বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৬ই নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৭৩, ৩০শে কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
বাংলাদেশ-গিনি যুক্ত বিবৃতি
গিনির খনিজ দপ্তরের মন্ত্রী মোহাম্মদ লামিন তুরে দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ শীঘ্রই জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করবে। গিনি সরকার বাংলাদেশকে কিভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে পারে সফরকারী গিনি প্রতিনিধিদলটি এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছেন। লামিন তুরের নেতৃত্বে সফরকারী শুভেচ্ছা প্রতিনিধিদলটি সফর শেষে এক যুক্তি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন। বিবৃতি ঐক্যমত প্রকাশ করা হয় যে, বাংলাদেশ ও গিনি দু’টি দেশই ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অভিন্ন অভিজ্ঞতার অধিকারী এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দু’টি দেশই জোটনিরপেক্ষতার নীতির প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বাংলাদেশ-গিনি যুক্ত বিবৃতিতে ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নীতি ও যুদ্ধবিরতি চুক্তি লংঘনের নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। ইসরাইল আরব ভূ-খন্ড ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে যে গড়িমসি করছে, তাতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবেনা বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। গিনির খনিজমন্ত্রী উপমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ব্যাপারে বাংলাদেশের ভূমিকার ভূয়শী প্রশংসা করেন এবং নয়াদিল্লী চুক্তির বাস্তবায়নের মাধ্যমেই যে এ উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে, সে ব্যাপারে গভীর আশাবাদ প্রকাশ করেন। গিনির প্রতিনিধিদলটি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে, রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ ও সব ধরনের নয়া ঔপনিবেশকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সমর্থন জানানোই বাংলাদেশের অবিচল নীতি। এতোদিন গিনি বিভিন্ন বিশ্বসংস্থায় বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নে বিরোধিতা করে এসেছে। এখন গিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির ব্যাপারে সমর্থন জানাচ্ছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে গিনি যে বক্তব্য পেশ করেছেন তা অভিনন্দনযোগ্য। অন্ততঃ গিনির সমর্থন আমাদের কাছে একেবারে হেলাফেলার ব্যাপার বলে প্রতিপন্ন হবেনা বলেই আমরা বিশ্বাস করি।
ইসরাইলের ধৃষ্টতা
মিসর-ইসরাইল যুদ্ধের অবসানের পর স্বভাবতঃই বিশ্বের শান্তিকামী জনগণ আশা করেছিলো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এবং প্যালেস্টাইনের মুক্তির পথও প্রশস্ত হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের কতকগুলো ঘটনা পরিক্রমায় শান্তি সুদূরপরাহত বলে মনে হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ছাড়াও জাতিসংঘ ইসরাইল ও মিসরের মধ্যে একটি আপোষ মীমাংসার জন্যে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো তা উল্লেখ। এ ব্যাপারে ছয় দফা শান্তি প্রস্তাব উভয় রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছিলো। ছয় দফা শান্তি প্রস্তাবের চুক্তি সম্পাদনের পর আমরাও প্রকাশ করেছিলাম—মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের কয়েকটি সংবাদে জানা গেছে, ইসরাইল চুক্তির শর্ত লংঘন করে গোঁয়ার্তুমির ন্যায় কতকগুলো কাজ করেছে। ইতিপূর্বের শর্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের প্রোথিত চেকপোস্ট উঠিয়ে ইসরাইল শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করেছে বলে সংবাদে প্রকাশ। ইসরাইল চেকপোস্ট উঠিয়ে গায়ের জারে সীমানা নির্ধারণের যে পথ গ্রহণ করেছে তাতে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গেছে। ইসরাইলের ঐ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে বিস্মিত করেছে, তেমনি ঐ এলাকার শান্তি সম্ভাবনাকেও বিলুপ্ত করেছে। সংবাদে আরো জানা গেছে, ছয় দফা শান্তি চুক্তিতে সই করা সত্ত্বেও ইসরাইলী বাহিনী জাতিসংঘের শান্তি সৈন্যদের চেকপোস্ট স্থাপনে বাঁধা সৃষ্টি করছে। এমনকি কায়রো-সুয়েজ সড়ক সমস্যাও ইসরাইল জাতিসংঘের হাতে তুলে দিতে নারাজ। এ কারণে মিসর ও ইসরাইল উভয় পক্ষই কায়রো-সুয়েজ সড়ক বিষয়টির সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ছয় দফা শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন স্থগিত রাখার পক্ষে মতপোষণ করেছে। ফলে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি আজ নিদারুণ সংকটের মধ্যে পতিত হয়েছে।
এদিকে গত পরশুর এক সংবাদে প্রকাশ, কায়রো-সুয়েজ সড়কের বিষয়টি নিয়ে উদ্ভূত সমস্যার জন্যে ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলকে দোষারোপ করেছে। অন্যদিকে মিসর হুমকি দিয়েছে যদি ইসরাইল ছয় দফা শান্তি চুক্তি ভঙ্গ করে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে তাহলে তারা বাধ্য হয়ে হামলা করবে। উদ্ভূত এই পরিস্থিতির এক পর্যায়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গোল্ডামায়ার বর্তমান যুদ্ধ বিরতিকে ‘কাল্পনিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। এবং জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেছে তারা বাইশে অক্টোবরের অবস্থানে ফিরে যাবেনা। এদিকে জাতিসংঘের জনৈক প্রতিনিধির সূত্রে প্রকাশ—ইসরাইলী প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল মোশে দায়ানের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর নাকি কায়েরো-সুয়েজ সড়কের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।
বস্তুতঃপক্ষে ইসরাইলের ধৃষ্টতার জন্যেই গোটা মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত যে শান্তি চুক্তি গৃহীত হয়েছিলো তাও ইসরাইলী কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার জন্যে ভন্ডুল হয়ে যেতে বসেছে। আমরা যেমন মধ্যপ্রাচ্যের আশু শান্তি কামনা করি তেমনি প্যালেস্টাইনীদের মুক্তিও কামনা করি। ইসরাইল যদি তার অসংযত আচরণ সংযত না করে তাহলে তার সমুচিত শিক্ষাও সে পাবে। বিশ্বের শান্তিকামী মানব জাতির ন্যায়সঙ্গত আশা মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান। এই আশাকে নস্যাৎ করে যারা সাম্রাজ্যবাদী পথের আশ্রয় নেবে তাদের ধ্বংস অনিবার্য বলে আমাদের বিশ্বাস।
দিয়াশলাই শিল্পকে বাঁচান
দিয়াশলাইর মতো একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর উৎপাদন, বন্টন ও বিক্রয় নিয়ে সম্প্রতি একশ্রেণীর অসাধু কর্মচারী ইউনিয়ন নেতা ও কালোবাজারী বেশ মেতে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ফলে, সরকারী নির্ধারিত মূল্য প্রতি ম্যাচ ১১ থেকে ১২ পয়সা এবং পাইকারী প্রতি গ্রোস ১৫ থেকে ১৬ টাকা হওয়া সত্ত্বেও কালোবাজারে প্রতি ম্যাচ ২৫ পয়সা এবং প্রতি গ্রোস ২৩ থেকে ২৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বর্তমানে সারাদেশে মোট ১৮টি দিয়াশলাইর কারখানা আছে। এর মধ্যে ৫টি কারখানা ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং ৬টি ব্যবস্থাপনা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন। অপর ৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত।
রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো মোট উৎপাদনের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ দিয়াশলাই উৎপাদন করছে।
দেশে দিয়াশলাইয়ের স্থানীয় দৈনিক চাহিদা প্রায় ২০ হাজার গ্রোস। এর মধ্যে কেবলমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোতেই প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২১ হাজার গ্রোস।
অতি উৎপাদন রোধের জন্যে কর্পোরেশন সম্প্রতি শতকরা ৪০ ভাগ উৎপাদন হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তাতে দাঁড়িয়েছে এই যে, দৈনিক প্রায় সাড়ে একান্ন হাজার গ্রোস দিয়াশলাই উৎপাদনের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোতে বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র দৈনিক সাড়ে তিন হাজার গ্রোস।
অভিযোগে প্রকাশ, স্বাধীনতার পর কয়েকটি কারখানায় যে বিপুল পরিমাণ কাঁচামালের স্টক ছিলো, তা কতিপয় অসাধু ব্যক্তির বদৌলতে কালোবাজারে বিক্রি হয়ে গেছে।
তা’ছাড়া, স্বাধীনতার পর টিসিবি যে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য আমদানী করে তাও প্রশাসনিক দুর্বলতার দরুণ সুষ্ঠু বন্টন বা সদ্ব্যবহার হয়নি।
পটাসিয়াম ক্লোরেট, রেড ফসফরাস প্রভৃতি প্রয়োজনীয় বস্তু এখন কালোবাজারের পণ্য। পারমিটধারী ও ডিস্ট্রিবিউটরদের বদৌলতে এখন কালোবাজারেই কাঁচামালের ছড়াছড়ি। শোনা যাচ্ছে, কেবলমাত্র ‘এলোটমেন্ট’ বিক্রি করেই নাকি অনেকে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছে।
ওদিকে কারখানাগুলোতেও তাদের কাঁচামালের লাইসেন্স সদ্ব্যবহার না করে কালোবাজারে বিক্রি করছে বলে অভিযোগে প্রকাশ। ইউনিয়নের উৎপাতে দিয়াশলাইয়ের রাজ্যে এখন চরম নৈরাজ্য চলছে। কর্পোরেশনেরও অজস্র গলদ আছে।
দিয়াশলাইর সুষ্ঠু উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষেত্রে কর্পোরেশন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। কেউ হয়তো হাজার হাজার গ্রোস দিয়াশলাই পেয়ে কালোবাজারী করছে, কেউ হয়তো মোটেই পাচ্ছে না।
এছাড়াও আরো হাজারো রকমের অভিযোগ আছে যা’ সত্যিই অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। এবং এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই মুহূর্তেই বাস্তব ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।
কারণ, দিয়াশলাই এমন একটি বস্তু যা’ শুধু আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয়ই নয়, বিদেশ থেকে মুদ্রা অর্জনেরও একটি প্রধান উৎস। আগে আমাদের উৎপাদিত দিয়াশলাইর শতকরা ৬০ ভাগ চাহিদা ছিলো পাকিস্তানে। এখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রতিও বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত।
কারণ, হিসাবে দেখা গেছে যে, কেবলমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোই দেশের সমগ্র চাহিদা মেটানোর পরে বছরে প্রায় ৪ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।
সুতরাং, দিয়াশলাই সম্পর্কে এই মুহূর্তেই দৃঢ় সরকারী উদ্যোগ নিয়ে দিয়াশলাইর ক্ষেত্রে সমস্ত অন্যায়, অরাজকতা ও কালোবাজারী প্রতিরোধ করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক