You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাংলাদেশের জন্য সমঝােতা বৈঠক
বৈপরীত্যে ভরা ব্যাখ্যা পাকিস্তানের, এবং তার মধ্যেও বিশেষ করে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের সিংহভাগই পরিচালিত হচ্ছিল সামরিক বাহিনীর খেয়ালখুশিমতাে। তাদের কাজকর্মের মূল্যায়ন করতে হলে ২৫ মার্চ ও তার পরবর্তী দিনগুলােতে পাকিস্তানে যা যা ঘটেছে, তার দিকে ফিরে তাকানাে দরকার। ২৫ মার্চের আগে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইয়াহিয়া। খানের রাজনৈতিক সংলাপ ব্যর্থ হওয়ায় ২৫ মার্চের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল—এমনটা বলা হয়ে থাকে। ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া খানের যে ভাষণ সম্প্রচার হলাে, সেখানেও এই বক্তব্যের কিছু প্রতিফলন দেখা যায়। ৬ মে এসে পাকিস্তান সরকার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করল। তাতে বলা হলাে, ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার ফন্দি এঁটেছিলেন। এ কাজে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিদ্রোহী বাঙালি সেনাদের সহযােগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ২৫ মার্চই আঘাত আনা হয়। এই ব্যাখ্যার সামান্য অংশও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণে ছিল না। এসবই পরে চিন্তাভাবনা করে বের করেছিলেন জেনারেলরা। এই ব্যাখ্যার সমর্থনে কোনাে পর্যবেক্ষকেরও কোনাে তথ্য নেই।  আসলে ঘটনাটি কী ছিল—এ নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অনেকেরই টুকরাে টুকরাে তথ্য জমা আছে, তবে ওই ঘটনার পেছনে সত্যিকারের কী উদ্দেশ্য ছিল, তার ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। সরাসরি যা কিছু নথিভুক্ত, তাতেই জোর দেওয়া উচিত, যদিও কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ঘটনা সম্পর্কে যে ধারণা তা একেবারে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
 
প্রথম দফা বৈঠক
 
সংবিধান নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় জানুয়ারির মধ্যভাগে। আশা করা হচ্ছিল, প্রেসিডেন্ট ওই বৈঠকে পাকিস্তানের ‘ঐক্য ও অখণ্ডতা বলতে তিনি কী বােঝাতে চাইছেন এবং আওয়ামী লীগ যে ছয় দফা দাবি পেশ করেছে, তার কোন দফাটি শাসকশ্রেণির কাছে অগ্রহণযােগ্য বলে মনে হচ্ছে, এসব বিষয় পরিষ্কার করবেন। আরও আশা করা হচ্ছিল, সেনাবাহিনীর স্বার্থ’ কী এবং কোন শর্তের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান, সে বিষয়ে তিনি সুস্পষ্টভাবে কিছু বলবেন। প্রেসিডেন্টের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ (এলএফও), ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিতর্কে যার উল্লেখ করা হয়েছে, আসলে একটি অস্পষ্ট নথি। একেকজনের কাছে এর একেক রকম অর্থ। পাকিস্তানের ‘ঐক্য ও অখণ্ডতা’ ক্ষুন্ন হতে পারে—এই অজুহাতে শাসকশ্রেণি নির্বাচনের প্রসঙ্গটিই ভুলে যেতে চাইল। আসলে পাকিস্তানের স্থায়িত্ব নিয়ে তাদের কোনাে মাথাব্যথা ছিল না। এলএফওতে জাতিসত্তা প্রসঙ্গে যার ব্যাখ্যা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযােগ্য হবে, সেটিই মেনে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল । এলএফও এ কারণে প্রাসঙ্গিক ছিল যে তাতে সংবিধানের যেকোনাে বিধিবিধানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্টের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা সংরক্ষিত ছিল। যেহেতু এলএফও খুব সুনির্দিষ্ট ছিল না এবং কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ভেটো দিতে পারবেন, তা-ও বলা ছিল না, সে কারণে আশা করা হচ্ছিল, প্রেসিডেন্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এলএফওতে বলা নেই, সে সম্পর্কেও বলবেন। কিন্তু সে আশা পূরণ হলাে না। মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়ার প্রাথমিক আলােচনায় বলার মতাে কোনাে ইতিবাচক অগ্রগতি হলাে না। ইয়াহিয়ার সহযােগী হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবি ও এর প্রভাব কী হতে পারে, সে সম্পর্কে আলােচনা আড়াল থেকে শুনতে লাগলেন। তিনি আসলে দেখতে চাইছিলেন যে আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে কি না। তিনি দেখলেন, ছয় দফা দাবি নিয়ে আইনি ও অর্থনৈতিক যে প্রশ্নগুলাে ছিল, সে সম্পর্কে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টারা প্রতিনিধিদলকে খুব ভালােভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। হয়তাে তিনি জানতেনও যে আওয়ামী লীগের পরামর্শকেরা আসলে ওই বৈঠকের আরও বছরখানেক আগেই প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে সংবিধানের খসড়া তারা তৈরি করেছিলেন এবং যেসব বিষয় নিয়ে দরকষাকষি হতে পারে, সেগুলাের বিষয়ে বক্তব্যও চূড়ান্ত করে রেখেছিলেন।
 
প্রথম দফা আলােচনার পর মনে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট সন্তুষ্ট। ছয় দফা মানে পাকিস্তানকে ভেঙে টুকরাে করা নয়, সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বললেন, এ নিয়ে ভুট্টোর সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে, তাহলেই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া দ্রুত হবে। ঢাকা ছাড়ার আগে তিনি শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী আখ্যা দিলেন।
 
ভুট্টোর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের আলােচনা
 
আওয়ামী লীগের বিশ্বাস ছিল, যা কিছু প্রেসিডেন্ট বলে যাননি, তা ভুট্টোর মুখ দিয়ে তিনি বলতে চান। ঢাকা থেকে ইয়াহিয়া লারকানায় ভুট্টোর বাড়িতে গেলেন। সেখানে তাদের দীর্ঘ বৈঠক হলাে। ঢাকায় ভুট্টোর সফরের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে এবং গুরুত্বের সঙ্গে আলােচিত হবে, এমনটিই সিদ্ধান্ত হলাে । | এর কয়েক সপ্তাহ আগে আমি পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। সেখানে পিপিপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তারা পিপিপির পক্ষে সংবিধান রচনার কাজে যুক্ত ছিলেন। ওই দলে শুধু ছিলেন আইনজীবীরা। অস্বাভাবিক যে বিষয়টি লক্ষ করলাম, তা হলাে ওই দলে কোনাে অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। তাদের সঙ্গে কথা বলে লাভ হলাে এই যে বুঝলাম, তারা ছয় দফার যে বিষয়গুলাে নিয়ে তাদের আপত্তি আছে, তার একটা খিচুড়ি সংস্করণ বানাচ্ছেন। ওই আলােচনা থেকে আমি নিশ্চিত হলাম যে তাদের দিক থেকে বিকল্প প্রস্তাব দেওয়ার কোনাে প্রস্তুতি নেই। এমনকি ছয় দফার কোন কোন বিষয় নিয়ে তাদের আপত্তি এবং সে আপত্তির পেছনের যুক্তি নিয়েও তারা কোনাে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেননি। তবে তাঁরা ধারণা দিলেন যে ঢাকায় আসার আগে পিপিপির ওই টিমটি তাদের বিকল্প প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে ফেলবেন।
 
অবস্থান ব্যাখ্যা
 
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ভুট্টো বাংলাদেশে এলেন। প্রথমে তিনি সরাসরি মুজিবের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। তারপর ভুট্টোর সংবিধান বিশেষজ্ঞ দল আওয়ামী লীগদলীয় তাদের প্রতিপক্ষের সঙ্গে বসল। কথাবার্তা যত গড়াল ততই পরিষ্কার হয়ে উঠতে লাগল যে আসলে পিপিপি তখনাে তাদের খসড়া প্রস্তুত করেনি। ইয়াহিয়া ছয় দফা সম্পর্কে যে কথা বলে গিয়েছিলেন, পিপিপিও সেই একই সুরে কথা বলছে। এতে করে সত্যিকারের কোনাে সমঝােতায় পৌছানাে অসম্ভব হয়ে পড়ল। ভুট্টো বিকল্প কিছু প্রস্তাব দেবেন এবং তাতে উভয় পক্ষের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা দূর হবে, এমনটাই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল না। আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিষয় উত্থাপিত হওয়া, সেগুলাে খতিয়ে দেখা দ্বিতীয় দফায় আরও যৌক্তিক একটা আলােচনার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে গেল। ভুট্টো ঢাকা ছাড়ার আগে ৩০ জানুয়ারি বললেন, ‘কোনাে অচলাবস্থা তৈরি হয়নি। এবং আপনি ২৩ বছরের সমস্যা এক দিনে সমাধান করতে পারবেন না।’ তিনি আরও যােগ করলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে তিনি আরও বৈঠক করবেন। মতৈক্যে পৌছানাের চেষ্টা করবেন। তারপর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝােতা বৈঠকে বসবেন। সে কারণেই ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ পর্যন্ত সংসদের অধিবেশন বসা উচিত হবে না বলেও তিনি উল্লেখ করলেন। বললেন, যেসব বিষয়ে সমঝােতা হয়ে গেছে, সেগুলাে নিয়ে সংসদে হাজির হওয়ার কোনাে প্রয়ােজন নেই; সংসদ অধিবেশন চলার সময়ও সমঝােতার জন্য আলােচনা চলতে পারে।
 
ভুট্টোর বয়কট ঢাকা বিমানবন্দরে ভুট্টো বললেন, আলােচনা ফলপ্রসূ হয়েছে এবং ছাড় দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি একেবারে অনড় এমনটা বলা যাবে না। তিনি আবারও বললেন, সংসদ অধিবেশনেও নেতাদের মধ্যে সংলাপ চলতে হবে। তিনি সংসদীয় কমিটিতে আলােচনার ইঙ্গিত দিলেন এবং বললেন, এটি একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। আমার মনে হয়, তার এসব মন্তব্য থেকে কোনাে সিদ্ধান্তে পৌছানাে ঠিক ছিল না। যেমন এম বি নকভিও ভেবেছিলেন। কারণ, আলােচনায় যে তির্যক বাক্য বিনিময় হয়েছিল, তাতেই বােঝা গিয়েছিল যে ভবিষ্যৎ আলােচনার পথ রুদ্ধ। আওয়ামী লীগ অবশ্য জনসমক্ষে ভুট্টোর যে ভাবভঙ্গি তাকে খুব একটা আমলে নেয়নি। তাই ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকের তিন দিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো যখন সংসদ অধিবেশন বয়কটের ঘােষণা দিলেন, তার সঙ্গে ঢাকায় ভুট্টোর সফর ও বৈঠকের কোনাে সম্পর্ক আওয়ামী লীগের নেতারা খুঁজে পেলেন না। তারা ধরে নিলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে এটা ইয়াহিয়া বা তার কোনাে জেনারেলের ষড়যন্ত্র । জেনারেলদের মনােভাব কমপক্ষে দুজন জেনারেলের মনােভাব শুরু থেকেই পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছিল। তারা হলেন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল উমর এবং আন্তবাহিনী গােয়েন্দাপ্রধান (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) আকবর। পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে যাক, তা তারা একেবারেই চাননি। তার ওপর বাঙালিদের হাতে এই শাসনভার এসে পড়ুক, এটা তাে তারা মানতেই পারছিলেন না। ইয়াহিয়া কিংবা তাঁর সহযােগী পীরজাদা এ দুই জেনারেলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন কি না, কিংবা ওই দুই বাজপাখি’র কথামতাে চলতে বাধ্য হয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। উমর ও আকবর তখন যেভাবে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছিলেন, সেটাকে এককথায় দৃষ্টিকটু বলা চলে। তাঁদের সঙ্গে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্সের প্রধান রিজভী, ইয়াহিয়ার মন্ত্রিসভার পাঞ্জাবি মন্ত্রী নওয়াব কিজিলবাশও ছিলেন। এই কিজিলবাশ আবার কাইয়ুম খানের মুসলিম লীগকে সমর্থন দিয়েছিলেন। মুজিব ও ভুট্টো নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের হিসাব-নিকাশ উল্টে দিলেন। নির্বাচন সম্পর্কে আকবর যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হলাে। তখন তারা পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষায় ভুট্টোর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
 
জাতীয় পরিষদে বেলুচিস্তানের এমএনএ গাউস বক্স বেজেনজো, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে নির্বাচিত এমএনএ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রেসিডেন্ট ওয়ালী খান, পাঞ্জাবের এমএনএ ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রেসিডেন্ট মিয়া মমতাজ দৌলতানা, পাঞ্জাবের সাংসদ ও পাঞ্জাব কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রেসিডেন্ট সরদার শওকত আলি প্রত্যেকেই দাবি করেন যে উমর নিজে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। ভুট্টো সংসদ অধিবেশন বয়কটের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা যেন তাতে সমর্থন দেন, এমন কথা আদায়ই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তাদের একজন এমনকি এ-ও বলেছেন যে উমর নিজেকে ইয়াহিয়ার মুখপাত্র বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি বলে বেড়াচ্ছিলেন, মুজিবকে ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক মােৰ্চা চান। বয়কটের উদ্দেশ্যও ছিল তা-ই। তবে বয়কটের ফলে কী পাওয়া গেল, তা এখনাে পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ। ধারণা করেন, ভুট্টোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থন জোগাতে সময় নেওয়া হচ্ছিল। পাঠানদের নেতা ওয়ালী খানের সঙ্গে ভুট্টোর আলােচনার সময় ওয়ালী খান তাকে বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদে তিনি মুজিবকে সমর্থন দেবেন। পশ্চিমের অন্য নেতাদের কাছ থেকেও একই ধরনের বার্তা পাওয়া যাচ্ছিল। এর ফলে সংবিধানের খসড়ায় যে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন দরকার, তা অর্জনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। পিপিপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া দলগুলাে কেন্দ্রে অংশীদারির ভিত্তিতে যে সরকার গঠিত হবে, তাতে নিজ নিজ দলের অন্তর্ভুক্তি দাবি করতে লাগল। কেন্দ্রের শাসনভার থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কায় ভুট্টোর নিজের দল পিপিপিতেও ভাঙনের কথা শােনা গেল। দলে সিন্ধের বেশ কিছু সুযােগসন্ধানী জমিদার ছিলেন, যারা বললেন শাসনক্ষমতার বাইরে যেতে হলে তারা দলের নেতৃত্ব মানবেন না, বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন।
 

ভুট্টো যখন সংসদকে কসাইখানা’ বললেন, তখনই বােঝা যাচ্ছিল। যে ভুট্টো আসলে জেনারেলদের মনের ভেতর পুষে রাখা শঙ্কাটাকেই প্রকাশ করে ফেলেছেন। তাদের ভয় ছিল, মুজিব যদি তার সংবিধানের পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ভােট পান, তাহলে এলএফওতে প্রেসিডেন্টের যে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আছে, সেটা প্রয়ােগ করা কঠিন হয়ে পড়বে। সে কারণেই সময়ক্ষেপণের প্রয়ােজন দেখা দিল। সেই সঙ্গে ভুট্টোর পেছনে সব রাজনৈতিক দলকে এক করে একটি ঐক্যমঞ্চ তৈরির চেষ্টা চলতে লাগল । ভুট্টো তখন মুজিবের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না মুজিব তার ছয় দফা সংস্কার করছেন, ততক্ষণ সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। কিন্তু মুজিবের পক্ষেও কোনাে রকম সংস্কারের পথে যাওয়া ছিল অসম্ভব। কারণ প্রথমত, মুজিবের প্রচারের ভিত্তি ছিল ছয় দফা এবং দ্বিতীয়ত ইয়াহিয়া বা ভুট্টো কেউই ছয় দফার বিকল্প কোনাে প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারেননি। যদি সত্যিই তাদের মুজিবের কাছ থেকে ছাড় পাওয়ার কোনাে আশা থাকত, তাহলে তারা ছয় দফার যেখানে যেখানে তাদের আপত্তি আছে, সেগুলাে নিয়ে আলােচনার টেবিলে বসতেন এবং গুরুত্বের সঙ্গে। আলােচনা করতেন। তার বদলে ভুট্টো সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তােলার চেষ্টা করলেন। ওই পর্যায়ে কোনাে বাঙালি নেতা ছয় দফা দাবি থেকে সরে এলে সাধারণ মানুষের কাছে আর মুখ দেখাতে পারতেন না। এর অর্থ হলাে এই যে গণতন্ত্রের পথে ফিরে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া, তা ওই বাজপাখি’দের বিরােধিতার ফলে মুখথুবড়ে পড়ল। তাই ১৫ ফেব্রুয়ারি সংসদ অধিবেশন বয়কটের যে ঘােষণা ভুট্টো দিলেন, তা ছিল অগণতান্ত্রিক পন্থা কায়েমের প্রথম ধাপ, যার শেষ হয় ২৫ মার্চের গণহত্যার মধ্য দিয়ে। মাঝখানের সময়টুকু ওরা স্রেফ কাটিয়ে দিল ছলচাতুরী দিয়ে ।

 
শেখ মুজিবের জবাব
 
ভুট্টোর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। ১ মার্চ ইয়াহিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন মুলতবি করলেন ভুট্টোকে বাঁচাতে—ওপরে ওপরে তা-ই মনে হচ্ছিল । যদিও বাঙালির মনের মধ্যে এমন একটা ভয় আগে থেকেই ছিল। সফলভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরও বাঙালির মনে এই আশঙ্কা ছিলই যে আর যা-ই হােক, জেনারেলরা কখনােই বাঙালির হাতে শাসনভার ছাড়বে না। সংসদ অধিবেশন মুলতবি করার অর্থ হলাে বাঙালির শাসনক্ষমতা গ্রহণের সম্ভাবনাকে মুলতবি করা, পাকিস্তানের ৫৫ শতাংশ মানুষ যে ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে অর্পণ করতে যাচ্ছিলেন, সে প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেওয়া। ২৩ বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তানিরা নানা পরিকল্পনা আর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে যা কিছু ন্যায্য, তা থেকে বাঙালিদের বঞ্চিত করেছে। নির্বাচনের পর গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া, যা কিছু ন্যায়সংগত তা আদায় করে নেওয়ার এই ছিল বাঙালির জন্য শেষ সুযােগ। মুজিবের অসহযােগ আন্দোলনের ডাকে যে অভূতপূর্ব সাড়া মেলে, তা আসলে ছিল ২৩ বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ। যখন এই আন্দোলনে পুলিশ ও সরকারি আমলারা যুক্ত হলেন, তখন বাংলাদেশের ভেতরেই আসলে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে গেল। আর এত সবকিছু ঘটল ইয়াহিয়ার ঘােষণার এক সপ্তাহের মধ্যেই। পরের তিন সপ্তাহে মুজিবের বাড়িই বাংলাদেশের সচিবালয়ে পরিণত হয়। যেসব বাঙালি আমলা ইসলামাবাদ বা ঢাকায় কর্মরত ছিলেন, তাঁরা স্বেচ্ছায় মুজিবের পক্ষে কাজ করতে চাইলেন। প্রশাসনে এমন এক শূন্যতা তৈরি হলাে যে আওয়ামী লীগ নির্দিষ্ট কিছু খাতকে অসহযােগ আন্দোলনের বাইরে রাখতে বাধ্য হলাে। সামাজিক নৈরাজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষতি এড়াতেই এ পথ বেছে নেওয়া হয়েছিল। এই সময়ে পুলিশ কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশ মেনে চলতে লাগলেন। জেলা প্রশাসকেরা আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে প্রদেশের শাসনকাজ পরিচালনা করছিলেন। ব্যবসায়ীরা মুজিবের প্রতি সমর্থন জানাতে ও তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা জানাতে মুজিবের বাড়ির সামনে লম্বা লাইন দিলেন। শুধু যে শহরের চিত্রই এমন ছিল, তা কিন্তু নয়। গ্রামবাসীও তাঁদের মতাে করে অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দিলেন। তারা সেনানিবাসে যাওয়ার রাস্তা কেটে দিলেন। পাঞ্জাবি সেনাদের খাদ্য ও রসদ সরবরাহের সব পথ বন্ধ করে দিলেন। যেকোনাে পর্যবেক্ষকের কাছেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে সর্বাত্মক যুদ্ধ ছাড়া এই বাংলায় আর ইয়াহিয়ার শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যাবে । মাত্র ২৫ দিনের অভিজ্ঞতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুঝতে পেরেছিল প্রতিটি বাঙালি তাদের শত্রু এবং ইসলামাবাদের প্রতি সামান্যতম আনুগত্য যে দেখাবে সে-ই বাঙালিদের কাছে সন্দেহভাজন। মূলত এই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই তারা ব্যাপকভিত্তিক তাণ্ডব ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।
 
আওয়ামী লীগের ওপর চাপ
জনগণের এই প্রতিক্রিয়া দেখে শুধু যে ইয়াহিয়াই বিস্মিত হলেন তা কিন্তু নয়, মুজিব নিজেও বিস্মিত হলেন। মুজিব বুঝলেন, ১ মার্চের আগে অধিবেশন আহ্বান করার যে দাবি তা আর সময়ােপযােগী নয়। মানুষ এখন ওই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। সামরিক আইন প্রত্যাহার ও প্রদেশের মানুষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি আসলে তত দিনে অনেকটাই তার আবেদন হারিয়েছে। গােটা দেশের চাওয়া তখন অন্য । প্রথম দুই দিন প্রদেশে ইয়াহিয়া খানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানাের পর সেনাবাহিনীর কমান্ডার ও প্রদেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুব সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিলেন। ইতিপূর্বে সংসদ অধিবেশন মুলতবির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় সাবেক গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। | ইয়াকুব নিজে যে শান্তিবাদী ছিলেন তা নয়, কিন্তু তার একধরনের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। জেনারেলদের মধ্যে তিনি ছিলেন পণ্ডিত। তিন মাসের মধ্যেই তিনি বাংলা ভাষা এত ভালােভাবে রপ্ত করেছিলেন যে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা সম্পর্কে আলােচনা করতে পারতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নির্যাতন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। কিন্তু তার কথায় কেউ কান দিল না। উল্টো তার জায়গায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এলেন। একজন কাজের লােক হিসেবে টিক্কা খানের পরিচিতি ছিল। ১৯৬৫ সালে শিয়ালকোট রণাঙ্গনে এবং রান অব কুচ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি এই পরিচিতি অর্জন করেন। সাধারণ সৈনিক থেকে পদোন্নতি পেয়ে তিনি অফিসার হয়েছিলেন। আইয়ুব খানের আমলে তিনি কঠোর হাতে বেলুচদের বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। টিক্কা খানকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যাপারটিকে কঠোরপন্থীদের বিজয় হিসেবে দেখা হয়। প্রতিবাদে জেনারেল ইয়াকুব তার দায়িত্ব ত্যাগ করলেন। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী তাদের খুব পরিচিত একজন জেনারেলকে কোর্ট মার্শাল করবে কি না তা নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ল। ইয়াকুবকে প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে সেনা ছাউনিগুলােয় সেনাসংখ্যা বাড়তে লাগল ।
 
৬ মার্চ ইয়াহিয়া পরিস্থিতির জন্য শেখ মুজিবকে দায়ী করে এক উসকানিমূলক বক্তৃতা দিলেন। একটিবারের জন্যও তিনি ভুট্টোর নাম উচ্চারণ করলেন না। ২৫ মার্চ অধিবেশন ডাকা ও তাতে অংশগ্রহণের যে আহ্বান, সেটা তত দিনে তামাদি হয়ে গেছে, প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। ওই অনুরােধে তখন বাঙালির নমনীয় হওয়ার আর কোনাে সুযােগই নেই। এ কারণেই অনেকের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে মুজিব ৭ মার্চ জনসভায় স্বাধীনতার ঘােষণা দেওয়ার সুযোেগ নেবেন। কারণ, ইয়াহিয়ার আগের সিদ্ধান্তের কারণে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তার সমাধানে ইয়াহিয়া একচুলও এগােচ্ছিলেন না। তেমন কোনাে ঘােষণা আসতে পারে, এই আশঙ্কায় সেনাবাহিনীকেও সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছিল। | মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীনতার ঘােষণা দিলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। তিনি এত মৃত্যুর দায়ভার নিতে রাজি ছিলেন না। বাংলাদেশের জনসাধারণ ও সেনাবাহিনী দুই পক্ষকেই নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল হিসেবে তিনি অসহযােগ আন্দোলন অব্যাহত রাখা ও আলােচনার দরজা খােলা রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। কোনাে সন্দেহ নেই, ১ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত মুজিব স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য মারাত্মক চাপে পড়েছিলেন। ৬ মার্চ ইয়াহিয়ার ভাষণ প্রচারের পর এই চাপ আরও বেড়ে গেল। কিন্তু ৭ মার্চ বিকেলের মধ্যে তিনি এই চাপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেন এবং পাকিস্তানের মধ্যে থেকে সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে তার দলকে রাজি করাতে সক্ষম হলেন। দলের চরমপন্থী অংশটির ওপর তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন, এই ধারণার সঙ্গে বাস্তবতার কোনাে সম্পর্ক ছিল না, আর এ কথা বলার সময় যে বিষয়টি খেয়াল করা হয় না তা হলাে, ৭ মার্চের আগেই এই জটিল বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল এবং সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলে মুজিবের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ছাত্রনেতারা যখন একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন, যেসব পশ্চিম পাকিস্তানি ঢাকা ছেড়ে যাবে, তাদের বাধ্যতামূলক কাস্টমস পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে, তখন তাদের সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরাতে মুজিবের ঠিক চার ঘণ্টা সময় লেগেছিল। মুজিবের কর্তৃত্বের এই প্রশ্নাতীত ধরনের ফলেই তিনি এ সময় তাঁর স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে সারা প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সক্ষম হয়েছিলেন। গােটা দেশ যখন টগবগ করে ফুটছে, তখন পরিস্থিতির ওপর মুজিবের এই নিয়ন্ত্রণ চাট্টিখানি কথা ছিল না। বিদেশ থেকে আসা এক বিশালসংখ্যক সাংবাদিক এর সাক্ষী, যাঁরা তখন বড় রকমের একটা ঝাকুনির প্রত্যক্ষদর্শী হতে ঢাকায় জড়াে হয়েছিলেন।
 
সমঝােতার জন্য প্রেসিডেন্ট এলেন। ইউডিআইএর উসকানি এমনকি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পরও ইয়াহিয়া সমঝােতার পথ বেছে নেবেন বলেই মনে হচ্ছিল। জেনারেল পীরজাদা ও উমরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ১৫ মার্চ ঢাকায় এলেন। পরে জানা গিয়েছিল, এ সময় জান্তার আরও অনেক সদস্যই কিছুটা গােপনে এসে সেনানিবাসে ঘাপটি মেরে ছিলেন। ইয়াহিয়া ঢাকায় আসার এক দিনের মধ্যেই মুজিবের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। বৈঠকে মুজিব চারটি দাবি উপস্থাপন করলেন : ১. সামরিক আইন প্রত্যাহার; ২. নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর; ৩. সেনাসদস্যদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়া ও নতুন করে শক্তিবৃদ্ধি বন্ধ করা; ৪, মার্চের ২ ও ৩ তারিখে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের ব্যাপারে তদন্ত করা। ইয়াহিয়া ৪ নম্বর দাবিটি মেনে নিলেন। বাংলাদেশে তখন যে পরিস্থিতি, তাতে বাকি তিনটি দাবির ক্ষেত্রে স্রেফ বিচার বিভাগীয় স্বীকৃতির দরকার ছিল। সেনারা তখন ব্যারাকে, ক্ষমতা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে এবং সামরিক আইন আদেশের কোনাে কার্যকারিতা নেই।
 
সত্যি কথা বলতে ইয়াহিয়া শুরুতে চারটি দাবিই নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া দাবি মেনে নিয়েছেন জানতে পেরেই ভুট্টো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে আলাদাভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তুললেন। এভাবে তিনি আসলে দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণাটাই তুলে ধরলেন। তিনি চাইলেন না গােটা পাকিস্তানের হয়ে মুজিব কথা বলুক। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাবশালী দল হিসেবে তিনি ওই অঞ্চলের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইলেন। পাঠান ও বেলুচরা এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানাল। তারা বলল, যেহেতু পাকিস্তান একটি অখণ্ড রাষ্ট্র, ভুট্টো শুধু পাঞ্জাব ও সিন্ধের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন, পুরাে পাকিস্তানের নয়। | এমন পরস্পরবিরােধী সব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মুজিব ভয় পাচ্ছিলেন তাকে না কেন্দ্রে কারও সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হয়। এমন ব্যবস্থায় হয়তাে নীতিগতভাবে তাঁর আপত্তি ছিল না, কিন্তু পিপিপির সঙ্গে সমান ভিত্তিতে আসন ভাগাভাগিতে তিনি রাজি ছিলেন না। কারণ, আওয়ামী লীগের ১৬৭টি আসনের বিপরীতে পিপিপির আসনসংখ্যা ছিল ৮৭। এই অচলাবস্থা কাটল যখন এ বিষয়ে একটা মতৈক্যে পৌছানাে গেল যে, যে দল যে প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তারাই সেই অংশ শাসন করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কেন্দ্রে থাকবেন ইয়াহিয়া, তার উপদেষ্টামণ্ডলীতে সব কটি দলের লােক মনােনয়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
 
আইনি জটিলতা
 
সামরিক আইন প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে কী কী আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে তা জানতে বিচারপতি কর্নেলিয়াসকে ডাকা হলাে। তিনি প্রথমেই বললেন, সামরিক আইন। থাকতে হবে। সমঝােতার বিষয়টিকে আইনি আচ্ছাদন দিতে সামরিক আইনের দরকার আছে, নইলে সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দেবে—এই ছিল তার যুক্তি। মুজিব মনে করলেন, সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি তােলায় তাকে আইনি মারপ্যাচ দেখানাে হচ্ছে। তিনি কর্নেলিয়াসকে বললেন, ইয়াহিয়া ও তিনি মার্শাল ল প্রত্যাহারের ব্যাপারে একমত হয়েছেন। এখানে নতুন করে আর আইনি বাধা সৃষ্টি করা ঠিক হবে। বরং তার উচিত হবে, যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছেন, সেটাকে আইনি কাঠামাের মধ্যে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা। পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী এ কে ব্রাহী এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাতলাতে নিজে থেকেই বাংলাদেশে এসে হাজির হয়েছিলেন। সম্ভবত তিনি দুই দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। তারপর ভারত শাসন আইন অনুসরণের পরামর্শ দিলেন। এই আইনের অধীনে একটা অ্যাক্ট অব প্রক্লামেশনের মাধ্যমে ব্রিটিশরাজ ভারত ও পাকিস্তান দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এই ঘােষণার ফলে নিজস্ব সংবিধান প্রণীত না হওয়া অবধি যেসব আইনি কাজ করা হয়, তার সবই আইনি বৈধতা পেল। ব্রোহী যুক্তি দেখালেন, একই পদ্ধতিতে ইয়াহিয়াও ঘােষণার মাধ্যমে তার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেন। তাতে করে যত দিন পর্যন্ত না পার্লামেন্ট একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করছে, সব কাজ আইনি বৈধতা পাবে। ইয়াহিয়া ও কর্নেলিয়াস এই যুক্তি মেনে নেওয়ায় শুরুতেই এ-সংক্রান্ত আলােচনা সংলাপ থেকে বাদ গেল। তার কিছুদিন পর মুসলিম লীগের দৌলতানা ও পিপলস পার্টির মােহাম্মদ আলি কাসুরি আবারও আইনি শূন্যতার কথা তুললেন। তারা বললেন, সংসদ অধিবেশনে নির্বাহী আদেশের বৈধতা এবং মার্শাল ল প্রত্যাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। যখন দৌলতানা মুজিবের কাছে এই প্রস্তাব উত্থাপন করলেন, মুজিব এককথায় তা বাতিল করে দিলেন। তিনি বললেন, এটা একটা। মীমাংসিত বিষয়। অধিবেশনের জন্য অপেক্ষা করে থাকার মানে হলাে মার্শাল লকে দীর্ঘায়িত করা । যখন প্রতিদিনই মানুষের মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে, তখন সাংসদদের নিয়ে বসে সরকারি আদেশ সম্পর্কে বিতর্ক করার অবস্থা জাতির নেই।
 
ফলে ইয়াহিয়া যখন এই আইনি আচ্ছাদনের প্রসঙ্গ তুলে একেই মুজিবের অসদুদ্দেশ্যের চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন, তখন তাতে আশ্চর্য না হয়ে উপায় থাকে না। কারণ, তার আপন উপদেষ্টা দলই ইতিমধ্যে এ বিষয়ে মীমাংসা করে ফেলেছিল। এরপর তারা অধিকতর বাস্তব সমস্যাগুলাের আলােচনায় প্রবেশ করেছিল। আইনি বিষয়গুলাে ছিল নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা এবং আইনজীবীরা ছাড়া কারও কাছেই তার কোনাে প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। তাই আইনি খুঁটিনাটির ওপর মতপার্থক্যের কারণে একটি জাতি দু-টুকরাে হয়ে যেতে পারে, এমন ধারণা ছিল। একেবারে অসার। আওয়ামী লীগের ছাড় মুজিবের শর্তগুলাে কেবল সামরিক আইন প্রত্যাহার ও পরিষদ কর্তৃক নতুন সংবিধান পাস হওয়ার মধ্যবর্তী সময়টুকুর জন্যই প্রযােজ্য ছিল। এই পর্বটা কত দীর্ঘ হবে তা জানা না গেলেও এ নিয়ে কোনাে সংশয় ছিল না যে দীর্ঘ মেয়াদে জাতিসত্তার পরিচয়টি সংসদ কর্তৃক নির্ধারিত হবে। যে সংসদের সার্বভৌমত্ব নির্ধারিত হবে কি না সংবিধানের বিভিন্ন বিধিবিধানের দ্বারা। ওই পর্যায়ে উভয় পক্ষই সাধারণভাবে ধরে নিয়েছিল, ছয় দফা দাবি সাংবিধানিক দলিলের অন্তত ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। ইয়াহিয়া যুক্তি দিলেন, ছয় দফা প্রণয়ন করা হয়েছে কেন্দ্রের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক কেমন হবে, তা নির্ধারণ করার জন্য। পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশগুলাের ক্ষেত্রে এর প্রয়ােগ নতুন করে জটিলতা তৈরি করবে। আওয়ামী লীগ সব সময় এই যুক্তি মেনে আসছিল। বাংলাদেশের জন্য ছয় দফা দাবি ছিল তাদের অস্তিত্বের রক্ষাকবচ। দেশটির অদ্ভুত ভৌগােলিক বাস্তবতা, একই রাষ্ট্রে দুই অর্থনীতি এর কারণ। ইয়াহিয়া যখন পশ্চিমাংশকে আলাদা একটি প্রস্তাব তৈরির কথা বললেন, তখন মুজিব সঙ্গে সঙ্গেই তাতে সায় দিলেন। এ ব্যাপারে দ্বিমত করার কোনাে ক্ষমতা তার ছিল না। যেহেতু নির্বাচনে তাঁর দল পশ্চিম পাকিস্তানে একটি আসনও পায়নি।
 
ইয়াহিয়া বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানিদের তাদের এক ইউনিট-পরবর্তী নিজেদের মধ্যকার আন্তঃপ্রাদেশিক সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য আরও সময় দরকার। কারণ, সেখানকার কোনাে দলেরই এ ব্যাপারে কোনাে পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। তিনি পরিষদের আলাদা দুটি অধিবেশনের প্রস্তাব দিলেন, যাতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্বাংশের দিক থেকে কোনাে রকম নাক গলানাে ছাড়াই কাজটা করতে পারে। এই পুরাে প্রস্তাবটিই ছিল ভুট্টোকে সুবিধা দেওয়ার জন্য। ভুট্টো তখন এই ভয়ে কাতর ছিলেন। যে মুজিব তাকে দুর্বল করার জন্য ছােট দল ও অঞ্চলগুলাের সঙ্গে আঁতাত করতে পারেন। পশ্চিমের জন্য ভুট্টো যা চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া মুজিবের কাছ থেকে তাঁকে তা আদায় করে দিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে মুজিব পশ্চিমে তার। সম্ভাব্য সমর্থন হারালেন। উল্লেখ্য, ভুট্টোর পরিষদ অধিবেশন বর্জনের সিদ্ধান্তের পর থেকে তার প্রতি পশ্চিমের এই সমর্থন বাড়ছিল। ইয়াহিয়া যখন বাংলাদেশে সামরিক অভিযান শুরু করলেন, তখন মুজিব পশ্চিমে নিজেকে একেবারে সঙ্গীহীন হিসেবে আবিষ্কার করলেন। তাই দুটি আলাদা পরিষদ অধিবেশনের পরিকল্পনা মুজিবের মাথা থেকে বেরিয়েছিল বলে যে ধারণা দেওয়া হয়, তা ছিল একেবারেই যুক্তিহীন। কারণ, আওয়ামী লীগের সে সময় কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতাই ছিল না, দুইতৃতীয়াংশের বেশি ভােটের ক্ষমতা নিয়ে তারা তখন পরিষদে যেকোনাে কিছুই করতে সক্ষম ছিল।
 
রাজনীতি থেকে অর্থনীতি
 
ক্ষমতা হস্তান্তরের রাজনৈতিক ও আইনি সমস্যার যখন সমাধান হয়ে গেছে, তখন অন্তর্বর্তী সময়ে কেন্দ্র থেকে প্রদেশে ক্ষমতা বণ্টন কীভাবে হবে, সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি সামনে এল। দুই দলই মতৈক্যে পৌছাল যে ছয় দফার ভিত্তিতে যে সংবিধান রচিত হবে, তা থেকে এই প্রক্রিয়া খুব বেশি ভিন্ন কিছু হবে না। যেহেতু অর্থনীতি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমেদকে ডেকে পাঠানাে হলাে। আওয়ামী লীগ যুক্তি দেখাল যে এই বাস্তব পরিস্থিতিকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তত দিনে রপ্তানি আয় ও সংগৃহীত কর বাংলাদেশের অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে। এম এম আহমেদ এই প্রস্তাবে খুব একটা বিচলিত হলেন না, সত্যিকার অর্থে তিনি একে কোনাে সমস্যাই মনে করলেন না। তিনি এমনকি এ-ও মেনে নিলেন যে এই অঞ্চলের নিজস্ব বাণিজ্যনীতি ও নিজস্ব রিজার্ভ ব্যাংকের মুদ্রানীতি তৈরির ক্ষমতা থাকবে। ২৩ মার্চ সর্বশেষ বৈঠকের দিন তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলকে কিছু সংশােধনীসহ একটি প্রস্তাব দিলেন : ১. যেহেতু নিজস্ব রিজার্ভ ব্যাংক হওয়ার জন্য সময় ও কিছু বিধিবিধানের প্রয়ােজন, তাই ঢাকার স্টেট ব্যাংক বাংলাদেশের পক্ষে রিজার্ভ ব্যাংকের ভূমিকা পালন করবে। যদি আঞ্চলিক মুদ্রানীতিতে কোনাে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংক হস্তক্ষেপ করতে পারবে। ২. কেন্দ্রে কর ও বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানাের যে চালু ব্যবস্থা, তা অব্যাহত থাকবে। ৩, বৈদেশিক সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে দুই অংশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি দল দাতাগােষ্ঠীর কাছে যাবে এবং সে প্রতিনিধিদলে বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে।

যখন দাতাগােষ্ঠী নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থসহায়তা দিতে সম্মত হবে, তখন প্রদেশগুলাে নিজেরা সমঝােতার ভিত্তিতে নিজেদের প্রাপ্য ঠিক করে নেবে। তার প্রস্তাবের মূলকথাগুলাে ছিল এ রকম। কিন্তু তাতে শর্তগুলাে লেখা হয়েছিল খুবই ঢিলেঢালাভাবে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টারা সে ভাষাকে শক্ত করলেন। তাতে করে বিষয়গুলাে পরিষ্কার হলাে। অর্থাৎ মােটের ওপর এই প্রস্তাবও আওয়ামী লীগ।  মেনে নিল ২৫ মার্চের পর যেকোনাে দিন ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে যৌথ ঘােষণা আসবে এবং কেউই আর তাতে কোনাে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না, এমন বিশ্বাস মানুষের মধ্যে তৈরি হলাে । সমঝােতার প্রক্রিয়া থেমে গেল সমঝােতার প্রক্রিয়া ভেঙে যাওয়ার আর কোনাে সম্ভাবনা রইল না।

 
কারণ, গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়েই মতৈক্যে পৌছানাে সম্ভব হয়েছিল। এম এম আহমেদ দাবি করলেন, সংশােধনীসহ প্রস্তাবটিই তার মতামত। ২৫ মার্চ এই বলে তিনি করাচির উদ্দেশে রওনা দিলেন। আওয়ামী লীগ এখন বুঝতে পারল, সেনাবাহিনীকে অভিযান করার পথ করে দিতেই আহমেদ চলে গেলেন। সমঝােতা-প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তিনি চলে গেলেন। বাংলাদেশের কোনাে জবাব না নিয়েই। আসলে ২৩ মার্চই শেষ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত আলােচনার জন্য বারবার পীরজাদাকে ফোন করেও কোনাে সাড়া পাওয়া গেল না। ইয়াহিয়া তখনাে পর্যন্ত তার নিজের দিক থেকে দৃঢ়ভাবে কোনাে প্রস্তাব দেননি। এমনকি একটা সমাধানে পৌছানাের ব্যাপারে তার কোনাে শর্ত আছে কি না, তা-ও বলেননি। বরাবরের মতােই বিতর্কটা ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের খসড়ার ওপর এবং পশ্চিমারা এ বিষয়ে তাদের মনােভাব গােপন রাখেনি। যদিও প্রেসিডেন্ট ও তার সামরিক জান্তা সত্যি সত্যি কী ফন্দি আঁটছেন, সে সম্পর্কে বিশ্ব অন্ধকারে থেকে গেল।  ভুট্টো তার দলবল নিয়ে ঢাকায় পৌছালেন। এখানে তিনি আলাদাভাবে প্রেসিডেন্টের দলের লােকজনের সঙ্গে বৈঠক করলেন। আওয়ামী লীগ মনে করেছিল, সমাধানের আসল চাবিকাঠি রয়েছে ইয়াহিয়ার হাতে এবং এ ব্যাপারে ভুট্টোর ভূমিকা হবে অতীত অভিজ্ঞতার আলােকে সেই সমাধানসূত্রটি খুঁজে নেওয়া। এর আগে প্রেসিডেন্ট যেহেতু খুব ভালােভাবেই ভুট্টোর বক্তব্য জেনে নিয়েছিলেন, ফলে তার দিক থেকে সমঝােতার বিরােধিতার আশঙ্কা করা হয়নি।  কিন্তু দেখা গেল, ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউসে বসে দুই পক্ষ যখন বৈঠক করছে, তখন ইয়াহিয়া নিজে সেনানিবাসে গিয়ে তাঁর জেনারেলদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করছেন। এ সময় সেনাবাহিনী হঠাৎ চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র খালাসের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলল। এর আগে অসহযােগ আন্দোলনের কারণে ১৭ দিন ধরে ওই অস্ত্র খালাস বন্ধ ছিল। ২৫ মার্চ রাত ১১টায় সেনা সদস্যরা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তার কয়েক ঘন্টা আগে করাচির উদ্দেশে বিমানে ঢাকা ছাড়লেন ইয়াহিয়া। সমঝােতার প্রচেষ্টা এভাবে যুদ্ধের উন্মাদনায় চাপা পড়ে গেল। কেবল এই সময় তারা তাদের অবস্থানে অনড় থাকলেন। মতৈক্যের ভিত্তিতে একটা সমঝােতার প্রস্তাব, যা কিনা সেদিন পর্যন্ত পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারত, জেনারেলরা পেয়েও তা উপেক্ষা করলেন।
সাউথ এশিয়ান রিভিউ, জুলাই ১৯৭১ ইংরেজি থেকে অনুবাদ : শেখ সাবিহা আলম

সূত্রঃ বাংলাদেশের অভ্যুদয় – রেহমান সোবহান

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!