You dont have javascript enabled! Please enable it!

জহির রায়হান অপরাধী
– শহীদুল হক খান

একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারী সময়টা সম্ভবত সকাল পৌনে আটটা। চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার শহীদ মিনার চত্ত্বরে অনেক মানুষের ভীড়ে, একজন ছোট খাট বেটে মানুষ। সাদা শার্টের সঙ্গে পরনে কালো ফুল প্যান্ট, খালি পা। বুকের মাঝে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা লেখা একটুখানি কাগজ। দুটা হাত আড়াআড়ি করে দাড়ানো। তাকিয়ে আছেন নবনির্মিত শহীদ মিনারের দিকে। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

আমি গিয়ে পাশে দাড়ালাম।

অনেকক্ষণ কিছু অনুমান করতে পারলেন না। এক সময় অনুভব হওয়াতে তাকালেন। একটু হাসতে চাইলেন কিন্তু থেমে গেলেন। মুখ থেকে শুধু একটা প্রশ্ন বেরুলো – কেমন আছেন?

বলতে চাইলাম, ভালো। কিন্তু আমিও থেমে গেলাম। প্রশ্ন রাখলাম, কিছু ভাবছিলেন বোধ হয়?

ঠিক দীর্ঘশ্বাস নয়, তবে কিছুটা ভাবনা ক্লান্তি তাড়াতে চেষ্টা করলেন। এরপর বললেন, হ্যাঁ, ভাবছিলাম একটা শহীদ মিনারের কথা। এই সালাম – বরকত – রফিকের শহীদ মিনার নয়। আপনার আমার অনেক মানুষের। একটা বিরাট শহীদ মিনার দেখবেন একদিন ঠিক বানাবার প্রয়োজন হবে। সেদিনও আমরা এমনি সবাই মিলিত হবো – তবে ভাষার জন্য নয়। আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য। আমাদের অধিকারের জন্য।

কথাগুলো দুর্বোধ্য নয়। নির্যাতিত , শোষিত মানুষের অনেকদিনের লালিত একটা স্বপ্নের পরিণতির গণ্ধ ছিল। তবু কেন যেন মনে হোল এটা অসম্ভব। ঠিক ঐ মুহূর্তে কিংবা খুব একটা তাড়াতাড়ি হয়তো সম্ভব নয়। তাই সেদিন সেই মানুষটিকে কিংবা বলা যায় তার ভাবনাকে ভেবেছিলাম অপরাধী।

আজ তিরিশে জানুয়ারীর সম্মুখে দাড়িয়ে ভাবছি অপরাধ আসলে কার?

আমি বলছি জহির রায়হান এর কথা।

চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান।

কথাশিল্পী জহির রায়হান।

চিত্রাভিনেত্রী সুমিতা দেবী ও সুচন্দার স্বামী জহির রায়হান।

বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক এবং কর্মী জহির রায়হান।

জহির রায়হানকে নিয়ে অনেক বিতর্ক। আলোচনা তার প্রতিভা নিয়ে। বিতর্ক ব্যাতিক্রম মূলক কতকগুলো ঘটনা নিয়ে। এবং সবচাইতে যেটা চরম ঘটনা তা হচ্ছে জহির রায়হান নিখোঁজ। আজ দীর্ঘদিন তিনি সকল মানুষ থেকে, সকল প্রয়োজন থেকে দূরে – অনেক দূরে।

আমাদের অনুমান তিনি মৃত। সরকারী ঘোষণা আজও অনুচ্চারিত। তবে জহির রায়হান নেই, জহির রায়হান আর কখনো ফিরে আসবেন না, এটাই আজ ধরে নেয়া সম্ভব। এবং সে কারণেই এই একটি মাত্র দিন অর্থাৎ তিরিশে জানুয়ারীকে উপলক্ষ করে আমরা কেউ বসছি দু – কলম লেখার জন্য। কেউ আয়োজন করছি কোন আলোচনা চক্রের। কারো বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস বেরুচ্ছে। কেউ বুক চাপড়ে বলার সুযোগ পাচ্ছি – জহির রায়হানের যা কিছু, সব তো আমিই শিখে নিয়েছি।

এতে কার কতটা লাভ হয় আমি জানি না তবে এইটুকু জানি জহির রায়হানের কোন লাভ হয় না। কেননা তিনি নেই। তিনি কখনো আসবেন না। তবে জহির রায়হান আছেন, জহির রায়হান থাকবেন, এটা চরম সত্য কথা।

যেদিন কাগজে সংবাদ বেরুবে সুচন্দা একজন ব্যবসায়ীকে বিয়ে করলেন। যেদিন চিত্রজগতের কেউ আর জহির রায়হান প্রসঙ্গ তুলবেন না, সেদিন হয়তো মনে হবে জহির রায়হান নেই। তবে যেদিন খবর ছাপা হয় স্টপ জেনোসাইড ছবির জন্য জহির রায়হান মরণোত্তর পুরষ্কার পেলেন। যেদিন এদেশের চিত্রশিল্পের ইতিহাস লেখা হবে। যখন কোন আলোচনায় এদেশের একজন নির্ভিক চিত্র পরিচালকের কথা উঠবে, যেদিন হাজার বছর ধরে, বরফ গলা নদী কেউ চিত্রায়িত করবেন, যেদিন অপু তপু বড় হবে সেদিন জহির রায়হান আবার বেঁচে উঠবেন। বেঁচে থাকবেন অনেকদিন এবং হয়তো চিরদিন।

জহির রায়হান একজন মানুষ। অনেক সাধারণ মানুষের ভীড়ে একজন অসাধারণ মানুষ।

জহির রায়হান ভালো লিখতেন। জহির রায়হান ভালো বলতে পারতেন। জহির রায়হান ভালো ছবি বানাতে পারতেন। এগুলো সচরাচর জহির রায়হানের গুণ হিসেবে উচ্চারিত। সে সঙ্গে আরো উচ্চারিত জহির রায়হান নিত্যনতুন গুজবের জন্ম দিতেন। মেয়েঘটিত ব্যাপারে বেশী জড়িয়ে পড়তেন। জহির রায়হান বড় বেশী ইমোশনাল ছিলেন।

জহির রায়হান ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে আরও অনেক দাবী, অনেক অধিকার, অনেক বক্তব্যের সমর্থক হিসেবে বার কয়েক কারা বরণ করেছেন। হয়তো সে সময় থেকেই কিংবা তারও আগে থেকেই লেখায় হাতে খড়ি। লিখেছেন ছোট গল্প, কবিতা, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ। সে সঙ্গে জড়িয়েছিলেন কিছু পত্রিকার সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে।

এরপর চলচ্চিত্র

শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে ‘র লেখক পরিপূর্ণ ভাবে উপস্থিত চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে৷ প্রথম ছবি কখনো আসেনি। এরপর এক এক করে অনেক ছবি। কাঁচের দেয়াল সঙ্গম আনোয়ারা কাঁচের দেয়াল, জীবন থেকে নেয়া কিংবা তারও পরে এবং সব শেষে স্টপ জেনোসাইড।

পৃথিবীর সব দেশেই যেমন একজন বিতর্কিত এবং সংগ্রামী চিত্র নির্মাতা থাকেন, জহির রায়হান আমাদের দেশে তাই। তার উপস্থিতি এমন একটা সময়ে যখন আমাদের পুঁজির ভান্ড শুন্য। তার গতি এমন একটা পথ ধরে সে পথ সবার কাছে এবং সবার জন্য অপরিচিত। অবিশ্বাস্য। তাই একদিনের সহকারী চিত্র নির্মাতা একজন সৃজনশীল চিত্র নির্মাতার ভূমিকা পেলেন। চলচ্চিত্র সৃষ্টির বিচারে শ্রেষ্ঠ চিত্র নির্মাতার সম্মান পেলেন। এবং সে সময়ে এমন একটা জায়গায় এসে দাড়ালেন যেখানে তিনি একক৷ তিনি অনন্য।

ইস্কাটনের একটা বড় দালানের এক তলা আমি এক দিন, দু দিন, তিন দিন পর পর গেলাম। উদ্দেশ্য জহির রায়হানের সাক্ষাৎকার গ্রহন। কিন্তু জহির রায়হান অনুপস্থিত। যেদিন তাকে সম্মুখে পেলাম – দূর থেকে এগিয়ে এসে কাঁধটা চেপে ধরে বললেনঃ শুনেছি আপনি কদিন আমাকে খুঁজতে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমার একটা মুহূর্তও সময় নেই। তাড়াহুড়ো করে যদি লেট দেয়ার বী লাইট শেষ না করতে পারি তাহলে এ ছবি বানাবার কোন মানে থাকবে না। আপনি আর কটা দিন অপেক্ষা করুন – এরপর একদিন সময় করে আমরা বসবো।

কিন্তু জহির রায়হানের সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। জহির রায়হান আর কোন দিন আমার সঙ্গে বসতে পারেননি। আমার অভিযোগ ঠিক সে কারণে নয় – আমি জহির রায়হানকে অপরাধী করবো কেন তিনি লেট দেয়ার বী লাইট শেষ করে গেলেন না। কেন নিজের লেখা অসাধারণ সৃষ্টি হাজার বছর ধরে – বরফ গলা নদী, আর এক ফাল্গুন নিজে চিত্রায়িত করে গেলেন না। আমি আরো অভিযোগ জানাবো কেন জহির রায়হান এ চিত্রশিল্পে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। যে জহির রায়হান পুঁজির জন্য, ভালো কিছু সৃষ্টির জন্য নিজেকে অর্থের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সুয়োরানী, দুয়োরাণী, কুচবরণ কন্যা বানাতে বাধ্য হয়েছিলেন, সে জহির রায়হান কেন আজ অনুপস্থিত, যখন ব্যাঙের ছাতার মত চতুর্পাশে শুধু প্রযোজক আর পরিবেশকদের জটলা। কেন জহির রায়হান এদেশে ভালো ছবি নির্মাণের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন? কেন জহির রায়হান অল্প দিনে ছবি বানানো সম্ভব এটা প্রমাণ করেছিলেন। অভিযোগ এখানেই শেষ নয়।

জহির রায়হান কে ছিলেন, কেমন ছিলেন তা আমরা কোনদিন খুঁজতে যেতাম না – যদি না জহির রায়হানের সৃষ্টির সঙ্গে আমাদের পরিচয় না ঘটতো –

জহির রায়হান একের মাঝে এতগুলো প্রতিভা নিয়ে উপস্থিত না হতেন। যেহেতু জহির রায়হান ছিলেন, জহির রায়হানের মাঝে আমরা প্রতিশ্রুতি দেখেছিলাম – তাই জহির রায়হানকে অপরাধী করবো তার দায়িত্ব অসমাপ্ত রেখে অন্তর্ধান করার জন্য। তিনি আরও অপরাধী চিত্রজগতের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে চিত্রজগতকে অসহায় অবস্থায় ফেলে যাবার জন্য। নিজে চলে গেছেন আমাদের দুঃখ নেই। তাকে আমরা পুরোপুরি পেলাম না। যেদিনটার জন্য জহির রায়হান চিত্রজগতে প্রবেশের শুরু থেকেই অপেক্ষা করেছিলেন সে দিন আজ এসেছিলো। আজ এ মুহূর্তে তাকে সবচাইতে বেশী দরকার ছিল। অথচ জহির রায়হান নেই। তার হাতে গড়া শিল্পী রাজ্জাক আজ চিত্রজগতের প্রধান অভিনেতা, ববিতা আন্তর্জাতিক সম্মানে সম্মানিতা। তার সহকর্মীদের অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু জহির রায়হান কিছুই দেখলেন না। এ জন্যেও হয়তো আমরা দুঃখ জানাবো না। তবে জহির রায়হানের যারা দর্শক, যারা প্রতি বছর বিশেষ কতকগুলো সময়ে অপেক্ষা করে থাকতেন জহির রায়হানের ছবি দেখার জন্য, তাদেরকে কে কি জবাব দেবেন আমি জানি না। জানি না কিভাবে জহির রায়হানের পাঠকদের চাহিদা পূরণ করবেন। আর এও জানি না অপু তপুর কাছে বাবার পরিচয় নিয়ে কে এসে দাড়াবে। ওরা যদি কোন দিন ওর বাবাকে খোঁজে তাহলেই বা কি বলবে। তাই আমি জহির রায়হানকে অপরাধী করবো।

আমরা যখন দেশ পেলাম, অধিকার পেলাম – সেদিন জহির রায়হান চলে গেলেন৷ চলে গেলেন আমাদেরকে নিঃস্ব করে। আমাদেরকে তার সৃষ্টির স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে। তবু আমরা অসন্তুষ্ট হতাম না। যদি এক টুকরো মাটি পেতাম। অপু তপুর সঙ্গে আমরাও যদি সেখানে গিয়ে দাড়াতে পারতাম। অন্তত তার আদর্শ না মেনে হোক, তার তৈরী করা পথ ধরে না চলে হোক – তবু অন্ততঃ গিয়ে একবার শ্রদ্ধা জানাতে পারতাম। অন্তত এইটুকু বলতে পারতাম – আমরা আজও কোন বিকল্প খুঁজে পাইনি। সুচন্দা হয়তো পাবেন – তার যারা সহকর্মী, তারাও হয়তো পাবেন কিংবা পেয়েছেন কিন্তু আমরা কি করবো? কার মাঝে তাকে খুঁজবো যারা সে মিছিলে ছিলেন এক এক করে সবাই তো আমাদেরকে নিরাশ করলেন। কিন্তু আর কতদিন?

আর কত দিন?

ইউনিকোডে টাইপ – Maruf Muktadir Khan

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/02/1971.01.31-bichitra.pdf” title=”1971.01.31 bichitra”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!