You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.11.20 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বিজ্ঞান গবেষণা সার্বিক উন্নয়নের সহায়ক | গ্রীসে গণতান্ত্রিক শক্তির জয়যাত্রা | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২০শে নভেম্বর, বুধবার, ১৯৭৪, ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

বিজ্ঞান গবেষণা সার্বিক উন্নয়নের সহায়ক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আণবিক শক্তি কমিশনের যৌথ উদ্যোগে গত পরশু সোমবার থেকে ঢাকায় এক আন্তর্জাতিক পদার্থ বিজ্ঞান সিম্পোজিয়াম শুরু হয়েছে। এই আলোচনায় কিছু বিদেশী প্রতিনিধিও উপস্থিতি হয়েছেন। এঁদের মধ্যে প্রফেসর ইরয়নয় (স্টুট গার্ট বিশ্ববিদ্যালয় ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মান), প্রফেসর এ.টি.জি ফারগুসন (আণবিক গবেষণাকন্দ্র, হারওয়েল, ইংল্যান্ড), প্রফেসর জি. আইবগ (এসটক বিশ্ববিদ্যালয় জি.ডি.আর), প্রফেসর এম মেহতা (ভাবী আণবিক গবেষণা পরিষদ, বোম্বে) প্রমুখ প্রধান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দেশের বিজ্ঞান প্রতিভা ও মেধার যথাযথ প্রয়োগ, বিজ্ঞানীদের যোগ্যভাবে ব্যবহার করা ও তাদের কাজের পরিবেশে সৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। তিনি আরো বলেন যে, আজকের দিনে বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে সংস্কৃতি চর্চা সম্ভব নয়। তিনি অবশ্য এ কথাও তার বক্তব্যে স্বীকার করেন যে, দেশের বিজ্ঞান গবেষণা পরিবেশ বর্তমানে নানা অসুবিধা হেতু বিঘ্নিত। কিন্তু তবু দেশকে বর্তমানের অবস্থা থেকে টেনে তুলে সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনার পথে পরিচালিত করার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক সহায়তাই সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। সে ব্যাপারে দেশী বিজ্ঞানীদের ভূমিকার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
পদার্থ বিজ্ঞান সিম্পোজিয়াম উদ্বোধনী ভাষণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন যে, বিজ্ঞান, কারিগরি বিদ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযোগ্য ব্যবহার ছাড়া কোনো দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি আসতে পারে না। আমাদের সামনেও সেই পথ। দেশের তরুণ বিজ্ঞানীগণ সেই পথকে সুগম করবে এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের সৃষ্টিধর্মী মৌলিক কাজও করতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। সিম্পোজিয়ামের সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ.কে.এম. সিদ্দিক উক্ত অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন যে, দেশে বিজ্ঞান গবেষণা সম্প্রসারিত ও কার্যকরী করতে হলে সরকারকে একটি জাতীয় বিজ্ঞান নীতি প্রণয়ন ও জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদ গঠন করতে হবে। কারণ এই সংহতির অভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে এবং বিজ্ঞান গবেষণাগারগুলোতে যে গবেষণা হয়, তার অধিকাংশই আলাদা আলাদা থেকে যায়। জাতীয় স্বার্থে কোনো কাজ দেয় না। তিনি বিজ্ঞানের সাধনা ও গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ তহবিল বরাদ্দের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমান বিশ্ব বিজ্ঞানকেন্দ্রিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমেই উন্নতি, সমৃদ্ধি, প্রগতি ও সভ্যতার শীর্ষ মার্গের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ কথাটির সার্থক বাস্তবায়ন আজ যে সকল দেশ করতে পেরেছে বা পারছে—সমৃদ্ধির চাবিকাঠি তাদেরই আওতায় আসছে। এবং গবেষণার মাধ্যমে সৃজনশীল কলাকৌশল আবিষ্কার করা এবং বাস্তবে তারই প্রয়োগের দ্বারা উন্নয়নের চাকা ঘুরানো সহজ কথা না হলেও অসম্ভব যে নয়—উন্নত বিশ্বই তার প্রমাণ।
সেদিকে চেয়ে নিজ স্বার্থেই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আজ বিজ্ঞানের সাধনায় সৃজনশীলতা ও মৌলিকতার পরিচয় রাখতে হবে। করতে হবে গভীর সাধনা। ধার করা বুদ্ধি এনে কোনো কারখানা চালু করলে বা তার দ্বারা কোনো যৌথ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করলে সমস্যার সমাধান হবেনা। উন্নতির চাবিকাঠি আনতে হবে হাতের মুঠোয়। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানের কঠোর সাধনা ও গবেষণা আজ আমাদের জন্যও অপরিহার্য। এই প্রসঙ্গে অতীত দীন পটভূমির প্রেক্ষিতকে জাপান কিভাবে পাল্টে দিয়েছে সে কথা স্মরণযোগ্য। সৃজনশীল বিজ্ঞান গবেষণা ও তার বাস্তবায়নের দ্বারা জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধিকে করায়ত্ত করে জাপান আজ স্বয়ম্ভর ও উন্নত দেশ বলে গণ্য হচ্ছে।
এ কথা সত্য যে, নতুন দেশ হিসেবে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে মাত্র বছর তিনেক আগে। বহু বিজাতি ও বিভাষীর শাসন ও শোষণে এদেশের বুদ্ধিজীবী সহ বিজ্ঞানীরা ছিল এতকাল কোণঠাসা। তাদের কাজের প্রতি ছিল না কারুর কোনো শ্রদ্ধা বা সাহায্য-সহযোগিতার নিশ্চিত আশ্বাস। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে গেলে আজ যথার্থই এদেশে জাতীয় বিজ্ঞাননীতি ও জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদ গঠনের প্রকট প্রয়োজনীয়তা আছে। যাতে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গবেষণা কর্মের মধ্যে একটা যোগাযোগ থাকে এবং কোনো বিজ্ঞান সাধনার ফল বা কোনো মৌলিক সৃজনশীল কর্মের নমুনা যেন বিফলে বয়ে যেতে না পারে।
আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের জন্য আর্থিক সহযোগিতা ও কর্মের পরিবেশও চাই। সৃজনধর্মী কর্ম দ্বারা এদেশের বিজ্ঞানীরা যখনই কোনো কিছু আবিষ্কার করবেন তখনই তার প্রতি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমরা দেখেছি, এদেশেরই বিজ্ঞানীরা ছোলার ডাল থেকে উচ্চহার প্রোটিনযুক্ত শিশুখাদ্য, উন্নতমানের ঔষধ, মোড়কের কাগজ, অপরিশোধিত তেল টেস্টার, স্বল্প সরঞ্জামের ট্রানজিস্টার ইত্যাদি তৈরী করেছেন। দুঃখের বিষয় এসব নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাথা ঘামানো তো দূরের কথা সামান্যতম লোক দেখানো হৈ চৈও আমরা শুনিনি।
তাই বলতে হয়, শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে এবং বস্তা বস্তা বক্তৃতার পাতা উড়িয়ে বাস্তবকে ছোঁয়া যায় না। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, কোনো প্রতিভাই পর্যাপ্ত লালন ও অনুকূল পারিপার্শ্বিকতা না পেলে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে না। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, যার স্মৃতিচারণে এই সিম্পোজিয়াম আয়োজিত সেই বিজ্ঞানী অধ্যাপক সত্যেন বোস এদেশেরই সন্তান। এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করার মতো প্রতিভাও এদেশে আছে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

গ্রীসে গণতান্ত্রিক শক্তির জয়যাত্রা

সুদীর্ঘ দশটি বছর পর গ্রীসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী কারামনলিসের নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। কারামনলিস ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত একটানা ন’টি বছর ধরে গ্রীসের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নির্বাচনে পরাজয়ের পর কারামনলিস ফ্রান্সে স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাল কাটান। ১৯৬৭ সালে গ্রীসে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। তারপরও অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে দু’বার। বর্তমান বছরে সাইপ্রাস সংকটকে কেন্দ্র করেও একটি অভ্যুত্থান ঘটে গ্রীসে। সর্বশেষ অভ্যুত্থানকারীরা গ্রীসকে সামরিক জান্তার হাত থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য এবং দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য কারামনলিসের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দেন।
এগারো বছর স্বেচ্ছা নির্বাসন যাপন করার পর প্রায় চার মাস আগে কারামনলিস সামরিক জান্তার হাত থেকে ক্ষমতা গ্রহণের সময় বলেছিলেন, তিনি গ্রীসকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে নেবেন। সামরিক জান্তা যে সাতটি বছর গ্রীসের শাসনভার পরিচালনা করেছেন, সেই বছরগুলোতে নির্যাতন এবং নিবর্তনমূলক বহু কালাকানুনই জারী করা হয়েছিল। কারামনলিস গ্রীসের ক্ষমতা গ্রহণের অব্যবহিত পর পরিই নিবর্তনমূলক সমুদয় কালাকানুন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিয়েছেন। সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণাদেশ বাতিল করেছেন। সামরিক আইনের কোনো ধারাই তিনি বলবৎ রাখেননি। সুদীর্ঘ তিরিশ বছরব্যাপী যে কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল, সেই কম্যুনিস্ট পার্টির উপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন এবং সর্বোপরি কনস্টান্টাইন কারামনলিস ঘোষণা করেছেন যে, তিনি গ্রীসের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ঘটাবেন। কারামনলিস ক্ষমতা গ্রহণ করেই গ্রীসে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছেন এবং ঘোষণানুযায়ী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছেন। নির্বাচনে কারামনলিসের পার্টিই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে কারামনলিস সর্বপ্রথম এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আগামী চারটি বছর হলো আমাদের কঠোর পরিশ্রমের সময়। গ্রীসকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই চারটি বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী কারামনলিস অঙ্গীকার করেছিলেন, ‘যদি জয়ী হই, গ্রীসকে আমি একটি পরিপূর্ণ এবং নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করবোই।’ গ্রীসে নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা, কারামনলিসেরই বিজয়। এবং এতে করে গ্রীসের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের পথও সুগম হলো বলেই আমরা মনে করি।
সামরিক শাসনের যাঁতাকলে গ্রীস সাতটি বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে কাল কাটিয়েছে। সামরিক শাসনামলে গ্রীসে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সব পথ ছিল ‍রুদ্ধ। এবারের নির্বাচন তাই গ্রীসকে গণতন্ত্রের পথে উজ্জীবনের ব্যাপারে সহায়ক শক্তি হিসেবেই কাজ করবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা গ্রীসকে গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হবেন সচেষ্ট। কারামনলিস শুধু রাজনৈতিক সংকট নয়, অর্থনৈতিক সংকটের কবল থেকেও গ্রীসকে মুক্ত করার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থাবলম্বন করেছেন। কারামনলিস ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাকে তাঁর ভাষায়,‘সংকটের লীলাক্ষেত্র’ হিসেবে দেখতে চান না বলেই ন্যাটোর সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কারামনলিস বিশ্বাস করেন, শাসনতান্ত্রিক সংশোধনী ছাড়া গ্রীসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কারামনলিসের পার্টির বিজয়ে গ্রীসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে এসেছে। ভবিষ্যতে গ্রীস একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক বিধিসম্মত দেশে পরিণত হবে, প্রধানমন্ত্রী কারামনলিসের প্রতিশ্রুতি থেকে সেই ইঙ্গিতই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গ্রীসে আজ আর সামরিক জান্তার পদভার নেই। সামাজিক বিধি বিধানও অপসৃত। গ্রীসে এখন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করছে। গ্রীসে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের জয়যাত্রা অব্যাহত থাক, গণতান্ত্রিক প্রতিটি দেশই তা চাইবেন, কিন্তু কারামনলিস নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছুতে পারবেন কি?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন