বাংলার বাণী
ঢাকা : ৪ঠা নভেম্বর, সোমবার, ১৯৭৪, ১৭ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
সাইপ্রাস প্রশ্নে জাতিসংঘের প্রস্তাব
ম্যাকারিয়াস দেশে ফেরেননি এখনো। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি যেদিন লন্ডন পৌঁছেছিলেন সেদিন আশা প্রকাশ করেছিলেন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গ্রীক সামরিক জান্তার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেবে—সে আশাও তার পূর্ণ হয়নি। তবে চলতি সাধারণ পরিষদে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর আনীত এক প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবে আহ্বান জানানো হয়েছে সাইপ্রাসে অবস্থানরত সকল বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহারের। কেউ এর বিরোধিতা করেনি এমনকি তুরস্কা, গ্রেট বৃটেনও নয়।
তুর্কী সৈন্যরা সাইপ্রাসের বর্তমান চল্লিশ শতাংশ এলাকা দখল করে আছে। পনেরোই জুলাই-এর ঘটনাবলীর পর গত সাড়ে তিন মাস কাল সময়ে ভূ-মধ্যসাগরীয় এই দ্বীপদেশ থেকে দু’লাখ আটত্রিশ হাজার নর-নারী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। রাজনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি উদ্বাস্তুদের এই বিপুল সংখ্যা মানবিক সমস্যারও সৃষ্টি করছে বৈকি!
সাইপ্রাস সমস্যা আজ অত্যন্ত প্রকট হয়ে বিশ্ববাসীর চোখে ধরা পড়লেও বাস্তব সমাধানের অপেক্ষায় এই সমস্যাটি দীর্ঘদিন ধরেই ছিল গুণছিল। বৃটিশ উপনিবেশবাদী শাসন থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ক্ষণটিতে যে সাম্প্রদায়িক সমস্যা আপাতঃকালের জন্য সুপ্ত ছিল তার বিস্ফোরণ ঘটে অচিরেই। গ্রীক বংশোদ্ভূত এবং ‘এওকা’ আন্দোলনের পুরোধা ম্যাকারিয়াস সাইপ্রাসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনবার প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। সারা দেশব্যাপী এক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ সাইপ্রাসে তুরস্ক এবং গ্রীসের হস্তক্ষেপের জন্য একটা অজুহাত সৃষ্টি করে।
জুলাই-এর ঘটনাবলী পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়লেও আসলে এটা ছিল মার্কিন প্ররোচিত গ্রীক জান্তাদের একটি ষড়যন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। ম্যাকারিয়াস নিজেও এই ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়েছিলেন ক’দিন আগেই। কিন্তু তা প্রতিরোধে ব্যর্থ ম্যাকারিয়াসকে অবশেষে গ্রীক জান্তার আগ্রাসনী নীতির কাছে পরাজিত হয়ে দেশ ত্যাগ করতে হয়।
তারপর ঐ দ্বীপটির রাজনৈতিক মঞ্চে অনেক দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়েছে। তুর্কী সাইপ্রিয়টদের নিরাপত্তার নাম করে তুর্কী সেনারা দখল করেছে সাইপ্রাসের প্রায় অর্ধাংশ। গ্রীসের রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং গ্রীক জান্তার পুতুল স্যামসনের দু’দিনের বাদশাহীর পরিসমাপ্তি সাইপ্রাসের রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন আনয়ন করেছে। গ্রীক এবং তুর্কী সাইপ্রিয়ট নেতারা নিজ দেশের ভবিষ্যত নিয়ে ক’দফা আলোচনা বৈঠকেও বসেছেন। এমনি মুহূর্তে জাতিসংঘের এই প্রস্তাব বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
শুধু তুর্কী সেনাই নয়, সাইপ্রাসে রয়েছে গ্রেট বৃটেনের সামরিক ঘাঁটি। জাতিসংঘ প্রস্তাবে স্পষ্টাস্পষ্টি উল্লেখ না থাকলেও আমরা মনে করি ‘সকল বিদেশী সৈন্যের’ মধ্যে বৃটিশ সেনাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাইপ্রাস একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এর স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের মর্যাদা প্রদান সকল দেশেরই অপরিহার্য কর্তব্য। সে দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যাবে সে ব্যাপারটা সাইপ্রাসবাসীরাই ভালো বোঝেন। তাদের পারস্পরিক আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টির প্রাথমিক শর্ত হিসেবে বৃটেন সহ সকল বিদেশী সৈন্যের অনতিবিলম্বে সাইপ্রাস ত্যাগ করা উচিত। জাতিসংঘ প্রস্তাব যাতে করে যথাযথভাবে কার্যকরী হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহ সহ শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সকল শক্তির প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।
সয়াবিন চাষ এবং ‘সয়-দুধে’র সম্ভাবনা
সয়াবিন বীজ আমাদের জন্য এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। ঈশ্বরদী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে সয়াবিন বীজ থেকে ‘সয়-দুধ’ উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং এই ‘সয়-দুধ’ নাকি গরুর দুধের মতোই পুষ্টিকর বলে জনৈক উদ্ভিদবিদ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ‘সয়-দুধে’ অবশ্য গরুর দুধের মতো খাদ্যপ্রাণ নেই, কিন্তু ‘সয়-দুধে’ প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে। জানা গেছে, গবেষণার মাধ্যমে ‘সয়-দুধ’কে উন্নত মানে উন্নীত করা হয়েছে। ‘সয়-দুধ’ যদি সত্যিই গরুর দুধের বিকল্প হিসেবে চালু হয়, তাহলে দেশের দুধ সংকট দূরীকরণ করাটা খুব একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে না বলেই আমরা মনে করি। সারা দেশব্যাপী যখন গরুর দুধ এবং গুঁড়ো দুধের হাহাকার, তখন সয়াবিন থেকে দুধ তৈরীর খবর আমাদের কাছে আশীর্বাদ বলেই প্রতিপন্ন হবে। আমরা জানতাম, সয়াবিন বীজ থেকে কেবল তেল-ই তৈরী হয়। কিন্তু সয়াবিন বীজ যে শুধুমাত্র তেলবীজ নয়, সয়াবিন থেকে দুধ, মাখন এবং ময়দা তৈরীও সম্ভব। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, সয়াবিন থেকে তৈরী করা ‘সয়-দুধ’, মাখন এবং ময়দা নাকি ঈশ্বরদীর জনসাধারণকে দেখানো হয়েছে। সয়াবিন বীজ পানিতে ভিজিয়ে রেখে তা পিষে আবার পানির সঙ্গে মিশিয়ে সিদ্ধ করে নিলেও তা দুধ হয়ে যাবে এবং বীজের গুঁড়ো অংশ নাকি ময়দা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ব্যাপারটা প্রথমাবস্থায় অলীক কিংবা অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা পরীক্ষিত সত্য। কৃষি বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে যে, বাংলাদেশের উর্বর মাটিতে সয়াবিন ফলনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বিদেশী সাহায্য সংস্থা মেনোজাইট ক্রিশ্চিয়ান কম্যুনিটির (এমসিসি) উদ্যোগে ইতিমধ্যেই দেশের কতিপয় এলাকায় সয়াবিনের চাষ করা হয়েছে। সয়াবিন চাষ করতে সামান্য মূলধন বিনিয়োগ করতে হয়। সয়াবিনকে কাঁচা অবস্থায় সবজি হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘সয়-দুধ’, মাখন এবং ময়দা তৈরীও এমন কিছু দুঃসাধ্য কাজ নয়। কাজেই সমুদয় সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে দেশে ব্যাপকভিত্তিতে সয়াবিন চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। সয়াবিন চাষ সারা বছরই করা যায়। প্রতি একর জমিতে বিশ থেকে চল্লিশ মণ পর্যন্ত সয়াবিন পাওয়া সম্ভব। প্রতি একর জমি থেকে কৃষকরা কম করে হলেও পাঁচ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন। এদিক দিয়েও সয়াবিন চাষ একটি লাভজনক ফসল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান এবং ইন্দোনেশিয়াতে প্রচুর পরিমাণ সয়াবিন উৎপন্ন হয়। আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে বাংলাদেশেও সয়াবিন উৎপাদন করে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করা যায়।
দেশে সয়াবিন চাষের জন্য সরকার এবং বিদেশী সংস্থাগুলো যদি সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করেন, তাহলে কৃষকরা নিশ্চয়ই সয়াবিন ফলানোর ব্যাপারে উৎসাহী হবে। এবং গরুর দুধের বদলে ‘সয়-দুধ’ উৎপন্ন হলে দেশের দুধ সংকট অনেকাংশে মোচন হবে। আমরা আশা করি, কৃষি মন্ত্রণালয় দেশে সয়াবিন চাষের সম্ভাবনা সম্পর্কে একটা বাস্তব ভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহণ করবেন। কারণ, সয়াবিন চাষের ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য জাগানোটাই এই মুহূর্তের কর্তব্য। কৃষকদের উৎসাহে যাতে ভাটা না পড়ে সে জন্য সরকারী সহযোগিতার প্রশ্নটিও বিবেচনা করা দরকার। দেশে শুধু দুধের সংকটই বর্তমান নয়, তেল এবং ময়দা সংকটও রয়েছে। কিন্তু সয়াবিন এমন একটি ফসল যা থেকে একসঙ্গে অনেকগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস তৈরী হয়। সে জন্য ব্যাপকহারে সয়াবিন চাষের প্রতি মনোযোগ দিলে তা আমাদের জন্য আশীর্বাদই বয়ে আনবে।
খ্যাতিমান প্রাবন্ধিকের প্রয়াণ
গত শনিবার ৭৬ বছর বয়সে প্রবীণ সাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহে….রাজেউন)। মৃত্যুকালে তিনি চার ছেলে ও ছয় মেয়ে রেখে গেছেন। এবং রেখে গেছেন অসংখ্য ভক্ত গুণগ্রাহী এবং অনুরাগী বন্ধুবান্ধব ও স্বজন প্রতিবেশী। আমরা তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করি এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গকে জানাই আন্তরিক সমবেদনা।
বলা বাঞ্ছনীয় যে, তার শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন ও সাহিত্য জীবন সুধীজনের কাছে প্রশংসার্হ, বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের কাছে প্রেরণাব্যঞ্জক। কর্মজীবনের গুরুদায়িত্বের মাঝেও যেন তাঁর সাহিত্য পিপাসু মন নিষ্ঠা, সাহিত্যানুরাগ ও অদম্য নিরলস সাধনার জগতে বিচরণ করে আনন্দ পেতো। শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়—বিদেশী সাহিত্য সম্বন্ধে জানতেও তিনি ছিলেন সদা উৎসুক। মরহুম বরকতু্ল্লাহর অমর গ্রন্থ ‘পারস্য প্রতিভা’ তারই সাক্ষ্য। এই গ্রন্থে তিনি পারস্য প্রতিভাধরদের সঙ্গে বাঙালী সুধী সমাজের বৌদ্ধিক যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, যে কয়েকজন মুসলিম প্রতিভাধর স্বীয় প্রতিভা বলে বাংলা গদ্য সাহিত্যের আসরে নিজেদেরকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন তাঁদের মধ্যে মরহুম বরকতুল্লাহ অন্যতম। তাঁর গদ্য ভাষা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী, বক্তব্য ভঙ্গি ঋজু, ব্যাখ্যায় পরিচ্ছন্ন, বর্ণনায় সাবলীল ও মনোরম, যুক্তিতে শাণিত এবং উপস্থাপনায় আকর্ষণীয়। সৃজনশীল সাহিত্যরচয়িতা তিনি ছিলেন না বটে, কিন্তু চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি সুধী সমাজকে সচকিত করতে যে পেরেছিলেন সে কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়।
মরহুম সাহিত্যিক বরকতুল্লাহ দর্শন চর্চাও করতেন। ‘মানুষের ধর্ম’ নামক গ্রন্থে তাঁর দার্শনিক চিন্তার অত্যন্ত বিচক্ষণ বক্তব্য সেই প্রমাণই বহন করে। সাহিত্য রচনার বিষয় নির্বাচনে তিনি ছিলেন সর্বদা গুরু ও গম্ভীর। তাই হয়তো তাঁর পাঠক সংখ্যা বেশী ছিল না কিন্তু বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁর কদর ছিল অসামান্য। এও সত্য যে, প্রতিভার তুলনায় তিনি কম সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেছেন। হয়তো আজীবন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে কাজ করাই তার মূলে রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। আত্মপ্রচার পছন্দ করতেন না। বলা যায়, নিরহঙ্কারী ও জ্ঞানানুরাগী এই সাহিত্যিক তাই সার্বিকভাবেই ছিলেন আমাদের জাতীয় গৌরব ও সম্পদ। তাই বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গন থেকে এহেন উচ্চ পর্যায়ের চিন্তাশীল ও খ্যাতিমান একজন সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিককে হারিয়ে সমগ্র দেশ এবং সাহিত্য সমাজ আজ অপুরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হলো। চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য ও গুণের জন্য এবং সাহিত্যকৃতী ও সাধন হিসেবে তিনি আমাদের জাতীয় জীবন ও সাহিত্যে অমর ও অনুসরণীয় হয়ে থাকুন—তাঁর সমগ্র জীবনের সৎ জীবন যাত্রা ও কর্মের পুরস্কার হোক এইটে। আমরা ঐকান্তিকভাবে তাই কামনা করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক