You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম দেশগুলাের কূটনৈতিক তৎপরতা
ভূমিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র বিশ্বকে আলােড়িত করেছে এর ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া ছিল সর্বব্যাপী। ১৯৭১ সালে বিশ্বে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ৮০ কোটি। পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ছিলাে শতকরা প্রায় ৮৮%। তৎকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছিল অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম অঞ্চল। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যার সিংহভাগ মুসলমান সেই জনগণের উপর যখন পাকিস্তান বর্বর বাহিনী হত্যা, ধর্ষণ এবং ধ্বংসলীলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন কোনাে মুসলিম দেশ পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ বাঙালি মুসলমানদের নির্বিচার গণহত্যা ও নির্মম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসেনি। বরং বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দোহাই দিয়ে মুসলিম দেশগুলাে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের আর্থিক-নৈতিক এবং সামরিক সাহায্য দিয়েছে। মুসলিম দেশগুলাে সবসময় ভেবে এসেছে পাকিস্তান শুধু দক্ষিণ এশিয় দেশ নয় এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলাে দক্ষিণ-পশ্চিম এশীয় অঞ্চলের একটি দেশ। সে কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই দেশটি মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলাের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক সামঞ্জস্য ও ভ্রাতৃত্ববােধ খুঁজে পায়। এমনকি সাধারণভাবে লক্ষ্য করা গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসকল মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেসব রাষ্ট্রগুলাের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানকে পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে, পূর্ব বাংলা নয়। সে কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানদের উপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আক্রমণকে তারা ইসলাম রক্ষা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয়দের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে বিবেচনা করেছে।
সাড়ে সাত কোটি বাঙালি মুসলমানের উপর নির্বিচারে গণহত্যার রক্তস্রোত, নিরীহ মা-বােনের ধর্ষণ, নিষ্করুণ আর্তনাদ তাদের হৃদয় বিদীর্ণ করেনি, সহানুভূতি জাগায়নি; এমনকি ইসলামবিরােধী সকল জঘন্য কর্মকাণ্ড ও দৃষ্টান্ত তাদের  আশা করেছিল মুসলিম দেশগুলাে ঐক্যবদ্ধভাবে অথবা শক্তিশালী কোনাে একক মুসলিম দেশ পাকিস্তানের আক্রমণ থেকে তাদের রক্ষা ও উদ্ধারে এগিয়ে আসবে। মুজিবনগর সরকার প্রতিটি মুসলিম দেশে ও ইসলামিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসি-র নিকট বারবার অনুরােধ করা সত্ত্বেও তারা পাকিস্তানের সার্বিক স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে গেছে। এর ঐতিহাসিক, ভৌগােলিক ও আদর্শিক কার্যকরণ বিশ্লেষণ করলে লক্ষ করা যাবে যে, তাদের মুখে যতই ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কথা উচ্চারিত হােক কেন বাস্তবতা হলাে তারা স্ব-স্ব রাষ্ট্র ও আন্তঃরাষ্ট্রের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে, ধর্ম বা ইসলামি ন্যায়-নীতিকে নয়। মুসলিম দেশগুলাে বিশেষকরে মুসলিম বিশ্ব সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে ভূমিকা রেখেছে কখনাে সরাসরি, প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে। কোনাে কোনাে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এটাও লক্ষ্য করা গেছে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় শাসকগােষ্ঠী পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করলেও সে দেশের কতিপয় গণমাধ্যম, সিভিলসমাজ, সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। বিশ্লেষণে একটি অন্যতম সূত্র স্পষ্ট যে স্নায়ু যুদ্ধের ঐযুগে কিছু কিছু মুসলিম দেশ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশ তালিম করেছে। বর্তমান অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম দেশগুলাের ভূমিকা নির্ণয়ে কয়েকটি বিষয় প্রধান বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। আলােচনার ক্ষেত্রে এক, মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী মুসলিম দেশগুলাের অবস্থান; দুই, পাকিস্তানের সঙ্গে মুসলিম দেশগুলাের সম্পর্ক অন্বেষণ; তিন, বিশ্বের প্রথম ধর্মভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার পাকিস্তানের নীতি গ্রহণের কারণ; চার, মুসলিম দেশসমূহের প্রতি মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা; ও পাঁচ, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া।
মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী মুসলিম দেশগুলাের অবস্থান প্রতিটি রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মৌল ভিত্তিগুলাে হলাে সে দেশের ভূ-প্রকৃতি, কৌশলগত অবস্থান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জন-আকাঙ্ক্ষা, অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আন্তঃরাষ্ট্র কূটনৈতিক বৈশিষ্ট্য ও পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়সমূহ। মুসলিম বিশ্বের বিশেষকরে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবন করতে গেলে আন্তঃরাষ্ট্রিক ও বহিঃশক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ধারাটি সামনে চলে আসে। ১৯৪৫ সালের ২৫ মার্চ কায়রােতে ৭টি আরব রাষ্ট্র আরব লীগ প্যাক্টে স্বাক্ষর করে। কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে আরব লীগ দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়। প্রথমত, প্যালেস্টাইনদের সমস্যা, ও দ্বিতীয়ত, বিদেশিদের হাত থেকে আরব জনগণের মুক্তি। পরবর্তীকালে ষাট-এর দশকে আরব লীগ পারস্পরিকভাবে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে উদ্যোমহীন হয়ে পড়ে। আরব ‘ঐক্য আন্দোলন’ বিভিন্ন সময় যেমন, হাসেমাইট আমল, মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসের কিংবা সৌদি বাদশাহ ফয়সালের আমলে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় মাথা তুলে দাঁড়ালেও সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক গতিধারাকে কার্যকরভাবে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হন। বহিঃশক্তি কর্তৃক তেলসম্পদ নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা এবং স্ব-জাত্য জাতীয়তাবাদ এই দুয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইহুদি-রাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে আরবদের বিরােধীতা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে ঘূর্ণাবর্তে নিয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদ প্রবল হয়ে উঠলেও পাশ্চাত্য রাষ্ট্র বিশেষকরে ব্রিটেন ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ করায়ত্ত করার প্রবল আকাক্ষায় জাতীয়তাবাদী শক্তিকে তােয়াক্কা করেনি। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সােভিয়েত রাশিয়ার হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বাস্তব হয়ে উঠলে পাশ্চাত্য গােষ্ঠী এ অঞ্চলকে ঠান্ডা লড়াইয়ের কেন্দ্রে পরিণত করে তুরস্ক ও গ্রিসকে নব উথিত শক্তি সােভিয়েত রাশিয়ার হাত থেকে রক্ষা এবং সােভিয়েতবিরােধী ঘাটি তৈরির জন্য টুম্যান নীতি ও মার্শাল পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসা হয়।
১৯৫৪ সালের ২রা এপ্রিল মােহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান তুরস্কের সঙ্গে সামরিক সমঝােতা চুক্তি করে। ঐ বছরই ৮ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিয়াটো চুক্তি করে। ১৯৫৫ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইরাক ও তুর্কির মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন করে। ১৯৬৪ সালের ২১শে জুলাই ইরানের শাহেনশাহ রেজা শাহ পাহলভী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কিমেল গুরশেল আঞ্চলিক সহযােগিতার চুক্তি (আর.সি.ডি.) সম্পাদন করেন।  ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান, ইরাক, ইরান, তুরস্কের সঙ্গে এবং পর্যায়ক্রমে দ্বিপাক্ষিক বা যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হলে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতা বৃদ্ধি পায়। অধিকাংশ আরব রাষ্ট্র বিষয়গুলাে নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতি বলয়ে প্রথম আঘাত আসে ইরানে ব্রিটিশ তেল কোম্পানিগুলাে জাতীয়করণের ফলে। দ্বিতীয় আঘাত আসে মিশর কর্তৃক সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করা হলে। ১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেন আওয়ার ঘােষণা করেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র কোনাে বহিঃশক্তিকে হস্তক্ষেপ করতে দেবে না। কিন্তু পরবছরে মার্কিন নৌ-সেনা লেবাননে অবতীর্ণ হয়। তারপর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ও হস্তক্ষেপ দৃঢ় হয়ে উঠে। তার প্রমাণ ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযােগিতাপ্রদান করে। ১৯৪৭ সালে ইহুদি জনসাধারণ ফিলিস্তানের মােট জনসংখ্যার শতকরা এক তৃতীয়াংশের বেশি ছিল না। আরবগণ প্রধানত ন্যায়-নীতির দৃষ্টিকোণ হতে ফিলিস্তিন বিভক্তির বিরােধীতা করে কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ন্যায়-নীতিকে উপেক্ষা করা হয়। ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম ঘােষণার দিনই মিসর, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও ইরাকের সৈনিকরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। আরবদের সামরিক সুবিধার সময় জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ৪ সপ্তাহ যুদ্ধবিরতির সময়ে ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক অস্ত্র সরবরাহ করে। যুদ্ধে আরব দেশগুলির পরাজয় আরব মানসিকতার উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।
পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ রাষ্ট্র ছিল হয় সদ্য স্বাধীন, না হয় বিদেশি নিয়ন্ত্রণাধীন। সিরিয়া-লেবানন দু’বছর আগে স্বাধীন হয় ! মিশর ও ইরাকে তখন পর্যন্ত ব্রিটেনের সেনাবাহিনীর প্রভাবাধীন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স ১৯৭০ সালের জুন মাসে ইসরাইল কর্তৃক দখলকৃত এলাকা প্রত্যার্পণ, পারস্পরিক শত্রুতার অবসান এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের সীমারেখা নির্দিষ্টকরণ । ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাবের অন্যান্য শর্তাবলি মিশর ও জর্ডান এই পরিকল্পনায় সম্মতি প্রদান করে। ১৯৭০ সালের ৭ই আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি রজার্স পরিকল্পনায় মিশর, ইসরাইল এবং অন্য সাতটি রাষ্ট্রের মধ্যে ৯০ দিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয়। অন্যদিকে, সােভিয়েত রাশিয়া ছিল আরব-ইসরাইল যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং আরব জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সমর্থন করে। আরব জগতে দু’টি ধারার প্রভাব যেকোন বিশ্লেষকের নিকটই ধরা পড়বে। একটি মৌলবাদী কট্টর সংকীর্ণতা ও রক্ষণশীলতা। অন্যটি, প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শের। প্রথম ধারাটি সৌদি আরব, কুয়েত এবং ইরান এবং দ্বিতীয়টি নাসেরের নেতৃত্বে সংঘটিত সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র, সিরিয়া, আলজিরিয়া, সুদান, লিবিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত। প্রগতি ও রক্ষণশীলতার এই দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্র শেষােক্ত শক্তির সমর্থক। ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের পর হইতে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট অগ্নিগর্ভ। ১৯৪৮ সালে যে অঞ্চল নিয়ে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বর্তমানে প্রায় বিশগুণ অধিক এলাকা তার কুক্ষিগত। মার্কিন পশ্চিমী এশীয়া নীতিতে এই দুদিক থেকেই কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে। একদিকে শক্তিশালী ইহুদী প্রভাব, অপরদিকে তৈলস্বার্থ । ইহুদী স্বার্থের প্রভাবে ইসরাইল অস্ত্র সাহায্য ও সমর্থন লাভ করেছে। তৈলস্বার্থে আরববিরােধী নীতি গ্রহনে তারা এগিয়ে আসতে পারেনি। এক্ষেত্রে সৌদি আরব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তির পক্ষে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব থেকে জ্বালানি সম্পদ আহরণের চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপন করেন। কিন্তু মিশরে নাসেরের অভ্যুত্থানের ফলে সৌদি আরবের মধ্যপ্রাচ্যের একচ্ছত্র নেতৃত্ব বাধার সম্মুখীন হয়। ফলে সৌদি আরবের সঙ্গে মিশর ও অন্যান্য প্রগতিশীল আরব রাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কিন্তু ১৯৬৭ সালে ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে আরব ঐক্য সংহত হলে আরব ও মিশর সম্পর্কের উন্নতি হয়। তারপরেও আরব রাষ্ট্রগুলির পররাষ্ট্রনীতি কূটনৈতিক তৎপরতা তাদের স্ব-স্ব ইতিহাস। ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং স্ব-স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত।
পাকিস্তানের বিদেশনীতি ও মুসলিম বিশ্ব
পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিদেশনীতি বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি স্তর প্রত্যক্ষ করা যায়। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বিদেশনীতি পর্যায় ক্রমিক লক্ষ্য ছিল জাতীতত্ত্ব এবং প্যান ইসলামিক এবং ভারত এবং আফগানিস্তানের সাথে বৈরিতা। এ সময় পাকিস্তানের কূটনৈতিক প্রচার ছিল পাকিস্তানের অভ্যুদয় মুসলিম আদর্শভিত্তিক, যার জন্ম ছিল অভিনব এবং যা মানবজাতির ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
পাকিস্তানের বিদেশনীতির মূল বিষয় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয় ইসলাম, মুসলমান ও মুসলিম বিশ্বকে প্রাধান্য প্রদান। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাষ্টীয় নীতির মূল কথাই ছিল ক. ইসলামিক আদর্শে রাষ্ট্র নির্মাণ; খ. মুসলিম জাতীয়তাবাদ; গ, ইসলামিক গণতন্ত্র; ঘ, ইসলামিক অনুশাসনে সামাজিক ন্যায় বিচার ও  উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য মাতৃভূমি স্থাপন।  পাকিস্তান নেতৃত্ব মনে করতেন, পাকিস্তানের অস্তিত্ব আল্লাহ প্রদত্ত (স্বর্গীয়) এবং ইসলামের উপর ভিত্তি করে সাম্য, সামাজিক ন্যায়-বিচার অনুযায়ী বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম একটা সামাজিক মডেল হিসেবে দাঁড় করানাে। ইসলামকে বিকশিত করার লক্ষ্যে একটি ন্যায়পরায়ন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তােলা। ভারত বিভাগের অবিশ্বাস ও বৈরিতা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দু’টি রাষ্ট্রকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দু’দিকে অগ্রসর হয়েছে। পাকিস্তান বিশ্বাস করতাে ভারত কখনাে শান্তিতে থাকতে দেবে না এবং যেকোনাে সুযােগ পেলে ধ্বংস করে দেবে। ভারত মনে করতাে পাকিস্তান সুযােগ পেলে ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এবং আক্রমণ করবে।’  মুসলিম বিশ্বের এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানকে মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলি সামনে রেখে পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের আন্তঃরাষ্ট্রীয় অনৈক্য ও বিভেদকে পাশ কাটিয়ে অথবা মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে পারস্পরিক কলহের মধ্যে নিজেকে মুসলিম জাহানের অগ্রপথিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে অগ্রসর হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ দূত হিসেবে ফিরােজ খান নুনকে প্রেরণ করেন। ফিরােজ খান নুন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পাকিস্তানের বিঘােষিত নীতি। ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার, দুনিয়ার সকল মুসলমান রক্তের ভাই (Blood Brother) এবং ভারতের প্রতি বৈরিতা ও শত্রুতাপূর্ণ আচরনের বিশদ বর্ণনা তুলে ধরতে সক্ষম হন। সে সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরউল্লাহ খানের বিজ্ঞ কূটনৈতিক পরিচালনায় মধ্যপ্রাচ্যে অতি দ্রুততার সঙ্গে পাকিস্তান একটি শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সমর্থ হয়।  ঘােষিত আদর্শের কথা বাদ দিলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা জোরদার করা তার বিদেশনীতির অন্যতম লক্ষ্য বলে নিদিষ্ট হয়।  পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের অভ্যুদয় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ইসলামের অগ্রণী ঝান্ডা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মনােভাব পােষণ করেন। এই লক্ষ্যে পাকিস্তান শক্তি সঞ্চয়ের লক্ষ্যে মুসলিম বিশ্বের বহু দেশের সঙ্গে নানা চুক্তি সম্পাদন করেন। পাকিস্তান বিশ্বাস করতাে, ভারত পাকিস্তানকে কখনাে শান্তিতে থাকতে দেবে না এবং যে কোনাে সুবিধাজনক সময় পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দেবে। একই সাথে ভারতও মনে করতে পাকিস্তানও সুযােগ পেলে ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এবং ভারতকে আক্রমণ করবে।”
১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে কাশ্মীর নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু মনে করতেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে পাকিস্তান রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়বে। তিনি মনে করতেন, একদিন না একদিন ভারত এবং পাকিস্তান এক হয়ে যাবে এটা হতে পারে চার, পাঁচ, দশ বছর বা তারও বেশি পাকিস্তানের বিদেশনীতির অন্যতম অগ্রাধিকার দিক ভারতবিরােধীতা। প্রথম সংকট শুরু হয় কাশ্মীরকে নিয়ে। রাজ্যটি ভারত চীন ও রাশিয়ার রাজ্য সীমার সংযােগ স্থলে অবস্থিত। সামরিক দিক থেকে এর গুরুত্ব সমধিক। ১৯৪৭ সালের ২৭শে অক্টোবর। ভারতের সৈন্য কাশ্মীরে প্রবেশ করলে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিকট কাশ্মীর প্রশ্ন উত্থাপন করে। জাতিসংঘের নির্দেশে কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি রেখা নির্ধারিত হয়।” ভারতের ভৌগােলিক অবস্থান ও অভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বৈদেশিক নীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতিতে আস্থাশীল ভারত জোটনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে-এ আন্দোলন সামরাজ্যবাদ, জাতি বিদ্বেষ ও বর্ণবাদবিরােধী। ভারত ও পঞ্চশীল ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। পরস্পরের সীমানা অতিক্রম না করা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা, পারস্পরিক সহাবস্থান ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দান পঞ্চশিলার অঙ্গ। অন্যদিকে, পাকিস্তানের বিদেশনীতি ছিল ভারত বিরােধীতা এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধন এবং ধর্মকে নিয়ে প্যান ইসলামিক পরিকল্পনায় সমর্থন ও শক্তি সঞ্চয় । একদিকে আদর্শগত বৈরিতা, পারস্পরিক সন্দেহে বিশ্বাস, দু’দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে। দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কূটনৈতিক ভূমিকায় মুসলিম বিশ্ব এই নীতি ও আদর্শ দ্বারা তাড়িত হয়েছে। ধনী আরব রাষ্ট্রগুলাের সহযােগিতা অর্জন ছিল পাকিস্তান কূটনীতির প্রথম ধাপ। এই লক্ষ্যে প্রথম থেকেই তার প্রচেষ্টা ছিলাে প্রধান মুসলিম হিসেবে মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণের আকাক্ষা। পাকিস্তান সৃষ্টির দু’বছরের মাথায় ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব ইসলামিক কংগ্রেস গঠনে এগিয়ে যায়। করাচিতে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে ১৯টি মুসলিম দেশের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে এবং এর ইতিবাচক প্রক্রিয়া মুসলিম বিশ্বের তেমন সাড়া জাগায়নি। ১৯৫১ সালে পুনরায় করাচিতে ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেসে চতুর্থ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই উদ্যোগের ফলে পাকিস্তান বিশেষ ভাবমূর্তি তৈরিতে সক্ষম হয়।
বিদেশনীতির দ্বিতীয় পর্যায়

১৯৫৪ সালের দিকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় পর্যায়ে কূটনীতির তৎপরতায় পশ্চিমা দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সামরিক সমঝােতার দিকে ঝুকে পড়ে। পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী উবিগ্ন করে তােলে কাশ্মীর সমস্যা এবং ভারতের নদীপ্রবাহে বাঁধ দেয়ার ফলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পরে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান অটুট বন্ধুত্ব স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে জড়িয়ে পরে।’

দ্বিতীয়ত, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে পাকিস্তান পশ্চিমা প্রভাবিত আরব স্বার্থবিরােধী বাগদাদ প্যাক্ট, সিয়াটো, সেন্টোর সদস্য হয় ! যে কারণে, পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বের বিরাগভাজন হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে সৌদি আরব, ইরান, তুরস্ক, জর্ডান, ইন্দোনেশিয়া বাদে মুসলিম দেশগুলাে নিরপেক্ষ থাকে। মুসলিম বিশ্বের এই ভূমিকার কারণে যুদ্ধের পর পাকিস্তান তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার প্রয়ােজন অনুভব করে। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ তাকে সে সুযােগ এনে দেয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বের কাছাকাছি আসে এবং পশ্চিমা জোট থেকেই আরব স্বার্থক প্রাধান্য দেয়। সৌদি আরব, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ইরাক, ইরানসহ কয়েকটি আরব দেশের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব পায়। এ সময় থেকে আরব বিশ্বের সদস্য না হয়েও পাকিস্তান আরব বিশ্বের মুখপাত্রে পরিণত হয়।
কমিউনিস্ট দেশগুলির প্রতি পাকিস্তানের নীতি
সােভিয়েত রাশিয়া কাশ্মীর প্রশ্নে সরাসরি ভারতকে এবং পাখতুনিস্থান প্রশ্নে সরাসরি আফগানিস্তানকে সমর্থন করে। নেহেরু কাশ্মীর থেকে মার্কিন সামরিক পর্যবেক্ষকদের প্রত্যাহারে দাবি জানান। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণভােটের মাধ্যমে রাজনৈতিক মীমাংসার অস্বীকৃতি জানায়। অন্যদিকে, এসময় পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তির ফলে আরব বিশ্বের বহুদেশ পাকিস্তানের থেকে সরে দাঁড়ায়, পাকিস্তান তখন এই অভিমত প্রকাশ করে যে তারা কাশ্মীর প্রসঙ্গে মুসলিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু ভারতকে সমর্থন দিচ্ছে। এভাবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি প্রাথমিক উদ্যোগ প্যান-ইসলামি ভেস্তে যায়। ১৯৪৯ সালের ১লা অক্টোবর চাইনিজ বিপ্লব সফল হলে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে পাকিস্তান নন কমিউনিস্ট ব্লকের মধ্যে তৃতীয় দেশ হিসেবে পাকিস্তান ১৯৫০ সালের ৫ই জানুয়ারি পিপলস রিপাবলিক অব চায়নাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। যার বিশ দিন পূর্বে বার্মা, ছয়দিন পরে ভারত, একদিন পরে ব্রিটেন স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫১ সালের মে মাসে পিকিং করাচির মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কোরীয় যুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকা কমিউনিস্টবিরােধী স্ট্যান্ড এবং প্রাচ্য-মুখীনীতির কারণে পাকিস্ত েিনর সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক টানপােড়েন চলতে থাকে। সে সময় চীন ভারতের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও চৌ এন লাই কাশ্মীর প্রসঙ্গে চীন ভারতকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমর্থন করেনি। ১৯৬১ সালে পিকিং এবং মস্কোর মধ্যে দূরত্ব শুরু হলে এবং ভারত পাকিস্তানের যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি নয়াদিল্লি প্রত্যাখ্যান করলে পাকিস্তান চীন সম্পর্কের নতুন মােড় পরিলক্ষিত হয়। ১৯৬৬ সালে সােভিয়েত রাশিয়ার মাধ্যমে তাসখন্দ ঘােষণায় যে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের উল্লেখ করা হয়েছিল, পরবর্তীকালে সেই কূটনৈতিক অবস্থান অব্যাহত থাকে। যার ফলে লক্ষ্য করা যায়, ১৯৬৭-৬৮ কালপর্বে পাকিস্তান মস্কোর সান্নিধ্যে চলে আসে।

ফলে পাকিস্তানের ও চীনের বন্ধুত্ব শীতল হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান মার্কিন প্রেসিডেন্টের বার্তা নিয়ে ওয়াশিংটন ও চীনের মধ্যে দূতিয়ালি করেন, তারপর হতে পাকিস্তান ও চীনের সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।

১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান যখন চীন সফর করেন তখন চীন পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে দেয়। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন জোট গঠন প্রথম থেকেই মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে দুটি ধারা লক্ষণীয়। সৌদি আরবের বাদশা ফয়সাল মুসলিম বিশ্বের প্যান-ইসলামিজম আদর্শ প্রচার করে। অন্যদিকে, মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের প্যান-অ্যারাবিজম প্রচার করে আরব জাতীয়তাবাদী ধারাকে সমুন্নত করার প্রচেষ্টা চালায়। পাকিস্তান সৌদি আরবের প্যান-ইসলামিজম মতবাদকে স্বাগত জানায়। মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসেরের জাতীয়তাবাদী ধারা আরব বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করলেও এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পাকিস্তান আরব ভূখণ্ডের কোনাে রাষ্ট্র নয়। সেজন্য সৌদির বাদশাহ ফয়সালের প্যান-ইসলামিজমকে দ্বাৰ্থহীনভাবে সমর্থন প্রদান তার পক্ষে সহজ হয়েছে। ১৯৬২ সালে সৌদি আরবের উদ্যোগে মক্কাতে একটি ইসলামিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং গঠিত হয় রাবেতা আল আলম ইসলামি। মূলত মুসলিম বিশ্বের ভেতরে মানবিক সাহায্য সহযােগিতা করার জন্য সংস্থাটি গঠিত হয়। ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে এর দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে অনুভূত হয় যে মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্যের লক্ষ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম প্রয়ােজন। এই উপলব্ধি থেকে সৌদি আরবের বাদশাহ একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সংস্থা গঠনের লক্ষ্যে ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে ইরান এবং ১৯৬৬ সালের এপ্রিল, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে যথাক্রমে পাকিস্তান, তুরস্ক, মরক্কো, গােয়েনা এবং সেপ্টেম্বরে তিউনেশিয়া সফর করেন।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবের বাদশাহর পাকিস্তান সফর ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই সফরকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সৌদি আরবের এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, “পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বকে এক মঞ্চে দেখতে চায়।” কিন্তু আইয়ুব খানের এই প্রত্যাশা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় প্রতিফলিত হয়নি। সেজন্য মুসলিম বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন জোগালেও পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যে মন্তব্য করেন তা ছিল একটি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। ১৯৬৭ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আর.সি,ডি, সম্মেলনে এভাবে মন্তব্য করেন যে, “পাকিস্তান আরব বিশ্বকে সমর্থন করে এটা নতুন কিছু নয়। ১৯৪৮ সাল থেকে প্যালেস্টাইন ইস্যুতে আমরা সমর্থন করে যাচ্ছি। আমরা সব সময় মুসলিম স্বার্থকে সমর্থন করছি সেটা যেভাবে যে স্থানেই থােক না কেন। আমরা বলকান যুদ্ধ থেকে তুরস্ককে পর্যন্ত সমর্থন করেছি। রাশিয়া কর্তৃক আজারবাইজান দখলের নিন্দা করেছি। আরাে মুঘারের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছি। আমরা আদর্শিক রাষ্ট্র (ideological state)। মুসলিম জাহানকে সমর্থন করা আমাদের বিশ্বাস। এটা এক তরফা নয় , ১৯৬৫ সালে ভারত যখন আমাদের আক্রমণ করে তখন ইরান, তুরস্ক, সৌদি আরব ও ইন্দোনেশিয়া উল্লেখযােগ্য সমর্থন দানের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তিনি তার ভাষণে আরাে বলেন, আমরা মিশরের নাসেরকে প্রিয় পাত্র মনে করি না, যেমন অনেকেই তার বিরুদ্ধে তবুও আমরা তার পেছনে দাড়িয়েছিলাম। কারণ আরব জনগণ নিশ্চিহ্ন হােক। তা চাইনি। ১৯৬৪ সালের ২১ জুলাই আঙ্কারায় ত্রিদেশীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযােগিতা দশটি দিক চিহ্নিত করেন। দশম ধারায় কারিগরি ও প্রযুক্তিগত পারস্পরিক সহযােগিতা, প্রশিক্ষণ এবং বিশেষজ্ঞ তৈরির যে সিদ্ধান্তে গৃহীত হয়েছিল সেই সমঝােতা ও সহযােগিতা ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় পর্যন্ত গােপনে কার্যকর ছিল।”  ওআইসির সংগঠিত রূপ ১৯৬৭ সালের আরব-ইসলাইল যুদ্ধ এবং আরবদের পরাজয় সৌদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযােগ এনে দেয়। বৃহত্তর মুসলিম ঐক্যের লক্ষ্যে প্রায় সকল মুসলিম দেশ মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়। এই সাফল্যের গরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের ২৬শে আগস্ট কায়রােতে আরব লীগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জরুরি বৈঠকে একটি ইসলামিক সংস্থা গঠনের ঐক্যমত্যে পৌছে এবং এ বিষয়ে মরক্কোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৩১শে আগস্ট সৌদি বাদশাহ ও মরক্কোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ লারাকির মধ্যে বৈঠকে একটি ইসলামি সম্মেলন সংস্থা গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় মরক্কোর দূত তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, লিবিয়া, ইরান সফর করেন এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে যােগাযােগ করেন।  এভাবে বৃহত্তর মুসলিম সংহতির লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষ, আরব জাতীয়তাবাদ, প্যান ইসলামিক মতবাদ ও ধর্মভিত্তিক দেশগুলাের সমন্বয়ে এই সংগঠন গড়ে ওঠে। বিচিত্র অবয়বের মধ্যে রাজতন্ত্র, সামরিক/আধা সামরিক, আধা গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক সরকারের অস্তিত্ব যা আবার পরস্পর স্বার্থ-সংঘাতে জড়িত।” 
 
 
 
 
হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মালয়েশিয়ার টুংকু আব্দুল রহমান। রাবাতে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার প্রথম সম্মেলনের প্রাক্কালে যা অনুষ্ঠিত হয় ৮-৯ই সেপ্টেম্বর। সে সময় মরক্কো, সৌদি আরব, সােমালিয়া, নাইজার, মালয়েশিয়া, ইরানসহ পাকিস্তানকেও ওই প্রস্তুতি কমিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেশে বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২২-২৫শে সেপ্টেম্বর সম্মেলনে ৩৫টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানাে হলেও ২৫টি দেশ এতে অংশ নেয়। সনদ অনুসারে ভারতকে আমন্ত্রণ জানানাে ও অনুষ্ঠানে যােগদানে পাকিস্তানের ঘােড় অসঙ্গতি ছিল সনদে বলা। সনদে বলা হয়, ৪ ধরনের রাষ্ট্র ওআইসির সদস্য হতে পারবে : ১. যে সকল দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান ও রাষ্ট্রপ্রধান মুসলমান; ২. জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান কিন্তু রাষ্ট্র প্রধান অমুসলিম; ৩. যে সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধান মুসলমান কিন্তু জনসংখ্যার বড় অংশ অমুসলিম; ৪. যে সকল দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক মুসলমান অর্ধেক অমুসলমান। এই শর্ত অনুযায়ী ভারত সদস্য হতে না পারলেও পর্যবেক্ষক হওয়ার যােগ্য বিবেচিত হয়। কারণ ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস। ভারত প্রথম থেকেই ওআইসির সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাবাতে সম্মেলনে ভারতকে আমন্ত্রণের দাবি জানান। যদিও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ভারতকে আমন্ত্রণ জানায়নি! ভারত এর প্রতিবাদ জানায় এবং ভারতের শিল্পমন্ত্রী ফখরুদ্দিন আলী আহমদ ওআইসির সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার আহ্বান জানান।
ভারতের পক্ষে মিশর ও মালয়েশিয়ার কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে। শেষপর্যন্ত সম্মেলনে ভারতের অংশগ্রহণ অনুমােদিত হয়। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ২৩শে সেপ্টেম্বর ভারতকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। তবে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় অবশ্যই একজন মুসলমানকে এতে অংশ নিতে হবে এবং সেক্ষেত্রে মুসলিম প্রতিনিধির পৌছার আগে পর্যন্ত অস্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে রাবাতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত গুৰ্বাচন সিংহ তার দেশের নেতৃত্ব দেন। এ সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। বাদশাহ্ ফয়সালের অনুরােধে জেনারেল ইয়াহিয়া ভারতের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানাতে রাজি হলেও ভারতের একজন অমুসলমান প্রতিনিধিকে সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতিনিধিরূপে। গ্রহণে তিনি অস্বীকার করেন। সম্মেলন দুই শিবিরে বিভক্তি তিনি প্রশ্ন তােলেন যদি ভারতকে আমন্ত্রণ জানানাে হয় তবে একই যােগ্যতাবলে কেন সােভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, আলবেনিয়া, কিংবা ইসরাইলকে আমন্ত্রণ জানানাে হবে অথচ এসব দেশ সম্মেলনে অংশগ্রহণ আগ্রহ প্রকাশ করেনি। সম্মেলনের পুরাে সময় পাকিস্তানের কট্টর ভারতবিরােধী মনােভাবের ফলে সম্মেলনে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের বিরােধের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে পাকিস্তান সম্মেলনকে ভারতবিরােধী প্লাটফর্মে পরিণত করার প্রয়াস পায়। এক পর্যায়ে ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান অধিবেশন বর্জন করে। এক, জর্ডানের বাদশাহ, ইরানের শাহ, তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেনারেল ইয়াহিয়াকে সমর্থন দেন। ইরানের শাহ সম্মেলনের সভাপতি মরক্কোর বাদশাহ হাসানকে জানিয়ে দেন ভারতের প্রতিনিধি সম্মেলনে যােগ দিলে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তিনিও সম্মেলন বর্জন করবেন। দুই, পাকিস্তান ও তাঁর কট্টরপন্থি মিত্রদের তৎপরতা সত্ত্বেও আরব আমিরাত, আলজেরিয়া, সুদান, লিবিয়া, দক্ষিণ ইয়েমেন ভারতের পক্ষে মত দেয়। ফখরুদ্দিন আলী আহমদের উপস্থিতির পরও পাকিস্তান তার মনােভাব অটল থাকে এবং স্বয়ং সৌদি বাদশাহর অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করে। পাকিস্তানের সম্মেলন বর্জনের কারণে। ২৪শে সেপ্টেম্বর সকালের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়নি। সংস্থার ভাঙনরােধ ও অচলাবস্থা নিরসনের জন্য মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টেংকু আবদুল রহমানের মধ্যস্থতায় ভারতীয় প্রতিনিধি স্বেচ্ছায় অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকায় ২৪শে সেপ্টেম্বর বৈকালিক অধিবেশনে ইয়াহিয়া খান যােগ দিলে সম্মেলনের কাজ পুনরায় চালু হয়। এসময় আফগানিস্তানের প্রতিনিধি পাকিস্তানের ভূমিকার তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
আফগানিস্তান ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির বিরােধীতা করে এবং পাখতুনিস্তানকে তার নিজস্ব এলাকা বলে দাবি করে এজন্য ১৯৪৮-১৯৫১ কালপর্ব পর্যন্ত দু’পক্ষের সংঘর্ষ চলে। ১৯৫৫ সালে পুনরায় বৈরিতা শুরু হলে মিশর এবং সৌদি আরবে এ বৈরিতা নিরসনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। দু’দেশের রাষ্ট্রীয় প্রধানগণ পারস্পরিক সফর বিনিময় হলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক নাজুক অবস্থা থেকেই যায়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হলেও ১৯৭০ সালে অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটে, যা মুসলিম আন্তর্জাতিক ইসলামিক ঐক্য সংস্থায় ছায়া ফেলে। ২৫ তারিখ ১ দিন সম্মেলনের সময়সীমা বাড়ানাে হয়। এরপর সম্মেলনে পাকিস্তানের মতামত গুরুত্বসহ বিবেচনা করা হয় এবং পাকিস্তানের আগ্রহের কারণেই ভারতের আহমেদাবাদে দাঙ্গায় উদবেগ প্রকাশ এবং ঘটনার নিন্দা জানানাে হয়।” ইয়াহিয়া তার বক্তৃতায় অধিকৃত আরব এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার, জেরুজালেমকে ইহুদি কবল থেকে পুনরুদ্ধারে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন যা মুসলিম বিশ্বে প্রশংসা অর্জন করে। আরব বিশ্বের সদস্য না হয়েও পাকিস্তান আরব বিশ্বের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়। পাকিস্তানের এই গুরুত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭০ সালে সংস্থার পররাষ্ট্রমন্ত্রী করাচিতে অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭০ সালের ২৬-২৮শে ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডা. আবদুল মালেক মুত্তালিব।” তিনি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আরব বিশ্বের সংহতি ও ইসলাইলের হাত থেকে আরব ভূখণ্ড মুক্ত। করার আহ্বান জানান। মুসলিম বিশ্বের প্রতি মুজিবনগর সরকারের আহ্বান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৩ই জুন আরব বিশ্বের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, যেসব রাষ্ট্র এখনাে কোনাে অবস্থান নেননি অথবা দোদুল্যমান কিংবা বিরােধীতা করছেন, তাদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই, সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যয়দৃপ্ত আকাক্ষার প্রতিফলন বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে উড্ডীন হয়েছে তা সমুন্নত থাকবে। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, “এত বিশাল মানবগােষ্ঠীকে উপেক্ষা কর। কোনাে রাষ্ট্রের পক্ষে যােক্তিক কি না?”৩” তিনি মুসলিম রাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের প্রতি বিশেষভাবে আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই ব্যাপক গণহত্যার নিন্দা করা হয়নি। তিনি বলেন, “এটা হবে একটি ট্রাজিক ভ্রান্তি যেক্ষেত্রে ইয়াহিয়া খানের এই যুদ্ধকে তারা ইসলামের ন্যায়ভিত্তিক বলে মনে করবেন। দাসত্ব ও বর্বরতাকে না দেখার ভান করেও নীরব রয়েছেন। তারা তাদের নৈতিকতাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। ইসলামাবাদকে বস্তুগত সাহায্য দিয়ে তারা যেমন স্বৈরতন্ত্রের পক্ষ নিয়েছেন অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত প্রামাণ্য হত্যা, খুন, লুণ্ঠন, ধর্ষণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি আরব দেশগুলােকে মনে করিয়ে দিতে চাই, তারা তুর্কি মুসলিম কলােনিয়েল শাসকদের হাত থেকে নিজেদের স্বাধীন করার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের কলােনিয়েল শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম তুর্কীদের বিরুদ্ধে যেভাবে সংগ্রাম করেছিল তারই অনুরূপ।”৩২
সম্মেলন চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সংস্থার কাছে প্রেরিত তারবার্তায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের জন্য সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন: “বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের শতকরা ৮০ ভাগ মুসলমান। ইয়াহিয়া সরকার জনগণের নির্বাচিত রায়কে অগ্রাহ্য করে বিশ্বাসঘাতকের মতাে অন্যায় যুদ্ধ শুরু করেছে বলেই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার ঘােষণা করেছেন। তারা দশ লাখের বেশি লােককে হত্যা করেছে। ৬০ লাখের বেশি লােক গৃহহারা হয়ে দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদাররা মসজিদসমূহ। ধ্বংস করেছে, মসজিদের ইমামদের এবং নামাজরত মুসলমানদের গুলি করে হত্যা করেছে। আর তারা এই করেছে ইসলামের নামেই।”৩৩ | এছাড়া সম্মেলনকালে ২৬ষে জুন নয়াদিল্লিস্থ বাংলাদেশের কূটনীতিক কে.এম. শিহাবুদ্দিন জেদ্দা সম্মেলনের সদস্যদের বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের আহ্বান জানান। বাঙালির উপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ তুলে ধরে তিনি বলেন : “The question of living together with Pakistan butchers, who have shed the blood of millions of our innocent people and who have disrupted our economy, does not arise. I emphasize again that Pakistan is dead and buried under the bodies of martyrs.”98 | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালালেও মুজিবনগর সরকার ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি দৃঢ় আস্থা জ্ঞাপন করে পাকিস্তানের বিদেশ মিশনে কর্মরত বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিকবৃন্দ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য পােষণ করে। পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনে যে সকল বাঙালি কূটনৈতিক কর্মরত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে তারা পাকিস্তানের পক্ষ পরিত্যাগ করেন। বাগদাদ থেকে রাষ্ট্রদূত এ,এফ,এম, আবদুল ফতেহ অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে শুধু পাকিস্তানের পক্ষই ত্যাগ করেননি পাকিস্তান দূতাবাসের ট্রেজারি হতে চৌত্রিশ হাজার ইরাকি ডলার। উত্তোলন করেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, এ সকল অর্থ বাংলাদেশের নগণের এবং তা তিনি মুজিবনগর সরকারের নিকট পাঠিয়ে দেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার কার্যক্রম সমর্থনে এক বিবৃতিতে বলেন, জনাব ফতেহ সমায়ােচিতভাবে শুধু বাংলাদেশ সরকারের আদেশ যথার্থভাবে পালন করেছেন এটা। বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত শেয়ারের একটি অংশ মাত্র। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই অর্থ বাংলাদেশ সরকারের এবং তা মুক্তিযুদ্ধে শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করা হয়। এভাবে রাষ্ট্রদূত এইচ.কে. পন্নিকে দামেস্কো থেকে দিল্লি কনসাল জেনারেল এ.এইচ. খানকে ইস্তাম্বুল থেকে বৈরুতে, আজাহারুল আনােয়ার চৌধুরিকে দুবাই থেকে বৈরুতে, কনসােলার মঞ্জুর চৌধুরীকে দুবাই থেকে বৈরুত, মাহবুবুল হককে তেহরান থেকে দিল্লি, ফজলুল করিমকে কায়রাে থেকে বৈরুত, আহমেদ তারিক করিমকে তেহরান থেকে বৈরুত, মােহাম্মদ জামিরকে কায়রাে। থেকে বৈরুত, আফসারুল কাদেরকে আনকারা থেকে বৈরুত, খাজা সারজিল হাসানকে। আঙ্কারা থেকে বৈরুত, আবদুল মােমেন চৌধুরীকে দামেস্কো থেকে বৈরুতে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। মুজিবনগর সরকার মুসলিম দেশগুলােতে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরার জন্য কয়েকটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ফকির সাহাবুদ্দিনকে ৭ই আগস্ট কুয়ালামপুরসহ কয়েকটি দেশে প্রেরণ করা হয়। অনুরূপভাবে জাতীয় পরিষদ সদস্য মােল্লা জালালউদ্দিন ও ড. মাহমুদ শাহ কোরেশীকে বৈরুত, কায়রাে এবং এডেন-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরার জন্য প্রেরণ করা হয়।
মােল্লা জালাল উদ্দিন বৈরুতে মধ্যস্তরে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাফল্যজনকভাবে যােগাযােগ করেন এবং সেখানে একটি ছােটো অফিস স্থাপনের সরকারি অনুমোদন লাভ করেন। তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। সেখানে তিনি নাবিল বারাদি নামের একজন স্থানীয় প্যালেস্টাইনের সাংবাদিকের সহায়তা লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামি সম্মেলন সংস্থা করাচি সম্মেলনের মাত্র তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওআইসিতে পাকিস্তানের গুরুত্ব ও পাকিস্তান কর্তৃক পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধবিরােধী তৎপরতার সঙ্গে সংস্থা দ্বিমত পােষণ করেনি। প্রথম থেকেই পাকিস্তান ওআইসির সদস্যদের সমর্থনের জন্য মুক্তিযুদ্ধকে পরিকল্পিতভাবে ভারত ও ইসরাইলের প্ররোচণায় মুসলিম সংহতি বিনষ্টের প্রচেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করে।

মূলত, নব প্রতিষ্ঠিত সংস্থার ভাঙনরােধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব, ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন তাদের 

সন্দিহান করে তােলে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ২৯শে মার্চ সংস্থার মহাসচিব টেংকু আবদুর রহমান এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাকে পাকিস্ত েিনর অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে মন্তব্য করেন। ভারতকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আমি মনে করি বাইরের কোনাে দেশের এতে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। এই বিবৃতির পর পর ৩০শে মার্চ ওআইসির সদস্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, ৩শে এপ্রিল তুরস্ক ও মালয়েশিয়া, ৭ই এপ্রিল লিবিয়া, ১২ই এপ্রিল ইয়েমেন এবং ২৮শে এপ্রিল সৌদি আরব অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেন। 
 
 
 
Pakistan Horizon, Cronology, Vol. XXIV, No. 2-4, 1971,
ওআইসি সবচেয়ে বেশি বৈঠক হয় ১৯৭১ সালে। এপ্রিলে ইরানে ইসলামিক সংবাদ সংস্থা বৈঠক, জুনের প্রথম দিকে মরক্কোতে ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বৈঠক এবং জুনের শেষ নাগাদ জেদ্দায় ওআইসি সম্মেলনের চার্টারে খসড়া সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে কাবুলে তৃতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন হওয়ার কথা। থাকলেও আফগাস্তিানের দুর্ভিক্ষের কারণে তা অনুষ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তানের তৎপরতার সাফল্য বয়ে আনে জুনের শেষ দিকে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত জেদ্দা সম্মেলনে। এই সম্মেলনে ওআইসির সনদ চূড়ান্ত হয়। সম্মেলনের প্রাক্কালে মহাসচিব তার ২৯শে মার্চে দেওয়া বিবৃতির পুনরাবৃত্তি করেন এবং পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। মুসলিম বিশ্বের কাছে পাকিস্তান সাহায্যের আবেদন জানান। অবশ্য এখানে তিনি পাকিস্তান জনগণ বলতে পাকিস্তানপন্থি না বাংলাদেশপন্থিদের বােঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট ছিল না। তবে ওআইসির কর্মকাণ্ড থেকে মনে হয় মহাসচিব পাকিস্তানের জন্যই সাহায্য চেয়েছেন।
জেদ্দা ইসলামিক সম্মেলনে প্রকারান্তে ভারতকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বৈদেশিক হস্তক্ষেপ বলতে ভারতকেই বােঝানাে হয়েছে। অন্যদিকে সংকটকালে পাকিস্তানের পাশে। এসে দাঁড়ানাের আহ্বানও ভারতকে ভয় দেখানাের জন্য বলা হয়েছে। ভারত তেল। সরবরাহসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে ধনী আরব রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল থাকায় এ হুমকি দেওয়া হয়। পাকিস্তানের গণমাধ্যমে যুক্ত ইশতেহারকে ভারতের কূটনৈতিক পরাজয় হিসেবে আখ্যা দেয়। অন্যদিকে একে পাকিস্তানের কূটনৈতিক বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয় : ১, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পৃথিবীব্যাপী যে প্রচারাভিযান চালাচ্ছে এ ঘােষণার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে ভারত একঘরে হয়ে যাবে; ২. ভারতকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে; ৩. কোনাে কোনাে দেশ পাকিস্তানকে সরাসরি সহযােগিতা আশ্বাস দিয়েছে। এর ফলে পাকিস্তান যে একা নয়, সংকটকালে সাহায্য ও সহযােগিতা পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা পায়। ফলে মে মাস পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিক্ষিপ্তভাবে পাকিস্তানের। অখণ্ডতার জন্য বিবৃতি দিলেও ইসলামি সম্মেলনের পর মুসলিম বিশ্ব একযােগে পাকিস্তানের। পক্ষ নেওয়ার সুযােগ পায় । ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক অরগনাইজেশন সেক্রেটারি জেনারেল এইচ, এইচ, মারজুকি জাতিস ভারতে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য রিলিফ পাঠানাের জন্য ইন্দোনেশিয়া সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ৯ই জুন ১৯৭১ সালে জাকার্তায় এক বিবৃতিতে বলেন, কলেরায় আক্রান্ত শরণার্থীদের জন্য আশু ঔষুধ জরুরি। তিনি বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক ইসলামিক সংস্থার নিকট বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া ন্যাশনাল গ্রুপকে পরামর্শ দেন তারা যেন বিভিন্ন মুসলিম দেশকে শরণার্থীদের বস্তুগত সাহায্য ও সহযােগিতায় এগিয়ে আসতে বলেন।” ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক সংস্থার মহাসচিব এইচ.এইচ, মারজুকি জাতিম ৯ই জুন জাকার্তায় এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য মুসলিম দেশগুলােকে সাহায্য প্রেরণের আবেদন জানান। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের অনেকেই কলেরা আক্রান্ত হয়েছে। তিনি বিভিন্ন দেশে ইসলামিক সংস্থাগুলােকে অভিলম্বে তাদের স্ব-স্ব দেশ হতে ব্যাপকভাবে শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য আহ্বান জানান। যদিও বাংলাদেশের এসব উদ্যোগ ও আহ্বান মুসলিম বিশ্বের নেতাদের মধ্যে কোনাে সহানুভূতি সৃষ্টি করেনি। তারা মুসলিম উম্মাহর সংহতি রক্ষায় পাকিস্তানকে। ব্ৰিত না করার নীতি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনের কোনাে চেষ্টা করেই পাকিস্তানের প্রতি একতরফা সমর্থন অব্যাহত রাখে। সম্মেলন শেষে ১লা জুলাই প্রকাশিত যুক্ত ইশতেহারে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশি হস্তক্ষেপের নিন্দা এবং পাকিস্তানের ভৌগােলিক অখণ্ডতা রক্ষার ন্যায়সঙ্গত প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানান।
অধিকাংশ সদস্য পাকিস্তানকে সহযােগিতার মত ব্যক্ত করে। ইরান সংকটকালে সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করার ইচ্ছে ব্যক্ত করে, কারণ ইসলামি সংহতি রক্ষার জন্য তা জেহাদের মতাে নৈতিক কর্তব্য।  এ প্রসঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মৌলিক নীতিমালা ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঘােষণা মুসলিম বিশ্বের বিশেষকরে ওআইসি-র নীতিমালার সঙ্গে ছিল সাংঘর্ষিক। এ সময়ে ইসরাইল কর্তৃক বাংলাদেশের গণহত্যা, শরণার্থী সমস্যা, মানবতাবিরােধী অপরাধ এবং ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে ইসরাইল পার্লামেন্টে (Knesset)। আলােচনা হয় এবং বাংলাদেশের সাহায্যের জন্য সংসদে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২৩শে জুন ১৯৭১ সালে পার্লামেন্টে এক বিবৃতিতে পূর্ববঙ্গের । জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও বেদনাদায়ক ঘটনাবলিতে গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করে ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় বর্তমান বিশ্বে এমন মর্মান্তিক ও নৃশংস ঘটনা আর ঘটেনি। ইয়াহিয়া খানের সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের জনগণের অবস্থা ও প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরার জন্য সেদেশে যেতে দেয়নি। মৃত্যু, ধ্বংস, অত্যাচার এমন এক নিষ্ঠুর অন্ধকার সৃষ্টি করেছে যার হাত থেকে নর-নারী, যুব, শিশু, বৃদ্ধ কেউই নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। এসব দুঃখজনক ঘটনাবলির দীর্ঘ পটভূমি বর্ণনা না করে বলা যেতে পারে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হতেই পূর্বাংশের জনগণের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়।
এসব তিক্ত অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও বৈষম্যের ফলাফল… নির্বাচন প্রতিফলিত নেতার দাবিসমূহ অগ্রাহ্য করে। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করে। আজকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামাে থাকবে কি থাকবে না সেটা বড়াে নয় বড়াে হলাে বিশ্ব এমন নিষ্ঠুর হত্যা, সন্ত্রাস ও ধ্বংসের মুখে নীরবতা। ইসরাইলের কাজ হবে এ সম্পর্কে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করা এবং এমন পদক্ষেপ গ্রহণ যা দুঃখ দুর্দশা হ্রাস করবে। ৪৫ ভৌগােলিক বিশ্লেষণে পাকিস্তানকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ না বলে দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের অংশ হিসেবে বিবেচিত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পারস্য উপসাগরীয় রাষ্ট্র ওমানের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তােলে। পাকিস্তানের মাক্রান ডিভিশনের গােয়াদার শহরটি সর্বশেষ সমুদ্র সংলগ্ন এবং ওমান আশি দশক পর্যন্ত পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনীর লােকদের সুলতানের সেনাবাহিনী হিসেবে নিয়ােগ দান করেছেন।  পাকিস্তান, সৌদি আরব, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে আদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জড়িত এবং এসব দেশগুলাের সঙ্গে পাকিস্তানের বাণিজ্য ও মানবসম্পদ রপ্তানির বিরাট বাধা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম বিশ্ব পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান শাসকচক্র পূর্ব বাংলার মানুষকে খাটি মুসলমান হিসেবে অনুধাবন করেননি। ১৯৪৭ সালের পর হতে পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে খাটি পাকিস্তানি নেতা হিসেবে মেনে নেয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব যখনই সুযােগ পেয়েছে তখনই এসব জননন্দিত নেতৃবৃন্দকে ভারতীয় চর’, ‘ইসলামের দুশমন’ কখনও বা ‘খতরে পাকিস্তান’ হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস। চালিয়েছে। এমনকি তাদেরকে বিরুদ্ধে নানা ধরনের মামলা ও কারাগারে যেতে হয়েছে। পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানরা যে খাটি মুসলমান’ নয় একথা পাকিস্তানের। শাসকবৃন্দ দেশে-বিদেশে সর্বত্র প্রচার করেছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্রভু নয় বন্ধু গ্রন্থতেও এ মনােভাব প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে এধরনের প্রচার-প্রচারণা প্রবলভাবে মুসলিম বিশ্বের নিকট উপস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের দু’অংশের ইসলামি সংহতিবিরােধী রুশ-ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র’ এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ‘ভারতীয় চর’ ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ধর্ম যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।” মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের বক্তৃতায় সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা মুসলিম বিশ্বের কাছে এ ধারণা দিয়েছে স্বাধীনতার পর দেশটি হবে কমিউনিস্ট ও ধর্মহীন একটি রাষ্ট্র। আর দেশটি হবে হিন্দুশাসিত ভারতের মিত্র রাষ্ট্র যা পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।  দ্বিতীয়ত, ওআইসির পাকিস্তানপন্থি নীতি গ্রহণের প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতি ইসরাইলের সমর্থনকে দায়ী করেন। মূলত ওআইসি গঠিত হয়েছিল ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। ২রা জুলাই মাসে ইসরাইলি সংসদ (Knesset) বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানি সামরিক চক্রের পাশবিক ও বেপরােয়া ধ্বংসলীলাকে নিন্দা করে একটি প্রস্তাব পাশ করে। এছাড়া বাঙালি জাতির প্রতি মুক্তিসংগ্রামের সংহতি প্রকাশ এবং ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে। ইসরাইল সংসদ বাঙালি মুক্তিযােদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য ইসরাইলি রেডক্রসের মাধ্যমে উল্লেখযােগ্য পরিমাণ ঔষুধ, খাদ্য, কাপড় পাঠানাের ঘােষণাও দেয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এ সাহায্য সহানুভূতি প্রত্যাখান করে।” আরব বিশ্ব যেখানে সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানকে সাহায্য দিয়েছে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে ইসরাইলি সহযােগিতা গ্রহণ খুবই স্বাভাবিক ছিল। অথচ বাংলাদেশ সরকার সাহায্য প্রত্যাখ্যান করলেও বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরাইলি যােগাযােগের অপপ্রচার থেমে থাকেনি। সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকার মাহমুদ কাশেম নামে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এক দূতের জেরুজালেমে উপস্থিতি এবং ইসরাইল সরকার কর্তৃক গােলাবারুদ, মেশিনগান, বিমানবিধ্বংসী কামান, ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযােগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সহায়তার গুজব ছড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানপন্থি দল জামায়াতের মুখপাত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’ ২রা আগস্ট একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধকে প্রকৃতপক্ষে ভারত-ইসরাইলের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। উল্লেখিত কারণে ওআইসি প্রথম থেকেই পাকিস্তানের ভৌগােলিক অখণ্ডতা, সংহতিতে  প্রাধান্য দেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধীতা করে।
মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দ, সিভিল সমাজ ও গণমাধ্যম যদিও সম্মেলনের পরই ইসলামি সম্মেলন সংস্থার মহাসচিব কুয়েত, ইরান, জর্ডানের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ওআইসির মহাসচিবের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত সফরের সিদ্ধান্ত ঘােষিত হয়। জুলাইয়ে এই প্রতিনিধিরা ঢাকা সফর করেন। সফরকালে তারা বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন ছাড়াও গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পাকিস্তানে জর্ডানের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ কামেল-আল-শারিফ ২৫শে জুলাই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে কুমিল্লা, ফেনী, নােয়াখালী সফর শেষে বলেন তার নিকট প্রতীয়মান হয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একটি অখণ্ড শক্তিশালী পাকিস্তান হিসেবেই থাকতে চায়। তিনি কুমিল্লায় বিভিন্ন স্তরে জনগণের সঙ্গে কথা বলে অনুধাবন করেছেন যে, তারা নিরাপত্তা এবং উন্নতির জন্য শান্তিপূর্ণ অবস্থায় পাকিস্তানে বসবাস করতে চায়। তিনি বলেন, সারাদিনের সফররত অবস্থায় তিনি কুমিল্লা, ফেনী ও নােয়াখালীতে দেখেছেন কৃষকরা মাঠে কাজ করছে, শ্রমিকরা কাজ করছে এবং এই সীমান্ত অঞ্চলে জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তিনি আনন্দিত এই কারণে যে, জনগণ মিথ্যা অপপ্রচারে কান দিচ্ছে না বরং অর্থনীতি, কষ্টলাঘবের জন্য কাজ করছেন। সরকার শান্তিপূর্ণ অবস্থা ও শক্তিশালী পাকিস্তান নির্মাণের জন্য কাজ করছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বৈরী প্রচার ও প্রচারণা এবং অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপের ফলে ঘটনমূলক পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ফলে জনগণের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি গুনাইবতি রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস দেখে মন্তব্য করেন এগুলাে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ বিশেষজ্ঞদের কাজ (‘Highly trained expertise’)। এদিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলাপ করে অনুধাবন করেন ইসলামিক আদর্শে উচ্চমানের নৈতিকতা নিয়ে তারা মিশনারি উৎসাহ নিয়ে কাজ করছে।” তুরস্কের সংসদীয় কমিটির সদস্য কাসিম গুলেক দুই সদস্যের প্রতিনিধি সহকারে ইসলামাবাদ এয়ারপাের্টে সাংবাদিকদের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সম্পর্কে বলেন, কোনাে স্বাধীন আত্মমর্যাদাশীল জাতি বিচ্ছিন্নতাবাদীর প্রচেষ্টাকে নিন্দা করবেন। তিনি শরণার্থীদের সংখ্যা অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন। তিনি জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রস্তাব অনুযায়ী উভয় দেশের সীমান্তে নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক নিয়ােগের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সম্মতিতে প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তান বাধাহীনভাবে শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে চায়। কিন্তু ভারত এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। যেহেতু শরণার্থী সমস্যা পাকিস্তানের সেজন্য পাকিস্তানের এককভাবে এই সমস্যাটিকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া দরকার। তিনি পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে মন্তব্য করেন যে, উন্নয়নে সহযােগিতার অর্থ এই নয় যে এটা দয়া-দাক্ষিণ্য। বরং এটা শান্তির জন্য বিনিয়োেগ। তিনি বলেন, অর্থনীতিক সাহায্য কোনােভাবেই উন্নয়নশীল দেশের জন্য চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটা শুধু পাকিস্তানের জন্য নয় সমস্ত উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
সুদানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে এক বিবৃতিতে বলেন, ভারত এবং পাকিস্তানের ভেতরে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ, সেনা প্রত্যাহার এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক মর্যাদা এবং সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান দেশ ও জনগণের জন্য প্রয়ােজন বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তানের ঐক্য, জনগণের সার্বভৌমত্ব, ভৌগােলিক অখণ্ডতা এবং সেদেশের অভ্যন্তরে যা কিছু ঘটুক না কেন সেগুলাে তার অভ্যন্তরীণ এবং পাকিস্তানের জনগণের বিষয়। সুদান গণতন্ত্র জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যদের নিকট দাবি করে যে, তারা যেন তাদের সর্বশক্তি নিয়ােগ করে এই সশস্ত্র সংঘাত বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।” যদিও তারা বাঙালি হত্যা বন্ধে কোন ভূমিকা রাখেননি। ওআইসির এই মিশনের দু’জন সদস্য কুয়েতের সুলায়মান আবু দাউস ও ইরানের রেজা তাখওয়াইকে ভারত সফরে অনুমতি না দেওয়ায় মহাসচিব ৩১শে জুলাই এক ঘােষণার দ্বারা তার ভারত সফর বাতিল করেন। মহাসচিব পরিষ্কার জানিয়ে দেন যেহেতু তিনি সংস্থার মহাসচিব হিসেবে এই সফর করেছেন ব্যক্তিগতভাবে কোনাে দেশের প্রতিনিধি হিসেবে নয় তাই অন্যান্য সদস্য ছাড়া তাঁর সফরের প্রশ্নই ওঠে না।” তিনি শরণার্থী সমস্যা সমাধানে ভারতের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন এবং বলেন পাকিস্তান নয়, ভারতের কারণেই শরণার্থী সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। তিনি পাকিস্তানের মতাে শরণার্থীদের সংখ্যা ভারতের ঘােষিত সংখ্যার চেয়ে অনেক কম মন্তব্য করেন। তিনি পরিষ্কার বলেন, ভারত শরণার্থীদের সংখ্যা ৭.২ মিলিয়ন বললেও প্রকৃতপক্ষে তা ৪ মিলিয়নের বেশি হবে না। অবশ্য ভারত সরকার মহাসচিবের বক্তব্য উড়িয়ে দেয় এবং স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, দুটি কারণে ভারত ইসলামি সংস্থার প্রতিনিধিদের গ্রহণ করতে পারে না : ১. ভারতে ৭০ মিলিয়ন মুসলমানের বসবাস হওয়া সত্ত্বেও এ সংস্থা কখনাে ভারতের প্রতিনিধিকে গ্রহণ করেনি; ২. ওআইসি বরাবর সাম্প্রদায়িক মনােভাব পােষণ করেছে। সাংবাদিকদের টেংকু আবদুর রহমান জানান ওআইসি শরণার্থীদের সহায়তা করতে চায় এবং বৈঠকে তা আলােচিত হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোনাে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি।” মহাসচিবের এসব একপেশে বক্তব্য থেকে মনে হয় তিনি পাকিস্তানের পথ ধরেই এগুচ্ছিলেন।  কাবুল সরকার ৬ই আগস্ট সংস্থাকে জানিয়ে দেয় আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে তারা সম্মেলনের আয়ােজন করতে পারবে না।  অনুষ্ঠানে চূড়ান্ত ইশতেহার তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। সেনেগালের প্রতিনিধি যিনি সম্মেলনের সঞ্চালক নির্বাচিত হয়েছেন তিনি সংবাদ সম্মেলনে ২২শে জুন বলেছেন, মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সহযােগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করাই এই সম্মেলনের লক্ষ্য এ বক্তব্য সৌদি আরবিয়ান রেডিও প্রচার করে। তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সৌদি আরবের প্রচেষ্টা হলাে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করা। কনফারেন্সের সেক্রেটারি প্রিন্স আবদুল রহমান মুসলিম বিশ্ব এ পর্যন্ত দুটি সভা করেছে, একটি রাতে এবং অন্যটি করাচিও। তিনি বলেন এই সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে ইসলামিক সংহতি এবং সেক্রেটারিয়েট জেনারেল চার্টার বিষয়ে আলােচনা হয়েছে। এই চার্টার ইসলামিক পররাষ্ট্র বৈঠকে পেশ হবে।”
২২ জাতির ইসলামিক কনফারেন্সের এক যৌথ বিবৃতিতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ  বিষয়ে হস্তক্ষেপে নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। উক্ত কনফারেন্সে পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্য ও ভৌগােলিক অখণ্ডতার নিরাপত্তা বিধানে পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। উক্ত ২২ জাতির কনফারেন্সের পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কমােডর আবদুল হামিদ পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব করেন। যৌথ বিবৃতিতে আরাে বলা হয়, পাকিস্তানের রাষ্ট্ৰীয় ঐক্য ও ভৌগােলিক অখণ্ডতা রক্ষায় যেকোনাে বৈদেশিক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের নিন্দা করা হয়। আফগানিস্তানঃ আফগানিস্তানের বাদশাহ জহির শাহ-র সম্মানে যুগােশ্লোভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর ভােজসভায় প্রদত্ত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বাদশাহ যুদ্ধাবস্থার (ভারত-পাকিস্তান) গভীর উদবেগ প্রকাশ করে বলেন, “The danger it represents for the security of our region and for peace in the world. লিবিয়া: লিবীয় নেতা কর্ণেল মুয়াম্মর গাদাফি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলাে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বন্ধে বিলম্ব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ভারত উপমহাদেশে পরাশক্তি ঔপনিবেশিক স্বার্থে অনুপ্রবেশের সুযােগ পাবে। মিশর থেকে ত্রিশ মাইল দূরে মানওয়াদহ-এ পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল মােজাফফর হাসান-এর সঙ্গে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত আলােচনা প্রসঙ্গে বলেন যাই হােক না কেন পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে (President Anwar Sadaat of Egypt has reiterated his support for Pakistan saying, “Whatever happens, we shall continue to support the integrity of Pakistan”)। এই সভায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ইকবাল আহমদ আখন্দ, মিশরের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মােহাম্মদ ফাহমী উপস্থিত। ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার দু’বার সাক্ষাতের কথা স্বরণ করে তিনি বলেন, রাবাত এবং কায়রােতে ঐ সাক্ষাৎ দুটির মাধ্যমে দু’দেশের যে সহযােগিতা ব্যক্ত হয়েছে তা অব্যাহত থাকবে। পাকিস্তান বিরাজমান অবস্থারন পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক পরিকল্পনা ঘােষণায় তিনি খুশি হয়েছেন। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইদি আমিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী বরাবর এক পত্রে বলেন, তার দেশ সর্বদাই অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। তিনি জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী পাকিস্তানের সঙ্গে যে পার্থক্য রয়েছে তার শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য আবেদন জানান। পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী প্রতিটি মুসলমানের জন্য গর্বের উৎস। জর্ডান রাষ্ট্রদূত সৈয়দ কামেল আল শারীদ যখন তিনি বাদশাহ হােসেন কর্তৃক পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের মেডেল উপহার দিচ্ছেলেন। জর্ডানের রাষ্ট্রদূত তার বাসভবনে দুপুরের ভােজসভায় আরাে বলেন, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ইসলামের আদর্শ ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ যারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। জর্ডান-পাকিস্তান সম্পর্ক পারস্পরিক মর্যাদা ও  সহযােগিতাপূর্ণ যা দুদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সম্প্রীতির ভিত্তি। তিনি আরাে বলেন, দুদেশের বন্ধুত্বের অনুপ্রেরণা মুসলিম দেশসমূহের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মুণ্ডিযুদ্ধের সময় ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো ৭ই ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্যের বিষয়ে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেন। ৬ই ডিসেম্বর মন্ত্রী পরিষদ সভাশেষে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে বিনাগ্রাহা প্রাসাদ থেকে এই সংকট সম্পর্কে বিবৃতি প্রদান করেন।
যেহেতু ইন্দোনেশিয়া ভারত ও পাকিস্তানের উভয়ের বন্ধু, সেহেতু বর্তমানে ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে সে উদবিগ্ন। বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট সুহার্তো বলেন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রকাশ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তিনি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। ইন্দোনেশিয়া তার উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এই ধরনের বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মােকাবেলা করেছে সেজন্য সে সহজেই উপলব্ধি করেন শুধু যুদ্ধ সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় নয়। যুদ্ধ অবশ্যই ধ্বংস ডেকে আনে এবং জনগণের দুর্দশা বৃদ্ধি করে ফেলে। সেজন্য ইন্দোনেশিয়ার সরকার আশা করেন যুদ্ধমান দুটো দেশ বুঝতে সক্ষম হবে যে, যুদ্ধের ফলাফল কী হতে পারে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে তারা প্রচেষ্টা চালাবে বলে তিনি আশা করেন। মালয়েশিয়া: মালােয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুল রাজ্জাক ৮ই ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মানবিক কারণে অবিলম্বে বৈরিতা পরিহারে যুদ্ধবিরতির আবেদন জানান। তিনি শান্তিপূর্ণ উপায়ে দুদেশের পার্থক্য নিরসনের আশা প্রকাশ করেন। সুশীলসমাজ ইন্দোনেশিয়া: ইন্দোনেশিয়ার সাবেক রাষ্ট্রদূত যিনি ব্রাজিল ও ইটালিতে নিয়ােজিত ছিলেন তিনি একটি দেশের ট্রাজেটি’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখেন, ‘বিশ্ব ইতিহাসে দেখা যায় নেতৃত্বের উচ্চাভিলাষ ও কর্তৃত্ব জনগণকে দুর্যোগের পথে নিয়ে যায়। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক অজ্ঞতা ভূট্টোর সঙ্গে চক্রান্ত এবং পাঞ্জাবি জেনারেলদের নিষ্ঠুর দমন প্রক্রিয়া পূর্ব পাকিস্তানের ভূমিকে রক্তাক্ত করেছে। পাকিস্তানকে ইসলামীক রাষ্ট্র বলা হলেও পাকিস্তান শাসকবৃন্দ তার নিজস্ব জনগণের প্রতি ইসলামের ‘ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন করেনি।
দামেস্ক: ঘটনাবলির প্রবণতায় দুদেশের (ভারত-পাকিস্তান) মধ্যে যুদ্ধ শরণার্থীদের আগত প্রবাহকে থামিয়ে দেবে না কিংবা রাজনৈতিক সমঝােতার দুয়ার খুলে দেবে না বরং সামরিক সমাধানে বাড়তি চেষ্টা হবে না মানুষের দুর্ভোগকে বাড়িয়ে দেবে। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের বাচাতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে।” পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষায় পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করিয়া নাইজেরিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম সােসাইটি একটি বিরাট মাহফিল-ই-মিলাদ লাগােসে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পাকিস্তানের হাই কমিশনার ড. এস. কোরেশী। অনুষ্ঠানে আয়ােজক কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব গিয়াস উদ্দিন আবদুল কাদেরী। আখরেদী পাকিস্তান সরকার ও জনগণের অখণ্ডতা রক্ষার প্রচেষ্টায় আন্তরিক সমর্থন জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, যে নামে বলা হােক না কেন, বিচ্ছিন্নতা সব অর্থেই বিচ্ছিন্নতা। তিনি পাকিস্তান সরকার ও জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেন, শান্তির শত্রুরা তারা যাই করুক বা তাদের মনে যাই থাকুক না কেন, সর্বশেষে সত্য এবং ভ্রাতৃত্ব বিজয় হবে। তিনি তার দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেন, নাইজেরিয়াতেও এ ধরনের ছােটোখাটো সমস্যা ছিল যার মধ্যেও আমরা ভ্রাতৃত্বসুলভ মনােভাব নিয়ে একই মাটিতে বসবাস করছি। তিনি পবিত্র কোরআনের সূরা-আল-ফীল-এর উদ্ধৃতি দেন। একইসাথে তিনি পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার লক্ষ্যে সাম্প্রতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন দেন। তিনি আশা করেন, শান্তির শত্রুরা পরাজিত হবে এবং পাকিস্তানের ভ্রাতাগণ বিজয়ী হবে যেমনটি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের যেসকল দেশ অনুরূপ সমস্যায় আছে তারাও বিজয়ী হবে।  মিশর কায়রাের ‘আল-আহরাম’ পত্রিকার সিনিয়র সম্পাদক ও সাবেক আরব লীগের ভারতীয় প্রতিনিধি মি. মাকসুদ বাংলাদেশ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলেন, আরব জনগণ ও রাষ্ট্রগুলাে পূর্ববঙ্গের সমস্যার ট্রাজিক ডাইমেনশন ক্রমশ উপলব্ধি করছে। পূর্ববঙ্গের এ মর্মান্তিক সমস্যার সমাধানের শেখ মুজিবের অবিলম্ব মুক্তি জরুরি। কমনওয়েলথ কনফারেন্স গায়েনা: কুয়ালালামপুর অনুষ্ঠিত কমনওলেন্থ আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি গায়েনার প্রতিনিধি আবেগপূর্ণ ভাষণে বলেন এটা আন্তর্জাতিক রীতি ও নীতি যে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ অনুষ্ঠিত, কিন্তু এটা ঠিক যে মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশা দুঃসহ অবস্থা যেখানে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, সকল জননৈতিকভাবে অমর্যদা বিপন্ন বৈশ্বিক ন্যায্যতা সেক্ষেত্রে কমনওয়েলথ এর পার্লামেন্ট সদস্যদের এ সম্পর্কে কথা বলার মতামত দেবার অধিকার দেয়। আইনের শাসন ও বৈশ্বিক ন্যায়তার স্বার্থে ভারত-পাকিস্তানে যা ঘটছে তার অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ইন্দোনেশিয়া: কুয়ালমপুরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি সম্মেলনে পর্যবেক্ষক মােহাম্মদ রয়েম এই ব্যক্তিগত অভিত প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় তা তিনি স্বীকার করেন না। বৈশ্বিক শান্তির ক্ষেত্রে কোনাে দেশ যদি হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তখন বিষয়টি অভ্যন্তরীণ থাকে না। তিনি পরামর্শ দেন জাতিসংঘ এবং নিরাপত্তা পরিষদ কেন হস্তক্ষেপ করছে না। ভারতের পক্ষে বিষয়টি জাতিসংঘ উত্থাপন সঠিক হবে না- তবে সহানুভূতিশীল দেশগুলো এ ব্যাপারে স্ব-ইচ্ছায় এগিয়ে আসতে পারে ।
 মালয়েশিয়া: মালয়েশিয়া ডেমােক্রেটিক অ্যাকশন পার্টির নেতা মােরিন তার বক্তব্যে ঈষৎ করে বলেন ইন্দোনেশিয়ার সরকার এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিষয়কে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে চিন্তা করছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘােষণা করেছে। দেশটির রয়েছে সুনির্দিষ্ট সীমান্ত, জনগণের উপর তাদের আইনানুগ কর্তৃত্ব রয়েছে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সরকার ও প্রশাসনিক কাঠামাে রয়েছে। দেশটির জাতিগত ও ভাষাগত মানবাধিকার ঘােষণার অনুচ্ছেদ ২০ (ক) বলা হয়েছে, জনগণের অভিপ্রায় হবে সরকারের ভিত্তি। কিন্তু সামরিক শক্তি বলে জনগণের আকাক্ষা ধূলিসাৎ করা হয়েছে। ইয়াহিয়া খান বাস্তবিক পক্ষে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে যা আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ হিসেবে ঘােষিত এটা অত্যন্ত পরিহাসের বিষয় যে, পশ্চিম পাকিস্তান ভিয়েতনামের হত্যাকাণ্ডে সােচ্চার বর্তমানে তারাই বাংলাদেশের চারমাসে যে সংখ্যায় গণহত্যা চালিয়েছে যা ভিয়েতনামে চার বছর লেগেছে শরণার্থী সদস্য বন্যা ইত্যাদির উল্লেখ করে বলেন এই সম্মেলন যেন কার্যকর হয় তার জন্য তিনি প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন :
১. অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি, ২. বাংলাদেশ হতে ইয়াহিয়া খানের সৈন্য প্রত্যাহার, ৩. বাংলাদেশকে পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান ও লক্ষ্য অর্জনে  ক, বাংলাদেশে যেন কলম্ব ও মালদ্বীপ হয়ে সৈন্য না আসতে পারে তার জন্য  শ্রীলংকা ও ব্রিটেনের উপর চাপ প্রদান; খ. ভারতের গণমাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য উদ্দীপক সংগীত প্রচারের ব্যবস্থা করা; গ, পরাশক্তিসমূহ যেন ইয়াহিয়া খান ও তার চক্রকে গণহত্যা বন্ধে বুঝাতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে; ঘ, স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশসমূহ শরণার্থীদের সাহায্য দিচ্ছে। এই সাহায্য রেডক্রস ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমেও হতে পারে সে জন্য অনুরােধ জানান। নয়াদিল্পি কনফারেন্স বাংলাদেশ প্রশ্নে ১৮ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিল্লিতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ২৪টি দেশের ১৫০জন প্রতিনিধি উপস্থিত হন। উক্ত সম্মেলনে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে আফগানিস্তান, ইউ,এ,আর, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিবর্গ অংশগ্রহণ করেন। আফগানিস্তানের প্রতিনিধি কুদরত উল্লাহ হাদাত তার বক্তব্যে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তার দেশের জনগণের গভীর সহানুভূতির কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জন করবে কেননা, ভৌগােলিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কোনাে মিল নেই। কিন্তু জনগণের ভােটের মাধ্যমে তা অর্জিত না হওয়ার ফলে বাংলাদেশের জনগণ নির্মম বর্বরতার শিকার হয়েছে যা আফগান জনগণ নিন্দা জ্ঞাপন করেন। তিনি সমগ্র বিশ্বের সহানুভূতি বাংলাদেশের অনুকূলে রয়েছে এবং অধিরেই তারা বিজয়ী হবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্লোডিজ মাকসুদ যিনি পর্যবেক্ষক হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যাবে যে, পূর্ববঙ্গের ভাগ্য ভারত ও পাকিস্তানভারতের অংশ নয়, হতে পারে না এবং হওয়া উচিত নয়। এটি সত্য যে বাংলাদেশের জনগণ সংগ্রাম করছে এবং তাদের স্বাধীনতা পাওয়া উচিত এবং একইসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি প্রদান করা উচিত। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। পূর্ববঙ্গের জনগণের মর্যাদা সম্মান ও সভ্যতার জন্য লড়াই করবাে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আগত পর্যবেক্ষক মােহাম্মদ রয়েম তার বক্তব্যে বলেন, যদি কোনাে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি যদি আন্তর্জাতিক হুমকির কারণ হয় তখন বিষয়টি অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকে না। এটা পরিষ্কার যে, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মালয়েশিয়া থেকে আগত প্রতিনিধি ভি, ডেজ্ঞি বলেন, বর্তমান সংকট সম্পর্কে মালয়েশিয়ার সরকার সম্পূর্ণ নীরব। কিন্তু জনগণ উদবিগ্ন। তারা বাংলাদেশের। স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা পাক তা দেখতে চায়। কেউ মনে করেন, এটা ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত; আবার অনেকেই বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। আমরা যদি আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে বিশ্বাস করি তাহলে বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ে নীরব থাকতে পারে না । দ্বিতীয়ত, কেউ যদি বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা বলতে চায় তাহলে তার যােগ্য ও যথার্থ গণতান্ত্রিক নেতা হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যদি এশিয়ায় শান্তি ও সমৃদ্ধি অক্ষুন্ন রাখতে হয় তাহলে অবিলম্বে তাকে মুক্ত করা উচিত এবং তার সঙ্গে কথা বলা উচিত। জাতিসংঘ যেভাবে কাজ করছে তাতে মালয়েশিয়ার জীবন বিব্রত ও উদবিগ্ন। এই ভয়ংকর বর্বর গণহত্যার নিন্দা করা। প্রয়ােজন এবং এ সঙ্গে এও বলে দিতে চাই মালয়েশিয়ান জনগণ বাংলাদেশের। ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে তাদের সঙ্গে আছে যে সংগ্রাম তাদের স্বাধীনতা এনে দেবে। দিল্লি সম্মেলনে ১৩টি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানের অধীন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন, শরণার্থীদের। সাহায্যের জন্য ভারত সরকার ও জনগণের প্রশংসা করা হয়। একই সাথে সভা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামকে স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়।
পাকিস্তান গুরুতর মানবাধিকার লঙ্নকে জাতিসংঘে ও তার অঙ্গ-সংগঠনসমূহে উত্থাপন করা জোর দাবি জানিয়ে বলা হয় মানবাধিকার লঙ্ঘনে বিশ্বশান্তি হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সভা দৃঢ়ভাবে মনে করে, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের অনুমােদন সাপেক্ষে রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হয় আশু করণীয়। বাংলাদেশ সরকারকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়ােজন এজন্য যে, ভৌগােলিক, ঐতিহাসিক, জাতিগত, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ করা নৈতিক দায়িত্ব। পাকিস্তানে অস্ত্র ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের প্রস্তাব গৃহীত হয়। দেশে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠন জানানাে হয়। মুসলিম দেশের গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ : মিশ্র প্রতিক্রিয়া পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, ধর্ষণ ও মানবতাবিরােধী জঘন্যতম কর্মকাণ্ড বিভিন্ন দেশের মতাে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলাের সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় এবং বিজয়ী দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর অস্বীকৃতি এবং আলােচনার অন্তরালে সামরিক প্রস্তুতি এবং নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর সশস্ত্র আক্রমণ, নিরাপত্তাহীন জনগণের প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয়গ্রহণ, শরণার্থী সমস্যা, ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, মুজিবনগর সরকার গঠন এবং বিশ্ব পরিসরে কূটনৈতিক তৎপরতা ও বিরাজমান সংকট সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদপত্রে সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। প্রধানত মুসলিম দেশগুলাের সংবাদপত্র মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে, কয়েকটি সংবাদপত্র পক্ষে বা নিরপেক্ষভাবে সংবাদ প্রকাশ ও বিশ্লেষণ দেখা যায়। সৌদি আরবসহ ইরান, নাইজেরিয়া এবং ত্রিপােলির সংবাদপত্রসমূহ সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সরকারের পক্ষাবলম্বন করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উল্লেখ করে এ সকল সংবাদপত্র একতরফাভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে একইসাথে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে ইসরাইলের প্ররােচনা আবিষ্কার করে। পকিস্তানের অখণ্ডতা বিনষ্টে ভারত অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দিয়ে উস্কানি দিচ্ছে।
এ ধরনের সংবাদের বিপরীত চিত্র পাওয়া যায় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, বৈরুত, কুয়েত এমনকি সেনেগালের পত্রিকায়। এসব পত্রিকা সামরিক জান্তা কর্তৃক গণরায় বানচাল, বাঙালির নিধনযজ্ঞ, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, শরণার্থীদের দুর্দশা, মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাদের প্রতিরােধ, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষণ ও পাকিস্তানের সামরিক চক্রসহ জেনারেল ইয়াহিয়াকে দায়ী করে সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। একইসঙ্গে বৃহৎ শক্তিগুলাের ভূমিকার সমালােচনা করে। তুরস্ক থেকে প্রকাশিত ‘আঙ্কারা নিউজ’ ম্যাগাজিন ইয়ানকি এক প্রতিবেদনে এই অভিমত প্রকাশ করে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন তা বাস্তবায়ন হয়নি। এখনও বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা- অসম্ভব, কেননা সবকিছু ত্যাগ করে পাচ লক্ষাধিক মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবং সেখানে তারা আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমান অবস্থায় সামরিক চক্র মুসলিম লীগকে সমর্থন করে যদিও এই দলটি পূর্ববঙ্গে একটিও আসন পায়নি। অন্য বিকল্প পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি যার নেতৃত্বে আমিন কিন্তু জনগণের মধ্যে বর্তমানে তিনি জনপ্রিয় নন। পত্রিকাটিতে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ব্যতীত পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা অসম্ভব যদি বর্তমানে তা হবার নয়।” বৈরুত থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা আল-আনবা ভারত সীমান্ত পরিদর্শন করে এক রিপাের্টে লেখেন পূর্ববঙ্গের জনগণের উপর যে ট্রাজেটি তা বাস্তবিক অর্থেই মর্মান্তিক, নির্যাতন কল্পনাতীত। নারী, শিশু ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যে নৃশংস অত্যাচার করা হয়েছে যা প্যালেস্টানিদের উপর যেভাবে ইহুদিরা করেছে। পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়, শরণার্থীদের সংখ্যা প্রায় আশি লক্ষ। 
কেনিয়ার ‘সানডে পােস্ট’-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ক্র্যাস ইন্ডিয়া’ আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানে ছড়িয়ে গেলেও দুর্দশাগ্রস্ত শরণার্থীরা যাতে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে সে পরিবেশ তৈরি করা। ইন্দোনেশিয়া রায়া পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, যুক্তির পরাজয় ঘটেছে, কামান কথা বলছে। পাকিস্তান এখন ইন্দোনেশিয়ায় বিশেষ প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। কিন্তু বিশ্ব দেখেছে পাকিস্তান কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে তার নিজ জনগণের সঙ্গে জঘন্য আচরণ করেছে, বিজয়ী আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করেছে, তার অনুসারীদের হত্যা বা গ্রেফতার করেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার বাংলাদেশের জনগণের উপর আক্রমণ চালালে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, যার ভার পৃথিবীর কোনাে একক দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পাকিস্তানকেই করতে হবে এবং এজন্য তাদের ভুল সংশােধন করতে হবে।” ইরানের নেতা-ই-ইরান নভিন (NEDA-I-IRAN NOVIN) ১১ই জুলাই উপমহাদেশে উদ্‌বেগ নিরসনে ভারতের নেতৃত্বকে আন্তরিকভাবে একটি স্বাধীন এবং স্বার্বোভৌম দেশ হিসেবে পাকিস্তানের অস্তিত্বকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। ভারতের সাপ্তাহিক পত্রিকা ব্লিস (Blitz) পত্রিকার সম্পাদক কারানজিয়া সম্পাদকীয়তে বলেছেন, ভারতের নেতৃত্ব মনে করে পাকিস্তান একটি অভিনব রাষ্ট্র যার আয়ুষ্কাল স্বল্প। ভারতের এই মনােভাব সম্পর্কে উক্ত পত্রিকায় বলা হয়, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় এবং ভারতসহ বিদেশি শক্তিগুলাের বাংলাদেশ সংকটকে নিরুৎসাহিত করা উচিত এবং বর্তমান পাকিস্তানের দুর্বল অবস্থান থেকে মুনাফা অর্জনের সুযােগ নেওয়া সঠিক হবে না। পত্রিকাতে বলা হয়, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমঝােতার মাধ্যমে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণ হবে সবচেয়ে ভালাে। পত্রিকাটি সরকারি দলের অফিসিয়াল মুখপাত্র হিসেবে এই বক্তব্য প্রদান করেন।  স্পেনের দৈনিক পত্রিকা দি আরাবিয়া ২২শে জুন, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলেন, শরণার্থীদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা থেকে ভারতকে নিবৃত্ত থাকতে হবে এবং এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ভারত শরণার্থীদের ছায়াবৃত্তভাবে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তাদের প্রয়ােজনের সময় যাতে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। পত্রিকাটি সতর্ক করে দিয়ে বলে, এর পরিণামে সম্ভবত ভারত-পাকিস্তানের নতুন যুদ্ধ ডেকে আনবে। পত্রিকাটি আরও মন্তব্য করে যে, এই গেরিলা ক্যাম্পগুলাে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত এবং পশ্চিমবঙ্গের কম্যুনিস্ট পার্টি দুই বাংলাকে স্বাধীন করবে যা নিয়ে নয়াদিল্লির সতর্ক হওয়া উচিত। পত্রিকাটি আরও মন্তব্য করেন দুর্বল পাকিস্তান ভারতের জন্য নিশ্চয় তুষ্টিকর। কিন্তু পশ্চিমবাংলার হিন্দু ক্যুনিস্টরা বাংলাদেশকে গিলে ফেললে তা হবে ভারতের জন্য ভয়ংকর ব্যাপার। পত্রিকাটি আরও বর্ণনা করে যে, ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা এ কথা স্বীকার করেছে যে, ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা পাকিস্তানের সীমান্তের ত্রিশ-চল্লিশ কিলােমিটারের ভেতরে অবস্থান নিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎসাহিত করার জন্য ভারতীয় গণমাধ্যম ও বেতারকে দোষারােপ করেন। পত্রিকাটি আরাে বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কেবল মাত্র আহম্মকদের কল্পনা ব্যতীত কিছু নয়। 
ডেইলি আল বিলাদ’ জেদ্দা, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এর সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল, পাকিস্তানের জন্য সম্মানজনক’। এতে মন্তব্য করা হয় যে, মুজিবুর রহমানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সহায়তার জন্য ইসরায়েলের সাথে যােগাযােগ করেছে তা পাকিস্তানের জন্য যথেষ্ট সম্মানজনক।’ এতে বলা হয়, “ইসরায়েলের কাছ থেকে দলটি কোনাে সাহায্য পায়নি। দলটির উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। এই সম্পাদকীয়তে ইসরায়েলকে আখ্যায়িত করা হয় মানবতা, আরব এবং ইসলামের শত্রু হিসেবে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিনিধি মাহমুদ কাশিম ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যােগাযােগ করছে। পূর্ব পাকিস্তানি জনগণকে ইসরায়েলিরা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আরবদের ধারণাতেই ছিল যে, কেউ যদি তার দেশের ঐক্যের ব্যাপারে অসৎ হয় তবে সে নিশ্চিতভাবেই একদিন ইসরায়েল বা অনুরূপ দেশের সঙ্গে যােগাযােগ করবে। শত্রুরা যদি পাকিস্তানের ক্ষতি করার জন্য ইসরায়েলের কাছ থেকে সহায়তা নেয় তাহলে ঐ মুসলিম দেশটির জন্য সম্মানজনক বিবেচিত হবে। এ দেশটি (পাকিস্তান) কোনাে ঘটনাতেই আরবদের পরিত্যাগ করেনি এবং হুমকি বা চাপের মুখেও ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে। “আমরা আরবরা স্থায়ীভাবে নৈতিক সমর্থন পাওয়ায় পাকিস্তানের কাছে ঋণী। কিছু আরব দেশ যখন তাদের অবস্থানে অবিচল ছিল , তখনও তারা এই সমর্থন দিয়েছে। তাদের এই সমর্থন ইসরায়েলকে ক্ষুব্ধ করেছে। এজন্যই ইসরায়েল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু ইসরায়েলের চেয়ে বড় শক্তিও আরবদের প্রতি সমর্থন দান থেকে পাকিস্তানকে বিরত রাখতে পারবে না।” পূর্ব পাকিস্তান সংঘাত সম্পর্কে বলা হয়, এটি মুসলমানদের মধ্যে ভাঙন ঘটানাের চেষ্টা মাত্র। “তথাকথিত মাহমুদ কাশিম (যিনি ইসরায়েলের সাথে বাংলাদেশের হয়ে যােগাযােগ করেন) গত ১৫ বছর ধরে তেহরানে বসবাস করছেন এবং পরে ইরান। সরকার তাকে বহিষ্কার করে। তিনি সেখান থেকে জেনেভা যান। নিঃসন্দেহে তিনি। সেখানে ইসরায়েলি গােয়েন্দাদের সংস্পর্শে আসেন এবং তারাই তেলআবিবে তার সফরের ব্যবস্থা করেন। কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপারে আমাদের অভিমত কিছুতেই পাল্টাবে না যে তারা হচ্ছে সেসব লােক যারা পাকিস্তানের কোনাে ক্ষতি করার আগে বরং নিজেদেরই ক্ষতি করছে।”
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলাে সমালােচনা করে নাইজেরিয়ার ‘ডেইলি মর্নিং পােস্ট ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এ তুনজি আদেওসুন লিখিত একটি রিপাের্ট প্রকাশ করে, যার শিরােনাম ছিলাে, পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা’। জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক গােষ্ঠী বিচ্ছিন্নতার একটি প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং পাকিস্তান সরকার পরিস্থিতি দমনের জন্য পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকে সশস্ত্র প্রতিরােধের মুখেও সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। পত্রিকাটিতে আরাে বলা হয়, পাকিস্তানের এ যুদ্ধই এমনটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলাের কিছু অংশ স্পর্শকাতর ভূমিকায় নেমেছে। দেশটির পরিস্থিতি সম্পর্কে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বিবরণ দেওয়ার ঘটনার মতই নাইজেরিয়ার সমস্যাকালে পাঠকদের অনুরূপ খবর দেওয়া হয়েছিল। এই সাংবাদিকরা পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করার চেষ্টা করেছে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের যুক্তরাষ্ট্রের স্থানে এবং পূর্ব পাকিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উত্তর ভিয়েতনামবাসীদের সঙ্গে তুলনা করছে। কিন্তু একটি শিশুও জানে অধিক যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণ এবং যা প্রত্যেকেই কামনা করে তা হচ্ছে নাইজেরিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি। ফেডারেল সৈন্য পাঠিয়েছে। গুলি ছুঁড়তে উৎসাহী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছবি সম্পূর্ণ। মিথ্যা। এই রিপাের্টে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আন্দোলনের সংগ্রামকে বলা হয়েছে বিচ্ছিন্নতার একটি প্রচেষ্টা’। আর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনার বর্বর হামলাকে বলা হয়েছে পরিস্থিতি দমনের জন্য নেওয়া পদক্ষেপ।
“আরেকটি বিস্ময়কর খবরে কিছু শরণার্থী লন্ডনে একটি পত্রিকাকে বলেছে যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের গলায় ও বুকে গুলি করে এবং তারা বেঁচে যায়। একজনের গলা এবং একজনের বুকের মধ্যদিয়ে সৈন্যদের গুলি চলে যাওয়ার পর বেঁচে যাওয়ার ঘটনা কেউ বিশ্বাস করলে তাকে নতুন বিজ্ঞান সৃষ্টি করতে হবে।” এই সংবাদপত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে সমালােচনা করে এবং বলে যে, শুরু থেকেই শেখ মুজিব আলােচনার ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন না এবং বিচ্ছিন্নতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। শেখ মুজিবের অসহযােগ আন্দোলনকে বলা হয়েছে আইন অমান্য করলে আন্দোলন শুরু করেন তিনি। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কঠোর মনােভাব গ্রহণ করেন যেখানে আলােচনার কোনাে সুযােগ দাঁড়ায়। কিন্তু সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় একই সময়ে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮% থেকে ৫৩% ছাড়িয়েছে। পত্রিকাটিতে উল্টা পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানাের চেষ্টা করা হয় যে, “পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করছে বলে ভারতীয়দের কথিত অভিযােগগুলাে আদত বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে ধােপে টেকে না।” সেনাবাহিনীর নৃশংসতা এবং হত্যা সম্পর্কিত খবরের ব্যাপারে পত্রিকাটি প্রকৃত অর্থেই পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি স্তুতি করেছে। বলা হয়েছে, “ঘটনা হচ্ছে সাংবাদিকদের কেউ নিজে কিছুই লিখেননি। কিন্তু বরাবরই তারা বিভিন্ন সূত্রের স্বীকৃতি দিয়েছেন। পূর্বপাকিস্তানে কী ঘটেছে কলকাতায় বসে সাংবাদিকরা কী করে জানলেন? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিবিসি’র প্রচারণা সম্পর্কে আমাদের কিছু আরব বন্ধুদের বলতে চাই যে, আপনারা যদি মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে বিবিসি’র খবরের জন্য নির্ভর করতে পারেন, তাহলেই কেবল পাকিস্তান সংশ্লিষ্ট খবরের জন্য বিবিসি’র উপর নির্ভর করতে পারেন। বলা হয়েছে, বিবিসিসহ অন্যান্য পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলােতে ইহুদিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। জেদ্দা থেকে প্রকাশিত ‘দি ডেইলি আল মদিনা’ ৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এ আদনান কামেল সালাহ কর্তৃক সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন তােলা হয়েছে, ‘যুদ্ধ কোথায়? “গতকাল (২৯শে সেপ্টেম্বর) মস্কোয় প্রকাশিত রুশ-ভারত যৌথ বিবৃতিটি পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাশিয়া ও ভারতের হস্তক্ষেপের পর আরেকটি পদক্ষেপ। সত্য বটে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ভারতে চলে গেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা মােটেও ৩০ লাখ নয়, যদিও ভারত এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। ভারতের ভূখণ্ড থেকে যাওয়া অন্তর্ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচার জন্যই শরণার্থীরা ভারতে পালিয়ে গেছে।” “পাকিস্তানকেই ভূখণ্ড রক্ষা এবং নিজ ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত বন্ধ করতে হবে। এজন্যই তারা আগ্রাসন চালাচ্ছে না বা যুদ্ধ লাগাচ্ছে না। কিন্তু ভারত রাশিয়ার সঙ্গে। প্রতিরক্ষা ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে একটা মারাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক কাজে সহায়তা দিচ্ছে। এজন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন অংশের। পরস্পরবিরােধী গােষ্ঠীগুলাের কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে মস্কোর কোসিগিন, কানাডা ও ব্রিটেনের বিভিন্ন খ্রিষ্টান সংগঠন, আমেরিকার কেনেডি এবং ইসরাইলের ইহুদি নেতৃবৃন্দ।

এ সকল পরস্পর বিরােধীদের প্রতিহত করতে পারলেই শান্তির ব্যাপারে প্রকৃত ইচ্ছার প্রকাশ ঘটতে পারে।” তুরস্ক থেকে প্রকাশিত আকশাম, ৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল-এ “পূর্বপাকিস্তানের। সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্কটি ছিল ঔপনিবেশিক ধরনের। ধর্ম ছাড়া এই দুই অঞ্চলের মধ্যে আর কোনাে মিলই নেই। পূর্ব পাকিস্তানিরা জাতীয় মুক্তির জন্য পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে লড়ছে।”

‘দি জাকার্তা টাইমস, ১৫ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল: সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল, “গণহত্যা বন্ধ কর।” পত্রিকাটি পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের পরিচালিত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলে যে, ইসলাম কি এটা অনুমােদন দেয়? অস্ত্রধারী একদল নেই। তখন তার মনোভাব ছিল ‘মেনে নাও অথবা চলে যাও।’ বলা হয়েছে, “এক শ্রেণির পত্রিকায় বিভিন্ন খবরে গণদাবী হিসেবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে বড় করে তােলার চেষ্টা কেবল সত্যের অপলাপ নয়, পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে সেটি হচ্ছে এক ধরনের মানসিক যুদ্ধ।” তেহরান থেকে প্রকাশিত ডেইলি আয়ানদেগান’ নামক একটি পত্রিকা ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে প্রতিবেদক হুমায়ুন দারাইউস কর্তৃক খবরের শিরােনামে ছিল, ‘পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান’। এই প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে সেই সময়ে ইরানের অবস্থান ও নীতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যেতে পারে। একটি মধ্যপ্রাচীয় দেশ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করে ইসলাম ধর্মের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের সাথে শুরু থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলাের সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং মধ্যপ্রাচ্য পাকিস্তান বলতে এর পশ্চিম অংশকেই বুঝাতাে। ইরানি এই পত্রিকাটি সংকট সমাধানে কতিপয় বক্তব্য তুলে ধরে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে যা প্রয়ােজন, তা হলাে একটি বেসামরিক মন্ত্রীপরিষদ গঠন, সামরিক শাসনের অবসান, সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দান এবং জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে সরকারের দায়িত্ব অর্পণ করা। ইয়াহিয়া খানের জন্য এইসব কম সমস্যাপূর্ণ না হলেও তিনি এখন এই পথই অবলম্বন করছেন। প্রথমত, আওয়ামী লীগের নির্বাচিত অনেক সদস্য ভারতে চলে গেছেন এবং তারা দেশে ফেরার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, তাদের ফেরার। ব্যবস্থা করার জন্য উপমহাদেশের একাধিক সরকারের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়ােজন।  পত্রিকাটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জন্য স্তুতি করে। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ইয়াহিয়া গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয়। বলা হয়েছে, একজন সৈনিক হিসেবে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষা এবং জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য এ যাবৎ আশাতীত উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি প্রথমবারের মতাে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রশংসনীয়ভাবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন এবং একদিকে বাঙালিদের ও অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর দাবি পূরণের জন্য তারপক্ষে সম্ভব সব কিছুই করেছেন। তিনি মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীত্ব উপহার দিতে চেয়েছেন বলে জনৈক পর্যবেক্ষক বলেন। কিন্তু মুজিব ক্ষমতা গ্রহণ করেননি এবং বৈধ উপায়ে সমস্যাগুলাে সমাধান করতে চাননি। এটা ইয়াহিয়া খানের ভুল নয়। এ পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করার উদ্যোগ রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে মােটেও সহায়ক হবে না।
ত্রিপােলি থেকে প্রকাশিত ডেইলি আল থাউরা’ ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এ সম্পাদকীয় পাকিস্তান পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, লিবীয় আরব প্রজাতন্ত্রের জনগণ পাকিস্তানের জনগণকে তাদের সংকটের মুহূর্তে অবিচল ও আন্তরিক সমর্থন দিয়েছে। তাসত্ত্বেও ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের একথা জানা জরুরি যে, তারা পাকিস্তানে তাদের ভাইদের কেবল সমর্থন করছে না বরং তারা একটি সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত বিষয়কে সমর্থন করছে। আন্তর্জাতিক ও ইহুদীবাদী চক্র পাকিস্তানের বর্তমান সংঘাতকে পাকিস্তান ধ্বংসের একটি সুবর্ণ সুযােগ হিসেবে বিবেচনা করছে এবং এর মাধ্যমে আরবদের সবচেয়ে ভ্রাতৃপ্রতিম দেশটিকে বিনাশ করতে চাইছে। | পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বঞ্চনার চিত্রকে উল্টো করে দেখার চেষ্টা করেছে লিবিয়ার এই সংবাদপত্র। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয় বর্তমানে দেশের আয়ের ৫০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকারে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ১৯৬১ সালে ছিল ২৬.১ শতাংশ এবং ১৯৬৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২৬.৩ শতাংশ  দাঁড়ায়। কিন্তু সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় একই সময়ে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮% থেকে ৫৩% ছাড়িয়েছে। পত্রিকাটিতে উল্টা পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানাের চেষ্টা করা হয় যে, “পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করছে বলে ভারতীয়দের কথিত অভিযােগগুলাে আদত বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে ধােপে টেকে না।” সেনাবাহিনীর নৃশংসতা এবং হত্যা সম্পর্কিত খবরের ব্যাপারে পত্রিকাটি প্রকৃত অর্থেই পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি স্তুতি করেছে। বলা হয়েছে, “ঘটনা হচ্ছে সাংবাদিকদের কেউ নিজে কিছুই লিখেননি। কিন্তু বরাবরই তারা বিভিন্ন সূত্রের স্বীকৃতি দিয়েছেন। পূর্বপাকিস্তানে কী ঘটেছে কলকাতায় বসে সাংবাদিকরা কী করে জানলেন? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিবিসি’র প্রচারণা সম্পর্কে আমাদের কিছু আরব বন্ধুদের বলতে চাই যে, আপনারা যদি মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে বিবিসি’র খবরের জন্য নির্ভর করতে পারেন, তাহলেই কেবল পাকিস্তান সংশ্লিষ্ট খবরের জন্য বিবিসি’র উপর নির্ভর করতে পারেন। বলা হয়েছে, বিবিসিসহ অন্যান্য পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলােতে ইহুদিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। জেদ্দা থেকে প্রকাশিত ‘দি ডেইলি আল মদিনা’ ৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এ আদনান কামেল সালাহ কর্তৃক সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন তােলা হয়েছে, ‘যুদ্ধ কোথায়? “গতকাল (২৯শে সেপ্টেম্বর) মস্কোয় প্রকাশিত রুশ-ভারত যৌথ বিবৃতিটি পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাশিয়া ও ভারতের হস্তক্ষেপের পর আরেকটি পদক্ষেপ। সত্য বটে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ভারতে চলে গেছে।

কিন্তু তাদের সংখ্যা মােটেও ৩০ লাখ নয়, যদিও ভারত এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। ভারতের ভূখণ্ড থেকে যাওয়া অন্তর্ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচার জন্যই শরণার্থীরা ভারতে পালিয়ে গেছে।” “পাকিস্তানকেই ভূখণ্ড রক্ষা এবং নিজ ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত বন্ধ করতে হবে। এজন্যই তারা আগ্রাসন চালাচ্ছে না বা যুদ্ধ লাগাচ্ছে না। কিন্তু ভারত রাশিয়ার সঙ্গে। প্রতিরক্ষা ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে একটা মারাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক কাজে সহায়তা দিচ্ছে। এজন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন অংশের। পরস্পরবিরােধী গােষ্ঠীগুলাের কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে মস্কোর কোসিগিন, কানাডা ও ব্রিটেনের বিভিন্ন খ্রিষ্টান সংগঠন, আমেরিকার কেনেডি এবং ইসরাইলের ইহুদি নেতৃবৃন্দ। এ সকল পরস্পর বিরােধীদের প্রতিহত করতে পারলেই শান্তির ব্যাপারে প্রকৃত ইচ্ছার প্রকাশ ঘটতে পারে।” তুরস্ক থেকে প্রকাশিত আকশাম, ৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল-এ “পূর্বপাকিস্তানের। সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্কটি ছিল ঔপনিবেশিক ধরনের। ধর্ম ছাড়া এই দুই অঞ্চলের মধ্যে আর কোনাে মিলই নেই। পূর্ব পাকিস্তানিরা জাতীয় মুক্তির জন্য পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে লড়ছে।”

 ‘দি জাকার্তা টাইমস, ১৫ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল: সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল, “গণহত্যা বন্ধ কর।” পত্রিকাটি পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের পরিচালিত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলে যে, ইসলাম কি এটা অনুমােদন দেয়? অস্ত্রধারী একদল।
মুসলমান, নিরীহ আরএকদল মুসলমানকে হত্যা করবে? এ বিষয়ে মুসলিম দেশসমূহের তড়িৎ পদক্ষেপ প্রয়ােজন। আন্তর্জাতিক ইসলামিক সংগঠনসমূহেও এ ব্যাপারে নিশ্রুপ। থাকতে পারে না।  ‘দি স্টেটস টাইমস’ মালয়েশিয়া, ৮ই জুন, ১৯৭১ সাল। সম্পাদকীয় পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী। পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা কোনােক্রমেই আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। বিপুলসংখ্যক শরণার্থী প্রতিদিন ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে এবং তাদের দুৰ্গীত ক্রমেই বাড়ছে। এ অবস্থায় ভারতের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। চার মিলিয়ন। শরণার্থী ইতােমধ্যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং এ সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রকাশিত ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার ৩০ই আগস্ট, ১৯৭১ সাল-এর সম্পাদকীয় নজিরবিহীন ট্র্যাজেডি’। পূর্ব পাকিস্তানের মানবিক বিপর্যয়ের খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণে স্বক্ষম হয়েছে, এর কারণ হলাে সেখানে সংঘটিত গণহত্যা নজিরবিহীন মাত্রায় এবং এর ফলে অসংখ্য লােক ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে, পাঁচ মাসের সংঘর্ষের ফলে ইতােমধ্যে সাড়ে সাত মিলিয়ন বাঙালি ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিকবাহিনী দিয়ে সমাধানের অভিযােগ উঠেছে ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে এবং এ বিচারে ইয়াহিয়া তার। পূর্বসূরি আইয়ুব খানের চেয়ে নিকৃষ্টতম কারণ সে তার সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে লাখ লাখ নিরস্ত্র বাঙালির বিরুদ্ধে। | ডাকার সেনেগাল থেকে প্রকাশিত লে সােলাই ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এ বারা ডিউফ এর প্রতিবেদন, পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের নিয়ে ভারত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন শিরােনামে বলা হয়, “ভারতে এখন ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন নাটকের মঞ্চায়ন হচ্ছে। প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি উদ্বাস্তু সীমান্ত অতিক্রম করে দেশে ঢুকছে। সরকার তাদের খাওয়ানাের জন্য প্রতিদিন দুই কোটি রুপি ব্যয় করছে। এ অর্থ তাদের সমুদ্র সমান দুর্দশার মধ্যে এক ফোটা পানি মাত্র। পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের এটি হচ্ছে করুণ পরিণতি। এতে বলা হয়, ২৬শে মার্চ ১৯৭১ সাল-এ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপারে ১৫০০ কিলােমিটার বেশি দূরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন। পাকিস্তানের একটি অংশের ভাষা অপর অংশের মানুষ ও ভাষা থেকে আলাদা। এমনকি আমাদের ধর্ম ইসলামও পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়েও ভিন্ন। এইসব পরিস্থিতিতে কিভাবে সাংস্কৃতিক ঐক্য হবে এবং একটি ঐকবদ্ধ জাতির যৌক্তিকতা কি হতে পারে?” পত্রিকাটিতে বলা হয়, কলােনিয়েল শশাষণ, শাসন, আর্থিক লুণ্ঠন, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তান গ্রাস করেছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। পত্রিকাটিতে লেখা হয়, “সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বিশ হাজার গেরিলা ছড়িয়ে রয়েছে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ইয়াহিয়া খানের সত্তর হাজার , সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।” বৈরুত ২রা অক্টোবর ১৯৭১ সাল, সাপ্তাহিক আল আনবা’ পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তানি নারী, শিশু ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের পরিচালিত গণহত্যাকে প্যালেস্টাইনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলিদের অপরাধের সাথে তুলনা করে। পত্রিকাটি অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ, পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে সম্পাকীয় লেখে। শিরােনাম ছিলাে, “বাংরাদেশের শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার আহ্বান।’
৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল, ইন্দোনেশিয়ায় ‘রায়া’ পত্রিকার সম্পাদকীয় শিরােনাম, ‘পাকিস্তান দায়ী’। এতে বলা হয়, নিজ দেশের জনগণেকে হত্যা করছে পাকিস্তানের সামরিক সরকার। পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান দেখানাে এবং তাদের ভুল সংশােধন করা।  ২২শে অক্টোবর ‘আল সাওরা দামেস্কে-এ বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সমাধানে সামরিক শক্তি প্রয়ােগ ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এবং তা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। পত্রিকাটি সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের পাশাপাশি ভারতে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ শরণার্থীর জন্য সাহায্য ও ত্রাণের আহ্বান জানান।  ৭ই ডিসেম্বর ‘দি স্টেটস টাইমস’ কুয়ালালামপুর-এ লেখা হয়, একটি রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব ছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে যথাযথ চাপ প্রয়ােগে ব্যর্থতার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলাের সমালােচনা করা হয়। ২২শে সেপ্টেম্বর ‘কুয়েত টাইসম’-এ রয়টার্স পরিবেশিত খবরে শরণার্থীদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি বিশেষ করে শিশুদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা প্রাধান্য পায়।
কাইহান ইন্টারন্যাশনালের আমির তাহেরি পূর্ব পাকিস্তান সংকটের উপর বেশ কিছু ধারাবাহিক প্রতিবেদন রচনা করেন। ২৭শে জুলাই থেকে ২রা আগস্ট পর্যন্ত সময়ে মােট ৪টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ইরানি এই সাংবাদিকের লেখার মধ্যে রয়েছে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। যেখানে ইয়াহিয়া পূর্বপাকিস্তানের সংকট, সংলাপ প্রচেষ্টা, সামরিক আক্রমণ, মুজিবের ভবিষ্যৎ, পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ এবং সংকট নিরসনে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।  প্রায় ৭৫ মিনিটের সাক্ষাৎকারে ইরান সম্পর্কে উষ্ণ অনুভূতি প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। আমির তাহেরির ভাষায়, ইরানের শাহানশাহকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ইরান আমাদের জন্য শক্তির একটি বড় উৎস। ইতিহাসের বিভিন্ন সময় পাকিস্তানকে সমর্থনকারী সবচেয়ে বড়াে শক্তি ইরান একথা জেনে সবসমই আমাদের দেশটি মনে জোর পাবে। ইয়াহিয়া খান বলেন, এ সংকটের শুরু থেকেই পাকিস্তান সম্পর্কে সঠিক নীতি গ্রহণ করেছে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ব্রিটেন সম্পর্কে একথা বলা যায় না। পূর্ব পাকিস্তান সংকটের জন্য ইয়াহিয়া খান রাজনীতিবিদদের দায়ী করেন।  ২৭শে জুলাই প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বলা হয়, “নির্ভেজাল বিষন্ন কণ্ঠে ইয়াহিয়া খান বলেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিলাম।
আমি এই চেয়ারের প্রতি আমার কোনাে আগ্রহ ছিল না এবং সৈনিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযােগের অপেক্ষায় ছিলাম আমি।” তারপর মনমরা অবস্থায় তিনি বলে যেতে থাকেন, রাজনীতিবিদরাই তাকে ডুবিয়েছে, তাঁরা একমতে পৌছাতে পারেননি এবং তাদেরই কারণে দেশ আজ খণ্ডিত হওয়ার মুখে । তিনি আরাে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনীতির ধারণার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।  তিনি কিন্তু শেখ মুজিবের বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পরিকল্পনা জানতে পেরে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে তিনি বাধ্য হন। পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টোর সহায়তায় তারা বেসামরিক সরকার গঠনের চিন্তা-ভাবনা করছেন কিনা? এ প্রশ্ন সম্পর্কে ইয়াহিয়া বলেন, “শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছেন ভুট্টো। কিন্তু বেসামরিক সরকারের ভেতর দু’অঞ্চলের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় সম্পর্কে তিনি বলেন, কারচুপি-সন্ত্রাস আর অসাধু উপায়ে জয়লাভ করেছিল আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব সম্পর্কে বলেন, ‘মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে খুব শিগগিরই মুজিবের বিচার হবে।’  উদ্বাস্তুদের বিষয়ে তিনি বলেন, “তাদেরকে দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানানাে হয়েছে এবং অনেকেই ফিরতে শুরু করেছেন। তবে উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরা ঠেকাতে ওঠে পড়ে লেগেছে ভারত, কারণ তারা এই ইস্যুটিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ভারত তার নিজস্ব ভূখণ্ডের ভেতরে গেরিলাদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির খুলেছে। প্রায় ৩৫ হাজার গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রয়হীন মানুষগুলােকে।”  ২৮শে জুলাই ডেটলাইনে আমির তাহেরির দ্বিতীয় প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সংঘাতের কারণ, বর্তমান অবস্থা জানতে লেফটেল্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, জনৈক আওয়ামী লীগের এম,এস, সাবেক, বিচ্ছিন্নতাবাদী এ, এ, এবং তাহসিন মুহাম্মদ নামে পিআইএ’র একজন স্টুয়ার্ডের নাতিদীর্ঘ মতামত ছাপা হয়। আমির তাহেরি নিজেই বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের কী ঘটছে এ সম্পর্কে বেশকিছু লােকের মতামত জানার সিদ্ধান্ত নিই আমি। দু’পক্ষের ছড়ানাে প্রচারণা, আর সত্যের অপলাপের মেঘ সরে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসতে লেগে যেতে পারে বহু বছর। পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতির কাছাকাছি পৌঁছতে পারলে হয়তাে একটি সাময়িক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হবে। এই প্রতিবেদনে সেই নাটকীয় ঘটনাগুলাে সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত আমরা দেখতে পাব।”
পূর্ব পাকিস্তানের মিলিটারি গভর্নর টিক্কা খান আমির তাহেরিকে বলেন, পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার জন্যই সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছে। তার ভাষায়, মুজিব প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছিল এবং একটি প্যারালাল সরকার গঠন করে, তার নির্দেশমতাে সমস্ত কিছু হচ্ছিল এ অঞ্চলে টিক্কা খান আরও বলেন, ভারত সরাসরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে একটি অংশ দখল করে ভারতীয় সৈন্যরা যাতে সেটিকে বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা করতে না পারে সেজন্য সারাদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সেনাবাহিনী। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বেসামরিক অংশটির দেখাশােনা করতেন। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। তিনিও শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য অভিযুক্ত করে বলেন, মুজিব বাধ্য না করলে আমরা কিছুতেই সেনা-অভিযানে যেতাম।
তিনি দাবি করেন, দাঙ্গার সময় পূর্ব পাকিস্তানে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজারও ছাড়ায়নি। ঢাকা ও অন্যত্র নিহতের যে সংখ্যা বলা হয়েছে তা অতিরঞ্জিত। দাবি করেন পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসছে, মানুষজন তাদের নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরছে এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ৯০ ভাগই কাজে যােগ দিয়েছে।  আওয়ামী লীগের চরমপন্থিরা প্রতিশােধ নেয় এবং যে অবাঙালিকে ধরতে পেরেছে। তাকেই হত্যা করে। সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হবার পরে গ্রাম ও প্রত্যন্ত শহরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অবাঙালিদেরকে গুপ্তচর সন্দেহে “পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তিনি সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনীতির ধারণার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেখ মুজিবের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরিকল্পনা জানতে পেরে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে তিনি বাধ্য হন। পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা ইতােমধ্যেই এত বেশি জটিলতা সৃষ্টি করেছিল যে সেনাবাহিনীর কেউ কেউ মনে করেছেন, নতুন করে আর কোনাে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানাে উচিত নয়।” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “তারপরও ইয়াহিয়া খান বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ওপর জোর দিচ্ছেন আমাদেরকে তিনি বলেন, অক্টোবরে ইরানি রাজতন্ত্রের আড়াইশতম বার্ষিকী উদযাপনের পর এবং যেমন করেই হােক সাম্প্রতিক বছরটি শেষ হবার আগেই এধরনের একটি সরকার গঠনের আশা করেছেন তিনি।” সাক্ষাতকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, “সকল আসন পূরণ হওয়ার সাথে সাথেই জাতীয় অ্যাসেম্বলির অধিবেশন শুরু হবে অ্যাসেম্বলিকে খুব শিগগিরই একটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হবে কিন্তু সেই সঙ্গে সরকার গঠনের আহ্বানও জানানাে হবে। প্রেসিডেন্টের নিজস্ব উপদেষ্টাদের তৈরি সংবিধানের খসড়াটি ‘বৃহত্তর অবকাঠামাে’ হিসেবে পেশ করা হবে অ্যাসেম্বলিতে উপযুক্ত করে তােলার জন্য অ্যাসেম্বলিতে এই খসড়াটি সংশােধন করা হবে।”
ইয়াহিয়া খান আমাদের বলেন, সংবিধানের খসড়াটি “রাজনৈতিক দলগুলাের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলাে কি চায় আমি তা জানি এবং তাদের চাহিদাগুলােকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য উপদেষ্টাদের নির্দেশ দিয়েছি আমি এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে যে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় সবকিছুই করতে হবে আমাদের।”
আমরা তার কাছে জানতে চাই দুই অঞ্চলের অপছন্দের লােকজন নিয়ে একটি ‘পুতুল বেসামরিক সরকার গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন কিনা? তিনি বলেন এটা একটা গুজব এবং একজন সৈনিক হিসেবে তিনি মনে করেন গুজব ছড়ানােটা একটি ‘অপরাধ।
গুরুতর রাষ্ট্রদ্রোহিতা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, “মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে খুব শিগগিরই মুজিবের বিচার হবে। তার বিরুদ্ধে মামলাটি তৈরি হবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হবে বিচার।” আওয়ামী লীগ নেতার বিচার হলে এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই তা কার্যকর করা হবে কিনা এর জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেন, বিষয়টি সামরিক বিচার বিভাগের হাতে এবং কবে বিচার শুরু হতে পারে তার সঠিক তারিখও বলতে পারেননি তিনি। ইয়াহিয়া মুজিব সম্পর্কে বলেন, ‘তার কোর্টমার্শাল হবে। অ্যাসেম্বলির অধিবেশন শুরু হওয়া পর্যন্ত সে জীবিত থাকবে কিনা সে কথাও বলতে পারছি না আমি।’ হত্যা শুরু করে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও বিদ্বেষের বিবরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমনকি যেসব বাঙালি সরকারি কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযােগিতা করতে রাজি হয়েছিলেন, তারা এখনও সন্দেহভাজনের তালিকায় রয়েছেন। কয়েক’শ সরকারি কর্মকর্তাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে এবং তাদের কাজ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নজর রাখা।
তাহছির মুহাম্মদ পি.আই.এর একজন স্টুয়ার্ড। তিনি বললেন, “সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই পাগলেরমতাে এখানে ওখানে যাওয়া আসা করতে হয় আমাদের সৈন্য বােঝাই করে ঢাকা আসতাম এবং ঢাকা থেকে আহত ও পঙ্গু মহিলা ও শিশুদের বােঝাই করে নিয়ে যেতাম। হতাহতদের বেশির ভাগই ছিল বিহারি। কয়েক হাজার বিহারিকে সরিয়ে নিয়ে গেছি আমরা তাদের অনেকেই চোখ তুলে নিয়েছে বাংলাদেশের সৈন্যরা। মহিলাদের স্তন কেটে নেওয়া হয়েছে। চোখের সামনে বাবাকে হত্যা করতে দেখে নির্বাক হয়ে গেছে অনেক শিশু।” ঢাকায় বসবাসকারী একজন বিহারি বলেছেন, “আমি বিভক্তির পথ বেছে নেওয়ার কথা বলছি কারণ, পাকিস্তানের দু’অংশের মধ্যে প্রায় ১০০ মাইলের ব্যবধান। ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিভক্ত পাকিস্তানের দু’অংশ। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তান টিকে থাকতে পারে । দেশবিভাগের সময় আমরা ছিলাম উদবাস্তু।  পাকিস্তানের কাছে আমদের অনেক আশা ছিল। স্বৈরাচারের কারণে ধূলিসাৎ হয়ে যায় আমাদের স্বপ্ন। দু’অংশেরই মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতি পূর্ব পাকিস্তানকে লুটে পুটে খাচ্ছিল।” কাইহান (ইন্টারন্যাশনাল), ২৭শে জুলাই, ১৯৭১ সাল কাইহান ইন্টারন্যাশনালের আমির তাহেরি পাকিস্তানের দু’টি অংশেই সপ্তাহব্যাপী সফর সবে শেষ করেছেন। প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানের কিছু নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। যেসব সাম্প্রতিক ঘটনা পাকিস্তানকে গৃহযুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে সেসব সম্পর্কে কয়েক সিরিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : “পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তিনি সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনীতির ধারণার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেখ মুজিবের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরিকল্পনা জানতে পেরে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে তিনি বাধ্য হন। পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা ইতােমধ্যেই এত বেশি জটিলতা সৃষ্টি করেছিল যে সেনাবাহিনীর কেউ কেউ মনে করেছেন, নতুন করে আর কোনাে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানাে উচিত নয়।” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “তারপরও ইয়াহিয়া খান বেসামরিক সরকারের কাছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের ওপর জোর দিচ্ছেন। আমাদেরকে তিনি বলেন, অক্টোবরে ইরানি রাজতন্ত্রের আড়াইশতম বার্ষিকী উদযাপনের পর এবং যেমন করেই হােক সাম্প্রতিক বছরটি শেষ হবার আগেই এধরনের একটি সরকার গঠনের আশা করেছেন তিনি।”  সাক্ষাতকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, “সকল আসন পূরণ হওয়ার সাথে সাথেই জাতীয় অ্যাসেম্বলির অধিবেশন শুরু হবে। অ্যাসেম্বলিকে খুব শিগগিরই একটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হবে কিন্তু সেই সঙ্গে সরকার গঠনের আহ্বানও জানানাে হবে। প্রেসিডেন্টের নিজস্ব উপদেষ্টাদের তৈরি সংবিধানের খসড়াটি ‘বৃহত্তর অবকাঠামাে’ হিসেবে পেশ করা হবে অ্যাসেম্বলিতে। উপযুক্ত করে তােলার। জন্য অ্যাসেম্বলিতে এই খসড়াটি সংশােধন করা হবে।”
ইয়াহিয়া খান আমাদের বলেন, সংবিধানের খসড়াটি “রাজনৈতিক দলগুলাের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলাে কি চায় আমি তা জানি এবং তাদের চাহিদাগুলােকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য উপদেষ্টাদের নির্দেশ দিয়েছি আমি। এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে যে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় সবকিছুই করতে হবে আমাদের।”
আমরা তার কাছে জানতে চাই দুই অঞ্চলের অপছন্দের লােকজন নিয়ে একটি ‘পুতুল বেসামরিক সরকার গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন কিনা? তিনি বলেন এটা একটা গুজব এবং একজন সৈনিক হিসেবে তিনি মনে করেন গুজব ছড়ানােটা একটি ‘অপরাধ।
গুরুতর রাষ্ট্রদ্রোহিতা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, “মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে খুব শিগগিরই মুজিবের বিচার হবে। তার বিরুদ্ধে মামলাটি তৈরি হবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হবে বিচার।” আওয়ামী লীগ নেতার বিচার হলে এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই তা কার্যকর করা হবে কিনা এর জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেন, বিষয়টি সামরিক বিচার বিভাগের হাতে এবং কবে বিচার শুরু হতে পারে তার সঠিক তারিখও বলতে পারেননি তিনি। ইয়াহিয়া মুজিব সম্পর্কে বলেন, ‘তার কোর্টমার্শাল হবে। অ্যাসেম্বলির অধিবেশন শুরু হওয়া পর্যন্ত সে জীবিত থাকবে কিনা সে কথাও বলতে পারছি না আমি।’
শরণার্থী সম্পর্কে ভারতে আশ্রয় নেওয়া পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের ব্যাপারে তার সরকারের কি ইচ্ছা-এ প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, তাদের সকলকেই ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি, কিন্তু এই আহ্বান ঘরছাড়া মানুষগুলাের কাছে পৌঁছেছে। কিনা সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত নন। প্রেসিডেন্ট জানান, “৮০ হাজার শরণার্থী ইতােমধ্যেই দেশে ফিরেছে এবং প্রতিদিন ফিরছে প্রায় ১,০০০ উদ্বাস্তু।” তিনি বলেন, উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরা ঠেকাতে উঠে-পড়ে লেগেছে ভারত। দেশটির এ ধরনের আচরণের কারণ হচ্ছে, ইন্দিরা গান্ধী এই ইস্যুটিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, “ভারত তার নিজস্ব-ভূখণ্ডের ভেতরে গেরিলাদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির খুলেছে। প্রায় ৩৫ হাজার গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রয়হীন মানুষগুলােকে।”
ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক। প্রায় ৭৫ মিনিটের বৈঠকে ইরান সম্পর্কে উষ্ণ অনুভূতি প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। ইরানের শাহানশাহকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শুভাকাক্ষী’ হিসেবে। আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ইরান আমাদের জন্য শক্তির একটি বড় উৎস’। ইতিহাসের বিভিন্ন সময় পাকিস্তানের প্রতি ইরানের সাহায্য সহযােগিতার কথা স্মরণ করে বলেন, বর্তমানে এ অঞ্চলে পাকিস্তানকে সমর্থনকারী সবচেয়ে বড় শক্তি’ ইরান একথা জেনে সবসময়ই আমাদের দেশটি মনে জোর পাবে। একটি ফার্সি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে ইয়াহিয়া বলেন, “আমরা ভিন্ন দুটি দেশ নই। দুটি ভিন্ন দেহ হলেও আমাদের আত্মা একই।”
তিনি আরাে বলেন, আমি নিজে একজন ইরানি। আমার পূর্বপুরুষরা ইরান থেকেই এ উপমহাদেশে এসেছিল। বাড়িতে ফার্সিতে কথা বলি আমরা। ইরানের সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের কারণে গর্ববােধ করি। একজন বাইরের লােক হিসেবে নয়, বরং নিজের ভাই অথবা ছেলের মতাে মনে করেই আপনার সঙ্গে কথা বলছি। বিশাল একটি পরিবারের এক সদস্য যেমন অন্য সদস্যদেরকে সালাম জানায় তেমনই ইরানের জনগণের প্রতি রইলাে আমার সালাম। আমাদের দেশ সফরে এসে আপনি আসলে ইরানের আরেকটি অংশ দেখে গেলেন। অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ইরানের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই, আমরা শাহানশাহ সর্বাত্মক সাফল্যের জন্য সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা জানাই। শুধু ইরান, পাকিস্তানের নয়, এটা হবে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সাফল্য।
কাইহান (ইন্টারন্যাশনাল) পত্রিকায় ২৮শে জুলাই, ১৯৭১ সাল তিনি পুনরায় আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। জেনারেল টিক্কা খান সাক্ষাতকারে বলেন, “পরিস্থিতি যে পুরাপুরি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে আমি সে কথা বলবাে না। তবে  প্রদেশটি এখন পুরাপুরি সেনাবাহিনীর দখলে। এখন সেখানে কোনাে লড়াই চলছে না, যদিও প্রতিরােধের ক্ষেত্রগুলাে নির্মূলের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। গুপ্ত হামলা চালানাে হচ্ছে। একদিনে ঢাকাতেই তিনটি বােমা হামলা হয়। উড়িয়ে দেওয়া হয় একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট। পাট পরিবহনকারী কনভয়ের ওপর কয়েকবার হামলা হওয়ায় সৈন্যদের প্রহরায় সেসব পাট আমরা চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। | মুজিবের তথাকথিত মুক্তিফৌজের সৈন্যদেরকে বহু প্রশিক্ষণ শিবিরে ভারতীয়রা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ভারতীয় সেনাবাহী পুরাে দফায় হামলা না চালানাে পর্যন্ত আমাদের বড়াে ধরনের ক্ষতি করতে পারবে না তারা। সেটা হবে দুই সেনাবাহিনীর সমানে লড়াই এবং সেটাকে আমরা অবশ্যই মােকাবিলা করবাে।”
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে সাক্ষাতকার উল্লেখ করে তার প্রতিবেদনে বলেন, “হাজার হাজার ঘরছাড়া লােক ফিরে আসছে নিজের ঘরে। গ্রামে ফিরে এসে নিজেদের জমি জমা ফিরে পেতে এবং স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করার ব্যাপারে আমরা তাদেরকে সাহায্য করছি। সীমান্তে আপনারা দেখতে পাবেন, ২০টি রিসেপশন সেন্টার খােলা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এবং ভারত থেকে আসার সকল আশ্রয়হারা মানুষর পূনর্বাসনের জন্য আমরা ক্রাশ প্রােগ্রামের ব্যবস্থা করেছি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর পূর্ব পাকিস্তানিদের দেশে ফিরতে বাধাদানের নির্দেশ থাকায়, উদবাস্তুদের অব্যহৃতত রুট ধরে ফিরতে হবে। আপনারা জানেন যে প্রেসিডেন্ট সাধারণ ক্ষমতা ঘােষণা করেছেন, এবং তাই পুরােপুরি নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে সবাই।”
কাইহান (ইন্টারন্যাশনাল), ১লা আগস্ট, ১৯৭১ সাল প্রতিবেদনে তিনি তার অভিমত ব্যক্ত করেন,  “পশ্চিম পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষের ধারণা মুজিব একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ভারত সরকারের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করাটা এখনও অসম্ভব রয়ে গেছে। খুব কম লােকই তার সম্পর্কে কথা বলতে আগ্রহী। মন্তব্যকারীদের বেশির ভাগই তার দলের সাবেক সদস্য। দলের লােকজনকে ফাঁদে ফেলার জন্য তারা দায়ী করেছে মুজিবকে। এদিকে, পাকিস্তানের রক্তক্ষয়ী দুঃস্বপ্ন সম্পর্কে মুজিবের নিজের বক্তব্য এখনাে জানা যায়নি। ইসলামাবাদে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর শুধুমাত্র কোর্ট মার্শালেই নয়, ইতিহাসের রায়েরও মুখােমুখি হতে হবে তাকে।”
কাইহান (ইন্টারন্যাশনাল), ২রা আগস্ট, ১৯৭১ সাল ক্ষুধার্ত দানবের ভয়াবহ। ছায়া শীর্ষক অন্য এক প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন :
“অদূর ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানে আদৌ শান্তি ফিরে আসবে কিনা এ ব্যাপারে এখনও কেউ নিশ্চিত নয়। ৩৫,০০০-এর চেয়েও বেশি গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ভারত। গত কয়েকমাস পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তানিদের বেশিরভাগই দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই, শুধু গেরিলা আর হামলাকারী ছাড়া। শক্তিশালী বিধ্বংসী বাহিনীও সক্রিয় রয়েছে। মহাপ্রলয়ের চার অশ্বারােহীর হাত থেকে বাচা হারকিউলিসের মতাে পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানাের চ্যালেঞ্জ মােকাবিলার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তি আর সম্পদও সীমিত। সামিরিক কর্তৃপক্ষ বলছে, ভারত পাকিস্তানকে বিভক্ত করার প্রচারণা বন্ধ করলেই পূর্বাঞ্চলে প্রকৃত অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হবেন তারা। গত কয়েক মাস ধরে পূর্ব পাকিস্তানের ট্র্যাজিক ঘটনাবলি ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সমরবাদী প্রবণতাকে আরও জোরদার করে তুলছে। সামরিক বাহিনীর প্রধানরা সব সময় মর্যাদার লালসা আর সৈনিকদের কাজের মধ্য” ডুবিয়ে রাখার ব্যাপারে আগ্রহী। ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লি উভয়ের নীতিমালার ওপর দিন দিন কার্যকর প্রভাব খাটানাে শুরু করেছেন। সামরিক প্রধানরা। দু’টি দেশেরই ভঙুর কাঠামাের তুলনায় তাদের সামরিক প্রধানদের ভার বেশি হয়ে গেছে । উপমহাদেশে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ সশস্ত্র সৈন্য রয়েছে এবং সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলে হাতে অস্ত্র তুলে নেবে আরও কয়েক লক্ষ লােক। ভারতীয় কার্যত বলে বেড়াচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণ করবে নয়াদিল্লি। উপেক্ষার মাধ্যমে এর জবাব দিয়েছে পাকিস্তান।
তিনি প্রতিবেদনে আরাে উল্লেখ করা হয়, “ইয়াহিয়া খানের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত এবং পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ব্যাপারে ভারতীয় প্রচেষ্টার একটি আংশিক কারণ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে দেশটির নিজস্ব ভীতি। তাই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত কাজ হচ্ছে বাঙালিদের মাথাব্যাথার কারণটি সারিয়ে তুলতে সহায়তা করা-বাংলার দু’টি অংশই যা নিয়ে কম বেশি ভুক্তভােগী। কিন্তু এ ধরনের একটি পদক্ষেপ অন্তত এ মুহুর্তে একেবারেই চিন্তা করা যায় না।  পশ্চিমবঙ্গে যখন নকশালবাদী আন্দোলন পুরােদমে ছড়িয়ে পড়ছে তখন ভারতকে দুর্বল করার লক্ষ্যে এ ব্যাপারে সব ধরনের ইন্ধন জুগিয়েছে পাকিস্তান। নকশালবাদীরা পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। চীনের পাঠানাে অস্ত্র দিনাজপুর আর রাজশাহীর মধ্যে দিয়ে তাদের হাতে এসে পৌছাতাে। ফলশ্রুতিতে পশ্চিমবঙ্গ একেবারে শাসনের অযােগ্য হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানি গেরিলাদের আশ্রয়, তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ এবং পূর্ণ রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে সে সময়কার প্রতিশােধ নিচ্ছে ভারত। পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত দুটি বােতলে বন্দি বাঙালি দানবকে মুক্ত করে দেওয়ায় ব্যপারে তারা উভয়েই হয়তাে নিজ নিজ সাফল্য প্রমাণ করছে। ইয়াহিয়া খানের সরকারই সম্ভবত পাকিস্তানের শেষ সরকার যেটা ভারতের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করেছে। কিন্তু নির্ভুলভাবে বলতে গেলে এই সরকারকেই ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছে নয়াদিল্লি। বর্তমান পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে গান্ধীর সরকার প্রয়ােজনে সামরিক প্রধানদের হাতের পুতুল হওয়ারও ঝুঁকি নিতে রাজি আছে। পাকিস্তানের পিঠে ছুরি মারার সাথে সাথে একই সময় হয়তাে আত্মঘাতী হতে হবে ভারতকেও।
তবে এ সবই কৌশলগত প্রকৃতি বিচার-বিবেচনার বিষয়। এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে এবং উদ্বাস্তুদের চাপের মুখে। অর্থনৈতিক ধ্বংসের হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করা। মার্কিনীরা প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও খাদ্য সাহায্য পাঠানাের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গ্রীষ্মকাল শেষ হওয়ার আগেই সাহায্যের প্রথম অংশটি এসে পৌছানাের কথা। কিন্তু দরকার আরও অনেক বেশি। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিকে গােটা বিশ্বেরই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দারিদ্র আর ক্ষুধার বিরুদ্ধে মানবিক সংগ্রামে এই কর্মক্ষেত্রে দানবীয় এক এশীয় ট্র্যাজেডির বীজ বপন করা হয়েছে।” দি ক্যানবেরা টাইমস (ক্যানবেরা)-এ ২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল রালফ জোসেফ ইরানে পাকিস্তানি নেতার সফর নিয়ে বিভ্রান্তি শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, “পূর্ব পাকিস্তানে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আগে গেরিলাদের নির্মূল করার লক্ষ্যে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আরেকটি বড়ো ধরনের সামরিক শুদ্ধি অভিযানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরিকল্পনা করেছেন? বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার এবং বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানেও চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই মুহূর্তে এমনটিই মনে হচ্ছে। সম্প্রতি তেহরানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একদিনের আকস্মিক সফর এখনাে রহস্যাবৃত রয়েছে। তবে কি তিনি শাহ’র কাছে পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয়বার বড়াে ধরনের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে নৈতিক বা অন্য কোনাে ধরনের সমর্থন চাইতে এসেছিলেন? তবে তিনি তা পেয়েছেন বলে কোনাে ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। ইরানের শাহ গত গ্রীষ্মের শুরুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়েছিলেন, সেটি পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশি বিদ্রোহীদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে ছিল বলে মনে করা হয়। ইয়াহিয়ার সফরের পর ঘােষিত যৌথ ইশতেহারে অবশ্য এই ধরনের কোনাে মনােভাব ফুটে ওঠেনি। আর তাতে ‘অব্যাহত পারস্পরিক সহায়তার’ যে উল্লেখ রয়েছে তাতে বরং এর বিপরীত দিকটিই প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে হয়।”
মার্কিন প্রয়াস: মুসলিম দেশ থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণ মার্কিন সিক্রেট ডকুমেন্টস থেকে দেখা যাচ্ছে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। পাকিস্তানের সমর্থক সৌদি আরব, জর্ডান, ইরান, তুরস্ক, লিবিয়া সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণ করে। মার্কিন কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুসারে, নিক্সন প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই ভারত ও পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু নিক্সন প্রশাসন গােপনে ইরানের মাধ্যমে ৫২টি মার্কিন ফ্যান্টম বিমান, লিবিয়া জেট বিমান, সৌদি আরব ৭৫টি জঙ্গি বােমারু বিমান এবং জর্ডান ১০টি এফ-১০৪ বিমান পাকিস্তানে সরবরাহ করে। এমনকি জাতিসংঘে লিবিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনাে প্রকার সহানুভূতি না জানিয়ে বরং সােভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের মহাসচিবের বরাবর পত্র প্রেরণ করে। সেখানে ইসরাইল যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যে আক্রমণ করেছিল ভারতও সেরূপভাবে পাকিস্তানের উপর চড়াও হয়েছে বলে মনােভাব ব্যক্ত করেন। এছাড়াও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত সরাসরি মুক্তিযুদ্ধকে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করে ভারতকে আক্রমণকারী হিসেবে নিন্দা জ্ঞাপন করে।
উপসংহার
মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র নিজেদের এড়িয়ে চলতে চেয়েছে। অধিকাংশ রাষ্ট্রকাঠামাে ছিল রাজতন্ত্র, সামরিক বা স্বৈরতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ধারায় পরিচালিত যার মৌলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, সেক্ষেত্রে তাদের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করা ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও বিপজ্জনক। মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও ভ্রাতৃত্ববােধের নীতির উপর ভিত্তি করে সংগঠন হিসেবে ওআইসি তার ভূমিকা পালন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানদের উপর নির্মম আক্রমণ, গণহত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ এবং মসজিদ ধ্বংস হলেও মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলাে নৈতিকভাবে হলেও এই জঘন্য মানবতাবিরােধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এতটুকু প্রতিবাদ বা নিন্দা জানায়নি বরং পাকিস্তান সামরিক জান্তার ইসলামবিরােধী কর্মকাণ্ডকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন জানিয়েছে। তবে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলাে আর্থিকভাবে সৌদি আরব, লিবিয়ার উপর নির্ভরশীল থাকায় তারা মুখ খুলতে পারেনি বা স্বাধীন নীতি গ্রহণ করতে অসমর্থ হয়েছে। তারপরেও মিশর, লিবিয়া, আলজেরিয়া ও আফগানিস্তান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল হলেও সােচ্চার হতে পারেনি। তবে এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যে, মুসলিম দেশগুলাের শাসকগােষ্ঠী তাদের ক্ষমতার স্বার্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযােগিতা না করলেও সেদেশের প্রগতিশীল গণমানুষ, গণমাধ্যম, গণসংগঠন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সিভিল সমাজের প্রতিনিধিবর্গ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অধিকাংশ মুসলিম দেশ পাকিস্তানের প্রত্যাশামতাে সাহায্য করেন। যে অবনতিশীল অভ্যন্তরীণ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে অনেক দেশই তাদের আঙুল জ্বলন্ত শিখায় প্রবেশ করাতে দ্বিধান্নিত ছিল এবং প্রত্যাশিত সাহায্য এবং সহযােগিতা নিয়ে এগিয়ে আসেন।
 

সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কূটনৈতিক যুদ্ধ – আবু সাইয়িদ

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!