বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৩শে মে, বৃহস্পতিবার, ৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১
পাট যেন লোপাট না হয়
কথায় বলে নিউক্যাসেলে কয়লা নিয়ে যাওয়া অর্থহীন। নিউক্যাসেলে কয়লার অভাব নেই। তাই সেখানে কয়লা নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারেন না কেউ। বাংলাদেশে কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে তাই হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পাট উৎপাদনে শীর্ষ স্থান অধিকার করেছিল একদিন। এ উপমহাদেশ ভাগ হবার আগে পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলের একমাত্র পাট উৎপাদিত হতো। সেই পাট যেত কলকাতার আশেপাশে অবস্থিত পাটকলগুলোতে। উপমা দেশভাগ হবার পরও অবস্থাটা তেমন কোন হতাশা ব্যঞ্জক ছিল না। নানান প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্বেও পাটেই ছিল একমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অবলম্বন। সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষকদের রক্তের বিনিময়ে উৎপাদিত সোনালী ফসল বিদেশে বিক্রি করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের তল্পিবাহকরা ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। বাইশ পরিবারের জন্মের অন্তরালে সোনালী আঁশের ভূমিকা কম ছিলনা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সরকার দেশের সার্বিক কল্যাণ ও অগ্রগতির প্রতি লক্ষ্য রেখে পাটশিল্প পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করেছেন। পাটের বিনিময়ে অর্জিত মুনাফা যেন কোন ব্যক্তি বিশেষের পকেট না যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই পাট শিল্প ব্যবসাকে জাতীয়করণ করা হয়েছে। বিদেশের বাজারে পাট ও পাটজাত দ্রব্য বিক্রি করে যে অর্থ ঘরে আসবে তা ব্যয় করা হবে দেশের সার্বিক উন্নয়নে। এক কথায় পাটের মুনাফার অংশ পাবেন দেশের জনসাধারণ।
সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগকে দেশবাসী জানিয়েছেন অকুণ্ঠ সমর্থন ও অভিনন্দন। কিন্তু তারপর? তারপর অনেক পানি বুড়িগঙ্গা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পাট নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে অনেক। পাটকে স্বতন্ত্র দপ্তরের আওতায় ফেলা হয়েছে। পাটমন্ত্রী দপ্তরের দায়িত্ব নিয়েছেন। পাটমন্ত্রী দায়িত্ব নেবার পর দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। পাটের মাধ্যমে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হব। চলতি বছরের প্রথম দিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, পাট রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ৪৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ১২ লাখ ৯ হাজার বেল পাট বিদেশে বিক্রি করা হয়েছে। ১লা জুলাই থেকে ৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ২৭ হাজার টন পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ৭৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা পাওয়া গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি ও মূল্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে পাটের সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ ও পাট নীতি ঘোষণা সম্পর্কিত বক্তব্য রাখা হয়েছিল পাট মন্ত্রণালয় থেকে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য ষাট টাকা ধার্য করা হলেও আজও পর্যন্ত পাটনীতি ঘোষণা করা হয়নি যদিও চলতি মাসের ঘোষণা করা হবে বলে পাটমন্ত্রী বলেছিলেন।
পাটের কপালেও আগুন। বিগত মার্চ মাসের আগে পর্যন্ত ছাব্বিশ মাসে ১৪ কোটি টাকার পাট পুড়েছে।
তৈল সংকটের ফলে বিদেশে “সিনথেটিক ফাইবার” প্রস্তুত করার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়াতে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিক তখনই দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের দেশের কৃষকরা পাট চাষে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। পাট চাষে কৃষকদের অনীহার কারণ হলো পাটের ন্যায্যমূল্য অভাব। পাট চাষে যেখানে জমি চাষ, বীজ বুনন, সার দেয়া, পাট পচানো, পাট বাছাই, শুকানো থেকে বাজারে আনা পর্যন্ত কৃষকদের খরচ পড়ে গড়পড়তা ৮৩-৮৪ টাকা সেখানে উৎপাদন পর্যায়ে প্রতি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ৬০ টাকা। তাছাড়া অনেক সময় ফরিয়া, আড়তদার ও সরকারি কর্মচারীদের কারচুপির ফলে সেই ৬০ টাকাও তারা পান না। অন্যদিকে ধান চাষের খরচ পড়ে মণপ্রতি ৪৪ টাকা, ইরিধান প্রতিমণে জলসেচ সহ খরচ পড়ে ৫৮ টাকা। স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে ধান চাষে লাভ বেশি। শুধু তাই নয়, এক মণ পাট বিক্রি করে এক মণ চাল তো দূরের কথা এক মণ ধানও আজ পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং কৃষকরা অন্য পথ ধরেছেন। সোজা কথায় পাট চাষে কৃষকরা আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। গতকাল “বাংলার বাণী”তে কৃষকদের পাট চাষ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, আগামী মৌসুমে বাংলাদেশকে তার নিজস্ব পাটকলগুলোর চাহিদা পূরণের জন্য বিদেশ থেকে ১০/১২ লাখ বেল পাট আমদানি করতে হবে। আর তাই যদি করতে হয় তাহলে কয়লা যে কোন কোন সময়ে নিউক্যাসেলেও আসে সে কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে। কাজেই আমার একটা অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার আগে পাট মন্ত্রণালয়কে কার্যকরী ও সুদূরপ্রসারী একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় তার পরিণাম হবে ভয়াবহ।
পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন
দেশের পরিবহন ব্যবস্থা আজও তেমন উল্লেখযোগ্য ভাবে উন্নত হয়নি। বহুদিন ধরে একটা অব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দিকটিতে বর্তমান রয়েছে। জাতীয় জীবনের প্রয়োজনে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন একটি অপরিহার্য শর্ত। যোগাযোগ উন্নত না হলে জাতীয় প্রগতি ব্যাহত হতে বাধ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধেরকালে দেশের অধিকাংশ সেতু এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ সেতু সময় বিধ্বস্ত আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত করার জন্য সেতু ধ্বংস করেছিল তেমনি পাকবাহিনীকেও অনুরূপ পথ অবলম্বন করতে হয়েছিল। ফলে সার্বিক অর্থে বিধ্বস্ত হয়েছিল আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঠিক একই কারণে ও প্রয়োজনে দেশের পরিবহন ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করা হয়েছিল। তবে দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পূর্বে অধিকাংশ পরিবহন যন্ত্র হয় বিকল নয়তো ধ্বংস করে দেয়। যার সরাসরি ক্ষতি ভোগ করতে হয় যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ সরকারকে। সহযোদ্ধা ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর পরেই আমাদের দেশের বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করে এবং অত্যন্ত স্বল্প সময়েই দেশের সকল বৃহৎ ও ক্ষুদ্র বিধ্বস্ত সেতুর মেরামত কাজ শেষ করে। যোগাযোগব্যবস্থার পুনর্জীবনের সঙ্গে সঙ্গেই যে বিষয়টির অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে তাহলে পরিবহনের উন্নতি সাধন। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো ও তার উন্নতি বিধানের জন্য কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকেই প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বাস ও ট্রাক কিছু পরিমাণ আমদানিও করা হয়েছে।
কিন্তু চাহিদা পূরণের মতো যথেষ্ট নয় বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। তবু এর মধ্যেই আবশ্যকীয় কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কর্তৃপক্ষ করছেন। এতদসত্ত্বেও পরিবহন ব্যবস্থায় কিছু কিছু ত্রুটি রয়েছে বলেও সবার ধারণা। গত পরশু দিনের একটি দৈনিকের এক খবরে প্রকাশ–পরিবহন ব্যবস্থায় নাকি ব্যাপকভাবে দুর্নীতি চলছে। একস্থান হতে অন্য স্থানে মাল পরিবহনে কেবল যে কার্গো ও ট্রাক ভাড়া লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তাই নয়–এক জেলা থেকে অন্য জেলায় মাল চলাচলের প্রচন্ড কষ্ট পোয়াতে হয়। খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা সমূহ থেকে বা থানা থেকে যখন ঘাট এলাকায় মাল পৌঁছানোর দরকার হয় তখন প্রয়োজনীয় সংখ্যক পরিবহন পাওয়া যায় না। এছাড়া পথে পথে নানা দুর্ভোগ এর মুখোমুখিও হতে হয়। পূর্বের দিনে ৫ টন ওজনবাহী ট্রাক দিনাজপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত তিনশ’ থেকে চারশো টাকায় ভাড়া পাওয়া যেত। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে ভাড়া দিতে হচ্ছে তিন হাজার টাকা। সংবাদে আরো বলা হয়েছে, উল্লেখিত মালবাহী ট্রাক পথের মাঝে অনেক সময় অযথা আটক করে রাখা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই ‘নগদ দণ্ড’ দিতে হয়। নইলে মালামাল গায়েবের হুমকি আসে। ওই সংবাদে ট্রাক মালিকদের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আরও বলা হয়েছে যে, কেবল জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির জন্যই নয়, মালামাল নিয়ে একস্থান হতে অন্য স্থানে চলাচল করার সময় দারুন রিস্ক নিতে হয়। পথের এই হয়রানির মোকাবেলার জন্য বাধ্য হয়ে মালিকগণ নাকি চড়া হারে ট্রাক ভাড়া দাবি করছেন। জানা গেছে, পরিবহন ব্যবস্থায় নাকি দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছে। রেল ওয়াগন পাওয়ায় অসম্ভব ঝক্কি। ফলে কোথাকার মাল কোথায় কখন পৌঁছাবে তার সঠিক সময় নির্ধারণ করা অসম্ভব। এই ত্রুটিপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থার দরুনই দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা বলে অনেকে প্রতীয়মান করছেন। বস্তুতঃপক্ষে দেশের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যের গতিপ্রকৃতি। যখন ভাল এবং দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব হবে তত জিনিসপত্রের চলাচল ও মূল্য স্থিতিশীল হবে। বাজারে জিনিসের প্রাদুর্ভাব যদি পরিবহনের কারণে হয় তাহলে জিনিসের দাম স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে। তাই সার্বিক যোগাযোগ যেমন উন্নত করতে হবে ঠিক তেমনি উন্নত করতে হবে পরিবহন ব্যবস্থার। যানবাহন নিশ্চিত চলাচলের সুযোগ না পেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের উপর তার প্রতিক্রিয়া হবে। অতএব দেশের প্রগতির প্রশ্নেই পরিবহন ব্যবস্থার আশু উন্নয়ন দরকার। এ ব্যাপারে কতৃপক্ষ সবিশেষ দৃষ্টিপাত করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক