বাংলার বাণী
ঢাকা: ৩০শে সেপ্টেম্বর, সোমবার, ১৩ই আশ্বিন, ১৩৮১
বন্দরে অব্যবস্থা এবং দুর্নীতি
জাহাজে বন্দরে পড়ে আছে মালামাল, খাদ্যশস্য। কোনটি রপ্তানির অপেক্ষায় কোনটি বা বন্দরে খালাস হয়ে দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহের অপেক্ষায়। আমদানিকৃত যেসব মাল আটকা আছে সেগুলো সঠিক সময়ে খালাস করা যাচ্ছে না লিফট ক্রেন, ড্যাকুভেটরের অভাবে। যতটুকু খালাস হচ্ছে যথোপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে তার অনেকাংশ নষ্ট অথবা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ওই যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার ফলেই রপ্তানি দ্রব্য জাহাজ বোঝাই করতে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
বন্দরে অব্যবস্থা সম্পর্কিত এমন নানা অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে। অর্থনীতিতে বিশেষ করে আমাদের ঘাটতি বাজারের এর প্রতিক্রিয়া যে কি মারাত্মক হতে পারে তা অনুমান সাপেক্ষ কিন্তু। বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। বাংলার বাণীর এক রিপোর্টে প্রকাশ, চট্টগ্রাম বন্দরে সাতাশটি ফর্ক লিফট এর মধ্যে পনেরোটি বিকল হয়ে রয়েছে। বাকি বারোটির মাত্র পাঁচটি সব সময় চালু থাকে। এর ফলে জাহাজ থেকে ট্রানজিট শেডে মাল সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ভারী মালামাল উত্তোলনে অব্যবহৃত গোলিয়াথ ক্রেন এবং দুটি মোবাইল ক্রেন দীর্ঘদিন যাবৎ মেরামতের অভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আছে।
এমনিতেই দেশের অভ্যন্তরে মালামাল চলাচলের জন্য যথেষ্ট যানবাহনের অভাব। বন্দর ছেড়ে মাল পৌঁছাবার পর তা দেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর ব্যাপারে অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়। দুর্গম দূরবর্তী এলাকাসমূহে চিটাগাং থেকে খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী পাঠানোর সময় সাপেক্ষ। সেখানে যদি জাহাজ থেকে মাল উত্তোলনেই অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয় তবে তা সার্বিক সমস্যাকেই জটিল করে তোলে।
অন্যান্য সময়ের চাইতে বর্তমান অবস্থা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সারা দেশে চরম দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর স্থানীয় মওজুদ রয়েছে তা যথেষ্ট নয়। স্বাভাবিক ভাবেই বিদেশ থেকে আনা মালামালের ওপর বর্তমানে অধিকতর নির্ভরশীল থাকতে হবে। বিদেশ থেকে যেসকল সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া গেছে তাও এখন ধীরে ধীরে বন্দরে ভিড়ছে। এখন যদি যন্ত্রপাতির অভাবে মাল খালাস বিলম্ব ঘটে অথবা সেই বিলম্বের কারণে কোনো জাহাজ গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় তবে তা সমূহ বিপদ ডেকে আনবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব বোঝেন না তা নয়। তারা এত সব বুঝেও কি করে নির্বিকার থাকতে পারেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। যে যন্ত্রপাতিগুলো আগে থেকে বিকল হয়ে রয়েছে বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে তারা কেন পূর্বাহ্নে মেরামতের ব্যবস্থা নিলেন না সে কৈফিয়ৎ কে দেবে?
পূর্বে চিটাগাং বন্দরের ট্রানজিটের আয়তন ছিল ১১ লাখ বর্গফুট। এখন সে থেকে দেড় লাখ বর্গফুট সংকুচিত করা হয়েছে। এছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যে শেডটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা মেরামতের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেয়া হয়নি। ফলে পণ্য সংকুলনে তীব্র অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, অপচয় এবং পাচারের পরিমাণ বাড়ছে।
আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করছি। আমদানিকৃত দ্রব্যের তড়িৎ খালাস এবং রপ্তানি দ্রব্য সময়মতো জাহাজ বোঝাই করণে সংশ্লিষ্ট সবাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ দুটো কাজেরই মন্থরতার ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দেশকে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। বন্দর এলাকায় ব্যাপক দুর্নীতি সম্বন্ধে ভুক্তভোগী সবাই অভিযোগ করে থাকেন। এমন নানা অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তেমন কোনো ব্যবস্থা এ ব্যাপারে নেয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। সরকারি মহল থেকে তদন্ত চালানো হলে এর অনেক শাখা-প্রশাখাও পাওয়া যাবে বলে আমাদের ধারণা। আমরা মনে করি অবিলম্বে বন্দরের সার্বিক অবস্থা এবং দুর্নীতি দূরীকরণে বাস্তব কর্মপন্থা গৃহীত হওয়া দরকার।
নারী বিক্ষোভ মিছিল কল্যাণ আনুক
জীবন সংগ্রামের নির্মম উত্তাপে আজ নারী সমাজ ও দগ্ধীভূত। অভাব-অনটন ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ঊর্ধ্ব মূল্য এবং দুষ্প্রাপ্যতা প্রত্যক্ষভাবে প্রতিটি সংসারে আঘাত হানছে। মা-বোনেরা তাই পীড়িত, ক্ষুব্ধ। গত পরশু শনিবার শিশুখাদ্যের অভাব পূরণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানোর দাবিতে রাজধানীর মহিলারা তাই এক বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। নারী মুক্তি সংসদের ডাকে এই মিছিল শনিবার সকালে তোপখানা রোড থেকে শুরু করে বায়তুল মোকারম এবং বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দিলকুশার বাংলাদেশ ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থাসমূহের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। মিছিলের পুরোভাগে নারী মুক্তি সংসদের সক্রিয় কর্মীরা বিভিন্ন ফেস্টুন প্ল্যাকার্ড বহন করে। পথ পরিক্রমায় অংশ নেন। প্রধানত ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড শিশু খাদ্যের কথাই লেখা ছিল।
মহিলাদের বিক্ষোভ মিছিলের সাথে শিশুখাদ্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে আপন সন্তানের মুখে আহার তুলে দেওয়ার অক্ষমতা যে কি নিদারুন এবং মায়ের জাত কে সেই পরিস্থিতি কিভাবে যে বিভ্রান্ত করে তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের রাজ পথ পরিক্রমায় বিশেষ করে দুগ্ধপোষ্য শিশুদের একমাত্র জীবন রক্ষাকারী প্রাণী ও দুধের সংকটের সারাদেশের মায়েরা আজ শঙ্কিত ও বিপন্ন। শিশুখাদ্যের এমন চরম সংকট এর আগে কখনো হয়েছে বলে মনে পড়েনা। প্রাণান্ত চেষ্টা এবং দুঃসহ উৎকণ্ঠার পর চড়া মূল্যে মাত্র ও এক টিন দুধ জোগাড় করা আজ কেবল মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্তদের পক্ষেই সম্ভব। বাকিদের কথা চিন্তা করা যায় না। শিশুকে দুধ খাওয়ানোর তাদের কাছে অলিভ বাসনা মাত্র। কিন্তু মা তো সবাই। এক ফোটা দুধের অভাবে মায়ের চোখের সামনে তার সন্তান কিন্ন ক্লিষ্ট হয়ে প্রাণ ত্যাগ করবে এর চেয়ে যন্ত্রণার বিষয় এ জগতে আর কিছুই নেই। ন্যায্যমূল্যে শিশু খাদ্য সরবরাহ করার দাবি নিয়ে বিক্ষোভ মিছিলে মায়েদের অংশগ্রহণ করার সৎসাহস অভিনন্দন জানাতে হয়।
একথা সত্য যে, এই শিশুই হল আজকের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। আগামী দিনের নাগরিক শিশুদের খাদ্য যোগান দেয়া তাই রাষ্ট্রীয় কর্তব্য ও দায়িত্বও বটে। কারণ এই শিশুরা যদি একদিন অনেক অপুষ্টি ও অপূর্ণতা নিয়ে বড় হয় তাহলে তা জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে সন্দেহ নেই। অতএব শিশু খাদ্য সরবরাহের এই মৌলিক দাবিকে সংশ্লিষ্ট মহল অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করুক আমরা চাই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঘরে-বাইরে আজকালকার জীবনসংগ্রাম পরিব্যপ্ত। সেই সংগ্রামের প্রায় সমান অংশীদারিত্ব আজ মহিলাদেরও । তাই নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি চাল, ডাল, তেল, নুন এর অগ্নিমূল্য তাদের সুখ শান্তি এবং নিরাপত্তা কে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। শিক্ষিত সচেতন মহিলাদের সমস্যা আরও বেশি। তাদের দায়িত্বও বেশি। নিজেদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তাই তাদের গড়ে তুলতে হচ্ছে নারী মুক্তি আন্দোলন। সুন্দরভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় দাবি-দাওয়া, ন্যায্য পাওনা আদায়ের সংগ্রামে তাদের সোচ্চার হতে হচ্ছে এবং চোখের ওপর দেখা যাচ্ছে যে, জীবিকার সন্ধানে আজ সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীকর্মীর আগমন ঘটছে। সুতরাং অধিকার আদায় ও ন্যায্য দাবি পূরণের ব্যাপারেই যে তারা পিছিয়ে থাকবেন কেন? এই বিক্ষোভ মিছিলে তাদের যে নাগরিক চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে তা আরো সুসংহত ও শক্তিশালী হোক। কল্যাণী মা-বোনেরা নিজেদের সন্তান তথা দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জীবন রক্ষার ব্যাপারে আরো যত্নশীল হোন এবং ঐ মৌলিক মঙ্গল চিন্তা থেকেই আজকের শিশুদের মধ্যে শুভ চিন্তা ও নৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটুক এই-ই প্রার্থনা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক