শক্ত অবস্থান থেকে আলােচনা
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন তখন তৃতীয় সপ্তাহ পেরােচ্ছে। ইতিমধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। বাংলাদেশের জনগণ এখানকার শাসনক্ষমতা, তাদের ভালাে-মন্দের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন তাদেরই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে। অন্যদিকে ইসলামাবাদের সঙ্গে অসহযােগ চলছে সমানতালে। প্রেসিডেন্ট এলেন, কিন্তু তাঁকে আনতে বেসামরিক প্রশাসনের কোনাে কর্মকর্তা বিমানবন্দরে গেলেন না। নিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৫ মার্চের মধ্যে কাজে যােগ দিতে এমএলআর নির্দেশনা দেওয়া হলাে। ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের ঝুঁকি সত্ত্বেও সেই নির্দেশ কেউ মানল না। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের এক দিনের বেতন আওয়ামী লীগের ত্রাণ তহবিলে জমা দিলেন। জয়দেবপুরের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির ১১ হাজার বেসামরিক কর্মী যােগ দিলেন ধর্মঘটে। নিরাপত্তা বাহিনীকে খাদ্য ও রসদ সরবরাহ আগেই বন্ধ করেছিল বাঙালিরা। সেই অসহযােগিতা অব্যাহত থাকল। পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখতে শেষ পর্যন্ত কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল নিজেই ঢাকায় এলেন। একপর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মালবাহী বিরাট উড়ােজাহাজ সি-১৩০-এ করে টিনজাত খাবার আনানাে হলাে। ওই একই সময়ে সেনাবাহিনীও তার শক্তি বৃদ্ধি করে যাচ্ছিল। উড়িয়ে আনা হচ্ছিল সেনাদের। যদিও তখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি সহযােগী বাহিনীর সাড়ে সাত হাজার সেনা নিয়ে এনএসসি কার্গো চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে কি না। তবে কুমিল্লা থেকে এসএসজি কমান্ডাে ইউনিটকে ঢাকায় নিয়ে আসার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। সীমান্তবর্তী এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে ট্যাংক ব্যবহার করা হয়, সেই ট্যাংকও রংপুর থেকে ঢাকায় আনা হয়েছিল।
সত্যিকার অর্থে ওই বৈঠককে কেন্দ্র করে ঢাকার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পারদ দ্রুত ওঠানামা করতে লাগল। এর মধ্যেই গােলাগুলির আশঙ্কায় ঢাকার মধ্যবিত্ত লােকেরা শহর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরলেন আর সেনাসদস্যরাও মহড়া চালাতে লাগলেন। মনে হচ্ছিল, সত্যিকারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ সময় অর্থনীতিতেও একটা ভারসাম্যহীনতা দেখা দিল। কখনাে অর্থনীতির গতি থেমে যাচ্ছিল, আবার কখনাে চলছিল দ্রুতলয়ে। আওয়ামী লীগ ১৫ মার্চ প্রশাসনের সুনির্দিষ্ট কিছু বিভাগ এবং অর্থনীতির প্রতিটি খাতকে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরুর জন্য নির্দেশ জারি করল। বাংলাদেশ যে এখন বাংলাদেশিদের হাতে, তা বােঝাতে ‘খাজনা বন্ধের প্রচার চালানাে হলাে। কর সংগ্রহ অবশ্য থেমে যায়নি, তবে তা জমা হচ্ছিল বাংলাদেশ সরকার’-এর অনুকূলে। বাংলাদেশে যাদের সদর দপ্তর এমন দুটি ব্যাংকের বিশেষ শাখা খােলা হলাে এবং সেখানেই কর জমা পড়তে লাগল।
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান ও ট্রেজারিতে একটি টাকাও জমা পড়ল না। রপ্তানি খাত থেকে যে আয়, সেই অর্থও ওই দুটি ব্যাংকে জমা নেওয়ার ব্যাপারে আলাপ-আলােচনা চলতে লাগল। স্টেট ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলাে আওয়ামী লীগের নির্দেশনা মেনে চলছিল। চালু ব্যাংকগুলাে বন্ধ হলাে না। যখন ব্যাংকগুলাের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমে এল, তখন পরিস্থিতির আরও একটু উন্নতি হলাে। এসব কিছুর অর্থ এই নয় যে অসহযােগ আন্দোলন থেকে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপান্তরের কারণে কোনাে সমস্যাই হয়নি। ব্যাংক-ব্যবস্থায় একটা ভারসাম্যহীনতা দেখা দিল। অস্থানীয় ব্যাংকগুলাের পরিবর্তে স্থানীয় ব্যাংকগুলােতে জমার পরিমাণ বাড়তে লাগল। অস্থানীয় ব্যাংকগুলাে করাচিতে তাদের প্রধান কার্যালয়ে তহবিল পাঠানাের জন্য অনুরােধ জানাল। কিন্তু করাচি তাতে সেভাবে সাড়া দিল না। করাচির প্রধান শাখা থেকে তহবিল এলে তারা এখানে স্টেট ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে তাদের জমার পরিমাণে একটা ভারসাম্য আনতে পারত। সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান করার মতাে অতটা স্থিতিশীল পরিস্থিতি তখন ছিল। অস্থানীয় ব্যাংকগুলােকে বাঁচাতে এগিয়ে এল স্থানীয় ব্যাংকগুলােই। জরুরি ভিত্তিতে তারা অস্থানীয় ব্যাংকগুলােকে ঋণের জোগান দিল। ফলে অস্থানীয় ব্যাংকগুলাে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলবে বলে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, সেই আশঙ্কা দূর হলাে। স্থানীয় ব্যাংকগুলাের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আবেগ সত্ত্বেও অস্থানীয় ব্যাংকগুলাে বুঝতে পারল ব্যাংক-ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার কারণে উৎপাদন কমে গেল, সেই সঙ্গে কমল কাজের গতি এবং দক্ষতাও। এখানেও অসহযােগ ও স্বরাজের মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠল বাংলাদেশের স্বার্থে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে কাজ করার জন্য দলের যে নির্দেশ, তা যথাস্থানে পৌছাল না।
দলের নির্দেশ সুস্পষ্টভাবে পৌছানাের কোনাে ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদনের কাজে নিয়ােজিত শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বুঝে উঠতে পারেননি যে বাংলাদেশের উন্নয়ন আর কারখানার মালিকের উন্নয়ন একই সূত্রে গাঁথা। এই অভূতপূর্ব অবস্থা প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছিল। সব অনিশ্চয়তার মধ্যে শুধু একটি বিষয়েই সুনিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। আর তা হলাে, বাংলাদেশের ওপর ইসলামাবাদের খবরদারি আর চলবে না। প্রতিদিনই একটু একটু করে সেই কর্তৃত্ব কমে আসছিল এবং সে সময় পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা ব্রিটিশ শাসকদের উপমহাদেশের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টার চেয়ে ভিন্ন কিছু হতাে না। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামাবাদের ক্ষমতা ছিল একটাই, তা হলাে এ দেশের মানুষের ওপর মৃত্যু চাপিয়ে দেওয়া এবং দেশের অর্থনীতিতে একটা নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করা ইসলামাবাদ তা-ই করল। তারা খাদ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রামে ভিড়তে না দিয়ে করাচিতে পাঠিয়ে দিল। প্রশ্ন উঠতে পারে, পরিস্থিতিকে কেন তারা এমন জায়গায় ঠেলে দিল। যে শেখ মুজিবের দাবি পূরণ না করে তাদের গণহত্যার পথ বেছে নিতে হলাে। উত্তরটা হলাে, পৃথিবীর সব আগ্রাসী যুদ্ধে যেমন হিসাব-নিকাশের ভুল থাকে, এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছিল পার্লামেন্ট অধিবেশন মুলতবি করে যারা এই বিরােধের সূত্রপাত করেছিলেন, তারা ভেবেছিলেন এর প্রতিক্রিয়া হবে খুবই দুর্বল বড়জোর স্থানীয়ভাবে সামান্য গন্ডগােল হতে পারে। দ্রুততার সঙ্গে বল প্রয়ােগ করলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি গণহত্যার প্রতিবাদে সাত দিনের মধ্যে মানুষ শুধু প্রতিরােধই গড়ে তুলবে না, তারা কেন্দ্রের কর্তৃত্বকে পুরােপুরি অচল করে দিতে সক্ষম হবে। সম্ভবত আওয়ামী লীগের ভেতরেও কেউ ভাবতে পারেননি যে অসহযােগ এতটা সর্বজনীন হবে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্বভার তাঁদের হাতে এসে পড়বে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর শেখ মুজিবের অতটা নিয়ন্ত্রণ নেই—এই ভাবনা ছিল শাসকদের দ্বিতীয় ভুল।
এমনকি অকারণে লুটপাট ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার যথেষ্ট উদাহরণও তারা খুঁজে পেল না। যদিও তারা দাবি করে লুটপাট ও দাঙ্গাহাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণ করতেই তারা গণহত্যা চালিয়েছিল। ৬ মার্চের মধ্যে ইয়াহিয়া যে অরাজকতার কথা বলছিলেন, তার অসারতা প্রমাণ হয়ে গেল। তার ঢাকা সফরের সময়ে যে শান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, তা-ই প্রমাণ করে পরিস্থিতির ওপর শেখ মুজিবের কতটা নিয়ন্ত্রণ ছিল। বিরােধের সূত্রপাত হয়েছিল যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেখানেও তা দুর্বল হতে শুরু করল। চেয়ারম্যান ভুট্টোর ওপর দায়িত্ব দেওয়া হলাে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মানুষকে খেপিয়ে তােলার ভুট্টো উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা গুজব রটাতে শুরু করলেন যে ছয় দফা দাবি মেনে নেওয়ার অর্থ হলাে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ওপর বাঙালিদের চিরস্থায়ী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা আসলে তাে ছয় দফা এই আধিপত্যবাদের ধারণাকেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। আশা করা হয়েছিল, ভুট্টো জনগণকে তার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন এবং তারাই পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য দলগুলােকে ভয় দেখাবে। এভাবে সব দলই অধিবেশন বয়কট করবে। তাতে করে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিরােধটা সমানে সমান হবে। ভুট্টো সাময়িকভাবে তার কাজে সফল হলেন। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এসে তার এই চেষ্টা ব্যর্থ হলাে। তিনি তাঁর পাশে কাইয়ুম মুসলিম লীগ ছাড়া কাউকেই পেলেন না।
দলটি বরাবরই ভুট্টোর সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্য প্রশাসনের একটি অংশের সমর্থন পেয়ে আসছিল। এটা সবারই জানা ছিল যে কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার পরিচালক রিজভী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কিউএমএলে যােগ দেওয়ানাের জন্য খােলাখুলিভাবেই চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। জেনারেল উমর ও নওয়াব কিজিলবাশও এই দলের জন্য সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছিলেন। রিজভী, উমর ও সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের প্রধান কিউএমএলের পরাজয়ের পর ভুট্টোর প্রতি তাদের সমর্থন দিলেন। প্রমাণ আছে যে উমর নিজে পিপিপি ও কিউএমএলের বাইরে অন্য এমএনএদের অধিবেশন বয়কট করতে প্রচার চালিয়েছিলেন। যখন কিউএমএলের তিনজন সদস্য ঢাকায় আসার জন্য টিকিট করলেন এবং সিন্ধের অর্ধেক ও পাঞ্জাবের বেশ কয়েকজন এমএনএও একই পথ ধরছেন বলে খবর পাওয়া গেল, তখন ভুট্টো একরকম হুমকির মুখেই পড়লেন। সে সময় ভুট্টোর উপদেষ্টা ও ঘনিষ্ঠ সহচর এম এম আহমেদের অনুরােধে উমর-আকবর সরাসরি হস্তক্ষেপ করলেন। অধিবেশন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিতে তারা খুব সম্ভব ভুট্টোর ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বিবদমান। রাজনৈতিক দলগুলােকে ভুট্টোর নেতৃত্বে নিয়ে আসার জন্যই অতিরিক্ত সময় চাওয়া হচ্ছিল কি না, সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া যায়নি। হয়তাে ভাবা হয়েছিল যে সব কটি দলকে এক করা গেলে তাতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে দাঁড়ানাে সম্ভব হবে কিংবা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টাটা রােধ করা যাবে।
সূত্রঃ বাংলাদেশের অভ্যুদয় – রেহমান সোবহান