You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রকৃত অর্থে ছিল একটি জনযুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রকৃত অর্থে ছিল একটি জনযুদ্ধ। জনগণ যার যা আছে তাই নিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগ্রাম গড়ে তােলে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শাসিত-শােষিত, বঞ্চিত বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে গণসংগ্রাম গড়ে তােলেন। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় যার দুই অংশের দূরত্ব প্রায় দুই হাজার মাইল, যা বিশাল ভারত রাষ্ট্রদ্বারা বিচ্ছিন্ন। পাকিস্তানের এই দুই অংশের মধ্যে ভৌগােলিক দূরত্ব যতটা না বেশি, তার চেয়ে বেশি ছিল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনার পার্থক্য। একমাত্র সেতুবন্ধন ধর্ম। অবিভক্ত ভারতে ইংরেজ এবং হিন্দু ভূস্বামীদের নিকট মুসলিম প্রদায় শােষিত, অবহেলিত, বঞ্চিত। হিন্দু উচ্চ বর্ণের ব্যক্তিকগােষ্ঠী, সামাজিক অসম আচরণের ফলে এবং সর্বোপরি অবহেলা ও শােষণের ফলে মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দু সম্প্রদায়ের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দ্বিজাতিতত্ত্বকে গ্রহণ করে, যেখানে ধর্মীয় উন্মাদনা প্রবল হয়ে ওঠে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ববঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায় পাকিস্তানের পক্ষে ভােট দেয় এবং যথারীতি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গের জনগণ উপলব্ধি করে যে প্রকৃত অর্থে তারা স্বাধীন হয়নি। শুধু প্রভু বদল হয়েছে। ইংরেজ ও হিন্দুদের পরিবর্তে রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী আরাে নগ্নভাবে পূর্ববঙ্গের জনগণকে ধর্মের নামে শাসন-শােষণ, অত্যাচার ও নিপীড়ন শুরু করে। যে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল, সে ধর্ম বা ইসলামকে নিয়ে পাকিস্তান শাসন ও শােষণের মাত্রা তীব্র হয়। এমনকি জনগণের মুখের বাংলা ভাষা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হয়। পূর্ববঙ্গের জনগণ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ সেহেতু স্বাভাবিক কারণে মুখের ভাষা বাংলা রাষ্ট্র ভাষা হওয়ার কথা।

কিন্তু বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত বাঙালি জাতিসত্তায় প্রচণ্ড আঘাত আসে। বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্বেষায় নতুনভাবে উপলব্ধি করে পাকিস্তান এক রাষ্ট্র হলেও এক জাতি নয়। বাঙালি ভিন্ন জাতি। এভাবে জাতিসত্তার বিকাশের ধারায় শাসন-শােষণ বিষয়টি সামনে চলে আসে এবং পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালি  জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। এর প্রথম ফলাফল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধর্মীয় বন্ধনকে ছিন্ন করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির নতুন অভিযাত্রা শুরু হয়। এরপর স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে ১৯৫২-৫৪ কালপর্বে জাতিসত্তা। বিকাশ ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি উপস্থাপিত হয়। ১৯৬৪ সালের পর হতে ঐ দাবি আদায়ে সংগ্রাম ও লড়াই শুরু হয়। এই সময় পাকিস্তান শাসকচক্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিয়াটো-সেন্টো চুক্তিতে আবদ্ধ। হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পেশােয়ারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি দেয়। সেখান থেকে সােভিয়েত রাশিয়া ইউ-২ গােয়েন্দা বিমানের মাধ্যমে কার্যক্রম চালানাের এক পর্যায়ে সােভিয়েত রাশিয়া গােয়েন্দা বিমানকে ভূপাতিত করে। পাকিস্তানের সঙ্গে সােভিয়েতের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পাশাপাশি পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপকভাবে সামরিক অদি প্রেরণ করে। দেশের অভ্যন্তরে স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামাে নিজেদের অধিকারসমূহ আদায় করতে গিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে যে আন্দোলন, চক্রান্ত ও নিষ্ঠুর বৈষম্যের নগ্ন চিত্র দৃশ্যমান হয় তারই আলােকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে উন্নীত হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ রক্ষায় পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়। নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ করা হয়।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। সামরিক শাসনের একটি পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তন করে। মৌলিক গণতন্ত্র না ছিল মৌলিক, না ছিল গণতন্ত্র। দেশে এই তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন দমনের জন্য ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খান কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত আক্রমণ করে। সেক্ষেত্রে চীন ব্যাপকভাবে পাকিস্তানকে সাহায্য করে।  এ সময় সােভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সহযােগিতায় এগিয়ে আসে। শেষপর্যন্ত সােভিয়েতের মধ্যস্থতায় তাসখণ্ড চুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান হয়। তাসখণ্ড চুক্তির ফলে পাকিস্তানে প্রচণ্ড গণআন্দোলন শুরু হয়। এই বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবি পেশ করেন। যা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি এলাকা সফর করে। জনগণের মধ্যে ছয় দফা ছড়িয়ে দেন। ছয় দফার ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন। পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী বাঙালি জাতির এই নব আত্ম-উপলব্ধিকে ধ্বংস করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়ার চক্রান্ত করে। কিন্তু বাঙালি জাতি উপলব্ধি করে যে, শেখ মুজিব ছয় দফার মাধ্যমে যে দাবিগুলাে উথাপন করেছেন তা হলাে তাদের বাঁচার দাবি। ১৯৬৯ সালে প্রচণ্ড গণ আন্দোলনে আইয়ুব খান দিশেহারা হয়ে গােলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে। কিন্তু শেখ মুজিব ব্যতীত কোনাে দলই গােলটেবিল বৈঠকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না বলে আইয়ুব খানকে। জানিয়ে দেয়। বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দেন।

বাংলার জনগণ সংগ্রামী এই নেতাকে বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। আইয়ুব খান আহুত গােলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি পুনরায় পেশ করলে আলােচনা ভেঙে যায়। গণ আন্দোলন তীব্রতর হয়। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসেন। তিনি চীন, সোভিয়েত রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আইয়ুব খানের আমলে যে কূটনৈতিক বন্ধন দৃঢ় হচ্ছিলাে ইয়াহিয়া খানও আইয়ুব অনুসৃত কূটনৈতিক ধারায় অগ্রসর হন। তিনি পাকিস্তানে প্রথমবারের মতাে সাধারণ নির্বাচন ঘােষণা করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক চক্র জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অনীহা প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হয় ব্যাপক অসহযােগ আন্দোলন। আন্দোলন এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়, যে পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তি দেখতে পায় পূর্ব পাকিস্তান দ্রুত স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে পড়ছে। এ পর্যায়ে ১৯৭১ সালে নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে, অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যেই তাকে সমাধান খুঁজে পেতে হবে। পাকিস্তান ভাঙন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে না। অসহযােগ আন্দোলন তীব্রতর হলে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলােচনায় মিলিত হন। গবেষক মাত্রই লক্ষ্য করবেন এই আলােচনাকে সামনে রেখে ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে সৈন্য মােতায়েন করা। আলােচনা একপর্যায়ে ভেঙে যায়। ইয়াহিয়া খান আন্দোলন দমনের জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযােগের এক বিভীষিকা সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তাকে বন্দি করা হয়। হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষ রিক্ত-নিঃস্ব হয়ে জীবনের নিরাপত্তার আশায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়-থানায়-গ্রাম-প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠে প্রতিরােধের দুর্বার প্রত্যয়। জনগণ মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে।
শুরু হয় জনযুদ্ধ। নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ ও অগণিত শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ৪ঠা এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সরকার গঠনের কথা জানান। ভারত এসময় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত সরকারকে ভারতে থাকার এবং সেখান থেকে কার্যক্রম চালানাের অনুমতি প্রদান করে। একইসাথে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মুক্তিযুদ্ধ প্রচারের জন্য একটি মিডিয়াওয়েভ বেতার যন্ত্র প্রদান করে। ১০ই এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় এই সরকার শপথ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করেন মুজিবনগর সরকার। প্রজাতন্ত্রের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মুজিবনগর সরকার তার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
সরকার গঠনের পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ২৪শে এপ্রিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারতের রাষ্ট্রপতি বরাবর একটি পত্র প্রেরণ করেন। এখানে উল্লেখ করার বিষয় এই যে, প্রেরিত পত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুস্বাক্ষর না থাকলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাকের স্বাক্ষর দৃষ্ট হয়। এর থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনে জটিলতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অবশ্য পরবর্তী অন্যসব পত্রে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর যুক্ত স্বাক্ষরে অথবা প্রধানমন্ত্রীর একাকী স্বাক্ষরে ভারতের সঙ্গে পত্র যােগাযােগ করেন। এর থেকে সরকার গঠনের জটিলতা নিরসনে প্রথমে খন্দকার মােশতাকের ক্রোধ হ্রাসের লক্ষ্যে সম্ভবত কৌশলগত কারনে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী এই পন্থা গ্রহণ করেছিলেন। মুজিবনগর সরকার গঠনে যে জটিলতা পরিদৃষ্ট হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তা আরাে দৃঢ় হয়। খন্দকার মােশতাক পূর্ণ স্বাধীনতার পরিবর্তে অখণ্ড পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় একটি কনফেডারেশন গঠনের ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই বিষয়ে তিনি ও তার বলয়ের ব্যক্তিবর্গ অন্তত তের বার যােগাযােগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলাে অখণ্ড পাকিস্তানের আওতায় সমাধান খুঁজে পেতে হবে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও গােয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তার এই গােপন যােগাযােগ প্রকাশিত হয়ে পড়লে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে না দিলেও মূলত অকার্যকর করে রাখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় ও নীতি অখণ্ড পাকিস্তানের আওতায় বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল এর পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাবিনেটে যেমন, তেমনি গণপ্রতিনিধির ভিতরেও যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল তা অস্বীকার করা যাবে কিন্তু অধিকাংশ গণপ্রতিনিধি রণাঙ্গন ও জোনাল কাউন্সিলের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় থাকায় এই ষড়যন্ত্র ফলপ্রসূ হতে পারেনি।
বিশেষকরে জুলাই মাসে শিলিগুড়ির বাগডােগরায় অনুষ্ঠিত অনানুষ্ঠানিক গণপরিষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে পূর্ণ স্বাধীনতার অর্জনের শপথের মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্র স্থিমিত হয়ে যায় এবং সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে কলকাতা থেকে যুক্তরাষ্ট্র কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব থেকে তাদের হাত গুটিয়ে নেয়। মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ছিল: এক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি; দুই, বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি এবং তিন, শরণার্থী প্রত্যাবর্তন। এই তিনটি মূল বিষয়ের একত্রিত যযাগফলের সঙ্গে উল্লেখযােগ্য দিক ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং গেরিলা যুদ্ধ জোরদার ও স্বাধীনতা অর্জন। মুজিবনগর সরকার রণাঙ্গণের যুদ্ধের পাশাপাশি বিশ্ব-কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেন। মুজিবনগর সরকারের পক্ষ হতে বিদেশে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। একইসাথে যেসমস্ত পেশাদার কূটনীতিক পাকিস্তানে চাকরিরত ছিলেন তাদের পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের আনুগত্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সফলতা অর্জন করে। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এটি ছিল পাকিস্তানের মুখে। চপেটাঘাত। এছাড়া প্রবাসী বাঙালিরা প্রতি মুহুর্তে বাংলাদেশের রক্তাক্ত চিত্র, স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাক্ষা তুলে ধরে বিশ্বপরিসরে মুক্তির বার্তা ছড়িয়ে দেন। বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার সঙ্গে যােগাযােগ করে সহমর্মিতা আদায় করেন। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রেরণ করে বিশ্বজনমতকে পক্ষে আনেন। মুজিবনগর সরকারের সমরনীতি ছিল দ্রুত সময়ে বিজয় অর্জন। পাকিস্তানি সেনাদের আঘাত করা এবং তাদের অবরুদ্ধ করা।
ভারতীয় পত্রপত্রিকা, গণমাধ্যম, লােকসভার বিতর্ক এবং জনগণের আবেগের পরিমাপে যেকোনাে গবেষকমাত্রই দেখতে পাবেন যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারে ভারতের সরকার, বিরােধীদল কিংবা জনগণ কারাে বিরােধীতা ছিল না। বরং অবিলম্বে বাংলাদেশে সরাসরি সামরিক বাহিনী প্রেরণ করে বাংলাদেশকে মুক্ত করার আকাঙক্ষাই প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত ও উচ্চরিত হয়েছে নানা মাত্রিকতায়। প্রথমদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ সংকট নিরসন করতে চাইলেও তার বিজ্ঞ উপদেষ্টামণ্ডলী বা ইনার সার্কেলের পরামর্শে তিনি তার মত পরিবর্তন করে কূটনৈতিক যুদ্ধের দিকে ধাবিত হন। তাকে পরিষ্কারভাবে একথা বলা হয়েছিল যে, কূটনৈতিক যুদ্ধে বিজয়ী না হলে সামরিক যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া এবং সেই বিজয়কে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। সেজন্য ভারত বিশ্বপরিসরে ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। ভারতের কূটনৈতিক কৌশল ছিলাে- ক, শরণার্থী সমস্যাকে মানবিক সমস্যা এবং স্মরণতম ইতিহাসে ভয়াবহ মানবিক ট্রাজেডি। হিসেবে বিশ্বপরিসরে তুলে ধরা; খ, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধান যুক্ত করা; গ, বাংলাদেশ সংকট নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয় বন্দি শেখ মুজিবের মুক্তি; এবং ঘ, শরণার্থীরা তাদের নিরাপত্তা, সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিষয়টিকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বিশেষকরে শেখ মুজিবের মুক্তির সাথে সম্পর্কিত করা। শরণার্থী সমস্যার ক্ষেত্রে ভারত এপ্রিল মাসেই জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর পত্র প্রেরণ করে ভারতে আশ্রিত ছিন্নমূল, অসহায়, বিপর্যস্ত, অত্যাচারিত মানবিক দিকটি সার্থকভাবে তুলে ধরে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৫শে মার্চ আর্মি ক্ৰাকডাউনের পর বহিষ্কৃত বিদেশি সাংবাদিকদের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠে দিল্লি, কলকাতা ও আগরতলা। রণাঙ্গন থেকে যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহ, দুর্দশাগ্রস্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের আর্তনাদ ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির রিপাের্ট, প্রতিবেদন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক মানবসৃষ্ট ট্রাজেডির মর্মন্তুদ আখ্যানলিপি বিশ্বপরিসরে এমনভাবে প্রচারিত হয়েছিল যা স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব বিবেককে হতভম্ব ও হতচকিত করে তুলেছিল, বিশ্ববিবেককে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল।
সেজন্য শিল্পের তুলিতে, সংগীতের মুর্ঘনায়, বিক্ষুব্ধ চিত্তের বেদনা দগ্ধ অনুভূতিতে, প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত যুদ্ধরত বাংলাদেশ উপস্থিত থেকেছে। শরণার্থীদের সাহায্যে মানবতাবাদী সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গ অকুণ্ঠভাবে এগিয়ে এসেছে। এই এগিয়ে আসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কী করে এই ট্রাজিক মানবিক সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়। এজন্য ভারত কূটনৈতিক ক্ষেত্রে মানবিক-রাজনৈতিক ফর্মুলা নিয়ে অগ্রসর হয়। ভারতের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, ১৯৭০ সালের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হলে শরণার্থীরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিরাপদ বােধ করবে না, মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুন্ন থাকবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বারবার কূটনৈতিক ভাষায় বিশ্বকে স্মরণ করে। দিয়েছেন পূর্ববঙ্গের ঘটনা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও পূর্ববঙ্গের জনগণের গণরায় অনুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধি বিশেষকরে তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাদের ইচ্ছানুযায়ী রাজনৈতিক সমঝােতা খুঁজে নিতে হবে। জুলাই এর পর থেকে ভারত পূর্ববঙ্গের সংকটকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। হিসেবে আর বিবেচনা করেনি। তার বক্তব্য ছিল অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যখন উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করছে এবং বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। তখন বিষয়টি অভ্যন্তরীণ নয় বরং তা আন্তর্জাতিক। যার সমাধান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে তা হবে এক নিষ্ঠুর পরিণতি। বাংলাদেশ সংকট প্রশ্নে শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বব্যাপী সফর করে সংকটের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনে রাষ্ট্রপ্রধানদের সচেষ্ট করার ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ও তার সরকার, মন্ত্রীবর্গ, বিশেষ দূত, কূটনীতিক, বেসরকারি বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ প্রায় ৭০টি দেশে কূটনৈতিক অভিযান পরিচালনা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা ও তার মুক্তির দাবিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট পত্র প্রেরণ। করেন। তিনি সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পুরাতন মিত্রতা ঝালাই করে নেন। রাজনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি সামরিক কূটনীতি জোরদার করার লক্ষ্যে ভারত ৯ই আগস্ট সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে একটি শান্তি সহযােগিতা মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অপরিহার্যতা ছিল এই যে, বিশ্ব কূটনৈতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র তখন।
নতুনভাবে কূটনৈতিক বিন্যাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। নিক্সনের ‘চীন ডকট্রিন’ ঘােষণার পর সােভিয়েত রাশিয়া ও ভারত দুই দেশই উপলব্ধি করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিপ্রেক্ষিতে চীনও তার ধ্রুপদী নীতির পরিবর্তন করেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চীনের পরিবর্তিত নীতিতে ঝাঁঝ কমে এসেছে এবং মিত্র হিসেবে পাওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে প্রাথমিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রীং বাের্ড হিসেবে পাকিস্তানকে বেছে নেন। জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তান থেকে গােপনে চীন গমন করেন এবং মাও সেতুং ও চৌ এন লাইএর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে বিস্তারিত আলাপ করেন। চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক জোরদার হয়। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে তার বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে এই সম্পর্ক স্থাপনে সেতু হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে কিসিঞ্জারের ভাষায় তারা যথেষ্ট সময় দিতে পারেনি’ মনােযােগী হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ সংকটকে যুক্তরাষ্ট্র একটি উৎকট ও বাড়তি সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেছে। বিশ্বস্ত হিসেবে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামাের আওতায় রাজনৈতিক সমাধানের উপরে গুরুত্বারােপ করেছে এবং মার্কিন নীতি হিসেবে তা বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছে।  বন্দি শেখ মুজিব সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ছিল তাকে জীবিত রাখতে হবে।
কেননা ‘জীবত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব হবে আরাে ভয়ঙ্কর’ । হেনরি কিসিঞ্জার বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের নিরাপত্তা, ক্যামেরা ট্রায়ালে বিচার এবং মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এ সম্পর্কিত সংবাদে উৎকণ্ঠিত ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রদূত সারল্যান্ডের মাধ্যমে বন্দি মুজিবের নিরাপত্তা বিধানে সরাসরি ইয়াহিয়া খানকে বার্তা পাঠান। কিসিঞ্জারের একথা বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির মধ্যপন্থি, গণতান্ত্রিক এবং ভারসাম্যমূলক। তার অবর্তমানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বামপন্থিদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তিনি দেখতে পান। তাছাড়া কূটনৈতিক ক্ষেত্রে শেখ মুজিবকে জীবিত রেখে পরিস্থিতির প্রয়ােজনে তাকে ‘ট্রাম কার্ড’ হিসেবে ব্যবহারের চিন্তা করেছিলেন। ভারত কিসিঞ্জারের এই মনােভাব সম্পর্কে অবগত ছিল। সেজন্য বাংলাদেশ সংকট নিরসনে শেখ মুজিবের মুক্তিকে রাজনৈতিক সমাধানের মূল সূত্র হিসেবে তুলে ধরতে বিলম্ব করেননি এবং কূটনীতিক পরিমণ্ডলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিকে শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের শর্ত হিসেবে যুক্ত করেন।
২৫শে মার্চ পাকিস্তান সামরিক জান্তার কাকডাউনের ফলে রক্তপাত, মানবিক নিপীড়ন, ধর্ষণ, খুন এবং নিরীহ মানুষের উপর আক্রমণের প্রতিবাদ জানিয়ে সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগোর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বরাবর ২রা এপ্রিল একটি প্রতিবাদ পত্র প্রেরণ করেন। পত্রে রক্তপাত’ ও সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের’ উল্লেখ ছিল। পাকিস্তানের। প্রেসিডেন্ট এই পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সােভিয়েত ইউনিয়ন উপমহাদেশের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করে। নিক্সনের চীনা নীতির ফলে সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালায় সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন পাকিস্তানের বিদ্যমান সংকটকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে মনে করলেও অবিলম্বে শান্তিপূর্ণ আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উপর চাপ প্রয়ােগ করেন। চীন পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানালে সােভিয়েত রাশিয়া ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানের সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখার মনােভাব ধরে রাখে। এসময় সােভিয়েত ইউনিয়ন ও পাকিস্তানের সম্পর্ক শীতল হয়ে আসে। তারপরেও সােভিয়েত এই ধারণা পােষণ করে যে, সংকটের এক পর্যায়ে। তাসখন্দের মতাে মধ্যস্থতা করার সুযােগ রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-চীন-পাকিস্তান যখন কূটনৈতিক ক্ষেত্রে একই লক্ষ্যে অগ্রসর হয় তখন সােভিয়েত ইউনিয়ন নীতিগত ও কৌশলগত কারণে উপমহাদেশে তার আধিপত্য বহাল ও বিস্তার করার লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক জোরদার করে। সেই লক্ষ্যে ৯ই আগস্ট ভারতসােভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও বন্ধুত্বের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এই চুক্তির একটি অনুচ্ছেদে ছিল সামরিক সাহায্যের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযােগিতা। ২৯শে সেপ্টেম্বর সােভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোমিকো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ওয়াশিংটনে মত বিনিময় করেন। সে সময় নিক্সন বলেন যে, সােভিয়েত রাশিয়া ইতিপূর্বেও ঐ অঞ্চলে শান্তি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং ভারত-পাকিস্তান ‘ যুদ্ধ যাতে না হয় সে লক্ষ্যে সােভিয়েত সংকট নিরসনে অগ্রসর হতে পারে। গ্রোমিকো নিক্সনকে আশ্বস্ত করেন সােভিয়েত ইউনিয়ন এই সংঘর্ষ যুদ্ধে পরিণত হােক তা চায় না। এবং সােভিয়েত যে যুদ্ধ চায় না সে সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করানাে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঐ সময় ২৭-২৯শে সেপ্টেম্বর মস্কো গমন করেন। মস্কো প্রশাসন তাকে পরামর্শ দেয় যে, শান্তিপূর্ণ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যাওয়া। এটা ছিল ইন্দিরা গান্ধীর নিকট একটি নেতিবাচক ঝাকুনি।’ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অবিলম্বে প্রয়ােজনীয় সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য অনুরোধ জানান। সােভিয়েত রাশিয়া এক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করতে সম্মত হয়। সােভিয়েত রাশিয়ার নিকট প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলেন যে, কোনাে দেশ ভারতকে সমর্থন করুক বা না করুক তিনি তার নিজস্ব মতে লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাবেন। যুক্তরাষ্ট্র-চীন-পাকিস্তান ত্রিভুজ কূটনৈতিক বন্ধনে সােভিয়েতকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস লক্ষ্য করে সােভিয়েত রাশিয়া ভারতের সাহায্যে এগিয়ে আসে। যুদ্ধের প্রাক্কালে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতবর্ষ প্রতিনিয়ত যােগাযােগ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের বাইরে অতিরিক্ত কটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। মস্কোর পক্ষে কুঝনেসভ ও ভারতের পক্ষে ডি.পি, ধর উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শ করে প্রতিনিয়ত যুদ্ধপ্রস্তুতি সামরিক গতিপ্রকৃতি মূল্যায়ন করেন। নভেম্বর মাসের ভিতরেই সােভিয়েত সামরিক সরঞ্জাম জাহাজযােগে ভারতে প্রেরণ করা হয় এবং শেষেরদিকে বিমানে করে অস্ত্র পাঠানাে চলমান থাকে। সােভিয়েত-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক জাতিসংঘের সাধারণ ও নিরাপত্তা পরিষদের কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয়। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের প্রাককালে। সােভিয়েত ইউনিয়ন কূটনৈতিক তৎপরতা বিশ্বপরিসরে ভারতের পক্ষে ঝুঁকে পড়ে, এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত প্রসারিত হয়।  ৪ ও ৫ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে আলোচনায় রাজনৈতিক সমঝােতার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাব উপেক্ষিত করা হয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন জাতিসংঘ কর্তৃক প্রস্তাবিত উভয় দেশের সৈন্য প্রত্যাহার এবং জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগে জোর তাগিদ দেন। ভারত ইতােপূর্বেই বারবার বলে এসেছিল যে, রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে কেবল ১৯৭০ সালে নির্বাচনের জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এই আলােচনা ব্যর্থ হবে যদি শেখ মুজিবকে আলােচনায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া হয়। হেনরি কিসিঞ্জারের বক্তব্য ছিলাে এই মূহুর্তে শেখ মুজিবের প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই আলােচনা ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয়। ফিরে এসে নয়াদিল্লি থেকে শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী নিক্সনকে এক পত্রে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের উপরে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রভাব বিস্তার করবে বলে তিনি আশা করেন।
২৫শে নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট রজার্স ভারতের চার্জ দি অ্যাফেয়ার্স’ রাজগোত্রাকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের অভ্যন্তরে ভারতীয় সৈন্য অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজগােত্রা এই বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে উদ্‌বেগ প্রকাশ করে। বলেন, কেউ চায় না যুদ্ধ হােক। কিন্তু যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি রজার্স সেনা প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রতিনিধির মধ্যে আলােচনার সম্ভাবনা বিষয়টি দেখতে বলেন। ২৬শে নভেম্বর মার্কিন সিনেটর কানসার্স ও কিটিং প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। ২৯শে নভেম্বর তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটি পত্র প্রধানমন্ত্রী বরাবর হস্তান্তর করেন। পত্রে পাকিস্তান এবং ভারতের প্রতিনিধিদের একত্র বৈঠক করা এবং সৈন্য প্রত্যাহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। এই পত্র পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী গান্ধী দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং ভারত তার স্বার্থের প্রয়ােজনে যা কিছু প্রয়ােজন তা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ইন্দিরা গান্ধী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উপমহাদেশের সমস্যা বিশেষকরে পূর্ববঙ্গের সমস্যার কোনাে সমাধান করবে না। নিক্সনের সৈন্য প্রত্যাহারের পরামর্শ ও জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা এমন কথা শুনতে পারি না যা আমাদের দূর্বল করবে। কিটিং-এর রিপাের্টে বলা হয়, ভারত তাকে আশ্বস্ত করেছে মুক্তিবাহিনী নিজেই পূর্ববঙ্গ মুক্ত করতে ব্যর্থ হবে না।
 চীনা বিপ্লব সফল হওয়ার পর ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কোরিয়া ও তিব্বতের মতাে চীনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ভারতের নির্জোট দৃষ্টিভঙ্গি চীন-ভারতকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে কাছাকাছি নিয়ে আসে। এ কূটনৈতিক ধারা ছিল পরাশক্তির বাইরে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলি স্বাধীনভাবে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ-বহির্ভূত’ একটি বাতাবরণ সৃষ্টি। ১৯৫০ থেকে এই দুটি এশীয় শক্তির মৈত্রী বান্দুং সম্মেলনে আরাে নিবিড় হলে সােভিয়েত ও চীন আফ্রো-এশিয়া অকমিউনিস্ট দেশগুলাের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনে ভারতকে সামনে এগিয়ে দেয়। কিন্তু ১৯৫০ সালের শেষদিকে চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে বিরােধ সৃষ্টি হয়। এই বিরােধের পরিণতিতে শেষ পর্যায় ১৯৬২ সালে এক স্বল্পকালীন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভারত এই সময় যুক্তরাষ্ট্রের দিকে হাত বাড়ায় এবং জাতীয় স্বার্থে উভয় পরাশক্তির সাহায্য লাভে কূটনীতি পরিচালনা করে। এই কারণে চীন কৌশলগতভাবে পর্যবেক্ষণ করে যে, প্রতিবেশী ভারত ও সােভিয়েতের বিরুদ্ধে তার এককভাবে রাজনৈতিক এবং কুটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করা কষ্টকর। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সমর্থন করে এবং পাকিস্তানের প্রতি প্রতিশ্রুত সকল সাহায্য বন্ধ করে দেয়। চীন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায় এবং পাকিস্তানের নিঃসঙ্গতা দূরীকরণে চীন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের প্রধান উৎস হিসেবে তাকে সাহায্য করে। এসময় সােভিয়েত রাশিয়া ভারত ও পাকিস্তানকে সাহায্য না দিয়ে অনেকটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তানকে চীন সাহায্য করায় ভারতের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠে।
১৯৬৯ সালে সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ ঘােষিত এশিয়া নিরাপত্তা বেষ্টনী তত্ত্ব হাজির করেন এবং বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এই তত্ত্বের প্রতি ভারত সমর্থন জ্ঞাপন করে। সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের নীতি ছিল দক্ষিণ এশিয়াসহ এমন একটি নিরাপত্তা কাঠামাে গড়ে তােলা যার ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সােভিয়েত কর্মকাণ্ডে গতি লাভ করে। সােভিয়েতের সঙ্গে ভারত এই তত্ত্বের আওতাভুক্ত হয় এবং চীন এর বাইরে অবস্থান করে। চীন মনে করে তাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এই তত্ত্ব হাজির করা হয়েছে । যে সময় চীন ও সােভিয়েত সীমান্তে উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছে। এই সময় পাকিস্তান চীনবিরােধী যেকোনাে পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে ১৯৭০ সালে সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। | ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণহত্যা চালালেও চীন তার প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি, বরং ৪ঠা এপ্রিল চীনের মুখপাত্র নিউ চায়না এজেন্সি সংবাদ প্রকাশ করে যে, পূর্ব পাকিস্তানে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ স্তব্ধ করার জন্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ১১ই এপ্রিল পিপলস ডেইলি ভারতের সমালােচনা করে এই বলে যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত হস্তক্ষেপ করছে। ঐদিনই চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বরাবর এক পত্রে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য ভারত * সরকারকে অভিযুক্ত করেন। অনেক গবেষক মনে করেন, চীন পাকিস্তানের জনগণের প্রতি সমর্থনসূচক অঙ্গীকার করলেও পাকিস্তান সামরিক সরকারের প্রতি কোনাে সুস্পষ্ট সমর্থন ছিল না। তারপরেও একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় চীন ব্যাপকভাবে পাকিস্তানকে সামরিক অস্ত্র সরবরাহ করে এবং চীনের একথা জানা ছিল যে, সরবরাহকৃত ঐ অস্ত্রদ্বারা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে গণহত্যা চলছে। সে সময় চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নব দিগন্ত উন্মােচিত হচ্ছিল। ৯ই আগস্ট চীন ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির কারণে দেখতে পায় যে, ভারত তার জোটনিরপেক্ষতার নীতি পরিত্যাগ করেছে এবং ভারত এবং সােভিয়েত মিলে তার চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলছে। চীন মনে করে এটা শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় বরং এই চুক্তি চীনের জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করবে।
এই অবস্থায় ভারত ও সােভিয়েত রাশিয়ার কূটনৈতিক পদক্ষেপের বিপরীতে চীন তার ঘােষিত নীতি পুনমূল্যায়ণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযােগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করে। অনেক গবেষক বলে থাকেন, ১৯৭১ সালে চীন পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় চীনের সৈন্য সমাবেশ কিংবা যুদ্ধের প্রস্তুতি তেমনটি না থাকায় এ কথা ধরে নেওয়া যায় যে, চীন ঐ সময় পাকিস্তানের সাহায্যে তিব্বত কিংবা শিলিগুড়ি অঞ্চলে সৈন্য মােতায়েন করেনি। কিংবা ভারতকে মােকাবেলা করার কোনাে তৎপরতা দেখা যায়নি। চীনের এই ভূমিকার কারণ অন্বেষণে অনেক গবেষক মনে। করেন, বাংলাদেশ সংকটে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে গেলে চীন পূর্ব পাকিস্তানের দিকে অগ্রসর হতে পারবে না এ কারণে যে, চীনের সিয়াং কিং প্রদেশে সােভিয়েত ইউনিয়ন দশ লক্ষাধিক সৈন্য সমাবেশ করেছিল যার ফলে চীন এদিকে যেন মনােযােগ দিতে না পারে। চীনের বাংলাদেশ সংকট সম্পর্কে অনেকেই এই মন্তব্য করে থাকে যে, চীন। সম্ভবত স্বাধীনতা সংগ্রামরত বাঙালিদের বিরুদ্ধাচরণ করেনি। কিন্তু জাতিসংঘে চীনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে এসব কথা মােটেই ধােপে টিকে না। জাতিসংঘে চীন বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচণ্ড বিরােধীতা করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের গােপন নথি থেকে দেখা যায়, হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে গােপন বৈঠকে চীনের রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে পাকিস্তানকে সাহায্য করার মনােভাব প্রতিফলিত হয়। এসময় যুক্তরাষ্ট্র চীনকে পূর্ব সীমান্তে সৈন্য প্রেরণের জন্য বারবার প্ররােচিত করে। এছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের মূল্যায়ন ছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলে তা হবে ভারতের মিত্র রাষ্ট্র এবং স্বাভাবিকভাবে তা হবে চীনবিরােধী। চীনের অন্য একটি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেসব পিকিংপন্থি উপদলগুলাে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং পশ্চিমবাংলা, মিজোরাম, নেপাল এসব অঞ্চলে যেসব সশস্ত্র পিকিংপন্থি দলগুলাে পারস্পরিক যােগসূত্রে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাবে যেখানে মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নেতৃত্বের পরিবর্তন হবে এবং বামপন্থি নেতৃত্বে সেসব জায়গায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভবনা উদিত হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে চীনের ভূমিকার কারন ভিন্নভবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
চীন পাকিস্তানকে নৈতিক সমর্থন, সামরিক সরবরাহ সত্ত্বেও রাশিয়া ভারতের বিরােধীতা কূটনৈতিক তৎপরতার ভিতরেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। নিক্সন অবশ্য জাতিসংঘে রাশিয়া-ভারতের বিরুদ্ধে চীনের এই ‘তীব্র ঝগড়াটে’ প্রতিবাদ উপভােগ করেছেন। তার কথা ছিল চীন এরকম ‘ঝগড়া করতে থাকলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুবিধাজনক। এসব ব্যক্তিত চীন মূলত তার ভূমিকা কূটনৈতিক তৎপরতার ভিতরেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল সরাসরি যুদ্ধে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু যুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে চীন সীমান্ত দিয়ে যেমন প্রতিদিন অস্ত্র পাঠিয়েছে, তেমনি চীন গেরিলা যুদ্ধ মােকাবেলার জন্য গেরিলা কৌশল প্রশিক্ষণে ঢাকায় দুইশত সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছিল। তাছাড়াও চীন বহুজাতিক রাষ্ট্রে বিভক্ত এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সমস্যা নিয়ে তখন পর্যন্ত তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সুসংহত ছিল না, সে কারণে বাংলাদেশের জাতিত্বের ভিত্তিতে বিচ্ছিন্নতাগামী জনগণকে সমর্থন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্বতঃস্ফূর্ত জনযুদ্ধ হিসেবে মনে করেনি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারীদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের উপযুক্ত বলে তার নিকট প্রতীয়মান হয়নি। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের অবস্থান ছিল নীরব কূটনৈতিক বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ ২৭শে মার্চ বলেন, পূর্ব পাকিস্তান সংকটে ব্রিটেন জড়িত হবে । ৫ই এপ্রিল ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউম ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বলেন ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। ব্রিটিশ সরকার ব্রিটেনের গণমাধ্যমের ব্যাপক সমালােচনার সম্মুখীন হন এবং সামরিক এবং অর্থ সাহায্য বন্ধের জন্য পার্লামেন্টের ভিতরে এবং বাইরে দারুণ চাপ সৃষ্টি হয়। যদিও প্রকাশ্যে ব্রিটেন দেখিয়েছে যে, তার ভূমিকা নিরপেক্ষ এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্ত ক্ষেপ করছে না, কিন্তু কূটনৈতিক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের সংকট নিয়ে যথেষ্ট উদবিগ্ন ও তৎপর ছিল। ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে জোর দেন এবং রাজনৈতিক মতপার্থক্য সমাধানে বন্দি মুজিবের সঙ্গে আলােচনার পরামর্শ প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী হীথ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। সঙ্গে একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করে বলেন, সমস্যা সমাধানের জন্য শেখ মুজিবের। মুক্তি অপরিহার্য। এই লক্ষ্যে ব্রিটেন সরকার পাকিস্তানের সরকার বরাবর কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিল।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিশেষ দূত হিসেবে মিয়া আরসাদ হােসেনকে বিদেশে পাঠান। তিনি মস্কো, লন্ডন, প্যারিসে সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন করার পর তার নিকট প্রতীয়মান হয়েছে দেশগুলাে ভারত কর্তৃক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যে সহায়তা দিচ্ছে তা তারা ভালােভাবে নিচ্ছেন না। সরকারগুলাে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য মতামত প্রকাশ করেন। ১৫ই জুন পার্লামেন্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি ভারতের কোনাে উবেগের কারণ নয়। কিন্তু ভারত এমন কোনাে সমাধান মেনে নেবে না যা বাংলাদেশের মৃত্যু ঘটাবে। এর কয়েকদিন পর শ্রীমতী গান্ধী বলেন, রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সংকটের সমাধান। ব্রিটিশ সরকার কমন্সসভায় বিরােধী দল এবং বাইরে গণমাধ্যমের। প্রবল বিরােধীতার সম্মুখীন হন। যার ফলে ব্রিটিশ সরকার অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করতে বাধ্য হয়। ৮ ও ৯ই জুন কমন্সসভায় বক্তৃতাকালে স্যার অ্যালেক বলেন, রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য এমন একটি কাঠামাের উদ্ভাবন করতে হবে যেক্ষেত্রে শরণার্থীরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিরাপত্তা বােধ করবে। ১৫ই জুন লেবার পাটির ১২০জন সদস্য বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা এবং বাংলাদেশ স্বীকৃতির জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১২-২০শে জুন পর্যন্ত কনজারভেটিভ পাটির জিল গেট, একজন লেবার পাটি এবং অন্য একজন সদস্য পাকিস্তান সফর করেন। প্রতিনিধিদল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ব্রিটেনে ফিরে এসে বিবৃতি বলেন, এখনও পূর্ব পাকিস্তানে অত্যাচার, নিপীড়ন ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। তিনি ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে। অভিযােগ উত্থাপন করে বলেন, তার বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বে যতই সমালােচনা হােক না কেন তাতে তিনি কান দিচ্ছেন না। ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয়বারের মতাে একটি পার্লামেন্ট প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। এর মধ্যে দুজন লেবার পার্টি ও দুজন কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য ছিলেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন কমনওয়েলথের প্রাক্তন সেক্রেটারি আর্থার বটমূলী। এর লক্ষ্য ছিল পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীদের অবস্থা অবলােকন এবং পরিস্থিতির বাস্তবতা অনুধাবন।
প্রতিনিধি দল ব্যাপকভাবে পূর্ব পাকিস্তান ঘুরে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। ২৮শে জুন প্রতিনিধি দলের সদস্য টবি জেসেল বলেন, যা দেখেছি তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে যারা উদ্বাস্তু আছে তাদের ফিরিয়ে আসার কথা বলা সমীচীন নয় ১লা জুলাই নয়াদিল্লিতে আর্থার বটমূলী প্রতিনিধি দলের পক্ষে বলেন, তারা পূর্ব পাকিস্তানে এখনাে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে এবং মানুষ আতঙ্কে আছে। তার কাছে মনে হয়েছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও সম্ভবত জানেন না পূর্ববঙ্গে কী ঘটে চলেছে। সমাধানের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযােগ্য হবে যদি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ্যে না হলেও নানাভাবে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। লন্ডনে বাংলাদেশের দূতাবাস খােলার অনুমতি দেয়। লন্ডন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন মিটিং, মিছিল, আন্দোলন, সংগ্রামে, শ্লোগানে, সঙ্গীতে যে পরিবেশ সৃষ্টি করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তা অবিস্মরণীয়। লন্ডনকে কেন্দ্র করে। বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাঙালিদের ও মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালিত হয়েছে।
সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ব্রিটেন যে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছিল এমনটি নয়, বরং ব্রিটেন বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেছে। ব্রিটেন-এর নীরব কূটনৈতিক তৎপরতা জাতিসংঘে নিরপেক্ষ ভূমিকা পরােক্ষভাবে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে এসে দাঁড়ায়।  মুসলিম বিশ্বের কূটনৈতিক কার্যক্রম পাকিস্তানের পক্ষে পরিচালিত হয়েছে। ওআইসির দেশগুলাে বাংলাদেশের গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্নের বিরুদ্ধে কোনাে নিন্দা জ্ঞাপন করেনি বা প্রস্তাব উত্থাপন করেনি। বরং পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যুদ্ধের শেষপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় অনুযায়ী লিবিয়া, জর্ডান, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান প্রভৃতি মুসলিম দেশগুলাে পাকিস্তানকে অর্থ ও সামরিক সরঞ্জাম এমনকি অত্যাধুনিক বিমান সরবরাহ করেছে। মুসলিম দেশগুলাে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের উপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া দূরে থাক, সহানুভূতি প্রকাশ করেনি। একমাত্র আফগানিস্তান ব্যতীত কোনাে মুসলিম দেশ বাংলাদেশ সংগ্রামকে সমর্থন জানায়নি। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করলেও একইসাথে তারা ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ রেখেছে। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জেনারেল সুহার্তো ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে মধ্যস্থতা করতে চেয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে তেমন কোনাে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে বলে তথ্য মেলে না।। 
সবচেয়ে বিস্মিত হতে হয় জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে যদিও শরণার্থী সাহায্যের ব্যাপারে জাতিসংঘ কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ সংকট নিরসনে প্রকাশ্যে কোনাে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেনি। যদিও ভারত প্রথমেই শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশ সংকট জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। জাতিসংঘের মহাসচিব ১৯শে জুলাই নিরাপত্তা পরিষদকে দেওয়া এক পত্রে তার উদ্‌বেগের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি একথা বলেছেন সমস্যাকে শুধু মানবিক দিক থেকে দেখলে চলবে না, বরং শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি এটা গুরুতর একটি হুমকি। যেক্ষেত্রে মানবিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যার মিশ্রণে এমন একটি জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে সেক্ষেত্রে জাতিসংঘের জন্য এটা হবে একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ এমন সুদূরপ্রসারী যে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা এই সমস্যা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ার আগেই জাতিসংঘ সর্বজনগ্রাহ্য কোনাে ভূমিকা নিতে পারে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদকে সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ মনোেযােগ ও আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করার কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি ন্যায়ানুগ ঘটনা। জাতিসংঘ দায়িত্ব পালনে যথাযথ । ভূমিকা পালন না করার ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে একটি দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে দেখা দেয় । নীতিটি হলো- এক, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং মানবাধিকার বিষয়ে; ও দুই, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার নীতি। বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসংঘের এই নীতির দুটি অংশ পারস্পরিক সাংঘর্ষিক হিসেবে উপস্থিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যখন ব্যাপক গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছিল তখন জাতিসংঘ তা বন্ধে ব্যর্থ হয়। কিন্তু মানবাধিকারে ঘােষিত অনুচ্ছেদগুলির কার্যকারিতা সহজেই এই ব্যর্থতাকে অতিক্রম করতে পারত। কিন্তু জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বাংলাদেশ সংকটকে তার চত্বরে প্রবেশ করতে দেয়নি। চীন ও মুসলিম দেশগুলাের প্রচণ্ড বিরােধীতার কারণে জাতিসংঘ তার প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়।
গণহত্যা ও নির্যাতনের বিষয়টি জাতিসংঘ প্রকাশ্যে তুলে ধরতে পারেনি এ কারণে যে, কোনাে দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অন্য কোনাে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কোনাে সুযােগ চার্টারে উল্লেখ ছিল না বলে দোহাই দেওয়া হয়েছে। অথচ জাতিসংঘ সনদে ধারা ২-এর ৭ উপধারায় বর্ণিত হয়েছে, বর্তমান সনদ জাতিসংঘকে কোনাে রাষ্ট্রের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার দিচ্ছে বা সেরূপ বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য কোন সদস্যকে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে না, কিন্তু সপ্তম অধ্যায় অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের ব্যাপারে এই নীতি অন্তরায় হবে। ” সপ্তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতিসংঘ এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনাে বাধা ছিল না। মুজিবনগর সরকার সর্বদা বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্ন জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে একটি সরকার গঠন অথবা স্বীকৃতির ক্ষেত্রে যে শর্তগুলাে পালন করা প্রয়ােজন ছিল বাংলাদেশ সরকার তার সবগুলাে পালন করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবার যােগ্যতা অর্জন করেছিলেন। শর্তগুলাের মধ্যে : ১. একটি সার্বভৌম সরকার গঠন; ২. অধিকৃত এলাকায় বৈধ শাসন; এবং ৩, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে সংগ্রাম অব্যাহত রাখা। মুজিবনগর সরকার হিলি, রৌমারি, পঞ্চগড় এলাকায় তার দখল কায়েম করেছিল, প্রশাসনযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাে, সচিবালয় স্থাপন করেছিল, কূটনৈতিক মিশন স্থাপন, নিজস্ব কোষাগার, কর্মচারীদের বেতন, পুলিশ বাহিনী ও সেনাবাহিনী গঠন করা এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়াও ছিল নিজস্ব প্রচারমাধ্যম, জয়বাংলা পত্রিকা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সর্বোপরি, সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সমগ্র জনগণের আস্থা অর্জন এবং আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালনে কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে দৃশ্যমান উপস্থিতি। এরপরেও জাতিসংঘ বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বরং জাতিসংঘের মহাসচিব ১৯শে জুলাই ভারত-পাকিস্তান উভয় সীমান্তে পর্যবেক্ষক মােতায়েনের যে প্রস্তাব দিয়েছিল তার উদ্দেশ্য মানবিক মনে হলেও রাজনৈতিকভাবে এবং সামরিকভাবে তা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। কেননা এই প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে মুক্তিযােদ্ধাদের যাতায়াত এবং যুদ্ধ প্রশিক্ষণের উপরে বিরাট অন্তরায় সৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল। সেজন্য মুজিবনগর সরকার এবং ভারত জাতিসংঘের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিষয়ে আটকে থাকায় রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে কোনাে অগ্রগতি সাধিত হয়নি। জাতিসংঘের ২৬তম অধিবেশনে বাংলাদেশের সংকট সরাসরি এজেন্ডাভুক্ত হয়নি। মহাসচিব কর্তৃক বাংলাদেশ’ শব্দটি উচ্চারিত না হলেও এবং সাধারণ পরিষদের সভাপতি কর্তৃক তা উপেক্ষা করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সংকট সম্পর্কে আলােচনা-সমালােচনা এবং বাংলাদেশ সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে না দেখে মানবিক সমস্যা হিসেবে এড়িয়ে গেছে। ৫৭টি দেশের মধ্যে ২২টি দেশ বাংলাদেশ সংকটকে সরাসরি মানবিক দৃষ্টি থেকে বিচার করেছে। ৩৩টি দেশ মানবিক সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক দিকটি চিহ্নিত করেছেন। পাকিস্তান বলেছে বাংলাদেশ সমস্যা বলে কিছু নেই বরং তাদের মতে এটা ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা। অন্যদিকে, ভারতের বক্তব্য ছিল এটা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমস্যা, এটা কোনােক্রমেই ভারতের সমস্যা নয়। প্রকৃতপক্ষে বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক চালে বাংলাদেশ সমস্যাকে আড়াল করার প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছে। যদিও জাতিসংঘে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে যখন বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় তখন বাংলাদেশ সমস্যা সামনে চলে আসে। চীনা প্রতিনিধি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতি কটাক্ষ করেছে সবচেয়ে বেশি। চীনা প্রতিনিধি হুয়াং বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীদের প্রতিনিধি’ বলে অভিহিত করেন। তিনি আরাে বলেন, বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানাের অর্থ হলাে, একটি সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্ত ক্ষেপ করা। তাই চীনা প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রতিনিধির বৈঠকে অংশগ্রহণেই শুধু বিরােধীতা করেননি, পরিষদে যাতে তার পত্রটি বিলি না হয়, সে জন্যেও তৎপর ছিলেন। কিন্তু সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদের ডকুমেন্ট হিসেবে পত্রটি বিলি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও অংশগ্রহণের দাবিটি সমর্থিত হয়নি। ভারত অবশ্য বলেছিল, আগা শাহী যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন তা পাকিস্তানের এক অংশের বক্তব্য।
পূর্ববঙ্গ পৃথক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেজন্য তাদের দাবি শােনা প্রয়ােজন। জাতিসংঘ স্বাধীনভাবে তার কার্য পরিচালনা করতে সমর্থ হয়নি, বরং জাতিসংঘের বাইরে অথবা জাতিসংঘের অভ্যন্তরে পরাশক্তি ও বৃহৎ শক্তিগুলাে জাতীয় স্বার্থ ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থকে সামনে রেখে অগ্রসর হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিজস্ব অবস্থান নিতে পারেনি এ কারণে যে, স্ব-স্ব দেশের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা’ প্রবণতা মনস্তাত্ত্বিকভাবে তাদের দুর্বল করে রেখেছিল। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত প্রস্তাব এবং চীনের উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয় সােভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে ফ্রান্স এবং ব্রিটেন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। সহায়ক হয়। তবে সাধারণ পরিষদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে পাকিস্তান অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন থাকলেও তা কাজে আসেনি, কারণ তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়ে গেছে। সেজন্য নিরাপত্তা ও সাধারণ পরিষদে বৈঠকগুলাের কার্যকারিতা অকেজো। হয়ে যায়।  চীন যুক্তরাষ্ট্রের বহুমূখী কূটনীতিক তৎপরতা ও মুসলিম দেশগুলাের পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান ভাঙন ঠেকানাে যায়নি। চতুর্ভূজ কূটনীতির কারনে একদিকে ভারত এবং সােভিয়েত, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও চীনের কূটনৈতিক মৈত্রীর বন্ধন সামরিক কূটনীতির কাছে পরাস্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গানবােট ডিপ্লোমেসির বিপরীতে সােভিয়েত পরমাণু নৌবহরের উপস্থিতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নতুন কূটনৈতিক মাত্রা যােগ করে। সামুদ্রিক কূটনীতির ক্ষেত্রে ভারতীয় সামুদ্রিক রণকৌশলের নিকট পাকিস্তান অসহায় হয়ে পড়েছিল, যেমন আকাশযুদ্ধে বাংলাদেশের সীমানায় ৭ই ডিসেম্বরের পর হতেই তারা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশের জনগণের দুর্দমনীয় মনােভাব ও স্বাধীনতার প্রতি অদম্য। আকাক্ষার প্রচণ্ডতা পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক পরাজয় ডেকে এনেছিল। যার ফলে বাংলাদেশের যুদ্ধরত পাকিস্তানি সেনানায়কগণকে ৯৩ হাজার সৈন্যসহ অমর্যাদা ও অসম্মানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। রাজনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি ভারতের সামরিক কূটনীতি এবং ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক কমান্ড গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাংশে ধ্বংসপ্রাপ্ত কফিনে শেষ পেরেকটি ঢুকে দেয় দ্রুততার সঙ্গে। ভারত-বাংলাদেশের সমর কূটনীতির যথার্থ বাস্তবায়নে জলস্থলে অন্তরীক্ষে পালাবার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ৯৩ হাজার সৈন্যের আত্মসমর্পণ তাদের জিম্মি করায় পশ্চিম পাকিস্তানের হিমশীতল বন্দি কারাগার থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিরাপত্তা ও মুক্তি অনিবার্য করে তুলেছিল। যা রাজনৈতিক কূটনীতি ও সমর কূটনীতির যৌথ ফলাফলের ফলশ্রুতি।

সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কূটনৈতিক যুদ্ধ – আবু সাইয়িদ