You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.11 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | আর্তের সেবায় গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ুন | কয়লার অভাব, ট্রাক্টর বিকল | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১১ই মার্চ, সোমবার, ১৯৭৪, ২৭শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

আর্তের সেবায় গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ুন

পৃথিবীর সব দেশেই এবং সব কালেই ডাক্তার বা চিকিৎসকদের একটা আলাদা গুরুত্ব দেয়া হয়। কারণ, তাদের উপরই রোগ ও রোগীর আরোগ্য বা অনারোগ্যতা প্রধানভাবে নির্ভরশীল। প্রাণীজগতে নানান কারণে জীবনের কোনো না কোনো স্তরে রোগ থাকবেই। আবার, এ রোগ নির্ধারণ বা নিরোধ করতে ডাক্তারদের প্রয়োজন পড়বেই। সুতরাং, যে কোনো দেশে ডাক্তারদের গুরুত্ব কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায় না।
আমাদের দেশেও ডাক্তারদের সম্মান, গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা কম নেই। বরং, অনেক ক্ষেত্রে অনেকের চেয়েই বেশী। সে কথা খোদ বঙ্গবন্ধু নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি গত পরশুদিন কারিগরি মিলনায়তনে এক বিদগ্ধ চিকিৎসক সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণ দিচ্ছিলেন। এ সমাবেশ ঘটেছিল বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের তৃতীয় জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে। এতে বঙ্গবন্ধু সরকারী নিরূপণে ডাক্তারদের কি পরিমাণ মর্যাদা দেয়া হয়েছে তারই উল্লেখ প্রসঙ্গে বলেন যে, জাতীয় বেতন কমিশনের সুপারিশে মন্ত্রী পরিষদের পরেই ডাক্তারদের স্থান চিহ্নিত হয়েছে।
সত্যিই, এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ও চিকিৎসকদের সম্মান গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উত্তরোত্তরই বেড়ে চলেছে। কারণ, নানান পরিবেশ অভাব-অসুবিধা ও উপযুক্ত পুষ্টির অভাবে দেশের প্রায় শতকরা ৯৯.০৮ জন লোকই কোনো না কোনোভাবে আজ রোগ জীর্ণ ও মুমূর্ষু। এদের উপযুক্তভাবে চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তোলাই আমাদের আজকের অন্যতম প্রধান সমস্যা ও দায়িত্ব।
অথচ, দেশের চারদিকে তাকালে কি এক বিষাদ ও হতাশার চিত্রই না দেখা যায়। আমাদের লক্ষ লক্ষ রোগ বিশীর্ণ মানুষের জন্য ভালো ডাক্তার চাই, আরো ডাক্তার। অথচ, নিয়তির এমনি নির্মম পরিহাস যে, আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার ও চিকিৎসা কেন্দ্রের সংখ্যা খুবই কম।
এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে, আমাদের দেশে ভালো ডাক্তারের এতো প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও তাদের সংখ্যা নিতান্তই সীমিত। ফলে, অনেক ক্ষেত্রেই অদক্ষ ও পুস্তক সর্বস্ব হাতুড়ে ডাক্তারদের হাতে আরোগ্যযোগ্য রোগীও অকালে প্রাণ হারায়।
একে ভালো ডাক্তারের সংখ্যা কম তার উপর যারা আছেন, তারাও আবার অত্যন্ত শহরমুখী। শহুরে আরাম আয়েশে গা’ ঢলিয়ে দিয়ে তারা তাদের বৃহত্তর কর্তব্য-বিস্মৃত। ফলে, গ্রামে গ্রামে আজ মৃত্যুর ধুক ধুক হাহাকার। অথচ, দেশের শতকরা ৯৫ জন মানুষই গ্রামে বাস করে। সুতরাং বললে অত্যুক্তি হয়না যে, ডাক্তারদের শহরমুখিতা বা গ্রাম বিমুখিতার ফলে দেশের বৃহত্তর জনসংখ্যাই আজ নিশ্চিত মৃত্যুর হুমকির সম্মুখীন। ডাক্তারদের এ মানসিকতা অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে তা না হলে দেশের মানুষ বাঁচবেনা। সবাইকে আগামী শিশুর কাছে নরহত্যার জবাবদিহি করতে হবে যেমনটি দোর্দন্ড প্রতাপ পাঞ্জাবী পশুরা জবাবদিহি করছে আজকে আমাদের ও সারাবিশ্বের কাছে নজিরবিহীন নরহত্যার জন্য।
ডাক্তারের ধর্ম নিদ্রা নয় জাগরণ। ডাক্তারের আদর্শ আরাম আয়েশ নয়, আর্ত মানবতার সেবায় বিনিদ্র জাগরণ। সেবাই তার জীবনের যথার্থ মূলমন্ত্র। সেবাতেই তার নামকরণের যথার্থ সার্থকতা।
এজন্যই গত পরশুর সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ডাক্তারদের এক উদাত্ত আহ্বান জানান, যাতে তারা ত্যাগ ও সেবার মনোভাব নিয়ে প্রত্যেক গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েন এবং এই গরীব-দুঃখী, নাঙ্গা-কাঙ্গালদের দেয়া ট্যাক্সের পয়সাতেই ডাক্তারদের চলতে হয়, সেইহেতু তারাও ডাক্তারদের নিবেদিত সেবা পাবার অধিকারী বলে বঙ্গবন্ধু জানান।
প্রসঙ্গতঃ তিনি উল্লেখ করেন যে, একজন রাজনীতিক হিসেবে আর্তের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ খুব একটা অপরিহার্য নয়, তবুও শুধুমাত্র আর্তের কান্নায় তিনি বার বার ছুটে গিয়েছেন তাদের সেবা করে বাঁচিয়ে তুলতে। এজন্য তার উপর অনেক কবিও এসেছে চারদিক থেকে। তবুও তিনি হতোদ্যম হননি। সুতরাং, যে ক্ষেত্রে ডাক্তারদের সাথে আর্তের একটা আবশ্যম্ভাবিক যোগাযোগ আছে, সে ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের কর্তব্য পালনে সচেতন তো হতেই হবে।
বঙ্গবন্ধু বলেন যে, ডাক্তারদের উচ্চ শিক্ষা নিতে সুযোগ দেবার জন্যে সরকার সব সময়েই নিবিড়ভাবে আগ্রহী। তবে একশ্রেণীর লোক আছেন যারা নিজের দেশের গরীব-নাঙ্গাদের পয়সায় বিদেশে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে পরে আর দেশে ফিরতে চান না কারণ তাদের চোখের সামনে তখন গ্রামের করিম মোল্লার সেই কঙ্কালসার রোগ বিশীর্ণ দেহটির প্রতি সামান্য মানবতার করুণ ছবিটি নেই আছে বিদিশি জাঁকজমক ও সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন ও হাতছানি। সত্যিই মানুষের ন্যূনতম মানবতাবোধে কি পরিমাণ ঘৃণ্য অধঃপতন এলে যে এমন মানসিকতার সৃষ্টি হয়, তা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা। আর, এ ধরনের মানসিকতা পৃথিবীর আর কোনো দেশের লোকের মধ্যে আছে কিনা তাও নিশ্চয় করে বলা যায় না। এটা সর্বতোভাবেই পরিত্যাজ্য।
উপস্থিত ডাক্তারদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তিনি তাদের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত এবং পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে তাদের যে কোনো সমস্যা সমাধানেও তার সরকার যথেষ্ট উদগ্রীব। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন যে, গত ২৫ বছরে যা করা হয়নি তার চেয়েও বেশী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে গত ২৫ মাসে দেশের চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের উন্নতি বিধানে। আর দেশের এতো সীমাহীন সমস্যার মধ্যে আর কেউ যদি এর চেয়ে বেশী করতে পারেন তিনি তাকে স্বাগতম জানান গদিতে বসার জন্য। তিনি সবাইকে মওজুত কাপড় অনুসারেই বস্ত্রাদি বানাবার উপদেশ দেন। অর্থাৎ যা’ কিছু করতে হবে, ক্ষমতার মধ্যে থেকেই করতে হবে।
আমরাও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন ডাক্তার ভাইদের বলতে চাই ত্যাগ, সেবা আর মানবতার মনোভাব নিয়ে আপনারা গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ুন, আপনাদের মহান কর্তব্য সচেতন হউন আর দেশের মানুষকে বাঁচান। ঐ লক্ষ লক্ষ মুমূর্ষু প্রাণ আপনাদেরই ভাই, আপনাদেরই রক্তের জিনিস। বাঁচার আকুল আশায় ওরা আপনাদের দিকেই উন্মুখ হয়ে আছে। আপনারা গ্রাম বিমুখিতা পরিহার করুন। আপনাদের উপস্থিতি পেলে বাংলার গ্রামাঞ্চলেও দৈনন্দিন উজ্জ্বলতায় শহরকে ম্লান করে দেবে তাও কি এমন বিচিত্র কিছু? বঙ্গবন্ধুর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চিকিৎসা জগতে আপনারা অমর, অক্ষয় স্বাক্ষর রাখুন আমরা এটাই আশা করি।

কয়লার অভাব, ট্রাক্টর বিকল

দেশে দুঃসংবাদের অন্ত নেই। একদিকে কয়লার অভাব, অপরদিকে ট্রাক্টর বিকল। জানুয়ারী থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই চারটি মাসই সমুদয় নির্মাণ কাজের জন্য প্রকৃষ্ট সময়। বছরের অন্যান্য সময়ে কম বেশী বর্ষার ফলে নির্মাণ কাজে বিঘ্ন ঘটে। কিন্তু দেশের প্রথম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনার শুরুতেই এতো প্রকটভাবে কয়লার অভাব দেখা দেখে তা আমরা আদৌ প্রত্যাশা করিনি। কয়লার অভাবে সবরকম উন্নয়ন পরিকল্পনা, গৃহনির্মাণ কর্মসূচী, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং দুর্গত এলাকায় পুনঃনির্মাণ কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে। কয়লার অভাবে জাহাজ এবং ট্রেন চলাচলের ক্ষেত্রেও অন্তরায় দেখা দিয়েছে। ইটখোলা থেকে শুরু করে শিল্প কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে। কয়লা আমদানীর জন্য ভারতের সঙ্গে দু’টি চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী প্রতিমাসে ন্যূনপক্ষে ৫৫ হাজার টন কয়লা সরবরাহের কথা থাকলেও, গত জানুয়ারী এবং ফেব্রুয়ারী মাসে নাকি একত্রে মাত্র ১৬ হাজার টন কয়লা আনা হয়েছে। প্রথম চুক্তিতে নাকি বারো মাসের কয়লা এসেছে আঠারো মাসে। দ্বিতীয় চুক্তির সময়ও সেই একই বিলম্বিত সময়ে কয়লা আসছে। এর ফলে বাংলাদেশের সমুদয় নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কয়লা আমদানীর ক্ষেত্রে এই গড়িমসি কেন ঘটছে, তা তলিয়ে দেখতে গিয়ে কয়লার অভাবে নির্মাণ কাজ ব্যাহত হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা দেখা দিলে কিংবা কল-কারখানায় চাকা না ঘুরলে দেশের যে সমূহ ক্ষতি সাধিত হবে তার জন্য দায়ী হবে কে? কয়লার মতো একটি জরুরী জিনিস নিয়ে আর যাই করা হোক না কেন গড়িমসি খেলা শোভা পায় না।
কারণ, কয়লা আমদানী আমাদের জাতীয় স্বার্থেই ত্বরান্বিত করা দরকার।
কয়লার অভাবের মতো ট্রাক্টর বিকলের খবরটিও আমাদের রীতিমতো শংকিত করে তুলেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, শুধুমাত্র খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবেই নাকি চার কোটি টাকা মূল্যের প্রায় এক হাজার ট্রাক্টর বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় অকেজো হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। ভারী দুঃখজনক খবর। ট্রাক্টর যদি বিকল হয়ে থাকে। তাহলে ‘সবুজ বিপ্লবে’র কী হবে। খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানী হচ্ছে না। ট্রাক্টর সার্ভিসিংও করা হচ্ছে না। ফলে বিকল ট্রাক্টরগুলো মুখব্য দান করছে কৃষককুলকে। এই অবস্থায় ট্রাক্টরগুলোকে সচল করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানী করা দরকার। সবুজ বিপ্লবকে বাস্তবায়িত করতে হলে অচল ট্রাক্টরগুলো অনতিবিলম্বে সচল করতে হবে। নইলে কৃষি ক্ষেত্রের দুরবস্থা ক্রমাগত আরো সঙ্গীন হয়ে উঠবে। কাজেই কয়লা বলুন আর ট্রাক্টরই বলুন, এগুলোর প্রতি তীক্ষ্ম নজর দিয়ে সমস্যা সমাধানকল্পে এগিয়ে না এলে আমাদের ভাগ্যে আরো চরম দুর্গতি অপেক্ষা করে আছে বলেই ভাবতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন