলেন। সম্পূর্ণ সাজানাে এই মামলা পরে একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর বিচারের সময় তার বিরুদ্ধে চার্জশিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কার্নেল ইয়াসিন আরও দুর্ভাগ্যের শিকার হন। তাকেও আটক করা হয় এবং পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লাহােরে। সেখানে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয় জিজ্ঞাসাবাদের সময় এবং বঙ্গবন্ধুর বিচারের সময় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তাকে বাধ্য করা হয়। এ দুজনই এ রকম দুর্ভাগ্যের শিকার হন স্রেফ অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ও আমার সঙ্গে মার্চের সেই দিনগুলােতে জড়িত থাকার কারণে ইয়াহিয়া ও মুজিবের সঙ্গে যখন আপস-মীমাংসা চলছিল, সে সময় আওয়ামী লীগ দলের সঙ্গে আমাদের অনেককে যুক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগ দলের সঙ্গে যুক্ত অন্যদের মধ্যে ছিলেন নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামাল হােসেন প্রমুখ।
 
এই দলের যা করার কথা ছিল তা হচ্ছে ইয়াহিয়ার বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে একটি মধ্যবর্তী সাংবিধানিক ব্যবস্থার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌছানাে। ইয়াহিয়া খানের বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন মেজর জেনারেল পীরজাদা, জাস্টিস কর্নেলিয়াস ও এম এম আহমেদ। আমরা প্রতিটি বৈঠকের পরই আওয়ামী লীগের দলটির সঙ্গে আলােচনায় বসতাম ইয়াহিয়ার দল যেসব পরামর্শ দিত সেগুলাের নােট নেওয়ার জন্য। এ ছাড়া আমাদের দায়িত্ব ছিল জবাব তৈরি করা বা আমাদের দলের পক্ষ থেকে বিকল্প ভাষ্য প্রস্তুত করার। এ বৈঠকগুলাে হতাে খুবই দীর্ঘ সময় ধরে, যেখানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত থাকতেন বঙ্গবন্ধু । এর মধ্যে একটি ছিল চরম পরিণতিমূলক বৈঠক, যেটি অনুষ্ঠিত হয় মতিঝিলে ড. কামাল হােসেনের চেম্বারে এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এবং এর উপদেষ্টাগণ। তাঁরা সবাই পরের দিনের আলােচনায় ঐকমত্যের চূড়ান্ত অবস্থান খাড়া করার জন্য সারা রাত কাজ করেন। বৈঠকে আমাদের শেষ অংশগ্রহণ ছিল আগের দিন রাতে তৈরি করা। প্রস্তাবাবলির ওপর এম এম আহমেদ নিজের হাতে সেসব সংশােধন করেছেন তা নিয়ে বসা। ইয়াহিয়ার দল চূড়ান্ত যে অবস্থান নেয় তাতে এটুকু ইঙ্গিত ছিল যে অন্তত অর্থনৈতিক ইস্যুগুলাের ক্ষেত্রে হয়তাে-বা একটি সিদ্ধান্তে পৌছানাে যাবে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, ২৪ মার্চ জেনারেল পীরজাদা ঐকমত্যে পৌছানাের জন্য শেষ বৈঠকে সমবেত হতে আমাদের আহ্বান জানাবেন। এমনকি পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি ঘােষণাও তিনি দেবেন। পরবর্তী দুদিন আমাদের এই অপেক্ষাতেই কাটল যে তিনি এই বৈঠক ডাকবেন। কিন্তু আমরা ২৫ তারিখেই জানতে পারলাম যে এম এম আহমেদ আগের দিন রাতেই পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গেছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, তিনিও এ বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু আকস্মিকভাবেই হয়তাে পীরজাদা তাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তার কাজ শেষ হয়ে গেছে এবং তিনি জাস্টিস কর্নেলিয়াসের সঙ্গে ঢাকা ত্যাগ করতে পারেন।
 
আপস-মীমাংসার সারসংক্ষেপ এখানে আর আলােচনা করছি না এ জন্য যে পরে সে বছরই সাউথ এশিয়ান রিভিউর জন্য লেখা আমার নিবন্ধ নেগােশিয়েটিং ফর বাংলাদেশ’-এ আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা ও ধারণার ইঙ্গিত দিয়েছি। ড. কামাল হােসেনও আলাদাভাবে এ বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেছেন, যেটি আরও নির্ভরযােগ্য। উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যেও যে প্রগতিশীল আবহ থাকে, ঐকমত্যের প্রক্রিয়া ক্রমশ তার বিরুদ্ধেই যাচ্ছিল। কেননা, প্রতিদিনই বাংলাদেশের সেনানিবাসগুলােতে পাকিস্তানি সেনাদের সমাবেশ ঘটানাে হচ্ছিল। সম্ভবত মার্চের শেষ সপ্তাহে মঈদুল হাসান নামে আমাদের এক বন্ধু আমাকে জানালেন যে বঙ্গবন্ধুকে দেওয়ার মতাে তাঁর কাছে একটি জরুরি মেসেজ আছে, যেটি তিনি ক্যান্টনমেন্টের একটি সূত্র থেকে পেয়েছেন। সে সময় তিনি এই সূত্রের নাম প্রকাশ না করলে পরে তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে এই সূত্রটি হচ্ছেন এয়ার ভাইস মার্শাল খােন্দকার। সে সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের গ্রুপ ক্যাপ্টেন। যা-ই হােক, একদিন রাত দশটায় আমি মুঈদকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিয়ে গেলাম, যেখানে তিনি তাঁর সেই মেসেজটি বঙ্গবন্ধুকে দিলেন। মেসেজটি আর কিছুই নয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সামরিক অভিযান চালানাের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সম্ভবত তারা যুদ্ধ করার জন্যই তৈরি হচ্ছে।  যখন আপস-মীমাংসার সময় চলছিল, তখন আমার সুযােগ হয় পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) কয়েকজন নেতার সঙ্গে দেখা।
 
করার। যত দূর মনে পড়ে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন এনডব্লিউএফপির আবদুল ওয়ালি খান এবং বেলুচিস্তানের গাউস বক্স বেজেনজো। তারা ছিলেন দৈনিক সংবাদ এর মালিক আহমদুল কবিরের সঙ্গে। ওয়ালি খান ও বেজেনজো দুজনই আমাকে তাদের এই আশঙ্কার কথা জানালেন যে ইয়াহিয়া, মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যকার আলােচনার অর্থই হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র প্রদেশগুলাের স্বার্থকে অগ্রাহ্য করা। পাঠান ও বেলুচদের এই আশঙ্কার বাস্তব কারণ হচ্ছে, ভুট্টো এসব আলােচনার মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর পুরাে সুবিধাই দাবি করছেন। আর এই সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে তার শক্তি হচ্ছে পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পূর্বাঞ্চলের জন্য মুজিব যে স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছেন, তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ভুট্টোও স্রেফ পাঞ্জাব সিন্ধু নয়—পুরাে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান নির্বাহী হতে চাইছেন। অথচ এই পিপলস পার্টি এনডব্লিউএফপি ও বেলুচিস্তানের দুটো নির্বাচনী এলাকাতেই এ দুটি দলের কাছে পরাজিত হয়েছে। ভুট্টো ভয় পাচ্ছিলেন যে সংসদে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাঠান ও বেলুচদের জায়গা করে দেবে এবং কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে পিপলস পার্টিকে একবারে সরিয়ে দেবে।
 
এ ছাড়া তার ভয়, এ পরিস্থিতি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলােকে স্বায়ত্তশাসনের দিকে এগিয়ে দেবে, যা তাদের পাঞ্জাবি নেতৃত্ব থেকেও একসময় সরিয়ে দিতে পারে। ন্যাপ নেতারা এদিকে ভয় পচ্ছিলেন যে পূর্বাঞ্চলে পুরাে কর্তৃত্ব পাওয়ার জন্য মুজিব হয়তাে পশ্চিম পাকিস্তানের ছােট অঞ্চলগুলাের স্বায়ত্তশাসনের মূল্যে ভুট্টোকে পশ্চিমাঞ্চলের পুরাে কর্তৃত্ব পাওয়ার সুযােগ তৈরি করে দিতে পারেন। যেহেতু এ রকম ঘটছে, কাজেই মুজিবের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁদের অশঙ্কা কিছুটা প্রাতিষ্ঠানিকই ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসনে তাদের স্বায়ত্তশাসন হারানাের ভয়, প্রথমত ভুট্টোর এবং তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বে শুধুই কিছু ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণিত হওয়ার অপেক্ষায়। আমার মন বলছিল, পাকিস্তানি জেনারেলরা দুমুখাে খেলা খেলছে। যারা আসলে আপস-মীমাংসার নামে স্রেফ সময় নিচ্ছে বাংলাদেশের সেনানিবাসগুলােয় তাদের সেনা-সমাবেশ বাড়ানের জন্য। ২৪ মার্চ ন্যাপ নেতৃবৃন্দ ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত ছােট দলগুলাের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সবাই ঢাকা ত্যাগ করলেন। তাঁরা ইঙ্গিত দিলেন, ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে তারা পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ পেয়েছেন। তারা আরও ইঙ্গিত দিলেন যে। সামরিক অভিযানের আর বেশি দেরি নেই। ২৫ মার্চ বিকেলে পাঁচটা কি ছয়টার দিকে তারিক আলীর বাবা মাজহার আলী খান এবং একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক যিনি ফোরাম এ প্রায়ই কলাম লিখতেন, তাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে গেলাম। সে সময় পুরাে বাসভবন ছিল সাংবাদিকে পরিপূর্ণ। তারা নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছেন, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আলােচনার সমস্ত পথ এখন রুদ্ধ। মাজহার আলী খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন। আমি তাকে তার কাছে নিয়ে গেলাম। আমার এ ধারণা ছিল যে সেখানে গিয়ে আমি প্রচণ্ড ভিড় দেখতে পাব—যেমন দেখি আমি বরাবর। বঙ্গবন্ধু মাজহারকে চিনতেন সেই সময় থেকে, যখন তিনি পাকিস্তান টাইমস-এর সম্পাদক ছিলেন। সে সময় এর মালিক ছিলেন মিয়া ইফতেখার উদ্দিন। বঙ্গবন্ধু তাকে বেশ উষ্ণতার সঙ্গেই অভ্যর্থনা জানালেন এবং তার ঘর খালি করে ফেললেন যাতে আমরা দুজন তার সঙ্গে কথা বলতে পারি। বঙ্গবন্ধু আমাদের জানালেন, সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তারা কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
 
তিনি কথা বলে যাচ্ছিলেন, আমি স্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার চেষ্টা করছি, ইয়াহিয়া মনে করেছে যে আমাকে হত্যা করলেই সে আন্দোলন ধ্বংস করে দিতে পারবে। কিন্তু সে ভুল করছে। আমার কবরের ওপর স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হবে। | বঙ্গবন্ধুর আচরণে তাঁকে বরং অদৃষ্টবাদী মনে হচ্ছিল, কারণ তিনি যেন তার সম্ভাব্য অকালমৃত্যুকে মেনেই নিয়েছেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বললেন যে নতুন প্রজন্ম এই স্বাধীনতাসংগ্রামকে এগিয়ে নেবে। এই বৈঠকের পরপরই মাজহার আলী খান কোনাে কোনাে পিপিপি নেতা যে আসন্ন রক্তপাত বিষয়ে বলেছেন, সে সম্পর্কে আলােচনা করলেন। ৩২ নম্বর থেকে আমরা মাহমুদ আলী কাসুরির সঙ্গে দেখা করার জন্য গেলাম হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। স্বভাবসুলভ তর্জন-গর্জনের বদলে কাসুরি সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের। অভ্যর্থনা জানাতে জানাতেই অভিযােগ করলেন, “এটা এখন স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগ কোনাে সমঝােতা চায় না। অথচ আমি জানি যে একটি খসড়া চুক্তিপত্র পত্রপত্রিকায় ঘােষণা দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে এখন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথেকে তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত হলেন তিনি জানালেন, জেনারেল পীরজাদা তাকে বলেছেন। আবার সেই পীরজাদা, যিনি আপস-মীমাংসার একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব এটা ইতিমধ্যে প্রমাণিত যে তারা পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতাদের অন্য গল্প শােনাচ্ছে এবং এদিকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ভিত্তি প্রস্তুত করছে। কাসুরি বলে যাচ্ছিলেন, রাষ্ট্রের ঐক্য এখন বিপন্ন এবং এ পরিস্থিতিতে যদি প্রয়ােজন পড়ে তাহলে একই পদ্ধতিতে রক্তপাত ঘটানাে হবে, যেভাবে লিংকন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐক্য রক্ষা করার জন্য একটি গৃহযুদ্ধের মােকাবিলা করেছিলেন।
 
আমি কসুরির ওখান থেকে চলে এলাম এটা মনে রেখে যে তিনি ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেলের যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালের একজন খ্যাতনামা বিচারক, যিনি ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণহত্যাকে তুলে ধরেছিলেন। যদি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের ওপর কঠোর ব্যবস্থার নামে গণহত্যা চালায়, আমি আশা করি যে তিনি ভিয়েতনামিদের জন্য যা করছিলেন, সেভাবেই বাঙালিদের পক্ষে সােচ্চার হবেন।  পাকিস্তানি জেনারেলদের দ্বিমুখী তৎপরতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই আমি সার্কিট হাউস রােডে কামাল হােসেনের বাড়িতে গেলাম তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। আমি তাকে এই মেসেজটাই দিতে গেলাম যে পীরজাদা নিশ্চয়ই পিপিপি নেতাদের কাছে আলােচনার সময় বানিয়ে কিছু বলেছেন এবং এখন তারা সামরিক অভিযানের জন্য রীতিমতাে প্রস্তুত। সেখান থেকে আমি গুলশানে আমার বাসায় গেলাম। সেখানে পৌছেই আমি সামরিক তৎপরতার খবর পেলাম। চিহ্ন হিসেবে দেখলাম কোনাে কোনাে সড়কে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা বড় বড় ইটপাথর দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করেছে।
 
রাত ৯টা-১০টার দিকে আমরা প্রথম কামানের গােলার শব্দ শুনতে পেলাম। এই গােলার শব্দ আমাদের বুঝিয়ে দিল যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইপিআর ও পুলিশ ব্যারাকগুলােতে তাদের সামরিক হামলা শুরু করে দিয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে ফোন করলাম এটা জানতে যে বঙ্গবন্ধু নিরাপদে আছেন কি না। আমি জানি না, ফোনে কে জবাব দিয়েছিলেন, তবে ফোনে কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলাে তিনি আশপাশেই আছেন। হঠাৎ অপর প্রান্ত নিশ্ৰুপ হয়ে গেল এবং এর কিছুক্ষণ পরই সমস্ত টেলিফোন লাইন ডেড হয়ে গেল। পরবর্তী ৩৬ ঘণ্টা আমরা কামানের গােলা আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের শব্দ শুনলাম। সেনা অভিযানে সেনাদের অস্ত্রের আগুনের হলকা দেখলাম এবং অবশেষে ২৬ মার্চ ইয়াহিয়ার ঘােষণা শুনলাম। আমাদের সবার কাছে তখন এ বিষয়টি স্পষ্ট যে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তবে এটা স্পষ্ট নয়, কবে এ যুদ্ধ শেষ হবে। পরবর্তী ৩৬ ঘণ্টা গুলশানে আমাদের বাড়িতে বন্দী থেকে টেলিফোন যােগাযােগবিহীন অমরা শুধু গােলাগুলির শব্দই শুনেছি। ২৭ মার্চ সকালে প্রথমবারের মতাে সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়া হলাে। কয়েকটি কারণে আমি প্রথমেই হাঁটতে হাঁটতে গুলশানে ফোর্ড ফাউন্ডেশন গেস্টহাউসে গেলাম। সেখানে থাকেন ড্যানিয়েল থার্নার। থার্নার একজন ভিজিটিং স্কলার। তিনি সরবােন থেকে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসে এসেছেন। আমি তার গাড়িতে করে আমাকে অবিলম্বে ধানমন্ডি নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরােধ করলাম।
 
সেখানে যাওয়ার একটাই কারণ, এটা নিশ্চিত হওয়া যে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম নিরাপদে আছেন কি না। যখন বাড়িতে ফিরে এলাম, দেখলাম আমার বন্ধু মুঈদুল হাসান ও পাকিস্তান টোব্যাকোর এ আলম আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। মুঈদ চাইলেন যাতে আমি তক্ষুনি আমার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই। তার মতে, সেনাবাহিনী ব্যাপক হারে গণহত্যা শুরু করেছে। তিনি কামাল হােসেনের বাড়িতে যােগাযােগ করেছিলেন এবং যােগাযােগ করতে গিয়ে জানতে পেরেছেন। যে তাকে আটক করার জন্য সেনাবাহিনী তার বাড়িতে অবস্থান করছে এখন। কিন্তু যাকে আটক করার জন্য সেনারা গেছে, সেই কামাল বাড়িতে নেই। | আমি নিজকে অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি যে আমি সেনাবাহিনীর টার্গেটে পরিণত হতে পারি। যদিও কেউ কেউ এ রকম ধারণা করছিলেন, সেনারা হয়তাে তাদেরই খুঁজবে, যারা সক্রিয় রাজনীতিবিদ। যা-ই হােক, মুঈদ আমাকে পরামর্শ দিলেন, যেন আমি এই সুযােগটা না নিই। তার পরামর্শ ছিল, যেন আমি বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই। বিষয়টি আমি গুরুত্ব দিইনি এটা ভেবে যে আমার উপস্থিতি আমার পরিবারের জন্য কোনাে হুমকি হবে না। কিন্তু আমার স্ত্রীর ধারণা ছিল অন্য রকম। তার ধারণা, যদি কিছু ঘটে, আমার উপস্থিতিই তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আমি না থাকলেই বরং সে যেকোনাে সময় বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারবে, যাতে আমি নিশ্চিন্তে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য কাজ করতে পারি ।
অতঃপর বেশ নিশ্চিন্তেই সেদিন ভােরে আমি আমার পরিবার ছেড়ে গুলশানেই অন্য একটি বাড়িতে চলে গেলাম। বিকেলে মুঈদ আমাকে খবর দিলেন, তিনি ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারগুলােতে গিয়েছিলেন, সেগুলাে এখন গণহত্যার চিহ্ন বহন করছে। জগন্নাথ হলের উল্টো দিকে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ও অধ্যাপক আনিসুর রহমানের ফ্ল্যাটের পুরাে ব্লকের মেঝে ও সিড়ি রক্তে ভেসে যাচ্ছে এবং সেগুলাে রীতিমতাে ধ্বংসভূপে পরিণত হয়েছে। মুঈদ আরও যে দুঃসংবাদটি দিলেন, সেটি হচ্ছে সেনারা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে মেরে ফেলেছে। এ ঘটনা জানার পর আমি খুবই মুষড়ে পড়লাম। কিন্তু এটা এ জন্য নয় যে অধ্যাপক রাজ্জাক আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আমার মুষড়ে পড়ার কারণ, এ ঘটনা এটাই ইঙ্গিত করে যে সেনাবাহিনী তাদের টার্গেট আরও বড় করেছে, তারা হয়তাে এমন লােকদেরও মারবে, যারা সত্যি সত্যি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলির সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন। নতুন যে বাড়িটিতে উঠেছি, ২৭ মার্চ আমি সেখানেই কাটালাম। পরের দিন সকালে মুঈদ আবার দেখা করতে এলেন আমার সঙ্গে। তিনি জানালেন যে কারফিউ জারির ঠিক পরপরই সেনারা আমাকে আটক করার জন্য আমার বাড়িতে গিয়েছিল।
 
পরে আমার স্ত্রীর মুখে শুনেছিলাম, কর্নেল সাইয়িদউদ্দিনের নেতৃত্বে দুই ট্রাকভর্তি পাকিস্তানি সেনা আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল। এই কর্নেল নিজেকে ‘এসল্ট পার্টির নেতা বলে দাবি করছিল। তার বক্তব্য অনুযায়ী এ দলটিই ২৫ মার্চ রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। পাকিস্তানি সেনাদের দলটি যখন আমাদের বাড়িতে আসে তল্লাশির জন্য, । তখন আমার বড় ছেলে তৈমুর বাড়িতেই ছিল। ওর বয়স তখন মাত্র ৮ বছর। কর্নেল সাইয়িদউদ্দিন ওকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করল। কিন্তু সে অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত সেনাদের সামনেও বেশ শান্ত ছিল। আমার স্ত্রী সালমা তৈমুরের জন্যই ভয় পাচ্ছিল। সেনারা যখন আমাদের বাড়ির সামনে এসে থামল, তাদের আওয়াজ পেয়ে সালমা বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালানাের চেষ্টা করছিল। কিন্তু। দুর্ভাগ্য তার, বন্দুকের নল এড়াতে পারেনি ও। কর্নেল সাইয়িদউদ্দিন আমাদের প্রতিবেশীদের কাছেও আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, জানতে চেয়েছিল, আমি কোথায় আছি। যখন সে । জানতে পারল আমি আজ সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি, তখন সে আমার স্ত্রী ও ছেলেদের ধরে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যেতে চাইল। ওর ধারণা ছিল, আমার স্ত্রী-সন্তানদের ধরে নিয়ে গেলে আমার খোঁজ পাওয়া সহজ হবে। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশীরা তাকে এমনভাবে বােঝাল যে সে তাদের বাড়িতে রেখেই। ফিরে গেল। অপারেশনের প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা আমাকে আটক । করতে গিয়েছিল—এটা শুনে আমি বেশ উদ্বেগ বােধ করলাম। কারণ, এ ঘটনা। এটাই ইঙ্গিত করে যে আমিও এখন তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট। মুঈদ। আমাকে ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন। তার । ধারণা, এরপর আমাকে ধরার জন্য বাড়ি বাড়ি সার্চ করা হবে। ফলে যারা আমাকে আশ্রয় দেবে, তাদের জন্যই ব্যাপারটা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। সেটা ছিল এমন একটা পরিস্থিতি যে কী ধরনের লড়াই হবে বা এ যুদ্ধে আমাদের কী ভূমিকা হবে, এ সম্পর্কে আমাদের কোনাে পূর্বধারণা একেবারেই ছিল না। আমি আমার স্ত্রীকে একটি চিরকুট পাঠালাম, যেন সে ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও, সম্ভব হলে দেশের বাইরে চলে যায়। কারণ, সে দেশের বাইরে চলে গেলে স্বাধীনতাযুদ্ধে আমি আরও নিশ্চিন্তে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারব।
 
ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে মুঈদ আমাকে গুলশানে মােকলেসুর । রহমানের (সিধু মিয়া) বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে আমরা নদী পার । হয়ে গেলাম বারাইদ গ্রামে—সিধু মিয়ার শ্বশুর মতিন সাহেবের বাড়িতে। গুলশান থেকে বারাইদ গ্রামের দিকে যেতে যেতে দেখলাম শুধু আমরাই নই, ঢাকা থেকে অসংখ্য লােক গ্রামের দিকে পালাচ্ছে। এই ভিড়ের মধ্যেই আমি আনিসুর রহমানকে দেখতে পেয়ে তাঁর কাছে ছুটে গেলাম। তিনিই আমাকে প্রথম ২৫ ও ২৬ মার্চের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন। তিনি তখন আরও ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিলেন। তিনি জানালেন, কীভাবে সেনারা তাদের ফ্ল্যাটে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে এবং স্ট্যাটিসটিকস বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে গুলি করে মেরেছে। অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা থাকতেন ফ্ল্যাটের নিচতলায়, আর অধ্যাপক মনিরুজ্জামান থাকতেন ফ্ল্যাটের একেবারে ওপরের তলায়। কিন্তু অধ্যাপক রাজ্জাক বেঁচে গেছেন স্রেফ ভাগ্যের জোরে। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ফ্ল্যাটের দোতলায় তার দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল। তিনি দরজা খুলতে খানিকটা দেরি করে ফেলেছিলেন। ফলে দরজা খােলার আগেই বাড়িতে কেউ নেই—এটা ভেবে সেনারা চলে যায়। আনিস থাকতেন অধ্যাপক রাজ্জাকের ঠিক উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে। ভাগ্যক্রমে তিনিও বেঁচে যান। তবে তার বেঁচে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, তিনি তাঁর ফ্ল্যাটের একটি দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে রেখেছিলেন, যাতে বাইরে থেকে মনে হয় বাড়িতে কেউ নেই। আনিস তার ফ্ল্যাটের মেঝেতে তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে দুই রাত ও এক দিন কাটিয়েছেন এবং বাইরে সিঁড়িতে সেনাদের ওঠা-নামা ও মৃতদেহ সরানাের শব্দ শুনেছেন।  বারাইদে মতিন সাহেবের গ্রামের বাড়িতে আমরা আরও কয়েকজন বন্ধুর দেখা পেলাম। তাদের মধ্যে ছিলেন জামিল চৌধুরী ও তার পরিবার, মতিন সাহেবের মেয়ের জামাই মােকাম্মেল হক ও তাঁর পরিবার এবং ঢাকা টেলিভিশনের মুস্তাফা মনােয়ার। বারাইদে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে, যেহেতু আমি এবং সম্ভবত আনিসও সেনাবাহিনীর সরাসরি টার্গেট, কাজেই আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাওয়া উচিত। আর সেখানে গিয়ে আমাদের কাজ হবে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের জন্য প্রচার চালানাে।

 
২৯ মার্চের ভােরবেলা আনিসুর রহমান, মুস্তাফা মনােয়ার ও আমি মতিন। সাহেবের আত্মীয়, এলাকার স্কুলশিক্ষক রশিদ রসিদ সাহেব ও রহমতউল্লাহ সাহেবের নেতৃত্বে সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। সিধু মিয়া আর মুঈদ নদীর তীর পর্যন্ত এসে আমাদের বিদায় জানালেন। সেখান থেকে আমরা নৌকায় করে শীতলক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর হলাম। সমস্ত পথজুড়েই আমরা একই দৃশ্য দেখতে পেলাম—ঢাকা থেকে মানুষ পালাচ্ছে দল বেঁধে। নরসিংদী এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে যেতে নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য আমাদের লঞ্চে উঠতে হলাে। এ পর্যন্ত আমরা একটামাত্র দৃশ্যই দেখেছি—সেনাদের ভয়ে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ। পথে এ রকম গুজব শুনলাম, চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলা হয়েছে। কিন্তু তাতে পুরােপুরি প্রতিরােধযুদ্ধ শুরু হওয়ার কোনাে ইঙ্গিত পাওয়া গেল না। এ-জাতীয় ঘটনার প্রথম দৃশ্য আমরা দেখলাম যখন মেঘনা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের পতাকাবাহী একটি লঞ্চ নরসিংদীতে এল যাত্রী নেওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পরই আমরা দেখতে পেলাম, লঞ্চটি নদীর অপর তীর ধরে চলছে এবং যাচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে অনেক দূরে। এখানে কিছু ছাত্র লঞ্চে তাদের সঙ্গী হওয়ার জন্য আমাদের অনুরােধ করল। এ রকম এক পরিস্থিতিতে আমি বা আনিস আমরা কেউই এই ভিড়ে পাকিস্তানি গােয়েন্দাদের কাছে আমাদের পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়ে পড়তে পারে, এ নিয়ে কোনাে উৎকণ্ঠায় ছিলাম না। আমরা দ্বিধা করছিলাম আমাদের অধিক পরিচিতি নিয়ে যে কীভাবে লােকজন তা গ্রহণ করবে।
কিন্তু ভাগ্যক্রমে বিস্তারিত পরিচয় দেওয়ার আগেই আমরা তীরে পৌছে গেলাম। তীরে এসে আমরা অপ্রত্যাশিত অবস্থায় পড়লাম। কারণ, কিছু কিছু লােক আমাদের পরিচয় নিয়ে অনিশ্চয়তা বােধ করছিল। পরিস্থিতি আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় হঠাৎ করেই মুস্তাফা মনােয়ার একটা বুদ্ধি বের করে ফেললেন। তিনি তাদের কাছে জানতে চাইলেন, আশপাশের গ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে ছাত্র আছে কি না। তিনি বললেন, তাদের ডেকে আনলে নিশ্চয়ই তারা তাদের শিক্ষকদের চিনতে পারবে। আনিস আর আমি বরং জানতে চাইলাম, সংগ্রাম পরিষদের কোনাে স্থানীয় নেতার কাছে আমাদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না। এই বিশাল ভিড়ের মধ্যে বলার চেয়ে তার কাছেই বরং আমরা আমাদের পরিচয় স্বচ্ছন্দে বলতে পারব। এ সময় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের এক পিওন আমাকে চিনতে পারল । কারণ, সে আমাকে বহুবার দেখেছে সেখানে। সে আমার সম্পর্কে বলার পর জনগণ আমাদের প্রস্তাবে রাজি হলাে। অতঃপর আমাদের স্থানীয় একটি স্কুলে নিয়ে যাওয়া হলাে। স্কুলটি চলে সংগ্রাম পরিষদের এক নেতা, যিনি নিজে একজন আওয়ামী লীগার—তার এবং অন্য কয়েকজনের নেতৃত্বে।
 
সেখানে আমরা আমাদের বিস্তারিত পরিচয় দিলাম । কিন্তু এর পরও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না যে আমরা নিজেদের সম্পর্কে যে পরিচয় দিচ্ছি, তা সঠিক কি না। কেউ কেউ আমার নাম শুনেছে বলে মনে করতে পারল । কিন্তু তার পরও আমাদের পরিচয় সম্পর্কে তাদের আশ্বস্ত করতে আমাদের অনেকটা সময় লেগে গেল। এ অবস্থায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে যে আমরা বাইরে গিয়ে জনতার উদ্দেশে বলব, আমাদের পরিচয় সঠিক, এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমরা বাইরে আসতেই মুকতাদা নামে আনিসের এবং আমার এক ছাত্রের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র। ওর সঙ্গে ছিল ওর চাচাতাে ভাই মােফাখখার। সে ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ওরা থাকে পাশের গ্রামে। মুস্তাফা। মনােয়ার যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের খোজ করছিলেন, তখনই এই খবর কীভাবে যেন শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে গিয়ে পৌছায়। কয়েক মাইল ছুটে তারা। শুধু এসেছে আমরা যে পরিচয় দিয়েছি, সেটা নিশ্চিত করতে। আমাদের পরিচয় প্রকাশিত হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা রীতিমতাে বিখ্যাত হয়ে উঠলাম সেই এলাকাটিতে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলাে আমাদের। সেই অবস্থায় একটি গুজব সারা গ্রামে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল যে আমরা যে জায়গাটিতে ছিলাম, সেখানে অসংখ্য লােক এসে জমা হতে শুরু করল। যা-ই হােক, ভাগ্যক্রমে সেই গুজব থামানাে গেল। কিন্তু যদি পরিচয় গােপন রাখার প্রয়ােজন পড়ে, সেই সম্ভাবনা টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা স্থান ত্যাগ করব—এই সিদ্ধান্ত নিলাম। স্থানীয় নেতারা আমাদের এ রকম বলেছিলেন যে গ্রামবাসী এখন এতটাই সতর্ক অবস্থায় আছে যে পাকিস্তানি সেনা বা তাদের দোসর ঘাতকদের দেখলেই তারা আটক করবে। স্থানীয় জনগণ হাতের কাছে যেসব অস্ত্র পেয়েছে, সেসব নিয়েই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া তারা রাত্রিকালীন কড়া পাহারারও ব্যবস্থা করেছে। এ সত্ত্বেও এটাই আমাদের দেখা সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে বাংলাদেশের গ্রামের জনগণ চার সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় যুদ্ধ করার জন্য বেশ ভালােভাবেই নিজেদের সংগঠিত করেছে। সারা দেশেই তারা সংগঠিত হয়েছে স্থানীয় নেতৃত্বে।
 
এই এলাকা থেকে মুকতাদা ও মােফাখখার আমাদের তাদের গ্রামে মােফাখখারের ভাই অধ্যাপক নােমানের (ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল) বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে যে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা দেব এবং সেই ভ্রমণ হওয়া উচিত রাতের বেলায়। কারণ, আমাদের আশঙ্কা—নিশ্চয় পাকিস্তানি সেনারা নদী পাহারা দেবে। ৩০ মার্চ ভোেররাতের দিকে নৌকায় করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিলাম। আমাদের সঙ্গী হলাে মুকতাদা, মােফাখখার ও তার ভাই রেডিও পাকিস্তানে কর্মরত মােহাদ্দেস। রশিদ ও রহমতউল্লাহ সেখানে আমাদের বিদায় জানাল । আমরা তাদের অনুরােধ জানালাম, যেন তারা আমাদের পরিবারের কাছে আমাদের খবর পৌছে দেয়।  ৩০ মার্চ সকালে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছালাম। প্রথমেই যে বিষয়টি আমাদের চোখে পড়ল, সেটি হচ্ছে শহরের রাস্তা পাহারা দিচ্ছে সেনাবাহিনীর একটি জিপ, যেটিতে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। সে সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অংশ। এটা বােঝা গেল যে শহরটি মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে  রয়েছে। আমরা তাদের কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করার সুযােগ পেলাম। সেদিন বিকেলেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া তিতাস গ্যাস কোম্পানির রেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়া হলাে আমাদের। সেখানেই আমি প্রথম দেখি বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মােশাররফকে। তিনি আমাদের বললেন, কীভাবে তার ইউনিট তাদের পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসারকে গ্রেপ্তার করেছে এবং মুক্ত করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে। এখন তারা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করার পরিকল্পনা করছে। মেজর মােশাররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ঘুরে দেখানাের জন্য আমাদের সঙ্গে নিলেন। তারপর যখন রাত রয়ে এল, তিনি আমাদের তিনজনকেই তেলিয়াপাড়া টি এস্টেটের কাছে তাঁর কমান্ড পােষ্টে আমাদের নিয়ে গেলেন। এটি ছিল তারই নিয়ন্ত্রণাধীন। পুরাে এলাকা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। পাকিস্তানি এয়ারফোর্সের বিমান আক্রমণ হতে পারে ভেবেই এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। চাবাগানের ম্যানেজারের বাংলাের সমস্ত বাতি ছিল নেভানাে। মেজর মােশাররফ সেখানে তার ব্যাটালিয়নের দুর্দশার কথা বর্ণনা করলেন। তিনি আমাদের আরও জানালেন, কীভাবে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তার বাঙালি সহকর্মীদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাসে।
 
অন্যান্য এলাকার প্রতিরােধযুদ্ধে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন না তিনি। ফলে অন্যান্য এলাকার প্রতিরােধযুদ্ধ সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা ছিল না তার । সেদিন রাতে চা-বাগানে আমরা সবাই রেডিওতে শুনলাম, প্রবাসী বাঙালিরা স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য অস্ত্র কিনতে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছে। মােশাররফ পরামর্শ দিলেন, যেন আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাই এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আরও যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করার জন্য প্রবাসী বাঙালিদের কাছে অনুরােধ পৌছে দিই।  এ ছাড়া তিনি আরও পরামর্শ দিলেন, যেন প্রবাসী বাঙালিদের জোগাড় করা অর্থে বিদেশি অস্ত্র সংগ্রহে তাদের সহায়তা করি। মােশাররফ তার এই উপলব্ধির কথা আমাদের জানালেন যে যদি অতিরিক্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ তারা না পান, তাহলে মুক্তিযােদ্ধারা শক্ত প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারবে না এবং পাকিস্তানি সেনাদের কাছে তারা মার খাবে। তিনি আমাকে আরও বললেন, এখন তিনি ও তার অফিসাররা বিদ্রোহীর পর্যায়ে আছেন। কাজেই বেসামরিক কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে তারা প্রয়ােজনীয় নির্দেশ চান। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব সেনা ও অফিসারকে স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে পুনরায় কমিশন প্রদান করা উচিত। খালেদ মােটেও বুঝতে পারেননি যে এসব কর্মকাণ্ড সম্পাদন করার ক্ষমতা আমার নেই। তবু আমি তাকে জানালাম, যদি আমার সঙ্গে নির্বাচিত কোনাে রাজনৈতিক নেতার দেখা হয়, তাহলে আমি তাকে তার এই মেসেজ অবশ্যই পৌছে দেব। আমরা তখন সবাই সেনাদের কর্তব্য পালনে ভীষণভাবে মুগ্ধ। কারণ, এরা নিজেদের পরিবারবর্গকে সেনানিবাসে ফেলে স্রেফ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মরণপণ যুদ্ধ করছে।  ৩১ মার্চের সকালে মেজর মােশাররফ ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় যাওয়ার সীমান্তে পৌঁছে দিতে আমাদের জন্য একটি জিপের ব্যবস্থা করে দিলেন। ওখানে গিয়ে এটাই মনে হলাে যে তত দিন সীমান্ত হয়ে উঠেছে খুবই নিষ্কণ্টক, ফলে অসংখ্য লােক বেশ নির্বিঘ্নেই তা অতিক্রম করতে পারছে। আগরতলায় গিয়ে আমরা জানতে পারলাম যে অজস্র নিরুপায় বাংলাদেশি স্পাের্টস স্পেডিয়ামে আশ্রয় নিয়েছে।

 
সেখানে আমরা এম আর সিদ্দিকী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ছাড়াও আওয়ামী লীগের বেশ কিছু এমপি, কর্মী ও ছাত্রের দেখা পেলাম, যারা চট্টগ্রাম, নােয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে এখানে এসেছেন। সেখানে পৌছেই জানা গেল, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সেদিন সন্ধ্যাবেলায়ই এম আর সিদ্দিকী ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুর দিল্লি যাচ্ছেন। সেখানে তারা ভারত সরকারের কাছে গণহত্যার প্রকৃত তথ্য তুলে ধরবেন এবং সাহায্যের জন্য অনুরােধ করবেন, যাতে প্রতিরােধযুদ্ধ স্থায়ী করা যায়। সিদ্দিকীই বললেন, অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতা বেঁচে আছেন কি না বা বেঁচে থাকলেও কোথায় আছেন, তা তিনি জানেন না। তিনি নিজে চট্টগ্রামে প্রতিরােধ সংগঠিত করার কাজে জড়িত এবং ত্রিপুরা এসেছেন স্রেফ সামরিক সহায়তা চাওয়ার জন্য, যাতে চট্টগ্রামে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। | সিদ্দিকী ও ঠাকুরের সঙ্গে বৈঠকের পর এটাও জানা গেল যে তারা দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের খুব অল্প কজনকেই চেনেন। ফলে তাদের ধারণা, বেশ কিছু খ্যাতনামা ভারতীয় অর্থনীতিবিদের সঙ্গে আমাদের যে যােগাযােগ আছে, তা হয়তাে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কাজেই সেদিন সন্ধ্যায় এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে একই ফ্লাইটে দিল্লি যাওয়ার জন্য আমাদেরও অনুরােধ করা হলাে। অবশেষে আমি আমার একমাত্র সম্বল—ধার করে আনা পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরেই আগরতলা থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দিলাম। 
৩১ মার্চ ১৯৭১ রাতে দিল্লি পৌছালাম আমরা। সেখানে পৌছেই আমি আর আনিস অমর্ত্য সেনকে ফোন করলাম। তিনি তখন দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক । ফোন পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ও তাঁর স্ত্রী চলে এলেন এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। পরদিন সকালে অধ্যাপক সেন আমাদের নিয়ে গেলেন ড, অশােক মিত্রের বাসভবনে। ডা. মিত্র তখন ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা (পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম সরকারের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন)। যা-ই হােক, ড. মিত্র আরেক খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. পি এন ধরকে অবিলম্বে সেখানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। অধ্যাপক ধর তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সচিব। তার কাছেই আনিস আর আমি এই গণহত্যার প্রকৃত কারণগুলাে যতটা জানি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলাম। এ ছাড়া বললাম, ঢাকায় কী পরিমাণ হত্যাযজ্ঞ চালানাে হয়েছে। এবং বাংলাদেশের জনগণ যে তাদের প্রতিরােধ করছে, তা কী অবস্থায় আছে। অধ্যাপক ধর এরপর আমাদের নিয়ে গেলেন শ্রী পি এন হাসারের কাছে। শ্রী হাকসার তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি। তার কাছেও আমরা একইভাবে বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করলাম। | আমি নিশ্চিত নই, স্বাধীনতাযুদ্ধ বিষয়ে ভারত সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগের এটাই প্রথম পরিপূর্ণ প্রচেষ্টা কি না। তবে এটা জানা গেছে। যে আমরা যখন দিল্লিতে পৌছাই, প্রায় সেই সময়ই ব্যারিস্টার আমীর-উলইসলামের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদও দিল্লিতে এসে হাজির হন এবং ভারত সরকারের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য আরও বেশি কর্তৃত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট তৈরি করতে সক্ষম হন।
 
দিল্লিতে পৌছানাের অল্প সময়ের মধ্যেই আমি তাজউদ্দীন আহমদের সংস্পর্শে আসি । তিনি আমাকে জানালেন যে তার দলীয় সহকর্মীদের কেউ বেঁচে আছেন কি না, তা তিনি নিজেও জানেন না। তিনি এ-ও জানালেন, কীভাবে আমীর-উল ইসলাম, ড. কামাল হােসেন এবং তিনি নিজে ২৫ মার্চ রাতে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গেলেন এবং তাঁকে তাদের সঙ্গে আরও নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন না। তিনি বরং তাদের পরামর্শ দিলেন গােপন জায়গায় লুকিয়ে পড়ার জন্য। তাজউদ্দীন ও আমীর-উল-ইসলাম তখন কামাল হােসেনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে পড়েন। আর কামাল হােসেন লুকানাের চেষ্টা করেন ধানমন্ডিতেই এবং একপর্যায়ে তার সঙ্গে তাদের যােগাযােগ ছিন্ন হয়ে যায়। তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলাম তখন একই সঙ্গে কুষ্টিয়া হয়ে সীমান্ত অতিক্রমের জন্য মনস্থির করে ফেলেন। আমরা যখন দিল্লিতে একত্র হলাম, ঠিক তখনই রেডিও মারফত জানতে পারলাম যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ড. কামাল হােসেনকে গ্রেপ্তার করেছে। এই খবরে আমরা খুবই বিচলিত হয়ে পড়লাম। যা-ই হােক, তত দিনে আমরা খবর পেতে শুরু করলাম যে একের পর এক আওয়ামী লীগের উর্ধ্বতন নেতারা সীমান্ত অতিক্রম করে এপারে আসতে শুরু করেছেন। তাজউদ্দীন আহমেদ ছিলেন খুবই উদ্বিগ্ন—কত দ্রুত তিনি সীমান্তে উড়ে যাবেন এবং তার দলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে মিলিত হবেন এই নিয়ে। তিনি আরও উদ্বিগ্ন ছিলেন এ নিয়েও—কতক্ষণে তাদের  নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করবেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবেন। এ রকম একটি সরকারের ঘােষণা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই অনুভব করলাম, একটি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘােষণার খসড়া তৈরি করা দরকার। 
অবশ্য এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথমে আওয়ামী লীগের আবদুল হান্নান এবং পরে মেজর জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম রেডিও থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা জনসাধারণ্যে প্রচার করা হয়েছে। এখন শুধু এ দুটোকে মিলিয়ে স্বাধীনতার | একটি আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দেওয়া প্রয়ােজন।  স্বাধীনতার ঘােষণার খসড়া তৈরি করার জন্য ব্যারিস্টার আমীর-উল| ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর ঘােষণাপত্রের প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বিষয়টি উল্লেখ করে একটি পৃথক বিবৃতি তৈরি করার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ আমার ওপর দায়িত্ব দিলেন। এই দায়িত্ব আমি নিলাম খুবই ভয়ে ভয়ে, কেননা এই কাজগুলাে একসময় | ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হবে। বিবৃতির খসড়া আমি তৈরি করলাম, তাতে খালেদ মােশাররফের অনুরােধ অনুযায়ী এটিও উল্লেখ করলাম যে যেসব বাঙালি প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীতে ছিল এবং এখন একাত্তরের ২৫ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা সকলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নবগঠিত সেনাবাহিনীতে পুনরায় কমিশনপ্রাপ্ত বলে গণ্য হবে।
 
ঘটনার প্রেক্ষাপটে আমার খসড়া যা ছিল, হুবহু তা-ই রাখা হলাে এবং ১৪ এপ্রিল কুষ্টিয়ার আম্রকাননে-যেটি এখন মুজিবনগর নামে পরিচিতি-বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পর তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে বিবৃতি দিলেন, তাতে, যা এখন প্রায়ই উদ্ধৃত করা হয়, তা হচ্ছে এই যে এক পাহাড় পরিমাণ লাশের নিচে পাকিস্তানের কবর রচিত হলাে’—এই কথাটি আমার খসড়া ব্ৰিতি থেকে নেওয়া হয়েছে পুরােপুরি। তাজউদ্দীন ও আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে যখন ছিলাম, তখনই একদিন বিবিসিতে শুনলাম যে ইয়াহিয়া খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমেদ ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন পাকিস্তানের দাতা দেশগুলাের কনসাের্টিয়ামে তাদের সাহায্য অব্যাহত রাখার আবেদন নিয়ে। তাজউদ্দীন বুঝতে পারলেন যে সাহায্যের নামে  পাকিস্তান যুদ্ধপ্রক্রিয়ায় কোনাে রকম সহায়তাকে আমাদের সব রাজনৈতিক  শক্তির বিনিময়ে হলেও প্রতিহত করতে হবে।  তাজউদ্দীন আমাকে দায়িত্ব দিলেন, অবিলম্বে লন্ডন ও ওয়াশিংটনে যাওয়ার  জন্য, যাতে ওখানে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পাকিস্তানের প্রধান দাতা দেশগুলাের কাছে তাদের এ ধরনের সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখার জন্য প্রচার চালাতে পারি। আমার দ্বিতীয় কাজ ছিল, পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনগুলােতে কর্মরত সব বাঙালি কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন দানের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। আমার নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশন, যেখানে অসংখ্য বাঙালি কর্মচারী রয়েছে, তাদের সমর্থন আদায় করা। কারণ, তাদের সমর্থন বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালানাের পক্ষে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে যাওয়ার সুযােগ হলাে আমার। লন্ডনে গিয়ে আমি জানতে পারলাম যে আমার স্ত্রী ও তিন ছেলে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে এবং তারা এখন আমার স্ত্রীর বােনের সঙ্গে জর্ডানে রয়েছে। এই খবর আমার জন্য ছিল খুবই আনন্দদায়ক। কারণ, আমি এখন নিশ্চিন্তে এবং স্বাধীনভাবে প্রকাশ্যে স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে কথা বলতে পারব। লন্ডনে আমি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করলাম। তিনি তখন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। লন্ডনে তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে তার সমর্থন ঘােষণা করেছিলেন এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন।
 
লন্ডনে আমার যােগাযােগ ছিল ব্রায়ান ল্যাপিং নামে এক সাংবাদিকের সঙ্গে। তার মাধ্যমে আমি ব্রিটিশ লেবার পার্টির সংস্পর্শে এলাম এবং হাউস অব কমন্সে লেবার পার্টির একদল সদস্যের উদ্দেশে বক্তৃতা করলাম। আমি তাদের অনুরােধ করলাম, কনজারভেটিভ সরকার যাতে পাকিস্তানে নতুন সাহায্য প্রদান স্থগিত রাখে, তার জন্য তারা যেন সরকারের প্রতি চাপ প্রয়ােগ করেন। তারা ছিলেন আমার প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। পাশাপাশি আমি দেখা করলাম ডেনিস হিলির সঙ্গেও। হিলি তখন হাউস অব কমন্স সভায় লেবার পার্টির বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিনিধি। টোরি সরকারের সিনিয়র এমপি স্যার ডগলাস ডডস পার্কারের মাধ্যমে আমি সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করলাম। স্যার পার্কার আমার স্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার মাধ্যমে আমি পররাষ্ট্রসচিব স্যার এলিস ডগলাস হােমেরও সংস্পর্শে এলাম। স্যার হােমও আমার স্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে পরিচিত। ডডস পার্কার আমাকে বললেন, তিনি পররাষ্ট্রসচিবকে বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবেন। এবং তিনি তা করলেনও। কিন্তু এসব ব্যাপারে পররাষ্ট্রসচিবের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে কোনাে রকম যােগাযােগই করা হলাে না। সম্ভবত একটি বিদ্রোহী সরকারের মুখপাত্রের সঙ্গে বৈঠক করার মতাে রাজনৈতিক ঝুঁকি তিনি নিতে চাইছিলেন না। এর পরও আমি তার ব্যক্তিগত সচিব নিকোলাস ব্যারিংটনের মাধ্যমে তার সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করলাম এবং যথারীতি এবারও ব্যর্থ হলাম। বলা দরকার, নিকোলাস ব্যারিংটনের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল। যা-ই হােক, এই ব্যারিংটনই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পর্কে। যাবতীয়, তথা পররাষ্ট্রসচিবকে পৌছানাের ব্যাপারে খুব সাহায্য করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, আসল ঘটনার সূত্রপাত ঘটল ওয়াশিংটনে, যখন এম এম । আহমেদ সেখানে গিয়ে পৌছালেন। আমরা জানতে পারলাম যে পাকিস্তানি সরকারের বহিঃসম্পদের পরিমাণ কমে গেছে। পাট রপ্তানির মাধ্যমে আয় এবং জাতীয় রাজস্ব থেকে প্রাপ্ত অর্থ ছাড়াও যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য পাকিস্তানের। বৈদেশিক সাহায্য প্রয়ােজন। এপ্রিলের শেষ দিকে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌছালাম। সেখানে পৌছেই আমি নিউইয়র্কে ছুটলাম অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ও অধ্যাপক আনিসুর রহমানের। কাছে, যারা উভয়েই নিজেদের মতাে করে আকস্মিকভাবে আমার জন্যই ক্ষেত্র। প্রস্তুত করে রেখেছেন। ঢাকার বাইরে অধ্যাপক ইসলামের এটা ছিল খুবই নাটকীয় ভ্রমণ  তিনি অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের আগে দিল্লিতে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
 
নিউইয়র্ক থেকে হারুন-উর রশিদের সঙ্গে আমি ওয়াশিংটনের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। হারুন-উর রশিদ ছিলেন একজন সিএসপি অফিসার এবং তিনি তখন বিশ্বব্যাংকে কর্মরত। ওয়াশিংটনে এ এম এ মুহিত আমাকে এয়ারপাের্টে রিসিভ করলেন। তিনি তখন ছিলেন পাকিস্তান দূতাবাসের ইকোনমিক মিনিস্টার। সেদিনই সন্ধ্যায় আমি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালির কর্মচারীদের। সঙ্গে মিলিত হলাম। তারা সবাই অভিজাত গােষ্ঠীর, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন এনায়েত করিম, শামসুল কিবরিয়া—যারা পরে পররাষ্ট্রসচিব হয়েছিলেন, ছিলেন অধ্যাপক আবু রুশদ মতীনউদ্দিন—তিনি তখন সেখানে শিক্ষাবিষয়ক । অ্যাটাশে, ছিলেন মােয়াজ্জেম আলী, সম্ভবত তখন তিনি থার্ড সেক্রেটারি; এ । ছাড়া ছিলেন বেশ কয়েকজন নন-পিএফএস অফিসার, যেমন : রুস্তম আলী, রাজ্জাক খান, শরিফুল আলম প্রমুখ। সে সময় তাদের কেউই বিদ্রোহ। করেননি। তারা সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি তাদের পরিপূর্ণ। সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। বলা দরকার, তাদের অনেকেই তখন গােপনে। কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করতেন বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার জন্য। আমি তাদের কাছে দল ত্যাগ করার তাজউদ্দীন আহমদের মেসেজ পৌছে দিলাম। তারা। সবাই পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করার জন্য তখন প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু তাঁরা। পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জনগণের ত্যাগ সম্পর্কে তার আগে নিশ্চিত হতে চাইছিলেন।
 
যা-ই হােক, তারা সে অবস্থায় বিদ্রোহ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের পক্ষে গােপনে প্রচার চালাতে রাজি হলেন। এই সময়েই, রাজ্জাক খান ও শরিফুল আলম বাংলাদেশের ছাত্র মােহসীন সিদ্দিকীকে নিয়ে প্রকাশ্যেই আমাকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে এলেন। প্রেস, টিভি ও কংগ্রেসিদের সঙ্গে যােগাযােগ তৈরির ক্ষেত্রে সাহায্য করার জন্যই তারা মূলত এগিয়ে এলেন। প্রেস বা টিভির সাহায্য আমাদের প্রয়ােজন ছিল এ জন্য, যাতে আমি পাকিস্তানের প্রতি সাহায্য বন্ধ রাখার জন্য দাতাদের কাছে আমার মেসেজ পৌছাতে পারি। আমাকে বাংলাদেশ বিষয়ে কথা বলার জন্য বেশ কয়েকবার টিভিতে সুযােগ দেওয়া হলাে। এর ফলে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ব্যাপক প্রচার পেল। আর এ কাজে আমাকে সর্বতােভাবে সাহায্য করলেন খ্যাতনামা সাংবাদিক ও টিভি ভাষ্যকার ওয়ারেন ইউনা। তখন পর্যন্ত রাজ্জাক ও আলম পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মী থাকা সত্ত্বেও তারা অনেকটা আমার সচিবালয়ের মতাে কাজ করছিলেন। পত্রিকা জগতের বিশিষ্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে আমি দেখা করলাম। আমি বিশেষভাবে দেখা করলাম, ওয়াশিংটন স্টার-এর হেনরি ব্রাডশার, ওয়াশিংটন পােস্ট-এর লুইস সাইমন, ব্যাল্টিমাের পােস্টএর অ্যাডাম কাইমার, নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেন ওয়েলস ও অভিজাত সাপ্তাহিক নিউ রিপাবলিক-এর সম্পাদক গিলবার্ট হ্যারিসনের সঙ্গে। ওয়াশিংটনে এগুলােই তখন উল্লেখযােগ্য কাগজ। এসব কাগজের কলাম লেখকেরা এবং এই কাগজগুলাের নেতৃস্থানীয় লেখকেরাই কংগ্রেসিদের মতামতকে যথাসম্ভব প্রভাবিত করতে পারেন। কাজেই এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি বড় রকমের অ্যুথান। কেননা, এমন এক সময়ে চার-চারটি কাগজে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়, যখন এম এম আহমেদ ঘটনাচক্রে ওয়াশিংটনে এসে উপস্থিত। সম্পাদকীয়গুলােতে মার্কিন সরকারের কাছে এই অনুরােধ করা হয়, যেন যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশে অব্যাহত গণহত্যার কারণে পাকিস্তানে তাদের সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখে। কংগ্রেসেও আমি একইভাবে কাজ চালিয়ে গেলাম। এখানে আমি বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি দুজন কার্যকর সমর্থকের সংস্পর্শে এলাম, তাদের একজন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এবং অপরজন ফ্রাংক চার্চ। তাঁরা দুজনই সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটির মর্যাদাসম্পন্ন সদস্য। অল্প সময়ের মধ্যেই সিনেটর চার্চের সহকারী টম ডাউন এবং সিনেটর কেনেডির সহকারী গেরি টিংকার ও ডেল ডেইহান আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সক্রিয় মুখপাত্রে পরিণত হলেন। তাদের মাধ্যমে আমি বেশ কয়েকজন সিনেট সদস্যের সঙ্গে দেখা করলাম। 
 
সে সময় কেনেডি, চার্চ ও গ্যালাগারের নেতৃত্বে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে কংগ্রেসম্যান ও সিনেটররা বাংলাদেশের যুদ্ধের পক্ষে কথা বলতে শুরু করলেন এবং সরকারের কাছে দাবি জানালেন বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার নিন্দা জানানাের জন্য। তারা পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য দেওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্যও অনুরােধ করলেন। ২৬ মার্চের পর বাংলাদেশ থেকে যেসব মার্কিন নাগরিক দেশে চলে এসেছিল, তাদের প্রেরিত অনেক চিঠিপত্র, দলিল ও কাগজপত্রও কংগ্রেশনাল নথিপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হলাে। ঠিক সে সময়েই আমি জানতে পারলাম যে পাকিস্তানের কিছু পুরােনাে বন্ধু সিনেটর সিমিংটনের নেতৃত্বে এম এম আহমেদের সম্মানে এক চা-চক্রের আয়ােজন করছেন, যাতে তিনি সেখানে পাকিস্তানের পক্ষে তার বক্তব্য সিনেটরদের উদ্দেশে পেশ করতে পারেন। এম এম আহমেদ বেশ একটা সুযােগ পেলেও আমাদের বন্ধুদের ধারণা ছিল যে এটা সামলানাে যাবে। যেহেতু চার্চ ও কেনেডি উভয়েই ডেমোেক্রটিক পার্টির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, কাজেই ঠিক করা হলাে যে একজন নির্দলীয় সিনেট সদস্যকে উদ্বুদ্ধ করা হবে আমাকে উদ্দেশ করে একটি লাঞ্চের আয়ােজন করার জন্য। আমাদের ধারণা, এটা হলে তা রিপাবলিকান ও ডেমােক্র্যাট—উভয় দলের লােকদেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হবে। ওহাইওর সিনেটর স্যাক্সবি এ ধরনের একটি লাঞ্চের আয়ােজন করতে রাজি হলেন। এবং সত্যি সত্যিই এটি শেষ পর্যন্ত একটি বিশাল অনুষ্ঠানে পরিণত হলাে এবং এম এম আহমেদের অনুষ্ঠানটির চেয়েও অনেক বেশিসংখ্যক মর্যাদাসম্পন্ন সিনেটর এ অনুষ্ঠানে যােগ দিলেন। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে অন্যদের ছাড়াও আমি পেলাম সিনেটর ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর চার্চ ফুলব্রাইট এবং রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যালঘুদের নেতা সিনেটর স্কটকে। মার্কিন রাজনীতির এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিস্তারিত ঘটনা গভীর মনােযােগের সঙ্গে শুনলেন। অনুষ্ঠানে এ-ও বলা হলাে যে যত দিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রধান দাতাদেশের ভূমিকায় থাকবে, তত দিন পর্যন্তই পাকিস্তানিদের দুষ্কর্মে সাহায্য করা হবে। সিনেটে অবিলম্বে এসব পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে স্যাক্সবি-চার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য বিল সংশােধনের উদ্যোগ নিলেন এবং পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য বন্ধের উপক্রম হলাে।
 
যদিও শেষাবধি বাংলাদেশে যত দিন গণহত্যা চলেছিল, মার্কিন সাহায্য তত দিন অব্যাহত ছিল। কিন্তু এসবই গল্পের পরবর্তী অংশ এবং তখন আমাদের জন্য আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ল। সিনেটে আমাদের সাফল্যের পরপরই আমরা শুনতে পেলাম যে ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে এম এম আহমেদ একটি সংবাদ সম্মেলন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এ ক্ষেত্রেও তাকে পরাস্ত করতে হবে। হলােও তা-ই। রাজ্জাক খান ও তার সহযােগীদের নিয়ে আমরা আমাদের নিজেদের জন্য একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়ােজন করলাম। এটিও ছিল একটি সফল অনুষ্ঠান, যেখানে রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্র জগতের অসংখ্য ব্যক্তির আগমন ঘটেছিল। ভয়েস অব আমেরিকা আমার বক্তৃতার অংশবিশেষ প্রচার করল, শুনতে পেল। সারা দুনিয়ার মানুষ। ডনএর সংবাদদাতা নাসিম, যিনি পরে ভুট্টোর তথ্যসচিব। হয়েছিলেন, পাকিস্তান তাকে পাঠাল আমার প্রচারের পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য। তার সঙ্গে সহযােগী হিসেবে এলেন আরও এক সাংবাদিক কুতুবুদ্দিন আজিজ। নাসিম আহমেদ আমার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বটে, তবে অনুষ্ঠান। শােনার চেয়ে প্রশ্নকর্তাদের আমার উদ্দেশে সিরিয়াস প্রশ্নের জোগান দিতেই তিনি। বেশি উৎসাহী ছিলেন। আমার সম্মেলনের সাফল্য ছাড়াও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ সব। প্রচারমাধ্যমকে যেভাবে আকৃষ্ট করল এবং ব্যাপক প্রচার পেল, তা এম এম আহমেদকে এতটাই হতাশ করল যে তিনি তার নিজের সংবাদ সম্মেলন শেষ। পর্যন্ত বাতিল করে দিলেন। যে সময় ইউএস কংগ্রেস ও প্রচারমাধ্যমগুলাে আমার। প্রতি এতটা সমর্থন দিচ্ছে, সে সময়েও নিক্সন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। কাছে পৌছানাে ছিল আমার জন্য খুবই কষ্টসাধ্য। তখন আমরা হেনরি। কিসিঞ্জারের সঙ্গে যােগাযােগ করার পরিকল্পনা করলাম। কিসিঞ্জার হার্ভার্ডে তার আন্তর্জাতিক সেমিনারে বেশ কিছু বাঙালিকে। শিক্ষাদানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফলে আমাদের এ রকম ধারণা হয়েছিল যে। তিনি হয়তাে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে মােটামুটি ওয়াকিবহাল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা দেখতে পেলাম যে মার্কিন প্রশাসন। বাঙালিদের হাতের নাগালে চলে এসেছে। আমাকে পরামর্শ দেওয়া হলাে যেন আমি কেমব্রিজে চলে যাই এবং কিসিঞ্জারের সাবেক সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা। করি । কিসিঞ্জারের সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা করার পেছনে একটি উদ্দেশ্যই কাজ। করেছিল। আর তা হচ্ছে, যাতে তারা আমাকে কিসিঞ্জারের শ্রোতা হিসেবে। উপস্থিত হওয়ার জন্য সুযােগ করে দেন। সেখানকার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক ডরফম্যান ছাড়াও আমি দেখা করলাম সরকার বিভাগের কয়েকজন। কিসিঞ্জার-সহকর্মীর সঙ্গে। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও কিসিঞ্জারের। ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক স্যামুয়েল হান্টিংটন ও অধ্যাপক লজের সঙ্গেও দেখা। করলাম।
 
কিন্তু এসব যােগাযােগ কোনাে কার্যকর ফল বয়ে আনল না। ওয়াশিংটনে কর্মকর্তা পর্যায়ে আমি সবচেয়ে বেশি যা করতে পারতাম তা। হচ্ছে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের বাংলাদেশ ডেস্কের কর্মকর্তা এনায়েত করিম, ক্রেইগ। বেক্সটার—তাঁদের সঙ্গে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করা, যদিও আমি

বিশ্বব্যাংকের কনসালট্যান্ট টম হাজহারের মাধ্যমে ইউএস এইডের ডেপুটি ডিরেক্টর মরিস উইলিয়ামসের সঙ্গে দেখা করলাম। আমার মনে পড়ে, সেই বৈঠক করা হয়েছিল শুধু এ জন্য, যাতে মরিস উইলিয়ামস এই বক্তব্য দেন যে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করছে, যদি ওয়াশিংটন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ সিরিয়াসলি নেয়, তাহলে দেশটি সামরিক তৎপরতায় তার সামর্থ্য দেখাতে পারবে। | ওয়াশিংটনে আমার অন্য টার্গেটটি ছিল বিশ্বব্যাংক। এটি তখন পাকিস্তান কনসাের্টিয়ামের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং সত্যিকার অর্থেই এটি তখন আন্তর্জাতিক কমিউনিটিতে পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র। বিশ্বব্যংকে আমার প্রথম যােগাযােগ ঘটল এক ইংরেজের সঙ্গে, যার নাম। আই পি কারগিল । তিনি তখন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং এমন এক ব্যক্তি, যিনি পাকিস্তান কনসাের্টিয়ামে সভাপতিত্ব করেন। তিনি আবার এম এম আহমেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন এবং এটা তাদের আইসিএসের সময় থেকেই। ফলে পাকিস্তান বিষয়ে তিনি বেশ ভালােই জানেন। প্যারিস কনসাের্টিয়ামের সদ্য সমাপ্ত এক বৈঠকে কারগিলের পরামর্শে এর সদস্যরা ব্যাংক ফান্ড মিশনের পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে রিপাের্ট করার আগ পর্যন্ত সাময়িক সময়ের জন্য পাকিস্তানে তাদের পরবর্তী সাহায্য বন্ধ করে দেয়। কারগিল দীর্ঘ সময় ধরে আমার বক্তব্য শুনলেন। তিনি আমাকে এই ধারণা দিলেন যে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান বন্ধ না হলে পাকিস্তানের জন্য নতুন সাহায্যের প্রতিশ্রুতি না-ও আসতে পারে।
 
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার ব্যাপারে কারগিলের সহযােগিতা ছাড়াই ব্যাংকের অন্যান্য বন্ধুর যথেষ্ট চেষ্টার পর আমাকে জানানাে হলাে যে ম্যাকনামারা আমার সঙ্গে বৈঠকে বসতে রাজি হয়েছেন। আমাকে বলা হলাে যে তার কম্পিউটারপ্রবণ মন শুধু মূল তথ্যগুলােই ধারণ করতে পারবে। ওয়াশিংটনে আমার অন্যান্য বন্ধুর সহায়তায় এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নেওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র তৈরি করলাম, যেখানে এই আবেদনের কথা উল্লেখ করা হলাে, যেন পাকিস্তানে সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখা হয়। এ কাগজপত্রগুলাে একই সঙ্গে ছাপানাে হলাে এবং সর্বত্র প্রচারের জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হলাে। আমার যত দূর মনে পড়ে, এই পেপারটির শিরােনাম ছিল ‘আ এইড টু পাকিস্তান : ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যান্ড অপশনস’। এই পেপারটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমাদের এই সংক্ষিপ্ত বৈঠকে ম্যাকনামারাকে সমস্যার মানবিক দিকগুলাের কারণে যথেষ্ট প্রভাবিত বলেই মনে হলাে। অন্তত তিনি আমাকে এই আশ্বাস দিলেন যে সংকটের প্রকৃতি বিবেচনা করে বিষয়টির ওপর ভালােভাবেই খেয়াল রাখা হবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে ম্যাকনামারার কর্মকাণ্ডের ভূমিকাকে বাদ দেওয়া খুবই কষ্টকর। বিশেষ করে, পাকিস্তানে এইড কনসাের্টিয়ামের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা ছিল বেশ ইতিবাচক। যে দিকগুলাে দেখা দরকার তা হচ্ছে, ব্যাংক পাকিস্তানে একটি প্রতিনিধিদল পাঠাল এবং সেই প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার ওপর একটি ভয়াবহ রিপাের্ট পেশ করল, যেখানে এই বিষয়টি উল্লেখ করা হলাে যে এই অঞ্চলে সব উন্নয়ন-প্রক্রিয়া একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মিশনের এই রিপাের্ট হারুন-উর রশিদের কাছে ফাঁস করা হলাে এবং তিনি নিউইয়র্ক টাইমসূএ তা প্রকাশ করে দিলেন। আর এই রিপাের্ট শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যবান অবদান রাখল, যার ফলে স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী করা সম্ভব হলাে এবং পাকিস্তান এইড কনসাের্টিয়ামের সদস্যরা ১৯৭১-এর জুনে প্যারিস বৈঠকে পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে নতুন প্রতিজ্ঞাপত্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কংগ্রেস, বিশ্বব্যাংক ও প্রচারমাধ্যমগুলাের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাঙালি অধিবাসীদের মধ্যে বেড়ে গজিয়ে ওঠা নেতৃস্থানীয় কয়েকটি গ্রুপের সঙ্গেও আমি যােগাযােগ অব্যাহত রাখলাম। এফ আর খানের (বর্তমানে মৃত) নেতৃত্বে বাঙালিদের অন্যতম প্রধান গ্রুপটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাঙালিদের বাংলাদেশ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করার কাজে নিয়ােজিত ছিল। এ ছাড়া তারা নিয়ােজিত ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তার জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থ সংগ্রহের কাজে। আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাস ও নিউইয়র্কের জাতিসংঘ মিশনের বাঙালিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের কাজে এই গ্রুপটিকে কাজে লাগানাে। কেননা, এরা বেশ আগেই বাংলাদেশের পক্ষে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছিল। বাঙালিদের মধ্যে এবং মিশনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বেশ ভুল-বােঝাবুঝি ছিল, যেটি আমি কাটানাের চেষ্টা করলাম।
 
ওয়াশিংটনে আমার চূড়ান্ত কাজ ছিল মিশনের সব সদস্যের সঙ্গে তাদের সাহায্য করার জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থের একটি হিসাব তৈরি করা এবং তাদের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত অর্থের ব্যবস্থা করে দেওয়া। যতটুকু মনে পড়ে, একটি তারিখও ঠিক করা হলাে—এটা ছিল সম্ভবত ১ জুলাই; যেদিন তারা সবাই জনসমক্ষে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের অনাস্থা প্রকাশ করবেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে তাদের সংহতি ঘােষণা করবেন। এরপর আমি ওয়াশিংটন থেকে নিউইয়র্কে গেলাম এবং সেখানে বসবাসরত বাঙালি কমিউনিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করলাম। শিকাগােতে আমি এফ আর খানের সঙ্গেও কথা বললাম। তার সঙ্গে কথা বলার  মূল কারণ ছিল, তার কাছ থেকে এই প্রতিজ্ঞা আদায় করা যে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে মিশনকে প্রয়ােজনীয় অর্থ জোগান দেবেন। এসব কর্মকাণ্ড ছাড়াও আমি বাকি সময়গুলােয় বিভিন্ন ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে তাদের সমর্থন আদায়ের জন্য আলাপ করলাম। নিউইয়র্কে আমি নিউইয়র্ক টাইমস-এর জিম ব্রাউনের সঙ্গেও আলাপ করলাম, যিনি পরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হামলা নিয়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমালােচনামূলক লেখা লিখেছিলেন। এ ছাড়া আমি টিভিতে আরও কয়েকটি অনুষ্ঠান করলাম। এরপর ফিলাডেলফিয়ার সুলতানা আলমের আমন্ত্রণে আমি একটা বেশ মূল্যবান সফর করলাম সেখানে। ক্রিপেনড্রফে তিনি বাংলাদেশের সমর্থনে এক সমাবেশের আয়ােজন করেছিলেন, সেখানে আমি তাদের উদ্দেশে এক জরুরি ভাষণ দিলাম। অন্যান্য গ্রুপও, যেখানে বাঙালি ছাড়াও ছিল আমেরিকানরা, আমার বক্তব্য শােনার জন্য হাজির হলাে। বাঙালিরাই তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল এ কাজে। | মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমার অবস্থানের শেষ দিকে বাঙালিদের একটি অ্যাকশন গ্রুপের অনুরােধে অটোয়ায় গেলাম আমি। এদের ধারণা ছিল, বাংলাদেশে সরকারের একজন মুখপাত্র হিসেবে সেখানে আমার উপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ হবে। অটোয়ায় পৌছেই আমি সেখানে একটি সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দিলাম। সংবাদ সম্মেলনে প্রচুর দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল।
 
অনুষ্ঠানের পর আমি অটোয়ার সংসদের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে লাঞ্চ করলাম। দুপুরের এই ভােজসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন বিরােধী শিবিরের একজন ছায়া বিদেশমন্ত্রী। বিকেলবেলা একজন ক্যাবিনেট সদস্যের সঙ্গে গােপন সাক্ষাৎকারে মিলিত হওয়ার জন্য আমাকে একটি প্রাইভেট ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হলাে। একজন মন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রকাশ্যেই আমাকে নিয়মমাফিক সাক্ষাতের সুযােগ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি আমার প্রতি ছিলেন বেশ সহানুভূতিশীল। সন্ধ্যায় আমি অটোয়ায় বসবাসরত বাঙালিদের সঙ্গে মিলিত হলাম। অটোয়ায় আমার এক দিনের সফর ছিল পুরাে কর্মসূচির মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর দিবস। মে মাসের শেষ দিকে আমি লন্ডনে ফিরে এলাম। লন্ডনে অল্প কয়েক দিন। অবস্থানকালে দেখলাম যে জনমতের হাওয়া বাংলাদেশের পক্ষেই বইছে—এবং তা বেশ ভালােভাবেই। কিউ গার্ডেনে জুডিট হার্টের বাসভবনে আমি তার সঙ্গে দেখা করলাম। এই মহিলা ছিলেন বৈদেশিক সাহায্যের লেবার ফ্রন্ট বেঞ্চের একজন মুখপাত্র। সৌভাগ্যক্রমে তিনি পরবর্তী লেবার সরকারের বিদেশ উন্নয়নমন্ত্রী হিসেবে তখন নিযুক্ত হয়েছেন। আমাদের বৈঠকের পরপরই তিনি হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশের সপক্ষে বেশ কর্তৃত্বপূর্ণ ভাষণ দিলেন। লেবার সরকারের বিরােধী দলের পক্ষে তিনি দাবি করলেন যে পাকিস্তানে ব্রিটেনের সাহায্য স্থগিত করতে হবে এবং ব্রিটেনকে এই সংকল্প ব্যক্ত করতে হবে যে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তারা পাকিস্তানকে কোনাে রকম সাহায্য প্রদান করবে না। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্রিটেনকে সংলাপ চালু করতে হবে। এসব ছাড়াও আমি টোরি ও লেবারএর সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলাপ-আলােচনা করলাম। আমি আবারও স্যার ডগলাস হােমের কাছে আমার বক্তব্য পৌছে দেওয়ার জন্য নিকোলাস ব্যারিংটনের সঙ্গে আমার সম্পর্ককে ব্যবহার করলাম। এ ছাড়া প্যারিস কনসাের্টিয়াম বৈঠকে ব্রিটেনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এবং বিদেশ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করলাম এবং তাদের কাছে আমাদের মেমােরেন্ডাম পৌছে দিলাম। মার্কিন কংগ্রেস ও ওয়াশিংটনে ম্যাকনামারার কাছে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের আমাদের যে দাবি আমরা তুলেছিলাম, তা একইভাবে এখানেও উল্লেখ করা হলাে। ব্রিটেনের বাঙালি সম্প্রদায়ের কাছে প্রচারের এই পদ্ধতিটিই প্রধান কৌশল হয়ে উঠল। প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায় বলে পরিচিত ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিরা পাকিস্তানে সাহায্য প্রদানের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের জনমত গড়ে তােলার জন্য এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য বেশ তৎপর হয়ে উঠল।
 
বাংলাদেশের সংগ্রামের পক্ষে প্রধান মুখপাত্র হিসেবে কথা বলার জন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে আফিশিয়ালি দায়িত্ব প্রদান করা হলাে এবং এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি পূর্ব লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশনের কাছে একটি অফিস খুললেন। এ সময় সৌভাগ্যবশত লন্ডন সফরে এলেন গ্যাঞ্জেস (Ganges) রেস্তোরার মালিক তাসাদুক আহমদ ও তার স্ত্রী রােজমেরি । তারা আমাকে বৈঠক করার জন্য এবং মােটামুটিভাবে লন্ডন অফিস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তাদের জেরাড স্ট্রিটের রেস্তোরার ওপরে তাদের যে স্টোররুমটি ছিল, তা ব্যবহারের জন্য দিলেন এবং অন্যান্য ব্যাপারেও বেশ সহায়তা করলেন। কিন্তু সেখানে আমি বেশ কিছু মজার বিরােধিতার মুখােমুখি হলাম। এর একটি ফিজোর সঙ্গে, যিনি নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের একজন প্রবাসী নেতা। তার সঙ্গে আমার একটি বৈঠকের সব রকমের ব্যবস্থা তৈরি করা হলাে। এটা করা হলাে এই ধারণা থেকে যে যেহেতু বেইজিংয়ের ক্ষমতাসীন চীনা নেতাদের সঙ্গে তার যােগাযােগ আছে, কাজেই তিনি হয়তাে বাংলাদেশের প্রতি তাদের সমর্থন আদায়ের জন্য তার অফিসকে ব্যবহার করতে পারবেন। কারণ, চীনারা বাংলাদেশের পক্ষে কোনাে অবস্থান নেয়নি তখনাে। গ্যাঞ্জেসে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ফিজো তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে চীনাদের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে নাগা বিষয়ে আমাকে প্রভাবিত করতেই তাকে বেশি আগ্রহী মনে হলাে। ফলে সেই বৈঠক মজার হলেও তা একেবারে বিফলে গেল। ব্রিটেনে অবস্থানের সময় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু লেখার সুযােগও আমি  গ্রহণ করলাম  এক ফাকে আমি বামপন্থী সাপ্তাহিক দ্য নিউ স্টেটসম্যান-এর সঙ্গে। আমার সম্পর্ক ঝালাই করে নিলাম এবং তাদের বাংলাদেশে গণহত্যা নিয়ে লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশের জন্য দিলাম। সেই নিবন্ধে আমি পাকিস্তানে বিদেশি সাহায্য যে ইয়াহিয়ার শাসনকালকেই আরও স্থায়ী করবে, সে বিষয়েও। আলােকপাত করলাম। শেষ পর্যন্ত দ্য নিউ স্টেটসম্যান-এর সম্পাদক আমার লেখার উল্লেখযােগ্য অংশগুলাে নিয়ে পত্রিকার প্রথম পাতায় সম্পাদকীয় লেখার  সিদ্ধান্ত নিলেন এবং সেখানে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের দাবিটিই ছিল প্রধান। সম্পাদক জন হােয়াইটের অনুরােধে আমি সাউথ এশিয়ান রিভিউয়ের জন্য একটি নিবন্ধ লিখলাম। সেখানে আমি প্রথমবারের মতাে সমঝােতার পরিপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে সামরিক অভিযানের কথা উল্লেখ করলাম। এসব ছাড়াও আমি গার্ডিয়ান এর জন্যও একটি নিবন্ধ লিখলাম । আমার এই সফরের সময় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ইউনিয়নের একটি। বিশাল প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতেও আমি অংশগ্রহণ করি। এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়ােজন করেন দুজন সহানুভূতিশীল পাকিস্তানি—আকবর নােমান ও তারিক। আবদুল্লাহ। এতে প্রচুর লােক অংশ নেয় এবং অধ্যাপক ডানিয়েল থরনার। বক্তৃতা করেনডানিয়েল যখন ঢাকার পিআইডির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তখন তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
 
তিনি প্যারিসের সরবােনে ফিরে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের একজন। নেতৃস্থানীয় মুখপাত্রে পরিণত হন। ডানিয়েল ছাড়াও তারিক আলী নামের অন্য এক পাকিস্তানিও পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অভিযানের কঠোর সমালােচক ছিলেন এবং তিনিও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি অবশ্য এটিকে দেখলেন একটি বৈপ্লবিক ঘটনা হিসেবে, যেখানে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে দুই বাংলার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সম্পর্কে তার কটু মন্তব্যের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারিতে উপস্থিত একজন প্রশ্নবাণে তাঁকে রীতিমতাে জর্জরিত করে ফেলল। পরে অবশ্য জানা গেল, এই প্রশ্নকারী পাকিস্তানি সামরিক  গােয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা এই অনুষ্ঠানে ভুট্টোর পিপলস পার্টির। একজন প্রতিনিধিও বক্তৃতা করেন। এটা প্রত্যাশা করাই যাচ্ছিল যে পাকিস্তান প্রসঙ্গ  এখানে তেমন সহানুভূতি পাবে না আমি ছিলাম অনুষ্ঠানের সর্বশেষ। বক্তা এবং আমি দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে বেশ উষ্ণ সাড়া পাচ্ছিলাম  প্রায়। সব গণসমাবেশেই এটা ছিল আমাদের মােটামুটি সাধারণ ধারণা যে আমরা সহানুভূতি পাব। লন্ডন থেকে আমি গেলাম প্যারিসে। আমার যত দূর মনে পড়ে, ৭ জুন তারিখে পাকিস্তান এইড কনসাের্টিয়ামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের সময় প্যারিসে উপস্থিত থাকার জন্য আমি গিয়েছিলাম সেখানে। এই বৈঠকের প্রতি পাকিস্তানিদের বেশ আস্থা ছিল যে তারা দাতা দেশগুলাের পক্ষ থেকে নতুন নতুন সাহায্যের আশ্বাস পাবে। কেননা যুদ্ধের কারণে তাদের আমদানি-ক্ষমতা প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্যারিসে আমি ডানিয়েল ও এলিস থরনারের সঙ্গে অবস্থান করছিলাম। থরনারের সঙ্গে ছিলেন আরও একজন, তিনি ছিলেন পিআইডিইর ড. হাসান ইমাম। মাত্র কিছুদিন আগে তিনি ভারত হয়ে প্যারিসে এসেছেন। ডানিয়েল, হাসান ইমাম ও আমি ম্যাকনামারাকে যে পেপারটি দিয়েছিলাম, সেটাকে ভিত্তি করেই কনসাের্টিয়ামের জন্য একটি মােমমারেন্ডাম প্রস্তুত করলাম। এরপর মেমােরেন্ডামটি আমরা কনসাের্টিয়াম বৈঠকের আগের রাতেই সব প্রতিনিধির কাছে বিলি করলাম। আমরা অবশ্য কনসাের্টিয়ামের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করারও চেষ্টা করলাম।
 
কেউ কেউ আমাদের কথা শুনলেনও। তবে অধিকাংশই আমাদের আহ্বানে সাড়া দিলেন না। আমি বৈঠকের আগের দিন রাতে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদলের উপপ্রধান ভােটারের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান। তিনি আমাকে বললেন যে কনসাের্টিয়াম হয়তাে নতুন কোনাে সাহায্যের আশ্বাস না-ও দিতে পারে। আমি বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার কারগিলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বললাম। তিনি তখন সবে পাকিস্তান থেকে ফিরেছেন। তিনি তার দলের উপনেতার কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন। তবে বৈঠক শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমরা তিনজন কনসাের্টিয়ামে লবি করার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। এ ছাড়া বাঙালিদের একটি গ্রুপ প্যারিসে চলে এল এবং কনসাের্টিয়ামের বৈঠক যে বাড়িটিতে হচ্ছিল, তার সামনে মিছিল করল। মিছিলকারীদের প্রত্যেকের হাতেই ছিল প্ল্যাকার্ড, যাতে তারা দাবি করছিল যেন পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। কনসাের্টিয়াম বৈঠক শেষ হওয়ার পরদিন সকালে রয়েল মশিয়ে নামের একটি পাঁচতারা হােটেলে নাশতার টেবিলে আমি পিটার কারগিলের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি আমাকে একটি ভালাে খবর দিলেন। তিনি জানালেন যে কনসাের্টিয়াম বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার আগে সাহায্যের নতুন কোনাে আশ্বাস দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কনসাের্টিয়ামের কর্মকর্তারা ঢাকা ও ইসলামাবাদ ঘুরে আসার পর কারগিল যে রিপাের্ট দিয়েছেন, তার দ্বারা তারা। খুবই প্রভাবিত হয়েছেন।  বৈঠকে তিনি এটা বিশ্বাস করাতে পেরেছেন যে পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ রকমের অস্থিতিশীল। বেশ কিছু সদস্য বৈঠকে পর্যবেক্ষণের ভূমিকা নিলেও বেশির ভাগ সদস্যই পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের চাপকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছেন। পাকিস্তানের অস্থিতিশীল এই পরিবেশে উন্নয়ন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে, এই অজুহাতে তারা সাহায্যের নতুন কোনাে আশ্বাস দেয়নি। মার্কিন প্রতিনিধিরা পাকিস্তানের সমর্থনে বেশ নমনীয় ভূমিকা পালন করেছেন এবং সাহায্যের ব্যাপারে তারা তেমন জোর করেননি। বরং কনসাের্টিয়ামের সিদ্ধান্তই মেনে নিয়েছেন তারা কনসাের্টিয়ামের বৈঠক পাকিস্তানের জন্য ছিল একটা বড় ধাক্কা এবং | আন্তর্জাতিক জনমতকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ, যে কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি সারা বিশ্বেই প্রাথমিকভাবে একটি সমর্থন আদায় করা গেল। কনসাের্টিয়ামে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া ছাড়াও ডানিয়েল বাংলাদেশের সংকটকে প্রভাবশালী ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের কাছে তুলে ধরার জন্য আমার প্যারিস উপস্থিতিকে কাজে লাগাতে শুরু করলেন।
 
আমি সেখানকার সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও নেতৃস্থানীয় ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে, বিশেষ করে রেমো আরাে ও সামাজিক নৃবিজ্ঞানী লুই দুমাে, আরবি ভাষাবিদ ম্যাক্সিম রবিনসন—তাঁদের সঙ্গে দেখা করলাম। আমি সরবােনে একটি সেমিনারও করলাম। আমরা জানতে পারলাম যে ফরাসি সরকারও পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সে একটি প্রভাবশালী জনমত তৈরির মাধ্যমে এই অস্ত্র বিক্রির পথ বন্ধ করে দেওয়া। সত্যিকার অর্থেই ফরাসি সরকারের ওপর একটি কর্তৃত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করাই ছিল পাকিস্তানের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু যখন ঋণের বিনিময়ে পাকিস্তান অস্ত্র সরবরাহের একটি শিডিউল দাবি করল, তখন সৌভাগ্যক্রমে ফ্রান্সই অস্ত্র সরবরাহের চুক্তি বাতিল করে দিল। প্যারিস থেকে আমি গেলাম রােমে। সেখানে আমি অল্প সময় থাকলেও ওয়ার্ল্ড ফুড প্রােগ্রামকে কিছু প্রস্তাবসমৃদ্ধ একটি স্মারকলিপি প্রদান করলাম। স্মারকলিপিতে প্রদত্ত প্রস্তাবগুলােয় বলা হলাে পাকিস্তানে খাদ্যসাহায্যের ভান করে সাহায্য যেন বাংলাদেশ সরকারের নামে পাঠানাে হয়, যাতে পরে এই সাহায্য পূর্বাঞ্চলের জনগণের মধ্যে বিতরণ করা যায়। এটা ছাড়াও আমি আরও কয়েকটি জরুরি কাজ করলাম। আমি তিনটি প্রধান ইতালীয় রাজনৈতিক দল—ক্রিশ্চিয়ান ডেমােক্র্যাটস, কমিউনিস্টস ও স্যোশালিস্টসদের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করলাম। আমি তাদের কাছে এই সমর্থন চাইলাম যেন তারা পাকিস্তানে ইতালীয় সাহায্য বন্ধ করার উদ্যোগ নেন। যদিও ইতালীয়রা পাকিস্তান বা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের উল্লেখযােগ্য দাতা দেশ ছিল না, কিন্তু তার পরও এই উদ্যোগের অর্থ ছিল তাদের মানসিক ও আচরণগত সমর্থন আদায় করা। আমি আমার প্রচারকাজের ফলাফলের রিপাের্ট মুজিবনগর সরকারের কাছে। পেশ করার জন্য রােম থেকে ফিরে এলাম। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে যখন সেখানে অবস্থান করছিলাম, তখন দেখতে পেলাম যে আমার অনেক বন্ধু ও প্রাতিষ্ঠানিক সহকর্মী প্রকাশ্যে চলে এসেছেন। আমরা উপলব্ধি করলাম, এটাই উপযুক্ত সময় যখন স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া যায়।
 
এই চিন্তাভাবনা থেকেই আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে বাংলাদেশ পরিকল্পনা পরিষদ গঠন করার জন্য প্রস্তাব দিলাম। আমার প্রস্তাবে এ কথার উল্লেখও থাকল, সেখানে আমি ছাড়াও এই পরিষদের সদস্য থাকতে পারেন অধ্যাপক মােশাররফ হােসেন, অধ্যাপক সারওয়ার মুরশেদ, ড. আনিসুজ্জামান ও ড. স্বদেশ বসু। এই প্রস্তাব প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সবাই গ্রহণ করলেন, কিন্তু এটি  বাস্তবায়ন করতে বেশ কিছু সময়ের প্রয়ােজন হয়ে পড়ল। মুজিবনগর থেকে আমি আবার যখন মাস খানেক পর ইউরােপে গেলাম, তখন পরিকল্পনা পরিষদ বাস্তবায়নের পুরাে দায়িত্ব পড়ল অধ্যাপক মােশাররফ হােসেনের ওপর। এদিকে অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ চৌধুরী প্রকাশ্যে চলে আসার পরপরই তাঁকে এই পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হলাে। এবং যুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে মন্ত্রণালয়ের জন্য কিছু নীতিনির্ধারণী খসড়া প্রস্তুত করার জন্য এই পরিষদ তার কাজ শুরু করে দিল। মুজিবনগরে থাকার সময়ই আমি আবার মেজর খালেদ মােশাররফের সঙ্গে দেখা করলাম। মেজর খালেদ তখন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত। হয়েছেন এবং তিনি ছিলেন একজন সেক্টর কমান্ডার। তিনি আমাকে বিলােনিয়ার যুদ্ধসংক্রান্ত তাঁর প্রতিবেদনটি দিলেন। এটি তিনি তৈরি করেছিলেন একজন ব্রিটিশ টেলিভিশন সাংবাদিক ভেনিয়া কাউলির জন্য, যিনি ছিলেন যুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষদর্শী । এই মহিলা সাংবাদিকটির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল লন্ডনে। তখন আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, যদি তিনি সরাসরি যুদ্ধ দেখতে চান, তাহলে যেন তিনি মেজর খালেদের সঙ্গে দেখা করেন। এই সফরের সময়েই আমি প্রথমবারের মতাে মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি ছিলেন অন্য একটি সেক্টরের কমান্ডার। জিয়ার কাছ থেকে আমি চট্টগ্রামের লড়াই সম্পর্কে বিস্তারিত শুনলাম। যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কেও তিনি তার বিশ্লেষণ করলেন।
 
এ ছাড়া আমি মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানী এবং ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন খােন্দকারের সঙ্গে দেখা করলাম। মুক্তিবাহিনীর যেসব উর্ধ্বতন ব্যক্তির সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তারা প্রায় প্রত্যেকেই বললেন যে প্রতিরােধযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যুবকেরা আকৃষ্ট হচ্ছে এবং এগিয়ে আসছে। মেজররা আমাকে এ-ও জানালেন, কী পদ্ধতিতে গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করছেন তারা। তবে অসংখ্য যােদ্ধা এই অভিযোেগও করেছেন যে ভালাে এবং প্রয়ােজনীয়সংখ্যক যুদ্ধাস্ত্রের অভাবের কারণেই তারা কার্যকর প্রতিরােধ তৈরি করতে পারছেন না। পরে আমি জানতে পারলাম যে আগস্ট মাসে ভারত সরকার তাদের নীতি নির্ধারণ করে ফেলেছে যে তারা মুক্তিবাহিনীকে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করতে এবং এর সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এগিয়ে আসবে। | বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমার প্রচারকাজসংক্রান্ত প্রতিবেদন এবং পরিকল্পনা পরিষদসংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করেই পাকিস্তানে বিদেশি সাহায্য বন্ধ করার জন্য আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনের কাজে ইউরােপ ও আমেরিকায় চলে গেলাম। এবার আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। এ জন্য যে এবার সরকারিভাবেই আমাকে অর্থনৈতিক বিষয়ে অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। আগস্ট মাসে আমি লন্ডনে পৌছে দেখলাম, স্থানীয় বাঙালিরা বাংলাদেশ বিষয়ে প্রচার চালানাের ক্ষেত্রে রীতিমতাে ঢেউ তুলেছেন। তাঁরা ট্রাফালগার স্কয়ারে একটি বিশাল র্যালি পর্যন্ত সংগঠিত করেছেন। সংবাদপত্রের প্রবল সমর্থন ছাড়াও সব রাজনৈতিক দল পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানাের বিরােধিতা করে তাদের সংসদ উত্তপ্ত করে তুলেছে। তা ছাড়া টোরি সরকারও বাধ্য হয়েছে নতুন সাহায্য বন্ধ রাখতে। | লন্ডনের চ্যাটহাম হাউসে একটি সমাবেশের আয়ােজন করল রয়েল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, যেখানে আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানাে হলাে। সমাবেশের দর্শক-শ্রোতারা ছিলেন খুবই অভিজাত শ্রেণির। কিন্তু আমি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সময়মতাে সেখানে উপস্থিত হতে পারলাম না। কারণ, আমার স্ত্রী সালমা আমাদের ছেলেদের নিয়ে তখন মাত্র ব্রিটেনে পৌঁছেছে। আমার বাসায় তখন তার সঙ্গে ছাড়াও আমি কথা বলছিলাম লেবার পার্টির এমপি আর্থার বটমলির সঙ্গে, যিনি কিছুদিন আগেই মাত্র পাকিস্তান সফর শেষে ব্রিটেনে ফিরেছেন। আর্থার বটমলিকে পাকিস্তানে পাঠানাে হয়েছিল ব্রিটিশ সংসদ সদস্যদের প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে এসে রিপাের্ট করার জন্য। সালমা পরিস্থিতি সম্পর্কে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা জানাল আমাকে। বটমলিও তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন।
 
চ্যাটহাম হাউস থেকে আমি আবার আমন্ত্রিত হলাম অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য। সমাবেশে বক্তৃতা করার জন্য। ব্রিটেন থেকে আমি আবার ওয়াশিংটনে গেলাম। সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই। ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের সব বাঙালি কর্মচারী এবং জাতিসংঘে কর্মরত বাঙালিরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘােষণা করলেন। এটা ছিল একটি বিশাল কূটনৈতিক অভ্যুত্থান—যেহেতু এটি ছিল একটি বিরাট গ্রুপ। এবং তাদের মধ্যে ছিলেন পদের দিক থেকে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। বিদ্রোহী এই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য জাতিসংঘের পাকিস্তান মিশনের ডেপুটি স্থায়ী প্রতিনিধি এবং স্থানীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে বয়ােজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এস এ করিম চলে এলেন নিউইয়র্ক থেকে এবং এই গ্রুপটি সবার উজ্জ্বল উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করল । নজর এড়ায় না এমন একজন বাঙালি শুধু এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না—তিনি এনায়েত করিম। সংবাদ সম্মেলনের মাত্র কয়েক দিন । আগে তিনি হঠাৎ হৃদরােগে আক্রান্ত হওয়ায় তাকে হাসপাতালে পাঠানাে হয়। যাই হােক, তিনি রােগশয্যায় থেকেই অন্যান্য বাঙালির সঙ্গে তার একাত্মতা ঘােষণা করলেন। জুনের প্রথম দিকেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে পাকিস্তানে প্রেরিত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মিশনের রিপাের্ট বিশ্বব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর কাছে ফাস করে দিয়েছেন। শুধু কনসাের্টিয়ামেই যে এই রিপাের্টটি উল্লেখযােগ্য প্রভাব ফেলল তা-ই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও কংগ্রেস ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের দাতা দেশগুলাের ওপরও এর । উল্লেখযােগ্য প্রভাব পড়ল।  এ সময়ের মধ্যেই নানা রকম যােগাযােগের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। বাংলাদেশ আন্দোলন অনেকটাই সংগঠিত হয়ে উঠেছে। মার্কিন জনগণের সমর্থন । তত দিনে এতটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে কমিটেড ও আদর্শবাদী আমেরিকানরা মিলে গঠন করলেন বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যেখানে তারা নিজেরাই বাংলাদেশের সংগ্রামের জন্য কাজ করতে তাদের প্রবল উৎসাহের কথা। জানালেন। এই সংগঠনগুলাের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর গ্রুপটি হচ্ছে—ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র। এই গ্রুপটি স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনীর । জন্য কার্যকর লবিং করার দায়িত্ব নিল। বাঙালি কূটনীতিবিদদের প্রয়ােজনীয় সংখ্যা ও উপস্থিতি এবং মার্কিন জনগণ ও কংগ্রেসের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন বাংলাদেশের সরকারকে উদ্বুদ্ধ করল ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের একটি স্থায়ী মিশন। স্থাপন করার ব্যাপারে। ওয়াশিংটনের উপকণ্ঠে কানেটিকাট অ্যাভিনিউতে এর অফিস নেওয়া হলাে। মিশনের প্রধান করা হলাে এম আর সিদ্দিকীকে। এ ছাড়া। বিদ্রোহী অথচ বিশিষ্ট কূটনীতিবিদেরাও যুক্ত হলেন এই মিশনের সঙ্গে। জাতিসংঘ ও নিউইয়র্ক অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হলাে এস এ করিমকে। নবগঠিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র ওয়াশিংটনে স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনীর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণের প্রধান কার্যক্ষেত্রে পরিণত হলাে। সংশােধনীতে এই প্রস্তাব রাখা হলাে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি সাহায্য বিলে অন্তর্ভুক্ত পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে এবং বাংলাদেশে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপের আয়ােজন করতে হবে।
 
এ ছাড়া মার্কিন সিনেটের বহুদলীয় গ্রুপটি একজন প্রভাবশালী রিপাবলিকান ও ডেমােক্র্যাটের নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই সিনেটের একটি বিরাট অংশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। সিনেট-সভায় সেই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল সংশােধনীর জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠের ভােট অর্জন করা। যখন সংশােধনীর পক্ষে প্রবল সমর্থন দেখা গেল, তখনই এর সমর্থকেরা মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকেও জোরালাে পাল্টা চাপের মুখােমুখি হলাে। মার্কিন প্রশাসন ইয়াহিয়া প্রশাসনের প্রতি তাদের সমর্থনকে যথার্থ বলে প্রমাণ করতে চাইল এই অজুহাতে যে তারা ইয়াহিয়া সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায় এবং সাহায্য বন্ধের যেকোনাে উদ্যোগ পাকিস্তানিদের প্রতি তাদের প্রভাবকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তারা পাকিস্তানে অস্ত্রশস্ত্র ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ অব্যাহত রাখল এবং সিনেট-সভায় সিনেটর কেনেডির মাধ্যমে তা প্রকাশও করল। অন্যদিকে আমেরিকানদের একটি বাংলাদেশ-সমর্থক গ্রুপ দূরদর্শী প্রচেষ্টা হিসেবে পাকিস্তানে সরবরাহকৃত অস্ত্রশস্ত্রের জাহাজটিকে নিরস্ত্র করার জন্য পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরে পাহারার আয়ােজন করলে এই ঘটনা ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করল । ওয়াশিংটনে ফিরে আসার পর আমার নিজের চেষ্টা ছিল হিলে কাজ করার ব্যাপারে মনােনিবেশ করা। আর এটা দরকার ছিল সাক্সবি-চার্চ সংশােধনীর ক্ষেত্রে সমর্থন আদায় করার জন্য। এ কাজে আমি বাংলাদেশ মিশন ও বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র—এই দুটি সংস্থার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হলাম। বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র বা বিআইসিকে এ বিষয়ে লবি করার জন্য তার কর্মীদের দায়িত্ব ছিল। এ দায়িত্বের মধ্যে ছিল প্রত্যেক কংগ্রেসম্যানের রাজনৈতিক অবস্থান এবং বৈশিষ্ট্যের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে ফাইল তৈরি করা। এরপর গােপন সমর্থন আদায়ের একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনামা তৈরি করা হলাে। ওয়াশিংটন ছাড়াও সারা দেশের সহানুভূতিশীল আমেরিকান ও বাঙালিদের আহ্বান জানানাে হলাে ওয়াশিংটনে আসার জন্য এবং এই লবি করার কাজে সহযােগিতা করার জন্য।
 
এই আহ্বানে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল। অজস্র লােক ওয়াশিংটনে আসার জন্য তাদের কাজ ছেড়ে দিল এবং গােপন সমর্থন আদায়ের কাজে তাদের সময় দিল। আমেরিকানদের পাঠানাে হলাে তাদের নিজ নিজ স্টেটের সিনেটরদের কাছে। অন্যদিকে নির্দিষ্ট সিনেটরদের প্রভাবিত করার জন্য পাঠানাে হলাে বাঙালিদের। এই গােপন সমর্থন আদায়ের কাজে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার কারণে আমি মার্কিন রাজনীতির জটিল দিকগুলাে জানার সুযােগ পেলাম। আমি আরও জানলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে রাজনৈতিক মতামত প্রভাবিত হয়। এই দলের সঙ্গে জড়িত কিছু কিছু মার্কিন বন্ধু এবং হিলের কর্মীদের মধ্যে যে বিপুলসংখ্যক বাঙালি একত্র হয়েছিল, তাদের কারাের কারাের ত্যাগ আমার স্মৃতিতে দীর্ঘদিন জাগরূক থাকবে। হিলের এই কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ দলের যে কয়েকজনের কর্মতৎপরতার কথা আমার মনে পড়ছে, তাদের মধ্যে আছেন হিলের একজন ঘােরতর সমর্থক টম ডাইনের স্ত্রী জোয়ান ডাইন এবং ডিগ্রি ক্লাসের তরুণ ছাত্র ডেইভ ওয়েসরাে, যিনি পরে বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্রের ফুলটাইম সেক্রেটারি হয়েছিলেন। তারা ছিলেন বাঙালি তরুণ কায়সার হকের সহযােগী । কায়সার হক এই অফিসে খুবই ভালাে কর্মতৎপরতা দেখিয়েছিল। হিলে টম ডাইন, গেরি টিংকার ও ডেল ডাইহান আগে থেকেই ছিলেন পরস্পরের বন্ধু । তারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হন সিনেটর স্যাক্সবির সহযােগী মাইক গার্টনারের মাধ্যমে। মে মাসে তিনি আমার উদ্দেশ্যে দুপুরের ভােজসভার যে আয়ােজন করেছিলেন, তখন থেকেই সিনেটর স্যাক্সবি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একজন ঘােরতর সমর্থক। তিনি যে সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল, তার বড় প্রমাণ তিনি তার নিজের প্রশাসনের বিদেশি সাহায্য বিলে স্বেচ্ছায় সংশােধনী এনেছিলেন। তিনি তার প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান রাখতে গিয়ে হােয়াইট হাউসের নানান চাপের শিকার হয়েছিলেন। এই পর্বে তার। সহযােগী মাইক গার্টনার ছিলেন সমর্থন ও পরামর্শদানের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযােগ্য উৎস। | সাক্সবি-চার্চ সংশােধনীর ক্ষেত্রে আমাদের গােপন সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা শেষতক এই সংশােধনীকে বাতিলের পর্যায়ে পৌছে দেয় এবং সিনেটের ফ্লোরে এ নিয়ে তীব্র বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এখানে একটি অদ্ভুত রকমের কোয়ালিশন হয়, বিশেষ করে উদারপন্থী সিনেটর ফ্রাংক চার্চ ও দক্ষিণী রক্ষণশীলদের মধ্যে। ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালাচ্ছেন তার সমর্থনে উদারপন্থীরা মার্কিন সাহায্যের অপচয় নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। কার্যত দেখা গেল, সংশােধনীর সমর্থক সব উদারপন্থীই একই ভঙ্গিতে কথা বলছেন। যা-ই হােক, তারা সবাই । যুক্ত হয়েছিলেন রক্ষণশীলদের মাধ্যমে।
 
১৯৭১ সালে বিপ্লবের প্রায় ২২ বছর পর সমাজতান্ত্রিক চীন জাতিসংঘে তার আসন থেকে তাইওয়ানকে সরিয়ে ফেলে। পুরাে ঘটনাটিই রক্ষণশীল কংগ্রেসিদের ভয়ানকভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তারা এটিকে দেখল মার্কিন সাহায্যনির্ভর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলাের একটি অকৃতজ্ঞ খেলা হিসেবে। ফলে তাদের আচরণ ছিল অনেকটা এ রকম যে যেকোনাে সময় তারা তাদের সাহায্য বন্ধ করে দিতে পারে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলােতে। যেহেতু পুরাে বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে গেছে, ফলে সিনেটের সভায় পুরাে সাহায্য বিলটিই অনুকূলে আসার বদলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলাে। এটি অবশ্যই বাকি দুনিয়ার জন্য বিষয়টিকে অনুকূলে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাড়াল। কিন্তু এটি একঅর্থে বাংলাদেশের গােপন সমর্থন আদায়ের যে প্রচেষ্টা সেদিক থেকে বিজয় বলেই পরিগণিত হলাে। কারণ, কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানসহ তার সাহায্যপ্রার্থী সব দেশের জন্যই নতুন সাহায্য দেওয়ার সব প্রতিশ্রুতি বাতিল করে দিল। তবে ঘটনা যা-ই হােক, এই বিজয় অবশ্য যথেষ্ট নয় যে মার্কিন প্রশাসনের পাকিস্তানে সাহায্য প্রদানকে সত্যিকার অর্থেই আটকে রাখতে পারে। কারণ, তত দিনে নিক্সন প্রশাসন ও তার ন্যাটোভুক্ত সব দেশই ইয়াহিয়া প্রশাসনের সমর্থকে পরিণত হয়েছিল। কাজেই মার্কিন জনগণ ও কংগ্রেসিদের মধ্যে আমাদের লবি করার যে প্রয়ােজনীয়তা ছিল, তা ধরে রাখা খুবই জরুরি হয়ে পড়ল। আর এটা দরকার হয়ে পড়ল স্রেফ পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে মার্কিন সাহায্য দেওয়ার যেকোনাে নতুন আশ্বাসকে ঠেকানাের লক্ষ্যে। ওয়াশিংটনে যখন গােপন সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চলছে, তখনাে পাকিস্তানের দাতা দেশগুলাের এইড কনসাের্টিয়ামে প্রভাব খাটানাের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা রয়ে গিয়েছিল আমাদের জন্য। কাজেই ১৯৭১ সালের অক্টোবরে ওয়াশিংটনের শেরাটন হােটেলে অনুষ্ঠিতব্য বার্ষিক বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ বৈঠক আমাদের সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টার জন্য লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলাে। যদিও পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বৈঠকের আলােচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তবু আমাদের বন্ধুরা পরামর্শ দিল যে পাকিস্তান এই বৈঠকটিকে তাদের দেশে সাহায্য পাঠানাের প্রতিশ্রুতি আদায়ের কাজে লাগাতে পারে এবং তাদের সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে পুনর্বিবেচনা করার জন্য কনসাের্টিয়ামের কাছে আবেদন জানাতে পারে। আমি আর এ এম এ মুহিত পাকিস্তানের ঘটনাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করে নতুন কাগজপত্র তৈরি করলাম। তাতে আমাদের বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ যেহেতু একটি জটিল অবস্থায় আছে, কাজেই পাকিস্তানে এ সময়ে যেকোনাে সাহায্য এ পরিস্থিতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
 
আমি আর মুহিত কনসাের্টিয়ামভুক্ত দেশগুলাের প্রতিনিধিদের প্রভাবিত করার দায়িত্ব নিলাম। আমাদের কাজ ছিল যেসব প্রতিনিধি বৈঠকে যােগ দিতে আসবেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলা এবং আমাদের কাগজপত্র তাদের দেওয়া। এই কাজে আমাদের একদিন সহযােগিতা করলেন অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। প্রকৃতপক্ষে তার কর্মস্থল ছিল ইয়েলে এবং তিনি ছুটে এসেছেন সেখান থেকেই। হােটেলের বাইরে একদিন বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র বা বিআইসি একটি ছােট মহড়ার আয়ােজন করল। মহড়ায় অন্যরা ছাড়াও জোয়ান ডাইন অংশ নিলেন। জোয়ান ডাইনের সঙ্গে তাঁর শিশুসন্তানটিও ছিল, যে তার বহন করার ছােট্ট বাহনে করে সেই মহড়ায় এসেছিল। একদিন ঘটনাচক্রে হােটেলের বাইরে মহড়ায় অংশ নিতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলেন মুহিত এবং নিরাপত্তা প্রহরীরা তাকে শেরাটন হােটেল থেকে বের করে দিল। সৌভাগ্যবশত আমি এ ঘটনার সময় কাছাকাছি ছিলাম এবং মুহিতকে আমাদের কাগজপত্রসহ উদ্ধার করতে পেরেছিলাম। এ ছাড়া গােপন সমর্থন আদায়ের সব কাজ হােটেলের ভেতরে থেকেই করার বিষয়টি ব্যবস্থা করে ফেললাম। এটা ছিল পুনরায় আমাদের জন্য একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা যে হােটেলের রুমে ও লবিতে প্রতিনিধিদের ধরছি এবং আমাদের কাজে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছি। কেউ কেউ আমাদের কথা শুনলেন, আবার কেউ কেউ আমাদের বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলেন না। আমরা কিছু বিস্ময়কর বিরােধিতারও মুখােমুখি হলাম।
এ রকম এক ঘটনায় আমি ছুটে গেলাম আমার এক পুরােনাে ক্লাসমেটের কাছে। তার নাম শাহপুর শিরাজী। কেমব্রিজে পড়াশােনা শেষ করার প্রায় ১৮ বছর পর দেখা হলাে আমাদের। তিনি তখন ইরানের ব্যাংক অব মারকাজির গভর্নর। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইরানের শাহ্ পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য দিচ্ছেন কি না। শাহপুর জানালেন যে বঙ্গবন্ধুর বিচার ঠেকানাের জন্য ইরানের শাহ্ বরং ইয়াহিয়ার সঙ্গে এ বিষয়ে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছেন। এই বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করার কোনাে উপায় অবশ্য আমার ছিল না। অন্য ঘটনায় আমরা দেখা করেছিলাম কেমব্রিজে আমাদের অন্য এক বন্ধুর সঙ্গে। তার নাম লাল জয়বর্ধনে। তিনি তখন শ্রীলঙ্কা সরকারের ইকোনমিকস অ্যাফেয়ার্সের সচিব। লাল অধ্যাপক ইসলাম ও আমার জন্য শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী এন এম পেরেরার সঙ্গে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করে দিলেন।
 
আমরা তাকে জানালাম যে পিআইএ এবং পাকিস্তান এয়ারফোর্স শ্রীলঙ্কায় ল্যান্ড করার যে অধিকার পায় সেটিকে বাংলাদেশে সেনা ও যুদ্ধাস্ত্র বহন করার কাজে অপব্যবহার করছে। কিন্তু তিনি এ ঘটনা অস্বীকার করলেন। তবে আশ্বাস দিলেন যে তিনি বিষয়টি দেখবেন এবং ল্যান্ডিং রাইটকে যাতে পাকিস্তান অন্যায় কাজে ব্যবহার করতে না পারে, তা তিনি দেখবেন। তিনি তার প্রতিশ্রুতি পালনে সফল হয়েছিলেন কি না, তার প্রমাণও পাইনি আমি । সে সময় আমার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব ছিল। জাতিসংঘে প্রচার চালানাের জন্যও আমি নিয়ােজিত হলাম। ১৯৭১ সালের অক্টোবর শুরু হতে যাচ্ছে। এমন একটি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রতিনিধিদল পাঠানাের জন্য সিদ্ধান্ত নিল বাংলাদেশ সরকার। এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়া হলাে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে। ম্যানিলা দূতাবাস থেকে বিদ্রোহ করে চলে আসা রাষ্ট্রদূত কে কে পন্নী, ইরাক থেকে বিদ্রোহ করে আসা রাষ্ট্রদূত এ ফতেহ, ড. এ আ মল্লিক এবং আমি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজনকে এই প্রতিনিধিদলের সদস্য করা হলাে। কিন্তু জাতিসংঘে গােপন সমর্থন আদায়ের ফলাফল ছিল আরও হতাশাজনক; যদিও আমাদের লক্ষ্য ছিল সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার পক্ষে একটি সিদ্ধান্ত (রেজলুশন) নেওয়ার জন্য সমর্থন আদায় করা। আমাদের আশা ছিল, অধিবেশনে বা কোনাে কোনাে কমিটিতে হয়তাে আমাদের পক্ষে কয়েকটি বক্তৃতা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কিছুই ঘটল না। কেননা, জাতিসংঘের বেশির ভাগ সদস্য দেশই নিরুৎসাহী ছিল। তাদের জন্য একটি সদস্য দেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে। তারা এটিকে মনে করছিল একটি সদস্য দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হস্তক্ষেপ হিসেবে। এমনকি সেই অবস্থায় ‘ভেটো’ দেওয়ার ক্ষমতা আছে—এমন কোনাে দেশও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে তাদের দেশের জনগণের সমর্থন আমাদের ধার দিল না ।। ফলে গােপন সমর্থন আদায়ের প্রাথমিক পর্ব একেবারেই বিফলে গেল। 

 
এ সময় আমি বাংলাদেশের পক্ষে বেশ কিছু বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নিজেকে নিয়ােজিত করলাম। এসব সমাবেশের প্রতিটিই ছিল দর্শক-শ্রোতায় পরিপূর্ণ। এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাকুজ বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক আনিসুর রহমান কর্তৃক আয়ােজিত উইলিয়ামস কলেজ এবং অধ্যাপক নূরুল ইসলাম কর্তৃক আয়ােজিত ইয়েলের সমাবেশ। এসব ছাড়াও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ড. মহিউদ্দিন আলমগীর ও আমি এমআইটিতেও একটি সমাবেশে বক্তৃতা দিলাম। সেসব সমাবেশের অনেকগুলােতেই পাকিস্তানিরা প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়ার ভয়ে উঠে চলে যেত এবং শেষ দিকে রাগ করার বদলে দুঃখের ভঙ্গিতে তাদের কেউ কেউ নালিশ জানাত। এভাবে আমি বেশ কিছু সমাবেশে হাজির হলাম এবং বেশ কয়েকটি পত্রিকার জন্য লেখালেখিও করলাম । যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের শেষ দিকে আমার দুটি চমৎকার উপস্থিতি ছিল টিভিতে। এ দুটোর একটি ছিল বােস্টনের ব্যক্তিমালিকানাধীন টেলিভিশনের অনুষ্ঠান এই অনুষ্ঠানটি আয়ােজন করা হয়েছিল আদালতে এবং তা জনগুরুত্বসম্পন্ন কয়েকটি ইস্যুর ওপর ভিত্তি করে, যেখানে দুজন আইনজীবী মামলা রুজু করা এবং তা রক্ষা করার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আইনজীবীদের প্রত্যেককেই তিনজন করে সাক্ষী আনার জন্য অনুমােদন দেওয়া হয়েছিল, যাঁরা নিজেদের অভিযােগ বর্ণনা করবেন। যত দূর মনে পড়ে, এই অনুষ্ঠানের আলােচ্যসূচিতে মামলার বিষয় ছিল—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সহায়তা দিচ্ছে। এই মামলায় বাংলাদেশের পক্ষে আইনজীবী কে ছিলেন, তা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। কিন্তু বিপক্ষে ছিলেন উইলিয়াম রাশার ।
 
রাশার ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী রক্ষণশীল সাপ্তাহিক ন্যাশনাল রিভিউর মালিক। এ সাপ্তাহিক কাগজটি আবার সম্পাদনা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপরিচিত ডানপন্থী ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম এ বাকলি জে আর। রাশার ছিলেন বাকলির ডান হাত এবং সম্ভবত চেঙ্গিস খানেরও। উপমহাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি জন ফস্টার ডালাসের সময়ে এসে থেমে ছিল। তিনি এখনাে ভারতকে আলাদা করতে পারেন। , যে ভারত ইন্দিরা গান্ধীর নাকি তার বাবার, যিনি ক্ষমতায় ছিলেন পঞ্চাশের দশকের প্রথমভাগে। তিনি এখনাে মনে করেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন। এই টেলিভিশন অনুষ্ঠানটির ব্যাপক দর্শক-শ্রোতা না থাকলেও একটি বেশ চমৎকার অনুষ্ঠান ছিল। কারণ এ অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে বা বিপক্ষে যা-ই হােক না কেন, অন্তত কিছু প্রশ্ন ও অভিযোেগ তােলা সম্ভব হয়েছে। রাশার তার মামলার কারণে ভুট্টোর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য টেলিভিশনের কুশলীদের পাকিস্তানে পাঠালেন। এ ঘটনা বরং আমাদের কাছে একটি পক্ষপাতমূলক প্রমাণ হিসেবেই পরিগণিত হলাে। এ ছাড়া রাশার নিউজার্সির কংগ্রেসম্যান ফ্রেলিংহাউসের সঙ্গে আঁতাত করার চেষ্টা করলেন। ইনি হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং পেপসি-কোলার অন্যতম ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের পক্ষে আমাদের আইনজীবী লেবার দলীয় এমপি জন। স্টোনহাউসের সহায়তা চাইলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন ঘনিষ্ঠ সমর্থক। শুধু টেলিভিশনের এই অনুষ্ঠানটির জন্যই তিনি লন্ডন থেকে উড়াল দিলেন। এ ছাড়া যুক্ত হলেন ওয়াশিংটনের ভারতীয় দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এম কে রাসগােত্র, যিনি পরে ভারত সরকারের পররাষ্ট্রসচিব হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানে আমিই ছিলাম একমাত্র বাংলাদেশি। অনুষ্ঠান ধারণের সময় স্টুডিওতে দর্শক-শ্রোতা ছিল পরিপূর্ণ। আমি তাঁদের সামনে এবং উৎসাহী অগণিত টিভিদর্শকদের সামনে আমার বক্তব্য পেশ করলাম।  টিভিতে আমার দ্বিতীয় উপস্থিতি ছিল আরও ঐতিহাসিক মুহূর্তে—এর আগে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের আমাদের কর্মতৎপরতা আরও বেড়ে গেল, যেহেতু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ অধিবেশনে উত্থাপিত হয়েছে। কারণ, তত দিনে ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পরিক শত্রুতামূলক। মনােভাব প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে।
 
ইতিমধ্যে উত্তর ভারতকে লক্ষ্য করে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর আকস্মিক বােমা হামলা ও আগ্রাসন বাংলাদেশ সীমান্তের একদিকে যেমন চরম উত্তেজনার জন্ম দিল, অন্যদিকে এর ফলে স্বাধীনতাযুদ্ধের তীব্রতাও বৃদ্ধি পেল । এ সময় পর্যন্ত পাকিস্তান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল যে তারা বাংলাদেশ প্রসঙ্গ জাতিসংঘের আলােচ্যসূচিতে তুলবে না, কিন্তু এখন তারা এই বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক চেহারা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগল। তারা চাইল বাঙালিদের স্বাধীনতাসংগ্রামকে বরং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে। একদিকে বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাদের অভাবিত ফলাফল এবং অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনারা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাওয়ার কারণে পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির জন্য এবং সীমান্তের অপর পারে ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে চাপ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন চাইল । এ কাজে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রবল সমর্থন পেল। জাতিসংঘে তাদের প্রথম কার্যকলাপ ছিল পাকিস্তানের মামলাটি একটি চিঠির মাধ্যমে পরিচালনার চেষ্টা করা। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ও সাধারণ অধিবেশনে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বা ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তারা সুযােগ খুঁজছিল এবং এটা ছিল তাদের জন্য একটি অপ্রতিরােধ্য সিদ্ধান্ত। আপাতদৃষ্টিতে প্রায় সব সদস্য দেশকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ বলে মনে হলেও যখন তারা এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব নেওয়ার জন্য তৈরি হলাে, তখনই দেখতে পেল তারা মােটামুটিভাবে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে উপস্থিত। এ রকম পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যৌথভাবে নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির জন্য সিদ্ধান্তের প্রস্তাব দিলে তা সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােট পেল। কিন্তু এই পথ স্রেফ সােভিয়েত ইউনিয়নই তার এক ‘ভােটো দিয়ে বন্ধ করে দিল। এই ভােটো’ ক্ষমতাকে এড়ানাের জন্য একই রকম আরেকটি প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আনা হলাে, যেখানে সদস্যরা প্রায় সবাই প্রস্তুত যুদ্ধবিরতির যেকোনাে প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন জানানাের জন্য। এই সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটিও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ পেল। অধিবেশনে এ-সংক্রান্ত বিতর্কে যেসব বক্তৃতা দেওয়া হয়েছিল, আমি তা সঙ্গে সঙ্গে বিশ্লেষণ। করে দেখছিলাম, খুব কম দেশই প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের পক্ষে ইতিবাচক অর্থে। সমর্থন দিয়েছে বরং আন্তর্জাতিক বিষয়ে সাধারণ বিধিবিধানের আওতায় শান্তির সমর্থনেই তারা যুদ্ধবিরতির পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল।
 
জাতিসংঘে সংঘটিত এই নাটকের দর্শক ছিলাম আমরা বাঙালিরা। এই নাটক আমরা দেখতে পেলাম গ্যালারিতে বসেই। জাতিসংঘে আমরা গােপন সমর্থনের যে চেষ্টা চালিয়েছিলাম, তাতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অনেকের ব্যক্তিগত সহানুভূতি পেলেও অধিবেশনের সময় ফ্লোরে খুব সমান্যই সমর্থন পেলাম। বেশির ভাগ বক্তা বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা এবং ৯ মাসের আগ্রাসনের ব্যাপারটি ভুলে গেলেও অবিলম্বে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে খুবই মনােযােগী ছিলেন। নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমি নিজে যেসব লবি করেছিলাম, তার ফলে নিউইয়র্কের ব্যক্তিমালিকানাধীন টেলিভিশনে উপস্থিত থাকার জন্য আমি আমন্ত্রণ পেলাম। এই চ্যানেলের বৈশিষ্ট্য ছিল, এটি নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ অধিবেশনের কার্যাবলির ওপর একটি ফিচার অনুষ্ঠান করবে। সাধারণ অধিবেশনে যে বিতর্ক হয়েছিল সেটার সঙ্গে যুক্ত করেই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এতে প্যানেল করা হয়েছিল দুটো, যার একটি গঠিত হয়েছিল শুধু আমেরিকানদের দিয়ে। যতটুকু মনে পড়ে, এই প্যানেলে ছিলেন টম ডাইন, নিউজউইকএর আর্নল্ড ডি বাের্চগ্রেভ এবং অন্য একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। এদের যুক্ত করার ফলে আলােচনার ধরন হয়ে উঠল ক্রিকৌণিক, যেখানে আলােচনা চলবে নিউইয়র্কে অবস্থিত পাকিস্তানি কনসাল জেনারেল নাজমুস সাকিব খান, ভারতীয় কনসাল জেনারেল ও আমার মধ্যে। আর এতে আমি কথা বলব বাংলাদেশের পক্ষে । পাকিস্তানি কনসাল জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হলাে যেন তিনি আমার সঙ্গে একই প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত থাকতে অস্বীকার করেন, যাতে তাঁকে এবং তাঁর ভারতীয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে একই সঙ্গে পর্দায় দৃষ্টিগােচর হয়। কিন্তু এর ফলে যখন আমি পর্দায় এলাম—অদ্ভুতভাবে ঠিক তখনই সাধারণ অধিবেশনের ভােট গণনা হচ্ছে ফলাফল ঘােষণার জন্য ।ঠিক যে সময়ে আমি আমার বক্তব্য পেশ করার জন্য মুখ খুলেছি, স্টুডিওর ক্যামেরাও চালু হয়েছে, ঠিক তখনই সেখানে দেখা যাচ্ছে সাধারণ অধিবেশনের ভােটের ফলাফল ঘােষণা করা হচ্ছে এবং প্রায় সবাই অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং ভারতীয় সেনাদের প্রত্যাহারের পক্ষে তাদের রায় দিয়েছেন। ক্যামেরা ঘুরে আবার আমার ওপর এসে নিবদ্ধ হলাে এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনাে সমর্থন যে পাওয়া গেল না, তার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে এবং এ বিষয়ে আমার জবাব কী? আমার যত দূর মনে পড়ে, আমি খুব দ্রুত জবাব দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেখানে গণহত্যা চালাচ্ছে, সেই বাংলাদেশ যুদ্ধের মূলে থাকলেও বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিতর্কে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশকে সাধারণ অধিবেশনে আমন্ত্রণ জানানাে হয়নি। কাজেই বাংলাদেশের জনগণ এবং বাংলাদেশের সরকার সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের কোনাে পক্ষ হিসেবে অংশ নেয়নি, ফলে যত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি আগ্রাসনকে পরাজিত না করছে, তত দিন পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। বাংলাদেশ পরিস্থিতি এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সংঘটিত বিতর্কের ওপর আমার বক্তব্য এবং উপস্থিত বিশ্লেষণ দর্শকশ্রোতারা বেশ ভালােভাবেই গ্রহণ করলেন। এ ঘটনার মাত্র এক দিন পরই। কয়েকজন অজ্ঞাত ব্যক্তি আমাকে নিউইয়র্কের রাস্তায় থামালেন। তারা টেলিভিশনে আমার বক্তব্য শুনেছেন এবং আমার যথার্থ মন্তব্যের জন্য খুবই প্রশংসা করলেন। | যা-ই হােক, তখন প্রকৃত নাটক চলছে বাংলাদেশে। তা ছাড়া কিছু অংশ অভিনীত হচ্ছে জাতিসংঘে। ইতিমধ্যে আমরা জানতে পারলাম যে প্রায় শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তিনি নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তান প্রসঙ্গ নিয়ে আলােচনা করার জন্য শিগগিরই নিউইয়র্কে আসছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত বেশ কিছু ঘটনা শেষ পর্যন্ত ভুট্টোর নিউইয়র্ক ফ্লাইটকে অনিশ্চিত করে তুলল। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অভাবিত অগ্রগতি এবং পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা একেবারে তছনছ হয়ে যাওয়ার কারণে জাতিসংঘ বিতর্কে নিজেদের মুখ তাদের নিজেদেরই বন্ধ করে দিতে হলাে। পাকিস্তানের জাতিসংঘ মিশনে কাজ করেন এমন একজন বাঙালি সাইফার ক্লার্কের’ (গুপ্ত ও সাংকেতিক লেখা লিখতে ও পড়তে পারেন যারা) মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম, একজন ‘টপ সিক্রেট’ সাইফার এই রিপাের্ট নিয়ে এসেছে। যে জেনারেল নিয়াজি এখন অগ্রবর্তী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য অনুমতি লাভের অপেক্ষা করছেন। আমরা আরও জানতে পারলাম যে ঢাকায় জাতিসংঘ প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরি রাও ফরমান আলীর পক্ষ থেকে এ রকম একটি মেসেজ পেয়েছেন, যাতে তিনি বলেছেন, তার অফিস এখন একটি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করছে, যেখানে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হবে যে বাংলাদেশ থেকে নিরাপদে পাকিস্তানি সেনাদের প্রত্যাহার করা যাবে। বিমানবন্দরেই ভুট্টোকে সংবর্ধনা জানানাের পাশাপাশি এ খবর জানিয়ে দেওয়া হলাে। আর এই খবর নিঃসন্দেহে তার জন্য ছিল বিব্রতকর।

নিরাপত্তা পরিষদে তার অভ্যুত্থান-পরিকল্পনাদাতারা তাদের উন্নাসিকতার জন্য তখন খুবই বিপদে পড়ল। এ রকম একটি পরিস্থিতির জন্য ভুট্টো মােটেই প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে তিনি পরবর্তী কয়েকটি দিন জাতিসংঘে মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ এবং জাতিসংঘে চীনা প্রতিনিধি হিসেবে সদ্য নিয়ােগপ্রাপ্ত হুয়ান হুয়াংয়ের সঙ্গে গল্পগুজব করে কাটালেন। আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল না, তাদের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু শিশগিরই আমরা জানতে পারলাম যে না, কোনাে আত্মসমর্পণের কথা নয়। আমাদের মনে হলাে ইসলামাবাদ থেকে নিয়াজি এবং ফরমান আলীর আত্মসমর্পণের বিষয়টি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের এই ভরসা দেওয়া হয়েছে যে তাঁদের জন্য নতুন সহায়তা আসছে শিগগিরই। ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর কাছে এ রকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলাে যে উত্তর দিক থেকে চীন এবং সমুদ্রপথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সাহায্য দেবে। হঠাৎ করেই আমরা দেখতে পেলাম যে নিরাপত্তা পরিষদের আরেকটি অধিবেশন ডাকা হয়েছে, যেখানে ভুট্টো ভাষণ দেবেন। | আবারও জাতিসংঘের বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা নিরাপত্তা পরিষদের গ্যালারির দর্শকে পরিণত হলেন নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টোর অভিনয় দেখার জন্য। এদিকে আমরা নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলাের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপআলােচনা চালানাের চেষ্টায় সময় ব্যয় করতে থাকলাম। তাদের পেছনে সময় ব্যয় করার উদ্দেশ্য একটাই—তাদের কাছে এই আবেদন জানানাে, যাতে তারা যুদ্ধবিরতির দাবির ব্যাপারে তাদের অবস্থানকে আরেকটু নমনীয় করে। আমরা তাদের এটা বােঝানাের চেষ্টা করলাম যে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অভ্যুদয় অবশ্যম্ভাবী। নিরাপত্তা পরিষদে বেশির ভাগ মুখপাত্রই তখন একমত হলেন যে বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব বিষয় এবং এর সমাধান একটাই—সম্মিলিত বাহিনীর দ্রুত বিজয় এবং যত শিগগির সম্ভব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ। তারা আরও একমত হলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন নিরাপত্তা পরিষদকে ব্যবহার করছে। তারা এ রকম একটি ধারণা তৈরি করতে চেয়েছিল—যেহেতু তারা তাদের বন্ধু ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন জানিয়েছে, কাজেই তার জন্য তারা সম্ভাব্য সবকিছুই করছে। নিরাপত্তা পরিষদের এই সভায় আমরা অক্সফোর্ডে পরিচিত আরও একজন ব্যক্তিকে পেলাম, যিনি পরিষদের জাপানি প্রতিনিধি। তিনি এরপর নিয়মিত দেখা করতেন আমার সঙ্গে এবং নিরাপত্তা পরিষদের সর্বশেষ তথ্য ও পরিস্থিতি আমাকে জানাতেন।

পরিষদে আমি পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের চোখেই পাকিস্তান-ভারতবাংলাদেশ বিতর্কটি দেখছিলাম। ভুট্টো যখন নিরাপত্তা পরিষদে তার ভূমিকা। পালন করছিলেন, তখনই এ রকম একটি খবর আমরা শুনতে পেলাম যে নিক্সন তাঁদের সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসারের দিকে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তবে নৌবহরটি কেন এ অঞ্চলে আসবে তা ব্যাখ্যা করা হলাে না। যে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের বিপর্যয় ঠেকানাের জন্য এ ব্যবস্থা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেষ মিনিটের সিদ্ধান্ত। আমাদের ধারণা, নিয়াজির কারণেই এই হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করা যায় এবং পাকিস্তানের মর্যাদা রক্ষা পায়। নিরাপত্তা পরিষদের নাটকে যে পার্শ্ব-অভিনয় চলছিল, সেটারই পূর্ণাঙ্গ অভিনয় শুরু হয় বাংলাদেশে। হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বা ভারতের উত্তর-পূর্ব সেক্টর থেকে চীনাদের বাধার বিষয়টি ছিল সম্ভাবনা মাত্র। আমরা শুনেছিলাম, ভুট্টোর প্ররােচনায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা পিকিংয়ের এই হস্তক্ষেপের উদ্যোগ নিয়েছিল। আমি নিজে এ সম্পর্কে আগে থেকেই জানতাম। অক্টোবরের শেষ দিকে আমি বেইজিংয়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সারের সঙ্গে একটি গােপন সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়েছিলাম। কায়সার জেনেভায় এসেছিলেন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতদের একটি সম্মেলনে যােগ দিতে। এই সম্মেলনের আয়ােজন করেছিলেন পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কায়সার গােপনে প্যারিসে উড়ে গিয়েছিলেন শুধু আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য। তিনি আমাকে এই গােপন তথ্যটি জানিয়েছিলেন যে চীন পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য কোনাে রকম সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না। তারা তাদের অস্ত্র-সাহায্য এবং কূটনৈতিক সহায়তা দিলেও গােপনে পরামর্শ দিয়েছিল পাকিস্তানকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝােতায় পৌছানাের জন্য। যদিও তারা প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন জানানাের নানান কায়দা দেখাচ্ছিল। আমি তার কথামতাে সব তথ্য জোগান দেওয়ার জন্য আমিই একমাত্র চ্যানেল ছিলাম না। বেইজিংয়ের পাকিস্তান দূতাবাসের বেশ কিছু বাঙালিও ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশে এসব তথ্য পাচার করেছিলেন। আমি অবশ্য জানি না, এসব গােপন তথ্যের ভিত্তিতে এ অঞ্চলে বিশেষ কোনাে সামরিক কৌশলের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল কি না। নিরাপত্তা পরিষদের ভেতরে ও বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান এমন কৌশল গ্রহণ করল যে ক্ষমতা থাকলে সম্মিলিত বাহিনীর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বাধ্য করুক। এই পরিস্থিতি ১০ ডিসেম্বরের সময়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ইসলামাবাদ এই নির্দেশ দিল, যেকোনােভাবেই তােক পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেন আত্মসমর্পণের জন্য কিছুটা সময় নেয়। কারণ তাদের ধারণা ছিল, বাইরের সাহায্য হয়তাে এসে পড়বে এরই মধ্যে । আমি যখন দেশে ফেরার পথে নিউইয়র্ক ত্যাগ করে লন্ডনে এলাম, তত দিনে পুরাে পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারণে যুদ্ধের নতুন মাত্রা পাওয়ার সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়ে গেল। কল্পনাতেও আর ঠাই পেল না সপ্তম নৌবহর।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বহু প্রত্যাশিত আত্মসমর্পণের খবর আমরা যখন পেলাম তখন আমি অক্সফোর্ডে । আমরা টেলিভিশনে এই দৃশ্য দেখতে পেলাম যে জেনারেল নিয়াজি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তার অস্ত্র লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার কাছে সমর্পণ করছেন। তবে এটা তখনাে আমাদের কাছে অজ্ঞাত যেখানে জেনারেল নিয়াজির সেনাবাহিনীকে সহায়তা দেওয়ার জন্য সপ্তম নৌবহর আসছে, তখন তিনি কেন আত্মসমর্পণ করছেন। হয়তাে-বা এটাই নিক্সনের আরেক ধরনের সম্পর্কের নমুনা যে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েই তিনি এটা প্রমাণ করতে চাইলেন যে তারা সত্যি সত্যি পাকিস্তানের শুভাকাঙ্ক্ষী। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমর্থন এ ধরনের হস্তক্ষেপের পক্ষে একেবারেই সংগতিপূর্ণ নয়। প্রচারমাধ্যম এসব বিষয়ে তখন রীতিমতাে উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে চার্চ, কেনেডি এবং বাংলাদেশের অন্যান্য বন্ধুর নেতৃত্বে জ্যাক এন্ডারসন তাঁর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করলেন, যেখানে তিনি ফাস করেছিলেন নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাবগুলাে। এতে মার্কিন টেস্ট ডিপার্টমেন্টের উদ্দেশে নিক্সন যে ভারতের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, সে সম্পর্কে কিসিঞ্জারের প্রতিবেদনগুলােও তুলে ধরলেন। এটা যদিও দেখা গেছে যে মার্কিন জনগণ, প্রচারমাধ্যম বা কংগ্রেসিদের মতামত বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তত সহানুভূতিশীল নয়, কিন্তু নিক্সন প্রশাসন ছিল আরেক কাঠি এগিয়ে—তারা এসব অগ্রাহ্য করেই সমর্থন জানিয়েছিল পাকিস্তানকে। নিক্সন প্রশাসনের সহানুভূতিহীনতা বা মার্কিন জনগণের উদাসীনতার পরও আমাদের প্রচারকাজের চেষ্টা। এগুলাের কোনােটাই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আমরা শেষ পর্যায়েও দাতাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করলাম এটা দেখার জন্য যে তারা পাকিস্তানে নতুন কোনাে সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছে কি না। আর এর জন্য নভেম্বরের প্রথম দিকে আমাকে শেষবারের জন্য প্যারিস সফরে যেতে হলাে। পাকিস্তান কনসাের্টিয়ামের বৈঠকের আগে। এ ছাড়া কারগিলের সঙ্গে আরেকটি প্রাতরাশের বৈঠক নিশ্চিত করতে হলাে, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ছাড়াই কনসাের্টিয়াম পাকিস্তানকে নতুন কোনাে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি অথবা ঋণ না দেয়। | আমাদের এ ধরনের অবস্থানে পাকিস্তানের মুখােশ আরও খুলে গেল।
তারা হুমকি দিল এ ধরনের ঘােষণা দেওয়ার যে তারা একতরফাভাবেই ঋণ পরিশােধ বন্ধ রাখবে। এ ধরনের ঘটনা খুব শিগগিরই দাতা দেশগুলােকে, বিশেষ করে জাপানকে খেপিয়ে তুলল। তারা আরও প্ররােচিত হলাে পাকিস্তানে সব সাহায্য বন্ধ করে দিতে এবং উদ্যোগ নিল পাকিস্তানের সম্ভাব্য ভূমিকার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে। এ পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক হয়তাে উপলব্ধি করল যে পরিস্থিতি সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে এবং পাকিস্তান ও কনসাের্টিয়ামের মধ্যে একটি আপসরফা হওয়া দরকার যেটি পাকিস্তানকে দেনা পরিশােধ না করার উদ্যোগ নেওয়া থেকে বিরত রাখবে। এখানে আবারও এই সত্য অনুমিত হলাে যে দাতাদের কাছে আমাদের প্রচার অব্যাহত রাখা প্রয়ােজন, যাতে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতি নমনীয় মনােভাব তৈরি করা যায়। ফলে দেখা গেছে, মে মাসে আমি নিজে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যে প্রচারকাজ শুরু করেছিলাম, তা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কনসাের্টিয়ামের সদস্যরা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানকে কোনাে নতুন সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়নি। যা-ই হােক, তারা অবশ্য খাদ্য ও পরিবহন যন্ত্রাংশ সরবরাহের ভঙ্গিতে রিলিফ দেওয়ার | প্রতিশ্রুতি দেয়। আর ওই সাহায্যদাতারা দেয় বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার জন্য এবং শুধুই মানবিক কারণে। | যা-ই হােক, প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের বিদেশি সাহায্য লাভের সম্পূর্ণ সুযােগ তখনাে অবশিষ্ট ছিল। তবে বাংলাদেশ অঞ্চলে যে আমদানি-প্রক্রিয়া চালু ছিল, সেটা কঠোরভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার যে সঞ্চয় এ অঞ্চলে ছিল। কার্যত পাকিস্তান সে সময় সেটাই খেয়ে ফেলতে থাকে। এটা পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছিল। যে অন্তত পশ্চিম পাকিস্তানে গ্রহণযােগ্য মাত্রায় আমদানি-প্রক্রিয়া চালু রাখতে চাইছিল পাকিস্তান। তবে দাতাদের কাছে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধে আমাদের যে আবেদন ছিল, সেটা খুব একটা সার্থক হতে পারেনি। কারণ, দাতারা অভিযােগের সুরে বলছিল, এর ফলে নানা রকম আইনগত জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ফলে পাকিস্তানের ব্যাপারে আমাদের প্রচার যতটা না ছিল তাদের কার্যকলাপ ধরে রাখার উদ্দেশ্যে, তার চেয়েও বেশি ছিল রাজনৈতিক ও মানসিক । কিন্তু তারা সবাই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ ভালােভাবেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল। পাকিস্তান টের পেল, দিনের পর দিন চলে গেলেও তারা সাহায্যের নতুন কোনাে আশ্বাসই আদায় করতে পারছে না, বরং তারা এই সন্দেহ করতে শুরু করল যে যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আরও প্রলম্বিত হয়, তাহলে তাদের বড় রকমের অর্থনৈতিক সংকটের মুখােমুখি হতে হবে এবং এর প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তান ও তার জনগণের ওপর পড়তে বাধ্য। নভেম্বরে প্যারিসে আমার শেষ সফরের উদ্দেশ্যই ছিল চূড়ান্ত কনসাের্টিয়াম বৈঠকে পুরােনাে’ পাকিস্তানের পক্ষে যে সাফাই গাওয়া হবে, সে সম্পর্কে আমা দের বক্তব্য পেশ করা। বৈঠকে আমি বিশেষ সুবিধা ভােগ করলাম বিশিষ্ট ফরাসি নােবেল লরিয়েট আঁদ্রে মালরাে (Andre Malraux)-এর সৌজন্যে। কারণ আগেই আমরা পত্রিকায় পড়েছিলাম মালরাে ইতিমধ্যেই জনসমক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি তার সমর্থন ঘােষণা করেছেন এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন যে তিনি জার্মান প্রতিরােধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তার ফরাসি সহকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করবেন এবং মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য তাদের এর সঙ্গে যুক্ত হতে আহ্বান জানাবেন।
মালরাের বয়স ছিল তখন ৭০ বছর এবং তার স্বাস্থ্য মােটেও ভালাে ছিল না। ফলে এটা স্পষ্ট ছিল না যে তিনি এ অবস্থায় বাস্তবে কতটা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন। কিন্তু ডানিয়েল থরনার এটা ভালােভাবেই উপলব্ধি করতে পারলেন যে বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমি অন্তত তার ব্যক্তিত্বকে আমাদের কাজে ব্যবহার করার জন্য তাকে আহ্বান জানাতে পারি। ডানিয়েল আমাকে প্যারিসের অদূরে মালয়াের বাড়িতে নিয়ে গেলেন এবং সেখানে আমি প্রথমবারের মতাে এই বিশাল ব্যক্তিত্বের কারণে বৈঠকে বিশেষ মর্যাদা লাভ করলাম। মালরাে অত্যন্ত ভালােবাসা দিয়ে আমাদের সম্পর্কে বললেন। তিনি এটাও বললেন যে স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের সময় তিনি ছিলেন একজন বৈমানিক এবং সে অবস্থাতেও তিনি এই প্রজাতন্ত্রের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে ছুটে গিয়েছিলেন। তবে এটা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন যে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য একটি দেশ নিয়ে উঠেপড়ে লাগতে চান না তিনি সংগত কারণেই। তিনি মনে করেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ন্যায়বিচার হওয়া দরকার। যেহেতু যথেষ্ট বয়স হয়েছে তার এবং তার স্বাস্থ্যও ভালাে নয়, কাজেই তিনি সাবেক প্রতিরােধযুদ্ধের সেনাদের বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার জন্য এবং এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আহ্বান জানাবেন। তিনি উল্লেখ করলেন, এরা গেরিলা যুদ্ধে এদের মূল্যবান দক্ষতা, বিশেষ করে গােলাবারুদ এবং যােগাযােগ ক্ষেত্রে এদের অভিজ্ঞতা দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে পারবে। তিনি নিজে যেচেই এ রকম একটি দল নিয়ে যেতে রাজি হলেন, যারা গােলাবারুদ ও যােগাযােগব্যবস্থার যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত থাকবে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য।
তিনি আমার সঙ্গে এরপর এ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর। প্রয়ােজনীয়তা বিষয়ে একেবারে উৎসমূলভিত্তিক কারিগরি আলােচনায় মগ্ন হলেন। তিনি আমাকে এ ধরনের যুদ্ধে তার জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে বাস্তব সমস্যার কথাও উল্লেখ করলেন। এ ব্যাপারে তাকে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার কোনাে যােগ্যতাই ছিল না। তবে তার এ রকম সহযােগিতাপরায়ণ আচরণের জন্য বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে আমি তাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালাম। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তার সহযােগিতা প্রদানের প্রতিশ্রুতির জন্য তাঁকে ধন্যবাদও জানালাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া ছাড়াও তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তিনি গলিস্ট (Gaullist) মন্ত্রিসভায় তার। সাবেক সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলবেন এবং ফ্রান্স যাতে পাকিস্তানে আর কোনাে অস্ত্র-সাহায্য না পাঠায়, তার জন্য তাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন, যদিও পাকিস্তান ঋণ পরিশােধে ব্যর্থ হওয়ায় অস্ত্র সাহায্যের বিষয়টি আপনা-আপনিই  শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়। পরে অবশ্য মনে হলাে যে ফ্রান্স অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে রাজনৈতিক বিষয়ের চেয়ে তাদের নীতিমালাকেই অধিকতর গুরুত্ব দেয়।  আগেই আমি এটা উল্লেখ করেছি যে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে যখন আমি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পেলাম, সে সময়ে আমি অক্সফোর্ডে। সে বছরেরই প্রথম দিকে আমি অক্সফোর্ডের কুইন এলিজাবেথ হাউসের পক্ষ থেকে একটি ফেলােশিপ পেয়েছিলাম, যেটা দিয়ে অক্সফোর্ডে আমি আমার পরিবারের খরচ খানিকটা নির্বাহ করতে পারতাম, যদিও আমি এই ফেলােশিপের খুব সামান্য একাডেমিক কাজই করতে পেরেছিলাম। বরং আমি। আমার পুরাে সময়টাই বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের কাজে ব্যয় করে ফেলি। ফলে একসময় আমার একটি চিন্তা মাথায় এল—অক্সফোর্ডে আমার পরিবারের সঙ্গে থেকেই আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট এবং এর কারগুলাে নিয়ে একটি বই লিখতে পারি এবং সেটা আমার ফেলােশিপের অর্থের সাহায্যেই করা সম্ভব। যা-ই হােক, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অভ্যুদয়ের আনন্দউল্লাসের সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা মনে হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে দূরে থাকা অসম্ভব একটি বিষয় হয়ে উঠল আমার কাছে। কাজেই আমি ঠিক করলাম কলকাতা হয়ে নিজ দেশ বাংলাদেশে চলে যাব, যদিও তখন পর্যন্ত কলকাতা। থেকে ঢাকায় কোনাে ফ্লাইট আদৌ ছিল না। | কলকাতায় আমি অধ্যাপক মােশাররফ হােসেন, ড. স্বদেশ বসু এবং ড. আনিসুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করলাম।
তারা তখন কয়েক মাস ধরেই শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছিলেন এবং এগুলাের জন্য নীতিনির্ধারণী কাগজপত্র তৈরি করছিলেন। মােশাররফ এরই মধ্যে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার সঙ্গে ঢাকায় চলে গেলেন এবং আবার ফিরে এলেন কলকাতায় চলে আসা তার পরিবারের সদস্যদের সংগঠিত করার জন্য। ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর জনাব কামরুজ্জামান, মােশাররফ ও আমি অবশেষে ঢাকা বিমানবন্দরের উদ্দেশে উড়াল দিলাম । আমাদের ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত বহন করে নিয়ে এসেছিল ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি প্রাচীন ডিসি-৩ বিমান। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বিমানবন্দরে দেখা হলাে আমাদের। তাঁর সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল এপ্রিলের সেই ভয়াবহ দিনগুলােতে, যখন সারা বিশ্বের কাছে প্রচারের জন্য আমি তার ঐতিহাসিক বিবৃতির খসড়া তৈরি করছিলাম। বিমানবন্দরে যখন পৌছালাম তখন ছিল শীতের সকাল, কিন্তু বেশ উজ্জ্বল। ছিল সূর্যের আলাে। এ রকম একটি অবস্থায় আমাদের মনে হচ্ছিল, যেন বহু বছর ধরে নিগৃহীত এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জনগণের জন্য অফুরন্ত আশা আর। সম্ভাবনার বাণী নিয়ে খুব কাছেই অপেক্ষা করছে একটি নতুন বছর ।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : ফরিদ কবির

সূত্রঃ বাংলাদেশের অভ্যুদয় – রেহমান সোবহান

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!