বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি
পরিধি
এই অধ্যায়ে ১৯৪৭-৭১ কালপর্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের ওপর আলােকপাত করা হয়েছে। সে সময় পূর্ব বাংলার বাঙালিরা পাকিস্তানের নাগরিক ছিল। তবে এটা অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে বাঙালি জাতীয় চেতনার বিকাশের ইতিহাস পূর্ববর্তী আরও কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। এ পর্যায়ে অর্থনৈতিক বঞ্চনার অনুভূতি বাঙালিদের চেতনায় সংক্রমিত হতে শুরু করে। এ চেতনার প্রাথমিক অভিব্যক্তি ঘটে পাকিস্তানের জন্য বাঙালি মুসলমানদের সংগ্রামের মাধ্যমে। পূর্ব বাংলার জনমন থেকে আপেক্ষিক বঞ্চনার অনুভূতি দূর করতে পাকিস্তান সরকার ব্যর্থ হয়; এ ব্যর্থতা ১৯৪৭-৭১ কালপর্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিগুলােকে জোরদার করে তােলে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে সহায়তা করে। এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তির বিভিন্ন দিক। কাজেই অধ্যায়টিতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাক-১৯৪৭ কালপর্ব সম্পর্কে মাত্র ভাসাভাসাভাবেই আলােচনা করা হবে। এ কথা বলা যায় যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূলে ছিল আপেক্ষিক অর্থনৈতিক বঞ্চনার অনুভূতি। পূর্ব বাংলার বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের সংগ্রাম এ বিশ্বাসকে ভিত্তি করে অগ্রসর হয় যে বাঙালিদের নিজেদের অর্থনৈতিক ভাগ্যনির্ধারণের জন্য প্রয়ােজনীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা না দেওয়াতেই অঞ্চলটি আপেক্ষিক বঞ্চনার শিকার হয়েছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বাঙালিদের ক্ষমতার হিস্যা পাওয়ার এবং পূর্ববাংলা অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন লাভের লড়াইকে ঘিরে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে পাকিস্তানে যে একটি সম্মিলিত জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি তার কারণ ছিল ক্ষমতার অংশ প্রদান কিংবা বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনদানে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির অস্বীকৃতি। ক্ষমতা বহুল পরিমাণে পশ্চিম পাকিস্তানে রেখে দেওয়ার এ বাধ্যবাধকতার উদ্ভব হয় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদ বিলিবণ্টনের ওপর নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে ন্যস্ত থাকার ফলে। পাকিস্তানে রাজনৈতিক ক্ষমতার এই বাস্তবতা এবং ক্ষমতার চাবিকাঠি হাতে না পাওয়ার বঞ্চনার প্রতিকারে অপারগতাজনিত হতাশা বাঙালিদের মনে সদাজাগ্রত ছিল। এটাই তাদের বঞ্চনাবােধকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে তােলে। বর্তমান অধ্যায়টি ছয়টি অংশে বিভক্ত। সূচনায় রয়েছে বঞ্চনা ও জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত কিছু ধারণাগত বিষয়ের ওপর আলােচনা। দ্বিতীয় অংশে পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালিদের অংশগ্রহণের বিষয় আলােচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অংশে রয়েছে ১৯৪৭-৭১ কালপর্বে বঞ্চনা যে-আকার ধারণ করে তার বস্তুগত মাত্রা বা পরিমাণ সম্পর্কে আলােচনা। বাঙালিদের মধ্যে বঞ্চনার অনুভূতি তীব্রতর করে তােলার ব্যাপারে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও তার নীতিগুলাে কী ভূমিকা পালন করেছে তা-ই চতুর্থ অংশের আলােচ্য বিষয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাবাদী মনােভাব কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং তা বাঙালিদের বঞ্চনার অনুভূতিকে কীভাবে প্রবলতর করেছে সে বিষয়ে আলােকপাত করা হয়েছে পঞ্চম অংশে। বাঙালিদের এই বঞ্চনাবােধ দূরীকরণে পাকিস্তান সরকারের ব্যর্থতা রাজনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রামকে কতটুকু ত্বরান্বিত করেছে সেটা আলােচিত হয়েছে ষষ্ঠ ও শেষ অংশে।
ধারণাগত বিষয়সমূহ
জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে আলােচনা করতে গেলে জাতীয়তাবাদ কথাটা দ্বারা কী বােঝাতে চাই সেটাই আগে উপলব্ধি করতে হবে। এই আলােচনা প্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদকে আমরা ভৌগােলিকভাবে সীমাবদ্ধ একটি স্থানে বসবাসরত একটি বিশেষ জনগােষ্ঠীর জাতীয় পরিচয়ের অনুভূতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। অনুরূপ জনগােষ্ঠীকে অবশ্যই চিন্তাচেতনা, সমৃদ্ধি, গােষ্ঠীগত ক্রিয়াকলাপ, সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া, নিজ ভূখণ্ডের সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে নিজেদের অপর জনগােষ্ঠীগুলাে থেকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে দেখতে হবে। এ রকম সংজ্ঞায়নে স্পষ্টত অনেক দুর্বলতা রয়েছে, যেহেতু গােষ্ঠীগত চেতনা বা অনুভূতি ওপরে বর্ণিত সব বিষয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ না-ও হতে পারে। একটা জনগােষ্ঠী সাংস্কৃতিকভাবে সমপ্রকৃতির হলেও তার মধ্যে জাতি, বর্ণ, গােত্র, ধর্ম ও পৃথক সামাজিক শ্রেণি থেকে উদ্ভূত সংগতি থাকা সম্ভব। একটি ভূখণ্ডের অন্তর্গত অঞ্চলগুলাের মধ্যেও অসংগতি থাকতে পারে, যা গ্রামকে গ্রাম থেকে, জেলাকে জেলা থেকে, কিংবা প্রদেশকে প্রদেশ থেকে বিভক্ত করতে পারে। একটি জাতিসত্তা অপর জনগােষ্ঠীর তুলনায় পণ্যসম্পদ, সরকারি চাকরি, উৎপাদনী সম্পদ, উৎপাদনের উপায়গুলাে নিয়ন্ত্রণ, নীতিনির্ধারণ ও বণ্টনপ্রক্রিয়ায় কতটুকু পরিমাণে হস্তক্ষেপ করতে পারে বা করার ক্ষমতা রাখে তা থেকেই বঞ্চনার ধারণা সৃষ্টি হয়। কাজেই জাতীয় একত্ববােধ হচ্ছে একটি জনগােষ্ঠী অপর জনগােষ্ঠীর তুলনায় কতটা বঞ্চিত হচ্ছে, সেটা নিরূপণের অনেক উপায়ের অন্যতম। পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালিদের অংশগ্রহণের অর্থনৈতিক ভিত্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নিরূপণ এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য যেহেতু জাতীয়তাবাদের তত্ত্বীয় বিষয়ে নতুন কিছু সংযােজন নয়, সুতরাং আমরা কেবল আমাদের ধারণাগত সমস্যাটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসের মধ্যেই সীমিত রাখতে চাই।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক আন্তঃসম্পর্কগুলাের দিকে তাকাতে গেলে বাংলাদেশের বাংলাভাষী জনগণের ইতিহাস এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার বাংলাভাষী জনগণের ইতিহাসকে এর অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়ােজন হবে। আসলে এ অঞ্চলের বাংলাভাষী মুসলমানরা একটি পৃথক জাতীয় পরিচিতির দাবি তুলেছিল, যা তাদের বিভাগপূর্ব (প্রাক-১৯৪৭) ভারতের মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক কাঠামাের মধ্যে স্থান করে দেয়। তবে রাজনৈতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য বাঙালি মুসলিমদের জাতীয় পরিচিতির একটা স্থানগত ভিত্তির দরকার ছিল। গােড়ার দিকে বাংলা ও আসামকে নিয়ে এই ভিত্তি গঠিত বলে মনে করা হতাে। ভারত বিভাগের প্রাক্কালে এখানে মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগুরু। প্রকৃতপক্ষে ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি হিসেবে তৎকালীন শাসক ব্রিটিশ সরকারের তৈরি ১৯৪৬-এর ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় এ রকমই অনুমান করা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনায় উত্তর-পশ্চিম, মধ্য ও উত্তর-পূর্ব ভারতের তিনটি উপরাষ্ট্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয়, জাতীয় যােগাযােগব্যবস্থা ও কিছু অর্থনৈতিক বিষয়ে যৎসামান্য ক্ষমতা প্রদানের কথা বলা হয়েছিল। | ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয় এবং মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকাগুলােকে নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের ব্যাপারে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অবস্থায় মুসলিম। বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার ভূখণ্ডগত সীমানা নতুনভাবে নির্ধারণ করে, যার মধ্যে। সমগ্র বঙ্গদেশ ও আসামের মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকা পড়ে। প্রস্তাবিত ভূখণ্ডে মুসলিম বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতাে। মুসলিম বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত আবাসস্থল হিসেবে বাংলা ও আসামের মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকাগুলাের কীটদষ্ট ও খণ্ডিত’ পাকিস্তানে যােগদানের চিন্তাটা মেনে নেওয়া হয় একমাত্র তখনই, যখন কংগ্রেস হাইকমান্ড ঐক্যবদ্ধ ও সার্বভৌম বাংলার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে।
বলা নিষ্প্রয়ােজন যে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ গােটা সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, রাজধানী লাহােরসহ পাঞ্জাবের সেরা অংশগুলাে নিয়ে গঠিত পশ্চিম পাকিস্তানের কথা চিন্তা করে কীটদষ্ট ও খণ্ডিত’ পাকিস্তানের কথা বলেননি। তিনি তখন ভাবছিলেন বাংলার কথা, যা তার রাজধানী হারিয়েছে, ভারতের বৃহত্তম শিল্পাঞ্চলগুলাের অন্যতম প্রধান নৌবন্দরটি হারিয়েছে এবং বাংলার অনগ্রসর কৃষিপ্রধান পশ্চাদভূমি আর আসামের চা উৎপাদনকারী জেলা সিলেটকে পাকিস্তানে নিয়ে এসেছে। পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে অভিব্যক্তি ঘটেছিল তাকে এভাবে শেষ পর্যন্ত র্যাডক্লিফ রােয়েদাদ কর্তৃক পুনর্নির্ধারিত সীমানায় পূর্ব বাংলা ও সিলেটের অন্তর্গত ভূখণ্ডে ধর্মের দ্বারা নির্দিষ্ট সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিসেবে নিজের জাতীয় পরিচিতি তুলে ধরতে হয়। এই সীমানার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে স্বীকার করে নিতে হয় বিপুলসংখ্যক অমুসলিমকে, যারা ছিল ভারত ও বাংলাগের। সময় পূর্ব বাংলার জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎস যা-ই থাকুক না কেন, ওই তারিখের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদ কেবল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত ভূভাগের জাতীয়তাবাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। জাতীয়তাবাদের এই সংজ্ঞার মধ্যে অমুসলিমরাও অন্তর্ভুক্ত হয়, কিন্তু জনসংখ্যার শতকরা ১ ভাগ—ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত লােকেরা সংজ্ঞায়নের দরুন নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাক্রমে বাদ পড়ে যায়। আমাদের জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আর বর্তমান বাংলাদেশের গারাে পাহাড় এলাকার স্বল্পসংখ্যক অবাঙালি উপজাতিগুলাের অবস্থান অস্পষ্ট থেকে যায়।
অর্থনৈতিক বঞ্চনা এই অধ্যায়ে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নিরূপণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত উল্লিখিত সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের কিছু প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে, যেহেতু এতে বাংলার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বঞ্চনার চেহারা তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সাধারণভাবে পূর্ব বাংলার জনগণ এবং বিশেষত বাঙালি মুসলিমরা কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা হিন্দু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের তুলনায় নিজেদের বঞ্চিত বােধ করত। ওই বঞ্চনার মূলে ছিল এই সত্য যে পশ্চিম বাংলা ছিল পূর্ব বাংলার চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। পূর্ব বাংলাতেও মুসলিমরা অনুভব করত যে অর্থনৈতিক জীবনে তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রাধান্য নেই, সেখানে রয়েছে অপর সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণ ও প্রাধান্য। ভূমির মালিকানা ছিল প্রধানত হিন্দু জমিদারদের হাতে। মুসলিমরা ছিল হিন্দু জমিদারদের রায়ত কিংবা ক্ষুদ্র চাষি। মধ্যবর্তী আর্থিক কায়কারবার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গ্রামীণ শিল্পের নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রধানত বাঙালি হিন্দুদের হাতে এবং কোনাে কোনাে ব্যবসা-বাণিজ্যের উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ ছিল মাড়ােয়ারিদের হাতে। পুঁজিবাদী শিল্প বলতে যা কিছু ছিল তার মালিকানা ছিল ব্রিটিশদের হাতে।
যেমন সিলেটের চা-শিল্প এবং পূর্ব বাংলার নদীপথে সংযােগ রক্ষাকারী যান্ত্রিক নৌ-পরিবহনব্যবস্থা। | কয়েকটি কাপড়ের কল ও একটি চিনিকল নিয়ে যে সামান্য আধুনিক পণ্য উৎপাদন শিল্প গড়ে ওঠে তার মালিক ছিল বাঙালি হিন্দুরা। শহরাঞ্চলের ব্যবসাবাণিজ্যও তারাই নিয়ন্ত্রণ করত। আমলাতন্ত্র, শিক্ষকতা ও আইন ব্যবসাতেও তাদেরই প্রাধান্য ছিল। পূর্ব বাংলার সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রক্রিয়াটি তুলে ধরা হচ্ছে তথ্য হিসেবে, বাঙালি মুসলমানদের নিজেদের একটি বঞ্চিত শ্রেণি হিসেবে দেখার যৌক্তিকতা প্রতিপাদনের জন্য। এ গ্রন্থের অন্যান্য অধ্যায় প্রাক-১৯৪৭ পূর্ব বাংলার সামাজিক কাঠামাে সম্পর্কে অধিকতর সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদানে সক্ষম হবে এবং সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থাসংক্রান্ত অধ্যায়গুলােতে লক্ষ করা যাবে যে ১৯৪৭ সাল নাগাদ বাংলায় একটি মধ্যস্বত্বভােগী মুসলিম জোতদার শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে, আর সরকারি চাকরিতে মুসলিম বাঙালিদের অনুপাত পদমর্যাদার দিক থেকে না হােক অন্তত সংখ্যার দিক থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঙালি মুসলমানরা এমন একটা শাসনব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হতে চাচ্ছিল, যেখানে তারা রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তারা আশা করছিল ভূমিস্বত্ব লাভের, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে শিক্ষা, সরকারি চাকরি ও বিভিন্ন পেশায় নিজেদের এগিয়ে নেওয়ার, পূর্ব বাংলায় শিল্পের অবকাঠামাে গড়ে তােলার এবং এ অঞ্চলে শিল্পায়ন ঘটাবার। ব্যবসাবাণিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রে বাঙালি মুসলিম-উদ্যোগের অস্তিত্ব কার্যত ছিল না বলে তারা আশা করছিল যে সম্পদ সংগ্রহ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া এবং কাঠামােগত পরিবর্তন সাধনের দুটো কাজ রাষ্ট্রই শুরু করবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে যে দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তার জন্য মুসলিম জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সর্বাধিক জোর দেয়।
ভারতের মুসলিমরা ধর্মের ভিত্তিতে তাদের জাতীয় পরিচয় বেছে নিয়েছিল বলে তাদের পক্ষে জাতীয় ক্ষমতার কেবল এমন একটা কাঠামােই কল্পনা করা সম্ভব ছিল, যেখানে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের প্রাধান্য নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও পেশাগুলােয় হিন্দুপ্রাধান্য থাকায় রাষ্ট্রশক্তির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রভুত্ব চিরস্থায়ী করার উপায় হিসেবে দেখা হতাে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের শ্রেণি, জাতি, বর্ণ অথবা ভূখণ্ডগত বৈষম্যগুলাের প্রতি খুব সামান্যই নজর দিয়েছে। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশে মুসলিমরা রাজনৈতিকভাবে প্রবল ছিল এবং অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত ছিল না। সেখানকার মুসলিম সংখ্যাগুরু জনগােষ্ঠীকে ভারতের অপরাপর অংশের সংখ্যালঘু মুসলিমদের বা আপেক্ষিকভাবে বঞ্চিত ও পশ্চাৎপদ বাংলার মুসলিমদের সঙ্গে এক নৌকায় তুলে দেওয়া হয়। অথচ তখনকার পরিস্থিতিতে একজন বাঙালি প্রজা বা রায়তের পরিপ্রেক্ষিত আর পাঞ্জাবের নুন-তিওয়ানা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের উপজাতি-সর্দার ও সিন্ধুর ওয়াদেরা বা অভিজাত ভূস্বামীদের পরিপ্রেক্ষিত ছিল কিছুটা ভিন্ন। বাঙালি প্রজা আইন পরিষদের নির্বাচনে পাকিস্তানের পক্ষে ভােট দিয়েছিল তার দৈনন্দিন জীবনের ওপর থেকে হিন্দু জমিদার-মহাজনদের কর্তৃত্ব অপসারণের জন্য। পক্ষান্তরে পাঞ্জাবের নুন-তিওয়ানা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের উপজাতীয় সর্দার এবং সিন্ধুর ওয়াদেরা ভূস্বামীরা চেয়েছিল হিন্দুপ্রাধান্যযুক্ত কেন্দ্রের অনধিকারমূলক হস্তক্ষেপ থেকে তাদের প্রাদেশিক ক্ষমতাকাঠামাের প্রাধান্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়ােজনীয় আঞ্চলিক ক্ষমতা। উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিম ভূস্বামী ও পূর্ব বাংলার কৃষক এমন একটা রাষ্ট চেয়েছিল, যা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিচালনার সুযােগ এনে দেবে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান আন্দোলন তাদের জাতীয় ক্ষমতা না। হােক, অন্তত স্থানীয় ক্ষমতা দখলের জন্য হাত মেলানাের একটা সুবিধা এনে দেয়। ভারতের মুসলিমদের স্বাধীন জাতীয় ক্ষমতা লাভের সংগ্রামের উদ্ভব ঘটেছিল নিজস্ব বিষয়াদি পরিচালনার জন্য যথাযথ রাজনৈতিক স্বাধিকার নিশ্চিতকরণে মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশগুলাের ব্যর্থতা থেকে। কিন্তু বাংলার মুসলিমদের জন্য এই স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতার লক্ষ্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক প্রাধান্য খর্ব করে নিজেদের অর্থনৈতিক বঞ্চনার অবসান ঘটানাে। লাহাের প্রস্তাবে দুটো স্বতন্ত্র মুসলিম সংখ্যাগুরু রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। কাজেই প্রস্তাবটি ছিল পরিকল্পিত অথবা আকস্মিকভাবে ভারতের এ দুই অঞ্চলের মুসলিমদের উদ্বেগের ফসল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পূর্ব বাংলার বাঙালিরা যে রাষ্ট্রটির উত্তরাধিকার লাভ করে, তার অংশীদার হয় উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিমরা এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছুসংখ্যক লােকসহ ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলাে থেকে আগত উদ্বাস্তুরা।
নতুন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে পরস্পরবিরােধী পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে এই উদ্বাস্তু নাগরিকেরা ভারতের নানা অঞ্চল ও পটভূমি থেকে এসে পাকিস্তানে প্রবেশ করে। যেসব সামাজিক শক্তি নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়, তার মধ্যে বাঙালিদের উচ্চাভিলাষী প্রত্যাশা ছিল সর্বাধিক। ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলােতে এবং দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিভিন্ন পেশা ও কারিগরি বৃত্তির ক্ষেত্রে মুসলিমদের বেশ ভালাে অবস্থান ছিল । হিন্দিভাষী উত্তরাঞ্চলে মুসলিমরা ছিল প্রধান শ্রেণি ভূস্বামী ও পেশাজীবীদের অংশ। তাদের মাতৃভাষা উর্দু ছিল এ অঞ্চলের উচ্চতর শ্রেণি হিন্দু-মুসলমানের মিলিত মাতৃভাষা। এভাবে দেখা গেল, যেসব জনগােষ্ঠী পাকিস্তান পেল তাদের মধ্যে পূর্ব। বাংলার বাঙালিরাই কেবল পর্যায়ক্রমে উত্তর ভারতের মােগল ও তাদের অনুচরদের, ব্রিটিশ শাসকদের ও হিন্দু জমিদারদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভুত্বের শিকার হয়েছিল। সুতরাং পূর্ব বাংলার পশ্চাৎপদতা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর এ অঞ্চলের জনগণের নিয়ন্ত্রণ না থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান থেকে স্বায়ত্তশাসন লাভের আন্দোলনের দিকে। দৃষ্টিকে কেন্দ্রীভূত করে। এটা পূর্ব বাংলার বাঙালিদের চেতনার মধ্যে স্থায়ীভাবে কাজ করতে থাকে। কাজেই এ প্রক্রিয়াকে কয়েকটি পৃথক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে দেখা উচিত হবে না।
বাঙালিদের অর্থনৈতিক বঞ্চনা কতিপয় ধারণাগত প্রশ্ন অর্থনৈতিক বঞ্চনাকে চূড়ান্ত ও আপেক্ষিক উভয়ভাবেই দেখা যেতে পারে। দারিদ্র্যপীড়িত কোনাে ব্যক্তির বঞ্চনার পরিমাপ সুনিশ্চিতভাবে করা যায় সে কত ক্যালরিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে পারে বা কত কম জিনিসপত্র, মালামাল ইত্যাদি তার আছে সেটা বিবেচনা করে। অপরাপর ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা ভূখণ্ডের সম্পদ ও সুবিধাদির বিচারে বঞ্চনা আপেক্ষিকও হতে পারে। বাঙালিদের জন্য একটি জাতীয় পরিচিতি নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে বঞ্চনা প্রসঙ্গে বলতে গেলে আমাদের একটি মিলিত জাতীয় আবাসস্থলে বসবাসরত বিভিন্ন জনগােষ্ঠী ও অঞ্চলের কথা বিবেচনায় রেখে বিষয়টির প্রতি নজর দিতে হবে। বিশ্লেষণে আমরা উৎপাদনশীল উপায়-উপকরণ, অস্থাবর সম্পত্তি ও চাকরির ওপর অধিকার বা কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে বঞ্চনার পরিমাপ করব। এসব বঞ্চনা দেশীয় ও বৈদেশিক সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব এবং শেষ পর্যন্ত নীতিনির্ধারণপ্রক্রিয়ার ওপর কর্তৃত্বের ব্যাপারে বিদ্যমান বঞ্চনার সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। | এ পরিচ্ছেদে পূর্ব বাংলা (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) ও সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনা করে এর আপেক্ষিকতার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা হবে। এটা করা হবে প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানের অঞ্চলসমূহ এবং পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মধ্যে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্যের আলােকে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে উৎপাদনী সম্পদের বিন্যাসের প্রতিও অবশ্য দৃষ্টিপাত করা হবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু বাঙালিদের ঐতিহাসিকভাবে অনুভূত আপেক্ষিক বঞ্চনাবােধের একটি তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান ছিল স্থানীয় অর্থনীতির ওপর বাইরের লােকদের কর্তৃত্ব। আঞ্চলিক হিসাবে পৃথকরণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অদ্ভুত ভৌগােলিক বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারটি পৃথকরণের ধারণাকে অধিকতর পরিমেয় করে তােলে। দুটি আঞ্চলিক অর্থনীতিকে দুটি স্বতন্ত্র অর্থনীতিরূপে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে। সম্ভব হয় প্রতিটি অঞ্চলের জিডিপি ও জিএনপি, সঞ্চয় বিনিয়ােগ, শ্রম ও পুঁজির আন্ত-আঞ্চলিক গতিবিধির মােটামুটি হিসাব নির্ধারণ, বাণিজ্য ও প্রদত্ত অর্থের স্বতন্ত্র মূল্যহারের পৃথক ব্যালেন্স প্রস্তুতকরণ, বাজেটের মাধ্যমে ও বৈদেশিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ ও ব্যয়ের আলাদা হিসাব প্রণয়ন। | সমস্যা দেখা দেয় কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিগুলাের খরচ ও সুবিধাদির হিসাব নির্ধারণের সময়। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য সংগৃহীত রাজস্বের হিসাব রাজস্ব সংগ্রহের আঞ্চলিক উৎসগুলাে থেকে সব সময় পাওয়া যেত বটে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানে সমিতিভুক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলাের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জিত আয়ের ওপর নিজ নিজ হেড অফিস থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে কর দেওয়ার ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় না। আদমজী, বাওয়ানী, আমিন, দাউদ প্রভৃতি ব্যবসায়ী গােষ্ঠীর আয়ের একটি বড় অংশ আসত পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম থেকে। অথচ তারা ট্যাক্স দিত পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত তাদের হেড অফিস থেকে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে, টেলিযােগাযােগ ও রেলওয়ের মতাে খাতে অঞ্চলবিশেষকে সুনির্দিষ্ট সুযােগ-সুবিধা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় বরাদ্দ করা যথেষ্ট সহজ ছিল ।
কেন্দ্রীয় শাসন, বৈদেশিক সার্ভিসসমূহ ও প্রতিরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যয় প্রধানত কর্মচারী ও দপ্তরগুলাের জন্য হলেও এবং এসব বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বৃহত্তর অংশ পশ্চিম পাকিস্তানি বংশােদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও এসব বিভাগের বা সার্ভিসের চাকরিতে পাকিস্তানের উভয় অংশের লােকদের সম-অধিকার রয়েছে বলে গণ্য করা হতাে এবং এসব ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য ব্যয় নির্দিষ্ট করে। দেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করা হতাে। বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা দৃঢ়ভাবে এ অবস্থার বিরােধিতা করেন। তারা যুক্তি দেখান যে প্রতিরক্ষা ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সুফলগুলাে যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানই পায়, সেহেতু বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একটা যথাযথ অংশ বা হার অনুযায়ী ওই সব ব্যয় ভাগ করা উচিত। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি ও অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্তগুলাের মাধ্যমে এটাও দেখা যায় যে বিভিন্ন সার্ভিসের চাকরির সুফলও পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় আপেক্ষিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানই অনেক বেশি ভােগ করে। ওই সব সুফল পক্ষপাতহীনভাবে বণ্টন করা হচ্ছে বলে মেনে নিতে বাঙালিরা সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের এ রকম ‘অ-বরাদ্দযােগ্য সম্পদ বণ্টনের পরিমাপ করতে গিয়ে বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা দেখেন যে চাকরি এবং কেন্দ্রীয় ব্যয় অন্যায়ভাবে অঞ্চলবিশেষে চলে গেছে। এসব দাবি ও অভিযােগের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলাে ভৌগােলিক বিচ্ছিন্নতা কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পদ ও অর্থের বেশির ভাগ কোথায় যায় সেটার হিসাব নেওয়াটা সম্ভব করে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের আপেক্ষিক বঞ্চনার ধারণাকে এটা পরিমাণগতভাবে কিছুটা নিখুঁত করে তােলে। আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে এমন অপরাপর দেশে পূর্ব পাকিস্তানের আপেক্ষিক বঞ্চনার মতাে ব্যাপার এতটা চট করে নজরে পড়ে না। কেবল আঞ্চলিক বৈষম্যের পরিমাপই নয়, বছরের পর বছর ধরে এর গতিধারার নকশা তৈরি ও ব্যাখ্যা করার সুযােগ ও ক্ষমতা। অর্থনীতিবিদদের নাগালের মধ্যে থাকায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের হিসাব-নিরূপণ বৈষম্যের অতি সহজপ্রাপ্য পরিমাপটি আঞ্চলিক জিডিপি ও মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাপের সঙ্গে সম্পর্কিত। আঞ্চলিক মাথাপিছু আয় এবং আঞ্চলিক বৈষম্যের যেকোনাে সূচক হাতের কাছেই রয়েছে। এসব হিসাবের বেশির ভাগ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের জাতীয় আয়সংক্রান্ত হিসাব থেকে নেওয়া উপাত্তগুলাের ভিত্তিতে প্রাপ্ত বলে বছরে বছরে বিভিন্ন উৎসের হিসাবে গরমিল দেখা যায়। এসব পরিসংখ্যানগত বিভিন্নতার কোনটা সঠিক বা কতটা সঠিক সে বিচারে না গিয়ে আমরা পাকিস্তানের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রণেতা অর্থনীতিবিদদের জন্য পেশকৃত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদদের দুটো পৃথক রিপাের্টে প্রদত্ত মাথাপিছু বৈষম্যের হিসাবকে কাজে লাগাতে পারি। তবে আঞ্চলিক অর্থনীতির বৈষম্যের পূর্ণতর বিবরণদানের জন্য আমরা অন্যান্য উপাত্তের প্রতিও দৃষ্টিপাত করব। যেসব তথ্যপ্রমাণ রয়েছে তাতে দেখা যায়, ভারত বিভাগের সময় পাকিস্তানের দুই অংশ যে অর্থনীতির উত্তরাধিকারী হয় তাতে তাদের বিকাশের স্তরে কোনাে তাৎপর্যপূর্ণ বৈষম্য ছিল না।১০ উভয় অঞ্চলের শিল্পভিত্তিই ছিল উপেক্ষণীয়। তবে পশ্চিম পাকিস্তান রাস্তাঘাট, সেচব্যবস্থার সুবিধা ও বিদ্যুৎ ইত্যাদি থেকে একটা উন্নততর অবকাঠামাে লাভ করে।১২ উভয় অংশের জিডিপি প্রায় সমানই ছিল।১৩ দেশজাত উৎপন্ন দ্রব্যের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে সামান্য পরিমাণে বেশি এবং তা ১৯৫৩-৫৪ সাল পর্যন্ত ওই অবস্থায় থাকে। তবে জিডিপির অবরাদ্দযােগ্য অংশগুলােকে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত করলে দেখা যায় যে ১৯৪৯-৫০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের হিস্যা পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে সামান্য পরিমাণে বেশি ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের মাত্রা বেশি হওয়ার কারণেই এটি ঘটে। ১৯৪৯-৫০ সালে জিডিপির পশ্চিম পাকিস্তানি হিস্যা ছিল ৫০.৫%। ১৯৫৯-৬০ সাল নাগাদ পশ্চিম পাকিস্তানের হিস্যা বেড়ে ৫২.৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এ ব্যবধান ১৯৬৯-৭০ সাল নাগাদ আরও প্রসারিত হয়ে পাকিস্তানের জিডিপিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ দাঁড়ায় ৫৭.৪%।১৫
কাঠামােগত পরিবর্তনে ভিন্নতা। এসব আঞ্চলিক বৈষম্য দেখিয়ে দেয় যে ১৯৪৯-৫০ এবং ১৯৬৯-৭০-এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের জিডিপি পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে দ্রুততার সঙ্গে বর্ধিত হয়।১৬ পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের ১.৯%-এর তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধির হারের গড় ছিল ২৭%। ষাটের দশকে এ ব্যবধান আরও বেড়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের ৪.৩%-এর তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৬.৪%-এ। পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির এই দ্রুততর বিকাশের হার পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির সঙ্গে তুলনায় উচ্চতর হারে বিনিয়ােগ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বৈচিত্র্য আনয়নের ফল। ১৯৫১-৫২ এবং ১৯৫৯-৬০ সালের মধ্যে পশ্চিম। পাকিস্তানের আঞ্চলিক আয়ের ক্ষেত্রে শিল্পের হিস্যা ৭% থেকে ১০%-এ উন্নীত হয়।১৭ একই সময়ে শিল্প খাতের মধ্যে বৃহৎ শিল্পের হিস্যা দাঁড়ায় ৪১% থেকে ৭২%। পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৫% থেকে ৪৩%। পাকিস্তানের উভয় অংশে শিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়ােগ এভাবেই ঘটেছিল। ১৯৪৯-৫০ এবং ১৯৫৭-৫৮ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পোৎপাদন ৩২ কোটি থেকে ৬৩ কোটি টাকায় বৃদ্ধি পায়, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে বৃদ্ধি পায় ৮৭ কোটি ১০ লাখ টাকা থেকে ১৮০ কোটি ৮০ লাখ টাকায়। এ থেকে বােঝা যায় যে। শিল্পের বিকাশ পাকিস্তানের উভয় অংশে ঘটলেও পঞ্চাশের দশকে পূর্ব ও পশ্চিম। পাকিস্তানের মধ্যকার ব্যবধান অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়ে যায়। | পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনীতির দ্রুততর উন্নতি ও কাঠামােগত বৈচিত্র্য সৃষ্টি ষাটের দশকেও অনুরূপ বৈষম্যকে স্থায়ী রাখার পরিবেশ তৈরি করে। এই একই সময়ের মধ্যে ১৯৬৯-৭০ নাগাদ পশ্চিম পাকিস্তানের জিডিপিতে শিল্পের হিস্যা ১৬%-এ বর্ধিত হয়, পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানে তা বৃদ্ধি পায় ৮.৯%।
হিস্যা ৪০.৫%-এ বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৫-৭০ সালের তৃতীয় পরিকল্পনাকালে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈদেশিক রপ্তানির পরিমাণ পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমাণকে অতিক্রম করে ৫০.২%-এ দাড়ায়। পূর্ব পাকিস্তান শুধু যে রপ্তানির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানকে স্থান ছেড়ে দিচ্ছিল তা-ই নয়, এর রপ্তানি-কাঠামাে গােটা পাকিস্তানি শাসনামলে অত্যধিক পরিমাণে পাটনির্ভর থেকে যায়। ১৯৫৬-৫৭ ও ১৯৫৮-৫৯-এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মােট আন্তর্জাতিক ও আন্ত-আঞ্চলিক রপ্তানি বাণিজ্যে পাট ও পাটজাত দ্রব্যাদির হিস্যা ছিল ৭৬.১ শতাংশ। ১৯৬৭-৬৮ থেকে ১৯৬৯-৭০ সালের মধ্যে পাটের ওপর পূর্ব পাকিস্তানের নির্ভরশীলতা সামান্য পরিমাণে হ্রাস পায় এবং মােট আঞ্চলিক রপ্তানির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের হিস্যা দাঁড়ায় ৬৯.৫ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে, গােড়ার দিকে বিদেশে পাকিস্তানের মােট রপ্তানির ক্ষেত্রে পাট ও পাটজাত দ্রব্যাদির হিস্যা ছিল ৯০.৫ শতাংশ। আরও সাম্প্রতিক কালে এটা ৯১.৪ শতাংশে দাড়ায়। পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি-কাঠামাের মধ্যে যে পরিবর্তন আনা হয় সেটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানমুখী। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানে কাঁচা তুলা, সুতা ও সুতিবস্ত্রের ওপর তার যে নির্ভরশীলতা ছিল সেটার অবসান ঘটে।২২ জীবনযাত্রা মানের বৈষম্য। পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনীতির অধিকতর দ্রুত উন্নতি ও বহুমুখীকরণ অনিবার্যভাবে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। ১ নম্বর সারণিতে মাথাপিছু আয়বৈষম্যের একটি মােটামুটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যাদিতে দেখা যায় যে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্যগুলাে পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে চূড়ান্ত ও আপেক্ষিকভাবে বেড়ে যায় ১৯৪৯-৫০ ও ১৯৬৯-৭০ সালের মধ্যে। ১৯৫০-এর দশকে বৈষম্যের বৃদ্ধি ঘটে ৫০ শতাংশ এবং ১৯৬০-এর দশকে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ১৯৫৯-৬০ সালে বৈষম্য ছিল ৩২.৫ শতাংশ, ১৯৬৯-৭০ সালে এটা দাড়ায় ৬১ শতাংশে। তর্ক তােলা হয়েছে যে এসব হিসাবে উচ্চ হারের ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে কম করে দেখানাে হয়েছে। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ যুক্তি দেখিয়েছেন যে মাথাপিছু আয়ের হিসাব তৈরি করার সময় পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের টাকার আপেক্ষিক কম ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি।২৩
পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান খাদ্য চাল ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান খাদ্য গমের মূল্যের তারতম্য লক্ষ করলেই এ বৈষম্য বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের ক্যালরিযুক্ত চালের দাম পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি পড়ে যায়। এ সত্য অনুভব করেন মাহবুবুল হক। ১৯৫৯-৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যখন এক টন চালের দাম ছিল ৫১৮ টাকা, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে তার দাম ছিল ৩৩৪ টাকা। ওই সময় এক টন গমের দাম ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ৫১৭ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে তার দাম ছিল ২৬৭ টাকা।২৪ এ সত্যের ভিত্তিতে মাহবুবুল হক আঞ্চলিক মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা নতুন করে তৈরি করেন। তার হিসাব। অনুযায়ী, ১৯৫৯-৬০ সালে আঞ্চলিক মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য পশ্চিম। পাকিস্তানের অনুকূলে ৬০ শতাংশে দাঁড়ায়। জনাব হক দেখিয়েছেন যে প্রচলিত পদ্ধতির হিসাবে এ বৈষম্যটা ৬০ শতাংশের স্থলে মাত্র ২৭ শতাংশ হয়। ১৯৬৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এক মণ চালের দাম ছিল ৪২ টাকা ৩৭ পয়সা আর পশ্চিম পাকিস্তানে এক মণ গমের দাম ছিল ২২ টাকা। তখন যদি জনাব হকের পদ্ধতিতে হিসাব করা হতাে তাহলে বৈষম্য পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে বৃদ্ধি পেয়ে ৬১ শতাংশে পৌঁছাত ।২৫ | মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে সৃষ্ট বৈষম্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হয় বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য, সেবা ও সুযােগ-সুবিধা ভােগের ব্যাপারে বিরাজমান বৈষম্য । ২ নম্বর সারণিতে আমরা ১৯৬৬-৬৭ সালের মধ্যে মূল ভােগ্যবস্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈষম্যের প্রবণতা তুলে ধরেছি। প্রাপ্ত প্রমাণাদিতে দেখা যায় যে কৃষিজাত দ্রব্যাদি ভােগের ক্ষেত্রে খাদ্যশস্যের ব্যাপারে বৈষম্য তেমন তাৎপর্যপূর্ণ নয়, যদিও অপরিশােধিত ও পরিশােধিত চিনির চাহিদা পশ্চিম পাকিস্তানে বেশি এবং কালক্রমে এই বৈষম্য বেড়ে চলে। অত্যন্ত স্কুল বৈষম্য সৃষ্টি হয় কারখানাজাত দ্রব্যাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। কাপড়, কাগজ, সিগারেট, দেশলাই ও বিদ্যুৎ শক্তির মাথাপিছু ব্যবহারের মাত্রা পশ্চিম পাকিস্তানে লক্ষণীয়ভাবে অনেক বেশি। এতে পশ্চিম পাকিস্তানে উচ্চতর হারে মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি তথা শিল্পায়নের দ্রুততর গতি প্রতিফলিত হয়। এই বৈষম্য বছর বছর বেড়ে চলে। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের গৃহস্থালির আয়-ব্যয়সংক্রান্ত জরিপ রিপাের্টে প্রাপ্ত মােটামুটি মাথাপিছু ভােগের প্রবণতাগুলাের দিকে তাকালে পশ্চিম পাকিস্তানে উচ্চতর হারে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও দ্রুততর গতিতে শিল্পায়নসংক্রান্ত বক্তব্যটি আরও সুদৃঢ় হয়। ২ নম্বর সারণিতে উল্লিখিত কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের জরিপে আমরা দেখি যে ভােগের ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি পায় ১৯৬০ ও ১৯৬৬৬৭ সালের মধ্যে। | পণ্যদ্রবাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সৃষ্ট বৈষম্যের অনুরূপ বৈষম্য দেখা দেয় জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানাদিতে সুযােগ লাভের ক্ষেত্রে।
৩ নম্বর সারণিতে দেখানাে হয়েছে যে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে হাসপাতাল, মাতৃসদন ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ, হাসপাতালের বেড়সংখ্যা ও ডিসপেনসারির সংখ্যা এবং ডাক্তার ও নার্সদের সংখ্যার দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে বৈষম্য বৃদ্ধি। পায়। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি এটা মেনে নিলেও দেখা যায় যে এ অঞ্চলের জনগণের জন্য চিকিৎসার সুযােগ-সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অত্যন্ত কম এবং এই বৈষম্য দূরীকরণের জন্য বছরের পর বছরব্যাপী প্রায় কিছুই করা হয়নি। | শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক স্তরে ভর্তির অনুপাত ঐতিহ্যগতভাবে বেশি ছিল, কিন্তু ৩ নম্বর সারণি ইঙ্গিত করে যে ১৯৪৭-৪৮ ও ১৯৬৬ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে শিক্ষার সর্বস্তরে ছাত্রসংখ্যার অনুপাত বেশ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৪৭-৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে মাইলের হিসাবে রাস্তা, রেলপথ, মােটরগাড়ি ও ব্যবহারাধীন রেডিওর সংখ্যা ছিল যথেষ্ট পরিমাণে বেশি। তবে পরবর্তী বছরগুলােতে এসব বৈষম্য আরও ব্যাপক হয়। ১৯৪৭-৪৮ ও ১৯৬৬-৬৭ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে মাইলের হিসাবে রাস্তা ১০ গুণ বৃদ্ধি পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানে রাস্তার দৈর্ঘ্য তখনাে ২০ হাজার মাইলের বেশি থেকে যায়। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের রাস্তায় ২ লাখের বেশি মােটরগাড়ি চলাচল করতে থাকে। এই বৈষম্য অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের নদীমাতৃক প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে। কিন্তু এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে পশ্চিম পাকিস্তানে মাইলের হিসাবে রাস্তা ও যানবাহন বৃদ্ধির তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের নদীপথের অনুরূপ সম্প্রসারণ ঘটেনি। স্থায়ীভাবে নাব্য নদীপথের মাইলের হিসাবে ১৯৫৯-৬০ সালে তা ছিল ২৬৬৮ এবং ১৯৬৯-৭০ সালে তা দাঁড়ায় ৩৩৫২ মাইল।২৬ বাঙালিদের বিশ্বাস জন্মে যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভালাে খায়, ভালাে পরে, উন্নততর স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও শিক্ষালাভ করে, উন্নততর যানবাহন, টেলিযােগাযােগব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাসহ অধিকতর উন্নত পরিবেশে বাস। করে। এই বিশ্বাস তাদের আপেক্ষিক বঞ্চনার ধারণাকে তীব্র করে এমনি করে।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যানগুলাে অধিকাংশ বাঙালির এ বিশ্বাসকেই শুধু বদ্ধমূল করে যে স্বাধীনতার সুযােগগুলাে পশ্চিম পাকিস্তানের লােকেরাই অনেক বেশি পরিমাণে ভােগ করে। বৈষম্য এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা অঞ্চলগুলাের উত্তরাধিকার পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক বিশ্বাস জন্মে যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যের মূলে ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট নীতি ও বরাদ্দমূলক সিদ্ধান্তসমূহ। এ অভিমত উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অর্থনৈতিক কাঠামাে, প্রাকৃতিক সম্পদ, ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষমতা ও বাজার শক্তিগুলাের অবদানকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের ওপর কিছু বেশি ক্ষমতা আরােপ করে। কাঠামােগত উত্তরাধিকার পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বিশেষভাবে অনুকূল ছিল না, যদিও রাস্তাঘাট, রেলপথ, সেচ, বিদ্যুৎ-ব্যবস্থাসহ তার ছিল একটা উন্নততর অবকাঠামাে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে বৃষ্টি হতাে অনেক বেশি পরিমাণে, এখানকার জমি ছিল অধিকতর উর্বর এবং এখানে ছিল নদীপথে মালামাল ও যাত্রী পরিবহনের একটি বেশ উন্নত ব্যবস্থা। পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষি-সম্ভাবনা পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে উৎকৃষ্টতর ছিল বলে বিশ্বাস করার কোনাে কারণই ছিল না, যদিও জনসংখ্যার দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান নিঃসন্দেহে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। তবে পূর্ব পাকিস্তানের ভূমির উৎপাদন ক্ষমতাও ছিল বেশি। শিল্প ক্ষমতার দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা পূর্ব পাকিস্তানেই মতােই শােচনীয় ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে আর কিছু না থাকলেও একটি অনেক উন্নত গ্রামীণ শিল্পাঞ্চল ছিল। তাঁতশিল্প এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের বস্ত্রের জোগান দিতে পারত। | শিক্ষা সম্পদের দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে নিকৃষ্ট ছিল না। শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের স্তর এখানে উদ্ধৃষ্টতর ছিল, যদিও পশ্চাৎপদতার মাত্রায় তেমন কোনাে ইতরবিশেষ ছিল না। | উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সামরিক বাহিনীগুলােয় অফিসার-কর্মচারী, উচ্চপদাধিকারী প্রশাসক, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সংখ্যা ও অবস্থানের দিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান সুস্পষ্টভাবে বেশি লাভবান হয়। পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল ছিল ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে লােক ভর্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে পাকিস্তান যে সশস্ত্র বাহিনীগুলাে পায়, সেগুলাে ছিল প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ে গঠিত । অনেক ক্যান্টনমেন্ট ও অর্ডিন্যান্স ডিপাের অবস্থানও ছিল সেখানে।
উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ব্যবসায়ী শ্রেণি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মানবিক সম্পদের মধ্যে ব্যবসায়ী-কারবারিরা ছিল অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। অবিভক্ত ভারতের ব্যবসাজাতে মুসলিম ব্যবসায়ীউদ্যোক্তাদের স্থান ছিল অতি নগণ্য। এই নগণ্য অবস্থার কারণেই করাচির হারুন, কলকাতার আদমজী-ইস্পাহানীদের মতাে ব্যবসায়ী পরিবার পাকিস্তান সংগ্রামে মুসলিম লীগকে সমর্থন করে। স্যার আদমজী, হাজী দাউদ, মির্জা আহমদ। ইস্পাহানী ও তাঁর ছােট ভাই হাসান ইস্পাহানী পর্যায়ক্রমে বাংলার মুসলিম লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। এসব ব্যবসায়ী ছিলেন পশ্চিম ভারতের ইসমাইলি, বােহরা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লােক। চিনিওটিরা এসেছিলেন পাঞ্জাব থেকে। ইরানি বংশােদ্ভূত ইস্পাহানীরা প্রধানত ব্যবসার কাজে নিয়ােজিত ছিলেন এবং বাংলার মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার কাছ থেকে কিছু পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা ছিলেন অধিকতর শক্তিশালী হিন্দু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রভাববলয়ের অধীন। হিন্দু ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রাধান্য ছিল শহরাঞ্চলের মাড়ােয়ারি, গুজরাটি ও পারসি গােত্রের লােকদের।
মুসলিম ব্যবসায়ীরা ভেবেছিলেন, পাকিস্তান হবে এমন একটি দেশ, যেখানে হিন্দুদের প্রতিযােগিতার হুমকি থাকবে না এবং যেখানে তারা বিনা প্রতিযােগিতায় পুঁজির প্রসার ঘটাতে পারবেন। পশ্চিম পাকিস্তানে রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে হিন্দু ও শিখরা দলে দলে দেশ ত্যাগ করলে ওই অঞ্চলে একটা বড় রকমের। ব্যবসা-বাণিজ্যিক শূন্যতা সৃষ্টি হয় । তখন ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প বলতে যা কিছু ছিল, তা হিন্দু ও শিখরা নিয়ন্ত্রণ করত । ওরা চলে যাওয়ায় ভারত থেকে আগত মুসলিম উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যবসায়ীরা এ শূন্যতা পূরণের আশা করেছিল । সুতরাং এসব পরিবারের অনেকেই যে দেশান্তরি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, এতে আশ্চর্যের কিছু ছিল না। করাচি ছিল পশ্চিম ভারতে তাদের পিতৃভূমির কাছাকাছি এবং সংস্কৃতিগতভাবেও পাকিস্তানের ওই অঞ্চলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠতর। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পূর্ব বাংলায়ও ঘটে। তবে এখানকার স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভুত্বকারী হিন্দু ও মাড়ােয়ারিরা এ অঞ্চল ত্যাগ করে চলে যাওয়ার কোনাে প্রবল তাগিদ অনুভব না করায় এখানে পশ্চিম পাকিস্তানের মতাে শূন্যতার সৃষ্টি হয়নি। এর ফলে ভারত থেকে উদ্বাস্তু ব্যবসায়ীরা এখানে আসতে উৎসাহ বােধ করেনি। কিন্তু কলকাতাভিত্তিক ব্যবসায়ী পরিবার ঢাকায় এসে আস্তানা গাড়ার চেষ্টা করে।
তবে তাদের মধ্যে একমাত্র ইস্পাহানীরা এবং চামড়ার কারবারে লব্ধপ্রতিষ্ঠ। চিনিওটি আমিন পরিবার ঢাকায় তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে। বাজার শক্তিগুলাের ভূমিকা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের হাতে যে অসামঞ্জস্য কর্তৃত্ব ন্যস্ত করা হয়, তা উন্নয়নপ্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে বাজার শক্তিগুলাের সীমাবদ্ধতাকে আবারও প্রকটিত করে তােলে। এ কথা বারবার বলা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের বাজারের আকার বড় হওয়ায় সেখানে অর্থনৈতিক বিকাশে গতি সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি যে ১৯৪৯৫০ সালের জিডিপির হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের জিডিপি ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কিছুটা বেশি (পূর্ব পাকিস্তানে ১২৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে ১২০৯ কোটি ১০ লাখ টাকা)।২৯ জিডিপির আকারই প্রাথমিকভাবে বাজারের আকার স্থির করে। বাজারের সঙ্গে যদি আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের করাচিতে অবস্থান, তার নিরাপত্তা ও বেসামরিক খাতে ব্যয়, চাকরি ইত্যাদিকে যুক্ত করি, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের বাজার সম্ভাবনা কিছু পরিমাণে বেশি দাড়ায় বৈকি। তবে পূর্ব পাকিস্তান রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস থেকে যায়। ১৯৪৮-৪৯ ও ১৯৫৪-৫৫ সালের মধ্যে অর্জিত সব বৈদেশিক মুদ্রার ৫১.৫% আসে পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি থেকে ।৩০ | এর বিপরীতে দেখা যায় যে পাকিস্তানে গােড়ার দিকের বছরগুলােয় অনিয়ন্ত্রিত আমদানির সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান সব আমদানির ৭০% গ্রাস করে। এতে দেখা যায় যে পশ্চিম পাকিস্তানের আমদানি ক্ষমতা বেশি। তবে আমদানির চাহিদা গড়ে ওঠে যতটা সমষ্টিগত চাহিদা থেকে, তার চেয়ে অনেক বেশি আয়ের বণ্টন থেকে। এভাবে মনে হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানে উচ্চতর আমদানি-চাহিদাসম্পন্ন অধিকতর সচ্ছল মানুষের একটা বৃহত্তর শ্রেণি রয়েছে। তার পরও পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা খাতে ক্রয়, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন গড়ে তােলার জন্য ব্যয় এবং কেন্দ্রের করাচিতে অবস্থান—এগুলাে আমদানিগ্রাসী। জনগণের চাহিদা, দাবি ও উন্নয়নের প্রয়ােজনকে অস্বীকার করে এভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রের অবস্থান ও আয়ের ভিত্তিতে আমদানি চাহিদা নির্ধারিত হতে দেওয়া ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণােদিত। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান অর্জনকারী পূর্ব পাকিস্তান হলেও তার প্রধান ব্যবহারকারী হতে দেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানকে।
তখন থেকে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে যে উদার আমদানির এ পর্যায় চলাকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পুঞ্জীভূত পাকিস্তানের স্টার্লিং-উদ্বৃত্তের হিস্যা এবং তার বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় হ্রাস পায়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপরও কিছুকাল ধরে ভয়ানক চাপ পড়ে এবং টাকার মূল্যমান বৃদ্ধি করতে হয়। | ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তানে বসতি স্থাপনকারী উদ্বাস্তু বণিকশ্রেণি আমদানিবাণিজ্যের ওপর একচেটিয়ে দখল কায়েম করে এবং এ বাণিজ্য থেকে বিপুল। মুনাফা অর্জন করে। এসব মুনাফাই পরে ১৯৫০-এর দশকে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পায়নে বীজ-পুঁজি জোগায়। শিল্পায়নের এই প্রক্রিয়াকে কঠোরভাবে আমদানিনিরােধ ও মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধির মাধ্যমে সংরক্ষণ দিয়ে জোরদার করে তােলা হয়।৩২ | এটা সুস্পষ্ট যে কিছুটা উন্নততর বাহ্যিক অবকাঠামাে, কেন্দ্রীয় সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীগুলাের সদর দপ্তরের অবস্থিতি, পশ্চিম পাকিস্তানে বসতি স্থাপনের ইচ্ছা নিয়ে আগত উদ্বাস্তু পেশাজীবী ও মুসলিম ব্যবসায়ীদের বৃহত্তর অংশের আকস্মিক উপস্থিতি ইত্যাদি ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তান উত্তরাধিকারসূত্রে কতিপয় | নিশ্চিত সুবিধা লাভ করে। ১৯৪৯-৫২ কালপর্বে আমদানি উদারীকরণের পর্যায়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের হাতে বিপুল পুঁজি সঞ্চিত হয়। ওই পর্যায়ে পাকিস্তান যদি অবাধ অর্থনীতি গ্রহণ করত, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান হয়তাে পূর্ব পাকিস্তান থেকে এগিয়ে যেত। ক্রমবর্ধিষ্ণু কার্যকরণ সম্বন্ধের নিয়ম এসব বৈষম্যকে স্পষ্টতর করে তুলল।৩৩ | কিন্তু পাকিস্তানের ইতিহাসের বাস্তবতা থেকে দেখা যায়, কোরীয় যুদ্ধের দরুন ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তার আকস্মিক অবসানের পর বাজার নয়, বরং রাষ্ট্রই পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে কোথায় কী পরিমাণে সম্পদ বরাদ্দ ও অর্থনৈতিক তৎপরতা চলবে, সেটাকে প্রভাবিত করার প্রধান নিয়ামক হয়ে ওঠে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ সরাসরি রাষ্ট্রীয় নীতির এখতিয়ারে ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা কেন্দ্র কর্তৃক বা প্রদেশ কর্তৃক বিতরিত হতাে, ওটা কোন অঞ্চলে ব্যয় করা হবে, কোন খাত অগ্রাধিকার পাবে এবং প্রায় ওই গােটা সময়টার বৈদেশিক মুদ্রা পেয়ে কোন কোন ব্যক্তি লাভবান হবেন—এসবই রাষ্ট্রীয় নীতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। এটা শিল্পায়নের স্থান ও গতিপ্রকৃতি, তাকে কাজে লাগানাের ক্ষমতা কোন অঞ্চলে কতটুকু রয়েছে এবং আমদানি ও পুঁজি সঞ্চয়জনিত চলতি ভােগের পরিমাণ কোন অঞ্চলে কতটা হবে, এসবকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে। পাকিস্তানের ইতিহাসের পুরাে সময়টায় টাকার অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণের দ্বারাই এসব করা সম্ভব হয়। টাকার মূল্যবৃদ্ধি পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি খাতকেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং আমদানিকারক কিংবা শিল্পপতি হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা হস্তগত করাকে উৎসাহিত করে। এমনি করে বৈদেশিক মুদ্রাপ্রাপ্তিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতায় ইচ্ছামতাে সম্পদ ও অনুগ্রহ বণ্টনের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়।
বৈদেশিক মুদ্রা প্রসঙ্গে পাকিস্তানের রপ্তানি আয় থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রাপ্রাপ্তির সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে বৈদেশিক সাহায্য যােগ হয়। ১৯৫০-৫১ সালের কোরীয় যুদ্ধকালীন রমরমা অবস্থার সময়টা বাদে ১৯৪৯-৫০ সাল থেকে পাকিস্তানের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ক্ষেত্রে স্থায়ী ঘাটতি চলতে থাকে। প্রাথমিকভাবে এই ঘাটতি পূরণ করা হয় জমা স্টালিং ব্যালেন্স ক্ষয় করে। ১৯৫৩-৫৪ সালের পর সরকারি উন্নয়ন সহায়তার খাতে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রবাহিত অর্থ পাকিস্তানের আমদানি ও উন্নয়নের জন্য বর্ধিষ্ণু হারে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯৪৮-৪৯ ও ১৯৬১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তান মঞ্জুরি ও ঋণ বাবদ আনুমানিক ৬ বিলিয়ন ডলার পায়। ১৯৪৭-৪৮ সালে পাকিস্তানের আমদানির ৪৪% আসে এ অর্থ থেকে ।৩৫ এতে বােঝা যায় যে বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্তি বৈদেশিক মুদ্রার ওপর দাবিকে জোরদার করে এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অঞ্চলগুলাের মধ্যে বৈদেশিক সাহায্য বন্টনের সিদ্ধান্তগুলােও প্রধানত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই থেকে যায়, যেহেতু বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়ােজন ছিল প্রচুর এবং প্রাপ্ত সাহায্যের চেয়ে অনেক বেশি। রাষ্ট্রের নিয়ামক ভূমিকা আঞ্চলিক উন্নয়নের হুঁচকে প্রভাবিত করার ব্যাপারে বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবধান অতি গুরুত্বপূর্ণ থেকে যাওয়ায় আঞ্চলিক উন্নয়নের ভারসাম্যকে প্রভাবিতকরণে ভােক্তা ও বিনিয়ােগকারী হিসেবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ছিল নিয়ামক।
গতিপ্রকৃতি, তাকে কাজে লাগানাের ক্ষমতা কোন অঞ্চলে কতটুকু রয়েছে এবং আমদানি ও পুঁজি সঞ্চয়জনিত চলতি ভােগের পরিমাণ কোন অঞ্চলে কতটা হবে, এসবকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে। পাকিস্তানের ইতিহাসের পুরাে সময়টায় টাকার অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণের দ্বারাই এসব করা সম্ভব হয়। টাকার মূল্যবৃদ্ধি | পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি খাতকেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং আমদানিকারক কিংবা শিল্পপতি হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা হস্তগত করাকে উৎসাহিত করে। এমনি করে বৈদেশিক মুদ্রাপ্রাপ্তিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতায় ইচ্ছামতাে সম্পদ ও অনুগ্রহ বণ্টনের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়।
বৈদেশিক মুদ্রা প্রসঙ্গে পাকিস্তানের রপ্তানি আয় থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রাপ্রাপ্তির সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে বৈদেশিক সাহায্য যােগ হয়। ১৯৫০-৫১ সালের কোরীয় যুদ্ধকালীন। রমরমা অবস্থার সময়টা বাদে ১৯৪৯-৫০ সাল থেকে পাকিস্তানের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ক্ষেত্রে স্থায়ী ঘাটতি চলতে থাকে। প্রাথমিকভাবে এই ঘাটতি পূরণ করা হয় জমা স্টালিং ব্যালেন্স ক্ষয় করে। ১৯৫৩-৫৪ সালের পর সরকারি উন্নয়ন সহায়তার খাতে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রবাহিত অর্থ পাকিস্তানের আমদানি ও উন্নয়নের জন্য বর্ধিষ্ণু হারে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯৪৮-৪৯ ও ১৯৬১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তান মঞ্জুরি ও ঋণ বাবদ আনুমানিক ৬ বিলিয়ন ডলার পায়।* ১৯৪৭-৪৮ সালে পাকিস্তানের আমদানির ৪৪% আসে এ অর্থ থেকে।৩৫ এতে বােঝা যায় যে বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্তি বৈদেশিক মুদ্রার ওপর দাবিকে জোরদার করে এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অঞ্চলগুলাের মধ্যে বৈদেশিক সাহায্য বন্টনের সিদ্ধান্তগুলােও প্রধানত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই থেকে যায়, যেহেতু বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়ােজন ছিল প্রচুর এবং প্রাপ্ত সাহায্যের চেয়ে অনেক বেশি। রাষ্ট্রের নিয়ামক ভূমিকা। আঞ্চলিক উন্নয়নের হুঁচকে প্রভাবিত করার ব্যাপারে বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবধান অতি গুরুত্বপূর্ণ থেকে যাওয়ায় আঞ্চলিক উন্নয়নের ভারসাম্যকে প্রভাবিতকরণে ভােক্তা ও বিনিয়ােগকারী হিসেবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ছিল নিয়ামক।
১৯৫০-৫১ ও ১৯৬৯-৭০ সালের মধ্যে পাকিস্তান সরকার রাজস্ব ও উন্নয়ন খাতে। ১১৩ বিলিয়ন টাকা খরচ করে।৩৬ আঞ্চলিক অর্থনীতিতে কার্যকর চাহিদা স্থির করার ব্যাপারে এটা রাষ্ট্রকে রীতিমতাে অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদান করে। এই ব্যয়ের স্থান নির্বাচনের ব্যাপারটি আঞ্চলিক পণ্যের বাজার ও জনকল্যাণ ব্যবস্থাগুলাের ওপর একটা তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এই ব্যয়ের যে অংশ উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট হয়, তার পরিমাণ ছিল ৫০ বিলিয়ন টাকা। এটা অবকাঠামাে, সরকারি খাতে শিল্প বিকাশ ও মানবিক সম্পদ উন্নয়নকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে অঞ্চলগুলাের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্ষমতার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। বেসরকারি খাতের বিকাশও কোনাে স্বাধীন স্বতন্ত্র কিছু ছিল না। বেসরকারি খাতের উন্নয়ন ছিল প্রত্যক্ষভাবে সরকারি ঋণ ও ভর্তুকি এবং অপ্রত্যক্ষভাবে অবকঠামাে ও দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য সরকারি অর্থ-বিনিয়োেগ দ্বারা, সরকারি ব্যয়ে সৃষ্ট বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে এবং সরকারি নীতির চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত। এগুলাে অর্থনৈতিক তৎপরতার উৎসাহদায়ক কাঠামােকে প্রভাবিত করে। আমরা নিচে বর্ণিত সরকারি হস্তক্ষেপের প্রতিটি ক্ষেত্রে, যথা সরকারি ও বেসরকারি ব্যয়, বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ, বৈদেশিক সাহায্য বরাদ্দ, সরকারি ব্যয়ের জন্য অর্থপ্রদান এবং সরকারি নীতির গতিপথ বা লক্ষ্য ইত্যাদিতে আঞ্চলিক পক্ষপাতের প্রতি দৃষ্টিপাত করব। সরকারি ব্যয় সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পক্ষপাতও আমরা দেখব ৪ নম্বর সারণিতে। এতে দেখা যাবে যে ১৯৫৯-৭০ কালপর্বে রাজস্ব থেকে পূর্ব পাকিস্তান সব ব্যয়ের মাত্র ২৩ শতাংশ পায়। সারণিতে প্রদত্ত পরবর্তী সময়ের মধ্যে এই প্রবণতার কোনাে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থিতি কোথায়, সেটা বিবেচনা করলে আঞ্চলিক ব্যয়ের এই নমুনা পুরােপুরি বিস্ময়কর ঠেকবে না। কেন্দ্রীয় সরকার প্রথমে অবস্থান করে করাচিতে এবং পরে ইসলামাবাদে। তিনটি সশস্ত্রবাহিনীর সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে হওয়ার অর্থ ছিল এই যে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় প্রধানত সেখানেই হতাে। সশস্ত্রবাহিনীগুলাের গঠনে দেখা গেছে যে সেনাবাহিনীতে জওয়ানদের মধ্যে ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানিদের সংখ্যা শতকরা মাত্র ৭.৪ জন, বিমানবাহিনীতে ২৮ জন এবং নৌবাহিনীতে ২৮৮ জন।৭ অফিসারদের অনুপাত ছিল আরও নিম্ন। আমলাতন্ত্রের মধ্যে ১৯৬৬ সাল। অবধি প্রথম শ্রেণির কেন্দ্রীয় অফিসারদের শতকরা মাত্র ৩০ জন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি।৩৮ কেন্দ্রীয় সরকারের নিম্নতর পদের চাকরিতে পূর্ব পাকিস্তানিদের সংখ্যা ছিল আরও কম। এসব কর্মচারী ছিল প্রধানত করাচিবাসী।
কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত কর্মচারীদের জন্য ব্যয়, স্টোরগুলাের জন্য কেনাকাটার ব্যয়, আবাসিক ভবনাদি ও দপ্তরগুলাের বেসরকারি বিনির্মাণের ব্যয়, বৈদ্যুতিক শক্তি, টেলিযােগাযােগ ও রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য ব্যয় প্রধানত করা হতাে পশ্চিম পাকিস্তানে। অনুরূপ কেন্দ্রীয় ব্যয় দ্বারাই গড়ে ওঠে করাচি, রাওয়ালপিন্ডি এবং পরে ইসলামাবাদে একটি সম্পূর্ণ নতুন জাতীয় রাজধানী। এসব ব্যয়ের দরুন সৃষ্ট নিয়ােগেরও বেশির ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে চলে যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের উপরিউক্ত ব্যয়গুলাে পশ্চিম পাকিস্তানে পণ্যদ্রব্যাদির ও জনসেবামূলক ব্যবস্থার চাহিদা বৃদ্ধি করে বেসরকারি অর্থনৈতিক তৎপরতাকে জোরদার করে তােলে। বাঙালিরা রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান এই গুরুতর অসমতাকে পাকিস্তানের দুই অংশের অসমতা স্থায়ীকরণের নিয়ামক কারণ রূপে দেখে। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে প্যারিটি’ বা সমতার দাবি, নৌবাহিনীর সদর দপ্তর চট্টগ্রামে এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানাদির অংশবিশেষ পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরের দাবি কেবল ক্ষমতা, চাকরি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ-ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার আকাক্ষা থেকেই ওঠেনি, ওই দাবিগুলাে উঠেছিল কেন্দ্রীয় সরকারের সম্ভাব্য ব্যয়ের সুফল লাভের প্রত্যাশায়। প্রশাসন ও সশস্ত্রবাহিনীর চাকরির জন্য বাঙালিদের যােগ্যতা কম—এই অভিমত বাঙালিরা কখনাে মেনে নেয়নি। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) মতাে উচ্চতর পদের প্রথম শ্রেণির চাকরিতে নিয়ােগের ক্ষেত্রে কোটা প্রবর্তন আদিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান করাচিতে হওয়ার দরুন সৃষ্ট অসমতা ও বিভাগকালে ভারত সরকারের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অসমতাকে কখনাে দূর করতে পারেনি। সশস্ত্রবাহিনীতে বাঙালিদের নিযুক্তিবৃদ্ধির ব্যাপারে দৈহিক সামর্থ্যসংক্রান্ত প্রশ্ন তােলা হয়। অথচ স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশে সশস্ত্রবাহিনীগুলাের বিকাশ প্রমাণ করে যে সশস্ত্রবাহিনীর চাকরিতে নিয়ােগলাভের জন্য উপযুক্ত বাঙালির কোনাে অভাব ছিল না এবং নিয়মিত উপযুক্ত ও পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ এবং শরীরচর্চা যেকোনাে জাতিসত্তার দৈহিক স্বাস্থ্য ও যােগ্যতা বহুল পরিমাণে বাড়িয়ে দিতে পারে। পাকিস্তান সরকার যদি শুরু থেকে সচেতনভাবে বেসরকারি ও সশস্ত্রবাহিনীর চাকরিতে সমতা আনার চেষ্টা করত, তাহলে হয়তাে দশ বছরের মধ্যে সে লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব হতাে। সে ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গীকারের বিশ্বাসযােগ্যতা সম্পর্কে বাঙালিদের ধারণা অনেকাংশে পরিবর্তিত হতাে।
উন্নয়ন ব্যয়
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতের মূল কারণ থেকে যায় সরকারি উন্নয়ন ব্যয় বণ্টনে পক্ষপাত। পাকিস্তানে শুরু থেকেই জাতীয় সংসদে এই মর্মে প্রশ্ন উঠতে থাকে যে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান তার প্রাপ্য হিস্যার চেয়ে কম পাচ্ছে। ১৯৫০-৫৫ সালের প্রাক-পরিকল্পনা আমলে সরকারি উন্নয়ন ব্যয়ের মাত্র ৭০ কোটি টাকা জোটে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তান পায় ২০০ কোটি টাকা।৩৯ বণ্টন বরাদ্দে এ ধরনের পাক্ষপাতিত্বের কী যুক্তি থাকতে পারে, তা কখনাে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। সরকারি ব্যয় বরাদ্দের পশ্চাতে কোনাে কৌশলগত চিন্তা ছিল না—এ কথা বলে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে পূর্ব পাকিস্তানকে সরকারি ব্যয়ের শতকরা মাত্র ৩৬ ভাগ প্রদানকে আর কোনােক্রমেই যুক্তিগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। আদায়কৃত ব্যয়ের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা দাঁড়ায় আরও করুণ। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে সরকারি ব্যয়ের মাত্র ৩০ শতাংশ পায় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৫৬ সালে বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা পূর্ব পাকিস্তানকে অবহেলা করার জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সমালােচনা করেন। তারা শুধু সরকারি সম্পদের অধিকতর পক্ষপাতশূন্য বণ্টনই নয়, পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বতন্ত্র উৎপাদনকারী ও ডােক্তা ইউনিটরূপে গণ্য করারও দাবি তোেলন। তারা পাকিস্তানকে একটি অখণ্ড পরিকল্পনা সত্তা হিসেবে না দেখে দুটো অর্থনীতি হিসেবে গণ্য করার এবং দুই অর্থনীতির জন্য দুটি পরিকল্পনা প্রণয়নের কথা বলেন। ৪০
পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকেরা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অর্থবরাদ্দের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখাতেন যে প্রদেশটির পরিশােষণক্ষমতা কম। তারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারকে পরিকল্পনার অধীনে বরাদ্দকৃত অর্থ অব্যবহৃত থেকে যাওয়ার বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতেন। বাঙালি অর্থনীতিবিদ ও প্রশাসকেরা যুক্তি দেখাতেন যে পরিশােষণক্ষমতা তহবিল প্রদান এবং কেন্দ্র থেকে প্রাদেশিক সরকারের কাছে কর্তৃত্ব হস্তান্তর—এই উভয়ের ওপর নির্ভর করে। পূর্ব পাকিস্তানে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, টেলিযােগাযােগ ইত্যাদি অবকাঠামাের আপেক্ষিক দুর্বলতা এমনিতেই পরিশােষণে বাধা সৃষ্টি করে। ১৯৫১-৫২ সালে কিলােওয়াটপ্রতি বিদ্যুতের মাথাপিছু ব্যবহার পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৮.৬ এবং পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ০.৫। ১৯৫০-৬০-এর দশকে বিদ্যুৎশক্তি খাতে পশ্চিম পাকিস্তানে বিপুল অর্থনিয়ােগের ফলে ১৯৫৯-৬০ সাল নাগাদ সেখানে বিদ্যুতের ব্যবহার ২৮৮ কিলােওয়াটে উন্নীত হয়। সে তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুতের মাথাপিছু ব্যবহারের পরিমাণ অতি সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে মাত্র ১.৬ কিলােওয়াটে পৌছায়। ১৯৪৭-৪৮ ও ১৯৫৭-৫৮ সালের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে মাইলের হিসাবে রাস্তা বৃদ্ধি পায় ৫৬০৩ মাইল, অথচ পূর্ব পাকিস্তানে রাস্তা বৃদ্ধি পায় মাত্র ৪৬০ মাইল।৪২ পূর্ব পাকিস্তানের তহবিল ব্যবহারের বিলম্বের কারণ ছিল ঝামেলাপূর্ণ অনুমােদন প্রক্রিয়া। চার-চারটি পৃথক সংস্থা দ্বারা এখানে যেকোনাে বড় প্রজেক্ট অনুমােদন করিয়ে নিতে হতাে। সংস্থাগুলাে হচ্ছে প্রাদেশিক উন্নয়ন ওয়ার্কিং পাটি, প্রাদেশিক প্ল্যানিং কর্তৃপক্ষ, কেন্দ্রীয় উন্নয়ন ওয়ার্কিং পার্টি ও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের পরিচালনা কমিটি (একনেক)। এ রকম পরিস্থিতিতে কেন্দ্র যত দ্রুততার সঙ্গে স্কিমগুলাে অনুমােদন করত ও পরে তহবিল ছাড়ত, সেটা সম্পদের ব্যবহারকে ততটা প্রভাবিত করত। তবে এমনকি তহবিল ছাড়ার পরও বৈদেশিক মুদ্রাপ্রাপ্তিতে বাধাবিঘ্ন, ইস্পাত ও সিমেন্ট ইত্যাদি উপকরণ (পূর্ব পাকিস্তানে যেগুলাের ঘাটতি ছিল) সংগ্রহে বিঘ্ন, বিদ্যুৎ সরবরাহের স্বল্পতা, যানবাহন ও যােগাযােগের অপর্যাপ্ততা প্রজেক্টগুলােকে বিলম্বিত করে দিতে পারত। পরিকল্পনায় বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন হারের ক্ষেত্রে যে। অঙ্ক নির্ধারিত হয়েছে, তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।
বৈষম্য প্রশ্নে বিতর্ক
১৯৬০-৬৫ সালে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নকালে আঞ্চলিক বরাদ্দ ও তার সদ্ব্যবহারসংক্রান্ত প্রশ্নাদি কিছুটা গভীরভাবে আলােচিত হয়। দ্বিতীয় পরিকল্পনার ওপর আলােচনার প্রস্তুতি উপলক্ষে পূর্ব পাকিস্তান পরিকল্পনা বাের্ড তৎকালে করাচিতে অবস্থিত পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্টে কর্মরত আখলাকুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৎকালীন রিডার মােশাররফ হােসেইন এবং তক্কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে কর্মরত বর্তমান প্রবন্ধকারকে দ্বিতীয় পরিকল্পনাকালে সম্পদ বরাদ্দসংক্রান্ত প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থান স্থিরীকরণে বাের্ডকে সাহায্য করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ওয়ার্কিং গ্রুপের আলােচনায় অর্থনীতিবিদেরা পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে একত্রে কাজ। করেন। তারা আঞ্চলিক পরিকল্পনায় সম্পদের বণ্টনকে জনসংখ্যার আকারের সঙ্গে সম্পর্কিত করার গুরুত্বের কথা এবং ১৯৫০-এর দশকে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে অসমতা ঘটেছে, তা সংশােধনের কথা বলেন। এসব আলােচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তবায়ন ক্ষমতার উন্নয়ন, পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন করপােরেশনের (পিআইডিসি) দ্বিধাবিভক্তি এবং কয়েকটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরের ওপর জোর দেওয়া হয়। পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশন মােটেই এসব যুক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। তখন দেশে সামরিক আইন চালু থাকায় বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা বিভিন্ন সেমিনার ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে যেসব প্রশ্নে সামান্য বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সেসব প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে উত্থাপন করার উপায় ছিল না। | দ্বিতীয় পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেল, পরিকল্পনা-ব্যয়ের শতকরা ৪১ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তুলনায় এটা অনেক বেশি। প্রথম পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানে আদায়কৃত বিনিয়ােগ ছিল শতকরা মাত্র ২০ ভাগ। দ্বিতীয় পরিকল্পনা কার্যত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে একটা আঞ্চলিক অসমতার ব্যাপার রয়েছে, সেটাকে বিষদভাবে স্বীকার করেনি। এই পরিকল্পনা পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়ােগ বৃদ্ধির প্রয়ােজনীয়তার ওপর জোর দেয়, তবে যুক্তি দেখায় যে ঐতিহাসিকভাবে
কোনাে দেশেই সব অঞ্চলে একই সঙ্গে এবং সমহারে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেনি।৪৫। সুতরাং এটা বিস্ময়কর নয় যে আঞ্চলিক প্রশ্ন আবারও পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের তীব্র বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ১৯৬০ সালের গ্রীষ্মে দ্বিতীয় পরিকল্পনার প্রকাশনা উপলক্ষে রাওয়ালপিন্ডিতে আয়ােজিত এক বর্ধিত সেমিনারে পরিকল্পনাটির প্রথম সমালােচনা উচ্চারিত হয়। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যােগদানকারী নূরুল ইসলাম ও এই প্রবন্ধকার, পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়ন ব্যাংকের তদানীন্তন ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম রশিদসহ কয়েকজন বাঙালি সিএসপি অফিসার আঞ্চলিকতার প্রশ্নে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান প্রধান ব্যক্তির। সঙ্গে বিতর্কে প্রবৃত্ত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। সাইদ হাসান, প্রধান অর্থনীতিবিদ এম এল কোরেশি, কমিশনের যুগ্ম প্রধান অর্থনীতিবিদ আফতাব আহমদ খান, উপপ্রধান অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল হক এবং পাকিস্তানের নীতিনির্ধারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ বেসামরিক আমলারা ।
দ্বিতীয় পরিকল্পনার অর্থনীতিবিদদের প্যানেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এন। হুদা ও মাযহারুল হক অংশগ্রহণ করেন। প্যানেল আঞ্চলিক প্রশ্নকে খাটো করে। দেখে এবং মেনে নেয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির গতিশীলতার দরুন ওই অঞ্চলে অধিকতর বিনিয়ােগ হওয়া উচিত। তবে তারা যুক্তি দেন যে দ্রুত বিকাশশীল অঞ্চল থেকে এবং বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তর করা দরকার, যাতে সেখানে উন্নয়ন দ্রুততর হয়। একটা সুপারিশে বলা হয়। যে পূর্ব পাকিস্তানে উন্নততর আঞ্চলিক ভারসাম্যের তাগিদে পশ্চিম পাকিস্তানে কিছু লাভজনক বিনিয়ােগ বাদ দেওয়া উচিত, তবে যে সীমার মধ্যে সেই নীতি কাজ করবে, তা সুস্পষ্টভাবে বেঁধে দিতে হবে, যাতে অর্থনীতির সার্বিক বিকাশের হারে কোনাে গুরুত্ব হ্রাস পেতে দেখা না যায়। পশ্চিম পাকিস্তান পুঁজির উৎপাদনক্ষমতা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের পরিমাণ এবং বিনিয়ােগ হার পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে বেশি—এমন অযাচাইকৃত ও ভ্রান্ত ধারণা থেকে এ কথা বলা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৫৯-৬০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের শতকরা ৫ ভাগের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে সঞ্চয়ের হার ছিল শতকরা ৮ ভাগ। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে মােট বিনিয়ােগ হার ছিল ৭% আর পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩%।৪৭
পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পরিশােষণক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে প্যানেল প্রস্তাব করে যে কেন্দ্র ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রকৌশলী ও প্রশাসনিক কর্মচারী মােতায়েনের মাধ্যমে কেন্দ্রের উচিত পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করা। | দ্বিতীয় পরিকল্পনার দলিল এবং অর্থনীতিবিদদের প্যানেলের মধ্যে এ রকম দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে যে পাকিস্তানের অর্থনীতি অখণ্ড এবং সেখানে আঞ্চলিক অসমতা দূরীকরণের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে গেলে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ বিঘ্নিত হতে পারে। এই দুশ্চিন্তা তৃতীয় ও চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে আলােচনা চলাকালেও কেন্দ্রীয় পরিকল্পক ও পশ্চিম পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদদের মন ঘিরে থাকে। বলা বাহুল্য, পরবর্তী তথ্য-প্রমাণে দেখা গেছে যে বিনিয়ােগদক্ষতার ক্ষেত্রে যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে শ্রেষ্ঠতা ছিল না, তেমনি পূর্ব পাকিস্তানে সম্পদ স্থানান্তরের জন্য উচ্চতর সঞ্চয়ও তার ছিল না, বরং প্রাক-পরিকল্পনা ব্যয় হিসেবে সিন্ধু অববাহিকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিনিয়ােগ এবং জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা হ্রাসকল্পে বিনিয়ােগকে হিসাবের মধ্যে ধরলে প্রমাণিত হবে যে ভেলকিবাজি করে পরিকল্পনার মধ্যে অধিকতর আঞ্চলিক ভারসাম্য নিশ্চিত করার কথা বলে দ্বিতীয় পরিকল্পনাকালে ব্যয় ও আয়ের বৈষম্যকে স্থায়ী করে রাখা হয়।
দুই অর্থনীতি ধীকল্প প্ল্যানিং ও সম্পদ বন্টনের ভিত্তি হিসেবে একটি অখণ্ড জাতীয় অর্থনীতির ধীকল্প (Ideal) দ্বিতীয় পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই কবরস্থ হয়। ১৯৬১ সাল নাগাদ বিতর্কটি সেমিনার কক্ষ ও সরকারি চেম্বারগুলাে থেকে রাজপথে ও প্রচারমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আইয়ুবের মার্শাল ল সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে গণতান্ত্রিক সমাবেশ জোরদার হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক বৈষম্য ও সম্পদ বরাদ্দের বৈষম্য বাঙালিদের দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় পরিকল্পনাকে দেখা হয় শার্শাল ল পরিকল্পনা হিসেবে, যা পূর্ববর্তী দশকে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনাকে সংশােধনের পরিবর্তে সেই একই অবিচার স্থায়ী করার জন্য সরকারি নীতি ও সম্পদকে ব্যবহারের চেষ্টা করে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্যের অবসান ও প্রদেশগুলাের হাতে ক্ষমতা প্রত্যর্পণের ওপর জনগণের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। কিছু কিছু বাঙালি অর্থনীতিবিদ এ সময় বাঙালিদের মধ্যে জাতীয় অধিকার ও দাবিদাওয়াভিত্তিক যে আন্দোলন গড়ে উঠছিল, তার মুখ্য প্রচারক হয়ে পড়েন। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত সেমিনারগুলােতে পাকিস্তানের অখণ্ড জাতীয় উন্নয়নসংক্রান্ত প্রচলিত কল্পকাহিনিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। এসব অর্থনীতিবিদের কারও কারও দ্বারা উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত ছাত্র আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান জঙ্গিপনা আঞ্চলিক বৈষম্যের প্রশ্নকে রাজনৈতিক শক্তি প্রদান করে। তা না হলে প্রশ্নটি সেমিনার কক্ষগুলােতে পণ্ডিতি বিতর্কের মধ্যে আবদ্ধ থেকে যেত। ১৯৬১ সালে ঢাকা সফরকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বাঙালি অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে এক আলােচনা বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকে স্থানীয় অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যারা ছিলেন অধিকতর মুখর, তাঁদের জোরালাে যুক্তি প্রেসিডেন্টকে বিচ্ছিন্ন ও নিরুত্তর করে দেয় এবং প্রবীণতম অর্থনীতিবিদেরা অধিকতর সহনীয় ভাষায় তাদের মতামত ব্যাখ্যা করেন। পরে এক জনসভায় প্রেসিডেন্ট প্রথমবারের মতাে আঞ্চলিক অসমতার সমস্যাটিকে স্বীকৃতি দেন এবং আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সরকারি সম্পদ বরাদ্দ সম্পর্কে আলােচনা ও সুপারিশ প্রদানের জন্য একটি জাতীয় অর্থ কমিশন গঠন করেন। ফিন্যান্স কমিশন। প্রথম ফিন্যান্স কমিশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় করাচিতে ১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে। এই প্রথম পাকিস্তানে উন্নয়নের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্যের প্রশ্নে আলােচনার জন্য একটি সরকারি কমিটির প্রথম বৈঠক বসে। কমিশনের পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব ডি কে পাওয়ার, এম রশীদ, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থসচিব আবুল খায়ের এবং নূরুল ইসলাম। এই প্রবন্ধকার কমিশনকে সহায়তা করেন। তিনি জনাব নুরুল ইসলামের সঙ্গে একত্রে কাজ করে একটা রিপাের্ট তৈরি করেন, যা পরে কমিশনের পৃথক রিপাের্ট হয়ে দাঁড়ায়। তিনটি রিপোের্ট পেশ করা হয়—একটি পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যদের তরফ থেকে, একটি পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের পক্ষ থেকে এবং একটি কমিশনের চেয়ারম্যান কর্তৃক।
পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের রিপাের্টে মাথাপিছু আয়বৈষম্যের শতকরা হিসাবের দিকে দৃষ্টি রেখে জনসংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সম্পদগুলাে বরাদ্দের জন্য একটি সুসন্বয়কারী ফর্মুলার কথা বলা হয়। বলা হয় যে বৈষম্য দূরীকৃত হওয়ামাত্রই জনসংখ্যার অনুপাতসংক্রান্ত ফর্মুলাটি প্রদত্ত হবে। সে সময় পাকিস্তানে সংবিধান প্রণীত হচ্ছিল। পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যরা এই ফর্মুলাটি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেন। তবে কমিশনের পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যরা বৈষম্য বিলােপে সরাসরি ব্যবহার। করা উচিত, এমন সব রাজস্ব সম্পদকে কাজে লাগানাের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর আস্থা স্থাপন করেন। এটা ছিল রাজস্বের স্থানীয় সংগ্রহের ভিত্তিতে রাজস্ব খাতে প্রাপ্ত আয় আরও বেশি পরিমাণে প্রদেশগুলাের হাতে রেখে দেওয়ার যে দাবি কমিশনের পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা তুলেছিলেন, সেটার প্রতি চ্যালেঞ্জ। চাকরি-সুবিধা, আয় বৃদ্ধি এবং এর উপায় সৃষ্টি, বাজারের বিকাশ ও নগরায়ণের ওপর স্থানীয় প্রভাবের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নবহির্ভূত বরাদ্দ আরও বেশি হওয়ার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়। তারা পরিশােষণ ক্ষমতাকে বিঘ্ন হিসেবে না দেখে উন্নয়নের একটা উপায় হিসেবে দেখেন এবং প্রজেক্টগুলাের। বাধাবিপত্তি উত্তরণে বৈদেশিক কারিগরি সাহায্য ব্যবহারের কথা বলেন। | আঞ্চলিক প্রশ্নে জনগণের উদ্বেগ যখন চরমে পৌছে যাচ্ছে, তখন ফিন্যান্স কমিশনের মধ্যে এই বিতর্ক চলতে থাকায় আইয়ুব সরকার ১৯৬২ সালের সংবিধানে আঞ্চলিক মাথাপিছু আয়বৈষম্য হ্রাসের স্পষ্ট উদ্দেশ্যে সরকারি সম্পদ বণ্টনের অঙ্গীকারটি অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হয়। ১৯৬০-এর মধ্যভাগে দ্বিতীয় পরিকল্পনা প্রকাশনা এবং ১৯৬২ সালের প্রথম দিকে সংবিধানের প্রকাশনাকালের মধ্যে এটা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে একটি নাটকীয় মত পরিবর্তন। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর বৈষম্য হ্রাসের সাংবিধানিক লক্ষ্য পূরণে অগ্রগতি পর্যালােচনাকল্পে দ্বিতীয় অর্থ কমিশন নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু বৈষম্য সম্পর্কে নির্ভরযােগ্য উপাত্তের অভাবে কমিশনের কাজ ব্যাহত হয় এবং তৃতীয় পরিকল্পনা বৈষম্য দূরীকরণ কতটা সফল হবে, তা অনুমান করতে কমিশন অক্ষম হয়।
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ১৯৬৫ সালে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হয় এমন একটা সময়ে, যখন আঞ্চলিক বরাদ্দের প্রশ্নে জনগণের বিতর্ক সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও আঞ্চলিক অর্থবরাদ্দের প্রশ্নকে পরিকল্পনাবিষয়ক বিতর্কের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে এসেছে। ফলে তৃতীয় পরিকল্পনায় পরিকল্পিত বিনিয়ােগের ৫১ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানকে দেওয়ার কথা বলা হয়। সরকারি ব্যয়ের ৫৩ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে হবে বলে নির্দিষ্ট হয় এবং বেসরকারি বিনিয়ােগে সমতা বজায় রাখার কথা বলা হয়। তবে দ্বিতীয় পরিকল্পনায় সিন্ধু অববাহিকা উন্নয়নে পরিকল্পনা-বহির্ভূতভাবে ব্যয়িত ৩৬০ কোটি টাকা ছিল বণ্টনের পাল্লাকে পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কার্যত, তৃতীয় পরিকল্পনাকালীন সরকারি বিনিয়ােগের শতকরা ৫৫
ভাগ ব্যয়িত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এতে পরিকল্পনাকে বৈষম্য হ্রাসকল্পে কাজে লাগানাের সাংবিধানিক অঙ্গীকার অপূর্ণ থেকে যায়। পরিকল্পনাকালের মধ্যে বৈষম্য ১৯৬৪-৬৫ সালের শতকরা ৪৫.৪ থেকে ১৯৬৯-৭০ সালে ৬১.৫ শতাংশে বর্ধিত হয়। | তৃতীয় পরিকল্পনার অর্থনীতিবিদ প্যানেলে মােশাররফ হােসেন এবং এই প্রবন্ধকার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্যানেলের আলােচনায় আঞ্চলিক বৈষম্য, সরকারি খাতের ভূমিকা ও ভূমি সংস্কার বিষয়ে বিতর্ক এমন তীব্র হয়ে ওঠে যে প্যানেলের চেয়ারম্যান কমিশনের মুখ্য অর্থনীতিবিদ এম এল কোরেশি দুই বা তিনটি বৈঠকের পরই প্যানেলের আলােচনা হঠাৎ এবং অসময়ে বন্ধ করে দেন। আঞ্চলিক বৈষম্য প্রশ্নে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে পার্লামেন্টের এমন কোনাে অধিবেশনই চলেনি, যেখানে বৈষম্য বিষয়টি প্রধান আলােচ্য বিষয় ছিল না। ১৯৬২ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতারা বাঙালি অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে যােগ দিয়ে বৈষম্যকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করেন। ১৯৬৬ সালের গ্রীষ্মে লাহােরে অনুষ্ঠিত বিরােধী। রাজনৈতিক নেতাদের গােলটেবিল বৈঠকে (আরটিসি) আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে উত্থাপিত ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি মূলত আঞ্চলিক অসমতাকে ভিত্তি করেই রচিত হয়। এতে পাকিস্তানে দুই অর্থনীতিযুক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তােলার আহ্বান জানানাে হয়। ছয় দফার তিনটি দফা অর্থ, রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি নির্ধারণের ক্ষমতা অঞ্চলগুলাের হাতে অর্পণসংক্রান্ত উদ্বেগ প্রকাশ করে। তবে ছয় দফা প্রণয়নের সঙ্গে কোনাে অর্থনীতিবিদই জড়িত ছিলেন না, যদিও বাঙালি অর্থনীতিবিদদের রচনাগুলাে ওই কর্মসূচিকে সুস্পষ্টভাবে প্রভাবিত করে। কোনাে কোনাে অর্থনীতিবিদ প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বসে অর্থনৈতিক সমস্যাদি আলােচনা করেন। আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসে তৃতীয় পরিকল্পনার ব্যর্থতা আঞ্চলিক বৈষম্যের প্রশ্নকে। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠার কেন্দ্রবিন্দু করে তােলে। আন্দোলনের লক্ষ্য বৈষম্য দূরীকরণের দিক থেকে স্বায়ত্তশাসনের দিকে সরে যায়।
১৯৬৯ সালের গােড়ার দিকে আইয়ুব সরকার যে রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়, তা নিরসন ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধন সম্পর্কে আলােচনার উদ্দেশ্যে আইয়ুব খান ইসলামাবাদে এক গােলটেবিল বৈঠক ডাকেন। কারাগার থেকে সদ্যমুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান গােলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য পেশকালে তাকে মুখ্য অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হকের সভাপতিত্বের অধীনে এ কারণে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান যে যাদের তৈরি বণ্টননীতির দরুন আঞ্চলিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। প্যানেলগুলাের ইতিহাসে সেই প্রথমবার পরিকল্পনা কমিশনের মুখ্য অর্থনীতিবিদ সভাপতির আসনে বসতে পারেননি। পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক সমিতির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাযহারুল হককে প্যানেলে সভাপতিত্ব করার জন্য আমন্ত্রণ জানানাে হয় । প্যানেলের আলােচনার শুরুতেই পূর্ব পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদগণ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক প্রশাসন কর্তৃক চতুর্থ পরিকল্পনা প্রণয়নের সৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তােলেন। তাদের মতে, কাজটি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের শেষে যে সরকার গঠিত হবে, সেই সরকারের। তবে তাঁরা প্যানেলের কাজে অংশ নেন এই প্রত্যাশায় যে আঞ্চলিক বৈষম্য সম্পর্কে এবং সেগুলাে দ্রুত দূরীকরণের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থাদি সম্পর্কে তারা বড় রকমের বক্তৃতা করতে পারবেন। | আঞ্চলিক প্রশ্নে সৃষ্ট পার্থক্য এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে এমনকি ১৯৭০ সালে পাকিস্তান যখন আঞ্চলিক প্রশ্নের চাপে দ্রুত ভেঙে পড়ছিল, তখনাে প্যানেলের পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা ঐতিহাসিক অসমতাগুলাে দূর করার অঙ্গীকার প্রদানে তাদের পূর্ব পাকিস্তানি সহকর্মীদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারেননি। উভয় গ্রুপই জানতেন যে চতুর্থ পরিকল্পনা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে এবং তাদের কাজ রাজনীতি-প্রভাবিত অকার্যকর কসরতমাত্র। তবু তারা দুটি পৃথক রিপাের্ট পেশ করেন। | বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা দুটি বিকল্প মডেল উপস্থিত করেন। একটিতে অপেক্ষাকৃত ছােট আকারের পরিকল্পনার কথা বলা হয়, যার ৭৫ বিলিয়ন টাকার ৪০.৫ বিলিয়ন (৫৪%) পাবে পূর্ব পাকিস্তান এবং ৩৪.৫ বিলিয়ন (৪৬%) পাবে পশ্চিম পাকিস্তান।
দ্বিতীয় মডেলটি ছিল অপেক্ষাকৃত বড় আকারের পরিকল্পনার। এতে পশ্চিম পাকিস্তানের ঐতিহাসিক প্রবৃদ্ধির হার বজায় রাখার জন্য পূর্বেকার অনুপাত অক্ষুন্ন রেখে ৪৩.২ বিলিয়ন টাকা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এবং ৩৬.৮ বিলিয়ন টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয়। | প্যানেলের পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের রিপাের্টে পূর্ব পাকিস্তানকে দেওয়া হয় ৩৬.৩৫ বিলিয়ন (৪৮%) টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানকে দেওয়া হয় ৩৮ বিলিয়ন টাকা। পরিকল্পিত ব্যয়ের পর্যায়গুলাে অবশ্য এমনভাবে স্থির করা হয়, যাতে চতুর্থ পরিকল্পনার শেষ দিকে (১৯৭০-৭৫) পরিকল্পনা ব্যয়ের ৫৪% হিস্যা পূর্ব পাকিস্তান পায়। আঞ্চলিক পুঁজির উৎপাদন অনুপাতে পেমেন্ট অ্যাকাউন্টের আঞ্চলিক ব্যালেন্স, সম্পদের চলন্ত আঞ্চলিক স্থানান্তর ইত্যাদি সূক্ষ্ম বিষয়
প্যানেলের সদস্যদের মনােযােগ আকৃষ্ট করে রাখে। দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাদের এসব বিতর্ক কিছুটা অবাস্তব শােনায় । | শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে চতুর্থ পরিকল্পনার চূড়ান্ত দলিলে এসব বিতর্কের রাজনৈতিক চরিত্রকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সংশােধিত পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত বরাদ্দের অনুপাত পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের দেওয়া অনুপাতের কাছাকাছি। প্যানেলের উভয় গ্রুপের সদস্যদের রিপাের্টে আঞ্চলিক মাথাপিছু আয় বৈষম্য, সম্পদের আন্ত-অঞ্চল স্থানান্তর ইত্যাদির হিসাবসংক্রান্ত অত্যন্ত নির্ভরযােগ্য তথ্যাদি সন্নিবেশিত থাকায় এগুলাে পাকিস্তানের আঞ্চলিক প্রশ্ন বিশ্লেষণের জন্য প্রয়ােজনীয় উৎসে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানের পরিকল্পিত উন্নয়নের স্থিতিপত্র পাকিস্তানে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের ২০ বছর শেষ হলে দেখা যায় যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ১৯৪৯-৫০-এর মাথাপিছু আয়ের ২১.৯ শতাংশ থেকে প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৬৯-৭০ সালে ৬১.৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এ থেকেই বােঝা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্র বন্টন ও নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করেছে। আমরা লক্ষ করেছি যে ১৯৫৯-৭০ কালপর্বে সব উন্নয়ন ব্যয়ের শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছে। পরবর্তী পরিকল্পনাগুলাের আমলে এই বৈষম্য কিছুটা হ্রাস পেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এতে বােঝা যায় যে জনসংখ্যার। ৫৪ শতাংশ-অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানে একের পর এক পরিকল্পনার আমলে মাথাপিছু বিনিয়োেগ সুনিশ্চিন্ত বৈষম্যগুলাে বেড়েই চলেছে। এভাবে মাথাপিছু উন্নয়ন ব্যয়ক্ষেত্রে বৈষম্য ১৯৫১-৫৫ সালের ৮৬ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৬৫৭০ সালে ২৮১ টাকায় পৌছায়। তার মানে, মাথাপিছু বিনিয়ােজিত সম্পদের ব্যবধান বছরের পর বছর বৃদ্ধি পেতে থাকে। অনুরূপ বরাদ্দব্যবস্থার অধীনের আন্ত-আঞ্চলিক মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি ছিল অবধারিত।
ইনক্রিমেন্টাল ক্যাপিটাল আউটপুট রেশিও (আইকোর) প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে ছােটখাটো উদ্যোগের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের পুঁজি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে বেশি উৎপাদনক্ষম ছিল। এর ওপর ভিত্তি করে চতুর্থ পরিকল্পনার খসড়া ও পশ্চিম পাকিস্তানি প্যানেলের অর্থনীতিবিদদের রিপাের্টে বরাদ্দের হিস্যা স্থির করা হয়। বিনিয়ােগের পাল্লা পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে ঝুঁকে থাকা সত্ত্বেও দুটো পরিকল্পনাকালে সরকার মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য হ্রাস করতে চায়। তারা চতুর্থ পরিকল্পনাকালে পূর্ব পাকিস্তানে আইকোর নিচু থাকবে বলে ধরে নেন। এই অনুমানকে প্যানেলের পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যরা চ্যালেঞ্জ করেন। চতুর্থ। পরিকল্পনাকালে পূর্ব পাকিস্তানে আইকোর সত্যি কম হলে এবং পূর্ববর্তী পরিকল্পনাগুলাের আমলেও তা-ই থাকলে পরিকল্পিত সর্বাধিক বৃদ্ধির কারণে পূর্ব পাকিস্তানে আগের পরিকল্পনাগুলাের সময়ের চেয়ে বরাদ্দের পরিমাণ আপেক্ষিকভাবে বেশি হওয়ার কথা। প্রথম ও দ্বিতীয় পরিকল্পনাতেও পশ্চিম পাকিস্তানে অধিকতর বিনিয়ােগকে ন্যায্য প্রমাণ করার জন্য অধিকতর বিনিয়ােগদক্ষতার একই যুক্তি ব্যবহৃত হয়। কার্যত আইকোর-সংক্রান্ত তথ্যগুলােই দুর্বল। কাজেই সম্পদ বরাদ্দকে প্রভাবিতকরণের ভিত্তি হিসেবে পুঁজির উৎপাদনশীলতার যুক্তি বাদ দেওয়া এবং শুধু বরাদ্দের হিস্যা ও মাথাপিছু আয়ের দিকে তাকানােই নিরাপদ। বরাদ্দের হিস্যা ও মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য বছরের পর বছর বৃদ্ধিই পেয়েছে। বৈষম্য স্পষ্টকরণে বেসরকারি খাতের ভূমিকা ৫২ মােট ব্যয়ের উপাত্তগুলাের দিকে তাকাতে গিয়ে আমরা বেসরকারি খাতে উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অনেক প্রবলতর বৈষম্যকে দৃষ্টির আড়ালে রেখে দিই । সরকারি খাতের ব্যয়ের হিসাবে দেখা যায় যে ১৯৫০-৭০ কালপর্বে ব্যয়ের ৪০% পূর্ব পাকিস্তানে করা হয় । কালক্রমে এই হিস্যা ১৯৫০-৫৫ সালের ২৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৬৫-৭০ সালে ৪৮ শতাংশে দাঁড়ায়। সরকারি উন্নয়ন ব্যয় স্বদেশে সংগৃহীত সরকারি সম্পদ ও বৈদেশিক উৎস থেকে সংগৃহীত সম্পদ থেকে সরকার কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে নির্বাহ করা হয়। এদিক থেকে রাষ্ট্র কোন অঞ্চলকে বা কোন কর্মকাণ্ডকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, সরকারি খাতে উন্নয়ন ব্যয়ের মাধ্যমে তা সরাসরি প্রতিফলিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদেরা যুক্তি দিয়ে এসেছেন যে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্যের মূলে রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে বেসরকারি খাতের গতিময়তা। ১৯৫০-৭০ কালপর্বে বেসরকারি খাতে উন্নয়ন ব্যয়ের শতকরা ৭৭ ভাগ ঘটে পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৫০-৭০ সময়পর্বে মােট উন্নয়ন ব্যয়ের শতকরা ৪৮ ভাগ বেসরকারি খাতে নির্বাহ করা হয় বিধায় (পশ্চিম পাকিস্তানে ৫১% এবং পূর্ব পাকিস্তানে ৩২%) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিনিয়ােগ-বৈষম্যের মূল উৎস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বেসরকারি খাত । পূর্ব পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদগণ এটা স্বীকার করে নিয়ে যুক্তি প্রদর্শন করেন যে পশ্চিম।
পাকিস্তানে বেসরকারি খাত অধিকতর গতিময় হওয়ার কারণেই রাষ্ট্রের উচিত পূর্ব পাকিস্তানে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। তারা আরও যুক্তি দেখান। যে দ্বিতীয় পরিকল্পনার সময় থেকেই পরিকল্পনা কমিশন উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের বেসরকারি খাতের জন্য অবাস্তব বিনিয়ােগ-লক্ষ্য স্থির করে দেয়। কমিশন ভালাে করেই জানত যে ওসব লক্ষ্য কখনাে বাস্তবায়িত হবে না। এটা প্রমাণিত হয় এ তথ্য দ্বারা যে পরবর্তী পরিকল্পনাগুলাের আমলে পূর্ব পাকিস্তানের বেসরকারি খাত তার ব্যয়ের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে পড়ে, অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে লক্ষ্যগুলাে বাস্তবায়িত কিংবা অতিক্রান্ত হয়। | পরিকল্পনার শুরুতেই সার্বিক উন্নয়নব্যয়ের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য কমিয়ে আনার কৃত্রিম ধারণা সৃষ্টির অভিসন্ধি নিয়েই কাজটি করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানি। অর্থনীতিবিদগণ যুক্তি দেখান যে সার্বিক উন্নয়ন ব্যয়ে সমতা আনার জন্য পূর্ব। পাকিস্তানে সরকারি ব্যয়ের হিস্যা বেশি প্রয়ােজন। চতুর্থ পরিকল্পনার প্যানেলের । বাঙালি সদস্যরা যুক্তি দেন যে খসড়া পরিকল্পনার সুপারিশকৃত ৫৫% এবং তৃতীয় পরিকল্পনায় কার্যত আদায়কৃত ৪৮%-এর স্থলে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি ব্যয়ের। পরিমাণ ৬২% নির্ধারিত হােক। খসড়া পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। বেসরকারি বিনিয়োেগ মােট পরিকল্পনাব্যয়ের ৩৮.৫ শতাংশ নির্ধারিত হয়। বাঙালি। অর্থনীতিবিদেরা বেসরকারি বিনিয়ােগের এ হিস্যাটি কাটছাট করার সুপারিশ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে বেসরকারি খাতের যে আপেক্ষিক দুর্বলতা আমরা লক্ষ করেছি, তা দুই অঞ্চলের ভিন্ন রকম উত্তরাধিকারের অংশ। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে। কোথাও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় ব্যবসায়িক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী ছিল না। সিন্ধুতে ব্যবসা-বাণিজ্য সবই হিন্দুরা নিয়ন্ত্রণ করত। পাঞ্জাবের ব্যবসা-বাণিজ্যে শিখ ও হিন্দুর প্রাধান্য ছিল। চামড়ার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত পাঞ্জাবি মুসলিম চিনিওটিরা। পাঞ্জাবের বাইরে ব্যবসা করতে পছন্দ করত। বাংলার বাঙালি মুসলিমরা সব। পর্যায়ের ব্যবসা-বাণিজ্যে অনুপস্থিত ছিল। সুতরাং, ভারত থেকে আগত ব্যবসায়ী। সম্প্রদায়গুলােই ব্যবসা-বাণিজ্যের পাল্লা পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে ভারী করে। তােলে। তবে এ সম্প্রদায়ও পশ্চিম পাকিস্তানে কলকারখানা স্থাপনে রাতারাতি। বিনিয়ােগের জন্য বস্তা বস্তা সােনা নিয়ে পাকিস্তানে আসেনি। তারা এনেছিল। ব্যবসাবুদ্ধি ও দক্ষতা। সেটা দ্বারা পাকিস্তানের সূচনাপর্বে বৈদেশিক মুদ্রা উদ্বৃত্ত থাকার বছরগুলােতে আমদানি-বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা বিপুল মুনাফা অর্জন। করে। কোরীয় যুদ্ধের রমরমা অবস্থা ধসে পড়ার পর এসব উদ্বৃত্ত সংরক্ষণশীল। বাণিজ্যনীতির আওতায় শিল্পায়নের বীজ-পুঁজিরূপে কাজ করে।
এটা পরিষ্কার যে ১৯৪৮-৪৯ সালে উভয় অঞ্চলের শিল্পক্ষমতাই ছিল নগণ্য। এবং বস্ত্র উৎপাদন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সমপরিমাণ ছিল। সিগারেট ও
সিমেন্ট উৎপাদনে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা ছিল সামান্য। পূর্ব পাকিস্তান ছিল বড় রকমের চা উৎপাদনকারী । ১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কলকারখানায় নিয়ােজিত কর্মীসংখ্যা ছিল ১,১৭,৩৫৫, আর পূর্ব পাকিস্তানে এদের সংখ্যা ছিল ৫৫,০৭৪। ১৯৫৪ সাল নাগাদ পশ্চিম পাকিস্তানে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে। যায়। সেখানে চাকরিরত লােকের সংখ্যা প্রায় ৮৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে বৃদ্ধি পায় মাত্র ৩৩ হাজার। পশ্চিম পাকিস্তানে বৃহদায়তন শিল্প উৎপাদন ১৯৪৯-৫০ সালের ২১ কোটি টাকা থেকে দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৫৯ কোটি ৫০ লাখ টাকায় পৌছায়। পক্ষান্তরে, পূর্ব পাকিস্তানে তা ৩ কোটি ৮০ লাখ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকায় দাঁড়ায়।৫৩ পশ্চিম পাকিস্তানে সুতার উৎপাদন ১৯৪৮-৪৯ সালের ১ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ড থেকে ১৯৫৪-৫৫ সালে ২৫ কোটি ২০ লাখ পাউন্ডে উপনীত হয় এবং বস্ত্রের উৎপাদন একই সময়ে ৪ কোটি ৪০ লাখ গজ থেকে ৩৮ কোটি ৯০ লাখ গজে বর্ধিত হয়।৫৪ পক্ষান্তরে, পূর্ব পাকিস্তানে সুতা ও কাপড়ের উৎপাদন সামান্যই বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৯-৫০ ও ১৯৫৪-৫৫ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প ও যানবাহন খাতে বেসরকারি বিনিয়ােগের পরিমাণ ছিল ৭০ কোটি টাকা, আর পশ্চিম পাকিস্তানে ওই খাতগুলােতে বিনিয়ােগ করা হয় ২১৩ কোটি টাকা।৫৫ বেসরকারি খাতের বিকাশের আরেকটি পরিমাপ পাওয়া যেতে পারে অঞ্চলগুলাের জন্য প্রদত্ত পুঁজির অনুমোেদনসংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকে। ১৯৪৮৫১ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ১০ কোটি ছয় লাখ টাকার পুঁজি প্রদান অনুমােদিত হয়, আর পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অনুমােদিত হয় ৪২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। তা থেকে ৩০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা (৭৩%) অনুমােদিত হয়। করাচির জন্য। এমনি করে পাকিস্তানে শিল্পায়নের গােড়ার দিকে করাচিতে বসবাসরত বহিরাগত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়গুলাের হাতে পুঞ্জীভূত বাণিজ্যিক পুঁজি একটি নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়। পাকিস্তানের প্রথম বছরগুলােয় অবাধ অর্থনীতির অধীনে ব্যবসার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র যে অবিন্যস্তভাবে কাজ করেছে, সেটাই হয়তাে পাকিস্তানে আদি পুঁজিগঠন বা পুঞ্জীভবন প্রক্রিয়ার আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্বের একটা ব্যাখ্যা দিতে পারে। রাষ্ট্র তখনাে বেসরকারি খাতে পুঁজি গঠনের জন্য অর্থ জোগানের একটা তাৎপর্যপূর্ণ উৎস হয়ে ওঠেনি।
পাকিস্তানের প্রথম বছরগুলােয় যে একমাত্র এজেন্সি হাতের কাছে ছিল, তা হচ্ছে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপােরেশন (পিআইএফসি)। এর দুই কোটি টাকার আদায়কৃত মূলধনের শতকরা মাত্র ৫১ ভাগ ছিল সরকারের।৫৭ বৈদেশিক মুদ্রার ওপর হাত না থাকায় এর ঋণদান তৎপরতা দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে এটা কেবল শতকরা ৬ টাকা সুদে ঋণদান করতে থাকে। ১৯৪৯-৬০ সালের মধ্যে পিআইএফসি প্রায় ২৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা ঋণদান করে। এর ৫৬ শতাংশ যায় বস্ত্র কারখানা ও পাটশিল্পে এবং অধিকাংশ যায় বৃহৎ কলকারখানার মালিকদের হাতে। ওই প্রাথমিক যুগে বেসরকারি খাতে এ রকম সব বড় কলকারখানা স্থাপিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। কাজেই এটা অনুমান করা ন্যায়সংগত হবে যে পিআইএফসি থেকে খুব স্বল্পসংখ্যক বাঙালিই উপকার পেয়েছে, যদিও এর ঋণ কয়েকটি অবাঙালি পরিবার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপিত পাটকলে বিনিয়ােগে সহায়তা করে। এটাও অনুমান করা যুক্তিসংগত হবে যে পাকিস্তানের প্রথম যুগের শুরুতে বেসরকারি শিল্প খাতে যে বিনিয়ােগ হয়, তা এসেছিল ব্যবসা এবং পরে পণ্য উৎপাদনে অর্জিত মুনাফার পুনর্বিনিয়ােগ থেকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এসব উৎসের সৃষ্টি হয়েছিল পুঁজি বা অর্থ জমানাের ক্ষেত্রে যা যা পারাে হাতিয়ে নাও’ নীতির ফল হিসেবে। ১৯৫২ সালের পরে ব্যবসাভিত্তিক পুঁজি সঞ্চয় আমদানি লাইসেন্স প্রাপ্তির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল থাকে। অতিরিক্ত মূল্যের বিনিময় হার, আমদানি সীমাবদ্ধকরণ এবং শিল্প খাতে আমদানি লাইসেন্স নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রে প্রবেশে কড়াকড়ি আরােপ—এসবের মানে দাঁড়ায় এই যে বরাদ্দসংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্তগুলাে একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিতে পরিণত হয়েছিল। আমদানি লাইসেন্স বিতরণ এমনি করে কে কোথায় কী শিল্প স্থাপন করবে, তা নির্ধারণের ব্যাপারে সরকারের একটা নীতিগত হাতিয়ারে পরিণত হয়। ১৯৫১ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে দেখা যায় যে পাকিস্তান সরকার ১১০ কোটি ৪০ লাখ টাকার বাণিজ্যিক আমদানি লাইসেন্স বরাদ্দ করেছে এবং তার ৬৭% পেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানি আমদানিকারকেরা। এসব লাইসেন্স শিল্পে বিনিয়োেগর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের হাতে প্রচুর সম্পদ এনে দেয়।
যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে, পাকিস্তান সরকার শিল্পায়নের এই প্রাথমিক পর্যায়ে উৎপত্তিস্থল, প্রাথমিক বাসস্থান ও নগদ টাকার উৎস যেখানেই হােক না কেন, তা বিচার না করে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়ােগে বাধ্য করতে পারত। অনুরূপভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বৈধ বাণিজ্যিক আমদানির লাইসেন্সগুলাে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস ও কর্মরত ব্যবসায়ীদের দেওয়া যেত। বাঙালিদের পুঁজি সঞ্চয়ের একটা উৎস প্রদানের বিষয়টাকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া যেত। আঞ্চলিক বৈষম্য স্থায়ীকরণে বিনিয়ােগের স্থান ও পুঁজি সঞ্চয়ের ক্ষমতা একটা বাজারসৃষ্ট শক্তি—এ ধারণাটি ১৯৫০-এর দশকে পাকিস্তানের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকালীন অর্থনীতির ব্যাপারে কোনােক্রমেই খাটে না। | শিল্পায়নের, বিশেষ করে মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের গতিবেগ বৃদ্ধিকল্পে পাকিস্তান সরকার পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন করপােরেশন (পিআইডিসি) স্থাপন করে। কথা ছিল, এই সরকারি সংস্থাটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার জন্য সরাসরি কিংবা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহযােগিতায় শিল্প স্থাপন করবে এবং শেষােক্তগুলাে থেকে অবিলম্বে বা পর্যায়ক্রমে সরকারি হােল্ডিংগুলাে প্রত্যাহার করবে। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পায়নে পিআইডিসি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানেও তা সক্রিয় ছিল। ১৯৫২ সালে জন্মের সময় থেকে ১৯৭০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পিআইডিসি ১১৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা বিনিয়ােগ করে পশ্চিম পাকিস্তানে ৫৮টি শিল্প প্রজেক্ট স্থাপন করে। এর ২০.৯% বিনিয়ােগ আসে বেসরকারি খাত থেকে।৫৮ পূর্ব পাকিস্তানে পিআইডিসি ১৮৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা বিনিয়ােগ করে ৭৪টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট স্থাপন করে। এতে দেখা যায়, পিআইডিসির ৬১ শতাংশ বিনিয়ােগ যায় পূর্ব পাকিস্তানে। যুক্তি দেখাননা যায় যে বেসরকারি খাত পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়ােগে অধিকতর আগ্রহী থাকার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য এসব সরকারি শিল্প বিনিয়ােগের আরও বৃহত্তর অংশ পূর্ব পাকিস্তানে আসতে পারত। ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহায়তাকল্পে পিআইডিসি আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান শিল্পঋণ করপােরেশন (পিআইসিআইসি) এবং ১৯৬১ সালে পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবিপি) স্থাপন করে।
ব্যাংকটি পিআইএফসিওর সম্পদ ও দায় আধগ্রহণ করে। পাকিস্তান সরকারও ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান বিনিয়ােগ করপােরেশন এবং ১৯৭০ সালে ইকুইটি পার্টিসিপেশন ফান্ড গঠন করে। এসব এজেন্সি পাকিস্তানে বেসরকারি শিল্পকে উৎসাহ প্রদানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পালন করে। ১৯৫৭-৬০ সালের মধ্যে এসব এজেন্সি কর্তৃক মঞ্জুরীকৃত ৪৮০ কোটি ৭০ লাখ থেকে ১৯২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রকল্পগুলাে। কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপােরেশন কর্তৃক মঞ্জুরীকৃত ১৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা থেকে ৭৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা (৪২%) পূর্ব পাকিস্তানে আসে। পাকিস্তানের সরকারি উন্নয়ন ফিন্যান্স ইনস্টিটিউটগুলাের (পিডিএফআই) ঋণদান নীতি এটাই প্রতিপন্ন করে যে পূর্ব পাকিস্তানে বেসরকারি খাতকে উৎসাহ প্রদানে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তারা বেসরকারি বিনিয়ােগের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে হওয়ার ব্যাপারটি সংশােধন করতে পারেনি, ফলে ১৯৫০ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতের উন্নয়ন ব্যয়ের শতকরা ৭৭ ভাগ চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। পিডিএফআই কার্যত এসব বৈষম্যে উৎসাহ প্রদান করে, যেহেতু বেসরকারি খাতের বিনিয়ােগে সরকারি ঋণদান কার্যক্রম সব সময়ই অনুঘটক হিসেবে কাজ করে এসেছে। পূর্ব পাকিস্তানে বেসরকারি খাতে অবাঙালিদের প্রাধান্য পাকিস্তান আমলে যেটা কম নজরে পড়েছে, তা হলাে এই যে পূর্ব পাকিস্তানে বেসরকারি বিনিয়ােগ বলতে বাঙালিদের দ্বারা বিনিয়োেগ বােঝাত না। পাকিস্তানে গণবিতর্কের মূলকথা ছিল বিনিয়ােগের স্থান হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানকে নির্বাচন এবং বেসরকারি বিনিয়ােগ যাতে সেভাবেই হয়, সে জন্য রাষ্ট্রীয় নীতি ও সম্পদকে কাজে লাগানাে। কিন্তু কার্যত বাঙালি মুসলিমদের দুর্বল ব্যবসায়িক যােগ্যতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে বেসরকারি বিনিয়ােগ ও অর্থনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রে অবাঙালিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আমরা লক্ষ করেছি যে অবাঙালি মুসলিমরা অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগ প্রশাসনের পৃষ্ঠপােষকতায় বিত্তবান ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছিল। বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতৃত্বের মধ্যে এ শ্রেণিটা ছিল যথেষ্ট প্রভাবশালী।
১৯৫২ ও ১৯৫৪ সালের মধ্যে পিআইডিসি আনুমানিক ২২ কোটি ৯০ লাখ টাকার স্থির পরিসম্পদসহ পূর্ব পাকিস্তানে ১২টি জুটমিল স্থাপন করে। এতে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক জীবনে অবাঙালিদের অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জুটমিলগুলাে প্রতিষ্ঠিত হয় অবাঙালি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলাের সঙ্গে সহযােগিতার ভিত্তিতে।৬২ ইপিআইডিসি এসব পাটকল স্থাপনে বৈদেশিক মুদ্রা জোগায়। পরবর্তীকালে তা ১৯৫৪ সালে। কর্ণফুলী কাগজের মিলটি ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যে দাউদগােষ্ঠীর কাছে। হস্তান্তর করে। এই অঙ্কটি ছিল মিলটির প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম।৬৩ পূর্ব। পাকিস্তানে পিআইসিআইসি ও আইডিবিপি প্রদত্ত ঋণের এক-তৃতীয়াংশ লাভ করে অবাঙালিরা।৬৪ ১৯৬৯-৭০ সালে বাঙালি ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণদান ত্বরান্বিত করা হয়। ১৯৫৭ সালের মধ্যে আইডিবিপি ও পিআইসিআইসি কর্তৃক প্রদত্ত ঋণের ৪২.২ শতাংশ, অর্থাৎ ১০২ কোটি ৭ লাখ টাকা কেবল বাঙালিদের দেওয়া হয়। এটা করা হয় ইতিপূর্বে পিডিএফআই বাঙালিদের উপেক্ষা করেছিল বলে।৬৫ এই সময়টুকু (১৯৬৯-৭১) বাদ দিয়ে আমরা যদি ধরে নিই যে ১৯৫৭১৯৬৯ কালপর্বেই পিডিএফআই পূর্ব পাকিস্তানে তার সব ঋণ অবাঙালিদের দিয়েছিল, তাহলে দেখা যায় যে ১৯৬৯ পর্যন্ত অবাঙালিরা পিডিএফআইগুলাের দেওয়া ১১৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণের ৬২ শতাংশ লাভ করেছে।৬৬
প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রীয় স্পনসরশিপ এবং অবকাঠামাের উন্নয়ন ও আঞ্চলিক বাজারের প্রসারের সঙ্গে বিনিয়ােগের উৎস হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন অবাঙালি ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা এদিকে আকৃষ্ট হতে থাকে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রাকমুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানের শহরাঞ্চলীয় অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে অবাঙালিদের কবজায় ছিল। শিল্প খাতে তারা শতকরা ৪৭ ভাগ শিল্প পরিসম্পৎ নিয়ন্ত্রণ করত। অবাঙালিরা ২৮টি চা-বাগানও নিয়ন্ত্রণ করত। চায়ের মােট উৎপাদনের শতকরা ১৯ ভাগ আসত এই বাগানগুলাে থেকে। বাণিজ্য খাতে বড় আমদানি ক্যাটাগরি হােল্ডারদের শতকরা ৯৩ ভাগই ছিল অবাঙালি এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৫৭ জন ছিল মেমন সম্প্রদায়ভুক্ত। ৬৮ পাকিস্তানের দুই অংশের আন্তবাণিজ্যেও নিরঙ্কুশ প্রাধান্য ছিল অবাঙালিদের। অবাঙালিদের আমদানি লাইসেন্স দেওয়া হলে বহু ক্ষেত্রে তারা সেগুলাে অপেক্ষাকৃত সুপ্রতিষ্ঠিত অবাঙালিদের কাছে বিক্রি করে দিত। শতকরা ৯৫ জন। তালিকাভুক্ত বাঙালি আমদানিকারক অত্যন্ত ছােট লাইসেন্সই পেত।৬৯ রপ্তানিবাণিজ্য অনুরূপভাবে অবাঙালিকবলিত ছিল। পাটের রপ্তানি-বাণিজ্যে অবাঙালিদের হিস্যা ছিল ২৫%, বাঙালিদের ৩৩% এবং বাকিটা নিয়ন্ত্র” রিত বিদেশি ও সরকারি খাতের ধারকগণ। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে চা, কাগজ, কাগজজাত দ্রব্যাদি, দেশলাই, ট্যাগ করা দ্রব্যাদি রপ্তানিতে অবাঙালিরাই ছিল প্রধান। পূর্ব পাকিস্তানের পাইকারি ব্যবসা এবং শহরাঞ্চলের খুচরা ব্যবসার বেশির ভাগও তারাই নিয়ন্ত্রণ করত। | ব্যাংকিংয়ের এলাকায় ডিপােজিটের শতকরা ৭০ ভাগই যেত অবাঙালি ব্যাংকগুলােতে। বিমা ব্যবসার বেশির ভাগ চালাত অবাঙালি বিমা কোম্পানিগুলাে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের ক্ষেত্রে অতি বৃহত্তম জাহাজমালিকদের দুজনই ছিলেন অবাঙালি। | পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক অবাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানের আধুনিক অর্থনৈতিক খাতও বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করত। এর ফলেই তারা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ব্যবসাবাণিজ্য থেকে অর্জিত মুনাফা পশ্চিম পাকিস্তানে পুঁজি হিসেবে বিনিয়ােগের জন্য সেখানে নিয়ে যেতে পারত। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানে রপ্তানির জন্য বিনিয়ােগ ও বাণিজ্যিক সুযােগ গ্রহণের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বিকাশকে উৎসাহিত করে। ১৯৭১ সাল নাগাদ পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহদায়তন শিল্প খাতের ১৫ শতাংশ উৎপন্ন দ্রব্যের বাজারে পরিণত হয়।”
পূর্ব পাকিস্তানের বেসরকারি খাতকে উৎসাহ প্রদান করতে হলে সম্পদ যাতে বাঙালিদের হাতে যায়, সে ব্যবস্থা করতে হতাে। কিন্তু পাকিস্তানের অখণ্ড বহুজাতিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে এ রকম জাতিভিত্তিক ব্যবস্থা সম্ভব ছিল না, যদিও মালয়েশিয়াতে চীনাদের মুখােমুখি মালয়িদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উৎসাহ। প্রদানের ক্ষেত্রে এটা বহু বছর ধরে নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। তার পরও সরকারি সম্পদাদি গ্রহণে ইচ্ছুক বাঙালি ব্যবসায়ী উদ্যোক্তার সংখ্যাল্পতাও ছিল একটি সমস্যা। আমদানি লাইসেন্স, শিল্পস্থাপনে অনুমতি এবং পিডিএফআইয়ের ঋণ প্রায়ই চলে যেত অবাঙালি ব্যবসায়ীদের হাতে। যা-ই হােক, ১৯৬০-এর দশকে পিডিএফআইয়ের সম্পদগুলাে যাতে বাঙালি ব্যবসায়ীরা পায়, সে জন্য একটি সচেতন প্রচেষ্টা নেওয়া হয় এবং প্রথমবারের মতাে একজন বাঙালিকে আইডিবিপিয়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে নিয়ােগ করা হয়। ১৯৬৯ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদী গণ-অভ্যুত্থানের পরে পিডিএফআইগুলাে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ঋণদান তৎপরতা বাড়িয়ে দেয় এবং বাঙালি আবেদনকারীদের ঋণদান বৃদ্ধি করে। বাঙালি উদ্যোক্তাশ্রেণির বিকাশ বাঙালিদের ব্যবসায় ও শিল্পোদ্যোগের যােগ্যতা কম থাকায় ইপিআইডিসির নেতৃত্বে সরকারি খাতকে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পায়ন জোরদারকরণে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়। সরকারি খাতকে বেসরকারি ব্যবসায়িক উদ্যোগের স্থান গ্রহণ করতে হয়। পূর্ব পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র অর্থনীতিতে অবাঙালিদের অধিকতর প্রভুত্ব নিরােধের গুপ্ত কৌশলরূপে সরকারি খাতের সম্প্রসারণকে ব্যবহার করে। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে ইপিআইডিসি বাঙালিদের পাটশিল্পে প্রবেশ করানাের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। এটি বাঙালি উদ্যোক্তাদের সহযােগিতায় ১০টি পাটকল স্থাপনের জন্য ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিনিয়ােগ করে।৭২
পিডিএফআইগুলাে থেকে অধিকতর সাহায্য পাওয়ার ফলে মিলগুলাের বাঙালি মালিকদের মিলগুলাে স্থাপনে প্রয়ােজনীয় মােট বিনিয়ােগ ১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার শতকরা মাত্র ২০ ভাগ দিতে হয়। ইপিআইডিসি সুবিধাজনক শর্তে ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা নিয়ে একটি কাপড়ের মিল এবং ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকায় একটি চিনিকল থেকে পুঁজি প্রত্যাহার করে বাঙালি উদ্যোক্তাদের হাতে ছেড়ে দেয়। | একটি বাঙালি উদ্যোক্তাশ্রেণি গড়ে তােলার উপরিউক্ত প্রয়াসগুলাের ফল হিসেবে স্বাধীনতা অর্জনকালে আধুনিক শিল্প খাতে স্থির পরিসম্পদ-এর ১৮ শতাংশ ছিল বাঙালিদের হাতে। তবে ওই বিনিয়ােগগুলাের পাঁচ-ষষ্ঠাংশই ছিল পাট ও বস্ত্র খাতে এবং একটি পুঁজি-প্রত্যাহৃত চিনিকলে। বাঙালি উদ্যোগ ও | মালিকানার বেশির ভাগই সীমাবদ্ধ থেকে যায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের কলকারখানায়। ব্যাংকিং খাতে বাঙালিরা ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও দ্য ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপােরেশন নামে দুটি ব্যাংক স্থাপন করে। বিমা খাতে স্বাধীনতা অর্জনকালে বাঙালিদের ১২টি কোম্পানি ছিল।৭৪ এগুলাের পরিসম্পদ-এর হিস্যা ছিল অতি ক্ষুদ্র। এগুলাে ব্যবসা করত প্রধানত পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে। বাঙালি পাট রপ্তানিকারকদের বেশির ভাগ স্মল শিপারস অ্যাসােসিয়েশনের সদস্য হলেও মিলিতভাবে পাটের মােট শিপমেন্টের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তারাই করত। জহুরুল ইসলাম পরিবারের মতাে কিছুসংখ্যক বাঙালি বেসামরিক বিনির্মাণের বড় বড় ঠিকাদারি পেতে শুরু করেছিল। সিভিল সার্ভিসের কোনাে কোনাে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী আমলাতন্ত্রের মধ্যে তাদের যােগ-সংযােগগুলােকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত লাভজনক ইনডেন্টিং ব্যবসায়ে ঢুকে পড়েন। ইনডেন্টিং ব্যবসায়ে, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সরবরাহের ক্ষেত্রেও অবাঙালি প্রাধান্য বিদ্যমান ছিল। বাঙালি ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাশ্রেণি গড়ে তােলার ক্ষেত্রে অর্জিত এসব সাফল্যের অধিকাংশ ১৯৬০-এর দশকের এবং বিশেষ করে ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগের ফসল, যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্রমবর্ধমান চাপ বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে আমলাতন্ত্রের মধ্যে ওপরে ওঠার এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে অধিকতর সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা লাভের সুযােগ এনে দিচ্ছিল। তবে এই উদীয়মান বাঙালি ব্যবসায়ী শিল্পপতিশ্রেণি অবাঙালিদের কনিষ্ঠ অংশীদার থেকে যায় স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসাজগতে অবাঙালি প্রাধান্য অব্যাহত থাকে।
সুতরাং এটা যুক্তিসংগত যে ব্যবসা-শিল্পগত উদ্যোগের ব্যাপারটি সব সময় পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে কাজ করে। ভারত থেকে আগত উদ্বাস্তু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়গুলাের আকস্মিক বসতি স্থাপনের দরুন পাকিস্তানের গােড়ার দিনগুলােয় পশ্চিম পাকিস্তানই এগিয়ে ছিল। এটা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান ব্যবধানকে ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তােলে এবং আরও প্রসারিত করে । বাঙালি ও অবাঙালি উদ্যোক্তাদের মধ্যকার ব্যবধানও এর ফলে আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে আমরা পরবর্তী অংশে দেখব যে অর্থনৈতিক নীতির দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই প্রধান প্রভাববিস্তারকারী হিসেবে থেকে যায়। পশ্চিম পাকিস্তান প্রথম থেকে যে সুবিধা ভােগ করে, তার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে বেসরকারি ব্যবসা-শিল্পকে উৎসাহদান ও সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, উভয় কাজই করতে পারত। রাষ্ট্র যে সামন্ত ও পেশাজীবী শ্রেণিগুলােকে শিল্পের ক্ষেত্রে টেনে আনার ব্যাপারে একটি নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারত, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬০-এর দশকে পাঞ্জাবি ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ব্যবসায়ী পরিবারগুলাের দ্রুত উত্থানের মধ্যে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা কোনাে রকম ব্যবসায়িক পশ্চাভূমিহীন এক ব্যক্তিকে পাকিস্তানের ৪৩টি শীর্ষস্থানীয় পরিবারে অন্যতম হিসেবে গড়ে তােলার জন্য কী করতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আছে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ছেলের শ্বশুর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশবাসী জেনারেল হাবিবুল্লাহ খান খট্টকের মালিকানাধীন গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজের উথান। আজ করাচির মতােই লাহাের পাকিস্তানের একটি গতিশীল বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতায় পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের একটি নতুন। প্রজন্ম সমৃদ্ধি লাভ করেছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে তেমনটি ঘটেনি। | বাঙালিরা তাদের নিজেদের দেশে বিদেশি উপস্থিতির ছায়ায় বাস করছিল। এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যবসার সুযোেগগুলােয় হাত দিতে পারছিল না। নতুন উদ্যোগ গ্রহণ বা ব্যবসার সুযােগ লাভের জন্য করাচি-ইসলামাবাদে ছােটাছুটি করতে তারা বিরক্তিবােধ করত এবং এসব কাজে অবাঙালি আমলারা বাঙালি ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপােষকতা করত বলে তারা অসন্তুষ্ট হতাে। গােড়ার দিকের বছরগুলােতে অবাঙালি সিভিল সার্ভেন্টরাই পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয় চালাত। পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করার পর বাঙালিরা ইসলামাবাদের তুলনায় তাদের ক্ষমতাহীনতা এবং সম্পদ ও দায়িত্বের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণহীনতার দরুন হতাশায় ভুগত। | আইডিবিপির মতাে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলাে পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ এবং কেন্দ্রে সচিব পদে বাঙালির নিযুক্তিলাভ শুরু হওয়ার পরই কেবল বাঙালি ব্যবসায়ীদের মনে বিশ্বাস জন্মে যে সুযােগের পাল্লা তাদের দিকে ঝুঁকছে। সুতরাং পাকিস্তান যেমন চিনিওটি ও মেমনদের অবিভক্ত ভারতের মাড়ােয়ারি ও গুজরাটি ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য থেকে মুক্তিলাভের সুযােগ এনে দিয়েছিল, তেমনি কেন্দ্রে বাঙালিদের ক্ষমতালাভ এবং প্রদেশে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বর্ধিষ্ণু বাঙালি ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের জন্য অবাঙালি বাণিজ্যিক প্রাধান্য থেকে মুক্তিলাভের সুযােগ এনে দেয়। অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে পক্ষপাতিত্ব সম্পদ বরাদ্দ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ব-পশ্চিম বিরােধের কারণ হিসেবে থেকে যায়।
সরকারি সম্পদ ও অর্থনৈতিক সুযােগ-সুবিধা নিয়ন্ত্রিত হতাে সরকারি নীতি দ্বারা, যা অর্থনৈতিক তৎপরতার স্থান অর্থ জোগানাের উৎস উভয়কেই প্রভাবিত করত। আমরা সরকারি নীতির চারটি এলাকার ওপর দৃষ্টিপাত করব। এগুলাে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্বকে প্রতিফলিত করেছে, বঞ্চনাবােধকে সুদৃঢ় করেছে এবং এ বঞ্চনাবােধ বাঙালি জাতীয়তাবােধের আগুনে ঘি ঢেলেছে। এই এলাকাগুলাের মধ্যে পড়ে বাণিজ্যনীতি, বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দের হার নির্ধারণ, ফেডারেল ফিন্যান্স ও বহিঃসম্পদ আহরণ নীতি। বাণিজ্যিক নীতি বাঙালিদের মনে অত্যন্ত গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল যে বিষয়টি, তা হলাে পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারে বঞ্চনা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রধান বাজার ছিল ভারত। পাকিস্তানের ৬৫ শতাংশ পাট যেত ভারতে এবং অবশিষ্ট ৩৫ শতাংশ রপ্তানি হতাে বিশ্বের অন্যান্য দেশে।৭৫ এ পরিস্থিতি শিল্পের ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলার বৈষম্যকে প্রতিফলিত করেছে। ভারতের পাটকলগুলাে ছিল পশ্চিম বাংলায়, আর সেরা পাট উৎপন্ন হতাে পূর্ব বাংলায়। ১৯৪৭-এর পরও ভারতের সঙ্গে পাটের বাণিজ্য পূর্ব বাংলার লাখ লাখ কৃষিজীবীর জীবনরক্ষার একমাত্র অবলম্বন থেকে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে পাট ও পশ্চিম পাকিস্তানে কাচা তুলা উৎপাদন যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, প্রধানত সে কারণেই ১৯৪৭-এর পর ভারতের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চলে। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান তার উৎপাদিত কাচা তুলার শতকরা ৮০-৯০ ভাগ ভারতে রপ্তানি করেছে। ভারত বিভক্তির পর কাঁচা পাট ও তুলার নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করার সচেতন প্রচেষ্টা শুরু হয়। ১৯৪৮ সাল নাগাদ উৎপন্ন কাঁচা পাটের ৪৮ শতাংশ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়, কিন্তু কাঁচা পাটের ১৮ শতাংশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের তুলা ফসলের ৪৩ শতাংশ তখনাে ভারতেই রপ্তানি হতাে। ১৯৪৯ সালে টাকার অবমূল্যায়নে ভারতের সঙ্গে যােগ দিতে পাকিস্তানের অস্বীকৃতির পরিণাম হিসেবে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক রহিত হওয়ার ফলে পাট উৎপাদনকারীরা বিপদের সম্মুখীন হয়।৭৬ এই বিরােধের গুণাগুণ যা-ই থাকুক না কেন, এর ফলে সৃষ্ট দুর্ভোগের পুরাে বােঝাটাই পড়ে পূর্ব বাংলার পাটচাষিদের ঘাড়ে। পাটের বিক্রি ও মূল্য হ্রাস পাওয়ায় পাটচাষিদের আয় মারাত্মকভাবে কমে যায়। পাটের মূল্যের সূচক ১৯৪৮ সালের এপ্রিল থেকে। ১৯৪৯ সালের মার্চ এবং ১৯৫০-এর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১০০ থেকে ৭১-এ নেমে আসে।৭৭
আরও অধিকতর পতন থেকে রেহাই পাওয়া যায় আকস্মিকভাবে কোরীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে। এতে পাটসহ সব দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং মূল্য ও আয় অনেক বেড়ে যায়। পূর্ব বাংলার রপ্তানি আয় ১৯৪৯৫০ সালের ৬২ কোটি টাকা থেকে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৫০-৫১ সালে ১২১ কোটি টাকায় দাড়ায়। এ ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হলাে করাচিতে নির্ধারিত বাণিজ্যিক নীতি পূর্ব বাংলার উৎপাদকদের জীবনকে কেমনভাবে প্রভাবিত করে, তা দেখানাের জন্য। ভারতে পাট রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ক্ষতি পােষানাে সম্ভব হয় পাটের বিকল্প বাজার সৃষ্টি হওয়ায় এবং পূর্ব বাংলা থেকে পাট আমদানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়ার পরিণতি হয় আরও দীর্ঘস্থায়ী। পূর্ব ভারতে পাটের উৎপাদন ১৯৪৫-৪৬ সালের ১ কোটি ৫৭ লাখ গাঁট থেকে বেড়ে ১৯৫১-৫২ সালে ৪ কোটি ৬৮ লাখ গাট এবং ১৯৫৮-৫৯ সালে ৫ কোটি ২০ লাখ গাটে উন্নীত হয়। পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে রপ্তানি ১৯৪৫-৪৬ সালে ৪০ লাখ গাঁট থেকে ১৯৫১-৫২ সালে ২৬ লাখ গাঁটে এবং ১৯৫৮-৫৯ সালে ২ লাখ গাঁটে নেমে আসে।
বিনিময় হার নীতি
বাঙালিদের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক নীতির পার্থক্যমূলক চরিত্রের কুফল আমদানি ও বিনিময় হার নীতির সুদূরপ্রসারী প্রভাব দ্বারা আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৫২ সালে কোরীয় যুদ্ধকালে রমরমা অবস্থার অবসান ঘটার পর পাকিস্তান আমদানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরােপ করে। এটা পাকিস্তানের পরবর্তী ইতিহাসে ১৯৭১ সাল। পর্যন্ত টাকার অতিরিক্ত মূল্যায়নকে টিকিয়ে রাখে। এর দরুন বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক রেশনিং এবং উচ্চ হারে আমদানি শুল্ক প্রবর্তনের প্রয়ােজন হয়। ১৯৫০-এর দশকে ১৯৫৫ সালের অবমূল্যায়নের সময় পর্যন্ত টাকার মূল্য ১০০% অতিরিক্ত ছিল। ১৯৫৮ সালের পরে এই অতিরিক্ত মূল্যায়ন কিছু কমানাে হলেও তা ১৯৬০-এর দশকেও শতকরা ৭৪ থেকে ১০০-এর মধ্যে থেকে যায়। পূর্ব পাকিস্তান দুভাবে এই বিশেষ নীতিব্যবস্থার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার এই অতিরিক্ত মূল্যায়নের অর্থ ছিল এই যে পশ্চিম পাকিস্তানি আমদানিকারকেরা পাচ্ছিল ভর্তুকি, আর পাট উৎপাদনকারীরা পাচ্ছিল তাদের রপ্তানির জন্য কম দাম। একজন প্রখ্যাত বাঙালি অর্থনীতিবিদ হিসাব করে দেখিয়েছেন যে ১৯৫৯ ৬০-এর একটিমাত্র বছরে টাকার এই অতিরিক্ত মূল্যায়নের মাধ্যমে পাটচাষিদের আয় থেকে ৬.৪% গােপন কর আদায় করা হয়। প্রথম দিকের ও শেষ দিকের বছরগুলােতে টাকার আরও অতিরিক্ত মূল্যায়ন ঘটায় পাটচাষিদের আয়ের ওপর এই কর ১০% পর্যন্ত উঠে থাকতে পারে। | পূর্ব পাকিস্তানের আমদানিকারকেরা অনুরূপ কোনাে সুবিধা পায়নি, যেহেতু | পাকিস্তান রাষ্ট্রের কঠোর আমদানিনীতির দ্বিতীয় পরিণাম ছিল বৈদেশিক মুদ্রা। বরাদ্দের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি আমদানিকারকদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। ১৯৫২ সাল থেকে পাকিস্তানের আমদানি-বাজারে অবাধ নীতির অতি সামান্যই বাজায় | ছিল। টাকার অতিরিক্ত মূল্যায়নভিত্তিক বিনিময় হার বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা দ্বারা স্থির হয় কারা আমদানির সুযােগ পাবে এবং সেভাবেই বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার এই নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা যে পক্ষপাতদুষ্ট ছিল, তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এই সত্যের মাধ্যমে যে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে পাকিস্তানের মােট আমদানির ৬৯ শতাংশ যায় পশ্চিম পাকিস্তানে।৮৩ | আমদানিতে এই আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্বের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হয়েছে বাজারের | গতিময়তা থেকে। একটি বৃহত্তর ও অধিকতর গতিময় অর্থনীতি ভােগ্য, মধ্যবর্তী | ও মূলধন দ্রব্যাদির আমদানি-চাহিদা বৃদ্ধি করে।
এর ফলে অধিকতর আনুকূল্যপ্রাপ্ত অঞ্চলের যে বিকাশ ঘটে, সেটা আমদানির চাহিদা আরও বাড়িয়ে | দেয়। এমনি করে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে দ্রুততর উন্নয়ন ও শিল্পায়নের ফলে সেখানে আমদানির জন্য বৃহত্তর বাজার সৃষ্টি হয়। অবশ্য যুক্তি | দেখানাে হয়েছে যে অতিরিক্ত মূল্যায়নের কারণে পাকিস্তানের উভয় অংশের | আমদানি-চাহিদাই অপূর্ণ ছিল। কঠোর আমদানি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অধীনে এক অঞ্চলের তুলনায় অপর অঞ্চলের আমদানি-চাহিদা অধিকতরভাবে মেটানাে নীতিনির্ধারকদের বিবেচনার আওতায় থেকে যায়। পশ্চাৎপদ পূর্বাংশের উন্নয়ন দ্রুততর করার জন্য সম্পদ প্রদানের প্রয়ােজন থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের আনুকূল্যে। | অনুরূপ পার্থক্যমূলক আমদানিনীতি অনুসৃত হলে তা এ অঞ্চলে যে সম্পদ। আকর্ষিত হতাে, সেটা বিনিয়ােগের ক্ষেত্রে অধিকতর আঞ্চলিক সমতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতাে এবং উৎপাদন ও আয়ের বৈষম্য কমিয়ে আনত।
কার্যত আমদানি রেশনিং ভিন্নমুখী কাজ করে। ১৯৫০-এর দশকে বাণিজ্যিক আমদানির জন্য প্রদত্ত নগদ আমদানি লাইসেন্সগুলাের সিংহভাগ কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের আমদানিকারকদের হাতে চলে যায়, তা আমরা লক্ষ করেছি। আমদানি রেশনিংয়ের পদ্ধতিটা এসেছে আমদানির অধিকার কাদের রয়েছে, সেটা স্থির করার ব্যবস্থা থেকে। সেটার ভিত্তি ছিল ১৯৫০এর দশকের গােড়ার দিকের ওজিএল নীতি, যে জন্য আমদানির বেশির ভাগ চলে গিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। এ ব্যবস্থার অধীনে পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে সৃষ্ট আদি বৈষম্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থায়ী হয়ে পড়ে।৮৪ ১৯৫০-এর দশকের শুরুতে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প স্থাপনের জন্য যেসব আমদানি লাইসেন্স দেওয়া হয়, সেগুলাে পরবর্তীকালে শিল্পে কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানকে আমদানি অধিকারের বৃহত্তর হিস্যা প্রদানের ভিত্তিতে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে ৯০% বাণিজ্যিক আমদানি লাইসেন্স দেওয়ার সচেতন নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পূর্ব পাকিস্তান থেকে নতুন আমদানিকারক গ্রহণ (বাঙালি) এবং কিছুকালের জন্য কেবল পূর্বাংশেই শিল্প স্থাপনের অনুমতিদান ছাড়া এ ব্যবস্থার অধীনে আমদানির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান যে পশ্চিম পাকিস্তানের সমপর্যায়ে যেতে পারবে, তার কোনাে উপায়ই ছিল না। অনুরূপ হস্তক্ষেপমূলক ব্যবস্থা স্পষ্টতই রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযােগ্য হতাে না এবং পশ্চিম পাকিস্তানে আমদানির সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ব্যবধান বেড়ে চলার দরুন গুরুতর বাজারসমস্যাও সৃষ্টি করত।
বিনিময় হার নীতিতে এই বিকৃতি এবং আমদানির অধিকার বরাদ্দে বিভেদাত্মক নীতির ফল আরও অবনতির দিকে যায় এ কারণে যে পূর্ব পাকিস্তানে বাণিজ্যিক ও শিল্প খাতে আমদানিকারক হিসেবে যােগ্য বিবেচিত হওয়ায় মূলত অবাঙালিরাই উপকৃত হয়। সুতরাং এই বাণিজ্যিক ও বিনিময় হার নীতি কেবল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পদ বরাদ্দের ব্যাপারেই অবিচার করেনি, পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে বাঙালি পাট উৎপাদনকারী ও অবাঙালি শিল্পপতি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বরাদ্দের ক্ষেত্রেও অবিচার করেছে। বাণিজ্যঘাটতি পূরণে অর্থসংস্থান বাজারের স্থান ও কার্যকারণ সম্পর্কের বর্ধিষ্ণু গতিময়তার যুক্তি কিছুটা বেশি সহনীয় হতাে যদি পূর্ব পাকিস্তান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস না হতাে। ১৯৪৭-৪৮ ও ১৯৬৯-৭০-এর মধ্যে পাকিস্তানের মােট রপ্তানি আয়ের ৫৫ শতাংশ অর্জন করে পূর্ব পাকিস্তান।৮৫ ২৩ বছরের মধ্যে মাত্র ৬ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের রপ্তানি আয় পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে বেশি ছিল। এর মধ্যে ৩ বছর ছিল ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৫২-৫৩ পর্যন্ত। শেষ তিন বছরে অর্থাৎ ১৯৬৭-৬৮ থেকে ১৯৬৯-৭০ পর্যন্ত পশ্চিমাংশে বহু বছর ধরে উচ্চ হারে শিল্প বিনিয়ােগের সুফল পাওয়া যেতে থাকে রপ্তানির ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি ও রপ্তানি কাঠামাের অধিকতর বৈচিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৩-৬৪ ও ১৯৬৪-৬৫ বাদে ১৯৪৭-৪৮ ও ১৯৬৬-৬৭ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে আমদানির চেয়ে রপ্তানিতে একটানা উদ্বৃত্ত থাকে। শুধু শেষ তিন বছরে ১৯৬৭-৬৮ থেকে ১৯৬৯-৭০ পর্যন্ত আমদানি বৃদ্ধি ও রপ্তানিতে স্থবিরতার দরুন পূর্ব পাকিস্তানে বৈদেশিক বাণিজ্যের হিসাবে ঘাটতি দেখা যায়। সে তুলনায় পুরাে ২৩ বছরের মধ্যে ১৯৫০-৫১ ছাড়া বাকি প্রতিটি বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি বিদ্যমান ছিল। পশ্চিমের ২৩.২ বিলিয়ন টাকার ঘাটতির তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের মােট উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫.৫ বিলিয়ন টাকা। ৮৬ আঞ্চলিক বাণিজ্যের হিসাবে উপরিউক্ত অসমতা থেকেই এ ধারণার সৃষ্টি হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের দ্রুততর শিল্পায়ন, শিল্পের বিকাশ ও বৈচিত্র্য সাধনের খরচ জোগানাের জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে সম্পদ স্থানান্তরিত হয়েছে, বিশেষ করে ১৯৫০-এর দশকে। | পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আন্ত-অঞ্চল বাণিজ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত ছিল। স্থায়ী ব্যাপার। এই অসমতা পরবর্তী সময়ে এবং ১৯৬০-৭০ সাল নাগাদ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মােট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭.৫ বিলিয়ন টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানিরা দাবি করত যে বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ স্থানান্তরের ক্ষতি আংশিকভাবে পুষিয়ে দেওয়া হতাে দুই অংশের আন্ত-অঞ্চল বাণিজ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত দ্বারা।
বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা এ যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে পূর্ব-পশ্চিম অংশের বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উদ্বৃত্তগুলাে টাকার অতিরিক্ত মূল্যায়নের কারণে তুলনীয় নয়। তার পরও পাকিস্তানে পুঁজিদ্রব্য উৎপাদন শিল্পের অনুপস্থিতিতে উন্নয়ন ও কাঠামােগত পরিবর্তন চালিয়ে যাওয়ার প্রয়ােজনে একমাত্র বৈদেশিক মুদ্রায় ওসব দ্রব্যাদি কিনতে হতাে বলে টাকার উদ্বৃত্তের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার উদ্বৃত্তের তুলনা করা চলে না।
বৈদেশিক সাহায্য ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য
বৈদেশিক সাহায্য বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্তির একটা বড় উৎস হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা জটিল আকার ধারণ করে। ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিক থেকে পাকিস্তান তার উন্নয়ন-তৎপরতা অব্যাহত রাখার জন্য বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ক্রমেই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান ৭০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ঋণ ও মজুরি পায়।৭ এর ৫.৬ বিলিয়ন ডলার আসে ঋণ হিসেবে এবং ১.৪ বিলিয়ন ডলার মঞ্জুরি হিসেবে। ঋণ তহবিলের ২ বিলিয়ন ডলার ছিল প্রজেক্ট সাহায্য, ০.৯ বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টবহির্ভূত সাহায্য এবং ০.১৫ বিলিয়ন ডলার আসে মার্কিন পিএল ৪৮০-এর অধীনে খাদ্য ও পণ্যঋণ হিসেবে। মঞ্জুরি তহবিলের বেশির ভাগই খাদ্যসাহায্য। তবে তার মধ্যে কিছু প্রজেক্ট ও পণ্য-সাহায্যও ছিল। ৫ নম্বর সারণিতে এ সাহায্য ও ঋণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কীভাবে বরাদ্দ করা হয়েছে, তা দেখানাে হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণে দেখা যায় যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল। পর্যন্ত পাকিস্তানকে প্রদত্ত ৭.৬ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অর্থনৈতিক সাহায্য থেকে পূর্ব পাকিস্তান পায় ২.০২ বিলিয়ন (২৬.৬%)। ১৯৪৭-৭০-এর মধ্যে প্রদত্ত তহবিলের প্রায় ৬.৪ বিলিয়ন ডলার কাজে লাগানাে হয়। তা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কাজে লাগানাে হয় ১.৯ বিলিয়ন ডলার (৩০%)। বিদেশি সাহায্য পাকিস্তানের উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে দেখা দেয়। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যে পাকিস্তানে উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯১.৯৪ বিলিয়ন টাকা। হিসাবে দেখা যায়, এর ৬১.৫৮ বিলিয়ন টাকা অর্থাৎ ৬৭ শতাংশই ছিল প্রদত্ত বৈদেশিক সাহায্য।৯০ পশ্চিম পাকিস্তানের মােট ৬২ বিলিয়ন টাকা উন্নয়ন ব্যয়ের শতকরা ৬৮ ভাগই ছিল বৈদেশিক সাহায্য। পূর্ব পাকিস্তানের ৩০ বিলিয়ন টাকা উন্নয়ন ব্যয়ের ৬৪.৫% ছিল বৈদেশিক সাহায্য। কাজেই এটা পরিষ্কার যে উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রদত্ত বৈদেশিক সাহায্য ও তা ব্যয়ের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পর্কিত ছিল। আমরা লক্ষ করেছি, পূর্ব পাকিস্তান ব্যয়িত বৈদেশিক সাহায্যের ৩০ শতাংশ এবং মােট উন্নয়ন ব্যয়েরও ৩০ শতাংশ লাভ করে। এভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে বৈষম্যমূলকভাবে বৈদেশিক সাহায্যের অর্থ প্রদান ও ব্যয় দুই অঞ্চলের বিদ্যমান বৈষম্যকে প্রভাবিত করে। সুতরাং এটা মােটেই আশ্চর্যজনক নয় যে বৈদেশিক সাহায্য হাতে পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য বাঙালিদের বঞ্চনাবােধকে আরও তীব্র করে তােলে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যের ন্যায্য হিস্যা পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক আত্মসাতের প্রশ্নে উত্তপ্ত বিতর্কের জন্ম দেয়।
পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ স্থানান্তর । পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক সাহায্যের অংশ পশ্চিম পাকিস্তানকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটি সম্পদ স্থানান্তরের প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৫০-এর দশকে বাঙালিরা বিশ্বাস করত যে তাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। এই স্থানান্তরের দরুন পূর্ব পাকিস্তানের যে ক্ষতি হয়, সেটা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের। বাণিজ্যঘাটতি দ্বারা পূরণ হয়নি। যা-ই হােক, এর সঙ্গে যদি আমরা পশ্চিম পাকিস্তানকে ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য বৈদেশিক সাহায্যের অংশকে যােগ করি, তাহলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ স্থানান্তরের অধিকতর ব্যাপক পরিমাণ পাওয়া যেতে পারে। এসব বিতর্কের অংশবিশেষের মধ্যে ধারণাগত বিভ্রান্তি ও হিসাবের গুরুতর সমস্যা দেখা যায়। চতুর্থ পরিকল্পনার প্যানেলভুক্ত বাঙালি অর্থনীতিবিদগণ অত্যন্ত সুনিশ্চিতভাবে এটা স্পষ্ট করে দেন। ১৯৪৯-৫০ ও ১৯৬৯-৭০-এর মধ্যে সব বছরে পাকিস্তানি টাকার যে অতিরিক্ত মূল্যায়ন হয়েছে, তার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অঙ্কে টাকার মূল্য নির্ধারণ করে তারা আন্ত-অঞ্চল ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেনের একটা কাছাকাছি হিসাব দাঁড় করাতে সক্ষম হন। ৬ নম্বর সারণিতে আমরা অর্থনীতিবিদ প্যানেলের তৈরি আঞ্চলিক ব্যালেন্স অব পেমেন্টের মােটামুটি হিসাব তুলে ধরব। ১৯৬০-৬১ পর্যন্ত দায় পরিশােধের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত থাকে এবং সেটা অধিক মূল্যের হিসাবে ৫.৪ বিলিয়ন টাকায় পৌছায়। পশ্চিম পাকিস্তানের ঘাটতি দাঁড়ায় ২১ বিলিয়ন টাকা। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে উভয় অঞ্চলেরই ঘাটতি হয়, যদিও পশ্চিম পাকিস্তানে ঘাটতি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে ৩.৭ গুণ বেশি। উভয় অঞ্চলের ঘাটতি পূরণ হয় বৈদেশিক সাহায্য দ্বারা। পশ্চিম পাকিস্তান এভাবে বৈদেশিক সাহায্যের বৃহত্তর হিস্যা লাভ করে। ১৯৬০-এর দশকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্য ও পেমেন্টের উদ্বৃত্ত এবং তৎসহ সব বৈদেশিক সাহায্য আত্মসাৎ করে এবং এর জন্য আন্ত-অঞ্চল রপ্তানির মাধ্যমে আংশিকভাবে মূল্য দিতে থাকে।
১৯৫০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানে উদ্বৃত্ত থাকার কারণে এখান থেকেই সম্পদ রপ্তানি হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান কোননা। বৈদেশিক সাহায্য পায়নি। পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যের প্রাপ্ত হিস্যা। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক আত্মসাকরণের মাধ্যমেই পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদের স্থানান্তর ঘটে। বৈদেশিক সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য হিস্যা ও প্রাপ্ত। হিস্যার পার্থক্য থেকেই বৈদেশিক সাহায্যের কাজে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সম্পদ। স্থানান্তরের হিসাব পাওয়া যায় । ৭ নম্বর সারণিতে আমরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ। স্থানান্তরের একটা প্রাক্কলন পেশ করব। অঙ্কগুলাে প্যানেলের বাঙালি। অর্থনীতিবিদদের তৈরি হিসাব থেকে নেওয়া। সারণিতে দেখা যাবে যে ১৯৫০এর দশকে দায় পরিশােধের উদ্বৃত্ত থাকার কারণে ও বৈদেশিক সাহায্যের প্রাপ্য। হিস্যা পশ্চিম পাকিস্তানকে দেওয়ার কারণে পূর্ব পাকিস্তান ৮.৯৬ বিলিয়ন টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করে। তবে ১৯৬০-এর দশকে দায় পরিশােধের। হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের ঘাটতি ছিল। কিন্তু তবু পূর্ব পাকিস্তান তার বৈদেশিক সাহায্যের প্রাপ্য হিস্যা থেকে ১২.২ বিলিয়ন টাকা ছেড়ে দেয়, যার ফলে। স্থানান্তরের পরিমাণ ১৯৫০-এর দশকের তুলনায় বেশ কিছুটা কম থাকে। ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত বিশ বছরে পূর্ব পাকিস্তান মােট ১১.৮ বিলিয়ন টাকার সম্পদ স্থানান্তর করে, যা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে নিয়ােজিত। হয়। ওটা ছিল ওই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মােট উন্নয়ন ব্যয়ের ১৯ শতাংশ। ওই ১১.৮ বিলিয়ন টাকা পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য ব্যবহৃত হলে এ অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ৩৯ ভাগ বৃদ্ধি পেত। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে উচ্চতর অনুপাতে সম্পদ সমাবেশের ক্ষমতার কারণেই পশ্চিম পাকিস্তানে দ্রুততর গতিতে উন্নয়ন ঘটেছে এমন ধারণা গুরুতর ভ্রান্তিপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের সঞ্চয় ও বৈদেশিক সাহায্যের হিস্যাই। পশ্চিম পাকিস্তানকে তার সাধ্যের বাইরে উন্নয়ন সাধনে সক্ষম করে তােলে। ১৯৬০-৬৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের ০.৯%-এর তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের সঞ্চয়ের হার ছিল ৪.৩%।
পাকিস্তানের আপেক্ষিকভাবে অধিক পশ্চাৎপদ ও অধিক জনসংখ্যা-অধ্যুষিত। অঞ্চলটি তার সম্পদসমূহ ও গােটা দেশের নামে আনীত তার বৈদেশিক সাহায্যের হিস্যা পাকিস্তানের অধিকতর উন্নত অংশের উন্নয়নের জন্য ছেড়ে দেয়—এটা। সত্যি একটি নির্মম পরিহাস। ন্যায়পরায়ণতা ও গণতন্ত্র এর উল্টোটাই দাবি করত। কাজেই সম্পদ স্থানান্তরের বিষয়টি যে তিক্ত বিতর্কের প্রশ্নে পরিণত হয় এবং বাঙালিদের মধ্যে বঞ্চিত হওয়ার চেতনাকে আর যেকোনাে কিছুর চেয়ে বেশি বদ্ধমূল করে দেয়, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। ফেডারেল ফিন্যান্সের সমস্যা বাণিজ্যিক ও বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ তাে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অসমতা স্থায়ীকরণের একটা প্রধান মাধ্যমরূপে বিদ্যমান ছিলই, তার পাশাপাশি ফেডারেল ফিন্যান্স ব্যবস্থা ছিল আর একটা সমান্তরাল মাধ্যম। ফেডারেল বাজেটে রাজস্ব সংগৃহীত হয় উভয় অঞ্চলে রাজস্ব আদায় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলাের উদ্বৃত্ত থেকে। পরে এসব রাজস্ব কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা প্রাদেশিক সরকারগুলাে দ্বারা দুই অঞ্চলের যেকোনাে অঞ্চলে ব্যয়িত হয়। একটি কারণ ছাড়া রাজস্ব সংগ্রহের হিসাব নিরূপণে স্বাভাবিকভাবে কোনাে সমস্যা ছিল না। সেই কারণটি হচ্ছে এই যে পশ্চিম পাকিস্তানে সদর দপ্তর, কিন্তু ব্যবসা করে উভয় অঞ্চলে এমন বহু কোম্পানি তাদের রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করিয়ে নিত তাদের সদর দপ্তরের মাধ্যমে। তার পরও জাহাজযােগে পশ্চিম পাকিস্তানের যেসব তৈরি ও আধা তৈরি পণ্য প্রেরিত হতাে সেগুলাের কাস্টমস ও আবগারি কর অবশেষে পূর্ব পাকিস্তানি ভােক্তাদেরই দিতে হতাে। কেন্দ্র তা সংগ্রহ করত পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত আমদানিকারক ও প্রস্তুতকারীদের কাছ থেকে। হিসাবটা এমনভাবে করা হতাে যাতে পূর্বাংশে প্রকৃতপক্ষে সংগ্রহকৃত রাজস্ব আঞ্চলিক অ্যাকাউন্টে এলে তখন জমা দেখানাে হয়েছে তার ১০ ভাগ কম। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজস্ব সংগ্রহের প্রকৃত প্রাক্কলনে পশ্চিম পাকিস্তানে সংগ্রহের উচ্চ হার দেখা যায়। ১৯৬১ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে ২২%।৯২ ১৯৬৫-৬৬ থেকে ১৯৬৭৬৮ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, ওই তিন বছরে পূর্ব পাকিস্তানে ২৫.৫% থেকে ২৯.৮% পর্যন্ত কেন্দ্রীয় রাজস্ব সংগৃহীত হয়। কেন্দ্রীয় রাজস্ব সংগ্রহ উৎপাদন, বিক্রয় ও আয়ের ওপর কাস্টমস শুল্ক ও করভিত্তিক হওয়ায় এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এটা আমদানি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্থানের ব্যাপারে আঞ্চলিক বৈষম্যকে প্রতিফলিত করে। সুতরাং কেন্দ্রীয় রাজস্ব ভান্ডারে পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চতর অবদান থেকে উন্নয়ন-বৈষম্যের আরেকটি পরিমাপই শুধু পাওয়া যায়।
বৈষম্যের উৎসরূপে রাষ্ট্র
প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক বাণিজ্য খাতের মতাে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রেও পশ্চিম পাকিস্তানে ঘাটতি ছিল বিরাট। ৪ নম্বর সারণিতে সরকারি রাজস্ব ব্যয়ের পর্যালােচনা দ্বারা এটা তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায় যে ১৯৪৯-৫০ থেকে ১৯৬৯-৭০ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের পরিমাণ মাত্র ২৩%। তার মানে হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তান রাজস্ব খাতে যা দিয়েছিল, তার চেয়ে সামান্য কম পেয়ে জমা-খরচের সমতার দিকে যাচ্ছিল। পক্ষান্তরে, পশ্চিম পাকিস্তান ফিরে পাচ্ছিল একটু বেশি। কার্যত রাজস্বের হিসাবে এই উদ্বৃত্ত ও ঘাটতির মানে তেমন বেশি কিছু ছিল না, যেহেতু | উন্নয়নের বৃহত্তর অংশের জন্য অর্থ জোগাত বৈদেশিক সাহায্য। যা-ই হােক, আমরা আগেই লক্ষ করেছি যে পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চতর মাত্রায় রাজস্ব ব্যয় সেখানকার অধিবাসীদের জন্য চাকরির অধিকতর সুযােগ ও অর্থনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার কার্যকর চাহিদা সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। স্বাধীনতার পথ এ অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে পাকিস্তান রাষ্ট্র আঞ্চলিক বৈষম্য সৃষ্টি ও তাকে স্থায়ী। করার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। রাজস্ব ও উন্নয়ন খাতে এর সরকারি ব্যয় বরাদ্দের নীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দের নীতি সর্বদা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছে। বিনিময় হার ও আমদানিসংক্রান্ত নীতি-পদ্ধতি বেসরকারি খাতের জন্য একটা উৎসাহদায়ক কাঠামাে সৃষ্টি করে, যা ছিল কৃষির চেয়ে শিল্পের প্রতি এবং বাঙালিদের চেয়ে অবাঙালিদের প্রতি বেশি অনুকূল। সুতরাং পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন, কার্যকলাপ ও রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােকপাত করেই আলােচনার ইতি টানা ঠিক হবে । গণতন্ত্র ও বৈষম্য রাষ্ট্রযন্ত্রের গঠন অধিকতর প্রতিনিধিত্বমূলক হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যগুলাে অপেক্ষাকৃত বেশি সহনীয় হতাে। পাকিস্তান রাষ্ট্র তার গােটা অস্তিত্বকালে দেশ শাসনে বাঙালিদের কার্যকর ভূমিকা পালন করা থেকে বঞ্চিত রাখে। পাকিস্তানের পুরাে আমলব্যাপী প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলাে ছিল বশংবদ।
১৯৪৭ ও ১৯৭১-এর মধ্যে ব্যালটের মাধ্যমে কেন্দ্রে একবারও ক্ষমতার | পরিবর্তন ঘটেনি। কাজেই এ সিদ্ধান্তে পৌছা সঠিক হবে যে পাকিস্তানের জন্মের
পরবর্তী কয়েক বছর বাদে বাকি সময়ে কোনাে কেন্দ্রীয় আইনসভা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে গঠিত ছিল না। | পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগুরু। ভােটারসংখ্যার দিক থেকেও তাদের ছিল সংখ্যাধিক্য। প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলাের অনুপস্থিতি তাদের জন্য ছিল সবচেয়ে ক্ষতিকর। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণভার বাঙালিরা কেউ কোনাে পর্যায়ে পায়নি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে অর্ধেক সময়ের জন্য। বাঙালিরা প্রধানমন্ত্রীরূপে কাজ করে। কিন্তু তাদের মধ্যে দুজন ছিল সাক্ষীগােপাল এবং একজন একটি কোয়ালিশনের সংখ্যালঘু অংশীদাররূপে ক্ষমতাসীন। কিন্তু আইনসভার কোনাে তােয়াক্কা না করে মাত্র ১৩ মাসের মধ্যে শেষােক্ত জনকে অপসারণ করা হয়। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পশ্চিম। পাকিস্তান দুজন সৈনিক প্রেসিডেন্ট জোগায়। তারা কেন্দ্রে অবিসংবাদী ও সীমাহীন ক্ষমতা ভােগ করেন। প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলাের দুর্বলতার দরুন এবং জাতীয় আইনসভাগুলাের গুরুত্ব না থাকার কারণে পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র, সশস্ত্রবাহিনী এবং শেষ দিকে ভূস্বামী ও ব্যবসায়ীশ্রেণি কর্তৃক কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়। ওই ব্যবসায়ীরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপােষকতা পেয়ে প্রবল হয়ে উঠেছিল। ফেডারেল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। কেন্দ্রীয় সরকার কেবল অভ্যন্তরীণ রাজস্বের মূল উৎসগুলাে এবং বৈদেশিক সাহায্য ও রপ্তানি আয় বরাদ্দের ক্ষমতাই হাতে রাখেনি, অর্থনীতিসংক্রান্ত সব প্রধান নীতিনির্ধারক সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে থাকে।
ফলে প্রাদেশিক সরকারগুলাে। ছিল কেন্দ্রের সৃষ্ট পুতুল। কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণভাবে আমলাতন্ত্র ও সশস্ত্রবাহিনীগুলাের কর্তৃত্বাধীন ছিল। এমন প্রতিষ্ঠানে, বিশেষত তাদের উচ্চতর স্তরে প্রাধান্য ছিল পশ্চিম। পাকিস্তানিদের। ৮ নম্বর সারণিতে কেন্দ্রের ক্ষমতাকাঠামাের গঠন কী রকম ছিল, তার একটি চিত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার উচ্চতর স্তরগুলাে থেকে। বাঙালিদের কোটার পরিমাণ বাদ দিয়ে রাখা হয়েছিল। তা ওই সারণিতে কম। করে দেখানাে হয়েছে। পাকিস্তান ছিল মূলত অতি-কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন একটি অপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার। আইয়ুব খান ও পরে ইয়াহিয়া খানের মতাে সর্বময়। ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট থাকার মানে হচ্ছে বাঙালিদের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সম্পূর্ণ বাইরে রাখা। পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনাে বাঙালি অর্থমন্ত্রী হননি কিংবা বৈদেশিক সাহায্যসংক্রান্ত আলাপ-আলােচনা নিয়ন্ত্রণকারীর পদে কোনাে বাঙালি কখনাে নিযুক্ত হননি। ১৯৭১ সালে পরিকল্পনা কমিশন বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু সে অবধি কোনাে বাঙালি পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হননি। কোনাে বাঙালি কেন্দ্রীয় সরকারের কোনাে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি হননি। শুধু ১৯৬৯ সালে একজন বাঙালি প্রথমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্ত হন। ১৯৭০ পর্যন্ত কোনাে বাঙালি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হননি। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতাে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কোনাে বাঙালি যুগ্ম সচিবের পদ পর্যন্ত উঠতে পারেননি। আর সশস্ত্রবাহিনীগুলাে তাে ছিল কমবেশি পশ্চিম পাকিস্তানিদেরই একচেটিয়া। কাজেই এ কথা বলা মােটেই অত্যুক্তি হবে না যে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বাঙালিদের অত্যন্ত কার্যকরভাবে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের উচ্চতর এবং এমনকি মাঝারি পদ থেকে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রগুলাে থেকে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক নীতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কেন্দ্রগুলাে থেকে দূরে রাখা হয়েছিল।
প্রাদেশিক সরকারকে ঠুটো জগন্নাথ করে রাখা ১৯৫০-এর দশকে কেন্দ্রের প্রাথমিক কুকর্ম-অকর্মগুলাে পূর্ব বাংলার প্রথম মুসলিম লীগ সরকার নিষ্ক্রিয় দর্শকের মতাে প্রত্যক্ষ করে। এগুলােই আন্তআঞ্চলিক বৈষম্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। ওই প্রাদেশিক সরকারের প্রতিনিধিত্বমূলক মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার দরুন তার কেন্দ্রকে মােকাবিলা করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। ১৯৫৪-৫৮ সালে যুক্তফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগ শাসনের কালে কেন্দ্রের কাছ থেকে সম্পদ দাবি ও প্রদেশের ক্ষমতা রক্ষার কিছু প্রচেষ্টা দেখা যায় । কিন্তু ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে প্রাদেশিক সরকারগুলাের অধীন প্রাদেশিক আমলাতন্ত্রের উচু পদগুলােতে বসে ছিল অবাঙালিরা। সংস্কৃতি ও চাকরিসূত্রে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এই অবাঙালি অফিসাররা কেন্দ্রের মােকাবিলায় তাদের বাঙালি মন্ত্রীদের খুব কমই সমর্থন দিতেন। আওয়ামী লীগ সরকার আমলাতন্ত্রের বাইরে গিয়ে প্রবীণ বাঙালি অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটা পরিকল্পনা বাের্ড গঠনের প্রয়াস নেয়। কিন্তু তাদের এসব প্রচেষ্টা প্রাদেশিক প্রশাসনকে অবাঙালি আমলাদের কবলমুক্ত করতে অথবা কেন্দ্রের সঙ্গে তাদের আমলাতান্ত্রিক সংযােগ বিচ্ছিন্ন করতে সফল হয়নি। ফলে প্ল্যানিং বাের্ড প্রাদেশিক প্রশাসনের মধ্যকার একটি নতুন কর্তৃত্বের উৎসরূপে কাজ করতে না পেরে কেন্দ্রের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৈঠকে বাঙালিদের দাবিদাওয়া নিয়ে ওকালতির একটি সংস্থায় পরিণত হয়।
১৯৬০-এর দিকে বাঙালিরা প্রাদেশিক সচিবের পদ লাভ করতে শুরু করার পর কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পদ বরাদ্দসংক্রান্ত বিতর্কে বাঙালিদের দাবি-উত্থাপনের অধিকতর সচেতন প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে সামরিক আইন প্রবর্তন এবং জাতীয় ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি প্রধান নির্বাহীর কুক্ষিগত হওয়ার পর কেন্দ্র ও প্রদেশ উভয় স্তরে বাঙালি মন্ত্রী ও প্রাদেশিক গভর্নরদের চাকরি প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা বা খেয়ালখুশির অধীন হয়ে পড়েছিল। তাদের প্রতিনিধিত্বমূলক মর্যাদা কিংবা রাজনৈতিক সমর্থন না থাকায় অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির প্রাধান্যের বলয়ে আমলাদের এমন একটা অবস্থার মধ্যে কাজ চালাতে হয়, যেখানে বাঙালি মন্ত্রীরা কেন্দ্রের সঙ্গে যেকোনাে মােকাবিলার সময় এলেই তাদের রক্ষা করতে পারতেন না। প্রাদেশিক প্রশাসনের ক্ষমতাহীন ও সম্পদহীন প্রকৃতির দরুন অনুরূপ ওকালতির সুযােগ এমনিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রদেশে ও কেন্দ্রের কর্মরত বাঙালি আমলারা এভাবে প্রায় ক্ষেত্রেই গােপন তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করতে পেরেছেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষ সমর্থনকারী। অর্থনীতিবিদদের পরামর্শদাতায় পরিণত হয়েছেন।
ব্যবসা খাতে বাঙালিদের কোণঠাসা অবস্থা পাকিস্তানের ইতিহাসের গােটা সময়টায় বাঙালিরা অনুভব করে যে তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রধান উৎস, যথা প্রেসিডেন্ট পদ, আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীর প্রধান প্রধান পদ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। সত্যিই তাদের এসব পদের বাইরে রাখা হয়েছিল। জাতীয় ক্ষমতা-কাঠামাের মধ্যে জাদরেল অবাঙালি ব্যবসায়ীদের উত্থানও বাঙালিদের জোর দিয়ে কথা বলার কোনাে সুযােগ দেয়নি। যে ৪৩টি পরিবার পাকিস্তানি অর্থনীতির ওপর প্রভুত্ব করত, তাদের মধ্যে একজন মাত্র বাঙালি ছিলেন এ কে খান । ১৯৫৯-এর এক জরিপে দেখা গেছে যে পাকিস্তানের সব শিল্প-পরিসম্পদের মাত্র ২.৫ ভাগ ছিল বাঙালি মুসলমানদের হাতে ৯৫ সে পর্যায়ে সেসব বাঙালি হিন্দু পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবসা করত তাদের হাতে ছিল পরিসম্পদের শতকরা ৮.৫ ভাগ। এতে বাঙালি মালিকানাধীন পরিসম্পদ দাড়ায় ১১%। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকের গােড়ার দিকে হিন্দু মালিকানাধীন এসব পরিসম্পদ ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল এবং তাদের কাজকারবারগুলাে অবাঙালি মুসলিমরা দখল করে নিচ্ছিল । ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর সব ‘হিন্দু পরিসম্পদ (মাড়ােয়ারিদের ২.৫%-এর যা কিছু অবশিষ্ট ছিল সেসবসহ) ১৯৬৫ সালের শত্ৰু-সম্পত্তি অর্ডিন্যান্সের বলে বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়। এতে কার্যত বাঙালিদের হাতে থাকে শিল্প-পরিসম্পদের শতকরা ৫ ভাগেরও কম। এভাবে বাঙালিদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সব ধাপের বাইরে রাখার কাজটি পুরােপুরি সম্পন্ন হয়। ক্লীব ও প্রতিনিধিত্বহীন রাষ্ট্রীয় আইনসভায় বাঙালিদের ৫০ শতাংশ আসন ছিল বটে, কিন্তু তাদের মন্ত্রীরা একজন পশ্চিম পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের খেয়ালখুশির অধীন থাকায় বাঙালিরা বরাবর পাকিস্তানের ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে অবস্থান করে।
বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম
পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক জীবনে বাঙালি জনগণকে সুস্পষ্টভাবে বঞ্চিত করার ফলে বাঙালিরা জাতীয় ক্ষমতা থেকে তাদের বাইরে রাখার ব্যাপারটিকে আঞ্চলিক বৈষম্যের সঙ্গে একটি শক্তিশালী কেন্দ্র কর্তৃক একচেটিয়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করে। একটি অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলাে পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছিল জাতীয় ক্ষমতার হিস্যা লাভকল্পে বাঙালিদের দ্বারা পরিচালিত সংগ্রামেরই অংশ। কিন্তু ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল প্রবর্তনের ফলে ১৯৫৯ সালের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বানচাল হওয়া, ১৯৬২ সালে প্রদেশগুলােকে কোনাে ক্ষমতা না দিয়ে প্রধান নির্বাহী ও কেন্দ্রের হাতে সময় ক্ষমতা দিয়ে সংবিধান প্রণয়ন এবং প্রত্যক্ষ ভােটের অধিকার হরণ বাঙালিদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম দেয় যে তারা জাতীয় ক্ষমতার হিস্যা কখনাে পাবে না। ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগ নেতা এইচ এস সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যু সেই একমাত্র ব্যক্তিটিকে দৃশ্যপট থেকে অপসারিত করে, যার একটি জাতীয় নির্বাচকমণ্ডলী ছিল এবং যিনি জাতীয় ক্ষমতা পেতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগে তার, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে উত্তরাধিকারীদের বিশ্বাস করার কারণ ছিল। যে বাঙালিরা কোনাে দিন জাতীয় ক্ষমতা পাবে না এবং কেন্দ্রের কাছ থেকে কখনাে ন্যায়বিচার পাবে না। এ রকম ধারণার যৌক্তিকতা নিয়ে আলােচনার সুযােগ এখানে নেই। তবে এটা ১৯৬০-এর দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উদীয়মান নেতাদের প্রভাবিত করে। এ রকম একটা ধারণা বা বােধ থেকেই লক্ষ করা যায় যে ১৯৬৫ সালের সীমাবদ্ধ ভােটাধিকারের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে বিরােধীপক্ষ আইয়ুব খানকে আসনচ্যুত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ এবং বেশির ভাগ অন্য দল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামের তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ােগ করে। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় আন্দোলন শুরু করার উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালে লাহােরে অনুষ্ঠিত বিরােধী নেতাদের এক গােলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ একটি ছয় দফাসংবলিত স্বায়ত্তশাসন কর্মসূচি পেশ করে। পাকিস্তানের জনগণের উদ্দেশে ঘােষিত ছয় দফা।
দেখিয়ে দেয় যে বাঙালি নেতৃত্ব আইয়ুবের অপসারণের মাধ্যমে জাতীয় ক্ষমতা দখলের চেয়ে পাকিস্তানি শাসন থেকে বাঙালিদের মুক্তি এবং তাদের জন্য স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ব্যাপারেই অধিকতর আগ্রহী। | ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্যে বাঙালি মুসলিমদের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি নিহিত ছিল। ১৯৪৬-৪৭ সালে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার যে দাবি তুলেছিলেন এইচ এস সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম, তা-ও বাঙালি মুসলিমদের সেই দাবিরই পুনরুক্তি। লাহাের প্রস্তাবের পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলাে এবং সােহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা’ এই উভয় উদ্যোগের পেছনে এ ধারণাই কাজ করেছিল যে বাঙালিরা কখনাে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার হিস্যা পাবে না, কাজেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতে পারে একমাত্র স্বায়ত্তশাসন লাভের মাধ্যমে। ছয় দফার উৎপত্তি হয় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৯তম দফা থেকে। এতে বলা হয়েছিল : ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা এবং কেবল প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয়সমূহ ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে রেখে আর সব বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের বৈধ কর্তৃত্বাধীন নিয়ে আসা হবে। এমনকি প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা করা হবে, যাতে সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে এবং নৌবাহিনীর সদর দপ্তর থাকে পূর্ব পাকিস্তানে। প্রতিরক্ষার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তােলার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিসমূহ প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং বর্তমান আনসার বাহিনীকে পুরােদস্তুর
মিলিশিয়াতে পরিবর্তিত করা হবে। পরবর্তী ১২ বছরে ১৯৫৪ সালে উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসনের এ দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় এবং বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে সমগ্র পাকিস্তানের জনগণকে গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত রাখার দরুন ১৯৬৬ সালে এ দাবি আরও তীব্র ও চূড়ান্ত আকারে পুনরুজ্জীবিত হয়। ছয় দফার ২য় দফার ২১ দফার মতােই প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক কেন্দ্রের | এখতিয়ারে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মুদ্রাব্যবস্থার ওপর কেন্দ্রের এখতিয়ারকে সীমাবদ্ধ করা হয়। তৃতীয় দফায় মুদ্রা সম্পর্কে দুটো বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয় : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটো পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যােগ্য মুদ্রা থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে না, থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। অথবা দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা থাকবে কেন্দ্রের হাতে। কিন্তু শাসনতন্ত্রে এমন বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে। এ বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুই অঞ্চলে দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
বিগত এক যুগে কেন্দ্রনির্ধারিত মুদ্রানীতির অভিজ্ঞতা থেকেই এ দাবি তােলা হয়েছিল। ছয় দফা কর্মসূচিতে মুদ্রানীতিকে আঞ্চলিকভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে চাওয়া হয়েছিল অঞ্চলের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক তৎপরতাকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে। তৃতীয় দফায় ধরে নেওয়া হয় যে মুদ্রানীতির ওপর আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম হলে এ অঞ্চলে ব্যবসারত অবাঙালি ব্যবসায়ীরা তাদের পুঞ্জীভূত উদ্বৃত্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্থানান্তরিত করতে পারবে না, অর্থাৎ এ অঞ্চল থেকে পুঁজি পাচার নিয়ন্ত্রিত হবে। মুদ্রার অবাধ বা সহজ বিনিময়যােগ্যতা গ্রহণ ও পুঁজির আন্ত-অঞ্চল। চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরােপের কথাসহ দফাটি কিছুটা পরস্পরবিরােধী। বাণিজ্যিক নীতির পরিবর্তে মুদ্রানীতির মাধ্যমে সম্পদ স্থানান্তর নিরােধের এ ধারণা ছিল কিছুটা ভ্রান্তিপূর্ণ, যেহেতু এতে ধরে নেওয়া হয় যে সম্পদ স্থানান্তরের উপায় বাণিজ্যিক চ্যানেল নয়, মুদ্রাব্যবস্থা । ছয় দফার চতুর্থ দফা দাবি করে : সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা-কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে ফেডারেশনভুক্ত আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত রেভিনিউয়ের নির্ধারিত অংশ আপনা হতেই আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে জমা হয়ে যাবে। রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের ওপর এ মর্মে বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকবে। এ ব্যবস্থা দ্বারা খাজনা-ট্যাক্স-কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা বাংলাদেশে সম্পদ সৃষ্টির উপায়রূপে এবং উন্নয়নকে উৎসাহিত করার নীতিগত হাতিয়াররূপে কাজে লাগাতে চাওয়া হয়েছিল। এতে প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থের চাহিদা মেটাতে চেষ্টা করা হয়েছিল রাজস্বের একটা তােলা বা লেভিব্যবস্থার মাধ্যমে। শাসনতন্ত্রে এমন বিধান থাকবে যে আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত খাজনা-ট্যাক্স থেকে ফেডারেল সরকারের লেভি বা টাকা শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত হারে রিজার্ভ ব্যাংকে কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হয়ে যায়। ছয় দফার এ দফাই কয়েকটি কারণে অত্যধিক উদ্বেগ সৃষ্টি করে এবং বলা হয় যে এটাই নাকি ছয় দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ভণ্ডুল করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে কৃতসংকল্প করে তােলে।
কার্যত দফাটি প্রথম দিকে স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের জন্যই বেশি অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারত। দেশজ রাজস্ব থেকে স্বীয় উন্নয়নের তহবিল জোগানাের দায় নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে এ অঞ্চলের মধ্যে কার্যত আদায়কৃত জাতীয় রাজস্বের ৩০ শতাংশের ওপর নির্ভরশীল করতে হতাে। উন্নয়নের নিজ স্তর এবং দুর্বল করভিত্তিক কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দায় গ্রহণ করার জন্য মােটা অঙ্কের রাজস্ব-উদ্বৃত্ত গড়ে তুলতে বাংলাদেশের অনেক সময় লেগে যেত। এমনকি প্রদেশগুলাে থেকে কেন্দ্রের জন্য দেয় লেভিকে আঞ্চলিক জিডিপির আকারের ভিত্তিতে আনুপাতিক করা হলেও পশ্চিম পাকিস্তান তার প্রতিরক্ষা স্থাপনাগুলােকে চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়ােজনীয় সব রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারত। অদ্ভুত শােনালেও সত্য এই যে কর ধার্য ও আদায়ের সব ক্ষমতা হাতে রেখেই একটি শক্তিশালী কেন্দ্র প্রতিরক্ষা বাজেটকে খর্ব করে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় রাজস্ব পুনর্বণ্টন করতে পারত। সে ক্ষেত্রে বার্ষিক বাজেট হয়ে দাঁড়াত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, কেন্দ্রীয় মঞ্জুরির জন্য প্রদেশগুলাের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দাবি এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধু-করাচির মতাে অপেক্ষাকৃত ধনী প্রদেশগুলাের নিজেদের অঞ্চলে সংগৃহীত রাজস্বের বৃহত্তর অংশ নিজেদের অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য রেখে দেওয়ার দাবির মধ্যে অবিরত দড়ি-টানাটানির খেলা। আঞ্চলিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় বাজেটের একটি লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সম্পদ হস্তান্তর করা। এই হস্তান্তর প্রশ্নে ছয় দফা দাবির চারসংখ্যক দাবিটি ছিল পাঞ্জাব ও সিন্ধুর জন্য এবং সেনাবাহিনীর জন্য সবচেয়ে বাস্তবমুখী প্রস্তাব। সেনাবাহিনীর জন্য চতুর্থ দফা স্বার্থহানিকর ছিল না এ জন্য যে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সংগৃহীত সেনাবাহিনীর রাজস্ব বাজেট ছিল সমাজতান্ত্রিকভাবে গ্যারান্টিযুক্ত। | পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের বিষয়ে ৫ নম্বর দফাটিই ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ।
এতে বলা হয় : ফেডারেশনভুক্ত ইউনিটসমূহে নিজ নিজ সরকারের অধীনে প্রতিটি ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখার জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকতে হবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা ফেডারেশনভুক্ত ইউনিটদ্বয় থেকে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হার অনুযায়ী আদায় হবে। ৫ম দফার এ অংশটি আপত্তিকর ছিল না। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানে রপ্তানি আয় যখন পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি ছিল, তখন এটা বৈপ্লবিক হতে পারত। কিন্তু ১৯৬৭-৬৮ সাল নাগাদ পশ্চিম পাকিস্তানের আয় কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল এবং তাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যের দরুন এ ব্যবধান তাদের অনুকূলে প্রসারিত হতাে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রপ্তানিদ্রব্য ও পাটজাত দ্রব্যাদি, যা থেকে তার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় ৯০% আসত, তা একটি বিশ্বব্যাপী ক্ষয়িষ্ণু শিল্পে পরিণত হচ্ছিল। ১৯৬৭-৬৮ থেকে ১৯৬৯-৭০ এই শেষ তিন বছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের হিসাবে প্রথমবারের মতাে পূর্ব পাকিস্তানে ঘাটতি হতে শুরু করে। কাজেই পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত আয় গ্রাস করার কোনাে সুযােগ ছিল না। পঞ্চম দফার যে প্রস্তাবটি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর পক্ষে হজম করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাড়িয়েছিল, তাতে বলা হয় : শাসনতান্ত্রিক বিধান অনুযায়ী দেশের বৈদেশিক নীতির সাহায্য-কাঠামাের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সাহায্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের ও আমদানি-রপ্তানি করার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারগুলাের হাতে ন্যস্ত থাকবে। এ প্রস্তাব পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতিদের গুরুতর ঝুঁকির সম্মুখীন করে। ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের আমদানি ৪৫ শতাংশ তারা সরবরাহ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানে তাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল তাদের মােট রপ্তানির ৪৮ শতাংশ। পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার এবং নিজের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের অধিকার থাকার মানে হলাে সর্বাধিক প্রতিযােগিতামূলক উৎসগুলাে থেকে তার আমদানির অধিকার থাকা। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেশি ভয় করছিল এ কারণে যে সে রকম হলে পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে সে রকম বিদেশি প্রতিযােগিতার সম্মুখীন হলে পশ্চিম পাকিস্তানি রপ্তানিকারকেরা অধিকতর প্রতিযােগী হতাে কি না, সেটা একটা তর্কের বিষয়। প্রকৃতপক্ষে, তা পূর্ব পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার অভাব টাকার অতিরিক্ত মূল্যায়ন বাতিল করে নির্ধারিত বিনিময় হার নীতির সহায়তায় দেশীয় টাকায় কাঁচা তুলা, তৈলবীজ, চাল ইত্যাদি পশ্চিম পাকিস্তানি দ্রব্যের কিছু চাহিদা বজায় রাখত।
সুতরাং, পূর্ব পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যের জন্য বিদেশের সঙ্গে আলােচনার অধিকারসংক্রান্ত প্রশ্নটিই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে অনুমান ছিল এই যে (ক) বাঙালি আলােচকেরা কেন্দ্রের কাছ থেকে পূর্ব। পাকিস্তান বৈদেশিক সাহায্যের যেটুকু পায়, তার চেয়ে অনেক বেশি আনতে পারবেন, এবং (খ) বিদেশ থেকে আলােচনার মাধ্যমে আনীত সেই সাহায্য কাজে লাগানাের অধিকার থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যের হিস্যা পশ্চিম পাকিস্তান হস্তগত করতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যের হিস্যা হারানাের ব্যাপারটা যদি পশ্চিম পাকিস্তানি সাহায্যসংক্রান্ত আলােচকেরা তাদের উচ্চতর আলােচনার দক্ষতা দ্বারা সামলাতে না পারতেন, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য উন্নয়ন ব্যয় অনেক বেশি পড়ে যেত। চতুর্থ পরিকল্পনার প্যানেলভুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদেরা এবং ১৯৬৯-৭০-এর কান্ট্রি মেমােরেন্ডামে বিশ্বব্যাংক উপরিউক্ত বক্তব্যই তুলে ধরে। উভয়ে যুক্তি দেখায় যে স্বীয় পুঁজি ও মধ্যবর্তী পণ্যাদি আমদানির অর্থ জোগানাের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যের কিছু কিছু অংশ আরও কয়েক বছর আত্মসাৎ করা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য প্রয়ােজন। ১৯৭০ সাল অবধি আন্ত-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক এ রকম ঔপনিবেশিক ও অদূরদর্শী। মনােভাব দ্বারা প্রভাবিত ছিল যে স্বায়ত্তশাসন পেলে পূর্ব পাকিস্তান তার বৈদেশিক সাহায্যের অর্থ ছাড়বে না এবং অত্যন্ত প্রতিযােগিতামূলক উৎসগুলাে থেকে প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি কিনবে। এ সম্ভাবনাই পশ্চিম পাকিস্তানিদের ছয় দফা দাবির বিরুদ্ধে তীব্রতম প্রতিবাদে মুখর করে তােলে। ওই সম্ভাবনা এবং প্রতিরক্ষা বাজেট সম্পর্কে সশস্ত্রবাহিনীগুলাের ভয়কে ঘিরেই হয়তাে বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির কাছে। অগ্রহণযােগ্য হয়ে উঠেছিল।
স্বায়ত্বশাসন থেকে স্বাধীনতা
১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালের মধ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতাদের ছয় দফা কর্মসূচির তাৎপর্য বােঝাতে এবং দাবির ওপর তাদের অবস্থানের দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠা করতে বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। এই পারস্পরিক ক্রিয়াটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর ফলে নেতারা বুঝতে সক্ষম হন। যে ছয় দফা কার্যোপযােগী এবং এ কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে একটা সংবিধান রচনা করা যেতে পারে। কিছু অজ্ঞাত কারণে ছয় দফা নিয়ে বিশদভাবে আলােচনায় বসা এবং তাদের সুনির্দিষ্ট আপত্তিগুলাে তুলে ধরার বিন্দুমাত্র আগ্রহ পশ্চিম পাকিস্তানি কোনাে নেতাই দেখাননি। না ইয়াহিয়া খান ও তার উপদেষ্টারা, না ভুট্টো ও তার সহযােগীরা। ১৯৭১-এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সঙ্গে আওয়ামী লীগের বৈঠক সাধারণ বিষয়ে মতামত-বিনিময় ও বাগ্মিতা প্রদর্শনে সীমাবদ্ধ থাকে এবং তাতে অর্থবহ কিছুই হয়নি। পিপিপি কিংবা ইয়াহিয়া ছয় দফার সমালােচনায় কোনাে বাস্তব যুক্তি তুলে ধরেননি। ছয় দফার ওপর বাস্তব আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় একমাত্র ১৯৭১ সালের সেই সংকটময় দিনগুলােতে, যখন ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হােসেনের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে আলােচনার জন্য জাস্টিস কর্নেলিয়াস ও কেন্দ্রীয় সরকারের লিগ্যাল ড্রাফটসম্যান কর্নেল হাসানসহ এম এম আহমদকে নিয়ে আসেন। আওয়ামী লীগের আলােচকদের সহায়তা করে বাঙালি অর্থনীতিবিদদের একটি দল। অর্থনীতিবিদেরা বৈঠকে উত্থাপিত সব অর্থনৈতিক প্রশ্ন নিয়ে আওয়ামী লীগের আললাচকদের সঙ্গে আলােচনা করেন। পাকিস্তানের অর্থনীতির এককালের ক্ষমতাবান ‘যুগল’ এম এম আহমদ ছয় দফার মূল অর্থনৈতিক দফাগুলাে মেনে নেন। প্রকৃত পক্ষে, উভয় আলােচক দল ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সাংবিধানিক পদ্ধতি সম্পর্কে | একটা ঐকমত্যে উপনীত হন। | তবে ওই সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে বাঙালি | জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটির নিষ্পত্তি করা হবে রক্ত আর গুলিগােলা দিয়ে, রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে নয়।
কিন্তু ২৩ মার্চ নাগাদ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে স্বায়ত্তশাসন কায়েম করে ফেলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে নির্বাচিত বাঙালি নেতারা সমসাময়িক ইতিহাসে প্রথমবারের মতাে বাংলাদেশ শাসন করছিলেন। তাদের আদেশ-নির্দেশ আমলাতন্ত্রের সব অংশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মেনে নিয়েছিল, কিন্তু অবাঙালি ব্যবসায়ীরা ছিল আনুগত্য প্রদর্শনে অত্যন্ত নারাজ। ১৯৭১ সালের ১ মার্চের মধ্যেই প্রজন্মের পর প্রজন্মের রাজনৈতিক সংগ্রাম যা অর্জন করতে পারেনি, সেটা অর্জিত হয়ে গিয়েছিল ১৯৭০-এর শেষে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য পরিচালিত প্রচার অভিযানে, দুই বছরের রাজনৈতিক আন্দোলন-সমাবেশের মধ্য দিয়ে। নির্বাচনী অভিযান হয়ে ওঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধাতুকে পিটিয়ে গঠন করার কামারশালা। ১৯৭১ সালের মার্চের স্বশাসন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইস্পাতকে কাঠিন্য প্রদানের নেহাই। ১৯৬৭ সালের মার্চ থেকে ১৯৭১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর রাজনৈতিক সমর্থকেরা এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাণীকে বাংলাদেশের প্রতিটি গৃহে পৌছে দেন। এ বাণীর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল অর্থনৈতিক বঞ্চনার প্রশ্ন এবং সমাপ্তিতে নিজেদের সমস্যা সমাধানে বাঙালিদের ক্ষমতাদানের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন-সমাবেশের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে ১৯৭১ সালের মার্চে স্বশাসনের প্রশ্নটি জোরদার হয়ে উঠেছিল। নির্বাচন স্বশাসনের জন্য রাজনৈতিক ম্যান্ডেট প্রদান করে এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির স্বশাসনের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য | অবিসংবাদী ক্ষমতা দান করে।
১৯৭১-এর মার্চে শেখ মুজিব আইন অমান্য আন্দোলন ঘােষণা করে কার্যত বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক নীতির দিকনির্দেশনা ও সম্পদগুলাের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ ও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের মধ্যকার আলােচনায় দেখা যায় যে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত প্রধান পাকিস্তানি আলােচক এম এম আহমদ বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা প্রশ্নে যে নতুন বাস্তবতার উদ্ভব ঘটেছে, তা মেনে নিয়েছেন। ছয় দফার অর্থনৈতিক দফাগুলােকে আইনগত স্বীকৃতিদানের জন্য প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংশােধনীগুলাে তিনি গ্রহণ করে নেন। বাঙালিদের এই স্বশাসন লাভের দাবিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র স্বীকার করে নিতে পারল না কেন? অধিকতর সুনির্দিষ্ট গবেষণা ছাড়া এর জবাব দিতে গেলে তা
বড়জোর কল্পনানির্ভর এবং সে কারণেই বিতর্কমূলক হবে। লেখক অন্যত্র বিষদভাবে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন যে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চরিত্র পরিবর্তন। ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালে যা ছিল মূলত ঐতিহ্যগতভাবে শহরাঞ্চলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির উদ্বেগপ্রভাবিত আন্দোলন, সেটাই এই বিরাট গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। এই প্রবণতা প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬৮-৬৯-এর শীতকালের আইয়ুববিরােধী বিদ্রোহের মাধ্যমে। সে সময় শহরাঞ্চলের শ্রমিকশ্রেণি রাজপথে ছাত্রদের সঙ্গে যােগ দিয়ে আইয়ুববিরােধী গণ-আন্দোলনে একটি নয়া শ্রেণিসচেতন জঙ্গিপনার সৃষ্টি করে। কিন্তু স্বশাসনের দাবিকে গ্রাম-গ্রামান্তরে নিয়ে যান এবং বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারকে বঞ্চনা সম্পর্কে সচেতন করে তােলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ ১৯৬৯৭১-এর নির্বাচনী অভিযানের মধ্য দিয়ে। এই বঞ্চনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাঙালিদের স্বশাসন প্রদানে অস্বীকৃতি, যার ফলে বাঙালি জনসাধারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের চালিকাশক্তিতে এবং ছয় দফা দাবির চূড়ান্ত জিম্মাদারে পরিণত হয়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে ভােট দিয়ে তারা জাতীয়তাবাদের পক্ষে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ব্যক্ত করে এবং পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয় যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এখন তাদের ম্যান্ডেট দ্বারা আবদ্ধ। ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের সামনে শেখ মুজিব কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথগ্রহণের অনুষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ছিল ছয় দফা ম্যান্ডেটের প্রতি প্রকাশ্য অঙ্গীকার ঘােষণা করা । সেই একই জনতা ১৯৭১ সালের মার্চে শহর ও গ্রামাঞ্চলে স্বশাসনকে টিকিয়ে রেখেছিল এবং ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পরবর্তীকালে নিজেদের জীবন দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আগ্রাসনের মােকাবিলা করেছিল। এই একই জনতা বাংলাদেশকে বিদেশি দখলমুক্ত করার দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের জন্য লড়েছিল ও প্রাণ দিয়েছিল। | জনগণকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে টেনে আনা না হলে পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালি মধ্যবিত্তশ্রেণিগুলাের ক্ষুধা মিটিয়ে তাদের সম্ভবত মানিয়ে রাখতে সক্ষম হতাে। ১৯৬০-এর দশকে এবং বেশি করে ১৯৬৯-এর মার্চের পরে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি বিনিয়ােগ বৃদ্ধির, একটি বাঙালি বুর্জোয়াশ্রেণি গড়ে তােলার, পাবলিক ওয়ার্কস প্রােগ্রামের মাধ্যমে গ্রামের ধনী কৃষকদের দিকে সম্পদ প্রবাহিত করার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পদগুলােতে বাঙালি সিভিল সার্ভেন্টদের উন্নীত করার একটি প্রচেষ্টা নেওয়া হয়।
এই প্রক্রিয়া হয়তাে পূর্ণ অংশীদারত্ব পর্যন্ত পৌঁছাত না, কিংবা ছয় দফার স্বায়ত্তশাসন দাবি মেনে নেওয়া পর্যন্ত এগােত না। তবে এটা বাঙালি মধ্যবিত্তশ্রেণিগুলাের জন্য সুযােগের নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারত। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্রণী বাহিনী মধ্যবিত্তকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে স্বশাসনের সংগ্রামকে বানচাল করার এই সম্ভাবনাটি শেখ মুজিবুর রহমানের নজরে পড়েছিল। তিনি যে আন্দোলনকে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া এবং জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রক্ষক ও অভিভাবকে পরিণত করার সচেতন সিদ্ধান্ত নেন, তার উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনের মধ্যবিত্ত নেতৃত্বকে বিভক্ত করে আন্দোলন থেকে সরিয়ে নেওয়ার ওই সম্ভাবনাটিকে আগে থেকেই নস্যাৎ করে দেওয়া। বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন বাস্তবতার মুখােমুখি হওয়ার পর পাকিস্তান রাষ্ট্র বুঝতে পারে যে এই নেতৃত্বকে কিনে ফেলা যাবে না। হয় স্বশাসনের বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে, যেমন তারা নিয়েছিল ১৯৭১-এর মার্চে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলােচনাকালে, নতুবা বাঙালি জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দিতে হবে। তারা আন্দোলনের গণভিত্তি বুঝতে পারেনি এবং ১৯৬৯-৭১ সালের একটানা বিক্ষোভ-সমাবেশের ফলে জনগণের সচেতনতা কী পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা-ও উপলব্ধি করতে পারেনি। এটাই মনে হয় তাদের ভ্রান্ত হিসাবের খতিয়ান। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রকেই ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র যে তার রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবিগুলােকে জায়গা করে দিতে পারেনি, তার চূড়ান্ত স্বীকৃতি হলাে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা অভিযান।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : এ টি এম শামসুদ্দিন
সূত্রঃ বাংলাদেশের অভ্যুদয় – রেহমান সোবহান