পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলেন, উপমহাদেশে যে সমস্যা উদ্ভব হয়েছে তা ভারতের নাশকতা, অস্ত্র সমর্থন এবং আগ্রাসনের কারণে। তিনি বলেন, ভারতের আক্রমণের কারণে পাকিস্তান সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিনিধির প্রশ্ন। উত্থাপন করেন, পরিষদ তথাকথিত বাস্তবতাকে বৈধতা দেবে? এবং জবরদস্তি দখল, আক্রমণ এবং অবৈধ শক্তি প্রয়ােগকে বৈধতা দেবে কিনা। | চীনের প্রতিনিধি বলেন, সােভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে ভারত পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার জন্য বাংলাদেশকে সৃষ্টি করেছেন। | সােমালিয়ার প্রতিনিধি নীতিগতভাবে একদেশ থেকে অন্যদেশ দেশের শত্রু সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি সমঝােতার বিষয় নয়। সামরিক উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান অন্যদেশ চাপিয়ে দিতে পারে না। সময় এসেছে প্রশ্নটি সাধারণ পরিষদে স্থানান্তরিত করা। যেমনটি হয়েছিল ১৯৫০ সালের ৩রা নভেম্বরে। (৩৭৭অ(৫)) প্রস্তাবে সাধারণ পরিষদে শান্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রস্তাব গৃহীত হয়। * যা পরবর্তী পর্যায়ে আলােচনায় উঠে আসবে। বাংলাদেশকে অস্বীকার করার কৌশল : শান্তির জন্য ঐক্য ফর্মুলা জতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অচলাবস্থার অবসানে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য। সাধারণ পরিষদ একটি গ্রহণযােগ্য ফর্মুলার অন্বেষণে ব্যস্ত থাকে। কয়েকটি দেশ জাতিসংঘের চত্বরে আনুষ্ঠানিক আলােচনা শুরু করে। নিকরাগুয়ার প্রতিনিধি সেভিল্লা। সাকাসা নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, “যদি আমরা কোনাে কিছু করতে ব্যর্থ হই, তবে সাধারণ পরিষদ উদ্যোগ নিতে পারে। কারণ এটা মনে করার কারণ নেই যে, কেবল নিরাপত্তা পরিষদই আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রশ্নে উদৃবিগ্ন থাকবে।” এই ধারণা থেকে নিরাপত্তা পরিষদের ছয়টি দেশ আর্জেন্টিনা, বুরুন্ডি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরে, লিওন ও সােমালিয়া ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ নিরাপত্তা পরিষদের ১৬০৬ ও ১৬০৭ বৈঠকে ঐক্যমতের প্রস্তাব গ্রহণের ব্যর্থ হওয়ায় একত্রে একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে। খসড়া প্রস্তাবের সুপারিশে বলা হয়, উক্ত বৈঠকসমূহে ঐক্যমত হওয়ায় ১৯৫০ সালে সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব (377 A(V)) অনুযায়ী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে প্রেরণ করা হােক।”
এই প্রস্তাব উত্থাপনের পর নিরাপত্তা পরিষদে সংক্ষিপ্ত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। প্রস্ত বিটির উপর বিতর্ক অনুষ্ঠানকালে সােভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স ও ব্রিটেন ও অস্থায়ী সদস্য পােল্যান্ড ভিন্ন মত প্রকাশ করে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যবৃন্দ অবগত ছিলেন যে, এই প্রস্তাবের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র শক্তভাবে পৃষ্ঠপােষকতা করেছে। ছয় জাতি উত্থাপিত এই প্রস্তাব ৬ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হয়। নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টকে জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি একটি পত্র লেখেন। পত্রটিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনােভাব ও নীতি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। পলাে বলা হয়েছে, ভারত উপমহাদেশে যুদ্ধ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতােমধ্যে নিরাপত্তা পরিষদের ১৬০৬, ১৬০৭, ১৬০৮ তারিখে বৈঠকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছে। সে লক্ষ্যে সাধারণ পরিষদ ৭ই ডিসেম্বরের বৈঠকে সংকট অবস্থা নিরসনে ‘শান্তির জন্য ঐক্য ফর্মুলা ১০৪ ভােট পক্ষে, ১১ ভােট বিপক্ষে এবং ১০ রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থেকেছে এবং ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য উভয় পক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে। পাকিস্তান প্রস্তাব মেনে নিয়েছে, ভারত এখন পর্যন্ত তা মেনে নেয়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন নিরাপত্তা পরিষদের বিশ্বশান্তি স্থাপন ও হুমকি মােকাবিলায় অবিলম্ব দায়িত্ব রয়েছে। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ হতে তিনি অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদের সভা ডাকার আহ্বান জানান। উপমহাদেশের যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মত সিদ্ধান্তগ্রহণে ব্যর্থ হলে বিষয়টি সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করা যায় কি না সে-সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদের ১১টি সমমনা রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলােচনা করে। এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলাে নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৫০ সালের ৩ নভেম্বরের প্রস্তাবনা অনুযায়ী। এটি সাধারণত ‘শান্তির জন্য ঐক্য ফর্মুলা’ নামে পরিচিত। এ চিন্তা থেকেই নিরাপত্তা পরিষদের ৬টি দেশ যথাক্রমে আর্জেন্টিনা, বুরুন্ডি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরােলিওন ও সােমালিয়া পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং বিষয়টির জন্য সুপারিশ করে। ৬টি দেশ এই প্রস্তাব উত্থাপনের পর নিরাপত্তা পরিষদে একটি সংক্ষিপ্ত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।
পরিষদের সভাপতি এই খসড়া প্রস্তাবের উপর বিতর্কের অবসানের জন্য ভােট গ্রহণ করেন। ভােটে কোনাে দেশ ভেটো না দেওয়ায় এই প্রস্তাব পাস হয় এবং পাসের পর জাতিসংঘ উপমহাদেশে যুদ্ধবন্ধের লক্ষ্যে ‘শান্তির জন্য ঐক্য ফর্মুলা’ প্রয়ােগের জন্য কার্যক্রম শুরু করে। | ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদে গৃহীত ‘শান্তির জন্য ঐক্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গৃহীত হলেও যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নির্দেশ মােতাবেক ১২ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট বরাবর নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকার আহ্বান জানান। ঐদিন বিকাল চারটায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে নিরাপত্তা পরিষদের ১৬১১তম বৈঠক বসে। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ এক প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতের প্রতি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। প্রস্তাবে বলা হয়, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত আছে কিন্তু ভারত এখন পর্যন্ত নিঃশর্তভাবে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেনি। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ১৩ই ডিসেম্বর সােভিয়েত রাশিয়া ভেটো প্রয়ােগ করে। পাকিস্তানের প্রতিনিধি ভুট্টো দীর্ঘ বক্তৃতায় অতীতের মতাে ভারতের আগ্রাসন থেকে পাকিস্তানকে রক্ষায় জাতিসংঘের ব্যর্থতার সমালােচনা করেন। ১২ই ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং তার বক্তব্য প্রদান শুরু করে। তার পক্ষ থেকে বলা হয়, একপক্ষ কালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার মর্মান্তিক ঘটনাবলি দ্বিতীয়বারের মতাে নিরাপত্তা পরিষদে আলােচনা শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিশেষজ্ঞগণ। মনে করেন, ৭ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস হওয়ার ফলে ভারত উদৃবিগ্ন হয়ে ওঠে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তড়িঘড়ি করে পুনরায় জাতিসংঘে ফিরে আসতে হয় । যেকোনাে সচেতন পাঠকমাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীর্ঘ ভাষণ প্রদান করেন। এই দীর্ঘ ভাষণ প্রদানের লক্ষ্য ছিল এই সময়ের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশ মিত্রবাহিনী যেন বাংলাদেশ কজা করতে পারে এবং নিরাপত্তা পরিষদ কোনাে রকম হস্তক্ষেপ করার সুযােগ না পায়, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণের বক্তব্য ছিল, সাধারণ পরিষদে আলােচনার শেষ পর্যায়ে গৃহীত প্রস্তাবে ভারত উপমহাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আলােচনা করেছে সম্ভবত তা ছিল অবাস্তব। কেননা সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে আলােচনা হয়নি।
তিনি বাংলাদেশের জনগণের উপরে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর অবর্ণনীয় নির্যাতন ও সামরিক শাসনের বিস্তারিত উল্লেখ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশের মন্তব্য খণ্ডন করে বলেন, ভারত সবসমই সহযােগিতার হাত সম্প্রসারিত করে আছে। যদি জাতিসংঘ বাস্তব অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে আসতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের আহ্বান বাস্তব সম্মত হবে যদি বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত রয়েছে কেন সে সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নিকট থেকে শুনতে দেওয়া হয়।” ১২ই ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে। হেনরি কিসিঞ্জার সভাপতিত্ব করেন। আলােচনায় শুরুতে সি.এ.আই. রিপাের্টের পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে বিদ্যমান পরিস্থিতির ওপরে সি.আই.এ উত্থাপিত পরস্পরবিরােধী রিপাের্ট পর্যালােচনা করা হয়। সিআইএ ভারতের দখলকৃত পূর্ব পাকিস্তান এলাকা মানচিত্রে দেখাতে সম্মত হয়। প্রেসিডেন্ট ৯৯ মিলিয়ন ডলারের সাথে সংশ্লিষ্ট আর কোনাে অপ্রত্যাহারযােগ্য ঋণপত্র ইস্যু এবং ৭২ মিলিয়ন ডলারের পিএল ৪৮০ ঋণ কার্যকর করার লক্ষ্যে নতুন কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বানের উদ্দেশ্যে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য বিকালে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের সাথে আনুষঙ্গিক আলােচনার পরিকল্পনা করা হয়। এসময় নিক্সন প্রশাসন কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং যেটি করা হয় নিক্সনের ইচ্ছানুসারে। এ সময় স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা উইলিয়াম বিশ্ব জনমতের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি প্রেসিডেন্ট ভেবে দেখেছেন কিনা প্রশ্ন তােলেন। কিসিঞ্জার জবাবে পরিষ্কার করে বলেন যে, উপমহাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির। পরিপ্রেক্ষিতে নতুন অর্থ সাহায্য স্থগিত রাখা হয়েছে। কিসিঞ্জার আরাে বলেন, এসময় যুক্তরাষ্ট্রের কাজ হলাে জাতিসংঘের দিকে হাত বাড়ানাে। এই লক্ষ্যে জাতিসংঘকে সক্রিয় করার জন্য অগ্রসর হন এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠান এবং কিসিঞ্জার তার মন্তব্য জুড়ে দেন যে, এই ধরনের পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ যদি কার্যকর ভূমিকা না রাখতে পারে, তাহলে বলতেই হবে যে, এর কার্যকারিতা ফুরিয়ে গেছে এবং মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে জাতিসংঘের দেওয়া নিশ্চয়তা অর্থহীন হয়ে গেছে।
এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বানের পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। কিসিঞ্জার আরাে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে, কিন্তু নিরপত্তা পরিষদের মূল কাজ হলাে সামরিক তৎপরতা বন্ধ করা, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে থাকা ? বৈঠকে অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনুরােধ জানাবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তৃতার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হবে। জাতিসংঘের কর্মকাণ্ডে মার্কিন সরকারের পক্ষপাতি থাকবে পাকিস্তানের দিকে। পাকিস্তানের প্রতি বর্তমানে বহাল অর্থনৈতিক সাহায্য বাতিল করা হবে না। কিসিঞ্জারের ভাষ্য ছিল, ভারত সর্বাত্মক আক্রমণ ঘােষণা করলে জাতিসংঘ প্রতিবেদনে অবশ্যই তার প্রতিফলন ঘটা উচিত । ডি। পালমা পরামর্শ দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি জাতিসংঘ আলােচনায় ভারতের বিরুদ্ধে। ঘোষণার প্রসঙ্গ টানা হয়, তাহলে তাদের অবশ্যই ইয়াহিয়া মন্তব্যের কথাও উল্লেখ করতে হবে। এসময় পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা করেছে, কিন্তু ভারত তেমনটি ঘােষণা দেয়নি। এ প্রসঙ্গে কিসিঞ্জার জানতে চান জাতিসংঘে কী হচ্ছে। এর উত্তরে ডি পালমা জানান যে, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, জাপান ও সম্ভবত ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। সভা আহবানের জন্য আমাদের অনুরােধ সম্বলিত চিঠিতে জাপান কিঞ্চিৎ পক্ষপাতিত্ব খুঁজে পেয়েছে। জাপানিরা শান্তিপূর্ণ আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য জাপানিদের কাছে। তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। এ কথায় ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কিসিঞ্জার। বলেন, জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অবশ্যই পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে হবে। জাতিসংঘের মার্কিন রাষ্ট্রদূত বুশ যদি বুঝতে পারেন কী তার বলা উচিত, তাহলে অন্য। কে কী মনে করল, সেটার পরােয়া তিনি করেন না। ডি পালমা জানান যে, নিরাপত্তা পরিষদের সভা (সেদিন) বিকালে না সন্ধ্যায় আহ্বান করা হবে, সেটা তার জানা নেই। সভার প্রাথমিক বিবৃতিগুলাে অবশ্য ভারতীয় ও পাকিস্তানিরাই দেবে। তিনি পরামর্শ দেন যে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ দুটোর বিবৃতি শেষ হয়ে যাবার পর প্রথমদিকেই রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তব্য দেওয়া উচিত। শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানিয়ে দিলে সেটার প্রভাব বেশি হবে বলে তিনি মনে করেন। কিসিঞ্জার এতে কোনাে আপত্তি করেননি। এ সময় ডি পালমারের বক্তব্য ছিল বিবৃতি প্রকাশ করার আগেই অন্যদেরকে সময় লাগলেও পক্ষে আনতে চাই কি না।
কিসিঞ্জার পরামর্শ দেন। যে, এভাবে এগুনাের চেয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, প্রয়ােজনে এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতি দিয়ে ফেলা উচিত। কিসিঞ্জারের মত অনুসারে, একমাত্র যে পথটি বর্তমানে খােলা আছে তা হল, যুক্তরাষ্ট্র বৃহত্তর স্ট্রাটেজির প্রেক্ষিতে তাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করা।’ সকলে জানেন, কীভাবে এটা ঘটবে এবং সকলেই এটাও জানেন যে, ভারত শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেবে। কাজেই, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ব্যক্ত করে তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত আলােচনার জন্য উপস্থাপন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়ােজন একটি সিদ্ধান্ত যা রাষ্ট্রদূত বুশ তাঁর বক্তৃতার মাধ্যমে ঘােষণা করবেন। অন্যেরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আসতে চায়, তা হবে চমৎকার। কিন্তু যে। কোনাে অবস্থায় রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তব্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করতে হবে। | কিসিঞ্জার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ব্যক্ত করাটা জরুরি। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবার আশঙ্কা প্রবল, কারণ সােভিয়েতরা ভেটো প্রয়ােগ করতে পারে। এই যুদ্ধ বন্ধ করতে জাতিসংঘেরও খুব সামান্যই করণীয় আছে। তিনি যা বলেন, তার সারসংক্ষেপ হলাে এই যে, তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তৃতার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত জাতিসংঘে প্রকাশ করা হবে এবং সেটা অবিলম্বে। পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যমান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে সাধারণ আলােচনায় যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই অংশ নেবে, কিন্তু কোনাে নির্দিষ্ট পরামর্শ, যেমন: মুজিবের মুক্তি, সে প্রস্তাব তারা দেবে না। জাতিসংঘে ভারতীয় কৌশল নিয়ে আলােচনা: কিসিঞ্জার জানতে চান, নিরাপত্তা পরিষদে ভারতীয়রা কাজ শুরু করতে কতটা দেরি করতে পারে। ডি পালমা বলেন, তারা দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে পারে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। ফন হেলেন বলেন যে, তারা যতটা সম্ভব প্রলম্বিত করবে, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে তারা মনােসংযােগ করতে সমর্থ হবে। ডি পালমা বলেন, তারা বড়জোর। তিন-চারদিন দ্বিধাগ্রস্ত থাকবে যা, হেমসের মতে, তাদের পূর্ব পাকিস্তান দখল করার পক্ষে যথেষ্ট সময়। ডি পালমা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই ভােটের জন্য চাপ প্রয়োেগ করতে পারে। কিসিঞ্জার পুনরাবৃত্তি করেন যে, জাতিসংঘ থেকে লাভজনক কিছু পাওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই। কেননা ডি পালমার অভিমত ছিলাে, কোনাে না কোনাে পক্ষের ভেটো দেবার আশঙ্কা খুবই প্রবল।
ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের প্রকাশ্যঅপ্রকাশ্য কূটনৈতিক তৎপরতা দৃশ্যত অকার্যকর হয়ে যায়। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে যে, এ সময় যুক্তরাষ্ট্র যেমন জাতিসংঘকে সামনে রেখে তাদের সুনির্দিষ্ট কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে তৎপর ছিল, তেমনি গােপনে সামরিক কূটনীতি জোরদার করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের গােপন নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ভারত পূর্বাঞ্চলে লড়াই জোরদার হয়েছে। ভারত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে তেমন সাফল্য অর্জন করেনি যদিও তারা আকাশ পথ কজা করেছে, নৌ-যুদ্ধে পাকিস্তানকে বেকায়দায় ফেলেছে এবং মস্কোর উত্তরােত্তর জোরালাে ও প্রকাশ্য সাহায্য জোরদার হয়েছে এবং জাতিসংঘে কোনাে . উদ্যোগকে বিশেষকরে লড়াই বন্ধের বিষয়ে সমর্থন দেয়নি।
কিসিঞ্জার এ সময় জাতিসংঘের উদ্যোগ প্রসঙ্গে অবগত হন। তাকে বলা হয়, নিরাপত্তা পরিষদের দুটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সােভিয়েত ভেটো প্রয়ােগ করেছে। এই অবস্থা নিরসনে সাধারণ পরিষদে ‘শান্তির জন্য ঐক্য সংক্রান্ত ধারার আওতায় একটি জরুরি সভা আহ্বানের ভিত্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। সভায় উল্লেখ করা হয় যে, ১৩৬টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বে এই পরিষদের যেকোনাে প্রতিকুলতা মােকাবেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে ডি, পালমা বলেন, ৩.৩০ মিনিটে যে। কাউন্সিলের একটি সভা আছে সেখান থেকে সমস্যাটি সাধারণ পরিষদে স্থানান্তর করতে হবে। কারণ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হচ্ছে না এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত’ । কিসিঞ্জার বলেন, ভারতীয়দের প্রতি নিস্পৃহ আচরণ এবং তাদের খুব। একটা সম্মান যুক্তরাষ্ট্র দেখাবে না। অবশ্য পালমা বলেন, সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব। উথাপনের পর ঘটনার নতুন মােড় নেবে। সেক্ষেত্রে ভারত আর সমস্যার রাজনৈতিক নিষ্পত্তির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবে না। কারণ এটা কোনাে সমস্যা বলে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়ােজন হবে না। তারপরেও কিসিঞ্জার বলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিশ্চিতভাবে চান না পাকিস্তান পরাজিত হােক। এরজন্য সামরিক কূটনীতি পরিচালনা পরিচালিত হবে গোপনে।
এসময় সিআইএ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে একটি গােপন রিপাের্ট তৈরি করে। রিপাের্টে প্রথম ৬ লাইন প্রকাশ করা হয়নি। রিপাের্টে জাতিসংঘে ভারতের ভূমিকা কী হতে পারে তা উঠে এসেছে। ১, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কূটনৈতিক ফ্রন্টে ভারত বেশ ভালাে করেছে। ভারত সােভিয়েত বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তির ফলে সােভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে ভারতকে সহায়তা করেছে। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের ভূমিকায় তিনি সন্তুষ্ট। যদিও চীন জাতিসংঘে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে তবুও এটা মারাত্মক কিছু নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আশা করেছেন চীন ভারতের উত্তর সীমান্তে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না। সােভিয়েত রাশিয়া লাদাখ এবং চমবাই এলাকায় তরবারি ঘুরাতে চীনকে সর্তক করে দিয়েছে। চীন যদি আক্রমণে এগিয়ে আসে তাহলে সােভিয়েত ইউনিয়ন কাউন্টার-ব্যালেন্স করবে। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত জাতিসংঘে যুদ্ধ বন্ধের জন্য আর একটি প্রস্তাব আনতে পারে। সােভিয়েত সেখানে ভেটো প্রয়ােগ করবে। সাধারণ পরিষদের কোনাে প্রস্তাব ভারত মানবে না যদি না : ক, বাংলাদেশ স্বাধীন না হয়, খ. আজাদ কাশ্মীরের দক্ষিণ অংশ মুক্ত না হয়, এবং গ. পাকিস্তান গােলন্দাজ এবং বিমান বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস হতে হবে যাতে পুনরায় তারা ভারতকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা না করতে পারে। ৪. এটা খুবই দুঃখজনক যে ভারতের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র উপমহাদেশ সম্পর্কে তাদের নীতির পরিবর্তন করেনি। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। জাতিসংঘে তা ঘােষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আশা করেন অচিরেই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলাে অতিশীঘ বাংলাদেশকে মুক্ত করা। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘে বিতর্ক তৎপরতা জোরদার করে বিশ্ব জনমতকে অনুকূলে রাখতে হবে। অঘােষিত যুদ্ধে সর্বাত্মক সক্রিয়তা বজায় রাখা অব্যাহত ও দ্রুততর করতে হবে। কেননা সােভিয়েত রাশিয়া ভারতকে জানিয়ে দিয়েছে। নতুন করে পুনরায় ভেটো ভােটে ক্ষমতা প্রয়ােগ করা যাবে না। ১০ই ডিসেম্বর হােয়াইট হাউসের এক বৈঠকে জাতিসংঘের স্পেশাল অ্যাসিস্টেন্ট পলমার্ক হেনরি অবহিত করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের রাও ফরমান আলী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট অনুমােদনের জন্য যে বার্তা পাঠিয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে জাতিসংঘের মাধ্যমে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ব্যবস্থা করা হােক এবং যাতে কোনাে প্রতিহিংসার ঘটনা না ঘটে তার গ্যারান্টি চাওয়া হয়।
কিন্তু কোনােক্রমেই আত্মসম্পূর্ণ নয়। ঐ বার্তায় এই ইঙ্গিত দেওয়া হয় এই যে, এই প্রস্তাব মানা হলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর শেষ মানুষটি জীবিত থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালাবে। এ সময় কিসিঞ্জার বলেন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানি সারেন্ডারের বিপক্ষে যেহেতু চীন। তাদের সঙ্গে আছে। প্রেসিডেন্ট সারেন্ডারের পক্ষে নয়। প্রয়ােজনে ভারতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কোনােক্রমেই পাকিস্তানকে ফেলে দিতে পারে না । ঐদিনই নিক্সন কিসিঞ্জারকে চীনা প্রতিনিধির সঙ্গে বসতে পরামর্শ দেন এই বলে যে, যদি সম্ভব হয় চীনা সামরিক বাহিনী ভারতের দিকে অগ্রসর হতে পারে কিনা অথবা তারা সৈন্য পাঠাচ্ছে বলে ভারতকে হুমকি দিতে পারে কিনা। সােভিয়েত প্রেসিডে ন্ট ব্রেজনেভের প্রস্তাবে যা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট পাঠানাে হয়েছিল, ইয়াহিয়া খান সে প্রস্তাবে যুদ্ধ বন্ধ, পারস্পরিক আলােচনার ভিত্তিতে সৈন্য প্রত্যাহার এবং আলােচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলেছেন। জাতিসংঘে পাকিস্তান প্রতিনিধি এ ধরনের সুস্পষ্ট প্রস্তাব ঘােষণা করেছে। কিন্তু ভারত এই মুহূর্তে জাতিসংঘে প্রকাশ্য ঘােষণা দিয়ে আলোচনায় বসতে অস্বীকার করেছে। আলােচনায় বসলেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি দল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করবে এবং পশ্চিম পাকিস্তান সেখানে শর্তারােপ করবে। এই উদ্যোগ তাদের নেয়া উচিত হবে না। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে নিক্সন বলেন, “we must never recognize Bangladesh until west Pakistan gives us the go ahead.” জাতিসংঘ অভিমুখে যাত্রার প্রাক্কালে লণ্ডনে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং বলেন, জাতিসংঘকে তিনি জানাবেন, বর্তমানে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণের অযােগ্য। বাংলাদেশ পরিস্থিতির মূল সমস্যা যতক্ষণ না মিটছে এবং বাংলাদেশের যুদ্ধবিরতির আলােচনায় যতক্ষণ না বাংলাদেশকে ডাকা হচ্ছে ততক্ষণ যুদ্ধবিরতি অবাস্তব বলে মনে হয়। তিনি আরাে বলেন, যতদিন প্রয়ােজন তার বেশি। একদিনও বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য থাকবে না। ১০ই ডিসেম্বর ভারতের বিদেশমন্ত্রী সিকিউরিটি কাউন্সিলে ভাষণ দেওয়ার জন্য নিউইয়র্কে আগমন করেন। সে সময় ভারতীয় কর্মকর্তাগণ জাতিসংঘে তাঁর ভাষণ প্রস্তুত করে রেখেছিলেন যা ছিল সংক্ষিপ্ত, সুনির্দিষ্ট এবং সুসংহত।
বিদেশমন্ত্রী ভাষণটি অবলােকন করে এটাকে নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, তার জন্য একটি দীর্ঘ ভাষণ তৈরি করতে। যে ভাষণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের উপর কীভাবে শােষণ-শাসন, অত্যাচার ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, হত্যাযজ্ঞ ও শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে তার বিশদ বর্ণনা দিতে বলেন। একই সাথে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতের সুস্পষ্ট কূটনৈতিক ভূমিকা করার নির্দেশ প্রদান করেন। সর্বমােট ৩০ পৃষ্ঠার ভাষণ তৈরি করা হয়।” ভাষণটি চারটি ভাষায় তা অনূদিত হয়। ভারতের বিদেশমন্ত্রী ১২ এবং ১৩ই ডিসেম্বর দুদিন দীর্ঘ সময় ধরে ভাষণ দেন। ১৪ তারিখের সকালে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পথে। পরবর্তীকালে সর্দার শরণ সিংহকে এই দীর্ঘ ভাষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য সময়ের প্রয়ােজন ছিল।” অন্যদিকে, তখন জাতিসংঘে চলছিল তুমুল বিতর্ক। বাংলাদেশ সংকট নিয়ে জাতিসংঘে প্রায় ১৭টি প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়। সাধারণ পরিষদে ৪টি এবং নিরাপত্তা পরিষদে ১৩টি। নিরাপত্তা পরিষদে ১২ই ডিসেম্বর থেকে ২১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রস্তাবগুলাে নিয়ে আলােচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত রাশিয়া এবং পােল্যান্ডের প্রস্তাবগুলাে ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব ছিল অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, পাকিস্তান ও ভারতের সৈন্য প্রত্যাহার এবং অনুকূল পরিবেশ তৈরি, যেন শরণার্থীরা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে সমর্থ হয়। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব যেন তার যথাযথ ভূমিকা রাখেন। মার্কিন নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণের কোনাে কথাই প্রস্তাবে ছিল না। পক্ষান্তরে, সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাব ছিলাে সংক্ষিপ্ত এবং সুনির্দিষ্ট। প্রস্তাবে বলা হয়, সােভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বাস করে রাজনৈতিক সমাধান এ সকল সমস্যার নিরসন করতে পারে, সংঘর্ষ বন্ধ হবে এবং পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক কার্যক্রম বন্ধের প্রস্তাব দেন। চীনের প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য ভারতবিরােধী। আগ্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে ভারতকে পাকিস্তান ও দখলি এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা। উচিত। বিশ্বের সব দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন করা উচিত এবং ভারতের আগ্রাসন বন্ধে কার্যকর ভূমিকা নেয়ার কথা জোরের সঙ্গে উত্থাপন করে। ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং স্থায়ী সদস্য নয় এমন প্রতিনিধিগণ যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ প্রস্তাবের পদক্ষেপ নেয়। সমর্থন করেও কিছুটা দূরত্ব নিস্পৃহ থাকেন।
১৪ই ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করে। পােল্যান্ড। পােল্যান্ডের খসড়া প্রস্তাব : ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর। বক্তব্য শােনার পর পােল্যান্ড প্রস্তাব করেন যে, (ডিসেম্বর ১৪) ১. সংঘর্ষপূর্ণ পূর্বাঞ্চল। (পূর্ব পাকিস্তান) ক্ষমতা তাদেরকে হস্তান্তর করতে হবে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ শীঘ্রই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত দলের কাছেই। ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে; ২. ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হওয়া মাত্রই সকল এলাকায় পরিচালিত সশস্ত্রবাহিনীর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে এবং প্রাথমিকভাবে ৭২ ঘন্টার যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করতে হবে; ৩, প্রাথমিক যুদ্ধবিরতি অবস্থা চালু হওয়া মাত্রই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অবস্থান থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে। হবে; ৪, পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক যারা এখানে আছেন তারা পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক যারা পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসতে চায়, তাদেরকে জাতিসংঘের নেতৃত্বে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কারাে উপর বলপ্রয়ােগ করা যাবে না; ৫. ৭২ ঘন্টার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সৈন্যসংখ্যা গুটিয়ে নেওয়ার সাথে সাথে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হওয়া মাত্রই ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকেও পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সামরিক অভিযান বন্ধ করে দিতে হবে; এবং ৬. যুদ্ধে শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারত সরকার যে সমস্ত এলাকা দখল করেছে তা নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে নীতিগতভাবে আলােচনা করতে হবে যাতে ঐ এলাকা কেউ দখলে না থাকতে পারে।” ১৪ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক শুরু হলে কোনাে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলাে স্ব-স্ব দেশের সরকারের নির্দেশের জন্য পরবর্তী দিন পর্যন্ত সভা মুলতুবি করার আহ্বান জানান। সিরিয়ার খসড়া প্রস্তাব : ১৫ই ডিসেম্বর। ১. পাকিস্তান সরকারকে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দেওয়ার উপর গুরুত্বারােপ করেছে; ২. সকল ফ্রন্টে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করা; পাকিস্তান ও ভারত স্বীয় সীমান্ত এলাকা এবং জম্বু কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে; ৩, মহাসচিবকে অতি শীঘই একজন বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরণের অনুরােধ করা হচ্ছে, যার দায়িত্ব হবেউপরােক্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা। পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করবেন। শরণার্থীদের স্বেচ্ছাপ্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবেন; এবং ৪. মহাসচিবকে অনুরােধ করা হচ্ছে।
তিনি যেন এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের কাউন্সিলকে তাগিদ দেন। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের খসড়া প্রস্তাব: ১৫ ডিসেম্বর। মানবজীবন রক্ষার্থে এবং ১৯৪৯। সালের জেনেভা কনভেনশনের প্রতিফলন ঘটাতে তাদের প্রস্তাব নিম্নরূপ: ১. ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং পশ্চিমাঞ্চলে সকল যুদ্ধাঞ্চলে সংঘর্ষ বন্ধে একই সাথে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি এবং সকল পক্ষের সংঘর্ষ এড়াতে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি; ২. পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে অবিলম্বে রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান। জানাচ্ছে; ৩, উপমহাদেশ অথবা বিশ্বের যেকোনাে স্থানে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এমন পরিস্থিতি হতে দূরে থাকার জন্য সকল সদস্যদের অনুরােধ করা হচ্ছে; ৪. অসুস্থ, যুদ্ধবন্দি এবং সাধারণ জনগণের জীবনকে ১৯৪৯-এর জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পরিচালিত করার লক্ষ্যে সকল প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সকলকে আহ্বান জানাচ্ছে; ৫. দুর্গতদের জন্য ত্রাণ, শরণার্থীদের পুনর্বাসন, তাদের নিরাপত্তা, বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মর্যাদা দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য কামনা করছে; ৬, মানবিক সমস্যা দূরীকরণে একজন বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরণের জন্য মহাসচিবকে আহ্বান জানাচ্ছে; ৭. এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনের জন্য যতাে শীঘ্র সম্ভব মহাসচিবকে অনুরােধ করছে।
| সােভিয়েত-এর খসড়া প্রস্তাব : ১৫ই ডিসেম্বর। ১, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সকল সংঘর্ষ এড়ানাের জন্য এবং অবিলম্বে যুদ্ধবন্ধের জন্য উভয়পক্ষকে আহ্বান জানায়; ২. পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান আনয়ন করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে; ৩. মানবজীবন রক্ষায় ও ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের প্রয়ােগ করার জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের। সকল প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আহ্বান জানাচ্ছে; ৪, এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিষদকে অবিলম্বে অবগত করানাের জন্য মহাসচিবকে অনুরােধ করছে; এবং ৫. সমস্ত এলাকায় শান্তি আনয়নে এই আলােচনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এছাড়া জাপান ও ইতালি যৌথভাবে একই ধরনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তবে এই প্রস্তাবের ৭নং অনুচ্ছেদের বৈশিষ্ট্য ছিল ভারত এবং পাকিস্তানের সম্মতিক্রমে সাংঘর্ষিক এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন, যারা পরিষদের প্রস্তাব ও জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী কাজ করবে। এসব প্রস্তাব আলােচনার পূর্বে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী। ভুট্টোকে জরুরি বিবৃতি দানের জন্য পরিষদের সভাপতি আহ্বান জানান। জুলফিকার আলী ভুট্টো ৮ই ডিসেম্বর ‘৭১ নিউইয়ক যাত্রা করেন। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত জায়গাগুলাে সম্পর্কে কিছু না হলেও অন্তত যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তা তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রয়াস চালান। যাত্রার প্রাক্কালে করাচি এয়ারপাের্টে আগত সমর্থক নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমরা থেমে থাকব না।” একই সঙ্গে তিনি জোরের সঙ্গে বলেন, প্রয়ােজনে আমরা পবিত্র পাকিস্তানের মাটি থেকে ভারতীয়দের কবলমুক্ত করতে হাজার বছর যুদ্ধ করবাে । ১১ই ডিসেম্বর নিউইয়র্কে ভুট্টো কিঞ্জিারের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিসিঞ্জার তাকে বলেন, “পাকিস্তান শুধুমাত্র চমৎকার কথা উচ্চারণের মাধ্যমে রক্ষা পাবে না। আমরা যে পাকিস্তানকে সাহায্য করব না তা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে রক্ষা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সব সময় পাশে থাকবে। আগামী ৪৮ ঘন্টা হচ্ছে সিদ্ধান্তমূলক সময়।” ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভুট্টো জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য রাখেন। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টোকে জরুরি বক্তব্য রাখার জন্য আহ্বান জানান।
ভারতের বিদেশমন্ত্রী সরদার শরণ সিংহ বক্তৃতার পরপরই তিনি বলেন, “সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি ভালাে ভালাে কথা বলা জন্য বা ভাষণ দেওয়ার। জন্য আসিনি। আমি যা বলছি বা বলতে চাই পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়ঙ্কর।” বক্তব্যের এক পর্যায়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে ভুট্টো বলেন, “আমরা অতীতের ভুলত্রুটি শুধরে নিতে প্রস্তুত। পাকিস্তান একটি আদর্শ। আমরা ফিজিক্যাল ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত। ১২০ মিলিয়ন জনগণ শেষ হয়ে যেতে পারে তারপরও নতুন করে নতুনভাবে আমরা নতুন পাকিস্তান গড়ে তুলবাে। এটা দুঃখজনক যে ভারত-পাকিস্তান আজ বর্বরােচিতভাবে পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে, একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করার কর্মে লিপ্ত। কিন্তু এটা অসম্ভব। পাকিস্তানের সাহসী জনগণ তাদের সম্মান, মর্যাদা ও স্বাধীনতা। রক্ষার জন্য মরণযুদ্ধ করবে। এ সব বিবেচনায় তিনি বলেন, আসুন বন্ধুত্বের হাত ধরে চলি।” ভুট্টো তার বক্তৃতা থামিয়ে তখনও বলেছেন, “বাংলাদেশের অস্তিত্ব কেবলমাত্র ভারত-সরকারের মুখে এটা কেবল তাদের মাথায় আছে, কিন্তু বাস্তবে এর কোনাে অস্তিত্ব ভুট্টো চিৎকার করে বলছিলেন, আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, মৃত্যুভয়ে আমরা ভীত নই। আমাদের জনগণ সাহসী। বিশ্বাস করুন, মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্র দখল করতে পারে, ডেনমার্ক, জার্মান, ফিনল্যান্ড সােভিয়েত ইউনিয়ন দখল করে নিতে পারে, কিন্তু ভারত কোনােভাবেই পাকিস্তান দখল করতে পারবে না। আমরা যুদ্ধ করবাে, প্রয়ােজনে হাজার বছর যুদ্ধ করবাে। অতীতে করেছি, এখনাে করবাে।” জুলফিকার আলী ভুট্টোর যুক্তরাষ্ট্র আগমনের পরপরই নিক্সন বিমানসজ্জিত পরমাণু জাহাজ ইন্টারপ্রাইজ ৭ম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যেতে নির্দেশ দেন। কিসিঞ্জার এই বলে ভুট্টোকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, ভারত-সােভিয়েত-এর আক্রমণ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করবে। ভুট্টো যখন দ্বিতীয়বারের জন্য জাতিসংঘে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী সারেন্ডার করার জন্য ভারতের সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট সিগন্যাল প্রেরণ করেন। বিষয়টি নিউইয়ক ভুট্টোর অজানা ছিল না। তারপরও বাইরে দৃঢ়তার ছাপ রেখে ভুট্টো জাতিসংঘে বলেন, পাঁচ দশ বছরের জন্য পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে নিলে কিছু আসে যায় না আমরা তা ফিরে নিয়ে আসবই পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অংশ।”
পাকিস্তান ভারতের বিদেশমন্ত্রী সর্দার শরণ সিংহের দিকে আঙুলি তুলে বলেন, বিশ্বাস করুন, এটা ইতিহাসের প্রাথমিক শিক্ষা যা জনগণের তা জনগণ ফিরে পাবেই। ভারতের বিদেশমন্ত্রীর প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিগণকে নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য রাখতে দেওয়া হােক এবং তার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন। এটা একটি অবাস্তব কথা। কোনাে দেশই সে দেশের একটি পাটি প্রতিনিধিকে নিরাপত্তা পরিষদে বক্তৃতা দেবার সুযােগ করে দিতে পারে না। তাহলে কোনাে সময় শিখ আসবে, কোনাে সময় পাঞ্জাবি আসবে বা কখন ভারত থেকেই কিছু লােক এসে বলবে আমরা বক্তব্য দিতে চাই। সর্দার শরণ সিংহ উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমরা শেষ পর্যন্ত, শেষ মানুষটি পর্যন্ত যুদ্ধ করব। ১৫ই ডিসেম্বর তৃতীয় এবং শেষ বারের মতাে এক বক্তৃতায় ভুট্টো বলেন, ঢাকার পতন হলে কি হবে? কিংবা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের পতন হলে কী আসে যায়? কী আসে যায় যদি সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের পতন ঘটে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর দিশেহারা নাটকীয়তা শিষ্টাচার ছড়িয়ে যায় ।
| জাতিসংঘের প্রেসিডেন্টকে সম্বােধন করে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, ভারতীয় বিদেশমন্ত্রীকে ‘ডিসটিংগুইসড়’ বলে কেন সম্বােধন করেছেন? কেমন করে তিনি ডিসটিংগুইসড হলেন? তার হাতে রক্ত লেগে আছে, বুকে আছে প্রতিহিংসা। আর আমি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি জনগণের প্রতিনিধি, এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়েও শক্ত অবস্থানে জনগণ আমাকে এনেছে। আমরা আমাদের সন্তানদের বলে যাব-তারা তাদের সন্তানদের বলে যাবে-তবুও আমরা নতি স্বীকার করব না। আবেগজড়িত কণ্ঠে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, আমরা হাজার বছর যুদ্ধ করব। এরপর ভুট্টো পােলান্ডের উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবসমূহ টুকরাে টুকরাে ছিড়ে ফেলে জাতিসংঘ ত্যাগ করেন। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পােল্যান্ড উত্থাপিত প্রস্তাব টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেলার মাধ্যমে ভুট্টো যেন পাকিস্তানের দ্বিখণ্ডিত বাস্তবতার প্রতিফলন দৃশ্যমান করেন। ভুট্টোর এইসব দৃশ্য জাতিসংঘের সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ বিশেষকরে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপভােগ করেন। ভুট্টোর বক্তৃতার জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং। ভুট্টোর যােগ্যতার প্রশংসা করে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নির্বাচিত নেতা হিসেবে তাকে আমরা সম্মান করি এবং আশা করি যে, সামরিক জান্তা জনগণের। রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন হলে সমস্যার মূল কারণসমূহ দূর করে শান্তি, বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতা সম্ভব হবে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, ভারত একদিনের জন্যও যুদ্ধ চালু রাখতে চায় না। ভারত শুধু আত্মরক্ষার প্রয়ােজনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। তিনি সংকট ও যুদ্ধ নিরসনে তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেন। যার মাধ্যমে কার্যকরভাবে পরিস্থিতির মােকাবেলা করা যাবে : ক, বাংলাদেশের জনগণের অধিকার সম্পর্কে আলােচনার জন্য তাদের বক্তব্য শুনতে হবে; খ. যুদ্ধবিরতি নিষ্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশকে অংশিদার করার অধিকার তাদের রয়েছে; গ. ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনে গণরায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধান খুঁজে পেতে হবে। এর সঙ্গে তিনি বলেন, এর ফলে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান এবং ভারতের সৈন্য প্রত্যাহার করা ও কার্যকর আলােচনায় উভয় দেশের ভূখণ্ড বিষয়ে সমঝােতা হতে পারে। | ঐদিন সন্ধ্যা ৭:২০টায় নিরাপত্তা পরিষদের ১৬১৫ তম বৈঠক বসে। শুরুতেই চীনা প্রতিনিধি তার বক্তৃতায় পােল্যান্ডের উত্থাপিত প্রস্তাবকে আনুষ্ঠানিক ও আইনসঙ্গতভাবে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার লক্ষ্যে আনীত প্রস্তাব হিসেবে অভিহিত করেন। শ্রীলংকার প্রতিনিধি (সভাপতির আমন্ত্রীত) তাঁর বক্তৃতায় বলেন যে, “শ্রীলংকা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সমস্যার সমাধান কামনা করে।” তাঁর মতে, এই সমাধান এরূপ হওয়া চাই যেখানে বিজয় হবে ঝামেলামুক্ত, পরাজয় হবে গ্লানিবিহীন এবং সর্বোপরি শান্তি বিরাজ করবে। সােভিয়েত প্রতিনিধি পােল্যান্ডের প্রস্তাবকে সমর্থন জানান। সিরিয়ার প্রস্তাবে বলা হয় যে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে যাতে তারা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ম্যান্ডেট কার্যকর করতে সক্ষম হয়। সিরিয়ার প্রস্তাবের অনুরূপ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স পারস্পরিক আলােচনার পর একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে-যাতে উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের যুদ্ধবিরতির বিষয়টিকে পৃথকভাবে দেখানাে হয়।
সােভিয়েত প্রস্তাবে বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক সমঝােতার পৌছাতে হবে এবং একই সাথে যুদ্ধবিরতির ঘােষণাও দিতে হবে। এসব প্রস্তাব উত্থাপনের পর কোনাে দেশই ভােটগ্রহণের জন্য উৎসাহ দেখায়নি। তাই ১৬ই ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পরিষদের বৈঠক মুলতবি ঘােষণা করা হয়। ১৬ই ডিসেম্বর দুপুর ১২:০৫টায় নিরাপত্তা পরিষদের ১৬তম বৈঠক শুরু হয়। সভাপতির প্রাথমিক বক্তব্যের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (আমন্ত্রীত) সরদার শরণ সিং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি বিবৃতি পড়ে শােনান। এতে দুটো মূল বক্তব্য ছিল :১, ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ঘটেছে, যার ফলে সংঘর্ষের আর কোনাে কারণ নেই; ২. অতিরিক্ত রক্তক্ষয়, জীবনহানি বন্ধে পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের যুদ্ধবিরতি ঘােষিত হয়েছে। বাংলাদেশে যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন, নিরাপত্তা পরিষদে উদ্ভূত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংবাদটি খুবই প্রাসঙ্গিক। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতির ঘােষণা দেয়ার সময় পাকিস্তানের প্রতিনিধি অনুপস্থিত ছিলেন। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রস্তাবে তাদের উদ্যোগ ও তাগাদা ছিল না। জাতিসংঘের সমস্ত পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কিসিঞ্জার এই সময় ফারল্যান্ডের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে একতরফা যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। ইয়াহিয়া খান বেকায়দায় পরে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং ভারতের একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘােষণার পরও নিরাপত্তা পরিষদে একটি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বির্তক অব্যাহত থাকে। শেষাবধি ২১ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের ৭টি অস্থায়ী সদস্য দেশের উত্থাপিত প্রস্তাবটি পাস হয়ে যায়। যখন এ প্রস্তাব বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের জন্য কোনাে ভূমিকাই। রাখতে পারেনি।
জাতিসংঘের বিভিন্ন তথ্য ও দলিলপত্র থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দক্ষিণ এশিয়ার এই সংকট নিয়ে বড় ধরনের সংঘর্ষ হতে পারে সে বিষয়ে প্রথমদিকে পরাশক্তিগুলাের ধারণা স্পষ্ট ছিল না। যদিও রুশ-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ কমবেশি দু’পক্ষে বিভক্ত, তবুও তৎসময়ে বিশ্ব পরিসরে ‘দাতাত’-এর আলােচনা চলছিলাে, ফলে আগ্রাসী মনােভাব স্থিত ও ভারসাম্যমূলক অবস্থায় বিদ্যমান ছিল। যার প্রেক্ষিতে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে স্ব-স্ব রাষ্ট্রের নীতিগত ও স্বার্থগত দিকটি প্রধান হয়ে উঠছিল। তবে পরাশক্তির সর্বাত্মক ভাবনার বিষয়টি ছিল বড় ধরনের আন্তঃদেশীয় সংঘর্ষ জড়িয়ে না পড়া। বাংলাদেশের মূল সমস্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের প্রতি তাদের তেমন আগ্রহ ও আস্থা প্রকাশ করেননি। বরং প্রথমদিকে শরণার্থীকেন্দ্রিক তৎপরতার জটিলতা নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানের পথে যুক্তরাষ্ট্রকে জাতিসংঘের দিকে হাত বাড়াতে হয়। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ে যা জাতিসংঘে তাদের নানা প্রকাশ্যঅপ্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের ভেতরে প্রতিফলিত। অন্যদিকে, সােভিয়েত রাশিয়া ভারতের ঘনিষ্ট মিত্র হওয়ার ফলে এবং ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান ও ভারতের কূটনৈতিক যুদ্ধ যখন সামরিক যুদ্ধে পরিণত হয় তখন সােভিয়েত ইউনিয়নের জাতিসংঘ ভেটো প্রদানের মাধ্যমে এটিই প্রমাণ করতে চেয়েছে বিষয়টি শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বাংলাদেশ সংকট ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ যা তাদের বিঘােষিত নীতি তার থেকে তারা পিছু হটবে না। শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের কূটনৈতিক বলয়কে ছাড়িয়ে সামরিক যুদ্ধের দিকে নাটকীয়ভাবে ধাবিত হচ্ছিলাে এবং যা বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকির কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। যদিও যুক্তরাষ্ট্র লুকিয়ে (Cover) ও প্রকাশ্যে (Over) কূটনীতির মাধ্যমে পাকিস্তানের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যেন পাকিস্তানের ভৌগােলিক অখণ্ডতা পুরােপুরি রক্ষা পায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত মার্কিন কূটনীতি এতটুকু সফল হয়েছে যে, তাদের শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগােলিক অখণ্ডতা নিয়েই সর্বশেষ কূটনৈতিক তৎপরতায় সন্তুষ্ট থাকতে হয়। মূলত সােভিয়েত রাশিয়ার ভেটো প্রদান ঢাকা দখলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সামরিক ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র প্রেরিত সপ্তম নৌবহর মােকাবেলায় সােভিয়েত পাল্টা নৌবহর পাঠিয়ে একথা প্রমাণের চেষ্টা করে যে, যেকোনাে ভাবেই হােক বিশ্বশক্তির ভারসাম্যের মাধ্যমে বৃহৎ আকারে যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে দুই পরাশক্তির ভাবনার বিষয় ছিল চীনের ভূমিকা কী হবে। সেজন্য লক্ষ্য করা যায় জাতিসংঘ বলয় ও তার বাইরে মার্কিন নীতি-নির্ধারকগণ চীনের সঙ্গে সংলাপ ও সংযােগ রেখে চলেছে। যদিও সােভিয়েত রাশিয়ার চাপে শেষ পর্যন্ত চীনের তেমন কিছু করণীয় ছিল না এজন্য যে, সােভিয়েত রাশিয়া চীন সীমান্তে ব্যাপক সেনা সমাবেশ করেছিল। সেজন্য জাতিসংঘে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে চীনের বৈরিতা শুধু চেচামেচির ভেতরে সীমাবদ্ধ ছিল। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে জাতিসংঘ চত্বরে ভারতের ভূমিকা ছিল পরিকল্পিত ও পরিপক্ক : ঢাকা দখলের সাথে সাথে ভারত স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে তার ত্বরিত কূটনৈতিক বিজ্ঞতার প্রমাণ করে। জাতিসংঘের সামগ্রিক পরিকল্পনায় শরণার্থীদের মানবিক বিষয়টি যেভাবে ক্রমান্বয়ে আলােড়িত এবং পর্যায়ক্রমে যা রাজনৈতিক সমাধানের কেন্দ্রে এসে দাঁড়ায়, তার শেষাংশে বাংলাদেশ প্রশ্নটি অপ্রত্যক্ষভাবে হলেও কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রবলভাবে চলে এসেছে। জাতিসংঘের কার্যকরভূমিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটি গৌণ থাকলেও বিশ্ব কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তা ছিল জীবন্ত, আলােড়িত এবং পরাশক্তি ও রাষ্ট্রগুলাের নিরবিচ্ছিন্ন অব্যক্ত কূটনৈতিক যন্ত্রণা। জাতিসংঘ বাংলাদেশ সংকট সমাধানে কার্যকর প্রস্তাব, ভূমিকা ও উদ্যোগ গ্রহণের পূর্বেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে।
সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কূটনৈতিক যুদ্ধ – আবু সাইয়িদ