You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা
১. ভূমিকা পাকিস্তান সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে বাংলাদেশে নৃশংস বর্বরােচিত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তান বাহিনী কীভাবে বাংলাদেশকে আক্রমণ ও রক্তাক্ত করেছে তার বিবরণ ২৬শে মার্চ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে রক্তখচিত অক্ষরে ও হৃদয়মথিত কণ্ঠে প্রকাশিত ও প্রচারিত হতে থাকে। তার প্রতিক্রিয়া প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দেয় প্রবাসী বাঙালিদের এবং বিশ্ব বিবেককে। মিটিং-মিছিলে যেমন রাজপথ আলােড়িত হয়েছে, তেমনি শিল্পীর তুলিতে, সংগীতের মূর্ঘনায়, কবিতায়-প্রবন্ধে, উচ্চকিত আলােচনা-অনুষ্ঠান ও গণমাধ্যমে অগ্নিদগ্ধ বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছে নির্দ্বিধায় নিরবচ্ছিন্নভাবে। প্রবাসে প্রতিটি পর্যায় ও স্তরের বাঙালি যে যেখানে পেরেছে সেক্ষেত্রেই জাতীয় স্বাধীনতা ও জাতির স্বার্থে যে অবিস্মরণীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে তা কূটনৈতিক বিশ্বকে প্রভাবান্বিত করে দ্রুততার সঙ্গে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নানা মাত্রিকতা। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারি নীতি বা ভূমিকা যাই থাকুক না কেন যন্ত্রণাদগ্ধ বিবেকের তাড়নায় মুক্তমনের মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী, শ্রেণি-পেশার মানুষ ও রাজনীতিবিদ নীরব থাকতে পারেননি। বিশ্বের সচেতন মানুষ ও সমাজের অগ্রসর চেতনাসম্পন্ন সংবেদনশীল অংশ বাংলাদেশের মানবিক ট্রাজেডি ও স্বাধীনতার পক্ষে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দিয়েছে যা তুলনাহীন।
বিভিন্ন দেশের শাসকগােষ্ঠীর বৈরিতা বা আপাত নিরপেক্ষতার পরিবেশে তারা নানাভাবে যেমন মানবিক সাহায্য-সহযােগিতা করেছে, তেমনি সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এভাবে শত শত আলােকিত মানুষের মন্ত্রমুগ্ধ প্রতিবেদন, বেদনার্ত জপমালা আলােড়িত করেছে বিশ্ব-মানবতাকে। মূলত বিপুল ছিন্নমূল ও শােষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তি ও জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করার ক্ষেত্র-নির্মাণে প্রবাসী বাঙালিদের দিবস-রজনীর অক্লান্ত উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। এই অধ্যায়ে সেই স্বর্ণোজ্জ্বল ঘটনাপরা,ও কার্যকরণগত সংশ্লিষ্টতা পর্যালােচনা করা হবে। ২. ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালি ২.১ ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালিদের ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভূমিকা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে লন্ডনে বাঙালির আগমন, অবস্থান এবং কার্যক্রম উল্লেখযােগ্য না হলেও অনুপস্থিত ছিল না। বাঙালির প্রবাস জীবনের ব্যাপ্তি শতাব্দী জুড়ে এবং তাদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্রিটিশ-ভারতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বহুকাল ধরেই পূর্ব বাংলার জাহাজিরা লন্ডনে বসবাস করে আসছেন। ১৮৬৫ সালে যুক্তরাজ্যে ভারতীয়রা ‘লন্ডন ইন্ডিয়ান সােসাইটি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তােলে মূলত প্রবাসীদের দাবি-দাওয়া উত্থাপনের জন্য। পরবর্তী লক্ষণীয় যে ব্রিটিশ হাউজ অব কমসে যে সকল ভারতীয় নির্বাচিত হন তাদের লক্ষ্য ছিল দ্বিবিধ; এক, প্রবাসীদের সমস্যা লাঘব, ও দুই, ভারতীয়দের দাবি সরাসরি পার্লামেন্টে উপস্থাপন করা। এসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পূর্ববাংলার জাহাজি নাবিকদের বিশেষ ভূমিকা বিদ্যমান।
পূর্ববঙ্গের প্রবাসী বাঙালি বিশেষ করে জাহাজি নাবিক আবদুল মান্নান, আলী মাস্টার, শাহ আব্দুল মজিদ কোরাইশী, মেহনাজ উদ্দিন প্রমুখ ভারতীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। তাঁরা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং রাজনীতিবিদ কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। উনিশ শতকের চল্লিশ দশকে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি জোরদার করলে লন্ডনে ‘স্বরাজ আন্দোলন পরিত্যাগ করে পূর্ব বাংলার প্রবাসীরা ১৯৪৪ সালে গঠন করে যুক্তরাজ্য মুসলিম লীগ শাখা। ১৯৪৬ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ নেতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ লন্ডনে আগমন করলে তাকে ব্যাপক সম্বর্ধনা জানানাে হয়। তিনি হােবর্ণ হলে জনসভা করেন। সেখানে প্রায় এক হাজার শ্রোতা ছিলেন। তার মধ্যে তিন, চতুর্থাংশ ছিলেন বাঙালি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রবাসী বাঙালিদের পাসপাের্ট ও ভিসা প্রদানে লন্ডনের হাই কমিশনে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারগণের দুর্ব্যবহার’ ও ‘দূরে ঠেলে রাখা নীতির ফলে বাঙালিরা হয়রানি ও বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়। পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠী “জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়া নাবিকদের নগদ জামানত ব্যতীত আন্তর্জাতিক পাসপাের্ট ও ভিসা প্রদানে গড়িমসি, হয়রানি ও অস্বীকৃতি প্রবাসী বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করে তােলে। ফলে তারা পাকিস্তানের হাই কমিশনের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায় বিক্ষুব্ধ বাঙালিদের হাতে পাকিস্তান হাই কমিশনের লেবার এটাচি প্রহৃত ও লাঞ্ছিত হয় ।
প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে পাকিস্তানি শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫০ সালে পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার এসােসিয়েশন’ গঠিত হয়। উক্ত সংগঠন গঠিত হবার পরপরই বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, কভেন্ট্রি, বেডবাের্ড, লীডস, লুটন, শেফিল্ডসহ অনেক জায়গায় বাঙালিদের মধ্যে এধরনের সংগঠন গড়ে ওঠে। প্রবাসী বাঙালিরা সবসময় স্বদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ঘটনাবলিতে আলােড়িত হয়েছে। স্বদেশে সংঘটিত ঘটনাবলি ও আদর্শিক ধারা লন্ডন প্রবাসী বাঙালিদের উদ্বেলিত করেছে। পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি ছাত্ররাই বেশিরভাগ এসব আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডে যােগ দিয়েছে। পাকিস্তানের শাসকবৃন্দ পূর্ববঙ্গে বাংলাভাষার পরিবর্তে উর্দুভাষাকে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমিছিলে গুলি হয় এবং অনেকেই শাহাদাৎ বরণ করেন। এ ঘটনায় ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালিরা ভাষা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় থেকেই প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা স্কুরিত হয়। পাকিস্তান শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্বদেশের মতাে প্রবাসেও অসন্তোষ ও আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনকে সামনে রেখে পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ১৯৫৩ সালের ১৩ই নভেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে ছিলেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠী বাঙালির দ্ব্যর্থহীন গণরায়কে নসাৎ করার লক্ষ্যে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে। রাজনৈতিক চক্রান্তে পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্টের বিশাল বিজয় ও জনগণের রায় বানচালের জন্য চন্দ্রঘােনা পেপার মিলে ও আদমজীতে দাঙ্গা বাধিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা’ ও ‘জনবিশৃঙ্খলা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনার অজুহাতে কেন্দ্রীয় শাসন বলবৎ করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫৪ সালের ১৯ মে, পূর্ববাংলায় যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল এবং প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হককে বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়ে গৃহবন্দি করে। জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ববঙ্গের গভর্নর নিযুক্ত হন।
জারি করা হয় ৯২ (ক) ধারা। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী ও আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রায় তিনহাজার নেতা-কর্মী কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। কেন্দ্র-নিযুক্ত গভর্নর ইস্কান্দার মীর্জা করাচি থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে আগমনের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সদম্ভে বলেন, “মওলানা ভাসানী এ দেশে ফেরত এলে তাকে গুলি করে হত্যা করার জন্যে আমি আমার শ্রেষ্ঠ হাবিলদারকে বিমান বন্দরে পাঠাবাে।” সে সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি ও মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সম্মেলন থেকে দেশে ফেরার পথে তিনি। লন্ডনে যাত্রাবিরতি করেন। ব্রিটেনে তাঁকে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। তিনি লন্ডনসহ বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করেন। পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীর নিষ্ঠুর-নির্মম, শাসন-শােষণ ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেন। বাঙালিদের বুঝিয়ে বলেন দেশের অবস্থা, ইসলাম আর ‘মুসলমানের নামে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বেঈমানি আর মােনাফেকির স্বরূপ, সারা পাকিস্তানে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা, তুলে ধরেন পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতি নিদারুণ অত্যাচার, নির্যাতন আর শােষণের চিত্র। বস্তুত মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ আট মাস বিলাতে অবস্থানের ফলে প্রবাসী বাঙালিসমাজ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির হালচাল সমন্ধে ওয়াকিবহাল হন। এ সময়ই প্রবাসে বাঙালির স্বজাত্যবােধ দৃঢ় হয়। শুরু হয় এর বাস্তব রূপায়নের মানসিক প্রক্রিয়া, স্বাধীন পূর্ববাংলা রাষ্ট্র স্থাপনের চিন্তাধারা। প্রবাসী বাঙালি জনগণ উপলব্ধি করে এক রাষ্ট্রের হলেও তারা এক জাতি নয়, স্বাধীন নাগরিক নন, স্বদেশে তারা পরবাসী।
১৯৫৭ সালে পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার এসােসিয়েশন’ এর বাঙালি কর্মকর্তাদের অনুরােধে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নির্দেশে ‘জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ে যে সমস্ত বাঙালি যুক্তরাজ্যে প্রবাসী ছিল, এমন ত্রিশ হাজার বাঙালিকে নগদ অর্থ ও জামানত ব্যতিরেকে আন্তর্জাতিক পাসপাের্ট ও ভিসা ইস্যু করা হয়। সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখল করলে পুনরায় তা বন্ধ হয়ে যায়। ব্রিটেনে বাঙালিরা সামরিক শাসন বিরােধী আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বামঘেঁষা ছাত্ররা পূর্বসূরি’ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তােলে। অকাট্য তথ্য, উপাত্ত সম্বলিত “অসন্তুষ্ট পূর্ব পাকিস্তান” নামে পাকিস্তান সরকারের শাসন, শােষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সিরিজ প্রকাশনা বের করে।
 ১৯৬০ সালে ব্রিটেনে রেস্টুরেন্ট মালিকদের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় সাধনের জন্য গঠিত হয় পাকিস্তান ক্যাটারারস এসােসিয়েশন’। ইমপ্লয়মেন্ট ভাউচার সিস্টেম চালু হওয়ার পর রেস্টুরেন্টের মালিকগণ তাদের কাজের জন্য বহু বাঙালিকে ব্রিটেনে নিয়ে আসেন। রেস্টুরেন্ট মালিকদের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজনৈতিক দলের যােগসূত্র ও সখ্যতা গড়ে ওঠে। ৬০ দশকের প্রথম দিকে ব্রিটেনের বাঙালি ছাত্ররা পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফেডারেশনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকায় ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেনের ছাত্ররাও মিটিং, বিক্ষোভ মিছিল করে সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে জোরালাে আন্দোলন গড়ে তােলে। | ১৯৬৩ সালে ১৩ ও ১৪ এপ্রিল লন্ডনের রয়েল হােটেলে পাকিস্তান ন্যাশনাল কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানি ওয়েলফেয়ার এসােসিয়েশন’সহ ২২টি কমিউনিটি সংগঠন এই সম্মেলনে যােগদান করেন। এই বছরই ৪৩টি সংগঠনসহ স্টুডেন্ট ফেডারেশন ন্যাশনাল-এর কনভেনশন ও বার্ষিক সাধারণ সভা বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত হয়। তাছাদুক আহমেদ, নুরুল ইসলাম সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এভাবে যুক্তরাজ্যের পাকিস্তানি সংগঠনসমূহের পুরাে নেতৃত্ব বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা ‘পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফেডারেশন’-এর নেতৃত্বে থাকলেও ১৫ চেসহাম … অবস্থিত ছাত্রদের হােস্টেলটি পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রদের দখলে ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্ররা উক্ত হােস্টেলে সমতার ভিত্তিতে আসন বণ্টণ ও থাকার বিষয়ে দাবি তুললেও তার কোনাে সুরাহা হয়নি। এক্ষেত্রে ইস্ট পাকিস্তান হাউস’ নামে একটি স্বতন্ত্র আবাস স্থাপন করার। জন্য ছাত্ররা এগিয়ে আসে। এর সঙ্গে দুটি বিষয়ে তারা জোর দেয়; এক, এই স্বতন্ত্র। হােস্টেলের মাধ্যমে বাঙালিদের জন্য ছাত্রাবাস; দুই, সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্র নির্মাণ। পাকিস্তান হাই কমিশনার আগা হিলালী পাকিস্তান থেকে সরকারি বৃত্তি নিয়ে আসা ছাত্রদের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের এসব কর্মকাণ্ডকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং দেশে গেলে তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে হুমকি প্রদান করেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ ছাত্র ও কমিউনিটি নেতৃত্ব হুমকি উপেক্ষা করেন। লন্ডনে প্রবাসী বাঙালি ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও ছাত্ররা মিলে ১৯৬৪ সালে ৯১ হাইবুরি হলে ১০ হাজার পাউন্ড মূল্যে ১৩ কক্ষবিশিষ্ট একটি বাড়ি ক্রয় করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউস’। এই সময় কমিউনিটি নেতৃত্ব ও ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার এসােসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউস’ কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেদের জড়িয়ে না ফেলে প্রবাসী বাঙালিদের দাবি-দাওয়া আদায়ের প্রশ্নে পাকিস্তান। হাই কমিশনের সঙ্গে লিয়াজো বজায় রাখবে।’ ১৯৬৫ সালে প্রবাসী বাঙালিরা সভা-সমিতি করার জন্য ৩৯ ফোরনিয়ার স্ট্রিটে একটি বাড়ি ক্রয় করেন এবং ভাষাশহিদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শন স্মরণে এর নাম রাখেন ‘শহিদ ভবন’। এ সময়ে লন্ডন বাংলা একাডেমী নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান জনাব তাছান্দুক আহম্মদের নেতৃত্বে গঠিত হয়। এ সংগঠনটির সেক্রেটারি হন। ড. আলীম চৌধুরী, যাকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরােধী চক্র নির্মমভাবে হত্যা করে। বিলাত প্রবাসী বামপন্থি নেতা জাকারিয়া চৌধুরী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের স্পষ্ট মূল্যায়ন হলাে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী কখনাে বাঙালিদের অধিকার মেনে নেবে না। স্বাধীনতা ব্যতীত বাংলার মানুষের মুক্তি নেই। সেই লক্ষ্যে জাকারিয়া চৌধুরী, তাছাদুক আহম্মদ, ড, কবির, ড. মনােয়ার হােসেন। ও আজিজুল হক লন্ডনে ‘ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করেন এবং কিউবান দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। কিন্তু ১৯৭০ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবল ধারা ও নির্বাচনী প্রচারণায় ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের কার্যক্রম তলিয়ে যায়। 
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা ঘােষণা করলে প্রবাসী বাঙালিরা ৬ দফা ছাপিয়ে যুক্তরাজ্যে তা প্রচারের ব্যবস্থা করে এবং বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে তা পৌছে দেওয়া হয়। এ সময় চীন মতাদর্শের সমর্থক কতিপয় প্রবাসী ছাত্র ৬-দফাকে সি, আই. এ.- এর দলিল বলে উল্লেখ করে এবং বিরােধীতা করে।” ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ২৯ জুলাই মামলার দিন ধার্য হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রবাসী বাঙালিরা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৪ই জুলাই বিক্ষোভকারী ছাত্ররা পাকিস্তান হাই কমিশন দখলের চেষ্টা করে এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি দ্ব্যর্থহীন আস্থা প্রকাশ করে। আগরতলা মামলা পরিচালনার ব্যাপারে সর্বপ্রকার সাহায্যের জন্য ‘ডিফেন্স কমিটি গঠিত হয়। সুলতান মাহমুদ শরীফ এই কমিটির অফিস পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই কমিটির পক্ষ থেকে লন্ডনে বিভিন্ন সংবাদপত্র, পার্লামেন্ট সদস্যর সাথে যােগাযােগ স্থাপন করা হয়। প্রবাসী বাঙালিরা ‘ডিফেন্স কমিটি’ তহবিলে সাধ্যমত দান করেন। এই অর্থ হতে কুইন্স কাউন্সিল ও শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য স্যার টমাস উইলিয়ামকে মামলা পরিচালনার জন্য ঢাকায় পাঠানাে হয়। আগরতলা মামলার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত প্রকাশিত হয়ে পড়লে গণবিক্ষোভ চরম পর্যায় উপনীত হয়। প্রবাসী বিক্ষুব্ধ বাঙালির শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে লন্ডনে পাকিস্তান হাই কমিশনে হামলা করে। হাই কমিশনার নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ডাকতে বাধ্য হন।” গণঅভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
৫ই মার্চ, ১৯৬৯ পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেশের বিরাজমান অবস্থায় হতাশা প্রকাশ করে সামরিক শাসন জারি করার জন্য চাপ দেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাকে ১০ মার্চ বিরােধী দলের সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে অগ্রগতির সম্ভাবনা ঝুলিয়ে রাখেন। আহুত গােলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে তীব্র গণআন্দোলনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন হয়। ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সামরিক শাসন জারি করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালে ২৪শে অক্টোবর লন্ডনে যান। লন্ডনে তাঁর আগমন ও কার্যক্রম পর্যালােচনায় তিনটি দিক থেকে ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। এক, লন্ডনে প্রবাসী বাঙালি, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য, নেতৃবৃন্দ এবং গণমাধ্যমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ; দুই, যুক্তরাজ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত জনগােষ্ঠীকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাঠামােয় শক্তিশালীকরণ; এবং তিন, বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠী বাধা সৃষ্টি করলে বহির্বিশ্বের, বিশেষকরে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সমর্থন ও সাহায্য পাওয়া যাবে কী না তা নিশ্চিত হওয়া। এ সময় ভারত সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে তার যােগাযােগ হয়।” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনের বর্ষীয়ান নেতা গাউস খান, মিনহাজ উদ্দিন, নেছার আলী, তৈয়বুর রহমান, হাফিজ মজির উদ্দিন, বার্মিংহােমর আফরােজ মিয়া ও জমশেদ মিয়া, ম্যাঞ্চেস্টারের আব্দুল মতিন, নজির উদ্দিন এবং মকদ্দস বস্তৃত প্রমুখকে বিলাতে আওয়ামী লীগ গঠন করার নির্দেশ দান করেন। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে বিলাতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। সংগঠনের নাম দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ, যুক্তরাজ্য শাখা।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে প্রবাসী বাঙালিরা লন্ডনে ক্লারিজেস হােটেলের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এক পর্যায়ে তিনি বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য জানতে বেরিয়ে আসলে সুলতান শরীফ ইয়াহিয়া খানকে জিজ্ঞেস করেন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হলে শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে কি না? জবাবে ইয়াহিয়া খান বলেন যে, পাকিস্তানকে ধ্বংস করার সুযােগ আমি কাউকে দেব না। যে কোনাে মূল্যে পাকিস্তানকে রক্ষা করবাে। ২.২ ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা, মার্চ-এপ্রিল-মে (১৯৭১) ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে বাংলাদেশে যে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয় তার। সমর্থনে ব্রিটেনে বসবাসকারী বাঙালিগণ ৭ মার্চ রবিবার লন্ডনে এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করেন। ধর্ম, দল বা রাজনৈতিক মতামত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির বাঙালি সকাল দশটায় ব্রিটেনের সকল প্রান্ত থেকে দলে দলে কোচ, ভ্যান, কার এবং রেলযােগে লন্ডনের হাইড পার্ক কর্নারে সমবেত হয় ও পার্কে পৌছাবার সঙ্গে সঙ্গে জনতা ‘স্বাধীন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘জয় বাংলা’, ‘খুনী ইয়াহিয়ার মুণ্ডু চাই’ ইত্যাদি স্লোগানে পশ্চিম লন্ডনের এই প্রান্তকে প্রকম্পিত করে তােলে। সভায় উপস্থিত জনতা পরম শৃঙ্খলার সঙ্গে পার্ক লেইন রাজপথ ধরে পাকিস্তান হাই কমিশন অভিমুখে যাত্রা করে। এই সময় রাস্তার সমস্ত যানবাহন বন্ধ হয়ে যায় এবং পুলিশের তত্ত্বাবধানে স্লোগান দিতে। দিতে মিছিলটি হাই কমিশন অফিস প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। দূরভিসন্ধিমূলক মনােভাব নিয়ে পাকিস্তানি হাই কমিশনার আগে থেকে পুলিশ ডেকে বাধার সৃষ্টি করে এবং বন্ধ করে দেন হাই কমিশন ভবনের দু’পাশের প্রবেশ পথ। ফলে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। হাই কমিশনার পুলিশ বেষ্টনে থেকে জনতাকে কিছু বলার চেষ্টা করেন। ক্ষিপ্ত জনতা হাই কমিশনারকে ব্যানারের কাগজ এবং দণ্ড ইত্যাদি নিক্ষেপ করে তার এই দূরভিসন্ধি ও দুষ্কর্মের প্রতিবাদ করে। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির ফলে কয়েকজন বিক্ষোভকারী আহত হন এবং একজনকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে অশ্বেতাঙ্গদের এত বড় বিক্ষোভ মিছিল এই প্রথম। আনুমানিক দশ হাজারের অধিক বাঙালি এই মিছিলে অংশগ্রহণ করে এ কথা প্রমাণ করে দেন যে, তাদের আর কোনােভাবেই দাবিয়ে রাখা। যাবে না।১৩
৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সে ভাষণের পরই স্বাধীনতার জন্য লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিরা প্রকাশ্যে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। ছাত্রনেতা শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও আফরােজ আফগান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের পাশে অনশন ধর্মঘটে অংশ নেন। লেবার পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের এ অনশন ভঙ্গ করান। ১৪ই মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ লন্ডনের হাইড পার্কে সমাবেশ শেষে পাকিস্তান হাইকমিশনে গিয়ে একটা স্মারকলিপি প্রদান করে। এ সমাবেশের পর ইংল্যান্ডের প্রায় ১৫টি শহরে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। এ সময় লন্ডনের স্বাধীনতাকামী প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষ থেকে বিদ্রোহী বাংলা’, ‘নিউজলেটার ও বাংলাদেশ টুডে’ প্রকাশিত হয়। এছাড়া প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিরােধী আন্দোলন চলাকালে প্রকাশিত ‘জনমত’ পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  প্রবাসী বাঙালিদের আন্দোলন, সংগ্রাম, সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ, বক্তৃতা-বিবৃতি, প্রবন্ধ-প্রতিবেদন পর্যালােচনায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন, জনমত গঠন ও সহযােগিতার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে যা কূটনৈতিক বিশ্বে ইতিবাচক প্রভাব দৃঢ় করেছে। ২৬শে মার্চের পূর্বেই বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রয়ােগের তাৎপর্য ছিল মূলত বিদেশি সরকারের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি প্রদানের আবশ্যকতার চেয়েও অনেক বেশি। বাংলাদেশে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক গণমাধমে তিনি এই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি স্বাধীন স্ব-শাসন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাবেন। বাধা দিলে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমে পড়তে দ্বিধা করবেন না। | ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় সংঘটিত পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার সংবাদ লন্ডনে পৌছলে ২৬শে মার্চ লন্ডনে অধ্যয়নরত শতাধিক ছাত্র পাকিস্তান হাই কমিশন ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার পর বাঙালিদের সহমর্মিতা ও সমর্থনের সক্রিয়তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নব। উদ্যমে দৃশ্যমান হয়। ২৮শে মার্চ উত্তর-পশ্চিম লন্ডনে অবস্থিত “ইস্ট পাকিস্তান হাউসে প্রায় ৮০০ জন বাঙালির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শেষে প্রদৃপ্ত চেতনায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। একই দিনে বার্মিংহামের স্মল হিথ পার্কে আরও একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বহনকারী ব্যানারে ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ কথাগুলি বড় বড় অক্ষরে লেখা হয়। এই সভাটিকে ‘শপথ-সভা’ নামকরণ করা হয় । এই সভার প্রচারপত্রের একাংশে বলা হয় : বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ কামান, বন্দুক আর বােমার সামনে প্রাণ দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশআর তার সাড়ে সাত কোটি লােককে বাঁচাতে হলে।
চাই অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ আর তার জন্য চাই আপনার আমার সাহায্য। আসুন, শপথ। সভায় যােগ দিয়ে আমাদের এই জীবনমরণ সংগ্রামকে সার্থক করে তুলি। এই সভাতে দলে দলে যােগ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলার এই স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলুন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার উদ্দেশ্যে মার্চ মাস থেকেই ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অন্যান্য দেশে বাঙালিদের বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। পরিশিষ্ট-৩.ক-এ সংগঠনগুলির নাম, ঠিকানা ও সংগঠকদের পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে । ২৮ মার্চ পশ্চিম লন্ডনে লেডবেরি রােডে জনৈক মিসেস জেবুন্নেসা বধূতের বাড়িতে নেতৃস্থানীয় বাঙালি মহিলাগণ সমবেত হয়ে ‘বাংলাদেশ মহিলা সমিতি গঠন করেন। মহিলা সমিতি বিভিন্ন সভা ও সম্মেলন আয়ােজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করে। তাছাড়া মহিলা সমিতির সদস্যগণ প্ল্যাকার্ড ও পতাকা তৈরি করেন। ভারতের শরণার্থী শিবিরের শিশুদের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজও করেছেন মহিলা সমিতির সদস্যগণ । ২৯শে মার্চ লন্ডনে ‘কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ নামক একটি সংগঠন গঠিত হয়। এই সংগঠনের ১১ সদস্যবিশিষ্ট কার্যকরী পরিষদের প্রেসিডেন্ট ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে গাউস খান ও শেখ আব্দুল মান্নান। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে চার দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করেন। দাবিগুলি ছিল নিম্নরূপ : ক. ব্রিটেন কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান, খ. জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভের লক্ষ্যে বাংলাদেশের পক্ষে ব্রিটেনের উদ্যোগ গ্রহণ। করা, গ, ব্রিটেনে তৈরি অস্ত্র-শস্ত্র পাকিস্তান বাহিনীকে সরবরাহ না করা, এবং ঘ, পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা বন্ধের জন্য পাকিস্তান সরকারের ওপর ব্রিটেনের রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। এই চার দফা দাবি মূলত প্রবাসে বাঙালিদের কূটনৈতিক তৎপরতার সমন্বিত আকর। ২৯শে মার্চ পিটার শাের এম. পি. হাউজ অব কমসে পূর্ব বাংলার গণহত্যা বন্ধ, সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার, শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের উপর পাকিস্তানি অত্যাচার বন্ধে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপর চাপ প্রয়ােগ করেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে ৩০শে মার্চ ‘নিউজ লেটার’ নামক একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
এটি প্রকাশ করেন তাছাদুক আহম্মদ এবং তাঁর স্ত্রী রােজমেরী। এর সম্পাদক ছিলেন ফরিদ জাফরী। আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ, প্রবাসী বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে উদ্বুদ্ধ করা, মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রকাশ ইত্যাদি ছিল এই পত্রিকাটির লক্ষ্য। ৪ঠা এপ্রিল দুপুরে বাঙালি ছাত্রদের উদ্যোগে লন্ডনের হাইড পার্কে একটি এবং বিকেলে ট্রাফালগার স্কোয়ারে প্রায় দশ হাজার লােকের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় অন্যান্যদের মধ্যে কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি শেখ আব্দুল মান্নান, সুলতান মাহমুদ শরীফ, আব্দুল মতিন, সাখাওয়াত হােসেন ও মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু বক্তৃতা করেন। সভাপতিত্ব করেন।
গাউস খান। এসব জনসভার মূল লক্ষ্য প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে ঐক্য দৃঢ় করা, স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশ্বে উপস্থাপন ও মুক্তিযুদ্ধে সর্বোতভাবে সাহায্য করার অঙ্গীকার। ২৩শে এপ্রিল গাউস খানের নেতৃত্বে কয়েক শ’ বাঙালি লন্ডনে চীনা দূতাবাসে গিয়ে পাকিস্তানের প্রতি চীনের সমর্থন প্রত্যাহারের আবেদন জানায়। ১৬ই এপ্রিল, ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষার প্রচেষ্টা চালানাের জন্য মার্কিন সিনেটরদের প্রতি ব্রিটেনের বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট উদাত্ত আহ্বান জানায়। বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধের প্রচেষ্টা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থনদানের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রতি বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট আহ্বান জানায়।” বাংলাদেশ এসােসিয়েশন ইন স্কটল্যান্ড কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের প্রতি আবেদন জানিয়ে প্রচারপত্র প্রকাশিত হয় ১৯শে এপ্রিল ১৯৭১। কেন্দ্রীয়ভাবে কার্যকরী কমিটি গঠনের পর শুরু হয় পরিকল্পিতভাবে সমগ্র ব্রিটেনে জনসংযােগের কাজ। ব্রাডফোর্ড বার্মিংহামে স্থানীয় কার্যকরী কমিটির উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মােশারফ হােসেন জোয়ারদার, জাকারিয়া চৌধুরী ও শেখ আব্দুল মান্নান প্রমুখ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে বিভিন্ন জনসভায় বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন।
প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতা, ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যমগুলাের ব্যাপক প্রচারণা ও মানবিক রাজনৈতিক কারণে ব্রিটেনের অনেক রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের পক্ষে বিশেষকরে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী কর্তৃক বাঙালি নিধনের প্রতিবাদ জানায়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য জন স্টোনহাউস, ব্রুস ডগলাসম্যান ও পিটার শাের বাংলাদেশের সমর্থনে নিরন্তর কাজ করেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় প্রায় ৩০০ জন পার্লামেন্ট সদস্য বাংলাদেশে অবিলম্বে রক্তক্ষয় বন্ধে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি জানায়। ফলে ১৪ই মে পার্লামেন্টে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলােচনা হয়। ডানপন্থি নেতা স্যার জের নেবারাে ও রেভারেন্ড ইয়ান পেইসলি। ও বামপন্থি নেতা ইয়ান মিকাডাে ও এন্ড্রু ফাউল্স বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অবিলম্বে বাংলাদেশের রক্তক্ষয় বন্ধ করতে পার্লামেন্টের তিনশত সদস্য ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। ব্রিটেনের বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালিরা পার্লামেন্টে গিয়ে সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ পরিস্থিতি তুলে ধরেন। কার্যকরী কমিটির উদ্যোগে অক্সফোর্ড, গ্লাসগাে, স্কটল্যান্ড, ম্যানচেষ্টার, শেফিল্ড ও লীডস প্রভৃতি শহরে জনসভা করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করা হয়। প্রবাসী বাঙালিদের পাশাপাশি কয়েকজন ইংরেজ তরুণ-তরুণী ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি কমিটি গঠন করে। পলকনেট ও ম্যারিয়টা এ সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ১লা আগস্ট (রবিবার) লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে পলকনেটের নেতৃত্বে গঠিত অ্যাকশন বাংলাদেশের উদ্যোগে এক বিরাট জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, লর্ড ব্রকওয়ে, অশােক সেন (পরবর্তীকালে ভারতের আইনমন্ত্রী), পিটার শাের, রেড প্রেন্টিস, ক্রস ডগলাসম্যান, জন স্টোনহাউস, লর্ড গিফোর্ড, পল কনেট, বেগম লুলু বিলকিস বানু ও গাউস খান প্রমুখ।
প্রবাসী বাঙালিরা সমগ্র যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেও জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। প্রখ্যাত সংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস-এর চাক্ষুষ বিবরণ ‘গণহত্যা’ শিরােনামে ছাপা হয়। শিহরিত হয় সমগ্র বিশ্ব ২৫শে মার্চ বাংলাদেশে আত্মগােপন করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নৃশংস আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ড্রিং-এর মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন দি ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয়। এ ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী রিপাের্টসমূহ বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্র, টিভি ও রেডিওর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এর ফলে পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ববঙ্গে গণহত্যা ও জঘন্য মানবতাবিরােধী কার্যক্রম সম্পর্কিত সংবাদ লুকানাের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। একই সময়ে প্রফেসর রেহমান সােবহান লিখিত বাংলাদেশ-সংকটের বিস্তারিত বিবরণ ও গণহত্যার বিষয়টি প্রচারিত হয়। প্রবাসী বাঙালিরা এসব রিপাের্ট, প্রতিবেদন ব্যাপকভাবে বিশ্বব্যাপী প্রচার করে। যুক্তরাজ্য কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যকে বাংলাদেশ ও ভারতে শরণার্থীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য অনুরােধ জানায়। এদের মধ্যে রক্ষণশীল দলের জেমস্ রেমসটেন ও টবিজেসেল এবং শ্রমিকদলের আর্থার বটমূলী ও রেজিনাল্ড প্রেন্টিংঙ্গের নাম উল্লেখ্য। তারা শরণার্থীদের দুর্দশা পর্যবেক্ষণ করে মানব ইতিহাসের চরম ট্রাজেডি সম্পর্কে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। তাদের রিপাের্টে পাকিস্তানি বর্বরতার চিত্রও প্রতিফলিত হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টরী প্রতিনিধি দলের নেতা আর্থার বটমূলী সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে বলেন, “পূর্ববঙ্গে আরাে একটি ভিয়েতনাম সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিনিধি দলের সদস্যগণ পাকিস্তানের গণতহ্যার ধ্বংস যজ্ঞের বিবরণ প্রকাশ করেন। এভাবে বাংলাদেশ-সমস্যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।
৩. মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর (১৯২১-১৯৮৭) ভূমিকা প্রবাসে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে প্রবাসী বাঙালিদের কর্মতৎপরতা অবিচ্ছিন্ন। মূলত মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বিভিন্ন সাংগঠনিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা ও উদ্যোগের নেপথ্যে প্রবাসী বাঙালিরা নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে অসহযােগ আন্দোলনকালে ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যােগদানের উদ্দেশ্যে জেনেভায় অবস্থান করছিলেন। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনি পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্র হত্যার খবর শুনে ক্ষুব্ধ হন এবং তার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষাসচিবের নিকট উপাচার্যের পদ থেকে। পদত্যাগ পত্র প্রেরণ করেন। | ২৬শে মার্চ জেনেভায় অবস্থানকালে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বিবিসির মাধ্যমে শুনতে পান, ঢাকার সাথে বহির্বিশ্বের যােগাযােগ বন্ধ এবং তখনই তার এ ধারণাটা বদ্ধমূল হয় যে, নিশ্চয়ই ঢাকায় সামরিক ‘ক্র্যাকডাউন’ হয়েছে। তিনি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এগিলার অনুমতি নিয়ে জেনেভা থেকে লন্ডন চলে আসেন এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ডের সাথে যােগাযােগ করেন। ২৭শে মার্চ তিনি সাদারল্যান্ড ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্তসচিব ব্যারিংটনের সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করতে গিয়ে তাদের কাছ থেকেই ঢাকায় গণহত্যার বিবরণ শশানেন। তাছাড়া করাচি থেকে পাঠানাে কেনেথ ক্লার্কের একটি রিপাের্ট যেখানে বলা হয়, “জিন্নাহর একতার স্বপ্ন রক্তে ধুয়ে মুছে গেছে” এবং বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ইয়াহিয়া খান কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশদ্রোহী ঘােষণার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ারি বিষয়ে অবহিত হন। টেলেক্সের লম্বা সংবাদ সাদারল্যান্ড পড়ে শােনান। সেখানেই তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্মমতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের মৃতদেহ, গণসমাধিতে ছুঁড়ে ফেলা এবং শেখ মুজিবকে বন্দি করার ঘটনা জানতে পারেন। এসব কথা শােনার পর বিচারপতি চৌধুরী সাদারল্যান্ডকে বললেন, “এই মুহূর্ত। থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমার আর কোনাে সম্পর্ক রইলাে না। আমি দেশ। থেকে দেশান্তরে যাব আর পাকিস্তানি সৈন্যদের এই নিষ্ঠুরতা-নির্মমতার কথা বিশ্বাবাসীকে জানাব।
তারা আমার ছেলে মেয়েদের হত্যা করেছে। এর প্রতিবিধান চাই। বিচারপতি চৌধুরী সাদারল্যান্ডকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে অনুরােধ করেন। তিনি বললেন যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউম (লর্ড হিউম) তখন স্কটল্যান্ডে। ফিরে এলেই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবেন। তবে তিনি বৈদেশিক মন্ত্রী (ওভারসিজ মিনিস্টার) রিচার্ড উডের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা শীঘ্রই করবেন বলে জানান। বিচারপতি চৌধুরী পার্লামেন্টের পরিচিত এমপিদের সঙ্গে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমার একটিমাত্র কর্তব্য দেশ স্বাধীন করে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর সমুচিত শাস্তি র ব্যবস্থা করা।”* বিভিন্ন দেশে গিয়ে পাকিস্তানের বর্বরতার কথা তুলে ধরবেন বলে তিনি সংকল্প ব্যক্ত করেন। এভাবে দেখা যায়, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুজিবনগর সরকার গঠনের আগেই স্ব-উদ্যোগে লন্ডনে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিচারপতি ও মানবাধিকার কমিশনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে ইউরােপের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে যােগাযােগ তাঁর জন্য সহজ হয়। ৩০শে মার্চ তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সেন্ট ক্যাথিরিন কলেজের অধ্যক্ষ লর্ড এলেন বুলেকের সাথে সাক্ষাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের হত্যা এবং সার্বিকভাবে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার কথা তুলে ধরেন। চৌধুরী কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজ এসােসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল স্যার হিউ প্রিংগারের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে পাকিস্তানের গণহত্যার বিবরণ দেন। স্যার স্প্রিংগার ইয়াহিয়া খানের নিকট প্রেরিত এক তারবার্তায় বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ জানান এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে শান্তি প্রতিষ্ঠার অনুরােধ জানান। বিচারপতি চৌধুরী ব্রিটিশ ওভারসিজ মিনিস্টার রিচার্ড উডের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে রক্তাক্ত যুদ্ধ বন্ধ ও শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চেষ্টা করার অনুরােধ জানান। রিচার্ড উড একটি বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে যতটুকু চাপ দেওয়া যায় তা দেবেন বলে তাঁর কাছে অঙ্গীকার করেন। ৬ই এপ্রিল তিনি ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর লর্ড জেমস-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ৭১-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল আরনল্ড শ্মীথের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরেন। তিনি বাংলাদেশে রক্তপাত বন্ধ ও শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারকে অনুরােধ জানাবেন বলে উল্লেখ করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে এসব কর্মসূচিতে শেখ আব্দুল মান্নান, ওয়ালী আশরাফ, মােশাররফ হােসেন, শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও রাজিউল হাসান রঞ্জু বিশেষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আবু সাঈদ চৌধুরী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক। ডগলাস হিউমের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার কাছ থেকে ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারকার্যে সব ধরনের বেসরকারি সহযােগিতার ব্যাপারে আশ্বাস লাভ করেন। ১০ এপ্রিল তিনি বিবিসি ও লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে পাকিস্তানের সাথে তার সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘােষণা দেন। তাঁর এ ঘােষণা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাঙালি ও ভারতে আশ্রিত বাঙালিদের মধ্যে বিপুল উৎসাহের সঞ্চার করে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথমদিকে তিনি রক্ষণশীল দলের কমনওয়েলথ গ্রুপের। সেক্রেটারি অধ্যাপক জিনকিনের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর আমন্ত্রণক্রমে পরবর্তীকালে রক্ষণশীল দলের পার্লামেন্টের সদস্যদের এক সভায় বক্তৃতা করেন। এভাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের রক্ষণশীল দলের সদস্যগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল হন। বিচারপতি চৌধুরীর এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই ১২ই এপ্রিল কলকাতা থেকে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম তাঁকে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হবার জন্য অনুরােধ জানান এবং মুজিবনগরে সরকারের শপথ গ্রহণের তিন দিন পর ২১শে এপ্রিল অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্বাক্ষরকৃত নিয়ােগপত্রে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন এনালস ও সােস্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল হান্স ইয়ান্টিসেকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। অ্যামেনেস্টি মহাসচিবের পরামর্শে যুক্তরাজ্য স্টিয়ারিং কমিটি অধ্যাপক ড্রেপারকে আন্ত র্জাতিক রেডক্রস কমিটির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা ও তার সঠিক সংবাদ নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ােগ দেওয়ার পর তাঁকে যথাশীঘ্র সম্ভৰ আমেরিকায় যাওয়ার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়। সেই অনুযায়ী বিচারপতি চৌধুরী ৪ বছরের ভিসা এবং যতবার ইচ্ছা আমেরিকায় যাবার অনুমতি লাভ করেন। বিচারপতি চৌধুরী ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালিদের পার্লামেন্টে পাঠিয়ে স্ব-স্ব অঞ্চলের এমপিদের সাথে দেখা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের সমর্থন কামনা করেন। বিচারপতি চৌধুরী নিজেও প্রতিদিন একবার করে হাউস অব কমন্সের লবিতে গেছেন। এর ফলে ব্রিটিশ এমপিগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। পার্লামেন্টের আলােচনার সূত্র ধরে ব্রিটিশ পত্রপত্রিকাতেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বক্তব্য, মন্তব্য, প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে ব্রিটেনে বাঙালিদের আন্দোলনে গতি সঞ্চারিত হয়। ৩রা এপ্রিল ছাত্ৰ-মহিলাদের প্রতিনিধি দল পৃথকভাবে লন্ডনের বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে বক্তব্য পেশ করেন। চীনা দূতাবাস স্মারকলিপি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। দূতাবাসের কর্মচারীরা বলেন যে, ইয়াহিয়া খান সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনেবিশবাদবিরােধী এবং বিদ্রোহ দমন করার অধিকার তার রয়েছে। অতএব তারা ইয়াহিয়া খানকে পুরােপুরি সমর্থন করেন। যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলাের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যের অভাব ছিল। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এ অনৈক্য দূর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক সমিতিগুলাের সাথে প্রথমে ঘরােয়া বৈঠকে একটা সম্মিলিত প্ল্যাটফরম গঠনের উদ্যোগ নেন। ২৩শে এপ্রিল বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৪শে এপ্রিল কভেন্ট্রি শহরের একটি মিলনায়তনে ১২৫জন প্রতিনিধি ও ২৫জন পর্যবেক্ষক যােগদান করে। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন মিসেস লুলু বিলকিস বানু। সভা শুরু হলেই বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নিয়োগ সম্পৃক্ত পত্রখানি পাঠ করে শােনানাে হয়। ঐ দিনই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের  প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক লন্ডন প্রবাসী বাঙালিদের উদ্দেশ্যে লিখিত একটি চিঠি পড়ে শােনানাে হয় : চিঠিতে বলা হয়: জাতির এক যুগসন্ধিক্ষণে এ দেশবাসী অধির আগ্রহ নিয়ে আপনাদের সামগ্রিক সাহায্য ও সহানুভূতির অপেক্ষা করছে। প্রবাসী সকল বাঙালি ভাইরা আজ পূর্ণ সংহতি নিয়ে একযােগে স্বদেশবাসীর পাশে দাড়াবেন এটাই আমাদের দৃঢ় প্রত্যাশা।
ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালিদের কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ পাকিস্তান ইন ইউকে’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ইন ইউকে গৃহীত হয়। কভেন্ট্রিতে অনুষ্ঠিত বাঙালিদের এই সভার প্রস্তাবে এই সংগঠনকে কেন্দ্রীয় সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সংগঠন পরিচালনার জন্য ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটা কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়।” যুক্তরাজ্যের অন্যান্য এলাকার বিদ্যমান কমিটিগুলাে অ্যাকশন কমিটির শাখা কমিটি হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এই কার্যকরী কমিটি স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনায় সার্বিকভাবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শে পরিচালিত হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। ১১ নং গােরিং স্ট্রীটে কার্যকরী কমিটির অফিস স্থাপিত হয় এবং এখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। ৩রা মে নতুন অফিস আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, “মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাকিস্তান মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশ আজ একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংগ্রাম করছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে খতম না করা পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। লন্ডনের বাইরে বসবাসরত বাঙালিদেরকে সংঘবদ্ধ করার জন্যও বিচারপতি চৌধুরী। সচেষ্ট হন। ৯ই মে তিনি ব্রাডফোর্ড (সকাল ১০টা) ও বার্মিংহাম (বিকাল ৩টা) জনাকীর্ণ হলে বক্তৃতা করেন। সভায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালবাসি’ গীত হয়। বার্মিংহামের জনসভা সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরী লিখেছেন: আমরা যখন হলে প্রবেশ করি তখন এই জনাকীর্ণ সভার সকলেরই মুখে-চোখে দৃঢ়তা, দেশপ্রেম ও দৃপ্ত শপথের সমম্বিত অভিব্যক্তি। আমি এই সভায় প্রবেশ করেই অনুভব করলাম এক অভূতপূর্ব শিহরন। মনে হলাে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের আত্মার গভীর মিলন হয়েছে। আমরা মঞ্চে স্থান গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে সভার কাজ শুরু হলাে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২২শে মে অক্সফোর্ড শহরে এক জনসভায় ভাষণ। দেন। অক্সফোর্ডের সভা শেষে তিনি ব্লেচলি শহরে, সেখান থেকে ২৩শে মে বিমানযােগে। গ্লাসগাে যান। এসময় তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন শেখ আব্দুল মান্নান। গ্লাসগােতে সংগঠক ছিলেন ডা. শামসুদ্দিন।
গ্লাসগাে থেকে ফিরে ২৪শে মে বিচারপতি চৌধুরী নিউইয়র্ক যান। সেখানে পূর্ব থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠকের কাজ করেন এ.এইচ, মাহমুদ আলী, স্থপতি ফজলুর রহমান খান, এ.এম,এ, মুহিত ও হারুন-অর-রশিদ প্রমুখ। বিচারপতি চৌধুরী নিউইয়র্কে কর্মব্যস্ত সময় কাটান। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে টেলিফোনে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন শাহীন মাহমুদ আলী। তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা ছিল সুপ্রণালীবদ্ধ।” একজন রাষ্ট্রদূত সঙ্গে সাক্ষাৎ চলাকালীন তিনি অন্য একজন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে ফেলতেন। পূর্বের সাক্ষাৎ শেষে প্রতিনিধিদল বাইরে এলে তাদের জন্য নির্ধারিত সময়ে পরবর্তী সাক্ষাৎকারের কথা বলে দিতেন। এভাবে স্বল্প সময়ে নিউইয়র্কে তার পক্ষে সম্ভব হয় নরওয়ে, সৌদি আরব, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মিসর, জর্ডান, ইরাক, ইরান, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা। ২৯শ মে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ৩০শে মে ম্যানচেস্টারে বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাটি আয়ােজন করেন ম্যানচেস্টারে বসবাসরত বাঙালি নেতা আব্দুল মতিন, ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন আহমেদ, স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য কবির চৌধুরী প্রমুখ। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ লন্ডনে এলে বিচারপতি চৌধুরী তাঁর সঙ্গে আলােচনা করেন। ৫ই জুন বিচারপতি চৌধুরী শেফিল্ড টাউন হলে বিরাট জনসভায় ভাষণ দেন। এরপর ৬ই জুন পূর্ব লন্ডনের এক জনসভায় ভাষণ দেন। ১১শে জুন লন্ডন উইক অ্যাণ্ডি টেলিভিশন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও প্রচার করে। ঐ সাক্ষাৎকারে বিচারপতি চৌধুরী জোরালাে যুক্তি, তথ্য ও উপাত্তের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ গ্রুপের সকল প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ শানিত জবাব দেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত বৃদ্ধি পায়। লীডস-এর সভায় ওয়ার্কার্স প্রেস বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্রসম্বলিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। গণহত্যা ও নির্মম নির্যাতনের ছবি দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়। এ দেখে অভিভূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, “পৃথিবীর এমন কোনাে শক্তি নেই যে, আমাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করতে পারে।” | ১৬ই জুন সন্ধ্যাবেলা আই. টিভির ‘ম্যান ইন দি নিউজ প্রােগ্রামে বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাতকারের বিবরণ প্রচারিত হয়। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকার। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞের খবর চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনী পাকিস্ত নিকে খতম করেছে, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হবে।
১৭ই জুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিচারপতি চৌধুরীর কুটনৈতিক পরিচয়পত্রে স্বাক্ষরদান করেন। এই পরিচয়পত্রে বিচারপতি চৌধুরীকে যুক্তরাজ্যে হাই কমিশনার হিসেবে নিয়ােগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষণা করা হয়। এই পরিচয়পত্র ইংল্যান্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সরকারি বাসভবন বার্মিংহাম প্যালেসে পেশ করা হয়। যথাসময়ে পরিচয়পত্র প্রাপ্তিস্বীকার করে বার্মিংহাম প্যালেস থেকে বিচারপতি চৌধুরীর নিকট একটি পত্র পাঠানাে হয়। এই পত্র প্রাপ্তিকে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বীকৃতি হিসেবে প্রবাসীরা প্রচার করেন।  ওয়েলসের রাজধানী শহর কার্ডিফে বসবাসরত বাঙালিদের আমন্ত্রণে বিচারপতি চৌধুরী ২০শে জুন কার্ডিফের জনাকীর্ণ সভায় মুক্তিযুদ্ধের বিগত কয়েক সপ্তাহের অগ্রগতির বিবরণ। দেন। এর ফলে সেখানকার কর্মীদের মধ্যে যেমন উৎসাহ ও উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধেও উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি আন্তর্জাতিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।  মুজিনগর সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরী এক ঝটিকা সফরে ২১শে জুন নেদারল্যান্ড গমন করেন। সেখানকার স্বল্পসংখ্যক বাঙালি সংশ্লিষ্ট সরকারের মনােযােগ আকর্ষণে সফল হন। নেদারল্যান্ডের কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য ও স্পিকারের সাথে বিচারপতি চৌধুরী সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে পাকিস্তানের গণহত্যার বিবরণ দেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তিনি পার্লামেন্টের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। এখানে তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, যা নেদারল্যান্ডের পত্রিকাগুলিতে প্রথম পৃষ্ঠার দু’তিন কলামব্যাপী শিরােনাম দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়।
২৩শে জুন তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং-এর সঙ্গে দেখা করে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র প্রেরণে ভারত সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। বলে মত প্রকাশ করেন। শরণ সিংহ বলেন যে, বিদেশ থেকে অস্ত্র না পাঠালেও মুক্তিযােদ্ধারা প্রয়ােজনীয় অস্ত্র পাচ্ছে। এসময় ব্রিটেনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন।  লন্ডনে ফিরে এসে তিনি ১০ই জুলাই বেডফোর্ড শহরে জনসভা করেন। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডশীফ এসােসিয়েশন’-এর ব্যানারে আয়ােজিত এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন ইউরােপীয় দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে বিচারপতি চৌধুরী আলাপকালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের সমর্থন কামনা করেন। ৩১শে আগস্ট বিচারপতি চৌধুরী প্রবাসী বাঙালিদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি প্রচার করেন।  বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠিত হবার পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলাে সফরে বের হন। প্রথমে ১লা সেপ্টেম্বর নরওয়ের অসলাে পৌছান। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পিয়ের অল্ডসহ অন্যান্য বিচারপতি এবং বিভিন্ন পর্যায়ে পেশাজীবী, পার্লামেন্ট সদস্য ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সাথে আলােচনা করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি ও যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী স্টলটেনবার্গের সাথে বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎ ঘটে। আলােচনার পর স্টলটেনবার্গে বলেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আসন্ন সম্মেলনে নরওয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি পেশ করবে।
প্রত্যেকের সাথে আলােচনায় তিনি বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করেন। ৭ই সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী নরওয়ে থেকে সুইডেন গমন করেন। সুইডেনে নিয়ােজিত পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত আব্দুর রাজ্জাক বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। স্টকহােমে পৌঁছাবার পর বিচারপতি চৌধুরী নােবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গুনার মীরডালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার পর বিচারপতি চৌধুরী অধ্যাপক মীরডালকে স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত করেন।” ৭ই সেপ্টেম্বর সুইডেনের সােসালিস্ট ডেমােক্রেটিক পাটির সেক্রেটারি জেনারেল স্টোন এন্ডারসনের সাথে সাক্ষাৎ করেন বিচারপতি চৌধুরী। তিনি তাঁর পাটির পক্ষ থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করার ঘােষণা ‘ দিয়েছিলেন। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিয়ের শােরির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়াও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যালবার্গ, সুপ্রিম কোটের অস্থায়ী বিচারপতি মিসেস ইনগ্রিড গার্ডেওয়াইডেমার এবং লিবারেল পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ ইয়ান স্টিফেনসনের সঙ্গে পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করে বিচারপতি চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে আলােচনা করেন। | ১৩ই সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী সুইডেন থেকে ফিনল্যান্ড পৌছেন। ১৪ই সেপ্টেম্বর তিনি ফিনিশ টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকার দেন। অতঃপর পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্যদের সাথে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। তিনি ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে আলােচনা করেন। সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিস ও মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ভ্যাটিওসারিওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৪ই সেপ্টেম্বর আবু সাঈদ চৌধুরী ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে পৌছালে মতিউর রহমান ও লিয়াকত হােসেনসহ কয়েকজন বাঙালি তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। ডেনমার্কে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির আহ্বায়ক কিস্টেন ওয়েস্টগার্ড ও তাঁর সহকর্মীরা বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে একটা বুলেটিন প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য যে, ওয়েস্টগার্ড ২৫ই মার্চ ঢাকায় অবস্থানকালে পাকিস্তানিদের গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেন। বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য, স্পিকার ও পার্লামেন্টের বৈদেশিক কমিটির সদস্যদের সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও সমকালিন পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলন করেন। এর ফলে পাকিস্তানে যে কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অস্ত্র সরবরাহ করতে চুক্তি করেছিল জনমতের প্রতিফলনে তা স্থগিত করে। তখন জাতিসংঘের অধিবেশন ছিল সমাগত। ডেনিশ প্রতিনিধিদের নেতা জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বস্ত করেন। এভাবে একনাগাড়ে ৭ই থেকে ১৬ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলাে সফর করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৬ই সেপ্টেম্বর রাতে বিচারপতি চৌধুরী ডেনমার্ক থেকে লন্ডনে ফিরে এসে। যথারীতি লন্ডনের কাজ শুরু করেন। অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত আবদুল মােমেনকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের একটি হােটেলে। মরিশাসের কৃষিমন্ত্রী স্যার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি মরিশাস কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে সমর্থনদানের জন্য আব্দুর রাজ্জাককে অনুরােধ করেন। তাঁর বক্তব্য শোনার পর আবদুর রাজ্জাক বলেন, “পাকিস্তান। ভেঙে দেওয়া ঠিক হবে না। অতীতের অন্যায় ক্ষমা করে নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এগিয়ে যেতে হবে। যদিও মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিউসাগর রামগােলাম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর দলের মুসলমান সদস্যদের বিরােধীতার ফলে তা সম্ভব হয়নি। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রােগ্রাম করেন। ২৮ই নভেম্বর থেকে ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছেন হার্ভার্ড, নিউইয়র্ক সিটি, কলম্বিয়া এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থান ও মুজিব নগর সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন যার ঐতিহাসিক ও কূটনৈতিক অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। বিবৃতিটি সদস্য দেশের মধ্যে প্রচার করা হয়। বিবৃতিতে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে তিনি ঘােষণা দেন চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর প্রবাস পরিচালিত কর্মকাণ্ড পর্যালােচনায় লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম-উৎসে আদর্শিক রাজনৈতিক অভিঘাতের চেয়ে সার্বজনীন মানবাধিকার এবং কূটনৈতিক রীতি-পদ্ধতি এবং জাতিসংঘ স্বীকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রায়ােগিক দিককে গুরুত্ব দিয়েছেন। পরাশক্তি বিভাজিত বিশ্ব ব্যবস্থায় এরূপ পদক্ষেপই তার জন্য যথার্থ বলে বিবেচনা করেছেন। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি যেমন মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করেছেন, তেমনি সােভিয়েত দূতাবাসে গিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ৪. ইকোনােমিক ডিপ্লোম্যাসি : প্রফেসর রেহমান সােবহানের ভূমিকা”। পাকিস্তান সরকার যেন দাতাদের সাহায্য না পায় এজন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ রেহমান সােবহানকে লন্ডন ও যুক্তরাষ্ট্র যেতে অনুরােধ করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে রেহমান। সােবহান এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে যান। তিনি সেখানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁর ব্রিটিশ বন্ধুদের সহায়তায় সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা করে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন এবং পাকিস্তানকে কোনাে ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান না করার অনুরােধ জানান। তিনি । ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ডগলাস হিউম ও তাঁর ব্যক্তিগত সচিব নিকোলাস ব্যারিংটনের সাথে । সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এছাড়া সাংবাদিক ব্রায়ান ল্যাপিং এর। মাধ্যমে লেবার পাটির কয়েকজন এমপির সাথে সাক্ষাৎ করেন। ব্রিটিশ সরকার যেন পাকিস্তানকে সহায়তা প্রদান না করে সেজন্য তাদেরকে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির অনুরােধ জানান। |জুন মাসের ১৯ তারিখে (১৯৭১) প্যারিসে এইড কনসাের্টিয়ামের বৈঠক উপলক্ষ্যে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদানের উদ্দেশ্যে গঠিত হয় ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি। অন্যদিকে, বাংলাদেশে নিষ্ঠুর গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন, ধ্বংসযজ্ঞ এবং নির্মম। সামরিক আক্রমণের সংবাদ দেশে-বিদেশে অগণিত গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। নরঘাতক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকারকে অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক সাহায্য না দেওয়ার জন্য বাঙালিদের বিশ্বব্যাপী আবেদন জনমনে ব্যাপক। প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। লন্ডনস্থ দূতাবাসগুলােতে প্রবাসী বাঙালিরা মুজিবনগর সরকারের আহ্বানে ও স্বপ্রণােদিতভাবে বারবার সাহায্য বন্ধের উচ্চকিত দাবি তােলেন। তারপরও অনুষ্ঠিত হয় কনসাের্টিয়াম বৈঠক। সেজন্য জরুরিভাবে গৃহীত হয় কর্মসূচি। যে কোনাে। মূল্যে পাকিস্তান যাতে সাহায্য না পায় তার জন্য সর্বপ্রকার উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে ১৪ই জুন ১১ জাতি কসসাের্টিয়ামের সদস্য দেশগুলাের লন্ডনস্থ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। ঐদিন বিকেল ৩টায় ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন বাঙালিরা। সাড়ে চারটায় মিছিল গিয়ে। পৌছে ট্রাফালগার স্কোয়ারস্থ কানাডা হাউসের দূতাবাসের সামনে। সেখানে বিক্ষোভ। প্রদর্শন করা হয়। দাবি জানানাে হয়, যেন বাঙালির খুনে রঞ্জিত ইয়াহিয়ার সরকারকে। কোনাে সাহায্য দেওয়া না হয়।  ১৫ই জুন দুপুর একটায় একই দাবি নিয়ে সংগ্রামী জনতা গিয়ে হাজির হন ফ্রান্স। দূতাবাসের সামনে। দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ৫৮, নাইটব্রিজে বিক্ষোভ করেন পূর্ব ঘােষিত কর্মসূচি অনুসারে। সাড়ে চারটায় একই কর্মসূচি পালিত হয় দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ইটন স্কোয়ারস্থ বেলজিয়াম দূতাবাসের সামনে, তারপর জার্মানির দূতাবাসের সামনে। ১৬ই । জুন একই এলাকার বেলগ্রেড স্কোয়ারে দূতাবাসের সামনে বিকাল সাড়ে চারটায় সুশৃঙ্খল ।
বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। একই দাবিতে বিক্ষোভ হয় অস্ট্রিয়ীয় রাষ্ট্রদূতের অফিসের সামনে। ১৭ই জুন-এ দুপুর একটায় লন্ডন শহরের গ্রোভনার পার্কে যুক্তরাষ্ট্রে দূতাবাসের সামনে এবং সাড়ে চারটায় একই এলাকার গ্রোভনার স্ট্রিটে জাপান দূতাবাসের সামনে। মুক্তিকামী বাঙালির বিক্ষুব্ধ সমাবেশ ঘটে। একইভাবে ১৮ই জুন হাইড পার্ক গেটে হল্যান্ড এবং থ্রিকিংস ইয়ার্ডে ইতালীয় দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। স্ব-স্ব সরকার যাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে সাহায্য প্রদান না করে তার যথাযথ ব্যবস্থা নেবার দাবি জানানাে হয়। পাকিস্তান সাহায্যদাতা কনসাের্টিয়াম বৈঠকের ঠিক আগে লন্ডনের মহিলারাও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। তাঁরা নারী নির্যাতনকারী খুনি ইয়াহিয়া চক্রকে সাহায্যদান বন্ধ রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তারা বলেন যে, পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে দেওয়া প্রতিটি পেনি বুলেট হয়ে বিদীর্ণ করছে বাঙালির হৃদয়। পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়ার অর্থই হলাে আরও রক্তপাত, গণহত্যা। এইড কনসাের্টিয়ামের বৈঠক। আসন্ন। তাই বিক্ষুব্ধ বাঙালি রমণীরা বেরিয়ে আসেন লন্ডনের রাজপথে। সংগঠিত করেন। মিছিল। ব্যানার, ফেস্টুনে সজ্জিত সেই মিছিল থেকে আওয়াজ ওঠে ‘Not a penny, not a Gun-Yahya Bhutto Tikka Khan.’ জনতা নেমে আসে রাজপথে। মিছিল স্ফীতকায় হয়ে ওঠে। রূপ নেয় বিশাল মিছিলে। কনসাের্টিয়াম বৈঠকের সময় ব্রিটেনের লন্ডন এবং বার্মিংহাম নগরী থেকে তিনটি কোচ ভর্তি হয়ে শ’ দেড়েক বাঙালি চলে যান প্যারিস। এর আগে তাঁরা সবাই ব্রিটিশ পাসপাের্ট করে নিয়েছেন। সাথে করে নিয়েছিলেন দোভাষী । সেখানে তারা বিক্ষোভ করেছেন পাকিস্তানের সামরিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সাহায্যদানের বিরুদ্ধে, কথা বলেছেন গণমাধ্যমের সাথে। বিশ্লেষণ করেছেন দাবির যৌক্তিকতা। সাহায্যদানকারী দেশগুলাের প্রতিনিধিদের সভায় অ্যাকশন বাংলাদেশ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদল জোর লবি করেন। সভাস্থলের বাইরেও তারা দেড়ঘণ্টা বিক্ষোভ প্রদর্শনের সুযোগ গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচি সফল হয় আশাতীতভাবে।
৭ই জুন পাকিস্তান প্যারিসে এইড কনসাের্টিয়ামের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে পাকিস্তান সরকারের আস্থা ছিল দাতা দেশগুলাের পক্ষ থেকে নতুন সাহায্যের আশ্বাস পাবে। যুদ্ধের কারণে তাদের আমদানি ক্ষমতা প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।  বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সােবহান প্যারিসে গিয়ে ডানিয়েল ও হাসান ইমামকে নিয়ে ইতিপূর্বে যে পেপারটি ম্যাকনামারাকে দিয়েছিলেন সেটার উপর ভিত্তি করেই তিনি কনসাের্টিয়ামের জন্য একটি মেমােরান্ডাম প্রস্তুত করেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার কারগিলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। পিটার কারগিল সবেমাত্র পাকিস্তানের অবস্থা পরিদর্শন করে ফিরে এসেছেন। তার রিপাের্টের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের অস্থিতিশীল এই পরিবেশে উন্নয়ন-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে এই অজুহাতে কনসাের্টিয়াম পাকিস্তানকে সাহায্যের নতুন কোনাে আশ্বাস দেয়নি। এমনকি নতুন সাহায্য প্রদানের বিষয় নিয়ে আলােচনাও অনুষ্ঠিত হয়নি। সদস্য দেশগুলাে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নতুন সাহায্যদানের প্রস্তাব সম্পর্কিত আলােচনা স্থগিত থাকবে। পাকিস্তান সরকারের জন্য এটা ছিল এক বিরাট আঘাত। সামরিক চক্র বিচলিত বােধ করে। রেহমান সােবহান লিখেছেন, “মার্কিনী প্রতিনিধিরা পাকিস্তানের সমর্থনে বেশ নমনীয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সাহায্যের ব্যাপারে তারা তেমন জোর করেনি। বরং কনসাের্টিয়ামের সিদ্ধান্তই মেনে নিয়েছেন তারা।” অধ্যাপক রেহমান সােবহান বিশ্বব্যাংকেও লবি করেছিলেন। বিশ্বব্যাংক যাতে পাকিস্তানে সাহায্য প্রেরণ থেকে বিরত থাকে তার জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামার সাথেও তিনি সাক্ষাৎ করেন। এ সময় সাহায্য বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে তৈরি করা একটি পেপারও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টকে হস্তান্তর করেন রেহমান সােবহান। একাত্তরের সেপ্টেম্বর অক্টোবরে ওয়াশিংটনের শেরাটন হােটেলে বিশ্বব্যাংক আই.এম.এফ.-এর বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও রেহমান সােবহান এবং এ.এম.এ. মুহিত উপস্থিত হয়ে পাকিস্তানকে কোনাে রকম সাহায্য প্রদান না করার জন্য লবি অব্যাহত রেখে সফলতা এনেছেন।  কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রবার্ট ডর্ফমেন, প্রফেসর স্যামুয়েন হান্টিংটন, হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের প্রফেসর লজসহ আরাে অনেকের সাথে প্রফেসর রেহমান সােবহান সাক্ষাৎ করে ড. কিসিঞ্জারের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার করার প্রয়াস চালান। এরা সবাই এককালে কিসিঞ্জারের সহকর্মী ছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তার সহকর্মী গুসতাভ পাপানেকসহ আরাে অনেকে এই প্রচেষ্টা চালান। তারা কিসিঞ্জারের মনােভাব পরিবর্তন করার লক্ষ্যে মিছিলও করেন। তাতে স্লোগান ছিল: “Wake up Henry.” কিন্তু সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পুরাে বছরব্যাপী। কোনাে বাঙালিই তার সাক্ষাৎ লাভে সক্ষম হননি।
৪.১ ড. এ. আর, মল্লিক। মুজিবনগর সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতিসংঘে লবি করার জন্য যে প্রতিনিধিদল প্রেরিত হয়েছিল ড, এ, আর, মল্লিক ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। তিনি শুধু জাতিসংঘ কেন্দ্রিক লবি করেননি তার বাইরেও সক্রিয় ছিলেন।  প্রতিনিধি দলের সদস্য ড, আজিজুর রহমান মল্লিক ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে অনেকগুলাে বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখেন। এ সময় ড, এ.আর, মল্লিক এককভাবে কিংবা অন্য প্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে প্রােগ্রাম করেছেন নিউইয়র্ক, কলম্বিয়া, পেনসিলভেনিয়া, স্টানফোর্ড, বার্কলে, লংবিচ, শিকাগাে, বাফেলাে, নর্থ ক্যারােলিনা, হার্ভার্ড, বােস্টন, ইয়েল, টেক্সাস প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব স্থানে তিনি ফ্যাকাল্টিতে বক্তব্য তুলে পরেছেন, সাংবাদিকদের সাক্ষাৎ দিয়েছেন, ছাত্র-শিক্ষকদের সভায় বক্তৃতা করেছেন। বহু শংগ্রেসম্যান ও সিনেটরদের সাথেও বৈঠক করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছেন তাদের কাছে এবং তাদের সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করেছেন। প্রভাবশালী সিনেটর কেনেডি, স্যাক্সবি, চার্চ প্রমুখের সাথে গড়ে ওঠে তার ব্যক্তিগত সখ্য। আর তা ব্যবহার করেছেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বক্তৃতা করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। তাঁর বক্তৃতা যুক্তরাষ্ট্রে কার্যকর প্রভাব ফেলে। ৫. স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিকৃতি ডাকটিকিট প্রকাশের মাধ্যমে জনমত গঠন ২৬শে জুলাই, হাউস অব কমন্সের হারকোট রুমে পার্লামেন্টের সকল দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য ও প্রায় ৪০জন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়।” ডাকটিকিট প্রকাশের উদ্দেশ্য স্পষ্ট, বিদেশে মুজিবনগর সরকারের অস্তিত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনার ধারণা প্রচার করা। ডাকটিকিটগুলির পরিচিতি নিম্নে উল্লেখ করা হলাে:
এক, প্রকাশিত দশ পয়সা মূল্যমানের ডাকটিকিটে বাংলাদেশের মানচিত্র ব্যবহৃত হয়েছে। এর উপরের অংশে বাংলাতে বাংলাদেশ এবং ইংরেজিতে Bangladesh ও দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডান পাশে কোণায় চ.১০ লেখা আছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ গঠনের প্রথম ও প্রধান শর্ত সেই দেশের একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, এই ডাকটিকিটে সদ্য স্বাধীনতা ঘােষিত দেশটির নিজস্ব ভূখণ্ড আছে এরই প্রচারণা ও বাংলাদেশের মানচিত্রকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। | দুইবিশ পয়সা মূল্যমানের ডাকটিকিটে উপরের অংশে বাংলাতে বাংলাদেশ এবং ইংরেজিতে Bangla Desh ও দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডান পাশে কোণায় P.20 লেখা আছে। এর নিচের অংশে সবুজ জমিনের উপর সােনালি ও সাদা রঙের লেখা। প্রথমে সাদা রঙের MASSACRE AT লেখা। এর নিচে সােনালি রঙের লেখা DACCA UNIVERSITY এবং এই লেখার উপর লাল রঙের ছােপ ছােপ। সবচেয়ে নিচে ON 25” 26″ MARCH ১৯৭১। এই ছবিটি মূলত হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালাে রাতে ও ২৬ মার্চ যে নির্মম গণহত্যা সংঘটিত হয় তার চিত্র ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। তিন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, একটি দেশ তখনই স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাওয়ার যােগ্য হবে যখন তার নিজস্ব জনসংখ্যা থাকবে।” সেই মতানুযায়ী বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাওয়ার যােগ্য। কেননা তার নিজস্ব জনসংখ্যা আছে যার সংখ্যা সাড়ে সাত কোটি। পঞ্চাশ পয়সা মূল্যমানের ডাকটিকিটে উপরের অংশে বাংলাতে বাংলাদেশ এবং ইংরেজিতে Bangla Desh লেখা হয়। বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা ডান পাশে কোণায় চ.৫০ লেখা আছে। নিচের অংশে ছােট করে A NATION OF এর নিচে বড় করে ইংরেজিতে ৭৫ লেখা এবং এর নিচের অংশে।
MILLION PEOPLE লেখা আছে। এর অর্থ সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিপীড়িত, নির্যাতিত ও গণহত্যার শিকার বিশ্ববাসীর কাছে এটা তুলে ধরা। চার, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানচিত্রসম্বলিত স্বাধীনতার পতাকা। পাঁচ, দুই রুপি মূল্যমানের ডাকটিকিটটি বক্তব্যধর্মী। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের বিশদ বিবরণে এই ডাকটিকিট চিত্রিত হয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাংলার জনগণ ৯৮% ভােটে নির্বাচিত করে, কিন্তু পাকিস্তানি শাসক-শােষক চক্র বাংলার জনগণের রায়কে ভূ-লুষ্ঠিত করে জনগণের ওপর অগণতান্ত্রিকভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তারা। বিচ্ছিন্নতাবাদী ও মুক্তিযােদ্ধাদের গুটিকয়েক ‘দুষ্কৃতিকারী’ হিসেবে প্রচার করে। এই প্রচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এই ডাকটিকিটে তা মূর্ত হয়েছে। এর উপরের অংশে বাংলাতে বাংলাদেশ এবং ইংরেজিতে Bangla Desh ও দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডান পাশে কোণায় Rs.2 লেখা আছে। এর নিচের অংশে একটি ব্যালট বাক্সের ছবি এর দু’পাশে ইংরেজিতে ৯৮ লেখা এবং তার উপর % চিহ্ন। বাক্সের উপরে ELECTION ১৯৭০ লেখা। এর পরের ব্যালট পেপার ফেলার অংশে এক টুকরাে কাগজের ছবি এর গায়ে VOTE এবং এর নীচের লাইনে RESULTS 167 SEAT লেখা। এর পরের লাইনে OUT OF 288 ও সর্বশেষ লাইনে FOR Bangla Desh লেখা রয়েছে।
ছয়, তিন রুপি মূল্যমানের ডাকটিকিটে উপরের অংশে বাংলাতে বাংলাদেশ এবং ইংরেজিতে Bangla Desh ও দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডান পাশে কোণায় জং.৩ লেখা আছে। নিচের দিকে ডাকটিকিটটিতে একটি বক্তব্যধর্মী বিশেষ ধরনের ছবির ব্যবহার দেখা যায়। এটি একটি সদ্য বিচ্ছিন্ন শিকলের ছবি। শিকলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে দুটি আলাদা অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ডানদিকের বিচ্ছিন্ন অংশটি অনেকটা বাংলাদেশের মানচিত্রের মত দেখতে। এই শিকলের ছবির উপরের লেখা আছে PROCLAMATION OF INDEPENDENT GOVERNMENT অর্থাৎ স্বাধীন সরকারের ঘােষণা। এর নিচে লেখা আছে বিপ্লবী। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ঘােষণার দিন 10′ APRIL ১৯৭১. সাত, পাঁচ রুপি মূল্যমানের ডাকটিকিটটি মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসম্বলিত। এর উপরের অংশে বাংলাতে বাংলাদেশ এবং ইংরেজিতে Bangla Desh ও দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডান পাশে কোণায় Rs.5 লেখা আছে। নিচের অংশে সােনালি। জমিনের উপর বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, ছবির বাম দিকে সাদা হরফে লেখা SHEIKH MUJIBUR RAHMAN. আট, দশ রুপি মূল্যমানের ডাকটিকিটটি বাংলাদেশের মানচিত্রের ছবি অঙ্কিত একটি ডাকটিকিট। এর উপরের অংশে বাংলাতে বাংলাদেশ এবং ইংরেজিতে Bangla Desh ও

দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডান পাশে কোণায় Rs.10 লেখা আছে। এর নিচের ডানদিকে বাংলাদেশের মানচিত্রের ছবি। এই ছবির বাম দিকে SUPPORT লেখা। ঠিক এর নিচে আড়াআড়িভাবে BANGLA এবং মানচিত্রের নিচে DESH লেখা । আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী বিমান মল্লিক এই ডাকটিকিটগুলাের ডিজাইন করেন। ব্রিটিশ এম, পি, জনস্টোনহাউস মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য মন্ত্রীদের সাথে আলাপ করে সরকারের নির্দেশেই ডাকটিকিটগুলাে প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এসব ডাকটিকিট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করা হয়। ৬. ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা (জুন-ডিসেম্বর, ১৯৭১) ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালিরা মূলত বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আঞ্চলিক সংগঠনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করেছে অবার বৃহত্তর পরিবেশে অনেকেই সংশ্লিষ্ট হয়েছেন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। প্রবাসী বাঙালিদের ব্যক্তিক উদ্যোগ বা স্থানীয় কমিউনিটি কর্মকাণ্ড ছাপিয়ে রাজনৈতিক চেতনাগত প্রবাহ তাদেরকে প্রভাবিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাঙালিরা ব্যক্তিগত বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অতিক্রম করে স্বাধীনতার মূল ধারায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। বিভিন্ন স্টিয়ারিং কমিটি ও অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন আঞ্চলিক বা কেন্দ্রীয় কমিটিগুলােতে সক্রিয় থেকেছেন।
| মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব থেকেই ব্রিটেনে আওয়ামী লীগ সংগঠন ক্রিয়াশীল থাকার ফলে দলীয়ভাবে প্রবাসী বাঙালিদের সে ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত হতে অসুবিধা হয়নি। তবে বামদল যেমন কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের একটি অংশ ব্যতিরেকে কট্টরপন্থি হিসেবে চিহ্নিত চীনের মতাদর্শের অনুবর্তী গ্রুপ এমন কর্মকাণ্ডে ও বক্তব্যে নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছে যা মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্বাধীনতার প্রশ্নে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে এমনি অবস্থায় আওয়ামী লীগ স্বাভাবিক কারণেই সাংগঠনিক অবস্থানকে সুদৃঢ় ও কর্মকাণ্ডকে সুবিস্তৃত করতে সচেষ্ট থেকেছে। জনাব আবদুস সামাদ আজাদ এক ঝাটিকা সফরে বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, ব্রাডফোর্ড, লুটন, সেন্ট আলােবান্স, হ্যালিক্স, কিথলীসহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ আয়ােজিত জনসভায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিত, বিশ্ব কূটনৈতিক যােগাযােগ ও অগ্রগতি সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে বার্মিংহাম ব্রাডফোর্ড ও ম্যানচেস্টার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও অংশগ্রহণ করেন। এই নেতা-কর্মীরা যেমন আঞ্চলিকভাবে গঠিত আওয়ামী লীগ কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পাশাপাশি তেমনি বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটি বা স্টিয়ারিং কমিটির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সন। ৪ জুন। শুক্রবার। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে একটি মিছিল বের করে। দু’শ মহিলা ও শিশু এতে অংশ নেয়। শাড়ি পরিহিত এসব মহিলা সহজেই পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরা বহন করেন পােস্টার ও প্ল্যাকার্ড। মহিলা সমিতির আহ্বায়ক জেবুন্নেসা বক্স এর নেতৃত্ব দেন।
মিছিলকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন মিসেস জাহানারা রহমান। সমিতির পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদলের নেত্রী হিসেবে বক্স ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হীথের নিকট পাকিস্তান। সামরিক সরকারকে সাহায্যদান বন্ধ, তাদের বর্বরােচিত অমানবিক নৃশংস কর্মকাণ্ডের। নিন্দা এবং মুজিবনগর সরকারের স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষে এই সমিতি সেইভ দ্যা চিলড্রেন ফান্ড, ব্রিটিশ রেডক্রস। সােসাইটি ও ক্রিশ্চিয়ান এইডসহ বিভিন্ন সংস্থার নিকট ত্রাণ কার্য পরিচালনার জন্য আবেদন পেশ করেন। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে শ্রমজীবী বাঙালির সংখ্যা অনুপাতে সিংহভাগ। হাজার। হাজার শ্রমজীবী মানুষ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও শােষণমুক্তির প্রতিশ্রুতি ঘােষণা করলে দেশের অভ্যন্তরে শ্রমিক শ্রেণি যেমন তেমনি প্রবাসে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে নতুন আশা ও আস্থার সঞ্চার হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে নানা চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জীবিত আকাক্ষায় শ্রমজীবী মানুষ ঝাপিয়ে পড়ে। ব্রিটেনের শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ গণ-সংগ্রামকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে নানাভাবে। শুধু বিভিন্ন মিটিং ও গণসমাবেশে অংশগ্রহণেই নয় কষ্টার্জিত বেতন থেকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য চাঁদা প্রদান করেছেন সাধ্যমত। জাতীয় শ্রমিক। লীগের সভাপতি মােহাম্মদ শাজাহান ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান ব্রিটেনে। শ্রমিকদের সংগঠিত করেছেন। ব্রিটেনের ইঞ্জিনয়ারিং শ্রমিকদের নেতা হিউস্ক্যানল, রাসায়নিক শ্রমিক নেতা বর অ্যাডওয়ার্ডস, সিনেমা শিল্পের শ্রমিক নেতা অ্যালান স্যাপার, খনি শ্রমিকের নেতা লরেন্স ড্যালি ছাপাখানার শ্রমিদের নেতা রিচার্ড ক্রিগিনশ’-এর সঙ্গে আবদুল মান্নান সাক্ষাৎ করেন। শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে ব্রিটিশ শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থনই দেননি, তারা আর্থিক সহায়তা। প্রদান করেন। প্রবাসী শ্রমজীবী মানুষের অবদান ইতিহাস নির্দিষ্ট। তবে এসব শ্রমজীবী মানুষ প্রবাসে শ্রম সংগঠনের চাইতে মুলধারায় আন্দোলনে সক্রিয় বা তৎপর ছিলেন।
ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় প্রত্যেকেই হয়ে উঠেছিলেন একজন স্বেচ্ছা-সৈনিক। আবদুল মালেক একজন প্রবাসী সমাজকর্মী, পূর্ব লন্ডনের বাসিন্দা। তিনি ব্রিটিশ টেলিভিশনের একটি সংবাদ পরিক্রমা দেখে রাতেই শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শােরকে টেলিফোনে এই মিথ্যা প্রচারের জোরালাে প্রতিবাদ জানাতে বলেন। সাের তাকে বলেন যে, প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবাদপত্র নিয়ে তাকে পালামেন্টে সাক্ষাৎ করতে। আবদুল মান্নান তার কন্যার সাহায্যে একটি প্রতিবাদলিপি টাইপ করে পরদিন পিটার শাের নিকট পৌছে দেন। পিটার শাের ও অন্যান্য সদস্য এ প্রতিবাদপত্র তুলে ধরে বাংলাদেশবিরােধী প্রচারণা বন্ধের দাবি জানান। একটিমাত্র ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয় ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালিদের দেশের প্রতি মমত্ববােধ, স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকার এবং স্বীধনতাবিরােধীদের প্রতি সতর্ক ও সচেতন দৃষ্টি।  ২০শে জুলাই বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি ইন গ্রেট ব্রিটেন লন্ডনে অনুষ্ঠিত আমেরিকান বার এসােসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে দি গার্ডিয়ান পত্রিকার অর্ধ পৃষ্ঠাব্যাপী

একটি খােলা চিঠি বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করে। খােলা চিঠি’তে পাকিস্তান। সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশ করা হয়। এসােসিয়েশনের সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয় বাঙালিদের দুঃখ-দুর্দশা, নির্যাতন এবং গণহত্যা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে তারা এমনভাবে অবহিত করেন যেন এই নৃশংস পাশবিকতার অবসান ঘটাতে পারেন।
| এই খােলা চিঠিতে বার সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবেদন জানানাে হয় ‘জেনােসাইড কনভেনশন’-এর ধারাগুলাে। ‘স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির ছাত্রছাত্রী বার সমিতির সদস্যদের পাচ দফা দাবি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে তাদের প্রতি আবেদন জানান। ছাত্রদের পাঁচ-দফা দাবির মধ্যে: ১. পাকিস্তানে অবিলম্বে মার্কিন সামরিক সাহায্য বন্ধ; ২. বাংলাদেশে থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার; ৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি; ৪. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান; এবং ৫, পাকিস্তান কর্তৃক জেনােসাইড কনভেনশন ভঙ্গ ও বিশ্বশান্তি বিপন্ন করার জন্য সমগ্র বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন। | এই পাঁচ-দফা দাবি বিশ্লেষণ করলে সহজেই প্রতীয়মান হবে, প্রবাসী ছাত্র, রাজনীতিক, কূটনীতিক, ব্যবসায়িক, আইনজীবী, চিকিৎসক, শ্রমিক-মালিক-ব্যবসায়ী সকলেই স্ব স্ব অবস্থান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সর্বত্রই একটি বার্তাই পৌছে দিয়েছেন বাঙালি জাতি স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ ও আপােষহীন, নেতৃত্বের প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা এবং বিশ্ব শান্তি ও মানবতার প্রতি প্রত্যয়বদ্ধ অঙ্গীকার। ১লা আগস্ট লন্ডনে পল্ কনেটের নেতৃত্বে অনুমিত জনসভায় প্রায় বিশ হাজার প্রবাসী বাঙালি যােগ দেন। ট্রাফালগার স্কয়ারে অনুষ্ঠিত এ সভা ছিল ঐতিহাসিক। গণহত্যা বন্ধ, বাংলাদেশের স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবিকে মুহুর্মুহু জয়বাংলা স্লোগানের মধ্যে বক্তারা উদ্দীপক ভাষণ দেন।  ১১ই সেপ্টেম্বর গ্রেটার লন্ডনস্থ সাউথলে স্থানীয় বাঙালিদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় ‘সাউথল বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের ১১ সদস্যবিশিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটি ও ২২ জন সাধারণ সদস্য নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। 
৩০শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গ্রেট ব্রিটেন’ এক দীর্ঘ বুলেটিন প্রচার করে। বুলেটিনে বাংলাদেশের স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করা হয়। | ১-১০ সেপ্টেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের বার্ষিক সভায় লন্ডনে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির একটা প্রতিনিধিদল গমন করেন।” প্রতিনিধিদলটি বিভিন্ন দেশ থেকে আগত জনপ্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশে পাকিস্তানিগণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণ কয়েকটি মুসলিম দেশ বিশেষ করে মিশর ও জর্ডানের প্রতিনিধিদেরকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যৌক্তিকতা ব্যাখ্যায় সফল হন। উক্ত দেশ দুটির পাকিস্তানের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। এভাবে লন্ডনের বাঙালি ছাত্র- জনতা ইউরােপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করেন। তাদের প্রচেষ্টায় এসব দেশের অনেক পত্র-পত্রিকা, বিভিন্ন পেশার মানুষ ও সাধারণ অথচ সচেতন জনগােষ্ঠী বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ব্রিটেনে অবস্থানকারী বাঙালি ডাক্তার ও মেডিকেল ছাত্ররাও অ্যাকশন কমিটিতে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। বাঙালি ডাক্তারদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি এবং তাদেরকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার পেছনে ছিল কয়েকজন ডাক্তারের বিশেষ অবদান। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. নুরুল আলম ও ডাক্তার সাইদুর রহমান প্রমুখ। এরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে সংগঠিত করেন বিভিন্ন স্থানের চিকিৎসক এবং মেডিকেল ছাত্রদের। তাদের ব্যানারে অর্থ সংগ্রহ করেন। সেই সাথে ব্রিটেনের বিভিন্ন ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এবং সাহায্যকারী সংস্থার কাছ থেকেও ঔষধ ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেন, তা প্রেরণ করেন রণাঙ্গনে।  ৭ই অক্টোবর ১৯৭১ সালে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পুত্র রাশেদ সােহরাওয়ার্দী লন্ডনে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেন। ইতােপূর্বে পাকিস্তান সরকারের প্রচারের অংশ হিসেবে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কন্যা আখতার সােলায়মানকে দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক বিবৃতি প্রদান করে। রাশেদ সােহরওয়ার্দী তার বক্তব্যে এ বিবৃতিতে তাঁর পিতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার প্রচেষ্টা বলে আখ্যায়িত করেন। রাশেদ সােহরাওয়ার্দীর এই বিবৃতি বাংলাদেশ মিশনের প্রেস এবং পাবলিসিটি ডিভিশন থেকেও প্রচার করা হয়। 
১৯৭১ সালের ২৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ লন্ডনের হেনরি থরানাটন স্কুল মিলনায়তনে একটি জাতীয় ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠানের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সম্মেলনে ৯টি প্রস্তাব গৃহীত হয় : ১. বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্র সম্মেলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণাকে পুনরায় স্বাগত জানায় এবং মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত যে-কোনো ত্যাগ স্বীকারের অঙ্গীকার করে; ২. সম্মেলন বিশ্ব জনমতকে জানিয়ে দিতে চায় যে, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনাে রাজনৈতিক সমাধান বাঙালিরা মেনে নেবে না; ৩, সম্মেলন পাকিস্তান জান্তার হাতে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজবন্দিদের মুক্তি দাবি এবং তাদের উপর যাতে কোনাে নির্যাতন না হয় তার নিশ্চয়তাদানের জন্য জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সরকারের কাছে আবেদন জানায়; ৪. সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানায়; ৫. ছাত্র সম্মেলন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত জনগণের সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের জন্য অভিনন্দন জানায় এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সংগ্রামী ঐক্য কামনা করে; ৬. লন্ডনে অনুষ্ঠিত ছাত্র সম্মেলন বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের রক্তিম অভিবাদন জানায় এবং তাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে একাত্মতা ঘােষণা করে; ৭. সম্মেলনে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের ভারতে আশ্রয়দান এবং সাহায্য প্রদানের জন্য ভারতের জনগণ ও সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে; ৮, সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধীদের দেশের অভ্যন্তরে এবং প্রবাসে হুশিয়ার করে দেওয়া হয় এবং তাদের যে কোনাে ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার আহ্বান জানানাে হয়; এবং ৯. ব্রিটেনে বাঙালি ছাত্রদের বিভিন্ন সাহায্য প্রদান এবং বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে প্রবাসী বাঙালিদের প্রতি সহযােগিতার জন্য সম্মেলন বিলাতের জনগণ ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।  ৩০শে অক্টোবর বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির স্টিয়ারিং কমিটি হাইডপার্কে এক জনসমাবেশ ও গণ মিছিলের আয়ােজন করে। মিছিলটি ক্লারিজেস হােটেলে যায় এবং এক প্রতিনিধিদল ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎ করলে তিনি বলেন, “শীঘ্র বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হবে।” ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্যদানের জন্য কিছুসংখ্যক চীনপন্থি বাঙালি ভারতের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা প্রচারে আত্মনিয়ােগ করে। চীনের বাংলাদেশবিরােধী নীতির সমর্থকরা দাবি করে, মুজিবনগর সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন দূরভিসন্ধিমূলক। বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশ করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। ভারতবিরােধী প্রচারে চীনপন্থিরা মওলানা ভাসানীর নাম ব্যবহার করে। ভারতে ও বিদেশে প্রচারিত বিবৃতিতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ব্যাহত করার জন্য ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দি অবস্থায় দিনযাপন করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু মওলানা ভাসানী এই মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। ১২ই নভেম্বর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নিকট লিখিত এক পত্রে তিনি গৃহবন্দি থাকার সংবাদ দূরভিসন্ধিমূলক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যখন খুশি এবং যে-কোনাে জায়গায় যাওয়ার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি ভােগ করছেন। বিলেতে প্রবাসী বাঙালিরা ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিকে লন্ডনস্থ বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আবেদন জানান। ৬ই ডিসেম্বর ভারত সরকার। কর্তৃক স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উক্ত স্বীকৃতি ঘােষণায় পাকিস্তান ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এই ঘােষণার ফলে এতদিনের অঘােষিত শক্রতা প্রকাশ্য যুদ্ধের রূপ লাভ করে। ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। প্রবাসী বাঙালিরা প্রতিদিন রণাঙ্গনের অগ্রগতি পত্র-পত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রেখে বিলাতে বিভিন্ন প্রচার কার্য অব্যাহত রাখে।
এদিকে বিশ্বজনমতকে আকর্ষণ করার জন্য বিলেতের সংগ্রাম পরিষদসমূহের কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটি ১২ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে হাইড পার্ক স্পিকার্স কর্নারে এক সমাবেশ ও মিছিলের আয়ােজন করে। উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি গাউস খান। ৭. ব্রিটেনে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে প্রবাসী বাঙালিদের আন্দোলন। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ঘােষণা করে অবিলম্বে তার শাস্তিদানের সংকল্প ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্টে আটক রাখা হয়।

লন্ডনে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্রিটিশ পত্রিকায় বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার শুরু হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে যে ব্যাপক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া শুরু হয় যে সম্পর্কে ভিন্ন অধ্যায়ে আলােচনার অনিবার্যতা বিদ্যমান। এ সংবাদে উদ্বিগ্ন বিচারপতি চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী শােন্ ম্যাকব্রাইডকে ইসলামাবাদে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। লন্ডনের বার্নাড শেরিডান সলিসিটার্স নামের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একজন অভিজ্ঞ সলিসিটারও তার সঙ্গে যান। ইয়াহিয়া খানের আইনবিষয়ক উপদেষ্টা কনেলিয়াস আইনজীবী শােন্ ম্যাকব্রাইডকে বলেন, কোনাে বিদেশি আইনজীবীকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ অথবা তার পক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হবে না। ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রুদ্ধদ্বার কক্ষে শেখ মুজিবের বিচার এবং তার পক্ষ সমর্থন করার জন্য একজন পাকিস্তানি আইনজীবী নিয়ােগ করা হবে। আইনি সহায়তায় বাধাদান লন্ডনে বিরূপ। প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। | সামরিক আদালতে গােপনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি এবং তার প্রতিবাদ করার জন্য ১১ই আগস্ট হাইডপার্ক স্পিকার্স কর্ণারে এক গণসমাবেশে ব্রিটিশ সরকারকে শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরােধ জানানাে হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আইজুল হক মিয়া এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সমাবেশে বক্তৃতা রাখেন ব্রিটিশ এম, পি, পিটার শশার, মাইকেল বার্নস, ফ্রস ডগলাস-ম্যান, জন স্টোনহাউজ, রেজ প্রেন্টিস ও লগ।
গিফোর্ড ও বাংলাদেশের সমর্থক ব্রিটিশ নাগরিকবৃন্দ। এছাড়াও বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন গাউস খান, শেখ আবদুল মান্নান, ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন এবং লুলু বিলকিস বানু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সমাবেশ শেষে বিচারপতি চৌধুরী ও ব্রিটিশ এমপিদের নেতৃত্বে একটি মিছিল ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে গমন করে এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে গােপন বিচার বন্ধ ও তার মুক্তির দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ইংল্যান্ডের লুটন শহরে একটি বিশাল র্যালি অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। মুক্তির দাবিতে। এই শহরে এর আগে এত বড় মিছিল হয়নি। | বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা ও বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ। মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানে গোপন বিচারের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকায় একটি বড় ধরনের বিজ্ঞাপন প্রদানের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বিজ্ঞাপন প্রদানের উদ্দেশ্যে। আর্থিক সহযােগিতার জন্য বিলাতের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদসমূহের কাছে আহ্বান জানিয়ে। পত্র দেন। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৬৩টি কমিটি সহযােগিতা করতে সম্মতি জানায়। ৬৩টি কমিটির নামসহ ১৬ই আগস্টের ‘দি টাইমস পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে যে শিরােনাম শােভা পায় তা হলাে- “Wake up world – please act immediately to stop camera trial-secure release of the President of the Peoples Republic of Bangladesh.” বিজ্ঞাপনে সংক্ষেপে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি এবং ২৫শে মার্চ থেকে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের একটি বিবরণ প্রদান করা হয়। বিজ্ঞাপনে শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচারের প্রচেষ্টাকে ন্যাক্কারজনক, দূরভিসন্ধিমূলক আখ্যায়িত করে এই বিচার বাংলাদেশের সকল জনগণের বিরুদ্ধে বিচার অনুষ্ঠানের শামিল বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, “Can the world really afford to watch such an outrageous act of vengeance?” Frealeta RTC4C*121 নির্যাতিত স্বাধীনতাকামী জনগণের পক্ষে ব্রিটিশ সরকার, জাতিসংঘ ও বিশ্বের জনগণের নিকট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা ও তার মুক্তি দাবি করা হয়। বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে মার্কিন, সােভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ভারত, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক তৎপরতা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও শেখ মুজিবের মুক্তি সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। ৮, পাকিস্তানের বাঙালি কূটনীতিকদের মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ মুক্তিযুদ্ধকালে বিশ্বজোড়া যেসব বাঙালি কূটনীতিবিদ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য গ্রহণ করেন তাঁদের একটি তালিকা পরিশিষ্ট ৩.খ-এ দেওয়া হয়েছে। উক্ত তালিকানুযায়ী পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগকারী প্রথম কূটনীতিক, দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত দ্বিতীয় সচিব কে,এম, শেহাবুদ্দিন ও সহকারী প্রেস এটাচি আমজাদুল হক। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের (১৭,৪,৭১) পরদিন কলকাতাস্থ পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশন অফিসে কর্মরত ডেপুটি হাই কমিশনার এম, হােসেন আলী ও অন্যান্য ৫জন কূটনীতিক, ১৮ই এপ্রিল পাকিস্তান। সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। ভারতের বাইরে প্রথম বাঙালি কূটনীতিক, নিউইয়র্কের ভাইস কনসাল এ.এইচ. মাহমুদ আলী পাকিস্তান কনস্যুলেট ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য ঘােষণা করেন। এরপর থেকে ক্রমাগতভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকগণ। বাংলাদেশের আনুগত্য ঘােষণা করতে থাকেন। ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত আবদুর রাজ্জাক খান ১৭ই মে এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত ৩০ জুন ঘােষণা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। অবশ্য ২৬শে মার্চ থেকেই তারা গােপনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছিলেন।
৫ই জুলাই মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিবিদগণকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুগত্য ঘােষণার আহ্বান জানান এবং তাদের চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করেন। এই অহ্বানে সাড়া দেন ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে কর্মরত প্রায় সকল কূটনীতিবিদ (পরিশিষ্ট ৩.খ দ্রষ্টব্য)। পলকানেটের নেতৃত্বাধীন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশের উদ্যোগে ১লা আগস্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারের সভায় পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। ১১ই আগস্ট লন্ডনের হাইড পার্কের এক জনসভায় পররাষ্ট্র দপ্তরের লুৎফুল মতিন ও ফজলুল হক চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করেন। এটা ছিল ব্রিটেনের বাঙালিদের বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। এ সভা থেকে একটি বিরাট শােভাযাত্রা ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে গমন করে এবং রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার দাবি সম্বলিত একটা স্মারকলিপি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। বরাবর পেশ করা হয়। লন্ডনের টাইমসসহ বেশ কিছু পত্রিকায় এ খবর পরদিন ফলাও করে প্রকাশিত হয়। এতে বাঙালিদের আন্দোলনের প্রতি ব্রিটেনের জনগণেরও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়। মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় আগস্ট মাসে ইরাকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ এবং সেপ্টেম্বরে আর্জেন্টিনায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবুল মােমেন বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র বিভাগে যােগ দেন। ২৭শে আগস্ট লন্ডনের বেজওয়াটার এলাকায় ২৪ নং পেমব্রিজ গার্ডেনের ওয়েস্ট এন্ডে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে বাংলাদেশ দূতাবাসে স্থাপন করা হয়। ভারতের বাইরে লন্ডনেই প্রথম বাংলাদেশ মিশন স্থাপিত হয়। ১১ নং গােরিং স্ট্রিট থেকে সাংগঠনিক কর্মকান্ড এবং পেমব্রিজ গার্ডেনে কূটনৈতিক ও সরকারি কার্যক্রম চলতে থাকে। অফিস দুটো হলেও রাজনৈতিক, সাগঠনিক ও সরকারি কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় করা হতাে।
৭ই অক্টোবর লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের কাউন্সিলর বাঙালি কূটনীতিবিদ রেজাউল করিম পাকিস্তান সরকারের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তিনি এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক সরকার ও জনগণকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সমর্থনের আবেদন জানান। এভাবে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার প্রত্যয় ঘােষণা করেন এবং লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনে যােগদান করেন। | ৭ই নভেম্বর স্টিয়ারিং কমিটি প্রকাশিত বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা ১২ই নভেম্বর পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাঙালি কূটনীতিবিদদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অংশগ্রহণের খবর পরিবেশ করে। জেনেভা পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি দ্বিতীয় সচিব ওয়ালিউর রহমান পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সুইজারল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। এছাড়া নেপালের পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মুস্তাফিজুর রহমান, কায়রাের হেড অফ চেরি ফজলুল করিম, টোকিও দূতাবাসের প্রেস এটাচি এস.এম, মাসউদ এবং টোকিও দূতাবাসের তৃতীয় সচিব আব্দুর রহিম পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যােগদান করে। এ সকল সম্পর্কচ্ছেদের ঘটনা বিলম্বে হলেও গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। মূলত ৪টি বিষয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে: এক. বাঙালি জাতির ঐক্য অভিন্ন; দুই. মুক্তিযােদ্ধাদের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধকরণ; তিন, স্বাধীন বাংলাদেশের বিশ্ব পরিসরে আত্মপ্রকাশের বার্তা; এবং চার, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যত কূটনৈতিক তৎপরতার সাফল্য।” ৯. যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা প্রায় পাঁচ হাজার বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসীরা ২৫শে নভেম্বর, ১৯৭০ ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাস কবলিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবহেলার প্রতিবাদ জানিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট একটি লিখিত চিঠি প্রেরণ করেন। তখনই গঠিত হয় আমেরিকান পাকিস্তান লীগ। এই সংগঠন গঠিত হবার পর প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু হয়। লিখিত পত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য এবং পাকিস্তানের শাসক-চক্রের চরম অবহেলার কথা উল্লেখ করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করা হয়।
| ২৬শে মার্চের পূর্ব থেকে প্রবাসী ছাত্ররা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত না ঘটিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক সরকারের উপর কার্যকর প্রভাব বিস্তারের আবেদন জানিয়ে এসব তারবার্তা প্রেরিত হয়। যাদের বরাবরে তারবার্তা পাঠানাে হয় তাঁদের মধ্যে ছিলেন। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ইউ থান্ট, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, মার্কিন সিনেটর এবং বৃহৎ দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিশ্ববরেণ্য নেতৃবৃন্দ উল্লেখ্য। ২৫শে মার্চের পর পরই এক ঘন্টার নােটিশে ছাত্ররা এক সভায় মিলিত হন। সেই থেকেই স্বাধীনতার পক্ষে তাদের কার্যক্রম শুরু। উদ্যোক্তরা প্রত্যেকে নূ্যন একশত ডলার চাঁদা প্রদানের প্রস্তাব গ্রহণ করলে তাৎক্ষণিকভাবে ৩ হাজার ডলার সংগৃহীত হয়। | ২৫শে মার্চের ঘটনার পর নানামুখি তৎপরতা শুরু হয়। প্রবাসী বাঙালিদের মূল। কার্যক্রমের টার্গেট ছিল মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি অবস্থানের বিরােধীতা। প্রচার চালানাে হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনীয়। ‘ইস্ট পাকিস্তান লীগ’ নামক একটি সংগঠন কর্তৃক ৫ এপ্রিলে বিলি করা এক প্রচারপত্রে বলা হয় যে, গৃহযুদ্ধ নয়, মার্কিনীদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র তুলনা চলে। এই সংগঠন তাদের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ লীগ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। সব সরকার ও রাষ্ট্রকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানকে সাহায্য না করার জন্য অনুরােধ জানায়। কাজী এস,আহমেদ এর সভাপতি হন। মুজিবনগর সরকারের সাথেও এরা যােগাযোেগ স্থাপন করে। ২৭শে মার্চ বিকালে ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রবাসী বাঙালিদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের গুরুত্বপূ কূটনীতিক এ.এম,এ. মুহিতের বাড়িতে। সে সভায় ঢাকায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ধ্বংসলীলা সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, পূর্বাংশে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। সুতরাং পাকিস্তান নিয়ে কারাে মাথাব্যথার প্রয়ােজন নেই। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে কত দ্রুত বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত করা যায় সেটাই একমাত্র কাজ। সেই সভায় আমেরিকা প্রবাসী বাঙালিদের তাৎক্ষণিক করণীয় হিসেবে বলা হয়: ১. আমেরিকার নেতৃত্ব, জনগণ ও বিশ্ববাসীর সমর্থন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নিয়ে আসা। বাংলার মাটিতে সংঘটিত ঘটনাবলির সঠিক তথ্য তাদের কাছে পৌছে দেওয়া; ২. বাংলার মাটি থেকে সৈন্যদের উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করা; ৩. দুর্গত বাঙালিদের জন্য ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ ও প্রেরণ; এবং ৪, পাকিস্তানকে বিশ্বের যে কোনাে ফোরামেই হােক অপদস্থ করে তােলা।
এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য মার্কিন এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নিকট কতগুলি বার্তা। প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তাছাড়া মার্কিন কংগ্রেস ভবনের সিড়িতে, বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অফিসের সামনে অবস্থান এবং বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ২৯শে মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে পালিত এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে শামসুল বারী উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। র্যালির জন্য পুলিশের অনুমতি সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত বাঙালিদের ফোনে আমন্ত্রণ জানানাে এবং রাত্রিযাপনের স্থান নির্ধারণ ইত্যাদি সকল দায়িত্ব তিনি পালন করেন। মাহবুব আলী নামে আরাে একজন বাঙালিও এসব কাজে অত্যন্ত উদ্যোগী ছিলেন। উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ওয়াশিংটনে আসা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এনায়েত রহিম। পােস্টার, ফেস্টুন লেখা, স্লোগান তৈরি করা ইত্যাদি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সম্পাদন করেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং হারুন রশীদের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন দফতরে প্রেরণের জন্য স্মারকলিপি তৈরি করা। উল্লেখ্য যে, নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন গিয়ে এসব কাজে সহায়তা করেছেন এস,এ করিম। ২৮শে মার্চ তৈরি অনেকগুলি স্মারকলিপি বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকে তারবার্তা করে বিশ্বনেতৃবৃন্দের কাছে পাঠানাে হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, বিদেশ সচিব উইলিয়াম রজার্স, নিরাপত্তা সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার, মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর ফুব্রাইট প্রমুখ। তারবার্তা প্রেরণ করা হয় জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেল ইউ থান্ট এবং নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকেও। সমাবেশস্থলে সেদিন উপস্থিত হন অনেকগুলাে পত্রিকা, রেডিও এবং টেলিভিশনের প্রতিনিধি। সমাবেশের কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য নির্ধারিত মুখপাত্রের মতাে কাজ করেন শামসুল বারী ও এনায়েত রহিম। বাঙালিদের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে সহানুভূতি সৃষ্টিতে এই র্যালি ব্যাপক সফলতা লাভ করে। র্যালিটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসভবন, বিশ্বব্যাংক সদর দফতর ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অফিস প্রদক্ষিণ করে। সবশেষে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে আবেদন পেশ করে। 
মার্চ মাসে বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ’ গঠিত হয় শিকাগাে শহরে। এই সংগঠন গড়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়: ১. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে মার্কিন জনগণকে সম্যক ধারণা দেওয়া। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাঙালিদের জীবন-মরণ লড়াইয়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মার্কিনীদের সহায়তা আদায় করা; ২. পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যা এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ, তা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে প্রচার করা। এ কাজের জন্য একটি তহবিল গঠন ও পরিচালনাও ছিল অন্যতম লক্ষ্য; ৩. পাকিস্তান বিষয়ে মার্কিন সরকারের অনুসৃত নীতি পরিবর্তন করানাের জন্য নিক্সন সরকার এবং মার্কিন কংগ্রেসের কাছে লবি করাটাও ছিল লীগ গঠনের বিশেষ উদ্দেশ্য; ৪, বহু যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালির আত্মীয়-স্বজন পাকসেনাদের হাতে প্রাণ দিচ্ছেন। এই আত্মীয়-স্বজনের পাশে দাঁড়ানাে, প্রয়ােজনীয় সহায়তা দান করা ইত্যাদি ছিল লীগ গঠনের অন্যতম লক্ষ্য। এপ্রিল মাসে মার্কিন জনগণ এবং নেতৃবৃন্দের প্রতি ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা, নিউইয়ক আর একটি আবেদন জানায়। লীগ সভাপতি কাজী শামসুদ্দিন আহমেদ প্রেরিত এই আবেদনে যে বিষয়গুলির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় তা হলাে: প্রথমত, পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বুটের তলায় পিষে হত্যা করছে গণতন্ত্রকে, সামরিকবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশে মানুষকে নির্বিচার হত্যা ও নারী নির্যাতন করছে দেশব্যাপী। হত্যা করছে শিক্ষক, ছাত্র ও শিশু। সুতরাং এই ‘খুনি’ পাকিস্তান সরকারকে সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানাে হয়; দ্বিতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানের অগণিত মানুষ বাস্তুত্যাগী। বাড়িঘর হারিয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে বসবাস করছেন; তৃতীয়ত, সমগ্র বাংলাদেশই বধ্যভূমি। বিশ্ববাসী যাতে এই নির্যাতনের সংবাদ অবগত হতে না পারে তার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদের আগেই দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কোনাে সাহায্য সংস্থাকেও সেখানে ত্রাণকার্য পরিচালনা করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এককথায় বিশ্ব থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। এ অবস্থায় দুর্গত মানুষের সেবা ও তাদের মধ্যে ত্রাণকার্য পরিচালনা করার জন্য বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলিকে যেন বাংলাদেশে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয় তার জন্য পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ প্রয়ােগ করার দাবি জানানাে হয়; চতুর্থত, বাংলাদেশে একটি জাতিসংঘ মিশন প্রেরণ এবং এর মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে অবহিত হওয়ারও আবেদন অন্তর্ভুক্ত ছিল; এবং সর্বোপরি, বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন জানানাে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা অসংখ্য বাঙালি সংগঠন বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর তাণ্ডব, মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ইত্যাদি সংবাদ সংগ্রহ করে প্রবাসী বাঙালি, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগঠন, জনগণ এবং প্রচারমাধ্যমকে গােচরীভূত করতে থাকে। ২৬শে এপ্রিল ইস্ট পাকিস্তান লীগের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সকল বাঙালির উদ্দেশ্যে একটি সার্কুলার বিলি করা হয়।
প্রচারিত একই সার্কুলারে প্রথমে প্রবাসীদের অবহিত করা হয় যে, মুজিবনগরস্থ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে ইস্ট পাকিস্তান লীগের যােগাযােগ হয়েছে। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ লীগের করণীয় সম্পর্কে কিছু দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহ; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও হাজারাে গ্রামের অগ্নিদগ্ধ বাড়ি-ঘর ইত্যাদির খতিয়ান তুলে ধরা হয়। এই অসহায় মানুষকে বাঁচাতে হবে’। মানবতার এই আহ্বানকে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা, সেবামূলক সংগঠন, দানশীল প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, ব্যক্তি, গির্জা সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। প্রকৃত অবস্থা অবহিত করে তাদের নিকট থেকে আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হওয়ার উদাত্ত আহ্বানও ছিল। সমস্ত সাহায্য বাংলাদেশ তহবিলের নামে সংগৃহীত হবে। বাংলাদেশ সরকারের কলকাতা মিশনের ঠিকানাও দেওয়া হয় পত্রে।
২৭শে এপ্রিল একটি দীর্ঘ আবেদন পাঠানাে হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কংগ্রেস সদস্যের প্রতি। বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, ওয়াশিংটন’-এর পক্ষ থেকে সংগঠনের সভাপতি স্বাক্ষরিত এক আবেদনে কংগ্রেস সদস্যদের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়ে নিম্নোক্ত বিষয়গুলাে নিয়ে নিক্সন সরকারকে যেন বাধ্য করেন। বিষয়গুলাে হলাে; ১. বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক সমর্থন দিতে; ২. পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা বন্ধ না হওয়া এবং বাংলার জনগণ যতােদিন মুক্ত না হয় ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ রাখতে তৎপরতা চালনাে; ৩. জাতিসংঘ, বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা এবং অন্যান্য দেশের সাথে সহযােগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশে খাদ্য, কাপড় ও ঔষধসামগ্রী প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং একইভাবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙালিদের সহায়তা দান; ৪. পাকিস্তান সরকার যাতে বাংলাদেশে অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ করে তার জন্য পাকিস্তান সরকারের ওপর কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং চাপ প্রয়ােগ।  ৩রা মে, ‘বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা ইন নিউইয়র্ক প্রকাশ করে আরাে একটি প্রচারপত্র। সংগঠনের সভাপতি কাজী শামসুদ্দিন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সকল বাঙালির প্রতি বক্তব্য তুলে ধরেন এই প্রচারপত্রের মাধ্যমে। ঠিক এর আগের দিন নিউইয়র্কের ১৪৫ ব্লিকার স্ট্রিটে বাংলাদেশ লীগের এক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য পেশ করেন মাহবুব হােসেন যিনি সম্প্রতি কলকাতা থেকে ঘুরে এসেছেন। এ সভাতেই জানানাে হয় যে, নিউইয়র্কে নিযুক্ত পাকিস্তানি ভাইস কনসাল এ.এইচ মাহমুদ আলীকে বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। মাহমুদ আলীও মিশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন।
পরের দিন এসব বক্তব্যকে একটি ফ্লায়ার হিসেবে ছেপে বিতরণ করা হয় বাঙালি কমিউনিটিতে। একই দিনে লীগের কার্যালয় থেকে আরও একটি প্রচারপত্র প্রকাশিত হয় লীগের সম্পাদক ফয়জুর রহমানের নামে। লীগের সাধারণ সভা অনুষ্ঠান সংক্রান্ত প্রচারপত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বলা হয়, উক্ত সংগঠনের সাধারণ সভার একটি প্রস্তাবে এর নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা ইন নিউইয়র্ক করা হয়েছে। তবে সিদ্ধান্ত হয় ব্যাংক হিসাব, নথিপত্র ইত্যাদি আইনগতভাবে পরিবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত পূর্বের। নামই ব্যবহার করা হবে। মে মাসেই গ্লেন ডেইল ক্যালিফোর্নিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের প্রতি একটি আবেদন জানায়। ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’ শিরােনামে প্রচারিত এই আবেদনে বলা হয়, “মার্কিন সরকার প্রদত্ত অস্ত্র দ্বারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কসাইরা বাংলাদেশে দু’লাখ নিরস্ত্র লােককে হত্যা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাংক দ্বারা ধ্বংস করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । এই বর্বররা পুড়িয়ে দিয়েছে বাংলার গ্রামের পর গ্রাম। বােমা মেরে ধ্বংস করে দিয়েছে। শহর বন্দর নগর।’ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পাশবিক তাণ্ডবলীলার বর্ণনা শেষে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে আকুল আবেদন জানানাে হয় যেন তারা: ১. বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন; ২. পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসককে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা দানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হন; ৩. বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করেন। এই আবেদনপত্রের শেষ বাক্য ছিল “আপনার সামান্য। সাহায্যই একজন দুর্গতকে বাঁচাতে পারে।”৯৯ এসব আবেদন-নিবেদনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয় ইতিবাচক। যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে যেসব বাঙালি বসবাস করছিলেন তারা সবাই সক্রিয় হয়ে বিভিন্ন স্থানে সংগঠিতভাবে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও সহায়তা করেন অর্থ, বস্ত্র, ঔষধপত্র এবং প্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে। 
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অগ্রগতি, বিশ্ববাসীর ভূমিকা এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিবরণ প্রবাসী বাঙালিদের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নগর থেকে পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। টেক্সাস রাজ্যের কলেজ স্টেশন থেকে প্রকাশিত একটি বাংলা পত্রিকার নাম বাংলাদেশ পত্র। ১৪ই মে এর যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতার ডাক’ শিরােনাম দিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক দেশব্যাপী পরিচালিত তাণ্ডবলীলার এক নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠেছিল পাঠকের চোখে। বাঙালির বিজয় অবশ্যম্ভাবী বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে শেষ করা হয় দীর্ঘ প্রতিবেদন। ১৪ই মে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সংগ্রামী ছাত্র সংস্থা’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ২৫শে মার্চের পর থেকে মধ্য মে পর্যন্ত পরিচালিত কার্যক্রমের মধ্যে ১. জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেল, শতাধিক মার্কিন সিনেটর এবং বৃহৎ দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকার প্রধানদের নিকট কয়েক দফায় তারবার্তা প্রেরণ উল্লেখযােগ্য; ২. বাংলাদেশের দুর্গত মানুষের সাহায্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন শহরের মার্কিন নাগরিকদের নিকট থেকে ১ হাজার ৫ শত আবেদনপত্র সংগ্রহ করে ১১ জন প্রভাবশালী সিনেটরের বরাবরে পাঠানাে; ৩, বাংলাদেশ প্রত্যাগত শিক্ষকদের সহায়তায় বাংলাদেশের। প্রকৃত চিত্র টেক্সাস এ,এন্ড,এম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অবহিত করা হয়। দল বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের ছাত্রদের জন্য সাহায্যের আশ্বাস আদায় করা হয়; ৪, মার্কিন টিভি, রেডিও এবং সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার। প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা; ৫, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন এবং পাকিস্তানে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন লকের সাথে সাক্ষাৎ করে উদ্বেগ প্রকাশ; ৬, হার্ভার্ডের প্রখ্যাত তিনজন অর্থনীতিবিদদের লেখা Conflict in East Pakistan: Background and Prospect পুস্তকখানি বিভিন্ন শহরে প্রচার করা : ৭. ছাত্র সিনেটে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক মার্কিন সরবরাহকৃত। অস্ত্র ব্যবহারে নিন্দা করার ব্যবস্থা গ্রহণ।
| বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা ইন নিউইয়র্ককে কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে গ্রহণ করা এবং কলেজ স্টেশনকে একটি উপকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা হয়। সে উপকেন্দ্র থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নয়টি রাজ্যে যােগাযােগ এবং কার্যকর কর্মসূচি পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়। রাজ্যগুলি ছিল টেক্সাস, নিউমেক্সিকো, লুইজিয়ানা, ওকলাহােমা, আলবামা, জর্জিয়া, আরাকানসাস, মিসিসিপি ও ফ্লোরিডা। ঐ সব রাজ্যে বসবাসরত বাঙালি ছাত্র বা চাকুরিজীবীদের কলেজ স্টেশন কিংবা সরাসরি নিউইয়র্কস্থ কেন্দ্রীয় সংস্থার সাথে যােগাযােগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার উদ্যোগে আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রসঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকদের কাছে চিঠি লেখা হয় যেন ঐ প্রহসনের বিচার কাজ বাতিল করে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

১০, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন স্থলে কূটনৈতিক তৎপরতা: সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরিত হয়। ১৬ সদস্যবিশিষ্ট এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। অন্য সদস্যরা হলেনআবদুস সামাদ আজাদ (এম.এন.এ), এম.আর. সিদ্দিকী (এম.এন.এ), সৈয়দ আবদুস সুলতান (এম,এন,এ), ড. মফিজ চৌধুরী (এম.এন.এ), সিরাজুল হক (এম.এন.এ), ড. আসহাবুল হক (এম.পি.এ), ফণীভূষণ মজুমদার (এম.পি.এ), ফকির শাহাবুদ্দিন (এম.পি.এ), অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ (ন্যাপ নেতা), ড. আজিজুর রহমান মল্লিক (ভাইস চ্যান্সেলর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), অধ্যাপক রেহমান সােবহান, রাষ্ট্রদূত এ.এফ.এম. আবুল ফতেহ, রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী এবং কূটনীতিক সৈয়দ আনােয়ারুল করিম। ওয়াশিংটনে অবস্থানরত এ.এম.এ. মুহিত ও এ.এইচ, মাহমুদ আলী এই দলকে সার্বিক সহযােগিতা প্রদান করেন। প্রতিনিধিদলটি প্রতিদিন জাতিসংঘ ভবনে গিয়ে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি, ভারতের সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় বিশদভাবে তুলে ধরতেন। ১৬ জনের দলটিকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে কয়েকটি ছােটো ছােটো দল তৈরি করা হয়। আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত হয়ে তারা যেতেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে।
আবু সাঈদ চৌধুরী, সৈয়দ আবদুস সুলতান এম.এন.এ. এবং কূটনীতিক এ.এইচ. মাহমুদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত গ্রুপটি যেতেন জাতিসংঘ ভবনে। এছাড়াও বিভিন্ন টেলিভিশন এবং পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। সহযােগিতা নিয়েছেন। জাতিসংঘের ভারতীয় কূটনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। এভাবে তারা সারা দুনিয়ার সামনে পাকিস্তানিদের নৃশংস অত্যাচারের কাহিনি তুলে ধরতে সমর্থ হন। মার্কিন সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী লােকজনের সাথে প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন। অনেক মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করেন। বিচারপতি চৌধুরী সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কারণ ব্যাখ্যা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রােকেয়া হলে পাকিস্তান।

বাহিনী কর্তৃক নারী নির্যাতনের সংবাদ দেখান, তা পড়ে সৌদি রাষ্ট্রদূত দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, তিন দিন পর সৌদি বাদশাহ্ ফয়সাল যুক্তরাষ্ট্র আসবেন এবং তখন তিনি তাঁকে তা জানাবেন। এছাড়াও ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের সাথে বিচারপতি চৌধুরী দেখা করেন এবং ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে অধ্যয়নরত বাঙালি ছাত্রদের বৃত্তির অর্থ উত্তোলনের সুরাহা করেন।০৩। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়। কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক যাদের মধ্যে- এম, সিদ্দিকী, এম, ইউনুস, এফ, ফয়সাল, ডব্লিউ গ্রিননা, ডি, নেলিন, এ, টেইনার প্রমুখের কাজ উল্লেখ্যযােগ্য। ১১. যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বাঙালি প্রবাসীদের ভূমিকা ১১.১ কানাডায় বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই কানাডার রাজধানী অটোয়া নগরীতে বাংলাদেশ এসােসিয়েশন গড়ে ওঠে।
এসােসিয়েশনের কতগুলাে সাধারণ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলাে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য যথাসাধ্য সহায়তা করা, শেখ মুজিবের মুক্তি, বাস্তুহারা দুর্গতদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা, জনমত সৃষ্টি ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পক্ষে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক লবি চালিয়ে যাওয়া। তহবিল সংগ্রহের প্রথম উদ্যোগ হিসেবে প্রত্যেক বাঙালি নিজের আয়ের শতকরা ৫ ভাগ। হিসেবে প্রতি মাসে জমা দেবেন। অনেক কানাডিয়ানও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্থ সাহায্য দিয়েছেন। সেই অর্থ অবশেষে অক্সফামের মাধ্যমে মুজিবনগর সরকারের কাছে প্রেরিত হয়। অটোয়া থেকে প্রেরিত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার ডলার বলে সংগঠক অধ্যাপক ড. মিজান রহমান উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন উ, মােয়াজ্জেম হােসেনের কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং করপােরেশন টেলিভিশনের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হওয়ার ফলে বাঙালিরা উজ্জীবিত হয়। কানাডিয়ানদের সাহায্যও যােগ হয়। গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশে পরিচালিত পাকিস্তানিদের শাসন ও শােষণ, তাদের অত্যাচার-নির্যাতনের কাহিনি কানাডার জনগণ, সরকার এবং অন্যান্য সংস্থার কাছে তুলে ধরা। এ বিষয়গুলাে কানাডার প্রচারমাধ্যমে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে উথাপনেরও প্রচেষ্টা চালানাে হয়। কানাডা থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণ বন্ধ এবং পাকিস্তানি জাহাজ থেকে নেমে কানাডায় আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয়দানের জন্যও কাজ করতে হয়েছে এখানে। এই কাজের বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশ এসােসিয়েশন। অব কানাডা’ একটি প্রচারপত্র বের করে। কানাডায় অল্পসংখ্যক বাঙালি যখন স্বাধীনতার পক্ষে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন কানাডা থেকে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল উপমহাদেশে সফর করেন। ভারত-পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান সংসদীয় প্রতিনিধি দল ঘুরে আসার পরপরই বাংলাদেশ এসােসিয়েশন অব কানাডা (টরেন্টো) একটি সেমিনারের আয়ােজন করে।
‘ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ’ শিরােনামে আয়ােজিত সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয় ৫ই আগস্ট টরেন্টোর মেডিকেল সাইন্স বিল্ডিং অডিটোরিয়ামে। এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন স্ট্যানলি বারকি এবং মূল বক্তা সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে উপমহাদেশ সফর করে আসা কানাডিয়ান পার্লামেন্ট সদস্য এন্ডু ব্রুইন। এছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বক্তব্য পেশ করেন টরেন্টো টেলিগ্রাম পত্রিকার সাংবাদিক ফ্রেডারিক কনসাল, অক্সফামের লেসসি স্মিথ এবং ইউনিসেফের পল ইগনিটিফ। তাঁরা শরণার্থী সমস্যা এবং সেখানকার রাজনৈতিক সমস্যা নিয়েও আলােচনা করেন। বাংলাদেশ’ নামক এসােসিয়েশনের মুখপত্রে এসব তথ্য প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানে অস্ত্র এবং অন্যান্য খাতে সাহায্য স্থগিত করা, শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন ও বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ প্রয়ােগ এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবিতে অটোয়ায় একটি ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয়। টরেন্টো, মন্ট্রিয়াল, হ্যামিল্টন, কিংস্টনসহ বিভিন্ন শহর থেকে লােকজন তাতে অংশগ্রহণ করে।
ঐদিন অটোয়াস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পাকিস্তানের পতাকা পােড়ানাে হয়। পাকিস্তানের অন্ধসমর্থক যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দূতাবাসের সামনেও এই কর্মসূচি পালিত হয়। কানাডিয়ান পার্লামেন্ট সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হয়। এনিডিপির এডু ব্রইন, লিবারেলের জর্জ ল্যাশান্স ও কনজারভেটিভ পার্টির হিথ ম্যাকুয়ারি প্রমুখ ছিলেন বাঙালির সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল। জুলাই মাসে অটোয়ায় আসেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি অধ্যাপক রেহমান সােবহান। সেখানে একটি বড় সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বক্তব্য পেশ করেন। কানাডিয়ান কয়েকজন পার্লামেন্ট মেম্বারের সাথেও তিনি মধ্যাহ্নভােজে শরিক হন। সভাপতিত্ব করেন বিরােধী দলীয় ছায়া-বিদেশমন্ত্রী। পরে গােপনে বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, সন্ধ্যায় যােগদান করেন বাঙালিদের এক বিরাট সমাবেশে। রেহমান সােবহান নিজেই বলেছেন, তাঁর এই ক্যাম্পেইনের মধ্যে এ দিনটিই ছিল বেশি কার্যকর দিবস। পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণায় বেরিয়েছিলেন মাহমুদ আলী এবং হামিদুল হক চৌধুরীসহ একটি দল। এঁরা দুজন আসেন কানাডায়। ১৮ই জুলাই তারা টরেন্টোতে একটি সভায় মিলিত হন। পাকিস্তানিদের এ সভার প্রতিবাদে বাঙালিরাও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তাঁদের সভাস্থলের বাইরে বাঙালিরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সেই সাথে বিতরণ করে প্রচারপত্র। এতে বাঙালির উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের কথা ছাড়াও এই দু’জনের অতীত ইতিহাসও তুলে ধরা হয়। এরা যখন ২২শে জুলাই অটোয়াতে সভা করতে যান তখন সেখানেও প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ৩০শে জুলাই একটি কর্মসূচি পালিত হয়। প্রচুর বাঙালি জমায়েত হয়ে মার্কিন কনস্যুলেটের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও মিছিল করে। এর আগে ২২ জুলাই ভ্যানকুবারস্থ মার্কিন কনস্যুলারকে একটি চিঠি দিয়ে বলা হয়, যেন পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে এবং বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খাটানাের অনুরােধ জানিয়ে সিনেটরদের কাছে লেখা চিঠির উত্তরে অনেকেই তাদের যথাসাধ্য চেষ্টার প্রতিশ্রুতি দেন। ‘বাংলাদেশ এসােসিয়েশন অফ কানাডা’ শেখ মুজিবের বিচারের বিপক্ষে প্রচারণা চালায়।
তারা বলেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একটা গােপন বিচার চালাচ্ছে সামরিক কৌশলে, যার ফলে আরাে রক্তপাত হবে। ১৬শে আগস্ট সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এম.এম. রহমান স্বাক্ষরিত এই রকম প্রতিবাদে অসংখ্য চিঠি পাঠানাে হয়।১০ কানাড়াস্থ বিভিন্ন বাঙালিদের সংগঠন প্রচার ও অর্থ সংগ্রহ করে স্থানীয় মানুষের। সাহায্য নিয়ে একটি প্রচারপত্র বিলি করে প্রচারপত্রের শিরােনামে লেখা হয়, ‘আপনি কি করতে পারেন?’ প্রবাসীদের বিলি করা এই প্রচারপত্রে লেখা হয়, “আমরা বাংলাদেশের আন্দোলনে সহায়তা করতে পারি সেখানে চলমান গেরিলা কর্মকাণ্ডকে সাহায্য করে।” কানাডার টরেন্টোতে তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে অন্যান্য পদক্ষেপের মতাে চলচ্চিত্র। প্রদশীনও অনুষ্ঠিত হয়। ২৬শে আগস্ট বৃহস্পতিবার অডিয়ন হলে সত্যজিৎ রায়ের তিন কন্যার চারটি প্রদর্শনী হয় বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে। যৌথ ব্যবস্থাপনায় ছিল বাংলাদেশ এসােসিয়েশন ও.আই.সি.এ। বিশিষ্ট সাংবাদিক স্টানলি বারকি টরেন্টোতে গঠন করেন ‘সাউথ এশিয়া ক্রাইসিস কমিটি। এই ব্যানারে দেশব্যাপী বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণাও চালান। অক্সফাম আহ্বান করে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন আরনল্ড স্মিথ। তিনি কানাডার নাগরিক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডাে ১৩ আগস্ট ইয়াহিয়ার কাছে লিখিত এক পত্রে শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার জন্য তাঁর মানবিক দায়িত্ববােধের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মন্ট্রিলে অনুষ্ঠিত এক মিছিলে অনেক কানাডিয়ান অংশগ্রহণ করেন। অন্যান্য দেশেরও বহু লােক তাতে শরিক হন। জুলাই মাসে সংসদীয় প্রতিনিধিদের সফরকালে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি দিয়ে কানাডা সরকারের কাছে দাবি জানানাে হয়, দাবিগুলাে হলাে: ১. অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান; ২. শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির জন্য ইসলামাবাদ সরকারের ওপর চাপ প্রয়ােগ; ৩. স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বাংলাদেশকে সব রকম সাহায্য প্রদান; ৪. পাকিস্তানে সর্বপ্রকার সাহায্য বন্ধ; ৫. পাকিস্তানের সাথে সকল বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করণ; এবং ৬, গণহত্যা এবং নারী নির্যাতনের ঘটনা তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন গঠন এবং দায়ীদের শাস্তি বিধান করা।
২২শে আগস্ট টরেন্টোতে অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সম্মেলনে যোগদান দেন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম, আর, সিদ্দিকী। সম্মেলন ছাড়াও বাংলাদেশ এসােসিয়েশনের সাথে সভায় মিলিত হন। একই সাথে আসেন কূটনীতিকের চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণায় লিপ্ত এ,এম,এ. মুহিত। তাঁরা কুইবেক প্রদেশেও যান এবং সেখানকার বাংলাদেশ এসােসিয়েশন আয়ােজিত মন্ট্রিলের এক সভায় যােগদান করেন। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য হিসেবে জাতিসংঘের কর্মসূচি শেষে দেশে। যাওয়ার পথে টরেন্টো সফর করেন। তিনি ৭ই অক্টোবর সেখানে বসবাসকারী বাঙালিদের উদ্দেশ্যে সভায় বক্তৃতা দেন। অন্যদিকে, ক্যারিবিয়ান স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন এবং বাংলাদেশ এসােসিয়েশন অব কানাডা ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি ৬ই অক্টোবর যৌথভাবে একটি সিম্পােজিয়ামের আয়ােজন করে। এতে জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভােকেট সৈয়দ আবদুস সুলতান ও জাতীয় পরিষদ সদস্য ড. মফিজ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। পরদিন ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এসােসিয়েশনের সাথে এবং সন্ধ্যায় টরেন্টো এসােসিয়েশনের অফিসে সভায় মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি আগস্ট মাসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের বিচার নিয়ে প্রহসন শুরু করলে কানাডায় বাঙালিদের দ্বারা গণস্বাক্ষর কর্মসূচি গৃহীত হয়। কানাডা সরকার যাতে এই অবিবেচনাপ্রসূত বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য পাকিস্তান সরকারের। ওপর চাপ সৃষ্টি করে সে লক্ষ্যে এই স্বাক্ষর-সংগ্রহ অভিযান চালানাে হয়। এতে বাঙালি। ছাড়াও বহু কানাডিয়ান স্বাক্ষর করেন।
১১.২ ফ্রান্সে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালি ১-১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ ফ্রান্সে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৭শ প্রতিনিধি যােগদান করেন। সংশ্লিষ্ট দেশের স্পিকার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করেন। সম্মেলনে যােগাদানকারী পার্লামেন্ট সদস্যদের বাংলাদেশের সংগঠিত পাকিস্তানি বর্বরতা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য ব্রিটেন। থেকে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি’র একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। ছাত্র প্রতিনিধিরা নানা দেশের পার্লামেন্ট সদস্যদের নিকট বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং মুক্তি আন্দোলনের ইতিবৃত্ত ব্যাখ্যা করেন। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা হলেন নজরুল ইসলাম, এম,এইচ,এ, প্রামাণিক, ওয়ালি আশরাফ, খন্দকার মােশাররফ হােসেন ও মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুর।৩

১১.৩ নরওয়ে। ১লা সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন থেকে রাজিউল হাসান রঞ্জুকে নিয়ে নরওয়ের রাজধানী অসলাে পৌঁছান। বিমানবন্দরে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুজ্জামানসহ অর্ধডজন বাঙালি তাদের অভ্যর্থনা জানান। অসলেবাসী বাঙালিদের কর্মতৎপরতার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নরওয়ের বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। তাঁদের প্রচেষ্টার ফলে স্থানীয় টিভি বিচারপতি চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রচার করে। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি নরওয়ের অধিবাসীদের নিকট স্বাধীনতা আন্দোলনের সারমর্ম ব্যখ্যা করার সুযােগ লাভ করেন।” ২রা সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী বেলা ১১টার সময় নরওয়ের প্রধান বিচারপতি স্পিয়ের অল্ড-এর সঙ্গে কফি পানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তারা জানতে চান, বাংলাদেশ কেন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়? বিচারপতি চৌধুরী সংক্ষেপে বাঙালির স্বাধীনতা সম্পর্কিত মূল কারণগুলি বিশ্লেষণ করেন।
তাঁরা বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আন্দোলনের সাফল্য কামনা করেন। ৩রা সেপ্টেম্বর সকালে বিচারপতি চৌধুরী অসলাের মেয়রের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানান। বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি অসলাে শহরের বিভিন্ন আলােকচিত্রসংবলিত বই উপহার দেন। বইটি প্রথম পৃষ্ঠায় তাকে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করেন। নরওয়ে কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগেই অসলাে মেয়র বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেন।১৫ নরওয়ে পররাষ্ট্রদপ্তরের প্রতিমন্ত্রী স্টলটেনবার্গ বিচারপতি চৌধুরীকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাদর অভ্যর্থনা জানান। প্রায় দেড়-ঘন্টা যাবৎ আলােচনার পর স্টলটেনবার্গ বলেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আসন্ন সম্মেলনে নরওয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি পেশ করবে। সম্মেলনের সরকারি বিবরণীতে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের কথা প্রকাশ করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। ৬ই সেপ্টেম্বর সকালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের সংগ্রামের উদ্দেশ্য, বর্তমান পরিস্থিতি এবং সংগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। পরদিন নরওয়ের সবগুলি সংবাদপত্রে তাঁর বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা হয়। উল্লিখিত তারিখে সন্ধ্যা ৭ টার সময় অসলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে এক বিরাট ছাত্র সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট বুল ছিলেন বাংলাদেশ। আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক। তার উদ্যোগে ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট আগে হামিদুল ইসলাম, আলী ইউসুফ, রফিকুজ্জামান এবং আরও কয়েকজন বাঙালি ছাত্রের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী মিলনায়তনে উপস্থিত হন। নরওয়ের ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা ও চাঞ্চল্যের কারণ হিসেবে তিনি লক্ষ্য করেন নরওয়ের একজন বিখ্যাত শিল্পী কর্তৃক অঙ্কিত একটি ব্যঙ্গচিত্র যা ছাত্র ইউনিয়ন পােস্টার হিসেবে ব্যবহার করে। এই ব্যঙ্গচিত্রে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে নরহত্যাকারী দানব রূপে দেখানাে হয়। কয়েকজন পাকিস্তানি ছাত্র প্রবেশদ্বারের নিকট সেঁটে দেওয়া পােস্টারটি ছিড়ে ফেলে। সে কারণে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বিচারপতি চৌধুরী পাকিস্তানি ছাত্রদের এরূপ আচরণকে তীব্রভাবে তুলে ধরেন। ১১.৪ আয়ারল্যান্ড ও মিশর স্বাধীনতা ও গণআন্দোলনের দেশ আয়ারল্যান্ডের দলীয় নেতা কমম্যাক রেসলিং এবং দলের সদস্য রিচার্ড গােগ্যান ও বিম্যাক শেরি বাংলাদেশের ছাত্র প্রতিনিধিদের পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দেন। মিশরীয় প্রতিনিধিদলের নেতা প্রথমে বাংলাদেশের ছাত্রনেতাদের বলেন যে, মিশর ত্যাগের পূর্বে তিনি পাকিস্তান দূতাবাসের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি মুসলিম রাষ্ট্রকে দ্বিখণ্ডিত করার অপচেষ্টা মাত্র। কিন্তু আলােচনার পরে তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই’ এ ধরনের মন্তব্য করেন। এছাড়া। বিভিন্ন সময়ে পত্র পত্রিকার সম্পাদকীয় ও অন্যান্য প্রতিবেদন পাঠের পর বাংলাদেশের আন্দোলনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং তারা শেষ পর্যন্ত প্রীতিপূর্ণ ও ভ্রাতৃসুলভ ব্যবহার করেন।
১১.৫ জাপান ১৯৭১ সালের দিকে টোকিওতে ছিল প্রায় ২৫জন বাঙালি। তাঁদের সবাই ছিলেন হয় ছাত্র, না হয় প্রশিক্ষণার্থী। সংখ্যায় কম হলেও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অবদান। প্রশংসনীয়। জাপানে অবস্থানকারী শুধু পূর্ব বাংলার জনগণই নয় সকল ভারতীয় বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন জানায়। এসােসিয়েশন শুধু ফান্ড সংগ্রহেই তার কার্যক্রম সীমিত রাখেনি, এটাকে একটা রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক ধারায় রূপান্তরিত করে। জাপানে নব নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত মােতাহের হােসেন দেশত্যাগী বাঙালিদের কর্মকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরে জাপান সরকারের কাছে এক সরকারি অভিযােগে তিনি বলেন যে, বৃত্তি নিয়ে পড়তে আসা পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা যেসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে অরাজকতার সৃষ্টি করছে তা বৃত্তির নীতি বহির্ভূত। তিনি আরাে বলেন, মােমবুশাে বৃত্তি নিয়ে পড়তে আসা বাঙালি ছাত্ররা বাংলাদেশের পক্ষে বাংলাদেশ সলিডারিটি লীগ গঠন করেছে। ইস্কান্দার আহমেদ চৌধুরী লীগের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং জি,এস, ছিলেন আমিনুল ইসলাম। আগস্টে ওসাকায় প্রফেসর সুরুশিমার নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন দেশের ৮০টিরও বেশি সংবাদপত্রের সাথে তাদের পত্র-যােগাযােগ রক্ষা করে এবং আশাব্যঞ্জক সাড়া পায়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে চাপ দেওয়ার জন্য ১০০জনেরও বেশি সিনেট এবং কংগ্রেস সদস্যের কাছে আপিল করে। লীগের পত্রের জবাবে সিনেটর ফ্রাংক চার্চ ও বীৰ্চ বে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ সরকারের পরিচিতি তুলে ধরার জন্য ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং আরাে ৫০টি দেশের প্রধানের কাছে আপিল করেন। টোকিওতে ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে ঐ পত্রের এক কপি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট পাঠাননা হয়।
ভারতের শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় এবং রাজনৈতিক নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ যখন টোকিও ভ্রমণ করেন তখন জাপানের বাঙালি সম্প্রদায় তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য ভারত সরকারকে অনুরােধ করেন। পাকিস্তানি কূটনীতিক মাসুদ কে, রহিম এবং পাকিস্তান। দূতাবাসের আরাে ৫জন বাঙালি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মাসুদ কে, রহিমের সরকারি বাসভবন বেসরকারি বাংলাদেশ মিশনে পরিণত হয়। তারা চাঁদা প্রদানের মাধ্যমে ফান্ড গঠন করেন এবং ফান্ডের টাকা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য গরম কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ের কাজে ব্যয় করেন। | ১৯৭১ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম, এ. জি. ওসমানী উক্ত সমিতি কর্তৃক সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে সমিতিপ্রধানের কাছে একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্রে তিনি লেখেন ইলেকট্রনিক যন্ত্রাদি, ওয়ার এন্টিনা এবং ট্রান্সরিসিভারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ সমিতি মুজিবনগর সরকারের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে।** জাপানে বসবাসকারী বাঙালিরা ডায়েট সদস্যদের সমর্থন আদায়ের জন্য প্রতিনিয়তই চাপ প্রয়ােগ করে এসেছেন। ডিসেম্বরে তারা সরাসরি ডায়েট সদস্যদের আবেদন জানিয়ে বলেন যে, টোকিওর ১১জন বাঙালি পূর্ব বাংলার ৭৫ মিলিয়ন বাঙালির স্বাধীনতাকে সমর্থনের জন্য অনুরােধ করছে। পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী অন্যায়ভাবে পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে তার চিত্র জাপানিদের তুলে ধরে বলেন যে, বাংলার জনগণ।
স্বাধীনভাবে ও সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার জন্য তাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এভাবেই জাপানে বসবাসকারী বাঙালিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য তাদের ঐকমত্য ও সমর্থন প্রকাশ করে। ১১.৬ ইন্দোনেশিয়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে মাত্র তিন চার ঘর বাঙালির অবস্থান জাকার্তায়। এদের মধ্যে বেশির ভাগ পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে ২২ জানুয়ারি আবুল ফজল শামসুজ্জামান পাকিস্তানি অ্যামবাসিতে (কর্মাশিয়াল) ফাস্ট সেক্রেটারি হিসেবে যােগদান করেন। ২৬শে মার্চ ইন্দোনেশিয়া অবজারভার-এর মাধ্যমে জাকার্তাস্থ বাঙালিরা জানতে পারেন বার্মার বিপ্লব দিবস উপলক্ষে বার্মিজ দূতাবাসে এক পার্টির আয়ােজন করা হয়েছে। আবুল ফজল শামসুজ্জামান অতিথি হিসেবে সেখানে উপস্থিত হন। অন্যান্য দেশের কূটনীতিক অনেকে এবং স্থানীয় বহু পদস্থ ব্যক্তি পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ভারত, পূর্ব ও পশ্চিম ইউরােপের অনেক কূটনীতিকদের সাথে তিনি বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলাপ করেন। কূটনীতিকগণ পাকিস্তানের পরিস্থিতি ভালােভাবে বুঝেছিলেন এবং ভীষণ একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে তারা নিঃসন্দেহ ছিলেন। ২৮শে মার্চ আবুল ফজল শামসুজ্জামানের বাড়িতে তাঁর সেকশনের সিদ্দিক আহমেদ ও একরাম আলী, প্রেস সেকশনের নূরুল ইসলাম, ডিফেন্স সেকশনের রুহুল আমিন, আইপেকের সানাউল্লাহ এবং প্রেস কাউন্সিলার আবেদনী একত্রিত হও। আবেদনী-এর অভিমত ছিলাে, “আমেরিকা, চীন, পাকিস্তানকে সমর্থন দেবে। মৌখিক সমর্থন দিলেও রাশিয়া সক্রিয় সাহায্য করবে না। বাঙালির জন্য এ যুদ্ধ আত্মঘাতী হবে।” আবুল ফজল শামসুজ্জামান বলেন যে, যেহেতু যুদ্ধ শুরু হয়েছে, এখন আপােষ সম্ভব নয়। পেছালে জাতি হিসেবে ধ্বংস অনিবার্য। বাঁচতে চাইলে সংগ্রাম করতে হবে। জাতি হিসেবে সসম্মানে বেঁচে থাকার সমস্যা অগ্রাহ্য করা অনুচিত হবে। আবুল ফজল শামসুজ্জামানের বক্তব্য শুনে সানাউল্লাহ, নুরুল ইসলাম ও রুহুল আমিন সমর্থন জানান। পরে এদের নিয়ে আবুল ফজল শামসুজ্জামানের নেতৃত্বে আমরা দল গঠন করা হয়। ২৮শে মার্চ সন্ধ্যায় আবুল ফজল শামসুজ্জামান ও সানাউল্লাহ মিলে ডিকটেশন তৈরি করেন।
আবুল ফজল শামসুজ্জামানের সহায়তায় সানাউল্লাহ লেখার কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। Is Islam Dead? শিরােনামের এই লেখাটি ১৫ই এপ্রিলের জাকার্তা টাইমস্ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় পাকিস্তান সরকারের কার্যকলাপ কেবল বর্বর নয়, অনৈসলামিক।১২৩ আর্থিক সংকট মেটানাের জন্য জাকার্তাস্থ বাঙালিরা একটি ফান্ড গঠন করেন। সবাই যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী এই ফান্ডে চাঁদা দিতেন। মােট চাঁদা সংগৃহীত হয়েছিল ৬১০ ডলার। এই ফান্ড থেকে কিছু টাকা কলকাতাস্থ মিশনে প্রেরণ করা হয়। এছাড়া মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য ১৪০ ডলার দিয়ে ৯০ টি নতুন গরম কাপড় ক্রয় করে প্রেরণ করা হয়।

১১.৭ সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পরই সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালির অবস্থান ও সংখ্যায় ছিল বেশি। তাদের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে এবং পঞ্চাশের দশকে সিঙ্গাপুরে পঞ্চশ / ষাট হাজার বাঙালি বসবাস করতেন। এরা প্রধানত জাহাজি। কিন্তু ১৯৫৭ সালে মালয়ের স্বাধীনতা এবং ১৯৫৯ সালে সিঙ্গাপুর স্বায়ত্তশাসন লাভ করলে সেখানে চীনা উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয় এবং এতে প্রবাসীদের চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে আরম্ভ করে। তাই অনেক জাহাজি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দিতে থাকেন। ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর মালয়েশীয়া থেকে বেরিয়ে এসে পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রবাসীদের পক্ষে সেখানে থাকা জটিল হয়ে পড়ে। তাদের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ১৯৭১ সালে প্রায় চার হাজার দাঁড়ায়।
প্রবাসী বাঙালিরা এখানে ছিলেন সুসংগঠিত, সত্যিকারের শ্রমজীবী প্রবাসী। তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘সিঙ্গাপুর পাকিস্তান সােসাইটি। বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে সিঙ্গপুরে প্রবাসীরা তাদের সংস্থার নাম পরিবর্তন করে ‘সিঙ্গাপুর বাংলাদেশ সােসাইটি নামকরণ করেন এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাচার এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে সিঙ্গাপুরে ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জনমত সৃষ্টি করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালান। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ সােসাইটির চেয়ারম্যান ছিলেন মনিরুদ্দিন মাস্টার এবং সেক্রেটারি ছিলেন নূরুল হক ওরফে বাদশা মিয়া।২৫ ২৭ মার্চ তারা দলে দলে গিয়ে হাজির হন। সিঙ্গাপুরে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশনে এবং পাকিস্তানবিরােধী বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। কয়েক ঘন্টা বিক্ষোভ শেষে পুলিশের হস্তক্ষেপে তারা ফিরে আসেন। দীর্ঘ নয় মাস স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তারা বহু সভা-সমিতি করেন। পত্র। পত্রিকায় পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর অত্যাচারের ঘটনা প্রচার করেন। পার্লামেন্ট সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী লী কুয়ান ইউর নিকটও তারা স্মারকলিপি পেশ করেন। সিঙ্গাপুর সরকার বাংলাদেশের মানুষের আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন এবং স্থানীয় পত্র-পত্রিকাও ছিল সংবেদনশীল। বিশেষকরে সাংবাদিক এস, এম, আলীর প্রচেষ্টায় সিঙ্গাপুরে দৈনিক ও সাময়িকীগুলােতে বাংলাদেশে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের উপর বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি জনমত গঠিত হয়। ভারতের ত্রাণ শিবিরে বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের জন্য তারা চাদা উঠিয়ে প্রায় পাঁচলক্ষ টাকার কাপড় জাহাজযােগে মুজিবনগর সরকারের নিকট পাঠান। ১১.৯ সৌদি আরব। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস সৌদি আরব পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাঙালির বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে। প্রায় এক কোটি বাঙালির ভারতে শরণার্থী হিসেবে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশাও সৌদি সরকারকে রেখাপাত করেনি। তবে নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও সৌদি আরবে বসবাসরত বাঙালি ও প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ শিক্ষা কেন্দ্র (সৌদি আরব)’ বাংলাদেশ সরকারকে ৪০২.৩৭ পাউন্ড দান করেছে। অন্যদিকে, ৮টি মুসলিম দেশে বসবাসরত বাঙালিরা সম্মিলিতভাবে শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকারকে ৫ লক্ষ ৭৪ হাজার ১৬২ ডলার সাহায্য দেয়।
এসব দেশের মধ্যে ইরাক, ইরান, লিবিয়া, মিশর, ওমান উল্লেখ্য।১২৬ ১২. প্রবাসী বাঙালিদের কূটনীতি: সাংস্কৃতিক কূটনীতি বর্তমান বিশ্ব পরিসরে কূটনীতির এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। এই সাংস্কৃতিক কূটনৈতিক তৎপরতা অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন পেশাদার অভিনেতা ও অভিনেত্রী, শিল্পী, সংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। যুক্তরাজ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৭১ সালে ৫ই মে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি’- স্বাধীন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত মুদ্রণ করে ব্যাপকভাবে যুক্তরাজ্যে প্রচার করে। ১৯৭১ সালে ৮ই মে ব্রিটেনের ম্যাঞ্চেস্টারে আয়ােজিত জনসভায় ব্রিটেনের কর্মরত এক সাধারণ শ্রমিক বিরাট জনসভায় একটি গান পরিবেশন করেন। শ্রমিকের নাম আব্দুর রহমান খান। গানটি বাংলাদেশে এ্যাসােসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিত হয়। প্রকাশনে বলা হয়, বাংলার এ দুর্দিনে যার অপার উৎসাহে এই ক্ষুদ্র কবিগান লেখা সম্ভব হলাে, তিনি আর কেউ নন- তিনি আমার প্রতিবেশী ও পরম শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুবর মাষ্টার এ, আজিজ। তারই সহযােগিতায় কবিগানটি উৎসর্গ করলাম রকেট যুগের অগ্নিপুরুষ, বঙ্গ জননীর বীর সন্তান, স্বাধীন বাংলার স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে, যিনি বলেছেন, “আমাকে বন্দি করাে, আমাকে হত্যা করাে, এতে আমার দুঃখ নেই; কিন্তু আমার দেশবাসীর উপর। অত্যাচার কোরাে না।” ১৭৪ লাইনের এই কবিতায় ১৯৪৭ সাল থেকে বাঙালি জাতির উপরে শাসন, শােষণ, লুণ্ঠন, নিপীড়ন এবং বাঙালি জাতির আন্দোলন সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলাে উল্লিখিত হয়েছে। শেষ লাইনে বলেছেন, “গানটি আমার রক্তলেখা, উর্ধ্বে তােল জয়পতাকা/মায়ের অঙ্গে রক্ত মাখা, বাংলা ভাষাতেবিলছে কথা এ রহমান, এবার মােদের শেষ রক্তদান/জয় বাংলার জয় গান, গাওরে খুশিতে।”১২৭ ১৯৭১ সালে জুন মাসে ইংল্যান্ডে গঠিত হয় বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদ। এই সংসদের উদ্যোগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে সংগীতানুষ্ঠান আয়ােজন করা হয়।১২৮
একাত্তরে ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের সংহতি আন্দোলনের সামনে ছিলেন লেখক, শিল্পী ও ধর্মীয় নেতারা। ১৯৭১ সালে ১১ই জুন একটি প্রতিনিধিদল আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের জন্য সাহায্য পাঠানাের দাবি জানান। এই দাবিনামায় যারা স্বাক্ষর করেন, তাদের মধ্যে প্রথমেই ছিলেন আশি-ঊর্ধ্ব ভিক্টোরিয়া ওকাম্পাের নাম। তার সঙ্গে ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক হাের্হে লুইস বাের্হেসসহ আর্জেন্টিনার সেরা লেখক ও শিল্পীদের অনেকে। বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ফ্রান্সের আঁদ্রে মালরাে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সময় গর্জে উঠেছিলেন প্রবল বিক্রমে, বাংলাদেশের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে যােগদানের অঙ্গীকার ঘােষণা করেন। সেই ঘাের অমানিশার দিনে তার দুঃসাহসী কণ্ঠস্বর বিপুল প্রেরণা জুগিয়েছে। বিট বংশের উদ্যোক্তা কবি অ্যালেন গিন্সবার্গকে বাংলাদেশের একাত্তরের ট্র্যাজেডি গভীরভাবে আলােড়িত করে। বাংলাদেশে লাখাে-কোটি মানুষের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখতে তিনি ভারতে আসেন। লেখেন ‘একাত্তরের সেপ্টেম্বর’ নামের দীর্ঘ কবিতা। তার একটি অংশ এ রকম: “লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার/উদর স্ফীত, বিস্ফারিত চোখের ধার/যশাের রােডে বিষন্ন সব বাঁশের ঘর/ধুকছে শুধু, কঠিন মাটি নিরুত্তর।” অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁর এই কবিতাটিতে সুর দিয়েছিলেন। হারমােনিয়াম বাজিয়ে নিজে গেয়েছেন বহুবার। এই কবিতা, এই গান গিন্সবার্গের খুব প্রিয় ছিল। উদ্দীপ্ত করেছিলাে লক্ষ লক্ষ মুক্তিকামী মানুষকে। একাত্তরে বাংলাদেশ নিয়ে গায়ক-শিল্পীদের সবচেয়ে বিশাল সংগঠিত আয়ােজন ছিল নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১লা আগস্টে অনুষ্ঠিত অবিস্মরণীয় সংগীতসন্ধ্যা।১২৯ এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর । বাংলাদেশের জনগণের সাহায্যার্থে তিনি প্রথম যােগাযােগ করেন জনপ্রিয় ‘বিটলস’- এর অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে। হ্যারিসন এগিয়ে আসেন এবং উদ্যোগী হয়ে অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ৪০ হাজার শ্রোতা-দর্শক এই অনুষ্ঠানে সমবেত হন। ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নামের এই অনুষ্ঠান থেকে উদ্যোক্তারা ২,৪৩,৪১৮.৫০ ডলার সংগ্রহ করে ইউনিসেফের বাংলাদেশ শিশু সাহায্য তহবিলে প্রদান করেন। ৪০টি মাইক্রোফোনে অনুষ্ঠানের গান ও কথা রেকর্ড করে তিনটি লং প্লেইং নিয়ে একটি বড় অ্যালবাম প্রকাশ করা হয়।
সঙ্গে ছিল বহু রঙে মুদ্রিত সেই অনুষ্ঠানের একটি সুদৃশ্য সচিত্র পুস্তিকা। সেদিন ম্যাডিসন স্কয়ারের অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্রতিবাদী গানের রাজা বব ডিলান। তিনি গেয়েছেন ছয়টি গান, মি. ট্যাম্বুরিনম্যান’ থেকে শুরু করে তাঁর লেখা ও সুরারােপিত ৫০ লাইনের বিখ্যাত গান ‘এ হার্ড রেইন ইজ গােননা ফল’। সেদিন বব ডিলানের সঙ্গে গিটার বাজিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন, ব্যাস লিওন রাসেল ও ট্যাঘুরিন রিঙ্গো ষ্টার। সে অনুষ্ঠানে বিটলস-এর অন্যতম সদস্য রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্ৰেষ্টন, ডন প্রেষ্টন প্রমুখ গান গেয়েছেন, গিটার বাজিয়েছেন। এই অনুষ্ঠানের জন্য জর্জ হ্যারিসন লেখেন নতুন গান: “এল একদিন বন্ধু আমার/চোখভরা তার ধু-ধু হাহাকার। বলে গেল, চাই শুধু সহায়তা দেশ তার আজ ধুকে ধুকে মরে বেশি কিছু আমি জানতে চাই না।” এটি ছিল অনুষ্ঠানের শেষ গান। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত চড়া সুরের মধ্যে আর্তনাদের মতাে করুণ অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জর্জ হ্যারিসনের এই গান আর তার মহতি উদ্যোগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সংহতি প্রকাশের বহু স্মরণীয় কার্যক্রমের মধ্যে এক সমুজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। পুরাে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা ছাড়াও জর্জ হ্যারিসন একাই ছয়টি গান গেয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সেদিনের সংগীতসন্ধ্যায় যুদ্ধবিরােধী আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে পরিচিত কণ্ঠশিল্পী জোয়ান বায়েজ অংশ নিতে পারেননি। সেদিন তার অন্য একটি পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান ছিল। মানবতাবাদী এই শিল্পী বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে সেই সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে না পারলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিদারুণ হত্যাযজ্ঞ নিয়ে লেখেন এক হৃদয় নিংড়ানাে সংগীতালেখ্য। গানের কয়েকটি রচনা এ রকম: “বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অস্তাচলে যেখানে দিন শেষ। লাখাে প্রাণের রক্তে রাঙা দেশ…/সবাই এসাে, দাঁড়াও হাতে হাত/ মরছে দ্যাখাে মানুষ দিনরাত/ কিশােরী মা’র দু-চোখ ভেসে যায় শিশুটি তার ধুকছে অসহায় বৃষ্টি আর ভীষণ কলেরায়।” ‘বাংলাদেশ’ গানটির সুরকার ছিলেন জোয়ান বায়েজ নিজেই। গানটি গেয়েছেনও তিনি। বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার উদ্যোগে ২২শে আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে জেফারসন হাই স্কুল অডিটরিয়ামে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়ােজন করা হয়।
১৯৭১ সালে ২০শে নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় নিউইয়র্কে সেন্ট জর্জ চার্চে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সে সময় বিভক্ত বিশ্বের দুই প্রধান কবি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালেন গিন্সবার্গ ও রাশিয়ার আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কি প্রথমবারের মতাে একই মঞ্চে কবিতা পড়েছিলেন। এ রকম একটি দৃশ্য ভাবতে মুক্তিকামী মানুষের মনে শিহরন জাগায়। তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন গ্রেগরি করসসা, পিটার অরলভস্কি, কেনেথ কচ, এড স্যান্ডার্স প্রমুখ। কবি। এই কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানটির আয়ােজন করেছিল আমেরিকানস্ ফর বাংলাদেশ। তারা বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও অর্থ সগ্রহের কাজ করেছে।”

১৩. প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে পত্র-পত্রিকা প্রকাশ মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী বাঙালিদের দ্বারা কিছু পত্র-পত্রিকা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়। যেমন:১৩২ 7. Gon: ‘Bangladesh News Letter’, ‘Bangladesh Today’, aleatichat ein পরিক্রমা’, ‘জনমত। খ, যুক্তরাষ্ট্র: Bangladesh News Letter, Bangladesh News Bulletin’,  Bangladesh News Letter (Chicago)’, ‘বাংলাদেশ পত্র’, ‘শিখা’। গ. কানাডা: Bangladesh’, ‘লিঙ্গ’। ঘ, মুজিবনগর সরকারের ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক প্রকাশিত – Bangladesh, এসব পত্র-পত্রিকা কেবল প্রবাসী বাঙালিদেরই উদ্বুদ্ধ করেনি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এসব পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও প্রবন্ধ শিরােনামের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন পরিশিষ্ট ৩.গ-এ দেওয়া হলাে। ১৪. পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণে প্রতিরােধ প্রবাসী বাঙালিদের অন্যতম কূটনৈতিক পদক্ষেপ ছিল বিদেশ থেকে পাকিস্তান যেন সামরিক সাহায্য ও যুদ্ধসরঞ্জম না পায়। এ সম্পর্কে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল-পাকিস্তানকে প্রদত্ত অস্ত্র-সরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে একটি জাতিকে ধ্বংস করার কাজে। প্রবাসী বাঙালিরা পাকিস্তানে সামরিক সাহায্যের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার প্রধানদের নিকট বার্তা প্রেরণ করেন। বাংলাদেশের গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও রক্তাক্ত পটভূমিকায় বিশ্বের শান্তিকামী, মানবতাবাদী মানুষ বিবেক দংশিত হয়ে পাকিস্তানকে অস্ত্র ও অর্থ প্রেরণে নৈতিক, মানবিক ও আইনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, যার প্রচণ্ড অভিঘাতে যে জনমত সৃষ্টি হয় তা যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন।
এড়িয়ে যেতে পারেনি। প্রবাসী বাঙালিরা স্ব অবস্থান থেকে যে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেন তা একদিকে যেমন কূটনৈতিক বলয়কে আলােড়িত করেছে, অন্যদিকে। জনপ্রতিনিধিদের গভীরভাবে উদ্বেলিত করেছে। যুক্তরাজ্যের সিনেটর জন এফ. কেনেডি, স্যাক্সবি, ফ্রাংক চার্চ প্রমুখ প্রত্যেকে বাংলাদেশ ইস্যুকে বার বার সিনেটে উত্থাপন করেছেন। এসব কারণে নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশ প্রশ্নে নেতিবাচক অবস্থান নিলেও জনমত গড়ে ওঠে বাংলাদেশের পক্ষে। ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অন্ত্র সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও গােপনে সিয়েটো-সেন্টো চুক্তির অজুহাতে অস্ত্র পাঠোনাের চেষ্টা করে। এ সময়ে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যবৃন্দ ও সিনেটরগণ পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য ও যে কোনাে ধরনের যুদ্ধসরঞ্জাম বন্ধের জন্য দাবি তােলেন। এমনকি ‘পদ্ম’ ও ‘সুন্দরবন’ অস্ত্রবাহী পাকিস্তানি জাহাজে মার্কিন সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অস্ত্র প্রেরণ করা হচ্ছে, এ সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য ও প্রমাণ সিনেট কমিটিতে উপস্থিত করেন এবং তদন্তের দাবি জানানাে হয়। সিনেট সদস্য ফ্র্যাংক চার্চ ২২শে জুন ১৯৭১ সাল মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিকট পত্র লিখে পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণে বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার উপর জোর দেন। পাকিস্তানের পূর্বাংশে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানে যুদ্ধাস্ত্র প্রেরণের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। এই জনমত গড়ে তােলার কার্যক্রমে গণমাধ্যম, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মার্কিন নাগরিক, জনপ্রতিনিধি ও প্রবাসী বাঙালিদের বিশেষ ভূমিকা উল্লেখযোেগ্য।
জনমতের চাপে নিক্সন প্রশাসন প্রকাশ্যে পাকিস্তানে সামরিক অস্ত্র সরবরাহে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বলবতে আইন পরিবর্তন করতে হয়। ওয়াশিংটন স্টার, বাল্টিমোের সান প্রভৃতি পত্রিকায় পাকিস্তানি জাহাজ ‘পদ্ম’, ‘সুন্দরবন এবং ‘আল আহমেদী’ বাল্টিমাের বন্দর থেকে অস্ত্র বােঝাই করা হচ্ছে এ মর্মে তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনসহ সকল প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার ভ্যালিতে প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন বাংলাদেশ এসােসিয়েশন ডেলাওয়ার ভ্যালি’র সদস্য সংখ্যা ছিলাে ৩০টি পরিবার। তারা একদিকে অর্থ সংগ্রহ করেন এবং একইসাথে মার্কিন নাগরিক রিচার্ড কে, টেইলর-এর নেতৃত্বে গঠিত ‘দি ফ্রেন্ডস অব ঈস্ট বেঙ্গল’ এর সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখেন। পাকিস্তান থেকে আগত বা পাকিস্তান অভিমুখি জাহাজগুলোর সংবাদ রাখার দায়িত্ব পালন করে ঐ সংগঠনটি। মূলত জাহাজ কোম্পানির এজেন্সি হতে কোনাে জাহাজে সামরিক যুদ্ধাস্ত্র যাচ্ছে কী না সংগঠনটি এর খবরাখবর রাখতেন। এসব জাহাজে যাতে অস্ত্র প্রেরিত হতে পারে সে লক্ষ্যে অবরােধ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যা ছিল ঐতিহাসিক। যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্রবন্দরগুলােতে যে অবরােধ সৃষ্টি করা হয়েছিল তা ছিল অভাবনীয় ও বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার সাফল্যজনক কৌশল। জুলাই মাসে বস্টন, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন থেকে প্রবাসী বাঙালি বন্দরে সমবেত হন মার্কিন বন্ধুদের সঙ্গে। বিভিন্ন শহরের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে সেখানে একটা সভা করেন। সভায় ‘অহিংসভাবে’ আন্দোলন গড়ে তােলার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রস্তুতি পুর্বে তারা সংগ্রহ করেন। ডিঙি নৌকা, রাবার বােট এবং সিলমাছের চামড়ায় আবৃত ক্ষুদ্র কাঠের নৌকা। পুলিশের নিষেধাজ্ঞাকে প্রত্যাখ্যান করে বন্দরের সমুদ্র সৈকতে ভাসিয়ে দেয় এসব নৌকা। সে সময় বন্দরনগরী বাল্টিমাের এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের স্থানীয় লােকজন সৈকতে সমবেত হয় খাদ্য ও পানীয় নিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত ছাত্ররা তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা নৌকা ভাসিয়ে দেয় সাগরে। এভাবে প্রতিটি এলাকা থেকে ছাত্রদের নিয়ে আসা অসংখ্য রাবার বােটও যুক্ত হয় মূল বহরের সাথে। যুদ্ধসাজের মতাে সজ্জিত নৌকাবহর ‘পদ্মা’ জাহাজে মালামাল বােঝাইয়ের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে এক অপ্রতিরােধ্য প্রতিরােধ। মালামাল শূন্য হয়ে পাকিস্তানি জাহাজ ‘আল আহমেদী’ বাল্টিমাের বন্দর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বাল্টিমাের থেকে সরে যাওয়া আল আহমেদী’ জাহাজ নােঙর করে ফিলাডেলফিয়ায়। সে সংবাদও পৌছে যায়। প্রতিরােধ কর্মীরা। সমুদ্রবন্দর পৌছে যান। তাদের দৃষ্টিতে জাহাজগুলাে ‘দু-কোটি মানুষের মৃত্যু ও ‘শয়তানের প্রতীক’। ‘অবরােধ’ সময়ে কয়েকজন গ্রেফতার হন। এ জাহাজে তেরজন বাঙালি নাবিক ছিলেন। তারা বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বন্দরে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হননি। কিন্তু ফিলাডেলফিয়ায় জাহাজ থেকে পালিয়ে আসেন মােফাজ্জেল আহমদ, আবু আহমেদ, সালেহ আহমেদ, মােত্তালেব, জহুরুল ও রমজান আলী। করাচি থেকে রওয়ানা হবার পর নানাভাবে তাদের হয়রানি, অপমানিত এমনকি শারীরিক নির্যাতন করা হয়। অফিসাদের মুখপাত্র এ. কে. এম. নুরুল হুদা পাকিস্তানে ফিরে গেলে তাদের শারীরিক নির্যাতন কিংবা হত্যা করা হবে বলে আশঙ্কা করেন। পার্লামেন্ট সদস্য এ্যালফ্রেড এভান্সের সহায়তায় বাঙালি খালাসি ও অফিসারদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থনা মঞ্জুর করাতে সক্ষম হন। ২৪শে জুলাই বাংলাদেশের ইনফরমেশন সেন্টার থেকে প্রকাশিত এক বুলেটিনে বলা হয়, ইন্টার ন্যাশনাল ‘লংশাের মেনস’ (জাহাজ শ্রমিক) ইউনিয়নের সদস্যরা পাকিস্তানমুখী জাহাজে অস্ত্র বােঝাই করবেন না বলে ইউনিয়েনের প্রেসিডেন্ট টমাস জানিয়েছেন। আগস্ট মাসে পাকিস্তানি জাহাজ ‘বাগে ঢাকা’ লন্ডন আসার পথে করাচিতে জাহাজের বাঙালি সেকেন্ড অফিসার আবদুর বশীরকে করাচিতে নামিয়ে রাখে।
জাহাজে আরাে তিনজন বাঙালি আবুল কালাম আবদুল সিদিকুল্লা ও নূরুল হক লন্ডনে নেমে যান। যুক্তরাষ্ট্রের গােপন দলিলপত্রে দেখা যাচ্ছে, ১০ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে জাতিংসংঘে নিযুক্ত চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি ওয়াং হুয়ার সঙ্গে এক বৈঠকে পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণ সম্পর্কে হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, “আমাদের পক্ষে এই মুহূর্তে অস্ত্র সরবরাহ সম্ভব নয়। আইন আমাদের হাত পা বেঁধে ফেলেছে।”১৭ ১৫. মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীদের আর্থিক সহায়তা প্রবাসী বাঙালিদের অনন্য সাধারণ অবদানের মধ্যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা যে আর্থিক সাহায্য ও সহযােগিতা করেন তা ছিল খুবই উল্লেখ্যযােগ্য। পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৩ সালের শেষার্ধে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে লন্ডনে বলেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘােষণা করলে, এখানকার প্রবাসীরাই অর্থের সংস্থান করবে। বঙ্গবন্ধু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হয় প্রবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে আর্থিক সহায়তা দানে। সে সময় তারা বিভিন্ন দেশে স্ব স্ব সংগঠনের মাধ্যমে ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা, জনমত . গঠন, মিটিং-মিছিলে লক্ষ লক্ষ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করেছেন। এছাড়া বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ ফাণ্ডে চাঁদা দান করেন ৪,০৬,৮৫৬ পাউন্ড। ‘বাংলাদেশ ফান্ডে’ গৃহীত চাঁদার মধ্যে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিরা দান করেন শতকরা ৯৫ ভাগ। বাকি ৫ ভাগ আসে তখন যে অল্পসংখ্যক বাঙালি মধ্যপ্রাচ্যে থাকতেন তাদের কাছ থেকে। এই অর্থ হতে প্রবাসে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমন্বয় সাধনের জন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত স্টিয়ারিং কমিটির মাধ্যমে খরচ হয় ৩৩,২১২ পাউন্ড। যুদ্ধশেষে বিচারপতি চৌধুরী যখন দেশে ফিরে আসেন তখন বাংলাদেশ ফান্ড’ হতে তিনি সাথে করে নিয়ে আসেন ৩,৭৬,৫৬৮ পাউন্ড এবং তা বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে জমা করেন। প্রাপ্ত তহবিলের আয় ও ব্যয়ের হিসাব পরিশিষ্ট (৩. ঘ দ্রষ্টব্য)।
এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, সিঙ্গাপুর, জাকার্তা প্রভৃতি দেশ থেকেও প্রবাসী বাঙালি নিজেদের মধ্যে ও বিদেশি বন্ধুদের নিকট হতে চাদা সংগ্রহ করে মুজিবনগর সরকার ও শরণার্থীদের জন্য বিভিন্ন সংস্থাকে প্রদান করেন। এছাড়া টেকনিক্যাল যন্ত্রপাতি ও শীতবস্ত্র ক্রয় করে মুজিবনগর সরকারের নিকট প্রেরণ করেন। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে বিদেশ থেকে অর্থ ও অন্যান্য সহযােগিতার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। প্রেরণের ঠিকানাও দেওয়া হয়। ১৬. উপসংহার। প্রবাসে স্থিত বাঙালিরা বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা ও সমিতির মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিনিয়ত মিটিং-মিছিল, স্মারকলিপি প্রেরণ, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ, নিরীহ মানুষের উপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর আক্রমণ, লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষের আর্তনাদ তুলে ধরে জনমত গঠন করেছেন। বিভিন্ন দলের জনপ্রতিনিধিদের নিকট বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে সীমাহীন নিষ্ঠুরতা, ধর্ষণ ও বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করার ব্লু-প্রিন্ট তুলে ধরে বাংলাদেশকে সমর্থন ও স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে নানা প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাদের এসব সামগ্রিক কার্যক্রম জনমনে যেমন, কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যে প্রতিক্রিয়ার অভিঘাত সমগ্র এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, সমগ্র ইউরােপ, যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন পর্যন্ত  ক্রিয়াশীল। মুজিবনগর সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও কূটনৈতিক দিক নির্দেশনায় প্রবাসী বাঙালিরা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়, আইন সভায় বা বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের নিকট কখন দলবদ্ধ, কখন গােষ্ঠীক বা ব্যক্তিক পর্যায়ে যােগাযােগ স্থাপন করে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক তৎপরতার ঘাটতি পূরণ করতে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।
যার ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগঠিত হয়েছে, অন্য দিকে। তেমনি কূটনৈতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালিদের কর্মকাণ্ড, গণমাধ্যম ও জনমত প্রবলভাবে বাংলাদেশের বাস্তব ঘটনাবলি ও হৃদয়বিদারক চিত্র তুলে ধরার ফলে ক্ষমতাসীন সরকার পাকিস্তান সরকারকে প্রত্যক্ষ সমর্থন না দিয়ে অনেকাংশে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকার পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে থেকেছে সর্বদাই। কিন্তু স্বদেশ ও বিশ্ব জনমতের চাপ মাথায় নিয়ে তাকে চলতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন স্থানে সংগঠনের মাধ্যমে অথবা স্ব স্ব অবস্থান থেকে জনমত সৃষ্টি, সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন নানাভাবে। দেশের মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে বিভিন্ন দূতাবাসে বহুমাত্রিক তৎপরতার সক্রিয় উদ্যোগ কূটনৈতিক ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বিশ্ব পরিসরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী বাঙালিরা নিরলস তৎপরতার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পক্ষে। অঘােষিত কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপস্থিতি দৃশ্যমান থেকেছে। প্রবাসী বাঙালিদের এই অবদান কূটনৈতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধে লিপ্ত একটি দেশের জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবেই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। পরিশিষ্ট ৩. ক। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবস্থিত বাঙালিরা যে সকল সংগঠন ও সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার তৎপরতা চালায় সে সব সংগঠনের মধ্যে উল্লেখ্য সংগঠনের নাম, ঠিকানা ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নাম:  
 

সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কূটনৈতিক যুদ্ধ – আবু সাইয়িদ