বাংলাদেশের স্বাধীনতা : চতুর্ভূজ কূটনীতি
ভূমিকা
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম লক্ষ্য ভারতবিরােধীতা। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতির সূত্র হিসেবে স্বাভাবিকভাবে গৃহীত হয়েছে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন। একইসঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার স্বার্থে তার পররাষ্ট্র নীতি পরিচালিত করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট বাধার আকাক্ষায়। ধর্মের ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি পরিচালিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কমিউনিজম বা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের বিরােধীতা তার মৌলিক নীতি হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, ভারতের ঘােষিত পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম লক্ষ্য জোটনিরপেক্ষ নীতি বাস্তবায়নের একটি মডেল রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে বিশ্ব পরিসরে উপস্থিত করা। ১৯৬১ সালে ২২শে আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু অত্যন্ত জোরের সঙ্গে পার্লামেন্টে ভারতের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের প্রয়ােজনীয়তা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘সামরিক সাহায্য নেওয়ার বাস্তব অর্থ হলাে এককাতারে সারিবদ্ধ হওয়া।” ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলাে পঞ্চশীল ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। পঞ্চশীল নীতিতে বিশ্বাসী শক্তিবর্গ পরস্পরের সীমানা অতিক্রম করে আক্রমণ করবে না ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না বলে চুক্তিবদ্ধ। পারস্পরিক সাহায্য, সহাবস্থান। ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দান করা পঞ্চশীলের অঙ্গ। নির্জোট আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে এই আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদ ও জাতিবিদ্বেষ বিরােধী। জোটনিরপেক্ষ নীতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুই বৃহৎশক্তির প্রতিযােগিতা ও দ্বন্দ্বে দুই শিবিরে বিভক্ত বিশ্বপরিস্থিতির ফলশ্রুতি। এছাড়া, অতীতে স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগ হতে ভারতের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহ্য এই নীতির দিকে পথনির্দেশ করেছিলাে।
ভারত বিভক্তির পর হতেই ভারত এবং পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও পারস্পরিক অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা এবং আদর্শগত কারণে পরস্পর একে অন্যের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ ক=েজুলুসুত্রের শত্রুতার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান পরাশক্তি বিভক্ত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্বের নামে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করে। অন্যদিকে, ভারত পরাশক্তি বিভক্ত বিশ্বের আওতা থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে তার পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনার সূত্র গ্রহণ করে। উপমহাদেশে এই দুই বৈরী রাষ্ট্রশক্তি জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যার ফলে দু’দেশেই শত্রু-মিত্রতার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিলাে ভারত পরিচালিত হয়েছে গণতান্ত্রিক ধারায় এবং পাকিস্তান পরিচালিত হয়েছে আমলাতন্ত্র, সামরিক চক্র এবং অগণতান্ত্রিক চক্রান্তের ঘাঁটি হিসেবে। তারপরেও ভারত তার মূল মৌলিক পররাষ্ট্র নীতিমালাকে নানাভাবে, নানামাত্রিকতায় এবং নবতর ব্যাখ্যার বৃত্তে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখারপ্রচেষ্টা চালিয়েছে। সেই বিশ্লেষণে দেখা যায়, পরাশক্তি ও বৃহৎ শক্তিবর্গের সঙ্গে দুই রাষ্ট্রের শক্রতা-মিত্রতার বন্ধন কখনাে দৃঢ় হয়েছে কখনােবা ছিন্ন হয়েছে। শক্রতা-মিত্রতা’র দাবাখেলায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বাপর ঘূর্ণাবৃত্ত চতুর্ভূজ কূটনীতিক কৌশলের অন্তর্গত দিকসমূহ যেকোনাে গবেষকের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না।
১. জন্মেই জটিলতা ভারত বিভক্তির সময় ও পরবর্তীকালে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উভয় দেশে ছিন্নমূল মানুষের ভিড় এবং কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে কয়েক দফা বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষে দুটি দেশই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। দুটি দেশই গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হতে চেয়েছে। ভারত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠা করে এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে রাষ্ট্রকে একটি সাংবিধানিক ধারায় পরিচালিত করতে সমর্থ হয়। অন্যদিকে, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক পথের অভিযাত্রায় এক বছরের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু, লিয়াকত আলী খান হত্যা, কাদিয়ানি দাঙ্গা এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ব্যর্থতা রাষ্ট্রটিকে সামরিক-বেসামরিক আমলা চক্র কবজা করে ফেলে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি অস্থিতিশীল ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শাসিত, শােষিত ও বঞ্চিত হতে থাকে। দুই অঞ্চলের গণমানুষের মৌলিক চেতনার পার্থক্য অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন কোনাে মৌলিক আদর্শের স্থিতি অর্জিত হয়নি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যবস্থায় নিজেকে বিশ্বাস ও গ্রহণযােগ্য করে তুলতে সমর্থ হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু জোটনিরপেক্ষ নীতি সম্পর্কে বলেছিলেন যে, “এ সম্পর্কে আমার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস আছে যে ভারতে যে কেওই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা এই নীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনাে ব্যতিক্রম করবে না। কিন্তু পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জোটনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে আপােষ করতে হয়। ১৯৬২ সালের ২২শে অক্টোবর ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্যর ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেনেডি শর্তহীনভাবে ভারতে অস্ত্র সরবরাহে সম্মত হয়। ইতােপূর্বে অবশ্য ভারত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ব্রিটেন ও ইউরোপ থেকে অস্ত্র আমদানি করেছে।
১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে মিচুয়্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এর অধীনে চুকিত আবদ্ধ হয় তখন ভারত ঐ চুক্তি করতে ঘােরতর আপত্তি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু সেই ভাতই যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হতে অস্ত্র সংগ্রহ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করে এই মর্মে যে, এই অস্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব শান্তি সমুন্নত রাখার স্বার্থে ব্যবহৃত হবে। ইতােপূর্বে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলাে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র এবং অস্ত্রের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেওয়ার যে শর্তগুলাে অপরিহার্য ছিল সে কারনে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র গ্রহণে অসম্মতি ছিলাে। কিন্তু ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনা সৈন্য পূর্ব সীমান্ত নেফা অঞ্চলের ম্যাকমােহন লাইন অতিক্রম করলে চীনা আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে নেহেরুকে নতুনভাবে কূটনৈতিক নীতিমালা মূল্যায়ন করতে হয়। ২০শে অক্টোবর লাদাখ ও নেফা এলাকায় চীন বড় ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করে এবং বেশ কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। প্রথম দিনেই ম্যাকমােহন লাইনের দক্ষিণের পাহারা চৌকি কবজা করে। এই আক্রমণে ভারত প্রাথমিক পর্যায়ে ব্ৰিত ও বিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই সময় হতে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র ভারতে অস্ত্র সরবরাহ শুরু করলে চীন একতরফাভাবে ২২শে নভেম্বর যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করে। চীন অনুধাবন করে যে, এই যুদ্ধে তাদের বিজয় হয়েছে এবং বিশ্ব পরিসরে তাকে নতুন মাত্রায় উপস্থিত করেছে। অন্যদিকে, ভারত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চীন-ভারত যুদ্ধবিরতির পর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেনেডি ভারতের কী ধরনের অস্ত্র প্রয়ােজন সে সম্পর্কে একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম প্রেরণ করেন। এক্ষেত্রে পাকিস্তান ভারতে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সমরসম্ভার প্রেরণে পাকিস্তান প্রবল আপত্তি জ্ঞাপন করে। কারণ পাকিস্ত েিনর আশঙ্কা ছিল যে, এই সকল অস্ত্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। পরবর্তীকালে ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পাকিস্তানই মার্কিন ট্যাংক ও বিমানবহর ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। পাকিস্তান চীনা নীতি পুনর্বিন্যাস করতে বাধ্য হয় যখন যুক্তরাষ্ট্রের মনােভাব ভারতের দিকে ঝুঁকে যায়। প্রেসিডেন্ট কেনেডি প্রশাসন ভারতকে সরাসরি বৃহৎ আকারে অর্থনৈতিক সহযােগিতায় এগিয়ে আসে যেন ভারত আর্থিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে। উপমহাদেশে সামরিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার ভয়ে পাকিস্তান ভীত হয়ে পড়ে। যদিও পাকিস্তান সামরিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত মিত্র। এ অবস্থায় পাকিস্তান অসন্তুষ্ট চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং ১৯৬১ সালে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে রাশিয়া কর্তৃক চীনের অন্তর্ভুক্তির খসড়া প্রস্তাবকে সমর্থন করে এবং চীন জাতিসংঘের সদস্য হয়। এভাবে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন রেখেও চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করে। ১৯৬২ সালের মে মাসে চীন এবং পাকিস্তানের সীমান্ত নিয়ে আলােচনা শুরু হয়। চীন-পাকিস্তান সীমান্ত সংশ্লিষ্ট এলাকা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এ বিষয়ে চীন একমত হয়। ভারত এই সমঝােতায় প্রতিবাদ করে।
ভারত দাবি করে সমগ্র কাশ্মীর তাদের এবং চীন-পাকিস্তান সীমান্ত নেই। চীনের সীমান্ত এলাকা যদি পাকিস্তানের দখলে থাকে চীন তা মেনে নিলে তা পাকিস্তানেরই। কিন্তু ভারতীয় সমীক্ষায় বলা হয়, কাশ্মীরের আড়াই হাজার বর্গমাইল এলাকা পাকিস্তান চীনকে ছেড়ে দিয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানের ১৬০০ বর্গমাইল এলাকার উপর কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই। চীন-পাকিস্তান সীমান্ত চুক্তির পর চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি ব্যবসায়িক চুক্তি এবং বিমান চলাচলের চুক্তি, বার্টার চুক্তি এবং সুদবিহীন ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য চীন সহায়তা প্রদানে সম্মত হয়। ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে চৌ এন লাই পাকিস্তান সফর করেন এবং এর ৯ বছর পর পুনরায় চৌ এন লাই ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান সফরে আসেন। এ সফরটি ছিল কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের জন্য উল্লেখযােগ্য অর্জন। চৌ। এন লাই ও আইয়ুব খান যুক্ত বিবৃতিতে আশা করেন কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে কাশ্মীরের জনগণের আশা-আকাক্ষা অনুযায়ী যা ভারত ও পাকিস্তান দুইপক্ষই মেনে নিয়েছে।
এ পর্যায়ে চীন-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে সােভিয়েত নেতৃত্ব ব্রিতকর অবস্থায় পড়ে। এ সময় পিকিং-এ অবস্থানরত সােভিয়েত রাষ্ট্রদূতকে চীনের পক্ষ থেকে অভিযোেগ করা হয় যে, ভারত সােভিয়েত তৈরি হেলিকপ্টার, যানবাহন ও বিমান ব্যবহার করছে। চীন কর্তৃক উত্থাপিত অভিযােগ সােভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ এই বলে অস্বীকার করেন যে, এটা আকাশচুম্বী কথা। এক্ষেত্রে সােভিয়েত নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেছে বলে জানানাে হয়। | ২০শে অক্টোবর ক্রুশ্চেভ চীন-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে শক্ত ভাষায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে পত্র লেখেন। নেহেরু কুশ্চেভ বরাবর এ বিষয়ে বিস্তারিত পত্র লেখেন কিন্তু সােভিয়েত প্রাভদা চীনকে সমর্থন করে সম্পাদকীয় লেখেন। বলা হয়, সােভিয়েত ইউনিয়ন চীনের সঙ্গে থাকবে। এমনকি ভারতের শাসকদের শ্রেণিচরিত্র ও আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। অভিযােগ উত্থাপন করা হয়, পূর্বে যে ভারত কোনাে সামরিক ব্লকে যায়নি, সাম্রাজ্যবাদী বেজ স্থাপনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, জোটনিরপেক্ষ ও পঞ্চশীলা ঘোষণা করেছে সেই নীতি থেকে সরে এসেছে। ভারতের বিদেশনীতি সাম্রাজ্যবাদীদের বাজারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্রের উত্তরণ এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শগত অবস্থান থেকে ভারত পিছু হটে এসেছে। | এছাড়াও পর্যবেক্ষকরা বলেছেন এ সময় সােভিয়েত ইউনিয়ন কিউবার মিসাইল সমস্যার সংকট নিয়ে ব্যস্ত ছিল এবং কোনােক্রমেই কমুনিস্ট ক্যাম্পে ভাঙন সৃষ্টি হয় এ ধরনের কোনাে ঝুঁকি নেয়নি। ৩১শে অক্টোবর নেহেরুকে লেখা এক পত্রে ক্রুশ্চেভ উল্লেখ করেন, ভারতের বিষয়ে সােভিয়েতের পূর্বে যে অবস্থান ছিল তা তারা পরিবর্তন করেনি। অন্যদিকে, ডিসেম্বরে প্রেরিত এক গােপন মেমােরেন্ডাম চীনা পার্টি থেকে বলা হয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে চীন আক্রমণ করেনি। কেবল চীনা ভূখণ্ড ফেরত চেয়েছে। তারপরেও চীনা পর্যবেক্ষণ এই যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন সাম্রাজ্যবাদীর পক্ষে সােভিয়েত ইউনিয়ন হাত মিলিয়েছে। সােভিয়েত সামরিক সাহায্য প্রকারান্তে চীনের বিরুদ্ধে। সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন কর্তৃক প্রদত্ত একটি চিঠি উল্লেখ করে বলে যে, যদি চীন জানতো যে, তারা ভারতকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে তবুও তারা যুদ্ধের জন্য সেভিতে সাহায্য চেয়েছে। সােভিয়েতের যুক্তি ছিল তারা অস্ত্র সাহায্য এজন্য দিয়েছে। ৬৩ যেন ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দিকে না যায়। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলাে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় সােভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ রাখে এবং যুদ্ধ বন্ধ হলে পুনরায় সাহায্য শুরু করে।
১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত চীনের সিনকিয়াং প্রদেশ থেকে বহুসংখ্যক কাজাখ সােভিয়েত অঞ্চলে ঢুকে পড়ে। চীন অভিযােগ করে যে এসব শরণার্থীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যারা সিনকিয়াং-এ এসে নাশকতা সৃষ্টি করে। এছাড়াও এটা পরিষ্কার যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়ে ভারতের পক্ষে কূটনৈতিক আগ্রাসনে অবতীর্ণ হয় চীনকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য। ভারতকে সােভিয়েত ইউনিয়ন যে সাহায্য করে যাচ্ছে এটা ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পূর্ব থেকেই পরিষ্কার ছিল এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সামরিক সাহায্য দিয়ে আসছিল চীনের সঙ্গে সংঘর্ষের বিষয়টিকে সামনে রেখে । চীন এক্ষেত্রে মনে করে ইন্ডিয়া ও চীনের মধ্যে সংঘর্ষ এশিয়াতে সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে সংঘর্ষে ভারতকে সাহায্য করার ব্যাপারে সােভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি মৌন সমঝােতার মনােভাব পরিলক্ষিত হয় এবং এই সাহায্যের ক্ষেত্রে কারাে কোনাে গুরুতর আপত্তি ছিল বলে মনে হয় না। ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্র চীনের ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে এবং ভারত তাদের নিয়ন্ত্রিত স্ট্রেটেজিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে যুক্তরাষ্ট্র এটা প্রত্যাশা করে। যুক্তরাষ্ট্র সেক্রেটারি অব স্ট্রেস ডীন রাস্ক ১৮ই জুন গুরুত্ব সহকারে পুনর্ব্যক্ত করে যে, আর্থিক ও প্রতিরক্ষা খাতে আগামী দিনগুলােতে তারা ভারতকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন অব্যাহত রাখবে। সেপ্টেম্বর মাসে সিনেটর হামফ্রে যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী তিনি এশিয়ান রাষ্ট্রগুলাের সমঝােতার ক্ষেত্রে ভারত মুখ্য ভূমিকা পালন করবে এবং যা নাকি চীনের শক্তিকে কাউন্টার ব্যালেন্স করবে।” ২. চীন-ভারত কূটনৈতিক টানাপােড়েন। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৪৭ সালের প্রথম থেকেই চীন ও সােভিয়েতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ধারণা গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ভাবনার সঙ্গে সামাজিক-আর্থিক সংস্কারের ক্ষেত্রে সােভিয়েত সমর্থন প্রয়ােজন ছিল।
অন্যদিকে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়ন অপরিহার্য ছিল। এ কারণে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির মূল লক্ষ্য সাম্রাজ্যবাদবিরােধী জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি সমর্থন আদায়, যেক্ষেত্রে কলােনিয়ান জোয়াল খসে পড়বে এবং একটি নতুন এশিয়ার স্বপ্ন উদিত হবে। যদিও ভারত একথা কখনই ভাবেনি যে চীন এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বা চীনের দিক থেকে হুমকি আসতে। পারে । বরং ভারত মনে করেছে পাশ্চাত্য বিশ্বের সঙ্গে একসঙ্গে দাঁড়ানাের জন্য চীনকে প্রয়ােজন। প্রাথমিক পর্যায়ে চীনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে সমাধানের তাগিদ ভারত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেনি। ১৫ই নভেম্বর ১৯৬২ সালে চৌ এন লাই আফ্রো-এশিয়ান নেতৃবৃন্দের নিকট প্রেরিত এক পত্রে উল্লেখ করেন যে, ভারত সরকার কলােনিয়ান মনােভাবের উত্তরাধিকারী হয়ে তিব্বতে প্রভাব বিস্তার বা তিব্বতকে চীন-ভারতের মধ্যে একটি বাফার স্টেটে পরিণতি করতে চায়। পূর্ব প্রান্তে ৯০,০০০ হাজার, মধ্যভাগে ২০০০ হাজার বর্গ কিলােমিটার মাইল ভারত দখল করে আছে। ভারত আরাে ৩৩ হাজার। কিলাে মাইল দখল করতে চায়। নেতৃবৃন্দকে জানানাে হয়, এশিয়ার এই দুই বৃহৎ প্রতিবেশী সরাসরি আলােচনা ও সমঝােতার মাধ্যমে কেবল সন্তোষজনকভাবে সীমান্ত। সমস্যার সমাধান হতে পারে। এর পূর্বে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নিকট এক পত্রে বলেন যে, ৫ বছর পূর্বে চীন ভারতের ১২ হাজার বর্গ মাইল দখল করেছে। ১৯৬২ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর চীন হঠাৎ করে পূর্ব সীমান্ত অতিক্রম করে। ভারত এই আক্রমণ প্রতিরােধ করে এবং এক পত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই মুহুর্তে প্রয়ােজন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যা উভয় দেশ ও বিশ্বশান্তির জন্য প্রয়ােজন।” জোটনিরপেক্ষ আফ্রো-এশিয়ান দেশসমূহ বার্মা, কম্বােডিয়া, সিংহল, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১২ই ডিসেম্বর ১৯৬২ সালে ৬-দফা প্রস্তাব কলম্বাে সম্মেলনে পেশ করে। আলােচনার ভিত্তিতে সমাধানের জন্য উভয় পক্ষকে আহ্বান জানায়। এ সময় পিকিং রিভিউ-এর মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ-যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ব্যাপকভাবে সমরাস্ত্র সাহায্য করে যাচ্ছে এবং ভারতকে প্রকাশ্যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তখন পর্যন্ত সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউরােপীয় কমুনিস্ট দেশগুলাে চীনের প্রকাশ্য সংঘর্ষের পরও ভারতের প্রতি তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ মনােভাব অক্ষুন্ন রেখেছে। এ সময় জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতি ও চীন-ভারত সংঘর্ষে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০শে এপ্রিল চৌ এন লাই ৫ই মার্চ নেহেরু কর্তৃক প্রেরিত পত্রের জবাবে বলেন, চীনা সরকার চীন-ভারত সীমান্ত বিরােধকে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার বিষয়ে পরিণত করতে কখনাে সম্মত হবে না।” বরং চীন পাল্টা অভিযােগ করে যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনে ভারত সরকার ‘দুই চীন নীতি অনুসরণ করছে। সে লক্ষ্যে ভারতের একটি প্রতিনিধি দল ও জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ তাইওয়ান সফরে গেছেন। চীন এসময় পরীক্ষামূলকভাবে আনবিক বিফোরণ ঘটায়। এর প্রতিবাদ করে লালবাহাদুর শাস্ত্রী ২৭শে নভেম্বর এসব মারণাস্ত্র তৈরি বন্ধের জন্য চৌ এন লাইকে পত্র দেন। এই পত্রের কোনাে তােয়াক্কা না করে চীন নিজস্ব পথে অগ্রসর হয় এবং ভারতবিরােধী প্রচার অব্যাহত রাখে।
এই প্রসঙ্গে চীনা তাত্ত্বিক পিকিং রিভিউ পত্রিকার শিরােনামে “Non-aligned India’s Double Alignment” প্রতিবেদন লেখেন, “জোটনিরপেক্ষ’ ভারতকে অক্টোবর ১৯৬২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ২৩০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য দিয়েছে। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক নিরীক্ষণে দেখা যায় সােভিয়েত ইউনিয়ন ১০০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য দিয়েছে।” পাকিস্তানের মত চীন মনে করে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ব্যাপক সামরিক অস্ত্র সরবরাহ শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। এ সময় চীনা সমর্থন পাকিস্তানের জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তান চীনের ভাইস প্রিমিয়ার চেং ইং করাচিতে ভারতীয় একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। এবং ভারতের সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ন্যায় সংগত সংগ্রামের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জ্ঞাপন করেন। এ সময় চীন সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবকে খর্ব করার জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করে। দ্বিতীয় আফ্রো-এশিয়ান সম্মেলন অক্টোবর, ৩০ তারিখে আলজিয়াসে অনুষ্ঠিত হয়। ৪৫টি দেশ অংশগ্রহণ করে। আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল ৬২টি দেশকে। চীন ও পাকিস্তান অংশগ্রহণ করে। প্রশ্ন ছিল সােভিয়েত ইউনিয়নে অংশগ্রহণ করার অধিকার আছে কিনা। সােভিয়েত ইউনিয়ন, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের অংশগ্রহণের প্রশ্নে কয়েকদিন আলােচনা এবং তাদের অংশগ্রহণের প্রশ্নে সমঝােতা হয়। চীন এ আলােচনার বিরােধীতা করে সম্মেলন বয়কট করে।” ১১ই নভেম্বর ১৯৬৫ সালে পিপলস ডেইলি ও রেডফ্লাগ সম্পদকীয় প্রকাশ করে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ক্রুশ্চেভ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ব্যস্ত ছিলেন। তার লক্ষ্য চীনকে এক ঘরে করা।
১৯৬৩ সালের ১লা এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এক ভাষণে প্রশ্নাকারে বলেন, চীন যদি ভারতের প্রতি হুমকি হয় তাহলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত কীভাবে তা মােকাবিলা করবে? ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ভিয়েতনামে চীন তার সামরিক বাহিনীকে সরাসরি যুক্ত না করার ব্যাপারে সতর্ক। কিন্তু চীনের ছায়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। চীনের পক্ষ থেকে প্রকৃত হুমকি যতটা না সামরিক তার চেয়েও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী সরকারগুলাে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের মাধ্যমে বর্তমানে উন্নয়ন প্রচেষ্টায় লিপ্ত এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তারা অগ্রসর হচ্ছে; সেক্ষেত্রে চীনের ভূমিকার কারণে তাদের বিরাটভাবে চ্যালেঞ্জ মােকাবিলা করতে হবে। | এসময় ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গােষ্ঠীর মধ্যে চৈনিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে সশস্ত্র লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। ভারত বিষয়টিতে চীনের উস্কানি রয়েছে বলে মনে করে এ কারণে যে, চীন তখন বিশ্বব্যাপী বিপ্লব ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ভারতের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে চীনপন্থি নেতারা কিছু কিছু এলাকা মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘােষণা করে এবং তাদের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ভারত সরকার এক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আদর্শ নিয়ে তাদের মােকাবিলা করছে, পরিকল্পিত অর্থনীতি ও দারিদ্র্য নিরসনের জন্য কাজ করছে। গণতন্ত্রের সুযােগ নিয়ে বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ যুবসমাজের একটি অংশ যেখানে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নিয়ম-নীতি ও কাঠামােয় সেই গেরিলা লড়াইকে নিয়ন্ত্রণ করা যেকোনাে গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে দাড়ায়। ভারতের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই ধরনের একটি পরিস্থিতি মােকাবেলা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। ভারত মনে করে, এটা সম্পূর্ণই চীনের কৌশলগত চাপ। পিকিং রিভিউ ১৫ই এপ্রিল ১৯৬৬ সালের ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়ন সফর নিয়ে একটি বক্তব্য প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট জনসন প্রশাসন যখন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে এবং যেখানে সােভিয়েত সংশােধনবাদীরা চীনবিরােধী প্রচারণা জোরদার করেছে এবং ভারত তার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অসুবিধায় আছে এবং ব্যাপক খাদ্যঘাটতির মুখােমুখি হয়ে। পড়েছে তখন ত্রিশক্তি চীনকে একলা করার জন্য কূটনৈতিকভাবে একত্রিত হয়েছে।
জনসনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর যে কথা হয়েছে তার মর্মকথা হল, “কমিউনিস্ট চীনের হুমকি যাতে বিস্তৃতি না হয় সে জন্য তাকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে বৃত্তায়িত করতে হবে।”২৩ ১৯৬৭ সালের ৭ই আগস্ট পিপলস ডেইলি একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার শিরােনাম ‘নক্সালবাড়ির লাল পতাকা উধ্বে তুলে ধর।’* নক্সালবাড়ি পশ্চিমবাংলায় একটি নাজুক পাবর্ত্য এলাকা। বস্তুত এই শিরােনামের মাধ্যমে একথা উপলব্ধি করা সহজ হয়ে পড়ে যে, চীন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ঢুকে পড়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ কর্তৃক বিপ্লবী কৃষক শক্তিকে ঘিরে রাখা ও নির্যাতন করার যে অভিযান চালিয়েছিল। নক্সালবাড়ি ও দার্জিলিং-এর আশেপাশে ও অন্যত্র; তা প্রতিহত করে প্রথম রাউন্ডে ‘বিপ্লবী’রা বিজয় অর্জন করেছে। দক্ষ ও সাহসিকতার সঙ্গে সশস্ত্র কৃষক বিপ্লবী ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলারা বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। সশস্ত্র কৃষক বিপ্লব দ্রুত এগিয়ে চলেছে শিরােনামে পিকিং রিভিউ ২৫শে সেপ্টেম্বর ১৯৭০ সালে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কমুনিস্ট পার্টি (এম. এল.) প্রত্যন্ত অঞ্চলে সক্রিয়, তাদের স্লোগান বন্দুকের নলের মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তি অর্জন। কমিউনিস্ট পার্টির আহ্বানে এই সশস্ত্র বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর বৈশিষ্ট্য হলাে বহু বুদ্ধিজীবী, কৃষক গেরিলাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করছে। শুধু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভারতীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপের সঙ্গে চীনের গৃহীত নীতিমালা বহু ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে দ্বিতীয় আফ্রো-এশিয়া ফোরামকে চীন তাদের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করার গৃহীত পরিকল্পনার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় ভারত। চীনের পরিকল্পনায় এই ফোরামকে জাতিসংঘের বিকল্প একটি বৈপ্লবিক সংস্থা হিসেবে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে চীনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ; যার অর্থ চীনা পরিকল্পনা বানচাল করা। বিশেষকরে চীনের গৃহীত পদক্ষেপ মােকাবিলা করার উদ্যোগ ভারতের কাধে গিয়ে পড়ে। দ্বিতীয় আফ্রো-এশিয়া সম্মেলনে সহযােগী আয়ােজক হিসেবে পাকিস্তানের ভূমিকা পালনের সিদ্ধান্ত ছিল।
এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তােলা। এই উপলক্ষে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ড, এ, আর, সুকানো দুইবার পাকিস্তান সফর করে কাশ্মীর প্রশ্নে সমর্থন দান করেন। ভারত পর্যবেক্ষণ করে যে, পাকিস্তান-ইন্দোনেশিয়া ও চীনের সহযােগিতামূলক চুক্তি একটি অশুভ আতাতে পরিণত হতে যাচ্ছে। এ কারণে ভারত এই সম্মেলনে সােভিয়েতকে আমন্ত্রণ করা এবং আফ্রিকার কোনাে দেশে সম্মেলন অনুষ্ঠানের দাবি জানায়। ভারত কর্তৃক সােভিয়েতকে অন্তর্ভুক্তি করার প্রচেষ্টা। সফল না হলেও সম্মেলন স্থান পরিবর্তিত হয়ে আলজেরিয়ায় নির্ধারিত হয়। কিন্তু আলজেরিয়ায় অবনতিশীল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এই সম্মেলন। অনুষ্ঠিত হয়নি। ৩. চীনের কূটনৈতিক মােড় ১৯৬০-এর দশকের শেষপাদ এবং ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে জাতীয় স্বার্থের সন্ধানে চীন পুনর্বার তার শত্রু-মিত্র চিহ্নিতকরণে সক্রিয় হয় এবং বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলাের সঙ্গে নাটকীয়ভাবে সম্পর্ক পুনঃনির্ধারণে তৎপর হয়। চেকোশ্লোভাকিয়ায় সােভিয়েত অভিযান (১৯৬৮ সাল) এবং ব্রেজনেভ নীতি ঘােষণা, যার মাধ্যমে মস্কো সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার দাবি করে। ১৯৬৯ সালে চীন-সােভিয়েত সীমান্তে রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষ, চীন পারমাণবিক শক্তি নির্মান-স্থলসমূহে আঘাত হানার পরােক্ষ সােভিয়েত হুমকি প্রভৃতির ফলে সােভিয়েত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের। বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণে চীন উদ্বুদ্ধ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন নীতি ‘নিক্সন ডকট্রিন’ ঘােষণার (১৯৬৯ সাল) ফলে ইন্দোচীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাবার উদ্যোগ এবং চীনের প্রতি মার্কিন হুমকিও হ্রাস পায়। কৌশলগত ধ্যান-ধারণা চীনা নেতৃত্বকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সক্রিয় করে তােলে এবং সম্ভাব্য সােভিয়েত হুমকির মােকাবেলা ও সােভিয়েত ‘আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ করে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে ‘পিং পং কূটনীতি’, চীনে কিসিঞ্জারের গােপন সফর এবং সাংহাই ইস্তেহার ঘােষণা ইত্যাদি ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে এসব ঘটনাপ্রবাহ চীন-মার্কিন সমঝােতার পথ উন্মুক্ত করে এবং এক কালের দুই চরম শত্রুদেশ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ও ভবিষ্যতে সহযােগিতা বিধানে জোর দ্বি-পাক্ষিক কূটনৈতিক তৎপরতা উন্মােচিত করে।
৪. পাকিস্তানের পক্ষে চীন চীন-ভারত যুদ্ধ এবং পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ, চীন-মার্কিন ও পাকিস্তান-মার্কিন চলতি সম্পর্কে ছেদ পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র চীন-পাকিস্তানের বন্ধুত্বে ব্রিতবােধ করে এবং পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য ও এইড পাকিস্তান ক্লাব মিটিং স্থগিত করে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধে পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যুদ্ধে চীন সরাসরি পাকিস্তানকে সমর্থন করে এবং চীন এই বলে ভারতকে অভিযােগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী এশীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে এবং আফ্রো-এশীয় ঐক্য ক্ষতিগ্রস্থ করছে।” এপ্রিল মে মাসে ভারত-পাকিস্তান বিরােধপূর্ণ সীমান্ত কুচ সেক্টরে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হলে চীন সরাসরি পাকিস্তানকে সমর্থন করে। আগস্ট মাসে কাশ্মীরে পাকিস্তানের অনুপ্রবেশকারীরা প্রবেশ করলে পরিস্থিতি অবনতি ঘটে এবং সংঘর্ষ শুরু হয়। ২৪শে আগস্ট প্রাভদা অভিযােগ করে যে, কাশ্মীর সমস্যা কলােনিয়েল ধারাবাহিকতা, যা নিয়ে পাকিস্তান এবং ভারত সাম্রাজ্যবাদী প্ররােচনায় যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। চীনের বিদেশমন্ত্রী চেন উই করাচি সফর করেন। পাকিস্তানের পক্ষ নেন এবং বলেন পাকিস্তান ভারতের সশস্ত্র প্ররােচণার বিরুদ্ধে কাশ্মীরে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। ৯ই সেপ্টেম্বর চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের আগ্রাসনকে নিন্দা করেন এবং বলেন এতে এশিয়া শান্তির হুমকিতে পড়েছে। এমনকি চীনা একটি নােটে অভিযােগ করা হয় যে, সিকি তিব্বত সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকেছে এবং দাবি করা হয় সিকি বর্ডারে বিরােধপূর্ণ এলাকা হতে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের। এই পরিস্থিতিতে সােভিয়েত ইউনিয়ন অদ্রুিত চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে সমর্থন জানান।
চীনের ভূমিকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়ন কৌশলগত কারণে সমান্ত রালভাবে ভারতকে শক্তিশালী করার নীতি গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে পাকিস্তানের চেয়ে ভারত চীনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভাল মিত্র হবে। কারণ সেন্টো ও সিয়াটো সদস্য হলেও ৬০-এর দশকে চায়নার ঘনিষ্ট হতে পাকিস্তান এগিয়ে যায়। চীন-পাকিস্তান। সম্পর্ক বান্দুং সম্মেলনের সময় হতে উষ্ণ হতে শুরু করে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মােহাম্মদ আলী (বগুড়া) সােভিয়েত ইউনিয়নকে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদী হিসেবে উল্লেখ করে এবং চীনকে বন্ধু ও শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশি হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি চৌ এন লাই-কে বুঝাতে সক্ষম হন যে, পাকিস্তান সিয়াটোর সদস্য হলে চীনের সঙ্গে তার কোনাে বৈরিতা নাই এবং ঐ চুক্তির ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনাে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেয় তাহলে পাকিস্তান তার সঙ্গে থাকবে না। এমনকি মােহাম্মদ আলী তাইওয়ানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বিরােধের মধ্যস্থতা। করার প্রস্তাব দেয়। যা ওয়াশিংটন ঠান্ডা মাথায় বিরােধীতা করে। প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এই সমঝােতায় উপনীত হয় যে পাকিস্তান সিয়াটো সদস্য হলেও চীনের সঙ্গে বৈরিতার কোনাে বাস্তব কারণ নাই। এইভাবে চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। যদিও পাকিস্তান ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে মিডিলিস্ট ডিফেন্স অরগানাইজেশন সদস্যভুক্ত হয়। গবেষকবৃন্দ এভাবে সমীক্ষা করেন যে, সীমান্ত নিয়ে চীন এবং ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমে চীনের যে সীমান্ত তা শান্তিপূর্ণ। এসময় সােভিয়েত ইউনিয়ন বান্দুং সম্মেলনে চীনের সাফল্যের প্রতিপক্ষে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কুটনৈতিক আক্রমণ পরিচালিত করে। সােভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ। ১৯৫৬ সালে ভারত সফর করেন এবং ঘােষণা করেন কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্তি চূড়ান্ত এবং সম্পূর্ণ ‘ চীন এ পর্যন্ত কাল কাশ্মীর সম্পর্কে ভারতকে সমর্থন করা থেকে বিরত ছিল।
১৯৫৮ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান সামরিক শাসন জারি হলে ৫ই মার্চ ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি করার বিষয়ে দ্বি-পাক্ষিক প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদিত হয় । এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে কমিউনিস্টদের উপর চড়াও হলে চীন-পাকিস্তান সম্পর্কে চিড় ধরে। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের লামা বিদ্রোহে পাকিস্তান চীনের নিন্দা করে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বৈদেশিক নীতিতে শক্তভাবে পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে যায় । তিব্বত বিদ্রোহ ও সীমান্ত বিরােধ নিয়ে চীন-ভারত সম্পর্ক যখন সংকটপূর্ণ তখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান উপমহাদেশের জন্য যৌথ প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার প্রস্তাব দেন। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এই প্রস্তাব বাগাড়ম্বরপূর্ণ এবং কার বিরুদ্ধে? চীন-ভারত সীমান্ত ঘটনায় পাকিস্তান চীনের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ায়। সােভিয়েত ইউনিয়ন অর্থনৈতিক সহযােগিতার মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ। সম্পর্ক রক্ষায় প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৫৯ সালে বার্টার এগ্রিমেন্ট, তেল এবং খনিজ সম্পদ। অনুসন্ধানে প্রযুক্তিগত সহযােগিতার আলােচনা চলে। ১৯৬০ সালের মে মাসে | সােভিয়েত সীমানায় যুক্তরাষ্ট্রের ইউ-২ গােয়েন্দা বিমান ভূপতিত হয় এবং দেখা যায় বিমানটি পাকিস্তানের পেশােয়ার ঘাটি থেকে এসেছে। তারপরও আলােচনা চলতে থাকে এবং ডিসেম্বরে তা সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কুটনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যােগ করে। সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ ১১ই সেপ্টেম্বর ভারত এবং পাকিস্তানকে ‘তৃতীয় শক্তি’ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এই সংঘর্ষে ‘তৃতীয় শক্তি’ লাভবানের প্রচেষ্টা নিচ্ছে | এবং মস্কো অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করেন। ‘তৃতীয় শক্তি’ বলতে সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ চীনকে ইঙ্গিত করেন। উপমহাদেশে চীনের প্রভাব যে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিলাে তা সােভিয়েতের নজর এড়ায়নি। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আদর্শগত দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, | মিজোরাম, বিহারসহ কয়েকটি প্রদেশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৩-৬৪ সালের মধ্যে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, সীমানা নির্ধারণ, বিমান চলাচল, বাটার | চুক্তি এবং দ্বিপাক্ষিক আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন | শ্রেণি-পেশার মানুষ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উভয় দেশ সফর করেন। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল চীনের অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকীতে যােগদান করেন এবং চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পাকিস্তানের সঙ্গে | চীনের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে মাও সেতুং-এর পরামর্শে মওলানা ভাসানী অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘ডন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’ এই নীতি গ্রহণ করেন। পাশাপাশি ১৯৬৪ সালের ১৮-২৬শে ফেব্রুয়ারি চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তান সফরে আসেন। চৌ এন লাইয়ের সফরের পর এক যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে হবে কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছা অনুসারে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালের ২৫ই মার্চ চীন সফর করেন। আইয়ুব খানের সফরের পর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতির এক অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘আফ্রো-এশীয় সংহতি বৃদ্ধি এবং উপনিবেশবাদ’ ও ‘বর্ণ বৈষম্য’কে জাতীয় স্বাধীনতা ও বিশ্বশান্তির পরিপন্থি বলে। অভিহিত করা হয়। পাকিস্তান এ সময় দুই চীন’ নীতির বিরােধীতা করে, অন্যদিকে চীন কাশ্মীরে গণভােটের কথা পুনরায় উল্লেখ করে।” ১১ই সেপ্টেম্বর পিপলস ডেইলি পাকিস্তানকে সমর্থন করে এবং প্রকাশ করে যে, পাকিস্তান আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে এবং কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য লড়াই করছে। ১৮ই সেপ্টেম্বর পিপলস ডেইলিতে বলা হয়, ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত রাশিয়া সাহায্য করছে। কারণ পাকিস্তানের স্বাধীন নীতিকে তারা সহ্য করতে পারছে না। পত্রিকাটিতে সােভিয়েত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, রাষ্ট্রটি ন্যায় এবং অন্যায় যুদ্ধের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেনি। যুদ্ধ গুরুতর আকার ধারণ করলে ১৬ই সেপ্টেম্বর চীন ৭২ ঘণ্টার হুমকি দিয়ে বলে যে, তিব্বত এবং সিকিম সীমান্তে কথিত ভারতীয় সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নিতে বা ধ্বংস করতে হবে। নাহলে পাকিস্তানের সমর্থনে চীন এগিয়ে যাবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী চীনের প্রতি-হুমকিতে বলেন, আক্রান্ত হলে ভারত দৃঢ় প্রত্যয়ে লড়াই করবে এবং পাশাপাশি সীমান্তে যৌথ পরিদর্শনের ব্যাপারে চীনের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।“ চীন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে ভারতকে সতর্ক করে দিয়ে বলে যে, তারা যেন পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ না করে।
নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত মােতাবেক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এই যুদ্ধে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না হলেও সােভিয়েত ইউনিয়নের বহুদিনের কাক্ষিত এশিয়ায় উপস্থিতির সুযােগ এনে দেয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য অবিলম্বে সােভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিপাক্ষিক সমস্যা ও ইস্যুগুলাের সমাধান খুঁজে নিতে উভয় পক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করে। রাশিয়ার প্রস্তাবে ভারত সম্মতি জ্ঞাপন করে। কিন্তু আইয়ুব খান এই প্রস্তাবে বিলম্ব করেন যতক্ষণ না পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের অনুমতি না পেয়েছেন। অন্যদিকে, তাসখণ্ড চুক্তি সম্পাদনে বহুবিধ জটিলতা অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকায় । | ১৯৬৬ সালের ৩-১০ই জানুয়ারি মাসে তাসখণ্ডে ত্রিদেশীয় মিটিং হয়। সভায় আলােচিত হয়, অঘােষিত যুদ্ধের বিরতি এবং ১৯৬৫ সালের ৫ই আগস্ট যে স্থানে উভয় দেশের সেনাবাহিনী ছিল সেখানে চলে যেতে হবে। বাণিজ্য, ভ্রমণ, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবে। কাশ্মীর পূর্ব অবস্থায় থাকবে। তাসখণ্ড স্পিরিট বাস্তবায়িত হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাসখণ্ড চুক্তি ঘােষণার পরই মৃত্যুবরণ করেন এবং আইয়ুব খান ঐ চুক্তির জন্য প্রচণ্ড সমালােচনার মুখে দেশে ফিরেন। চীন পর্যবেক্ষণে বলেছে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের যােগসূত্র রয়েছে। প্রেসিডেন্ট জনসন প্রশাসন কোনাে সময়ক্ষেপণ না করে তাসখণ্ড ঘােষণাকে। সমর্থন জানান। এ সম্পর্কে পিপলস ডেইলি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবকে আক্রমণ করে প্রতিবেদন লেখে। প্রথমত, ভারতকে আক্রমণকারী হিসেবে নিন্দা করা হয়নি; দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের আত্মরক্ষার জন্য যে প্রতিআক্রমণ করা হয়েছিল তা উল্লেখ করা হয়নি; এবং তৃতীয়ত, তারা অন্যান্য দেশকে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থনের সুযােগ দেননি এবং কাশ্মীর সম্পর্কে বলা হয়, নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে অবহেলা করেছে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতে অস্ত্র সরবরাহের সুযােগ। এনে দেয়। পাশাপাশি এ সময়ে ভারতে প্রচণ্ড খরা হওয়ায় দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ। করছিল। এজন্য ভারত খাদ্যশস্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং পিএল-৪৮০ অনুযায়ী শান্তির জন্য খাদ্য কর্মসূচি জুন মাসে শেষ হয়ে আসছিল। ভারতের অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে। এ সময় প্রেসিডেন্ট জনসন সমস্ত সাহায্য বন্ধ করে দেন। যুক্তরাষ্ট্র ওয়ার্ল্ডব্যাংকের সাহায্য শক্তভাবে ক্রমসংকুচিত করে। ভারত পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী গৃহীত ঋণ পরিশােধে অসুবিধায় পড়ে। বাধ্য হয়ে ডিসেম্বর মাসে ভারত সরকার বেসরকারি বিনিয়ােগের ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করে। এটি এমন সময়ের চিত্র যেক্ষেত্রে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে সাহায্যের আশায় গমন করেন।
এসময় প্রেসিডেন্ট জনসন এই শর্ত আরােপ করেন যে, ভারতকে অধিক পরিমাণে বেসরকারি পুঁজি বিনিয়ােগের সুযােগ দিতে হবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাধাহীন সুবিধা দিতে হবে এবং বেশি পরিমাণে জমিতে সার ব্যবহার করতে হবে। ইন্দিরা গান্ধীর পাঁচদিন ওয়াশিংটন সফর শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনসন ৩০শে মার্চ ঘােষণা করেন যে, ভারতকে ৩৫০ মিলিয়ন টন খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে এবং বিশ্বব্যাংক ভারতের জন্য কনসাের্টিয়াম-এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাহায্য দেবে।” | ইন্দিরা গান্ধীর মার্কিন অভিমুখি কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে কাশীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি চীন বিপজ্জনক বলে মনে করে। এমনকি ভারতের কতিপয় বিশেষজ্ঞরা চীন বিরােধকে আদর্শিক সংঘর্ষ বলে মনে করে, যেমনটি পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু মনে করতেন, ১৯৬২ সালে চীন কর্তৃক ভারত আক্রমণ ছিল বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে। ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটন থেকে মস্কো হয়ে সােভিয়েত প্লেনে ভারতে চলে আসেন। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিদেশনীতি প্রভাবান্বিত করার জন্য সহযােগিতা কূটনীতির কথা ঘােষণা করেন। এসময় ‘শর্ত’ বা ‘নিয়ন্ত্রণ’ যাই বলা হােক না কেন যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাহায্য পেতে ভারতকে শর্তগুলাে মানতে হয়েছে। এমনকি ৬ই জুলাই ওয়ার্ল্ডব্যাংকের পরামর্শ মােতাবেক শতকরা ৫৭ ভাগ টাকা অবমূল্যায়ন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ ভারতের ঘােষিত পঞ্চশীল নীতিতে পরিবর্তন এনে দেয়। ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার উপর নির্ভরশীল হওয়ায় ভারত ভিয়েতনাম সম্পর্কে সরকারিভাবে স্বাধীন ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয় । ভারত বৈদেশিক নীতিতে এই কথা বিশ্বাস করে যে, ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ও ভূমিকা প্রকৃত পক্ষে ভারতের স্বার্থকে সমুন্নত রাখবে এবং তা হবে চীনের বিপক্ষে।
এভাবে ভারতের বিদেশনীতি স্বতঃসিদ্ধভাবে একদিকে চীন রাশিয়ার মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধি করে। ভারত একদিকে সােভিয়েত রাশিয়া থেকে সামরিক-অর্থনৈতিক সহযােগিতা লাভ করে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে। কিন্তু তাকে মূলনীতি থেকে সরে আসতে হয়। যদিও এসময় জোটনিরপেক্ষ নীতির ব্যাখ্যার পরিবর্তন ঘটানাে হয়েছে। ১৯৭১ সালে এসে ভারত চীন কর্তৃক ১৯৬১ সালে প্রদত্ত প্রস্তাবের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু এই পদক্ষেপ বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেনি। জুলাই মাসে হেনরি কিসিঞ্জারের পিকিং সফরের পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর বরাবর বাংলাদেশ ও অন্যান্য পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলােচনার জন্য এক পত্র লেখেন। পত্রে ইঙ্গিত প্রদান করা হয় যে, ভারত মর্যাদার সঙ্গে উভয় পক্ষের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী, একই সঙ্গে মুখ্য বিষয় হিসেবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আলােচিত হবে। ডি. পি, ধর মস্কোতে চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মে মাসে এ প্রসঙ্গে আলােচনা করেন। চীনের পক্ষ থেকে তখন বিষয়টি বিবেচনা। করা হবে বলে বলা হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর পত্রের কোনাে সাড়া পাওয়া যায়নি। তখন চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে কূটনৈতিকভাবে ব্যস্ত ছিল। এমতাবস্থায় কিসিঞ্জার পিকিং সফরের চার সপ্তাহের ভেতরে সােভিয়েত রাশিয়া ও ভারত মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এই চুক্তি বাংলাদেশ সংকটে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যবহন করে। এই চুক্তি সম্পর্কে প্রাথমিক পর্যায়ে চীন কূটনৈতিক নীরবতা পালন করে। কিন্তু মধ্য নভেম্বরে ভারত এবং পাকিস্তানের সংঘর্ষ শুরু হলে চীন এই চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে মুখ খােলে। এ সময় চীন দেখতে পায়, সােভিয়েত ইউনিয়ন চীনা সীমান্তে ১০ লক্ষ সৈন্য সমাবেশ করেছে এবং এশিয়ায় ‘কালেক্টিভ সিকিউরিটি সিস্টেম’-এর লক্ষ্যে সােভিয়েত তৎপর হয়ে উঠছে যা চীন মনে করে এসবই চীনের বিরুদ্ধে। এভাবে উপমহাদেশে বাংলাদেশ সংকট সম্পর্কে সােভিয়েতের লক্ষ্য এবং ভারতের ভূমিকা চীনকে তার অবস্থান নিতে অগ্রসর করে দেয়। বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রতি চীনের মনােভঙ্গি এই প্রতীতি জন্মায় যে, এটা হলো চীন এবং সােভিয়েতের মধ্যকার বৃহত্তর আদর্শিক বিরােধ।
৫. চীনের কূটকৌশল এ সম্পর্কে চীন তার নিজস্ব মন্তব্য প্রকাশ করে। একইসাথে বাংলাদেশের সংকট প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পিপলস ডেইলি মন্তব্য করে যে, বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে সােভিয়েত ইউনিয়ন চীনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পত্রিকায় বলা হয়,
জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি হুওয়াং বলেন, সােভিয়েত সরকার চীনের সিনকিয়াং প্রদেশের প্রতিবিপ্লবী বিদ্রোহীদের দিয়ে নাশকতা এবং চীনের বিরুদ্ধে বিভক্তিমূলক কাজ করছে। কয়েক লক্ষ বেসরকারি লােককে জোরপূর্বক গ্রহণ করে তাদের দ্বারা চীনবিরােধী কার্যক্রম ঘটিয়ে চলেছে। পাকিস্তানের শরণার্থী প্রসঙ্গে জ্যাকব মালিকের যুক্তি অনুযায়ী সােভিয়েত রাশিয়া এই সুযোেগই খুঁজছে যে, কীভাবে চীনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ করা যায়। এ পর্যায়ে বৈশ্বিকভাবে চীনের কূটনৈতিক নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশীয়। নীতিমালা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। চীনা নীতির আলােকে ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় গেরিলাযুদ্ধ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ভারতে সর্বহারাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উষ্কানিমূলক প্রচার চালায়। ১৯৬৫-৬৬ সালের মধ্যে আইভরিকোষ্ট, কেনিয়া, মালাগাছি, মালয় প্রভৃতি রাষ্ট্র থেকে অভ্যন্তরীণ অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের অভিযােগে চীনা কুটনীতিকদের বহিষ্কার করা হয়। রুয়ান্ডা এ সম্পর্কে অভিযােগ উত্থাপন করেন। এমনকি নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা প্রদেশের সশস্ত্র অভ্যুত্থানকে চীন সমর্থন করে। শ্রীলংকার জেভিসি যারা চেগুয়েভারার গেরিলা পদ্ধতি অনুসরণে সশস্ত্ৰযুদ্ধ পরিচালনা করছিল কিংবা সুদানের চীনপন্থি কমিউনিস্টদের জেনারেল নিউমেরি যাদের ফাঁসি দিয়েছিল চীনের এই সমস্ত কার্যক্রম বৈশ্বিক স্ট্র্যাটেজি বা জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের চেয়েও আদর্শবাদ দ্বারা তাড়িত ছিল যার লক্ষ্য ছিল বিশ্ব বিপ্লবের অগ্রসেনানী হিসেবে নিজেকে প্রকাশিত করা। যুক্তরাষ্ট্র ও মস্কোকে এক কাতারে ঠেলে দেওয়া। মস্কো এক সময় জেনারেল নিউমেরিকে সবসময় সমর্থন করেছিল। ভারত-সােভিয়েত শ্রীলংকায় জেভিসি বিপ্লবীদের দমনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে সাহায্য করে। শেষপর্যন্ত চীনও ঐসব বিপ্লবীদের হঠকারি বলে চিহ্নিত করে। এশিয়ায় চীনকে একইসঙ্গে ভারত, সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে কূটনৈতিকভাবে মােকাবেলা করতে হয়। এ কারণে কোনােক্রমেই পাকিস্তানকে চীন হাতছাড়া করতে চায়নি। চীনকে যখন নিরাপত্তার বেষ্টনী দ্বারা বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা চলে তখন চীন তার জাতীয় স্বার্থেই কতিপয় নীতিমালা গ্রহণ করতে হয়।
এইসব নীতিমালার বিশ্লেষণে লক্ষ্য করা যাবে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রধান মিত্র পাকিস্তান এবং স্বাভাবিকভাবে নয়াদিল্লি ছিল তার স্বাভাবিক অমিত্র, যদিও সময়ে সময়ে স্ট্রাটেজিক কারণে ভারতের সঙ্গেও অনুকূল সম্পর্কও বজায় রেখেছে। দ্বিতীয়ত, সােভিয়েত কৌশলগত বলয়ে ভারতকে ঠেলে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক করার তাগিদ অনুভব করেছে। এমনকি ভারতে বিপ্লবী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রতি চীনের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা এবং সুবিধামতাে বিরােধ পূর্ণ চীন-ভারত সীমান্ত অঞ্চলে চাপ সৃষ্টি করার কৌশল গ্রহণ করে।” চীন স্বয়ং পাকিস্তানের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী ছিল, এমনকি পাকিস্ত নের সঙ্গে যে বিদ্যমান সম্পর্ক তা গভীর করতেও তৎপর হয়। ১৯৬০-এর দশকের সূচনা থেকে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলাকাল অবধি চীন বহির্বিশ্বের সঙ্গে, বিশেষকরে মুসলিম দুনিয়ার দেশসমূহ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যােগাযােগের মাধ্যম হিসেবে পাকিস্ত নিকে ব্যবহার করে কূটনৈতিক যােগযােগ প্রতিষ্ঠা করে। এসব সত্ত্বেও আরেকটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটলে পাকিস্তানের সাহায্যে হস্তক্ষেপ করার বিষয়ে কোনােরূপ সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার প্রদান থেকে নিঃশব্দে চীন বিরত থাকে। ৬. মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালের পর চীন নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের জন্য প্রতিশ্রুত তার অর্থনৈতিক ও সামরিক সরবরাহ অব্যাহত রাখে। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর জন্য প্রেরিত ব্যাপক চীনা সামরিক সরঞ্জাম জাহাজ থেকে খালাশ করার বিষয়েও বেইজিং আপত্তি তােলেনি। তবে উল্লেখ্য বিষয় এই যে, এসব সামরিক সরঞ্জাম ২৫শে মার্চের পূর্বেই জাহাজবােঝাই করা হয়, যদিও চট্টগ্রাম নৌ-বন্দরে এসব। সরঞ্জামাদি এপ্রিলের দিকে পৌছে। এভাবে চীন তার পূর্বে ওয়াদাকৃত সামরিক সরবরাহ পাকিস্তানকে প্রদান করে, কিন্তু ১৯৭১-এর বসন্ত ও গ্রীষ্মকালের নতুন সামরিক সাহায্য প্রদানের বিষয়ে অনীহার ভাব প্রদর্শন করে। পাকিস্তান চীন থেকে বিশেষকরে কিছু জঙ্গি বিমানের জন্য আবেদন করে। এসকল আবেদন বিবেচনার প্রক্রিয়ায় বেইজিং বেশ কালক্ষেপণ করে এবং পরবর্তীকালে কয়েক মাস সময় নিয়ে যখন পাকিস্তানকে ঐ সকল জঙ্গি বিমান পাঠায়, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ তখন শেষ হয়ে যায়। | ৫ই এপ্রিল পিকিং রেডিও পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলির উপর কোনাে মন্তব্য না করে সম্প্রচার করে যে, এটা ভারতের হস্তক্ষেপ’ ও ‘আধিপত্যবাদ’। একই দিনে নয়াদিল্লিতে চীনা দূতাবাসের সামনে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভের বিরুদ্ধে চীন একটি প্রতিবাদ নােট প্রেরণ করে। ১১ই এপ্রিল পিপলস ডেইলিতে কর্তৃপক্ষীয় মন্তব্যে বলা হয়, ৩১শে মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে এবং কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটিতে যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদ। পত্রিকায় বলা হয়, ভারত পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে ব্যাপক সেনা সমাবেশ করেছে, যা পাকিস্তানের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি। ঐ পত্রিকার মন্তব্যে পদগোনির পত্র এবং মার্কিন মুখপাত্রের বক্তব্যে দুই পরাশক্তি ভারতের সঙ্গে নিবিড় সহযােগিতায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে রুঢ়ভাবে হস্তক্ষেপ করছে। পাকিস্তান সরকারের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে চীন পাকিস্তানকে সমর্থন দেবে। এই পর্যায়ে ভারত এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের মতাে চীনও মনে করেছে বাংলাদেশ সংকট পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ১৩ই এপ্রিল চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ইয়াহিয়া খান বরাবর এক পত্রে লেখেন, সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগাের্নির চিঠির বিষয়টি চীনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে; এ কথা উল্লেখ করে বলেন : “চীন বিশ্বাস করে ঘটনাটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
যা পাকিস্তানের জনগণই সমাধান করতে পারবে এবং এক্ষেত্রে বিদেশি কারাে নাক গলানাের প্রয়ােজন নাই। পত্রে আরও উল্লেখ করা হয় যে, গুটিকয়েক লােক পাকিস্তান বিভক্তি করার জন্য নাশকতামূলক কাজ করছে : ভারত যদি পাকিস্তান আক্রমণের দুঃসাহস দেখায় তাহলে চীনা সরকার পাকিস্তান সরকার ও জনগণকে তাদের স্বাধীনতার সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে দৃঢ়ভাবে সর্বদা সমর্থন করবে।” ২১শে মে চীন পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কের ২০তম বার্ষিকীতে ভাইস ফরেন মিনিস্টার হান নেইন লিউ বাংলাদেশ ও ভারত প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। কিন্তু ঐ একই ভােজ সভায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বলেন, বাইরের বৈরী হস্তক্ষেপের ফলে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। চীন দ্বিধাহীনভাবে পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। এটা ছিল নিছক পাকিস্তান কূটনীতিকের মন্তব্য। ভারত আশ্বস্ত ছিল যে, বাংলাদেশ সংকটে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে চীন হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে একজন সরকারি মুখপাত্র চাতুর্যপূর্ণ মন্তব্যে বলেন, চীনা সৈন্যরা সীমান্তে আনাগােনা করছে কিন্তু দুই পক্ষই বরফ পরার জন্য প্রার্থনা করছে। ভারত সম্ভবত তৃতীয় কোনাে দেশের মাধ্যমে এই আশ্বাস পেয়েছে এই সংঘর্ষে চীন হস্তক্ষেপ করবে না। যখন সীমান্তে বরফ পড়েছে চীন এই অযুহাতই দেখাবে যে, বরফে ভারত-সীমান্ত ঢাকা পড়ে গেছে এবং হস্তক্ষেপের কোনাে সুযােগ। নেই। তবুও ভারত চীন সীমান্ত থেকে তার মাউন্টেন ডিভিশন সরিয়ে নেয়নি এই আশংকায় যে, চীন এই যুদ্ধে জড়িত হবে কি হবে না তা স্পষ্ট নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩১শে ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চীনের ক্রিয়াকার্য তিনি যেভাবে আশা করেছেন তার থেকে কোনাে কম বেশি হয়নি।’
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চীনের প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, ভারত যদি যুদ্ধে উস্কানি দেয় তাহলে এর থেকে কোনাে ফায়দা বা সমস্যার সমাধান করতে পারবে? যদি দুই পক্ষের যুদ্ধ বেধে যায় দু’পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুদ্ধ বেধে গেলে চীনের অবস্থান কী হবে তা নির্দিষ্ট আছে। চীন ভারতের নাশকতামূলক এবং আক্রমণাত্মক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। ভারত যা তৈরি করছে তার বিষাক্ত স্বাদ তাকেই নিতে হবে। এর ফলে উপমহাদেশে ভারসাম্য ফিরে আসবে না। ৫৪ যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কলামিস্ট জ্যাক এন্ডারসন-এর ভাষ্যে বলা হয়েছে, ভারতকে সােভিয়েত রাশিয়া এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, চীন যদি যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহলে সােভিয়েত রাশিয়া চীনের সিনকিয়াং এলাকা ফ্রন্ট খুলে বসবে। হােয়াইট হাউসের গোপন দলিলের সূত্র থেকে এন্ডারসন দাবি করেন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে সমুদ্রে এবং সমতলে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে কাছাকাছি চলে এসেছিল। এইসব দলিল অনুসারে ১১ই ডিসেম্বর হােয়াইট হাউসে এ রিপাের্ট পৌছে যে, পাঁচটি সােভিয়েত নৌ-বহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করেছে। যার অবস্থান শ্রীলংকার দক্ষিণপশ্চিমের ১৮০ মাইল দূরে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফিল্ড কমান্ডার অ্যাডমিরাল জন ম্যাককেইন রিপাের্টটি ওয়াশিংটনকে জানায় এবং জিজ্ঞেস করে সে এয়ারক্রাপ্ট কেরিয়ার ইন্টারপ্রাইজ সােভিয়েত যুদ্ধ জাহাজের পূর্বগামিনী হবে কিনা? যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে টাস্কফোর্সটি ১৩ই ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে এবং নয়াদিল্লিতে বেসরকারি সূত্র থেকে সংবাদ পৌছে যে, নৌ-বহরটি চট্টগ্রাম এসে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু নৌ-বহরটির চলাচল ও অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনাে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অবশ্য কিসিঞ্জার বলেছেন, ‘চীনের সঙ্গে যে মিত্রতা গড়ে উঠছে তার বিশ্বস্ততা প্রমাণের জন্য সপ্তম নৌ-বহর পাঠানাে জরুরি ছিল।’ সিআইএ উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ইসলামাবাদে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াহিয়া খানকে আশ্বস্ত করেছেন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চীনা সৈন্য সীমান্ত অভিমুখে অগ্রসর হবে। কিন্তু সিআইএ এই রিপাের্টটি অনুমােদন করেনি। নেপালের কাঠমাণ্ডুতে নিয়ােজিত যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি অ্যাটাচি ওয়াশিংটনে একটি রিপাের্ট পাঠায়। রিপাের্টে বলা হয়, সােভিয়েত অ্যাটাচি চীনের অ্যাটাচিকে বলেছে যে, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ নিয়ে চীনের হস্তক্ষেপ করলে তা হবে গুরুতর এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ এবং প্রয়ােজনে তার দেশ মিসাইল ও অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করবে।* সিআইএ কাঠমান্ডু থেকে ৮ই ডিসেম্বর রিপাের্ট করে যে, চীনারা হিমালয় অঞ্চলে আবহাওয়া পরিসংখ্যান সংগ্রহ করছে। সম্ভবত তারা বরফের মধ্যেও ভারত সীমান্ত অতিক্রম করতে বদ্ধপরিকর। নয়াদিল্লি থেকে সিআইএ রিপাের্টে বলা হয়, ইন্দিরা গান্ধী গােপন ও বিশ্বস্ত সূত্রের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে কংগ্রেস পার্টি মিটিং-এ বলেন, তার কাছে এমন সংবাদ রয়েছে যে, চীন হস্তক্ষেপের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং তাদের আক্রমণ আসতে পারে লাদাখ এলাকা হতে। কিন্তু সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেখভ ১৩ই ডিসেম্বর ভারত সরকারকে জানান যে, চীনের বিরুদ্ধে সিনকিয়াং-এ তারা একটি ফ্রন্ট খুলেছে এবং বঙ্গোপসাগর হতে সপ্তম নৌবহর টাস্কফোর্সকে হস্তক্ষেপ করতে দেবে না। ষাটের দশকে চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং ঘােষণা করেন, বিপ্লবােত্তর চীনের সামন্তবাদের অবশেষ ও প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামের অবসান হয়নি। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি স্থায়ীভাবে দূর করার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেন।
১৯৬৭ সালে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলে লিও শাওচির বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্র বিরােধী কার্যকলাপের অভিযােগ ওঠে এবং রেডগার্ড আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ধনতান্ত্রিক পথে প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টা বন্ধ করার অযুহাতে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ১৯৬৯ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় লিন-পি-আও-র প্রভাব বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে চীনের পার্টি কংগ্রেস তার কার্যকলাপকে গর্হিত বলে নিন্দা করা হয় এবং মাও সেতুং এর রেডগার্ড ও রেডবুকের স্থলে পার্টি উদারপন্থি। নীতি গ্রহণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে মিত্ররূপে গ্রহণ করতে নীতি পরিবর্তনে দ্বিধা করেনি। এই পরিবর্তনশীল অবস্থায় চীন ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের অবনতি এবং পাশাপাশি ওয়াশিংটন ও পিকিং-এর মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীন পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে।
অংশগ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ঢাকা পতনের পরে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানকে সমর্থন করে চীন। প্রকাশ্যে বাইরের শক্তির আক্রমণ সম্পর্কে এক বিবৃতি প্রকাশ করে। ঐ একই দিনে পিকিং-এ ভারতীয় দূতাবাসে সীমান্ত সংঘর্ষের অভিযােগ উত্থাপন করে ১০ই ডিসেম্বরের ঘটনা বর্ণনা করেন এবং অভিযােগ করে জাতিসংঘের ৭ই ডিসেম্বর প্রস্তাব অমান্য করে একটি পুতুল সরকারকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে ও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে যে, ভারতকে সােভিয়েত রাশিয়া বিপুল পরিমাণ সামরিক অস্ত্র সরবরাহ করে উৎসাহ জুগিয়েছে। ৭. বাংলাদেশের স্বাধীনতা: সােভিয়েতের ভূমিকা ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ চালালে চীন কোনাে মন্তব্য করেনি। ২রা এপ্রিল সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগােনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বরাবর এক পত্র প্রেরণ করে অত্যাচার বন্ধ এবং সমস্যার শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য আহ্বান জানান। পত্রে উল্লেখ করা হয় । পাকিস্তান জনগণের এই দুর্দশার দিনে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে কয়েকটি কথা না বলে পারছি না। আমরা সবসমই বিশ্বাস করে এসেছি এবং এখনাে মনে করি যে, পাকিস্তানে সপ্রতি যে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, তার সমাধান অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে এবং সামরিক শক্তি প্রয়ােগ না করেই করতে হবে। অব্যাহত পীড়ন নীতি ও রক্তপাতের ফলে সমস্যার সমাধান নিঃসন্দেহে সুদূরপরাহত হয়ে যাবে এবং তা পাকিস্তানের জনগণের সামগ্রিক মৌলিক স্বার্থ ক্ষুন্ন করবে।’ | ইউএসএসআর (USSR)-এর সুপ্রীম সােভিয়েতের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট, আপনার কাছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করাটা আমরা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করছি এবং সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত দমন-পীড়ন ও রক্তপাত অবিলম্বে জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করার লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে বিদ্যমান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সনির্বন্ধ আবেদন জানাচ্ছি। আমরা আশাবাদী, পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণের স্বার্থ এবং এই অঞ্চলের শান্তি রক্ষার স্বার্থ সংরক্ষণে এই পদক্ষেপ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। উদ্ভূত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হলে সােভিয়েত জনগণ স্বস্তি ও তৃপ্তি লাভ করবে।” এই বার্তা সম্পর্কে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট পদগােনি রক্তপাত ও “নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তার বার্তায় রূঢ় শব্দ ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু তিনি আশা করেছিলেন বার্তাটি অপ্রকাশিত থাকুক, কিন্তু রুশ কর্তৃপক্ষ বার্তাটি প্রকাশ করে দেওয়ায় সােভিয়েতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের আরাে অবনতি ঘটেছে। তাসখণ্ড চুক্তির পর সােভিয়েত ইউনিয়ন উপমহাদেশে নীতিগতভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। পূর্বে ১৯৬৫ সালে যুদ্ধকালীন পূর্বাপর সােভিয়েত রাশিয়া ভারতকে যেভাবে সহযােগিতা করেছে তার থেকে দূরে সরে এসেছে বলে ভারতীয় বিশেষজ্ঞগণ মনে করে। শুধু তাই নয়, ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সহযােগিতা প্রদান করে। পাকিস্তানে তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আহরণ ও অনুসন্ধানে ২.৫ ভাগ সুদে ৩২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাহায্য প্রদানের চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু পাকিস্তান তার পাশ্চাত্য ঘেষা বৈদেশিক নীতি অব্যাহত রাখলে মস্কোর প্রত্যাশা দুর্বল হয়ে পড়ে। বরং এই সময় পাকিস্তান চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ কারনে সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সােভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ কমিউনিস্ট পার্টির এক সম্মেলনে পাকিস্তানের শাসক এলিট শ্রেণিকে ‘সামন্তবাদী’ ও ‘সাম্রাজ্যবাদের তােষামদকারী’ এমন এক কায়েমি স্বার্থের চক্র হিসেবে অভিহিত করেন যা প্রগতিশীলতার পথ থেকে দূরে থাকে। যদিও পাকিস্তান এর প্রতিবাদ জানায়। এ সময় সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে তিন | স্কোরাল মিগ-২১ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় আইয়ুব খান এটিকে “গুরুতর ঘটনাবলি’ উল্লেখ করেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মস্কো সফরের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের প্রতি সােভিয়েতের ক্ষোভ প্রশমন, সন্দেহ দূর করা এবং উপমহাদেশে নিরপেক্ষ নীতির প্রত্যাশা। আইয়ুব খানের মস্কো সফরের পর প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন ভারত সফর করেন এবং নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে, পাকিস্তান সােভিয়েতের সম্পর্কের উন্নতি কখনই ভারত-সােভিয়েত বন্ধুত্বের বিনিময়ে সাধিত হবে না। এই পরিস্থিতির বিবেচনায় পাকিস্তানের গণমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্র এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী এই সময় বিবেচনা করে যে, সােভিয়েত রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন জরুরি। পাকিস্তান নীতি-নির্ধারকগণ বিশেষভাবে জ্ঞাত ছিলেন যে, পিকিং-এর সঙ্গে তাদের গাটছাড়া বাধার ব্যাপারটি যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি।
জুলাই মাসে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক রিপাের্ট পর্যালােচনায় পরিলক্ষিত হয় যে, ভারত ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত পঞ্চাশ জনের অধিক রাষ্ট্রদূত বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে চীন সম্পর্কে কূটনৈতিক আক্রমণ চালিয়েছে। রিপাের্টে চীন সম্পর্কে শক্ত ভাষায় বলা হয়েছে, এই প্রথমবারের মতাে তারা অবন্ধুসুলভ প্রতিবেশীর মতাে কাজ করছে। পাকিস্তান সম্পর্কে বলা হয়, পাকিস্তান কলােনিয়াল পদ্ধতিতে পূর্বাংশে কাজ করছে এবং সেনাবাহিনী সাম্রাজ্যবাদী’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ভারতীয় বিশ্লেষকগণ এই রিপাের্টে পরামর্শ দেন যে, চীনের হুমকি নিয়ে উদবিগ্ন হওয়ার কারণ নেই, যা পূর্বের বছরগুলােতেও দিয়েছে। ১৯৬৫ সালে ভারতপাকিস্তান যুদ্ধের পূর্বে চীন এই ধরনের হুমকি দিয়েছে যা বর্তমানে বাংলাদেশ সংকট সম্পর্কে বলছে। ১৯৬৫ সালে চীন ভারতের বিদেশ ও অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে ব্যাপক সমালােচনা করে। কিন্তু বর্তমানে তাদের সমালােচনা শুধু ভারত-পাকিস্তান ইস্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। বিশ্লেষকগণ এটাও মনে করেন, চীনের এই ধরনের মনােভাবের নেপথ্যে রয়েছে মস্কো ও ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে যতটা না তারচেয়ে বেশি নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে। ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির পূর্বে চীন ভারতের বিরুদ্ধে বৈরিতাপূর্ণ আচরণ করেছে এমন লক্ষণ দেখা যায় না।
ক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘােষণা দিলে ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল ইতিবাচক। ভারতের বিদেশ বিষয়কমন্ত্রী শরণ সিং বরাতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে উন্নীত হবে এটা ভারতের প্রত্যাশা। ভারত আশা করে উভয় দেশের সম্পর্ক হবে পারস্পরিক মর্যাদা, নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপহীন। লােকসভায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৯ই আগস্ট সােভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি সম্পর্কে চীন সম্পর্কে মুখ খােলেনি তার অর্থ এই নয় যে, উপমহাদেশে সােভিয়েতের লক্ষ্য সম্পর্কে তারা তাদের নিজস্ব মূল্যায়ন করা থেকে বিরত থেকেছে। তিন সপ্তাহের মধ্যেই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী অভিমতের যথার্থতা প্রমাণ হয় চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই যুগােস্লাভিয়ার একটি পত্রিকায় যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তার মাধ্যমে। ঐ পত্রিকার সম্পদকের নিকট তিনি মন্তব্য করেন যে, দু’টি পরাশক্তি ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। চীন তা মুক্ত করার জন্য সবকিছু করবে। এই চুক্তি সম্পর্কে ৩রা সেপ্টেম্বর আরাে স্পষ্ট অভিমত পাওয়া যায় গায়েনা সফররত একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দল যাদের মধ্যে একজন মন্তব্য করে চীন অবশ্যই ইন্দো-সােভিয়েত চুক্তিকে বন্ধু সুলভ কাজ মনে করে না। উক্ত প্রতিনিধি হান সুইন পিকিং-এ মন্তব্য করেন, চুক্তিটিতে সামরিক অনুচ্ছেদ যুক্ত হওয়ায় ভারতের অবস্থানকে নিচু পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। ২০শে নভেম্বর চুক্তি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষীয় মন্তব্য পাওয়া যায়। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “নিক্সনের চীন সফরের ঘােষণা শােনার পর সােভিয়েত ইউনিয়ন দ্রুততার সঙ্গে এই চুক্তি সম্পাদন করেন। এর লক্ষ্য হলাে ব্রেজনেভ কর্তৃক ঘােষিত এশিয়ান কালেক্টিভ সিকিউরিটি সিস্টেম’ বাস্তবায়ন করা। যার লক্ষ্য যেসব দেশের প্রতি সােভিয়েত রাশিয়ার বৈরিতা রয়েছে তাদেরকে ঘিরে ফেলা। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন এ কারণে যে, অন্যকোনাে দেশ এ পর্যন্ত উক্ত পরিকল্পনার পক্ষে সমর্থন জানায়নি। অন্যান্য দেশের সঙ্গে এই ধরনের চুক্তি করতে সােভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তুত থাকলেও অধিকাংশ দেশই তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ২৭শে নভেম্বর জাতিসংঘে চীনা প্রতিনিধি দলের নেতা সিহাইও হুয়ান হুয়া বলেন, সােভিয়েত সাম্রাজ্যবাদ’ ভারতের সঙ্গে সামরিক জোট বেঁধেছে এবং ভারত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে সক্রিয়ভাবে পূর্ব পাকিস্তানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে নিয়ােজিত করেছে।
৭ ক, চুক্তি পরবর্তী ভারতের মূল্যায়ন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৭-২৮শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মস্কো সফর করেন। তার এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেস্কি কোসিগিনের এক যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পূর্ববঙ্গের জনগণের ইচ্ছা, অপরিবর্তনীয় অধিকার এবং আইনসঙ্গত স্বার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান, দ্রুততম সময়ে শরণার্থীদের মর্যাদা, সম্মান নিয়ে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার মধ্যে এই সংকটের সমাধান নিহিত রয়েছে। কিন্তু যুক্ত বিবৃতিতে ভারত ও সােভিয়েতের গুরুতর মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাশিয়ান ভাষ্যে পূর্ব পাকিস্তান’ উল্লেখ করা হলেও ইংরেজি ভাষ্যে পূর্ববঙ্গ’ উল্লেখ করা হয়। ভারতীয় বিশ্লেষকরা চারটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন সােভিয়েত রাশিয়া যুদ্ধকে পরিহার করতে চেয়েছিল। প্রথমত, সােভিয়েত পক্ষ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সেই অংশটুকু উদ্ধৃত করা হয়েছে, যেখানে ভারতে আশ্রিত পূর্ব বাংলার শরণার্থীরা যাতে অবিলম্বে স্বদেশে ফিরতে পারে সে সম্পর্কে দৃঢ় অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছে; দ্বিতীয়ত, ইন্দিরা গান্ধী ভারত ত্যাগের পর সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় সংবাদদাতাদের বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে সমস্ত সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে ভারত যুদ্ধে যেতে পারে, কিন্তু তার আগে নয়। ভারতের বিশ্লেষকরা বলেছেন, এর দ্বারা কোসেগিন এই কথা বুঝাতে চেয়েছেন যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের বাইরে অন্য কোনােভাবে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়; তৃতীয়ত, ১লা অক্টোবর পদগােনি নয়াদিল্লিতে পূর্ব বাংলার সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের উপর জোর দিয়ে বলেন, উপমহাদেশে সামরিক সংঘর্ষ পুনরায় সংঘটিত না হয় তা হতে বিরত থাকার জন্য সােভিয়েত ইউনিয়ন মধ্যস্থতা করতে সম্মত; এবং চতুর্থত, সােভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকো ২০শে সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে উপমহাদেশে পুনরায় যেন উত্তেজনা বৃদ্ধি না পায় তা রােধ করার বিষয়ে একমত হন। সােভিয়েত উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেরুবিন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অক্টোবরের শেষে নয়াদিল্লিতে একটি যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতকে হুমকি দেওয়ার ধারণার পরিমাপ কী ধরনের এবং তা কীভাবে মােকাবেলা করা যাবে তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে । উপমহাদেশের বর্তমান অবস্থায় শান্তিপূর্ণ অবস্থার পরিবর্তে যে হুমকি ও উত্তেজনা বিরাজ করছে এর সম্পর্কে উভয় পক্ষ মূল্যায়ন করেন। এসময় যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষণ করে যে, আগস্টের শেষদিকে সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সংযত করার পরিবর্তে তারা জাতিসংঘে ভারতকে আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টার উপর ভেটো প্রয়োগ করবে। চীন বা পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে সােভিয়েত ইউনিয়ন জরুরি প্রয়ােজনে বিমানে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, সােভিয়েত ইউনিয়ন ইন্দিরা গান্ধীকে ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক প্রদান করেছে।
এ সম্পর্কে ২৯শে সেপ্টেম্বর সােভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোর সঙ্গে ওয়াশিংটনে আলাপ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারতকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করার প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে গ্রোমিকো অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। এমনকি বেসামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরপূর্বক মার্চ মাস পর্যন্তু কেন যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চায় এ সম্পর্কে তিনি ব্যাখ্যা দাবি করেননি। এসময় কিসিঞ্জারের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে, ভারত কর্তৃক পাকিস্তানকে অপদস্ত করার সুযােগ সােভিয়েত ইউনিয়ন চীনকে লাঞ্ছিত করার সুযােগ হিসেবে গ্রহণ করবে। যদিও সিনেট বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানে আর্থিক ও সামরিক সরঞ্জাম স্থগিতে ভােট দিয়েছে এবং অনেক সিনেট সদস্য তখন পর্যন্ত আরাে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শােরগােল করে আসছিল। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে সােভিয়েতের লক্ষ্য ছিল, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে একটি ব্রিতকর ফেনিল অবস্থা সৃষ্টি এবং উভয়ের দেশের মধ্যে মিত্রতার সম্পর্ক উন্নয়নে বিশ্বাসযােগ্যতার প্রশ্নে অন্তঃসারশূন্যতা প্রমান করা। ৭ খ, চুক্তি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মনােভাব। ৯ই আগস্ট ১৯৭১ সালে ভারত-সােভিয়েতের বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের। পররাষ্ট্রসচিব হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে বােম শেল’-এর (Bombshell) মত প্রতিয়মান হয়। যদিও এটা ছিল বিশ বছরব্যাপী শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চুক্তির ১১ অনুচ্ছেদ ব্যতীত অন্যান্য অনুচ্ছেদগুলাে নিয়ে উদবিগ্ন তার কোনাে কারণ ছিল না। কিসিঞ্জারের কাছে এবং বিশেষজ্ঞদের কাছে মনে হয়েছে, এর ফলে নেহেরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধী জোটনিরপেক্ষ নীতি বর্জন করে সামরিক জোটের সঙ্গে বাধা পড়বে। সােভিয়েত ইউনিয়নও এই চুক্তিকে কূটনৈতিক সাফল্যের অন্তবৃত্ত বলে উল্লেখ করে। ভারতের নীতি-নির্ধারকদের কাছে এতােদিন পর্যন্ত যে সামরিক মিত্রতার বিচ্ছিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছিলাে এই চুক্তির ফলে এখন তারা মনে করে যুদ্ধের সময় সােভিয়েত সামরিক সরবরাহ চীন আক্রমণ করলেও তা অব্যাহত থাকবে। ৮. ভারতের সঙ্গে সােভিয়েত সম্পর্ক ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৪৭ সালে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক প্রথম দিকে উষ্ণ না থাকলেও নয়াচীনের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তি ও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা উভয় দেশকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে কাছাকাছি নিয়ে আসে। দক্ষিণ-আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বিরােধীতা করে এবং বিষয়টি উক্ত দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অভিহিত করে। ১৯৫০ সালে ভারত জাতিসংঘে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব উত্থাপন কালে সােভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থন জানায়। | কোরিয়ার যুদ্ধে ১৩ই জুলাই ১৯৫০ সালে জওহরলাল নেহেরু স্টালিন বরাবর ব্যক্তিগত বার্তায় সােভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, চীন ও অন্যান্য দেশের সহযােগিতায় একটি সমঝােতায় উপনীত হওয়ার প্রস্তাব রাখেন। নেহেরুর এই শান্তি উদ্যোগ সােভিয়েত ইউনিয়ন যথাযথ মনে করে। নেহেরু কর্তৃক কোরিয়ার যুদ্ধে শাস্তি উদ্যোগ প্রাভদায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়।
স্টালিন অতিদ্রুত এই শান্তি উদ্যোগ জাতিসংঘে কোরীয় জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে সে দেশের প্রতিনিধির বক্তব্য শশানার আগ্রহ প্রকাশ করে নেহেরুকে পত্র লেখেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাজনৈতিক সম্মেলনের প্রস্তাবে ভারতের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সােভিয়েত সমর্থন করে । যুক্তরাষ্ট্র বিরােধীতা করে। স্টালিনের উত্তরাধিকারী মালেনকভ প্রকাশ্যে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের উপর গুরুত্ব আরােপ করেন। পাশাপাশি তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তার অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক সমঝােতা হয়। প্রাভদা এসময় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার তীব্র সমালােচনা করে বলে যে, ওয়াশিংটন পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি বানাতে চায়। যার ফলে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরীতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাকিস্তানে মার্কিন ঘাঁটি তৈরির পদক্ষেপ কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত জোরেশােরে উথাপন করে। এ সম্পর্কে সােভিয়েত মুখপাত্র প্রাভদা ১৬বার প্রতিবেদন ও রিপাের্ট প্রকাশ করে। ৩০শে নভেম্বর ১৯৫৩ সালে সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত পাকিস্তানের ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানিয়ে দেয় যে, পাকিস্তান সেন্ট্রো চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তা সােভিয়েত ইউনিয়নের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি।” ১৯৫৪ সালে সােভিয়েত-পাকিস্তান সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে দাড়ায় এ কারণে যে, এ সময় পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। যদিও স্বাভাবিক যােগসূত্র অব্যাহত থাকে। সােভিয়েত ইউনিয়ন নিরস্ত্রীকরণ ফোরামে ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করার সর্বদা প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘ নিরস্ত্রীকরণের সাব-কমিশনে ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কমিশনের কলেবর বৃদ্ধির চেষ্টা চালানাে হয়। এমনকি এ সম্পর্কিত বিতর্ক অনুষ্ঠানে সােভিয়েত প্রতিনিধি ডি, সিনােস্কি এ পর্যন্ত বলেন যে, ব্রিটেন কেন কমনওয়েলথের একজন সদস্য রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তিতে আপত্তি জানাচ্ছে।
১৯৫৪ সালে জেনেভা কনফারেন্সে ইন্দো-চীন নেগােশিয়সনে ভারতের প্রতিনিধি কৃষ্ণ মেনন নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাশিয়া কারিগরি ক্ষেত্রে অনুন্নয়নশীল দেশে বিনিয়ােগের জন্য ৪ মিলিয়ন রুবল জাতিসংঘ তহবিলে প্রদান করলে কেবল তা সরকারি খাতে বিনিয়ােগের শর্ত থাকায় ভারত বেশি সহায়তা গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। ১৯৫৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের মধ্য প্রদেশের বিল্লাই স্টিলপ্লান্ট স্থাপনে সােভিয়েতের সঙ্গে চুক্তি হয়। সাংস্কৃতিক-শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক শুভেচ্ছা সফর অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি ৫টি ভারতীয় ছবি ২৪-২৯শে সেপ্টেম্বর ১৯টি শহরে প্রদর্শিত হয়। রাজকাপুরের আওয়ারা এবং বিমল রায়ের দো বিঘা জমিন মস্কোতে প্রদর্শিত হয়। দশ লক্ষ লােক ছবিগুলাে অবলােকন করে। ১৯৫৪ সালে ভারত চীনের সঙ্গে পঞ্চশীল নীতি তুলে ধরে যা সােভিয়েত কর্তৃক অভিনন্দিত হয়। ১৯৫৫ সালে সুপ্রীম সােভিয়েত পঞ্চশীল-এর ভিত্তিতে যে সম্পর্ক গড়ে উঠে তা অনুমােদন পূর্ব ঘােষণা করে অন্যান্য দেশও পাঁচটি নীতি গ্রহণ করতে পারে। এ সময় সােভিয়েত নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়। মালেনকভের পরিবর্তে বুলগানিন ক্ষমতাসীন হন। কিন্তু ভারতের সঙ্গে স্বার্থের বিষয়ে কোনাে পরিবর্তন সাধিত হয়নি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে তা উষ্ণ হয়নি। কারণ পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে ছিল!
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৫৫ সালের জুন মাসে সােভিয়েত ইউনিয়নে সফর করেন, সে সময় পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে, যুগােস্লাভিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিবিড় করেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সম্পর্কের দিগন্ত খুলে দিয়েছে। সর্বোপরি, বান্দুং সম্মেলন তার সফরের পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল। নেহেরুর সােভিয়েতে প্রথম সফর ছিল ঐহিতাসিক। তার সাথে ছিলেন তার কন্যা শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী। নেহেরু প্রথম মস্কো ভ্রমণ ছিল ১৯২৭ সালে তার বাবা মতিলাল নেহেরুর সঙ্গে। উক্ত ভ্রমণে নেহেরু শুধু রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং সফরের বিশেষ দিক হলাে তিনি জনসভায় প্রকাশ্যে ভাষণ দেন। মস্কো, লেনিনগার্ড, তাসখণ্ড অন্যান্য শহরে ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ লােকের সমাবেশে ভাষণ দেন। এসময় ক্রশ্চেভ বুলগানিন সােভিয়েত নেতৃবৃন্দ তার সঙ্গে থাকতেন। সফর শেষে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে পঞ্চশীল নীতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। একথাও উল্লেখ করা হয়, বৃহৎ শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলাের ভয়ে ছােটো ছােটো রাষ্ট্রগুলাে। ভীতির মধ্যে থাকে তার উল্লেখ করে এর সমাধান হিসেবে বলা হয়, শুধু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি এক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। উভয় প্রধানমন্ত্রী এমনকি যৌথ বিবৃতিতে স্ব-স্ব রাষ্ট্রের সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পরিবেশের ভিন্নতা থাকলেও সহযােগিতার ক্ষেত্রে তা বাধা হতে পারে না। নেহেরু মস্কো থেকে প্রত্যাবর্তনকালে বলেন, ‘আমার হৃদয়কে পেছনে রেখে যাচ্ছি।’ পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে নেহেরুর এই সফরকে সহজভাবে গ্রহণ করেনি। লন্ডন টাইমস সম্পাদকীয় মন্তব্যে প্রকাশ করে যে, সােভিয়েত-ভারত যুক্ত বিবৃতি শান্তি ও ঐক্যের ক্ষেত্রে সামান্যই অবদান রাখবে। নিউইয়র্ক টাইমস নেহেরুকে এই বলে সতর্ক করে যে, তাকে নিপুণতার সঙ্গে ‘ইদুর বন্দি করা হয়েছে। ১২ই নভেম্বর ১৯৫৫ সালে ক্রুশ্চেভ এবং বুলগানিন ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ দিল্লি। সফরে আসেন। দিল্লি, চন্ডীগড়, জয়পুর, পুনা, বােম্বে, মাদ্রাজ, কলকাতাসহ ১১টি প্রদেশের জনসভায় জনগণের বিপুল সমাগম তাদের মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় করে যে, প্রকৃতপক্ষে ভারতের জনগণের সঙ্গে সােভিয়েত ইউনিয়নের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কলকাতায় কুশ্চেভ বলেন, গােয়া বিদেশি শাসকদের হাত থেকে শীঘ মুক্ত হবে। ১০ই ডিসেম্বর শ্রীনগরের এক জনসভায় ক্রুশ্চেভ ঘােষণা করেন, কলােনীয়াল শক্তি কাশ্মীর সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কাশ্মীরের জনগণ ইচ্ছেমত ভারত প্রজাতন্ত্রে যােগদান করবে যা সােভিয়েত মেনে নেবে। ক্রুশ্চেভ ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির নিন্দা করেন।” এসময় সুপ্রীম সােভিয়েতে ক্রুশ্চেভ কূটনৈতিক কৌশল তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের বন্ধুদের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমরা বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পারি।”
মিশরের সুয়েজ খাল নিয়ে যে প্রকট সমস্যা দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে ভারতসােভিয়েত দুটি দেশ প্রায় একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করে। ১৯৫৬ সালে ইন্দোফ্রান্স-ইসরাইল মিলিত হয়ে মিশর আক্রমণ করলে ভারত সাথে সাথে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এ সময় সােভিয়েত রাশিয়াও ঐ আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানায় এবং ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। সুয়েজ খাল নিয়ে লন্ডন কনফারেন্সে সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি স্পিল ভারতীয় প্রস্তাবকে ‘সুয়েজ সমস্যা’র শান্তিপূর্ণ পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করেন। এসময় হাঙেরী সমস্যা সম্পর্কে ভারতের অভিমত ভারতীয় পার্লামেন্টে এভাবে প্রকাশ করে যে, হাঙেরীর অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে দমনে সহযােগিতা করতে রাশিয়া বাধ্য হয়ে এ ব্যবস্থাকে বেছে নিতে হয়েছে। জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভােট দানে ভারত বিরত থাকে। ৮ ক, ভারত-চীন সংঘর্ষে সােভিয়েত নিরপেক্ষতা মধ্য ১৯৫৯ সালের হিমালয় সীমান্তে ভারত-চীন বর্ডার গার্ডদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়-যা বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ৯ সেপ্টেম্বর তাস-এর মন্তব্যে বলা হয়, এই দ্বন্দ্ব ভিন্ন সামাজিক পদ্ধতি সত্ত্বেও এশিয়ার জনগণের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার বিপরীতে সহঅবস্থানের ধারণাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ৩০শে অক্টোবর সুপ্রীম সােভিয়েত নীতি নির্ধারণী সভায় সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী বলেন, চীন-ভারত সীমান্তে যে বিরােধ দেখা দিয়েছে উভয় দেশের সন্তুষ্টি অনুযায়ী তার সমাধান গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে করা সঙ্গত। নয়াদিল্লির রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন, সােভিয়েতের এ মন্তব্য তাদের পক্ষে। যদিও সােভিয়েত সংঘর্ষের কারণ সম্পর্কে কোনাে মন্তব্য করেনি, যাতে মনে হতে পারে তারা চীনকে সমর্থন দিয়েছে। ১৯৬০ সালে ভারতের প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্র প্রসাদ মস্কো ভ্রমণের সময় সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ বলেন, শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে আমাদের উষ্ণ সহযােগিতার ক্ষেত্রে কেউ বাধা দিতে পারবে না। ১৯৬১ সালে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বেলগ্রেড থেকে ফিরতি পথে চারদিনের জন্য মস্কো সফর করেন। ঘানার নকুমার নিকট থেকে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে লেখা নিউক্লিয়ার পরীক্ষা বন্ধের একটি বার্তা বহন করেন। মস্কোর জনসভায় নেহেরু তা প্রকাশ করেন। জনসভায় ক্রুশ্চেভ বলেন, জার্মান শান্তিচুক্তি করতে পশ্চিমা শক্তি অগ্রাহ্য করেছে। সােভিয়েত ইউনিয়নের চারদিকে সামরিক ব্লক গড়ে তুলছে এবং সােভিয়েতের প্রস্তাবিত সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি তারা অগ্রাহ্য করছে। যুক্ত বিবৃতিতে জার্মানির বর্তমান অবস্থা পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে বলে। উল্লেখ করা হয়।
৮ খ, চীন-সােভিয়েত কূটনৈতিক দূরত্ব। ১৯৫০ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি মৈত্রী সমঝােতা চুক্তি চীন-সােভিয়েতের মধ্যে সম্পাদিত হয়। জানুয়ারি ১৯৫৭ সালে চীন-সােভিয়েত বৈঠকে ঘােষিত হয় যে, উভয় দেশ একত্রে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে সহযােগিতা করার ক্ষেত্রে সংকল্পবদ্ধ। এ সময় সােভিয়েত ইউনিয়ন চীনকে কারিগরি দিক থেকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। সােভিয়েত ইউনিয়ন একটি স্বল্প তরঙ্গের রাডার চীন ভূখণ্ডে নিমার্ণের জন্য প্রস্তাব দেয়, নেপথ্য কারণ প্রশান্ত মহাসাগরে সােভিয়েত সাবমেরিনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনে পরিকল্পনা। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ডুবন্ত ও ভাসন্ত সাবমেরিনসমূহ যাতে পর্যবেক্ষণ করতে পারে এজন্য যৌথ
কারিগরি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়; যার কমান্ড রাশিয়ার হাতে থাকার কথা বলা হয়। মাত্ত সেতুং এর মতে, এটি হলাে চীনে সােভিয়েতের সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের প্রস্ত বি। অথচ চীন চাচ্ছিল সােভিয়েত প্রযুক্তির সাহায্যে চীন নিজেই পরমাণু সাবমেরিন তৈরি করবে। চীন সােভিয়েতের বিরুদ্ধে অভিযােগ করে যে, তারা চীনকে সামরিক কমান্ডে নিয়ে যাচ্ছে। চীন এসময় মনে করে সােভিয়েত যে প্রস্তাব দিয়েছে ও কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তাতে প্রতীয়মান হয়, চীনের উপরে তাদের কোনােরূপ বিশ্বাস নেই ।
মাও সেতুং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সােভিয়েত ইউনিয়নের নমনীয় আচরণগত নীতির বিরােধীতা করেন। তার স্লোগান, “বর্তমানে পশ্চিমের হাওয়ার চেয়ে পুবের হাওয়া অনেক শক্তিশালী।’ এই নীতিতে চীন সােভিয়েতের মার্কিন নীতির প্রতি দ্বিমত প্রকাশ করে। এবং এই শ্লোগানটি বিশ্বব্যাপী জোরেশােরে তুলে ধরলে পরাশক্তি হিসেবে। সােভিয়েত রাশিয়া এ পর্যায়ে আরাে ব্রিত বােধ করে। ৮ গ. ভারসাম্য বিলীন হলাে ১৯৬০ সালে চীন ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পার্থক্য দৃশ্যমান হয়ে উঠে। এপ্রিল ১৯৬০ সালে লেনিনের উনিশতম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে চীন তাদের তত্ত্ব হাজির করে। এর মূল কথা হলাে, বন্দুকের নল, ক্ষমতা উৎস ও বিপ্লব’ ছড়িয়ে দেওয়া এবং সাম্রাজ্যবাদকে ক্রমাগত আঘাত করা। রেড ফ্লাগ-এ প্রকাশিত এ তত্ত্বে আন্তর্জাতিকভাবে চীনা কমুনিস্ট পার্টির মতামত তুলে ধরা হয়। এর এক মাসের মধ্যে চৌ এন লাই সীমান্ত সমস্যা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনার জন্য দিল্লি সফর করেন। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। এসময় পাকিস্তানের পেশােয়ারের ঘাটি হতে মার্কিন গােয়েন্দা বিমান ইউ-২ সােভিয়েত তার ভূখণ্ডে ভূপাতিত করে। চীন মনে করেছিল এক্ষেত্রে সােভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে। কিন্তু ক্রুশ্চেভ মে মাসে। ক্যাম্প ডেভিড কনফারেন্সে এ সম্পর্কে উত্তপ্ত বাক্য প্রয়ােগ করলেও চীন-রাশিয়াকে কাছাকাছি আনতে সমর্থ হয়নি। চীন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক গােয়েন্দা বিমান ইউ-২ নিয়ে সােভিয়েত ইউনিয়নে কুশ্চেভের বক্তব্যে সমর্থন দানের ক্ষেত্রে চীন নেতৃবৃন্দ এগিয়ে আসে। ভারতের বক্তব্য ছিলাে মার্কিনঘেষা, তা ছিল সােভিয়েত সমর্থনের চেয়ে বেশি। চীন সে সময় মস্কোর নিকট প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে যে, ভারত হলাে সুন্দর আবহাওয়ার বন্ধু’। মাও সেতুং ক্রমাগতভাবে ক্রুশ্চেভের সমালােচনায় অগ্রসর হয় এবং সােভিয়েতকে। সংশােধনবাদী হিসেবে আক্রমণ করতে থাকেন। ১৯৫৮ সালের জুলাই মাসে ইরাকে গভীর সংকট দেখা দিলে মার্কিন-ব্রিটিশ সৈন্য তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। এ সময় চীন সােভিয়েতকে জোর দিয়ে বলে যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ক্রুশ্চেভ শক্ত অবস্থান গ্রহণ না করে ১৯শে জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ভারত রাষ্ট্রবর্গের নেতৃবৃন্দ কীভাবে এই সংকট মােকাবিলা করা যায় তার জন্য একটি শীর্ষ সামিট গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রস্তাব দেয়। এই প্রস্তাব মস্কো-দিল্লির সম্পর্ক উন্নয়ন হয় এবং চীন আড়ালে পড়ে যায়। ১৯৫৭ সালের অক্টোবর সােভিয়েত ইউনিয়ন চীনকে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি এবং কারিগরি সহযােগিতা দিয়ে সাহায্য করে। কিন্তু ১৯৫৯ সালের ২০শে জুন রাশিয়া জানিয়ে দেয়, যে ধরনের প্রযুক্তি ও বােমা বা অস্ত্র রাশিয়া নিজেদের জন্য তৈরি করে সে অনুরূপ প্রযুক্তিগত সাহায্য ও সহযােগিতা তারা করবে না। চীন এসময় তিব্বত সংক্রান্ত বিষয়ে নেহেরু সম্পর্কে কড়া সমালােচনা করতে থাকে। অথচ সােভিয়েত ইউনিয়ন মনে করে জওহরলাল নেহেরু একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব, যার প্রজ্ঞা সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব নির্মাণে সাহায্য করবে। এসময় দালাইলামা ভারতে চলে আসার পেছনে চীনকে পরােক্ষভাবে দায়ী করে। নেহেরু সব সময় বলে এসেছে তিব্বত চীনের অংশ। তারপরও নেহেরুর বা ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসন সােভিয়েতের মতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই এতে লাভবান হবে। মস্কো ও পিকিং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমশঃ দূরে সরে যায় এবং সেক্ষেত্রে এ সময় লক্ষণীয় ভারত মস্কোর দিকে হাত বাড়ায়।
৯. পাকিস্তানের সঙ্গে সােভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক প্রাথমিকভাবে রাশিয়ান তাত্ত্বিকেরা যেমন দেকভ লিখেছেন, পাকিস্তান একটি আর্টিফিসিয়াল রাষ্ট্র এবং মন্তব্য করেন, এর দুই অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র সংযােগ ধর্ম। রাশিয়ার অনেক লেখক মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তানকে মার্ক্সীয় মতবাদ ও আদর্শের ক্ষেত্র হিসেবে মনে করেনি। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে.পি,এস, মেননকে ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্টালিন বলেছিলেন, এটি আদিম অবস্থার মত যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। পাকিস্তান প্রকৃত অর্থেই ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিজাতিতত্ত্বের মােড়কে গঠিত একটি রাষ্ট্র। সেজন্য ইসলাম ধর্মের মূলনীতি অনুসারে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা মৌলনীতি বিরুদ্ধ হওয়ায় সােভিয়েত রাশিয়ার আগ্রহের উদ্রেক করেনি। পাকিস্তান প্রথম থেকেই প্যান-ইসলামিক শক্তির প্রতি ঝুলে পড়ায় রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্থাপনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। মস্কো প্রথম ইসলামিক অর্থনৈতিক সম্মেলন করাচিতে আহবান করার নিন্দা জ্ঞাপন করে। পাকিস্তানের পাশ্চাত্য-ঘেষা নীতির কারণে সােভিয়েত রাশিয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সন্দেহ পােষণ করে। রাশিয়া মনে করে, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের গােপন চুক্তি রয়েছে এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ও অন্যত্র তাদেরকে ঘাটি দেওয়া হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মার্কিনীদের ঘনঘন যাতায়াতকে সােভিয়েতের সন্দেহকে দৃঢ় করে। এমনকি খাইবার পাশ পর্যন্ত তাদের গমনাগমন, ছবি তােলা-এসব। মিলিয়ে প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। এ ছাড়া কোরীয় যুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকা সােভিয়েতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কোন্নয়নে অন্তরায় সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রকাশ্যে জাতিসংঘের প্রতি সমর্থন ঘােষণা করে উত্তর কোরিয়ার পদক্ষেপকে পরিষ্কার আগ্রাসন হিসেবে চিহ্নিত করে। এমনকি দক্ষিণ কোরিয়াকে সাহায্যের জন্য পাঁচ হাজার টন গম অনুদান হিসেবে ঘােষণা করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপকে সােভিয়েত পত্রিকা লিয়াকত আলী খানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে টিকে থাকার। উদ্দীপক হিসেবে মন্তব্য করে।”
১৯৫০-৫২ এ দুই বছর সােভিয়েত গণমাধ্যম কাশ্মীর সমস্যা সম্পর্কে ভারতের পক্ষে ব্যাপকভাবে সমর্থন করে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এই প্রচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় সমর্থনের জন্য পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ১৯৫২ সালের ১৯শে জুন প্রাভদা ইতালির অভাস্তি পত্রিকার বরাত দিয়ে প্রকাশ করে যে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে। শুধু সামরিক বা অর্থনৈতিক সাহায্য করছে না, যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে পাকিস্তানের ভূমিকাকে সমর্থন করছে। ১৯৬০ সালের ৯ই আগস্ট ইজভেস্তিয়া রিপাের্ট প্রকাশ করে যে, কাশ্মীর সমর্থনের বিপরীতে পাকিস্তান কোরীয় যুদ্ধে মার্কিন পক্ষ অবলম্বন করেছে। পাকিস্তান প্যান-ইসলামিইজম-এর মুখােশ পড়ে মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্য দেশগুলােতে সােভিয়েতবিরােধী জোটকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়। সােভিয়েত তাত্ত্বিক দেভকএর পর্যবেক্ষণ হলাে, পাকিস্তান সােভিয়েত ব্লকের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে প্যান-ইসলামিজমের স্লোগান তােলে যা প্রকারান্তে আমেরিকা ও ব্রিটেনের অক্ষশক্তির পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তােলে। এবং পরস্পর রাষ্ট্রদূত নিয়ােগ করে। নীতি-নির্ধারকগণ উপলব্ধি করেন যে, রাষ্ট্র হিসেবে সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তােলা প্রয়ােজন। পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী যারা ছিল জমিদার ভূস্বামী তারা কেন্দ্র এবং প্রদেশসমূহে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে সমাজতান্ত্রিক দেশের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট বিজয় হওয়ার ফলে পাকিস্তানের রাজনীতি ও কূটনীতিক ক্ষেত্র নতুন ধারার দিকে মােড় নেয়। পাকিস্তান নীতিগতভাবে জোটবদ্ধ নীতির পাশাপাশি দ্বি-পাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তােলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৪৭ সালে আফগানিস্তান জাতিসংঘে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বিরােধীতা করে এবং ঐ বছরের ডিসেম্বর মাসে পাখতুনিস্তানের দাবি তুলে ধরে। সেজন্য ১৯৫১ সন পর্যন্ত উভয় দেশের সীমান্তে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ চলতে থাকে। এমনকি ১৯৫৫ সালে কাবুলে পাকিস্তানের দূতাবাস থেকে পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়। এর পরিণতিতে পেশােয়ারে আফগান কল্পলেট আক্রমণ করা হয় ও পতাকা পুড়িয়ে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ইরান, তুরস্ক, মিশর হস্তক্ষেপ করে এবং ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাসে উভয় দেশে পুনরায় রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন।
ক্রুশ্চেভ ডিসেম্বর মাসে আফগানিস্তানের দাবি অনুসারে পাখতুনিস্তানকে সমর্থন করে, যা ছিল আগুনে তেল ঢালার মতাে। আফগানিস্তানে সােভিয়েত প্রভাব প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এ সময় সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মীর্জা এবং প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৫৬ এবং ১৯৫৭ সালে কাবুল সফর করেন। আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী দাউদ খান ও বাদশাহ জহির শাহ্ ১৯৫৭ এবং ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সফর করেন। ১৯৫৭ সালে বিমান চুক্তি, ১৯৫৮ সালে ভিসা চুক্তি, ১৯৫৯ সালে টেলিযােগাযােগ চুক্তি দু’দেশের মধ্যে সম্পন্ন হয়। ১৯৫৯ সালে সােভিয়েত সমর্থনে আফগানিস্তান পুনরায় পাখতুনিস্তান দাবি করলে অবস্থার অবনতি হয়। অন্যদিকে, ১৯৬১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান-সােভিয়েত সম্পর্কের উন্নতি হলেও কাশ্মীর প্রশ্নে ১৯৬২ সালে জাতিসংঘে রাশিয়া পুনরায় ভেটো প্রয়ােগ করে। এসময় পাকিস্তান উপলব্ধি করে যে, পরাশক্তি হিসেবে সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন অপরিহার্য। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-সােভিয়েত সম্পর্ক নতুন দিকে মােড় নেয়। পাকিস্ত নি লক্ষ্য করে ভারত-চীন যুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে ব্যাপক অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে। এসময় চীনের সঙ্গে পাকিস্তান সীমান্ত চুক্তি করলে অবস্থার আরাে অবনতি হয়। ফলশ্রুতিতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জনসন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন সফর আকস্মিক বাতিল ঘােষণা করেন। ঋণ স্থগিত করে। এসময় আইয়ুব খান উপলব্ধি করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের বন্ধু নয়, প্রভু হিসেবে ব্যবহার করছে। এ প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে সােভিয়েত সফর করেন। বিশ্লেষকগণ মনে করেন, রাশিয়া কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এতােদিন পর্যন্ত আফগানিস্তান ও পাখতুনিস্তান সমস্যাকে সামনে রেখে পাকিস্তানের সঙ্গে ‘ঝাঝালাে সম্পর্ক তৈরি করেছিল। ১৯৬৫ সালের ২৯শে জুলাই সােভিয়েত রাশিয়া অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে। সােভিয়েত পরিকল্পনাবিদরা ২৮শে আগস্ট এবং ২৪শে অক্টোবর পাকিস্তানে আগমন করে। সােভিয়েত রাশিয়া পাকিস্তানকে তৃতীয় বার্ষিক পরিকল্পনা ৩০টি বৃহৎ প্রকল্পে সহায়তা দান ঘােষণা করে। পাকিস্তানের সামরিক প্রতিনিধি দল ১৯৬৬ সালের জুন মাসে সােভিয়েত ভ্রমণে যান। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসেগিন পাকিস্তানে এই প্রথমবারের মত সফর করেন। ১৯৬৮ সালে সােভিয়েত রাশিয়া পাকিস্ত নে অস্ত্র বিক্রয়ের চুক্তি করে। সােভিয়েত রাশিয়ার নিকট পশ্চিম পাকিস্তান ভূ-রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর থেকে শুধুমাত্র ভারতকে সমর্থন করার নীতিমালা থেকে সরে এসে সােভিয়েত ইউনিয়ন একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে। একটি পরাশক্তি হিসেবে সােভিয়েত ইউনিয়ন আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সমঝােতার উদ্যোগ নেয়, যার ফলশ্রুতি তাসখন্দ চুক্তি। এই চুক্তির ফলে পাকিস্তান-সােভিয়েত রাশিয়ার সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটে। বাণিজ্য, সাহায্য, পারস্পরিক যােগাযােগ ও বিভিন্ন রকম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এমনকি ১৯৬৮ সালে ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করে। ঐ বছরের এপ্রিল মাসে সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসেগিন পাকিস্তান সফরে আসেন এবং পারস্পরিক সহযােগিতার দৃষ্টান্ত হিসেবে কালাবাগ স্টিল মিল ও পূর্ব পাকিস্তানে আনবিক প্রকল্প সহায়তার ঘােষণা দেন। কয়েক মাস পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান। মস্কো সফর করেন এবং পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহে সােভিয়েতের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে দ্বিতীয় সপ্তাহে সােভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল গ্রেসকো পাকিস্তান সফর করেন। তিনি পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের সােভিয়েত মিলিটারি একাডেমি পরিদর্শন এবং সােভিয়েত নৌজাহাজ পাকিস্তান বন্দর থেকে যেন মেরামত ও জ্বালানি পেতে পারে সে প্রস্তাব রাখেন। মার্শাল গ্রেসকোর সফরসঙ্গীর সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকর্তাগণ যারা তার সঙ্গে এসেছিলেন তারা প্রস্তাব রাখেন যে, ভারত-পাকিস্তানের বিরােধ ধাপে ধাপে মিটাতে হবে এবং কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল ইস্যু হিসেবে আলােচনা করা যাবে না। এমনকি তারা পাকিস্তানের অর্থনীতির উন্নয়নে সন্তোষ প্রকাশ করেন, যদিও ভারতের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে তারা উদবেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু তারা এটাও বলেন, তাদের নিকট সবচেয়ে বড় উদূবেগের কারণ হলাে চীন। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর চীন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বব্যাপী নানাভাবে সােভিয়েতের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় যা সােভিয়েত ইউনিয়ন ‘জালাতন’ হিসেবে বিবেচনা করেছে। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাসের মধ্যে ৩০শে মে, ১৯৬৯ সালে সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান সফর করেন। তিনি পাকিস্তানের গণতন্ত্র পূর্ণঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের প্রশংসা করেন। আশা করেন যে, পাকিস্তান-সােভিয়েত সম্পর্ক প্রকৃত অর্থেই বিশ্বস্ততা ও পারস্পরিক সহযােগিতা উন্নীত হবে। কোসেগিন। ইয়াহিয়া খানকে বলেন, ভারত এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তান বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহী। কিন্তু কাশ্মীর ও পাখতুনিস্তান ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষ নাক গলালে তা জটিল হবে। সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসেগিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সরাসরি আফগানিস্তানের বাদশাহ জহির শাহ্ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে চীনের গৃহীত পলিসির তীব্র সমালােচনা করে বলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনকে কোন দেশ সাহায্য করে সে সম্পর্কে সােভিয়েত রাশিয়া উদাসীন থাকবে না। কোসেগিন আরাে সুনির্দিষ্টভাবে ভারতপাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বৈঠক করার এবং এসব দেশগুলাের মধ্যে ট্রানজিট, বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে প্রস্তাব করেন। তিনি একথাও বলেন, এক্ষেত্রে কোনাে রাজনৈতিক জটিলতা বা আলােচনা হবে না। অন্যান্য দেশ যেমন, ইরান এবং তুরস্ক পরবর্তীকালে অংশগ্রহণ করবে এবং এই ট্রানজিট বাণিজ্য ইউরােপ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এ বিষয়ে আলােচনার জন্য আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসেনি এবং এরকম ব্যবহার করেছেন যে, বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য জটিলতাপূর্ণ।
তারপরও কোসেগিন মনে করেছেন ইয়াহিয়া খান প্রস্তাব সম্পর্কে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালের ৭ই জুন মস্কোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ এশিয়ায় কালেক্টিভ সিকিউরিটি সিস্টেমের প্রস্তাব করেন এবং এ ব্যাপারে একটি ধারণাপত্র পাকিস্তান সরকারের নিকট মন্তব্যের জন্য প্রেরণ করেন। এটা কোনাে সামরিক জোট তৈরির জন্য নয়, বরং পারস্পরিক নিরাপত্তার জন্য শান্তিপূর্ণ সহযােগিতার মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক পদ্ধতির ব্যবস্থাপনা, শক্তি প্রয়ােগ আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাগ, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ভূখণ্ডগত সম্মতি এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ । পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যালােচনা করে স্পষ্টত দেখতে পায় এই প্রস্তাবের লক্ষ্য চীনকে একঘরে করে ফেলা। পাকিস্তান সেজন্য এ প্রস্তাবে নির্দেশ করে যে, এশিয়ার নিরাপত্তা পদ্ধতি চীনকে বাদ দিয়ে করলে তা উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে এবং এশিয়ার দেশগুলােতে সংঘর্ষকে উস্কে দেওয়া হবে। এসময় চীন পাকিস্তানকে সতর্ক করে দেয় যে, ট্রানজিট, বাণিজ্য চুক্তি এই হালকা দাবিটি প্রকৃতঅর্থে যৌথ অর্থনৈতিক উদ্যোগের জন্য এবং যা এশিয়ান সিকোরিটি সিস্টেমের দিকে এগিয়ে যাবে। চীন দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দেয় এটা সামগ্রিক অর্থে চীনের বিরুদ্ধে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রাথমিক পর্যায়ে এশিয়ান সিকিউরিটি সিস্টেম। নিয়ে সতর্ক মন্তব্য করেন। কিন্তু ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে ভারত সরকার এই পরিকল্পনাকে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নতুন উন্নয়ন এবং একথা উল্লেখ করে যে, ইউরােপীয় শক্তির মতাে সােভিয়েত ইউনিয়ন এশিয়ান শক্তিও বটে। একইসাথে ভারত ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে কাবুলে পাঁচজাতির সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রস্তাবকে অভিনন্দন জানান। পাকিস্তান ব্রেজনেভ পরিকল্পনা ট্রানজিট বাণিজ্য প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে। সােভিয়েত ইউনিয়ন এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭০ সালের প্রথম দিকেই পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মস্কো সফরে যান এবং পদগাের্নির সঙ্গে দেখা করে বিষয়গুলাে উত্থাপন করলে কোনাে সুনির্দিষ্ট জবাব পাননি। বরং ইয়াহিয়া খানকে বলে দেয়া হয়, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমন সম্পর্কে আলােচনা করতে। ইয়াহিয়া আগ্রহ দেখান কিন্তু এর সঙ্গে একথা বলেন যে, কাশ্মীর সম্পর্কে আলােচনা হবে না, এ সম্পর্কে ভারতকে একটি বিবৃতি দিতে হবে। এ সফরে সােভিয়েত সরকার করাচি স্টিল মিলের জন্য ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করে এবং আশা প্রকাশ করে যে, অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হবে। কিন্তু অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ থাকবে। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত প্রেসিডেন্টকে জানায় যে, ইন্দিরা গান্ধী মনে করেন যে, শীর্ষ সম্মেলনের জন্য বিদ্যমান অবস্থা সঠিক সময় নয়, বরং মন্ত্রীপর্যায়ে সভা করে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে, ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে কারাকোরাম মহাসড়ক খুলে দেওয়ার ফলে চীন ভারত মহাসাগরে আসার সুযোগ পেয়ে যায়। ভারত এসময় বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত চীন এবং সােভিয়েত সীমান্ত সংঘর্ষে রাশিয়াকে সমর্থন করে, কিন্তু পাকিস্তান নিরপেক্ষ থাকে।
এসময় ভারত এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে দু’টি ঘটনা ঘটে। একটি হলাে ভারতের জাতীয় নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী পুনরায় বিপুল সংখ্যক আসন লাভ করেন; অন্যটি হলাে, পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেন। উপমহাদেশের এই দুটি ঘটনা ছিল সােভিয়েত ইউনিয়নের জন্য তৃপ্তিদায়ক, যা পরবর্তীকালে ঘটনাবহুল রক্তাক্ত দৃশ্যমান ট্রাজেডি ও কূটনৈতিক বিশ্ব পরিমণ্ডলকে তােলপাড় করে তুলে। ১০. ব্রিটেনের ভূমিকা: ভারত-পাকিস্তান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটেনের সংশ্লিষ্টতা নানামাত্রিকতায় পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। কিন্তু কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘কভার ডিপ্লোমেসির অন্তর্ভুক্ত করাই বিধেয়। গােপনে ও নীরবে তাদের নির্দিষ্ট অথচ সীমিত কূটনৈতিক তৎপরতার বিষয়টি। অনেক গবেষকই এড়িয়ে গেছেন।
প্রবাসে বাঙালিদের বসবাস ব্রিটেনে ছিল সবচেয়ে বেশি। একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলি নিয়ে তাদের মধ্যে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া ছিল ত্বরিৎ ও গতিশীল। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর হতেই পূর্ব বাংলার বাঙালিদের উপরে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী যেভাবে অবহেলা, নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়েছে। স্বদেশে ও ব্রিটেনেও যে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে স্বাভাবিকভাবেই সে কারনে প্রবাসী বাঙালিরা ছিল ক্ষুব্ধ এবং সংগ্রামী। বিদেশে থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি তাদেরকে আলােড়িত করেছে নানাভাবে। নিপীড়ন, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবসময়ই তারা ছিল সংগ্রামরত। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকারের সংগ্রাম প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা বিদেশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে তাদের যেমন উজ্জ্বল উপস্থিতির মধ্যে পাই, তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত শুরু হলে তাদের উচ্চকিত কণ্ঠস্বর বিশ্ববাসীকে আকৃষ্ট করেছে। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাঙালি জাতির উপর আক্রমণ করলে লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিরা তাৎক্ষণিকভাবেই প্রতিবাদ, আন্দোলন গড়ে তােলে এবং বিশ্বব্যাপী তা বিস্তৃত করার লক্ষ্যে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এ কথাগুলাে বলার উদ্দেশ্য হলাে তাদের এই আন্দোলনের সঙ্গে সে দেশের জনগণ, গণমাধ্যম, সরকার এবং বিরােধীদলসমূহ কীভাবে সক্রিয়তা দেখিয়েছে তা যেমন বিচার্য তেমনি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেন বাংলাদেশকে ঘিরে যেসব গােপন পদক্ষেপ নিয়েছে তাও উদঘাটিত হওয়া প্রয়ােজন। মার্চ মাসে ইসলামাবাদের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস থেকে প্রেরিত এক টেলিগ্রামে পাকিস্তান সামরিক জান্তার মনােভাব জানিয়ে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসবে বলে আমি মনে করি না। বাঙালির নেতৃত্ব চলে যাবে আন্ডারগ্রাউন্ডে অবস্থানরত উগ্রপন্থিদের হাতে। পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়ে আসার পর থেকেই প্রতিরােধ মুভমেন্ট শুরু হবে বলে আমি মনে করি; প্রায়ই তা হয়তাে ছােটোখাটো ডাকাতির মতাে মনে হবে এবং কিন্তু তা অনির্দিষ্ট কাল ধরে চলতে থাকবে। নক্সালপন্থি এবং অস্ত্রের প্রবেশ ঘটবে।
অর্থনৈতিক জীবন প্রবলভাবে অসংগঠিত হয়ে পড়বে। ধনী ও বিদেশি নাগরিকগণ বিপজ্জনকভাবে আক্রান্ত হবেন ও অপহৃত হবেন। সন্দেহ নেই, সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে যে, যখন কিছু সংখ্যক ষড়যন্ত্রকারীকে জনগণের মধ্যে থেকে নিশ্চিহ্ন করা হবে, তখন তারা পাকিস্তানের অংশ হয়ে থাকতে চাইবে। কিন্তু প্রতিরােধের তীব্রতা যখন বাড়বে তখন ব্রিটিশ কর্মকর্তার মনে হয়েছে সেনাবাহিনী নিরাপদে ক্যান্টমেন্টে অবস্থানকেই বেছে নেবে এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে, যতটা চলবে তা স্বয়ষ্ণু এবং এটা সর্বাংশেই সত্য প্রমাণিত হবে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের এই বিবরণ কূটনৈতিক ব্যাখ্যার আওতাভুক্ত করলে দেখা যাবে, গেরিলাযুদ্ধ তীব্রতর হবে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী ডিফেন্সিভ অবস্থায় চলে যাবে।। ৩১শে মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথকে। চিঠি লিখে জানান যে, শেখ মুজিবের শেষ মুহুর্তের আলােচনাগুলাের সরলার্থ হলাে দেশের বিভাজন। সেজন্য সরকার বাধ্য হয়েই রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষার্থে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। পত্রে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযােগ উত্থাপন করে বলা হয়, ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে নাক গলাচ্ছে যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গােচরে আনা জরুরি। সীমান্তে ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতি পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের এই পত্রে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। পাকিস্তানে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার স্যার সিরিল পিকার্ড প্রেরিত এক টেলিগ্রামে এটা স্পষ্ট যে, ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ৭ই এপ্রিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ ইয়াহিয়া খানকে এক ব্যক্তিগত পত্রে বলেন, সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান প্রয়ােজন। এই পত্রে উল্লেখযােগ্য দিক হলাে, পাকিস্তান সামরিক জান্তার হাতে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রকাশ্যে জনসমক্ষে নিয়ে আসার জন্য প্রেসিডেন্টের উপরে চাপ সৃষ্টি করেন। একইসাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ভারত সরকারের নিকট থেকে তিনি এই মর্মে নিশ্চয়তা পেয়েছেন যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত কোনাে প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না।
প্রধানমন্ত্রী বার্তা হস্তান্তর কালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রধানমন্ত্রীর বার্তায় রক্তপাত’ শব্দটি ব্যবহারে মর্মাহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। প্রেসিডেন্ট আরাে বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ‘রক্তপাত’ ও ‘নিষ্ঠুরতা’র বিরুদ্ধে তার বার্তায় অত্যন্ত রূঢ় শব্দ ব্যবহার করেছেন বলে উল্লেখ করেন। ১৫ই এপ্রিল ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ সেক্রেটারি স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউম। এমপি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে আলােচনায় বলেন, গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসী শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে যদি শেষ করে দেওয়া হয় তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্ব কমিউনিস্ট বিশেষকরে চীনপন্থিদের হাতে চলে যাবে । অ্যালেক ডগলাস হিউমের মন্তব্য ছিল, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা এক হলে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে। সে কারণে ধারণা হয় ব্রিটিশ কূটনীতি সর্বদা বাংলাদেশ সংকটকে অখণ্ড পাকিস্তানের আওতায় রাখতে চেয়েছেন। ব্রিটেন সর্বদা বলে এসেছে বর্তমান সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ব্রিটেন পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানাের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে। এ সময় ব্রিটেনের নীতিগত অবস্থান হল, পাকিস্তানের কাছে ব্রিটেন অস্ত্র বিক্রি করে থাকে এটা ঠিক, কিন্তু এই পর্যায়ে পাকিস্তানের সরকারের পক্ষ থেকে কোনাে অস্ত্রের অর্ডার এলে। তা বিবেচনার জন্য সময়ক্ষেপণ করা হবে। ব্রিটেন এ সময় মানবিক সাহায্য প্রদানের জন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট আবেদন করার জন্য। জাতিসংঘ মহাসচিবকে অনুরােধ করে। ৩রা মে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রেরিত স্পেশাল এনভয় মিয়া আরশাদ হােসেনের সঙ্গে বৈঠকে ফরেন সেক্রেটারি স্যার অ্যালেক ডগলাস হীউম বলেন, ব্রিটেন মনে করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মৌন থাকা ব্রিটেনের কর্তব্য। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে সেক্ষেত্রে এই নীরবতা’ ব্রিটেনের জনগণের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ১৩ই মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি পত্র ভারতীয় হাই কমিশনার আপা বি, পান্থ ব্রিটিশ হাই কমিশনারের নিকট হস্তান্তর করেন। পত্রের একটি অংশে বলা হয়, বন্দুকের নল ঠেকিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আনুগত্য আদায় করা সম্ভব নয়। জনগণের ইচ্ছাকে শক্তভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে উগ্ররাজনৈতিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পত্রে আরাে বলা হয়, যুক্তরাজ্য পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীকে। চাপ প্রয়ােগ করে বুঝতে বাধ্য করে, যেন পাকিস্তান তার নিজস্ব নাগরিকের উপর।
অমানবিক অত্যাচার না চালায় এবং বিদেশি রাষ্ট্রে তাদের আশ্রয় গ্রহণ করতে না হয়। পত্রে বন্দি শেখ মুজিবের নিরাপত্তার বিষয়টি জোর দেয়া হয়। পত্রের উত্তরে ২০শে মে। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার জন্য অনুরােধ জানিয়েছি।” কুটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত ও ব্রিটেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা সমর্থকে একই ধরনের মনােভাব। প্রকাশ করেন। | ১১ই জুন প্রধানমন্ত্রী হীথ শরণার্থীদের বিষয়টি উল্লেখ করে ইয়হিয়া খানকে লেখেন মর্মান্তিক মানবিক সমস্যার সমাধান করা না গেলে বিশ্ব সম্প্রদায় উদ্বেগাকুল হয়ে পড়বে। এর সঙ্গে তিনি এও বলেন, এর জন্য রাজনৈতিক সমাধান জরুরি। ২১শে জুন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ ১০নং ডাউন স্ট্রিটে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং-এর সঙ্গে আলােচনায় বলেন, ব্রিটেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বারবারই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়ে তাগিদ দিয়েছে। এ সময় ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা অনুসারে বিকল্প সরকার গঠনে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা সফল হবে কিনা জানতে চাইলে শরণ সিং বলেন, ‘তারা সবসময় দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত থাকবে।’ ব্রিটিশ সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, জুলাই মাসে ব্রিটেন পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তােলার চিন্তা-ভাবনা করছে তবে।
ব্রিটেনের শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন যদি এর মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হয়ে যায়, তাহলে পূর্ব পাকিস্তান সংকট নিরসন কঠিন হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে চীনকে স্থায়ী সদস্য করে নেয় যা ছিল ব্রিটেনের উদ্বগের কারণ। কারণ ব্রিটেনের অজানা ছিল না যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নেবে এবং ভারতের তীব্র বিরােধীতা করবে যেটা হবে সংকট নিরসনে বাধা। ৫ই জুলাই ইসলামাবাদ থেকে পামফ্রে’র (তিনি স্যার সিরিল পিকার্ডের স্থলাভিষিক্ত হন) পাঠানাে এক টেলিগ্রাম থেকে জানা যায়, সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীর সফরকালে এ কথা বলেছেন যে, তিনি শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে জবাই হতে দেবেন না। এর অর্থ দাঁড়ায় দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান না হলে বাংলাদেশের সংকট নিরসনে ভারত একাই অগ্রসর হবে। এর অর্থ কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে বুঝানাে হয়েছে, শরণার্থী সমস্যা সমাধানে পূর্ববঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে রাজনৈতিক সমাধানে পাকিস্তানকে সমুঝাতা করতে হবে। ২৮শে জুলাই এই সময় যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন সরকারকে পাকিস্তানের পক্ষে সােচ্চার হওয়ার জন্য ইঙ্গিত প্রদান করেন। সেখানে বলা হয়, রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ব্রিটেন ও আমেরিকা যৌথভাবে এমন কোনাে উদ্যোগ নিতে পারে কিনা যেক্ষেত্রে ইয়াহিয়া খানের মঙ্গল হবে। ব্রিটেন সেদিকে অগ্রসর হয়নি। বরং ব্রিটেন এ সময় অর্থনৈতিক কূটনীতির দিকে অগ্রসর হয়। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় লক্ষণীয় হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছে। সেক্ষেত্রে ব্রিটেন মনে করে, বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দানের ব্যাপারে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক সমাধানে পৌছানাের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করা যেতে পারে এবং রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্রিটেন পূর্ণ সহযােগিতা দিয়ে যাবে।
আগস্ট মাসে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করার বিষয়টি জোরেশােরে উচ্চারিত হয়। ব্রিটেন এক্ষেত্রে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে অনুরােধ করেন ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে, যাতে শেখ মুজিবের বিচার ও তাকে হত্যা না করা হয়। ব্রিটেনের এই উদ্যোগের সঙ্গে মার্কিন স্ট্রেট ডিপার্টমেন্টের সিসকো একমত প্রকাশ করেন। ব্রিটেন নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। | ৪ঠা অক্টোবর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানাে এক মেমােরেন্ডামে বলা হয়, বাংলাদেশ সংকট নিয়ে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ পলিসি কী হতে পারে। সেখানে বলা হয় : ক. অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রকে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানে শরণার্থীদের সাহায্য প্রদানের ব্যাপারে ব্রিটেন উৎসাহ প্রদান করবে; খ, পাকিস্তান সরকারকে একটি রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনায় বসতে উৎসাহ প্রদান অব্যাহত থাকবে; গ, পরবর্তী কয়েক মাস পাকিস্তানকে মারণাস্ত্র সরবরাহ থেকে ব্রিটেন বিরত থাকবে; এবং ঘ, ভারত সরকারকে গেরিলাদের সাহায্য সহযােগিতা প্রদান থেকে বিরত থাকার বিষয়ে ভারতকে বুঝানাের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের উপরে ব্রিটেনের প্রভাব সীমিত হলেও তা অব্যাহত রাখতে হবে এবং উভয়ের ক্ষেত্রেই গ্রহণযােগ্যতা বজায় রাখতে হবে। অখণ্ড পাকিস্তান ব্রিটেনের কাম্য হলেও শেষ পর্যন্ত তা বােধহয় এক থাকছে না। অক্টোবর মাসে সংকট ঘনীভূত হয় এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে। | ৩১শে অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অবকাশ নিকেতন চেকার্স-এ। আলােচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, ‘যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানের যে জায়গা দখল করা হবে তা ফেরত দেওয়া হবে না। এরকম ধারণা ভারতের জনগণের এবং পার্লামেন্টের । অধিবেশন শুরু হলে গান্ধী শঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এই দাবি শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের গেরিলারা বিভিন্নভাবে। সাহায্য পাচ্ছে। তারা নিজেরাই যথাসাধ্য করছে। বেশিরভাগ সাহায্য আসছে প্রবাসী বাঙালিদের কাছ থেকে। বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ আবেগপ্রবণ এবং স্বাধীনতার প্রতি তারা এতটাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে স্বাধীনতা ব্যতীত অন্যকোনাে চুক্তি করতে রাজি হবে । ইন্দিরা গান্ধী আরাে বলেন যে, তার দেশের উগ্রপন্থিরা মনে করে প্রথমেই ভারতের যুদ্ধ করা উচিত ছিল।
এতে জনগণ ও আন্তর্জাতিকভাবে সকলকে ব্যাপারটা বুঝানাে সুবিধা হত ; পরিস্থিতি এখন আরাে জটিল। নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও প্রধানমন্ত্রী হীথ বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে মূল্যায়ন করেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন অত্যন্ত নগ্নভাবেই ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি সরাসরি বলেন, ভারত শুধু উস্কানিদাতাই নন, পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রকারী। প্রধানমন্ত্রী হীথ অবশ্য দ্বিমত প্রকাশ করেন। এই সময় ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসকে নতুন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চিন্তায় পেয়ে বসে। ভারত বিভক্তির সময় ব্রিটেন কাশীর নিয়ে সে সমস্যার জন্ম দিয়েছিলেন তা শেষ করার নতুন উদ্যোগ দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের বিনিময়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে কিনা সে বিষয়টি নিয়ে তারা হিসাব-নিকাশ শুরু করে। ব্রিটেন ও আমেরিকা এই বিষয়ে একমত হতে পারেননি। তবে এ বিষয়ে উভয়ে উপলব্ধি করে যে, পাকিস্তান কোনােমতেই অখন্ড থাকবে না। পরিস্থিতি এমন যে পাকিস্তান ভাঙনের দিকে এগিয়ে গেছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই ব্যাপারে একমত হলেও ডিসেম্বরে গিয়ে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র শেষপর্যন্ত পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বিষয়টি পূর্ব থেকেই। অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ব্রিটেন জাতিসংঘ কর্তৃক প্রস্তাবিত উভয়পক্ষের সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি সমর্থন করে। ভারতকে এই মর্মে অবহিত করেছে যে, জাতিসংঘের এই প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ভারতের অবস্থান ক্ষুন্ন হবে, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সহযােগিতা কমে যেতে পারে।
১৬ই নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের কাছে পাঠানাে এক চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সংকট নিয়ে জড়িত হওয়াকে ভারত মূল সমস্যা সমাধানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ হিসেবেই মনে করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জনগণের সংগ্রামের ফলাফল ভােগ করার ও গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের পথে এই পদক্ষেপ বাধা বলে গণ্য হবে। ২৩শে নভেম্বর ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ক্রোমারের টেলিগ্রাম সূত্র হতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পাকিস্তান সামরিক শক্তি প্রয়ােগ করলে ব্রিটেন সামরিক আক্রমণের নিন্দা করলেও সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করবে না। ২৫শে নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে লেখা এক পত্রে এডওয়ার্ড হীথ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করলে পরিস্থিতি আরাে কঠিন হয়ে যাবে।’ ঐদিনই প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের টেলিফোনের কথােপকথনের সূত্রে প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেন, “বর্তমান মুহূর্তে পাকিস্তানের তুলনায় ভারতকে বেশি আগ্রাসী মনে হচ্ছে। যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানের জন্য তা হবে মারাত্মক হুমকি।” এই মুহূর্তে ভারতকে প্রতিহত করার জন্য উভয় দেশ যতটুকু প্রভাব খাটাতে পারে তা ব্যবহার করা হবে। নিক্সন বলেন, চীন পাকিস্তানের পক্ষে আছে এবং রাশিয়ানরা ধৈর্য ধরেছে এই কারণে যে, একসময় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় তাদের আসতে হতে পারে। নিক্সন বলেন, আমি নিশ্চিত যে, ভারত পাকিস্তানকে ভাঙতে চাইছে এবং সেই পথে এগিয়ে যাচ্ছে এবং সে জন্যে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক তারা মেনে নেয়নি এবং এভাবে তারা সমাধান চায়নি। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এডওয়ার্ড হীথকে বলেন, ইন্দিরা গান্ধী যখন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন তখন তাকে বলা হয়েছিল, কোনাে শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে প্রস্তুত; কিন্তু গান্ধী এই সম্পর্কে কোনাে কথাই বলেননি। এ সময় ব্রিটেন অবশ্য প্রেসিডেন্টকে বলেন, শেখ মুজিবের সঙ্গে পাকিস্তানকে আলােচনার জন্য রাজি করাতে পারলে রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যেতাে। ৩রা ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভারত ও পাকিস্তান সরকার প্রধানগণ পত্র লেখেন। দু’দেশের এই চিঠির মধ্যে দৃশ্যত দু’ধরনের মতামত বেরিয়ে এসেছে।
৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথকে লেখা ইয়াহিয়া খানের চিঠির সারমর্ম হলাে, পাকিস্তানের ওপর ভারতের নগ্ন আগ্রাসন এমন একটি অসম্ভব পরিস্থিতির তৈরি করে দিয়েছে যা সবাইকে একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক ও বহুমাত্রিক যুদ্ধের মুখােমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আগ্রাসনের শিকার হিসেবে পাকিস্তান আপনার সরকারের অকুণ্ঠ সহযােগিতা আশা করে এবং একটি দেশের সীমানাগত অখণ্ডতা রক্ষার নীতিকে সম্মান দেখিয়ে দুটি দেশের মধ্যে অস্ত্রের ব্যবহারকে উৎসাহ না দেওয়ার জন্য অনুরােধ জানাচ্ছি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অনুরােধ জানায় যে, ব্রিটেন এমন কিছু করুক যাতে ভারত তার আক্রমণ বন্ধ করে এবং সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে এগিয়ে আসে। | ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথকে লেখা গান্ধীর চিঠিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে এই ঘটনার বাস্তবতা সম্পর্কে ভারত বার বার বােঝানাের চেষ্টা করেছে। জাতিসংঘে এ ব্যাপারে ভারতের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী নিজে ও তার সহকর্মীগণ দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে, কিন্তু তাতে কোনাে ফল হয়নি। ভারত আশা করেছিলাে যে, বিশ্ব নেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বােঝাতে সক্ষম হবেন যে, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানে যেন তিনি ব্রতী হন, কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। আমরা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে বিশ্বাসী, কিন্তু আমরা এও জানি যে, শান্তি স্থায়ী। হবে না যদি আমরা আমাদের গণতন্ত্র এবং জীবনধারণ পদ্ধতিকে নিরাপত্তা দিতে না। পারি। আমরা শুধু আমাদের ভৌগােলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য লড়ছি না; যে-মৌলিক ভিত্তির উপর ভারত দাঁড়িয়ে আছে এবং যার উপর ভারতের ভবিষ্যৎ নিহিত, আমরা সেটি রক্ষার জন্যও লড়ে যাবাে। ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ। বার্তা পাঠান। সে বার্তায় বলা হয়, নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে আলােচনাকালে ব্রিটিশ সরকার সকল অর্থহীন ইঙ্গিত এড়িয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে সমস্যা সমাধানে যা কিছু প্রয়ােজন আমরা তা করতে প্রস্তুত, একথা আপনি বিশ্বাস করবেন বলে আমি আশা করি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় রাখা হবে সবচেয়ে ভালাে কাজ। | ১১ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসে পাঠানাে দিল্লি থেকে ব্রিটিশ হাই কমিশনার মি. গার্ভে-র টেলিগ্রাম। টেলিগ্রামে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব পি.এন, হাসকার-এর কথা উল্লেখ করে বলা হয়, রাও ফরমান আলীর যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ। সম্পর্কিত বার্তা হেনরি কিসিঞ্জারের মাধ্যমে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে পৌছালে আগা শাহী তা “সৈনিকের খসড়া প্রস্তাব” ও অযৌক্তিক বলে নাকচ করে দেন, কিন্তু একে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেন।”
হাসকার বলেন, দিল্লিতে নিয়ােজিত আমেরিকান কূটনীতিবিদরা পশ্চিম ও উত্তর সীমান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ভারতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করে তার কান। ঝালাপালা করে দিচ্ছে। তার অভিযােগ আমেরিকা ভারতকে এই বলে চোখ রাঙাচ্ছে। | যে, যদি ভারত পাকিস্তানের কোনও জায়গা দখলের চেষ্টা করে, তাহলে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকান যে চুক্তি হয়েছে সে অনুযায়ী আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে এগিয়ে আসবে। আমেরিকা নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানের জায়গা দখল বলতে আজাদ কাশ্মীরকে বুঝিয়েছে। | ১১ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। দিল্লি থেকে ব্রিটিশ হাই কমিশনার মি. গার্ভের টেলিগ্রামে বলা হয়, ক, সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মি, নজরুল ইসলাম ও মিসেস গান্ধীর মধ্যে এক আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যাতে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের পুনর্গঠনে ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক সহযােগিতা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে ভারত। এতে আরও বলা হয়েছে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী এখন থেকে যৌথবাহিনী হিসেবে কাজ করবে যার পরিপূর্ণ দায়িত্ব থাকবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে। যতােদিন পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসে ততােদিন পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে অবস্থান করতে পারবে বলে চুক্তিতে বলা হয়েছে। খ, বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসা মাত্র শরণার্থীদের ক্যাম্প থেকে ফিরে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সেখানে বেসামরিক কর্তৃত্ব শাক্তিশালী করার উদ্যোগ ইতােমধ্যেই নেয়া হয়েছে। শীঘ ২৮ জন আইএএস ও আইপিএস অফিসার বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন, সেখানে সাধারণ ও পুলিশ প্রশাসন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে। এদের পর পরই বাংলাদেশে যাবে রেলওয়ে, পােষ্ট, টেলিগ্রাফ, যাতায়াত ব্যবস্থা, মেডিকেল সার্ভিস ইত্যাদি সম্পকিত বিশেষজ্ঞ গ্রুপ! গ, এসব অফিসারদের বলা হয়েছে যে, তাদের ৩ থেকে ৬ মাস বাংলাদেশে অবস্থান করতে হতে পারে। তবে দায়িত্বকাল ততােদিনই স্থায়ী হবে যতােদিন বাংলাদেশ সরকার চায়। ঘ, চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় কমান্ডার নির্দিষ্ট সময়ের পর পর রিপাের্ট পেশ করবেন চীফ অব আর্মি স্টাফের কাছে এবং তিনি বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে সকল বিষয় অবগত করবেন। মুক্ত এলাকায় উভয় দেশের বাহিনী। “সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে চুক্তিতে বলা হয়েছে। ১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিল্লি থেকে পি, ক্র্যাডকএর (সম্ভবতঃ দিল্লিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ গােয়েন্দা কর্মকর্তা) বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য বিষয় হলাে : ক. ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভারসাম্যে মৌলিক পরিবর্তন আসবে। এমন কি যুদ্ধের আগে ভারত আকারে বড় এবং ক্ষমতাবান শক্তিশালী ছিল। পাকিস্তানের তুলনায় ভারতে ব্রিটেনের স্বার্থ অধিকতর ছিল। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার ফলে ভারতে ব্রিটিশ স্বার্থ একেবারেই নিরঙ্কুশ হল।
আমাদের নীতি নির্ধারনে একথা মনে রাখতে হবে। | খ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গায় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই নতুন দেশটি টিকে থাকতে সক্ষম হবে। পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক সম্পদের অধিকারী, বিশেষ করে পাট যা থেকে গােটা পাকিস্তানের বৈদেশিক আয়ের শতকরা ৪৮ ভাগ অর্জিত হত। এছাড়া এই দেশটির সঙ্গে ভারতের প্রাকৃতিক সীমারেখা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ভারতের শুভেচ্ছার ফল দেশটি ভােগ করবে। ভারতের সহযােগিতায় দেশটি উল্লেখযােগ্য ভূ-খণ্ডের স্বত্বাধিকারী হবে এবং অতি সহজেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করে নেবে। বর্তমান সঙ্কট কেটে গেলেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ভাবে প্রাধান্য কম। পাবে এবং ভারতের “ক্লায়েন্ট স্টেট” অথবা “তাবেদার রাষ্ট্র” হিসেবে গণ্য হবে। ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সমস্যা এবং পাশ্ববর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের অস্থিতিশীলতা এই নতুন দেশটিকে কম্যুনিস্ট এবং চরমপন্থিদের স্বর্গরাজ্য করে তুলবে। গ, পাকিস্তান সম্পর্কে মূল্যায়নে বলা হয়েছে, যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানও ভেঙে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। যদি নাও ভাঙে তাহলে দেশটি চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাবে; সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের যােগ্যতা এবং সুনামের দেয়ালটি একেবারেই ধ্বসে পড়বে; দেশের অভ্যন্তরে তিক্ততা এবং ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে; পাট থেকে অর্জিত অর্থ এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাজার হাতছাড়া হওয়ায় দেশটি আরও গরীব হতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত ত্রাণ সাহায্যের জন্য দেশটি তার মুসলিম প্রতিবেশী যেমন ইরান ও তুরস্কের কাছে হাত পাতবে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রয়ােজনীয়তা সম্মন্ধে প্রশ্ন উঠবে, কিন্তু এই সম্পর্ক টিকে থাকবে। এই সম্পর্কের ভিত্তি হবে অস্ত্রের গ্রাহক হিসেবে এবং টিকে থাকবে একটি সুপার পাওয়ারেরও সাহায্যভাগী। হিসেবে। | ঘ, সােভিয়েত ইউনিয়নের জয় এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়; এবং কী করে। “প্রক্সিওয়ার” (অন্যের পরিবর্তরূপে যুদ্ধ) করা হয় সে সম্পর্কে ব্রিটেনের একটা শিক্ষা। হলাে এবং এটা স্পষ্ট হলাে যে, যেখানে অন্য সুপার পাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে সেখানে সােভিয়েত নিজের স্বার্থে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ১৯৬৫ সালে তাসখন্দের সােভিয়েত ইউনিয়ন যে নীতি অবলম্বন করেছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত নীতি আমরা এখানে দেখতে পেলাম। আগস্টে সম্পন্ন ইন্দো-সােভিয়েত চুক্তি এখন আরও শক্তিশালী এবং প্রতিষ্ঠিত। তবে এক্ষেত্রে দীর্ঘকাল আগে পরিকল্পিত ভারত-সােভিয়েত ষড়যন্ত্রের কথা ভাবার প্রয়ােজন নেই। বস্তুতঃ সােভিয়েত ডেটো-ই পূর্ব পাকিস্তানে জয়লাভের সহায়ক হয়েছে; ফলত এখানে সােভিয়েত-এর ভূমিকা আরও বৃদ্ধি পাবে, যা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে নিঃসন্দেহে মিলে-মিশে থাকবে, অর্থাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও প্রশাসন উভয় স্থানেই সােভিয়েত বলয় বলবৎ থাকবে; হয়তাে সােভিয়েত নৌবাহিনী এ অঞ্চলে স্থায়ী ঘাঁটি গড়বে।
তবে এর মধ্যেও খানিকটা “কিন্তু” রয়েছে। সােভিয়েত ইউনিয়ন আজাদ কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ভারতকে কোনও প্রকার সহযােগিতা করবে না। কারন সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভাল রাখতে আগ্রহী এবং তার দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত রাষ্ট্রসমূহ যেমন ইরান, তুরস্ক ইত্যাদি দেশগুলােকেও সে হাতছাড়া করতে চায় না। ওদিকে ভারতও তার পশ্চিমা মিত্রদের চিরতরে হারাতে চাইবে না। এছাড়া ভারতের ভৌগােলিক আকার ও তার ভেতরের চাহিদার কারণেই তাকে নানা দিক দিয়ে আপােস করে চলতে শেখাবে। | ঙ, এখানে সােভিয়েত-চীন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সােভিয়েত ইউনিয়ন আরও লাভবান হয়। পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার প্রশ্নে চীন তার পরম মিত্রের ব্যাপারে অত্যন্ত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করায় সােভিয়েত ইউনিয়ন এতদঅঞ্চলে একক কমুনিস্ট পাওয়ার হিসেবে স্বীকৃত হল, যদিও চীন পূর্ব পাকিস্তানকে এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বলে মনে করে না।
চ, চীন এখানেই তার চালে ভুল করেছে। পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ইন্দো-সােভিয়েত চুক্তির কারণে এই মুহুর্তে হয়তাে কঠিন হতাে, তাছাড়া চীন-এর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণেও তাকে বাধ্য হয়েই পিছিয়ে আসতে হয়েছে এবং যে কারণে চীন যুদ্ধ শুরু করার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান যদি সর্বাত্মকভাবে আক্রান্ত হতাে, তাহলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার জন্য চীন অধিকতর চাপের সম্মুখীন হত। কিন্তু তা করতেও চীন হয়তাে ব্যর্থ হতাে; তারা শুধু পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্ররােচনা দিয়েই ক্ষান্ত হতাে। আক্রমণকারী ভারত ও তাদের তাবেদারদের পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রতিরােধ করবে বলে চীন দাবি করতে পারে। কিন্তু তাদের এই দাবি অর্থহীন বলে মনে হয় । উপমহাদেশ নিয়ে চীনের সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা রয়েছে যা বাস্তবায়নে তারা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে রাজি বলেই প্রতীয়মান হয়। সােভিয়েত ইউনিয়নের সে ধরনের চিন্তাভাবনা নেই। ভঙ্গুর পাকিস্তান, নতুন দেশ বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চীনকে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবদিক দিয়েই সুযােগ করে দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। অন্যদিকে তারা ভারতের এই বিজয়কে এ কারণে ভয় পাচ্ছে যে, ভারত এতে নতুন করে শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং এই অঞ্চলে সােভিয়েত স্বার্থের পাহারাদার হিসেবে কাজ করা ছাড়াও ভারত মহাসাগরে সােভিয়েত ঘাঁটি স্থাপনের সুযােগ করে দেবে।
ছ, আমেরিকা চরমভাবে ভারতের উপর থেকে তার প্রভাব হারালাে। তবে এই ক্ষত একেবারে নিজের তৈরি করা, কোনও যুদ্ধের দ্বারা সৃষ্ট নয়। যথাসময়ে এই ক্ষত শুকিয়ে যেতে পারে। ভারতের আমেরিকা তথা পশ্চিমকে যেমন প্রয়ােজন রয়েছে, তেমনি সােভিয়েত ইউনিয়নের ওপর অতিমাত্রায় বােঝা হয়ে ওঠার ব্যাপারে ভারত অস্বস্তি বােধ করবে। ব্রিটেনের আগ্রহ হবে যতাে তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক সুস্থ হয়ে ওঠার ব্যাপারে নিশ্চিত করা। এ কারণে ইউরােপ থেকে ভারতকে বেশি পরিমাণে সাহায্য দিয়ে তাকে সােভিয়েত বলয় থেকে সরিয়ে আনার ব্যাপারটিও এগিয়ে নিতে হবে। তবে একটি দুঃখজনক ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, আমেরিকা হয়তাে শত্রুর কবল থেকে দেশ উদ্ধারের পাকিস্তানি মনােবৃত্তিকে সহায়তা দিতে পারে যা এখানে পাকিস্তান-আমেরিকা ও ভারত-সােভিয়েত ইউনিয়ন সংঘর্ষের জন্ম দেবে। | জ, এই যুদ্ধে জাতিসংঘেরও বড় ধরনের পরাজয় ঘটেছে। নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়ায় এখন থেকে যে অঞ্চলে দুই পরাশক্তির আগ্রহ রয়েছে সেখানে কোনও সমস্যা দেখা দিলেই তারা জাতিসংঘকে বাদ দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে। জাতিসংঘের অসহায় অবস্থা এবং বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মতৎপরতা হ্রাস পাওয়ার ফলে তৃতীয় বিশ্বকে একটি মহাশক্তির দেশের (কমিউনিস্ট হলেই ভালাে) সহায়তা গ্রহণ (ভেটো দেওয়ার জন্য) করতে হবে। এর ফলে তৃতীয়। বিশ্বের অস্ত্র ক্রয় এবং স্থিতিহীন পরিস্থিতি হবে নিরুৎসাহব্যঞ্জক।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডগলাস হিউম পূর্ব পাকিস্তানের প্রাণহানিতে নিন্দাজ্ঞাপন করেন, তিনি বলেন যে এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ব্রিটেন এতে হস্তক্ষেপ করবে না। ৫ই এপ্রিল পুনরায় বলেন, ব্রিটেন অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না; তবে রক্তপাত বন্ধ হওয়া এবং জনগণের পছন্দমতাে রাজনৈতিক সমাধান যে তার কাম্য তা প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছেন। ২৬শে এপ্রিল কমন্সসভার বিবরণী থেকে জানা যায়, যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ প্রদান, অস্ত্র বিক্রি এবং সিয়াটো চুক্তি অনুসারে সামরিক সাহায্য সম্পর্কে বিতর্ক হয়। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নোত্তর অংশে ব্রিটিশ নীতি ব্যাখ্যা করে বলেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে ব্রিটেন বিশ্বাসী। তিনি কমনওয়েলথের মাধ্যমে এই সমস্যার মধ্যস্থতা সম্ভব নয় বলে মনে করেন। | ১৫ই মে কমন্সসভার এমপি’রা বাংলাদেশ পরিস্থিতি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ব্রিটিশ সরকারের এই অবস্থান পরিত্যাগপূর্বক ২০০জনের বেশি এমপি, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী শ্রেণির পক্ষ থেকে দাবি করা হয় পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধের দাবি জানানাে হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য রাজনৈতিক সমাধানের উপরে জোর দেন। গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক আইনের এখতিয়ারে নেওয়া যায় কিনা এরকম দাবি উত্থাপনও হয়।
মে মাসে বাংলাদেশের পরিস্থিতি প্রত্যক্ষদর্শী এমপিদের বিবরণ কমন্সসভায় তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, “স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদী গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে।”৯৩ দীর্ঘ বিতর্কে ব্রিটিশ এম.পি,গণ অনেকেই বাংলাদেশকে সমর্থন করেন, অনেকেই পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন দেন। কেউ কেউ অবশ্য মন্তব্য করেন, বর্তমান সংকট থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে। আবার কেউ অভিমত প্রকাশ করেন, জনগণের পছন্দমত রাজনৈতিক সমাধান হওয়া দরকার । ৮ই জুন ব্রিটিশ সরকার এই প্রথমবারের মতাে স্বীকার করেন। যে, বর্তমান পরিস্থিতি শুধু পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বিষয়ও। ৩১শে আগস্ট ব্রিটিশ এমপি পিটার শাের অভিমত প্রকাশ করেন যে, “বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে পুরােনাে জাতির মৃত্যুযন্ত্রণা ও নতুন জাতির প্রসববেদনার সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বর্তমান সংকট নিরসনে শেখ মুজিবের মুক্তি ও নির্বাচিত প্রতিনিধির সাথে। আলােচনাকে একমাত্র উপায় ও পাকিস্তানের উপর বিদেশি সাহায্য বন্ধ করে চাপ সৃষ্টি করা উচিত।” ২৩শে সেপ্টেম্বর হাউজ অব কমন্স-এর কার্যবিবরণীর শিরােনামে পূর্ব পাকিস্তানের। পরিবর্তে এই প্রথমবার পূর্ব বাংলা ব্যবহার করা হয়। ৪ঠা নভেম্বর হাউজ অব কমন্স-এ পররাষ্ট্রসচিবের মন্তব্য থেকে জানা যায়, ইয়াহিয়া খান শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপনার লক্ষ্যে দু’দেশের সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেওয়া, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগের প্রস্তাব করেন। ভারত এইসব প্রস্তাবকে অকার্যকর বলে মন্তব্য করেছেন।
১১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটেনের ভূমিকা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার অবসান হয়ে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হলেও উভয় দেশের উপরই যুক্তরাজ্যের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। উভয়েই অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য, বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্রিটেনের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। যুক্তরাজ্য সংকট শুরু হবার বেশ আগে থেকেই পরিস্থিতির উপর সতর্ক নজর রাখছিল এবং সাবেক ঔপনিবেশিক হিসেবে এ উপমহাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয়। থাকায় সমস্যার স্বরূপ ও এর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন পক্ষ সম্পর্কে স্পষ্ট ও খুঁটিনাটি ধারণা ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকেই ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম ও জনগণ বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে সাহায্যে এগিয়ে আসে। পূর্ব পাকিস্তানে। বাঙালিদের হত্যা-নির্যাতনের খবর প্রকাশ করে বিবিসি রেডিও ও ব্রিটিশ সংবাদপত্রসমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে বিশ্বজনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্রিটিশ রাজনীতিকগণও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দুর্দশা লাঘব এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন, তাদের এ প্রয়াস কতটা জোরালাে ছিল তা বোঝা যায়, যখন ১৪ই মে ১৯৭১ কমন্স সভায় পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি আলােচিত হয় এবং এতে এমনও বলা হয় যে, “মৃত দেহের স্থূপের নিচে পাকিস্তান কবরস্থ হয়েছে।”
বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসে ব্রিটেন নীরব কূটনৈতিক ভূমিকায় অগ্রসর হয়েছে। প্রতিপাদ্য এভাবে লিপিবদ্ধ করা যায় যার : ১. ব্রিটেন কোনাে পক্ষের দিকে ঝুঁকে পড়েনি বা বিবদমান কোনাে পক্ষের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেনি; ২. পূর্ব পাকিস্তানে যা সংঘঠিত হয়েছে। তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়, কিন্তু একথাও একইসাথে ভারত এবং পাকিস্তানের সরকারপ্রধানের কাছে লিখিত বক্তব্যে পূর্ববঙ্গের ট্রাজেডির বিষয় উল্লেখ করেছেন, বিভিন্নভাবে নিযতিন, হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের আওতায় প্রতিবাদ করেছে; ৩. বে%E