১৯৬৯ সালে সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ ঘােষিত এশিয়া নিরাপত্তা বেষ্টনী তত্ত্ব হাজির করেন এবং বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এই তত্ত্বের প্রতি ভারত সমর্থন জ্ঞাপন করে। সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের নীতি ছিল দক্ষিণ এশিয়াসহ এমন একটি নিরাপত্তা কাঠামাে গড়ে তােলা যার ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সােভিয়েত কর্মকাণ্ডে গতি লাভ করে। সােভিয়েতের সঙ্গে ভারত এই তত্ত্বের আওতাভুক্ত হয় এবং চীন এর বাইরে অবস্থান করে। চীন মনে করে তাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এই তত্ত্ব হাজির করা হয়েছে । যে সময় চীন ও সােভিয়েত সীমান্তে উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছে। এই সময় পাকিস্তান চীনবিরােধী যেকোনাে পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে ১৯৭০ সালে সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। | ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণহত্যা চালালেও চীন তার প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি, বরং ৪ঠা এপ্রিল চীনের মুখপাত্র নিউ চায়না এজেন্সি সংবাদ প্রকাশ করে যে, পূর্ব পাকিস্তানে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ স্তব্ধ করার জন্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ১১ই এপ্রিল পিপলস ডেইলি ভারতের সমালােচনা করে এই বলে যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত হস্তক্ষেপ করছে। ঐদিনই চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বরাবর এক পত্রে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য ভারত * সরকারকে অভিযুক্ত করেন। অনেক গবেষক মনে করেন, চীন পাকিস্তানের জনগণের প্রতি সমর্থনসূচক অঙ্গীকার করলেও পাকিস্তান সামরিক সরকারের প্রতি কোনাে সুস্পষ্ট সমর্থন ছিল না। তারপরেও একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় চীন ব্যাপকভাবে পাকিস্তানকে সামরিক অস্ত্র সরবরাহ করে এবং চীনের একথা জানা ছিল যে, সরবরাহকৃত ঐ অস্ত্রদ্বারা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে গণহত্যা চলছে। সে সময় চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নব দিগন্ত উন্মােচিত হচ্ছিল। ৯ই আগস্ট চীন ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির কারণে দেখতে পায় যে, ভারত তার জোটনিরপেক্ষতার নীতি পরিত্যাগ করেছে এবং ভারত এবং সােভিয়েত মিলে তার চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলছে। চীন মনে করে এটা শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় বরং এই চুক্তি চীনের জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করবে।
এই অবস্থায় ভারত ও সােভিয়েত রাশিয়ার কূটনৈতিক পদক্ষেপের বিপরীতে চীন তার ঘােষিত নীতি পুনমূল্যায়ণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযােগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করে। অনেক গবেষক বলে থাকেন, ১৯৭১ সালে চীন পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় চীনের সৈন্য সমাবেশ কিংবা যুদ্ধের প্রস্তুতি তেমনটি না থাকায় এ কথা ধরে নেওয়া যায় যে, চীন ঐ সময় পাকিস্তানের সাহায্যে তিব্বত কিংবা শিলিগুড়ি অঞ্চলে সৈন্য মােতায়েন করেনি। কিংবা ভারতকে মােকাবেলা করার কোনাে তৎপরতা দেখা যায়নি। চীনের এই ভূমিকার কারণ অন্বেষণে অনেক গবেষক মনে। করেন, বাংলাদেশ সংকটে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে গেলে চীন পূর্ব পাকিস্তানের দিকে অগ্রসর হতে পারবে না এ কারণে যে, চীনের সিয়াং কিং প্রদেশে সােভিয়েত ইউনিয়ন দশ লক্ষাধিক সৈন্য সমাবেশ করেছিল যার ফলে চীন এদিকে যেন মনােযােগ দিতে না পারে। চীনের বাংলাদেশ সংকট সম্পর্কে অনেকেই এই মন্তব্য করে থাকে যে, চীন। সম্ভবত স্বাধীনতা সংগ্রামরত বাঙালিদের বিরুদ্ধাচরণ করেনি। কিন্তু জাতিসংঘে চীনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে এসব কথা মােটেই ধােপে টিকে না। জাতিসংঘে চীন বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচণ্ড বিরােধীতা করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের গােপন নথি থেকে দেখা যায়, হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে গােপন বৈঠকে চীনের রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে পাকিস্তানকে সাহায্য করার মনােভাব প্রতিফলিত হয়। এসময় যুক্তরাষ্ট্র চীনকে পূর্ব সীমান্তে সৈন্য প্রেরণের জন্য বারবার প্ররােচিত করে। এছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের মূল্যায়ন ছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলে তা হবে ভারতের মিত্র রাষ্ট্র এবং স্বাভাবিকভাবে তা হবে চীনবিরােধী। চীনের অন্য একটি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেসব পিকিংপন্থি উপদলগুলাে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং পশ্চিমবাংলা, মিজোরাম, নেপাল এসব অঞ্চলে যেসব সশস্ত্র পিকিংপন্থি দলগুলাে পারস্পরিক যােগসূত্রে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাবে যেখানে মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নেতৃত্বের পরিবর্তন হবে এবং বামপন্থি নেতৃত্বে সেসব জায়গায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভবনা উদিত হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে চীনের ভূমিকার কারন ভিন্নভবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
চীন পাকিস্তানকে নৈতিক সমর্থন, সামরিক সরবরাহ সত্ত্বেও রাশিয়া ভারতের বিরােধীতা কূটনৈতিক তৎপরতার ভিতরেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। নিক্সন অবশ্য জাতিসংঘে রাশিয়া-ভারতের বিরুদ্ধে চীনের এই ‘তীব্র ঝগড়াটে’ প্রতিবাদ উপভােগ করেছেন। তার কথা ছিল চীন এরকম ‘ঝগড়া করতে থাকলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুবিধাজনক। এসব ব্যক্তিত চীন মূলত তার ভূমিকা কূটনৈতিক তৎপরতার ভিতরেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল সরাসরি যুদ্ধে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু যুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে চীন সীমান্ত দিয়ে যেমন প্রতিদিন অস্ত্র পাঠিয়েছে, তেমনি চীন গেরিলা যুদ্ধ মােকাবেলার জন্য গেরিলা কৌশল প্রশিক্ষণে ঢাকায় দুইশত সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছিল। তাছাড়াও চীন বহুজাতিক রাষ্ট্রে বিভক্ত এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সমস্যা নিয়ে তখন পর্যন্ত তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সুসংহত ছিল না, সে কারণে বাংলাদেশের জাতিত্বের ভিত্তিতে বিচ্ছিন্নতাগামী জনগণকে সমর্থন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্বতঃস্ফূর্ত জনযুদ্ধ হিসেবে মনে করেনি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারীদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের উপযুক্ত বলে তার নিকট প্রতীয়মান হয়নি। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের অবস্থান ছিল নীরব কূটনৈতিক বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ ২৭শে মার্চ বলেন, পূর্ব পাকিস্তান সংকটে ব্রিটেন জড়িত হবে । ৫ই এপ্রিল ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউম ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বলেন ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। ব্রিটিশ সরকার ব্রিটেনের গণমাধ্যমের ব্যাপক সমালােচনার সম্মুখীন হন এবং সামরিক এবং অর্থ সাহায্য বন্ধের জন্য পার্লামেন্টের ভিতরে এবং বাইরে দারুণ চাপ সৃষ্টি হয়। যদিও প্রকাশ্যে ব্রিটেন দেখিয়েছে যে, তার ভূমিকা নিরপেক্ষ এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্ত ক্ষেপ করছে না, কিন্তু কূটনৈতিক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের সংকট নিয়ে যথেষ্ট উদবিগ্ন ও তৎপর ছিল। ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে জোর দেন এবং রাজনৈতিক মতপার্থক্য সমাধানে বন্দি মুজিবের সঙ্গে আলােচনার পরামর্শ প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী হীথ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। সঙ্গে একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করে বলেন, সমস্যা সমাধানের জন্য শেখ মুজিবের। মুক্তি অপরিহার্য। এই লক্ষ্যে ব্রিটেন সরকার পাকিস্তানের সরকার বরাবর কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিল।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিশেষ দূত হিসেবে মিয়া আরসাদ হােসেনকে বিদেশে পাঠান। তিনি মস্কো, লন্ডন, প্যারিসে সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন করার পর তার নিকট প্রতীয়মান হয়েছে দেশগুলাে ভারত কর্তৃক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যে সহায়তা দিচ্ছে তা তারা ভালােভাবে নিচ্ছেন না। সরকারগুলাে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য মতামত প্রকাশ করেন। ১৫ই জুন পার্লামেন্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি ভারতের কোনাে উবেগের কারণ নয়। কিন্তু ভারত এমন কোনাে সমাধান মেনে নেবে না যা বাংলাদেশের মৃত্যু ঘটাবে। এর কয়েকদিন পর শ্রীমতী গান্ধী বলেন, রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সংকটের সমাধান। ব্রিটিশ সরকার কমন্সসভায় বিরােধী দল এবং বাইরে গণমাধ্যমের। প্রবল বিরােধীতার সম্মুখীন হন। যার ফলে ব্রিটিশ সরকার অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করতে বাধ্য হয়। ৮ ও ৯ই জুন কমন্সসভায় বক্তৃতাকালে স্যার অ্যালেক বলেন, রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য এমন একটি কাঠামাের উদ্ভাবন করতে হবে যেক্ষেত্রে শরণার্থীরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিরাপত্তা বােধ করবে। ১৫ই জুন লেবার পাটির ১২০জন সদস্য বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা এবং বাংলাদেশ স্বীকৃতির জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১২-২০শে জুন পর্যন্ত কনজারভেটিভ পাটির জিল গেট, একজন লেবার পাটি এবং অন্য একজন সদস্য পাকিস্তান সফর করেন। প্রতিনিধিদল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ব্রিটেনে ফিরে এসে বিবৃতি বলেন, এখনও পূর্ব পাকিস্তানে অত্যাচার, নিপীড়ন ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। তিনি ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে। অভিযােগ উত্থাপন করে বলেন, তার বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বে যতই সমালােচনা হােক না কেন তাতে তিনি কান দিচ্ছেন না। ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয়বারের মতাে একটি পার্লামেন্ট প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। এর মধ্যে দুজন লেবার পার্টি ও দুজন কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য ছিলেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন কমনওয়েলথের প্রাক্তন সেক্রেটারি আর্থার বটমূলী। এর লক্ষ্য ছিল পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীদের অবস্থা অবলােকন এবং পরিস্থিতির বাস্তবতা অনুধাবন।
প্রতিনিধি দল ব্যাপকভাবে পূর্ব পাকিস্তান ঘুরে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। ২৮শে জুন প্রতিনিধি দলের সদস্য টবি জেসেল বলেন, যা দেখেছি তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে যারা উদ্বাস্তু আছে তাদের ফিরিয়ে আসার কথা বলা সমীচীন নয় ১লা জুলাই নয়াদিল্লিতে আর্থার বটমূলী প্রতিনিধি দলের পক্ষে বলেন, তারা পূর্ব পাকিস্তানে এখনাে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে এবং মানুষ আতঙ্কে আছে। তার কাছে মনে হয়েছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও সম্ভবত জানেন না পূর্ববঙ্গে কী ঘটে চলেছে। সমাধানের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযােগ্য হবে যদি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ্যে না হলেও নানাভাবে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। লন্ডনে বাংলাদেশের দূতাবাস খােলার অনুমতি দেয়। লন্ডন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন মিটিং, মিছিল, আন্দোলন, সংগ্রামে, শ্লোগানে, সঙ্গীতে যে পরিবেশ সৃষ্টি করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তা অবিস্মরণীয়। লন্ডনকে কেন্দ্র করে। বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাঙালিদের ও মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালিত হয়েছে।
সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ব্রিটেন যে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছিল এমনটি নয়, বরং ব্রিটেন বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেছে। ব্রিটেন-এর নীরব কূটনৈতিক তৎপরতা জাতিসংঘে নিরপেক্ষ ভূমিকা পরােক্ষভাবে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে এসে দাঁড়ায়। মুসলিম বিশ্বের কূটনৈতিক কার্যক্রম পাকিস্তানের পক্ষে পরিচালিত হয়েছে। ওআইসির দেশগুলাে বাংলাদেশের গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্নের বিরুদ্ধে কোনাে নিন্দা জ্ঞাপন করেনি বা প্রস্তাব উত্থাপন করেনি। বরং পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যুদ্ধের শেষপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় অনুযায়ী লিবিয়া, জর্ডান, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান প্রভৃতি মুসলিম দেশগুলাে পাকিস্তানকে অর্থ ও সামরিক সরঞ্জাম এমনকি অত্যাধুনিক বিমান সরবরাহ করেছে। মুসলিম দেশগুলাে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের উপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া দূরে থাক, সহানুভূতি প্রকাশ করেনি। একমাত্র আফগানিস্তান ব্যতীত কোনাে মুসলিম দেশ বাংলাদেশ সংগ্রামকে সমর্থন জানায়নি। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করলেও একইসাথে তারা ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ রেখেছে। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জেনারেল সুহার্তো ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে মধ্যস্থতা করতে চেয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে তেমন কোনাে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে বলে তথ্য মেলে না।।
সবচেয়ে বিস্মিত হতে হয় জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে যদিও শরণার্থী সাহায্যের ব্যাপারে জাতিসংঘ কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ সংকট নিরসনে প্রকাশ্যে কোনাে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেনি। যদিও ভারত প্রথমেই শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশ সংকট জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। জাতিসংঘের মহাসচিব ১৯শে জুলাই নিরাপত্তা পরিষদকে দেওয়া এক পত্রে তার উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি একথা বলেছেন সমস্যাকে শুধু মানবিক দিক থেকে দেখলে চলবে না, বরং শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি এটা গুরুতর একটি হুমকি। যেক্ষেত্রে মানবিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যার মিশ্রণে এমন একটি জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে সেক্ষেত্রে জাতিসংঘের জন্য এটা হবে একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ এমন সুদূরপ্রসারী যে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা এই সমস্যা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ার আগেই জাতিসংঘ সর্বজনগ্রাহ্য কোনাে ভূমিকা নিতে পারে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদকে সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ মনোেযােগ ও আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করার কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি ন্যায়ানুগ ঘটনা। জাতিসংঘ দায়িত্ব পালনে যথাযথ । ভূমিকা পালন না করার ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে একটি দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে দেখা দেয় । নীতিটি হলো- এক, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং মানবাধিকার বিষয়ে; ও দুই, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার নীতি। বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসংঘের এই নীতির দুটি অংশ পারস্পরিক সাংঘর্ষিক হিসেবে উপস্থিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যখন ব্যাপক গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছিল তখন জাতিসংঘ তা বন্ধে ব্যর্থ হয়। কিন্তু মানবাধিকারে ঘােষিত অনুচ্ছেদগুলির কার্যকারিতা সহজেই এই ব্যর্থতাকে অতিক্রম করতে পারত। কিন্তু জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বাংলাদেশ সংকটকে তার চত্বরে প্রবেশ করতে দেয়নি। চীন ও মুসলিম দেশগুলাের প্রচণ্ড বিরােধীতার কারণে জাতিসংঘ তার প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়।
গণহত্যা ও নির্যাতনের বিষয়টি জাতিসংঘ প্রকাশ্যে তুলে ধরতে পারেনি এ কারণে যে, কোনাে দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অন্য কোনাে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কোনাে সুযােগ চার্টারে উল্লেখ ছিল না বলে দোহাই দেওয়া হয়েছে। অথচ জাতিসংঘ সনদে ধারা ২-এর ৭ উপধারায় বর্ণিত হয়েছে, বর্তমান সনদ জাতিসংঘকে কোনাে রাষ্ট্রের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার দিচ্ছে বা সেরূপ বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য কোন সদস্যকে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে না, কিন্তু সপ্তম অধ্যায় অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের ব্যাপারে এই নীতি অন্তরায় হবে। ” সপ্তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতিসংঘ এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনাে বাধা ছিল না। মুজিবনগর সরকার সর্বদা বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্ন জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে একটি সরকার গঠন অথবা স্বীকৃতির ক্ষেত্রে যে শর্তগুলাে পালন করা প্রয়ােজন ছিল বাংলাদেশ সরকার তার সবগুলাে পালন করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবার যােগ্যতা অর্জন করেছিলেন। শর্তগুলাের মধ্যে : ১. একটি সার্বভৌম সরকার গঠন; ২. অধিকৃত এলাকায় বৈধ শাসন; এবং ৩, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে সংগ্রাম অব্যাহত রাখা। মুজিবনগর সরকার হিলি, রৌমারি, পঞ্চগড় এলাকায় তার দখল কায়েম করেছিল, প্রশাসনযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাে, সচিবালয় স্থাপন করেছিল, কূটনৈতিক মিশন স্থাপন, নিজস্ব কোষাগার, কর্মচারীদের বেতন, পুলিশ বাহিনী ও সেনাবাহিনী গঠন করা এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়াও ছিল নিজস্ব প্রচারমাধ্যম, জয়বাংলা পত্রিকা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সর্বোপরি, সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সমগ্র জনগণের আস্থা অর্জন এবং আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালনে কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে দৃশ্যমান উপস্থিতি। এরপরেও জাতিসংঘ বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বরং জাতিসংঘের মহাসচিব ১৯শে জুলাই ভারত-পাকিস্তান উভয় সীমান্তে পর্যবেক্ষক মােতায়েনের যে প্রস্তাব দিয়েছিল তার উদ্দেশ্য মানবিক মনে হলেও রাজনৈতিকভাবে এবং সামরিকভাবে তা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। কেননা এই প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে মুক্তিযােদ্ধাদের যাতায়াত এবং যুদ্ধ প্রশিক্ষণের উপরে বিরাট অন্তরায় সৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল। সেজন্য মুজিবনগর সরকার এবং ভারত জাতিসংঘের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিষয়ে আটকে থাকায় রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে কোনাে অগ্রগতি সাধিত হয়নি। জাতিসংঘের ২৬তম অধিবেশনে বাংলাদেশের সংকট সরাসরি এজেন্ডাভুক্ত হয়নি। মহাসচিব কর্তৃক বাংলাদেশ’ শব্দটি উচ্চারিত না হলেও এবং সাধারণ পরিষদের সভাপতি কর্তৃক তা উপেক্ষা করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সংকট সম্পর্কে আলােচনা-সমালােচনা এবং বাংলাদেশ সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে না দেখে মানবিক সমস্যা হিসেবে এড়িয়ে গেছে। ৫৭টি দেশের মধ্যে ২২টি দেশ বাংলাদেশ সংকটকে সরাসরি মানবিক দৃষ্টি থেকে বিচার করেছে। ৩৩টি দেশ মানবিক সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক দিকটি চিহ্নিত করেছেন। পাকিস্তান বলেছে বাংলাদেশ সমস্যা বলে কিছু নেই বরং তাদের মতে এটা ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা। অন্যদিকে, ভারতের বক্তব্য ছিল এটা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমস্যা, এটা কোনােক্রমেই ভারতের সমস্যা নয়। প্রকৃতপক্ষে বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক চালে বাংলাদেশ সমস্যাকে আড়াল করার প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছে। যদিও জাতিসংঘে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে যখন বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় তখন বাংলাদেশ সমস্যা সামনে চলে আসে। চীনা প্রতিনিধি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতি কটাক্ষ করেছে সবচেয়ে বেশি। চীনা প্রতিনিধি হুয়াং বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীদের প্রতিনিধি’ বলে অভিহিত করেন। তিনি আরাে বলেন, বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানাের অর্থ হলাে, একটি সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্ত ক্ষেপ করা। তাই চীনা প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রতিনিধির বৈঠকে অংশগ্রহণেই শুধু বিরােধীতা করেননি, পরিষদে যাতে তার পত্রটি বিলি না হয়, সে জন্যেও তৎপর ছিলেন। কিন্তু সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদের ডকুমেন্ট হিসেবে পত্রটি বিলি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও অংশগ্রহণের দাবিটি সমর্থিত হয়নি। ভারত অবশ্য বলেছিল, আগা শাহী যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন তা পাকিস্তানের এক অংশের বক্তব্য।
পূর্ববঙ্গ পৃথক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেজন্য তাদের দাবি শােনা প্রয়ােজন। জাতিসংঘ স্বাধীনভাবে তার কার্য পরিচালনা করতে সমর্থ হয়নি, বরং জাতিসংঘের বাইরে অথবা জাতিসংঘের অভ্যন্তরে পরাশক্তি ও বৃহৎ শক্তিগুলাে জাতীয় স্বার্থ ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থকে সামনে রেখে অগ্রসর হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিজস্ব অবস্থান নিতে পারেনি এ কারণে যে, স্ব-স্ব দেশের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা’ প্রবণতা মনস্তাত্ত্বিকভাবে তাদের দুর্বল করে রেখেছিল। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত প্রস্তাব এবং চীনের উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয় সােভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে ফ্রান্স এবং ব্রিটেন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। সহায়ক হয়। তবে সাধারণ পরিষদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে পাকিস্তান অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন থাকলেও তা কাজে আসেনি, কারণ তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়ে গেছে। সেজন্য নিরাপত্তা ও সাধারণ পরিষদে বৈঠকগুলাের কার্যকারিতা অকেজো। হয়ে যায়। চীন যুক্তরাষ্ট্রের বহুমূখী কূটনীতিক তৎপরতা ও মুসলিম দেশগুলাের পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান ভাঙন ঠেকানাে যায়নি। চতুর্ভূজ কূটনীতির কারনে একদিকে ভারত এবং সােভিয়েত, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও চীনের কূটনৈতিক মৈত্রীর বন্ধন সামরিক কূটনীতির কাছে পরাস্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গানবােট ডিপ্লোমেসির বিপরীতে সােভিয়েত পরমাণু নৌবহরের উপস্থিতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নতুন কূটনৈতিক মাত্রা যােগ করে। সামুদ্রিক কূটনীতির ক্ষেত্রে ভারতীয় সামুদ্রিক রণকৌশলের নিকট পাকিস্তান অসহায় হয়ে পড়েছিল, যেমন আকাশযুদ্ধে বাংলাদেশের সীমানায় ৭ই ডিসেম্বরের পর হতেই তারা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশের জনগণের দুর্দমনীয় মনােভাব ও স্বাধীনতার প্রতি অদম্য। আকাক্ষার প্রচণ্ডতা পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক পরাজয় ডেকে এনেছিল। যার ফলে বাংলাদেশের যুদ্ধরত পাকিস্তানি সেনানায়কগণকে ৯৩ হাজার সৈন্যসহ অমর্যাদা ও অসম্মানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। রাজনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি ভারতের সামরিক কূটনীতি এবং ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক কমান্ড গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাংশে ধ্বংসপ্রাপ্ত কফিনে শেষ পেরেকটি ঢুকে দেয় দ্রুততার সঙ্গে। ভারত-বাংলাদেশের সমর কূটনীতির যথার্থ বাস্তবায়নে জলস্থলে অন্তরীক্ষে পালাবার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ৯৩ হাজার সৈন্যের আত্মসমর্পণ তাদের জিম্মি করায় পশ্চিম পাকিস্তানের হিমশীতল বন্দি কারাগার থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিরাপত্তা ও মুক্তি অনিবার্য করে তুলেছিল। যা রাজনৈতিক কূটনীতি ও সমর কূটনীতির যৌথ ফলাফলের ফলশ্রুতি।