দ্বিতীয় অধ্যায় সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য– এ রচনা দুটি আমি একাত্তরের মার্চ মাসে লিখেছিলাম। সে বছরেরই ১ মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সে অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি রাখার প্রস্তাব করলে যে নজিরবিহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, রচনা দুটিতে তা-ই তুলে ধরা হয়েছে। ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলােচনার পর লারকানায় ভুট্টো ইয়াহিয়া আলােচনা শেষে মধ্য-ফেব্রুয়ারিতেই জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতীয় পরিষদ বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তখন এ রকম একটা ধারণা ও আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে ভুট্টোর এসব কার্যকলাপের উদ্দেশ্যটা ছিল একটা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করা এবং তার মাধ্যমে সামরিক আইনের শাসনকে আরও প্রলম্বিত করে ছয় দফা দাবিতে ছাড় দিতে বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ সৃষ্টি করা। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য যেসব সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যােগ দিতে ইচ্ছুক ছিলেন, ভুট্টো তাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই, বিশেষত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের সংসদ সদস্যগণ ছয় দফার ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পক্ষে ভােট দিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযােগিতা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রতিক্রিয়ার লক্ষ্য ছিল ইয়াহিয়া ও ভুট্টোকে এটাই প্রমাণ করে দেখানাে যে বাংলাদেশের জনগণ এসব চাপ প্রয়ােগের কৌশলকে ভয় করে ম—ছয় দফার সমর্থনে তারা বঙ্গবন্ধুর পেছনে সম্পূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার যেকোনাে প্রচেষ্টাই তাই সারা দেশে এক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সেই অনন্যসাধারণ কালপর্বে বাংলাদেশে সংঘটিত নাটকীয় ঘটনাবলি ও জনসাধারণের ক্রমপরিবর্তনশীল মেজাজ-মানসিকতাই এ রচনা দুটিতে স্থান পেয়েছে। স্বাধীনতার প্রস্তুতিপর্বে জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘােষণার পর থেকেই একটা গােলযােগের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। বিমানবন্দরের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানগুলােতে সপ্তাহ খানেক আগেই বিমানবিধ্বংসী কামানগুলাের আনাগােনা। দেখে জনসাধারণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ভাবছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
এ রকম একটা খবর শােনা গিয়েছিল যে সাবেক গভর্নর আহসান সাহেব শেষ মুহূর্তে তার পিন্ডি সফর বাতিল করেছেন। কিন্তু জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটল যখন পরদিনই তিনি গভর্নরদের সম্মেলনে যােগ দিতে পিন্ডি চলে গেলেন। এর পেছনের কারণটা ছিল পিন্ডিতে জনাব ভুট্টো ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এক জরুরি আলােচনা বৈঠক। পরিণতিতে তড়িঘড়ি করে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়। সামরিক আইন প্রশাসক গভর্নরদের সম্মেলনের পর লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুব, গভর্নর আহসান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা প্রথমে ভুট্টোর সঙ্গে এবং তার পরে শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করার উদ্দেশ্যে বিমানযােগে করাচি চলে গেলেন। তাদের তিনজনের করাচি অবস্থানকালেই টেলিগ্রাম মারফত খবর পাওয়া গেল, এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব ভুট্টোর রাজনৈতিক চালভঙ্গির ব্যাপারে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবারও স্থগিত করে ৩ মার্চের পরে নিয়ে গেলে যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, তার গুরুত্ব সম্পর্কেও মন্তব্য করেছেন। ভুট্টোর নাটুকেপনা সম্পর্কে শেখ মুজিব দীর্ঘদিন ধরে যে একটা সংযমের নীতি পালন করে আসছিলেন, তাঁর বিবৃতি থেকে মনে হলাে সংযমের সে বাঁধটি ভেঙে গেছে। ভুট্টোর আপসহীন মনােভাবই জাতীয় পরিষদ স্থগিত করার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, এই চিন্তাই সম্ভবত এই বিবৃতি দানে তাকে উৎসাহ জুগিয়ে থাকতে পারে । শেখ মুজিবের এই বিবৃতির পরই মনে হয় প্রেসিডেন্টের ওই তিন দূত পিন্ডি ফিরে গেলেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে আরও শলাপরামর্শ করার জন্য। পরে আহসান ও ইয়াকুব ঢাকায় ফিরে এলেন। পীরজাদারও আসার কথা ছিল। এমনকি কজন সাংবাদিক তার সঙ্গে কথা বলার জন্য বিমানবন্দরেও গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আসেনইনি। মনে হয় ঢাকায় গভর্নর আহসান শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ ও চরম সাক্ষাৎকারকালে তাঁকে জাতীয় পরিষদ মুলতবি হওয়ার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
মুজিব তাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এ ধরনের কোনাে চালের ভয়াবহ। পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। এদিকে আওয়ামী লীগের এমএলএরা ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে পার্টির সংবিধানের খসড়া নিয়ে আলােচনার উদ্দেশ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও বিমানে ঢাকায় আসার পথে করাচিতে গেলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং এমনকি উপজাতীয় এলাকাগুলাের এমএলএরাও জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের লক্ষ্যে ঢাকার পথে ছিলেন—সবদিক বিবেচনার পর অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ৩ মার্চ। ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে একটি জরুরি বৈদ্যুতিক জেনারেটর এনে বসানাে হলাে প্রেসিডেন্ট ভবনের লাগােয়া জমিতে, যার অর্থ হলাে প্রেসিডেন্ট এসে পড়লেন বলে। | করাচি থেকে আগত যাত্রীরা জানালেন, বিকেলের প্লেনেই ঢাকায় আসার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার টিকিট বুক করা ছিল। করাচি বিমানবন্দরে সব ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। এ রকম একজন মহামান্য সফরসঙ্গী থাকলে যেমনটা নিয়ম—অন্য যাত্রীরা সেইমতােই দুঘন্টা আগে বিমানবন্দরে রিপাের্ট করেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তাঁর এই ফ্লাইট ধরলেন না। আর তাকে বাদ দিয়েই বিমানটি উড়ে এসে নামল এক অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে-বাংলাদেশজুড়ে যা চড়িয়ে পড়ছিল দাবানলের মতাে। | ১ মার্চ বেলা ১টা ৫ মিনিটে রেডিও মারফত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একটি বিবৃতি প্রচার করা হলাে এবং অতীতের সব নজির উল্টে দিয়ে সেটি পাঠ করে শােনালেন রেডিও পাকিস্তানের একজন ঘােষক। অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ মুলতবির ঘােষণা শােনার আধা ঘণ্টা পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল এবং ঢাকা শহরের সব এলাকা থেকে তারা হােটেল পূর্বাণী অভিমুখে জড়াে হতে থাকল। হােটেলটিতে তখন আওয়ামী লীগের এমএলএদের একটা অধিবেশন চলছিল। জনতার অনেকেরই হাতে বাঁশের লাঠি, লােহার রড, আর হকিস্টিক। ঢাকা স্টেডিয়ামে তখন একটা একঘেয়ে ক্রিকেট ম্যাচের শেষ পর্যায়ের খেলা চলছিল। খেলা ছেড়ে দর্শকেরাও যােগ দিল বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে। রেডিওতে খবরটি প্রচারের পরপরই খেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় এবং লােকজন যার যার শ্রেণিচরিত্র অনুযায়ী ঘরমুখী ছুটে পালাল, আবার অনেকেই লাঠিসোটা জোগাড় করে পূর্বাণী অভিমুখে ছুটে চলল। বাক্রুদ্ধ গম্ভীর কঠোর চেহারার উচ্চপদস্থ সহকর্মীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত শেখ মুজিব বেলা আড়াইটায় তাড়াহুড়াে করে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘােষণা করলেন, মুলতবির ঘােষণাকে বিনা চ্যালেঞ্জে পার পেতে দেওয়া হবে না। তিনি দুই দিনের হরতাল ডাকলেন—২ তারিখে ঢাকায় এবং ৩ তারিখে সমগ্র বাংলাদেশে। পূর্বাণী থেকে জনতা এসে জমায়েত হলাে পল্টন ময়দানে। সেখানে জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন তােফায়েল আহমদ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের আবদুল মান্নান। গােটা ময়দানেই পরিলক্ষিত হলাে একটা জঙ্গি মনােভাব। জনতার দাবি উঠল, আমরা ‘অ্যাকশন’ চাই। কিছু একটা করতে চাই। | মার্চের ২ তারিখে তারা তা পেয়েও গেল। হরতাল হয়েছিল সর্বাত্মক। ঢাকার কোথাও একটা সাইকেল পর্যন্ত চলতে পারেনি। নিরাপত্তা বাহিনীর চলাচল বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে সব কটি প্রধান সড়কে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। আর প্রথম সংঘর্ষটি বাধে তার ফলেই। তেজগাঁওয়ে সেকেন্ড ক্যাপিটালের প্রবেশপথে মঙ্গলবার সকালের মধ্যেই বসানাে হয় ভয়ংকর সব ব্যারিকেড। এগুলাের পাহারায় নিয়ােজিত থাকে মারমুখী মানুষের দল। তেজগাঁও থানার পুলিশকে ওসব ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলার হুকুম দেওয়া হয়। কিন্তু জনতার জঙ্গিভাব দেখে তারা দৌড়ে গিয়ে থানায় আশ্রয় নেয় এবং তাদের ওপরওয়ালাদের কাকুতিমিনতি সত্ত্বেও রাস্তায় বেরােতে অস্বীকৃতি জানায়। কিছুক্ষণ পর বিমানবন্দরের দিক থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ছােট দল এসে হাজির হয়। তারা যখন ব্যারিকেড সরানাের চেষ্টা করতে থাকে, তখন জনতা তাদের উদ্দেশে নানা রকম স্লোগান দিতে থাকে। নিরাপত্তা বাহিনীর লােকজন অ্যাকশনের অবস্থা গ্রহণ করে। ওই সময় সেকেন্ড ক্যাপিটাল থেকে একটা জিপে করে নিরাপত্তা বাহিনীর আরও একটা দল এসে হাজির হয়। জনতার মুখােমুখি পড়ে যাওয়াতে এই বাহিনীটি হঠাৎ গােলাগুলি শুরু করে দেয়। হিসাবে দুজন নিহত ও পাঁচজনের আহত হওয়ার কথা বলা হয়, কিন্তু এই সংখ্যা কতটা সঠিক, তা প্রমাণ করার কোনাে উপায় নেই। তখন থেকেই এই এলাকাটি এক ‘ট্রাবল স্পট’-এ পরিণত হয়, এবং রাত আটটায় কারফিউ জারি করা হলে সে রাতেই আবারও সেখানে গােলাগুলি হয়।
শহরের অন্যান্য এলাকা থেকেও সংঘর্ষের খবর পাওয়া যেতে থাকে। জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে গুন্ডা-বদমাশরা পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে অবাঙালি মালিকানাধীন বলে পরিচিত দোকানপাট থেকে লুটতরাজের চেষ্টা চালায়। এ রকম একটি ঘটনায় রাজ্জাকস নামক স্থানীয় একটি শার্টের দোকান লুট হলে আওয়ামী লীগের নগরপ্রধান স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে সেখানে ছুটে যান এবং মালামালসহ কয়েকজন লুটেরাকে ধরে ফেলেন এবং তাদের লুট করা দ্রব্যাদি ফেরত দিতে বাধ্য করেন; এরপর তাদের আচ্ছা করে পিটুনি দেওয়া হয়। নবাবপুরেও স্থানীয় গুন্ডারা এ ধরনের লুটপাট চালায়। ওখানে কয়েকটা সাম্প্রদায়িক (বাঙালি-বিহারি) সংঘর্ষও হয়—অবশ্য তা সীমাবদ্ধ ছিল স্থানীয় গুন্ডাদের মধ্যেই। দিনভর উত্তেজনা ও বিবাদ-সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড, মুহুর্মুহু স্লোগান আর থেকে থেকে গােলাগুলির আওয়াজ শহরটাকে একটা যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য অংশেও ছােট-বড় শহরগুলাে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অচল হয়ে পড়েছিল। পিআইএ কর্মচারীদের এক ধর্মঘটের ফলে। পূর্ব পাকিস্তান পৃথিবীর অন্যান্য অংশ থেকেও কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে রাত আটটা থেকে বলবৎ হওয়া কারফিউ আরও বেশি সংঘর্ষের সুযােগ করে দেয়। রাত নয়টার মধ্যেই ঢাকার বহু এলাকার লােক রাস্তায় নেমে পড়েছে বলে খবর পাওয়া যায়। শহরের বহু এলাকাতেই রাতভর গােলাগুলির আওয়াজ শােনা যায়। পরের দিনের হিসাবে জানা যায় যে কেবল মেডিকেল কলেজেই মৃতের সংখ্যা ৩৫ আর আহতের সংখ্যা ১১৩, অন্যান্য হতাহত ব্যক্তিদের মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, নয়তাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে রেখে দেওয়া হয়। ৩ মার্চ বুধবার আবহাওয়া আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। জনতার ঢল নামে রাস্তায়, ঢাকার রাজপথে আরও ব্যারিকেড দেওয়া হয়, গােটা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে পড়ে। ঢাকায় খবর ছড়িয়ে পড়ে যে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ-আহূত এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান সেদিনই ভাষণ দেবেন। বেলা তিনটার মধ্যেই জনতার জোয়ারে পল্টন উপচে পড়ে। অধিকাংশই ছিল লাঠিসোটা প্রভৃতি অস্ত্রে সজ্জিত—তারা নরকেও ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত, কেবল একটি আহ্বানের অপেক্ষা। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছাত্রসমাজ, শিল্প এলাকার শ্রমিকশ্রেণি আর রাস্তা ও বস্তি এলাকার সর্বহারাদের এ ছিল এক অভূতপূর্ব সম্মিলন। এর মেজাজটা ছিল বিপ্লবের। সচরাচর এ ধরনের সভার যে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণিসুলভ আরামপ্রদ পরিবেষ্টনী থাকে, এখানে তা নিশ্চিহ্ন। এই জনতা ছিল একেবারে স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত—যাদের দাবি, কিছু একটা করতে হবে’। প্রথম দিকে বক্তব্য দিলেন ছাত্রলীগের নেতারা, শ্রমিক লীগের মান্নান—এরা।
তারা সর্বক্ষণ তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে এমন সােচ্চার ছিলেন, যাতে করে ছয় দফার দাবিটা স্পষ্টতই একটা প্রতিক্রিয়াধর্মী স্লোগানে পরিণত হলাে। এই সশস্ত্র জঙ্গি মনােভাবাপন্ন জনতার সামনে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব অনুভব করলেন, এ এক মাহেন্দ্রক্ষণ, তার জন্য এক কঠিন দায়িত্ব ও পরীক্ষার সময়। কিন্তু টগবগ করে ফুটতে থাকা, উত্তেজনায় অধীর জনতাকে শান্ত করার মন্ত্র জানতেন তিনি এবং পরীক্ষিত সেই মন্ত্রগুণে এবারও প্রায় অসাধ্য সে কাজটি তিনি করলেন। জনতার মানসিক উত্তাপটাকে তিনি প্রশমিত করলেন পূর্ববর্তী বক্তারা যেসব দাবিদাওয়ার কথা বলেছেন, সেসবের ধারেকাছে গেলেন না তিনি। শেখ মুজিব দাবি জানালেন, সামরিক আইন প্রত্যাহার করে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। কারফিউ তুলে। নিলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে তিনি নিশ্চয়তা দিলেন। লুটেরাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি নিজে সব মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। এই অঙ্গীকারের উদ্দেশ্য ছিল আতঙ্কগ্রস্ত অবাঙালি লােকজনের মনে আস্থার ভাব ফিরিয়ে আনা, কেননা ওরা ধরেই নিয়েছিল, আন্দোলনটা ক্রমশ সম্প্রদায়গত, অর্থাৎ বাঙালিবিহারি বিদ্বেষের রূপ নিচ্ছে। একটা সমঝােতায় আসার জন্য শেখ মুজিব শাসকগােষ্ঠীকে ৭ মার্চ পর্যন্ত সময় দিলেন। তিনি ঘােষণা করলেন, তত দিন পর্যন্ত হরতাল চলতেই থাকবে, তার জনগণ কোনাে রকম ট্যাক্স না দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে অসহযােগ আন্দোলন চালিয়ে যাবে। জনতার উত্তেজনা প্রশমিত হলাে, তারা সভাস্থল ত্যাগ করে ঘরমুখী রওনা হলাে। এর প্রতিক্রিয়াটি পরদিনই বােঝা গেল। সামরিক বাহিনী অনেকটা সংযত আচরণ করল, তেমন উল্লেখযােগ্য গােলাগুলিও হলাে না। ব্যাপারটা এ কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে সেদিন সকালেই টাঙ্গাইলের এমএলএ আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ ও পার্টির প্রচার সম্পাদক আবদুল মান্নানকে নিরাপত্তা বাহিনীর লােকজন প্রচণ্ড মারধর করে তার কাঁধের হাড় ভেঙে দিয়েছিল। তার সঙ্গী আওয়ামী লীগেরই আশরাফউদ্দিন চৌধুরীকে বন্দুকের মুখে বাধ্য করা হয়েছিল আউটার সার্কুলার রােড থেকে একটা ব্যারিকেড সরিয়ে নিতে । এ ধরনের আরও ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকলেও ওই জনসভার পর স্পষ্টতই সেটা কমে গেল।
অবশ্য তা সত্ত্বেও সে রাতে গােলাগুলি একেবারেই হয়নি তা নয়, তবে আগের রাতের তুলনায় অনেক কম। আবহাওয়া-পরিবেশ-পরিস্থিতি যখন এই রকম, তখন ১০ মার্চে একটা গােলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘােষণাটিকে প্রায়। বাস্তববিমুখ, কাণ্ডজ্ঞানশূন্য বলেই মনে হয়। এই ঘােষণার মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপেই। অগ্রাহ্য করা হলাে এই প্রদেশটির মতামতকে, উপেক্ষা করা হলাে গােটা প্রদেশের বিদ্যমান অবস্থাটাকেই, যে অবস্থাটা কজন উপজাতীয় মালিকের সঙ্গে বা জামায়াতের মতাে একটা প্রাগৈতিহাসিক ধ্যানধারণাসম্পন্ন দলের, এমনকি কনভেনশন মুসলিম লীগেরও একমাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে—আর খােদ ভুট্টো সাহেবের কথা তাে না বললেও চলে—বিচ্ছিন্ন আলাপ-আলােচনার জন্য মােটেই অনুকূল ছিল না। গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানে শেখ মুজিবের অস্বীকৃতির ব্যাপারে খুব বেশি। আলাপ-আলােচনার তেমন প্রয়ােজন পড়েনি। ইতিমধ্যে পরিস্থিতি ক্রমেই শাসক দলের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল। কেননা, প্রশাসনের কর্তৃত্ব তখন অচল এবং তার প্রভাব শুধু তার বন্দুকের আওতার মধ্যেই প্রসারিত। লাগাতার হরতাল যে কেবল গােটা দেশকেই (পূর্ব পাকিস্তান) অচল করে দিয়েছিল তা-ই নয়, গােটা প্রশাসনই জনগণের সঙ্গে যােগ দিতে লাগল। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, বিচারকগণসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীও স্বেচ্ছায় নিজ নিজ কাজ থেকে বিরত রইলেন এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা-সংগঠনগুলাে সক্রিয়ভাবেই জনপ্রতিনিধিদের প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রমাণ দিতে লাগল । ব্যাপারটা এমনই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছায় যে নতুন গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য একজন বিচারপতিকেও পাওয়া যায়নি। শেখ মুজিবের পেছনে জনগণ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং শাসকদের সঙ্গে যে পরিমাণে অসহযােগিতা করেছিল, তার তুলনা উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসেও পাওয়া যায় না। শাসক দলের সংযমী হওয়ার জন্য এটি ছিল দৃষ্টান্তমূলক। সংযমের ফল পেতে অবশ্য সময় লাগে। ইতিমধ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে। টঙ্গীতে নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর, যশাের, খুলনা ও অন্যান্য প্রত্যন্ত এলাকায় মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণের ফলে শহীদের তালিকা কেবল বাড়তেই লাগল। যখন কোথাও কোনাে লুটপাটের বা সাম্প্রদায়িক (বাঙালি-অবাঙালি) দাঙ্গার ঘটনা ঘটত, তখন নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে খুব কমই যেত। এ ব্যাপারগুলাের দায়িত্ব আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল—তারাই অকুস্থলে গিয়ে লুটেরাদের পাকড়াও করত, লুষ্ঠিত মালামাল উদ্ধার করে তুলে দিত এদের মালিকদের হাতে তৃতীয় দিনের রাতের মধ্যেই স্বেচ্ছাসেবকেরা অন্তত ঢাকা শহরে এতটাই আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল, যা বন্দুকধারী ভ্রাম্যমাণ সামরিক বহরেরও সাধ্যের অতীত ছিল—এত দিন তাে তারাই শহরে পুলিশি চৌকি দিয়ে এসেছে।
শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকে সরিয়ে নিয়ে বিমানবন্দর ও ক্যান্টনমেন্টের আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলােতে মােতায়েন করার ব্যাপারটা যেমন ছিল বাস্তবতারই প্রতিফলন, তেমনই ছিল জনসাধারণের শৃঙ্খলাবােধের প্রতি সপ্রশংস সমর্থন। শাসক দলের কর্তৃত্ব ক্রমান্বয়ে যেভাবে হ্রাস পাচ্ছিল, আর জনসাধারণ যেভাবে তাদের নেতাদের সমর্থনে এবং অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে একযােগে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাড়া দিচ্ছিল, তাতে আশা করা গিয়েছিল শাসকমহলের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, তাদের কাছ থেকে একটা ইতিবাচক ও যুক্তিসংগত সাড়া পাওয়া যাবে। কিন্তু হলাে উল্টোটা। ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট এক বেতার ভাষণ দিলেন, যা প্রথমে গােটা বাংলাদেশের মানুষকে বিস্মিত ও পরে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ করে তুলল। ভাষণে জননেতাকে দোষারােপ করা হলাে এবং জনগণের এই অভ্যুত্থানকে মুষ্টিমেয় কিছু গুন্ডা-বদমাশ, অগ্নিসংযােগকারী ও খুনির কারসাজি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলাে। এই সংকটের মূল হােতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যে এহেন উলঙ্গ অভিযােগ থেকে রেহাই দেওয়া হলাে, তাতে এটাই বােঝা গেল যে শাসক দলের সঙ্গে তার দহরমমহরম নীতির সফলতা তিনি পেয়ে গেছেন। বাংলাদেশের দাবির জবাব যে প্রয়ােজন হলে অস্ত্রের ভাষায় দেওয়া হবে, তা বােঝা গেল যখন অ্যাডমিরাল আহসানের জায়গায় গভর্নর করে নিয়ে আসা হলাে এক কুখ্যাত যুদ্ধবাজ ব্যক্তিকে স্মরণ করা যেতে পারে যে জাতীয় সংসদ স্থগিতকরণের পরিণামের দায়িদায়িত্ব বহন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। অ্যাডমিরাল আহসান।
সামরিক বাহিনীকে আরও জোরদার করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। যেসব প্রশাসক সরকারের বদলে জনগণের প্রতি তাদের আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছেন, তাদের ওপর কর্তৃত্ব প্রয়ােগের চেষ্টা করা হতে পারে। শেখ মুজিব তার ৭ মার্চের ভাষণে ইয়াহিয়ার চ্যালেঞ্জের যে জবাব দিয়েছেন, তাতে আরেকটি চরম পরীক্ষার ক্ষেত্রও তৈরি হয়ে গেছে । শেখ মুজিব অবশ্য তার নেতা-কর্মী বাহিনীর অব্যাহত চাপ সত্ত্বেও সংকটের একটা আপসমূলক সমাধানের লক্ষ্যে আলােচনার দ্বার উন্মুক্ত রেখেছেন। জনগণের মনােভাব থেকে বােঝা যায়, তারা নিছক আলােচনার চেয়ে আরও বেশি কিছু চায়, লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) যে এ আলােচনা বানচাল করেও দিতে পারে, তারও আলামত পাওয়া গেছে যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবারও তার কথা উল্লেখ করেছেন। নববলে বলীয়ান যুদ্ধবাজ শাসক চক্রের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী সংঘর্ষের পর যে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড প্রায় অনিবার্য, সেটা ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন কি না, বা কতটা পারবেন, এ ব্যাপারে শেখ মুজিব তার নিজের নেতৃত্বকেই এক অগ্নিপরীক্ষার মুখে ঠেলে দিয়েছেন। এ ব্যাপারেও তাকে অনেক কিছু হিসাব-নিকাশ করে দেখতে হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির কেউ কেউ তখন হরতালের ধাক্কাটা টের পাচ্ছে, ওদিকে ছাত্র-সর্বহারাশ্রমিকদের যে ভিত্তিভূমি এখন পথেঘাটে সর্বত্র চিন্তাচেতনা নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে গেলে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, তাকেও তারা ভয় পাচ্ছে।
এরা তাগিদ দিচ্ছে একটা আপসরফা করে ফেলার জন্য। এই সবকিছুই বিচার-বিবেচনা করে দেখতে হয়েছে তাকে ফলে শেখ মুজিবের ভাষণটা ঠিক সে রকমটা হয়নি জঙ্গি-জনতা যে রকমটা। দাবি করেছিল। তবে তা কাপুরুষােচিত আত্মসমর্পণও ছিল না। তিনি যথাযথভাবেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার চ্যালেঞ্জ ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং যারা ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ছেন, তাদের ঘাড়েই গণহত্যা ও জাতীয় অখণ্ডতা নষ্ট করার পুরাে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলেন। সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাদের অপসারণ, জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁর যে দাবি, সেটা আজকের বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতির সঙ্গে একটা সমঝােতায় আসার অনুরােধের চেয়ে অধিক কিছু নয়। হত্যা, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযােগ বন্ধ হয়েছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটি প্রমাণ করেছে যে তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম। প্রশাসনের যেটুকুই অবশিষ্ট রয়েছে, তারা ইতিমধ্যেই তা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সব কর্মকর্তাকর্মচারীই স্বেচ্ছায় তাদের আদেশ-নির্দেশ গ্রহণ করছে, যাতে প্রদেশটি বিশৃঙ্খলার আবর্তে তলিয়ে না যায়। সামরিক আইনের অধীনে প্রশাসন পুনর্দখলের চেষ্টা করে পরিস্থিতিকে উল্টে দেওয়ার যেকোনাে প্রচেষ্টা প্রদেশটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখেই ঠেলে দেবে। শাসক চক্রের যােগ্যতা ও সামর্থ্য অবশ্য কেবল ওই পর্যন্তই বিস্তৃত, যেখানে তারা নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি চালাতে আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে পারে। কিন্তু জনগণের সম্মতি নিয়ে তারা কোনাে দিনই এই প্রদেশের অর্থনীতি ও প্রশাসনকে পুনরায় চালু করার আশা করতে পারে না। কাজেই তারা যদি দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের একটা স্থায়ী, টেকসই সমাধান খোঁজার ব্যাপারে সত্যিই আন্তরিক হয়ে থাকে, তাহলে নিদেনপক্ষে যা তাদের করতেই হবে তা হচ্ছে শেখ মুজিবের শর্তগুলাে মেনে নেওয়া। তাহলেই দেশটাকে যে অটুট রাখা যাবে, এটা জনগণকে বিশ্বাস করানাের জন্য ওইটুকুই যথেষ্ট হবে কি না, তা নির্ভর করবে জাতীয় পরিষদ জনগণের ন্যূনতম দাবি স্বীকার করে নেবে, নাকি তারা একটা চরম পরীক্ষার ক্ষণকে কেবল বিলম্বিত করতে চাইছে—তার ওপর। অবস্থা যে রকম দাড়িয়েছে, তাতে মনে হয়, বাংলাদেশেও ছয় দফার আর কোনাে মূল্য আছে কি না, এটা আর নিশ্চিত নয়। ভুট্টো নাকি এ রকম বলেছেন। যে তিনি ছয় দফা আর বিচ্ছিন্নতার (বা দেশ-বিভাজনের) মধ্যে কোনাে তফাত দেখেন না। তাকে এখন হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখানাে হচ্ছে যে ছয় দফার বাইরেও পড়ে আছে এক সম্পূর্ণ নতুন জগৎ। আর পরিহাস হলেও সত্যি যে ছয় দফার প্রণেতারাই ছিলেন সম্ভবত পাকিস্তানে সর্বশেষ সত্যিকারের অখণ্ডতাবাদী।
আজ যদি বাংলাদেশের জনসাধারণ স্বেচ্ছাপ্রণােদিতভাবে সম্মতি দেয়, কেবল তাহলেই সমগ্র জাতি একত্রে বাধা থাকতে পারবে। দেশের অখণ্ডতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে অস্ত্রের শক্তি ততটাই ক্ষমতা ধরে, যতটা ক্ষমতা ছিল ভারতবর্ষকে ব্রিটিশদের অধীনে কিংবা একত্রে যুক্ত রাখতে। শেখ মুজিব ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং তার গােটা রাজনৈতিক জীবনটাকেই বাজি রেখেছেন একটা চূড়ান্ত জবাবের আশায় কালক্ষেপণে। এই সহজ কর্মটিতে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে দেশটা যদি ভেঙে পড়ে, তাহলে পড়বে তাদেরই মাথার ওপর, যারা বন্দুক চালায়।
সাপ্তাহিক ফোরাম, ৬ মার্চ, ১৯৭১
বাংলাদেশে এখন যা হচ্ছে, তার নজির খুব বেশি দেখা যায় না। বলা চলে, মাত্র সাত দিনের মধ্যেই ইসলামাবাদ সরকারের কাছ থেকে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কার্যটি প্রকৃতপ্রস্তাবে সম্পন্ন হয়ে গেছে। না, যুদ্ধক্ষেত্রে জাকালাে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে কিংবা কোনাে বিদেশি হস্তক্ষেপ বা কূটকৌশলের সাহায্যে কাজটি সাধিত হয়নি। শাসক দলের আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা ত্যাগের মাধ্যমেও এটি অর্জিত হয়নি বরং এটি সম্ভব হয়েছে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উপায়েই। গত সপ্তাহের মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা সত্ত্বেও এই কথা বলা চলে, কেননা এই সব মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যেমন বাংলাদেশের জনসাধারণ, তেমনি নিপীড়ক শক্তিগুলােও। এই অবস্থার অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি যে বাস্তবতার মধ্যে নিহিত, তা হচ্ছে। শান্তিপূর্ণ অসহযােগিতাকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে, যা জনগণের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সক্রিয় সহযােগিতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। অধিকাংশ মুক্তিসংগ্রামেই অসহযােগিতা বা অসহযােগ আন্দোলন ছিল সে সংগ্রামের একটি অত্যাবশ্যক উপাদান। এ আন্দোলনের লক্ষ্য হতাে অর্থনীতি ও প্রশাসনকে পঙ্গু করে দিয়ে শাসকদের জীবনকে অসহনীয়, অতিষ্ঠ করে তােলা। এ ধরনের কোনাে আন্দোলন অনির্দিষ্টকালের জন্য জিইয়ে রাখা যেত না, কেননা শাসকগােষ্ঠী সব সময়ই প্রশাসন, ব্যবসায়ী ও ভূম্যধিকারী শ্রেণির অন্তর্গত একটা সহযােগী গােষ্ঠীর (নিন্দার্থে দালাল গােষ্ঠী) ওপর নির্ভর করতে পারত। এই সব ব্যক্তিগােষ্ঠীর দরুন ফরাসিদের পক্ষে ইন্দোচীনে প্রবল প্রতিরােধের মুখেও তাদের রিট বলবৎ করা সম্ভবপর হয়েছিল, এদেরই বদৌলতে এমনকি জার্মান ও জাপানিরাও ইউরােপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের দখল আমলে সমাজের জীবনযাত্রা চালু রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ভারতবর্ষে মুক্তিসংগ্রামকালেও সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে এটা দেখার জন্য সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের, জজ সাহেবদের ও অন্যান্য ব্যক্তিকে সব সময় হাতের কাছে পাওয়া যেত, আর পুলিশ বাহিনী তাে সর্বক্ষণই থাকত আইনশৃঙ্খলা জোরদার করার জন্য। তবে কৃচিৎ-কদাচিৎ সেনাদেরও ডাকতে হতাে—তাও স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করতে, তাদের বিকল্প হিসেবে নয়। কাজেই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা নজিরবিহীন, সেটা হচ্ছে এই যে ইসলামাবাদের শাসক দলের সঙ্গে অসহযােগিতাটা হয়েছে সামগ্রিক অর্থে। কেননা, গত সপ্তাহে প্রশাসনের কোনাে ব্যক্তিকেই সরকারের পক্ষে কাজ করতে পাওয়া যায়নি—পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি কিংবা মুখ্য সচিব বা চিফ সেক্রেটারি, কাউকেই আমার জানামতে, সমকালীন ইতিহাসে অন্য কোনাে দেশেই এ রকমটি কখনাে ঘটেনি। এমনও হয়েছে যে কোনাে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়তাে রুটিনমাফিক তার নিয়ন্ত্রক দপ্তরে কোনাে সংবাদ পাঠাতে চেষ্টা করেছেন, সে ক্ষেত্রে তার অধীনস্থ কর্মচারীরাই সেই কাগজপত্র ছিড়ে ফেলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে ঘটেছিল এক অসাধারণ ঘটনা। শেখ মুজিবের রেসকোর্সের ভাষণটি রেডিও থেকে সরাসরি সম্প্রচারের অনুমতি দিয়েছিল সামরিক কর্মকর্তাগণ । কিন্তু তারাই যখন তাদের খেয়াল-খুশিমাফিক ভাষণটির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়, তখন রেডিও কর্মচারীবৃন্দ রেডিও অফিস বন্ধ করে দিয়ে সােজা বাড়ি চলে যান। এর ফলে জেলাগুলােতে এক বড় সংকট সৃষ্টি হয়। পূর্বঘােষিত ভাষণ সম্প্রচার হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে জনসাধারণ ধরে নিল শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটার আশঙ্কা দেখা দেয়।
বিষয়টি যখন সামরিক কর্তৃপক্ষের গােচরে আনা হয় এবং সেই সঙ্গে এটাও জানানাে হয় যে অতঃপর বাংলাদেশের কোনাে রেডিও স্টেশন থেকেই আর কোনাে সংবাদ প্রচার করা হবে না, তখন তারা খবরটি ৮ মার্চের সকালে প্রচার করতে দিতে রাজি হয়। এ রকম শর্তে এখানকার রেডিও স্টেশনগুলাে আবার কাজ শুরু করে এবং ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে করাচি থেকে পাঠানাে লাওস, মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য যেকোনাে স্থানের সংবাদ বাদ দিয়ে শুধু বাংলাদেশ সম্পর্কে নিজস্ব সংবাদ বুলেটিন প্রচার করতে থাকে । অবশ্য অসহযােগ আন্দোলনটা ছিল কেবল প্রথম ধাপমাত্র। তার চেয়েও বেশি লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামাবাদের সঙ্গে অসহযােগিতা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সহযােগিতায় ক্রমবিকশিত হওয়াটা। ইডেন বিল্ডিং যেখানে পরিণত হয়েছে এক হৃত আশার সমাধিতে, সেখানে শেখ মুজিবের বাসস্থান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে প্রশাসন জেগে উঠেছে প্রাণচাঞ্চল্যে।
দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মার্চের ৪ তারিখ থেকেই নীতিমালাসংবলিত বিবৃতি প্রচারিত হতে থাকল এবং এগুলাের উৎসস্থল ৩২ নম্বর সড়কের ওই বাড়িই। প্রথম ফরমানগুলােতে ৫ মার্চ থেকে ব্যাংকগুলােকে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত খােলা রাখার এবং ১৫০০ টাকার অনধিক চেক ক্যাশ করার অনুমতি দেওয়া হলাে। পরদিন এটাকে বাড়িয়ে বেতনাদি পরিশােধ করার লক্ষ্যে চেক ভাঙানাের অনুমতি দেওয়া হয়, তবে তার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ট্রেড ইউনিয়ন নেতার সত্যায়নের প্রয়ােজন হবে, এই শর্তে। সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথা ভেবেই এই পদক্ষেপগুলাে নেওয়া হয়। বহু কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের মাইনের দিন থেকেই সংকটের শুরু হয়, হাতে নগদ টাকাপয়সা নেই বলে বহু শ্রমিককেই অনাহারে থাকতে হবে—এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করার ফলে যে কোনাে সমস্যা দেখা দেয়নি, তা নয়। প্রথমত, ব্যাংকগুলাে অচিরেই দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে, এ আশঙ্কার চেয়ে এগুলাে আবারও বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় প্রতিটি ব্যাংকেই। টাকা ওঠানাের ব্যাপারে গ্রাহকদের হুড়ােহুড়ি পড়ে গেল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শাখাগুলাে খােলা সম্ভব হয়নি। কেননা, সেগুলােতে নগদ টাকার সঞ্চয় ফুরিয়ে গিয়েছিল । এদিকে যােগাযােগব্যবস্থা ভেঙে পড়াতে তারা তাদের ঢাকাস্থ হেড অফিস থেকে যে টাকা নিয়ে আসবে সে উপায়ও ছিল না। যােগাযােগব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ার পর এ ব্যাপারে কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। আশা করা যাচ্ছে, নগদ টাকার ব্যাপারে লােকজনের অধিক আগ্রহটা ক্রমশ হ্রাস পাবে এবং ফলে ব্যাংক থেকে টাকা ওঠানাের হিড়িকটাও আর থাকবে না। ব্যাংকের কাজকর্ম মাত্র দুঘণ্টার জন্য হওয়ার ফলে তাদের কর্মতৎপরতা সীমিত হয়ে পড়ল। ৮ মার্চে জারি করা আরেকটি নির্দেশবলে ব্যাংকগুলােকে আরও অধিকক্ষণ কাজ চালানাের ক্ষমতা দেওয়া হয়।
এই নির্দেশটিতে ব্যাংকগুলােকে কলকারখানা চালু রাখার উদ্দেশ্যে কাঁচামাল কেনার জন্য অর্থ প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়। কেননা, ৫ মার্চ থেকে কলকারখানা পুনরায় চালু করার অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকলেও ব্যাংকের কড়াকড়ির দরুন এগুলাে অসুবিধায় পড়ে গিয়েছিল। অর্থনীতিকে আবার চাঙা করে তােলার প্রয়ােজনীয়তা এবং শ্রমিকদের যেকোনাে প্রকার দুর্দশা লাঘবের কথা ভেবেই এই ব্যবস্থাগুলাে নেওয়া হয়। তবে আসল সমস্যাটি ছিল ব্যাংক থেকে পুঁজি পাচার রােধ করা । একইভাবে ৯ মার্চ তারিখে জারি করা নির্দেশবলে বেছে বেছে কিছু সরকারি কাজকর্ম পুনরারম্ভ করার অনুমতি দেওয়া হয়। ব্যাংকগুলাের কাজ চালানাের সুবিধার জন্য স্টেট ব্যাংকের কিছু কিছু অংশ বা বিভাগ খুলে দেওয়া হয় । কৃষকদের খুব অসুবিধা হচ্ছিল, তাই তাদের যাতে সার সরবরাহ করা যায় এবং শীতকালীন ফসলের খেতে সেচ দেওয়ার জন্য পাওয়ার পাম্প চালু করা যায়, সে উদ্দেশ্যে কৃষি উন্নয়ন সংস্থাও খুলে দেওয়া হলাে । পাট ও ধানের বীজ বিতরণের অনুমতি দেওয়া হলাে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খাদ্যশস্য আনা-নেওয়া, খাদ্যগুদামগুলাে চালু করাসহ পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ এবং নৌ ও রেল পরিবহন চালু করারও অনুমতি দেওয়া হয়। এগুলাে ছাড়া ইডেন বিল্ডিং (সচিবালয়), কোর্ট-কাছারি সবই বন্ধ রইল। মার্চের ১২ তারিখে অত্যন্ত বিশদ আরও একটি নির্দেশ জারি করা হয়, যার বলে বাছাই করা ক্ষেত্রবিশেষে অসহযােগিতা নীতি আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়।
তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে সিভিল সার্ভেন্ট বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের সবাই নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে ছিলেন। সংগ্রামকে তারা অসহযােগ আন্দোলনের পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সক্রিয় সহযােগিতার স্তরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের একেকটি গ্রুপ বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলাে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পার্টির কাছে পেশ করার দায়িত্বটা মেনে নিয়েছিল। এভাবে একটা কাজ চালানাে গােছের সেক্রেটারিয়েট সচিবালয় চালু হয়ে গেল এবং সমস্যার সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে, আলাপ-পরামর্শ ও আশ্বাসের জন্য উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ীবৃন্দ সেখানেই দলে দলে আসা-যাওয়া করতে লাগলেন। কর্মপরিবেশ বা কাজকর্মের ধরন হয়তাে খুব আরামপ্রদ ছিল না, কিন্তু তাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত তাে হয়ইনি, বরং অনেক ক্ষেত্রেই তা ইডেন বিল্ডিংয়ের তুলনায় ত্বরিতগতিতে সম্পন্ন হয়েছে। সরঞ্জামাদি, কাজের পরিবেশ, কর্মপ্রণালি ইত্যাদি খুব একটা সন্তোষজনক ছিল না। যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার অভাবটাও একটা বাধা বটে, কিন্তু তবু কাজকর্ম এগিয়ে যেতে থাকল। ফলত এখন জনপ্রতিনিধিদের রিট বা আদেশপত্র বাংলাদেশের প্রতিটি কোনায়ই ক্রিয়াশীল সেক্রেটারি, ডেপুটি কমিশনার, সার্কেল অফিসার, পুলিশ কর্মকর্তা—সবাই তাদের হুকুম তামিল করছেন। আইনশৃঙ্খলা জোরদার করার লক্ষ্যে পুলিশ আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে মিলে কাজ করছে—গােলযােগপূর্ণ সময়ের কথা বিবেচনা করলে যা প্রায় অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। মফস্বলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সংগ্রাম পষিদের সঙ্গে সহযােগিতা করা শুরু করেছে এবং তাদের নির্দেশ পালন করছে। বস্তুত এখন প্রশাসনের আওতাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কার্যকর ক্ষমতার উৎস একটাই, তা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সহযােগিতা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একটা অনুপম মাত্রা যােগ করলেও কার্যকারিতার দিক থেকে তা কিন্তু জনগণের সাড়ার তুলনায় ততটা তাৎপর্যবহ নয়। যেমন কোনাে কোনাে ঊর্ধ্বতন প্রশাসন-কর্মকর্তার ওপর আরােপিত শাস্তির বিধান এখন কার্যত তাদেরই অধীনস্থ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাই প্রয়ােগ করছে। পার্টির সিদ্ধান্ত বানচালে যেকোনাে প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার ব্যাপারে তাদের অতি উৎসাহ প্রায়ই প্রশাসনের পুনরায় শুরু হওয়া অনেক ক্ষেত্রকেই অকেজো করে দিয়েছে, যার ফলে কর্মকর্তাদের তাদের কর্তৃত্ব পুনর্বহাল করার আরজি নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যেতে হয়েছে ৩২ নম্বরে। প্রকৃত ক্ষমতা এখন সেক্রেটারির হাত থেকে চলে গেছে তারই অধস্তনের হাতে এবং মনে হচ্ছে, কর্তৃত্বের স্বাভাবিক নিয়মশৃঙ্খলা যদি আবার ফিরিয়ে আনাও হয়, উধ্বতন-অধস্তনের মধ্যকার সম্পর্কটা আর আগের মতাে হবে না।
ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক, অফিসসহ কলকারখানাগুলােতেও একই ব্যাপারে শ্রমিক-কর্মচারীরাই বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষাকল্পে নজর রাখছে, যাতে উচ্চ পদে আসীনরা কোনাে রকম ফাকিজুকি দিতে বা কোনাে অন্তর্ঘাতমূলক কিছু একটা করতে না পারেন। এই সব উচ্চ পদের নির্বাহীদের মধ্যে অনেকেই হয়তাে এ দেশের প্রতি সত্যিকার অঙ্গীকার বােধ থেকে সহযােগিতা করেছেন। কেউ কেউ হয়তাে তাদের অধস্তনদের ভয়েও তা করে থাকতে পারেন—তবে এমনও কেউ কেউ ছিলেন, যারা টাকাকড়ি ওঠানােসংক্রান্ত কড়াকড়ি হ্রাসের সুযােগটা অন্যভাবে নিতেও চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কিন্তু অবস্থা যে আরও খারাপ হতে পারেনি, তার পুরাে কৃতিত্বটা তাদেরই কর্মচারীদের প্রাপ্য, যাদের দেশপ্রেম ও সতর্কতা প্রশংসাযােগ্য। আন্দোলনটি কার্যত জনসাধারণের মধ্য থেকে এমন সব সম্ভাবনা, এমন অমূল্য সম্পদ বের করে এনেছে, যার হিসাব আগে জানা ছিল না। এখন বাংলাদেশে আইনত কোনাে সরকার নেই, নেই কোনাে সরকারি বিধিনিষেধ, নিষেধাজ্ঞা বা অনুমােদনের ব্যাপারও। আওয়ামী লীগ যে সীমিত পরিমাণ সিদ্ধান্ত ও কর্তৃত্ব প্রয়ােগ করছে, সেগুলাে কোনাে আদালতে প্রযােজ্য নয়, তাদের সিদ্ধান্তগুলাে বাস্তবায়ন করার মতাে কোনাে কার্যকর ব্যবস্থাও নেই। তারা যদি বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানাে যাবে না বা অননুমােদিত উদ্দেশ্যে টাকা ওঠানাে যাবে না—এই মর্মে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুলাের উদ্দেশে কোনাে নির্দেশ জারি করে, সে নির্দেশ তাদের হয়ে বলবৎ করারও কেউ নেই। এই যে একটা অস্বাভাবিক, অসাধারণ গঠন কাঠামাে, সেটা যে অনড় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা হচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিচল আনুগত্য ও সহযােগিতা। আমরা দেখেছি, অফিসগুলােতে নিম্নপর্যায়ের কেরানি ও কর্মীরাই কীভাবে জনসাধারণের স্বার্থ দেখাশােনা করছে। প্রথম দিককার কিছু উচ্ছলতা, লুটপাট, জাতিগত দাঙ্গা ইত্যাদি সত্ত্বেও বাইরেও এখন স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। এমনকি জেলপালানাে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরাও দেশপ্রেম ও সংযমের পরিচয় দিচ্ছে। পুলিশের রিপাের্টে দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অপরাধের মাত্রা বেশ হ্রাস পেয়েছে। এখন তারা সবুজ টুপি পরা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে শহরময় চৌকি দেওয়ার কাজে সহায়তা করছে—এবং তা কেবল সহিংসতা দমনের লক্ষ্যেই নয়, বরং সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা জোরদার করার লক্ষ্যে। গুলশান ও ধানমন্ডি এলাকায়, যেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিশেষভাবে এমনিতেই ভয়ে তটস্থ থাকে, স্বেচ্ছাসেবকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের উপস্থিতির কথা জানান দিয়ে অভয় দিচ্ছে।
এ কথাও বলা হচ্ছে না যে বাংলাদেশের ওপর একটা শান্তিপূর্ণ স্বর্গসুখ নেমে এসেছে। খবর পাওয়া গেছে, একদল সশস্ত্র যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে বিস্ফোরক তৈরির কিছু রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ে গেছে। ভিআইপিদের পাহারায় রত সেন্ট্রিদের কাবু করে তাদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সংগ্রামের অন্য পর্বটি শুরু হয়ে গেছে এবং এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া চলে যে আগামী যেকোনাে অভ্যুত্থানেই সহিংসতাটা একতরফা হবে না। নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধমূলক কর্মকাণ্ডে একটা জঙ্গি মনােভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ওদের নিজস্ব প্রেসনােটে খবর দেওয়া হয়েছে যে সিলেট ও যশাের এলাকাস্থ তাদের ঘাঁটিতে রসদ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কৃষকেরা রাস্তা কেটে রেখেছে বলে খুলনা থেকে একটি সরবরাহ-বহরের যশাের পৌছাতে ১৮ ঘণ্টা লেগেছে। এমভি সােয়াত জাহাজযােগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে প্রথম অতিরিক্ত সাহায্যের চালান এসে পৌঁছেছে চট্টগ্রাম বন্দরে, তার আংশিকমাত্র খালাস করে ওয়াগনে তােলা হয়েছে। বন্দর-শ্রমিকেরা নিজেদের উদ্যোগেই খালাস করার কাজ বন্ধ করে দেয় এবং থেমে থাকা ওয়াগনগুলাে সরিয়ে নেওয়ার জন্য যাতে কোনাে ইঞ্জিন না পাওয়া যায়, তারও ব্যবস্থা করে। শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার সংগ্রাম বলতে যা বােঝে, উপরিউক্ত কাজগুলাে থেকে সে সংগ্রামের প্রতি তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ারই প্রমাণ মেলে।
সাপ্তাহিক ফোরাম, ১৩ মার্চ, ১৯৭১ ইংরেজি থেকে অনুবাদ : এ টি এম হাই
সূত্রঃ বাংলাদেশের অভ্যুদয় – রেহমান সোবহান