You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩০শে নভেম্বর, শনিবার, ১৯৭৪, ১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

ঢাকা-বার্লিন সহযোগিতা চুক্তি

ঢাকায় স্বাক্ষরিত এক অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তির অধীনে পূর্ব জার্মানী বাংলাদেশকে প্রকল্প সাহায্য হিসাবে ১ কোটি পাউন্ড (১৯ কোটি টাকা) ঋণ প্রদান করবে। বাংলাদেশেকে এগারো বছর মেয়াদে পূর্ব জার্মানীর কাছে পণ্য রপ্তানী করে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণের বার্ষিক সুদের হার হচ্ছে শতকরা আড়াই ভাগ। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। একই দিনে দুই দেশের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পূর্ব জার্মানীর দেয়া এই ঋণের অর্থ ক্যালসাইন সোডা কারখানা, কৃষি যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত ওয়ার্কশপ, চাউলের কল ও কোর্টাল ক্রেন এবং টাইপরাইটার সংযোজন কারখানা সহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পের জন্য ব্যয় করা হবে। এই ঋণের বাইরে পূর্ব জার্মানী বয়ন ও সার শিল্পে নিয়োজিত ৬০ জন অফিসারকে প্রশিক্ষণ দান করবে।
স্বাক্ষরিত সাংস্কৃতিক সহযোগিতা কর্মসূচী অনুযায়ী দু’দেশের মধ্যে অধ্যাপক, শিক্ষার পরিকল্পনার প্রণেতা ও প্রশাসক বিনিময়ের ব্যবস্থা রয়েছে। পূর্ব জার্মানীতে উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য বাংলাদেশকে ১৪টি বৃত্তি দেওয়া হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বাংলাভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়নের জন্য পূর্ব জার্মানীকে একটি বৃত্তি দেবে। শিল্প সাহিত্য ক্ষেত্রে পূর্ব জার্মানী ও বাংলাদেশ শিল্পী, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল বিনিময় করবে।
স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে আবার পূর্ব জার্মানী বাংলাদেশের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশই ঘটালেন। জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ পূর্ব জার্মান সরকার ও জনগণের অকুণ্ঠ সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়ে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে এক ফিরতি নৈশভোজে ভাষণদানকালে পূর্ব জার্মান মন্ত্রী পরিষদের চেয়ারম্যান মিঃ হস্ট সিন্ডারম্যান বলেছেন, আমাদের দু’টি দেশের জনগণ ভয়াবহ যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞের দুঃসহকাল অতিক্রম করে এসেছে। এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা এ কথা উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, একমাত্র শান্তির মাধ্যমেই আমাদের জনগণ অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
মাননীয় অতিথি মিঃ সিন্ডারম্যানের কথার সুরে সুর মিলিয়ে আমরাও বলবো যে, দু’টি দেশের মধ্যে লক্ষ্য, আদর্শ ও মতামতের মিল রয়েছে বলেই আমাদের মধ্যে নিবিড়তর মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এ মৈত্রী একই আদর্শের অনুসারী দু’টি বন্ধু দেশের মৈত্রী। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্যাপারে স্বাক্ষরিত দু’টি চুক্তি দুই দেশের মধ্যে অধিকতর সহযোগিতার অভিপ্রায়ই প্রতিফলিত করেছে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা চাই

বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে আবার প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এক নাগাড়ে পাঁচ-ছয় ঘন্টা ধরে ঝড় ও বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের তান্ডব চলে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী, রামগতি, হাতিয়া, খেপুপাড়া, ভোলা সহ উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। প্রতিবেদন সূত্র জানাচ্ছে, ঐসব অঞ্চলে ঝড়ের গতিবেগ ছিল কোথাও ৪০ বা ৪৫ মাইল, কোথাও বা ৯০ থেকে ১০০ মাইল। ঝড় শুরু হবার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ঢাকার সাথে একমাত্র চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী সদর ছাড়া ঘূর্ণিঝড় কবলিত অন্যান্য সকল উপকূলীয় অঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পরিস্থিতির মোকাবেলায় সর্বাত্মক তৎপরতা সহযোগে জরুরী ভিত্তিতে ত্রাণ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সকল সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ইতিমধ্যেই নৌবাহিনীর দু’টি জাহাজ ঘূর্ণি-উপদ্রুত উপকূলবর্তী দ্বীপাঞ্চলের উদ্দেশে উদ্ধার কাজে যাত্রা করেছে। এবং অতি সত্ত্বর উপদ্রুত এলাকায় আরো কয়েকটি জাহাজ পাঠাবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকার জান ও মালের যথার্থ ক্ষয়ক্ষতি কি পরিমাণ হয়েছে তা সরেজমিনে তদারক করে খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, লীগ অব রেডক্রসের প্রধান প্রতিনিধি, কয়েকজন চিকিৎসা উপদেষ্টা ও বিভিন্ন বিভাগীয় কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাও ঢাকায় ফিরে এসেছেন। ঝড়ের দিনই দু’টি হেলিকপ্টার ত্রাণ সামগ্রী সহ উদ্ধার কাছে গিয়েও ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য।
রাজনৈতিক দলগুলোর তরফ থেকেও সকল রাজনৈতিক কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতি ঘূর্ণিঝড় কবলিত অঞ্চলে ত্রাণ ও উদ্ধারের কাজে আত্মনিয়োগ করার আবেদন জানানো হয়। রেডক্রস জানিয়েছে যে, দুর্গত অঞ্চলে এখন প্রায় ২০ স্বেচ্ছাসেবক ত্রাণ কাজে নিয়োজিত আছে। ত্রাণের কাজে দুর্গত অঞ্চলগুলোর রাজনৈতিক কর্মী ও নাগরিকদের তরফ থেকেও সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে বলে প্রতিবেদন সূত্রে প্রকাশ।
দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, সর্বনাশা ঝড় ‍ও জলোচ্ছ্বাসের পৌনঃপুনিক আঘাতে আমরা প্রতি বছরই একাধিকবার মর্মান্তিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই। ঠিক নুয়ে পড়া মেরুদন্ডের উপর যেন নেমে আসে ক্ষতির দুর্বহ বোঝা। যার ফলে আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর লক্ষ্য সরে যায় দূর থেকে দূরান্তরে। তখন সর্বশক্তি নিয়োগ করে দুর্গত মানুষগুলোকে দিতে হয় বাঁচার অবলম্বন ও সাজ-সরঞ্জাম। নতুন স্বাধীনতালব্ধ বাংলাদেশের পক্ষে নিঃসন্দেহে সে কাজ দুরূহ ও কষ্টসাধ্য।
তাই উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবনকে জান ও মালের এই নিশ্চিতপ্রায় ক্ষয়ক্ষতির দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত রাখার জন্যই আজ সরকারী পর্যায়ে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। যেন ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস পাওয়া মাত্রই যতটা সম্ভব জান ও মালকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরিত করা সম্ভব হয়। এ কাজ আমাদের জাতীয় স্বার্থানুকূলেই আসবে এবং এতে করে জাতীয় অপচয়ও রোধ হবে। এ ছাড়া ঝড় কবলিত অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির হিসাবের ক্ষেত্রে আরো সঠিক ও যথার্থ রিপোর্ট পেশ করতে হবে। কারণ ক্ষতিপূরণের সেটিই মূল শর্ত। আবেগভিত্তিক রিপোর্টে ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ শুরু করলে ত্রাণ সামগ্রীর অপব্যয় হবার সম্ভাবনা থাকে বেশী, মানবতা থাকে কম এবং যথেষ্ট চুরি ও আত্মসাতের মতো অপ্রিয় কাজগুলো সেখানে আসে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই। সে অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। অতএব জরুরী ভিত্তিতে অভিজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা ক্ষয়ক্ষতির যথার্থ পরিমাণ নির্ধারণ করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে যেন দেশের গণশক্তি ও প্রশাসন শক্তি নিয়োজিত হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের সেদিকেও নজর দিতে হবে বৈ কি!

পর্যটন উন্নয়ন

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলানিকেতন হিসেবে বাংলাদেশের সুনাম সুবিদিত। বাংলার শ্যামল শোভা, বাংলার নদী, বাংলার সমুদ্র সৈকত যে কোনো বিদেশীকেই অনায়াসে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। বাংলার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীই শুধু নয়, বাংলার ঐতিহাসিক স্থান এবং নির্দশনও রয়েছে, যা বিদেশীরা দেখে মনপ্রাণ তৃপ্ত করতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে বিদেশী পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার সুচারু ব্যবস্থা অদ্যাবধি গ্রহণ করা হয়নি। অথচ পর্যটন শিল্পের প্রতি মনোযোগ দিলে, বাংলাদেশ নির্বিঘ্নে প্রতিবছর বেশ কিছু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। তবে, পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা-চরিত্র যে করা হচ্ছে না, তা নয়। বাংলাদেশে পর্যটনের সুষম উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘের উন্নয়ন কার্যক্রম বিশ বছরের জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা তৈরী করতে সম্মত হয়েছে। এই পর্যটন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ আগামী বছরের গোড়ার দিকেই শুরু করা হবে। পরিকল্পনাটি প্রণয়ন সমাপ্ত করতে এক বছর সময় লাগবে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কার্যক্রমের অধীনে যে কারিগরি সাহায্য দেয়া হবে, সে জন্য এক লক্ষ বাষট্টি হাজার ডলারের পুরোটাই বৈদেশিক মুদ্রায় জাতিসংঘের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যয় করবে। বাংলাদেশ সরকার স্থানীয় খরচগুলো বাংলাদেশ পর্যটন সংস্থার মাধ্যমে বহন করবেন। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন সাধন করা একান্ত জরুরী। এই জরুরী ব্যাপারটিতে জাতিসংঘের উন্নয়ন কার্যক্রমের সহায়তা তাই একটি বিশেষ অবদান রাখবে বলেই আমরা মনে করি। পরিকল্পনার কাঠামোটি প্রণীত হওয়ার পর শুরু হবে আসল কাজ। এতে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হবে। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের মোটেলগুলোর উন্নতি সাধন করা দরকার। এছাড়া সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে। পর্যটনকারীরা যাতে সহজ উপায়ে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাতায়াত করতে পারে, সেজন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা একান্ত অপরিহার্য। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত যে বিশ সাল ব্যাপী পরিকল্পনা প্রণীত হবে তাতে বাংলাদেশের পর্যটন মূল্য বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ বিদেশী পর্যটকদের কাছে একটি আদর্শ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হোক। বিশ্বের বহু দেশেই পর্যটন একটি শিল্প হিসেবে বিরাজিত। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বাংলার ঐতিহাসিক নির্দশনাবলী দেখে বিদেশী পর্যটকরা যাতে অভিভূত হন, সে ব্যবস্থা অবলম্বিত হলে দেশের সুনামই বর্ধিত হবে। শুধু সুনাম নয়, এতে আর্থিক লাভালাভের প্রশ্নও জড়িত।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!