You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.26 | মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকা
ভূমিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকা মােটাদাগে সরলীকৃত মনে হলেও প্রকৃত অর্থে বিষয়টি জটিল। প্রথাগত কূটনৈতিক নীতি নির্ধারণে ভূ-প্রকৃতি, ইতিহাসঐতিহ্য, জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ ও আদর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এই মৌলিক নির্ধারক সূচকগুলাে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও ভারতের গণ-আকাক্ষায় তাড়িত ভাবাবেগ কূটনৈতিক নীতি নির্ধারণকে জটিল করে। তােলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে সামরিক সংঘর্ষ, মানবাধিকার লঙ্নের নৃশংস ঘটনাবলি এবং অভ্যন্তরীণ জনমতের প্রবল চাপ, বৈশ্বিক অবস্থান ও পরিবেশ। অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের মৌল কূটনৈতিক নীতিমালা ভূমণ্ডলীয় বৈশিষ্ট্যে বিশেষ ছকে বিচার্য হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা সহজসাধ্য ছিল না। এক্ষেত্রে শুধু আদর্শগত-রণনীতিক দিক যা কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ছায়াবৃত বা সম্প্রসারিত করে থাকে তার উর্ধ্বে বিষয়টি ভিন্নতর অবয়বে বিচার্য। রাজনৈতিক, আদর্শগত দিক যাকে বলা হয়ে থাকে ‘পদ্ধতিগত চিন্তার বৃত্তে আটকানাে পদ্ধতি যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পালন করেছে সত্য, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এটাই পূর্ণাঙ্গ রূপকল্প হিসেবে। গ্রহণ করা ছিল অপর্যাপ্ততা। এক্ষেত্রে ভারতকে আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করতে গিয়ে মূলত কয়েকটি মৌলিক স্তরকে বিবেচনা করতে হয়েছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ও বৈশ্বিক পরিবেশ; অন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটে জড়িয়ে পড়ার যৌক্তিকতা; দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ভারতের জনগণের অদম্য মনােভাব এবং মতামতের প্রভাব; তৃতীয়ত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির সক্ষমতা; এবং চতুর্থত, শীর্ষ নেতৃত্বের বিশ্বাস, মূল্যবােধ ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির প্রক্রিয়ায় বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল এবং দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে ভয়াবহ মতবিরােধ, সংঘর্ষ ও দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়েছিল মনােজগৎ থেকে সাম্প্রদায়িকতার সেই রেশ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিদূরিত হয়েছিল এমনটি বলা যাবে না । ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজত্রে।  অবসান এবং মুসলিম লীগের লক্ষ্য ছিল কংগ্রেসের ‘অখণ্ড ভারত থেকে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি।
সে কারণেই মূলত বাঙালি মুসলমানদের রাজনৈতিক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল ভারতীয় কংগ্রেস, যে সংগঠনটি প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের করায়ত্ত ছিল । এই বিরােধের মূল সূত্রপাত ছিল প্রথমদিকে যতটা অর্থনৈতিক ধর্ম ততটা মুখ্য ছিল না। কিন্তু ১৯৪০-১৯৪৬ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক বঞ্চনাকে ছাপিয়ে ধর্ম মুখ্য ভূমিকায় চলে আসে। শেষপর্যায়ে ধর্মই বিরােধের মূল কেন্দ্র হিসেবেই বিবেচিত হয়। এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা বাঙালি মুসলমান মনােজগতে প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল হয়েছে। আবার লক্ষণীয় যে, পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরপরই পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর ধর্মীয় জিগির ও ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের উপর যে কলােনিয়েল শাসন-শােষণ চাপিয়ে দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামীণ খেটে খাওয়া জনগােষ্ঠীকে বিক্ষুব্ধ করে তােলে। ফলে ধর্মের শ্লোগান দিয়ে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে রাষ্ট্রের মূল সূত্রকেই পূর্ববঙ্গের সচেতন জনগণ অস্বীকৃতি জানাতে থাকে। ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গে যেখানে ধারণাগতভাবে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ অথবা সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার বিপরীতে পূর্বাপর বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা বিকশিত হতে থাকে। ১৯৪৮ সাল থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার অশুভ তৎপরতার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা স্ফীত হতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পিছু হটার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আঞ্চলিক শাসন-শােষণের চিত্রটি সামনে চলে আসার ফলাফল হিসেবে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী পূর্ববঙ্গে চরমভাবে পরাজিত হয়। পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠী গণ-আকাক্ষার এই সম্মিলিত চরিত্রকে বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়ে একে ‘ভারতের চক্রান্ত’ হিসেবেই অভিহিত করেছে। পূর্ব বাংলার জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গােষ্ঠীর ‘ইসলাম বিপন্ন’ ও ‘কাশ্মীর ইস্যুকে’ তেমন প্রাধান্য দেয়নি বরং তাদের কাছে বড়াে হয়ে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণ, অত্যাচার ও নিপীড়ন। ১৯৫৮ সালের পর বাঙালি রাজনীতিবিদদের কাছে এমন কোনাে আশা জাগ্রত ছিল না যে, পাকিস্তান  রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে তারা কোনাে দিন ক্ষমতাসীন হবেন অথবা শাসন-শােষণের অবসান ঘটাতে সক্ষম হবেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবের ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিদায়, প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণ, ১৯৭০ এর নির্বাচন বাঙালি জাতীয় জীবনকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত করেছে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় গণমুক্তির প্রকাশ। এই নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের নিরঙ্কুশ গণ-ম্যান্ডেট। | ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর হতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কাঙ্খিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রকাশ্যে মাঠে নেমে পড়েন। অসহযােগ আন্দোলনকে পর্যায়ক্রমিক সশস্ত্রকরণের মাধ্যমে পহেলা মার্চ ‘৭১ থেকে। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অতুলনীয় নেতৃত্বে গােটা বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্মম আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রবল গণ-প্রতিরােধ ও সশস্ত্র সংগ্রামে যে আবেগ তৈরি হয়, সেই আবেগ পশ্চিম বাংলা ও সর্ব ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। সেই বিপুল আবেগকে অস্বীকার করার উপায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ছিল না। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে যেখানে নির্মোহ দৃষ্টিতেই সবকিছু বিচার্য, কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে, কূটনৈতিক নীতি নির্ধারণেও এই ভাবাবেগকে এড়িয়ে যাবার উপায় ছিলাে না। বিষয়টি গতানুগতিক দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের মতাে নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে। রক্তস্নাত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য রাষ্ট্রের যে দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক তা থেকে এর পরিপ্রেক্ষিত ও পটভূমিকা ছিল ভিন্নতর। এমনকি, অভ্যন্তরীণভাবে বাংলাদেশকে ঘিরে ভারত সরকার কূটনৈতিক সূত্র নির্ধারণে নানামুখি চাপের সম্মুখীন কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আদর্শিক সূত্রগুলাের প্রভাব যে নেই একথা বলা চলে না। আন্ত জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে আদর্শবাদ কখনাে ভিত্তি হয়ে থাকে, কখনাে বা কৌশলগত পর্যায়ে গৌণ হয়ে পড়ে। কিন্তু আদর্শিক ও মৌলিক নির্দেশনা ব্যতীত কোনাে রাষ্ট্রই কূটনৈতিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারে না; অনেক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক পর্যায়ে আদর্শের নিরিখে করণীয় বা বর্জন নীতি গৃহীত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকা নির্ধারণে আদর্শিক দিকগুলাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা মুজিবনগর সরকারের ঘােষিত নীতি ভারতের রাষ্ট্রীয় ও কূটনৈতিক আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্য হওয়ায় নীতি নির্ধারণে ভারতকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘােষিত মৌলিক নীতিমালার সঙ্গে ভারতীয় রাষ্ট্র দর্শন ও ক্ষমতাশীন কংগ্রেসের নীতিগত বৈপরীত্য না থাকায় ভারত সরকারের পক্ষে নীতি নির্ধারণে অসুবিধার সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের জনগণ ও সরকারের নিকট থেকে যে সর্বাত্মক সাহায্য-সহানুভূতি লাভ করে তার একটা বড় কারণ হলাে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শ। প্রথমত, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শগত সাদৃশ্য। দ্বিতীয়ত, ভারতের রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে পূর্ণমাত্রায়। তৃতীয়ত, ভারত বিভাগে ‘এপার বাংলা, ওপার বাংলা’ সংক্রান্ত বিভক্তির মর্মবেদনা ও ঐ সময় জন্মভূমি ত্যাগকারী মানুষের নস্টালজিয়া। চতুর্থত, মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচারে নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণ যে কোনাে হৃদয়বান মানুষকে অসহায় ছিন্নমূল বাঙালি জাতির পাশে দাড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের জনগণ ও প্রায় সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলাে আবেগ ও আদর্শগতভাবে দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের নৈতিক ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিল। সেজন্য দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা মৌলিক নীতি নির্ধারণে ভারত সরকারের উপর প্রায় অভিন্ন চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এমনকি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যে একুশ দফাভিত্তিক ম্যানিফেস্টো রচিত হয়েছিল তার ভিত্তি ছিল ভাষা-সাহিত্য, সাংস্কৃতিক মুক্তি ও সামন্ততন্ত্রের অবশেষসমূহের বিলুপ্তি, স্বশাসন এবং সমাজতান্ত্রিক দাবিগুলাে। পরবর্তীকালে বড়াে বড়াে শিল্পের জাতীয়করণের দাবি তােলে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ। ১৯৬৯ সালে প্রচারিত নীতি ও কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের লক্ষ্য হিসেবে বর্ণিত হয় অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সমাজতন্ত্র কায়েম’। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর ১লা মার্চ করাচির ডন পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তার বক্তব্যের স্পষ্ট চিত্রায়ন ছিল, ভারতের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সম্পূরক অর্থনৈতিক সম্পর্ক। যে কারণে ভারতের বামদলসহ উদার রাজনৈতিকদলগুলাে মুক্তিযুদ্ধকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন জানিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সূত্র হিসেবে সােভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরােপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। একই পরিপ্রেক্ষিত ইসলামি উম্মাহ এবং পুঁজিবাদের সমর্থক রাষ্ট্রগুলাে বাংলাদেশের বিরােধীতা করে। চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, কারণ চীনের সমাজতান্ত্রিক ধারণার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ সরকারের সমাজতান্ত্রিক ধারণার পার্থক্য ছিল। উপরন্তু, চীন-ভারত দ্বন্দ্ব ও সােভিয়েত-চীন দ্বন্দ্বও এই ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিল। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পায় এটা অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতের ভূমিকাকে কেবল জাতীয় স্বার্থের নিরিখে বিচার করা ঠিক হবে না। কারণ ভারতের গণমানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক গ্রহণযােগ্যতার পেছনে ভাবাবেগ ও আদর্শিক আবেদন কোনােক্রমেই খাটো করে দেখা যাবে না। এর অর্থ এই নয় যে, কেবল ভাবাদর্শগত কারণে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে ভারতের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে ছিল এই সিদ্ধান্ত। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ভারতের দিক থেকে কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে বিশেষ
স্বার্থসংশ্লিষ্ট। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকা ছিল একই সঙ্গে মানবিক, আদর্শবাদিতা ও জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। জাতীয় স্বার্থ অর্জন করা প্রতিটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির মূল লক্ষ্য। ভারত জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের আগ্রাসী ভূমিকা ভারতের পররাষ্ট্র পরিমণ্ডলকে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে কাশ্মীর সমস্যা এবং পূর্বাঞ্চলে। আসাম বিদ্রোহ তৎপরতা ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতাকে সর্বদাই হুমকির মুখে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তান সামরিক গােয়েন্দা বাহিনী পূর্বাঞ্চলকে অস্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে সশস্ত্র সহায়তা প্রদান করেছে। এটা ছিল ভারত। রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তার প্রতি একটি অসহনীয় ঝুঁকির বিষয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পূর্বাঞ্চলে ভারত বিরােধী। সশস্ত্র তৎপরতা বন্ধের এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই ধরনের তৎপরতা ভারত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সংহতি বিদূরিত হবে বা বহুলাংশে হ্রাস পাবে, ভারতীয় কূটনৈতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের নিকট এই পরিস্থিতি ছিল এক অপূর্ব সুযােগ। একই সঙ্গে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল হাতছাড়া হলে বা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যেমন সংহত হবে, তেমনি বৈরী দেশ পাকিস্তানের সরাসরি সশস্ত্র হস্ত ক্ষেপের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের কাছে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে একদিকে যেমন পূর্বাঞ্চলে সামরিকসংহতিমূলক কর্মকাণ্ডে ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুদৃঢ় হবে, অন্যদিকে আর্থিক ক্ষেত্রে বিপুল সামরিক বাহিনী রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় সাশ্রয় পাবে।
এছাড়াও বাংলাদেশ সংকটে ভারতের কূটনৈতিক মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে দুর্বল করে উপমহাদেশে স্বীয় ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং উদীয়মান এশীয় শক্তি হিসেবে নিজেকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকার অম্বেষায় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাঙিক্ষত ভাবনার দৃঢ়তার বহিঃপ্রকাশ ভারত সরকারকে তড়িৎ কার্যকর এবং সফল কূটনৈতিক তৎপরতা গ্রহণে অব্যাহতভাবে ইতিবাচক চাপ সৃষ্টি করেছে। সে সময়কার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, পরাশক্তির অবস্থান এবং বৃহৎ শক্তিবর্গ কর্তৃক বাংলাদেশ সংকটকে পাস কাটিয়ে যাবার মনােভাবের সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের আবেগ, আদর্শগত ও জাতীয় স্বার্থের ধারণাগত পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করতে হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কূটনৈতিক আচরণ ও অবস্থান। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে ভারত সরকার, জনগণ, রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, গণমাধ্যম ও সংগঠন এত গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল যে, শেষ পর্যন্ত ভারতকে বিশ্ব পরিসরে সার্বিকভাবে কূটনীতিক যুদ্ধের মনােভাব ও দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে সকল প্রতিকূলতা। মােকাবিলা করতে হয়েছে। 
বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা-পরিকল্পনা ভারতের অজানা ছিল না। ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গণরায়কে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে যেভাবে বাংলাদেশের জনগণের উপর আকস্মিক আক্রমণ ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায় ভারত সরকারের কাছে তা ছিল অচিন্তনীয়। অগণিত ছিন্নমূল নিঃস্ব মানুষের নিরবচ্ছিন্ন মিছিল, বাংলাদেশের প্রতিরােধ যুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণাসহ উদ্ভূত পরিস্থিতি ভারতকে। রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক সংকটের আবর্তে ঠেলে দেয়। এ অবস্থা ভারতের জনগণ, পার্লামেন্ট, জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে আবেগ আপ্লুত করে ফেলে। সেই আবেগের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় ভারতের লােকসভা ও রাজ্যসভায় উপস্থাপিত জনপ্রতিনিধিদের কণ্ঠস্বরে। বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের দুঃসহ অবস্থা, মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া এবং অবিলম্বে সরাসরি সামরিকবাহিনী প্রেরণ। করে পাকিস্তানহানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান ভারতীয় জনগণের আশু দাবি হিসেবে সরকারকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দেয়। গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে এসব দাবিকে উপেক্ষা করার কোনাে পথ খােলা ছিল । বরং পার্লামেন্টে ও রাজনৈতিক দলসমূহে এবং বিভিন্ন শ্রেণি পেশা বিশেষজ্ঞদের অভ্যন্তরীণ এসব দাবিকে সরকার বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক নীতি নির্ধারণ ও কূটনীতি পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। অভ্যন্তরীণ গণ-আকাক্ষা, কূটনৈতিকভাবে বিশ্ব পরিসরে তুলে ধরার ক্ষেত্র নির্ণয়ে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সার্থকভাবে ইস্যুগুলােকে কাজে লাগিয়ে সমগ্র ভারতের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হন। সেজন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের কূটনৈতিক ভিত্তির গতিধারা বিচিত্র ধারায় পরিচালিত হয়েছে মনে হলেও কূটনীতি ভিত্তি নির্মিত হয়েছে অর্ধ-শতকোটি মানুষের মূর্তআকাক্ষার রূপায়ণে।
| এ অধ্যায়ে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন পার্লামেন্ট, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ যেভাবে সরকারের উপর ঐক্যবদ্ধ ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে চাপ প্রয়োেগ করেছে, কূটনৈতিক ভূমিকার বিশ্লেষণে সেসব ঘটনাপ্রবাহ ও কার্যক্রম অপরিহার্যভাবে চলে এসেছে। সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয় এই যে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সামগ্রিক পরিস্থিতি একটি দেশের কূটনীতিকে কীভাবে অবয়ব দিয়েছে এবং সুনির্দিষ্টভাবে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে বিশ্লেষণে তার যথার্থ উপযােগিতা খুঁজে পাওয়া যাবে। এ কারণে পর্ব বিভক্তি প্রয়ােজন। এই অধ্যায়ের প্রথম পর্বে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে। সর্বস্তরের গণ-আকাক্ষার প্রবল আবেগ এবং আবেগকে ঘিরে কূটনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠার পশ্চাদভূমির (Hinter land) সার সংক্ষেপ বর্ণিত হয়েছে এবং দ্বিতীয় পর্বে প্রথম পর্বে আবর্তিত দাবিগুলাের কূটনৈতিক রূপায়ণ ও বাস্তবায়ন কীভাবে পরিচালিত হয়েছে। তার বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
প্রথম পর্ব
কূটনীতির প্রথম ধাপ: পূর্ববঙ্গ নামকরণ
ভারতীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে প্রথম ধাপেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের দু’অংশের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে পৃথক সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর এবং ১৭ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের পূর্বেই ১৫ই এপ্রিল ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তান নাম ব্যবহার না করা এবং এর স্থলে ‘পূর্ববঙ্গ’ নামটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। পূর্ব পাকিস্তান নামের স্থলে সরকারিভাবে পূর্ববঙ্গ নাম ব্যবহার করার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভারত সরকার বিশ্ববাসীকে এই বার্তা পাঠিয়ে দেয় যে, বর্তমান অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান একটি পৃথক রাষ্ট্রীয় সত্তা যা পূর্ববঙ্গ নামে তারা অভিহিত করবে। এখানে কৌশলগত কূটনৈতিক কারণে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে পূর্ববঙ্গ’ নাম ব্যবহার করলেও বাংলাদেশ নাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকে।
১. কূটনৈতিক নীতি নির্ধারণে অভ্যন্তরীণ চাপ বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে। সরকারগুলাের পক্ষ থেকে বিশেষকরে চীন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘােষণা করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু ভারতীয় জনমত, গণসংগঠন এবং সভ্যসমাজ মনে করে যে, বাংলাদেশের নিষ্ঠুর অমানবিক কর্মকাণ্ড যা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন ট্রাজেডি, তার মােকাবেলায় ভারতকে ‘এক্ষুণি’ ঝাপিয়ে পড়তে হবে। বাংলাদেশকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে দখল করতে হবে এবং স্বীকৃতি দিতে হবে। এই মনােভাব প্রকাশ পেয়েছে ভারতীয় পার্লামেন্টে; লােকসভায় আবেগ আপ্লুত সদস্যদের কণ্ঠস্বরে, জনসভায় উত্তেলিত স্লোগানে, রাজপথে দীর্ঘ মিছিলের অবয়বে, গণমাধ্যমের নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার-প্রচারণা কিংবা সংগীতের বিদ্রোহী সুরবাণীতে বা জয়বাংলার অহােরাত্রির জয়ধ্বনিতে। এই সম্মিলিত গণশক্তির অন্তর্নিহিত প্রচণ্ড প্রভাবকে কোনাে গণতান্ত্রিক সরকারই উপেক্ষা করার ক্ষমতা রাখে । যার ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে ঘােষিত হয় যে, “ভারত কোনাে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না, কিন্তু পূর্ববঙ্গে যা ঘটছে তা প্রকৃতপক্ষে অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না।”
ক. ভারতীয় লােকসভায় আলােচনা ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ সাল দুপুর ২টা ৪ মিনিটে ভারতের লােকসভা অধিবেশন চলছিল। স্পিকারের আসনে ছিলেন আর.ডি, ভান্ডারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা, প্রতিরােধ সংগ্রাম ও স্বাধীন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে আলােচনা শুরু হয়। আলােচনার শুরুতেই ভারতীয় লােকসভার সদস্য সমর গুহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃসংশতা, নিরীহ জনগণের উপর নিষ্ঠুর আক্রমণ, 
গণহত্যা এবং মানবতাবিরােধী কর্মকাণ্ডের ঘটনাবলি উপস্থাপন করেন। পাশাপাশি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ, বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা অথবা বন্দি করার প্রসঙ্গ বিশ্বপরিসরে তুলে ধরার। আহ্বান জানান। তার বক্তব্যে প্রতিফলিত হয় যে, পাকিস্তান জনগণ ও সামরিক সরকারকে জানিয়ে দেওয়া দরকার যে, ইয়াহিয়া খান যে ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করেছে তার বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতবাসী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সংগ্রামের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এরই সাথে সুর মিলিয়ে ইসহাক সম্ভলী বলেন, “আজ পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, অনতিবিলম্বে এই সমস্যা রাষ্ট্রসংঘে তােলা উচিত।  বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২৭শে মার্চ ভারতীয় রাজ্যসভায় বিতর্ককালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করে পাকিস্তান সামরিক জান্তা আলােকিত পথ থেকে অন্ধকারে, গণতন্ত্রের পরিবর্তে রক্তস্নাত। ট্র্যাজেডি, আস্থা ও বিশ্বাসের পথ থেকে বিপর্যয়ের পথে সমগ্র জাতিকে ঠেলে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য ছিল, “এটা। বাংলাদেশের জন্য শুধু বিপজ্জনক নয় অথবা ভারতের একটি অংশের জন্যও নয় বরং গোটা ভারতের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতান্ত্রিক মূল্যবােধে বিশ্বাসী এবং সমগ্র জনগণ তার পেছনে বিস্ময়করভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের সীমাহীন দুঃখ বেদনার সঙ্গে আমরা শুধু সহমর্মিতা প্রকাশ করছি না, তাঁদের এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্ত করার বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।” ২৭শে মার্চ বিকাল ৪ টায় ঝংলাদেশের সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়ে ভারতের লােকসভায় পুনরায় আলােচনা শুরু হলে স্পিকার বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির পর আর কোনাে আলােচনা চলতে পারে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী স্পিকারকে অনুরােধ করে বলেন যে, ব্যতিক্রম হলেও এই হাউজে সদস্যদের গভীর অনুভূতি প্রকাশের সুযােগ দেওয়া উচিত। এ পর্যায়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের ২৮শে নভেম্বর যে ঘােষণা দিয়েছিলেন সে বিষয়ে সরকার অবগত। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়।
শান্তিপূর্ণ অবস্থা থেকে সংঘর্ষের পথে ধাবিত হয়। তিনি বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সাহায্য কামনা করেছেন, “এই সংগ্রাম যদি অব্যাহত থাকে তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমর্থনে আমাদের সম্ভাব্য প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের সংগ্রাম সম্পর্কে দুটি বিষয় পার্লামেন্ট সদস্যদের নিকট থেকে স্পষ্টভাবে অবহিত হতে চেয়েছেন। তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের চলমান ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে কিনা এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কেননা তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনাে গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি বা বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহ সম্পূর্ণরূপে তিনি অবগত হতে পারেননি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তখন বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরােধ সংগ্রাম চলছিল। এই অবস্থায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে এই সংগ্রাম যদি অব্যাহত থাকে এ ধরনের মন্তব্য করাটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকেফহাল না হওয়া পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের সংগ্রাম সম্পর্কে যে সংশয় প্রকাশ করেছেন তার যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না।” অবস্থা ছায়াবৃত থাকার পরেও লােকসভায় সসদ্যগণ বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক। বক্তব্য রাখেন। এ.কে, গােপালন বলেন, “বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থেই গৃহযুদ্ধ চলছে, যে যুদ্ধ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী মানুষের ইচ্ছা ও আকাঙক্ষা বাস্তবায়নের যুদ্ধ।” বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি মার্চের শেষ দিক হতে শুরু করে ক্রমাগতভাবে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়। ২৭শে মার্চেই লােকসভার কিছু সংখ্যক সদস্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি জানান। সমর গুহ তাৎক্ষণিক স্বীকৃতির দাবি সমর্থন করে বলেন, প্রকৃত গণতন্ত্রের মর্মবাণী অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আছে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘােষণার এবং আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী ভারতেরও অধিকার আছে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের। সাবেক প্রভাবশালী কেন্দ্রীয়মন্ত্রী ভি. কে, কৃষ্ণ মেনন মন্তব্য করেন, “ভারত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের বিষয়টি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে খুব একটা দূরে নয়। বাংলাদেশের নবীন সরকার যদি আবেদন করে বা অনুরােধ জানায় তাহলে কোনাে কিছুর লেশমাত্র পরােয়া না করে ঐ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের ঝুঁকি নিতে হবে।”১৫ হরি প্রসাদ শর্মা স্বীকৃতি বিষয়ে বলেন, এ বিষয়ে যথাসময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে, ভারত যে কেবল প্রতিবেশীর স্বার্থের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার নজির স্থাপন করবে তাই নয় বরং ভারতের নিজস্ব মৌল আদর্শের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। আলােচনায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এস, এ, শামীম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিরােধীতা করেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিবেচনা করেছেন বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে।

পরবর্তী বাংলাদেশ বিষয়ক যে কোনাে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে স্বীকৃতিদানের বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে রাজনৈতিক দলগুলো। আলােচনার শেষ পর্যায়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “যারা নিপীড়িত, নির্যাতিত তাদের অধিকার আদায়ে ভারতের কষ্ঠ সর্বদা সােচ্চার থাকবে। কিন্তু বর্তমান গুরুতর এই পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে এই মুহুর্তে কমকথা’ বলা ভালাে।”১৬ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণে তিনি বিরােধী দলের সঙ্গে বসবেন। ৩১শে মার্চ ভারতের লােকসভায় বাংলাদেশের উপর পাকিস্তান সৈন্যের আক্রমণে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক। বিজয়, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতি ভারতের জনগণের সমর্থন জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। অবিলম্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবিক কারণে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্য যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, নিরস্ত্র জনগণের উপরে যে গণহত্যা চালাচ্ছে তা বন্ধ করার দাবি প্রস্তাবে উপস্থাপিত হয়।” লােকসভায় ইন্দরা গান্ধী বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবের প্রথম অংশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর আক্রমণের কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবে পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়। বলা হয় যে, পূর্ববঙ্গের সমগ্র জনগণের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য তাদের আশা আকাঙক্ষা ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে। বাংলাদেশ সগ্রামের পটভূমি তুলে ধরে বলা হয়, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জনগণ নির্ভুলভাবে তাদের ম্যান্ডেড প্রদান করেছে, কিন্তু পাকিস্তান সরকার ত বানচালের পন্থা অবলম্বন করেছে। পাকিস্তান সরকার জনগণের রায় অনুযায়ী। আইনানুগভাবে জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে, সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে জনগণের ম্যান্ডেড ও সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করেছে। একই সঙ্গে নগ্নভাবে শক্তি প্রয়ােগ, গ্রেনেড, মেশিনগান, ট্যাংক, আর্টিলারি, এয়ারক্র্যাফট ব্যবহার করেছে তাদের স্তব্ধ করার জন্য। ভারত সরকারের অবস্থান সম্পর্কে প্রস্তাবে বলা হয়, “সরকার এবং ভারতীয় জনগণ সবসময় জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে চায়। একই ধরনের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও পড়শি দেশে অবর্ণনীয় বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটছে এতে ভারত উদাসীন। থাকতে পারে না। দেশের সর্বস্তরের জনগণ নৃশংস ঘটনাবলি যা নিরস্ত্র জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। এই প্রস্তাবে পূর্ববঙ্গের জনগণের গণতান্ত্রিক জীবন নির্মাণের লক্ষ্যে যে সংগ্রাম চলছে তার প্রতি গভীর সমবেদনা ও সমর্থন প্রকাশ করছে। ভারত সরকার ও জনগণ সব সময় পাকিস্তানের সাথে একটি শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছে এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করেছে।” প্রস্তাবে ভারতের নীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, “শান্তি রক্ষায় ভারতের স্থায়ী স্বার্থ এবং মানবাধিকার সংরক্ষণে আমাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি শিরােধার্য করে এই সভা অরক্ষিত জনগণের নিধনযজ্ঞ থেকে সামরিক বাহিনীকে বিরত থাকার দাবি জানাচ্ছে। পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে অবিলম্বে এই পরিকল্পিত গণহত্যা বন্ধ করার জন্য বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রের জনগণ ও সরকারের প্রতিও এই সভা আহ্বান জানাচ্ছে।

একইসঙ্গে প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, “পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক জাগরণ যে শেষ পর্যন্ত সাফল্য অর্জন করবে, এই সভা সে ব্যাপারে তার দৃঢ় আশাবাদ নথিভুক্ত করছে। এই সভা এই মর্মে তাদেরকে নিশ্চয়তা প্রদান করছে যে, তাদের সংগ্রাম ও ত্যাগে তারা সব সময় ভারতের জনগণের আন্তরিক সহানুভূতি ও সহযােগিতা লাভ করবে। বলাবাহুল্য, ভারতের লােকসভার এই প্রস্তাব বাংলাদেশের জনগণকে মুক্তিসংগ্রামে উদ্দীপ্ত করেছে এবং সরকার গঠনের লক্ষ্যে ভারত সরকারের সঙ্গে যােগাযােগের ক্ষেত্রে যে সংশয় ছিল তা তিরােহিত হয়েছে। ফলে নয়াদিল্লির পথে তাজউদ্দীন আহমদকে প্রত যােগাযােগ স্থাপনে উৎসাহিত করেছে।” ভারত পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র । এই রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশেষকরে বাংলাদেশের সমস্যা সংকট সম্পর্কে সরকারকে প্রতিনিয়ত পার্লামেন্টে জবাবদিহি করতে হয়েছে। সে জবাবদিহিতার নানামুখী বিতর্ক পর্যালােচনায় গবেষক মাত্রই লক্ষ্য করবেন। লােকসভা এবং রাজ্যসভার কার্যবিবরণীতে বিভিন্ন মতাদর্শের প্রতিফলন। ঘটেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটি স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয় চরম সংকটকালে বিশেষকরে যেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে নিয়ে জটিল দাবা খেলা চলছে, সেক্ষেত্রে কূটনৈতিক গােপনীয়তা সবসময় পার্লামেন্টে উপস্থাপিত হবে বা হওয়া সমীচীন নয়। নীতি-নির্ধারকগণ বিশেষকরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মতাে দক্ষ, অভিজ্ঞ রাষ্ট্র-নেতাদের পক্ষে সেক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করাই স্বাভাবিক।
সেজন্য ভারতীয় পার্লামেন্টের বিশাল কার্যবিবরণী থেকে ভারতের কৌশলগত কূটনৈতিক তৎপরতা ও গভীরতা খুঁজে বের করা কঠিন বিষয় হলে অপ্রাপ্য নয়। তারপরেও বিভিন্ন তারিখে পার্লামেন্টের অধিবেশনসমূহে সংসদ সদস্যগণ যেভাবে সরকারকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি, বাংলাদেশ-সমস্যা সংকট, বিশ্ব রাজনীতি, পরিস্থিতি, সামরিক অবস্থান ও বিদেশ থেকে পাকিস্তানকে প্রদত্ত অস্ত্র সরবরাহ, শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে সংকট থেকে উত্তরণের উপায় উদ্ভাবন, শরণার্থী সমস্যাকে মানবিক সমস্যায় রূপদান এবং তা আন্তর্জাতিকীকরণ, বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পাকিস্তানের সরকারের রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টিতে কৌশলগত কূটনৈতিক তৎপরতা এবং বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বীকৃতিকে সমার্থক করে তােলার কৌশল ভারতীয় পার্লামেন্টকে সর্বদা জীবন্ত, সজিব এবং সক্রিয় করে রেখেছিল। | প্রকারান্তে এইসব আলােচনা-বিতর্ক ভারতের কূটনৈতিক নীতি নির্ধারণ ও বিশ্ব। পরিমণ্ডলে কার্যকর করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদান রেখেছে সন্দেহ নেই। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, শরণার্থী বিষয়ে পৃথক এজেন্ডায় সরাসরি তিন বার ব্যাপক আলােচনা অনুষ্ঠিত হলেও প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে শরণার্থীদের মানবিক ট্র্যাজেডির কথা উল্লেখিত হয়েছে। যেমন ২৪শে মে, ভারতে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর আগমনের ফলে সৃষ্ট অস্বাভাবিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রম ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর। বিবৃতিতে উল্লেখ্য রয়েছে যে, বিপুল শরণার্থী ভারতে আগমন করেছে তার অর্ধেক মাত্র। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করতে পেরেছে, বাকিরা আত্মীয়স্বজন কিংবা বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। শরণার্থীদের জন্য ব্যয়ের প্রসঙ্গ তুলে ভারতীয় দূতাবাসগুলােকে এ সম্পর্কে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট তাদের দায়িত্বের বিষয়টি তুলে। ধরার জন্য অনুরােধ করা হয়েছে। ২৪শে মে এ প্রসঙ্গে লােকসভায় আসাম, ত্রিপুরা। এবং পশ্চিমবাংলার সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনের (১৫-১৬ই মে) অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, প্রতিদিন এখনও গড়ে ৬০ হাজার শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সব ধরনের লােক বিদ্যমান। এদের। মধ্যে অনেকেই যুদ্ধাহত। তাদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিগত ২৩ বছর ভারত কখনাে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেনি। যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বলা হচ্ছে তা। ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ভারতের মাটিতে অগণিত শরণার্থী পাঠিয়ে পাকিস্তান তার সমস্যা সমাধান করতে চাচ্ছে, যা ভারত কোনােভাবে মেনে নেবে না। প্রধানমন্ত্রী “ভারত ঐতিহ্যগতভাবে সহ্যশক্তি নিয়ে গর্বের কথা বােধ করে। ভারত জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে বলেছে রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। বিশ্ব জনমত বিরাট শক্তি। যা কেউ উপেক্ষা করতে পারবে না। বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব রয়েছে উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনে এগিয়ে আসা। মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিষ্পেষণ ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য ভারত সবকিছুই করবে। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন, “এটি একটি জাতীয় সমস্যা হলেও মূলত এটি হলাে আন্তর্জাতিক সমস্যার অংশ।”২২
২৬শে মে লােকসভায় বিভিন্ন সদস্যবর্গ শরণার্থী সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে বক্তব্য পেশ করেন। তাঁদের বক্তব্যের মর্মার্থ বিশ্লেষণ করলে বেরিয়ে আসবে, বিশ্বে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গণতন্ত্র রক্ষার দাবি করা হলেও ভারতবাসী। দেখতে পাচ্ছে, পাকিস্তানে গণতন্ত্র যেক্ষেত্রে নিমর্মভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি ও গণতন্ত্রমনা জনগণের উপরে নিমর্ম ও নির্দয়ভাবে আক্রমণ ও ধ্বংস করা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে স্বতস্ফূর্তভাবে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য পৃথিবীর কোনাে রাষ্ট্রই সােচ্চার নয় কিংবা কেউই তা প্রতিরােধে এগিয়ে আসছে না। উপরন্ত | দোষারােপ করা হচ্ছে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে, দেশটিকে ভেঙে ফেলছে। অথচ বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বুঝতে হবে পাকিস্তান সামরিক জান্তা নিজেরাই দেশটিকে ভেঙে ফেলেছে। পরিণতিতে ভারতের উপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে নিষ্ঠুর ট্র্যাজেডি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, “এ সময়। ভারত শুধু নিজেদের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার কথাই ভাবছে না, স্বাভাবিকভাবেই ভারতকে ভাবতে হচ্ছে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার কথা। সেজন্য এই ভয়ঙ্কর। অবস্থায় ভারতকে স্থিরভাবে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এরূপ মন্ত ব্য করেন যে, তিনি সংযত ভাষায় কথা বলছেন এই কারণে, ভয়ংকর অবস্থাকে মােকাবেলা করা তখনই সম্ভব যখন ভারত প্রস্তুত হবে। এ কথার মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্টভাবে একটি বার্তা প্রদান করেন যে, ভারত বাংলাদেশ সংকট মােকাবেলায় পূর্ণ ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে প্রস্তুত নয় । ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যার ক্ষেত্রে শরণার্থীদের নিয়ে সাম্প্রদায়িক মনােভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার প্রবণতাকে প্রথমেই চাপা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ঘােষণা দেন। এই প্রথমবারের মতাে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে আস্থা প্রকাশ করে বলেন, কোনাে মহৎ কাজই আত্মত্যাগ। ব্যতীত অর্জিত হয় না, বাংলাদেশের সাহসী জনগণের অঙ্গীকারবদ্ধ সংকল্পের উপর সকলের আস্থা রাখা উচিত। কেননা তারা ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করছে। তাদের উপর সেই বিশ্বাস অব্যাহত থাকবে।
১৫ই জুন ভারতীয় পার্লামেন্টের কার্যপ্রণালি ধারা ১৭৬ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে শরণার্থীদের সমস্যা মােকাবিলা করার ক্ষেত্রে সরকারের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে এ কথা স্বীকার করার পরেও বলেন, “তার অর্থ এই নয় আকস্মিকভাবে আগত লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের সমস্যা সহজেই সমাধান করা সম্ভব। এই বিপুল শরণার্থী এসেছে ভয়াবহ সন্ত্রাসের রাজত্ব থেকে, এসেছে আহত হয়ে। তারা রােগাক্রান্ত, অসুস্থ, ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত। এদের সঙ্গে ভারতের দারিদ্র্যপীড়িত জনগণের কথা ভাবতে হবে। তারাও ক্ষুধার্ত ও বিপর্যস্ত। কিন্তু একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে ‘সানকি’ হাতে বিশ্বের দুয়ারে দুয়ারে ভারত ভিক্ষা চাইতে পারে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কর্তব্য ও দায়িত্ব তাদের পালন করতে হবে।” | পার্লামেন্টে শরণার্থী সমস্যার নানা দিক নিয়ে বিশদ আলােচনার ফলশ্রুতিতে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিবেকবান গণসম্প্রদায় শরণার্থীদের সম্পর্কে একদিকে যেমন সাহায্যের হাত প্রসারিত করে, অন্যদিকে তেমনি শরণার্থী সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তৎপর হয়ে ওঠে। শরণার্থী সমস্যাকে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ক্রমান্বয়ে জড়িয়ে ফেলার যে বাস্তব কৌশল গ্রহণ করে তা হতে বােঝা যায় প্রথম থেকে এটি ছিল ভারত সরকার নীতি নির্ধারক গগাষ্ঠীর লক্ষ্য। | খ, শরণার্থীদের সম্পর্কে নীতি : ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে শরণার্থী সমস্যা নানা ধরনের সংকট তৈরি করে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়েও বহু জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়। ৫ই জুন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা রাজভবনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রীসভার সদস্য এবং সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলােচনাকালে বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ। শরণার্থী আগমনের ফলে অতি গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যার পরিণতি দেশের জন্য গুরুতর হতে পারে। এই পরিস্থিতির মােকালের জন্য সুস্থির পদক্ষেপ, ঠিক সময়ে, ঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি। বাংলাদেশের ব্যাপারে সমস্যার ব্যাপকতা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সমর্থন মেলেনি। প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে জানান, শরণার্থীদের রাজ্যের বাইরে কেন্দ্রীয় সরকারের যে জমি আছে, সেসব জমিতে শিবির করে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্ত ব্যবস্থাই হচ্ছে অস্থায়ী ভিত্তিতে; কারণ শরণার্থীদের দেশে ফিরে যেতে হবে এবং স্বদেশে ফিরে যাবার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কোনােক্রমে যেন আইন-শৃঙ্খলার পরিবেশ বিঘ্ন না হয় সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
পূর্ব পাকিস্তানের সংকট বিষয়ক স্পেসাল ব্যুরাের পরিচালক জে, এন, দীক্ষিত শরণার্থী প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, শরণার্থী সমস্যা ভারতের ওপর দুই ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। প্রথমত, আমাদের স্পর্শকাতর রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মণিপুর, আসাম এসব এলাকার ওপর ভৌগােলিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছিল এবং আমরা সামাজিক অস্থিরতা সম্পর্কে ভীত ছিলাম। দ্বিতীয়ত, শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানােটা সহজ কাজ ছিল না। শরণার্থীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছিল মুসলমান। ভারতে ব্যাপকসংখ্যক শরণার্থীর আগমনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলাে সাধারণভাবে ভারত সরকারকে দায়ী করে। তাদের বক্তব্য হলাে মার্চের শেষ দিকে কিংবা এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করলে, দলে দলে শরণার্থী ভারতে আসতাে না।” ভারতের কমিউনিস্ট পাটির সাধারণ সম্পাদক সি, রাজেশ্বর রাও সংবাদ সম্মেলনে ১২ই জুন কেন্দ্রীয় সরকারের সমালােচনা করে মন্তব্য করেন, মনে হচ্ছে কেন্দ্র এখনও শরণার্থী সমস্যার গুরুত্ব পুরােপুরি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলােকে শরণার্থীর চাপে মাত্রাতিরিক্তভাবে ভারাক্রান্ত করে তুলছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ১৫-১৯শে জুন কোয়েম্বাটোরে অনুষ্ঠিত পরিটব্যুরাের সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণ করে। শরণার্থী বিষয়ে বলা হয় যে, “অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি ও সমস্ত সাহায্য দিতে এই ব্যর্থতা বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং এরই ফলে বাংলাদেশ থেকে ৫০ লাখের উপর মানুষকে ভারতে এসে শরণার্থী হতে হয়েছে। এটা কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা। ২১ লােকসভা ও রাজ্যসভায় শরণার্থী সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্নউত্তর পর্ব, আলােচনা এবং বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এ আলােচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান বা ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে শরণার্থী সমস্যার সমাধান। রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে শরণার্থী সমস্যার বিষয়টি জোরেসােরে উত্থাপিত হয়নি। কোনাে কোনাে গবেষক” এই অভিমত উত্থাপন করার প্রয়াস নিয়েছেন যে, এই সব দাবি তারা তুলেছিল কংগ্রেস সরকারকে রাজনৈতিকভাবে পর্যদুস্থ করার জন্য। কিন্তু সার্বিক পর্যালােচনায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দক্ষ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে জনমত এমনভাবে সংগঠিত হয়েছিল যেক্ষেত্রে জনসংঘ, স্বতন্ত্র ও হিন্দু মহাসভার মতাে ভারতের দক্ষিণপন্থি ও সাম্প্রদায়িক দলগুলাে ঘােলা জলে মাছ শিকারের সুযােগ পায়নি। 

১৮ই জুন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রসঙ্গে ভারতীয় লােকসভায় ব্যাপক বিতর্ক লক্ষ্য করা যায়। জনসংঘের নেতা এ. বি. বাজপেয়ী লােকসভায় বলেন, যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা আলােচনা করা হচ্ছে তার অর্থ বাংলাদেশে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে, বাংলাদেশ উপনিবেশ থাকবে না, যত শরণার্থী এসেছে তারা ফিরে যাবে, জানমালের নিরাপত্তা থাকবে। কিন্তু সরকারের এই ‘পবিত্র ইচ্ছা’র স্বপক্ষে বিশ্ব রাষ্ট্রসমূহ যে সাহায্য করবে তার কোনাে সম্ভাবনা দেখা। যাচ্ছে না। তিনি ভারতের নীতি নির্ধারণ সম্পর্কে বলেন, “নীতি একটাই হতে পারে এবং সেটি হচ্ছে একটি প্রতিজ্ঞা-আজকের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে কোনাে আপস নেই । বাংলাদেশে সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে যাতে উদ্বাস্তুরা ফিরে যেতে পারে। তথা •ণত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সেজন্য যুদ্ধ ছাড়া যদি কোনাে উপায় না থাকে তবে ভারতের যুদ্ধ করার জন্যও তৈরি থাকতে হবে।” শরণার্থী সমস্যার শুরু থেকেই জনসংঘ একটি বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান। নয়াদিল্লিকে করতে হবে। অন্য কেউ করে দেবে না এবং শেষবাক্যে তিনি এমনটি সংশয়াশ্রিত আশা প্রকাশ করেন যে, নয়াদিল্লি সাহসের সঙ্গে চললে এক নতুন ইতিহাস লেখা যেতে পারে।” | গ. বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া: ২৭শে মার্চ। কলকাতার সর্বস্তরের মানুষ পূর্ববাংলায় মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে সভা-সমিতি, বিক্ষোভমিছিলে পূর্ববাংলার প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সমর্থন জানান। ঐদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের সিনেটের এক সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় যে, অবিলম্বে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ভারত সরকারের প্রতি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের আবেদন জানানাে হয়। দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র-শিক্ষক-যুবক এবং শিক্ষাবিদগণ জাতীয়তাবাদী-নায়ক শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন এবং সেখানে জঙ্গীশাহীর গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে প্রস্তাবে বলা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বীকৃতি দিতে হবে। ঐদিন সমগ্র পশ্চিম বাংলায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয় এবং ১৪৪ ধারা অমান্য করা হয়। | ২৮শে মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে পশ্চিম বাংলার লেখক-বুদ্ধিজীবীবৃন্দ এক বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতির একাংশে বলা হয়, “পৃথিবীতে আজ বহু দেশ আছে, বহু জাতি আছে যারা নিজেদের সুসভ্য বলে দাবি করে। সে দাবি অনেকাংশে স্বীকার্য। তাদের বিবেক কি আজ সাড়া দেবে না? আমরা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিকর্মীরা বিশেষ করে আবেদন জানাই পৃথিবীর সব দেশের শিল্পস্রষ্টা ও জ্ঞানতপস্বীদের কাছে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে এই বীভৎস বিরাট নরহত্যার সংবাদ তারা পেয়েছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের সকলের তীব্র প্রতিবাদ ঘােষিত হােক, তাদের সরকারকে তাঁরা উদ্বুদ্ধ করুন এই অর্থহীন নৃশংসতার নিন্দা করতে, প্রতিবাদ করতে, এ বিষয়ে তাদের যথােচিত কর্তব্য পালন করতে। আমাদের সরকার কবে স্বাধীন বাংলাদেশ-এর রাষ্ট্রিক মর্যাদা স্বীকার করবেন, ঐ দেশের সংগ্রামী নিপীড়িত মানুষকে সর্বপ্রকার অসামরিক সাহায্য দানে উদ্যোগী হবেন। একটি বিক্ষোভ মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা সমবেত হয়ে পাকিস্তান দূতাবাস ভবনের গেটে স্বাধীন বাংলার পতাকা টাঙ্গিয়ে দেয়।

৮ই এপ্রিল কলকাতার শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সমিতি বাংলাদেশের সাহায্যে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে। বিবৃতিতে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সর্বপ্রকার সাহায্যের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিকবুদ্ধিজীবী সমিতি’ গঠন করেন। ১৯শে এপ্রিল ভারতের মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য ভারত সরকারের নিকট আবেদন করেন এবং বিশ্বকে অনুরূপভাবে স্বীকৃতির জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।” বাংলাদেশের বিপর্যস্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে ভারতের প্রখ্যাত ৪৪জন অধ্যাপক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীগণ এক আবেদনে বলেন যে, এখন পর্যন্ত মানবজাতির নৈতিক মূল্যবােধ ক্ষেত্রবিশেষে বিপন্ন হলেও বিশ্বের অগণিত মানুষ এই মূল্যবোধকে সমুন্নত করে রেখেছে। পূর্ববঙ্গে নিঃশেষ ক্রন্দন শােনার দাবি জানাই এবং তাদের কাছে আবেদন জানাই গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সম্মান জানাই এবং সামরিক জান্তার বিকারগ্রস্তকে আটকানাের দাবি জানাই। ঘ, বিভিন্ন সংস্থা: ২৫শে এপ্রিল হরিশ মহীন্দ্র এবং মেহবুব নসরুল্লাহকে যথাক্রমে চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি করে বােম্বের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি গঠিত হয়। এই কমিটিতে বিশিষ্ট অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমান এবং শর্মিলা ঠাকুর সদস্য ছিলেন।
কমিটির উদ্দেশ্য হলাে, বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষদের সাহায্য করা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যের জন্য পাঁচ লক্ষ পতাকা তৈরি করা, যার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। শুধু তাই নয়, এই সংস্থার মাধ্যমে চ্যারিটি শাের আয়ােজন করা হয়। ২৯শে এপ্রিল গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাংলাদেশের সমর্থনে রাষ্ট্র সংঘ ও বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিদল প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশনের সম্পাদক রাজা কৃষ্ণ এক বিবৃতিতে বলেন যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে অবিলম্বে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বানের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। একই সাথে সানফ্রান্সিস্কোমস্কো অভিযান অথবা দিল্লি-পিকিং অভিযানের মতাে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি অভিযান শুরু করার জন্য ভারতের শান্তি সংস্থাগুলি প্রস্তাব করে। এ লক্ষ্যে যুদ্ধ-প্রতিরােধকারী লীগ, আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি এবং আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ ও শান্তি কনফেডারেশনের সঙ্গে যােগাযােগ করা হয়।” | ২রা মে, ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সােসাইটি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে স্বীকার করে নেয়ার জন্য সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানান। এ সংস্থার পূর্বের নাম ভারত-পাকিস্তান ফ্রেন্ডশিপ সােসাইটি পরিবর্তন করে বাংলাদেশভারত করা হয়। ৬ই মে বাংলাদেশ জাতীয় সমন্বয় কমিটির সমাবেশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান ভারত সরকারের অপরিহার্য কর্তব্য বলে দাবি করা হয়। সভায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হয়। সভাপতির ভাষণে রমেশ মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের সমস্যাটি হলাে মনুষ্যত্বের প্রশ্ন। এর একটি প্রতিবিধান হওয়া উচিত। হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রভু সেন বলেন, “গণতান্ত্রিক আন্দোলন জয়যুক্ত করার জন্য প্রয়ােজন হলে সৈন্য পাঠিয়ে যুদ্ধ করতে হবে।” ৭ই মে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে পশ্চিমবঙ্গের বৌদ্ধ সম্প্রদায় পূর্ববাংলার বৌদ্ধদের উপর পাকিস্তান বাহিনীর হত্যা নির্যাতনের প্রতিবাদে স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। তাঁরা বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপরে যে নির্যাতন হয়েছে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টকে তারবার্তার মাধ্যমে তা জানিয়ে দেন। ২০শে মে নয়াদিল্লিতে এমসি চাগলা, ভি.কে. কৃষ্ণমেননসহ কয়েকজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়ে জোরালাে যুক্তি উপস্থাপন করেন। চাগলা যুক্তি দিয়ে বলেন, নৈতিক, আইনগত, রাজনৈতিক অপরাপর দিক থেকে ভারতের উচিত শীঘই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া। প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণমেনন বলেন, স্বীকৃতিদানের প্রশ্নটি আইনসম্মত কি না তা নিয়ে বিতর্ক করার বিষয়। নয়। এখন বিপ্লবের সময়, আইন বা বিধির প্রশ্ন নয়, তাহলে ফরাসি শাসন থেকে আলজেরিয়া মুক্ত হতে পারতাে না। ৩১শে জুলাই ভারতের সাবেক সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল কাউল বাংলাদেশ প্রশ্নে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থতার জন্য সরকারি নীতির সমালােচনা করেন। তিনি বলেন, ২৫শে মার্চ-এর পরে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলাে ভারতকে তখনই বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তানকে আঘাত করা। কিন্তু তা করা হয়নি। আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দোদুল্যমানতার জন্য ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে যে বিপর্যয় হয়েছে তার দায়-দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের। এখনও ভারতের যে সামর্থ আছে তা দিয়েই চীন এবং পাকিস্তানকে ভারত প্রতিহত করতে পারে। এখন পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে এবং তাদের চারদিকে সব সৈন্য মােতায়েন আছে। মার্চ-এপ্রিলে যুদ্ধ পরিস্থিতি ছিল ভারতের পক্ষে এবং সে সময়ই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে স্বাধীন করা উচিত ছিল। ও, আন্তর্জাতিক সম্মেলন, বাংলাদেশকে সমর্থন: ১৯শে সেপ্টেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ২৪টি দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের চলমান ঘটনায় দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ এবং অবিলম্বে শেখ মুজিবের শর্তহীন মুক্তির জোর দাবি জানান। দিল্লির এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১৪০জন প্রতিনিধি ছিলেন, তার মধ্যে ৭০জন ছিলেন বিদেশ থেকে আগত এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকেও অনেক প্রতিনিধি। অংশগ্রহণ করেন। ১৮-২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ বিষয়ে এক আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়ােজন করে। বিশ্বের ২৪টি দেশের ১৫০জন প্রতিনিধি অংশ নেন সেমিনারে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক ছিলেন।
জয়প্রকাশ নারায়ণ-এর সভাপতিত্বে সেমিনারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেমিনার থেকে জাতিসংঘের কাছে আহ্বান জানানাে হয় যে, “…to place the Bangladesh problem before all organs of the international body as a violation of human rights and as a threat to world peace.”৪৭ সম্মেলন আয়ােজনে ও বিদেশি প্রতিনিধি আমন্ত্রণে ভারত সরকারের সহযােগিতা পেয়েছে উদ্যোক্তারা। তিনদিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই-এর জন্য একটি সশস্ত্র আন্তর্জাতিক বাহিনী গড়ে তােলার প্রস্তাব করা হয়। সম্মেলনে বলা হয়, প্রস্তাব দিলেই বাংলাদেশে। স্বাধীনতা আসবে না, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ব্যর্থ হলে বিশ্বের এই অংশের সমস্ত মানুষের মুক্তিসংগ্রাম ব্যর্থ হবে। সভায় সর্বসম্মত প্রস্তাবে শেখ মুজিবের গােপন বিচারের নিন্দা করা এবং তার মুক্তির জন্য বিশ্বের রাষ্ট্রগােষ্ঠীর উপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানানাে হয়। শেষদিনে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শেখ মুজিবের মুক্তি, বাংলাদেশের মুক্তির জন্য একটি বিশ্ব ব্রিগেড গঠনের আহ্বান জানানাে হয় এবং একই সাথে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানানাে হয়।” এ সম্পর্কে ২৪শে সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় বলা হয়। সাধারণ পরিষদের বৈঠকের মাত্র কয়দিন আগে ভারতের রাজধানীতে একটি বিশ্ব বৈঠক বসেছিল। সেখানে হাজির ছিলেন ২৪টি দেশের প্রতিনিধি। বৈঠকটি অবশ্য রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈঠকের মতাে সরকারি শিলমােহরাঙ্কিত নয়,-একান্তভাবেই বে-সরকারি। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায়, অনেক বেশি প্রতিনিধিত্বমূলক। কেননা, যাকে বলে প্রকৃত জনমত তারই যথার্থ প্রকাশ দেখা গেছে দিল্লি-সম্মেলনে। নানা দেশের সংবাদপত্রে যে সব দাবিমুখরিত, কূটনৈতিক ভাষায় যেসব দাবির কথা কোনাে কোনাে সরকারের কাছেও স্বীকৃতি বলে কথিত-দিল্লিতে তারই সহজ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিধ্বনি শােনা গেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতােই এই জনমতের ভিত্তি নৈতিকতায় দৃঢ়। বস্তুত রাষ্ট্রীয় আচরণে যে দ্বিধা, কপটতা, এবং স্বার্থপরতা তার বিরুদ্ধে এই অকপট ভূমিকা বিশ্বমানবতার লাঞ্ছিত পতাকাকে আবার তুলে ধরল। সম্মেলন ‘আন্তর্জাতিক বিগ্রেড’ শেষ পর্যন্ত অবশ্য গড়েনি, কিন্তু তারা কথা তুলেছে-এটাও সামান্য কথা নয়। ওমেগাঅভিযাত্রীদের অভিযান যেমন প্রতীকী, তেমনই রীতিমতাে তাৎপর্যপূর্ণ দিল্লি সম্মেলনের কথােপকথন। বিশ্বের লুপ্তপ্রায় নৈতিকতা আবার একবার ঝিলিক দিল। কে জানে, এই সব সূত্র ধরে একদিন হয়তাে রাষ্ট্রপুঞ্জের পাশাপাশি আর এক রাষ্ট্রপুঞ্জ গড়ে উঠবে। একটি দরবারি, অন্যটি জনতার আদালত। এসব অবশ্য ক্ষোভের কথা। | রাষ্ট্রপুঞ্জের বিরুদ্ধে ক্ষোভের হেতু যে আছে, তাও বােধহয় অস্বীকার করার উপায় নেই। আশার কথা শুধু এই, কোনাে দেশ রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুমতি নিয়ে স্বাধীনতার লড়াই করে না। সে লড়াইয়ে যা সবচেয়ে মূল্যবান সেই গণ-সমর্থন যে ইয়াহিয়া খানের পিছনে নেই, বাংলাদেশের বীর যােদ্ধাদের পেছনে বিশ্বের মানুষ ক্রমাগত তা জানিয়ে দিচ্ছেন। নিউইয়র্কে কাচের মিনারে কী ঘটল, তার চেয়েও বাংলাদেশের পক্ষে আজ। জরুরি সমাচার-দিল্লিতে সমবেত প্রতিনিধিবৃন্দের মুখে তার জয়-জয়কার।” | ২৩শে সেপ্টেম্বর দিল্লির আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধি দল, বাংলাদেশে প্রবেশ করে পাকিস্তান কর্তৃক পরিচালিত অবৈধ সামরিক অভিযানের প্রতিবাদ জানানাের প্রস্তাব উঠলেও বিভিন্ন সমস্যার কথা বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করা হয়। তবে কেউ ব্যক্তিগতভাবে যেতে চাইলে তাতে কোনাে বাধা থাকবে এরকম মতপ্রকাশ করা হয়। পাকিস্তানবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের বিপরীতে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার আদর্শিক আবেদন ছিল অনেক তীব্র। যা অনুপ্রাণিত করে ভারতের সাধারণ জনগণ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে ও শরণার্থীদের মধ্যে আহার-বাসস্থানের সংস্থান করতে সাধারণ জনগণ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলাের ভূমিকা ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
ভারতের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষাবিদ, শিল্পীদের মধ্যে অধিকাংশই সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধ। ভারতব্যাপী গড়ে উঠতে থাকে নানা সংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধে যাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ পশ্চিমবঙ্গে লেগে থাকবে বেশি যে কারণে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতাে। বাংলাদেশকে কার্যকর সহায়তা দেবার দাবি জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সর্বসম্মতিক্রমে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। বিভিন্ন দল, শ্রমিকসংগঠন ও কলকাতার বিখ্যাত নাগরিকদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য একটি সংগঠন গড়ে তােলে। এছাড়া বাংলাদেশ সেবা সংঘ’ নামে আরেকটি সংগঠন কলকাতায় কাজ করে বাংলাদেশের পক্ষে। স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম। সহায়ক কমিটি’ কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন সৃষ্টিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য ভূমিকা পালন করে। ২৭শে মার্চ, ১৯৭১ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশন ছিল বাজেট বিষয়ে। এই অধিবেশন প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, “বাংলাদেশ সম্পর্কে সুনিদিষ্টভাবে করণীয় রয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর এস, এ, সেনকে সভাপতি করে “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ গঠন করা হয়। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, মুক্তিবাহিনী ও ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সহায়তা দেওয়া। বুদ্ধিজীবীদের সহায়তা, ভারত ও ভারতের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে সমিতি ইংরেজিতে ছয়টি ও বাংলায় পাঁচটি মনােগ্রাফ প্রকাশ করে। সারাবিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ, রােটারিয়ানদের ঠিকানায় ইংরেজি প্রকাশনাসমূহ প্রেরণ করে সমিতি। সমিতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত রাখা হতাে। ভারতের অনেক শহরেই জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তােলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দেবার জন্য। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ নামে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা গঠন করা হয়। ভারতের প্রাক্তন এটর্নী জেনারেল এম.সি, শীতলবাদ ছিলেন সমিতির চেয়ারম্যান। এই সমিতির অন্যতম সদস্য ড, ত্রিগুণা সেন জানান যে, বাংলাদেশের জনগণ যে সাহায্যেই চাইবে, তা তারা দেবেন। যে সাহায্যের মধ্যে… প্রাথমিক পর্যায়ে ঔষধপত্র, খাদ্য ও বস্ত্র দেবেন। যদিও কৌশলগতভাবে এটি ছিল একটি বেসরকারি সংগঠন, তথাপি ভারত। সরকারের মৌন অনুমােদন ছিল।
বােম্বাইয়ে বিশিষ্ট নাগরিকরা ‘বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি’ গড়ে তােলেন ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১। হরিশ মহীন্দ্রকে চেয়ারম্যান করে কমিটি গঠন করা হয়। সম্পাদক ছিলেন বেগম মহবুব নসরুল্লা, যুগ্মসম্পাদক খলিল ঘােষ। ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রতারকা ওয়াহিদা রহমান ও শর্মিলা ঠাকুর। বিখ্যাত উর্দু কবি আলি সর্দার জাফরী, কায়ফী আজমি, জনপ্রিয় কাওয়ালী শিল্পী ইউসুফ আজাদ, রশিদা খাতুনের সক্রিয় সহযােগিতা পায় এই কমিটি, যা ভারতীয় মুসলমানদের বাংলাদেশের পক্ষে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করে। এ প্রসঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছে ‘সারা ভারতবর্ষ যেন বাংলাদেশ-এ পরিণত হয়েছে। ভাবা যায় না। সাম্প্রদায়িক মনােভাবের উর্ধ্বে উঠে এদেশের হিন্দু-মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এই সম্প্রীতির মনােভাব অন্য উপলক্ষ্যে কখনও ঘটেনি।”* বাংলাদেশের সহায়তার জন্য হায়দ্রাবাদে গঠন করা হয় ‘আন্দ্রা প্রদেশ বাংলা সেবা সমিতি।’ হায়দ্রাবাদের এই সমিতির সভাপতি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কূটনীতিক বদরুদ্দিন তায়েবজী এবং সম্পাদক ছিলেন প্রাক্তন সংসদ সদস্য কে, হানারধন। সাবেক কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী সি, এল, নান্দাকে প্রধান করে চন্ডীগড়ে আরেকটি সহায়ক সমিতি গঠন করা হয়। এমনি সহায়ক সমিতি ভারতের অন্যান্য অংশেও গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই সমিতিগুলাের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সমিতিগুলাের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে তিনটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসবে। এক, শরণার্থীদের মানবিক সাহায্য; দুই, মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য সহায়তা প্রদান; এবং তিন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি। | ‘ডেমােক্রেসি এণ্ড মিলিটারিজম অব ইনকমপেটিবল’ শীর্ষক এক সংস্থার প্রশ্নের জবাবে আচার্য বিনােভাভাবে বলেন, তােমরা শুধু ভারত নয়, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাও, জানিয়ে দাও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে কীভাবে গণহত্যা করছে। মার্কিন জনগণকে বলে দাও, তাদের অস্ত্র নিয়ে কী নিষ্ঠুরভাবে হত্যাযজ্ঞ চালানাে হচ্ছে। সরকারগুলাের উপর চাপ সৃষ্টি করাে। ভারত সরকারকে এই সমস্যার সমাধানে ত্বরিৎ এগিয়ে আসতে বলাে।” | বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংস্থাগুলাের ভূমিকা ছিল একদিকে বাংলাদেশ থেকে আগত ছিন্নমূল মানুষদের সহায়তা, এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে দেশে ও বিশ্ব পরিসরে জনমত গঠন। ভারতের বিশ্বনন্দিত বুদ্ধিজীবী ও শ্রেণি-পেশার মানুষ বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দেওয়ার প্রশ্নে দিল্লির উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা ভারত সরকারের কূটনৈতিক নীতি নির্ধারণে ও পরিচালনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বুদাপেস্ট: ১৩ই মে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেষ্টে বিশ্বশান্তি কংগ্রেসের তিনদিনব্যাপী অধিবেশন শুরু হয়েছে। অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সমর্থন জানানাের জন্য ভারতের বক্তব্য অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা মনােযােগ দিয়ে শােনেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও একজন প্রতিনিধি সম্মেলনে যােগ দিয়েছেন।
৮০টি দেশের প্রায় ৭০০জন প্রতিনিধির সামনে প্রকাশ্য অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বার্তাটি পড়ে শােনানাে হয়। তাতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, ভারতের অবস্থান পূর্ববঙ্গের ঘটনাবলি উদাসীন থাকা কঠিন। প্রধানমন্ত্রী ওই বার্তায় বলেছেন, প্রায় ২০ লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতে চলে এসেছেন। ফলে আমাদের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। এই উদ্বাস্তুরা যাতে নিরাপদে মর্যাদার সঙ্গে দেশে ফিরে যেতে পারেন- তেমন অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য পাকিস্তানকে অবশ্যই বাধ্য করতে হবে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। বলেছেন, আশা করি, বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানবসমাজ মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য উঠে দাঁড়াবেন। পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের ন্যায্য দাবি, তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই তাঁদের দেশ শাসন করবেন। বিশ্বের মানুষ, আশা করি, এই দাবি সমর্থন করবেন এবং তাদের ওই অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হবেন। এই গুরুত্বের পরিস্থিতি এবং লক্ষ লক্ষ নির্দোষ মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশায় আমার মন ভারাক্রান্ত। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য অমৃত নাহাতা বার্তাটি পড়ে শােনান। তাঁকে প্রবল হর্ষধ্বনি জানিয়ে সদস্যরা অভিনন্দন জানান। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা শ্রীকৃষ্ণ মেনন বলেন, পূর্ববঙ্গে গৃহযুদ্ধ নয়, গুলি চালিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করা হচ্ছে। তিনি হিটলারি অত্যাচারের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের ঘটনার তুলনা করেন। মেনন আরও বলেন, পূর্ববঙ্গ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জাতীয় এলাকা এবং হাঙ্গেরির চেয়ে তার জনসংখ্যা ১০গুণের বেশি।
| ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা কৃষ্ণ মেনন হিটলারি অত্যাচারের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের ঘটনার তুলনা করে বলেন, অত্যাচার নির্যাতন কামান দিয়ে স্বাধীনতাকামীদের দমানাে যাবে না। ভারত সরকার নিজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি প্রেরণ করা ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারকেও বহির্বিশ্বে তার অবস্থান তুলে ধরতে সহায়তা দেয়, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে এশিয়া ও ইউরােপের বিভিন্ন দেশ সফর করেন আব্দুস সামাদ আজাদ। বুদাপেস্টে ১৩-১৬ই মে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে (World Peace Assembly) পাকিস্তান বাহিনীর নজিরবিহীন অত্যাচার-নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেন আব্দুস সামাদ আজাদ।

চ, গণমাধ্যমের ভূমিকা: বাংলাদেশের জ্বলন্ত সংকট আকস্মিকভাবে ভারত সরকার ও সর্বস্তরের গণ-মানুষকে বিস্ময় বিমূঢ় ও বিরামহীন উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ভারতবর্ষ উত্তাল হয়ে ওঠে। অগ্নিদগ্ধ রক্তস্নাত বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতের মানুষের বিবেককে ধাক্কা দেয়, হৃদয়কে বেদনাহত এবং মানসিকতাকে উদ্দীপ্ত করে অমানবিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ও অভ্যন্তরীণ এ অবস্থায় বাংলাদেশ-সংকট ভারতীয় সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত, প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিদিন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয় জনমতের প্রতিফলন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র সংগ্রামের বর্ণনা এবং বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে বক্তব্য, মন্তব্য ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেদন নানা পত্রিকায় ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যম প্রথম থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ববঙ্গ’ বা বাংলাদেশ’ নামে উল্লেখ করেছে যা পরবর্তীকালে সরকারি ভাষ্যে উচ্চারিত হয়েছে। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন দিক

সম্পর্কে ভারতীয় গণমাধ্যম যে কষ্টসাধ্য আগ্রহ ও আন্তরিকতা নিয়ে সংবাদ প্রচার করেছে যার ফলে একদিকে যেমন জনমত সংগঠিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি ভারত সরকারের উপর বাংলাদেশ-সংকট সমাধানে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনাে গবেষকদের কাছেই বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের তথ্য, উপাত্ত ও রাজনৈতিক গতিধারা নির্ধারণে ভারতীয় গণমাধ্যম সর্বদাই উৎসের প্রেরণা হিসেবে জীবন্ত থাকবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে যে, কোথাও কোথাও গণমাধ্যমের সংবাদগুলাে অতিরঞ্জিত এবং উদ্দেশ্য প্রণােদিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। | প্রতিবেশি দেশ হিসেবে পূর্বপাকিস্তানের নির্বাচনী তৎপরতা থেকে উত্তাল অসহযােগ আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকাগুলােকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। যে কারণে শেষ সময় পর্যন্ত সীমান্তে ভারতীয় সৈন্য মােতায়েন ও মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে গণমাধ্যম ও সংবাদকর্মীরা ছিলেন ক্লান্তিহীন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ২৬শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশি সাংবাদিকদের জোরপূর্বক বহিস্কৃত করলে বিদেশি সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্র হিসেবে ভারতের মাটিকে বেছে নেওয়া ব্যতীত অন্য কোনাে বিকল্প ছিল না। ভারতীয় সাংবাদিকগণ এই সুযােগে বিদেশি সাংবাদিকদের সহায়তা করার সুযােগটি হাতছাড়া করেনি। ফলে সংবাদ সংগ্রহের মূল কেন্দ্র হিসেবে দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত সংবাদ ভারতীয় মিডিয়ার সহযােগিতায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলাে অনায়াসে সংবাদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত সরকারের কর্মকাণ্ড বিশ্ব পরিসরে অতি ইতিবাচক হিসেবে প্রতিফলিত হতে থাকে। বিবিসি, রয়টার্স, ভয়েস অব আমেরিকা ইত্যাদি সংবাদমাধ্যম আকাশবাণী কিংবা ভারতীয় পত্রপত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। যেমনটি দেখা যায়, আনন্দবাজার, অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ কিংবা ভারতীয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি সংবাদ প্রচার করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বা মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ-প্রতিরােধ নিয়ে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার মূল কারণ ছিল সামরিক জান্তা কর্তৃক গণহত্যার ব্যাপকতা ও বিপুল সংখ্যক ছিন্নমূল মানুষের বিরামহীন মিছিল এবং একই সঙ্গে ট্যাংকের নিচে গণতন্ত্র হত্যার কারণসমূহ। যা ভারতীয় ও বিশ্ব বিবেককে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত সরকারের কর্মকাণ্ড যখন শুধু মৌন সমর্থন’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তখন প্রভাবশালী দৈনিকগুলােতে সরকারের তীব্র সমালােচনা করা থেকে বিরত ছিল না। পত্রিকাগুলাে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভিসি শুক্লা’র সমালােচনা করে এমন কথাও লিখেছে যে, প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি করে কোনাে লাভ হবে না যদি না তা অবিলম্বে পাকিস্তানের জঘন্য ও অমানবিক বর্বরতার জবাব দিতে ভারত সরকার অনীহা প্রকাশ করে, তারা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীরও সমালােচনা শুরু করেন। এ সময় “আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, কম্পাস, নিউ এজ, কালান্তর, যুগান্তর, দি স্টেটসম্যান, ফ্রন্টিয়ার, হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান স্টান্ডার্ড, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ ইত্যাদির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই সব পত্রিকা প্রতিদিন বিভিন্ন শিরােনামে, সম্পাদকীয়তে ও প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধের কলমসৈনিক হিসেবে যুদ্ধারত ছিল। প্রতিনিয়ত গণআকাক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে গণমাধ্যমগুলাে রণাঙ্গনের কর্মকাণ্ড প্রচারের ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে তা অবিস্মরণীয়। এ প্রসঙ্গে আকাশবাণীর ভূমিকা সেদিন যুদ্ধরত প্রতিটি মানুষকে করেছিল অনুপ্রাণিত। সরকারনিয়ন্ত্রিত মাধ্যম হলেও আকাশবাণী জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করেছে, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছে, সংগীতে, কবিতায়, কথিকায় ও সুরের মুছনায় এমন একটি আবহ তৈরি করেছে যার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। | বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে সবাই একমত, তবু সরকার নীরব কেন?’ সমর গুহ, এমপি’র একটি লিখিত প্রবন্ধে এ প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। প্রবন্ধের এক অংশে বলেন, নীতিগতভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের বিরােধী নন ভারত সরকার। তবে, ভারত সরকার মনে করেন যে, এখন স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের পক্ষে সহায়ক হবে না, ক্ষতি করা হবে। অর্থাৎ সরকারি ভাষায়, “হেল্পফুল হবে না, হার্মফুল হবে।” এদিকে বাংলাদেশের সরকার এবং সকল রাজনৈতিক জাতীয় দল বারবার বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আবেদন জানিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে কোনটা স্বার্থসম্মত এবং কোনাে কাজ ক্ষতিকর সেই বিচারের প্রধান যােগ্যতা এবং অধিকার যে বাংলাদেশের সরকারের, এই মূল কথাটি স্বীকার করে নিয়ে ভারত সরকারের বরং স্পষ্ট করে বলা উচিত যে, ভারতের স্বার্থে ভারত সরকারের পক্ষে এখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়-যদিও, ভারতীয় জনমত মনে করে যে, বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতি দেওয়াই ভারতের পক্ষে স্বার্থসম্মত।

| ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সম্বন্ধে বলেছেন, রাইট টাইমে রাইট ডিসিশন’ নেওয়া হবে। এই সঠিক সিদ্ধান্তের ঠিক সময়টি কখন আসবে? ঠিক সময় ও ঠিক সিদ্ধান্তের নিয়ামক বা নির্ণায়ক অথবা পারিপার্শ্বিকতার সূচকই বা কি?
ছ, নানামুখী চাপঃ ২৫শে মে, রাজ্যসভার অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংহ বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। ১৮ই জুন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রসঙ্গে লােকসভায় বিরােধীদলের সদস্যরা জোর দাবি করেন। লােকসভায় বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করে বিশ্ব-সমর্থন আদায়ের জন্য সরকারকে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে বলা হয়। ২রা জুলাই, লােকসভার অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে সকল দলের সদস্যরা ব্যাপক আলােচনা করেন। অধিকাংশ সদস্য স্বীকৃতির প্রশ্নে সরকারের গড়িমসির কড়া সমালােচনা করেন। ২১শে জুলাই (৬২৭-৬২৮) ৩১শে জুলাই, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে রাজ্যসভায় একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং তার ওপর ব্যাপক আলােচনা হয়। 
৯ই আগস্ট। মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল সরকারের। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার ফলে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন উত্থাপন করে। এমনকি কতিপয় রাজনৈতিক দল বিশেষকরে বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে সত্যাগ্রহ করার শ্লোগান দিচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কখনাে বলিনি যে, বাংলাদেশকে আমরা স্বীকৃতি দেব না। কিন্তু সবদিক বিবেচনা করেই বাংলাদেশ সমস্যা সমাধান ও আমাদের জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি করেই আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যেই শুধু সাহসিকতা প্রদর্শিত হয় , কিন্তু আমাদের বিবেচনা করতে হচ্ছে, ভারতের কোটি কোটি মানুষ ও বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের কথা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া গেটে আয়ােজিত এক বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এই সভার অন্যতম একটি লক্ষ্য হলাে সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দেয়া ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ এবং সরকারের পেছনে তারা শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যেকোনাে ত্যাগ স্বীকারে তারা প্রস্তুত। আমাদের এই শক্তি বাংলাদেশের জনগণকে প্রেরণা দিবে এবং বিশ্ব দেখতে পাবে ভারত ও ভারত সরকার দুর্বল নয় এবং যেকোনাে হুমকির মােকাবেলায় আমরা
প্রস্তুত।
২. বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের ভূমিকা ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁদের আন্তরিক সহযােগিতা, সহানুভূতি এবং সক্রিয় সমর্থন দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করেন। তবে ভারতের রাজনৈতিক দল, সংগঠন বা গণআকাক্ষা এবং প্রতিক্রিয়া একই সমান্তরাল শক্তিতে ও ব্যাপকতায় প্রকাশিত হয়নি।
ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বিভিন্ন সময়ে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে তার সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলাের নীতিগত বিরােধীতা ছিল না, ছিল মাত্রাগত। কারণ বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত সরকার বিভিন্ন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলাের কর্মকাণ্ড ও দাবি-দাওয়ার দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড পর্যালােচনার জন্য ১৯৭১ সালে লােকসভায় প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলসমূহ যে মতামত প্রদান করেন তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অধিক মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে জাতিগত সম্মান, মর্যাদা ও বীরত্ব প্রকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করেছে। সেই বিবেচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন তাদের দলীয় অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধে তাদের করণীয় নির্ধারণ করেছে।
একাত্তরে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের বিরােধী রাজনৈতিকদলগুলাের বক্তৃতা, বিবৃতি, সভা-সমাবেশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ইস্যু’ আধিপত্য বিস্তার করে। ভারতের সব বিরােধী দল স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে বারবার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। সরকারি দল কংগ্রেসও বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে। ভারত সরকার বরাবরই বলেছে যে, তাদের বিবেচনায় ‘উপযুক্ত সময়ে স্বীকৃতি প্রদান করবে। বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা। গান্ধীর কাছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ৭ই মে, ১৯৭১ এক স্বারকলিপি প্রদান করে ‘বিলম্ব হলে সংগ্রামরত বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদেরই শুধু যে বিপদগ্রস্ত করা হবে তাই নয় ভারতেরও মারাত্মক ক্ষতি করা হবে।’ সংসদের বিরােধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে ৭ই মে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়ে দীর্ঘ আলােচনা করেন। বিরােধী নেতাদের স্বীকৃতিদানের দাবির জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, স্বীকৃতি বিষয়ে ভারতের বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলাের সঙ্গে আলােচনা করা হয়েছে তবে বর্তমান অবস্থায় কোনাে রাষ্ট্রই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পক্ষপাতী নয়। তিনি বলেন, এখনই স্বীকৃতি না দিলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সার্বিক সহায়তা দেবে ভারত। মুসলিম লীগ ও বিকানীর মহারাজা করণ সিং ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি, ডিএমকে, সিপিএম, পিএসসি, আরএসপি ও জনসংঘের নেতারা স্বীকৃতিদানের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ৮ই মে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভা ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন’ শিরােনামে সর্বসম্মতিক্রমে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদের আহ্বানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সার্বিক সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে সারা ভারতব্যাপী ১৫ই মে বাংলাদেশ দিবস’ পালন করা হয়। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে কলকাতায় অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে কমিউনিস্ট নেতা অধ্যাপক হীরেন্দ্র নাথ মুখােপাধ্যায় বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে পূর্ণ স্বীকৃতি না দিলে সার্বিক সাহায্য দেওয়া সম্ভব নয়।” রাজ্যসভায় বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে বিরােধীদলীয় নেতাদের বক্তব্যের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারি অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন যে, “জাতিসংঘ যাকে একটি দেশ বলে স্বীকার করে সে দেশের একটি অংশকে স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে খুব সতর্কতা প্রয়ােজন। এটাও বিবেচনা করতে হবে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কারণ তাদের সঙ্গে রয়েছে আমাদের দীর্ঘ সীমান্ত। এ ধরনের ইস্যুর ক্ষেত্রে একজন আবেগপ্রবণ হয়ে যেতে পারেন যদিও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়গুলােকে হালকাভাবে একপাশে রেখে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশ সম্পর্কে আট ঘন্টার লােকসভা বিতর্কের জবাব দানকালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্নটি প্রতিনিয়ত ভেবে দেখছি। এ ব্যাপারে বা অন্য বিষয়ে আমরা যে সিদ্ধান্তগ্রহণ করি না কেন তা স্বাধীনভাবেই বিচার বিবেচনা করে গ্রহণ করবাে। আমাদের বৃহত্তর স্বার্থের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবাে।” মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরাে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে কেন্দ্রের বিলম্বের সমালােচনা করে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। বলা হয়, “অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতিদানসহ সব ধরনের বস্তুগত সহায়তা প্রদানের ব্যর্থতার ফলে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এবং এর ফলে বাংলাদেশের পাঁচ মিলিয়নের অধিক লােক ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।” ২রা জুলাই সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানান। এমনকি এর ফলে যদি পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের জন্ম হয় তবুও তাঁর মতে, অন্য দেশের মনােভাব জানার অপেক্ষায় না থেকে ভারতের উচিত এ বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়া।
সিমলায় অনুষ্ঠিত সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ এই নয় যে, যেমন অন্যরা বলে থাকেন ভারত বাংলাদেশ প্রশ্নে আপােষ করছে; সেক্ষেত্রে স্পষ্ট করে সমালােচকদের বলা উচিত বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পাকিস্তান সামরিক জান্তার সঙ্গে যে মীমাংসায় উপনীত হবেন আমরা তাই বুঝাতে চাচ্ছি। এই সমাধানের ভিত্তি হবে স্বাধীনতা বা বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন যা বাংলাদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট গ্রহণযােগ্য হতে হবে। | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং সামগ্রিক বিচারে ইতিবাচক। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের। পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যময় ইস্যু দেখা দেয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না রাজনৈতিক দলগুলাে স্ব-স্ব আদর্শ-কর্মসূচি ও লাভ-ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাদের করণীয় স্থির করেছে। দক্ষিণপন্থি দলগুলাের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সাতচল্লিশ, পূর্ব ভারতে ফিরে যাবার পথে প্রথম সােপান। অন্যদিকে, বামপন্থিদলগুলাে বাংলাদেশ সমস্যাকে বিবেচনা করেছে বাঙালির ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ হিসেবে। একাত্তরের মাঝামাঝি ভারতের রাজনীতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। ভারতের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনেও মুক্তিযুদ্ধের ইস্যু জনমত প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে কারণে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত ইস্যু অগ্রাধিকার পায়। বলা যায়, রাজনৈতিক দলগুলাের দাবি-দাওয়া; মতামতের আলােকেই ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে করণীয় স্থির করেছে। | ক, রাজনৈতিক দলগুলাের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতপার্থক্য: পূর্ববঙ্গের জনগণের দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ আর আদর্শিক প্রেরণা বামদল ও উদারনৈতিক রাজনৈতিক দলগুলাের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কের আলােকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিবেচনা করেনি বরং জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পর্যায় পর্যন্ত দৃষ্টিবদ্ধ করেছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রাজেশ্বর রাও আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বালুর ঘাট কুরমাইল ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। এই ক্যাম্পে অবস্থিত প্রশিক্ষণার্থীদের সামনে যে বক্তব্য পেশ করেন তার। সােজাসাপটা অর্থ ছিল বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে তার দল মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন প্রদান করছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ করে সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যে শান্তি, সৌহাদ্য ও বন্ধুত্বমূলক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বক্তৃতায় তিনি দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেন যে, “সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যতই কৌশল গ্রহণ করুক না কেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।” এই লক্ষ্যে তিনি অবিলম্বে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। প্রজা সােস্যালিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘জনতা’য় দলীয় অবস্থান সম্পর্কে লেখা হয় যে, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাসহ মৌলিক আদর্শগত বিষয়ে আওয়ামী লীগ এবং ভারত নীতিগতভাবে ঐক্যমত থাকায় ভারতীয় জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সীয়) দৃষ্টিতে বাংলাদেশ আন্দোলন পাকিস্তানের দু’অংশের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ছিল না, বরং এটা ক্ষুদ্র শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জনতার ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রাম যা পাকিস্তানের উভয় অংশ এবং ভারতের জনসাধারণের সমর্থন করা উচিত। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের মধ্যে নীতিগত অবস্থানের দিক থেকে আদর্শগত সাদৃশ্য, বিশেষত গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বারবার উল্লিখিত হয়। নীতিগত প্রশ্নে ভারতের শাসক দল কংগ্রেস এবং ভারত সরকারের মধ্যে। মতানৈক্য না থাকায় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে বাংলাদেশকে জোরগলায় সমর্থন প্রদান সহজ হয়ে যায়। যদিও লােকসভায় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিতর্কে শাসকদলের অনেক সদস্য সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

তবে সামগ্রিক বিচারে কংগ্রেস এবং ভারত সরকারের নীতি ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্ত েিব বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সর্বাত্মক সংহতি প্রকাশ করে। তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে করণীয় যা কিছু করবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে সামগ্রিক বিচারে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলাের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। অর্থাৎ বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছিলাে। তবে রাজনৈতিক দলগুলাে দলীয় আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে তাদের করণীয় স্থির করেছে। যে কারণে দক্ষিণপন্থি দলের সঙ্গে বামপন্থি দলের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। শাসকগােষ্ঠীর গৃহীত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের সঙ্গে ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করলেও তাদের মূল সূত্র ও লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন।

৭ই মে সকালে বিরােধী নেতাদের সঙ্গে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ নিয়ে আলােচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বৈঠকে বসেন। প্রায় সকল নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। বিকানীরের মহারাজা ড. করণ সিং এবং মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ ইসমাইল দুজনের বক্তব্যে অবশ্য কিছু পার্থক্য ছিল। অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবির বিরােধীতা করেন বিকানীরের মহারাজা ড, করণ সিং। তিনি লােকসভায় কয়েকটি ছােটো গ্রুপ ও কয়েকজন নির্দল সদস্যের নেতা। সেই গ্রুপ ও ব্যক্তিরা আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। ড. করণ সিং-এর বক্তব্যের মূল কথা ছিল, বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে বাঙালিদের বিদ্রোহ। ভারতের এ ধরনের ব্যাপার ঘটলে সরকার কি করতেন?

কাশ্মীরের কথাও ভাবা দরকার। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার জবাবে এ কথা বলেন। যে, কাশ্মীরে যারা হাঙ্গামা করতে চায় তারা জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের পেছনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিমত ও অভিপ্রায়কে পাকিস্তান অস্ত্র দ্বারা দাবিয়ে রাখতে চাইছে। মুসলিম লীগ নেতা মুহম্মদ ইসমাইলের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হলাে, এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় বা কোনাে সংকট গুরুতর হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে ঐ ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে। তবে সরকার এ ব্যাপারে যে কোনাে ব্যবস্থাই নিন না কেন তার প্রতি তাদের দলের সমর্থন থাকবে। মুসলিম লীগ ব্যতীত রাজা গােপালাচারির স্বতন্ত্র পার্টি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধীতা করেন এবং ভারত-পাকিস্তান স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করার পক্ষে মতামত পেশ করেন। এই অবস্থানের প্রধান কারণ হলাে সম্ভাব্য চৈনিক হস্তক্ষেপের ভীতি। তাছাড়া শরণার্থীর ভরণপােষণ যুদ্ধের চেয়ে কম ব্যয়বহুল এই যুক্তিতে ভারতের যুদ্ধে জড়িয়ে পরাকে স্বতন্ত্র পার্টি সমর্থন করে না। বরং যুদ্ধের কারণে ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাবার আশঙ্কা যেমন প্রবল, তেমনি পশ্চিমা সরকারগুলাের কাছ থেকে পাকিস্তানের সাহায্য প্রাপ্তির সম্ভবনাও বৃদ্ধি পাবে। উপরন্ত মুক্তিযুদ্ধে বিপুল শরণার্থীর আগমন ও ভারতের সক্রিয় ভূমিকা ভারতের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সঞ্চার করতে পারে। “The Hindu-Muslim relations within the country might also become strained if India became deeply involved in the Bangladesh problem.”৮৬ স্বতন্ত্র পাটি মুক্তিযুদ্ধকে হিন্দু-মুসলিম। সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে যেমন দেখেছে তেমনি চীনের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের বিষয়ও বিবেচনা করেছে। শেষপর্যন্ত দলীয় অবস্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে নিজের স্বার্থে ভারতের নিরপেক্ষ থাকা বাঞ্চনীয়। আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চিন্তাধারা স্পষ্টত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম ভাগ পর্যালােচনায় একথাটি বেরিয়ে আসবে যে, মূলধারার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যমত্য পােষণ করলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন ভিন্ন। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও ডানপন্থি দলগুলাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে মূল্যায়ন করেছে অখণ্ড ভারতের স্বপ্নকে সামনে রেখে। জনসংঘ, উগ্রপন্থি দলগুলাে, স্বতন্ত্র ও হিন্দু মহাসভার তৎপরতা সে রকমই সাক্ষ্য দেয়। তবে সকল রাজনৈতিক সংগঠন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা হিসেবে গ্রহণ। করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। এই দক্ষিণপন্থি দলগুলাের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক কোনাে গুরুত্ব ছিল না। মুসলিম লীগ এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে বিশেষকরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক। এমনকি অধিকাংশ মুসলিম জনগােষ্ঠী পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি।
এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, “বাংলাদেশের ব্যাপারকে কেন্দ্র করে কিছু লােক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছে। সকলকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। অধিকাংশ বিরােধী নেতা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য জোর দাবি জানান। পরিস্থিতি সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্লেষণ তারা মেনে নেননি। তারা বলেন যে, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। স্বীকৃতি দিয়ে সরকার শুধু সেই সত্যটিকে মেনে নেবেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধ। জোরদার হবে। ভারত এ বিষয়ে বিলম্ব করলে ভারতেরই ক্ষতি হতে পারে। এই দাবি জানান, সি পিএম; সিপিআই; ডি এম কে আদি কংগ্রেস; পি,এস,এস; পি.এস.পি; ফরােয়ার্ড ব্লক ও আর এস পি । সি পি আই-এর সদস্য ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে যে স্মারকলিপি দেন সেখানে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবি ছিল অন্যতম। সি পি এম-এর সদস্য এ কে গােপালন স্পষ্ট করে বলেন যে, পাকিস্তানকে ভয় না করে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের সব রকমের সাহায্য দেয়া উচিত। ডি এম কে-এর কে, মনোেহারণ, জনসংঘ-এর অটলবিহারী বাজপেয়ী, ফরােয়ার্ড ব্লক-এর চিত্ত বসু, আর এসপি-এর ত্রিদিব চৌধুরী, পিএসপি-এর এন জি গােরে ও আদি কংগ্রেসের এস এন মিশ্র একইভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন। | শ্রীমতী গান্ধীর প্রাথমিক এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দান এবং মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণভাবে সামরিক সহায়তা প্রদান।” কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং প্রধানমন্ত্রীর এই মনােভাবের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে ভিন্নভাবে তাকে পরামর্শ দেন যে, এই মুহুর্তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রবল বিরােধীতার সম্মুখীন হতে হবে এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অভিযােগ এবং প্রতিবেশী দেশের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্য একতরফাভাবে ভারতকে দায়ী হতে হবে। ডি.পি.ধর, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সমর্থন করে অবিলম্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মতামত দেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এবং সেনাপ্রধানদের সঙ্গে আলােচনার পর অবিলম্বে সামরিক অভিযান থেকে প্রধানমন্ত্রী বিরত থাকেন এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। এই উপলক্ষে বিরােধীদলের বৈঠক আহ্বান করেন। সভায় সকলের কথা শােনার পর প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার মর্মার্থ হলাে, বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি ভারত পূর্ণ সমর্থন জানাবে। কিন্তু বাংলাদেশকে এখনই কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া ঐ দেশেরই স্বার্থের পরিপন্থি হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি প্রচুর সহানুভূতি থাকলেও স্বীকৃতির ব্যাপারে সক্রিয় ভাবনার পর্যায় অতিক্রম করেনি। এ সময় চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করবে না। এমনকি এ প্রচারও চালানাে হচ্ছিলাে যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যে সরকার গঠিত হয়েছে তারা মুক্তিযুদ্ধকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারবে না। এই সময় এমন পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল, প্রতিরােধ যুদ্ধের উন্মাদনা হ্রাস পেয়েছে ও নতুন উদ্যোমে মুক্তিযুদ্ধ নব শক্তিতে উজ্জীবিত হচ্ছে তার কোনাে ক্রিয়া-কারন দৃশ্যমান ছিল না। প্রচার করা হচ্ছিলাে তাজউদ্দীন সরকার ক্ষমতাসীন থাকলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হবে এবং ভারত কোনােভাবেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে না। ভারত সরকার থেকে মুজিবনগর সরকারকে তখন পর্যন্ত অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও সামরিক সাহায্যের ব্যাপারে কোনাে প্রকার নির্দেশ দিয়েছে কিনা জানা যায়নি। অবশ্য এই গুজবের তেমন কোনাে ভিত্তি ছিল না এই কারণে যে, মে মাস থেকেই লক্ষণীয় হয় যে, ভারত সরকার মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদান ভারতীয় সামরিক বাহিনীর উপর ন্যস্ত করে। যদিও প্রথমদিকে স্পষ্টভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “কোন অবস্থাতেই ভারত ভীত নয়।” পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে নানা উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে এবং ভারতকে নানাভাবে সরাসরি বাংলাদেশের ব্যাপারে জড়াতে চাচ্ছে। কিন্তু ভারত যা ঠিক মনে করবে, তা করতে ভীত নয়। ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন যে, “বাংলাদেশে আগে দুই ডিভিশন পাকিস্তান ফৌজ ছিল। এখন আছে চার ডিভিশন। শহরগুলির অধিকাংশ পাকফৌজের দখলে আছে। গ্রামাঞ্চলের বহু এলাকাই এখনও মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে।

গেরিলা তৎপরতা চালিয়ে তারা পাকিস্তানফৌজের আক্রমণকে সাফল্যের সঙ্গে মােকাবিলা করছেন।” বাংলাদেশ স্বীকৃতির প্রশ্নে বিভিন্ন গণমাধ্যমে, পত্রিকায় ও সম্পাদকীয়তে বিভিন্ন ধরনের মতামত প্রকাশিত হয়। একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “সেই পুরাতন স্বীকৃতির প্রশ্নটা মাঝে মাঝে চকিতে আশার রেখা দেখিয়ে যেন মরীচিকার মতাে মিলে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারে উপর চাপ প্রবল, প্রায় সমস্ত বিরােধী দল একবাক্যে বলছেন, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিন।’ এই দাবি নানা রাজনৈতিক দলের কণ্ঠে, এমনকি একাধিক রাজ্যের বিধানসভাতেও ধ্বনিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় সর্বসম্মত প্রস্তাবটি নানা দিক হতে ঐতিহাসিক। এর মর্মবস্তু বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি সৌভ্রাতৃত্বের নিদর্শন, সেই সঙ্গে উচ্চরিত হয়েছে। আন্তরিক সমর্থন। স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশের এই সংকটে তার কী প্রত্যাশা এবং কী প্রয়ােজন। বলিষ্ঠ ভাষায় বলা হয়েছে, গেরিলাদের অস্ত্র জোগান দিতে হবে। মুক্তি আন্দোলনের প্রতি ভারত পূর্ণ সমর্থন জানাবে, অথচ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেবে না, পরস্পরবিরােধী এই পদক্ষেপ ভারতকে দুর্বল করবে। প্রশ্ন করেছে কেন্দ্রের নিকট স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা আর কতকাল?

লােকসভার সদস্য অধ্যাপক সমর গুহ লিখিতভাবে যা বলেছেন যে, “একথা আজ সুস্পষ্ট যে রুশ-মার্কিন, ব্রিটেন বা ফ্রান্স পাকিস্তানের বিখণ্ডন চায় না, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় এই রাষ্ট্রগুলাের উদগ্রীব।” এ কথার অর্থ দাড়ায় ভারত বাংলাদেশ। সংকটকে নিয়ে একাকী হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কখনাে বিচ্ছিন্নতাবাদ বা কখনাে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে পাশ। কাটিয়ে যাচ্ছে। এমনকি শতাব্দির ভয়াবহ ট্রাজেডি যেখানে দৃশ্যমান, সেক্ষেত্রে কোনাে দেশই তা জাতিসংঘে উত্থাপন করেনি। যেভাবে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে তাতে প্রতীয়মান হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষার দায়িত্ব যেন তারাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তাদের কূট তৎপরতায় একটি কথায় বেরিয়ে এসেছে যে, বাংলাদেশের জন্য অধিকতর স্বায়ত্তশাসন যেন জন-আকাঙক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। রাজনৈতিক সমাধান বলতে সেসব বৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় বাংলাদেশের ‘শিথিল স্বাধীনতা’কে এভাবে দেখতে চায়। এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি শিথিল কনফেডারেশন গঠন করে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করা। এর প্রতিকূলে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ভারত স্বীকতি না দিলে অন্য রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসার কারন নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে সকল শর্তই পূরণ করে এবং যােগ্যতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের নিজস্ব নাম, স্বাধীন পতাকা, জাতীয় সংগীত, ভাষা-সংস্কৃতি ও নিজস্ব ভূখণ্ড রয়েছে। একটি নির্বাচিত আইনানুগ সরকার। মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করছেন। রাষ্ট্রীয় কাঠামাে, প্রশাসন ব্যবস্থা, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন কার্যক্রম, নিজস্ব সামরিক ও পুলিশ বাহিনী বিদ্যমান। নিজস্ব অর্থে বাজেট পরিচালিত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রকার্য সম্পাদিত হচ্ছে। এমন অবস্থায় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী নৈতিক দায়িত্ব। ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পক্ষে বিশেষ কোনাে যুক্তিযুক্ত বাধা নেই। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির অধিবেশনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানে কেন্দ্রের বিলম্বের সমালােচনা করা হয়। সমালােচনার সারসংক্ষেপ হলাে, মুজিবনগর সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান না করা, বস্তুগত সাহায্য না করায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ভয়ানক ক্ষগ্রিস্ত হচ্ছে এবং ৫০ লক্ষ শরণার্থী ভারতে আগমন করার ফলে ভারতে বিশেষকরে সীমান্ত রাজ্যগুলােতে ব্যাপক অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। এ সবই হচ্ছে ভারত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার ফলশ্রুতি। বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিম অঙ্গরাজ্য পরিষদ ১৬ ও ১৭ই জুন দু’দিনব্যাপী অধিবেশনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানায়। একইসাথে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র ও সামরিক শিক্ষাসহ সর্বপ্রকার সাহায্য দেওয়ার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রস্তাব গ্রহণ করে। কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য পরিষদ মনে করে, বাংলাদেশের এই সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখাতে হবে। রাজ্য পরিষদ বাংলাদেশের শরণার্থী গ্রহণের বিষয়ে উড়িষ্যা সরকারের মনােভাব এবং মেঘালয়ে দাঙ্গার বিষয়ে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একটি জাতীয় সংহতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন এবং সীমান্ত রাজ্যগুলির স্কন্ধভার ভাগ করে নেওয়ার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে সকল রাজ্যগুলিকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্ৰীসমূহের সম্মেলন আহ্বানের জন্য পার্টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এর কারণস্বরূপ বলা হয়েছে যে, যদি বাংলাদেশের সংগ্রাম ব্যর্থ হয় তাহলে ভারতের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়ার জোয়ারে ভেসে যাবে।
খ. মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে: ভিন্ন পথের দিশারি: বাংলাদেশের স্বাধীনতা দীর্ঘস্থায়ী করার রাজনৈতিক কৌশলে ভারতের সােশ্যলিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। গ্রামে গ্রামে মুক্তিবাহিনী দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ তরুণ যুবকের হাতে অস্ত্র চলে যাচ্ছে। নতুন নেতৃত্ব তৈরির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয় না। মুক্তিফৌজের যে সমস্ত নেতারা হাতে হাতিয়ার নিয়ে লড়াই করছেন তাঁদের সম্পর্কে বলা হয়, তারা নতুন নেতৃত্বের প্রতি তেমনটি আস্থাশীল নন। অল্প কিছুদিন পূর্বে জাতীয় আওয়ামী পার্টির মওলানা ভাসানী এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, অন্য বামপন্থি দলগুলি গ্রামে গ্রামে সর্বদলীয় কর্ম। পরিষদ গড়ছে। উদ্দেশ্য হলাে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য গণপ্রস্তুতি। | তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হলে কী নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব হবে ? উত্তরে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন, বাঘ কখনও মানুষের রক্তের স্বাদ ভুলতে পারে না। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ১৩ লক্ষ। হাতে হাতিয়ার পেলে মানুষের চাল-চলন, ধ্যান-ধারণা ও আচার-ব্যবহার সবই বদলে যায়। অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদের জাতীয় আওয়ামী পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পাটি (মস্কোপন্থি) ও অন্য কমিউনিস্ট গােষ্ঠী (যারা এককালে মাও নীতি ঘেঁসা ছিল) এসমস্ত দলের নেতাদের ধারনা বিপ্লব কষ্টসাধ্য ও দীর্ঘায়িত হবে। এর জন্য প্রয়ােজন সশস্ত্র মােকাবেলার উপযুক্ত রণকৌশল ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জনগণের রাজনৈতিক প্রতিরােধের কার্যক্রম। বৈপ্লবিক দলগুলির মধ্যে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি যার নেতা মতিন-আলাউদ্দিন ও কমিউনিস্ট গ্রুপ যার নেতা কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেনন। তৃতীয়টি হলাে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এম.এল.) এর নেতা মুহম্মদ তােয়াহা। এ দলটি পিকিংপস্থির কাছ ঘেঁষেই চলে। বর্তমান বিপ্লব সম্পর্কে এদের নীতি দ্বিধাগ্রস্ত ও অস্পষ্ট। পাকিস্তানি জঙ্গি বাহিনীর হাতে এদের মার খেতে হয়েছে। সােশালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির চতুর্থ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ভারত শাখার সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতে প্রথমে যে স্বস্তিবোেধ ছিল তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের অমানবিক আচরণে ভারতবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যাকে দেখতে চেয়েছেন। কিছু লােক হিন্দু সাম্প্রদায়িক মনােভাব নিয়ে বাংলাদেশকে বিচার করেছে। পুজিবাদীরা দেখেছে বাজার সম্প্রসারণ ক্ষেত্র হিসেবে। বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী হলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে বাংলাদেশের ঘটনাবলি মোেড় নিবে। কেননা, বাংলাদেশের বিপ্লব এক অভূতপূর্ব গণতান্ত্রিক বিপ্লব। “চীন বিপ্লবের পর এটাই এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যদি এই বিপ্লবকে সফল করতে হয় তবে একে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত করতে হবে। আর সেকাজের নেতা হবে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি।”৯০
২৯শে জুন কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির এক সভায় লােকসভার সদস্যদের মধ্যে অনেকেই প্রশ্ন তুলেন যে, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত তেমন কার্যকর কিছু করতে পারছে। না, যা নৈরাশ্যজনক। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এর জবাবে বলেন, ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা ভারতের নিরাপত্তা ও আর্থিক সক্ষমতার প্রশ্নটি বিশ্বের রাষ্ট্রগুলাে বুঝতে সক্ষম হয়েছে । নৈরাশ্যজনক ছবি উপস্থাপনের কোনাে কারণ নেই। তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে কোনাে হটকারী নীতি নয়, এরকম একটি সূক্ষ্ম সমস্যায় কোনো সরকারই অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না।  গ, আওয়ামী নেতৃত্বের মূল্যায়ন: ১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। গৃহীত হয় স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক, তার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, এম, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান ও খন্দকার মােশতাককে (পরে মন্ত্রীত্ব অকেজো করে রাখা হয়) নিয়ে ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল তারা মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করেন। নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ২৪শে এপ্রিল স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতি বরাবর পত্র প্রেরণ করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরাবর বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবং দুটি ভ্রাতৃপ্রতীম স্বাধীন দেশের। মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য দুটি পত্র প্রেরণ করা হয়। ভারতের বামদল, তার অনুসারী নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং কতিপয় সংবাদপত্র এ বিষয়ে একমত যে, আওয়ামী লীগ মধ্যপন্থি জাতীয়তাবাদী দল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত গেরিলা যুদ্ধে রূপান্তরিত হলে বর্তমানে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্বের যােগ্য ভূমিকা পালন করতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্বের প্রধান উৎস হলাে বৈপ্লবিক রাজনৈতিক মানসিকতা। আওয়ামী লীগ বৈপ্লবিক দল হিসেবে নিজেদের রূপান্তরিত করতে পারবে কিনা এই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। আওয়ামী লীগের মানসিক গঠন ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ অনুপস্থিত। একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বা গণ-ম্যান্ডেটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হওয়া এক কথা; কিন্তু রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে রণনীতি ও রণকৌশল গ্রহণ করে দীর্ঘস্থায়ী একটি বৈপ্লবিক গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা অবশ্যই কঠিন ও ভিন্ন বিষয়। সে অবস্থায় পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে বাম বৈপ্লবিক দলগুলাে বর্তমান বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে সমান্তরালভাবে যুদ্ধ পরিচালনার দীর্ঘস্থায়ী সুযােগ পেলে বর্তমান নেতৃত্ব পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠবে।
যদিও এসব বিষয় বিবেচনা করেই ভারত সরকার বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি তরুণ নেতৃত্ব নিয়ে একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তােলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত।”” কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান প্রথাবদ্ধ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে এইসব বৈপ্লবিক চেতনা সম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জন আরাে জটিল হয়ে পড়বে। সে কারণে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমরবিদ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে পরিচালিত ন্যায়সঙ্গত মুক্তিযুদ্ধকে সার্বিকভাবে আশু সাহায্য ও সহযােগিতা করার অপরিহার্যতাকে তুলে ধরেছেন এবং একইসাথে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে অভিমত প্রদান। করেন। সরকারি দল হিসেবে কংগ্রেসের ভূমিকা সূচনালগ্নে ছিল অনেকটা সতর্কমূলক এবং রক্ষণশীল। অন্যদিকে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং উৎসাহব্যঞ্জক। বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় জনগণের তাৎক্ষণিক সমর্থন ও সক্রিয় সহানুভূতি অধিকাংশ ভারতীয় রাজনৈতিক দলের নীতি ও কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়েছে। বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে বিশেষভাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সীয়), সােশ্যলিস্ট পার্টি, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এবং জনসংঘ সরকারের কাছে দাবি জানায় বাংলাদেশকে কার্যকর সাহায্য প্রদানের জন্য, যাতে করে বাংলাদেশের মানুষ তাদের সংগ্রামে সফল হয়। রাজনৈতিক দলগুলাের মূলদাবি ছিল বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্র প্রদান করা নতুবা কাগুজে সহানুভূতির বাণী মুক্তিযােদ্ধাদের সংগ্রামকে শেষপর্যন্ত ব্যর্থ করে দেবে। মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময়টাই রাজনৈতিকদলগুলাে বাংলাদেশ বিষয়ক বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারিনীতির সমালােচনায় মুখর ছিল, এর ফলে বাংলাদেশ সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জনমত প্রভাবিত করার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়।” এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল তা ভারত সরকারের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার শেষপর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে পারবে কিনা এ সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। মার্কিন প্রশাসনকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে স্থিত একটি শক্তিশালী লবি এই মর্মে বার্তা পাঠিয়েছিল বর্তমান নেতৃত্ব দ্বারা বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, তাদের উপর জনপ্রতিনিধিদের আস্থা নেই। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে তা বামপন্থিদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের যােগাযােগ মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে গােপনীয়ভাবে অব্যাহত ছিল। সিআইএ’র মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে সি.আই.এ’র নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত, তিনি এবং জহিরুল কাইয়ুম এর মাধ্যমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদকে দিয়ে স্বাধীনতার চেয়ে কম অর্থাৎ কনফেডারেশন গঠনের ফর্মুলায় সম্মত করাতে সচেষ্ট ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতা চাও-না বঙ্গবন্ধুকে চাও’-এই স্লোগান ও লিফলেট দিয়ে স্বাধীনতার মূলশক্তি মুজিবপন্থিদের বিভক্ত করে স্বাধীনতার মূলে কুঠারাঘাত করার সি.আই.এ’র কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই ঘটনা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নজরে এলে খন্দকার মােশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে অবসর না দিলেও তার ভূমিকা ও কর্তৃত্বকে খর্ব করা হয়। মাহবুব আলম চাষীকে সচিব পদ হতে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারকে মুজিবনগর সরকারের উপর জনপ্রতিনিধিদের আস্থা আছে কি না তা যাচাই করে নেওয়া ছিল অবধারিত এক সংশয় মুক্ত উপায়।
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদের অভ্যন্তরে নড়বড়ে অবস্থা- সেনাকাঠামােয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের পদক্ষেপ এবং আওয়ামী নেতৃত্বের উপদলীয় কোন্দল, বাঙালি সশস্ত্র কতিপয় সদস্যের পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন ও আত্মসমর্পণ ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করে। প্রশাসনিক সূত্রে দিল্লিতে এ খবরও আসছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান হতে ১৯৭০ এর নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। ভারত সরকারের নিকট এমনও প্রমাণ ছিল যে, সামরিক বাহিনীর, এমনকি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কিছু সদস্য পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী। কনফেডারেশন। গঠনের কূটনৈতিক তৎপরতা তখনও অব্যাহত ছিল। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলাদেশের সরকারকে কার্যকর সামরিক ও রাজনৈতিক সাহায্য ‘প্রদানের ক্ষেত্রে ভারতকে সবদিক নতুন করে ঝালাই করে নিতে হয়। ২০শে জুন। ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের যুগ্মসচিব অশােক রায় যতদূর সম্ভব শীঘ্র’ বাংলাদেশের নির্বাচিত এম.এন,এও এম.পি, দের যৌথ বৈঠক আহ্বানের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদকে অনুরােধ করেন।
এই অধিবেশন ৫ ও ৬ই জুলাই শিলিগুড়ির বাগডােগরাতে অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রী পরিষদে অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিভিন্ন উপদলীয় কোন্দল এবং পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এই বৈঠক ছিল নানাদিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। যে সকল গণপ্রতিনিধিবৃন্দ বিভিন্ন সেক্টরে প্রত্যক্ষ রণাঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের কাছে কলকাতার তথাকথিত কোন্দল ও চক্রান্ত তেমন কোনাে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। সেদিন অত্যন্ত জোরালােভাবেই গণপরিষদ সদস্যগণ বাংলাদেশ সরকার, পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সশস্ত্র যুদ্ধ ত্বরান্বিত করার উপর গুরুত্ব আরােপ করে সম্মিলিত ও ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বৈঠকটির তাৎপর্য ছিল সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্যম ও প্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার অঙ্গীকারদৃপ্ত শপথ। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম দৃপ্ত কণ্ঠে ঘােষণা করেছিলেন, ডিসেম্বরের ভিতরে দেশ স্বাধীন না হলে আপনারা নতুন নেতা নির্বাচন করবেন। বাংলাদেশের আশু স্বীকৃতি ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিরােধীদের দাবির প্রেক্ষিতে বলেন, ভারতের মিত্রদের বিশেষকরে সােভিয়েত রাশিয়ার অভিমত হলাে, অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া সমীচীন হবে না। যদিও ভারতের জনগণ এবং জনমত এখনই স্বীকৃতি দেবার পক্ষে। এই গুরুতর বিষয়টি নিয়ে আবেগ তাড়িত না। 
 
হয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশে ও জনমতকে পক্ষে আনতে হবে।১০০
দ্বিতীয় পর্ব এ পর্যন্ত আলােচনায় অভ্যন্তরীণভাবে কূটনৈতিক ক্ষেত্র গ্রহণের প্রেক্ষিত ও ইস্যুসমূহ আলােচিত হয়েছে। আলােচনায় স্পষ্ট যে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জনমতের প্রতিফলনে রাজনৈতিক সংগঠন, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, গণমাধ্যম, সর্বোপরি পার্লামেন্টে বাংলাদেশ-সংকট নিয়ে আলােচনায় যেসব গুরুত্ব ইস্যুসমূহ বেরিয়ে আসে বিশ্ব পরিসরে কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে ভারত সরকার তা বাস্তবায়নে এগিয়ে যায়। ৩. কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভারত সরকারের প্রক্রিয়া ১৯৬৯ সালে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে ছােটো ছােটো বিরােধী দলের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। এটা ছিল সংকটময় সময়। এরূপ বিড়ম্বিত অবস্থায় ১৯৭১ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘােষণা করলে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃতাধীন কংগ্রেস পার্টি লােকসভায় দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করে। বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী নেহেরু যুগের নির্জোট পররাষ্ট্রনীতির আলােকে আঞ্চলিক সহযােগিতার উন্নয়নে কাজ করতে থাকেন যদিও মার্চ মাস থেকে পূর্ববঙ্গের ঘটনাগুলি তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এসময় ইন্দিরা গান্ধীকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে জটিল বিষয়সমূহে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। ইন্দিরা গান্ধী প্রাথমিকভাবে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি পি. এন. হাসকার এবং যার সঙ্গে ছিলেন জি, রাম চন্দ্র, এম মালহােত্রা, শারুদা প্রসাদ এবং ভি, এন, টেন্ডনকে নিয়ে কাজ করতে হয়। এই গ্রুপের সঙ্গে জি, পার্থ সারথি (যিনি কর্মকর্তা ছিলেন না, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন) এবং ডি, পি, ধর (যিনি সােভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে বিদেশ মন্ত্রণালয়ের পলিসি প্যানেলের প্রধান নিযুক্ত হন। যারা প্রায় প্রতিদিনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতেন। | ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠিত পলিটিক্যাল এ্যাফেয়ার্স কমিটিতে (প্যাক) পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, অর্থমন্ত্রী ওয়াই ভি চ্যাবন, অন্যান্য মন্ত্রী ও সচিব (যখন যাদের প্রয়ােজন হতাে) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলােচনা করতেন। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী নিজেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু দু’জন প্রতিমন্ত্রী কেসি পান্ট ও আর এন মৃধাকে নিয়ােগ দান করেন। পান্ট ছিলেন পশ্চিমবাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বে। যার জন্য প্রায় তাদেরকে প্যাকের মিটিং-এ উপস্থিত থেকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করতে হতাে। পান্ট যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ট এবং পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বে ছিলেন সেজন্য শীর্ষ পর্যায়ে ক্যাবিনেট মিনিস্টারদের সঙ্গে তাকে সক্রিয়ভাবে তৎপর থাকতে হতাে।
শীর্ষ আমলাতান্ত্রিক পর্যায়ে প্রশাসনে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে মন্ত্রীপরিষদ সচিব ভি ডব্লিউ, স্বামীনাথন, পি এন হাসকার, প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি. এন. ধর, প্রতিরক্ষাসচিব কে, বি, লাল, অর্থনৈতিক বিষয়ক সচিব আই. জি. প্যাটেল, পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল এবং শীর্ষ পর্যায়ের আমলা যাদের যখন প্রয়ােজন হত তারা সেই বিষয়ে প্রয়ােজনীয় মতামত প্রদানের জন্য আহ্বান করা হতাে। এই কমিটি পূর্ববঙ্গের নীতি নির্ধারণে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন যারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি চ্যানেলে যােগাযােগ রাখতেন। অন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠিত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের থেকে আসা শরণার্থীদের সমস্যা বিষয়ে। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় সামরিক নেতৃত্ব বিশেষকরে তিন বাহিনীর প্রধানগণ বিদেশনীতির ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষার ভূমিকা কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে ক্রমাগতভাবে আসন গেড়ে বসে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত প্রতিরক্ষা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যে কমিটি ছিল তা অকেজো করে রাখেন।” অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর প্রধানগণ পলিটিক্যাল এ্যাফেয়ার্স কমিটিতে তাদের প্রয়ােজনীয় মতামত রাখতে পারতেন। সেনা প্রধান জেনারেল এস, এফ. এইচ. জে. (স্যাম) মানেকশ স্টাফ কমিটির প্রধানরূপে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন এবং বৈদেশিক এ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারিয়েটের ডি, পি, ধরের সঙ্গে কখনাে কখনাে পলিসি প্রভাবিত করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু সেনাপ্রধানদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতে হতাে এবং তার নিকট মতামত পেশ করতে হতাে। জগজীবন রাম সামরিক চ্যানেলের বিশ্বাসযােগ্যতা পুরােপুরি বিবেচনা করতেন না। গােয়েন্দা সংস্থাসমূহ বহু শাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটি রিসার্চ এন্ড এনালাইসিচ উইং (RAW), তিন বাহিনীর গােয়েন্দা ডিরেক্টর মাধ্যমে তথ্য প্রদান করতেন, যেক্ষেত্রে উপ-প্রধান সেনাপতি প্রধান দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গের সংকট নিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নীতি নির্ধারণে এভাবে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সেল ও সংস্থাগুলাে কাজ করেছে। সাধারণত মন্ত্রী পরিষদে সব বিষয় আলােচিত হতাে না; কেবল তাদের অবহিত ও প্রয়ােজনবােধে তাদের কাছ থেকে অনুমােদন নেওয়া হতাে। এমনিভাবে লােকসভার বৈদেশিক পরামর্শক কমিটিতে বাংলাদেশের সংকট নিয়ে খুব বেশি আলােচনা হয়নি। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ নীতি ও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হতাে অথবা সংসদে আলােচনা-সমালােচনার দুয়ার খােলা রাখা থাকত। লােকসভায় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় এইসব আলােচনা তার জন্য বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেনি। অন্যদিকে, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে টি.এন.কাউল, ডি.পি.ধর, হাসকার, পি,এন,ধর এদের শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে ঘনিষ্টতা থাকায় বাংলাদেশ সংকট নিয়ে নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে তেমন বেগ পেতে হয়নি। বিদেশ মন্ত্রণালয়কে সংকটকালীন সময়ে পূর্বে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সংকটে সেক্ষেত্রে গুরুত্ব তেমনটি ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানে কর্তব্যরত বাঙালি কূটনীতিবিদদের সঙ্গে যােগাযােগ, পক্ষত্যাগ, তাদের আশ্রয় এবং কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিদেশ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ সরকারকে ব্যাপকভাবে সহায়তা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীকে ঘিরে একটি কার্যকর গােষ্ঠী অনানুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত। গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করে। ভারতীয় কূটনৈতিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে এই গ্রুপটি একত্রিত হয়ে কাজ করেছে এবং মৌলিক নীতিমালা নির্ধারণে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য কম ছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু মতদ্বৈততা লক্ষণীয়। এরপরে যে কথাটি বলা প্রয়ােজন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক সময় কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধানতম ব্যক্তিত্বের ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারত বিভক্তি। হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ভারতীয় বিদেশনীতি ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। সেজন্য ১৯৪৭-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ভারতের কূটনীতি প্রধানত নেহেরু ডকট্রিন হিসেবে পরিচয় লাভ করে। | ১৯৭১ সালে কূটনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন ব্যক্তি, গােষ্ঠী বা দলের নিকট থেকে পরামর্শ গ্রহণ করলেও কূটনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রেও তার ছিল অপ্রতিরােধ ক্ষমতা। ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলাে বাংলাদেশের সংকট নিয়ে সােচ্চার ছিলেন, কিন্তু সুনির্দিষ্ট নীতি বা পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব সরকারের নিকট তুলে ধরতে সক্ষম হয়নি। কতিপয় কংগ্রেস সদস্য ও নেতা প্রথম দিকে পার্লামেন্টে পাকিস্তানের উপরে চাপ সৃষ্টির জন্য কঠোর মনােভাব তুলে ধরেন। কিন্তু মে মাসের শেষদিকে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পরিষ্কার করে বলেন যে, বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তার সরকার সম্পূর্ণ সজাগ এবং যথা সময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। বিরােধী দল সরকারের সমালােচনায় বারবার বলেছেন, এই মুহুর্তে মুজিবনগর সরকারের সমর্থনে সরাসরি পাকিস্তানকে আক্রমণ করে বাংলাদেশ সংকটের সমাধান করা উচিত। তারপরেও পর্যালােচনা করে দেখা যায়, বিরােধী দল যতই সমালােচনা করুক না কেন তা শেষপর্যন্ত তারা সরকারের নীতিকেই সমর্থন। করেছে।১০২ ৪. ধ্রুপদী পররাষ্ট্রনীতি ও প্রাসঙ্গিক বিবেচনা “ঠান্ডা লড়াই’-বিভক্ত বিশ্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর শাসনামলে পরাশক্তি এবং তার বলয়ে অনেক ক্ষুদ্র ও বৃহৎ রাষ্ট্র সামরিক শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে অস্ত্র প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলাে। এসময় আফ্রো-এশীয় দেশের নব স্বাধীনতালব্ধ রাষ্ট্রগুলি নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ব্যগ্র । কমিউনিস্ট চীনের অ্যুত্থান পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলিকে উদ্বিগ্ন করেছে এবং পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে বিশেষত কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যের মদতে অশান্তি সৃষ্টি অব্যাহত ছিলাে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু, মিশরের নাসের ও যুগােস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো নির্জোট নীতিতে নেতৃত্ব দানের সিদ্ধান্তগ্রহণ করেন। যার লক্ষ্য ছিল তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলাে পরাশক্তির

দ্বন্দ্বে জড়িয়ে না পড়ে। স্বতন্ত্র নীতি অনুসরণ করতে সক্ষম হবে এবং ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল মােচনে আফ্রো-এশীয় জনগণের মুক্তি আন্দোলনের শরিক হতে পারবে। নির্জোট আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে এই আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণ, ভাতিবিদ্বেষবিরােধী জোটনিরপেক্ষ নীতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুই পরাশক্তির প্রতিযােগিতা ও দ্বন্দ্বে দুই শিবিরে বিভক্ত বিশ্ব পরিস্থিতির ফলশ্রুতি। অতীতে স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগ হতে ভারতের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহ্য এই নীতির দিকে পথ। নির্দেশ করেছিল। নেহেরু বলেছিলেন যে, “এ সম্পর্কে আমার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস আছে। যে ভারতে যে কেউ ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা এই নীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনাে ব্যতিক্রম করবে না।” ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলাে পঞ্চশীল ও শান্তিপূর্ণ। সহাবস্থান। পঞ্চশীল নীতিতে বিশ্বাসী শক্তিবৃন্দ পরস্পরের সীমানা অতিক্রম করে আক্রমণ করবে না ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না বলে চুক্তিবদ্ধ । পারস্পরিক সাহায্য, সহাবস্থান ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দান করা পঞ্চশীলের অঙ্গ। ভারত সহাবস্থান নীতিতে বিশ্বাসী। ভারতের কূটনৈতিক মূলনীতির অন্যতম দিক হলাে উপনিবেশ বিরােধীতা।
১৯৭১ সালে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে নেহেরু নির্দেশিত পররাষ্ট্রনীতির আলােকে পথ চলতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ-সংকট ছিল ভিন্ন প্রকৃতি। সে প্রকৃতির দৃশ্যমান দিক হলাে মানবাধিকার সমস্যার ভয়ঙ্কর দিকগুলাে এবং পাশাপাশি দুই পরাশক্তি প্রভাবান্বিত দেশগুলাে বাংলাদেশ সংকটকে পাশ কাটিয়ে থাকার প্রবণতা এবং নিষ্ঠুর নির্লিপ্ততা। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি এ ধারণা পােষণ করতেন যে, বাংলাদেশ সমস্যা মূলত ভারত-পাকিস্তান সমস্যা। মুসলিম বিশ্ব মনে করেছে হিন্দু-ভারত মুসলমানদের দেশ। পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলতে চায় পুরনাে শত্রুতা থেকে। সেজন্য পর্যবেক্ষকমাত্রই লক্ষ্য করেন ডিসেম্বর মাসের পূর্ব পর্যন্ত জাতিসংঘে বাংলাদেশের নামটি পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু নাম অনুল্লেখ রেখে আলােচনা হয়েছে বাংলাদেশের সংকট নিয়ে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে বিশ্ব-পরিসরে কূটনীতি কার্যকর পরিচালনা ছিল। দুঃষহ ব্যাপার। ৫. আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ে বিবেচ্য বিষয় মে মাসের শেষভাগ পর্যন্ত নয়াদিল্লির কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালিত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে একটি সমঝােতা সৃষ্টির ক্ষেত্র নির্মাণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন রাওয়ালপিন্ডির উপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু ভারত সরকারের মধ্যে একটি অসন্তুষ্টির ভাব পরিলক্ষিত এই ভাবে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাকিস্তানের উপরে কার্যকর চাপ সৃষ্টি করে তাদের নীতি পরিবর্তন করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তখন পর্যন্ত বলে আসছিল যে, বাংলাদেশে ২৫শে মার্চ যে ক্রাকডাউন হয়েছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতের প্রাথমিক কূটনৈতিক টার্গেটের ক্ষেত্র হয়ে দাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। যে ক্ষেত্রে নিউইয়র্ক টাইমস ২১শে জুন সংখ্যায় প্রকাশিত রিপাের্টে বলা হয়েছে, এপ্রিল মাসে পাকিস্তানে সামরিক সহায়তা বন্ধ করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা অব্যাহত রয়েছে। ভারতের সামনে সােভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাও পরিষ্কার ছিল বরং বিষয়টিকে তারা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে এবং ইউরােপিয়ান দেশগুলাে ও জোটনিরপেক্ষ শক্তিসমূহ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। | নয়াদিল্লির দৃষ্টিকোণ থেকে এই অবস্থা দৃষ্টে তাদের নীতি ও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়ে, যেক্ষেত্রে শরণার্থীদের বিপুল সংখ্যা ভারতে ঢুকে পড়ছিল। নয়াদিল্লি এই সময় বাংলাদেশ প্রতিরােধ শক্তির প্রতি তাদের সমর্থন বিস্তৃত করে এবং সরাসরি ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভবনা সামনে চলে আসে। এই সময় ভারত সরকার প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তান সরকারের নীতি সম্পর্কে পরিষ্কার বিবৃতি প্রকাশিত করে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এক বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ বিদেশমন্ত্রি সরদার শরণ সিং ২৪শে জুন কংগ্রেস পার্লামেন্টের পার্টির সভায় বলেন, যদি কোনাে রাজনৈতিক সমঝােতা আওয়ামী লীগের নিকট গ্রহণযােগ্য না হয় তাহলে ভারত নিজেই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। এই বিবৃতিগুলাের পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনী এমনকি গােলন্দাজ বাহিনীও সীমান্তের দিকে এগিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনীর অপারেশনে সাহায্য করে।১০৩ এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে যে উপদেষ্টাগােষ্ঠী ইন্দিরা গান্ধীর চারপাশে ছিল তারা কতিপয় নীতি এবং কাঠামাের বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ করেন। প্রথমত, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে বাঙালি হিন্দুসহ সকল শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন যেক্ষেত্রে কোনাে শান্তিপূর্ণ সমাধান নেই; দ্বিতীয়ত, মধ্যপন্থি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর যেটা হতে পারে শিথিল কনফেডারেশন অথবা নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি, যদি সেক্ষেত্রে শরণার্থীরা ফিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে; এবং তৃতীয়ত, প্রাথমিকভাবে অপ্রত্যক্ষভাবে মুক্তিবাহিনীর প্রতি সমর্থন জোরদার করা, যদি তা ফলপ্রসূ না হয় যথা। সময়ে ভারতীয় সৈন্য সরাসরি হস্তক্ষেপ। এই গােষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল ব্যাপকভাবে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা এবং ভারতের লক্ষ্য সম্পর্কে সমর্থন আদায় করা। এই বিষয়ে তারা নানা ধরনের বিকল্প পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ ছিল পাকিস্তান যেন অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে সাহায্য না পায়। ১৭ই মে ইউনেস্কোতে এভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে শান্তিপূর্ণ সমাধান, মানবাধিকার পুনরুদ্ধার এবং পূর্ব বাংলার শরণার্থী এবং তাদের পুনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি যতদিন পর্যন্ত এইসব শরণার্থী ভারতে অবস্থান করবে। একইসাথে ২৪শে মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে বলেন, “If the world does not take heed, we shall be constrained to take all measures as may be necessary to ensure our own security and the preservation and devlopments of the structure of our social and economic life”- the first discreet official threat to use force if the ‘Great Powers, (who had a speacial responsibility to act on this issue failed to do so. 130
ক. বিদেশ তৎপরতা: শ্রীমতী গান্ধী মন্ত্রীসভাকে জানান যে, ভারত পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতায় উৎসাহী নয়। বাংলাদেশে যে অশান্তি, তা পাকিস্তানের নিজেদেরই সৃষ্ট। কিন্তু “ঐসব ঘটনা সম্পর্কে আমরা উদাসীন থাকতে পারি না। কারণ আমরা ভারতের শান্তি ও স্থিতিশীলতায় আগ্রহী। ভারতের শান্তি ও স্থিতি বিঘ্নিত করে এমন যে কোনােও ঘটনাই আমাদের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। বস্তুত আমরা মনে করি, ভারতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা পাকিস্তানের উপরেও একটা নিয়ামক প্রভাব বিস্তার করবে।” | ৫ই জুন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আগমনের ফলে অতি গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে এবং এর পরিণতি দেশের পক্ষে গুরুতর হতে পারে। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ঠেলে দিয়ে পাকিস্তান সরকার ভারতের উপর ‘অপ্রত্যক্ষ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা যেন তাতে শঙ্কিত না হই। আমাদের সুস্থিরভাবে এই পরিস্থিতির মােকাবেলা করতে হবে যাতে ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি।’ শ্ৰীমতী গান্ধী মন্ত্রীসভাকে জানান যে, ভারত পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা উৎসাহী নয়। বাংলাদেশে যে অশান্তি, তা পাকিস্তানের নিজেদেরই সৃষ্ট। আন্তর্জাতিক জনমতকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনার ক্ষেত্রে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মুসলিম বিশ্বের জোরালাে সমর্থন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে, এমনকি অপর পরাশক্তি সােভিয়েত ইউনিয়নও জুনজুলাই মাস পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। এমনি পরিপ্রেক্ষিতে ভারত বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে সরকারি, বেসরকারি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। মুজিবনগর সরকারকেও সহায়তা দেয় বিভিন্ন দেশে তাদের প্রতিনিধি পাঠানাের জন্য। বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রসমূহ সফর করেন। উপরন্ত, নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়ােজন করে দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মীদের আমন্ত্রণ জানায়, বিদেশি প্রতিনিধিদলের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন ও বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করে। একাত্তর সালব্যাপী ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল ভারতের গৃহীত পদক্ষেপের যৌক্তিকতা তুলে ধরা। অন্যদিকে, পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশ করে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল জনমত গড়ে তােলা। ইন্দিরা গান্ধী অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে নিরাপদ হলেও পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা শক্তিসমূহের চাপ তার জন্য ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। মুসলিম বিশ্ব এবং পশ্চিমা শক্তিবর্গকে পাকিস্তানের পর্যায়ক্রমিক অপপ্রচারের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এক্ষেত্রে ভারতীয় কৌশল সম্পর্কে ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনােয়ার হােসেনের মন্তব্য প্রণিধানযােগ্য, “প্রথম থেকেই ভারত তার প্রচার মাধ্যমগুলাের সাহায্যে যে বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করে তা ছিল যে, অভ্যন্তরীণ সমস্যা। সমাধানের অজুহাতে বাংলাদেশে যে গণহত্যা শুরু হয়েছিল তা প্রতিহত করা বাইরের পৃথিবীর নৈতিক দায়িত্ব।”৯০৬ ভারত বারবার এই নৈতিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে মূল সমস্যাকে পাশ কাটানাের বিষয়টি তুলে ধরে। মূল সমস্যা হলাে। বাংলাদেশের সংকট মােচনে রাজনৈতিক সমঝােতা, যা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট গ্রহণযােগ্য হতে হবে। মিশর: পাকিস্তানের ওপর প্রভাব খাটানাের আহ্বান জানিয়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট সাদাতের প্রতি প্রধানমন্ত্রী এক পত্র লেখেন। তিনি পূর্ববঙ্গের ঘটনাবলি নিয়ে উদ্বেগ। প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ববঙ্গে যেভাবে গণহত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে তা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী এগুলাে বন্ধ করার জন্য মিসরের প্রেসিডেন্টকে ওয়াকিবহাল করেন। তিনি পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সামরিক জান্তা যেভাবে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে যার ফলে অগণিত মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রেসিডেন্ট সাদাতকে পাকিস্তানের সরকারের উপর প্রভাব বিস্তারের আহ্বান জানান। 
মস্কো: মস্কো সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী গান্ধী পরিষ্কার ভাষায় দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, বর্ষা শেষে তিনি বাংলাদেশ সংকটের সমাধান চান। কিন্তু সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন সামরিক সমাধানের পরিবর্তে রাজনৈতিক সমঝােতার উপর জোর দেন। কিন্তু শ্রীমতী গান্ধী এ সফরে হার্ডলাইন গ্রহণ করলে মস্কো উপলব্ধি করে যে অন্য কোনােভাবে ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ২৯শে সেপ্টেম্বর মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এক অভিভাষণে বলেন, যখন লক্ষ লক্ষ লােককে ভিন্ন দেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন তখন শান্তি বিঘ্নিত হতে পারত। সংশ্লিষ্ট জনগণ কর্তৃক রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণ করার মাধ্যমে বর্তমান সংকটের মূল কারণ দূর করা সম্ভব। বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব রয়েছে অবিলম্বে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যেখানে নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে শরণার্থীরা স্বদেশে ফিরতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, ১লা অক্টোবর আকস্মিকভাবে প্রেসিডেন্ট পদগনি হ্যানয় যাওয়ার পথে নয়াদিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন এবং কোসিগিনের মতামত পুনর্ব্যক্ত করেন। ৯ই অক্টোবর সােভিয়েত-আলজেরিয়া যৌথ বিবৃবিতে তাসখন্ডের স্পিরিটে ভারত-পাকিস্তানের সমস্যার সমাধানের উপর গুরুত্ব দেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মস্কোর সঙ্গে ‘ঠান্ডা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এ অবস্থায় মস্কো উপলব্ধি করে যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানে অগ্রসর হবে। বিষয়টি নিয়ে দুই সপ্তাহ চিন্তাভাবনার পর মধ্য অক্টোবরে সােভিয়েত উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই মােরুবিন চুক্তির নবম ধাপ সম্পর্কে ‘আলােচনার জন্য নয়াদিল্লি আসেন। পশ্চিম ইউরােপ এবং যুক্তরাষ্ট্র সাক্ষাতের জন্য ২২শে অক্টোবর দিল্লিতে আসে। সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দিরা গান্ধী সােভিয়েত ইউনিয়নের নিকট যুদ্ধাস্ত্রের অনুরােধ করেন। সে সময় এক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহের কথা বলা হলে তা নির্দিষ্ট ছিল না। কিন্তু এ সময় সােভিয়েত প্রতিনিধি সুনির্দিষ্টভাবে ভারতকে অস্ত্র সরবরাহে সম্মত হয়। ৩০শে অক্টোবর সােভিয়েত ইয়ার মার্শাল পি,এস,কৌটা নয়াদিল্লি আসেন এবং ভারতকে জরুরিভাবে অস্ত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। তিন জাহাজ বােঝাই অস্ত্র ও বিমানের মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে সােভিয়েত ইউনিয়ন সামরিকভাবে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।১০৯ যুক্তরাজ্য: মার্চ মাস থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সংকট সম্পর্কে যুক্তরাজ্য প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলেও বিভিন্ন গােপন দলিলপত্রে এ কথা প্রমাণ হয় যে, প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস-হিউম, বিরােধী দলের এমপি এমনকি সরকারি দলের প্রতিনিধিরাও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। সেদিক থেকে প্রধানমন্ত্রী হীথ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের ভিত্তি খুঁজে পেয়েছেন। যদিও ব্রিটেন এবং পাকিস্তানের মধ্যে অস্ত্র বিক্রির চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালে সামরিক অস্ত্র সরবরাহের কথা থাকলেও তা থেকে ব্রিটেন বিরত থেকেছে, কালক্ষেপণ করেছে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র বিক্রির অর্ডার বাস্তবায়িত করেনি। পূর্ব পাকিস্তানে মানবাধিকার লঙ্নের বিষয়ে ব্রিটেন প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছে যার পিছনে ব্রিটিশ জনগণের অখণ্ড সমর্থন ছিল। ব্রিটিশ সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনবলিকে যদিও সবসময় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার বলে অবহিত করেছে কিন্তু বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতি এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একথাও বলেছে যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করাই হবে বর্তমান সমস্যা সমাধানের উৎকৃষ্ট উপায় ।
গবেষকমাত্রই পর্যবেক্ষণ করবেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচার বন্ধ, তার প্রাণ রক্ষা এবং মৃত্যুদণ্ড না দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার যে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তা প্রণিধানযােগ্য। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে লেখা পত্র, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পত্রের উত্তরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের বিচলিত মনােভাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে লেখা পত্রগুলাে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন ভারত ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আদান-প্রদানকৃত পত্র পর্যালােচনা করলে আরাে একটি কথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে এই ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরাে করা ভারতের উদ্দেশ্য নয়। ভারতের মূল উদ্দেশ্য হলাে, অধিকার বঞ্চিত জনগণের পাশে দাঁড়ানাে, পূর্ববঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক সমঝােতা জরুরি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ১৩ই মে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরাবর যে পত্র লেখেন সেখানে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য তার ক্ষমতা ও সম্মানকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের সামরিক শাসককে এও বােঝাতে সমর্থ হবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা নিরসনে পাকিস্তান যে পথ অবলম্বন করেছে তা অবাস্তব ও অজ্ঞানতাপ্রসূত।” ৭ই জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক পত্রে এডওয়ার্ড হীথ বলেন, “নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সমস্যার সমাধান আশু প্রয়ােজন, না হলে তা উগ্রপন্থিদের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” ৩১শে অক্টোবর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সঙ্গে চেকার্সে (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অবকাশ-নিকেতন) বৈঠক করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আলােচনার এক পর্যায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, তার আশঙ্কা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান একটি যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে এবং তা হবে দীর্ঘস্থায়ী। তাই যদি হয় তাহলে তার দখল চলে যাবে বামপন্থিদের হাতে। ইন্দিরা গান্ধী একথা বলেন যে, ভারতের উগ্রপন্থিরা মনে করে যে, প্রথমেই ভারতের যুদ্ধ শুরু করা উচিত ছিল। তাতে জনগণ ও আন্তর্জাতিকভাবে সকলকে বিষয়টি বােঝানাে সহজ হত। এখন পরিস্থিতি আরাে জটিল হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে ভারতের সমস্যা ও সমাধানের বিষয়টি তুলে ধরার বিষয়ে মতামত প্রকাশ করলে ব্রটেনের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে একমত হন। ১৬ই নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বরাবর এক পত্রে যুক্তরাজ্যের বিশাল অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও সম্মানকে ব্যবহার করে পূর্ববাংলার জনগণ ও তাদের নেতা। শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গ্রহণযােগ্য একটি সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। ২৫শে নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বরাবর লেখা এক পত্রে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ লেখেন, “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়ে। একটি রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে আমার আবেদন ব্যক্ত করে আমি ইয়াহিয়া। খানকে পুনরায় চিঠি দিয়েছি। আমি তাকে বলেছি বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনায় বসা পাকিস্তান সরকারের জন্য অত্যন্ত জরুরি।” | সূত্রে প্রকাশিত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আলােচনায় দু’টি শর্ত দৃঢ়তার সঙ্গে উত্থাপন করেন। প্রথমটি হলাে ভারতে যে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী এসেছে তাদের স্বদেশ । প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রয়ােজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝােতা। এই সমঝােতায় উপনীত হতে হলে অপরিহার্য শেখ মুজিবের মুক্তি। দ্বিতীয় শর্তে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যা বলেছেন তার অর্থ হলাে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং এক্ষেত্রে তার অনমনীয় দৃঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও শ্রীমতী ইন্দিরা। গান্ধী একমত হয়েছেন যে, বাংলাদেশ সংকট সমাধানে পাকিস্তান সামরিক জান্তাকে। শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করতে হবে, ভারতের সঙ্গে নয়। প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেকের ডগলাস হিউম-এর সঙ্গে ঘন্টাধিক আলােচনা করেন।”
যুক্তরাষ্ট্র: ১৭ই জুন ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং বর্তমান সমস্যার সমাধানে মৌলিক দু’টি পূর্ব শর্তের উল্লেখ করেন। প্রথমত, অতিদ্রুত রাজনৈতিক সমাধান, যার মাধ্যমে শরণার্থীরা নিরাপত্তা ও আশ্বস্ত হয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন। দ্বিতীয়ত, পূর্ববঙ্গে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছানুযায়ী কার্যকর ও স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া যেতে পারে। তিনি একইসাথে মনে করেন, রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রয়ােজন শেখ মুজিবের মুক্তি। এই সাংবাদিক সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়, পূর্ব পাকিস্তানকে তিনি পূর্ববঙ্গ বলছেন কেন? এতে ভবিষ্যতে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ এক হয়ে যাবে কিনা? বিদেশমন্ত্রী শ্রী শরণ সিং বলেন, পূর্ববঙ্গ বলছি এই কারণে যে, প্রথম থেকেই এটা ছিল পূর্ববঙ্গ। বৃহত্তর বঙ্গকে ভেঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ করা হয়েছে। আমরা পূর্ববঙ্গ বলছি। এই কারণে সাড়ে সাত কোটি মানুষ যারা পাকিস্তানের সামরিক নির্যাতন ও নির্মম আধিপত্য থেকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিজেদের পৃথক হওয়ার যে ধারণা লালন করছেন ও সংগ্রাম করেছে সে সম্পর্কে তাদের মনে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। পূর্ববঙ্গ বলার মাধ্যমে আমরা এই ধারণা মনে করি না যে, পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হয়ে গেলেও পশ্চিমবঙ্গ যা ভারত ইউনিয়নের একটি রাজ্য তা পূর্ববঙ্গের সঙ্গে চলে যাবে। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসিরা ভারতে রাজনৈতিকভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেজন্য পশ্চিমবঙ্গ পূর্ববঙ্গের সঙ্গে মিশে যাবে এমনটি ভাবার কারণ নেই। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি রাজ্য, ভারতের সঙ্গে থাকার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন এবং তারা কোনােদিনও পাকিস্তান সরকারের মতাে নির্যাতনের সম্মুখীন হয়নি।১৯২ ২৬শে জুন ভারতের বিদেশমন্ত্রী একটি বিবৃতিতে পূর্বে উল্লেখিত ধারণা ও শর্তাদি পুনরুল্লেখ করে এবং বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ও রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে কেবল সে দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্মতির মাধ্যমে। তিনি ৬ই জুন থেকে ২২শে জুন মস্কো, বন, প্যারিস, অটোয়া, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ও লন্ডন সফর করেন। তার এই ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতায় তিনি সমঝোতা সীমানা নির্ধারণে তিনটি শর্ত তুলে ধরেন। বিশ্বব্যাপী তার সফরের মূল প্রতিপাদ্য ছিল: এক, বাংলাদেশে অবিলম্বে সামরিক কার্যক্রম বন্ধ এবং সামরিক সমাধানের কার্যক্রম বন্ধ করা এবং রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে সংকট নিরসন; দুই, বাংলাদেশ থেকে যে অগণিত শরণার্থী আসছে অবিলম্বে তা রােধ করা। তার জন্য বাংলাদেশে শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ এমনভাবে সৃষ্টি করা যাতে শরণার্থীরা স্বদেশে ফিরে যেতে আশ্বস্ত হয়; এবং তিন, অবনতিশীল পরিস্থিতি রােধ এবং এই উপমহাদেশে শান্তি ও নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন। এড়াতে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমস্যার মীমাংসা করা।” ৬. যুক্তরাষ্ট্রে ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক তৎপরতা | শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হয়। ওয়াশিংটন থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি বলেন, যখন একটি জনগােষ্ঠী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেখানে কি শান্তি থাকে? জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক জান্তা যেখানে যুদ্ধ শুরু করে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করছে ও বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করছে সেখানে জনগণের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ চলছে বিশ্ব সেখানে উদ্বিগ্ন নয়। ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রদত্ত ভােজসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সংকট সম্পর্কে বলেন, ভারত একটি অনিশ্চিত অর্থনীতি ও নিরাপত্তা সম্পর্কে গুরুতর হুমকির সম্মুখীন। ভৌগােলিক কারণেই লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ মধ্যযুগের বর্বরতার শিকার হয়ে ভারতে চলে আসছে এবং ভারত গণতান্ত্রিক নিয়মরীতি মেনে চলছে। তবে অপর পরাশক্তি সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে ভারত বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক ধরনের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তথাপি আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “The International response has fallen short of the scale which a grim tragedy of this magnitude demands.”
ভারতরে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কয়েকটি পাশ্চাত্য দেশ সফর করেন এবং ১৯৭১ সালের নভেম্বরের ৪ ও ৫ তারিখে ওয়াশিংটনে গমন করেন। নিক্সন সংঘর্ষ এড়ানাের শেষ চেষ্টা হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে সম্মত হন। ৪ এবং ৫ই নভেম্বর ইন্দিরা গান্ধী ও নিক্সনের সঙ্গে দু’দফা বৈঠক হয়। ৪ঠা নভেম্বর সকালে ওভাল অফিসে বৈঠক বসে। তারা দক্ষিণ এশিয়ার উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করতে সম্মত হন এবং দ্বিতীয় দিনে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। সকালের বৈঠকে উত্তেজনা পরিহারের কোনাে সহজ উপায় বের করা সম্ভব হয়নি। নিক্সন জোর দিয়ে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের ভেতরে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য শরণার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত সহযােগিতা দিয়েছেন যারা উভয় দেশের সীমান্তে সমবেত হয়েছে। নিক্সন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, স্বল্প মেয়াদী ভাবে সামরিক ব্যবস্থা ভারতকে লাভবান করতে পারে, কিন্তু কালিক পরিক্রমায় রাজনৈতিক স্বার্থে তা ভারতের বিরুদ্ধে যাবে। শুধু তাই নয় যুদ্ধ বিশ্বশান্তি ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই যুক্তিকে উপেক্ষা করে বলেন, পাকিস্তানের বিদ্বেষের ফলে ১৯৪৭ ও ১৯৬৫ সালে যুদ্ধ হয়েছে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র প্রেরণ ভারতের জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। পাকিস্তান নিজেই। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে যা এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী আরাে মন্তব্য করেন, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান একত্রে থাকার এখন আর কোনাে আশা নাই।” নিক্সন প্রধানমন্ত্রীর নিকট জানতে চান, কীভাবে সমঝােতা অর্জন করা যায়। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ভারতের মুখ্য উদ্বিগ্নতা হলাে ভারতীয় অবস্থা সম্পর্কিত। দক্ষিণ এশিয়ার যুদ্ধ বিশ্ব শান্তিকে বিপন্ন করবে এ সম্পর্কে নিক্সনের উক্তিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাস কাটিয়ে যান এবং বলেন, তিনি শুধু ভারতের সমস্যা দেখছেন এবং দক্ষিণ এশিয়ার যুদ্ধ সম্ভবত ঠান্ডা যুদ্ধের বিপদে রূপান্তরিত হবে না। নিক্সনের কথায় গুরুত্ব না দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক হুমকির বিষয়ে উদাসীন থাকায় নিক্সন ক্ষুব্ধ হন। তার প্রকাশ ঘটে ৫ই নভেম্বর বৈঠকে। ৫ই নভেম্বরের বৈঠকে কোনাে কারণ ছাড়াই প্রেসিডেন্ট নিক্সন ৪৫ মিনিট নিজেকে অদৃশ্য করে রাখেন এবং ইন্দিরা। গান্ধীকে ‘কুকুরী’ বলে গালাগাল করতে থাকেন। ঐদিন সকালে কিসিঞ্জার বলেন, ভারতের লক্ষ্য পাকিস্তানকে ধ্বংস করা। তাদের কাছে পূর্ব পাকিস্তান এখন কোনাে ইস্যু নয়। নিক্সন আরাে বলেছেন, ‘বুড়ি ডাইনি’কে অযথাই মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়েছি।১১৮ দু’দিনের আলােচনা শেষে ইন্দিরা গান্ধী সাংবাদিকের নিকট বলেন, “তিন/চার হাজার মাইল দূর থেকে শুধুমাত্র বর্ণগেীরবে কোনাে দেশ ভারতকে তাদের ইচ্ছে মতাে আদেশ দেয়ার ক্ষমতার দিন শেষ হয়ে গেছে। এরপর থেকে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয়। যদিও সে সময় কংগ্রেস, গণমাধ্যম, সিভিলসমাজ প্রায় সকলেই ভারতের পক্ষে সােচ্চার ছিল। বাংলাদেশ-সংকটে ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকাকে সমর্থন করে যাচ্ছিলাে। ৫ই ডিসেম্বর নিক্সনের অনুমােদন নিয়ে কিসিঞ্জার সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত ইউলি ভােরােন্টসােভকে বলেন, মস্কো যদি অন্যদেশকে নিরস্ত্র করতে চায় তাহলে মার্কিনসােভিয়েত সম্পর্ক বিপন্ন হবে। তিনি বলেন, ভারতীয় সামরিক আক্রমণকে সােভিয়েত সাহায্য করবে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রাখবে; প্রেসিডেন্ট নিক্সন এর কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত আশা করেন আসন্ন সােভিয়েত-মার্কিন সামিট স্থগিত হবে না। পরদিন নিক্সন প্রশাসন পর্যবেক্ষণ করে সােভিয়েতের সাহায্যে ভারতের যে বিজয় অর্জিত হতে চলেছে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পরাজয়। যদিও রাশিয়ার সঙ্গে যােগাযােগ পূর্বেই করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ভারতের নিকট আন্তর্জাতিক জনমত গঠন, জাতিসংঘের সমর্থন আদায় এবং বিপুল শরণার্থীদের মানবিক ট্রাজেডির বিষয়টি বিশ্ব পরিসরে তুলে ধরা ভারতীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে নীতি নির্ধারকদের সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য, লােকসভার কার্যবিধি এবং ভারতীয় জনমত ও দলগুলাের ক্রমবর্ধমান সমর্থন বাংলাদেশের অনূকুলে ঝুকে থাকায় ভারত সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মিলিত কুটনৈতিক তৎপরতার নতুন ভিত্তি নির্ধারণ করতে খুব বেশি একটা বেগ পেতে হয়নি। নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক বিষয় নিয়ে ভারত সরকার আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়: এক, বিগত নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের জনগণের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক যে ন্যায্য আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে, সেই গণরায়ের প্রতি যদি পাকিস্তান সরকার সম্মান প্রদর্শন করে তাহলে পূর্ববঙ্গের সংকট সমাধান সম্ভব হতে পারে।
দুই, এই লক্ষ্য পূরণের জন্য পাকিস্তান সামরিক জান্তা অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত করে ঢাকায় রাজনৈতিক সমঝােতায় উপনীত হতে পারে; তিন, সম্মান, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযােগিতা প্রদানপূর্বক শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার নিরাপদ নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করতে হবে; চার, পাকিস্তান সামরিক জান্তাকে অবিলম্বে জনগণের উপর আক্রমণ বন্ধ করতে হবে এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে; পাঁচ, শান্তি পূর্ণভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাকিস্ত েিনর উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, সেটা হতে পারে দ্বিপাক্ষিক অথবা জাতিসংঘের মাধ্যমে; এবং ছয়, লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যারা ক্ষুধার্ত ও আশ্রয়হীন যাঁদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতে ঠেলে দিয়েছে সেই সব শরণার্থীদের আর্থিক ও সাহায্যের মাধ্যমে পূর্ণভাবে পুর্নবাসন করতে হবে এবং পূর্ববঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই সবগুলােই করতে হবে জাতিসংঘ ও তার বিশেষায়িত সংস্থাগুলাের মাধ্যমে। এই নীতিমালার আলােকে ২রা এপ্রিল জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি। সমর সেন জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টের নিকট প্রেরিত এক পত্রে আন্ত। র্জাতিক সম্প্রদায়ের নিস্ক্রিয়তা ও নীরবতার সমালােচনা করে বলেন, “পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশের মানুষের ওপর যে হারে নির্যাতন শুরু করেছে, তা বর্তমানে এমন এক স্তরে এসে পৌছেছে যে, তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার মনে করে নিশ্চেষ্ট থাকার আর সময় নেই। আন্তর্জাতিক মানবগােষ্ঠী কর্তৃক একটি উপযুক্ত ব্যবস্থা। অবলম্বন করা অত্যাবশক হয়ে উঠেছে।”১২১ পত্রে আরাে উল্লেখ করা হয়, মানব দুর্গতি। এই মুহুর্তে নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতাকে দুর্গত জনসাধারণ বহির্বিশ্বের উদাসীনতা বলে ভাববে। পত্রটি জাতিসংঘের ইস্তেহার আকারে প্রকাশ করা হয়।

এসময় নানা ধরনের বিবৃতি ও প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক লড়াই চলতে থাকে। ১৬ই এপ্রিল ভারতের পররাষ্ট্রদপ্তর কর্তৃক পাকিস্তানের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভারত কোনাে না কোনােভাবে জড়িত আছে বলে পাকিস্তান যে মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে ভারত তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আরাে বলা হয়, ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযােগ ও প্রচার চালিয়ে পাকিস্তান জঙ্গিশাহী বাংলাদেশে যে বর্বর ও অমানুষিক গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তা। কিছুতেই ঢাকতে পারবে না। কেউ কেউ এই প্রতিবাদকে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পূর্ব-সূচনা বলে মনে করেছেন। একজন বিদেশি সাংবাদিক এ-সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে। সরকারি মুখপাত্র এর সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, যখন যে-অবস্থা দেখা দেবে তখন তা সেভাবে মােকাবেলা করা হবে, এই হলাে ভারত সরকারের নীতি।

‘ জাতিসংঘের ‘সােস্যাল কমিটি অব দি ইকোনােমিক এন্ড সােস্যাল কাউন্সিল’-এ ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন ১২ই মে প্রদত্ত ভাষণে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদসহ এ-সংক্রান্ত অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঘােষণা ও সনদের ধারা উল্লেখ করে বলেন, পাকিস্তান পূর্ববঙ্গের ওপর হামলা চালিয়ে এসব ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে; যদিও পাকিস্তান মানবাধিকার-সংক্রান্ত এসব ঘােষণা ও চার্টারে স্বাক্ষরদানকারী দেশ। সমর সেন তার ভাষণে শরণার্থীদের সংখ্যা ও তাদের দুর্গতির চিত্র তুলে ধরে সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত আন্তর্জাতিক ত্রাণ কার্যক্রম গ্রহণের জন্যে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান। সেই সাথে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্যে জোরালাে দাবি জানানাে হয়। সপ্তম অধ্যায়ে জাতিসংঘে কূটনৈতিক তৎপরতার ব্যাপকতা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আলােচনা করা হয়েছে। ৭. বহির্বিশ্বে ভারতে কূটনৈতিক প্রতিনিধি প্রেরণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা ও ভারতীয় ভূমিকার যথার্থতা ব্যাখ্যা করার জন্য ৬৭টি রাষ্ট্রে ১৮টি সরকারি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে ভারত সরকার। এর মধ্যে চারটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রী সরদার শরণ সিং। এই বিদেশ ভ্রমণে ভারত সরকারকে বিপুল পরিমাণ। অর্থ ব্যয় করতে হয়। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট জোর দাবি জানান। বিশেষকরে যারা পাকিস্তানের উপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন রাষ্ট্রেগুলাের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, পাকিস্তান সরকার যেন রাজনৈতিক সমাধান মেনে নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালে মুসলিম উম্মাহ্র নামে পাকিস্তানের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয় মুসলিম দেশগুলাে। মুসলিম বিশ্বের জনমতকে কিছুটা নমনীয় করবার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ভারতের বৈদেশিক সম্পর্ক। বিষয়ক মন্ত্রী ইন্দোনেশিয়া সফর করেন। সফর শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর কারণে সৃষ্ট সংকটে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয় জরুরি ভিত্তিতে অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে শরণার্থীরা তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে।১২৭ ধারণা দেওয়া হয়েছিল, “ইসলামি রাষ্ট্রগুলাের দৃষ্টিতে এ-মুক্তিযুদ্ধ ইসলামবিরােধী অপপ্রয়াস এবং ইসলামি সংহতির প্রতি হুমকি হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিল। ১৯৭১-এ ২২ সদস্যবিশিষ্ট ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (OIC) জেদ্দা অধিবেশন ‘জাতীয় সংহতি ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানান।”২৮। | মুসলিম বিশ্বে কূটনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে।
| ভারতীয় কূটনৈতিক তৎপরতা ব্যাপকভাবে বিশ্বপরিসরে বৃদ্ধি পায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন রাষ্ট্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি, সংকট, কার্যকরণ এবং সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে অবগত করানোর জন্য বিশেষ দূত প্রেরণ করে। শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিষয়ে বিশেষভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে সফর করে। তিনি সর্বত্র আন্তরিক সমবেদনা ও পর্যবেক্ষণ করেন সমর্থন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে জনমত গঠনে ব্যাপক সাড়া পান। | প্রতিনিধিদল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বশীল দল আওয়ামী লীগের নির্বাচিত নেতৃত্বের সঙ্গে গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমঝােতার ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। এই বার্তাটি সর্বত্রই সমাদৃত হলেও পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলাে দ্বিধান্বিত ছিল। পাকিস্তানের নীতি পরিবর্তের ক্ষেত্রে তারা চাপ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু প্রথম থেকেই ভারতীয় নীতি নির্ধারণগণ দেখতে পেলেন সফরগুলাে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে সফল হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র বা সংস্থাগুলাে উদ্যোগ গ্রহণে অগ্রসর হচ্ছে না। এর ফলে জনগণের মতামত, গণমাধ্যমগুলাের ইতিবাচক প্রচারে ক্ষমতাসীন সরকার বেকায়দা, বিব্রত ও অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়বারের মতাে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহে প্রতিনিধি প্রেরণ করে যার লক্ষ্য ছিল আসন্ন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে অবগত করানাে, সংকট নিরসনে পন্থা উদ্ভাবন এবং শান্তির অন্বেষায় ব্যর্থ হলে বিপুল বিপন্ন মানুষের জন্য প্রয়ােজনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করা হবে তার ইঙ্গিত প্রদান। | কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে ইউরােপের অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, সুইডেন, হল্যান্ড এবং ইতালি সফর করেন। তার এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে কী ঘটছে সে সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ও সেদেশের জনগণকে অবহিত করা। ভারতের কৃষিমন্ত্রী ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ বৈরুত ও পশ্চিম এশিয়ার চারটি দেশ সফর করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও ভারতের অবস্থান তুলে ধরেন। ভারতের বিমান ও পর্যটক মন্ত্রী ড, করণ সিং বার্লিনে পরিষ্কারভাবে বলেন যে, শরণার্থীদের বিপুল চাপ ভারতের পক্ষে এককভাবে বহন করা সম্ভব নয়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী ও উইলি স্টফন ও বিদেশমন্ত্রী ওট্টো উইনজারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ কথা বলেন।” | ৫ই সেপ্টেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেপাল সফরকালে প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের জন্যে প্রয়ােজনীয় পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানান।
৮. বেসরকারি কূটনেতিক তৎপরতা-জয়প্রকাশ। বাংলাদেশে সংঘঠিত অবর্ণনীয় মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা ও বিশাল মানবিক ট্রাজেডি বিশ্ব পরিসরে তুলে ধরার জন্য শুধু সরকারি উদ্যোগে নয় বেসরকারিভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তােলার লক্ষ্যে ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ ১৬ই মে থেকে ২৭শে জুন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া, জার্মানি, প্যারিস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, জাপান, সিঙ্গাপুর, মিশর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন শহর সফর করেন। তিনি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি শরণার্থী সমস্যা এবং পাকিস্তান বাহিনীর নির্যাতনসহ ভারতের ওপর প্রবল আর্থ-সামাজিক চাপের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বাঙালির ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁর সফরকালে বিদেশে বাংলাদেশের সমর্থনে গঠিত বিভিন্ন সমিতির আয়ােজিত অনুষ্ঠানেও বক্তৃতা করেন। মিশরঃ কায়রােতে সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশে জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেন, বাংলাদেশ সংকট অবিলম্বে সমাধান করা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। বিলম্ব হলে পূর্ববঙ্গ ভিয়েতনাম হবে’। ১৯শে মে কায়রােতে তিনি আরাে বলেন, পূর্ববঙ্গে রক্তপাত বন্ধ করে সেখানে সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সংযুক্ত আরব ও মিত্র মুসলিম দেশগুলি ইয়াহিয়ার উপর চাপ দেবে বলে ভারত আশা করেছিল। আরব দুনিয়ার বন্ধু হিসেবেই ভারত এই আশা করতে পারে। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ মিশনে একদল সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীর কাছে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, দ্রুত পূর্ববঙ্গ সংকটের সন্তোষজনক সমাধান না হলে চীনের জড়িয়ে পড়ার বিপদ রয়েছে। অনিশ্চয়তা চলতেই থাকবে। বৃহৎ শক্তি নাক গলাবে। সেখানে অবস্থা ভালাের দিকে না গেলে পূর্ববঙ্গ দ্বিতীয় ভিয়েতনামে পরিণত হবে।৩৩ | লন্ডন: ৪ঠা জুন জয়প্রকাশ নারায়ণ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। প্রথমেই তিনি দেখা করেন কমনওয়েলথ রিলেশনস অফিসের এন্থনী কেরশার সঙ্গে। কেরশা ভারত-পাকিস্তান সমস্যা সম্বন্ধে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল। নারায়ণ বলেছেন, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গণহত্যার ফলে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে চলে আসায় যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সেই ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের যথেষ্ট সহানুভূতি রয়েছে। কেরশা ভারতের এই সমস্যায় ব্রিটিশ সরকারের অকুণ্ঠ সহানুভূতি প্রকাশ করেন। নারায়ণের মতে, পশ্চিম পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য বন্ধ করার ব্যাপারে পশ্চিমা শক্তিগুলাের অনিচ্ছার কারণ আছে দু’টো। একটি হলাে পশ্চিমা শক্তিগুলাে মনে করছে সাহায্য বন্ধ করলে পাকিস্তানের কাছে পূর্বের পাওনা টাকা হয়তাে ফেরৎ পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, প্রয়ােজনীয় আর্থিক সাহায্য না পেলে পাকিস্তান সাহায্য লাভের জন্য হয়তাে চীনের দ্বারস্থ হবে। নারায়ণ এর আগে কায়রাে, রােম, বেলগ্রেড, মস্কো, হেলসিঙ্কি, বন এবং প্যারিস ঘুরে এসেছেন। লন্ডন থেকে ওয়াশিংটন এবং অটোয়া সফরে যাবেন। তার সফরের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সমস্যা বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করার দাবি তুলে ধরা। বাংলাদেশের ঘটনায় বিশ্ব সক্রিয় না হলে ভারত কড়া ব্যবস্থা নেবে ৬ই জুন লন্ডনে জয়প্রকাশ নারায়ণ দ্ব্যর্থহীনভাবে একথা ঘােষণা দিয়ে বলেন, বিশ্বকে অতি দ্রুত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা উপলব্ধি করতে হবে। না হলে ভারত একাই তার স্বার্থে ব্যবস্থা নেবে। ইতিমধ্যেই জনগণ, রাজনৈতিক দল এবং পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, কেউ কেউ মনে করেন আরাে দুর্গতি ও সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকলে মুক্তিসংগ্রাম স্তব্ধ হয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের অবস্থা আবার স্বাভাবিক হবে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল। পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে সাক্ষাৎকালে নারায়ণ তাঁকে বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ নেতাদের সঙ্গে আলােচনা করে তার এই ধারনা হয়েছে যে তাদের স্বাধীনতা ছাড়া আর অন্য কিছু মেনে নেবার কোনাে সম্ভাবনা নেই। এটা মেনে নিতে ব্রিটিশ সরকার কীভাবে পাকিস্তানকে বাধ্য করবে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সব। রকম সাহায্য বন্ধ করলেই এটা হবে। কেন না এখন যে সমস্ত সাহায্য করা হবে তা যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত হবে এবং স্বভাবতই সাহায্যকারী দেশ বাংলাদেশের ঘটনাবলির। জন্য দায়ী হবেন।১৩৫
হেলসিঙ্কি: মে মাসের শেষে ও জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে জয়প্রকাশ নারায়ণ হেলসিঙ্কি সফরে যান। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে বহুদেশের সমাজতন্ত্রী নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করেন। তিনি পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলার উইলি ব্রান্ট, ব্রিটেনের বিরােধী দলের নেতা হ্যারলন্ড উইলসন, নরওয়ে ও সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় এবং ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডের সমাজতন্ত্রী দলের নেতৃবর্গের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনা করেন।
ব্রান্ট বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে যথেষ্ট সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও তিনি। জানিয়েছেন পশ্চিম জার্মানি পাকিস্তানের উপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে অক্ষম। সম্মেলনের পর তিনি বনে যান। সেখানে পার্লামেন্ট সদস্য এবং ক্রিশ্চান ডেমােক্র্যাট পার্টির সদস্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। তিনি জানতে পারেন ভারতে আগত শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য পশ্চিম জার্মানির পার্লামেন্টে শীঘই একটি বাড়তি বাজেট পেশ করা হবে। জয়প্রকাশ নারায়ণ এরপর ফ্রান্সে যান। তাকে ফরাসি সরকারি সূত্র থেকে জানানাে হয়েছে যে, পাকিস্তানকে কোনাে অস্ত্র সাহায্য দেওয়া হচ্ছে না। তবে ফরাসি বেসরকারি অস্ত্র ব্যবসায়ীদের পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি।১৩৫ নিউইয়র্ক: ১৩ই জুন জাতিসংঘের সামনে এক সমাবেশে জয়প্রকাশ নারায়ণ। বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানপূর্বক শাস্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা না করতে পারলে উপমহাদেশে অশান্তি বৃদ্ধি পাবে এবং এর পরিণতি বিশ্বকে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। সমস্যার মূল বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬০ লক্ষ মানুষ ভারতে শরণার্থী। পাশ্চাত্য ও ইউরােপে সামান্য প্রতিক্রিয়া হয়েছে, এতে করে প্রতীয়মান হয় বিশ্ব বিবেক মৃত।’ ‘মুক্ত দুনিয়া’র নেতৃত্ব কেন নীরব। ফ্রীওয়াল্ড আজ বন্দি-বিশ্ব। প্রেসিডেন্ট নিক্সন, এডােয়ার্ড হীথ কেউ প্রকাশ্যে বলেছেন না, পাকিস্তানে যে সাহায্য যাবে তা মিলিটারিরা খেয়ে ফেলবে এবং তা হবে গণহত্যাকে সাহায্য। তাদের উচিত ইয়াহিয়া খানকে চাপ দেওয়া যাতে সে রাজনৈতিক সমাধান মেনে নেয়। সিঙ্গাপুর: ২৪শে জুন সিঙ্গাপুরে জয়প্রকাশ নারায়ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, বিপর্যয়ের হাত হতে রক্ষার জন্য অবিলম্বে বৃহৎশক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে রাজনৈতিক সমাধানে আসতে পারে। বাংলাদেশ মুক্ত হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের স্ট্রাটেজিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল না হলে মাওবাদী চীন সে শূন্যস্থান পূরণ করবে। সেজন্য অবিলম্বে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করা জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে আশু করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।১৩৭ বিদেশ সফরশেষে সংবাদপত্রে প্রদত্ত জয়প্রকাশ নারায়ণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এক বিবৃতিতে বলেন, অনেক রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকগণ আশ্বস্ত হতে পারছেন না যে, মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠবে। তারা মনে করেন, বাংলাদেশ সমস্যা ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সেজন্য বর্তমান সংকট তীব্র হবে কিনা এ সম্পর্কে তাদের সন্দেহ রয়েছে। তবে জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেন, ভারতের স্বাণে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাচ্ছে না, বরং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তাঁর উপদেষ্টাগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে ফেলেছে। প্রশ্নটি হলাে, কতদিন বলপূর্বক তারা বাংলাদেশ দখলে রাখতে পারবে। তিনি বলেন, আমি পরিষ্কার যে, স্বীকৃতির বিলম্ব হলে ও বাংলাদেশের সাহায্যে ভারত এগিয়ে না আসলে তা হবে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা। অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিহারে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সম্মেলন সমিতির এক ভাষণে জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেন যে, বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলছে, তাকে বাইরে থেকে মনে হবে গৃহযুদ্ধ।
কিন্তু বাস্তবে এ যুদ্ধ গৃহযুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী একটা জাতির সঙ্গে একটি মুক্তিকামী উপনিবেশিক রাষ্ট্রের জনগণের যুদ্ধ। হিসেবে গণ্য করা উচিত হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বার্তা বহন করে তিনি এটা উপলব্ধি করেছেন যে, বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশে পাকিস্তানি সামরিক চক্রের ভারতবিরােধী প্রচারকার্য ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তান বিদেশে এরকম একটা ধারণা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল যে পাকিস্তানে বাংলাদেশকে নিয়ে যে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে তার মূলে আছে ভারত। তবে বাংলাদেশের সমস্যাবলি নিয়ে বিশ্বের দুটি রাষ্ট্র অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তাকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে পাকিস্তানকে আর অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানে আরও ছ’সাত জাহাজ বােঝাই অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে। ফ্রান্স সরাসরি পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র না পাঠালেও, সেখানে খােলা বাজারে পাকিস্তানে জনগণের কাছে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক (Aid-Pakistan) কমিটি সাহায্য দেওয়া বন্ধ রাখলেও, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বলে পাকিস্তান সাহায্য পেতে থাকবেই।১৩৯ ৯, মুজিবনগর সরকারের প্রস্তাব ভারতের কাছে মুজিবনগর সরকার কতিপয় প্রস্তাব উত্থাপন করেন: ১. বাংলাদেশকে ভারত স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে; ২. পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ভারতের সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সমন্বয়ে যৌথ কমান্ড গঠন করতে হবে; এবং ৩. বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে জাতিসংঘে উত্থাপিত যে কোনাে ধরনের প্রস্তাব বাধাগ্রস্থ করতে হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটন থেকে ফিরে এসে এ প্রস্তাবগুলাের সঙ্গে একমত পােষণ করেন। ইন্দিরা গান্ধীর নিকট অজানা ছিল না যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাধাগ্রস্ত করার জন্য তার মিত্র দেশগুলাের নিকট বার্তাপ্রেরণ করেছেন।১৪০ ১০. পাকিস্তানের কূটনৈতিক চাল মূল সমস্যা নিরসনে না গিয়ে পাকিস্তান বিশ্বব্যাপী ধাপ্পা দিতে চেয়েছে এভাবে যে, শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবার ক্ষেত্রে তারা আন্তরিক। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান নতুন নিয়ােগপ্রাপ্ত আন্তসার্ভিস গােয়েন্দা প্রধান জেনারেল জিলানীর নিকট থেকে এই মর্মে রিপাের্ট পান যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং পাশাপাশি সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারী অস্ত্রশস্ত্র সমুদ্রপথে ভারতে প্রেরণ করছে। ইয়াহিয়া খান ত্বড়িৎ গতিতে গােপনে একটি শান্তি পরিকল্পনা ইসলামাবাদে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জয়কুমার অটলার হাতে পৌঁছে দেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এ বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে এই সবই ইয়াহিয়া খানের। ধাপ্পাবাজি। একই সাথে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ দেন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী দুটি। মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব গ্রহণের অনুরােধ করেন। ভুট্টো নুরুল আমিনের অধীনে উপপ্রধানমন্ত্রী হতে অস্বীকৃতি জানান, কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। ভারতীয় কূটনীতিক তৎপরতার বিপরীতে ইয়াহিয়া খান ২১শে মে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের ফর্মুলা ঘােষণা করেন এবং এর সম্পর্কে তিনি ২৫শে মে, ১লা জুন, ১০ই জুন, ১৮ই জুন এবং ২৮শে জুন শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ভারতের কোনাে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা সম্পর্কে কর্মকর্তাগণ জ্ঞাত ছিলেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, শরণার্থী সম্পর্কে মধ্য-এপ্রিলে সরকারের সিদ্ধান্ত হলে তাদের জন্য আশ্রয়ের। ব্যবস্থা করা এবং প্রয়ােজনমতে তাদের ক্যাম্পের বাইরে থাকার ব্যবস্থা করা। এ সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ৪ঠা মে বলেন, পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীদের স্থায়ীভাবে ভারত জায়গা দিবে না। যা প্যাকের মিটিং-এ আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এখানে লক্ষণীয় যে, অনেক শরণার্থী তাদের পূর্ব কোনাে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে, যাদেরকে সীমান্ত প্রহরীরা ক্যাম্পে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়নি। সে কারণে। প্যাকের সিদ্ধান্ত মােতাবেক শরণার্থীদের ক্যাম্পের অবস্থানের বিষয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।১৪২ এই পরিপ্রেক্ষিতে ২৮শে জুন ইয়াহিয়া খান ডা. এম. এ. মালিককে প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারি হিসেবে ছিন্নমূল ও শরণার্থীদের বিষয়টি দেখাশুনার জন্যে নিয়ােগ দেন। কিন্তু এই আবেদন ও কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে পড়ে। শরণার্থীরা পূর্ববঙ্গে ফিরে আসেননি। নয়াদিল্লি স্পষ্টত উপলব্ধি করে শরণার্থী সমস্যা সমাধানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের সমঝােতা হতে হবে। তাহলে শরণার্থী প্রত্যাবর্তন সম্ভব হবে। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের তত্ত্বাবধানে শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাব ভারত নাকচ করে দেয়। ক, উপনির্বাচন ঘােষণা: আরেক প্রহসন: নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হওয়ার ভারতীয় চাপের মুখে পাকিস্তান সামরিক জান্তা১৯৭০ সালের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে জাতীয় পরিষদের ৮০জনের সদস্যপদ বাতিল করে। তদস্থলে উপনির্বাচনের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানের দালালদের মনােনয়নের ব্যবস্থা করে সংসদ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই নির্বাচন ছিল কূটনেতিক ফৌশলে ধন্যতম ধাপ্পাবাজি। নয়াদিল্লি আরাে উদবিগ্ন হয়ে পড়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৮শে জুন তাঁর ভাষণে ইয়াহিয়া খান দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, তিনি নতুন নির্বাচন দেবেন না এবং পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবেন না। তিনি নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কথা পূণর্ব্যক্ত করে বলেন, আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্নতাবাদী দল এবং শেখ মুজিব দেশদ্রোহী। তিনি দেশকে বিভক্ত করার জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন যা বানচাল করে দেওয়া হয়েছে। ইয়াহিয়া খান ঘােষণা দেন শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে যােগসাজশে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তিনি আরাে বলেন, প্রতিবেশী ভারত পাকিস্তানকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করার এই সুযােগ হাতছাড়া করেনি। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জনবল এবং বস্তুগত সাহায্য দিয়ে পরিস্থিতিকে জ্বলন্ত করেছে। এগুলাে ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। এসব অন্ধকারের পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়ে পড়ে যখন সামরিক বাহিনী এগিয়ে যায়। | প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক সমঝােতার পরিকল্পনা ছিল: এক, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদী যারা পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে ধ্বংস করতে চায় তাদেরকে নির্মূল করে ফেলা; দুই, সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ভেতরে বিভক্ত সৃষ্টি; তিন, সামরিক প্রশাসক হিসেবে কমিটি অব এক্সপার্ট গঠন করে খসড়া শাসনতন্ত্র রচনা করা এবং তিনি নিজেই এই খসড়া শাসনতন্ত্র অনুসারে জাতির সামনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং জনমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দেবেন; এবং চার, রাজনৈতিক দলগুলাের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং আঞ্চলিক সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া অন্য কোনাে বিষয় নিয়ে সামনে এগুতে পারবে না সেক্ষেত্রে দলগুলােকে বাতিল করা যাবে। জুলাই মাসে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা রাজনৈতিক সমঝোতাকে দ্বিতীয় সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন।
১১. কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন মােড়। এই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তান সফরে যান। পাকিস্তান সরকার গােপনে সেখান থেকে চীনে যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করে। দিল্লি সফরকালে কিসিঞ্জার দেখতে পান ভারত তিক্ত, শত্রুতাপূর্ণ এবং যুদ্ধংদেহী। কিসিঞ্জার ভারত থেকে পরিষ্কার ধারনা পেয়েছেন সম্ভবত ভারত-পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে সেজন্য তিনি ভারতকে এই বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেন। তিনি এও উপলব্ধি করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে পাকিস্তানের প্রতি নিক্সন যে নীতি গ্রহণ করেছে তাতে তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি বিরাজ করছিল, যার সুযােগ ভারত নেবে এবং পাকিস্তানে আক্রমণ করবে। নিক্সনের চীন সফরকালে চীনের নিকট এই মনােভাব পেয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত যদি আক্রমণ করে তাহলে চীন নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকবে না। এই হুমকিতে হয়তাে ভারত পাকিস্তানে আক্রমণ করবে না। কিন্তু সি.আই.এ. রিপাের্টে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের কিছু অংশ দখল করে সেখানে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিষ্ঠা করবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে অংশ যদি ভারত দখল করে তাহলে পরিপূর্ণভাবে যুদ্ধ শুরু হবে। ইয়াহিয়া খান আরাে ঘােষণা করেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার জন্য মিলিটারি কোর্টে শেখ মুজিবের গােপন বিচার হবে। ইয়াহিয়া খানের এই ঘােষণায় ভারতের নীতিনির্ধারকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পাকিস্তান কোনোক্রমে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসবে না এবং শেখ মুজিবকে হত্যা করা হলে আওয়ামী লীগের ভিতরে সংহতি বিপন্ন হবে এবং কোন্দল মাথা চাড়া দিবে। এই কথা বিবেচনায় রেখে ৯ই আগস্ট সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করে। পাশাপাশি ইয়াহিয়া খান ১১ই আগস্ট ঘােষণা করেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যামেরা ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং ৭ই সেপ্টেম্বর প্রেসরিলিজের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, এই বিচার কার্য ২৮শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে এবং এর জন্য বিশজন স্বাক্ষীকে তলব করা হয়েছে। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের সংঘর্ষময় পরিস্থিতি এবং ৩রা ডিসেম্বর যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় বিচার কার্যের ঘােষণা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ক. আওয়ামী লীগ বিভক্তকরণের পাকিস্তানি চক্রান্ত : এই সময় আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করার জন্য সামরিক, বেসামরিক, গােয়েন্দা সংস্থা এবং প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় সদস্যদের ভিতর থেকে কাদের যােগ্য বা অযােগ্য ঘােষণা করা হবে সে সম্পর্কে তালিকা করে ইয়াহিয়াখানের নিকট পেশ করা হয়। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে নির্বাচিত ১৬০জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের মধ্যে ৭৯জনকে অযােগ্য ঘােষণা করা হয়। এর মধ্যে ৩০জনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে অভিযুক্ত করা হয়। ২২৮জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের মধ্যে ১৯৫জন সদস্যকে অযােগ্য ঘােষণা করা হয়। যারা যােগ্য ঘােষিত হয় তারা আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে সংসদে বসতে পারবে না। অযােগ্য ঘােষিত জাতীয় পরিষদের ৭৮টি আসন এবং ১০৫টি প্রাদেশিক পরিষদের আসন ২৫শে নভেম্বর ও ৯ই ডিসেম্বর নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত হয়। বাকি শূন্য আসনগুলাে পরবর্তীকালে সুনির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। বলে ঘােষণা করা হয়।১৯৬
১২ই অক্টোবর ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেন, ২০শে ডিসেম্বরের মধ্যে শাসনতন্ত্র জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে, ২৩শে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন শেষ হবে এবং জাতীয় পরিষদ ২৭শে ডিসেম্বর অধিবেশনে বসবে। এই ঘােষণায় মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম ও প্রতিরােধ বেগবান হয়ে উঠে এবং ভারত সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক শক্তি প্রয়ােগ বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় পাকিস্তান সরকার অনুধাবন করে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। ফলে সরকার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের কৌশল গ্রহণ করে। ২৬শে অক্টোবর নুরুল আমিন ছয়টি আওয়ামী বিরােধী দল নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন এবং জাতীয় পরিষদের ৭৮আসনে ও প্রাদেশিক পরিষদে ১৭৮আসন ভাগাভাগি হয়।” ৭ই ডিসেম্বর সরকার ঘােষণা করে, অসমাপ্ত নির্বাচন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। ইয়াহিয়া খানের এই পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়েছিল এই লক্ষ্য নিয়ে, ভারত কর্তৃক রাজনৈতিক সমাধান উপনির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংসদ তৈরি করা এবং তার মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা অনুযায়ী সংবিধান গ্রহণ ও রাজনৈতিক সমঝােতার উপনীত হওয়ার উপায় হিসেবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রকাশ্য উক্তি ছিল ৭০-এর নির্বাচন যথাযথ হয়নি, যদিও পূর্বে তিনি ঘােষণা দিয়েছিলেন এ নির্বাচন নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও সর্বজন গ্রহণযােগ্য, তা বিশ্ব গ্রহণ করেছে। বর্তমান অবস্থায় পূর্বের মত পাল্টিয়ে তিনি বক্তব্য প্রকাশ করেন যে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এসব জাতীয় সংসদ সদস্য এখন আর জনমতকে ধারণ করছেন না। আসলে এসবই ছিল ভারতীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপ মােকাবেলার ব্যর্থ কৌশল। থ, আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করার মার্কিন ষড়যন্ত্র : জুন মাসে ভারতের বিদেশমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের ট্রাজেডি সম্পর্কে অবহিত এবং পাকিস্তানে সামরিক সহযােগিতা প্রেরণ বন্ধ করার লক্ষ্যে আলােচনা করতে গেলে কার্যকর কোনাে ফল বয়ে আনতে পারেনি। সবকিছু অবগত থেকে যুক্তরাষ্ট্র “tilt in favour of Pakistan” এই নীতিতে অটল ছিল এবং যে কোনােভাবে পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণ যাতে অব্যাহত থাকে তার ব্যবস্থার জন্য কৌশল গ্রহণ করে। এই সময় কলকাতায় খন্দকার মােশতাক এবং জহিরুল কাইয়ুমের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল জেনারেল গ্রিফিং-এর সঙ্গে কলকাতায় বৈঠক করে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ধূর্ত কৌশল গ্রহণ করে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যেই রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা চালানাের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। স্বাধীনতার পরিবর্তে কনফেডারেশন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য জহিরুল কাইয়ুম, খন্দকার মােশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী প্রমুখের সঙ্গে কলকাতার মার্কিন কাউন্সিল অফিসের কর্মকর্তাগণ কমপক্ষে ১৩বার বৈঠক করেন এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ভাঙন সৃষ্টির অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। বিষয়টি ভারত সরকারের অবিদিত ছিল না। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ডি.পি, ধর-এর সঙ্গে পরামর্শ করে এই সর্বনাশা পদক্ষেপ বানচাল করে দেয় এবং বলতে গেলে তখন থেকেই খন্দকার মােশাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের হস্তক্ষেপে নামমাত্র খন্দকার মােশাককে ঐ পদে অকেজোভাবে বহাল রাখা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র। সচিব হেনরি কিসিঞ্জার লিখিত White House years” বইটিতে এই বিষয়ে বিশদ বিবরণ রয়েছে। পাকিস্তানের গােপন কূটনৈতিক ষড়যন্ত্র ও মার্কিন কভারড় কূটনৈতিক উদ্যোগ জাতিসংঘে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য দানের মাধ্যমে বানচাল করে দেন।
ভারতের বিদেশমন্ত্রী শরণ সিং জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিষয়টি যেভাবে তুলে ধরেছিলেন খন্দকার মােশাক-এর কার্যকলাপ ছিল তার বিপরীত। সেজন্য শেষ মুহুর্তে তাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া হয়নি। সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখে সর্দার শরণ সিং জাতিসংঘে বাংলাদেশের ঘটনাবলি বিশদভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভারতে শরণার্থীদের আগমনের স্রোতােধারা কখনই থেমে যাবে না অথবা তারা স্বদেশের মাটিতে ফেরত যাবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হওয়া যাবে। কারণ তিনি বাঙালিদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। কেবল পূর্ব বাংলার পক্ষে তারই একমাত্র কথা বলার অধিকার রয়েছে। ১২. বন্দি শেখ মুজিবের বিচার ৪, ৯ ও ১২ই আগস্ট, লােকসভায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক শেখ মুজিবের হত্যার হুমকি প্রসঙ্গে তিন দিনব্যাপী ব্যাপক আলােচনা হয়।* ১২ই আগস্ট, পাক-প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার এবং প্রাণদণ্ডের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যসভায় আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে চতুর্থ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৩. সমর কূটনীতি: মার্কিন গােপন নথিতে পাকিস্তানের আক্রমণ নিক্সন প্রেসিডেন্টসিয়াল ম্যাটেরিয়ালস, জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত ফাইল থেকে আরাে জানা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পাকিস্তান সর্বাত্মকভাবে ভারতকে আক্রমণ করেছে। ৫:৩০ মিনিটে পাকিস্তানি এয়ারফোর্স ভারতের ৬টি বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করেছে। পাকিস্তানের আর্টিলারি বাহিনী সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর উপর কামান দাগছে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “Iad no option but to adopt a war footing.” ঐ রিপাের্টে আরাে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তান অভিযােগ করেছে ভারতের যুদ্ধবিমান তিন-চারদিন হলাে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণাত্মক হানা দিচ্ছে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ৩:৩০ মিনিটে এবং ৪টায় রহিম ইয়ার খান-এর দক্ষিণে কাশ্মীর এলাকায় হানা দিয়েছে। পাকিস্তান বিমান বাহিনী তার পাল্টা জবাব দিয়েছে। সি.আই.এ. রিপাের্টে বলা হয়েছে, কোনাে পক্ষ আগে আক্রমণের সূচনা করেছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিকসন ও হেনরি কিসিঞ্জার ভারতকে প্রথম আক্রমণকারী দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

১৪, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে কূটনৈতিক সহায়তা বিশ্বব্যাপী মুজিবনগর সরকার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে উপস্থিত করেছে প্রবাসী বাঙালিদের কার্যক্রম ও পাকিস্তান থেকে পদত্যাগ করে আগত কূটনৈতিকবৃন্দের সাহসী। পদক্ষেপ। ভারত সরকারের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রচার বিভাগ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে পুস্তক, পত্রিকা, দলিল, প্রামাণ্য চিত্র, চলচ্চিত্র তৈরি করে ভারতীয় দূতাবাসের সাহায্যে মুজিবনগর সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা সারাবিশ্বে ব্যাপক প্রচার করে। এসব পুস্তক-পত্রিকায় পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন ও শরণার্থী সমস্যার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযােগ্য। কেবল সরকারি প্রচার বিভাগ নয় বেসরকারি গণমাধ্যমেও মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রাধান্য পায়। ভারতীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে সহায়ক হয়েছিল। কূটনীতিকদের বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বনের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পাকিস্তানের পক্ষত্যাগকারী কূটনীতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যােগোযােগ প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারত প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সহায়তা প্রদান করে। এই কূটনীতিকদের দিয়েই বাংলাদেশ সরকার কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, নিউইয়ক, ওয়াশিংটন এবং হংকংয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়। কূটনৈতিক এসব গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়গুলাে দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলােচিত হয়েছে। ভারতীয় কূটনীতির ভিন্ন একটি আইনটি কৌশল ছিল প্রবাসী বাঙালিদের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রচার কাজ ও তৎপরতা পরিচালনা করে। ভারতের সাহায্যে মুজিবনগর সরকার বিদেশে কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। পৃথিবীর সর্বত্র ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনগুলাে সাহায্য গ্রহণ করে। বেসামরিক জনগণের ওপর আক্রমণকে ‘gravest and the most tragic development’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রাধান্য দেওয়া হয় ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রকে, বিশেষভাবে জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে দু’টি দেশ পরিকল্পিত প্রচারণা চালায়। এক্ষেত্রে ভারতীয় দূতাবাসসহ প্রবাসী ভারতীয় নাগরিকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে লন্ডনে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারণার ক্ষেত্রেও বিচারপতি চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিশেষভাবে ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত। জাতিংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধির কাছে বাংলাদেশের সংগ্রামের যৌক্তিকতা বর্ণনা করেন। বিশ্বজনমত সংগঠনে জাতিসংঘ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ভারতীয় বাঙালি ড, যােগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলকে বিশেষ সহায়তা দেন। ১৫. কতিপয় মৌলিক প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিবাহিনী হাতে অস্ত্র প্রসঙ্গে: সিডনি এইচ. শ্যনবার্গের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের অস্ত্রপ্রাপ্তি সম্পর্কে যেখানে পূর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র সম্পর্কে বলতে

দ্বিধান্বিত ছিলেন; কিন্তু অনুরূপ প্রশ্নের জবাবে ১৯শে অক্টোবর নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বব্যাপী নেটওয়াক রয়েছে, বিশ্বব্যাপী তাদের জনগণ। এবং তাদের জন্য বহু দরজা খােলা হয়েছে। যাই হােক না কেন, অস্ত্র থাক বা না থাক কেউ তাঁদের স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করে দিতে পারবে না।
শ্যানবার্গ লিখেছেন, ৫৩ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শান্তি-সংলাপ প্রত্যাখ্যান করে। বলেন, পাকিস্তানকে প্রথম বাংলাদেশের সংকট সেদেশের জনপ্রতিনিধিদের সাথে। সমাধান করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁদের নীতি দীর্ঘ দৃষ্টিভঙ্গি সুদূরপ্রসারী নয়। তিনি আরােও বলেন, মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অবনতি ঘটলেও মার্কিন জনগণের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব অটুট রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র শুধু কমিউনিজম ঠেকানাের জন্য নয়, তারা উপমহাদেশে যা ভারতকে বলা হয়েছে এবং যতদূর জানা যাচ্ছে তা হলাে, পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করছে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের ভালাে বােঝাপড়া রয়েছে। ক. পর্যবেক্ষক নিয়ােগ প্রসঙ্গে: ২৭শে অক্টোবর অস্ট্রীয় বেতারে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী। ইন্দিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল জাতিসংঘ কর্তৃক উভয় সীমান্তে পর্যবেক্ষক নিয়ােগে পাকিস্তান সম্মত হলেও ভারত বিরােধীতা করছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, ভারতে ইতােমধ্যে জাতিসংঘের দশজন পর্যবেক্ষক রয়েছে। তারা সীমান্ত পরিদর্শন করছেন। প্রতিদিন ৩২-৪২ হাজার শরণার্থী ভারতে আসছে। কারণ গণহত্যা, নির্যাতন, অত্যাচার থামেনি। যদি কেউ নতুন করে পর্যবেক্ষক পাঠাতে আগ্রহী হয় তাহলে প্রথমেই অগণিত শরণার্থীদের আসা বন্ধ করতে হবে, তারপরে অন্য বিষয় ভেবে দেখা যাবে।১৫৮
খ, জোটনিরপেক্ষ নীতির ব্যাখ্যা: ব্রিটিশ পত্রিকা ‘অবজারভার’ ইন্দিরা গান্ধীকে ‘তীক্ষ নখরযুক্ত শান্তির পায়রা’ (dove with sharp claws) অভিহিত করলেও পরিস্থিতি আরাে অবনতি হলে তিনি কী করবেন এই প্রশ্নের জবাবে শ্রীমতী গান্ধী তার গৃহীত নীতির পুনরুল্লেখ করেন, সমস্যা সমাধানে আমরা যুদ্ধে বিশ্বাস করি না। কিন্তু ভারত অবশ্যই জাতীয় স্বার্থে নিরাপত্তা বিধান করবে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্ব শান্তি ও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক ঘটনার প্রতিটি বিষয়ে নিজস্ব স্বাধীন বিচার বিবেচনা ও কার্যক্রম পরিচালনা করার লক্ষ্যে জোটনিরপেক্ষ নীতি প্রণীত। সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করে ভারত সেই নীতি থেকে সরে আসেনি।১৫৯। গ. ভারত-সােভিয়েত চুক্তি: ৭ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের এন.বি.সি, টেলিভিশনে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিক ফ্রেডরিকের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সমস্যাটি ভারত ও পাকিস্তানের নয়, বিষয়টি হলাে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের নির্বাচিত নেতৃত্বের। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারত ডিফেন্স প্যাক্ট করেনি। এটা শুধু শান্তি, সহযােগিতা, বন্ধুত্বের চুক্তি মাত্র। এটা কোনাে সামরিক চুক্তি নয়। ঘ, মৌলিক সমাধান প্রয়ােজন: ৮ই নভেম্বর প্যারিসের রাষ্ট্রীয় ভােজসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ভারত সর্বাত্মক আত্মসংযম করে আছে। কিন্তু সন্দেহ নেই ভারতের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন। শুধু তাই নয়, এটা সমগ্র অঞ্চলের জন্যই শান্তির প্রতি হুমকি। বর্তমান সংকটের মৌলিক সমাধান প্রয়ােজন। কাশকর রাজনৈতিক সমাধান দরকার যা বাংলাদেশের জনগণ ও তাদের প্রতিনিধিরা। গ্রহণ করে।১৬১ ঙ, তৃতীয় পার্টির মাধ্যমে অস্ত্র বিক্রয়: তিন সপ্তাহের সফর শেষে শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি ফিরে এসে বলেন, “বিশ্ব এখন বাংলাদেশ সংকট সম্পর্কে আগের চেয়ে বেশি সচেতন’। ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের নেতৃবৃন্দ ভাবছেন যেমনটি আমিও ভাবছি। তিনি সীমান্ত সমস্যার বিষয়টি ওয়াকিবহাল আছেন। তিনি আরাে বলেন, তার কাছে এটা পরিষ্কার নয় যে অস্ত্র বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা আছে তৃতীয় পার্টির মাধ্যমে মার্কিন অস্ত্র বিক্রয় করবে কিনা। তিনি এই বিষয়ে অনিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট উইলিয়াম রজার্স বিবৃতিতে। বলেছেন যে, পাকিস্তান-ভারত সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্র দূরে থাকবে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে মুসলিম দেশগুলাের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে যুদ্ধ বিমান ও অস্ত্র প্রেরণ করে। চ, কূটনৈতিক ফর্মুলা: ১৫ই নভেম্বর, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং জার্মানি সফরশেষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লােকসভায় একটি বিবৃতি প্রদান করেন।৬৯ ১৫ই নভেম্বর অটলবিহারী বাজপেয়ী সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্রহসন নির্বাচন করছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যারা নির্বাচনে হেরে গিয়েছেন তাঁদের জনপ্রতিনিধি বানানাে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে গােপনে প্রতিনিধি নির্বাচন করে নতুন লােক নিয়ে আসা হবে এবং একটি পুতুল সরকার গঠন করা হবে। তখন রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নটি কীভাবে সমাধান করা হবে। তখন তাঁদের সঙ্গে ইয়াহিয়া খান একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছতে সক্ষম হবে এবং বিশ্বকে দেখাতে পারবে যে, জনপ্রতিনিধির হাতেই তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন, যারা স্বাধীন বাংলাদেশ চায় না। চায় একটি শিথিল কনফেডারেশন জাতীয় রাষ্ট্র। বিশ্ব ইতিহাসে এরূপ নজির মেলে। এ প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্তগ্রহণে ভারত পিছপা হবে না। জ, ভারত চোখ বন্ধ করেনি: ১৫ই নভেম্বর নিউজউইক-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, মােটামুটিভাবে আমি বলতে পারি ভারতের জনগণ যুদ্ধ চায় না। কিছু সােচ্চার কণ্ঠ এবং উগ্রদল যুদ্ধের স্বপক্ষে কথা বলছে। আমি আশা করি, যুদ্ধ হবে না এবং যুদ্ধ যাতে না হয় তার জন্য সবকিছুই করছি। যুদ্ধের হুমকি সম্ভবত কম এই কারণে যে, আমরা পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে সৈন্য পাঠিয়েছি, কিন্তু পূর্ব দিকে অবস্থা এমন যে সেখানে যুদ্ধের হুমকি বিরাজ করছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিনই ক্রমাগত বিপদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে ভারত চোখ বন্ধ করে রাখেনি।
ঝ, অসুখের চিকিৎসা করতে হবে উপসর্গকে নয়: বি.বি.সি,’তে ১৬ই নভেম্বর প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক যে, যুক্তরাষ্ট্র শুধু শরণার্থীদের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়েছে, কিন্তু সমস্যার মূল কারণ অনুসন্ধান করে তা সমাধানের পথে অগ্রসর হননি। সাংবাদিক মার্ক টালির এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা পূর্ববঙ্গের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ কীভাবে সমস্যার সমাধান করবে তারাই জানেন, যেখানে এখন পর্যন্ত রক্ত ঝরছে এবং বুদ্ধিজীবী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তরুণদের হত্যা করা হচ্ছে। মার্ক টালি তাকে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, শত শত পর্যবেক্ষক আসলেও কিছুই হবে না। তারা কিছুই করতে পারবে না। জাতিসংঘ দুই দেশকে এক পাল্লায় মাপতে পারে না। গেরিলাদের আশ্রয় ও সাহায্যের জন্য ভারতকে দায়ী করা হচ্ছে এই অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত লাগােয়া সেজন্য জনগণের আসা-যাওয়া রােধ করা সম্ভব নয়। সাহায্যের ব্যাপারে আমি বলতে পারি, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশে প্রচুর পূর্ববঙ্গের প্রবাসী বসবাস করে। যারা এই সংগ্রামকে সমর্থন করেছে। তাছাড়া গেরিলারা সমগ্র বাংলাদেশে তৎপর, শুধু ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি না। তাছাড়া তাদের রয়েছে আধা সামরিক বাহিনী এবং সামরিক বাহিনী যাদের কাছে পূর্ব থেকেই অস্ত্র ছিল। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, এটা সীমান্ত সমস্যা নয়, এখানে মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে, আপনাকে অসুখের চিকিৎসা করতে হবে উপসর্গকে নয়। মার্ক টালি তাকে প্রশ্ন করেন যে, বর্তমান অবস্থা কি যুদ্ধের দিকে চলে যাচ্ছে? উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধ খুবই খারাপ বিষয়। ভারত সবসময় যুদ্ধের বিরুদ্ধে, যেখানে তা। ঘটুক না কেন। কিন্তু কতগুলাে বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেমন আমরা শুধু ভারতের জনগণের জন্য অনুভব করি না, আমরা এশিয়া ও বিশ্বের শান্তি, স্থিতিশীলতা, সংহতি এবং ভারতের নিরাপত্তার বিষয়টি মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি না এই বিষয়গুলাে থেকে বিশ্ব তাঁদের মনােযােগ অন্যদিকে তাড়িত করতে পারবে। মার্ক টালি তাকে প্রশ্ন করেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তার সঙ্গে আলােচনা করতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করেছিলেন কেন? ইন্দিরা গান্ধী বলেন, তার সাথে কথা এবং কী জন্য। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সর্বত্র বলে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তাই যদি হয় তার অর্থ দাঁড়ায় তিনি বাস্তব কথা বলছেন না অথবা অসত্য কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের কিছু রাষ্ট্র পাকিস্তানকে কিংবা পাকিস্তানের জনগণকে সহায়তা করছেন বরং তারা সামরিক জান্তাকে সাহায্য করছে যা জনগণের কল্যাণে আসবে না।১৬৭

ঞ, বিশ্ববাসী বাংলাদেশ সম্পর্কে আরাে সচেতন হয়েছে : ২৩শে নভেম্বর, বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে চীন কর্তৃক পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনের ভূমিকা গ্রহণের বিষয় নিয়ে রাজ্যসভায় বিস্তারিত আলােচনা হয়। ৩০শে নভেম্বর, তিন সপ্তাহব্যাপী ইউরােপের কয়েকটি দেশ সফরশেষে দেশে ফিরে এর যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তার ওপর প্রধানমন্ত্রীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়।

জাতিসংঘ অচলাবস্থা: জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানভারত যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারে যেসব প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়েছিল সােভিয়েত রাশিয়া সে প্রস্তাবে ভেটো প্রয়ােগ করে। ফলে পাকিস্তানের প্রতি ঝুকে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রস্তাবগুলাে অকেজো হয়ে পড়ে। জাতিসংঘের পরিস্থিতি এই মুহুর্তে স্ট্যাটিক হয়ে আছে। জাপান এবং বেলজিয়াম-এর স্থায়ী প্রতিনিধির নিকট থেকে কোনাে উৎসাহ না পেয়ে থমকে আছে। বর্তমান মুহুর্তে সেভিয়েত এবং ভারত চুপ করে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মনে করে অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক হওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান যদি প্রত্যাশা করে তাহলে চীন। তাদের পক্ষে ভেটো প্রয়ােগ করবে। অন্যদিকে, এটাও প্রতীয়মান হয়েছে ভারত চাইলে সােভিয়েত তাদের পক্ষে ভেটো দেবে। মার্কিন সিক্রেট ডকুমেন্ট থেকে জানা যায়, তাঁরা। ডিসেম্বর হংকঙের চায়না ওয়াচার এই মর্মে রিপাের্ট দিয়েছে যে, চীনের মিডিয়াগুলাে ১০ দিন ব্যাপকভাবে ভারতবিরােধী প্রচার চালিয়েছে। তারা বিভিন্ন প্রতিবেদন, বর্ণনা এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভারতকে সামরিক আক্রমণকারী ‘(armed aggression)’ উস্কানীদাতা হিসেবে দোষারােপ করেছে। হঠাৎ করেই সােভিয়েত রাশিয়ার ভারত সংশ্লেষকে (ভারত-সােভিয়েত চুক্তি) তারা সরাসরি আক্রমণ করেছে। চীনা জনগণ। সাধারণভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রাথমিকভাবে ভারতকে সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব কাউল এ ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে। তিনি বন্ধুসুলভভাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিংকে বলেছেন, ভারতকে কেউ এখন পর্যন্ত কোনাে দেশই চাপ প্রয়ােগ করেনি। তিনি কিটিংকে আরাে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এটা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র একই ধরনের মূল্যবােধ এবং গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাস করে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র চীনকে বারবার প্ররােচিত করেছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। শেষ পর্যায় পর্যন্ত চীন দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানের পক্ষে জাতিসংঘে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। ১৬. ভারতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত: ধারাবাহিক প্রস্তুতি অক্টোবরের ৩য় সপ্তাহের মধ্যেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পাকিস্তান হতে বাংলাদেশ স্বাধীন হােক এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সমর্থনযােগ্য ছিল না। ভারত প্রথম থেকেই এটা অনুধাবন করতে সক্ষম হয় যে, আন্তর্জাতিক মৌলিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াকে কেউ সমর্থন দেবে না। এমতাবস্থায় ভারত সরকার মধ্য-মে মাসে প্যাকের সঙ্গে আলােচনা করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে মূলত ৪টি বিষয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন দিতে হয় : ১. গেরিলা যুদ্ধ জোরদার করার লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং তাদের প্রশিক্ষণের জন্য সামরিক বিশেষজ্ঞদের নির্দেশ প্রদান; ২. ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়ার চূড়ান্ত নির্দেশ প্রদান; ৩. অবিলম্বে বিদেশে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশা বিশ্ব পরিসরে তুলে ধরা এবং বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্ব জনমত গঠন; এবং ৪. সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার বন্ধ এবং তার মুক্তি এবং তাঁর সঙ্গে আলােচনা করে উপমহাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতির নিরসন। এর পূর্বেই ডি.পি, ধর ভারতের বিশেষজ্ঞদের নিকট একটি পজিশন-পেপার তৈরি করার ব্যবস্থা করেন। পজিশন পেপার বিশ্লেষণে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে আস্থাশীল নয়। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা স্থাপন করতে সক্ষম হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাকিস্তানকে সমর্থন করবে। ভারত সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র এবং গণতান্ত্রিক দেশসমূহ এবং চীন ভারতকে বাধা দেবে না, কিন্তু রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে পাকিস্তানকে তারা সমর্থন যােগাবে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে গেলে পাকিস্তান তার মিত্ররা অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা নেবে। মুসলিম দেশগুলাে পাকিস্তান সামরিক জান্তাকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বস্তুগত সাহায্য প্রদান করবে। এমনকি জোটনিরপেক্ষ দেশগুলাের অনেকেই পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেবে। শুধু সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার মিত্র শক্তি ভারতের পক্ষে থাকবে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই বিদেশে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও ভারতের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। এমন কি, ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বব্যাপী ঝটিকা সফরে বের হন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন-এর ভূমিকা কী হবে তা অজানা ছিল না। ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে এটা পরিষ্কার উপলব্ধি করেছিলেন যে, আলােচনার মাধ্যমে সকল সমঝােতার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম, এ. জি. ওসমানী ভারতের সামরিক কর্মকর্তাদের এই ধারণা দিয়েছিলেন যে, শক্তিশালী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যে সকল গেরিলা গ্রুপগুলাে কাজ করছে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ ব্যতীত তাদের আশা ক্রমশ অপসৃত হচ্ছে। সেজন্য তিনি যথাশীঘ্র ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ কামনা করেন।১৭০
১৭. কূটনীতিক যুদ্ধের শেষ প্রান্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র সফর সমাপ্ত হবার পর যুক্তরাষ্ট্রের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ঐ জেদি, সাহসী ও অনমনীয় নারীর বাংলাদেশ সংকট নিরসনে যুদ্ধের মাধ্যমে হলেও ঝুঁকি নেবেন। সামরিক পথেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সিদ্ধান্ত মােতাবেক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট এই মর্মে গোপন নির্দেশ প্রদান করা হয় যে, তারা যে কোনাে আক্রমণের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং বিশ্বজনমত তাদর পক্ষে আনার জন্য যেন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ অবস্থাকে। সামনে রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সীমান্তের চারদিকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ প্রস্তুতির সিগন্যাল প্রদান করেন। ২২শে নভেম্বর থেকে প্রকৃতপক্ষে বয়রা সীমান্ত

সংঘর্ষের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ সূচনা হয়। এবং ২৮ থেকে ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে। মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য পূর্বের যে প্রস্তাবগুলাে দিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধী তা অনুমােদন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ১লা ডিসেম্বর থেকে ৩রা। ডিসেম্বর পর্যন্ত গৃহীত পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য ব্যস্ত থাকেন। ঐ সময় তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের অনীহা সত্ত্বেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ডি.পি, ধর সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত ভারতের শীর্ষ সামরিক কমান্ডকে জয়েন্ট কমান্ড স্ট্রাকচারে এম,এ,জি ওসমানীকে যৌথ মিত্র বাহিনীতে কাউন্টার-পার্ট হিসেবে। জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে সমর্থ হন। এই সমঝোতা ডিসেম্বরের ১ থেকে ৩ তারিখের ভেতরে সম্পন্ন হয়। | ২রা ডিসেম্বর ওয়াশিংটন পােস্ট রিপাের্ট থেকে জানা যায় ভারতীয় বাহিনী এবং গেরিলা যােদ্ধারা একত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করেছে। সৈন্যবল এবং সরবরাহের অপ্রতুলতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতােমধ্যেই বিভিন্ন অবস্থান থেকে সরে গেছে। আরাে লক্ষণীয় ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলারা বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করে ফেলেছে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাংকারে ঠেলে দিয়েছে। অনেক শহরে, এমনকি ঢাকা থেকে ১৭ মাইলের ভেতরে গেরিলা যােদ্ধারা চলে এসেছে এবং বহু জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে  ভারত তার নৌবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর নাবিকদের যুক্ত করে পাকিস্তানি নৌপথকে ব্লক করে দিয়েছে। ৩রা ডিসেম্বর গান্ধী যখন কলকাতায় বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন তখনই | চিরকুট পেলেন ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছে এবং ভারতের  বিমান ঘাঁটি অমৃতশ্বর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্ডীপুর, যােধপুর, আমবালা, আগ্রা, জ, পাঞ্জাব ও রাজস্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে। একই সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সোলায়মানকি, খেমকারান, পুঞ্চ এবং অন্যান্য সেক্টরে আক্রমণ চালায়। এ সম্পর্কে strata u facet- “The fool has done exactly what one had expected.”** এর পূর্বে ২৫শে নভেম্বর পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান CBCTA, “In ten days, I might not be here in Rawalpindi. I will be fighting a war,১৭৩ ৩রা ডিসেম্বর থেকেই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৮, সমর কূটনীতি: ধারাবাহিক প্রস্তুতি ২৪শে এপ্রিল কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রাম এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন | যে, ভারতীয় এলাকায় পাকিস্তানের কোনাে সামরিক অভিযানই বরদাস্ত করবে না। পশ্চিমবঙ্গে বনগাঁর অনতিদূরে ভারতীয় সীমান্তে পাকিস্তানি গােলাবর্ষণের সংবাদ পেয়ে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই হুশিয়ারি দেন। প্রসঙ্গত জগজীবন রাম বলেন, ভারতকে

সর্বক্ষণ সজাগ-সতর্ক এবং ভারতের মাটিতে যে কোনাে আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ভারত-তিব্বত সীমান্ত বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই কথাগুলাে বলেন। তিনি ভারতের মাটিতে গােলা ফেলা বন্ধ কর নতুবা পরিণামের জন্য দায়ী হবে’, পাকিস্তানের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন ভারতীয় সীমান্ত বনগাঁর কাছে সকালে পাকিস্তানি গােলা এসে পড়ে। তাছাড়া এক কোম্পানি পাকিস্তান ফৌজ সীমান্ত সীমার পাঁচ কিলােমিটার ভেতরে এসে, পেটরাপােলের রেল লাইনের কাছে অবস্থান নিয়ে, এক ঘন্টা ধরে ভারতীয় গ্রামগুলাের উপর গুলি চালায়। পরে তারা বেনাপােলে হটে যায়। নয়াদিল্লি থেকে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। দাবি করা হয়েছে যে, পাকিস্তানকে কথা দিতে হবে যে, এ ধরনের ব্যাপার আর ঘটবে না, আর না হলে সম্ভাব্য পরিণাম যা ঘটবে তার জন্য পাকিস্তানি দায়ী হবে। বহিঃবিষয়ক মন্ত্রণালয় পাক হাইকমিশনকে ওই ঘটনাগুলাের প্রতিবাদে যে নােট পাঠিয়েছে, তা রীতিমতাে কড়া ধাচের। এ ছাড়া অন্য একটি নােটে পাকিস্তানকে জানানাে হয়েছে যে, ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর লােকেরা কখনই পাকিস্তানে প্রবেশ করেননি। এ বিষয়ে পাকিস্তানের ১৪ই এপ্রিলের অভিযােগ একবারেই ভিত্তিহীন উল্লেখ করে ভারত পাকিস্তানকে দুটি নোেট পাঠিয়েছে।
ভারতের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম হতেই সামরিক হস্তক্ষেপের যে জোরালাে দাবি উত্থাপিত হয় তা পার্লামেন্টে কার্য-বিশ্লেষণে লক্ষ্য করা যায়। ২৪শে মে, লােকসভায় পূর্বসীমান্তে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আক্রমণাত্মক তৎপরতা সম্পর্কে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে সদস্যদের দাবি ছিল এই ধরনের আক্রমণাত্মক ঘটনা আন্তর্জাতিক রীতি-নীতির বরখেলাপ এবং ভারতীয় সার্বভৌম সত্ত্বার অবমাননা। এ ব্যাপারে ভারত সরকার পাল্টা কী ব্যবস্থা নিয়েছে তার জবাবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রামের মন্তব্য ছিল, পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশে যা ঘটছে এই ঘটনাবলীকে এর বাইরে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ঠিক হবে না। বাংলাদেশের সাহসী জনগণ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের সংকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সংগ্রামী দেশপ্রেমিক জনগণ সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তুলেছে। তারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্যরা যেভাবে আক্রমণ করেছে তার যথাযথ মােকাবেলা করা হবে। অটল বিহারী বাজপেয়ীর প্রশ্নের জবাবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা পাঠ করে শােনান। পার্লামেন্টে কল এটেনশনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৭শে মে সীমান্তে পাকিস্তান। সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্বাঞ্চলে শেল নিক্ষেপের প্রেক্ষিতে সরকারি পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানিরা গ্রাউন্ড রুলস-এর কোনাে তােয়াক্কা করছে না। কিন্তু ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কোনাে প্রকার দুর্বলতা দেখাবে না। সমর গুহ প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, গ্রাউন্ড রুল বলতে আমরা কী বুঝবাে? শুধু কি একতরফাভাবেই ভারত গ্রাউন্ড রুলস্ মেনে চলবে? কেন সরকার পক্ষ থেকে দৃঢ় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? প্রতিমন্ত্রী তার জবাবে বলেন, পুনরায় যদি পরিস্থিতি এরূপ হয় তাহলে ভারতের পক্ষে পদ্ধতিগত বিষয় বাধা হবে না। পরিস্থিতি যাই হােক না কেন ভারত তা মােকাবেলা যাবে।” ২১শে জুলাই পার্লামেন্টে জরুরি বিষয়ে কল এটেনশনে পাকিস্তানের লেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার যে হুমকি দেন, সে সম্পর্কে আলােচনায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি এবং সদস্যদের প্রশ্ন এবং বক্তব্য নিয়ে পার্লামেন্ট উত্তপ্ত হয়ে উঠে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সারমর্ম ছিল, কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তান বিশ্বকে জানাতে চায় বাংলাদেশ সমস্যা বলে কিছু নেই এটি সম্পূর্ণ ভারত ও পাকিস্তানের সমস্যা। এ বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য হলাে, বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তান যে বর্বর আক্রমণ করেছে যার ফলে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। পাকিস্তান সরকারকেই বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে হবে। যে পর্যন্ত পাকিস্তানের সরকার এটি না করবে সে পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের মাটিকে মুক্ত করবে। মুক্তিবাহিনী আক্রমণকে অজুহাত হিসেবে ধরে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে ভারত নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বিশ্বকে ভ্রিান্ত করতে চায় এভাবে যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানের একটি অংশ দখল করে সে জায়গায় বাংলাদেশ সরকারকে পুনর্বাসিত করতে চায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানের অংশ দখল করার কোনাে ইচ্ছা ভারতের নেই। আলােচনায় জনৈক সদস্য (এন, জি, গােরে) পরিষ্কারভাবে ইয়াহিয়া খানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “তিনি যুদ্ধ ঘােষণা করবেন এবং তিনি একা নন।” বাংলাদেশ থেকে অস্ত্রের মুখে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী পাঠানাের অর্থই হলাে এক ধরনের সামাজিক আক্রমণ (civil invasion) । এর উপরে যদি পাকিস্তান সত্যি আক্রমণ করে বসে তাহলে ভারত কি ভূমিকা নেবে? পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের জাতীয় স্বার্থে এসব সূক্ষ্ম বিষয়ে পার্লামেন্টে খােলামেলা সবকিছু আলােচনা না করার জন্য আবেদন জানান। ১৫ই নভেম্বর ভারত সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কে প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে কল এটেনশনের জবাবে বলতে হয়, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্র্যাশ ইন্ডিয়া’, ‘কনকার ইন্ডিয়া’ এবং ‘জিহাদের স্লোগান’ পাকিস্তানের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে। এর অর্থ হলাে, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মানসিক প্রস্তুতি। পাকিস্ত নি সামরিক বাহিনী উভয় সীমান্তে যুদ্ধের জন্য সমবেত হয়েছে। তাঁদের বিমান আকাশ সীমা লঙ্ঘন করেছে। এমতাবস্থায় ভারত সশস্ত্র বাহিনীকে উভয় সীমান্তে সতর্কতামূলকভাবে মােতায়েন করা হয়েছে। ভারত তার আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত এবং শত্রুকে তাদের মাটিতে হটিয়ে দিতে সক্ষম। এই উত্তেজক পরিস্থিতির মূল জেনেসিস হলাে, “বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যুদ্ধকে পাকিস্তান। সামরিক জান্তা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে রূপান্তরিত করতে চায়।” | মুক্তিবাহিনী প্রসঙ্গে তিনি সংসদকে জানান, বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাঙালি যারা ইউরােপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে তারা মুক্তিবাহিনীর জন্য নৌ, বিমান এবং যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। এ সময় অটলবিহারী বাজপেয়ী পার্লামেন্টে পাল্টা। 
প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, শরণার্থী ঠেলে দেওয়া, আকাশসীমা লঙ্ন, প্রতিদিন। গুলিবর্ষণ এগুলাে যদি হামলা না হয় তাহলে হামলা কোনটি? তিনি আরাে বলেন, আগে বলা হয়েছিল পাকিস্তান বিমান গুলি করে ফেলে দেওয়া হবে, এখন বলা হচ্ছে তাড়িয়ে দেয়া হবে। এ যাবৎ একটি বিমানও ফেলা হয়নি, যদিও পাকিস্তান ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। ১৮ই নভেম্বর, পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তানের সেনাবাহিন কর্তৃক ভারতের প্রতি অব্যাহত শত্রুতামূলক কার্যকলাপের ফলে সৃষ্ট মারাত্মক পরিস্থিতির ওপর রাজ্যসভায় আলােচনা হয়। প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী সংসদে সরকার পক্ষ থেকে পূর্বে যা বলা হয়েছে তারই পুনরুক্তি করে বলেন, সীমান্তে সশস্ত্র বাহিনীকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় প্রেরণ করা হয়েছে, যেক্ষেত্রে তারা যেকোনাে পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য তৈরি। সংসদকে আরাে জানানাে হয়, পাকিস্তানের হাই কমিশনে ৬৭জন কর্মমর্তা-কর্মচারী একটি বিদেশি বিমানে নয়াদিল্লি ত্যাগ করেছেন। সামরিক প্রস্তুতি সম্পর্কে আরাে আলােচনা শুরু হলে প্রতিমন্ত্রী বিনয়ের সঙ্গে হাউসকে বলেন, বিস্তারিত বলা সমীচীন হবে না। ২৩শে নভেম্বর, লােকসভায় অটলবিহারী বাজপেয়ী দৃষ্টি আকর্ষণ প্রস্তাবে পাকিস্ত নি-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি এবং ভারত সীমান্তের ভেতরে পাকিস্তানি জঙ্গিবিমানের অনুপ্রবেশের ওপর আলােচনা শুরু করেন। বাজপেয়ীর বক্তব্যের মূল কথা ছিল প্রতিরক্ষা বিষয়ে কিংবা যুদ্ধাবস্থা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী যদি সংসদে কথা বলতে না চান তাহলে বিবৃতি দিতে পারেন। কিন্তু এসব বিষয়ে সরকারের নিন্দুপ থাকা সংসদের মর্যাদার সঙ্গে অনুকূল নয়। যেসব ঘটনা ঘটছে বা ঘটবে এ সম্পর্কে সংসদ সদস্যদের জানার অধিকার আছে। সংসদকে সামনে রেখেই কথা বলতে হবে, সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ থাকতে হবে, সংবাদপত্রসমূহের সঙ্গে নয়। প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা বলেন, পাকিস্তান জাতিসংঘ এবং সর্বত্র বাংলাদেশ সংকটকে সামনে রেখে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে বিশ্ব পরিসরে এটাকে চালিয়ে দেওয়ার জন্য কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছে। সংসদে কারাে এমন কথা বলা ঠিক হবে না, যেটা পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচারের উপাদান হয়ে পড়ে। ভারতের সামরিক কূটনীতির একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে আক্রমণকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সুযােগ দেওয়া। সেজন্য দেখা যায় পাকিস্তান জরুরি অবস্থা ঘােষণা করলেও ভারত তা করেনি। কিংবা পাকিস্তান যেমন পেশােয়ার সীমান্ত এলাকায় নিপ্রদীপ মহড়া দিয়েছে ভারত তা করেনি। কারণ ভারত এসব উল্লেখ করে বিশ্ব ফোরামে প্রমাণ করতে চেয়েছে কারা প্রথম যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়েছে। সে মােতাবেক আক্রমণ করেছে।  ২৪শে নভেম্বর, লােকসভার অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্ত নি জরুরি অবস্থা ঘােষণার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর মনােযােগ অন্যত্র সরিয়ে দিতে চাচ্ছে। এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সৃষ্ট কর্মের ভার ভারতের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। বাংলাদেশে বর্ষা চলে গেছে। মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত আক্রমণ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পরিকল্পনাকে হতবিহবল করে তুলেছে। সমগ্র জনগােষ্ঠীর সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়েছে, তাদের হটিয়ে দিচ্ছে এবং বিরাট অঞ্চল মুক্ত করেছে।

পাকিস্তান ২১ ও ২২শে নভেম্বর পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে ট্যাংক নামিয়েছে। যুদ্ধ বিমান দিয়ে ভারতের বিভিন্ন অবস্থানে অমণ করেছে। তিনটি স্যার জেট ধ্বংস করেছে। দু’জন পাকিস্তানি পাইলট বন্দি হয়েছে। তারপরেও পাকিস্তানি আক্রমণের মুখে আমরা জরুরি অবস্থা ঘােষণা থেকে বিরত আছি। তবে পাকিস্তান অধিকতর আক্রমণ করে জাতীয় নিরাপত্তা ও সংহতির উপর আঘাত করে আমাদের বাধ্য না করলে জরুরি অবস্থা জারি থেকে বিরত থাকবাে। পাকিস্তান সামরিক জান্তার উপলব্ধি করা উচিত শান্তির পথ হলাে আলােচনা ও সমঝােতা। যা যুদ্ধের চেয়ে উত্তম এবং যা কোনােক্রমেই স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রকে দমন করে রাখে না।১৮২

৪ঠা ডিসেম্বর, ভারতের ওপর পাকিস্তানের যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ায় রাজ্যসভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, দৃঢ়তা ও সংকল্প নিয়ে আমাদের আরােপিত যুদ্ধের মােকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা শান্তির জন্য দাড়িয়েছি, কিন্তু শান্তিকে রক্ষা করতে হয়। আমাদের জাতীয় সমান, সংহতি, ভৌগােলিক অখণ্ডতা, নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধ করছি, যুদ্ধ করছি মুক্তি ও আদর্শকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, মুক্তিবাহিনীর কার্যকর ক্রমাগত বিজয় অর্জনের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা বেপােরােয়া হয়ে গেছে। মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ। করছে আদর্শ ও মূল্যবােধের জন্য, তাদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যুদ্ধ। করতে তুলনামূলকভাবে অক্ষম। ভারতের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সেনাবাহিনী যুদ্ধ করার সাহসের নেপথ্যে রয়েছে কৃষক, শ্রমিক, কারিগর এবং ব্যবসায়ীদের আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সামাজিক দায়িত্ব হলাে অধিক মুনাফা থেকে বিরত থাকা। শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, ছাত্র এবং সমগ্র জাতি ভারতীয় আদর্শ, মর্যাদা এবং নৈতিকতা সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট। প্রত্যেকের সম্মিলিত আত্মত্যাগ হলাে আমাদের শক্তি। রাজ্যসভার এই অধিবেশনে বিরােধীদলের নেতা এম, এস, গুরুপাধ্যয় স্বামী বলেন, এখন ভুল ধরার সময় নয়, দ্বিধা নয়, বিরােধ নয়, এখন দেশকে আমরা কী দিতে পারি এই ভয়াবহ মুহুর্তে সেটি বড় কথা! এটা এমন এক যুদ্ধ, যে যুদ্ধে আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে, উপমহাদেশে চিরদিনের মতাে সকল সংঘর্ষের বিলুপ্ত হবে। আমি সরকারের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করছি। আমি নিশ্চিত, সকল দল আজ সর্বসম্মতিক্রমভাবে এই সংকট থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সরকারকে সাহায্য করবে।
তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আর কোনাে আপােষ নয়, আবার যেন আরেকটি তাসখন্দ না হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর, পাকিস্তান কর্তৃক ভারতের ওপর যুদ্ধের হুমকি এবং বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত সাফল্যে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে সরানাের জন্যে এবং এই ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে ভারতের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও স্বাধীনতার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছে। ৩রা ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তান এয়ারফোর্স ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে ভারতের বহু বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করেছে । পাকিস্তানের প্রচারমাধ্যম ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করেছে এগুলাে যে প্রচার করছে তা সর্বৈব মিথ্যা। কলকাতা থেকে ফিরে আসার মুহুর্তে তিনি সংবাদটি পান। ফিরে এসে সহকর্মীদের সঙ্গে বিরােধীদলসমূহের সঙ্গে অবিলম্বে বৈঠক করা হয়। ভারতের সকলে। একচিত্ত, জাতির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ এবং আক্রমণকারীকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সকলে সর্বসম্মত। “আমি নিশ্চিত এই ধরনের সংহতির মনােভাব এই দুর্দিনে এবং সামনেও প্রতিফলিত হবে। জরুরি অবস্থা ঘােষণা করা হয়েছে।”
ক, সামরিক কূটনীতি নিয়ে বিতর্ক কয়েকজন ব্যক্তি বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক উপস্থাপন করেন। তন্মধ্যে দি ইনিস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিস অ্যান্ড অ্যানালাইসিস এর ডাইরেক্টর কে, সুব্রামানিয়াম ছিলেন সবচেয়ে আলােচিত ব্যক্তি। ৩১শে মার্চ তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি নিয়ে কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স সেমিনারে ভারতের সমঝােতা নীতির সমালােচনা করেন। ৫ই এপ্রিলে ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকায় (যে পত্রিকা নেহেরু পরিবার ও ইন্দিরা গান্ধীর সমর্থক) একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যেখানে তিনি লেখেন পূর্ব পাকিস্তানের সংকট ভারতের জন্য এমন এক সুযােগ নিয়ে এসেছে যা আর কখনাে আসবে না। তার এই বাক্যটি পাকিস্তান সরকার, পাকিস্তানের গণমাধ্যম এবং বুদ্ধিজীবীগণ প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, ভারত-পাকিস্তানে আক্রমণের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অথচ প্রকৃত ঘটনা হলাে, তার মতে তিনি সরকার বা সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনাে আলােচনা না করেই এই প্রবন্ধটি লিখেছেন। পরবর্তীকালে তার এই ধরনের লেখা উক্ত পত্রিকায় ছাপাতে অস্বীকার করলে তিনি জনসংঘ সমর্থিত পত্রিকায় তার এই ধরনের প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। এই সময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই ধরনের প্রবন্ধ প্রকাশ না করার বিষয়ে উপদেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে লন্ডন | টাইমস বিশাল আকারে তার মতামত প্রকাশ করে। এই থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সুব্রামানিয়াম যে মতামত প্রকাশ করেছেন তা তার নিজস্ব এবং ভারত সরকারের মুখপাত্র হিসেবে তিনি কিছুই করেননি। ১৯৪৭-১৯৫০ সাল পর্যন্ত ভারতের গর্ভনর জেনারেল সি, রাজা গোপালাচারি এবং ভারতের সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনালের কারিআপ্পা ও তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম, করুনানিধি ভারত সরকারকে এই বলে পরামর্শ দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে অধিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে ভারতের সহযােগিতা করা দরকার, তার অতিরিক্ত কিছু না। কতিপয় বুদ্ধিজীবীগােষ্ঠী এ কথা সরকারকে। অবগত করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ভারতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমনকি পূর্ববাংলা এবং পশ্চিমবাংলা মিলে অখণ্ড বাংলার আন্দোলন শুরু হতে পারে। কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা একথাও মনে করতেন যে, পূর্ব পাকিস্তান পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে তা হবে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র যা ভারতের জন্য। সুখকর হবে না। | এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে নয়াদিল্লিকে বাংলাদেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে। সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকগণ মার্চ-এপ্রিলে সামরিক শক্তির বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন সরাসরি পূর্ব পাকিস্তান দখল করার মতাে পর্যাপ্ত লজিস্টিক সামরিক সরঞ্জামের অপ্রতুলতা রয়েছে; একই সাথে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মিশ্র পরিবেশ বিরাজ করছে। তখন পর্যন্ত বিদেশে পাকিস্তান যথার্থভাবেই প্রচার করেছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং ভারতের মনােভাবও অনুরূপ ছিল। প্রথমদিকে ভারত বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিকে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন মহাসচিব বরাবর যে ‘নােট প্রদান করেন সেখানে বিষয়টি পাকিস্তানের ‘ডমিস্টিক বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট ৩রা এপ্রিলের পূর্ব পর্যন্ত বিশেষ করে ২৭শে মার্চ যে বিবৃতি প্রদান করেন সেক্ষেত্রে বােধগম্য ধারণায় পূর্ব পাকিস্তানের সংকটকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে প্রতীতি জন্মেছে। বাংলাদেশের নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ৪ঠা এপ্রিল সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সভা পূর্ববঙ্গের ঘটনা পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয় এই ধারণাটি প্রত্যাখ্যান করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম দিকে ভারতের সরাসরি আক্রমণ বা হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষকরে ভারতের মিত্ররা পছন্দ করেনি।
সেজন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতের কূটনৈতিক ক্ষেত্রের কার্য-পরিধি ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ, যার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি এবং ভারতে আগত শরণার্থীদের ফেরত পাঠানাে। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা নয়াদিল্লির শর্তানুসারে পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহ যাতে অনুধাবন ও আগ্রহী হয়ে ওঠে সে ধরনের তৎপরতা চালানাে হয়। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের ও সর্বস্তরের নাগরিক ও ব্যাপক ট্রাজেডি, গণহত্যা, লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের ভারতে আগমন ভারত সরকারের ধারণাকে উল্টে দেয়। একই সাথে পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র প্রতিরােধে ভারতীয় জনগণের নিরবিচ্ছিন্ন আকাক্ষা এবং গণ ঐক্যের প্রচণ্ড প্রবাহকে নয়াদিল্লির পক্ষে উপেক্ষা করা ছিল রাজনৈতিক দিক থেকে দুরূহ বিষয়। এছাড়া মধ্য-মে থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ লক্ষ্য করে যে, পূর্ববঙ্গে সশস্ত্র গেরিলাদের কার্যক্রম নিবিড় ও ব্যাপকতা লাভ করেছে। সে লক্ষ্যে ভারত সরকার পূর্ববঙ্গের সশস্ত্র শক্তিকে সহযােগিতা ও উৎসাহ যােগায় এ কারণে | যে, এর ফলে ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে সমঝােতা অথবা দর-কষাকষিতে সহায়ক হবে। এ সময় নয়াদিল্লি মে মাসের শেষ প্রান্তে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, প্রয়ােজনে ভারতের সরাসরিভাবে হস্তক্ষেপের বাইরে মুক্তিবাহিনীকে জইয়ে রাখা এবং তাদের শক্তিশালী করার। মধ্যে বিকল্প সহায়ক শক্তি গড়ে উঠবে যা প্রয়ােজনে কাজে লাগবে। ভারত-সরকার খুব সাবধানতার সাথে এসকল বিষয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে । যে কোনাে প্রকার যুদ্ধের বিপক্ষে রাজনৈতিক সমঝােতা ও মানবিক সমস্যার বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার কূটনৈতিক ভূমিকা জোরদার করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ভারত কৌশলগত প্রস্তুতিমূলক নীতি গ্রহণ করে। প্রথমে শরণার্থী সমস্যাকে বিশ্বব্যাপী মানবিক সমস্যায় রূপান্তর এবং বাংলাদেশ সংকট উত্তরণে রাজনৈতিক সমঝােতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু রণকৌশলগত দিক নির্দেশনা নীতি-নির্ধারকদের কাছে অস্পষ্ট ছিল না। যদি কেউ কেউ। অভিমত প্রকাশ করেছেন শুরু থেকেই ভারত যুদ্ধের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।” কথাটি সত্য হলেও প্রকাশ্যে ভারতের কূটনৈতিক ভাবভঙ্গি ছিল সামরিক নয়, রাজনৈতিক সমাধান। মানবিক ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা কূটনৈতিক মহলে। পুনঃপুন উচ্চারিত হলেও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ভারত কেবল কৌশলগত কারণে। সময়ক্ষেপণ করছিল।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য ভারত কূটনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। অন্যপক্ষের মতে, ভারত সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিপক্ষে ছিল। তবে চেষ্টা হয়েছিল চাপ সৃষ্টি করে ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে পাকিস্তানকে বাধ্য করতে। ভারতের নীতি-নির্ধারকদের পলিসি ছিল ভারত যুদ্ধ চায় না, কিন্তু কীভাবে যুদ্ধ। এড়িয়ে যাবে তা ভারতের জানা নেই। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতি যাই থাকুক কেন, বিভিন্ন মহলের চাপ সত্ত্বেও ভারত-সরকার প্রকাশ্যে সবসময় যুদ্ধের বিপক্ষে বক্তব্য রেখেছে। পাশাপাশি একথাও বলেছে যে, পাকিস্তান যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তবে। ভারত তার উপযুক্ত জবাব দেবে। ভারতের সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সম্পর্কে ভারতের ডিফেন্স ইন্সস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালক ও প্রতিরক্ষা-বিষয়ক গবেষককে সুব্রামানিয়াম সাক্ষাৎকারে সে সময়ে তার নিজস্ব অবস্থান ও তৎপরতা বিষয়ে বলেন, “সে সময় আমি প্রায় একা ছিলাম… আমি বলেছি, আমি যুদ্ধ চাই না, আমি সবসময় সহিংসতার বিপক্ষে। কিন্তু এটি এড়ানাে সম্ভব না। তখন একটা বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, মুক্তিবাহিনী নিজেরাই যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে। আমি বলেছি, মুক্তিবাহিনী তাদের পক্ষে সম্ভব সবকিছুই করবে। কিন্তু তারা জয়লাভ করতে পারে না। এজন্য ভারতীয় বাহিনীকে এগিয়ে যেতে হবে। আমার এ ধরনের লেখালেখিকে ভারত সরকার কখনই অনুমােদন করেনি এবং এজন্যে আমাকে ধমক খেতে হয়েছে। কিন্তু, যা হােক, আমি বলেছি ভারত ও বাংলাদেশের মানবাধিকার রক্ষায় আমি যা সঠিক মনে করছি তা আমি বলে যাব।” জনসংঘের নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী লােকসভায় ভারত সরকারের দুর্বল বাংলাদেশ নীতির সমালােচনা করে বলেন যে, পাকিস্তানের গণহত্যার ফলে ভারতে আগত শরণার্থী স্রোত অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। তার মতে শরণার্থীদের পেছনে যে-ব্যয় হচ্ছে তা যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সরকারের পবিত্র ইচ্ছার’ বেশি কিছু নয়। বাজপেয়ী বলেন, শরণার্থী সমস্যার শুরু কিন্তু বিশ্ব জনমত ও মার্কিনী জনগণের চাবা ও প্রতিরােধে অস্ত্রবােঝাই জাহাজগুলাে আটকে দেয় : মার্কিন সরকার মার্চ মাসেই অস্ত্র সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
১৯, কূটনীতির মূলনীতি থেকে সরে আসা না আসা প্রথমত, কতিপয় ইস্যু নিয়ে ভারতকে কূটনৈতিক বৈপরীত্যের সম্মুখীন হতে হয়, যা কূটনৈতিকভাবে ভারতকে মােকাবিলা করতে হয়। উপমহাদেশের ঘটনাবলি বিশেষ করে বাংলাদেশ সংকট, গণহত্যা, বর্বর নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলি আন্তর্জাতিককরণ করতে গিয়ে ভারত উপলব্ধি করে যে, মূল বাংলাদেশ নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ সর্বদাই মনে করছে বাংলাদেশ সংকট পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর, নির্মম আক্রমণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে অগণিত শরণার্থীদের ভারতে ঠেলে দেওয়াকে ভারত ‘অপ্রত্যক্ষ আক্রমণ’ (Indirect aggression) হিসেবে উল্লেখ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেন, এটা সাধারণভাবে কোনাে গৃহযুদ্ধ নয় বরং এটা হলাে। গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী নাগরিক যারা ভােট দিয়েছিল তাদেরকে গণহত্যার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। ভারত মনে করে এটা নতুন ধরনের আক্রমণ যা। ভারতের উপর অবর্ণনীয় অর্থনৈতিক বােঝা চাপিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক, সামরিক এবং সামাজিক উদ্বেগ সৃষ্টি করে নিরাপত্তার প্রতি হুমকির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সেজন্য এটা শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় হতে পারে না। ভারত বাংলাদেশ সংকটকে পাকিস্তানের নিজস্ব সংকট হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করাই হলাে এর মূল কারণ।

দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান উভয় দেশের সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মােতায়ে, ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক আলােচনা এবং সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ইত্যাদি প্রস্তাব এনেছে আপতদৃষ্টিতে বিশ্বের কাছে তা সুগ্রাহ্য বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ভারতের কূটনৈতিক কৌশল বিশ্লেষণে পরিলক্ষিত হয়েছে এগুলােকে মূল সমস্যা থেকে ভিন্ন দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই প্রস্তাবগুলাে উপস্থাপন করেছে বলে চিহ্নিত করেছে। ভারতের কূটনৈতিক কৌশল হলাে তারা সবসময় অস্বীকার করেছে যে, এটা পাকিস্তান-ভারতের সমস্যা নয়। ভারতের কূটনৈতিক কৌশল ছিল ভারতের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তার মনােনীত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গেই কেবল পাকিস্তান কথা বলতে পারে। | তৃতীয়ত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত মূলনীতি থেকে সরে আসেনি। জোট নিরপেক্ষতার অর্থই হলাে চুপ করে থাকা নয় বা সমস্যা উপেক্ষা বা পাশ কাটিয়ে যাওয়া নয়। এর অর্থ হলাে কোনাে সামরিক ব্লকের প্রভাবে নয় বরং সকল আন্তর্জাতিক সমস্যা ন্যায়সঙ্গত বিচারে পরিমাপ করা হয়। সেটা আমেরিকা বা সােভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা যে কেউ হােক না কেন। জোটনিরপেক্ষতার অর্থ হলাে অন্যায়কে মেনে নেওয়া নয় বরং ন্যায়ের পক্ষে থাকা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন, উভয় সীমান্তে

একাত্তর সালে পূর্ব পাকিস্তানের সংকট বিষয়ক স্পেশাল ব্যুরাের ডাইরেক্টর জে. এন, দীক্ষিত এক সাক্ষাৎকারে সে সময়কার ভারতীয় নীতি-নির্ধারকদের ভাবনা সম্পর্কে বলেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ক্যাবিনেটে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সতর্ক করেছিলেন যে, বাংলাদেশকে সরাসরি সমর্থন করা ও পাকিস্তানকে আক্রমণ করা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে কারাে জন্যই ভালাে হবে না। সাক্ষাৎকারে তিনি। বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে আগস্টের শেষ অবধি ভারতের নীতি ছিল প্রধানত দুটি : প্রথমত, ভারত হতে শরণার্থীদের নিরাপদে ও সসম্মানে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা, এবং দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধানত লজিস্টিক সাহায্য দিচিছল। একটি মত অনুযায়ী ভারতের সরাসরি যুদ্ধে জড়ানাের কোনাে পরিকল্পনা আগস্ট পর্যন্ত ছিল না, যতােক্ষণ পর্যন্ত না সরকার পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে যে, রাজনৈতিক সমাধানের পথ ব্যর্থ হয়েছে। ইয়াহিয়া সরকারের শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি প্রদানের কোনাে পরিকল্পনা নেই, উপরন্তু, শেখ মুজিবকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে অন্য মতটি হল, ভারত প্রথম থেকেই নিশ্চিত ছিল বাংলাদেশকে সামরিক আক্রমণে। সহায়তা করবে এবং প্রয়ােজনে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, শুধু কূটনৈতিক প্রচারণার মাধ্যমে বিশ্বজনমত গঠন ও সর্বাত্মক সামরিক প্রস্তুতি গড়ে তােলার জন্য সময় নিচ্ছিলাে। পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত হবার জন্য এবং বিশেষত ভারত অপেক্ষায় ছিল শীতকালের জন্য। কেননা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে যাওয়া মানেই হলাে ভারতকে প্রধানত দুই সীমান্তে অর্থাৎ চীনের সাথে যুদ্ধে জড়ানাে, বিশেষত চীনের পাকিস্তানকে সাহায্যে এগিয়ে আসার বিষয়টিও পরিকল্পনায় রাখতে হয়। চীনের যুদ্ধে জড়ানাে মানেই ভারতকে উত্তর-পূর্ব সীমান্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে এই যুদ্ধ যদি শীতকাল পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা যায়, তাহলে চীনের পক্ষে শিয়াচিং পর্বতমালা (Glacier) পার হয়ে ভারত আক্রমণ করা কঠিন বিষয় হবে।”” ভারত কূটনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে সেই সময়টি পর্যন্ত দৌড়ঝাপ করেছিল।
| ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব কে, বি, লাল যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে চীন। কতােটা প্রভাব ফেলেছিল সে বিষয়ে সাক্ষাৎকারে বলেন, গােয়েন্দা রিপাের্ট অনুযায়ী, পাকিস্তান ভরসায় ছিল চীন তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। ভারতও ঠিক নিশ্চিত ছিল।
যে চীন হস্তক্ষেপ করবে কিনা। কাজেই ভারত কিছুটা স্বস্তি বােধ করে, যখন নভেম্বর পর্যন্ত কোনাে সংঘর্ষ বাধেনি। রাশিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে কে.বি, লাল বলেন যে, “ভারত এতােটা বােকা ছিল না যে, বিশ্বাস করে বসে থাকবে যে, রাশিয়া এগিয়ে এসে। ভারতকে রক্ষা করবে বা পাকিস্তানকে আক্রমণ করবে অথবা চীনের উপর প্রভাব খাটাবে। ভারত এটিও বিশ্বাস করিনি, যেমন পূর্ব পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করেছিল যে চীন হস্তক্ষেপ করবে। তবে চীন আক্রমণ করবে না-এই ধারণার উপর ভিত্তি করে ভারত প্রস্তুতি নেয়নি বা ভীত ছিল। ভারত যৌক্তিকভাবে নিশ্চিত ছিল যে, রাশিয়া, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাজ এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানে। তারা তাদের সৈন্য নিয়ে ভারত বা পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করতে আসবে না”। ভারতীয় কূটনীতিক এবং তৎকালে পােল্যান্ডে ভারতের অ্যামবাসেডর নটবর সিংও চীনের ভূমিকা নিয়ে একই ধরনের মন্তব্য করেন। চীন নিষ্ক্রিয় বসে থাকবে না’ বলে কিসিঞ্জারের হুমকি সম্পর্কে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি মনে করি, সে সময় চীন প্রয়ােজনীয় চেঁচামেচি করেছে, কিন্তু তারা সরাসরি জড়িত হয়নি এবং সব কিছুই খুব দ্রুত হয়েছিল।”১৯৯ | কয়েকটি বিশেষ কারণে এই সময় গান্ধী যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যেতে আগ্রহ বােধ করেছিলেন। যেমন, ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সমস্যা, রাজনৈতিক সমাধান-সংক্রান্ত পদক্ষেপের অনিশ্চয়তা, রুশ-ভারত চুক্তির ফলে ভারতের নতুন আত্মবিশ্বাস এবং চীনের পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপের আশঙ্কা নিরসন ইত্যাদি। তবে ৩রা ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ পাকিস্তানি আক্রমণের ফলেই ত্বরান্বিত হয়েছিল। ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান। বিমানবাহিনী ভারতের উত্তর ও পশ্চিম বিমানঘাঁটি আক্রমণ করে। ফলে ভারত যুদ্ধের অজুহাত পেয়ে যায়। অবশ্য এটা তখন অবধারিত পরিণতি এবং ঘটনা ছিল। | খ, পাকিস্তানকে অস্ত্র প্রেরণে প্রতিবন্ধকতা: কূটনৈতিক তৎপরতা: ভারতীয় সমর কূটনীতির একটি বিরাট উদ্যোগ ছিল পাকিস্তান যেন পরাশক্তি বা বৃহৎ শক্তিবর্গের উপর নিকট থেকে ঢালাওভাবে অস্ত্র সংগ্রহ না করতে পারে। এভাবে রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে একটি গুলি দেবার অর্থই হলাে একজন নিরীহ মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করা।’ এ মনােভাব বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করেছে। পাকিস্তান যাতে অস্ত্র না পায় তার জন্য দেশে দেশে মিটিং, মিছিল অব্যাহত ছিল। ১লা জুন, পাকিস্তান সামরিক জান্তা সৃষ্ট বাংলাদেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ থেকে বিরত থাকার জন্য যুক্তরাজ্যকে ভারত অনুরােধ করলে যুক্তরাজ্য তা প্রত্যাখ্যান করে এই বলে যে, বাণিজ্যিক কারণে তারা শুধু হালকা অস্ত্র দিচ্ছে। একই সঙ্গে পূর্বের অন্যান্য অর্ডার সরবরাহে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ করে। এর-উপর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। ২৪শে জুন, মার্চে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানে জাহাজ বােঝাই অস্ত্র-প্রেরণ সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জগজীবন। রামের বিবৃতির ওপর লােকসভায় আলােচনা হয়। ঐদিন রাজ্যসভার কার্যবিবরণীতে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানকে সম্প্রতি অস্ত্র সরবরাহের রিপাের্টের ওপর আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। ১২ই জুলাই, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানকে সাড়ে তিনকোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে লােকসভায় আলােচনা হয়। সেখানে। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র শরণার্থীদের জন্য ভারতের কাছে সাহায্য দিচেছ আর পাকিস্তানকে দিচ্ছে অস্ত্র। এক আমেরিকার দুই রূপ!১০৫ ১৯শে জুলাই, পাকিস্তান মার্কিন অস্ত্রের অব্যাহত সরবরাহ এবং তা ফলশ্রুতিতে পূর্ব পাকিস্তানে সংগঠিত ঘটনার ভয়াবহতা বৃদ্ধি এবং ভারতের ওপর তার প্রভাব নিয়ে রাজ্যসভায় বিস্তারিত আলােচনা হয়।
কিন্তু বিশ্ব জনমত ও মার্কিনী জনগণের চাবা ও প্রতিরােধে অস্ত্রবােঝাই জাহাজগুলাে আটকে দেয় : মার্কিন সরকার মার্চ মাসেই অস্ত্র সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৯, কূটনীতির মূলনীতি থেকে সরে আসা না আসা প্রথমত, কতিপয় ইস্যু নিয়ে ভারতকে কূটনৈতিক বৈপরীত্যের সম্মুখীন হতে হয়, যা কূটনৈতিকভাবে ভারতকে মােকাবিলা করতে হয়। উপমহাদেশের ঘটনাবলি বিশেষ করে বাংলাদেশ সংকট, গণহত্যা, বর্বর নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলি আন্তর্জাতিককরণ করতে গিয়ে ভারত উপলব্ধি করে যে, মূল বাংলাদেশ নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ সর্বদাই মনে করছে বাংলাদেশ সংকট পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর, নির্মম আক্রমণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে অগণিত শরণার্থীদের ভারতে ঠেলে দেওয়াকে ভারত ‘অপ্রত্যক্ষ আক্রমণ’ (Indirect aggression) হিসেবে উল্লেখ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেন, এটা সাধারণভাবে কোনাে গৃহযুদ্ধ নয় বরং এটা হলাে। গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী নাগরিক যারা ভােট দিয়েছিল তাদেরকে গণহত্যার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। ভারত মনে করে এটা নতুন ধরনের আক্রমণ যা। ভারতের উপর অবর্ণনীয় অর্থনৈতিক বােঝা চাপিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক, সামরিক এবং সামাজিক উদ্বেগ সৃষ্টি করে নিরাপত্তার প্রতি হুমকির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সেজন্য এটা শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় হতে পারে না। ভারত বাংলাদেশ সংকটকে পাকিস্তানের নিজস্ব সংকট হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করাই হলাে। এর মূল কারণ।
| দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান উভয় দেশের সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মােতায়ে, ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক আলােচনা এবং সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ইত্যাদি প্রস্তাব এনেছে আপতদৃষ্টিতে বিশ্বের কাছে তা সুগ্রাহ্য বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ভারতের কূটনৈতিক কৌশল বিশ্লেষণে পরিলক্ষিত হয়েছে এগুলােকে মূল সমস্যা থেকে ভিন্ন দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই প্রস্তাবগুলাে উপস্থাপন করেছে বলে চিহ্নিত করেছে। ভারতের কূটনৈতিক কৌশল হলাে তারা সবসময় অস্বীকার করেছে যে, এটা পাকিস্তান-ভারতের সমস্যা নয়। ভারতের কূটনৈতিক কৌশল ছিল ভারতের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তার মনােনীত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গেই কেবল পাকিস্তান কথা বলতে পারে। | তৃতীয়ত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত মূলনীতি থেকে সরে আসেনি। জোট নিরপেক্ষতার অর্থই হলাে চুপ করে থাকা নয় বা সমস্যা উপেক্ষা বা পাশ কাটিয়ে যাওয়া নয়। এর অর্থ হলাে কোনাে সামরিক ব্লকের প্রভাবে নয় বরং সকল আন্তর্জাতিক সমস্যা ন্যায়সঙ্গত বিচারে পরিমাপ করা হয়। সেটা আমেরিকা বা সােভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা যে কেউ হােক না কেন। জোটনিরপেক্ষতার অর্থ হলাে অন্যায়কে মেনে নেওয়া নয় বরং ন্যায়ের পক্ষে থাকা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন, উভয় সীমান্তে পর্যবেক্ষক নিয়ােগের ক্ষেত্রে ভারতের কৌশলগত ধারণা ছিল জাতিসংঘ সীমান্তে পর্যবেক্ষক নিয়ােগের নেপথ্যে ভারতীয় সৈন্যের অবস্থান, চলাফেরা, মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও অপারেশন, অস্ত্র সরবরাহ ইত্যাদির উপর নজরদারি করতে পারে। সেজন্য ভারত সরকার শরণার্থী শিবিরে সকল বিদেশি বেসরকারি সংস্থাসমূহকে প্রত্যাহার করার আদেশ জারি করেন। পর্যবেক্ষক নিয়ােগের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মনােভাব ছিল ইতিবাচক। কিন্তু এক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বেশ শক্ত অথচ বিনয়ী ভাষায় জাতিসংঘের মহাসচিবকে লেখেন, “There is what must be kept in mind instead of the present attempt and to convert it into an Indo-Pakistani dispute can only aggravate tensions.” U Thant was urged to focus his attention on a political settlement in “East Bengal which meets the declared wishes of the people.২০৮ ২০. সামরিক কূটনীতির পূর্বাপর । পঞ্চাশ দশকে কমিউনিজম ঠেকাতে পাকিস্তান মার্কিন সামরিক জোট সিয়াটো ও সেন্টোর সঙ্গে যুক্ত হয় । সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত বলে দূরে ঠেলে রাখে। পক্ষান্তরে, জোটনিরপেক্ষ নীতির কারণে ভারত কমিউনিস্ট ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ১৯৬২ সালে চীন-ভারতের যুদ্ধের পর পাকিস্তান চীনের কাছাকাছি চলে আসে। এরপর পরই ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করে যদিও পাকিস্তান ছিল কমিউনিস্ট বিরােধী রাষ্ট্র। এই যুদ্ধের ফলে সােভিয়েত রাশিয়াকে উভয় দেশের মধ্যে অনুঘটকের সুযােগ এনে দেয় এবং এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধ বন্ধে সােভিয়েতের ভূমিকাকে অপ্রকাশ্য সমর্থন প্রদান করে। সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যে তাসখন্দে একটি বৈঠকে মিলিত হতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

১৯৬৬ সালের জানুয়ারি উভয় দেশের মাঝে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে কোসিগিন দক্ষতার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, কয়েকটি বিষয়ে ভারতকে ছাড় দিতে হবে। যেমন যুদ্ধের সময় ভারতের সেনাবাহিনী কাশ্মীরে হাজী পীর পাস যা ভারত দখল করেছিল তা ছেড়ে দেয়। তাসখন্দ চুক্তির ফলে সােভিয়েত রাশিয়া ভারত উপমহাদেশে এবং একইসাথে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি শক্তিশালী ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ১৯৬৮ সালে সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া শুরু করে যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব অনেক হ্রাস পায়। ভারত এসময় এই বলে সতর্ক প্রতিবাদ জানায় যে, যে সমস্ত অস্ত্র পাকিস্তানকে দেওয়া হচ্ছে যার ফলে পাকিস্তান নতুন করে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উৎসাহিত হবে। একইসাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত দক্ষ কূটনৈতিক হিসেবে একথা ঘােষণা করে যে, এর ফলে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের নীতিগত অবস্থানের পরিবর্তন হবে না। যেকোনাে দেশের অন্য দেশের সহযােগিতা করার স্বাধীনতা রয়েছে। এ বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপ করার কিছু নেই। ইতােমধ্যে চীন এবং রাশিয়ার ভিতরে সিনকিয়াং অঞ্চল ও অন্যান্য বিষয়ে মতপার্থক্য প্রকাশ্যে চলে আসে এবং এসময়ও দু’দেশ থেকে পাকিস্তান সামরিক সাহায্য পেতে থাকে। এছাড়া সামরিক চুক্তির শর্তানুযায়ী, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র পেতে থাকে। এসময় সামরিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত পিছিয়ে পড়ে। এই অবস্থায় সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের প্রতি যে উষ্ণ মনােভাব ছিল তা আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং সামরিক সরঞ্জাম প্রেরণ কমে আসে। ফলে পাকিস্তান পুনরায় চীনের দিকে জোরেশােরে ঝুঁকে পড়ে।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে নিক্সন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে কতিপয় বিরাজমান অবস্থা তার সামনে চলে আসে। প্রথমত, ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সৈন্য অপসারণ। এক্ষেত্রে তার কাছে দু’টো পথ খােলা ছিল। সেটা হলাে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিলে চীনকে বাগে আনা, অপরটি হলাে সরাসরি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা। মস্কো প্যারিসে অনুষ্ঠিত শান্তি আলােচনায় ভিয়েতকং-এর পক্ষে ভূমিকা নেয় এবং নর্থ ভিয়েতনামে সমুদ্র পথে সামরিক সাহায্য পাঠাতে থাকে যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র সােভিয়েত রাশিয়ার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে। নিক্সনের কাছে প্রতীয়মান হয় মস্কো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাব হ্রাসের একটি বৃত্ত রচনা করছে। এই লক্ষ্যে সােভিয়েত ইউনিয়ন ষাট দশকে নৌ-শক্তি বৃদ্ধি করে। সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে এমনকি মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত নৌ-শক্তি বৃদ্ধি করে। মিসরের সুয়েজ খালকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত যুদ্ধে সােভিয়েত নৌ-শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এর অর্থ হলাে ভিয়েতনাম সমস্যায় সােভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সহযােগিতায় এগিয়ে আসবে না। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র মনে করে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা যথাপােযুক্ত।
সেজন্য নিক্সন প্রেসিডেন্ট হয়েই ১৯৬৯ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল মিটিং-এ চীন নীতি ঘােষণা করেন।২০৯ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিক্সনের নয়া নীতি চীনের জন্য অনুকূল বলে বিবেচিত হয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিশৃঙ্খলা তখন শেষ হয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে পাঁচ হাজার মাইল সীমান্ত নিয়ে চীন হুমকির সম্মুখীন ছিল এবং জাপান তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছিল। এই মুহুর্তে চীনের একঘরে হওয়া থেকে নিষ্কৃতির জন্য জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন জরুরি বলে বিবেচিত হয়। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে নিক্সনের প্রতিনিধির কাছে চীনের প্রধানমন্ত্রী চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়টি খতিয়ে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কয়েকদিন আগে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক ক্র্যাকডাউনের পর পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার প্রতি সমর্থন ও ভারতের হুমকির বিরুদ্ধে পিকিং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে প্রকাশ্যে সমর্থন দান করে।
এর ফলে পাকিস্তান ভারতবিরােধী ভূমিকা জোরদার করে। হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে গােপনে পাকিস্তান হয়ে পিকিং গমন। করেন এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন চুড়ান্তভাবে চীনের প্রেসিডেন্ট মাও এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর সঙ্গে সাক্ষাতের ঘােষণা দেন। এই ঘােষণা এমন সময় আসে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগে লিপ্ত এবং যখন অগণিত মানুষ প্রাণভয়ে ভারতে আশ্রয়ের জন্য ছুটে চলেছে। এসময় নিক্সনের সিদ্ধান্ত এমনটি ছিল যে, চীনের সঙ্গে আতাত করার জন্য পাকিস্তানের মধ্যস্থতা তার অপরিহার্য। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ভিয়েতনাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে উপমহাদেশে সংকট সম্পর্কে তিনি অতটা উদবিগ্ন ছিলেন না। এ কারণে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর গণতান্ত্রিক দেশের নেতা হিসেবে নিক্সন একটি ক্ষুদ্র মিলিটারি ডিক্টেটরের সঙ্গে হাত মেলাতে দ্বিধা করেননি এবং তার ঘােষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে। নিক্সন ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
নিক্সনের নয়া চীন নীতি রাশিয়াকে বিস্মিত করে। এসময় রাশিয়া ভারত ও পাকিস্তানকে সামরিক, অর্থনৈতিক, কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছিল। এই অবস্থায় ভারত পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণের ঘটনায় বেকায়দায় পড়ে যায়। বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশ সংকট উপলব্ধি করতে আগ্রহী ছিল না। ওয়াশিংটন বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে অনিচ্ছুক এবং ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমাধানে এগিয়ে আসতে চাপ সৃষ্টি করেনি। জুলাই মাসে পিকিং থেকে কিসিঞ্জার ফিরে এসে তার সফরকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন সুযােগ’ হিসেবে। উল্লেখ করলে ভারতকে নতুন করে সমগ্র কূটনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে হয়। ভারত একথা উপলব্ধি করে যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। অন্যদিকে, পাকিস্তান পিকিং এবং ওয়াশিংটনের সাহায্য পেয়ে বাংলাদেশের সংকট নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানে না এসে সামরিক সমাধানের দিকে শক্ত অবস্থান গ্রহণ। করে। ভারত অবশ্য প্রাথমিকভাবে যুদ্ধ চায়নি, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি ছিল না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলাদেশ-সংকটে রাজনৈতিক সমাধান ও শরণার্থী সমস্যা সমাধান চেয়েছেন যাতে তারা সম্মান ও নিরাপত্তা নিয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে। কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে যদি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তাহলে ভারতকে অবশ্যই বৈশ্বিক অবস্থানগত দুর্বলতা নিয়ে মােকাবিলা করতে হতাে। এ দুঃসময়ের প্রয়ােজন হলাে শক্ত সমর্থকের। এসময় সােভিয়েত ইউনিয়ন চীনের বিরুদ্ধে যে নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তােলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল পাকিস্তান তার বিপরীতে অবস্থান নেয়। নিক্সনের নয়া চীন নীতি এবং পাকিস্তানের কার্যকর সহযােগিতার পরিপ্রেক্ষিতে সােভিয়েত ইউনিয়নকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবিত করে। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের ৯ই আগস্ট সােভিয়েত-ভারত শান্তি, মৈত্রী এবং বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে। দু’দেশের প্রয়ােজনে চুক্তিটি ছিল অপরিহার্য। সােভিয়েত ইউনিয়নের নিকট কূটনৈতিক ক্ষেত্রে চুক্তিটি ছিল চীন-আমেরিকার বিরুদ্ধে এবং ভারতের কাছে ছিল পাকিস্তান এবং চীনের আগ্রাসন হতে নিরাপত্তা ! এই চুক্তির ফলে এতােদিন যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হচ্ছিল তার একটি ভিত্তি রচিত হয়। এর ফলে পাকিস্তানের উপরে চাপ সৃষ্টি হয়। কিন্তু ইয়াহিয়া খান রাজনীতিবিদ ছিলেন না অথবা বাস্তব অবস্থার অনুধাবন করতে অক্ষম ছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন একজন সৈনিক মাত্র। যেখানে এতদিন ভারত বিচ্ছিন্নকরণ অবস্থায় ছিলেন এই চুক্তির ফলে পাকিস্তান বিচ্ছিন্নকরণের মুখােমুখি দাঁড়ায়, যদিও ইয়াহিয়া খান ভাবছিলেন তিনি যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলাে এবং চীন থেকে বন্ধুর মতাে উদার সাহায্য সহযােগিতা পাবেন। ১৮ই আগস্ট পাকিস্তান জাতিসংঘে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে মহাসচিবের হস্তক্ষেপ দাবি করেন এবং জাতিসংঘ সৈন্য প্রেরণের প্রস্তাব দেন যা ভারত কর্তৃক নাকচ হয়ে যায়।
২৮শে সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত মধ্যাহ্নভােজে সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসেগিন বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়া খানকে আহ্বান জানান। ৫ই অক্টোবর পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে বিরাজমান সংকট সমাধানে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের প্রস্তাব দিলে নয়াদিল্লি স্পষ্টভাবে বলে দেয় যে, বাংলাদেশ সমস্যা সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের তৈরি। এ সময় একদিকে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য যাতায়াতের ক্ষেত্রে সিংহল তার। বিমান ও নৌবন্দর ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। এই সময় পাকিস্তান আসাম ও ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে কামানের ঘােলা নিক্ষেপ করে সরাসরি যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে। | অক্টোবর মাসে পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় সামরিক বাহিনীকে প্রেরণ করে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেন। এই সময় সীমান্তে ভারতও তাদের সৈন্য প্রেরণ করে। ২০শে অক্টোবর জাতিসংঘ মহাসচিব ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে লেখেন, “পরিস্থিতি বাস্তবিক অর্থে ভয়াবহ।’ উত্তরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মহাসচিব উ থান্টকে লেখেন, ‘সামরিক সংঘর্ষের ভারতের কোনাে ইচ্ছা নেই, আমরা শুধু দেশের নিরাপত্তার জন্য এরূপ ব্যবস্থা নিয়েছি।’ তিনি আরাে লেখেন, ‘মহাসচিব পূর্ববঙ্গের জনগণের গণআকাঙ্ক্ষা পূরণে রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ নিলে ভারত তাঁকে সর্বত্রভাবে সাহায্য করবে।’ নভেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করেন। এবং ইউরােপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গিয়ে ভারতের অবস্থান, শরণার্থী পরিস্থিতি, রাজনৈতিক সমাধানের উপর জোর দেন এবং বলেন, বর্তমান সমস্যা সমাধান হতে পারে কেবল পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের মীমাংসার উপর। “This is possible only if Pakistan’s friends or world opinion can make Gen Yahya Khan seek a settlement with the elected leaders of East Bengal, If they fail to do so, we might have to take all necessary steps in the interests of our own economy and security. Let no one say afterwards ‘we were not warned’. In any case we shall not strike first to precipitate matters.”২১২
অর্থাৎ নভেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সম্পর্কে কৌশলগত ইঙ্গিত প্রদান করেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ২৫শে নভেম্বর পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং ১০ দিনের মধ্যে তিনি যুদ্ধে যাবেন বলে আল্টিমেটাম ঘােষণা করেন। এই সময় যুক্তরাষ্ট্র উপমহাদেশে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে একটি কমিশন। পাঠানাের ঘােষণা দেন। ভারত এতে অসম্মতি জানান। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রাজ্যসভায় বলেন, শরণার্থী বিষয়ে অনুসন্ধানের লক্ষ্যে যে কোনাে দেশই কমিশন গঠনকে ভারত কোনােভাবেই স্বীকার করবে না। এই সময় সােভিয়েত ইউনিয়ন তার রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই সংঘর্ষ এড়ানাের বিষয়ে আলােচনা করেন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ও নিউজউইক ম্যাগাজিনের প্রকাশিত খবরে জানা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক জেনারেলগণ পূর্ববঙ্গের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝােতা করতে বিরােধীতা করছেন। শুধু তাই নয় জেনারেলগণ চাচ্ছিলেন রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার সমাপ্ত হওয়ার আগেই শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা। টাইম ম্যাগাজিন পশ্চিমা এক কূটনৈতিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “Mujib may never get back to Bengal alive.” কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও সিদ্ধান্ত হলাে যে কোনােভাবেই শেখ মুজিবকে জীবিত রাখা। কেননা তাদের কাছে “মৃত মুজিবের চেয়ে জীবন্ত মুজিব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” ২৭শে নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারত-পাকিস্তান ও সােভিয়েত ইউনিয়ন বরাবর একটি বার্তা পাঠিয়ে সীমান্তে উত্তেজনা নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি, কিনেথ কিটিং ২৯শে নভেম্বর সকালে পত্র হস্তান্তরকালে গান্ধীকে সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারপূর্বক উত্তেজনা নিরসনের অনুরােধ জানান। এর একদিন পূর্বে জয়পুরে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ পর্যন্ত শুধু মুখের কথা বা সহানুভূতি জানিয়ে এসেছেন, কিন্তু মূল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ‘বিশ্ব চাক বা না চাক আমরা যা ভালাে মনে করব, আমরা তাই করব।’ এর ভিত্তিতে নিউইয়র্কে কিটিং একটি রিপাের্ট পাঠান। রিপাের্টটি পহেলা ডিসেম্বর কিসিঞ্জারের হাতে এসে পৌছায়। যেখানে বলা হয়েছে, “-India has great admiration for the US but every country must first look to its national interest. It was her duty to see what as in the interests of her country.” যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভারতের অনেক সম্মান রয়েছে, কিন্তু প্রত্যেক দেশে তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রাথমিক কর্তব্য রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান প্রথমে সীমান্তে সৈন্য প্রেরণ করে, কিন্তু কেউ তখন প্রত্যাহারের কথা বলেনি। যখন ভারত সীমান্তে সৈন্য পাঠিয়েছে কেবল তখনই সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব উঠানাে হয়েছে। ইয়াহিয়া খানের সমস্যা তার নিজ সৃষ্ট। ভারত তা সহজ করে দেবে এমন অবস্থায় নেই। সে কারণে ভারত সৈন্য প্রত্যাহার করতে পারেনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি যেভাবে যুদ্ধে বিরােধীতা করেছে যা ভারতের কেউ করেনি, কিন্তু এই যুদ্ধ ও এই অবস্থা আমরা সৃষ্টি করিনি। তার অপকর্মকে ভারত সমর্থন করে না।
রাষ্ট্রদূত কিটিং-এর সঙ্গে আলােচনায় এ সময় প্রধানমন্ত্রী গান্ধী বলেন, আমরা এমন উপদেশ গ্রহণ করতে পারি না যা ভারতকে দুর্বল করবে। রাষ্ট্রদূত কিটিং আলােচনার পর্যবেক্ষণে লেখেন, বড়াে ধরনের রাজনৈতিক সমঝােতা না হলে। মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম বাংলাদেশকে স্বাধীন করবে, যা ব্যর্থ হবার নয়। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘আমরা কাউকে হুমকি দিচ্ছি না এবং কারাে হুমকিতে আমরা ভীত নই।’ এই ঘােষণার পরপরই প্যাক (পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স কমিটি) বৈঠক করে। কমিটি প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নিকট হতে নিরাপত্তা প্রস্তুতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন। অল্প সময়ের বৈঠকে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি, বিদেশ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবদের মিটিং-এ আহ্বান করা হয়। এর সঙ্গে আহ্বান করা হয় তিন বাহিনীর প্রধানদের। বৈঠকে পলিসি প্লানিং বাের্ডের চেয়ারম্যান ডি.পি, ধর উপস্থিত ছিলেন। মিটিং-এ ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বক্তব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা হয় এবং এ বিষয়ে সবাই একমত হন যে, রাজনৈতিক সমঝােতার ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের কোনাে ইচ্ছাই নেই। কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, বাংলাদেশ ইস্যুকে আন্তর্জাতিকীকরণের লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা প্রয়ােজন। কমিটি এই অবস্থান গ্রহণ করে, যে পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা অনুধাবন না করবে সে পর্যন্ত তারা মূল সমস্যাকে সামনের দিকে নিয়ে আসবে।  ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিবকে অনুরােধ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগের জন্য অনুরােধ জানান। যা পূর্বেই ভারত নাকচ করে দিয়েছে। অন্যদিকে, ইয়াহিয়া খান ইসরাইল টাইপের আকস্মিক আক্রমণের। জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহন করেন।  প্যাকের নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত মুজিবনগর সরকারকে জানানাে হয়। মুজিবনগর সরকারের একজন প্রতিনিধি পরিষদে বক্তৃতা করবেন স্থির হয়। নিরাপত্তা পরিষদে সভাপতি করছিলেন সিয়েরাে লিয়েনাের প্রতিনিধি। মিটিং-এর দু’ঘন্টা আগে বাংলাদেশ মিশনের পক্ষ থেকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী লিখিত অনুমতি গ্রহন করেন। মিটিং শুরু হলে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে, আলােচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান। ভারতের বক্তব্য হলাে, এটা ভারত-পাকিস্তানের বিষয় নয় অথবা ভারত-পাকিস্তানের ভিতরে যে ক্রমাগত যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে মূল বিষয়টি তাও না। এই বৈরিতা অবসানের জন্য জরুরিভাবে অপরিহার্য হলাে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সমাধান। পাকিস্তান বাংলাদেশের প্রতিনিধির আলােচনার বিষয়ে ঘােরতর আপত্তি উত্থাপন করে। বিষয়টি সমর সেন উত্থাপন করে। বলেন, পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা হিলালি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা হলাে অর্ধেকপাকিস্তানের কথা। অন্য অর্ধেক অংশের প্রতিনিধি বক্তব্য প্রদানের জন্য জাতিসংঘের লবিং-এ অপেক্ষা করছেন। ভারত পাকিস্তান ভাঙেনি। পাকিস্তান নিজেই তার দেশটিকে ভেঙে ফেলেছে এবং জনগণের নির্বাচিত নেতাকে জেলে আটকে রেখেছে।
তিনি সিকিউরিটি কাউন্সিলে জোরালাে বক্তব্য উথাপন করে বলেন, ভারত কী যুদ্ধবিরতি মেনে নেবে যাতে পাকিস্তানের সৈন্যরা আরাে বেশি করে বেসরকারি লােককে হত্যা করতে পারে, শিশুদের নিধন করতে পারে কিংবা মহিলা এবং যুবতীদের ধর্ষণ করতে পারে? এটা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির বিষয় নয়, এটা হলাে পূর্ববঙ্গের জনগণ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির বিষয়। তিনি আরাে বলেন, পূর্ববঙ্গকে দাবিয়ে রাখা হবে এমন কোনাে সমাধান ভারত মেনে নেবে না। পাকিস্তান এই আক্রমণ করার সাহস পেয়েছে বৃহৎ শক্তিবর্গের উৎসাহের কারণে। এই সময় পাকিস্তান প্রচারণা শুরু করে যে, ভারতের নৌবাহিনী মিসাইল বােটে রাশিয়ার দক্ষ নৌসেনা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এবং তারাই মূলত পাকিস্তানের নৌ জাহাজকে আঘাত করে চলেছে। পাকিস্তানের এই প্রচারণার উদ্দেশ্য ছিল সেন্টো এবং সিয়াটো চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্যে এগিয়ে আসে। ১২ই ডিসেম্বর এই অপপ্রচারের প্রতি ইঙ্গিত করে নয়াদিল্লিতে এক বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উল্লেখ করেন যে, ইতােপূর্বের পাকিস্তান সামরিক চুক্তির কারণে। ভারতকে হুমকি দিচ্ছে। ইতােপূর্বে যাই চুক্তি হােক না কেন আমি জানি তা হয়েছিল কমিউনিজমের বিরুদ্ধে একটি প্যাক্ট। কিন্তু এটা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্যাক্ট ছিল না, এটা ন্যায়ের কণ্ঠের বিরুদ্ধে ছিল না, এটা অসহায় দরিদ্র মানুষকে ধ্বংসের জন্য ছিল না। এটা যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে বিশ্বের কাছে তা মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে, নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ ভারতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কতিপয় প্রশ্ন উত্থাপন করেন। এর জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং বলেন, “ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধির উত্থাপিত প্রশ্ন সম্পর্কে কথা বলা থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে হাজার মাইল দূরে সৈন্য পাঠিয়ে যে সংঘর্ষ সৃষ্টি করেছে। যার ফলে বছরের পর বছর রক্ত ঝরছে এ বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে যে আহ্বান জানানাে হয়েছিল তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বিদেশি সৈন্যের বিরুদ্ধে সেখানে যে প্রতিরােধ গড়ে উঠেছে এই সম্পর্কে ভারত কোনাে প্রশ্ন উত্থাপন করতে যাচ্ছে না।” নিরাপত্তা পরিষদের এই আলােচনার সময় নিক্সন প্রশাসন “গান-বােট ডিপ্লোমেসি’ (Gun-boat diplomecy) পরিচালনা করার নির্দেশ প্রদান করে। একই সঙ্গে জর্ডানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে যুদ্ধ বিমান পাঠানাের নির্দেশ প্রদান করে যা এন্ডারসন। পেপারে লক্ষণীয়।২১৬ ২১. গান-বােট ডিপ্লোমেসি ১৪ই ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের তৎপরতা নিয়ে ভারতের লােকসভায় জ্যোতির্ময় বসুর মুলতুবি নােটিশের পরিপ্রেক্ষিতে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি এই বিষয়ে হাউজ মুলতবি করে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলােচনার জন্য। স্পিকারের নিকট আবেদন জানান। তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে লােকসভার সদস্য এইচ, এম, মুখার্জি বলেন, ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র অস্বীকার করছেন না, বরং বলা হচ্ছে, ঢাকায় যে সমস্ত মার্কিন নাগরিক রয়েছে তাদেরকে উদ্ধারের জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এটা অতীতের ন্যায় গান-বােট পলিসি যার মাধ্যমে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি ও ব্ল্যাকমেইল করার জন্য। তিনি এই সম্পর্কে সরকারকে পরিষ্কারভাবে দেশবাসীকে। জানানাের আহ্বান জানান। পার্লামেন্ট সদস্যগণ জাতির প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং দেশের অবস্থানকে শক্ত করছে। কোনাে হুমকি সদস্যদের নতাে করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম থেকে কাপুরুষােচিতভাবে উচ্ছেদ হচ্ছে এবং চীনের দিকে হামাগুড়ি দিচ্ছে, ভারতকে হুমকি ও যুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে। এক্ষেত্রে হতবল হওয়া ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র অভদ্র ও জেদি মনােভাব নিয়ে একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। ভারত সরকারের প্রতি তার আস্থা রয়েছে এই চ্যালেঞ্জ সরকার যথাযথ মােকাবিলা করতে পারবে। জ্যোতির্ময় বসু বলেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন অসৎ ও উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে নিউক্লিয়ার সজ্জিত বিমানবহনকারী এন্টারপ্রাইজ মালাক্কা থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে ভারত মহাসাগরের দিকে পাঠাচ্ছে। এটা শুধু নিউক্লিয়ার সজ্জিত নৌবহর নয়, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে অনেকগুলাে এমফেবিয়ান শিপ (উভােচর জাহাজ) এবং বহুসংখ্যক ডেস্ট্রয়ার। এন্টারপ্রাইজ নামক এই নৌ জাহাজে ৯৯ হাজার টন ভেসেল যুক্ত, যা যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারক্রাক্ট বহনকারী যুদ্ধ জাহাজগুলাের বৃহত্তম। এই নৌবহর ১০০টি যুদ্ধ বােমারু বিমান বহন করতে সক্ষম। যুদ্ধ বিমান, গােয়েন্দা বিমান, ফাইটার এবং হেলিকপ্টার এর সঙ্গে যুক্ত। যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। এস, এম, ব্যানার্জি তার বক্তব্যে বলেন, পাকিস্তান রেডিও বিশেষকরে লাহাের রেডিও তাদের সৈন্য ও অফিসারদের এই বার্তা দিয়েছে যে, ভারতীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে সপ্তম নৌবহর আসছে তাদের পক্ষে। এটা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি। দেশবাসীর জানা আছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও সরকার এতে ভীত হবে না। যদি সপ্তম নৌবহর ভারতের মাটি স্পর্শ করে তাহলে তাদের নর্থ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের মতাে ভাগ্যবরণ করতে হবে। এমনি পরিস্থিতি বিবেচনায় সােভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো প্রয়ােগ করে। ভেটো প্রয়ােগের কয়েক ঘন্টা পূর্বেই যুক্তরাষ্ট্র আণবিক শক্তি সজ্জিত সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রেরণের নির্দেশ দেন। রেডিও পাকিস্তানের খবর অনুসারে, ১৫ই ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পৌছাবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের ঐ অংশে একটি ঘাঁটি তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যে সমস্ত মার্কিন নাগরিক রয়েছে তাদের এবং পাকিস্তানের সামরিক অফিসার ও বেসামরিক লােকদের উদ্ধারের জন্য সপ্তম নৌবহরকে পাঠানাে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত লক্ষীকান্ত ঝা যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সহকারী সচিব সিসকোর সঙ্গে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নেওয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নিস্তব্ধতা খুঁজে পান। এটা ছিল ব্রিতকর অবস্থা। বাংলাদেশে তখন ৪৭জন মার্কিন নাগরিক ছিল তা মধ্যে ৩০ জন ছিল মিশনারিজ। সেজন্য এটা সহজেই বােধগম্য যে, যুক্তরাষ্ট্র যা বলেছিল তার নেপথ্যে ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকাও বিচিত্র নয়। |
১৫ই ডিসেম্বর সােভিয়েত ইউনিয়ন মিসাইলসজ্জিত যুদ্ধজাহাজ ভারত মহাসাগরে প্রেরণ করে। জাপান এবং কোরিয়া এলাকা ত্যাগ করে নৌবাহিনী ভারত মহাসাগরের অভিমুখে যাত্রা শুরু করে, যেখানে সপ্তম নৌবহর পৌছে গিয়েছিল। সাধারণভাবে এটা। বিশ্বাসযােগ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর প্রতিরােধে এটা ছিল সােভিয়েত রাশিয়ার অনমনীয় সিদ্ধান্ত, যা বিশ্ব যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। এই সময় অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকার করে যে, পূর্ব পাকিস্তানে “বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ঠেকাতে তারা সপ্তম নৌবহর পাঠায়নি।” পর্যবেক্ষকগণ বিশ্বাস করেন, সােভিয়েত যুদ্ধ জাহাজের আগমনের ফলে মার্কিন নৌবহরকে থেমে যেতে হয়েছিল। অনেকেই এই অভিমত পােষণ করেন যে, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে সাহায্যের জন্য সপ্তম নৌবহর পাঠানাে হয়নি, বরং চীনকে দেখানাে যে, তারা রাশিয়ার বিপক্ষে। প্রকৃত পক্ষে এই সময় বাংলাদেশের পূর্ব আঞ্চলিক কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল নিয়াজী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে এবং আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু মার্কিন যুদ্ধজাহাজ বঙ্গোপসাগরের চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে দু’দিন মাত্র সময় লাগত। আত্মসমর্পণের ফলে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বলতে পেরেছে।

‘আমাদের সাহায্যের আগেই তােমরা আত্মসমর্পন করে বসে আছে। তারপরেও যুক্তরাষ্ট্র এই কৃতিত্ব নিয়েছে যে, তাঁদের কার্যক্রম বিশেষকরে সপ্তম নৌবহর পাঠানাের ফলে পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।  যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানাে নিয়ে দু’ধরনের মতামত বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। একটি হলাে ভারতকে বুঝানাে যে, সংঘর্ষ বন্ধ করতে হবে; দ্বিতীয়ত, পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছে যে, ভারত সুযােগ পেলে গােটা পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দেবে এবং দখল নেবে; তৃতীয়ত, চীনকে বােঝানাে যে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নিয়েছে। অন্য মতামত এভাবে বলা যায়, আরাে কয়েকদিন যুদ্ধ চললে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন সক্রিয়ভাবে চলমান যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করত। এই মতামত এভাবে উপলব্ধি করা যায়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে সােভিয়েত রাশিয়া যুদ্ধ শেষ করার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছিলাে যেন দশ দিনের ভেতরে যুদ্ধ। শেষ হয়। সােভিয়েত রাশিয়া অবশ্য এই অঙ্গিকারও করেছিল, চীন যদি হিমালয় অতিক্রম করে ভারতকে আক্রমণ করে, তাহলে রাশিয়া প্রকাশ্যে সিংকিয়াং আক্রমণ। করে দখলে যাবে। সােভিয়েতের অঙ্গিকার ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানাে। এই বিষয়গুলাে সােভিয়েত রাশিয়ার মুখপাত্র প্রাভদা ও রেড স্টার-এ প্রকাশিত হয়েছে। প্রাভদা মন্তব্যকারী প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন নৌবহরের এমনকি কাজ ছিল যে তারা ভারত মহাসাগরে এসেছিল। এই অঞ্চলে পরিস্থিতিকে জটিল করার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র গান-বােট কূটনীতি পরিচালনা করেছে। রেড স্টার-এর এক প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়, ভারত মহাসাগর আমেরিকার লেক নয়’। এতে বলা হয়েছে, মার্কিন ফ্লিট যদি ভারত মহাসাগরে আসতে পারে তাহলে অন্যরাও আসতে পারে। টাইমস অব ইন্ডিয়া-র গিরিলাল জৈন লিখেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ঠেকিয়ে দিতেন যদি তিনি দেখতে না পেতেন যে, এতে সরাসরি সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যাবে। ২১শে ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদে যে প্রস্তাব গৃহীত হয় সেখানে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ না থাকলেও প্রস্তাবে বলা হয়েছিল। ‘সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য’ শব্দগুলাে যুক্ত করার মাধ্যমে পরােক্ষভাবে বাংলাদেশকেও ঐ। প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে বুঝানাে

হয়েছে।২২০
উপসংহার
প্রথম পর্বে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, ভারতের জনগণ, শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিভিন্ন সংস্থা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল এবং জনপ্রতিনিধিবর্গ বাংলাদেশ সংকট নিয়ে এমনভাবে অগ্রসর হয়েছিলেন যেক্ষেত্রে ভারত সরকার জনমতকে কোনোভাবেই অবমূল্যায়ন করতে পারেনি। বাংলাদেশ সংকটকে ভারত ও বিশ্ব জনমত এমনভাবে প্রবাহিত হয়েছিল যেক্ষেত্রে কূটনৈতিক নীতি নির্ধারণে ভারত সরকারকে খুব একটি বেকায়দায় পড়তে হয়নি। অভ্যন্তরীণ জনমত কূটনৈতিক ক্ষেত্রকে এমনভাবে প্রসারিত করেছিল যেখানে মানবিক মূল্যবােধ এবং স্বাধীন বাংলার গণ-আকাক্ষার রূপায়ণে সরকারকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। অভ্যন্তরীণ গণ-আকাক্ষার মূল্যায়ন করতে গিয়ে ভারত সরকারকে জুন-জুলাই পর্যন্ত মিত্রহীন অবস্থায় কূটনৈতিক ক্ষেত্রে একাকী লড়াই। করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বাত্মক উদ্যোগে পরিচালিত কূটনৈতিক নীতি ও ব্যবস্থা দিয়ে একটি সুসমন্বিত কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। যার ফলে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকা ছিল সুনির্দিষ্ট, সুস্থির এবং লক্ষ্যাভিসারী। কোনােক্রমেই ভারতকে তার কূটনৈতিক লক্ষ্য থেকে অদৃশ্য করা সম্ভব হয়নি। সাময়িকভাবে কৌশলগত কারণে পরাশক্তি ও বৃহৎ শক্তিগুলাের সঙ্গে আপােষমূলক আচরণ লক্ষ্য করা গেলেও তা ছিল ঘুরেফিরে পুনরায় মূল লক্ষ্যের দিকেই অনুবর্তন। প্রথম পর্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়টি বারবার বিভিন্নভাবে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে উচ্চারিত হয়েছে। কূটনৈতিক পরিভাষায় কোনাে রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে যে সকল উপাদান ও বস্তুগত সংশ্লেষ অপরিহার্য প্রথম পর্বে সে কথা উল্লেখিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সার্বিক শর্ত পূরণ সত্ত্বেও সহসাই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রতিবন্ধকতা দ্বিতীয় পর্বে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলােচিত হয়েছে। রাজনৈতিক কূটনীতিকে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও চাতুর্যের সঙ্গে ভারত সরকার সামরিক কূটনীতিতে রূপান্তরিত করেছিল যা ছিল অনন্যসাধারণ । বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে কাঙ্খিত পরিণতির দিকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে কূটনৈতিক ইতিহাসে তা দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখিত থাকবে।
 

সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কূটনৈতিক যুদ্ধ – আবু সাইয়িদ