You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনে মেহেরপুর - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনে মেহেরপুর
স্কুলছাত্রদের তৎপরতায় উত্তাল একুশে

১৯৪৭-এর আগস্টে দেশভাগের পর নদীয়া জেলার একাংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় কুষ্টিয়া জেলার অধীন অঞ্চল হিসেবে। নবগঠিত কুষ্টিয়া জেলা সদর বাদে এখানে থাকে মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা মহকুমা। মেহেরপুর কুষ্টিয়া জেলার সর্বপশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ভারতসীমান্ত-সংলগ্ন প্রায় অখ্যাত এক প্রান্তিক মহকুমা শহর। আশ্চর্য, এখনাে এখানে ঘন আমবাগান ঐতিহাসিক পলাশীর আম্রকাননের স্মৃতি বহন করে চলেছে।
মেহেরপুরে সংঘটিত ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আবারও মনে করতে হচ্ছে এ আন্দোলনের দূর আঞ্চলিক বিস্তৃতি ও গুরুত্ব, যা যথাযথভাবে এতকাল পরও নির্ভুল বাস্তবতায় পুরােপুরি সংকলিত হয়নি এবং যা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রবল অভিযােগ। মেহেরপুরসহ এমন একাধিক প্রান্তিক শহর থেকে প্রাপ্ত অভিযােগে তাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে।
দূর অঞ্চলের ভাষা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলাে ভাষার আবেগে স্বতঃস্ফুর্ত প্রেরণায় স্কুলছাত্রদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের একুশের আন্দোলনে। একে অংশগ্রহণ না বলে সূচনা ঘটানাে বলাই যুক্তিসংগত। টেকনাফ-কক্সবাজার থেকে কুড়িগ্রাম- তেঁতুলিয়া হয়ে মেহেরপুর তার প্রমাণ। প্রমাণ কলেজ নেই এমন শহর বা এলাকাগুলাে।
আরও একটি বিষয় লক্ষ করার মতাে যে অনুন্নত এলাকাগুলোতেও স্কুলছাত্রদের সূচিত একুশের ভাষা আন্দোলনের পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শহরবাসী বা এলাকাবাসীর সমর্থনও এক বাস্তব সত্য। অল্প বয়সী ছাত্রদের মাতৃভাষার প্রতি আবেগ এবং এর অধিকার রক্ষায় তাদের সাহস ও শ্রম বিস্ময়কর। মেহেরপুর তার অন্যতম উদাহরণ।
ভাষা আন্দোলন সংগঠিত রূপ নিয়ে শুরু হয় ১৯৪৮-এর মার্চে। এ সময়পর্বে পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান নিয়ে ছিল প্রবল মুগ্ধতা। স্বভাবতই ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলন অনেক শহরে যথাযথ শক্তিতে ও মর্যাদায় পালিত হয়নি। হতে পারেনি প্রচণ্ড সরকারি দমননীতির মুখে। সেই সঙ্গে সমাজের বড়সড় অংশে পাকিস্তানকে ঘিরে রক্ষণশীলতার কারণে। তদুপরি বাধা এসেছে মুসলিম লীগের রাজনীতির মহল থেকে।
মেহেরপুরের ঘন ছায়ার আমবাগানগুলােতে তখন আমের বােলের ম-ম গন্ধ। এই প্রাকৃতিক আচ্ছন্নতার ঘাের কেটে শুরু হয়ে যায় ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী তৎপরতা। এ সম্পর্কে সরাসরি কথা বলেছেন প্রবীণ ভাষাসংগ্রামী নজীর হােসেন ও ইসমাইল হােসেন। নজীর হােসেনের পুত্র অসুস্থ পিতার হয়ে একাধিকবার কথা বলেছেন এবং এ ব্যাপারে পিতার সতীর্থ ভাষাসংগ্রামী ইসমাইল হােসেনের বক্তব্য গােচরে এনেছেন।
ইসমাইল হােসেন জানিয়েছেন, (২৩ এপ্রিল ২০১৩) : রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালেই মেহেরপুরে আন্দোলন শুরু হয়। তার মতে, সারা দেশের মতাে মেহেরপুরেও রাষ্ট্রভাষা উর্দুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে স্থানীয় হাইস্কুল থেকে। স্লোগান, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মেহেরপুরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রধর্মঘট পালিত হয়। সেই সঙ্গে ছাত্রদের বিক্ষোভ-মিছিল শহরের প্রধান সড়কগুলাে প্রদক্ষিণ করে প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে।
তার বিবরণ, ‘১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে এ আন্দোলন আবার বেগবান হয়ে ওঠে। তবে ঘটনাদৃষ্টে মনে হয়, মেহেরপুরে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত রূপ ধারণ করে ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় বহু ঘােষিত কর্মসূচির আহ্বানে। গঠিত হয় ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম কমিটি’।
ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার সংবাদ মেহেরপুরে পৌছে যাওয়ার পর সক্রিয় হয়ে ওঠে মেহেরপুরের ছাত্রসমাজ।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও নুরুল আমিনের পদত্যাগের দাবিসহ পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে ২১ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুরে প্রতিবাদ সমাবেশ আহ্বান করা হয়।
শুরু হয়ে যায় মেহেরপুরে একুশের ভাষা আন্দোলন। স্কুলছাত্রদের ক্লাস বর্জন, বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভার মধ্য দিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুরে ভাষা আন্দোলনের তৎপরতা শুরু হয়। এ সম্পর্কে পত্রিকার সংবাদ, ‘মেহেরপুর উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ের ছাত্ররা গত ২২ শে ও ২৪ শে ফেব্রুয়ারী হরতাল পালন করে।…উক্ত দুই দিবসব্যাপী তাহারা বিরাট শােভাযাত্রা ও জনসভা করে। শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” প্রভৃতি ধ্বনি উচ্চারণ করে। জনসভায় সভাপতিত্ব করেন মি. আবুল কালাম।’ (নরুল ইসলাম)
এ সম্পর্কে কিছুটা বিশদ বিবরণ দিয়েছেন পূর্বোক্ত ছাত্রনেতা ইসমাইল হােসেন। তাঁর মতে, ছাত্ররা নানাবিধ প্রতিবাদী তৎপরতার সূচনা ঘটায়।
ইসমাইল হােসেন জানাচ্ছেন, একই সঙ্গে মুন্সী সাখাওয়াত হােসেনের নেতৃত্বে আওলাদ হােসেন, কাওসার আলী, ইসমাইল হােসেনসহ মেহেরপুর স্কুলের ছেলেরা পােস্টারিং, পিকেটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি একটি মিছিল শহর প্রদক্ষিণকালে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেও ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি। ওই দিন আবুল কালামের সভাপতিত্বে কালাচাদ হলের সামনে সমাবেশ হয়। সমাবেশে সরকারের নীতিনির্ধারণের সমালােচনা ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তাঁরা বক্তব্য রাখেন।
এভাবেই বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার ডাকে পূর্ববঙ্গের পশ্চিম প্রান্তিক শহর মেহেরপুরে ব্যাপক উত্তেজনার মধ্যে ছাত্র-জনতার সমন্বিত পদচারণে একুশের ভাষা আন্দোলন শেষ হয়। কিন্তু ভাষার দাবি অপূর্ণ থাকায় গােটা প্রদেশের মতাে মেহেরপুরেও আন্দোলন শেষ হয়েও হইল না শেষ। ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা শহরের মতােই মেহেরপুরেও শহীদ দিবস পালিত হয় ভাষার প্রতি মমতা নিয়ে, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে—গভীর আবেগে।
কিন্তু সরকারি প্রশাসন, স্কুল কর্তৃপক্ষ বিগত বছরের মতােই আন্দোলনবিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করে। বলা যায়, কঠোর দমননীতি চলে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ক্ষমতাও ব্যবহার করা হয়। এর প্রমাণ ১৯৫৩ সালে শহীদ দিবসের মিছিল ও সমাবেশে অংশগ্রহণ করার অপরাধে মেহেরপুর সরকারি বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র নজীর হােসেন বিশ্বাস এবং তার সহযাত্রী কদম রসুল, সামসুল আলা, আবুল কাসেম, ইসমাইল হােসেন প্রমুখের গ্রেপ্তার বরণের ঘটনা।
শহীদ দিবস পালনের এই ধারাবাহিকতা চলে ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি অবধি। লক্ষণীয় যে এ সময় স্কুলছাত্রীরাও মিছিল- সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। যেমন শুক্লা গাঙ্গুলির নেতৃত্বে রিপন গার্লস স্কুলের ছাত্রীরা পূর্বোক্ত মিছিলে অংশ নেয়। শিক্ষকদের বাধা অতিক্রম করে এভাবে মেহেরপুরে শহীদ দিবস উদ্যাপিত হয়। সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এ জাতীয় প্রতিবাদী আচরণের কারণে ১৯৫৫ সালে শহীদ দিবস উদযাপনকালে আবুল কাসেম, নজীর হােসেন, সামসুল আলা, কদম রসুল, ইসমাইল হােসেন, মােশারফ হােসেন ও গােলাম কবির খানকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে অবশ্য শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের তদবিরে ওই বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়েছিল। ওই সাতজনের মধ্যে এখনাে জীবিত আছেন ভাষাসংগ্রামী নজীর হােসেন বিশ্বাস ও ইসমাইল হােসেন। তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত ভাষা আন্দোলনের এই বিবরণ সত্যি অবাক করার মতােই।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক