You dont have javascript enabled! Please enable it! একাত্তরের অটোয়া -ড. মিজান রহমান - সংগ্রামের নোটবুক
একাত্তরের অটোয়া –ড., মিজান রহমান
মুক্তিযুদ্ধ অটোয়ায় ঘটেনি, ঘটেছিল বাংলাদেশে। হানাদার বাহিনীর শানানাে তলােয়ারের ঝরেনি আমার রক্ত, স্বাধীনতার নিশান উচিয়ে আমি স্পর্ধাভরে ঝাপিয়ে পড়িনি মরণের যঙ্গে-আমি মুক্তিযােদ্ধা নই। হিংস্র পশুগুলাে যখন নির্মম থাবা মেলে ধাওয়া করেছিল অসহায় মানুষকে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল সারা দেশটাতে, আমি তখন নিরাপদ পৃথিবীর নিশ্চিন্ত অধিবাসী। মুক্তির ভাবনাতে আমি যদিও নিমজ্জিত, কিন্তু যুদ্ধের প্রাঙ্গণ থেকে আমি বিদূরিত। নিজেকে মুক্তিযােদ্ধা বলে ঘােষণা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবু, ইতিহাসে একটা কৌতূহল নিশ্চয়ই থেকে যাবে, ঐ সময়টাতে প্রবাসের বাঙালি জনগােষ্ঠী কী ভূমিকা পালন করেছিল। চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী মুগ্ধ পর্যটকের মতাে  আমরা কি কেবলি প্রফুল্ল জীবনের উপাসনাতে মগ্ন ছিলাম, না দেশের কান্না আমাদেরও তাড়িত করতে পেরেছিল বৃহত্তর কোনাে কর্মসূচিতে। নিহতের বিবর্ণ চোখ আর আহতের আকাশ ফাটা চিৎকার যা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবীতে তেজস্ক্রিয় কিরণের মতাে, আমরা কি ছিলাম শুধুই তার নিষ্ক্রিয় শ্রোতা আর নির্লিপ্ত দর্শক? আমি ঐতিহাসিক নই  স্থানকাল পাত্র খাতায়-কলমে লিপিবদ্ধ করে রাখিনি আমি, সুতরাং চলচ্চিত্রের মতাে নিখুঁত বর্ণনা আমি দিতে পারবাে না ঐ কালাে সময়টার নানা ঘটনাপুঞ্জের। শুধুমাত্র স্মৃতির ওপর নির্ভর করে কিছু কিছু আলােকচিত্র তুলে ধরবার চেষ্টা করবাে এ নিবন্ধে। আশা করবাে যে তথ্যাপিপাসু পাঠকের খানিকটা তৃষ্ণা মিটবে এতে ব্যাপক গবেষণার ফলশ্রুতি নয় আমার এই উদ্যোগ, সুতরাং সবটা মহাদেশের কথা আমি বলতে পারবাে না, এমনকি সবটা কানাডার কথাও আমার বলা উচিৎ হবে না। আমি শুধু অটোয়ার কথাই বলবাে যেখানে আমি সপরিবারে বাস করেছি উনিশ শ’ পঁয়ষট্টি সাল  থেকে একটানা।
বাংলাদেশের এলাকা থেকে আগত প্রবাসীর সংখ্যা তখন হাতে গােনার মতােসব মিলিয়ে হয়তাে ত্রিশ কি চল্লিশ জন। চারপাঁচ জন ছাত্র ছিল পাকিস্তান সরকার বা অন্য কোনাে সংস্থার বৃত্তিভােগী, বাকি সবাই চাকরিজীবী। ছাত্রদের মধ্যে দুটি নাম আমার এখনও মনে আছে-আব্দুল আওয়াল আর মহম্মদ হানিফ। এরা এসেছিল কলম্বাে প্ল্যানের বৃত্তি নিয়ে প্রকৌশলী ডিগ্রি করার জন্য। এদের কথা কেন বিশেষভাবে মনে আছে তার কারণ পরে বলবাে  চাকরিজীবীদের মধ্যে যারা এখন অটোয়াতে আছেন তারা হলেন ড. নাসিরুদ্দিন আহমেদ, ড. লুৎফুল কবির, আব্দুর রহিম আর ড, এহসানেস সালেহ যারা অন্যত্র চলে গেছেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ছিলেন আজমত আলী, ড. আহসানুল্লা আর আব্দুস সাত্তার  অটোয়ার মুক্তিযুদ্ধ বলতে কোনাে বস্তুর উদ্ভাবন যদি করতেই হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে যে তার সূচনা হয়েছিল আজমত আলী সাহেবের মেডেল্যান্ডস ড্রাইভের ওপর যে এপার্টমেন্টটা ছিল তার লিভিংরুম থেকে। উনিশ শ’ একাত্তরের সাতই মার্চ- সেদিনটার কথা কোনাে বাঙালিরই ভােলার কথা নয়। ঢাকা শহরের এক খােলা ময়দান থেকে একটি উদাত্ত কণ্ঠ বেজে উঠেছিল সেদিন যার তরঙ্গে কেঁপে উঠেছিল প্রতিটি মহাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ। আলী সাহেবের বাসাতে আমরা জড় হয়েছিলাম টেলিভিশনে দেখার জন্য বঙ্গবন্ধুকে। দেখছিলাম যে পাকিস্তানের জঙ্গি বিমানগুলাে মহড়া দিচ্ছিল জনসভার ওপর দিয়ে হয়তাে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরকে যন্ত্রের নিনাদে আচ্ছন্ন করার জন্যে, কিন্তু পারেনি। বিদ্রোহী নেতার বাণী আকাশ চূর্ণ করে ফেটে পড়েছিলাে সমস্ত পৃথিবীতে।
মুগ্ধ বিস্ময়ে, আনন্দে, গর্বে আপুত হয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করছিলাম ইতিহাসের সেই অপূর্ব মুহূর্তটি, আর উপভােগ করছিলাম আলীর স্ত্রী কর্তৃক সাদরে পরিবেশিত মিষ্টান্ন। কথা ছিল যে বক্তৃতা শেষ হলেই মিটিং এ আলােচনা হবে পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের কি কর্মসূচী হওয়া উচিৎ। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধু জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে আমাদের অনেকের মনেই সেদিন দ্বিধা ছিল পাকিস্তান থেকে ছিন্ন হয়ে পড়াটা একটু অপ্রাপ্তকালিক ব্যাপার কিনা। আমরা ছিলাম পূর্ব পাকিস্তান এসােসিয়েশনের সদস্য, যার সভাপতি ছিলেন। আলী সাহেব। সিদ্ধান্ত হলাে নামটা বদলে পূর্ববঙ্গ করা হবে, কিন্তু সরাসরি বাংলাদেশ কথাটা প্রকাশ্যে আওড়াতে আমরা তখনও প্রস্তুত ছিলাম না। পঁচিশে মার্চের পর অবশ্য সবার মন থেকেই সবরকম দ্বিধা চুকে গেল। পত্র-পত্রিকায়, রেডিওতে, টেলিভিশনে প্রতিদিন নানা লােহমর্ষক খবর আসতে লাগলাে। কামান দিয়ে। উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ইকবাল হল, জগন্নাথ হলের হিন্দু ছাত্রগুলােকে হত্যা করে ট্রাক্টারের সাহায্যে পােতা হয়েছে, মাটিতে, চামেলি হল থেকে মেয়েগুলােকে ধরে চালান করা হয়েছে সেনানিবাসে। গােবিন্দ দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান-এদের মত পণ্ডিত লােকগুলাের মগজ উড়ে গেছে বন্দুকের গুলিতে। খালি রিক্সার পাটাতনে পড়ে আছে রিক্সওয়ালার দেহ, ‘সিটিজেন’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাতেই তার ভয়াবহ ছবি। শিরােনামে লিখা ছিল: গুলিবিদ্ধ হবার জন্যে বাঙালিত্বই যথেষ্ট’। ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় বেরুল এন্থনি মাসকারেনহাসের বিস্তারিত বিবরণ। ‘টাইম’, ‘নিউজউইক’ এগুলােতে নিত্য বেরুতে লাগলাে পাকিস্তানি বাহিনীর পৈশাচিক তাণ্ডবলীলার রক্তাক্ত কাহিনি। ইতিমধ্যে চাটগাঁয়ে এক বিদ্রোহী সেনাশিবির থেকে জিয়াউর রহমান সাহেব বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘােষণা করলেন স্বাধীন বাংলাদেশ। প্রবাসের বাঙালি জনগােষ্ঠীর কর্তব্য স্থির হয়ে গেল।
ভৌগোলিক কারণে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে শরিক হওয়া সম্ভব ছিল না, কিন্তু পরােক্ষে যতরকম সাহায্যের প্রয়ােজন আমরা প্রস্তুত হয়ে গেলাম তার জন্যে। স্বাধীনতা ঘােষণার কয়েকদিন পর শেরকের অধ্যাপক মােয়াজ্জেম হােসেন সাহেব সিবিসি’র খবরের শেষে এক বিশেষ বিবৃতিতে দেশের হত্যাকাণ্ডের মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়ে কানাডিয়ানদের কাছে প্রশ্ন তুললেন, ‘এই ক’টা দিনের মধ্যেই বহু সহগ্র বাঙালি প্রাণ হারিয়েছে, বহু লক্ষ হয়েছে বাস্তুহারা। কানাডার বিবেককে নাড়া দেয়ার জন্যে আর কত হাজার বাঙালিকে প্রাণ দিতে হবে?’ ঐ বিবৃতিটা কানাডার চেতনাকে সত্যি দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিলাে। পথেঘাটে, চেনা-অচেনা অনেক কানাডিয়ানদের কাছ থেকেই সহানুভূতিশীল কথা শুনেছি ঐ বিবৃতিকে কেন্দ্র করে। মােয়াজ্জেম সাহেবের সেই সাক্ষাৎকারের সুফল আমরা প্রভূত পরিমাণে উপলব্ধি করেছি। আমাদের পরবর্তীকালের সংগ্রামে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে এই নেতৃস্থানীয় লােকটি ইদানিং ইহলোক ত্যাগ করেছেন। অটোয়াতে আমাদের এ্যাসােসিয়েশনটির নতুন নামকরণ হল: বাংলাদেশে কানাডাএ্যাসােসিয়েশন। সংবিধান বলতে পাকাপাকিভাবে তেমন কিছু আমরা দাড় করাতে পারিনি যদিও, তবু একটা খসড়া দলিল আমরা তৈরি করেছিলাম। তাতে ঠিক হলাে যে যারা বাংলাদেশের বাসিন্দা শুধু তারাই হবে সদস্য, যারা কানাডিয়ান তারা ইচ্ছে করলে চাঁদা দিয়ে হবে ভােটাধিকারশূন্য যুগসদস্য। এই পর্ভূক্তিতে সবচেয়ে বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন জালালুদ্দিন, যিনি এখনও অটোয়াতে বাস করেন। উনি তখন কানাডিয়ান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী, উপরতলার অনেক পদন্থের সঙ্গে ছিল তার দহরম-মহরম। তার মাধ্যমে আমরা সরকারি ও বেসরকারি অনেক পদস্থ লােকদের সঙ্গে পরিচিত হই এবং তাদের সহায়তা ও সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হই। এ্যাসােসিয়েশনের সদস্যদের মধ্য থেকে পুরনাে কিছু লােকদের নিয়ে গঠন করা হলাে একটি কার্যকরী সমিতি। তাতে ছিলেন এই জালাল সাহেব, আর ছিলেন আলী, আহসান, নাসির আর আমি।
আমাদের কর্মসূচি মােটামুটি চারভাগে বিভক্ত হল: ১. মুক্তিযুদ্ধের জন্যে সাহায্য পাঠানাে; ২. বাস্তুহারা দুর্গতদের জন্যে টাকা তােলা; ৩, কানাডা-আমেরিকাতে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল জনমত সৃষ্টি করা; এবং ৪. রাজনৈতিক স্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লবি করা আর স্বাধীনতার সপক্ষে আন্দোলন চালানাে। প্রথমটির উদ্দেশ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে যে মে মাস থেকে শুরু করে স্বাধীনতাসিদ্ধির সময় পর্যন্ত আমরা চাকরিজীবীরা প্রতি মাসে বেতনের শতকরা পাঁচভাগ অনুদান করব একটা বিশেষ ফান্ডে। যাদের চাকরি ছিল না তাদের কাছ থেকে অর্থসাহায্য চাওয়া হয়নি। কিন্তু আওয়াল আর হানিফ নিজের থেকেই গরজ করে বললাে যে ওদের মাসিক উপার্জন যত সামান্যই হােক না কেন, ওরাও শতকরা পাঁচভাগ দেশের জন্যে ত্যাগ করবে। এমনকি আমাদের জালাল, জন্মসূত্রে ভারতগত হওয়া সত্ত্বেও, অকাতরে দান করতে লাগলেন তার মাসিক বরাদ্দটি। একাত্তরের সংগ্রামী চেতনা আর দেশাত্ববােধ যেভাবে আমাদের সবাইকে জাগিয়ে তুলেছিলাে তার তুলনা হয়তাে ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পঞ্জিকার কয়েকটি জ্বলন্ত মাসের জন্যে বাংলাদেশের আরামপ্রিয় মানুষ আগুনের শিখা হাতে করে বেরিয়ে পড়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে দেশের মানুষের যেমন বুক থেকে ঝরেছে রক্ত, বিদেশে বাঙালিরও প্রাণ ফেটে বেরিয়েছে কান্না, উজার করে সে দিতে চেয়েছে সর্বস্ব দেশকে বর্বরের থাবা থেকে উদ্ধারের জন্যে। ঐ চেতনার একাংশও যদি বেঁচে থাকতে হৃদয়ে তাহলে হয়তাে দেশটা আজ আন্তর্জাতিক লীলাভূমিতে উপহাসের পাত্র হয়ে উঠতাে না।
শুধু অটোয়াতে নয়, উত্তর আমেরিকার ছােটো বড়াে প্রতিটি শহরে বাঙালিরা এমনি করে গােপন তহবিল সৃষ্টি করেছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্যে। দেশবিদেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র, ওষুধপত্র, লেপকম্বল কিনে দেশে পাঠানােই ছিল আমাদের মূল উদ্দেশ্য। অটোয়ার গুটিকয়েক লােকের সামান্য ক’টা টাকা দিয়ে হয়তাে দশটা কম্বলও কেনা যেত না, তবু অনেক জায়গার ছােটো অঙ্কগুলাে যােগ করলে নিশ্চয়ই বেশ বড় একটা সংখ্যায় দাঁড়াতে পারতাে। দুঃখের বিষয় যে বিশ্বসংগ্রামের সাংগঠনিক দিকটা ঠিক দানা বেঁধে ওঠেনি দু’সাতমাস পর্যন্ত। এখানে থেকে আমরা নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন আর লন্ডনের খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম টাকাটা কোথায় পাঠানাে যায়, কার কাছে এবং কার মাধ্যমে। কোথাও থেকে কোনােরকম সুস্পষ্ট নির্দেশ না পেয়ে আমরা কলকাতায় লিখেছিলাম জনাব হুসেন আলীর কাছে। স্বাধীনতার পর হুসেন আলী সাহেব বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে অটোয়াতে এসেছিলেন এবং এখানেই তিনি অকালে মৃত্যবরণ করেন। একাত্তরের সেই চরম দুর্যোগের দিনে তিনি কলকাতার নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থিত থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বব্যাপী কর্মধারার সমন্বয়-প্রচেষ্টায় নিযুক্ত ছিলেন। অভিজ্ঞতার অভাব ও অন্যান্য কারণে সে প্রচেষ্টার পথে ছিল নানারকম বাধাবিপত্তি। ফলে ওঁর কাছ থেকে প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে কোনাে দিক নির্দেশ আমরা পাইনি। শেষ পর্যন্ত নভেম্বরের শেষের দিকে অক্সফামের এক কর্মকর্তার সঙ্গে একান্তে বৈঠক করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমাদের মধ্য থেকেই একজনকে সশরীরে পাঠানাে হবে ভারত সীমানায় এবং তার জন্যে যাওয়াআসার ভাড়া চুকোবে অক্সফ্যাম। সাত্তার সাহেব তখন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জানালেন যে বড়দিনের ছুটিতে তিনি মিশন নিয়ে দেশে যেতে প্রস্তুত।
কিন্তু তার আগেই এসে গেল ষােলই ডিসেম্বর। যুদ্ধের কারণে দেশের সীমান্ত এলাকাগুলােতে ভিড় জমেছিল অজস্র এতিম শিশু আর বাস্তুহারা পরিবারের তাদের দৈনন্দিন জীবনের মর্মান্তিক কষ্টের ছবি টেলিভিশনের পর্দা থেকে বেরিয়ে এসে রােজ হানা দিচ্ছিলাে পশ্চিম গােলার্ধের প্রতিটি লিভিং রুমে। দৃশ্যগুলাে আঘাতের পর হানছিল ওদের মানবতার চেতনার ! বাংলাদেশের দুঃস্থ মানবতার জন্যে একটা অসাধারণ সমবেদনা সহানুভূতির আবহাওয়া সৃষ্টি হয়েছিল সারা পৃথিবীতে। যারা হয়তাে জীবন্ত কাউকে কোন অযাচিত সাহায্য দেয়নি তাদের থেকেও অনেকে টেলিফোন করে জানতে চেয়েছে ওদের পক্ষে অর্থমূলক কিছু করা সম্ভব কিনা। এই অনুরূপ পরিস্থিতির সুযােগ নেয়া হয়েছিল সুন্দরভাবে উত্তর আমেরিকায় প্রায় প্রতি শহরে। এ্যাসােসিয়েশনের পক্ষ থেকে অটোয়াতেও আমরা একটি রিলিফ ফান্ড খুলেছিলাম- সরকার থেকে পেয়েছিলাম দাতব্য সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি হাজার হাজার খাম আমরা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম অটোওয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ব্যবসায়ী আর পেশাদার লােকেদের কাছে। প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা আমরা তুলেছিলাম মাস চারেকের ভেতর। ঐ টাকাটা শেষ পর্যন্ত দেওয়া হলাে অক্সফ্যামের কাছে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অক্সফ্যাম যে বিরাট ভূমিকা পাল করেছিল সেটা হয়তাে অনেকেরই জানা নেই। একদিকে শরণার্থীর শিবিরে শিবিরে ওদের স্বেচ্ছাসেবকরা যেমন অসাধারণ মমতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি ওদের কর্মীরা দেশের ভেতরেই পরােক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রয়াসে নানাভাবে সাহায্য করেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী তখন পিয়ের এলিয়েট ট্রুডো। পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর প্রতি তাঁর বা তার লিবারেল পার্টি কোনসময়ই খুব একটা অনুরাগ ছিল না।
রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কীভাবে উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল সে সম্পর্কে তারা ভালােভাবেই ওয়াকেফহাল ছিলেন। সুতরাং বাংলাদেশের ওপর যখন পাকিস্তানের সামরিক অভিযান শুরু হলাে তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এদের যে একটা নৈতিক সমর্থন ছিল সেটা উপলদ্ধি করতে কষ্ট হলনা। ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করার কাজে আমাদের খুব একটা বাধা পেতে হয়নি। পঁচিশে মার্চের পর থেকে দুয়েক মাসের মধ্যেই ক্যানাডার এ-অঞ্চলটাতে বেশ কয়েকটা শােভাযাত্রার ব্যবস্থা হয়েছিল। অটোয়াতে বেশ বড়ােসড়াে এটা র্যালিতে যােগ দিয়েছিল টরন্টো, হ্যামিলটন, কিংস্টন আর মন্ট্রিয়লের অনেক বাঙালি। পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে গিয়ে আমরা পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়েছিলাম, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলাম কারণ এই দু’টি দেশ তখনও পাকিস্তানের সমর্থক। অটোয়ার স্থানীয় দু’টি দৈনিক পত্রিকা-জারনাল’ আর ‘সিটিজেন’-দু’টিতেই আমাদের র্যালি, দাবি আর বক্তব্যকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা। হয়েছিল। টরন্টোর ‘গােব এন্ড মেইল আর মন্ট্রিলের ‘গ্যাজেট’ আর ষ্টার’ এ প্রায় রােজই বেরুচ্ছিল হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক কীর্তির বিবরণ আর আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল সম্পাদকীয় নিবন্ধ। কানাডার সাধারণ জনগণ চারদিক থেকে পাচ্ছিলাে একই রকম বার্তা। পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে জোর গলায় কথা বলার মত সাহস কারাে ছিল। খবরের কাগজে মাঝে মাঝে দু’চারটে লেখা যে বের হয়নি তা নয়, তবে একটা লেখার প্রতিবাদে আমাদের পক্ষ থেকে দশটা চিঠি বেরুত পরের সপ্তাহে। শুধু অটায়াতে নয়, মন্ট্রিল আর টরন্টোতেও আমাদের র্যালি হয়েছিল, সেখানেও আমরা গিয়েছিলাম সদলবলে।
গলা ফাটিয়ে আমরা চিৎকার করেছি পথে পথে  আমাদের চিৎকার শুনে কেউ বিরক্ত হয়নি, বরঞ্চ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লােককে উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখেছি। আমাদের র্যালিতে বেশ কিছু শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ানও অংশ নিয়েছিল, সাংবাদিকরা দিয়েছিল সাগ্রহ সমর্থন, পুলিশের কাছ থেকে পেয়েছিলাম মাজিত ব্যবহার। মৌন সমর্থন থাকলেও কূটনৈতিক কারণে আমাদের পক্ষ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনাে মন্তব্য করার উপায় ছিল না কানাডিয়ান সরকারের বা সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনাে সংস্থার। তাই রাজনৈতিক লবি বলতে যা বােঝায় তার অনেকখানিই আমাদের চালিয়ে যেতে হয়েছিল কানাডায়, বিশেষকরে এই রাজধানী শহরে। জালাল সাহেবের সহায়তায় আমরা বেশ কিছু পার্লামেন্টারি সদস্যের সঙ্গে করার সুযােগ পেয়েছিলাম। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ছিলেন এন.ডি.পি.র এনডু ব্রম্ননই, লিবারেলের জর্জ লাশান্স, কনজারভেটিভের হিথ ম্যাকুয়ারী। এঁরা তিনজনই আমাদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং দেশ স্বাধীন হবার পর সরকার প্রেরিত তথ্যসংগ্রহকারী দল হিসেবে ঢাকায় গিয়েছিলেন। বাংলাদেশকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে এঁদের রিপাের্টের একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে অনেকের বিশ্বাস। সিবিসি’র রাতের খবর পড়তেন তখন স্ট্যানলি বার্ক বলে এক ভদ্রলােক। ভীষণ। অমায়িক, সহৃদয় ব্যক্তি, নির্যাতিত মানবতার অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপােষক ও মুখপাত্র। বাংলাদেশের প্রতি এমনিতেই তার সহানুভূতির অভাব ছিল না, তার উপর রহমতুল্লাহ নামে টরেন্টোর এক বাঙালির সঙ্গে তাঁর ছিল ব্যক্তিগত পরিচয়। এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই আমরা একবার টরন্টো গিয়েছিলাম তার সঙ্গে দেখা করতে- আহসান, জালাল, কবির, নাসির, সাত্তার আর আমি। টরন্টোতে যাবার অবশ্য আরাে একটা উদ্দেশ্য ছিল-অক্সফ্যামের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটা চাক্ষুষ যােগাযােগ স্থাপন করা। প্রথমে গেলাম বার্ক সাহেবের বাড়িতে। দুটি দাবি ছিল।
প্রথমত, রেহমান সােবহান সাহেবকে এক প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের কাছে পরিচয় করানাে। দ্বিতীয়, তাকে নিয়ে সিবিসি তে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা। দু’টিতেই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। তারপর নিজের খরচায় অটোয়াতে এসে অত্যন্ত সৌজন্যের সঙ্গে আমাদের সবার সঙ্গে বসে কথা বললেন এবং দেশের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর জানতে চাইলেন সােবহান সাহেবের কাছ থেকে। সােবহান সাহেব তখন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে বেরিয়েছিলেন স্বাধীনতার বার্তা প্রচার করার জন্যে। উনি আমাদেরই অতিথি হয়ে অটোয়াতে ছিলেন দু’দিন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, এর কিছুদিন পরই পাকিস্তানের সাফাই গাওয়ার জন্যে। কয়েকজন বঙ্গসন্তানকে পাঠানাে হয়েছিলাে উত্তর আমেরিকায়। তার মধ্যে একজনের কথা মনে আছে যিনি সশরীরে অটোয়াতে এসে সাংবাদিকদের কাছে পাকিস্তানের বুলি ছাড়ার চেষ্টা করেছিলেন-তার নাম হামিদুল হক চৌধুরী। অনেকেরই হয়তাে মনে আছে নামটা। বেচারা বেশ নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন এখানে এসে। অ্যাসােসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমরা তুমুল হট্টগােল চালিয়েছিলাম প্রেস বিল্ডিং-এর বাইরে। ভেতরেও সাংবাদিকরা খুব একটা পাত্তা দেয়নি ভদ্রলােককে। চৌধুরীকে শেষ পর্যন্ত পুলিশের আশ্রয়ে বাপ-বাপ করে পালাতে হয়েছিলাে- আমাদের মধ্যে দু’একজন প্রস্তুত হয়ে ছিল তার ওপর একপশলা কিলঘুষি চালানাের । বাংলার মুক্তিসংগ্রামের বড় প্রতিবন্ধক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন নিক্সন সরকার যার সামরিক আর আর্থিক সাহায্যই ছিলাে পাকিস্তানের বড় সম্বল। তাই আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রধান প্রেক্ষাগার ছিলাে ওয়াশিংটন আর নিউইয়র্ক। নিউইয়র্কের জাতিপুঞ্জ প্রাঙ্গণে একবার জমায়েত হয়েছিল বঙ্গ সহস্র বাঙালি-পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক পন্থা অবলম্বন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেবার দাবিতে। মহাদেশের নানা জায়গা থেকে ওরা গিয়েছিলাে দল বেধে-প্লেনে, ট্রেনে, বাসে বা নিজেদের গাড়িতে। অটোওয়া থেকে আমরা গিয়েছিলাম বাসে করে।
প্রকাণ্ড শােভাযাত্রা হয়েছিলাে। নিউইয়র্কের রাজপথে, যানশকট সব থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল মিছিলের জন্যে। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম নগরে সেদিন ছােটোখাটো একটা ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছিলাম। তারপর আগস্টের দিকে আরেকটা হলাে ওয়াশিংটনে। ঐ মাসেই পাকিস্তানকে অস্ত্রসাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ হরার কথা। বিলটা যাতে পাশ হয় সেজন্যে আমরা সব উঠে পড়ে লাগলাম। রাজনৈতিক লবির ব্যাপারে আমাদের কারাে অভিজ্ঞতা ছিল না, বিশেষকরে অতটা উচু পর্যায়। কিন্তু প্রাণের ভেতরে নৈতিক শক্তি যার প্রবল তার জন্যে অভিজ্ঞতার প্রয়ােজন হয় না। উত্তর আমেরিকার ছােটো-বড়ো প্রতিটি শহর থেকে অন্তত একজন প্রতিনিধি পাঠানাে হয়েছিল এই লবির কাজে। পুরাে দু’টো দিন ধরে এরা কংগ্রেসের প্রতিটি সদস্যের ঘরে ঘরে গিয়ে বিলটার বিপক্ষে নানা যুক্তি পেশ করেছিল। অনেকেরই হয়তাে মনে নেই যে বিলটা শেষ পর্যন্ত পাশ হয়নি। আমার চেয়ে প্রথর স্মরণ ও ধীরশক্তিসম্পন্ন লােক তখন অটোয়াতে ছিলেন বেশ কিছু। তারা হয়তাে বিস্তারিত ও নির্ভুল বিবরণ দিতে পারবেন ঐ সময়টার। উপরের ক’টি ছত্রে আমি ঐটুকুই পেশ করলাম যা আমি চয়ন করতে পেরেছি আমার ক্ষীয়মান স্মৃতি থেকে। কেউ কেউ হয়তাে আরাে বলতে চাইবেন যে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের মধ্যে যে একটা একাত্ববােধ গড়ে উঠেছিল তাতে খানিকটা ভাঙনও ধরেছিল শেষের দিকে। আমি সেটা অস্বীকার করছি না, কিন্তু দীর্ঘ তেইশ বছর পরে আমি ওটাকে বড়াে করে দেখতে চাইছি না। বৃহৎ কোনাে সংঘবদ্ধ কর্মের উদ্যমে কখনাে কখনাে মতান্তর ঘটে থাকে, তা। থেকে মতান্তরও সৃষ্টি হয় মাঝে মাঝে, কিন্তু বেলাশেষে শুধু একটি জিনিষই মানুষের মনে থাকার কথা, ব্যক্তি আর সমষ্টিগতভাবে সে কিছু দিতে পেরেছে কিনা তার দেশকে, সমাজকে।’ সেদিক থেকে বিচার করতে গেলে আমি খানিকটা গর্বের সঙ্গেই বলব, লজ্জায় মাথা নােয়ানাের মতাে গহিত কোনাে কাজ করেনি একাত্তরের বাঙালি সমাজ  আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে ক্ষুদ্রভাবে যা কিছু করা সম্ভব ছিল আমাদের পক্ষে, করেছি।

সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কূটনৈতিক যুদ্ধ – আবু সাইয়িদ