বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৯শে অক্টোবর, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ১১ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
খাদ্যশস্য চুরি
খাদ্যশস্য চুরি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে অনেক। কিন্তু খাদ্যশস্য চুরি আজো বন্ধ হয়নি। এ এক আজব ব্যাপার। দেশের মানুষ না খেতে পেয়ে পথে ঘাটে মারা যাচ্ছে অথচ খাদ্যশস্য চুরি বন্ধ করার কোনো ব্যাপক তৎপরতা নেই। এ যেন গা স’হা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যশস্য আছে বলেই তো চুরি হচ্ছে, না হলে হতো না—ঠিক এমন একটি মানসিকতাই বিরাজ করছে। মাত্র এক মাস আগেই খাদ্যশস্য চুরি সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল বাংলার বাণীতে। তাতে বলা হয়েছিল ‘আমদানীকৃত ও স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ খাদ্য দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবহনের সময় নিয়মিত চুরি হচ্ছে।’ শুধু বাংলার বাণী কেন সব পত্রিকাতেই খবর বেরিয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। গতকাল বাংলার বাণী’তে ‘সি.এস.ডি গুদাম থেকে তিন মাসে ১৩ হাজার মণ খাদ্যশস্য চুরি’ শীর্ষক সংবাদে দেখা যাচ্ছে খাদ্যমন্ত্রী এই চুরি ব্যাপারটা যে জানেন না তেমন নয়। তিনি জানেন। তিনি বলেছেন যে, এ ধরনের চুরি প্রায়ই হচ্ছে। যে খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হয় তার পুরোটা কোনো সময়েই নির্দিষ্টস্থানে পৌঁছায় না। শুধু তাই নয়, খাদ্যশস্য চুরির সাথে বিভিন্ন প্রশাসনিক ও স্থানীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জড়িত থাকার অভিযোগও তিনি স্বীকার করেছেন।
চুরি হচ্ছে জেনেও যদি চোর ধরা না যায় তাহলে তো সত্যিই ভাবনার কথা। সোনার চেয়ে দামী বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আনা হবে আর তা চোরেরা লুটেপুটে খাবে তেমন তো হতে পারে না। হওয়া উচিতও নয়।
কথায় বলে যে বেড়া দিয়ে ক্ষেতের ফসল রক্ষা হবে সেই বেড়াই যদি ক্ষেত খায় তাহলে আর দাঁড়াবার জায়গা থাকে না। এক্ষেত্রে হচ্ছেও তাই। খাদ্যশস্য চুরি যে সিঁধেল চোররা করছে না এটা পানির মতো পরিষ্কার। এ চুরির পেছনে রয়েছে রাঘব বোয়াল থেকে আরম্ভ করে চুনোপুটি পর্যন্ত। সকলেই এক সূতোয় গাঁথা। কাজেই চুরি বন্ধ করতে হলে রাঘব বোয়ালদের আগে ধরতে হবে। আর এ কাজটি করতে হবে ত্বড়িৎ গতিতে। হবে হচ্ছে করলে গ্রামবাংলার ভাষায় বললে বলতে হয়, শেষে গাইলও যাবে খোলাও যাবে অর্থাৎ তুলেমূলে সর্বনাশ হবে।
আসন্ন ব্রেজনেভ-ফোর্ড বৈঠক
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ডঃ হেনরী কিসিঞ্জারের মস্কো সফর এবং সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টি প্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভের সাথে তার তিন দফায় দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনার পরও মধ্যপ্রাচ্য সংকট যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রধান একটি মতবিরোধের বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে বলে মস্কো থেকে এএফপি’র পাঠানো খবরে বলা হয়েছে। কিসিঞ্জারের সফর সম্পর্কে প্রাভদা সংযত নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। কিসিঞ্জার এ বৈঠককে সন্তোষজনক বলে অভিহিত করেছেন।
এদিকে রয়টারের এ সংবাদ পর্যালোচনায় বলা হয়, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ব্রেজনেভ হোয়াইট হাউজ ও ক্রেমলিনের মধ্যে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফোর্ড নাকি সে ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন।
এ কথা অবশ্যই ঠিক যে, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমলে মস্কো-ওয়াশিংটনের মধ্যে একটা সমঝোতা ও সুস্থ মতামত বিনিময়ে উপযুক্ত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং নিক্সনের আকস্মিক বিদায়ে ও ফোর্ডের আগমনে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক অতীতের রেশ ধরে চলবে কি না তা নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে জল্পনা-কল্পনা চলছে। এরই মধ্যে ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার মস্কো সফরে এলেন। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অথবা শীর্ষ বৈঠকের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার কাজে সিদ্ধহস্ত কিসিঞ্জারের চার দিনব্যাপী মস্কো সফরকালেই সরকারীভাবে ঘোষণা করা হলো আগামী চব্বিশ ও পঁচিশে নভেম্বর ব্লাডিভষ্টকে রুশ-মার্কিন শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ঐ বৈঠকের প্রয়োজন রয়েছে : কারণ পৃথিবীর দু’টো মহাশক্তিশালী দেশের যে কোনো একটির রাষ্ট্রীয় কর্ণধারের পরিবর্তন ঘটলে সঙ্গত কারণেই নতুন নেতার আগমনে দু’দেশের অতীতের সম্পর্ক নতুনভাবে খতিয়ে দেখার প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক এবং সে কারণেই আমরা নভেম্বরের শীর্ষ বৈঠক ও তার সম্ভাব্য সফলতা কামনা করছি। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড নাকি সমঝোতার মনোভাবকে তার পূর্বসুরীর চাইতে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে বিশ্বাসী। বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধা নয় বরং পারস্পরিক প্রয়োজনের তাগিদেই দুই বৃহৎ শক্তি তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বর্তমান তাৎপর্য এনেছে বলে ফোর্ডের ধারণা। ভাবাবেগ কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। সম্পূর্ণ বাস্তবতার নিরিখেই যে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব এবং আমরা মনে করি বর্তমান মস্কো-ওয়াশিংটন সম্পর্কও বাস্তব পরিস্থিতি ও পারস্পরিক প্রয়োজনকে সামনে রেখে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করছে। রাষ্ট্রীয় কর্ণধারের পরিবর্তন ঘটলেও রাষ্ট্রীয় মৌলনীতির কোনো পরিবর্তন সাধারণতঃ ঘটে না। সুতরাং ব্যক্তি নিক্সনের চাইতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সময় অনুসৃত নীতিমালারও কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে এমন কোনো আভাস-ইঙ্গিত আমরা দেখিনি। তবে পরিস্থিতিকে সহজ করার প্রয়োজনে নীতিমালার পরিবর্তন অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য এবং আসন্ন ব্রেজনেভ-ফোর্ড বৈঠককে আমরা সেইভাবেই প্রত্যাশা করবো।
মধ্যপ্রাচ্য, ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ার সমস্যা আজকের নয়। এ সমস্যার গ্রন্থিগুলো একে একে উন্মুক্ত করবার দায়িত্ব বহুলাংশে বৃহৎ শক্তিসমূহের। সুতরাং এই সব সমস্যা পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করবে—অতীতের সেই ভ্রান্ত ধারণা আজ পৃথিবী থেকে আপসৃয়মান। সমস্যার বাস্তব সমাধানের মধ্য দিয়েই বিশ্ব সম্প্রীতি গড়ে উঠবে এই প্রত্যাশিত সত্যকে সামনে রেখেই ব্রেজনেভ-ফোর্ড বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বলে আমাদের ধারণা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক