সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্লোডিজ মাকসুদ যিনি পর্যবেক্ষক হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যাবে যে, পূর্ববঙ্গের ভাগ্য ভারত ও পাকিস্তানভারতের অংশ নয়, হতে পারে না এবং হওয়া উচিত নয়। এটি সত্য যে বাংলাদেশের জনগণ সংগ্রাম করছে এবং তাদের স্বাধীনতা পাওয়া উচিত এবং একইসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি প্রদান করা উচিত। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। পূর্ববঙ্গের জনগণের মর্যাদা সম্মান ও সভ্যতার জন্য লড়াই করবাে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আগত পর্যবেক্ষক মােহাম্মদ রয়েম তার বক্তব্যে বলেন, যদি কোনাে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি যদি আন্তর্জাতিক হুমকির কারণ হয় তখন বিষয়টি অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকে না। এটা পরিষ্কার যে, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মালয়েশিয়া থেকে আগত প্রতিনিধি ভি, ডেজ্ঞি বলেন, বর্তমান সংকট সম্পর্কে মালয়েশিয়ার সরকার সম্পূর্ণ নীরব। কিন্তু জনগণ উদবিগ্ন। তারা বাংলাদেশের। স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা পাক তা দেখতে চায়। কেউ মনে করেন, এটা ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত; আবার অনেকেই বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। আমরা যদি আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে বিশ্বাস করি তাহলে বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ে নীরব থাকতে পারে না । দ্বিতীয়ত, কেউ যদি বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা বলতে চায় তাহলে তার যােগ্য ও যথার্থ গণতান্ত্রিক নেতা হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যদি এশিয়ায় শান্তি ও সমৃদ্ধি অক্ষুন্ন রাখতে হয় তাহলে অবিলম্বে তাকে মুক্ত করা উচিত এবং তার সঙ্গে কথা বলা উচিত। জাতিসংঘ যেভাবে কাজ করছে তাতে মালয়েশিয়ার জীবন বিব্রত ও উদবিগ্ন। এই ভয়ংকর বর্বর গণহত্যার নিন্দা করা। প্রয়ােজন এবং এ সঙ্গে এও বলে দিতে চাই মালয়েশিয়ান জনগণ বাংলাদেশের। ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে তাদের সঙ্গে আছে যে সংগ্রাম তাদের স্বাধীনতা এনে দেবে। দিল্লি সম্মেলনে ১৩টি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানের অধীন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন, শরণার্থীদের। সাহায্যের জন্য ভারত সরকার ও জনগণের প্রশংসা করা হয়। একই সাথে সভা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামকে স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়।
পাকিস্তান গুরুতর মানবাধিকার লঙ্নকে জাতিসংঘে ও তার অঙ্গ-সংগঠনসমূহে উত্থাপন করা জোর দাবি জানিয়ে বলা হয় মানবাধিকার লঙ্ঘনে বিশ্বশান্তি হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সভা দৃঢ়ভাবে মনে করে, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের অনুমােদন সাপেক্ষে রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হয় আশু করণীয়। বাংলাদেশ সরকারকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়ােজন এজন্য যে, ভৌগােলিক, ঐতিহাসিক, জাতিগত, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ করা নৈতিক দায়িত্ব। পাকিস্তানে অস্ত্র ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের প্রস্তাব গৃহীত হয়। দেশে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠন জানানাে হয়। মুসলিম দেশের গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ : মিশ্র প্রতিক্রিয়া পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, ধর্ষণ ও মানবতাবিরােধী জঘন্যতম কর্মকাণ্ড বিভিন্ন দেশের মতাে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলাের সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় এবং বিজয়ী দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর অস্বীকৃতি এবং আলােচনার অন্তরালে সামরিক প্রস্তুতি এবং নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর সশস্ত্র আক্রমণ, নিরাপত্তাহীন জনগণের প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয়গ্রহণ, শরণার্থী সমস্যা, ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, মুজিবনগর সরকার গঠন এবং বিশ্ব পরিসরে কূটনৈতিক তৎপরতা ও বিরাজমান সংকট সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদপত্রে সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। প্রধানত মুসলিম দেশগুলাের সংবাদপত্র মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে, কয়েকটি সংবাদপত্র পক্ষে বা নিরপেক্ষভাবে সংবাদ প্রকাশ ও বিশ্লেষণ দেখা যায়। সৌদি আরবসহ ইরান, নাইজেরিয়া এবং ত্রিপােলির সংবাদপত্রসমূহ সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সরকারের পক্ষাবলম্বন করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উল্লেখ করে এ সকল সংবাদপত্র একতরফাভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে একইসাথে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে ইসরাইলের প্ররােচনা আবিষ্কার করে। পকিস্তানের অখণ্ডতা বিনষ্টে ভারত অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দিয়ে উস্কানি দিচ্ছে।
এ ধরনের সংবাদের বিপরীত চিত্র পাওয়া যায় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, বৈরুত, কুয়েত এমনকি সেনেগালের পত্রিকায়। এসব পত্রিকা সামরিক জান্তা কর্তৃক গণরায় বানচাল, বাঙালির নিধনযজ্ঞ, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, শরণার্থীদের দুর্দশা, মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাদের প্রতিরােধ, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষণ ও পাকিস্তানের সামরিক চক্রসহ জেনারেল ইয়াহিয়াকে দায়ী করে সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। একইসঙ্গে বৃহৎ শক্তিগুলাের ভূমিকার সমালােচনা করে। তুরস্ক থেকে প্রকাশিত ‘আঙ্কারা নিউজ’ ম্যাগাজিন ইয়ানকি এক প্রতিবেদনে এই অভিমত প্রকাশ করে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন তা বাস্তবায়ন হয়নি। এখনও বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা- অসম্ভব, কেননা সবকিছু ত্যাগ করে পাচ লক্ষাধিক মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবং সেখানে তারা আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমান অবস্থায় সামরিক চক্র মুসলিম লীগকে সমর্থন করে যদিও এই দলটি পূর্ববঙ্গে একটিও আসন পায়নি। অন্য বিকল্প পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি যার নেতৃত্বে আমিন কিন্তু জনগণের মধ্যে বর্তমানে তিনি জনপ্রিয় নন। পত্রিকাটিতে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ব্যতীত পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা অসম্ভব যদি বর্তমানে তা হবার নয়।” বৈরুত থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা আল-আনবা ভারত সীমান্ত পরিদর্শন করে এক রিপাের্টে লেখেন পূর্ববঙ্গের জনগণের উপর যে ট্রাজেটি তা বাস্তবিক অর্থেই মর্মান্তিক, নির্যাতন কল্পনাতীত। নারী, শিশু ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যে নৃশংস অত্যাচার করা হয়েছে যা প্যালেস্টানিদের উপর যেভাবে ইহুদিরা করেছে। পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়, শরণার্থীদের সংখ্যা প্রায় আশি লক্ষ।
কেনিয়ার ‘সানডে পােস্ট’-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ক্র্যাস ইন্ডিয়া’ আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানে ছড়িয়ে গেলেও দুর্দশাগ্রস্ত শরণার্থীরা যাতে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে সে পরিবেশ তৈরি করা। ইন্দোনেশিয়া রায়া পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, যুক্তির পরাজয় ঘটেছে, কামান কথা বলছে। পাকিস্তান এখন ইন্দোনেশিয়ায় বিশেষ প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। কিন্তু বিশ্ব দেখেছে পাকিস্তান কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে তার নিজ জনগণের সঙ্গে জঘন্য আচরণ করেছে, বিজয়ী আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করেছে, তার অনুসারীদের হত্যা বা গ্রেফতার করেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার বাংলাদেশের জনগণের উপর আক্রমণ চালালে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, যার ভার পৃথিবীর কোনাে একক দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পাকিস্তানকেই করতে হবে এবং এজন্য তাদের ভুল সংশােধন করতে হবে।” ইরানের নেতা-ই-ইরান নভিন (NEDA-I-IRAN NOVIN) ১১ই জুলাই উপমহাদেশে উদ্বেগ নিরসনে ভারতের নেতৃত্বকে আন্তরিকভাবে একটি স্বাধীন এবং স্বার্বোভৌম দেশ হিসেবে পাকিস্তানের অস্তিত্বকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। ভারতের সাপ্তাহিক পত্রিকা ব্লিস (Blitz) পত্রিকার সম্পাদক কারানজিয়া সম্পাদকীয়তে বলেছেন, ভারতের নেতৃত্ব মনে করে পাকিস্তান একটি অভিনব রাষ্ট্র যার আয়ুষ্কাল স্বল্প। ভারতের এই মনােভাব সম্পর্কে উক্ত পত্রিকায় বলা হয়, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় এবং ভারতসহ বিদেশি শক্তিগুলাের বাংলাদেশ সংকটকে নিরুৎসাহিত করা উচিত এবং বর্তমান পাকিস্তানের দুর্বল অবস্থান থেকে মুনাফা অর্জনের সুযােগ নেওয়া সঠিক হবে না। পত্রিকাতে বলা হয়, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমঝােতার মাধ্যমে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণ হবে সবচেয়ে ভালাে। পত্রিকাটি সরকারি দলের অফিসিয়াল মুখপাত্র হিসেবে এই বক্তব্য প্রদান করেন। স্পেনের দৈনিক পত্রিকা দি আরাবিয়া ২২শে জুন, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলেন, শরণার্থীদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা থেকে ভারতকে নিবৃত্ত থাকতে হবে এবং এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ভারত শরণার্থীদের ছায়াবৃত্তভাবে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তাদের প্রয়ােজনের সময় যাতে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। পত্রিকাটি সতর্ক করে দিয়ে বলে, এর পরিণামে সম্ভবত ভারত-পাকিস্তানের নতুন যুদ্ধ ডেকে আনবে। পত্রিকাটি আরও মন্তব্য করে যে, এই গেরিলা ক্যাম্পগুলাে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত এবং পশ্চিমবঙ্গের কম্যুনিস্ট পার্টি দুই বাংলাকে স্বাধীন করবে যা নিয়ে নয়াদিল্লির সতর্ক হওয়া উচিত। পত্রিকাটি আরও মন্তব্য করেন দুর্বল পাকিস্তান ভারতের জন্য নিশ্চয় তুষ্টিকর। কিন্তু পশ্চিমবাংলার হিন্দু ক্যুনিস্টরা বাংলাদেশকে গিলে ফেললে তা হবে ভারতের জন্য ভয়ংকর ব্যাপার। পত্রিকাটি আরও বর্ণনা করে যে, ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা এ কথা স্বীকার করেছে যে, ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা পাকিস্তানের সীমান্তের ত্রিশ-চল্লিশ কিলােমিটারের ভেতরে অবস্থান নিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎসাহিত করার জন্য ভারতীয় গণমাধ্যম ও বেতারকে দোষারােপ করেন। পত্রিকাটি আরাে বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কেবল মাত্র আহম্মকদের কল্পনা ব্যতীত কিছু নয়।
ডেইলি আল বিলাদ’ জেদ্দা, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এর সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল, পাকিস্তানের জন্য সম্মানজনক’। এতে মন্তব্য করা হয় যে, মুজিবুর রহমানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সহায়তার জন্য ইসরায়েলের সাথে যােগাযােগ করেছে তা পাকিস্তানের জন্য যথেষ্ট সম্মানজনক।’ এতে বলা হয়, “ইসরায়েলের কাছ থেকে দলটি কোনাে সাহায্য পায়নি। দলটির উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। এই সম্পাদকীয়তে ইসরায়েলকে আখ্যায়িত করা হয় মানবতা, আরব এবং ইসলামের শত্রু হিসেবে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিনিধি মাহমুদ কাশিম ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যােগাযােগ করছে। পূর্ব পাকিস্তানি জনগণকে ইসরায়েলিরা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আরবদের ধারণাতেই ছিল যে, কেউ যদি তার দেশের ঐক্যের ব্যাপারে অসৎ হয় তবে সে নিশ্চিতভাবেই একদিন ইসরায়েল বা অনুরূপ দেশের সঙ্গে যােগাযােগ করবে। শত্রুরা যদি পাকিস্তানের ক্ষতি করার জন্য ইসরায়েলের কাছ থেকে সহায়তা নেয় তাহলে ঐ মুসলিম দেশটির জন্য সম্মানজনক বিবেচিত হবে। এ দেশটি (পাকিস্তান) কোনাে ঘটনাতেই আরবদের পরিত্যাগ করেনি এবং হুমকি বা চাপের মুখেও ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে। “আমরা আরবরা স্থায়ীভাবে নৈতিক সমর্থন পাওয়ায় পাকিস্তানের কাছে ঋণী। কিছু আরব দেশ যখন তাদের অবস্থানে অবিচল ছিল , তখনও তারা এই সমর্থন দিয়েছে। তাদের এই সমর্থন ইসরায়েলকে ক্ষুব্ধ করেছে। এজন্যই ইসরায়েল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু ইসরায়েলের চেয়ে বড় শক্তিও আরবদের প্রতি সমর্থন দান থেকে পাকিস্তানকে বিরত রাখতে পারবে না।” পূর্ব পাকিস্তান সংঘাত সম্পর্কে বলা হয়, এটি মুসলমানদের মধ্যে ভাঙন ঘটানাের চেষ্টা মাত্র। “তথাকথিত মাহমুদ কাশিম (যিনি ইসরায়েলের সাথে বাংলাদেশের হয়ে যােগাযােগ করেন) গত ১৫ বছর ধরে তেহরানে বসবাস করছেন এবং পরে ইরান। সরকার তাকে বহিষ্কার করে। তিনি সেখান থেকে জেনেভা যান। নিঃসন্দেহে তিনি। সেখানে ইসরায়েলি গােয়েন্দাদের সংস্পর্শে আসেন এবং তারাই তেলআবিবে তার সফরের ব্যবস্থা করেন। কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপারে আমাদের অভিমত কিছুতেই পাল্টাবে না যে তারা হচ্ছে সেসব লােক যারা পাকিস্তানের কোনাে ক্ষতি করার আগে বরং নিজেদেরই ক্ষতি করছে।”
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলাে সমালােচনা করে নাইজেরিয়ার ‘ডেইলি মর্নিং পােস্ট ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এ তুনজি আদেওসুন লিখিত একটি রিপাের্ট প্রকাশ করে, যার শিরােনাম ছিলাে, পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা’। জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক গােষ্ঠী বিচ্ছিন্নতার একটি প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং পাকিস্তান সরকার পরিস্থিতি দমনের জন্য পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকে সশস্ত্র প্রতিরােধের মুখেও সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। পত্রিকাটিতে আরাে বলা হয়, পাকিস্তানের এ যুদ্ধই এমনটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলাের কিছু অংশ স্পর্শকাতর ভূমিকায় নেমেছে। দেশটির পরিস্থিতি সম্পর্কে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বিবরণ দেওয়ার ঘটনার মতই নাইজেরিয়ার সমস্যাকালে পাঠকদের অনুরূপ খবর দেওয়া হয়েছিল। এই সাংবাদিকরা পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করার চেষ্টা করেছে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের যুক্তরাষ্ট্রের স্থানে এবং পূর্ব পাকিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উত্তর ভিয়েতনামবাসীদের সঙ্গে তুলনা করছে। কিন্তু একটি শিশুও জানে অধিক যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণ এবং যা প্রত্যেকেই কামনা করে তা হচ্ছে নাইজেরিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি। ফেডারেল সৈন্য পাঠিয়েছে। গুলি ছুঁড়তে উৎসাহী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছবি সম্পূর্ণ। মিথ্যা। এই রিপাের্টে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আন্দোলনের সংগ্রামকে বলা হয়েছে বিচ্ছিন্নতার একটি প্রচেষ্টা’। আর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনার বর্বর হামলাকে বলা হয়েছে পরিস্থিতি দমনের জন্য নেওয়া পদক্ষেপ।
“আরেকটি বিস্ময়কর খবরে কিছু শরণার্থী লন্ডনে একটি পত্রিকাকে বলেছে যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের গলায় ও বুকে গুলি করে এবং তারা বেঁচে যায়। একজনের গলা এবং একজনের বুকের মধ্যদিয়ে সৈন্যদের গুলি চলে যাওয়ার পর বেঁচে যাওয়ার ঘটনা কেউ বিশ্বাস করলে তাকে নতুন বিজ্ঞান সৃষ্টি করতে হবে।” এই সংবাদপত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে সমালােচনা করে এবং বলে যে, শুরু থেকেই শেখ মুজিব আলােচনার ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন না এবং বিচ্ছিন্নতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। শেখ মুজিবের অসহযােগ আন্দোলনকে বলা হয়েছে আইন অমান্য করলে আন্দোলন শুরু করেন তিনি। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কঠোর মনােভাব গ্রহণ করেন যেখানে আলােচনার কোনাে সুযােগ দাঁড়ায়। কিন্তু সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় একই সময়ে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮% থেকে ৫৩% ছাড়িয়েছে। পত্রিকাটিতে উল্টা পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানাের চেষ্টা করা হয় যে, “পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করছে বলে ভারতীয়দের কথিত অভিযােগগুলাে আদত বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে ধােপে টেকে না।” সেনাবাহিনীর নৃশংসতা এবং হত্যা সম্পর্কিত খবরের ব্যাপারে পত্রিকাটি প্রকৃত অর্থেই পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি স্তুতি করেছে। বলা হয়েছে, “ঘটনা হচ্ছে সাংবাদিকদের কেউ নিজে কিছুই লিখেননি। কিন্তু বরাবরই তারা বিভিন্ন সূত্রের স্বীকৃতি দিয়েছেন। পূর্বপাকিস্তানে কী ঘটেছে কলকাতায় বসে সাংবাদিকরা কী করে জানলেন? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিবিসি’র প্রচারণা সম্পর্কে আমাদের কিছু আরব বন্ধুদের বলতে চাই যে, আপনারা যদি মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে বিবিসি’র খবরের জন্য নির্ভর করতে পারেন, তাহলেই কেবল পাকিস্তান সংশ্লিষ্ট খবরের জন্য বিবিসি’র উপর নির্ভর করতে পারেন। বলা হয়েছে, বিবিসিসহ অন্যান্য পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলােতে ইহুদিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। জেদ্দা থেকে প্রকাশিত ‘দি ডেইলি আল মদিনা’ ৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এ আদনান কামেল সালাহ কর্তৃক সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন তােলা হয়েছে, ‘যুদ্ধ কোথায়? “গতকাল (২৯শে সেপ্টেম্বর) মস্কোয় প্রকাশিত রুশ-ভারত যৌথ বিবৃতিটি পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাশিয়া ও ভারতের হস্তক্ষেপের পর আরেকটি পদক্ষেপ। সত্য বটে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ভারতে চলে গেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা মােটেও ৩০ লাখ নয়, যদিও ভারত এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। ভারতের ভূখণ্ড থেকে যাওয়া অন্তর্ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচার জন্যই শরণার্থীরা ভারতে পালিয়ে গেছে।” “পাকিস্তানকেই ভূখণ্ড রক্ষা এবং নিজ ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত বন্ধ করতে হবে। এজন্যই তারা আগ্রাসন চালাচ্ছে না বা যুদ্ধ লাগাচ্ছে না। কিন্তু ভারত রাশিয়ার সঙ্গে। প্রতিরক্ষা ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে একটা মারাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক কাজে সহায়তা দিচ্ছে। এজন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন অংশের। পরস্পরবিরােধী গােষ্ঠীগুলাের কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে মস্কোর কোসিগিন, কানাডা ও ব্রিটেনের বিভিন্ন খ্রিষ্টান সংগঠন, আমেরিকার কেনেডি এবং ইসরাইলের ইহুদি নেতৃবৃন্দ।
এ সকল পরস্পর বিরােধীদের প্রতিহত করতে পারলেই শান্তির ব্যাপারে প্রকৃত ইচ্ছার প্রকাশ ঘটতে পারে।” তুরস্ক থেকে প্রকাশিত আকশাম, ৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল-এ “পূর্বপাকিস্তানের। সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্কটি ছিল ঔপনিবেশিক ধরনের। ধর্ম ছাড়া এই দুই অঞ্চলের মধ্যে আর কোনাে মিলই নেই। পূর্ব পাকিস্তানিরা জাতীয় মুক্তির জন্য পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে লড়ছে।”
‘দি জাকার্তা টাইমস, ১৫ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল: সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল, “গণহত্যা বন্ধ কর।” পত্রিকাটি পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের পরিচালিত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলে যে, ইসলাম কি এটা অনুমােদন দেয়? অস্ত্রধারী একদল নেই। তখন তার মনোভাব ছিল ‘মেনে নাও অথবা চলে যাও।’ বলা হয়েছে, “এক শ্রেণির পত্রিকায় বিভিন্ন খবরে গণদাবী হিসেবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে বড় করে তােলার চেষ্টা কেবল সত্যের অপলাপ নয়, পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে সেটি হচ্ছে এক ধরনের মানসিক যুদ্ধ।” তেহরান থেকে প্রকাশিত ডেইলি আয়ানদেগান’ নামক একটি পত্রিকা ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে প্রতিবেদক হুমায়ুন দারাইউস কর্তৃক খবরের শিরােনামে ছিল, ‘পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান’। এই প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে সেই সময়ে ইরানের অবস্থান ও নীতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যেতে পারে। একটি মধ্যপ্রাচীয় দেশ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করে ইসলাম ধর্মের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের সাথে শুরু থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলাের সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং মধ্যপ্রাচ্য পাকিস্তান বলতে এর পশ্চিম অংশকেই বুঝাতাে। ইরানি এই পত্রিকাটি সংকট সমাধানে কতিপয় বক্তব্য তুলে ধরে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে যা প্রয়ােজন, তা হলাে একটি বেসামরিক মন্ত্রীপরিষদ গঠন, সামরিক শাসনের অবসান, সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দান এবং জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে সরকারের দায়িত্ব অর্পণ করা। ইয়াহিয়া খানের জন্য এইসব কম সমস্যাপূর্ণ না হলেও তিনি এখন এই পথই অবলম্বন করছেন। প্রথমত, আওয়ামী লীগের নির্বাচিত অনেক সদস্য ভারতে চলে গেছেন এবং তারা দেশে ফেরার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, তাদের ফেরার। ব্যবস্থা করার জন্য উপমহাদেশের একাধিক সরকারের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়ােজন। পত্রিকাটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জন্য স্তুতি করে। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ইয়াহিয়া গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয়। বলা হয়েছে, একজন সৈনিক হিসেবে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষা এবং জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য এ যাবৎ আশাতীত উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি প্রথমবারের মতাে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রশংসনীয়ভাবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন এবং একদিকে বাঙালিদের ও অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর দাবি পূরণের জন্য তারপক্ষে সম্ভব সব কিছুই করেছেন। তিনি মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীত্ব উপহার দিতে চেয়েছেন বলে জনৈক পর্যবেক্ষক বলেন। কিন্তু মুজিব ক্ষমতা গ্রহণ করেননি এবং বৈধ উপায়ে সমস্যাগুলাে সমাধান করতে চাননি। এটা ইয়াহিয়া খানের ভুল নয়। এ পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করার উদ্যোগ রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে মােটেও সহায়ক হবে না।
ত্রিপােলি থেকে প্রকাশিত ডেইলি আল থাউরা’ ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এ সম্পাদকীয় পাকিস্তান পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, লিবীয় আরব প্রজাতন্ত্রের জনগণ পাকিস্তানের জনগণকে তাদের সংকটের মুহূর্তে অবিচল ও আন্তরিক সমর্থন দিয়েছে। তাসত্ত্বেও ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের একথা জানা জরুরি যে, তারা পাকিস্তানে তাদের ভাইদের কেবল সমর্থন করছে না বরং তারা একটি সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত বিষয়কে সমর্থন করছে। আন্তর্জাতিক ও ইহুদীবাদী চক্র পাকিস্তানের বর্তমান সংঘাতকে পাকিস্তান ধ্বংসের একটি সুবর্ণ সুযােগ হিসেবে বিবেচনা করছে এবং এর মাধ্যমে আরবদের সবচেয়ে ভ্রাতৃপ্রতিম দেশটিকে বিনাশ করতে চাইছে। | পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বঞ্চনার চিত্রকে উল্টো করে দেখার চেষ্টা করেছে লিবিয়ার এই সংবাদপত্র। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয় বর্তমানে দেশের আয়ের ৫০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকারে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ১৯৬১ সালে ছিল ২৬.১ শতাংশ এবং ১৯৬৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২৬.৩ শতাংশ দাঁড়ায়। কিন্তু সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় একই সময়ে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮% থেকে ৫৩% ছাড়িয়েছে। পত্রিকাটিতে উল্টা পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানাের চেষ্টা করা হয় যে, “পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করছে বলে ভারতীয়দের কথিত অভিযােগগুলাে আদত বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে ধােপে টেকে না।” সেনাবাহিনীর নৃশংসতা এবং হত্যা সম্পর্কিত খবরের ব্যাপারে পত্রিকাটি প্রকৃত অর্থেই পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি স্তুতি করেছে। বলা হয়েছে, “ঘটনা হচ্ছে সাংবাদিকদের কেউ নিজে কিছুই লিখেননি। কিন্তু বরাবরই তারা বিভিন্ন সূত্রের স্বীকৃতি দিয়েছেন। পূর্বপাকিস্তানে কী ঘটেছে কলকাতায় বসে সাংবাদিকরা কী করে জানলেন? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিবিসি’র প্রচারণা সম্পর্কে আমাদের কিছু আরব বন্ধুদের বলতে চাই যে, আপনারা যদি মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে বিবিসি’র খবরের জন্য নির্ভর করতে পারেন, তাহলেই কেবল পাকিস্তান সংশ্লিষ্ট খবরের জন্য বিবিসি’র উপর নির্ভর করতে পারেন। বলা হয়েছে, বিবিসিসহ অন্যান্য পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলােতে ইহুদিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। জেদ্দা থেকে প্রকাশিত ‘দি ডেইলি আল মদিনা’ ৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এ আদনান কামেল সালাহ কর্তৃক সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন তােলা হয়েছে, ‘যুদ্ধ কোথায়? “গতকাল (২৯শে সেপ্টেম্বর) মস্কোয় প্রকাশিত রুশ-ভারত যৌথ বিবৃতিটি পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাশিয়া ও ভারতের হস্তক্ষেপের পর আরেকটি পদক্ষেপ। সত্য বটে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ভারতে চলে গেছে।
কিন্তু তাদের সংখ্যা মােটেও ৩০ লাখ নয়, যদিও ভারত এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। ভারতের ভূখণ্ড থেকে যাওয়া অন্তর্ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচার জন্যই শরণার্থীরা ভারতে পালিয়ে গেছে।” “পাকিস্তানকেই ভূখণ্ড রক্ষা এবং নিজ ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত বন্ধ করতে হবে। এজন্যই তারা আগ্রাসন চালাচ্ছে না বা যুদ্ধ লাগাচ্ছে না। কিন্তু ভারত রাশিয়ার সঙ্গে। প্রতিরক্ষা ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে একটা মারাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক কাজে সহায়তা দিচ্ছে। এজন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন অংশের। পরস্পরবিরােধী গােষ্ঠীগুলাের কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে মস্কোর কোসিগিন, কানাডা ও ব্রিটেনের বিভিন্ন খ্রিষ্টান সংগঠন, আমেরিকার কেনেডি এবং ইসরাইলের ইহুদি নেতৃবৃন্দ। এ সকল পরস্পর বিরােধীদের প্রতিহত করতে পারলেই শান্তির ব্যাপারে প্রকৃত ইচ্ছার প্রকাশ ঘটতে পারে।” তুরস্ক থেকে প্রকাশিত আকশাম, ৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল-এ “পূর্বপাকিস্তানের। সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্কটি ছিল ঔপনিবেশিক ধরনের। ধর্ম ছাড়া এই দুই অঞ্চলের মধ্যে আর কোনাে মিলই নেই। পূর্ব পাকিস্তানিরা জাতীয় মুক্তির জন্য পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে লড়ছে।”
‘দি জাকার্তা টাইমস, ১৫ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল: সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল, “গণহত্যা বন্ধ কর।” পত্রিকাটি পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের পরিচালিত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলে যে, ইসলাম কি এটা অনুমােদন দেয়? অস্ত্রধারী একদল।
মুসলমান, নিরীহ আরএকদল মুসলমানকে হত্যা করবে? এ বিষয়ে মুসলিম দেশসমূহের তড়িৎ পদক্ষেপ প্রয়ােজন। আন্তর্জাতিক ইসলামিক সংগঠনসমূহেও এ ব্যাপারে নিশ্রুপ। থাকতে পারে না। ‘দি স্টেটস টাইমস’ মালয়েশিয়া, ৮ই জুন, ১৯৭১ সাল। সম্পাদকীয় পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী। পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা কোনােক্রমেই আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। বিপুলসংখ্যক শরণার্থী প্রতিদিন ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে এবং তাদের দুৰ্গীত ক্রমেই বাড়ছে। এ অবস্থায় ভারতের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। চার মিলিয়ন। শরণার্থী ইতােমধ্যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং এ সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রকাশিত ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার ৩০ই আগস্ট, ১৯৭১ সাল-এর সম্পাদকীয় নজিরবিহীন ট্র্যাজেডি’। পূর্ব পাকিস্তানের মানবিক বিপর্যয়ের খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণে স্বক্ষম হয়েছে, এর কারণ হলাে সেখানে সংঘটিত গণহত্যা নজিরবিহীন মাত্রায় এবং এর ফলে অসংখ্য লােক ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে, পাঁচ মাসের সংঘর্ষের ফলে ইতােমধ্যে সাড়ে সাত মিলিয়ন বাঙালি ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিকবাহিনী দিয়ে সমাধানের অভিযােগ উঠেছে ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে এবং এ বিচারে ইয়াহিয়া তার। পূর্বসূরি আইয়ুব খানের চেয়ে নিকৃষ্টতম কারণ সে তার সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে লাখ লাখ নিরস্ত্র বাঙালির বিরুদ্ধে। | ডাকার সেনেগাল থেকে প্রকাশিত লে সােলাই ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল-এ বারা ডিউফ এর প্রতিবেদন, পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের নিয়ে ভারত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন শিরােনামে বলা হয়, “ভারতে এখন ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন নাটকের মঞ্চায়ন হচ্ছে। প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি উদ্বাস্তু সীমান্ত অতিক্রম করে দেশে ঢুকছে। সরকার তাদের খাওয়ানাের জন্য প্রতিদিন দুই কোটি রুপি ব্যয় করছে। এ অর্থ তাদের সমুদ্র সমান দুর্দশার মধ্যে এক ফোটা পানি মাত্র। পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের এটি হচ্ছে করুণ পরিণতি। এতে বলা হয়, ২৬শে মার্চ ১৯৭১ সাল-এ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপারে ১৫০০ কিলােমিটার বেশি দূরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন। পাকিস্তানের একটি অংশের ভাষা অপর অংশের মানুষ ও ভাষা থেকে আলাদা। এমনকি আমাদের ধর্ম ইসলামও পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়েও ভিন্ন। এইসব পরিস্থিতিতে কিভাবে সাংস্কৃতিক ঐক্য হবে এবং একটি ঐকবদ্ধ জাতির যৌক্তিকতা কি হতে পারে?” পত্রিকাটিতে বলা হয়, কলােনিয়েল শশাষণ, শাসন, আর্থিক লুণ্ঠন, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তান গ্রাস করেছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। পত্রিকাটিতে লেখা হয়, “সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বিশ হাজার গেরিলা ছড়িয়ে রয়েছে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ইয়াহিয়া খানের সত্তর হাজার , সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।” বৈরুত ২রা অক্টোবর ১৯৭১ সাল, সাপ্তাহিক আল আনবা’ পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তানি নারী, শিশু ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের পরিচালিত গণহত্যাকে প্যালেস্টাইনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলিদের অপরাধের সাথে তুলনা করে। পত্রিকাটি অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ, পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে সম্পাকীয় লেখে। শিরােনাম ছিলাে, “বাংরাদেশের শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার আহ্বান।’
৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল, ইন্দোনেশিয়ায় ‘রায়া’ পত্রিকার সম্পাদকীয় শিরােনাম, ‘পাকিস্তান দায়ী’। এতে বলা হয়, নিজ দেশের জনগণেকে হত্যা করছে পাকিস্তানের সামরিক সরকার। পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান দেখানাে এবং তাদের ভুল সংশােধন করা। ২২শে অক্টোবর ‘আল সাওরা দামেস্কে-এ বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সমাধানে সামরিক শক্তি প্রয়ােগ ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এবং তা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। পত্রিকাটি সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের পাশাপাশি ভারতে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ শরণার্থীর জন্য সাহায্য ও ত্রাণের আহ্বান জানান। ৭ই ডিসেম্বর ‘দি স্টেটস টাইমস’ কুয়ালালামপুর-এ লেখা হয়, একটি রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব ছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে যথাযথ চাপ প্রয়ােগে ব্যর্থতার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলাের সমালােচনা করা হয়। ২২শে সেপ্টেম্বর ‘কুয়েত টাইসম’-এ রয়টার্স পরিবেশিত খবরে শরণার্থীদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি বিশেষ করে শিশুদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা প্রাধান্য পায়।
কাইহান ইন্টারন্যাশনালের আমির তাহেরি পূর্ব পাকিস্তান সংকটের উপর বেশ কিছু ধারাবাহিক প্রতিবেদন রচনা করেন। ২৭শে জুলাই থেকে ২রা আগস্ট পর্যন্ত সময়ে মােট ৪টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ইরানি এই সাংবাদিকের লেখার মধ্যে রয়েছে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। যেখানে ইয়াহিয়া পূর্বপাকিস্তানের সংকট, সংলাপ প্রচেষ্টা, সামরিক আক্রমণ, মুজিবের ভবিষ্যৎ, পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ এবং সংকট নিরসনে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। প্রায় ৭৫ মিনিটের সাক্ষাৎকারে ইরান সম্পর্কে উষ্ণ অনুভূতি প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। আমির তাহেরির ভাষায়, ইরানের শাহানশাহকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ইরান আমাদের জন্য শক্তির একটি বড় উৎস। ইতিহাসের বিভিন্ন সময় পাকিস্তানকে সমর্থনকারী সবচেয়ে বড়াে শক্তি ইরান একথা জেনে সবসমই আমাদের দেশটি মনে জোর পাবে। ইয়াহিয়া খান বলেন, এ সংকটের শুরু থেকেই পাকিস্তান সম্পর্কে সঠিক নীতি গ্রহণ করেছে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ব্রিটেন সম্পর্কে একথা বলা যায় না। পূর্ব পাকিস্তান সংকটের জন্য ইয়াহিয়া খান রাজনীতিবিদদের দায়ী করেন। ২৭শে জুলাই প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বলা হয়, “নির্ভেজাল বিষন্ন কণ্ঠে ইয়াহিয়া খান বলেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিলাম।
আমি এই চেয়ারের প্রতি আমার কোনাে আগ্রহ ছিল না এবং সৈনিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযােগের অপেক্ষায় ছিলাম আমি।” তারপর মনমরা অবস্থায় তিনি বলে যেতে থাকেন, রাজনীতিবিদরাই তাকে ডুবিয়েছে, তাঁরা একমতে পৌছাতে পারেননি এবং তাদেরই কারণে দেশ আজ খণ্ডিত হওয়ার মুখে । তিনি আরাে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনীতির ধারণার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি কিন্তু শেখ মুজিবের বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পরিকল্পনা জানতে পেরে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে তিনি বাধ্য হন। পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টোর সহায়তায় তারা বেসামরিক সরকার গঠনের চিন্তা-ভাবনা করছেন কিনা? এ প্রশ্ন সম্পর্কে ইয়াহিয়া বলেন, “শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছেন ভুট্টো। কিন্তু বেসামরিক সরকারের ভেতর দু’অঞ্চলের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় সম্পর্কে তিনি বলেন, কারচুপি-সন্ত্রাস আর অসাধু উপায়ে জয়লাভ করেছিল আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব সম্পর্কে বলেন, ‘মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে খুব শিগগিরই মুজিবের বিচার হবে।’ উদ্বাস্তুদের বিষয়ে তিনি বলেন, “তাদেরকে দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানানাে হয়েছে এবং অনেকেই ফিরতে শুরু করেছেন। তবে উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরা ঠেকাতে ওঠে পড়ে লেগেছে ভারত, কারণ তারা এই ইস্যুটিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ভারত তার নিজস্ব ভূখণ্ডের ভেতরে গেরিলাদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির খুলেছে। প্রায় ৩৫ হাজার গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রয়হীন মানুষগুলােকে।” ২৮শে জুলাই ডেটলাইনে আমির তাহেরির দ্বিতীয় প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সংঘাতের কারণ, বর্তমান অবস্থা জানতে লেফটেল্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, জনৈক আওয়ামী লীগের এম,এস, সাবেক, বিচ্ছিন্নতাবাদী এ, এ, এবং তাহসিন মুহাম্মদ নামে পিআইএ’র একজন স্টুয়ার্ডের নাতিদীর্ঘ মতামত ছাপা হয়। আমির তাহেরি নিজেই বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের কী ঘটছে এ সম্পর্কে বেশকিছু লােকের মতামত জানার সিদ্ধান্ত নিই আমি। দু’পক্ষের ছড়ানাে প্রচারণা, আর সত্যের অপলাপের মেঘ সরে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসতে লেগে যেতে পারে বহু বছর। পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতির কাছাকাছি পৌঁছতে পারলে হয়তাে একটি সাময়িক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হবে। এই প্রতিবেদনে সেই নাটকীয় ঘটনাগুলাে সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত আমরা দেখতে পাব।”
পূর্ব পাকিস্তানের মিলিটারি গভর্নর টিক্কা খান আমির তাহেরিকে বলেন, পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার জন্যই সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছে। তার ভাষায়, মুজিব প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছিল এবং একটি প্যারালাল সরকার গঠন করে, তার নির্দেশমতাে সমস্ত কিছু হচ্ছিল এ অঞ্চলে টিক্কা খান আরও বলেন, ভারত সরাসরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে একটি অংশ দখল করে ভারতীয় সৈন্যরা যাতে সেটিকে বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা করতে না পারে সেজন্য সারাদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সেনাবাহিনী। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বেসামরিক অংশটির দেখাশােনা করতেন। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। তিনিও শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য অভিযুক্ত করে বলেন, মুজিব বাধ্য না করলে আমরা কিছুতেই সেনা-অভিযানে যেতাম।
তিনি দাবি করেন, দাঙ্গার সময় পূর্ব পাকিস্তানে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজারও ছাড়ায়নি। ঢাকা ও অন্যত্র নিহতের যে সংখ্যা বলা হয়েছে তা অতিরঞ্জিত। দাবি করেন পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসছে, মানুষজন তাদের নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরছে এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ৯০ ভাগই কাজে যােগ দিয়েছে। আওয়ামী লীগের চরমপন্থিরা প্রতিশােধ নেয় এবং যে অবাঙালিকে ধরতে পেরেছে। তাকেই হত্যা করে। সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হবার পরে গ্রাম ও প্রত্যন্ত শহরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অবাঙালিদেরকে গুপ্তচর সন্দেহে “পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তিনি সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনীতির ধারণার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেখ মুজিবের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরিকল্পনা জানতে পেরে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে তিনি বাধ্য হন। পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা ইতােমধ্যেই এত বেশি জটিলতা সৃষ্টি করেছিল যে সেনাবাহিনীর কেউ কেউ মনে করেছেন, নতুন করে আর কোনাে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানাে উচিত নয়।” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “তারপরও ইয়াহিয়া খান বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ওপর জোর দিচ্ছেন আমাদেরকে তিনি বলেন, অক্টোবরে ইরানি রাজতন্ত্রের আড়াইশতম বার্ষিকী উদযাপনের পর এবং যেমন করেই হােক সাম্প্রতিক বছরটি শেষ হবার আগেই এধরনের একটি সরকার গঠনের আশা করেছেন তিনি।” সাক্ষাতকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, “সকল আসন পূরণ হওয়ার সাথে সাথেই জাতীয় অ্যাসেম্বলির অধিবেশন শুরু হবে অ্যাসেম্বলিকে খুব শিগগিরই একটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হবে কিন্তু সেই সঙ্গে সরকার গঠনের আহ্বানও জানানাে হবে। প্রেসিডেন্টের নিজস্ব উপদেষ্টাদের তৈরি সংবিধানের খসড়াটি ‘বৃহত্তর অবকাঠামাে’ হিসেবে পেশ করা হবে অ্যাসেম্বলিতে উপযুক্ত করে তােলার জন্য অ্যাসেম্বলিতে এই খসড়াটি সংশােধন করা হবে।”
ইয়াহিয়া খান আমাদের বলেন, সংবিধানের খসড়াটি “রাজনৈতিক দলগুলাের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলাে কি চায় আমি তা জানি এবং তাদের চাহিদাগুলােকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য উপদেষ্টাদের নির্দেশ দিয়েছি আমি এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে যে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় সবকিছুই করতে হবে আমাদের।”
আমরা তার কাছে জানতে চাই দুই অঞ্চলের অপছন্দের লােকজন নিয়ে একটি ‘পুতুল বেসামরিক সরকার গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন কিনা? তিনি বলেন এটা একটা গুজব এবং একজন সৈনিক হিসেবে তিনি মনে করেন গুজব ছড়ানােটা একটি ‘অপরাধ।
গুরুতর রাষ্ট্রদ্রোহিতা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, “মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে খুব শিগগিরই মুজিবের বিচার হবে। তার বিরুদ্ধে মামলাটি তৈরি হবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হবে বিচার।” আওয়ামী লীগ নেতার বিচার হলে এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই তা কার্যকর করা হবে কিনা এর জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেন, বিষয়টি সামরিক বিচার বিভাগের হাতে এবং কবে বিচার শুরু হতে পারে তার সঠিক তারিখও বলতে পারেননি তিনি। ইয়াহিয়া মুজিব সম্পর্কে বলেন, ‘তার কোর্টমার্শাল হবে। অ্যাসেম্বলির অধিবেশন শুরু হওয়া পর্যন্ত সে জীবিত থাকবে কিনা সে কথাও বলতে পারছি না আমি।’ হত্যা শুরু করে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও বিদ্বেষের বিবরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমনকি যেসব বাঙালি সরকারি কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযােগিতা করতে রাজি হয়েছিলেন, তারা এখনও সন্দেহভাজনের তালিকায় রয়েছেন। কয়েক’শ সরকারি কর্মকর্তাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে এবং তাদের কাজ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নজর রাখা।
তাহছির মুহাম্মদ পি.আই.এর একজন স্টুয়ার্ড। তিনি বললেন, “সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই পাগলেরমতাে এখানে ওখানে যাওয়া আসা করতে হয় আমাদের সৈন্য বােঝাই করে ঢাকা আসতাম এবং ঢাকা থেকে আহত ও পঙ্গু মহিলা ও শিশুদের বােঝাই করে নিয়ে যেতাম। হতাহতদের বেশির ভাগই ছিল বিহারি। কয়েক হাজার বিহারিকে সরিয়ে নিয়ে গেছি আমরা তাদের অনেকেই চোখ তুলে নিয়েছে বাংলাদেশের সৈন্যরা। মহিলাদের স্তন কেটে নেওয়া হয়েছে। চোখের সামনে বাবাকে হত্যা করতে দেখে নির্বাক হয়ে গেছে অনেক শিশু।” ঢাকায় বসবাসকারী একজন বিহারি বলেছেন, “আমি বিভক্তির পথ বেছে নেওয়ার কথা বলছি কারণ, পাকিস্তানের দু’অংশের মধ্যে প্রায় ১০০ মাইলের ব্যবধান। ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিভক্ত পাকিস্তানের দু’অংশ। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তান টিকে থাকতে পারে । দেশবিভাগের সময় আমরা ছিলাম উদবাস্তু। পাকিস্তানের কাছে আমদের অনেক আশা ছিল। স্বৈরাচারের কারণে ধূলিসাৎ হয়ে যায় আমাদের স্বপ্ন। দু’অংশেরই মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতি পূর্ব পাকিস্তানকে লুটে পুটে খাচ্ছিল।” কাইহান (ইন্টারন্যাশনাল), ২৭শে জুলাই, ১৯৭১ সাল কাইহান ইন্টারন্যাশনালের আমির তাহেরি পাকিস্তানের দু’টি অংশেই সপ্তাহব্যাপী সফর সবে শেষ করেছেন। প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানের কিছু নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। যেসব সাম্প্রতিক ঘটনা পাকিস্তানকে গৃহযুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে সেসব সম্পর্কে কয়েক সিরিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : “পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তিনি সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনীতির ধারণার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেখ মুজিবের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরিকল্পনা জানতে পেরে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে তিনি বাধ্য হন। পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা ইতােমধ্যেই এত বেশি জটিলতা সৃষ্টি করেছিল যে সেনাবাহিনীর কেউ কেউ মনে করেছেন, নতুন করে আর কোনাে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানাে উচিত নয়।” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “তারপরও ইয়াহিয়া খান বেসামরিক সরকারের কাছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের ওপর জোর দিচ্ছেন। আমাদেরকে তিনি বলেন, অক্টোবরে ইরানি রাজতন্ত্রের আড়াইশতম বার্ষিকী উদযাপনের পর এবং যেমন করেই হােক সাম্প্রতিক বছরটি শেষ হবার আগেই এধরনের একটি সরকার গঠনের আশা করেছেন তিনি।” সাক্ষাতকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, “সকল আসন পূরণ হওয়ার সাথে সাথেই জাতীয় অ্যাসেম্বলির অধিবেশন শুরু হবে। অ্যাসেম্বলিকে খুব শিগগিরই একটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হবে কিন্তু সেই সঙ্গে সরকার গঠনের আহ্বানও জানানাে হবে। প্রেসিডেন্টের নিজস্ব উপদেষ্টাদের তৈরি সংবিধানের খসড়াটি ‘বৃহত্তর অবকাঠামাে’ হিসেবে পেশ করা হবে অ্যাসেম্বলিতে। উপযুক্ত করে তােলার। জন্য অ্যাসেম্বলিতে এই খসড়াটি সংশােধন করা হবে।”
ইয়াহিয়া খান আমাদের বলেন, সংবিধানের খসড়াটি “রাজনৈতিক দলগুলাের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলাে কি চায় আমি তা জানি এবং তাদের চাহিদাগুলােকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য উপদেষ্টাদের নির্দেশ দিয়েছি আমি। এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে যে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় সবকিছুই করতে হবে আমাদের।”
আমরা তার কাছে জানতে চাই দুই অঞ্চলের অপছন্দের লােকজন নিয়ে একটি ‘পুতুল বেসামরিক সরকার গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন কিনা? তিনি বলেন এটা একটা গুজব এবং একজন সৈনিক হিসেবে তিনি মনে করেন গুজব ছড়ানােটা একটি ‘অপরাধ।
গুরুতর রাষ্ট্রদ্রোহিতা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, “মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে খুব শিগগিরই মুজিবের বিচার হবে। তার বিরুদ্ধে মামলাটি তৈরি হবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হবে বিচার।” আওয়ামী লীগ নেতার বিচার হলে এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই তা কার্যকর করা হবে কিনা এর জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেন, বিষয়টি সামরিক বিচার বিভাগের হাতে এবং কবে বিচার শুরু হতে পারে তার সঠিক তারিখও বলতে পারেননি তিনি। ইয়াহিয়া মুজিব সম্পর্কে বলেন, ‘তার কোর্টমার্শাল হবে। অ্যাসেম্বলির অধিবেশন শুরু হওয়া পর্যন্ত সে জীবিত থাকবে কিনা সে কথাও বলতে পারছি না আমি।’
শরণার্থী সম্পর্কে ভারতে আশ্রয় নেওয়া পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের ব্যাপারে তার সরকারের কি ইচ্ছা-এ প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, তাদের সকলকেই ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি, কিন্তু এই আহ্বান ঘরছাড়া মানুষগুলাের কাছে পৌঁছেছে। কিনা সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত নন। প্রেসিডেন্ট জানান, “৮০ হাজার শরণার্থী ইতােমধ্যেই দেশে ফিরেছে এবং প্রতিদিন ফিরছে প্রায় ১,০০০ উদ্বাস্তু।” তিনি বলেন, উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরা ঠেকাতে উঠে-পড়ে লেগেছে ভারত। দেশটির এ ধরনের আচরণের কারণ হচ্ছে, ইন্দিরা গান্ধী এই ইস্যুটিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, “ভারত তার নিজস্ব-ভূখণ্ডের ভেতরে গেরিলাদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির খুলেছে। প্রায় ৩৫ হাজার গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রয়হীন মানুষগুলােকে।”
ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক। প্রায় ৭৫ মিনিটের বৈঠকে ইরান সম্পর্কে উষ্ণ অনুভূতি প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। ইরানের শাহানশাহকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শুভাকাক্ষী’ হিসেবে। আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ইরান আমাদের জন্য শক্তির একটি বড় উৎস’। ইতিহাসের বিভিন্ন সময় পাকিস্তানের প্রতি ইরানের সাহায্য সহযােগিতার কথা স্মরণ করে বলেন, বর্তমানে এ অঞ্চলে পাকিস্তানকে সমর্থনকারী সবচেয়ে বড় শক্তি’ ইরান একথা জেনে সবসময়ই আমাদের দেশটি মনে জোর পাবে। একটি ফার্সি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে ইয়াহিয়া বলেন, “আমরা ভিন্ন দুটি দেশ নই। দুটি ভিন্ন দেহ হলেও আমাদের আত্মা একই।”
তিনি আরাে বলেন, আমি নিজে একজন ইরানি। আমার পূর্বপুরুষরা ইরান থেকেই এ উপমহাদেশে এসেছিল। বাড়িতে ফার্সিতে কথা বলি আমরা। ইরানের সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের কারণে গর্ববােধ করি। একজন বাইরের লােক হিসেবে নয়, বরং নিজের ভাই অথবা ছেলের মতাে মনে করেই আপনার সঙ্গে কথা বলছি। বিশাল একটি পরিবারের এক সদস্য যেমন অন্য সদস্যদেরকে সালাম জানায় তেমনই ইরানের জনগণের প্রতি রইলাে আমার সালাম। আমাদের দেশ সফরে এসে আপনি আসলে ইরানের আরেকটি অংশ দেখে গেলেন। অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ইরানের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই, আমরা শাহানশাহ সর্বাত্মক সাফল্যের জন্য সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা জানাই। শুধু ইরান, পাকিস্তানের নয়, এটা হবে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সাফল্য।
কাইহান (ইন্টারন্যাশনাল) পত্রিকায় ২৮শে জুলাই, ১৯৭১ সাল তিনি পুনরায় আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। জেনারেল টিক্কা খান সাক্ষাতকারে বলেন, “পরিস্থিতি যে পুরাপুরি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে আমি সে কথা বলবাে না। তবে প্রদেশটি এখন পুরাপুরি সেনাবাহিনীর দখলে। এখন সেখানে কোনাে লড়াই চলছে না, যদিও প্রতিরােধের ক্ষেত্রগুলাে নির্মূলের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। গুপ্ত হামলা চালানাে হচ্ছে। একদিনে ঢাকাতেই তিনটি বােমা হামলা হয়। উড়িয়ে দেওয়া হয় একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট। পাট পরিবহনকারী কনভয়ের ওপর কয়েকবার হামলা হওয়ায় সৈন্যদের প্রহরায় সেসব পাট আমরা চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। | মুজিবের তথাকথিত মুক্তিফৌজের সৈন্যদেরকে বহু প্রশিক্ষণ শিবিরে ভারতীয়রা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ভারতীয় সেনাবাহী পুরাে দফায় হামলা না চালানাে পর্যন্ত আমাদের বড়াে ধরনের ক্ষতি করতে পারবে না তারা। সেটা হবে দুই সেনাবাহিনীর সমানে লড়াই এবং সেটাকে আমরা অবশ্যই মােকাবিলা করবাে।”
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে সাক্ষাতকার উল্লেখ করে তার প্রতিবেদনে বলেন, “হাজার হাজার ঘরছাড়া লােক ফিরে আসছে নিজের ঘরে। গ্রামে ফিরে এসে নিজেদের জমি জমা ফিরে পেতে এবং স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করার ব্যাপারে আমরা তাদেরকে সাহায্য করছি। সীমান্তে আপনারা দেখতে পাবেন, ২০টি রিসেপশন সেন্টার খােলা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এবং ভারত থেকে আসার সকল আশ্রয়হারা মানুষর পূনর্বাসনের জন্য আমরা ক্রাশ প্রােগ্রামের ব্যবস্থা করেছি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর পূর্ব পাকিস্তানিদের দেশে ফিরতে বাধাদানের নির্দেশ থাকায়, উদবাস্তুদের অব্যহৃতত রুট ধরে ফিরতে হবে। আপনারা জানেন যে প্রেসিডেন্ট সাধারণ ক্ষমতা ঘােষণা করেছেন, এবং তাই পুরােপুরি নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে সবাই।”
কাইহান (ইন্টারন্যাশনাল), ১লা আগস্ট, ১৯৭১ সাল প্রতিবেদনে তিনি তার অভিমত ব্যক্ত করেন, “পশ্চিম পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষের ধারণা মুজিব একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ভারত সরকারের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করাটা এখনও অসম্ভব রয়ে গেছে। খুব কম লােকই তার সম্পর্কে কথা বলতে আগ্রহী। মন্তব্যকারীদের বেশির ভাগই তার দলের সাবেক সদস্য। দলের লােকজনকে ফাঁদে ফেলার জন্য তারা দায়ী করেছে মুজিবকে। এদিকে, পাকিস্তানের রক্তক্ষয়ী দুঃস্বপ্ন সম্পর্কে মুজিবের নিজের বক্তব্য এখনাে জানা যায়নি। ইসলামাবাদে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর শুধুমাত্র কোর্ট মার্শালেই নয়, ইতিহাসের রায়েরও মুখােমুখি হতে হবে তাকে।”
কাইহান (ইন্টারন্যাশনাল), ২রা আগস্ট, ১৯৭১ সাল ক্ষুধার্ত দানবের ভয়াবহ। ছায়া শীর্ষক অন্য এক প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন :
“অদূর ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানে আদৌ শান্তি ফিরে আসবে কিনা এ ব্যাপারে এখনও কেউ নিশ্চিত নয়। ৩৫,০০০-এর চেয়েও বেশি গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ভারত। গত কয়েকমাস পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তানিদের বেশিরভাগই দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই, শুধু গেরিলা আর হামলাকারী ছাড়া। শক্তিশালী বিধ্বংসী বাহিনীও সক্রিয় রয়েছে। মহাপ্রলয়ের চার অশ্বারােহীর হাত থেকে বাচা হারকিউলিসের মতাে পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানাের চ্যালেঞ্জ মােকাবিলার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তি আর সম্পদও সীমিত। সামিরিক কর্তৃপক্ষ বলছে, ভারত পাকিস্তানকে বিভক্ত করার প্রচারণা বন্ধ করলেই পূর্বাঞ্চলে প্রকৃত অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হবেন তারা। গত কয়েক মাস ধরে পূর্ব পাকিস্তানের ট্র্যাজিক ঘটনাবলি ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সমরবাদী প্রবণতাকে আরও জোরদার করে তুলছে। সামরিক বাহিনীর প্রধানরা সব সময় মর্যাদার লালসা আর সৈনিকদের কাজের মধ্য” ডুবিয়ে রাখার ব্যাপারে আগ্রহী। ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লি উভয়ের নীতিমালার ওপর দিন দিন কার্যকর প্রভাব খাটানাে শুরু করেছেন। সামরিক প্রধানরা। দু’টি দেশেরই ভঙুর কাঠামাের তুলনায় তাদের সামরিক প্রধানদের ভার বেশি হয়ে গেছে । উপমহাদেশে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ সশস্ত্র সৈন্য রয়েছে এবং সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলে হাতে অস্ত্র তুলে নেবে আরও কয়েক লক্ষ লােক। ভারতীয় কার্যত বলে বেড়াচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণ করবে নয়াদিল্লি। উপেক্ষার মাধ্যমে এর জবাব দিয়েছে পাকিস্তান।
তিনি প্রতিবেদনে আরাে উল্লেখ করা হয়, “ইয়াহিয়া খানের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত এবং পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ব্যাপারে ভারতীয় প্রচেষ্টার একটি আংশিক কারণ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে দেশটির নিজস্ব ভীতি। তাই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত কাজ হচ্ছে বাঙালিদের মাথাব্যাথার কারণটি সারিয়ে তুলতে সহায়তা করা-বাংলার দু’টি অংশই যা নিয়ে কম বেশি ভুক্তভােগী। কিন্তু এ ধরনের একটি পদক্ষেপ অন্তত এ মুহুর্তে একেবারেই চিন্তা করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে যখন নকশালবাদী আন্দোলন পুরােদমে ছড়িয়ে পড়ছে তখন ভারতকে দুর্বল করার লক্ষ্যে এ ব্যাপারে সব ধরনের ইন্ধন জুগিয়েছে পাকিস্তান। নকশালবাদীরা পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। চীনের পাঠানাে অস্ত্র দিনাজপুর আর রাজশাহীর মধ্যে দিয়ে তাদের হাতে এসে পৌছাতাে। ফলশ্রুতিতে পশ্চিমবঙ্গ একেবারে শাসনের অযােগ্য হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানি গেরিলাদের আশ্রয়, তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ এবং পূর্ণ রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে সে সময়কার প্রতিশােধ নিচ্ছে ভারত। পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত দুটি বােতলে বন্দি বাঙালি দানবকে মুক্ত করে দেওয়ায় ব্যপারে তারা উভয়েই হয়তাে নিজ নিজ সাফল্য প্রমাণ করছে। ইয়াহিয়া খানের সরকারই সম্ভবত পাকিস্তানের শেষ সরকার যেটা ভারতের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করেছে। কিন্তু নির্ভুলভাবে বলতে গেলে এই সরকারকেই ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছে নয়াদিল্লি। বর্তমান পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে গান্ধীর সরকার প্রয়ােজনে সামরিক প্রধানদের হাতের পুতুল হওয়ারও ঝুঁকি নিতে রাজি আছে। পাকিস্তানের পিঠে ছুরি মারার সাথে সাথে একই সময় হয়তাে আত্মঘাতী হতে হবে ভারতকেও।
তবে এ সবই কৌশলগত প্রকৃতি বিচার-বিবেচনার বিষয়। এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে এবং উদ্বাস্তুদের চাপের মুখে। অর্থনৈতিক ধ্বংসের হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করা। মার্কিনীরা প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও খাদ্য সাহায্য পাঠানাের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গ্রীষ্মকাল শেষ হওয়ার আগেই সাহায্যের প্রথম অংশটি এসে পৌছানাের কথা। কিন্তু দরকার আরও অনেক বেশি। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিকে গােটা বিশ্বেরই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দারিদ্র আর ক্ষুধার বিরুদ্ধে মানবিক সংগ্রামে এই কর্মক্ষেত্রে দানবীয় এক এশীয় ট্র্যাজেডির বীজ বপন করা হয়েছে।” দি ক্যানবেরা টাইমস (ক্যানবেরা)-এ ২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল রালফ জোসেফ ইরানে পাকিস্তানি নেতার সফর নিয়ে বিভ্রান্তি শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, “পূর্ব পাকিস্তানে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আগে গেরিলাদের নির্মূল করার লক্ষ্যে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আরেকটি বড়ো ধরনের সামরিক শুদ্ধি অভিযানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরিকল্পনা করেছেন? বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার এবং বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানেও চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই মুহূর্তে এমনটিই মনে হচ্ছে। সম্প্রতি তেহরানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একদিনের আকস্মিক সফর এখনাে রহস্যাবৃত রয়েছে। তবে কি তিনি শাহ’র কাছে পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয়বার বড়াে ধরনের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে নৈতিক বা অন্য কোনাে ধরনের সমর্থন চাইতে এসেছিলেন? তবে তিনি তা পেয়েছেন বলে কোনাে ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। ইরানের শাহ গত গ্রীষ্মের শুরুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়েছিলেন, সেটি পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশি বিদ্রোহীদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে ছিল বলে মনে করা হয়। ইয়াহিয়ার সফরের পর ঘােষিত যৌথ ইশতেহারে অবশ্য এই ধরনের কোনাে মনােভাব ফুটে ওঠেনি। আর তাতে ‘অব্যাহত পারস্পরিক সহায়তার’ যে উল্লেখ রয়েছে তাতে বরং এর বিপরীত দিকটিই প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে হয়।”
মার্কিন প্রয়াস: মুসলিম দেশ থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণ মার্কিন সিক্রেট ডকুমেন্টস থেকে দেখা যাচ্ছে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। পাকিস্তানের সমর্থক সৌদি আরব, জর্ডান, ইরান, তুরস্ক, লিবিয়া সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণ করে। মার্কিন কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুসারে, নিক্সন প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই ভারত ও পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু নিক্সন প্রশাসন গােপনে ইরানের মাধ্যমে ৫২টি মার্কিন ফ্যান্টম বিমান, লিবিয়া জেট বিমান, সৌদি আরব ৭৫টি জঙ্গি বােমারু বিমান এবং জর্ডান ১০টি এফ-১০৪ বিমান পাকিস্তানে সরবরাহ করে। এমনকি জাতিসংঘে লিবিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনাে প্রকার সহানুভূতি না জানিয়ে বরং সােভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের মহাসচিবের বরাবর পত্র প্রেরণ করে। সেখানে ইসরাইল যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যে আক্রমণ করেছিল ভারতও সেরূপভাবে পাকিস্তানের উপর চড়াও হয়েছে বলে মনােভাব ব্যক্ত করেন। এছাড়াও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত সরাসরি মুক্তিযুদ্ধকে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করে ভারতকে আক্রমণকারী হিসেবে নিন্দা জ্ঞাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র নিজেদের এড়িয়ে চলতে চেয়েছে। অধিকাংশ রাষ্ট্রকাঠামাে ছিল রাজতন্ত্র, সামরিক বা স্বৈরতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ধারায় পরিচালিত যার মৌলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, সেক্ষেত্রে তাদের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করা ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও বিপজ্জনক। মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও ভ্রাতৃত্ববােধের নীতির উপর ভিত্তি করে সংগঠন হিসেবে ওআইসি তার ভূমিকা পালন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানদের উপর নির্মম আক্রমণ, গণহত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ এবং মসজিদ ধ্বংস হলেও মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলাে নৈতিকভাবে হলেও এই জঘন্য মানবতাবিরােধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এতটুকু প্রতিবাদ বা নিন্দা জানায়নি বরং পাকিস্তান সামরিক জান্তার ইসলামবিরােধী কর্মকাণ্ডকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন জানিয়েছে। তবে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলাে আর্থিকভাবে সৌদি আরব, লিবিয়ার উপর নির্ভরশীল থাকায় তারা মুখ খুলতে পারেনি বা স্বাধীন নীতি গ্রহণ করতে অসমর্থ হয়েছে। তারপরেও মিশর, লিবিয়া, আলজেরিয়া ও আফগানিস্তান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল হলেও সােচ্চার হতে পারেনি। তবে এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যে, মুসলিম দেশগুলাের শাসকগােষ্ঠী তাদের ক্ষমতার স্বার্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযােগিতা না করলেও সেদেশের প্রগতিশীল গণমানুষ, গণমাধ্যম, গণসংগঠন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সিভিল সমাজের প্রতিনিধিবর্গ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অধিকাংশ মুসলিম দেশ পাকিস্তানের প্রত্যাশামতাে সাহায্য করেন। যে অবনতিশীল অভ্যন্তরীণ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে অনেক দেশই তাদের আঙুল জ্বলন্ত শিখায় প্রবেশ করাতে দ্বিধান্নিত ছিল এবং প্রত্যাশিত সাহায্য এবং সহযােগিতা নিয়ে এগিয়ে আসেন।
সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কূটনৈতিক যুদ্ধ – আবু সাইয়িদ