You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.25 | জাতিসংঘে বাংলাদেশ সম্পর্কিত কূটনৈতিক তৎপরতা - সংগ্রামের নোটবুক
জাতিসংঘে বাংলাদেশ সম্পর্কিত কূটনৈতিক তৎপরতা
ভূমিকা পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করে। সকল ন্যায়-নীতি, দ্ব্যর্থহীন গণরায়, গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ, রীতিনীতি, মানবাধিকারের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে দল, মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি জাতিকে ধ্বংস করার ব্লু-প্রিন্ট কার্যকর করতে আগ্রাসন চালায়। যুদ্ধআক্রান্ত, অসহায়, আতঙ্কগ্রস্ত এবং নিরাপত্তাহীন অগণিত মানুষ জীবনের আশ্রয়ে প্রতিবেশী ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে। মানবিক বিপর্যয়ের এই জঘন্যতম কর্মকাণ্ড বিশ্ববিবেকে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পরিণামে তা কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয়, বিশ্বশান্তিকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। এই অবস্থায় বাংলাদেশের নৃশংস ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে বিশ পরিসরে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে গণতান্ত্রিক-নির্বাচনে একটি জাতির দ্ব্যর্থহীন গণরায় নস্যাৎ করার লক্ষ্যে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত আক্রমণ, অগণিত গণহত্যা ও শতাব্দীর মানবিক ট্রাজেডির বিষয়টিকে জাতিসংঘ কীভাবে গ্রহণ করেছিল। | জাতিসংঘে কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে মূলত দুটি ধারা বেরিয়ে আসে যদিও এর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে ভিন্ন উপধারী। দুটি মূল ধারার একটিতে শরণার্থীদের মানবিক সমস্যা প্রাথমিক তৎপরতা কীভাবে রাজনৈতিক সমঝােতার সমন্বিত প্রান্তে দাঁড়িয়েছে তার বহুমুখী উদ্যোগ ও কূটনৈতিক তৎপরতার প্রকাশ্য রূপ। অন্য ধারায় বাংলাদেশ সম্পর্কে কূটনৈতিক তৎপরতাকে চেপে ধরে এই প্রকট ও ভয়াবহ সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তানের সমস্যায় রূপ দেবার প্রয়াস চালানাে হয়েছে। তারপরও লক্ষণীয় প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সংকটের শেষ অংকে এসে বাংলাদেশকে ঘিরেই জাতিসংঘের কূটনৈতিক উদ্যোগ, কার্যক্রম ও তৎপরতা পরিচালিত হয়েছে। জাতিসংঘ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাকে।
 

প্রাথমিকভাবে মানবিক ট্রাজেডি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যাবে যে, বাস্তবতার কারণে এই ভয়াবহ মানবিক সমস্যা রাজনৈতিক সমাধানে তারা আগ্রহী। হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক সমাধানের ইতি লক্ষ্য ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় সমাধান পাওয়া; হেনরি কিসিঞ্জারের কথার সরল অর্থ ছিল রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন অর্থাৎ স্বাধীন বাঙালি জাতির আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই মৌলিক নীতি জাতিসংঘের কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয়েছে। মার্কিন কূট-কৌশলে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্মসূত্র দাবিকে প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে রাখার সযত্ন প্রয়াস পরিলক্ষিত হলেও সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নটি পরিশেষে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্টের বিঘােষিত নীতি অনুযায়ী বাইরে যেমন জাতিসংঘের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করতে কুণ্ঠিত ছিল না। অন্যদিকে, সােভিয়েত রাশিয়া ভূ-রাজনৈতিক ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে ভারতের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান। নিতে গিয়ে বাংলাদেশের গণ-আকাক্ষার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জাতিসংঘের চত্বরে কূটনৈতিক দাবাখেলার চাল এবং পাল্টা চাল যেকোনাে বিশ্লেষকের জন্যই চমকপ্রদ। প্রাথমিকভাবে জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিষয়টি অপ্রকাশ্যে এসেছে শরণার্থীআন্তর্জাতিকীকরণ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিপর্যয়কর মানবিক ঘটনাবলির সমাধানে রাজনৈতিক সমঝােতার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে পেতে চেয়েছে। মানবিক বিপর্যয়ের স্তুপীকৃত ঘনীভূত সমস্যার রাজনৈতিক সমধানের কূটনৈতিক তৎপরতার শেষাঙ্কে সামরিক যুদ্ধ অনিবার্য ও দৃশ্যমান হয়ে উঠলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে উপস্থিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিভিন্ন দেশ বিশেষকরে পরাশক্তিগুলাে জাতিসংঘে পরিচালিত হয় স্ব-স্ব দেশের বহুমাত্রিক ও বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক তৎপরতার পরিমণ্ডলে আবর্তিত হয়েছে এবং সর্বশেষ সমন্বিত পরিমণ্ডলকে সামনে রেখে পরাশক্তিগুলাের সর্তক পদক্ষেপ ছিল বিশ্বযুদ্ধ এড়ানাে, যা এই অধ্যায়ে সংক্ষিপ্ত আকারে আলােচিত হবে।

 
জাতিসংঘের দায়িত্ববোধ 
 
জাতিসংঘ সনদে পৃথিবীর সকল দেশের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, মানবাধিকার রক্ষা এবং গণহত্যা রােধ ও শান্তি বিষয়ক সনদ গ্রহণ করা হয়েছে। জাতিসংঘের ২ (৭) উপধারায় বলা হয়েছে, বর্তমান সনদ জাতিসংঘকে কোনাে রাষ্ট্রের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার দিচ্ছে না বা সেরূপ বিষয়ের নিস্পত্তির জন্য কোনাে সদস্যকে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে না, কিন্তু সপ্তম অধ্যায় অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে এই নীতি অন্তরায় হবে না। যদিও তা বাংলাদেশের বেলায় সপ্তম ধারা কোনাে ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়নি বা বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সপ্তম ধারা অনুযায়ী কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু একথা সত্য যে, জাতিসংঘ সনদের সপ্তম ধারা অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের ব্যবস্থা যে নিতে পারতাে না। এমনটি নয়।  জাতিসংঘের পূর্বাপর ভূমিকা বিশ্লেষণে দৃষ্টান্ত হিসেবে এ কথাটি উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধে স্বাধীন সার্বভৌম ইরাক প্রজাতন্ত্রের সম্মতি ব্যতিরেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে পশ্চিমা দেশগুলাে কুর্দি জনগণের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করেছে অথবা এটাও দৃষ্টান্ত হতে পারে, কেন্দ্র সরকারের বিনা অনুমতিতে সােমালিয়ায় জাতিসংঘ ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছে। সে কারণে এ কথা উঠে আসে যে, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যে বিশাল মানবিক ট্রাজেডি সৃষ্টি হয়েছিল, যে ব্যাপক গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন যেখানে নিত্যদিনের দিনপঞ্জির নিষ্ঠুর আলেখ্য এবং যা ছিল বিশ্ব মানবতা ও শান্তির পক্ষে চরম হুমকি, সেক্ষেত্রে জাতিসংঘ তার যথাযথ ভূমিকা পালনে দ্বিধান্বিত ছিল। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন যেকোনাে পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ সনদের ৯৯ ধারার ক্ষমতানুসারে মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ। করতে পারে। কিন্তু তিনি তা করেননি। এই ব্যাখ্যা তিনি নিজেই দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ভারত ও পাকিস্তানের ঋণাত্মক মনােভাবের কারণে নিরাপত্তা পরিষদের অধিকাংশ সদস্য কোনাে সভা ডাকতে রাজি হবে কিনা, সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান ছিলেন।
 
আর তা যদি সম্ভব হতাে, তাহলেও সে সভার কোনাে এজেন্ডা নির্ধারণ সম্ভব। হতাে না। কারণ পাকিস্তান তখন যুক্তি দেখিয়ে বলতাে, আন্তর্জাতিক শান্তি বিঘ্নিত হয় এমন কোনাে ঘটনা ঘটেনি। চলতি বিবাদ শুধু পাকিস্তান সরকার ও আওয়ামী লীগের ভেতর। “এরপরে যদি আমি মিথ্যা’ যুক্তিতে ৯৯ ধারা ব্যবহারের চেষ্টা করেছি বলে অভিযুক্ত হতাম, তাহলে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আমার কার্যকারিতা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হতাে।” এতদ্সত্ত্বেও মার্চে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলােচনা ভেঙে যাওয়ার ৪৮ ঘন্টা পর মহাসচিব উ’থান্ট জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগাশাহীর সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হয়ে ঢাকার পরিস্থিতি ও মানবিক বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। নিরাপত্তা পরিষদের নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও উ থান্ট পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অর্জন না করা গেলে মানবিক বিপর্যয় এড়ানাে যাবে না সে কথা তিনি ভালােভাবেই জানতেন। আর তেমন কোনাে সমাধান ফর্মুলা বের করতে হলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে আলােচনার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর আনতে হবে। আর এই কঠিন কাজটি করার জন্যই উ থান্ট টুংকু আবদুর রহমানের দ্বারস্থ হন।’ এ সম্পর্কে উ থান্ট গােপন কূটনৈতিক পত্রালাপ করেন। কিন্তু তাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ২৫শে মার্চের গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্বে এ প্রশ্নের উদ্রেক করে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’, জেনেভা কনভেনশন মান্যতা এবং রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক নীতি’ সমুন্নত রাখার কথা সমভাবে ঘােষিত হলেও জাতিসংঘের গায়ে তা আচড় কাটতে পারেনি, কিংবা জাতিসংঘের কর্ণকুহরে তা প্রবেশ করেনি বা দৃশ্যমান হয়নি। বরং এই মৌলনীতিকে ‘অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার ঝুলিতে ঠেলে দিয়ে এর ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া থেকে জাতিসংঘ সনদ ও কাঠামােগত কারণের দোহাই দিয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
 
পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীর ভয়াবহ মানবাধিকার লঘন, গণহত্যা এবং মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবোেধকে নির্মমভাবে উপেক্ষা করে। পাকিস্তান সামরিক জান্তা এক কথায় বলা যেতে পারে, প্রথমদিকে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যা এবং নির্মম মানবাধিকার লঙ্ন এবং সীমাহীন নির্যাতনের বিষয়টি উপেক্ষা করে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে কেবলমাত্র অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। ও সংহতির কথাই জোরেশােরে তুলে ধরে। কেননা পাকিস্তান মনে করেছিল সামরিক অভিযানেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব এবং তা হবে ‘স্বল্প সময়ের মধ্যেই। বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে এই যে, একান্তরের শেষ প্রান্তিক ব্যতীত জাতিসংঘ বিতর্ক, আলােচনা বা প্রস্তাবে বাংলাদেশকে সরাসরি খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রথম থেকেই জাতিসংঘের সম্পর্কের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশ সমস্যাটিকে সামনে নিয়ে আসা হয়নি। বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার গুরুতর প্রশ্নটিকে এড়িয়ে পাকিস্তান প্রথম থেকে পূর্ববঙ্গের উদ্ভূত ভয়ংকর পরিস্থিতিকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যায় রূপান্তকরণের প্রচেষ্টা, কখনাে শরণার্থী সংখ্যাতত্ত্বের জটিলতা, রাজনৈতিক সমঝােতাকে চাপা দিতে মানবিক সমস্যার আপাত স্বীকৃতি এবং সর্বোপরি ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ, যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের মতাে বিষয়কে জাতিসংঘের কূটনৈতিক এজেণ্ডায় বড় করে তুলে। ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এর নেপথ্যে শক্তিশালী ও সক্রিয় পৃষ্ঠপােষক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র-চীন ও তাদের অনুসারী রাষ্ট্রগুলাে যেমন যুক্ত ছিল তেমনি মুসলিম বিশ্ব সংশ্লিষ্ট ছিল। গবেষণায় প্রতীয়মান হবে যে, এই জ্বলন্ত আন্তর্জাতিক ইস্যু সমাধানে জাতিসংঘের অসফলতার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ সনদে উল্লেখিত জাতির ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের মৌলিক দিকটিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সমগ্র পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সংগ্রাম কোনােভাবেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হতে পারে না এ কথা উপলব্ধি করতে তারা যে অক্ষম ছিল এমনটি নয়। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং ঐ দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হত্যা এবং নির্বিচার গণহত্যার প্রয়াস চালানাে হয়। পােড়া মাটি নীতি’ গ্রহণ করা হয় । ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার সবকিছুই অস্বীকার করা হয় । বাধ্য হয়ে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনে স্বাধীনতা ঘােষণা করে। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সনদ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেও দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জাতিসংঘের দুয়ার পর্যন্ত এ বার্তা পৌঁছায়নি।
 
জাতিসংঘে বাংলাদেশের ইস্যু
 

২৯ মার্চ জাতিসংঘে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন উ থান্টের সাথে দেখা করে উপমহাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন! উ থান্ট ৩০ মার্চ সমর সেনের কাছে লেখা এক অনানুষ্ঠানিক পত্রে জানান, “আমার ব্যক্তিগত অবস্থান ও জাতিসংঘ মহাসচিবের অবস্থান উভয় থেকেই, মানবিক বিষয়সমূহে আমি কখনই নিরপেক্ষ থাকি না।” কিন্তু কার্যত তা হয়নি এ জন্য যে, এই সময় বিভিন্ন দেশের সরকার দাবি করে যে, মহাসচিব কোনাে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। উ থান্টের পত্রের জবাবে জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন অনানুষ্ঠানিক পত্রে যুক্তি দেখান যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটা গ্রহণযােগ্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘মানব্লিক বিপর্যয়ের মাত্রার ব্যাপকতা বিচার করলে দেখা যায় যে, এটি এখন আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব ১৯৭১-এর মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় তার উদৃবেগের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “যদিও এ-যুদ্ধ পাকিস্তানের অভ্যন্ত রীণ বিষয় তবুও কিছু কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গােচরীভূত হয়েছে।” পূর্ব পাকিস্তানে মার্চ মাসে সংকট সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের মহাসচিব বসন্ত এবং গ্রীষ্মে মানবিক কর্মসূচি গ্রহণ করলেও প্রতিদিন এ অঞ্চলের পরিস্থিতি সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। সীমান্ত সংঘর্ষ, হামলা এবং নাশকতামূলক কাজ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অবস্থায় ২০ জুলাই ১৯৭১ জাতিসংঘের মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টের নিকট ইঙ্গিত প্রদান করেন যে, মানবিক সমস্যা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, রাজনৈতিক সমঝােতার অভাবে আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসনের উল্লেখযােগ্য উন্নতি হয়নি। রাজনৈতিক সমঝােতা, পরিবেশের উন্নয়ন, আস্থা প্রভৃতি শরণার্থীদের দেশে। ফেরার সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। ভয়ানক খাদ্য ঘাটতির বিপদ রয়েছে, যেক্ষেত্রে ত্রাণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা দরকার। কিন্তু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপকরণসমূহ এমন পর্যায় রয়েছে যেখানে বিশাল মানবিক সাহায্যের ক্ষেত্রে একটি বিষাক্ত চক্র তৈরি হয়ে আছে। এসব বিবেচনায় রেখে যদিও নিরাপত্তা পরিষদের এজেন্ডায় এসব অন্তর্ভুক্ত নেই, তবুও জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে তিনি এই অস্বাভাবিক বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিগোচর এড়াতে পারেন না। মূলকথা হলাে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সংহতি যেখানে সনদের মূল নীতিমালা এবং অন্যদিকে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রশ্নটি সেখানে জড়িত, সেহেতু বিষয়টি সংঘাত, ও সংকটপূর্ণ। জাতিসংঘের মহাসচিব সম্ভাব্য কার্যক্রম সম্পর্কে উদবেগ প্রকাশ করে বলেন, “এটা শুধু মানবিক বিবেচনায় যথেষ্ট নয়, এটা জাতিসংঘের নিকট শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও একটি কার্যকর হুমকি বটে।” তিনি আরাে বলেন, বর্তমান অবস্থার অধিক অবনতি এড়িয়ে যেতে জাতিসংঘের দীর্ঘকালীন শান্তিরক্ষা ও অন্যান্য ব্যবস্থাবলির

অভিজ্ঞতা কাজে লাগানাে উচিত এবং এটা আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে, প্রকাশ্যে বা গােপনে হতে পারে।”
 
শরণার্থী সমস্যা ও জাতিসংঘ। ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল জাতিসংঘের মহাসচিব উপমহাদেশের সম্পর্কে কী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন সে সম্পর্কে চাপ সৃষ্টি হলে তার মুখপাত্র যা বলেন, তার সহজ অর্থ হলাে পাকিস্তানের ঘটনাবলি সম্পর্কে তিনি অবহিত। এসব নৃশংস জ্ঞাত ঘটনাবলির মধ্যে রয়েছে ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিদ্বগ্ধ বাড়িঘর থেকে তাড়া খাওয়া ছিন্নমূল মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশা, মিছিলে আক্রমণােদ্যত্ত কামানের গােলাবর্ষণ এবং বিপর্যস্ত মানবিক ট্রাজেডি। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এ সম্পর্কে মানবিক বিপর্যয়ে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানাের মতাে ন্যূনতম সহযােগিতা করার কোনাে উদ্যোগ বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনুরােধ জানায়নি। সেজন্য মহাসচিবের ভাষ্যমতে তিনি যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারছেন না। কিন্তু জাতিসংঘ থেকে প্রকাশিত ইস্তেহারে দেখা যাচ্ছে ২রা এপ্রিল ভারত মহাসচিব উ থান্টের নিকট পাকিস্তানের বর্বর ও নিষ্ঠুরতার প্রশ্নে সমালােচনা করে বলা হয়েছে, পাকিস্তান সৈন্যরা বাংলাদেশে মানুষের ওপর যেভাবে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়েছে এবং তা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার মনে করে নিচেষ্ট থাকার সময় নেই। তারপরও দেখা যায়, ২২শে এপ্রিল মহাসচিব পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি নিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বরাবর লিখিত এক পত্রে উদবেগ প্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তানে অবিলম্বে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযােগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে মহাসচিব জাতিসংঘ সনদে প্রথম অধ্যায়ের ২ ধারার ৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেন। এর একদিন পরে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য তিনি প্রকাশ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শরনার্থী সমস্যা ও জাতিসংঘ। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে লিখিত জাতিসংঘ মহাসচিবের ২২শে এপ্রিলে পত্রের প্রত্যুত্তরে জাতিসংঘ শরণার্থী সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে পরার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট হয়। | শরণার্থী সমস্যা বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব ২২শে এপ্রিল (১৯৭০) পাকিস্ত েিনর প্রেসিডেন্ট যে পত্র দেন তার প্রতুত্তরে পাক-প্রেসিডেন্ট বিষয়টিকে ‘অতিরঞ্জিত বলে নাকচ করে দেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট একইসঙ্গে শর্ত আরােপ করেন যে, যেকোনাে আন্তর্জাতিক সাহায্য পাকিস্তানের ত্রাণ সংস্থাগুলাের মাধ্যমে পরিচালিত হতে শরণার্থীদের মানবিক সাহায্য সম্পর্কে পাকিস্তানের নেতিবাচক অবস্থানের দিকটি স্পষ্ট এ কারণে যে, শরণার্থী সমস্যাটি যেন কোনােভাবেই আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্রে এসে না দাঁড়ায় যার দূরবর্তী ফলাফল হবে পাকিস্তানের জন্য কূটনৈতিক কালাে ঘােড়া’ ।
 
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান সামরিক জান্তা প্রণীত পরিকল্পনায় ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান সংকট সাময়িক এবং স্বল্প সময়ে নিরাময়যােগ্য। পাকিস্তান সামরিক জান্তার ঘােষণায় এ কথাটি বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। সেজন্য ১৯শে মে মহাসচিবের নিকট বিভিন্ন রাষ্ট্র ও বেসরকারি সংস্থা এবং তার ব্যক্তিগত সূত্র থেকে প্রাপ্ত ভারতে আশি লক্ষ শরণার্থীর দাবিকৃত সংখ্যা সম্পর্কে পাকিস্তান আপত্তি জানিয়ে বলেছে এর সংখ্যা কোনােক্রমে দু’লাখের বেশি হবে না। | ভারত-পাকিস্তানের এই পরস্পরবিরােধী অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ২৮শে মে জাতিসংঘের সহকারি মহাসচিব ইসমাত টি কিত্তানি পাকিস্তানে গিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপ করে পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য দাতা সংস্থা ও দেশসমূহের অভিপ্রায় এভাবে তুলে ধরেন যে, ‘সমগ্র সাহায্য যেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে পৌছে।’ এভাবে প্রথম থেকেই মানবিক সাহায্য নিয়েও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু জাতিসংঘসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই মানবিক ট্রাজেডির ক্ষেত্রে মহাসচিবের যে ত্বরিৎ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ যেক্ষেত্রে অনিবার্য ছিল সেক্ষেত্রে তার দীর্ঘায়িত পদক্ষেপ ‘স্ব-আরােপিত সতর্কতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহের অনুমােদন বা সম্মতি ব্যতিরেকে জাতিসংঘ উদ্যোগ নিতে পারে না, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব লিখিত বিশ্বপরিসরে এই প্রতিপাদ্য সর্বক্ষেত্রে বা সমভাবে। প্রতিপালিত হয়েছে এমনটি বলা যাবে না। ২৩শে জুন শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার আবারাে জোর দিয়ে বলেন যে, সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার আওতায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অভ্যর্থনা শিবির খুললেও তারা তেমনভাবে ফিরে আসেনি। তিনি অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, রাজনৈতিক সমাধান ব্যতীত তারা স্ব-গৃহে ফিরে আসবে না।  জাতিসংঘের সহযােগী সংগঠনসমূহ, শরণার্থী বিষয়ক কমিশন, ইকোনােমিক অ্যান্ড সােস্যাল কাউন্সিল, আইনবিদ পরিষদ, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা, উপ-সংস্থা এবং সর্বোপরি জাতিসংঘের মহাসচিব উপলব্ধি করেছেন কেবলমাত্র ত্রাণসাহায্যের মধ্যে শরণার্থী সমস্যার সমধান নিহিত নেই, বরং রাজনৈতিক সমঝােতার মধ্যে এর সমাধান খুঁজে পেতে পারে। শরণার্থীদের সামনে রেখে আন্তঃরাষ্ট্র কূটনৈতিক তৎপরতা প্রণিধানযােগ্য। ১৯৭১ সালের ১৬ই জুলাই অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ সভায় হাই কমিশনার ও মহাসচিবের বক্তব্যের উপর পূর্ণ আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলােচনায় পরিলক্ষিত হয়েছে যে, শরণার্থীদের স্বেচ্ছাপ্রণােদিত প্রত্যাবর্তনের বিষয় উপেক্ষিত রয়ে গেছে। ২৫শে মে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শরণার্থী ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ঘােষণা দেওয়ার পরও খুব অল্পসংখ্যক শরণার্থী ও স্বেচ্ছায় ফিরে যায়নি বরং বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত সংবাদে দেখা গেছে ভারতে শরণার্থী সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর অর্থ হলাে পাকিস্তানের প্রতি আস্থাহীনতা।
 
শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের সমস্যাটিকে কূটনৈতিক কৌশলে ভারতসহ কয়েকটি দেশ রাজনৈতিক সমঝােতার পথে টেনে আনে। জাতিসংঘ স্বীকার করে যে, ঐ অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি থাকায় পূর্ব পাকিস্তানে সবরকম সাহায্য কাজে বিঘ্ন ঘটছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির উল্লেখ এই ইঙ্গিত দিয়েছে। যে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই। সংকট ও সংঘাত চলছে। যুদ্ধ ও গণহত্যা চলছে। যা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে অঙুলি নির্দেশ করেছে। শরণার্থী সমস্যা শুধু চিরায়িত সমস্যার বৃত্তে আবদ্ধ থাকেনি, বরং এই মানবিক সমস্যা বহুদূরব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে। যার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের অগণিত মানুষের রক্তস্রোত, আকাক্ষা এবং একটি জাতিগােষ্ঠীর অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আকাক্ষা । মহাসচিব যদিও মনে করেছেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ধ্রুপদী সম্পর্কও এই সমস্যার অন্যতম কারণ তারপরও একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, ৬ বছর আগে। সম্পাদিত তাসখন্দ চুক্তির বিপরীতের এই মানবিক ট্রাজেডি দু’দেশকেই ভয়াবহ সংকট ও যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের আওতায় গােপন সংলাপ, পত্রালাপ বা আলােচনা কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা কার্যকর করা সহজসাধ্য নয়, কারণ এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নিষ্ঠুর রাজনৈতিক ও কষ্টকর মানবিক সমস্যার উপায় উদ্ভাবন। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মধ্য জুলাইতে মহাসচিব এই সিদ্ধান্তে পৌছেন যে, শুধু কিছু ত্রাণ পাঠিয়ে ও সমবেদনা জ্ঞাপন করে মানবিক সমস্যা দূর করার চেষ্টার দিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ফুরিয়ে গেছে।  মানবিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যা মিলে এমন একটি সমস্যা সৃষ্টি করেছিলাে যেখানে জাতিসংঘের সকল সংস্থাকে একক সত্তা হিসেবে কাজ করে সমস্যার মােকাবেলা করতে হবে। এসব কারণে মহাসচিব হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার তাগিদ অনুভব করেন। একই সময়ে মহাসচিব দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, “প্রধান যে সমস্যা তার সমাধানের জন্য প্রয়ােজন রাজনৈতিক সমঝোতা ।
 
জেনেভায় সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সম্বন্ধে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগাখান একইভাবে বলেন, রাজনৈতিক কারণে নিরাপত্তার অভাবে শরণার্থীরা দেশ ছাড়ছে এবং তাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষেদের সামাজিক সমিতির আলােচ্যসূচি ৫ (ক) মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর জাতিসংঘের নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি কর্তৃক মানবাধিকার ঘােষণা’সহ জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য মানবাধিকার-সংক্রান্ত চুক্তি ও দলিলের। উল্লেখ করে বলা হয়, এসবে স্বাক্ষরকারী হয়েও পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জানমাল ধ্বংস করছে এবং নজিরবিহীন মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। তারা এমনকি আন্তর্জাতিক আইনবিদ পরিষদ (ইন্টারন্যাশনাল কমিশন। অব জুরিস্ট)-এর অবদানেও বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করেনি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এসব লংঘন খতিয়ে না দেখে তবে মানবাধিকার দলিলসমূহ কৌতুকে পর্যবসিত হবে।” ইকোনােমিক এন্ড সােশ্যাল কাউন্সিল-এর সােস্যাল কমিটিতে নিউজিল্যান্ড প্রতিনিধি “মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলাের দায়িত্ব সম্পর্কে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে জাতিসংঘে আলােচনা করা আবশ্যক। তিনি ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসােদ্বেগ প্রকাশ করে গণতান্ত্রিক একটি অখণ্ড পাকিস্তান দেখার আকাক্সক্ষার কথাও বলেন। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় প্রতিনিধি বলেন, প্রতিদিন মৃত মানুষের লাশের সংখ্যা স্তুপীকৃত হচ্ছে, নির্যাতন ও অবর্ণনীয় ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, মানবাধিকার সনদের সব কিছুই লঙ্ঘন করা হয়েছে-সে ফোরামে এখন পূর্ববঙ্গের মানবিক পরিস্থিতি ও সমস্যা তুলে ধরা অপাক্তেয়।” উক্ত সংস্থার ৫১তম অধিবেশন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতির গুরুত্ব অংশে বলা হয়, এরকম ভয়াবহ দুর্যোগ আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রচেষ্টা প্রয়ােজনের তুলনায় অনেক কম হয়। একই সাথে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জরুরি অবস্থাকে আধুনিক সমাজের সম্পদ ও কারিগরি ক্ষমতার অতীত বলে উল্লেখ করে এর মােকাবেলায় জাতিসংঘের বিরাজমান কাঠামাের পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক সাহায্য বাড়ানাের কথা বলেন।
 
(পরিশিষ্ট-এক) কাঠামাের পরিবর্তন সম্পর্কে মহাসচিব অবশ্য স্পষ্ট ব্যাখ্যা বা রূপরেখা তুলে ধরেছেন এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। ৫১তম অধিবেশনে যুগােস্লাভ প্রতিনিধি এল, মেজভ জোরের সঙ্গে অভিমত প্রকাশ করেন, ‘শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় ঘরে ফেরার মতাে নিরাপদ ও তাদের পছন্দমতাে ব্যবস্থা নেবার মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।২৩ জাতিসংঘ উপসংস্থা (ইউএন সাব কমিশন)-এর কাছে ২২টি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা জাতিসংঘের সংখ্যালঘু রক্ষা ও বৈষম্য প্রতিরােধ উপসংস্থার অনুষ্ঠিতব্য ২৪তম অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন ও স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করা নিয়ে আলােচনা ও প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানান। জেনেভায় অনুষ্ঠিত ইউ.এন.এইচ.সি.আর.-এর নির্বাহী কমিটির ২২তম অধিবেশনে ভারত সরকারের পুনর্বাসন সচিব জি.এস.কাহলন ভারত সরকারের পক্ষে ‘শরণার্থীদের দ্রুত ও নিরাপদে দেশ ফেরা তাদের পছন্দমত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে ও পাকিস্তান সরকারকে চাপ দিতে কমিটি ও বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান।২৫ ১৬ই জুন ১৯৭০ থেকে ১৫ই জুন ১৯৭১ মহাসচিব তার সংস্থার কার্যক্রমের বার্ষিক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ যা ২১শে সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন মাত্রার সাম্প্রতিক ঘটনাবলির কার্যকরণে ভারতে সীমান্ত রাজ্যগুলােতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যা ভারতের অর্থনীতি ও সম্পদের উপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করেছে মর্মে উল্লেখ করেন এবং দাবি করেন। আন্ত র্জাতিক ব্যাপক সাহায্য সহযােগিতা অবিলম্বে প্রয়ােজন যা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে এবং ভারতের অবস্থিত শরণার্থীদের সাহায্য করা যায়। তিনি আরাে উল্লেখ করেন যে, মানবিক নীতি সমূহের প্রতি সম্মান এবং অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক সমঝােতার অভাবে মানবিক সাহায্য প্রদানের বিষয় প্রকট হয়েছে। বিশেষকরে পাকিস্তানে আইন-শৃঙ্খলা জনপ্রশাসনকে আক্রান্ত করেছে, খাদ্য স্বল্পতা ভয়ঙ্করভাবে দৃশ্যমান হয়েছে এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টাকে ভয়ঙ্করভাবে বিষাক্ত করে তুলেছে।” তিনি আরাে উল্লেখ করেন যে, ১০ই আগস্ট ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বরাবর ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অফ জুরিস্ট এক টেলিগ্রামে মহাসচিবের বক্তব্য উদ্ধৃত করে স্মরণ করিয়ে দেন যে, সেই ট্রাজিক অবস্থা মানবিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে যে, যা অভিন্ন ও অবিচ্ছিন্ন উপায়ে একত্রে জাতিসংঘের সামনে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।
 
টেলিগ্রামে অভিমত প্রকাশ করা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সম্মান দেখানাে ব্যতীত এই সমস্যা সমাধানের সাফল্যজনক পথ নেই।” এসব আলােচনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে আলােচনা হয়। মহাসচিব কর্তৃক শরণার্থীদের মানবিক সাহায্য প্রদানের বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের উত্থাপিত আলােচ্যসূচি ‘শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের রিপােট’ শিরােনামে বিষয়গুলাে আলােচিত হয়। হাই কমিশনার জোরের সঙ্গে বলেন যে, স্বেচ্ছায় শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন একমাত্র কার্যকর সমাধান যা উভয় সরকার নীতিগতভাবে সম্মত । তিনি আরাে বলেন, শরণার্থীরা অধিক সংখ্যায় ফিরে যাবে যখন তারা উপলব্ধি করবে তাদের দেশে প্রকৃত অর্থে শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করছে।” সে সময় পাকিস্তানের প্রতিনিধি উল্লেখ করেন, তাঁর সরকার শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে আসার জন্য বারবার আবেদন করেছেন, উৎসাহব্যঞ্জক পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন এবং তারা কোনাে প্রতিহিংসার শিকার হবে না তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শরণার্থীদের ফিরিয়ে আসার ব্যাপারে ভারতের সহযােগিতা অপরিহার্য। তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে “রাজনৈতিক সমঝোতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন যে, উক্ত বছরের শেষের দিকে যা একমাত্র পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব তা সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।” | ভারতীয় প্রতিনিধির বক্তব্য ছিল পাকিস্তানের উদ্ভূত ঘটনাবলির কারণে এই মানবিক সমস্যা ভারতের কাঁধে এসে পড়েছে। পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের আন্ত র্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষে ভারত দেখাশুনা করছে, কিন্তু এই অবস্থাকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য চলতে দেওয়া যায় না। তখন পর্যন্ত রাজনৈতিক সমঝােতার ক্ষেত্রে কোনাে প্রকার সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। পূর্ববঙ্গে গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের অভিপ্রায়কে চূর্ণ করে, মৌল মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গণহত্যা চালানাে হয়েছে। ভারত মনে করে এটি ভারত পাকিস্তানের বিবাদমান বিষয় নয়, পাকিস্তানকে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানে। ১৮ই নভেম্বর জাতিসংঘের সহকারি মহাসচিবের বিবৃতি থার্ড কমিটিতে উপস্থাপন করে বলা হয়, সেখানে ৩০ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি এবং প্রতি মাসে দুই লক্ষ টন খাদ্য প্রয়ােজন।
 
এই লক্ষ্যে ক্ষুদ্রায়তনের খাদ্য-শস্যবাহী জাহাজ ও অন্যান্য  নৌযান এনে কার্যক্রমের জন্য ভাড়া করা হয়েছে। এজন্য এক হাজার ট্রাক প্রয়ােজন! সাম্প্রতিক ঘটনায় রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়েছে। জাতিসংঘের যানবাহন স্পষ্টভাবে নির্দিষ্টকরণ এবং জাতিসংঘের নাম দৃশ্যমানভাবে লক্ষিত হয় এমনভাবে উত্তীর্ণ করতে হবে যেন মানবিক সাহায্যের ব্যাপারে এগুলাে ব্যবহৃত হচ্ছে তা বােধগম্য হয়। পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মীদের পূর্ব পাকিস্তানে অবাধভাবে কাজ করার অনুমতি দিলেও নিয়ন্ত্রণহীন ঘটনাবলি যেমন, সীমান্ত এলাকায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে সামরিক চাপ থাকায় এবং যানবাহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতি এমন সংকটপূর্ণ অবস্থায় চলে যাচ্ছে যে ক্ষেত্রে মহাসচিবের পক্ষে দীর্ঘদিন ত্রাণ সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না। নীতিগতভাবে জাতিসংঘ পূর্ব পাকিস্তানের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে না জড়িয়ে কাজ করছে কিন্তু যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে সেক্ষেত্রে এহেনকার্য পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিতর্কের সময় সদস্যগণ বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের ভারতে আগমনে উদবেগ প্রকাশ করেন। অনেক বক্তা নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অবস্থার ক্রমাবনতি সম্পর্কে উদবেগ প্রকাশ করেন। অনেক প্রতিনিধি পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি সম্পর্কে শুধু মানবিক দিকটিকে বিবেচনা না নিয়ে রাজনৈতিক বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সহকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিনিধি উল্লেখ করেন, শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতি করছেন, আগ্রাসন চালাচ্ছেন যা প্রশ্রয় দেওয়া কোনােক্রমেই আশ্রয়দাতা। দেশের উচিত হবে না। বরং তাদের উচিত হবে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। তিনি আরাে বলেন, পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে আলাচনায় প্রস্তুত আছে এবং জাতিসংঘের শরণার্থী প্রত্যর্পণের সঙ্গে একমত আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি শরণার্থীদের মানবিক ব্যবস্থাপনায় ভারতীয় কার্যক্রমের প্রশংসা করেন এবং একই সাথে পাকিস্তানের শরণার্থী প্রত্যর্পণের জন্য সীমান্তে বিশেষ ক্যাম্প খােলার জন্য সন্তোষ প্রকাশ করেন। ফরাসি প্রতিনিধি মনে করেন, রাজনৈতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের মাধ্যমে জনগণের দুঃখ লাঘব সম্ভব। | থার্ড কমিটির ভূমিকা নিয়ে মৃদু সমলােচনা করে যুক্তরাজ্য তার মতামত ব্যক্ত করেন এভাবে যে, “এটা পরিষ্কার যে, সমস্যাটির কারণ রাজনৈতিক যা রাজনৈতিক সমাধানের ভেতর দিয়ে হবে। এটা থার্ড কমিটির কাজ নয় যে বিষয়টির সমাধান তারা। দেখবে। | সােভিয়েত রাশিয়া উপমহাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্‌বেগ প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তানের কষ্টদায়ক কারণসমূহ অবশ্যই সমাধান করতে হবে যে নিপীড়নসমূহ তার স্বার্থকে ক্ষতি করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্মগত অধিকারকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে।
 
ভারতীয় প্রতিনিধি বলেন, মানবিক কার্যক্রম কোনােক্রমেই রাজনৈতিক সমঝােতার সম্পূরক হতে পারে না। খাদ্যঘাটতির কারণে শরণার্থীরা ভারতে আসেনি। তারা  এসেছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। ভারতের প্রতিনিধি বলেন, পাকিস্তানের যদি আঞ্চলিক অখণ্ডতা বিপর্যস্ত হয় সেটা হচ্ছে সেদেশের সরকারের কর্মকাণ্ডের ফলে।” চীন এই বলে অভিমত প্রকাশ করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রশ্নটি অভ্যন্তরীণ বিষয় যা পাকিস্তানের জনগণ সমাধান করবে। তথাকথিত শরণার্থী প্রশ্নটি এসেছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কারণে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি দেশের ক্রমাগত নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের ফলে। চীন একটি দেশ বলতে ভারতকে বুঝিয়েছে। নেদারল্যাণ্ড, নিউজিল্যাণ্ড এবং সুইডেন একটি খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করে শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে সাধারণ পরিষদ যেন ভারত এবং পাকিস্তানের প্রতি আবেদন জানান। জাতিসংঘের মহাসচিব এবং হাই কমিশনার আন্তর্জাতিক সাহায্য যাতে অব্যাহত থাকে এবং ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের জন্য ত্রাণসামগ্রী সর্বোত্তম ব্যবহৃত হয় তার জন্য তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। এই খসড়া প্রস্তাবের সংশােধনী আনে নাইজেরিয়া, সৌদি আরর এবং সােমালিয়া। এসব সংশােধনের মাধ্যমে জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশসমূহকে ত্বরিৎ এবং স্বেচ্ছায় শরণার্থীদের প্রত্যর্পণের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। সংশােধনীসহ সর্বেসম্মতিক্রমে ২২শে নভেম্বর থার্ড কমিটি কর্তৃক গৃহীত হয়। ২২শে নভেম্বর থার্ড কমিটির সভার সময় ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিগণ জানান সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলেন, শরণার্থী সমস্যাকে ভারত রাজনৈতিক ও সামরিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে যা পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে বিপন্ন করে ফেলেছে এবং জাতিসংঘ যেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে তার কারণ সৃষ্টি করছে। ভারতের প্রতিনিধি বলেন, পাকিস্তানের সামরিক জান্তার হুমকির কারণে ভারতের জাতীয় জীবনে নিরাপত্তার সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি মনে করেন, এই সমস্যার শান্তি পূর্ণ সমাধান হতে পারে যদি পাকিস্তান সামরিক নেতৃত্ব পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলােচনা করেন যার প্রথম পদক্ষেপ হবে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি। থার্ড কমিটি কর্তৃক ভােটাভুটি ব্যতিরেকে টু পাট প্রস্তাব হিসেবে গৃহীত হয়। রেজুলেশন প্রস্তাবনায় পূর্ব পাকিস্তান সংকটে মানবিক ট্রাজেডির বিষয়ে গভীর উদ্‌বেগ প্রকাশ করা হয় এবং ভারতের উপর অত্যধিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপের উল্লেখ করা হয়। প্রস্তাবে অধিক পরিমাণে মানবিক সাহায্য প্রদান এবং শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে কেবল সন্তোষজনকভাবে সমস্যার সমাধান হতে পারে। অপারেটিভ অংশে ৫নং স্তবকে জাতিসংঘের মূল সনদ অনুসারে শরণার্থীরা যাতে অতিদ্রুত স্বেচ্ছায় স্বদেশে প্রত্যর্পণ করতে পারে তার জন্য জোর প্রচেষ্টার আবেদন জানানাে হয়। প্রস্তাবের দ্বিতীয় পার্টে শরণার্থীরা যাতে অনুকূল পরিবেশে স্বদেশে প্রত্যর্পণ করতে পারে তার উল্লেখ করা হয়।
 
এই পর্যায়ে রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নটি সরাসরি শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় স্বদেশে। প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। জেনেভায় শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার প্রিন্স। সদরুদ্দিন আগা খান জানান, গত কয়েক সপ্তাহ নতুন সাহায্য পাচ্ছেন না, তাই ত্রাণসাহায্য সরবরাহে ছেদ পড়তে পারে। যা পরিস্থিতিকে অত্যন্ত ভয়াবহ করে তুলবে। পরে তিনি যােগ করেন যে, ত্রাণ সরবরাহ নয়, স্বেচ্ছায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তনই একমাত্র সমাধান।” তিনি বলেন, সাধারণ পরিষদ থেকে যুক্তিযুক্তভাবেই বলা হয়েছে শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনের কাজটি কেবলমাত্র মানবিক। কমিশনের এই মানবিক দায়িত্ব পালনে সবার শুভ ইচ্ছার সঙ্গে মর্যদাপূর্ণ। শরণার্থীরা তখনই প্রত্যাবর্তন করবে যখন তারা যথার্থভাবেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে, স্বদেশে প্রকৃত শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করছে। স্থায়ী সমাধান ব্যতীত শুধু কথামালা, সহৃদয়তা কিংবা সদিচ্ছা তাদের আশার সঙ্গে কৌতুক করা হবে। জাতিসংঘ সাধারণ পষিদের থার্ড কমিটিতে ইউ.এন.এইচ.সি.আর-এর প্রতিবেদনের ওপর ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজনীয়তা উল্লেখ করে পাকিস্তানে শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের দাবিকে বিশ্বাসযােগ্য নয় বলে জানান। দু’দিনব্যাপী একত্রিশটি দেশের প্রতিনিধিদের বক্তব্যের মাধ্যমে ফুটে ওঠে যে, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা স্মরণকালের বৃহত্তম মানবিক বিপর্যয়। যদিও তারা অভিমত প্রকাশ করেন স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার মতাে অবস্থা তৈরিই এ সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক উপায় এবং এ লক্ষ্যে ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করার অনুরােধ জানানাে হয়।” জাতিসংঘে থার্ড কমিটির প্রস্তাব: প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে শরণার্থী সমস্যা পরিধির দিক দিয়ে ইতিহাসে বিরল। শরণার্থীদের সাহায্যে সব সরকার ও সংস্থার এগিয়ে আসা উচিত এবং এর একমাত্র সমাধান নিরাপদ প্রত্যর্পণ ।
 
যার জন্য সকলের চেষ্টা করা উচিত। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে থার্ড কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবের যে সুপারিশ পেশ করা হয় তার ৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, শরণার্থী সমস্যার প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল পরিবেশ দরকার এবং জাতিসংঘের সনদে মূলনীতি মেনে সকলের মর্যাদাপূর্ণ স্পিরিট নিয়ে কাজ করা দরকার। থার্ড কমিটির প্রতিবেদনের। ওপর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবে অন্যান্য বিষয়ে আলােকপাতের পর ২২শে নভেম্বর ১৯৭১ সন-এ থার্ড কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবেরই পুনরাবৃত্তি করা হয়। এ দুটি প্রস্তাবই নেদারল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের সংশােধিত খসড়া প্রস্তাবের পরিবর্তিত রূপ, যেখানে পাকিস্তান ও ভারতের প্রতি শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় নিরাপদে ঘরে ফেরার মতাে পরিবেশ ও অবস্থা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করার আহ্বান জানানাে হয়। জাতিসংঘ উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশ থেকে ভারতে অগণিত শরণার্থীদের স্বদেশে স্বেচ্ছায় ফিরে আসার প্রস্তাব বাস্তব কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ‘ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক দলখকৃত ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে যেক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর ‘সাহসী ও আশান্বিত’ তৎপরতা কার্যকর হয়ে উঠেছিল সেক্ষেত্রে অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও নিরাপত্তাহীন শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নটি নিরর্থক হয়ে পড়ে। তারা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে ফিরতে আশান্বিত ছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রে নয়। থার্ড কমিটির প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে গৃহীত উদ্যোগ ব্যর্থ হবার ফলে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে যে, এই মানবিক সমস্যা নিরসনের মূলে রয়েছে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে। তারপরও মূল সমস্যাটির সমাধান কূটনৈতিক করিডােরে ঝুলন্ত অবস্থায় থেকে যায়।
 
জাতিসংঘের বিভিন্ন কূটনৈতিক উদ্যোগ
 
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ২০ অক্টোবর ভারত ও পাকিস্তান সরকারের কাছে এক পত্রে ১৯শে জুলাই ১৯৭১ সালে নিরাপত্তা পরিষদের প্রধানের নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করার কথা উল্লেখ করে বলেন, ঐ স্মারকলিপিতে তিনি ঐ অঞ্চলের শান্তিরক্ষার আবেদন জানিয়ে ছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে এই ভেবে যে এই পরিস্থিতি যেকোনও সময় দুই দেশের মধ্যে খােলামেলা বৈরিতা ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে যা বিশ্বশান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। তার নিকট খবর রয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত সীমান্ত এবং জম্মু কাশ্মীরের যুদ্ধবিরতি এলাকাসমূহে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি আশা করেন, যুদ্ধ এড়ানাে সম্ভব হবে এবং এই দুই দেশের সরকারের সদিচ্ছার উপর তার পূর্ণ আস্থা আছে। তিনি উভয় দেশের কিছু নেতার উস্কানি লক্ষ্য করেছেন। এমতবস্থায় তার বক্তব্য, “মানুষের অনুভূতি যেখানে প্রবল। সেখানে সামান্য অনিচ্ছাকৃত উস্কানিই বড় সংঘর্ষ ঘটাতে পারে।” উভয় সরকারের উপর তার দৃঢ় আস্থা রয়েছে যে কাণ্ডজ্ঞানহীন ও যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এড়িয়ে যেতে তারা সক্ষম। | উ থান্টের পত্রের জবাবে ২২শে অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ২০শে অক্টোবর প্রেরিত পত্র রাষ্ট্রদূত মারফত প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে বলেন, ভারত-পাকিস্ত নি সীমান্তের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাঁর দুশ্চিন্তায় তিনিও একমত। দুই দেশে। যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তাতে কয়েক মিলিয়ন জনগণ দুর্ভোগের শিকার হতে পারে। এ বিষয় দূর করে শান্তিরক্ষায় মহাসচিবের দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি সমর্থন করেন। এ কথাটিও উল্লেখ করা হয়, এটা দুঃখজনক যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী সীমান্ত হতে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান-ভারত আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকা হতে গােলাবারুদ, সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

এতেও যদি সম্মত না হয় তবে উভয় দেশের সীমান্ত এলাকা হতে নিরাপদ দূরত্বে দেশ প্রতিরক্ষায় সৈন্য সমাবেশ করার প্রস্তাব তিনি দেন। একই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে গােলাবর্ষণও বন্ধ করার দাবি জানান। শান্তিরক্ষায় সৈন্য প্রত্যাহার ও অন্যান্য বিষয় প্রত্যক্ষ করার জন্য জাতিসংঘের পরিদর্শক নিয়ােগের ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সম্মতি রয়েছে। তার প্রস্তাব হলাে প্রথমদিকে যেমন চলে আসছিল ঠিক সেরকম সীমান্তরক্ষী ও পুলিশ। বাহিনী ঐখানে থাকবে। পাকিস্তানে জাতিসংঘের দপ্তর প্রতিষ্ঠা বিষয়কে তিনি স্বাগত জানান এবং প্রেসিডেন্ট আশা করেন সৈন্য প্রত্যাহারের উপায় বের করতে খুব শীঘ্রই ভারত ও পাকিস্তান সফর করতে পারবেন। শান্তিরক্ষায় যেকোনাে পদক্ষেপে পাকিস্তান। জাতিসংঘের সাথে আছে।” জাতিসংঘ মহাসচিব ১৯শে জুলাই ভারত ও পাকিস্তান সরকার বরাবর এক পত্রে বলেন যে, ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন এমন একটি জরুরি ও উদ্‌বেগের বিষয় যা সংশ্লিষ্ট সরকারকে সম্ভাব্য সকল ধরনের সহযােগিতা জাতিসংঘ করবে। যার লক্ষ্য হবে, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা স্বদেশে ফিরে আসতে পারে। তার প্রস্তাব ছিল, সীমান্তের দুই প্রান্তে শরণার্থী প্রত্যাবর্তন তদারকির জন্য সীমিত আকারে হলেও জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মােতায়েন করা যায় কিনা এই সম্পর্কে কোনাে পদ্ধতি বা ব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। এজন্য সম্ভাব্য পদ্ধতি হতে পারে প্রাথমিক পর্যায়ে শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে সীমান্ত এলাকায় দু’তিনটি স্থান বেছে নেওয়া যেতে পারে। যদি এটি ফলদায়ক হয় তাহলে বৃহৎভাবে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।৪৬। | মহাসচিবের জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মােতায়েনের ধারণার সঙ্গে ভারত সরকারের নীতি ও মৌলিক অবস্থানের বিরাট বৈপরীত্য লক্ষিত হয়। ২রা আগস্ট মহাসচিবের ত্রাণসংক্রান্ত এক পত্রে ভারত তাকে জানিয়ে দেয় যে, বিষয়টি যৌথভাবে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। ভারত সরকার বুঝতে অক্ষম কতিপয় পর্যবেক্ষক দ্বারা এ লক্ষ্য অর্জনে কী করে সম্ভব? ভারত সরকারের অভিমত হলাে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি মনে করে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন জরুরি, তাহলে সর্বাগ্রে-পূর্ববঙ্গের জনগণের আকাক্ষা অনুযায়ী তাদের নিকট প্রাথমিকভাবে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ গ্রহণযােগ্য হতে হবে। যেখানে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তাদেরকে হয়রানি ও নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত।

 
১৬ই নভেম্বর ১৯৭১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর এক পত্রে বলেন, পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ববাংলার জনগণের উপরে অব্যাহতভাবে। নির্যাতন চালাচ্ছে। যার ফলে বিশাল জনগােষ্ঠী ভারতে চলে এসেছে। এর ফলে। ভারতের উপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বােঝা নেমে এসেছে। পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার এবং ভাগ্য শুধু সমাধান হতে পারে পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলােচনার মাধ্যমে। পূর্ববঙ্গের অভ্যন্তরে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি পূর্ববাংলার জনগণের সাথে কোনাে সমঝােতায় না আসা, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে প্রত্যাখ্যান করা এইসব বিষয়কে লােকচক্ষুর আড়াল করার জন্য পাকিস্তান পাক-ভারত ইস্যু সৃষ্টি করছে। এর সবচেয়ে বাস্তব প্রমাণ হচ্ছে, ভারত সীমান্ত বরাবর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদলের সমাবেশ ঘটানাে। এইসব পর্যালােচনা করে ভারত বুঝতে পেরেছে পাকিস্তান ভারতের সাথে  বড়াে ধরনের যুদ্ধ বাধাতে চায়। কিন্তু ভারত সরকার মহাসচিবকে আশ্বাস দিচ্ছে যে, “ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ বাধানাের কোনাে ইচ্ছা ভারতের নেই।” ভারত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা শুধু প্রতিরক্ষার জন্য। ভারতকে স্মরণ রাখতে হবে যে, সীমান্ত হতে পাকিস্তানের সেনা ক্যাম্প কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে অবস্থিত হলেও তারা প্রচুর সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে। যেখানে সীমান্ত হতে ভারতের সেনাক্যাম্প কয়েক দিনের দুরত্বে অবস্থিত, ভারত তার সীমান্ত এলাকায় সৈন্য পাঠানাের পূর্বে অনেকদিন অপেক্ষা করেছে।
 
ভারত সরকার মহাসচিবকে জানিয়ে দেয় যে, “এই সমস্যার মূলে রয়েছে পূর্ব পাকিস্ত েিনর ৭৫ মিলিয়ন জনগণের ভাগ্য এবং অবিচ্ছেদ্য অধিকার। এইসব বিষয় দূরে ঠেলে রাখার লক্ষ্যে পাক ভারত ইস্যু সৃষ্টি করে শুধু উত্তেজনাই বৃদ্ধি করবে।” কেবল এভাবেই শরণার্থী আসা বন্ধ হতে পারে এবং ভারতের নিরাপত্তার চাপ লাঘব হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে এ কথাও প্রকাশিত হয়ে পড়ে যে, পাকিস্তান শুধু পূর্ব বাংলার সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ভারত-পাকিস্তানের বিরােধের কথা সামনে এনেছে। এ সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সমাধানে সেদেশের জনগণের দ্ব্যর্থহীন অভিপ্রায়কে যদি সক্রিয় উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মহাসচিব শুভ উদ্যোগ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন সে প্রচেষ্টা হবে অভিনন্দিত। সমস্যা সমাধানের এ ধারণাকে যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলে তার উদ্যোগকে ভারত সরকার সমর্থন করবে। | ২২শে নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জবাবে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, তিনি আন্ত। র্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা যেমনটি এখন উপমহাদেশে বিদ্যমান সে অবস্থায় জাতিসংঘের সনদ উপেক্ষা করতে পারেন না। জাতিসংঘের মহাসচিব এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, উভয় পক্ষের সম্মতি সহযােগিতা ব্যতিত তিনি তার আন্তরিক। উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন না।”
 
২৩শে নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের মহাসচিবকে অবহিত করেন যে, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তান সীমান্তে চাপ সৃষ্টি করছে। পাকিস্তান বাহিনীকে তিনি কঠোরভাবে সংযত থাকতে বলেছেন। কিন্তু ভারতীয় সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর কমান্ডারগণ মােকাবেলা করতে যাচ্ছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বলেন, পরিস্থিতি দ্রুততার সঙ্গে এমনদিকে যাচ্ছে যেখান থেকে ফেরার কোনাে পথ নেই। কেবল মহাসচিবের ব্যক্তিগত আন্তরিক উদ্যোগে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে। ২৬শে নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের জবাবে জাতিসংঘের মহাসচিব এই ইঙ্গিত দেন যে, জাতিসংঘের সনদ তাকে যতটুকু অনুমতি ও কর্তৃত্ব দেয় সেই পর্যন্ত যাবেন, কিন্তু তিনি একই সাথে বলেন যে, উভয় দেশের স্থায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে শান্তি রক্ষার জন্য যােগাযােগ রক্ষা করে চলেছেন। ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি মহাসচিবকে জানান পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট এক বার্তায় বলেছেন, ভারতের সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালিয়েছে। তিনি পাকিস্তান সীমান্তে অবিলম্বে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীকে অবস্থান নেওয়ার অনুরােধ জানান।” ঐ একই দিনে তিনি ২৯শে নভেম্বরে পাঠানাে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বার্তাটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টকে জানান এবং প্রতিনিয়ত তার উদ্যোগের কথা অবহিত করেন। মহাসচিব উল্লেখ করেন যে, পর্যবেক্ষক নিয়ােগ করতে নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতে হবে। বর্তমান উপমহাদেশে যে অবস্থা বিরাজ করছে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে নিরাপত্তা পরিষদকে তা গভীরভাবে পর্যালােচনা করা দরকার। ৩রা ডিসেম্বর উপমহাদেশের বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে চলে যায়। মহাসচিব এ সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদকে তার ভূমিকা সম্পর্কে অবগত করেন। তিনি আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তার স্বার্থে জাতিসংঘ সনদের ৯৯ অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জাতিসংঘের মহাসচিব উপলব্ধি করেন যে, এ ধরনের ঘটনা জাতিসংঘে উপস্থাপন হতে পারে শুধু উভয়পক্ষের দ্বারা। অথবা নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের দ্বারা।
 
উপমহাদেশে ভূমিকা পালনের জন্যে জাতিসংঘের আরেকটি উদ্যোগের এভাবেই সমাপ্তি ঘটে। এই প্রক্রিয়াগুলাের মধ্যে ছিল জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মােতায়েনের প্রস্ত বি, যেমন-জাতিসংঘের মহাসচিব জুলাই মাসের ১৯ তারিখ প্রথম প্রস্তাব করেন যে, শরণার্থী সমস্যা সমাধানে ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তে ‘জাতিসংঘ শান্তিবাহিনী’ বা পর্যবেক্ষক মােতায়েন করা। জাতিসংঘের এই প্রস্তাব বিভিন্ন মহলে সন্দেহের উদ্রেক করে। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন যে, ভারত সরকার যখন ধ্বংসযজ্ঞ এবং হত্যাযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের কাছে ও বৃহৎ রাষ্ট্রের কাছে মানবতা ও বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য সহায়তার আবেদন জানিয়েছিলেন তখন এই সহায়তার আবেদনে তারা সাড়া দেয়নি কিন্তু যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে তাদের পর্যবেক্ষক মােতায়েন প্রস্তাবকে মুজিবনগর সরকারসহ বাংলাদেশের সপক্ষের অন্যান্য শক্তিসমূহ এটাকে পাকিস্তান ও তার মিত্রদের প্রভাবিত প্রস্তাব বলে মনে করেন। জাতিসংঘের এই প্রস্তাবের বিশ্লেষণে একথাটিও বেরিয়ে আসে। যে, মুক্তিযােদ্ধাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পথে বাধা সৃষ্টি ও ভারতীয় বাহিনীর সহায়তার প্রতি নজরদারি করা এবং তা বন্ধ করা। মুজিবনগর সরকার সরাসরি এই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেন। | অক্টোবরের ৩য় সপ্তাহের মধ্যেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন এবং পাকিস্তান হতে বাংলাদেশ স্বাধীন হােক এটা। অধিকাংশ দেশের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। ভারত এটা অনুধাবন করতে সক্ষম হয় যে, আন্তর্জাতিক মৌলিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াকে বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের অভ্যন্তরীণ বিছিন্নতাবাদ বা জটিলতার। কারণে সমর্থন দিতে পারছে না। এমতাবস্থায় ভারত সরকার বিশেষত ভারতের  প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে মূলত অগ্রবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই সিদ্ধান্তের মর্মে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার। কারণ ‘অনির্দিষ্টকাল ভারত শরণার্থীদের ভার টানতে পারে না।’ এ কথা বলার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কূটনৈতিক যুদ্ধ অতিক্রম করে যুদ্ধের কূটনৈতিক পদক্ষেপের উপর জোর দেন। এজন্য বিশ্ব জনমত গঠনের পাশাপাশি সামরিক যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে কূটনৈতিক তৎপরতায় এটাও পরিষ্কার হয়ে এসেছিল যে, বিশ্বের বহু সরকার প্রকাশ্যে বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসংঘ বা জাতিসংঘের বাইরে সমর্থন দিতে না পারলেও বিশাল জনগােষ্ঠী নীতিগতভাবে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামে সােচ্চার। সেই সঙ্গে তিনি, তার সরকার ও সুশীলসমাজ বিশ্ব পরিসরে ও জাতিসংঘ বিতর্ক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জনগণের মানবিক বিপর্যয় ও মুক্তির আকাক্ষার বিষয়টি যথার্থভাবেই তুলে ধরতে সক্ষম হন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী। লক্ষ্যাভিসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বেই দুর্গাপ্রসাদ ধর যিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর নীতিনির্ধারকদের অন্যতম তিনি ভারতের বিশেষজ্ঞদের নিকট একটি পজিশন পেপার তৈরি করার ব্যবস্থা করেন। পজিশন পেপার বিশ্লেষণে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে আস্থাশীল নয়। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা স্থাপন করতে সক্ষম হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে।
 
ভারত সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র, পুঁজিবাদী দেশসমূহ এবং চীন ভারতকে বাধা দেবে না কিন্তু রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে পাকিস্তানকে তারা সমর্থন যােগাবে। যুদ্ধ বেঁধে গেলে পাকিস্তান সামরিক জান্তাকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বস্তুগত সাহায্য প্রদান করবে। এমনকি জোটনিরপেক্ষ দেশগুলাের অনেকেই পাকিস্ত ানের পক্ষে অবস্থান নেবে। শুধু সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার মিত্র শক্তিসমূহ ভারতের পক্ষে থাকবে। এ সমস্ত বিষয় মাথায় রেখেই ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বব্যাপী ঝটিকা সফরে বের হন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন-এর ভূমিকা কী হবে তা অজানা ছিল না। ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে এটা পরিষ্কার উপলব্ধি করেছিলেন যে, আলােচনার মাধ্যমে সকল সমঝােতার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাকে ‘যুদ্ধ-কুটনীতির’ কঠিন পথে অগ্রসর হতে হবে। বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানী ভারতের সামরিক কর্মকর্তাদের এই ধারণা দিয়েছিলেন যে, শক্তিশালী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যে সকল গেরিলা কাজ করছে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ ব্যতীত তাদের আশা দিন দিন ঝুলে যাচ্ছে। সেজন্য তিনি যথাসীঘ্র সম্ভব ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ কামনা করেন। ২৭শে নভেম্বর বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধান এবং অবিলম্বে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার জন্য পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি আরাে বলেন, “বাংলাদেশের জনসাধারণকে তিনি কোনাে সমাধানে রাজি হয়ে যেতে বলতে পারেন না। কারণ এ ব্যাপারে তার কোনাে অধিকার নেই।” এটা ছিল নিক্সন প্রশাসনের প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পরােক্ষ স্পষ্ট। জবাব। ইন্দিরা গান্ধী নভেম্বর মাসে ওয়াশিংটন গমন করেন। বলাবাহুল্য, নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সঙ্গে তার আলােচনা ব্যর্থ হয়। ওয়াশিংটন থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি। বলেন, “যখন জনগণকে ধ্বংস করা হচ্ছে তখন শান্তির উদ্যোগ কোথায় ছিল? জনগণের বিরুদ্ধে যখন আক্রমণ করা হলাে, গণহত্যা চলছিলাে, লক্ষ লক্ষ জনগণ অভুক্ত অনাহারে মারা গেছে, তখন বিশ্ব সম্প্রদায় কোথায় ছিল?” তিনি কূটনৈতিক পরিভাষায় বিশ্বকে জানিয়ে ছিলেন, মানবিক ট্রাজেডি দীর্ঘদিন ভারত সহ্য করবে না। যে কথাটি জাতিসংঘে ভারতীয় স্থায়ী প্রতিনিধি দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেন।
 
অন্যদিকে, জুলফিকার আলী ভুট্টো জরুরিভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে পিকিং রওনা দেন এবং চেয়ারম্যান মাও সেতুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই’র সঙ্গে দেখা করে ভারত আক্রমণ করলে সর্বপ্রকার সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায়ে সচেষ্ট হন এবং জাতিসংঘ চীনের কূটনৈতিক তৎপরতায় আশ্বস্ত হন। ৩রা ডিসেম্বর জাতিসংঘ নথি হতে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান প্রতিনিধি অভিযােগ উথাপন করে যে, ভারতীয় বাহিনী এবং গেরিলাযােদ্ধারা একত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করেছে। সৈন্যবল এবং সরবরাহের অপ্রতুলতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতােমধ্যেই বিভিন্ন অবস্থান থেকে সরে গেছে। আরাে লক্ষণীয় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যােদ্ধারা চলে এসেছে এবং বহু জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে। ভারত তার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর নাবিকদের যুক্ত করে পাকিস্তানি নৌ-পথকে ব্লক করে দিয়েছে। ৩রা ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী যখন কলকতায় বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন তখনই চিরকুট পেলেন ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছে এবং ভারতের বিমানঘাঁটি অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, সােধপুর, আমবালা, আগ্রা, জম্মু, পাঞ্জাব ও রাজস্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে। একই সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সােলায়মানকি, খেমকারান, পুঞ্চ এবং অন্যান্য সেক্টরে আক্রমণ চালায়। এ সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীর মন্তব্য ছিল- “The fool has done exactly what one had expected”.৩৬ এর পূর্বে ২৫শে নভেম্বর পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, “In ten days, I might not be here in Rawalpindi. I will be fighting a war. ৭ উক্ত পত্রের জবাবে জাতিসংঘের মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি বরাবর একটি পত্র লেখেন। পত্রে বলা হয়, বর্তমান সামরিক সংঘর্ষকালে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগ, যদি একটি দেশ অনুরােধ করে থাকে তবুও নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতায়ন ব্যতীত তা সম্ভব নয় । এরপর ঐ দিনই জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির মাধ্যমে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট একটি বার্তা প্রেরণ করেন।
 
৩রা ডিসেম্বর থেকেই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। জাতিসংঘের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে স্থবির হয়ে যায়। জাপান এবং বেলজিয়াম স্থায়ী প্রতিনিধির নিকট থেকে কোনাে উৎসাহ না পেয়ে থমকে যায় । সােভিয়েত এবং ভারত চুপ করে ঘটনা পর্যবেক্ষণ। করেন। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মনে করে অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠক হওয়া উচিত। তখন পরিস্থিতি এমন হয় যে, পাকিস্তান যদি প্রত্যাশা করে তাহলে চীন তাদের পক্ষে ভেটো প্রয়ােগ করবে। অন্যদিকে, এটাও প্রতীয়মান হয়েছে ভারত চাইলে। সােভিয়েত তাদের পক্ষে ডেটো দেবে। মার্কিন সিক্রেট ডকুমেন্ট থেকে জানা যায়, ৩রা ডিসেম্বর হংকংকের চায়না ওয়াচার এই মর্মে রিপোর্ট দিয়েছে যে, চীনের মিডিয়াগুলাে। ১০ দিন ব্যাপকভাবে ভারতবিরােধী প্রচার চালিয়েছে। তারা বিভিন্ন প্রতিবেদন, বর্ণনা এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভারতকে সশস্ত্র আক্রমণকারী’ ও উস্কানিদাতা হিসেবে দোষারােপ করেছে। হঠাৎ করেই সােভিয়েত রাশিয়ার ভারত সংশ্লেষকে সামনে রেখে (ভারত-সােভিয়েত চুক্তি) তারা সরাসরি আক্রমণ করে। একই সঙ্গে চীন তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনাে ঝুঁকি না নেওয়ার চিন্তা করে। নিক্সন প্রেসিডেন্টসিয়াল ম্যাটেরিয়ালস্, জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত ফাইল থেকে আরাে জানা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পাকিস্তান সর্বাত্মকভাবে ভারতকে আক্রমণ করেছে। জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধি তুলে ধরেন ৫:৩০ মিনিটে পাকিস্তানি এয়ারফোর্স ভারতের ৬টি বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করেছে এবং পাকিস্তানের আটিলারি। বাহিনী সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর উপরে কামান দাগছে। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, রাজনৈতিক কূটনৈতিক সমাধান ব্যর্থ হওয়ায় যুদ্ধ যাওয়া ব্যতীত অন্য কোনাে বিকল্প ছিল না। ঐ রিপাের্টে আরাে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তান স্থায়ী প্রতিনিধি জাতিসংঘে অভিযােগ করেছে ভারতের যুদ্ধবিমান তিন-চারদিন হলাে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণাত্মক হানা দিচ্ছে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ৩:৩০মিনিট এবং ৪টায় রহিম ইয়ার খান এর দক্ষিণে কাশ্মীর এলাকায় আক্রমণ করেছে। পাকিস্তান বিমান। বাহিনী তার পাল্টা জবাব দিয়েছে। সিআই-এ রিপাের্টে বলা হয়েছে, কোনাে পক্ষ আগে। আক্রমণের সূচনা করেছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। | ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ক্রমাগত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, উথাপিত হয়। বিভিন্ন প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাব। নিরাপত্তা পরিষদে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তগ্রহণ সম্ভব হয়নি। ৩। দিনে ২০ ঘণ্টা আলােচনা, বিতর্ক ও ভােটগ্রহণের পর নিরাপত্তা পরিষদ থেকে এজেন্ডাটি সাধারণ পরিষদে স্থানান্তরিত হয়। সাধারণ পরিষদে কুটনৈতিক তৎপরতা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ১১৭টি দেশ অংশগ্রহণ করে যার মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানসহ ৫৫টি দেশ বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে বিতর্কে অংশ নেয়। নিচে ৬টি ভাগে এই বিতর্ক উল্লেখ করা যায় :
১, ২৪টি দেশ এই অভিমত প্রকাশ করে যে, মানবিক সমস্যার বিষয়টি জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে। তারা রাজনৈতিক বিষয়টির রেফারেন্স এড়িয়ে যায়। দেশগুলাের মধ্যে ছিল । আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, মিশর, ঘানা, জ্যামাইকা, জাপান, লাওস, লাইবেরিয়া, লিবিয়া, মেক্সিকো, মাদাগাস্কার, নেদারল্যান্ড, নিকারাগুয়া, সিরিয়া, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, উগান্ডা, উরুগুয়ে, ইয়েমেন এবং জাম্বিয়া।
২, প্রাথমিকভাবে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করার জন্য এবং শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার পূর্বশর্তরূপে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করার উপর গুরুত্বারােপ করে আটটি দেশ। দেশগুলাে হলাে : আফগানিস্তান, শ্রীলংকা, ইকোএডর, গ্রিনল্যান্ড, ইটালি, নেপাল, যুক্তরাজ্য এবং যুগােশ্লাভিয়া। | ৩, ১৪টি দেশ, আংশিকভাবে ১৫টি দেশ মানবিক বিপর্যয়ে উদ্যোগ প্রকাশ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক সমাধানের কথা উল্লেখ করেন। দেশগুলাে হলাে : অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, সাইপ্রাস, ফ্রান্স, গায়না, আয়ারল্যান্ড, মালটা, মঙ্গোলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পােল্যান্ড, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়ন। | ৪, ৫টি দেশ মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়টি ভারত ও পাকিস্তান আলােচনার মাধ্যমে সমাধান করুক তাই চায় । দেশগুলাে হলাে : আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, লেবানন, সিয়েরালিয়ন এবং বেলজিয়াম।
৫, সৌদি আরব পাকিস্তানকে সমর্থন করে।
৬. তিনটি দেশ ভাসাভাসা বক্তব্য পেশ করে : ইথিওপিয়া, আইসল্যান্ড ও ইসরাইল। | মানবিকাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৮টি দেশ বিস্তারিতভাবে আলােচনা করে : বেলজিয়াম, ইকুয়েডর (পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়), আয়ারল্যান্ড, মাল্টা (শরণার্থীরা ত্রাণশিরিরে থাকার অর্থই হলাে তাদের উপর রাজনৈতিক ও সামরিক নিপীড়ন চালানাে হয়েছে) মাদাগাস্কার, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন ও উরুগুয়ে। | ৪টি দেশ বিস্তারিতভাবে এই বিষয়ে আলােচনা করেছে যে, জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত ব্যক্তিদের সাথে সমঝােতার মাধ্যমেই রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব ফ্রান্স, মঙ্গোলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন।
এ অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিক। তিনি সমস্যাটিকে মূলত ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং রাজনৈতিক সমঝােতার পরিপ্রেক্ষিতে উভয় দেশের উপর প্রভাব বিস্তারের কথা বলেন। তিনি বাংলাদেশের প্রশ্নে সাধারণ পরিষদের বিতর্কের পক্ষে ছিলেন না। কারণ তাঁর ভাষ্যমতে জাতিসংঘের জরুরি কর্তব্য হলাে পাক-ভারত সমস্যার সমাধান, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ভাগ্য বা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়।”  ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উপমহাদেশের বাস্তব অবস্থাকে উপেক্ষা করে এবং মুখ্য সংকটকে পাশ কাটিয়ে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য  
 
 
 
পূর্ববঙ্গের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক সমাধান অবহেলা করার কারণে ভারত প্রস্তাবটি বিরােধীতা করে। প্রস্তাবটির প্রকৃত ছিল সুপারিশমূলক। রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবর্জিত কারণে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। যদিও ১০৪টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে, ১১টি বিপক্ষে এবং ১০ দেশ ভােটদানে বিরত থাকে। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি সদস্যের পরস্পরবিরােধী বক্তব্য এবং বিপরীতধর্মী। অবস্থান নিরাপত্তা পরিষদে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছিল এসব বিতর্কে তা প্রতিফলিত হয়। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন প্রতিনিধি ভারত কর্তৃক কিছু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের উল্লেখ করে ভারতকে এককভাবে দায়ী করেছেন। চীনা প্রতিনিধিও ভারতকে নগ্ন আগ্রাসী’ হিসেবে অভিহিত করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা এবং নিজ নিজ দেশের সীমান্তে দু’দেশের সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানায়। অন্যদিকে, সােভিয়েত প্রতিনিধি প্রস্তাবিত উদ্যোগের সমালােচনা করেন। তিনি এ উদ্যোগকে চীন-মার্কিন আতাত বলেও অভিহিত করেন। সাধারণ পরিষদের খসড়া প্রস্তাবসমূহের উপর আলােচনাকালে দুটো বৃহৎ শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স গােটা পরিস্থিতির উপর একটা নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে। ফরাসি প্রতিনিধি সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত দুটো খসড়া প্রস্তাবের উল্লেখ করে মন্তব্য করেন। যে, “পরিষদের বিতর্ক থেকে কোনাে সমধান বেরিয়ে আসবে না।” | নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক শুরু হওয়ার পর মাত্র কয়েকদিনে সেখানে কতগুলাে। গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। প্রথমত, ভারতীয় ও বাংলাদেশিয় যৌথবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের হাত থেকে বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা মুক্ত করায় স্বাধীনতা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। দ্বিতীয়ত, ভারত বাংলাদেশকে এ সময় স্বীকৃতি দেওয়ায় উপমহাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। আর এ বিষয়টি ফরাসি প্রতিনিধি সাধারণ পরিষদের সদস্যদের অবহিত করেন। দেখা যাচ্ছে যে, ফরাসি প্রতিনিধি | সাধারণ পরিষদের সদস্যদের অবহিত করেন প্রজ্ঞার সাথে। | ব্রিটেনের প্রতিনিধি অবশ্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আস্থা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদই হচ্ছে প্রধান ফোরাম এবং প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ শুধু | নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমেই নেওয়া যায়।” 
 
সাধারণ পরিষদে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের নিকট থেকে নতুনভাবে কূটনৈতিক সমাধানের কোনাে সূত্র বের হয়ে আসেনি। মূলত বিশ্ব পরিসরে দু’পরাশক্তির কৌশলগত কূটনীতিক নীতিমালাই জাতিসংঘে বারবার প্রতিফলিত হয়েছে।  সাধারণ পরিষদের বিতর্কে উপমহাদেশের প্রতিবেশী দেশসমূহের মধ্যে আফগানিস্তান ও বার্মা বিতর্কে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। শ্রীলংকার প্রতিনিধি তার। দীর্ঘ বক্তব্যের প্রথমেই কঠোরভাবে নিরপেক্ষ থাকার কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, জাতিসংঘের বাইরেও শ্রীলংকা, পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে।  ভারতের উপর দিয়ে পাকিস্তানের বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাবার পর ১৯৭১ সালের সংকটময় দিনগুলােতে শ্রীলংকা পাকিস্তানকে ট্রানজিট সহায়তা প্রদানে এগিয়ে এসেছিল। অন্যদিকে, নেপালের প্রতিনিধি পাকিস্তানের সম্ভাব্য বিভক্তিতে শ্রীলংকার মতাে এতােটা উদৃবিগ্ন ছিলেন না। তিনি যুদ্ধবিরতি ঘােষণা ও সৈন্য প্রত্যাহার-বিষয়ক প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। দক্ষিণ এশিয়ার অপর দেশ ভুটান ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। ক, সাধারণ পরিষদের বিতর্কে আরব বিশ্বের জর্ডান ও লেবানন মাত্র দু’টি দেশ। অংশ নিয়েছিল। তারা ১৩টি দেশের উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবটির প্রতি সমর্থন জানায়। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা রাষ্ট্র মিশর ভারতের সাথে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্কের কারণে আবার অন্যদিকে মুসলিম দেশ হিসেবে পাকিস্তানের সাথে। সমকালীন প্রেক্ষাপটে দায়বদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ প্রশ্নে অংশগ্রহণ করেনি। খ, পূর্ব ইউরােপের সােভিয়েত বলয়ের দেশ যেমন, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি ও পােল্যান্ড এবং এশিয়ার মঙ্গোলিয়া তাদের বিবৃতির দুটো বিষয়ের উপর জোর দেয় : ১. সামরিক দিক থেকে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা। ২. রাজনৈতিক দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার একটি গ্রহণযােগ্য সমাধান। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা। গ, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইকুয়েডর, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, উরুগুয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের সংঘাত প্রশ্নে অনেকটা একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি পােষণ করে। তারা মােটামুটি সবাই ১৩টি দেশের খসড়া প্রস্তাবকে সমর্থন করে এবং তারা সবাই মনে করে যে, জাতিসংঘের উচিত প্রথমেই উপমহাদেশে সৃষ্ট সংঘাত বন্ধ করা। অন্যদিকে, চিলির। প্রতিনিধি তাঁর বক্তব্যে সমস্যা সমাধানের একটি চমৎকার সুপারিশ করেন।
 

তিনি ১৩টি দেশের উত্থাপিত প্রস্তাব (অখ/৬৪৭) এবং সােভিয়েত প্রস্তাব (অখ/৬৪৮)-এর মধ্যে ‘সমঝােতার মাধ্যমে একটি সমন্বয় সাধনের প্রস্তাব করেন। তদুপরি, পেরুর প্রতিনিধি মন্তব্য করেছিলেন যে, সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাব (অখ/৬৪৭) একটি অসম্পূর্ণ প্রস্তাব। কারণ তাঁর মতে, কেবল যুদ্ধবিরতি এ সমস্যার সমাধান করতে পারে বিশেষকরে যে প্রশ্নটি উপমহাদেশের বৈরিতার সূচনা করেছে তা অবহেলা করা। যৌক্তিক হবে না।  ভারত ও পাকিস্তানের মতামত: ভারত ও পাকিস্তান নিরাপত্তা পরিষদে যে বক্তব্য দিয়েছিল, সাধারণ পরিষদে তারই প্রতিধ্বনি করে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগাশাহী ‘তথাকথিত বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য ভারতকে দোষারােপ করেন। তিনি বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর ‘বাংলাদেশ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে আগাশাহী ৩৪টি দেশের সংশােধিত প্রস্তাবকে সমালােচনা করেন।

ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন বলেন যে, “অখণ্ড পাকিস্তানের ধারনায় প্রভাবিত , হয়ে সাধারণ পরিষদের অধিকাংশ দেশ উপমহাদেশের বাস্তবতা সম্পর্কে চোখ বন্ধ  করে রেখেছে।” তিনি বলেন যে, সেই পাকিস্তান এখন অতীতের বিষয় এবং নতুন বাস্ত বতা হলাে বাংলাদেশের অচ্যুদয় ঘটেছে। তিনি ১৩টি দেশের খসড়া প্রস্তাবের সাধু উদ্দেশ্যের প্রশংসা করেন এবং বলেন যে, এর মাধ্যমে বিশ্ব সংস্থাটির সংবেদনশীল মনােভাব প্রকাশ পেয়েছে। তবে প্রস্তাবটি অবাস্তব, অপ্রাসঙ্গিক, এমনকি বিপজ্জনক। ভােটগ্রহণ: সাধারণ পরিষদে ‘শান্তির জন্য ঐক্য ফর্মুলা’ অনুসারে মােট ৩টি প্রস্ত বি- ১৩টি দেশের প্রস্তাব, ৩৪টি দেশের প্রস্তাব এবং সােভিয়েত প্রস্তাব সম্পর্কে বিস্ত রিত আলােচনার পর সাধারণ পরিষদের সভাপতি কার্যপ্রণালীর ৯৩ ধারা অনুযায়ী ভােটগ্রহণের উদ্যোগ নেন। ৩টি প্রস্তাবের মধ্যে ৩৪টি দেশের সংশােধিত প্রস্তাব সম্পর্কে ভােটগ্রহণ করা হয়।
 
ভােটের ফলাফল পক্ষে : ১০৪টি দেশ; বিপক্ষে : ১১টি দেশ এবং বিরত : ১৬টি প্রস্তাবটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে পাস হয়। এখানে বাঙালিদের একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিকে কার্যত অস্বীকার করা হয় এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার নীতির সাথে সহানুভূতি প্রদর্শন করা হয়। | ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া : জাতিসংঘ মহাসচিব ৭ই ডিসেম্বর এক টেলিগ্রাম বার্তায় সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব সম্পর্কে ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে অবহিত করেন। ৯ই ডিসেম্বর পাকিস্তান এই প্রস্তাবের একাংশ গ্রহণ করে জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর বার্তা প্রেরণ করে। পাকিস্তান অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য। প্রত্যাহারের বিষয়টি মেনে নিলেও ১ কোটি শরণার্থীর শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে। নীরব থাকে। অন্যদিকে, ভারত জাতিসংঘের সাথে সহযােগিতার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও উপমহাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য এবং সংঘর্ষের মূল কারণসমূহ অনুসন্ধান করার জন্য জাতিসংঘকে অনুরােধ জানায়। অর্থাৎ ভারত প্রস্তাবটি সম্পর্কে। নেতিবাচক মনােভাব পােষণ করে। নিরাপত্তা পরিষদে কূটনৈতিক যুদ্ধ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ৪ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। 
নিরপত্তা পরিষদের সভা এবং আলােচনা ও এর কার্যাবলি পর্যালােচনাকালে অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই অভিমত প্রকাশ করবেন যে, নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের ছকবাধা কূটনৈতিক বিতর্ক সভায় পরিণত হয়। উপমহাদেশের সংকটের মূল কেন্দ্র-উদ্ভূত বাংলাদেশ সমস্যাকে এড়িয়ে সেনা প্রত্যাহার, পর্যবেক্ষক নিয়ােগ, শান্তি স্থাপন ও সংঘর্ষ বন্ধ ইত্যাকার কথামালায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে। একটি বিশ্ব ফোরামকে পরাশক্তি বিভক্ত দেশগুলাে প্রকৃত সমস্যার সমাধান অন্বেষণ ও ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতীত কীভাবে অকার্যকর ও নিষ্ফল ডিবেটিং ক্লাবে পরিণত করেছে যা ভাবলে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ  হতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে অগণিত মানুষের আত্মাৎসর্গ, আত্মবলিদান এবং শতাব্দীর মানবিক ট্রাজেডিকে নিদারুণ উপেক্ষা ও জাতিসংঘের কাঠামােগত ছকে আবদ্ধ বিশ্ববিবেক বাধা পড়েছিল তাও কূটনৈতিক ‘অপরিধেয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকছে। পরাশক্তি বিভক্ত বিশেষকরে মার্কিন প্রভাবিত রাষ্ট্রগুলাে কূটনীতির অন্ধ অনুকরণে সমস্যার মৌলিক সূত্রের দিকে অগ্রসর হয়নি বা হতে পারেনি। সােভিয়েত রাশিয়া পােলান্ড এবং উক্ত বলয়ের ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ ও যুদ্ধের নেপথ্যে মূল। কারণ হিসেবে বাংলাদেশ সমস্যাকে তুলে ধরতে চেয়েছে। ফ্রান্স ও ব্রিটেন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ নিয়ে উপমহাদেশের সংকটময় পরিস্থিতির অন্বেষণে মূল সমস্যা-সমাধানে বাংলাদেশের পরােক্ষ বা প্রত্যক্ষ উপস্থিতি আন্তঃকূটনৈতিক সমীকরণ দ্বারা তাড়িত হয়েছে।
 
যার পেছনে ছিল বিপুল বিশ্ব জনমত ! সব মিলিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বিতর্কে শরণার্থী সমস্যা অতিক্রমণে রাজনৈতিক সমঝােতার কূটনৈতিক কণ্ঠস্বর প্রাধান্য পেয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা, খসড়া প্রস্তাব, আলােচনা ও বিতর্কে সে বৈশিষ্ট্য ও দৃষ্টান্তগুলাে লক্ষণীয় হবে।৪ঠা ডিসেম্বর আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, ইটালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সােমালিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সশস্ত্র সংঘর্ষে ক্রমবনতিশীল অবস্থায় অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদের সভা ডাকার অনুরােধ জানান। ঐদিনই পরিষদের সভা বসে এবং বিষয়টি মহাসচিবের রিপাের্টসহ এজেন্ডার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রথমেই ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের বিতর্কে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানাে হয়। যদিও তাদের ভােটাধিকার ছিল না। পরিষদের নিকট ভারতের ৪ঠা ডিসেম্বরের পত্র যা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বিবৃতিটি সংশ্লিষ্ট করে দেয়া হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ৩রা ডিসেম্বের আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে একদিন পর ৪ঠা ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশন শুরু হয়। পরিষদের সভা বসার পূর্বক্ষণে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ্যে বক্তব্য রাখার জন্য এক পত্রে আবেদন জানান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ পত্রটির অন্যান্য সাধারণ গুরুত্ব রয়েছে। এতে সংক্ষিপ্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, কারণ ও জাতিসংঘের ভূমিকা এবং কর্তব্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। স্মরণ রাখা প্রয়ােজন যে, ৪ঠা ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, কিন্তু তখন এ পত্রটিকে নিরাপত্তা পরিষদের সরকারি দলিল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই প্রথম জাতিসংঘে বাংলাদেশের মানুষের বক্তব্য বাংলাদেশের প্রতিনিধির মাধ্যমে সরাসরি উচ্চারিত হল।। পত্রটি বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের স্বপক্ষে কিছু মৌল বক্তব্য খুজে পাওয়া যায় : ক, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তান ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে যে যুদ্ধ শুরু করেছে সেটাই হলাে এ সংকটের মূল কারণ, খ, জাতিসংঘ এ পর্যন্ত মূল সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয়নি। কারণ জাতিসংঘ এ বিয়ােগান্তক ও মারাত্মক সংকটের প্রধান পক্ষ বাংলাদেশের মানুষকে বিবেচনায় আনেননি, গ, চলমান সংকটের বর্তমান পরিস্থিতি, এর প্রকৃতি কারণ এবং সামগ্রিক সমাধান কোনাে কিছুই সম্ভব নয়, যদি না বাংলাদেশের মানুষের বক্তব্য এখানে শােনা না হয়, এবং ঘ, বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদের সামনে একটি বিবৃতি পাঠের জন্যও বিচারপতি চৌধুরী অনুরােধ জানান। | সােভিয়েট রাশিয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধির বক্তব্য শােনার প্রস্তাব করেন। কিন্তু নিরাপত্তার পরিষদের প্রেসিডেন্ট এই প্রস্তাব ‘রুল্ড আওট করেন এবং বিষয়টি বিবেচনার ব্যাপারে একমত হননি। 
 
বিতর্কের শুরুতে পাকিস্তানের প্রতিনিধি ভারত কর্তৃক পাকিস্তান ভূখণ্ড আক্রমণের বিষয়টি উল্লেখ করে ক্ষান্ত হয়নি বরং প্রকাশ্যে পাকিস্তান ভাঙার দাবি তুলছে। তার বক্তব্য ছিল, এই পরিষদ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এভাবে সংশ্লিষ্ট হতে পারে যে এটা শুধু পাকিস্তানের বিষয় নয়, বরং একটি বৃহৎ প্রতিবেশী শক্তি যেকোনাে রাষ্ট্রের জন্য হুমকির বিষয়। যার ফলে জাতিসংঘ সনদ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ২১শে নভেম্বর থেকে ভারতের নিয়মিত সশস্ত্রবাহিনী ট্যাংক বিমান নিয়ে উস্কানি ব্যতিত পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছে। এতে সর্বাত্মক যুদ্ধ চলে। যেখানে নাশকতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম ভারত দ্বারা সংঘটিত হচ্ছিলাে। এটা নিরাপত্তার পরিষদের দায়িত্ব ভারতকে কীভাবে এই আক্রমণ থেকে প্রতিহত করবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত সামাজিক ও আদর্শগত দিক বিবেচনায় একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এসব বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদ পাকিস্তানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং অন্য সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক নীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ভারতের প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদের সামনে সমস্যার দীর্ঘ ইতিহাস ও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সম্পর্কের বিষয় প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তার বক্তব্য ভারত নয়, বরং পাকিস্তান নিজেই তার দেশকে ভেঙে ফেলছে এবং সেই লক্ষ্যে ভারতকে আক্রমণ করেছে। এক কোটি লােককে ভারতে পাঠানাের অর্থই হলাে এক ধরনের আক্রমণ। যার ফলে ভারতের উপরে অসহনীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টি করেছে। ভারত-প্রতিনিধি পাকিস্তান উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে পাল্টা একথা তুলে ধরেন যে, বাঙালি বিদ্রোহীদের দমিত করতে না পেরে পাকিস্তান এখন সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিকীকরণ করছেন এবং তা ভারত পাকিস্ত েিনর সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং পাকিস্তান যে সমস্ত ঘটনাবলি পূর্ব পাকিস্তানে ঘটিয়েছে তা থেকে ভিন্ন দিকে দৃষ্টি সরাতে চায়। ভারত এ সম্পর্কে দৃঢ় ইচ্ছা পােষণ করে বলতে চায় পূর্ববঙ্গের জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতীত এবং জনগণের উপর নির্যাতন অব্যাহত রেখে নিরাপত্তা পরিষদের এ বিষয়ে কোনাে পক্ষ হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, “যুদ্ধবিরতি ভারতের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের সাথে হতে হবে।”
 
ভারত ও পাকিস্তান প্রতিনিধির বক্তব্য পেশের পর বিভিন্ন রাষ্ট্র বক্তব্য প্রদান করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি বলেন, ভারত পাকিস্তানের সংঘর্ষ শুরু হয়েছে যা এশিয়ার শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব করে যে, উভয় পক্ষ সীমান্ত থেকে তাদের সামরিক সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার করবে। মহাসচিব দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা সমধানে কল্যাণকর উদ্যোগ নিবে। কিন্তু ভারত কোনাে প্রস্তাবেই সমর্থন করছে না। জাতিসংঘের উচিত ভারত এবং পাকিস্তানকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করানাে, অবিলম্বে বিদেশের মাটি থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা। যার ফলে রাজনৈতিক সমাধানের অগ্রগতির জন্য সন্তোষজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের বক্তব্য প্রদানের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ ৭টি পয়েন্ট সম্বলিত একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবগুলাের উদ্দেশ্য যুদ্ধবিরতি, সৈন্য প্রত্যাহার, শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং শরণার্থী প্রত্যাবর্তন হলেও মূল বাংলাদেশ সংকট-সমস্যা সমাধানে কোনাে কিছু ছিল না। লক্ষ্য, মার্কিন নীতি অনুসরণে অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষা। | আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, ফ্রান্স, ইটালি, জাপান, সিয়েরা লিয়েননা, সােমালিয়া, সিরিয়া, আরব রিপাবলিক এবং যুক্তরাজ্য অবিলম্বে সংঘর্ষ বন্ধের আহ্বান জানান। অনেকেই অবিলম্বে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানান। কতিপয় সদস্য উভয় পক্ষের সীমানা সংঘর্ষের কথা, মানবিক দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার পরামর্শ দেন। জাতিসংঘের তদারকিতে যুদ্ধবিরতি, পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি যাতে শরণার্থীরা স্বেচ্ছায় ফিরতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতির সমাধানের প্রয়ােজনীয়তার কথা বলা হয়। বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান প্রস্তাব পেশ করেন।” তারা ৫টি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। 
চীনের প্রতিনিধি অভিযােগ করেন, ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে জয় করার জন্য সরাসরি সৈন্য পাঠিয়েছে। এর ফলে উপমহাদেশ বিশেষকরে সমগ্র এশিয়ায় ব্যাপক আকারে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ভারতের আক্রমণের জন্য। নিরাপত্তা পরিষদের নিন্দা করা উচিৎ, যাকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ সমর্থন দিয়েছে। চীনা প্রতিনিধি অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে পাকিস্তান এলাকা থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। | সােভিয়েত প্রতিনিধি পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ডে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপরে সন্ত্রাস ও শক্তি প্রয়ােগ করেছে। লক্ষ লক্ষ লােককে বাড়িছাড়া করেছে, সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত হয়েছে এবং পালিয়ে এসে ভারতের শরণার্থী হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিনিধির অফিসিয়ালি স্বীকার করা উচিত তাদের দেশে। ভয়ানক অভ্যন্তরীণ সংকট রয়েছে। যে সংকট আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের উচিত সংকটের গভীরে প্রবেশ করা। একই সঙ্গে সােভিয়েট রাশিয়া পরিষদের একটি প্রস্তাব পেশ করেন। যেখানে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের সংকট নিরসনে প্রয়ােজন রাজনৈতিক সমঝােতা এবং পাকিস্তান সরকারের উচিত পূর্ব।
 
পাকিস্তানে যে সশস্ত্র সংঘর্ষ চলছে তা বন্ধ করা। যার ফলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। পােল্যান্ডের প্রতিনিধি স্পষ্ট করে বলেন, সংঘর্ষের মৌলিক সূত্র মুছে ফেলার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমঝােতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। | আর্জেন্টিনা, বুরুন্ডি, নিকারাগুয়া, সিয়ারােলিয়েননা এবং সােমালিয়া একটি খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপনপূর্বক ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর সংঘর্ষের খবর সম্বন্ধে দারুণ। উদ্‌বেগ প্রকাশ করে। যতাে শীঘ্র সম্ভব এই শত্রুতা দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধ বন্ধ। করার এবং সৈন্য প্রত্যাহারের প্রয়ােজনীয়তা অনুধাবন করার সুপারিশ পেশ করে।” ৫ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের খসড়া প্রস্তাবের উপর ভােট গৃহীত হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১১টি, বিপক্ষে ২টি (পােল্যান্ড এবং সােভিয়েত রাশিয়া) এবং দুটি দেশ (ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য) ভােট দানে বিরত থাকেন। পরে ৫ই ডিসেম্বর পুনরায় নিরাপত্তা পরিষদে বসলে তাদের অনুরােধে তিউনেশিয়া ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানান। যদিও তাদের ভােটাধিকার ছিল না। সােভিয়েত রাশিয়ার প্রতিনিধি পুনরায় বিতর্কে অংশগ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানাের দাবি জানান। আর্জেন্টিনা, চীন, ভারত, ইটালি, পাকিস্তান, পােল্যান্ড এবং সােভিয়েত রাশিয়া এ বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখেন। সােভিয়েত রাশিয়ার সম্মতিক্রমে বিষয়টি পরবর্তী দিনের আলােচনার জন্য মুলতুবি রাখা হয়। সােভিয়েত রাশিয়ার প্রতিনিধি সােভিয়েত ইউনিয়নের তাস (Tass) এর একটি টেলিগ্রাফিক এজেন্সি কর্তৃক প্রকাশিত বিবৃতি জাতিসংঘে প্রচার করে। প্রচারিত শেষ তিনটি অনুচ্ছেদে বলা হয় : “হিন্দুস্তান উপদ্বীপে শান্তি রক্ষার জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে সােভিয়েত সরকার। পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে সুস্পষ্টভাবে তাদের এই বিপজ্জনক পথে চলার গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করে দেওয়া প্রয়ােজন মনে করে। বর্তমানে হিন্দুস্তানে যে সামরিক বিপদ দেখা দিয়েছে-যে সামরিক বিপদের দিকে কোনাে শান্তিকামী দেশই উদাসীন থাকতে পারে না-সেই বিপদের মুখে সােভিয়েত ইউনিয়ন অবিলম্বে এই রক্তক্ষয় বন্ধের জন্য, এবং আইনসঙ্গত অধিকারের ভিত্তিতে। এবং সে দেশের জনগণের স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের। জন্য আহ্বান জানিয়েছে। সােভিয়েত সরকার একথাও বিশ্বাস করে যে, পৃথিবীর সব দেশের সরকারেরই এই বিরােধের সঙ্গে কোনাে না কোনােভাবে জড়িত হওয়া থেকে- যা হিন্দুস্থান উপদ্বীপের পরিস্থিতির আরাে অবনতি ঘটাবে-বিরত থাকা উচিত।” সেখানে সােভিয়েত রাশিয়ার অবস্থান তুলে ধরা হয়। বিবৃতিতে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়, পাকিস্তান যে ভয়ঙ্কর পথ অনুসরণ করেছে যা প্রত্যক্ষভাবে সােভিয়েত সীমান্তে গুরুতর ঘটনার জন্ম দিবে।
 
চীন একটি খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করে। প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্য হলাে এখানে ভারতকে দোষারােপ করা হয়, এভাবে যে, ভারত বাংলাদেশ নামক নামসর্বস্ব ইস্যু তৈরি করছে। প্রস্তাবনায় বলা হয় ইন্দো-পাকিস্তান উপমহাদেশে মারাত্মকভাবে শান্তি। বিঘ্নিত হচ্ছে। ভারত পাকিস্তানের উপর আক্রমণ করেছে । তথাকথিত বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য ভারত সরকার পাকিস্তানের উপর নাশকতা, পকিস্তান ভেঙে ফেলা এবং অখণ্ডতা ধ্বংসের জন্য আগ্রাসন চালিয়েছে। অপারেটিভ পার্টে বলা হয়, ভারত পাকিস্তান সীমান্ত হতে সৈন্য প্রত্যাহার, বৈরিতা হ্রাস এবং পাকিস্তানের জনগণের উপরে পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের বিরুদ্ধে ভারত যে আক্রমণ করেছে তা প্রতিহত করার আহবান জানান। প্রস্তাবের পক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে চীন বলে সৈন্য প্রত্যাহার ব্যতিত যুদ্ধবিরতিতে কোনাে লাভ হবে না। এটা শুধু আগ্রাসনকে উৎসাহিত করবে। তিউনিশিয়ার প্রতিনিধি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের সরাসরি নির্দেশ দেওয়া উচিত। না হলে অন্তত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের আবেদন করা উচিত। প্রতিনিধি বলেন, শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন সবচেয়ে ভালাে সমাধান কিন্তু তার জন্য আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার। সৌদি আরবের প্রতিনিধি বলেন, এশিয়ার সরকারপ্রধানদের এ সংঘর্ষ অবসানের জন্য একটি সমঝােতায় উপনীত হওয়ার জন্য একটি সভা আহ্বানের প্রস্তাব দেন। ৮টি দেশ আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, ইটালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়রাে, লিয়েন এবং সােমালিয়া প্রস্তাব করে যে : ক. অবিলম্বে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বন্ধ; খ, জাতিসংঘের চার্টার অনুসারে যে কারণসমূহে বর্তমান বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছে তার যথাযথ অনুমােদন প্রয়ােজন; গ. শরণর্থীদের প্রত্যাবর্তনের জন্য রাজনৈতিক সমাধান প্রয়ােজন যেখানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে; এবং ঘ. জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা শক্তিশালী করার লক্ষে ১৯৭০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ যে ঘােষণা করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে হুমকি ও শক্তির বিরুদ্ধে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, একইসাথে জনগণের আত্ননিয়ন্ত্রণ অধিকার অনুযায়ী তাদের ভাগ্য নির্ধারণ এবং জাতিসংঘের চার্টার অনুসারে বিবাদ নিরসন করা। 
 
অপারেটিভ পার্টে বলা হয় রাষ্ট্রসমূহ যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার করে তাদের ভূখণ্ডে নিয়ে যাবে। শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে স্ব-স্ব পক্ষ প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। মহাসচিবকে শরণার্থীদের সাহায্যের ব্যাপারে রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। পরে ৫ই ডিসেম্বর সােভিয়েত খসড়া প্রস্তাব ভােটে দেওয়া হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ২টি, বিপক্ষে ১টি এবং ১২জন ভােটদানে বিরত থাকে। সেজন্য প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। ৭৫ | এরপর নিরাপত্তা পরিষদ আট জাতির খসড়া প্রস্তাব ভােটে প্রদান করলে পক্ষে ১১টি, বিপক্ষে ২টি এবং বিরত থাকে ২টি দেশ। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী প্রতিনিধি সােভিয়েত রাশিয়া নেতিবাচক ভােট দেওয়ার ফলে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। . ফ্রান্সের প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকর ব্যর্থতীয় উদ্‌বেগ প্রকাশ করেন। এবং ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে মহাসচিব কর্তৃক অবস্থা সম্পর্কে উদবেগপূর্ণ দৃষ্টি  আর্কষণ সম্পর্কে উল্লেখ করেন এবং এ সম্পর্কে বলেন ফ্রান্স এবং ইতালির প্রতিনিধি যখন পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন তখন সেটি বিবেচনার জন্য বলেছিলেন। তিনি বলেন, আট জাতির প্রস্তাবে তার অনুপস্থিত কারণ হলাে এটা গ্রহণ করার কোনাে সম্ভাবনা ছিল না। তিনি পরিষদে পুনরায় আলােচনার অনুরােধ জানান। যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি ফ্রান্সের অনুরূপ অভিমত প্রকাশ করেন এবং আলােচনার জন্য আহ্বান করেন। চীন, রাশিয়া ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিস্থিতি সম্পর্কে স্ব-স্ব সরকারের অবস্থান থেকে মতামত তুলে ধরেন। পরে ৫ই ডিসেম্বর বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়ারাে লিয়ন একটি নতুন খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এ প্রস্তাবে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি এবং সংঘর্ষ সম্পর্কে গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। এই লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, যুদ্ধ বন্ধ এবং এ সম্পর্কে মহাসচিবকে প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন সম্পর্কে অবগত করার অনুরােধ জানানাে হয়। ৬ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদ পুনরায় বৈঠকে বসলে তিউনেশিয়া যুদ্ধ বন্ধ ও সৈন্য প্রত্যাহারের আবেদন করেন। নিকারাগুয়ার প্রতিনিধি বলেন, যদি নিরাপত্তা পরিষদ ভেটো প্রদানে পঙ্গুত্ব বরণ করে থাকে তাহলে সাধারণ পরিষদে এই ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।” 
 
 
ফ্রান্সের প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদকে অবহিত করেন যে, যুক্তরাজ্যের সহযােগিতায় তিনি একটি প্রস্তাব তৈরি করেছেন যা বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান ৪ ডিসেম্বর প্রস্তাব করেছিলেন যে, অবিলম্বে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যুদ্ধবিরতি, সামরিক কার্যক্রম এবং পারস্পরিক সৈন্য সমাবেশ বন্ধের কথা বলা হয়েছিল। এ প্রস্তাবটি ফ্রান্স এবং ব্রিটেন কতিপয় সদ স্যদের বিরােধীতার কারণে পেশ করেনি। ফলে শান্তি পরাজিত হয়েছে। জাতিসংঘ পুনরায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং অস্ত্র বিষয়টি নির্ধারণ করছে।” | সােভিয়েত প্রতিনিধি বলেন, বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া ও সিয়ারাে লিয়ন আট জাতির এই খসড়া প্রস্তাবে শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক আগ্রাসন বন্ধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলাে, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনগণের অভিপ্রায় এখানে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত যা উপেক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু আট জাতির প্রস্তাবে এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যার ফলে তিনি সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এসময় ইতালি পূর্বে পাঁচ জাতি দেওয়া প্রস্তাব প্রত্যাহারে ঘােষণা দিয়ে বলেন, এটা এই মূহুর্তে সময়ােপযােগী নয় এবং গৃহীত হওয়ার কোনাে সুযােগ নেই। ভারতের প্রতিনিধি ৬ই ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর একটি বিবৃতি পরিষদে পড়ে শােনান এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি কথা জানান। তিনি বলেন, ভারত পাকিস্তানের ক্যাটাগরিতে পড়ে না। ভারত এমন কোনাে সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না যেখানে দু’দেশকে এক করে দেখা হয়। তিনি বলেন, উপমহাদেশে মূল সমস্যা ও কারণ না জেনে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধির অভিমত না জেনে কোনাে সিদ্ধান্তই গ্রহণে সম্মত হবে না।
 
পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলেন, উপমহাদেশে যে সমস্যা উদ্ভব হয়েছে তা ভারতের নাশকতা, অস্ত্র সমর্থন এবং আগ্রাসনের কারণে। তিনি বলেন, ভারতের আক্রমণের কারণে পাকিস্তান সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিনিধির প্রশ্ন। উত্থাপন করেন, পরিষদ তথাকথিত বাস্তবতাকে বৈধতা দেবে? এবং জবরদস্তি দখল, আক্রমণ এবং অবৈধ শক্তি প্রয়ােগকে বৈধতা দেবে কিনা। | চীনের প্রতিনিধি বলেন, সােভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে ভারত পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার জন্য বাংলাদেশকে সৃষ্টি করেছেন। | সােমালিয়ার প্রতিনিধি নীতিগতভাবে একদেশ থেকে অন্যদেশ দেশের শত্রু সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি সমঝােতার বিষয় নয়। সামরিক উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান অন্যদেশ চাপিয়ে দিতে পারে না। সময় এসেছে প্রশ্নটি সাধারণ পরিষদে স্থানান্তরিত করা। যেমনটি হয়েছিল ১৯৫০ সালের ৩রা নভেম্বরে। (৩৭৭অ(৫)) প্রস্তাবে সাধারণ পরিষদে শান্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রস্তাব গৃহীত হয়। * যা পরবর্তী পর্যায়ে আলােচনায় উঠে আসবে। বাংলাদেশকে অস্বীকার করার কৌশল : শান্তির জন্য ঐক্য ফর্মুলা জতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অচলাবস্থার অবসানে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য। সাধারণ পরিষদ একটি গ্রহণযােগ্য ফর্মুলার অন্বেষণে ব্যস্ত থাকে। কয়েকটি দেশ জাতিসংঘের চত্বরে আনুষ্ঠানিক আলােচনা শুরু করে। নিকরাগুয়ার প্রতিনিধি সেভিল্লা। সাকাসা নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, “যদি আমরা কোনাে কিছু করতে ব্যর্থ হই, তবে সাধারণ পরিষদ উদ্যোগ নিতে পারে। কারণ এটা মনে করার কারণ নেই যে, কেবল নিরাপত্তা পরিষদই আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রশ্নে উদৃবিগ্ন থাকবে।” এই ধারণা থেকে নিরাপত্তা পরিষদের ছয়টি দেশ আর্জেন্টিনা, বুরুন্ডি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরে, লিওন ও সােমালিয়া ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ নিরাপত্তা পরিষদের ১৬০৬ ও ১৬০৭ বৈঠকে ঐক্যমতের প্রস্তাব গ্রহণের ব্যর্থ হওয়ায় একত্রে একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে। খসড়া প্রস্তাবের সুপারিশে বলা হয়, উক্ত বৈঠকসমূহে ঐক্যমত হওয়ায় ১৯৫০ সালে সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব (377 A(V)) অনুযায়ী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে প্রেরণ করা হােক।”
 
এই প্রস্তাব উত্থাপনের পর নিরাপত্তা পরিষদে সংক্ষিপ্ত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। প্রস্ত বিটির উপর বিতর্ক অনুষ্ঠানকালে সােভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স ও ব্রিটেন ও অস্থায়ী সদস্য পােল্যান্ড ভিন্ন মত প্রকাশ করে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যবৃন্দ অবগত ছিলেন যে, এই প্রস্তাবের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র শক্তভাবে পৃষ্ঠপােষকতা করেছে। ছয় জাতি উত্থাপিত এই প্রস্তাব ৬ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হয়। নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টকে জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি একটি পত্র লেখেন। পত্রটিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনােভাব ও নীতি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। পলাে বলা হয়েছে, ভারত উপমহাদেশে যুদ্ধ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতােমধ্যে নিরাপত্তা পরিষদের ১৬০৬, ১৬০৭, ১৬০৮ তারিখে বৈঠকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছে। সে লক্ষ্যে সাধারণ পরিষদ ৭ই ডিসেম্বরের বৈঠকে সংকট অবস্থা নিরসনে ‘শান্তির জন্য ঐক্য ফর্মুলা ১০৪ ভােট পক্ষে, ১১ ভােট বিপক্ষে এবং ১০ রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থেকেছে এবং ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য উভয় পক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে। পাকিস্তান প্রস্তাব মেনে নিয়েছে, ভারত এখন পর্যন্ত তা মেনে নেয়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন নিরাপত্তা পরিষদের বিশ্বশান্তি স্থাপন ও হুমকি মােকাবিলায় অবিলম্ব দায়িত্ব রয়েছে। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ হতে তিনি অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদের সভা ডাকার আহ্বান জানান। উপমহাদেশের যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মত সিদ্ধান্তগ্রহণে ব্যর্থ হলে বিষয়টি সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করা যায় কি না সে-সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদের ১১টি সমমনা রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলােচনা করে। এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলাে নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৫০ সালের ৩ নভেম্বরের প্রস্তাবনা অনুযায়ী। এটি সাধারণত ‘শান্তির জন্য ঐক্য ফর্মুলা’ নামে পরিচিত। এ চিন্তা থেকেই নিরাপত্তা পরিষদের ৬টি দেশ যথাক্রমে আর্জেন্টিনা, বুরুন্ডি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরােলিওন ও সােমালিয়া পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং বিষয়টির জন্য সুপারিশ করে। ৬টি দেশ এই প্রস্তাব উত্থাপনের পর নিরাপত্তা পরিষদে একটি সংক্ষিপ্ত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।
 
পরিষদের সভাপতি এই খসড়া প্রস্তাবের উপর বিতর্কের অবসানের জন্য ভােট গ্রহণ করেন। ভােটে কোনাে দেশ ভেটো না দেওয়ায় এই প্রস্তাব পাস হয় এবং পাসের পর জাতিসংঘ উপমহাদেশে যুদ্ধবন্ধের লক্ষ্যে ‘শান্তির জন্য ঐক্য ফর্মুলা’ প্রয়ােগের জন্য কার্যক্রম শুরু করে। | ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদে গৃহীত ‘শান্তির জন্য ঐক্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গৃহীত হলেও যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নির্দেশ মােতাবেক ১২ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট বরাবর নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকার আহ্বান জানান। ঐদিন বিকাল চারটায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে নিরাপত্তা পরিষদের ১৬১১তম বৈঠক বসে। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ এক প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতের প্রতি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। প্রস্তাবে বলা হয়, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত আছে কিন্তু ভারত এখন পর্যন্ত নিঃশর্তভাবে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেনি। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ১৩ই ডিসেম্বর সােভিয়েত রাশিয়া ভেটো প্রয়ােগ করে। পাকিস্তানের প্রতিনিধি ভুট্টো দীর্ঘ বক্তৃতায় অতীতের মতাে ভারতের আগ্রাসন থেকে পাকিস্তানকে রক্ষায় জাতিসংঘের ব্যর্থতার সমালােচনা করেন। ১২ই ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং তার বক্তব্য প্রদান শুরু করে। তার পক্ষ থেকে বলা হয়, একপক্ষ কালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার মর্মান্তিক ঘটনাবলি দ্বিতীয়বারের মতাে নিরাপত্তা পরিষদে আলােচনা শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিশেষজ্ঞগণ। মনে করেন, ৭ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস হওয়ার ফলে ভারত উদৃবিগ্ন হয়ে ওঠে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তড়িঘড়ি করে পুনরায় জাতিসংঘে ফিরে আসতে হয় । যেকোনাে সচেতন পাঠকমাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীর্ঘ ভাষণ প্রদান করেন। এই দীর্ঘ ভাষণ প্রদানের লক্ষ্য ছিল এই সময়ের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশ মিত্রবাহিনী যেন বাংলাদেশ কজা করতে পারে এবং নিরাপত্তা পরিষদ কোনাে রকম হস্তক্ষেপ করার সুযােগ না পায়, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণের বক্তব্য ছিল, সাধারণ পরিষদে আলােচনার শেষ পর্যায়ে গৃহীত প্রস্তাবে ভারত উপমহাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আলােচনা করেছে সম্ভবত তা ছিল অবাস্তব। কেননা সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে আলােচনা হয়নি।
 
তিনি বাংলাদেশের জনগণের উপরে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর অবর্ণনীয় নির্যাতন ও সামরিক শাসনের বিস্তারিত উল্লেখ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশের মন্তব্য খণ্ডন করে বলেন, ভারত সবসমই সহযােগিতার হাত সম্প্রসারিত করে আছে। যদি জাতিসংঘ বাস্তব অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে আসতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের আহ্বান বাস্তব সম্মত হবে যদি বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত রয়েছে কেন সে সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নিকট থেকে শুনতে দেওয়া হয়।” ১২ই ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে। হেনরি কিসিঞ্জার সভাপতিত্ব করেন। আলােচনায় শুরুতে সি.এ.আই. রিপাের্টের পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে বিদ্যমান পরিস্থিতির ওপরে সি.আই.এ উত্থাপিত পরস্পরবিরােধী রিপাের্ট পর্যালােচনা করা হয়। সিআইএ ভারতের দখলকৃত পূর্ব পাকিস্তান এলাকা মানচিত্রে দেখাতে সম্মত হয়। প্রেসিডেন্ট ৯৯ মিলিয়ন ডলারের সাথে সংশ্লিষ্ট আর কোনাে অপ্রত্যাহারযােগ্য ঋণপত্র ইস্যু এবং ৭২ মিলিয়ন ডলারের পিএল ৪৮০ ঋণ কার্যকর করার লক্ষ্যে নতুন কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বানের উদ্দেশ্যে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য বিকালে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের সাথে আনুষঙ্গিক আলােচনার পরিকল্পনা করা হয়। এসময় নিক্সন প্রশাসন কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং যেটি করা হয় নিক্সনের ইচ্ছানুসারে। এ সময় স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা উইলিয়াম বিশ্ব জনমতের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি প্রেসিডেন্ট ভেবে দেখেছেন কিনা প্রশ্ন তােলেন। কিসিঞ্জার জবাবে পরিষ্কার করে বলেন যে, উপমহাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির। পরিপ্রেক্ষিতে নতুন অর্থ সাহায্য স্থগিত রাখা হয়েছে। কিসিঞ্জার আরাে বলেন, এসময় যুক্তরাষ্ট্রের কাজ হলাে জাতিসংঘের দিকে হাত বাড়ানাে। এই লক্ষ্যে জাতিসংঘকে সক্রিয় করার জন্য অগ্রসর হন এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠান এবং কিসিঞ্জার তার মন্তব্য জুড়ে দেন যে, এই ধরনের পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ যদি কার্যকর ভূমিকা না রাখতে পারে, তাহলে বলতেই হবে যে, এর কার্যকারিতা ফুরিয়ে গেছে এবং  মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে জাতিসংঘের দেওয়া নিশ্চয়তা অর্থহীন হয়ে গেছে।
 
এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বানের পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। কিসিঞ্জার আরাে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে, কিন্তু নিরপত্তা পরিষদের মূল কাজ হলাে সামরিক তৎপরতা বন্ধ করা, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে থাকা ? বৈঠকে অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনুরােধ জানাবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তৃতার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হবে। জাতিসংঘের কর্মকাণ্ডে মার্কিন সরকারের পক্ষপাতি থাকবে পাকিস্তানের দিকে। পাকিস্তানের প্রতি বর্তমানে বহাল অর্থনৈতিক সাহায্য বাতিল করা হবে না। কিসিঞ্জারের ভাষ্য ছিল, ভারত সর্বাত্মক আক্রমণ ঘােষণা করলে জাতিসংঘ প্রতিবেদনে অবশ্যই তার প্রতিফলন ঘটা উচিত । ডি। পালমা পরামর্শ দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি জাতিসংঘ আলােচনায় ভারতের বিরুদ্ধে। ঘোষণার প্রসঙ্গ টানা হয়, তাহলে তাদের অবশ্যই ইয়াহিয়া মন্তব্যের কথাও উল্লেখ করতে হবে। এসময় পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা করেছে, কিন্তু ভারত তেমনটি ঘােষণা দেয়নি। এ প্রসঙ্গে কিসিঞ্জার জানতে চান জাতিসংঘে কী হচ্ছে। এর উত্তরে ডি পালমা জানান যে, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, জাপান ও সম্ভবত ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। সভা আহবানের জন্য আমাদের অনুরােধ সম্বলিত চিঠিতে জাপান কিঞ্চিৎ পক্ষপাতিত্ব খুঁজে পেয়েছে। জাপানিরা শান্তিপূর্ণ আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য জাপানিদের কাছে। তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। এ কথায় ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কিসিঞ্জার। বলেন, জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অবশ্যই পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে হবে। জাতিসংঘের মার্কিন রাষ্ট্রদূত বুশ যদি বুঝতে পারেন কী তার বলা উচিত, তাহলে অন্য। কে কী মনে করল, সেটার পরােয়া তিনি করেন না। ডি পালমা জানান যে, নিরাপত্তা পরিষদের সভা (সেদিন) বিকালে না সন্ধ্যায় আহ্বান করা হবে, সেটা তার জানা নেই। সভার প্রাথমিক বিবৃতিগুলাে অবশ্য ভারতীয় ও পাকিস্তানিরাই দেবে। তিনি পরামর্শ দেন যে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ দুটোর বিবৃতি শেষ হয়ে যাবার পর প্রথমদিকেই রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তব্য দেওয়া উচিত। শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানিয়ে দিলে সেটার প্রভাব বেশি হবে বলে তিনি মনে করেন। কিসিঞ্জার এতে কোনাে আপত্তি করেননি। এ সময় ডি পালমারের বক্তব্য ছিল বিবৃতি প্রকাশ করার আগেই অন্যদেরকে সময় লাগলেও পক্ষে আনতে চাই কি না।
 
কিসিঞ্জার পরামর্শ দেন। যে, এভাবে এগুনাের চেয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, প্রয়ােজনে এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতি দিয়ে ফেলা উচিত। কিসিঞ্জারের মত অনুসারে, একমাত্র যে পথটি বর্তমানে খােলা আছে তা হল, যুক্তরাষ্ট্র বৃহত্তর স্ট্রাটেজির প্রেক্ষিতে তাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করা।’ সকলে জানেন, কীভাবে এটা ঘটবে এবং সকলেই এটাও জানেন যে, ভারত শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেবে। কাজেই, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ব্যক্ত করে তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত আলােচনার জন্য উপস্থাপন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়ােজন একটি সিদ্ধান্ত যা রাষ্ট্রদূত বুশ তাঁর বক্তৃতার মাধ্যমে ঘােষণা করবেন। অন্যেরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আসতে চায়, তা হবে চমৎকার। কিন্তু যে। কোনাে অবস্থায় রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তব্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করতে হবে। | কিসিঞ্জার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ব্যক্ত করাটা জরুরি। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবার আশঙ্কা প্রবল, কারণ সােভিয়েতরা ভেটো প্রয়ােগ করতে পারে। এই যুদ্ধ বন্ধ করতে জাতিসংঘেরও খুব সামান্যই করণীয় আছে। তিনি যা বলেন, তার সারসংক্ষেপ হলাে এই যে, তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তৃতার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত জাতিসংঘে প্রকাশ করা হবে এবং সেটা অবিলম্বে। পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যমান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে সাধারণ আলােচনায় যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই অংশ নেবে, কিন্তু কোনাে নির্দিষ্ট পরামর্শ, যেমন: মুজিবের মুক্তি, সে প্রস্তাব তারা দেবে না। জাতিসংঘে ভারতীয় কৌশল নিয়ে আলােচনা: কিসিঞ্জার জানতে চান, নিরাপত্তা পরিষদে ভারতীয়রা কাজ শুরু করতে কতটা দেরি করতে পারে। ডি পালমা বলেন, তারা দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে পারে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। ফন হেলেন বলেন যে, তারা যতটা সম্ভব প্রলম্বিত করবে, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে তারা মনােসংযােগ করতে সমর্থ হবে। ডি পালমা বলেন, তারা বড়জোর। তিন-চারদিন দ্বিধাগ্রস্ত থাকবে যা, হেমসের মতে, তাদের পূর্ব পাকিস্তান দখল করার পক্ষে যথেষ্ট সময়। ডি পালমা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই ভােটের জন্য চাপ প্রয়োেগ করতে পারে। কিসিঞ্জার পুনরাবৃত্তি করেন যে, জাতিসংঘ থেকে লাভজনক কিছু পাওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই। কেননা ডি পালমার অভিমত ছিলাে, কোনাে না কোনাে পক্ষের ভেটো দেবার আশঙ্কা খুবই প্রবল।
 
ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের প্রকাশ্যঅপ্রকাশ্য কূটনৈতিক তৎপরতা দৃশ্যত অকার্যকর হয়ে যায়। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে যে, এ সময় যুক্তরাষ্ট্র যেমন জাতিসংঘকে সামনে রেখে তাদের সুনির্দিষ্ট কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে তৎপর ছিল, তেমনি গােপনে সামরিক কূটনীতি জোরদার করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের গােপন নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ভারত পূর্বাঞ্চলে লড়াই জোরদার হয়েছে। ভারত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে তেমন সাফল্য অর্জন করেনি যদিও তারা আকাশ পথ কজা করেছে, নৌ-যুদ্ধে পাকিস্তানকে বেকায়দায় ফেলেছে এবং মস্কোর উত্তরােত্তর জোরালাে ও প্রকাশ্য সাহায্য জোরদার হয়েছে এবং জাতিসংঘে কোনাে . উদ্যোগকে বিশেষকরে লড়াই বন্ধের বিষয়ে সমর্থন দেয়নি।
 
কিসিঞ্জার এ সময় জাতিসংঘের উদ্যোগ প্রসঙ্গে অবগত হন। তাকে বলা হয়, নিরাপত্তা পরিষদের দুটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সােভিয়েত ভেটো প্রয়ােগ করেছে। এই অবস্থা নিরসনে সাধারণ পরিষদে ‘শান্তির জন্য ঐক্য সংক্রান্ত ধারার আওতায় একটি জরুরি সভা আহ্বানের ভিত্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। সভায় উল্লেখ করা হয় যে, ১৩৬টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বে এই পরিষদের যেকোনাে প্রতিকুলতা মােকাবেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে ডি, পালমা বলেন, ৩.৩০ মিনিটে যে। কাউন্সিলের একটি সভা আছে সেখান থেকে সমস্যাটি সাধারণ পরিষদে স্থানান্তর করতে হবে। কারণ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হচ্ছে না এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত’ । কিসিঞ্জার বলেন, ভারতীয়দের প্রতি নিস্পৃহ আচরণ এবং তাদের খুব। একটা সম্মান যুক্তরাষ্ট্র দেখাবে না। অবশ্য পালমা বলেন, সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব। উথাপনের পর ঘটনার নতুন মােড় নেবে। সেক্ষেত্রে ভারত আর সমস্যার রাজনৈতিক নিষ্পত্তির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবে না। কারণ এটা কোনাে সমস্যা বলে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়ােজন হবে না। তারপরেও কিসিঞ্জার বলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিশ্চিতভাবে চান না পাকিস্তান পরাজিত হােক। এরজন্য সামরিক কূটনীতি পরিচালনা পরিচালিত হবে গোপনে।
 
এসময় সিআইএ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে একটি গােপন রিপাের্ট তৈরি করে। রিপাের্টে প্রথম ৬ লাইন প্রকাশ করা হয়নি। রিপাের্টে জাতিসংঘে ভারতের ভূমিকা কী হতে পারে তা উঠে এসেছে। ১, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কূটনৈতিক ফ্রন্টে ভারত বেশ ভালাে করেছে। ভারত সােভিয়েত বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তির ফলে সােভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে ভারতকে সহায়তা করেছে। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের ভূমিকায় তিনি সন্তুষ্ট। যদিও চীন জাতিসংঘে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে তবুও এটা মারাত্মক কিছু নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আশা করেছেন চীন ভারতের উত্তর সীমান্তে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না। সােভিয়েত রাশিয়া লাদাখ এবং চমবাই এলাকায় তরবারি ঘুরাতে চীনকে সর্তক করে দিয়েছে। চীন যদি আক্রমণে এগিয়ে আসে তাহলে সােভিয়েত ইউনিয়ন কাউন্টার-ব্যালেন্স করবে। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত জাতিসংঘে যুদ্ধ বন্ধের জন্য আর একটি প্রস্তাব আনতে পারে। সােভিয়েত সেখানে ভেটো প্রয়ােগ করবে। সাধারণ পরিষদের কোনাে প্রস্তাব ভারত মানবে না যদি না : ক, বাংলাদেশ স্বাধীন না হয়, খ. আজাদ কাশ্মীরের দক্ষিণ অংশ মুক্ত না হয়, এবং গ. পাকিস্তান গােলন্দাজ এবং বিমান বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস হতে হবে যাতে পুনরায় তারা ভারতকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা না করতে পারে। ৪. এটা খুবই দুঃখজনক যে ভারতের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র উপমহাদেশ সম্পর্কে তাদের নীতির পরিবর্তন করেনি। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। জাতিসংঘে তা ঘােষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আশা করেন অচিরেই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলাে অতিশীঘ বাংলাদেশকে মুক্ত করা। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘে বিতর্ক তৎপরতা জোরদার করে বিশ্ব জনমতকে অনুকূলে রাখতে হবে। অঘােষিত যুদ্ধে সর্বাত্মক সক্রিয়তা বজায় রাখা অব্যাহত ও দ্রুততর করতে হবে। কেননা সােভিয়েত রাশিয়া ভারতকে জানিয়ে দিয়েছে। নতুন করে পুনরায় ভেটো ভােটে ক্ষমতা প্রয়ােগ করা যাবে না। ১০ই ডিসেম্বর হােয়াইট হাউসের এক বৈঠকে জাতিসংঘের স্পেশাল অ্যাসিস্টেন্ট পলমার্ক হেনরি অবহিত করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের রাও ফরমান আলী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট অনুমােদনের জন্য যে বার্তা পাঠিয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে জাতিসংঘের মাধ্যমে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ব্যবস্থা করা হােক এবং যাতে কোনাে প্রতিহিংসার ঘটনা না ঘটে তার গ্যারান্টি চাওয়া হয়।
 
কিন্তু কোনােক্রমেই আত্মসম্পূর্ণ নয়। ঐ বার্তায় এই ইঙ্গিত দেওয়া হয় এই যে, এই প্রস্তাব মানা হলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর শেষ মানুষটি জীবিত থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালাবে। এ সময় কিসিঞ্জার বলেন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানি সারেন্ডারের বিপক্ষে যেহেতু চীন। তাদের সঙ্গে আছে। প্রেসিডেন্ট সারেন্ডারের পক্ষে নয়। প্রয়ােজনে ভারতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কোনােক্রমেই পাকিস্তানকে ফেলে দিতে পারে না । ঐদিনই নিক্সন কিসিঞ্জারকে চীনা প্রতিনিধির সঙ্গে বসতে পরামর্শ দেন এই বলে যে, যদি সম্ভব হয় চীনা সামরিক বাহিনী ভারতের দিকে অগ্রসর হতে পারে কিনা অথবা তারা সৈন্য পাঠাচ্ছে বলে ভারতকে হুমকি দিতে পারে কিনা। সােভিয়েত প্রেসিডে ন্ট ব্রেজনেভের প্রস্তাবে যা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট পাঠানাে হয়েছিল, ইয়াহিয়া খান সে প্রস্তাবে যুদ্ধ বন্ধ, পারস্পরিক আলােচনার ভিত্তিতে সৈন্য প্রত্যাহার এবং আলােচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলেছেন। জাতিসংঘে পাকিস্তান প্রতিনিধি এ ধরনের সুস্পষ্ট প্রস্তাব ঘােষণা করেছে। কিন্তু ভারত এই মুহূর্তে জাতিসংঘে প্রকাশ্য ঘােষণা দিয়ে আলোচনায় বসতে অস্বীকার করেছে। আলােচনায় বসলেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি দল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করবে এবং পশ্চিম পাকিস্তান সেখানে শর্তারােপ করবে। এই উদ্যোগ তাদের নেয়া উচিত হবে না। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে নিক্সন বলেন, “we must never recognize Bangladesh until west Pakistan gives us the go ahead.” জাতিসংঘ অভিমুখে যাত্রার প্রাক্কালে লণ্ডনে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং বলেন, জাতিসংঘকে তিনি জানাবেন, বর্তমানে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণের অযােগ্য। বাংলাদেশ পরিস্থিতির মূল সমস্যা যতক্ষণ না মিটছে এবং বাংলাদেশের যুদ্ধবিরতির আলােচনায় যতক্ষণ না বাংলাদেশকে ডাকা হচ্ছে ততক্ষণ যুদ্ধবিরতি অবাস্তব বলে মনে হয়। তিনি আরাে বলেন, যতদিন প্রয়ােজন তার বেশি। একদিনও বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য থাকবে না। ১০ই ডিসেম্বর ভারতের বিদেশমন্ত্রী সিকিউরিটি কাউন্সিলে ভাষণ দেওয়ার জন্য নিউইয়র্কে আগমন করেন। সে সময় ভারতীয় কর্মকর্তাগণ জাতিসংঘে তাঁর ভাষণ প্রস্তুত করে রেখেছিলেন যা ছিল সংক্ষিপ্ত, সুনির্দিষ্ট এবং সুসংহত।
 
বিদেশমন্ত্রী ভাষণটি অবলােকন করে এটাকে নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, তার জন্য একটি দীর্ঘ ভাষণ তৈরি করতে। যে ভাষণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের উপর কীভাবে শােষণ-শাসন, অত্যাচার ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, হত্যাযজ্ঞ ও শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে তার বিশদ বর্ণনা দিতে বলেন। একই সাথে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতের সুস্পষ্ট কূটনৈতিক ভূমিকা করার নির্দেশ প্রদান করেন। সর্বমােট ৩০ পৃষ্ঠার ভাষণ তৈরি করা হয়।” ভাষণটি চারটি ভাষায় তা অনূদিত হয়। ভারতের বিদেশমন্ত্রী ১২ এবং ১৩ই ডিসেম্বর দুদিন দীর্ঘ সময় ধরে ভাষণ দেন। ১৪ তারিখের সকালে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পথে। পরবর্তীকালে সর্দার শরণ সিংহকে এই দীর্ঘ ভাষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য সময়ের প্রয়ােজন ছিল।” অন্যদিকে, তখন জাতিসংঘে চলছিল তুমুল বিতর্ক। বাংলাদেশ সংকট নিয়ে জাতিসংঘে প্রায় ১৭টি প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়। সাধারণ পরিষদে ৪টি এবং নিরাপত্তা পরিষদে ১৩টি। নিরাপত্তা পরিষদে ১২ই ডিসেম্বর থেকে ২১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রস্তাবগুলাে নিয়ে আলােচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত রাশিয়া এবং পােল্যান্ডের প্রস্তাবগুলাে ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব ছিল অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, পাকিস্তান ও ভারতের সৈন্য প্রত্যাহার এবং অনুকূল পরিবেশ তৈরি, যেন শরণার্থীরা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে সমর্থ হয়। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব যেন তার যথাযথ ভূমিকা রাখেন। মার্কিন নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণের কোনাে কথাই প্রস্তাবে ছিল না।  পক্ষান্তরে, সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাব ছিলাে সংক্ষিপ্ত এবং সুনির্দিষ্ট। প্রস্তাবে বলা হয়, সােভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বাস করে রাজনৈতিক সমাধান এ সকল সমস্যার নিরসন করতে পারে, সংঘর্ষ বন্ধ হবে এবং পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক কার্যক্রম বন্ধের প্রস্তাব দেন। চীনের প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য ভারতবিরােধী। আগ্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে ভারতকে পাকিস্তান ও দখলি এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা। উচিত। বিশ্বের সব দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন করা উচিত এবং ভারতের আগ্রাসন বন্ধে কার্যকর ভূমিকা নেয়ার কথা জোরের সঙ্গে উত্থাপন করে। ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং স্থায়ী সদস্য নয় এমন প্রতিনিধিগণ যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ প্রস্তাবের পদক্ষেপ নেয়। সমর্থন করেও কিছুটা দূরত্ব নিস্পৃহ থাকেন।
 
১৪ই ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করে। পােল্যান্ড। পােল্যান্ডের খসড়া প্রস্তাব : ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর। বক্তব্য শােনার পর পােল্যান্ড প্রস্তাব করেন যে, (ডিসেম্বর ১৪) ১. সংঘর্ষপূর্ণ পূর্বাঞ্চল। (পূর্ব পাকিস্তান) ক্ষমতা তাদেরকে হস্তান্তর করতে হবে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ শীঘ্রই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত দলের কাছেই। ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে; ২. ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হওয়া মাত্রই সকল এলাকায় পরিচালিত সশস্ত্রবাহিনীর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে এবং প্রাথমিকভাবে ৭২ ঘন্টার যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করতে হবে; ৩, প্রাথমিক যুদ্ধবিরতি অবস্থা চালু হওয়া মাত্রই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অবস্থান থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে। হবে; ৪, পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক যারা এখানে আছেন তারা পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক যারা পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসতে চায়, তাদেরকে জাতিসংঘের নেতৃত্বে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কারাে উপর বলপ্রয়ােগ করা যাবে না; ৫. ৭২ ঘন্টার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সৈন্যসংখ্যা গুটিয়ে নেওয়ার সাথে সাথে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হওয়া মাত্রই ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকেও পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সামরিক অভিযান বন্ধ করে দিতে হবে; এবং ৬. যুদ্ধে শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারত সরকার যে সমস্ত এলাকা দখল করেছে তা নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে নীতিগতভাবে আলােচনা করতে হবে যাতে ঐ এলাকা কেউ দখলে না থাকতে পারে।” ১৪ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক শুরু হলে কোনাে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলাে স্ব-স্ব দেশের সরকারের নির্দেশের জন্য পরবর্তী দিন পর্যন্ত সভা মুলতুবি করার আহ্বান জানান।  সিরিয়ার খসড়া প্রস্তাব : ১৫ই ডিসেম্বর। ১. পাকিস্তান সরকারকে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দেওয়ার উপর গুরুত্বারােপ করেছে; ২. সকল ফ্রন্টে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করা; পাকিস্তান ও ভারত স্বীয় সীমান্ত এলাকা এবং জম্বু কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে; ৩, মহাসচিবকে অতি শীঘই একজন বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরণের অনুরােধ করা হচ্ছে, যার দায়িত্ব হবেউপরােক্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা। পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করবেন। শরণার্থীদের স্বেচ্ছাপ্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবেন; এবং ৪. মহাসচিবকে অনুরােধ করা হচ্ছে।
 
তিনি যেন এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের কাউন্সিলকে তাগিদ দেন। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের খসড়া প্রস্তাব: ১৫ ডিসেম্বর। মানবজীবন রক্ষার্থে এবং ১৯৪৯। সালের জেনেভা কনভেনশনের প্রতিফলন ঘটাতে তাদের প্রস্তাব নিম্নরূপ: ১. ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং পশ্চিমাঞ্চলে সকল যুদ্ধাঞ্চলে সংঘর্ষ বন্ধে একই সাথে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি এবং সকল পক্ষের সংঘর্ষ এড়াতে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি; ২. পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে অবিলম্বে রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান। জানাচ্ছে; ৩, উপমহাদেশ অথবা বিশ্বের যেকোনাে স্থানে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এমন পরিস্থিতি হতে দূরে থাকার জন্য সকল সদস্যদের অনুরােধ করা হচ্ছে; ৪. অসুস্থ, যুদ্ধবন্দি এবং সাধারণ জনগণের জীবনকে ১৯৪৯-এর জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পরিচালিত করার লক্ষ্যে সকল প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সকলকে আহ্বান জানাচ্ছে; ৫. দুর্গতদের জন্য ত্রাণ, শরণার্থীদের পুনর্বাসন, তাদের নিরাপত্তা, বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মর্যাদা দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য কামনা করছে; ৬, মানবিক সমস্যা দূরীকরণে একজন বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরণের জন্য মহাসচিবকে আহ্বান জানাচ্ছে; ৭. এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনের জন্য যতাে শীঘ্র সম্ভব মহাসচিবকে অনুরােধ করছে।
 
| সােভিয়েত-এর খসড়া প্রস্তাব : ১৫ই ডিসেম্বর। ১, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সকল সংঘর্ষ এড়ানাের জন্য এবং অবিলম্বে যুদ্ধবন্ধের জন্য উভয়পক্ষকে আহ্বান জানায়; ২. পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান আনয়ন করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে; ৩. মানবজীবন রক্ষায় ও ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের প্রয়ােগ করার জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের। সকল প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আহ্বান জানাচ্ছে; ৪, এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিষদকে অবিলম্বে অবগত করানাের জন্য মহাসচিবকে অনুরােধ করছে; এবং ৫. সমস্ত এলাকায় শান্তি আনয়নে এই আলােচনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এছাড়া জাপান ও ইতালি যৌথভাবে একই ধরনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তবে এই প্রস্তাবের ৭নং অনুচ্ছেদের বৈশিষ্ট্য ছিল ভারত এবং পাকিস্তানের সম্মতিক্রমে সাংঘর্ষিক এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন, যারা পরিষদের প্রস্তাব ও জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী কাজ করবে। এসব প্রস্তাব আলােচনার পূর্বে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী। ভুট্টোকে জরুরি বিবৃতি দানের জন্য পরিষদের সভাপতি আহ্বান জানান। জুলফিকার আলী ভুট্টো ৮ই ডিসেম্বর ‘৭১ নিউইয়ক যাত্রা করেন। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত জায়গাগুলাে সম্পর্কে কিছু না হলেও অন্তত যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তা তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রয়াস চালান। যাত্রার প্রাক্কালে করাচি এয়ারপাের্টে আগত সমর্থক নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমরা থেমে থাকব না।” একই সঙ্গে তিনি জোরের সঙ্গে বলেন, প্রয়ােজনে আমরা পবিত্র পাকিস্তানের মাটি থেকে ভারতীয়দের কবলমুক্ত করতে হাজার বছর যুদ্ধ করবাে । ১১ই ডিসেম্বর নিউইয়র্কে ভুট্টো কিঞ্জিারের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিসিঞ্জার তাকে বলেন, “পাকিস্তান শুধুমাত্র চমৎকার কথা উচ্চারণের মাধ্যমে রক্ষা পাবে না। আমরা যে পাকিস্তানকে সাহায্য করব না তা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে রক্ষা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সব সময় পাশে থাকবে। আগামী ৪৮ ঘন্টা হচ্ছে সিদ্ধান্তমূলক সময়।” ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভুট্টো জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য রাখেন। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টোকে জরুরি বক্তব্য রাখার জন্য আহ্বান জানান।
 
ভারতের বিদেশমন্ত্রী সরদার শরণ সিংহ বক্তৃতার পরপরই তিনি বলেন, “সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি ভালাে ভালাে কথা বলা জন্য বা ভাষণ দেওয়ার। জন্য আসিনি। আমি যা বলছি বা বলতে চাই পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়ঙ্কর।” বক্তব্যের এক পর্যায়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে ভুট্টো বলেন, “আমরা অতীতের ভুলত্রুটি শুধরে নিতে প্রস্তুত। পাকিস্তান একটি আদর্শ। আমরা ফিজিক্যাল ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত। ১২০ মিলিয়ন জনগণ শেষ হয়ে যেতে পারে তারপরও নতুন করে নতুনভাবে আমরা নতুন পাকিস্তান গড়ে তুলবাে। এটা দুঃখজনক যে ভারত-পাকিস্তান আজ বর্বরােচিতভাবে পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে, একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করার কর্মে লিপ্ত। কিন্তু এটা অসম্ভব। পাকিস্তানের সাহসী জনগণ তাদের সম্মান, মর্যাদা ও স্বাধীনতা। রক্ষার জন্য মরণযুদ্ধ করবে। এ সব বিবেচনায় তিনি বলেন, আসুন বন্ধুত্বের হাত ধরে চলি।” ভুট্টো তার বক্তৃতা থামিয়ে তখনও বলেছেন, “বাংলাদেশের অস্তিত্ব কেবলমাত্র ভারত-সরকারের মুখে এটা কেবল তাদের মাথায় আছে, কিন্তু বাস্তবে এর কোনাে অস্তিত্ব ভুট্টো চিৎকার করে বলছিলেন, আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, মৃত্যুভয়ে আমরা ভীত নই। আমাদের জনগণ সাহসী। বিশ্বাস করুন, মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্র দখল করতে পারে, ডেনমার্ক, জার্মান, ফিনল্যান্ড সােভিয়েত ইউনিয়ন দখল করে নিতে পারে, কিন্তু ভারত কোনােভাবেই পাকিস্তান দখল করতে পারবে না। আমরা যুদ্ধ করবাে, প্রয়ােজনে হাজার বছর যুদ্ধ করবাে। অতীতে করেছি, এখনাে করবাে।” জুলফিকার আলী ভুট্টোর যুক্তরাষ্ট্র আগমনের পরপরই নিক্সন বিমানসজ্জিত পরমাণু জাহাজ ইন্টারপ্রাইজ ৭ম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যেতে নির্দেশ দেন। কিসিঞ্জার এই বলে ভুট্টোকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, ভারত-সােভিয়েত-এর আক্রমণ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করবে। ভুট্টো যখন দ্বিতীয়বারের জন্য জাতিসংঘে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী সারেন্ডার করার জন্য ভারতের সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট সিগন্যাল প্রেরণ করেন। বিষয়টি নিউইয়ক ভুট্টোর অজানা ছিল না। তারপরও বাইরে দৃঢ়তার ছাপ রেখে ভুট্টো জাতিসংঘে বলেন, পাঁচ দশ বছরের জন্য পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে নিলে কিছু আসে যায় না আমরা তা ফিরে নিয়ে আসবই পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অংশ।” 
 
পাকিস্তান ভারতের বিদেশমন্ত্রী সর্দার শরণ সিংহের দিকে আঙুলি তুলে বলেন, বিশ্বাস করুন, এটা ইতিহাসের প্রাথমিক শিক্ষা যা জনগণের তা জনগণ ফিরে পাবেই। ভারতের বিদেশমন্ত্রীর প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিগণকে নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য রাখতে দেওয়া হােক এবং তার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন। এটা একটি অবাস্তব কথা। কোনাে দেশই সে দেশের একটি পাটি প্রতিনিধিকে নিরাপত্তা পরিষদে বক্তৃতা দেবার সুযােগ করে দিতে পারে না। তাহলে কোনাে সময় শিখ আসবে, কোনাে সময় পাঞ্জাবি আসবে বা কখন ভারত থেকেই কিছু লােক এসে বলবে আমরা বক্তব্য দিতে চাই।  সর্দার শরণ সিংহ উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমরা শেষ পর্যন্ত, শেষ মানুষটি পর্যন্ত যুদ্ধ করব। ১৫ই ডিসেম্বর তৃতীয় এবং শেষ বারের মতাে এক বক্তৃতায় ভুট্টো বলেন, ঢাকার পতন হলে কি হবে? কিংবা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের পতন হলে কী আসে যায়? কী আসে যায় যদি সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের পতন ঘটে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর দিশেহারা নাটকীয়তা শিষ্টাচার ছড়িয়ে যায় ।
 
| জাতিসংঘের প্রেসিডেন্টকে সম্বােধন করে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, ভারতীয়  বিদেশমন্ত্রীকে ‘ডিসটিংগুইসড়’ বলে কেন সম্বােধন করেছেন? কেমন করে তিনি ডিসটিংগুইসড হলেন? তার হাতে রক্ত লেগে আছে, বুকে আছে প্রতিহিংসা। আর আমি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি জনগণের প্রতিনিধি, এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়েও শক্ত অবস্থানে জনগণ আমাকে এনেছে। আমরা আমাদের সন্তানদের বলে যাব-তারা তাদের সন্তানদের বলে যাবে-তবুও আমরা নতি স্বীকার করব না। আবেগজড়িত কণ্ঠে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, আমরা হাজার বছর যুদ্ধ করব। এরপর ভুট্টো পােলান্ডের উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবসমূহ টুকরাে টুকরাে ছিড়ে ফেলে জাতিসংঘ ত্যাগ করেন। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পােল্যান্ড উত্থাপিত প্রস্তাব টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেলার মাধ্যমে ভুট্টো যেন পাকিস্তানের দ্বিখণ্ডিত বাস্তবতার প্রতিফলন দৃশ্যমান করেন। ভুট্টোর এইসব দৃশ্য জাতিসংঘের সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ বিশেষকরে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপভােগ করেন। ভুট্টোর বক্তৃতার জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং। ভুট্টোর যােগ্যতার প্রশংসা করে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নির্বাচিত নেতা হিসেবে তাকে আমরা সম্মান করি এবং আশা করি যে, সামরিক জান্তা জনগণের। রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন হলে সমস্যার মূল কারণসমূহ দূর করে শান্তি, বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতা সম্ভব হবে।
 
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, ভারত একদিনের জন্যও যুদ্ধ চালু রাখতে চায় না। ভারত শুধু আত্মরক্ষার প্রয়ােজনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। তিনি সংকট ও যুদ্ধ নিরসনে তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেন। যার মাধ্যমে কার্যকরভাবে পরিস্থিতির মােকাবেলা করা যাবে : ক, বাংলাদেশের জনগণের অধিকার সম্পর্কে আলােচনার জন্য তাদের বক্তব্য শুনতে হবে; খ. যুদ্ধবিরতি নিষ্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশকে অংশিদার করার অধিকার তাদের রয়েছে; গ. ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনে গণরায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধান খুঁজে পেতে হবে। এর সঙ্গে তিনি বলেন, এর ফলে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান এবং ভারতের সৈন্য প্রত্যাহার করা ও কার্যকর আলােচনায় উভয় দেশের ভূখণ্ড বিষয়ে সমঝােতা হতে পারে। | ঐদিন সন্ধ্যা ৭:২০টায় নিরাপত্তা পরিষদের ১৬১৫ তম বৈঠক বসে। শুরুতেই চীনা প্রতিনিধি তার বক্তৃতায় পােল্যান্ডের উত্থাপিত প্রস্তাবকে আনুষ্ঠানিক ও আইনসঙ্গতভাবে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার লক্ষ্যে আনীত প্রস্তাব হিসেবে অভিহিত করেন। শ্রীলংকার প্রতিনিধি (সভাপতির আমন্ত্রীত) তাঁর বক্তৃতায় বলেন যে, “শ্রীলংকা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সমস্যার সমাধান কামনা করে।” তাঁর মতে, এই সমাধান এরূপ হওয়া চাই যেখানে বিজয় হবে ঝামেলামুক্ত, পরাজয় হবে গ্লানিবিহীন এবং সর্বোপরি শান্তি বিরাজ করবে। সােভিয়েত প্রতিনিধি পােল্যান্ডের প্রস্তাবকে সমর্থন জানান। সিরিয়ার প্রস্তাবে বলা হয় যে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে যাতে তারা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ম্যান্ডেট কার্যকর করতে সক্ষম হয়। সিরিয়ার প্রস্তাবের অনুরূপ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স পারস্পরিক আলােচনার পর একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে-যাতে উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের যুদ্ধবিরতির বিষয়টিকে পৃথকভাবে দেখানাে হয়।
 
সােভিয়েত প্রস্তাবে বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক সমঝােতার পৌছাতে হবে এবং একই সাথে যুদ্ধবিরতির ঘােষণাও দিতে হবে। এসব প্রস্তাব উত্থাপনের পর কোনাে দেশই ভােটগ্রহণের জন্য উৎসাহ দেখায়নি। তাই ১৬ই ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পরিষদের বৈঠক মুলতবি ঘােষণা করা হয়। ১৬ই ডিসেম্বর দুপুর ১২:০৫টায় নিরাপত্তা পরিষদের ১৬তম বৈঠক শুরু হয়। সভাপতির প্রাথমিক বক্তব্যের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (আমন্ত্রীত) সরদার শরণ সিং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি বিবৃতি পড়ে শােনান। এতে দুটো মূল বক্তব্য ছিল :১, ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ঘটেছে, যার ফলে সংঘর্ষের আর কোনাে কারণ নেই; ২. অতিরিক্ত রক্তক্ষয়, জীবনহানি বন্ধে পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের যুদ্ধবিরতি ঘােষিত হয়েছে। বাংলাদেশে যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন, নিরাপত্তা পরিষদে উদ্ভূত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংবাদটি খুবই প্রাসঙ্গিক। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতির ঘােষণা দেয়ার সময় পাকিস্তানের প্রতিনিধি অনুপস্থিত ছিলেন। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রস্তাবে তাদের উদ্যোগ ও তাগাদা ছিল না।  জাতিসংঘের সমস্ত পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কিসিঞ্জার এই সময় ফারল্যান্ডের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে একতরফা যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। ইয়াহিয়া খান বেকায়দায় পরে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করেন।  বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং ভারতের একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘােষণার পরও নিরাপত্তা পরিষদে একটি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বির্তক অব্যাহত থাকে। শেষাবধি ২১ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের ৭টি অস্থায়ী সদস্য দেশের উত্থাপিত প্রস্তাবটি পাস হয়ে যায়। যখন এ প্রস্তাব বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের জন্য কোনাে ভূমিকাই। রাখতে পারেনি।
 
উপসংহার
 
জাতিসংঘের বিভিন্ন তথ্য ও দলিলপত্র থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দক্ষিণ এশিয়ার এই সংকট নিয়ে বড় ধরনের সংঘর্ষ হতে পারে সে বিষয়ে প্রথমদিকে পরাশক্তিগুলাের ধারণা স্পষ্ট ছিল না। যদিও রুশ-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ কমবেশি দু’পক্ষে বিভক্ত, তবুও তৎসময়ে বিশ্ব পরিসরে ‘দাতাত’-এর আলােচনা চলছিলাে, ফলে আগ্রাসী মনােভাব স্থিত ও ভারসাম্যমূলক অবস্থায় বিদ্যমান ছিল। যার প্রেক্ষিতে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে স্ব-স্ব রাষ্ট্রের নীতিগত ও স্বার্থগত দিকটি প্রধান হয়ে উঠছিল। তবে পরাশক্তির সর্বাত্মক ভাবনার বিষয়টি ছিল বড় ধরনের আন্তঃদেশীয় সংঘর্ষ জড়িয়ে না পড়া। বাংলাদেশের মূল সমস্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের প্রতি তাদের তেমন আগ্রহ ও আস্থা প্রকাশ করেননি। বরং প্রথমদিকে শরণার্থীকেন্দ্রিক তৎপরতার জটিলতা নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানের পথে যুক্তরাষ্ট্রকে জাতিসংঘের দিকে হাত বাড়াতে হয়। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ে যা জাতিসংঘে তাদের নানা প্রকাশ্যঅপ্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের ভেতরে প্রতিফলিত। অন্যদিকে, সােভিয়েত রাশিয়া ভারতের ঘনিষ্ট মিত্র হওয়ার ফলে এবং ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান ও ভারতের কূটনৈতিক যুদ্ধ যখন সামরিক যুদ্ধে পরিণত হয় তখন সােভিয়েত ইউনিয়নের জাতিসংঘ ভেটো প্রদানের মাধ্যমে এটিই প্রমাণ করতে চেয়েছে বিষয়টি শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বাংলাদেশ সংকট ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ যা তাদের বিঘােষিত নীতি তার থেকে তারা পিছু হটবে না। শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের কূটনৈতিক বলয়কে ছাড়িয়ে সামরিক যুদ্ধের দিকে নাটকীয়ভাবে ধাবিত হচ্ছিলাে এবং যা বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকির কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। যদিও যুক্তরাষ্ট্র লুকিয়ে (Cover) ও প্রকাশ্যে (Over) কূটনীতির মাধ্যমে পাকিস্তানের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যেন পাকিস্তানের ভৌগােলিক অখণ্ডতা পুরােপুরি রক্ষা পায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত মার্কিন কূটনীতি এতটুকু সফল হয়েছে যে, তাদের শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগােলিক অখণ্ডতা নিয়েই সর্বশেষ কূটনৈতিক তৎপরতায় সন্তুষ্ট থাকতে হয়।  মূলত সােভিয়েত রাশিয়ার ভেটো প্রদান ঢাকা দখলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
 

কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সামরিক ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র প্রেরিত সপ্তম নৌবহর মােকাবেলায় সােভিয়েত পাল্টা নৌবহর পাঠিয়ে একথা প্রমাণের চেষ্টা করে যে, যেকোনাে ভাবেই হােক বিশ্বশক্তির ভারসাম্যের মাধ্যমে বৃহৎ আকারে যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে দুই পরাশক্তির ভাবনার বিষয় ছিল চীনের ভূমিকা কী হবে। সেজন্য লক্ষ্য করা যায় জাতিসংঘ বলয় ও তার বাইরে মার্কিন নীতি-নির্ধারকগণ চীনের সঙ্গে সংলাপ ও সংযােগ রেখে চলেছে। যদিও সােভিয়েত রাশিয়ার চাপে শেষ পর্যন্ত চীনের তেমন কিছু করণীয় ছিল না এজন্য যে, সােভিয়েত রাশিয়া চীন সীমান্তে ব্যাপক সেনা সমাবেশ করেছিল। সেজন্য জাতিসংঘে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে চীনের বৈরিতা শুধু চেচামেচির ভেতরে সীমাবদ্ধ ছিল। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে জাতিসংঘ চত্বরে  ভারতের ভূমিকা ছিল পরিকল্পিত ও পরিপক্ক : ঢাকা দখলের সাথে সাথে ভারত স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে তার ত্বরিত কূটনৈতিক বিজ্ঞতার প্রমাণ করে।  জাতিসংঘের সামগ্রিক পরিকল্পনায় শরণার্থীদের মানবিক বিষয়টি যেভাবে ক্রমান্বয়ে আলােড়িত এবং পর্যায়ক্রমে যা রাজনৈতিক সমাধানের কেন্দ্রে এসে দাঁড়ায়, তার শেষাংশে বাংলাদেশ প্রশ্নটি অপ্রত্যক্ষভাবে হলেও কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রবলভাবে চলে এসেছে। জাতিসংঘের কার্যকরভূমিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটি গৌণ থাকলেও বিশ্ব কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তা ছিল জীবন্ত, আলােড়িত এবং পরাশক্তি ও রাষ্ট্রগুলাের নিরবিচ্ছিন্ন অব্যক্ত কূটনৈতিক যন্ত্রণা। জাতিসংঘ বাংলাদেশ সংকট সমাধানে কার্যকর প্রস্তাব, ভূমিকা ও উদ্যোগ গ্রহণের পূর্বেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে।

 
 

সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কূটনৈতিক যুদ্ধ – আবু সাইয়িদ