You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক কার্যক্রম
১. ভূমিকা পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের ভিন্নতা, বৈষম্য, নিষ্ঠুরতা ও ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণ বাঙালি জাতির মনে স্বাধীনতা অর্জনে অদম্য আকাক্ষার জন্ম দিয়েছিলাে। সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের কার্যকারণগত প্রেক্ষিত ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বজনমত গঠন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন এবং স্বীকৃতি আদায় ছিল বৈরী পরিবেশে অসম এক বাস্তবতা। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি অপরিহার্য হয়ে ওঠে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা। | বাংলাদেশের সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে জরুরি ও অবিলম্ব তৎপরতার সাফল্যই কেবল বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে নিশ্চিত করতে পারে একথাটি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক শক্তিকে পরাজিত করতে যেমন অপিরহার্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার করা তেমনি পাশাপাশি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী তাদের বিস্তৃত কাঠামােতে আঘাত করে ফলাফল করায়ত্ত করতে কর্মক্ষম ও উদ্যোগী ভূমিকা ছিল জরুরি। পাকিস্তান জন্মের পর হতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের এ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল না- কোথায় কোন্ অবস্থায় কী ধরনের কৌশল গ্রহণ করতে হবে তা তাদের অজ্ঞাত ও অবিদিত ছিল না। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী প্রতিটি রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরে যে বিভিন্ন জাতিসত্তার কিছু না কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড চালু ছিল সেক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্র দেশের অভ্যন্তরে চোখ রেখে পাকিস্তান হতে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে প্রকাশ্য সমর্থন ও সহযােগিতা করার বিষয়টি সর্বদাই মনস্তাত্ত্বিকভাবে তাদের নেতিবাচক দিকে তাড়িত করেছে।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে কোনাে রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি, সমর্থন বা সাহায্য সহযােগিতা করবে এটা কূটনৈতিক দিক থেকে ছিল অচিন্তনীয়। ১৯৭০ সালে নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা প্রদেশে জেনারেল ওজুকো স্বাধীনতা ঘােষণা করলেও তার করুণ পরিণতির বিষয়টি গভীর ক্ষতের মতাে তখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পরিসরে ক্রিয়াশীল ছিল। পাশাপাশি ভিয়েতনামের দীর্ঘদিনের লড়াই বিশ্বকে বিশেষকরে পরাশক্তিগুলােকে জড়িত করেছিল সে অভিজ্ঞতাও বিশ্বের রাষ্ট্রগুলাের সামনে দৃশ্যমান ছিল।
এই অবস্থায় বিশ্বব্যাপী দীর্ঘ ২৪ বছর যাবৎ কূটনীতিক ক্ষেত্রে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, মুসলিম দেশগুলাের সঙ্গে চুক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সমঝােতা, চুক্তি এবং পারস্পরিকভাবে কাঁধে হাত রাখার বন্ধন ছিন্ন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সদ্য স্বাধীনতা ঘােষিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি, সমর্থনদানের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাবে একথা ভাববার কোনাে কারণ ছিল না। এই অবস্থায় মুজিবনগর সরকারকে স্বাধীনতাযুদ্ধের পাশাপাশি নানা মাত্রিকতায় কূটনৈতিক যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল গ্রহণ করতে হয়। এই অধ্যায়ে মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন কূটনৈতিক কার্যক্রম আলােচিত হয়েছে।
২. কূটনৈতিক তৎপরতার প্রয়ােজনীয়তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের অপরিহার্যতা ছিল অনস্বীকার্য। এ লক্ষ্যে পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীর দীর্ঘদিনের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রহীনতা, সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী বাঙালি জাতিকে শাসন ক্ষমতা থেকে হটিয়ে রাখা এবং বাঙালি সংস্কৃতির বিলােপ সাধন করে জাতিসত্তাকে ধ্বংসের পরিকল্পিত পদক্ষেপ এবং ২৫শে মার্চে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্মম আক্রমণ, বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর ভারতে গমন, গণহত্যা ও মানবতাবিরােধী কর্মকাণ্ড বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বাঙালি জাতিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামােতে সার্বিকভাবে অবদমন করা হয়েছে তার অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ যে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল তার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন আবশ্যিক হয়ে পড়ে।
৩. কুটনৈতিক তৎপরতার সূচনা স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬শে | মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে। বারবার উদাত্ত আহ্বান জানানাে হয়। ২৭শে মার্চ জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য সহযােগিতার আহ্বান জানান। স্বাধীন বাংলা বেতার হতে বারবার জাতিসংঘ, বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ। বিশেষকরে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে সহযােগিতার আহ্বান জানানাে হয়। এই আহ্বানে তাৎক্ষণিক সাড়া পাওয়া যায়। ৬ই এপ্রিল নয়াদিল্লিতে কার্যরত দু’জন কূটনীতিক কে.এম, শেহাবউদ্দিন (সেকেন্ড সেক্রেটারি) এবং সহকারী প্রেস এটাচি আমজাদুল হক বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং যারা বাংলাদেশের নিরীহ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করছে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং বিশ্বজনমতকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি অনুধাবন করার আহ্বান জানান। তারা ভারত সরকারের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কলিকাতাস্থ পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশনার অফিসের ডেপুটি হাই কমিশনার এম. হােসেন আলী ১৮ই এপ্রিল পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের আনুগত্য ঘােষণা করেন। ১৭ই এপ্রিল প্রণীত হয় স্বাধীনতার সনদ। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয় নির্বাচিত গণ। পরিষদের সদস্যগণ স্বাধীনতার এই সনদে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘােষণা করেছেন যে, জাতিসংঘের চার্টার মােতাবেক মুজিবনগর সরকার দায়িত্ব কর্তব্য পালন করবে, বিশ্ববাসীকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়।” ৩ ক, তাজউদ্দীন আহমদের প্রাথমিক কূটনৈতিক তৎপরতা (এপ্রিল ১৯৭১)।
১০ই এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঐ দিন। জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি সাহায্য-সহযােগিতার। আবেদন জানান। তিনি ভাষণে বলেন: .আমরা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, তারা যেন স্বচক্ষে এবং সরেজমিনে দেখে যান যে, স্বাধীন বাংলাদেশ আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। সাথে সাথে আমরা সমস্ত বন্ধুরাষ্ট্র ও পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে ও ‘রেডক্রস’ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছি। যারা আমাদের সাহায্য। করতে ইচ্ছুক অথচ বর্বর ইসলামাবাদ শক্তি যাদের এই মানবিক কাজটুকু করবার বিরুদ্ধে নিষেধ উচিয়ে দাড়িয়েছে তারা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে সরাসরি। যােগাযােগ স্থাপন করতে পারেন। …বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রাগারের আধুনিক সরঞ্জামে। সজ্জিত জেনারেল ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী আজ আমাদের শান্তিপ্রিয় ও নিরস্ত্র বাঙ্গালীর কন্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার এক পৈশাচিক উন্মতায় মত্ত। আমরা সেই সব বৃহৎ শক্তিবর্গের। কাছে মানবতার নামে আবেদন জানাচ্ছি, যেন এই হত্যাকারীদের হাতে আর অস্ত্র সরবরাহ করা না হয়। …বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি, তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে-একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আর একটি। স্বাধীন দেশের মানুষের কাছে। এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে আমাদের স্বাধীনতা। সংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসাবে-হানাদারদের রুখে। দাঁড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসাবে, যে অধিকার মানব জাতির শাশ্বত অধিকার। বহু বছরের সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পত্তন করেছি। স্বাধীনতার জন্যে যে মূল্য আমরা দিয়েছি তা কোন বিদেশি রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হবার জন্যে নয়।
পৃথিবীর বুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি শান্তিকামী দেশ হিসাবে রাষ্ট্রপরিবার গােষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য। এ অধিকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্মগত অধিকার। … ইতিমধ্যে সােভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতবর্ষ এই নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছে এবং সােভিয়েত রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। গ্রেট ব্রিটেনও বাংলাদেশের এ অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয়েছে উঠেছে। যে সমস্ত পাকিস্তানি বিমান মৃত্যুর সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকায় আসার পথে জ্বালানী সংগ্রহ করছিল তাদেরকে জ্বালানী সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিংহল ও ব্রহ্মদেশ।  পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক এই ভাষণ প্রদানে কোনাে প্রকার জটিলতার প্রশ্ন ছিল না। কেননা, ১৯৬৯ সালে ১লা আগস্টে গৃহীত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচি, ঘােষণাপত্রে (ম্যানিফেস্টো) বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল, “সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব, বিদ্বেষ কাহারও প্রতি নয়” “আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই নীতিতে বিশ্বাসী। বিশ্বে শান্তি স্থাপনের বিভিন্ন প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ সর্বপ্রকার সহযােগিতা প্রদান করিবে। আওয়ামী লীগ জাতিসংঘ সনদের পূর্ণ সমর্থক এবং এই প্রতিষ্ঠানকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযােগিতা দান করিবে। আওয়ামী লীগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতিতে বিশ্বাস করে।
সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং একনায়কত্বমূলক শাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের প্রতি আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থন থাকিবে।” প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে উপস্থাপন এবং বিভিন্ন দেশ থেকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায়ের পদক্ষেপ মার্কিন সিক্রেট ডকুমেন্ট থেকে পরিলক্ষিত হয়। ১৩ই এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় ব্রিটেনের ডেপুটি হাই কমিশনার এবং মার্কিন কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠকে আগ্রহ প্রকাশ করলে প্রথম দিকে ব্রিটেনের পক্ষে সম্মতি জানানাে হয়। কিন্তু ঢাকা থেকে মার্কিন কর্তৃপক্ষ কলকাতায় কনসুলের সঙ্গে বৈঠকে অস্বীকৃতি জানায়। ঢাকা থেকে মনে করা হয়, এই বৈঠক বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে বলে ধারণা করা হতে পারে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টে ক্রিস্টোফার ভ্যান হেলেনের সঙ্গে। সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে যে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে তার কোনাে প্রতিনিধি যেন। মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করতে না পারে তার জন্য বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
১৫ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন গােপনে কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার হােসেন আলীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। দু-দফা বৈঠকে স্থির হয় যে, ডেপুটি হাই কমিশনার হােসেন আলী এবং ঐ কমিশনে বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ ১৮ই এপ্রিল একযােগে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করবেন।” ১৭ই এপ্রিল স্বাধীনতার সনদ অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে নবগঠিত সরকার শপথ গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা সনদে ঘােষিত হয়, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, প্রধান সেনাপতির ক্ষমতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার সদস্য নিয়ােগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে এবং বঙ্গবন্ধু ২৬শে মার্চ যে স্বাধীনতার ঘােষণা দেন তখন থেকেই তা কার্যকারিতা পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ১৭ই এপ্রিল বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে মন্ত্রীসভা এই শপথ অনুষ্ঠান মেহেরপুরে বৈদ্যনাথ তলায় অনুষ্ঠিত হয়। যার নতুন নামকরণ হয়, ‘মুজিবনগর’। শপথ অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা ঘােষিত হয়। স্বাধীনতা ঘােষণা সনদে উল্লেখ করা হয়, জাতিসংঘ চার্টার অনুসরণ করেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তার দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবে।

১৭ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক ভাষণে বৃহত্তর ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি আরাে বলেন, কোন ব্লক বা প্যাক্টে আমরা যােগদানে উৎসাহী না, কিন্তু যারা আমাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে শুভেচ্ছা ও সাহায্য করতে আগ্রহী তাদের কাছ

থেকে সহযােগিতা চাই। আমরা বিশ্বের দেশসমূহের নিকট স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি, বস্তুগত ও নৈতিক সাহায্য চাই আমাদের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে। প্রতিটি মুহুতের বিলম্ব হাজার হাজার মানুষের জীবন ও সম্পত্তি ধ্বংস হচ্ছে। মানবিক কার্যক্রমে যারা এগিয়ে আসবে তাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব অমলিন থাকবে।”
২৮শে এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিবেশী দেশসমূহের প্রতি অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান এবং বিনাশর্তে অস্ত্র সরবরাহ করার আবেদন জানান, যাতে পাকিস্তানের খুনি সামরিক বাহিনীর হাত থেকে নবরাষ্ট্র বাংলাদেশকে মুক্ত করা সম্ভব হয়।
৩ খ, কূটনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন
বিরাজমান অবস্থার প্রেক্ষিতে মুজিবনগর সরকারকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা গ্রহণ করতে হয়। যেমন :
ক. সরকারের পক্ষ হতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ, খ. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন, গ. এ লক্ষ্যে পাকিস্তানে কর্মরত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিশেষকরে বিদেশি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত কূটনৈতিকবৃন্দকে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা ও কর্মে যােগদান, ঘ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দূতাবাস খুলে স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার, জনমত ও স্বীকৃতি।
আদায়ে তৎপর হওয়া, ঙ. বহির্বিশ্বে প্রচার প্রচারণা চালানাের জন্য প্রয়ােজনীয় প্রচারপত্র, নিবন্ধ, প্রতিবেদন ও প্রামাণ্য চিত্র তৈরি, চ, বাংলাদেশবিরােধী প্রচারের সমুচিত জবাবদান, ছ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধী যে কোনাে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করা, জ, সর্বোপরি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় ও জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি, এবং ঝ. মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার করার লক্ষ্যে সর্বক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার
করা। একই সঙ্গে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য সমন্বিত করা হয়। যেমন :
ক. সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারাে প্রতি বিদ্বেষ নয়, খ. রাজনৈতিক অবদমন, অর্থনৈতিক শােষণ ও বঞ্চনা এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন
অবসানে অঙ্গীকার, গ. জোটনিরপেক্ষ, সাম্রাজ্যবাদবিরােধী এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান এ তিনটি বিষয়
হবে বৈদেশিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, পৃথিবীত্রাসী ও আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্টকারী সকল প্রকার সামরিক চুক্তির বিরােধিতা, ও, সেন্টো এবং সিয়াটো চুক্তিসহ ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমন করার সহায়ক সকল

প্রকার সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ,

চ, সাম্রাজ্যবাদ ও নব্যসাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং ছােট দেশগুলাের উপর বহিশক্তির সর্বপ্রকার অশুভ প্রভাব নিরােধ প্রচেষ্টা এবং ছ, পারস্পরিক সমঝােতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সংলাপ প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশ বা জাতির মধ্যে বিরাজমান জটিলতার সমাধান। একই সঙ্গে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রশ্নে সকল পরাশক্তির সমর্থন প্রত্যাশা, এশিয়ার পুনজোটবদ্ধতার বিরােধিতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ, ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সংক্রান্ত প্রস্তাবের বিরােধিতা এবং বাংলাদেশ হতে পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী প্রত্যাহার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন। দেশে আবেদন ও অব্যাহত কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার।
১৯৭১ সালের জুন মাসে বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমেও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। আহমদ এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র নীতি ব্যখ্যা করেন। ১লা জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক নীতি নির্ধারণী বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। পাকিস্তানের কাঠামােতে কোন রকম আপােস-মীমাংসার প্রশ্নই উঠতে পারে না।” বহির্বিশ্বে বিভিন্ন মহলে বাংলাদেশ সমস্যার ‘রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে যেসব কথাবার্তা উঠেছে। তৎসম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জনাব তাজউদ্দীন উপযুক্ত ঘােষণা দেন। এই বিবৃতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান কাঠামাের আওতায় যে রাজনৈতিক সমাধান হবে না তার দ্ব্যর্থহীন প্ৰতিত্তোর দেওয়া হয়। বিদেশনীতি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, “আমাদের বৈদেশিক নীতি হবে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারাে সাথে শত্রুতা নয়।” তিনি বৃহৎ শক্তির নিশ্ৰুপ থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বর্তমান আমাদের সংকটময় সময়ে প্রতিবেশি বা যে কোন রাষ্ট্র যে ভূমিকা পালন করুক না কেন, আমাদের বিদেশ নীতির মূল কথা হল, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারাে সাথে শত্রুতা নয়।” এই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের বিদেশে প্রেরিত প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করে যাচ্ছে।
এ সময় পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামাের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করলে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৬ই জুন এক বেতার ভাষণে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি ব্যাখ্যা করে বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আটক সকল গণপ্রতিনিধিদের অবিলম্বে মুক্তিদান, বাংলাদেশের মাটি থেকে সামরিকবাহিনী। ফিরিয়ে নেওয়া, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শােষকশ্রেণি কর্তৃক এ যাবৎ বাংলাদেশ থেকে অপহৃত ধনসম্পদ ও গত আড়াই মাসের লড়াইয়ে হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের যে ক্ষতিসাধন করেছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে তা নির্ণয় করে লুষ্ঠিত ধন প্রত্যার্পণ ও পূর্ণ ক্ষতিপূরণের দ্বারাই কেবল রাজনৈতিক সমাধান আসতে পারে অন্যথা রাজনৈতিক সমাধানের কোনাে প্রশ্নই উঠতে পারে না। ৩ গ. কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার লক্ষ্যে গণপরিষদ অধিবেশন আহ্বান ১৯৭১ সালের ২০শে জুন কলকাতায় ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের যুগ্মসচিব অশোক রায়। যথাশীঘ্র বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে অনুরােধ করেন এবং অনাপত্তি না থাকলে ২৯শে জুন নাগাদ মেঘালয় রাজ্যের তুরায় এই অধিবেশনের আয়ােজন করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন। সময়ের। স্বল্পতা ও যােগাযােগের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে গণপরিষদের এই অধিবেশন ৬ই  ও ৭ই জুলাই শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠানের দিন ধার্য হয়। দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার উদ্দেশ্যে গৃহীত ব্যবস্থাদির ফললাভের আগেই নানা কারণে সন্দেহ, বিভক্তি, বিভ্রান্ত ও বিক্ষুদ্ধ জনপ্রতিনিধিদের সম্মুখীন হওয়া প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তথা । মন্ত্রিসভার জন্য সুখপ্রদ ছিল না। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত প্রায় ৩১০জন প্রতিনিধির এই সমাবেশে নীতিগত, ব্যক্তিগত, পারস্পরিক, আঞ্চলিক অভিযােগ ও অপপ্রচারের স্রোতধারাই ছিল অধিক প্রবল যুদ্ধ পরিচালনায় ত্রুটি-বিচ্যুতিও নিঃসন্দেহে ছিল সমালােচনার যােগ্য। এসব অভাব-অভিযােগ ও ত্রুটি-বিচ্যুতিকে অবলম্বন করে। কয়েকটি গ্রুপ উপদলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মন্ত্রিসভার ব্যর্থতাকে সামনে এনেছিল, যার  লক্ষ্য ছিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। লক্ষ্য ছিল তাদের পদত্যাগ। আওয়ামী লীগের ভেতরে একটি গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের যােগ্যতা এবং তার ক্ষমতা গ্রহণের বৈধতা নিয়ে নানা বিরুদ্ধ প্রচারণা চলতে থাকে। কর্নেল ওসমানীর বিরুদ্ধেও জিয়ার নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর একাংশ এই মর্মে প্রচারণা চালাতে থাকে যে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় তিনি অদক্ষ ও অক্ষম। প্রচারণা ছিল মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ভারতের মৌলিক অনীহা। কূটনৈতিক স্বীকৃতির প্রশ্নে তাদের নানা অজুহাত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষপর্যন্ত তাদের সমর্থন লাভ করবে কিনা তা-ও ছিল সন্দেহজনক আলােচ্য বিষয়। এসবের পেছনে খন্দকার মােশতাক চক্র সূক্ষ্মভাবে প্রচার চালাচ্ছিল। মন্ত্রীসভার বাইরে মিজান চৌধুরী গণপরিষদের অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের পদত্যাগ দাবি করেন এই বলে। যে, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রী হলে গঠনতন্ত্র মােতাবেক তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকতে পারেন না এবং মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে বিষয়গত ও বস্তুগত দুর্বলতার প্রশ্ন উত্থাপন করেন। 
রতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে দৃঢ়। সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে গণ-পরিষদ সদস্যদের মতামত, সরকারের প্রতি তাদের আস্থা পরীক্ষা। ও স্বাধীনতা অর্জন বিষয়ে তাদের প্রকৃত মনােভাব অবগত হওয়া ছিল জরুরি। গণপরিষদের এই অধিবেশন ৬ ও ৭ই জুলাই শিলিগুড়ির বাগডােগরাতে অনুষ্ঠিত হয়। ইন্দিরা গান্ধীর আসন্ন বিদেশ সফর, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদের অভ্যন্তরে নড়বড়ে অবস্থা, সেনাকাঠামােয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক উপনির্বাচন ও শরণার্থী। প্রত্যাবর্তনের পদক্ষেপ এবং আওয়ামী নেতৃত্বের উপদলীয় কোন্দল, কতিপয় বাঙালি সদস্যের পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন ও আত্মসমর্পণ ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। এ খবরও ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান হতে ৭০ এর নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। ভারত সরকারের নিকট এমনও প্রমাণ ছিল যে, সামরিক বাহিনীর, এমনকি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কতিপয় সদস্য পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী। কনফেডারেশন গঠনের কূটনৈতিক তৎপরতা তখনও অব্যাহত ছিল।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলাদেশের সরকারকে কার্যকর সামরিক ও রাজনৈতিক সর্বোপরি কূটনৈতিক সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রে ভারতকে সর্বদিক নতুন করে ঝালাই করে নিতে হয়। জাতীয় পরিষদের ১১০জন ও প্রাদেশিক পরিষদের আনুমানিক ২০০ জন সংসদ সদস্য সেদিন গণপরিষদ অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। শপথ নেওয়া হয়, “শত্রুকে জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে চিরদিনের মতাে পরাস্ত করেই স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে হবে।” প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, “আমরা যদি ভুল করে করে থাকি তবে দেশ। স্বাধীন হলে আপনারা আমাদের বিচার করবেন এবং আপনাদের রায় মাথা পেতে নেব।” “পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতীত কোন কিছুই গ্রহণযােগ্য নয়।” অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বললেন : “মনে রাখবেন বর্তমান মুহূর্তে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রয়ােজন ঐক্যের। আপনাদেরকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যদি আমাদের নীতি ও আদর্শ থেকে কোনদিন বিচ্যুতি দেখেন, আপনারা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবেন। কিন্তু বাংলার এই সংকট মূহুর্তে, জাতির স্বাধীনতার এই ক্রান্তিলগ্নে যেখানে শত শহীদের রক্তে ইতিহাস লেখা হয়েছে, আর যেখানে হাজার হাজার সৈনিক বন প্রান্তরে ইতিহাস লিখে চলেছে, সেই মুহুর্তে আর একবার আপনারা আস্থা স্থাপন করুন।” অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম-এর ভাষণ ছিল অত্যন্ত আবেগপূর্ণ এবং মর্মস্পর্শী। তিনি বললেন। “আপনারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ বিশ্বাস করে তাদের দায়িত্ব আপনাদের ওপর অর্পণ করেছিল। আপনারা সবাই বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিক বৈ আর কিছু নন। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ দিনের সহচর হিসাবে তাঁর জীবনব্যাপী আদর্শ আর সংগ্রামের আমরা ধারক ও বাহক। আদর্শের জন্য, নীতির জন্য, নেতার কাছে আর বাংলার মানুষের কাছে দেয়া প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য এই ধরনের অটুট মনােৰল আর কোন দেশের জনপ্রতিনিধিরা দেখাতে পেরেছেন কিনা তার নজির আমার জানা নেই। আপনাদের বীরত্ব, আদর্শনিষ্ঠা, মনােবল ও ত্যাগের জন্য আমি অভিনন্দন জানাই। আপনারা গৃহহারা, সর্বহারা হয়ে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করেছেন তাই আপনাদের প্রতি আমার অকুণ্ঠ আন্তরিক সালাম আর অভিনন্দন।” | তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু যদি গ্রেপ্তার হন, তবে স্বাধীনতা ঘােষণা তিনি করেই যাবেন। আর এই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম করে যেতে হবে। বিভিন্ন প্রচারণার জবাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দৃঢ় ভাবে ঘােষণা করেন, “ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং এর জন্য যে সব ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে তার ফল সঞ্চারের জন্য ৩-৪ মাস সময় প্রয়ােজন, এর জন্য অধৈর্য হয়ে পড়লে চলবে না।” তার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল ডিসেম্বরের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে!

গণপরিষদে প্রকাশ্যে আলােচনা ও পরবর্তী পর্যায়ে স্থির হয় সাবেক নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটি নয়, বরং সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিকেই অতঃপর দলের বৈধ নেতৃত্ব হিসেবে গ্রাহ্য করা হবে। বিভ্রান্তি ও অনৈক্য সৃষ্টির নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান এবং মন্ত্রিসভার সমর্থনে সর্বসম্মত আস্থা জ্ঞাপনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। সার্বিক অর্থে গণপরিষদ অধিবেশনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব ঐতিহাসিক। এই অধিবেশনের এক সপ্তাহের মধ্যে সেক্টর কমান্ডারগণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিক আনুগত্য ও শপথ গ্রহণ করেন। শুরু হয় নব উদ্যমে যুদ্ধজয়ের গৌরবগাঁথা। অঙ্গীকারে রক্তস্নাত শপথ : “যে কোন মূল্যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”  জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন গণপরিষদ অধিবেশন, কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত পর্যালােচনা করা হয়নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গণপরিষদের এই অধিবেশন ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট।

৩ ঘ, প্রাথমিক সাফল্য অর্জন। মুজিবনগর সরকার কূটনৈতিকভাবে নিজেদের ভাবমূর্তি যথাসম্ভব তুলে ধরতে সক্ষম হন। এবং আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও তাদের আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযােগ্যতা অর্জন করেন। মার্কিন সিনেটর কেনেডি যখন তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে দেখা করতে আসেন তার মাধ্যমে এই সরকারের গ্রহণযােগ্য ভাবমূর্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। অশােক রায়ের বর্ণনা মতে ; “কেনেডি সাহেব একটা গেট দিয়ে রাজভবনে ঢুকলেন। এমন ব্যবস্থা করেছিলাম তাজউদ্দীন সাহেব, খন্দকার মুশতাক আহমেদ সাহেব এলেন এবং দেখা হল। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। যে জিনিসটা হলাে কেনেডি ঘরে ঢােকার পর পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম, উনি হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। মি. কেনেডি বললেন, আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি টু মিট ইউ মি, প্রাইম মিনিস্টার।”
এটা নিছক কথা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও কংগ্রেসের ভেতরে আলােচনা হয়েছে। সে যাই হােক উনি কথা বললেন বেশ অন্তরঙ্গভাবে। সব কথা বেশ খুটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্বােধন করা অশােক রায়ের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ঠেকেছিল।
৪. মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রতিবন্ধকতা ৪. ক. মুজিব বাহিনী মুজিবনগর সরকার দায়িত্ব পরিচালনা করতে গিয়ে এক জটিল পরিস্থিতির মুখােমুখি হতে হয়। মুক্তিবাহিনীর সমান্তরাল মুজিব বাহিনী সৃষ্টি এবং বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সামরিক বাহিনীকে কমান্ডভুক্তকরণ এবং ভারতে ও বহির্বিশ্বে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করার পাশাপাশি সরকারের অভ্যন্তরে পাকিস্তান ও মার্কিন চক্রান্তকে প্রতিহত করার কঠিন অথচ নীরব কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ মুজিবনগর সরকারকে উদবিগ্ন করে তােলে। ৩১শে মার্চ ভারতের লােকসভা পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে
সমর্থন করে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। এসময় কলকাতায় উপস্থিত তরুণ-যুব নেতৃত্বের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা বদ্ধমূল হয় যে নিশ্চয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধকে সহযােগিতা করার লক্ষ্যে ভারত সরকারের সঙ্গে পূর্বে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যুব সংগঠনের চার নেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান,আব্দুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমদ দাবি করেন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু তাদের উপর ন্যস্ত করেছেন। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে তখন একটি কথা পরিষ্কার হয়ে আসে যে, অসহযােগ আন্দোলনের কোনাে এক পর্যায়ে এই চার নেতার অধীনে সশস্ত্র যুবকরা প্রশিক্ষণ নেবে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তারা নিজেরাও সীমান্ত অতিক্রম করার পর প্রকাশ্যে দাবি করতে থাকেন যে সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন এবং পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল তাদের চার জনের উপরই দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। অন্য কারও উপর নয়। একই সঙ্গে তারা বিপ্লবী কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জোর দাবি জানায়। তারা বিকল্পভাবে মুজিব বাহিনী গঠন করেন। এর ফলে মুজিবনগর সরকারকে অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
৪.খ, খন্দকার মােশতাকের চক্রান্ত বাংলাদেশ সরকারের জন্য যে-দ্বন্দ্বটি সবচেয়ে বেশি দুর্ভাবনা সৃষ্টি করে সেটি হচ্ছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাকের পক্ষ হয়ে তার সমর্থকদের মার্কিনীদের সাথে আলাদাভাবে যােগাযােগ স্থাপনের প্রক্রিয়া। মুজিবনগর সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতে এই ঘটনা জানাজানি হবার পর খন্দকার মােশতাককে তার কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়। এ বক্তব্য কেবিনেট সচিব হােসেন তৌফিক ইমাম ও খন্দকার আসাদুজ্জামানের। এ প্রসঙ্গে হােসেন তৌফিক ইমাম বলেন : বাংলাদেশে থেকে যে প্রতিনিধিদল বিদেশে যাবার কথা ছিল, তার নেতৃত্ব দেবার কথা স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমেদের। এরা রওয়ানা হবার বেশ কিছুদিন আগেই বিভিন্ন গােপন সূত্রে খবর পেলাম যে খন্দকার মােশতাক এবং যে প্রতিনিধি এখান থেকে যাচ্ছেন এবং পাকিস্তান থেকে যে দল যাবে তার নেতৃত্ব দেবেন শাহ আজিজুর রহমান। তারা ওখানে গিয়ে মিলিত হবেন এবং একটি আপােষ ফর্মুলা করে একটা মিত্রসংঘ করবেন। এটি কিন্তু তখনই একবারে মূলােচ্ছেদ করা হয়। খন্দকার মােশতাককে আর যেতে দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ থেকে কোনাে প্রতিনিধি দল গেলেও এবং মীমাংসার প্রশ্নও ওঠেনি। কারণ আমরা জানতাম যে এখানে যুদ্ধ ছাড়া এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া ছাড়া আর কোনাে বিকল্প ছিল না। খন্দকার মােশতাকের অনুপস্থিতিতে ভিন্নভাবে এ বিষয়টি কখনাে মন্ত্রিপরিষদে আলাপ হয়নি। আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন-এর কাছে শুনেছি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে শুনেছি এরকম ষড়যন্ত্র হতে যাচ্ছিল, এবং এটিকে এভাবে ঠেকানাে হলাে। কিন্তু এ সম্পর্কে প্রকাশ্যে আলােচনা কখনাে হয়নি।
খন্দকার আসাদুজ্জামান বলেন :
“খন্দকার মােশতাক এবং তার সাথে মাহবুব আলম চাষী, এই দু’জন সম্পর্কে তখন নানা আলাপ-আলােচনা, গুজব চলছিল। খন্দকার মােশতাক-এর গতিবিধি ও কথাবার্তা একটু সন্দেহজনক ছিলাে। আমরা তখন এদের সম্পর্কে একটু সতর্কতা অবলম্বন করছিলাম । ভারতীয় সরকারও এই সম্পর্কে অনেকটা জেনে গিয়েছিলেন। মােশতাক-এর পরিকল্পনা ছিল যে বিদেশ সফরের নাম করে কোনােভাবে যদি তিনি ঐ জায়গা থেকে। বের হয়ে আসতে পারতেন, তবে পাকিস্তানিদের সাথে একটা সমঝােতা করার একটা। উদ্যোগ তিনি নিতেন। সেটা শেষ পর্যন্ত তিনি করতে পারেননি। কারণ মুজিবনগর। সরকার এটা বুঝতে পেরে খন্দকার মােশতাক যেন বিদেশ যেতে না পারেন সেই ব্যবস্থা করেছিলেন। তাদের গতিবিধির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এবং তার সাথে তার যারা সহযােগী নেতৃবৃন্দ ছিলেন বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা আরও ছিলেন, তাদের যে স্বাধীন বাংলার ধারণা আর মােশতাক সাহেবের স্বাধীন বাংলার ধারণা এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের দলিল থেকে জানা যায় যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কাজী জহিরুল কাইয়ুম মার্কিন দূতাবাসের সাথে যােগাযােগ করেন এবং প্রস্তাব করেন যে, যেহেত পাক-ভারত যুদ্ধের পরিণতিতে বহু মানুষ মারা যাবে, ক্ষয়ক্ষতি হবে, তিনি খন্দকার মােশতাকের পক্ষ হয়ে পাকিস্তানের সাথে আলােচনার জন্যে একটি সমঝােতা প্রস্তাব পেশ করতে চান।
এ প্রস্তাবের মধ্যে অবশ্য একটি দিক ছিল যে, যে সমাধান হােক না কেন শেখ মুজিবকে অবশ্যই এর সঙ্গে জড়িত রাখতে হবে। এ ধরনের একটি আলােচনার প্রস্তাব মার্কিনীদের হাত হয়ে ইয়াহিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছিল এবং তিনি আলােচনা করতে রাজি হয়েছিলেন। পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দিল্লিতে যখন এই বিষয়ে আলােচনা হয় তখন তিনি বলেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনাে আপােষ করা হবে না। এক পর্যায়ে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে। দূতাবাসের এক কর্মকর্তার আলাপ হয় এবং সেখানে খন্দকার মােশতাক বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পাকিস্তানের ওপর তাদের প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তুরান্বিত করা।” আমীর-উল ইসলাম তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে খন্দকার মােশতাক তাকে বলেছিলেন, “হয় স্বাধীনতা, হয় শেখ মুজিব, দুটোর একটা বেছে নিতে হবে। তিনি এটা শুনে খুব মর্মাহত হন। এ সম্পর্কে একটি লিফলেট বিলি করা হয়েছিলাে। সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানাের জন্য এটা করা হয়েছিল তা। মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা সবাই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এই লিফলেটের মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধী একটি চক্র সরকার ও দলের অভ্যন্তরে সক্রিয় ছিল। | জহিরুল কাইয়ুম বামবিরােধী বা মার্কিনঘেঁষা। খন্দকার মােশতাক এদের নেতা। দলিল মতে, মার্কিনীদের সাথে আলাপকালে কাইয়ুম বলেছেন যে মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বামদের হাতে চলে যাচ্ছে এবং যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বামরাই ক্ষমতায় আসতে পারে। এমন ভাবনা অনেকেরই ছিল এবং মুজিব বাহিনীর একটা অংশ বামভাবনা প্রভাবিত ছিল। এটা তারা মুজিববাহিনীর বাম অংশকে বুঝিয়েছিলেন। তাছাড়া চীনপন্থি বামরাও বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় ছিলাে। যদিও তারা প্রতিপক্ষ অবস্থায় ছিল না, দীর্ঘ যুদ্ধ হলে কে ক্ষমতায় থাকবে এটা নিয়ে দুর্ভাবনা হতে পারে ডানপন্থিদের। মার্কিনীরা বামদের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর ছিলাে। বাম শক্তি সম্পর্কে মার্কিন সরকারি মহলে যথেষ্ট দুর্ভাবনার কারণ ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র খন্দকার মােশতাকের সাথে আলাপের পর অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর সাথেও আলাপ করতে আগ্রহী হয়। তবে তাজউদ্দীন আহমদ মার্কিনীদের সাথে যােগাযােগ করতে রাজি হন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম যােগাযােগের ক্ষেত্রে কৌশল গ্রহণ করে বলেন, মার্কিন পলিটিক্যাল অফিসারের সঙ্গে আলােচনার জন্য তাকে ভারত সরকারের কাছ থেকে অনুমতি লাভ করতে হবে। মার্কিন দলিলেও শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে কোনাে সমঝােতা বা আলাপ প্রস্তাবে উল্লেখ নেই। ২৩শে সেপ্টেম্বর জহুরুল কাইয়ুম একজন সংবাদ বাহককে যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল-এর নিকট প্রেরণ করে বলেন, ভারত সরকার এই যােগাযােগ সম্পর্কে জেনেছে এবং এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। ২০শে অক্টোবর বাংলাদেশের কূটনীতিবিদ হােসেন আলী কলকাতার মার্কিন কনসালের নিকট বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের উপরে শেখ মুজিবের মুক্তি ও অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি উত্থাপন করেন। এরপর বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক যােগাযােগ স্থগিত হয়ে যায়।
২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের কলকাতাস্থ কনসালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বলেন, এসব আলােচনা ফলপ্রসু হবে না যদিও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আকাক্ষা অনুসারে প্রভাব বিস্তার না করে, মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে এবং যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত। ১৬ই অক্টোবর জহুরুল কাইয়ুম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কনসাল জেনারেলের সঙ্গে বৈঠকে অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, ভারত এতে আপত্তি দিয়েছে। খন্দকার মােশতাকের আগ্রহ সত্ত্বেও এভাবে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধানের আলােচনা ভেঙ্গে যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহযােগিতার বিষয়ে জনাব জহিরুল কাইয়ুম মার্কিন কনসালকে বলেন যে, “He and many others in the Awami League would walkout from the Bangladesh Government rather than ‘Sellout to India.’ Further more he added, “We do not want the Indian army in our country any more than we want the Pak army.২ ভারতে অবস্থান করে এবং ভারত সরকারের সার্বিক সহযােগিতা পাবার পরেও আওয়ামী লীগের একজন নির্বাচিত প্রতিনিধির এ ধরনের বক্তব্য অন্তর্দলীয় কোন্দলকে উস্কে দেওয়া ছাড়াও শত্রুপক্ষকে অনেক ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ ২৮শে সেপ্টেম্বর ১৯৭১ কলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিসে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা পলােঅফ-এর সাথে ৯০ মিনিটব্যাপী এক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকের সময় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হােসেন আলীকে ঘরের বাইরে রাখা হয়। বৈঠককালে মােশতাক যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে বলেন। আলােচনার এক পর্যায়ে। তিনি আরও বলেন যে, “I know Yahya, I know hir to be a good man and I think he knows that I am a good man.” ইয়াহিয়া খানের প্রতি মােশতাকের এ উচ্চ ধারণা স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ক্ষেত্রকে জটিল করে তােলে।

১৯৭১ সালের ২৭শে নভেম্বর মােশতাকের প্রতিনিধি জহিরুল কাইয়ুম আকস্মিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল অফিসের এক কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতে ভারত

সরকার মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতায় কীভাবে কাজ করছে সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয় । তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি ডি.পি, ধরের সাথে মােশতাকের আলাপ-আলােচনার। প্রসঙ্গও স্থান পায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মােশতাকের যােগাযােগকে ডি.পি, ধর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বাঘাতকতা বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু মােশতাক সব অভিযােগ অস্বীকার করে বলে। কাইয়ুমের সাক্ষ্যে পাওয়া যায় । জহিরুল কাইয়ুমের উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন কনসাল অফিস। উল্লেখ করে যে, “He (Zahirul Qaiyum) and his group in Awami League did not intend to be dictated to by GOI (Government of India) and in addition he had threatened to wallkout on BDG (Bangladesh Government) along with some 43 supporters and go to Pakistan rather than Sell out’ to India,”” জহিরুল কাইয়ুমের এ বক্তব্যে আরও পরিষ্কার হয় যে, তারা মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার বিরােধী। ছিলেন। কিন্তু ভারতের সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাক্ষা তখন পর্যন্ত ছিল। অবাস্তব। ভারতের সাথে পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে আদর্শগত মিল থাকায় মুজিবনগর সরকার ভারতের সাহায্য কামনা করে। কিন্তু খন্দকার মােশতাক, কাইয়ুম ও কয়েকজন নেতা ভারতে অবস্থান করে ভারতীয় সহায়তার বিরােধিতা করেন। এটা প্রকারান্তরে বাংলাদেশ বিরােধিতার শামিল বলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে মনে করা হয়। এ সমস্ত কারণে সরকারের অভ্যন্তরে বিরােধ চরম আকার ধারণ করে।
খন্দকার মােশতাক যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে সরাসরি যােগাযােগ স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্র গমনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু মার্কিন সরকার তাকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রটোকল দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যুক্তরাষ্ট্র খন্দকার মােশতাককে লন্ডন বা প্যারিসে গিয়ে পাকিস্তানের সাথে কথা বলার জন্য পরামর্শ দেয়।” মােশতাক পাকিস্তানের সাথে যােগাযােগ রক্ষার জন্য শেখ মুজিবের মুক্তি চাইতেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে ।

খন্দকার মােশতাকের পাকিস্তান সম্পৃক্ততার বিষয়টি মুজিবনগর সরকারের নিকট অজ্ঞাত ছিল না। পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে মােশতাক জনাব মাহবুবুল আলম চাষীকে নিয়ােগ দেন। এ নিয়ােগ মােশতাকের পছন্দের ছিল। কিন্তু মাহবুবুল আলম পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের মধ্যে কট্টর পাকিস্তানপন্থি ছিলেন। পাকিস্তানের সাথে যােগাযােগের ক্ষেত্রে মােশতাক মাহবুবুল আলম চাষীকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। এ জন্য পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী তাকে এ পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে আব্দুল ফতেহকে পররাষ্ট্রসচিব নিয়ােগ দেন। খন্দকার মােশতাক অত্যন্ত চতুরতায় তার মিশনকে সফল করতে অনুগত ব্যক্তিদের তিনি মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ােগে অনেকটা সফলকামও হন। কুমিল্লা অঞ্চল থেকে নির্বাচিত এম,এন.এ. তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য। তিনি তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। এ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা ছিলেন আব্দুল মান্নান এম,এন,এ.। ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম দিকে আব্দুল মান্নান সরকারি কাজে কলকাতার বাইরে গেলে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বেতার কেন্দ্রের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালােচনার জন্য একটি বৈঠক ডাকেন। তাহের ঠাকুর বেতার স্টুডিওতেই অবস্থান করতেন। আব্দুল

মান্নান কলকাতায় ফিরে এসে তার এ কর্মকাণ্ড পছন্দ করেননি। তখন ঠাকুর পার্ক সার্কাসে বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবনে মােশতাকের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেন। এর কিছু দিন পরই বেতারকর্মীরা বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। ৩ দিনের এ ধর্মঘট এক গােপন মহলের প্রচেষ্টায় হয়েছিল বলে এম.আর, আকতার মুকুল উল্লেখ করেছেন। এই ‘গােপন মহল’ কারা তা সহজেই বােধগম্য। তাহের ঠাকুর স্টুডিও থেকে চলে গিয়ে পার্ক সার্কাসে অবস্থান নিলেও তিনি সুকৌশলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ নিজেদের জীবন দিয়ে দেশ রক্ষার জন্য যুদ্ধ করছিল সেখানে ধর্মঘট করার মতাে অনভিপ্রেত ও হঠকারী কর্মকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধকেই বিপদগ্রস্ত করার নামান্তর।
৪ গ. সমঝােতার প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে সংকট সৃষ্টির চেষ্টা রাজনৈতিক সমাধানের আপ্তবাক্য উচ্চারণের আড়ালে চক্রান্ত চলতে থাকে। মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে সি, আই. এ.’র নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত, তার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদকে দিয়ে স্বাধীনতার চেয়ে কম’ অর্থাৎ কনফেডারেশন গঠনের ফর্মুলায় সম্মত করাতে সচেষ্ট ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতা চাও, না বঙ্গবন্ধুকে চাও,’ এই স্লোগান ও লিফলেট ছড়িয়ে স্বাধীনতার মূলশক্তি টগবগে তরুণ মুজিব ভক্তদের বিভক্ত করার দুরভিসন্ধি চালানাে হয়। স্বাধীনতার মূলে কুঠারাঘাত করার সিআইএর চক্রান্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের গােচরীভূত করেন। তখন থেকে মন্ত্রীপরিষদে খন্দকার মােশতাকের ভূমিকা গৌণ, কর্তৃত্ব খর্ব হয় এবং তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়েন। অস্থায়ী। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর যৌথ সিদ্ধান্তে পররাষ্ট্রসচিবের পদ হতে মাহবুব আলম চাষীকে সরিয়ে দেওয়া হয়। 

ইতােমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফমুর্লা অনুসারে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতিনিধি একটি সমঝােতার প্রস্তাব করলে বাংলাদেশ সরকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, অখণ্ড পাকিস্তানের আওতায় আলােচনার কোনাে সুযােগ নেই। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ. এইচ, এম, কামারুজ্জামান ৩০শে মে এক বিবৃতিতে ইয়াহিয়া খানের সমঝােতার প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, “সমঝােতার প্রশ্নই উঠে না। তিনি বিশ্বের যে সকল রাষ্ট্র শান্তিকামী ও গণতান্ত্রিক নাতি ও মূল্যবােধে প্রচার ও প্রয়ােগ করে তাদের উচিত পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জনগণকে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করা।” ৫, সামরিক বিজয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত প্রতিনিধি দু’জনের বক্তব্যের ব্যবধান থেকে এটা উপলব্ধি হয় যে, সরকারের অভ্যন্তরীণ বিরােধ বেশ প্রকট ছিল। প্রধানমন্ত্রী যেখানে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সব সম্ভাবনাকে বাতিল করে শুধু যুদ্ধের মাধ্যমে সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অন্তরায় ছিল। কারণ ৫ ও ৬ই জুলাই (১৯৭১) শিলিগুড়ির সভায়ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার শপথ নেন এম এন.এ., এম.পি.এ বৃন্দ। এরপরই মূলত যুদ্ধ ক্ষেত্রকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও সামরিক বিজয়ের উপর গুরুত্ব দেন। ১৯৭১ সালের ৩০শে জুন স্বাধীন বাংলা বেতারে তিনি বলেন, “Freedom fighteres would give a befitting reply on the battle field to Gen. Yaya Khan’s audacity”.

৬. মুজিবনগর সরকারের প্রতি বাংলাদেশি বিভিন্ন দল ও ব্যক্তির ভূমিকা। ২৯শে আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘পলিসি প্লানিং কমিটি’-র চেয়ারম্যান ডি.পি. ধর-এর কলকাতায় মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে আলােচনায় ব্যর্থতা প্রকাশ পায় যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলােকে একটি জাতীয় ফোরামে একত্রিত করা জরুরি। এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বাম দলগুলাে স্বাধীনতা সংগ্রামে কাঠামােগতভাবে সংযুক্ত করা যাতে এই সংগ্রাম জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে রূপ পরিগ্রহ করে। ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির ফলে সােভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন পেতে হলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের তাত্ত্বিক বন্ধনে রণনৈতিক বিবেচনায় অগ্রসর হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো সফর শুরু করার পূর্বে জাতীয় মাের্চা গঠন করার তাৎপর্য বিশেষভাবে বিবেচিত হয়। এরকম একটি মাের্চা গঠন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একাংশের কোনাে সময় মনপুত হয়নি। যার ফলে এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের কিছু অংশকে ক্ষুদ্ধ করে তােলে। তারপরেও বিরাজমান পরিস্থিতিতে মন্ত্রীসভা জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। উপদেষ্টা কমিটি গঠন করার লক্ষ্য যাই থাক না কেন এটা কোনাে কার্যকরী কাঠামােগত রূপ যেমন নিতে পারেনি তেমনি সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এই কমিটির সীমায়িত বাস্তবতা ছিল মূলত মুজিবনগর সরকারকে মুক্তিসংগ্রামে পরামর্শ দান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এর সম্পর্কে ১০ই সেপ্টেম্বর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণ প্রচারিত হয়।
ন্যাপ (মােজাফফর)।
১৯৭১ সালের ২০শে এপ্রিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর প্রেসিডেন্ট মােজাফফর আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন: | আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘােষণা করছি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে তা বাংলাদেশের বৈধ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার। আমরা সমগ্র বিশ্বের নিকট আবেদন জানাচ্ছি, সাংবিধানিকভাবে গঠিত সরকার ও নবজাত রাষ্ট্রকে নৈতিক ও বস্তুগত সমর্থনের জন্য। এ প্রসঙ্গে আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, বিশ্বের যে সমস্ত গণতান্ত্রিক শান্তিকামী দেশ বিশেষকরে ইন্ডিয়া এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন যে সমর্থন ও সহযােগিতা করছে তার প্রতি। হাজার নিরীহ মানুষ, নারী এবং শিশুদের গণহত্যা করা হচ্ছে তা বন্ধ করতে জাতিসংঘকে যেন চাপ প্রয়ােগ করে।
কূটনৈতিক দৃষ্টিতে এই বিবৃতি ছিল মুজিবনগর সরকারের প্রতি সরাসরি রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থান।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাপ ও তার ছাত্র সংগঠন ভারত সরকারের সক্রিয় সহযােগিতা পায়নি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বিশ্ব পরিসরে কূটনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত করতে সমর্থ হয়। প্রধানমন্ত্রীর অনুরােধে তিনি পরাশক্তিরাষ্ট্র, জাতিসংঘ বিশেষকরে চীনের প্রতি পত্র লেখেন। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এটা ছিল বিশেষ কার্যকর ও ফলপ্রসূ। তিনি ৭১ সালের ২১শে এপ্রিল বিশ্বের নেতাদের কাছে আবেদন জানান। এই নেতারা হচ্ছেন, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, প্রেসিডেন্ট মাও, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, ইউ,এস,এস, আর,-এর সেক্রেটারি জেনারেল ব্রেজনেভ, প্রেসিডেন্ট পােগনি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, যুগােশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত প্রমুখ।
ক, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে মওলানা ভাসানীর লিখিত পত্রে বলা হয়, সাড়ে সাতকোটি মানুষের পক্ষ থেকে আমি আবেদন জানাচ্ছি সামরিক বাহিনী ডিক্টেটর জেনারেল ইয়াহিয়া খান নিরীহ, নিরস্ত্র এবং অসহায় বর্ণ, ধর্ম, সম্প্রদায়, নারী, শিশু এমনকি সদ্যজাত শিশুকে হত্যা করছে, এই বর্বর নৃশংস কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আপনি কার্যকর ভূমিকা নেবেন। বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভাগ্য নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার ব্যবস্থা নেন। একই দিনে মওলানা ভাসানী চীনের চেয়ারম্যান মাও সে। তুং, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের দাবি জানান। ভারত সরকার তার এই সমস্ত চিঠিপত্র-তারবার্তা যথাস্থানে পাঠাবার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন।
খ, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিকট বাংলাদেশের এই প্রবীণ নেতার। আবেদন, “চীনের ও আপনাদের দেওয়া সামরিক সম্ভার দিয়ে স্বৈরাচারী একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া ‘বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ নিরীহ নরনারী শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। আপনি অবিলম্বে পাকিস্তানকে নতুন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করুন। বাংলাদেশ’ প্রজাতন্ত্রকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন। তাদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করুন।”

গ, চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুংকে মওলানা ভাসানী এক আবেগময় পত্র লেখেন। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রের আদর্শ হচ্ছে অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা। একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক চক্র বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর যে বর্বর অত্যাচার চালিয়েছে তা থেকে তাদের বাঁচাবার জন্য আমি আপনার নিকট আবেদন করছি। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থের সাহায্যে সামরিকচক্র বাংলাদেশের অত্যাচারিত জনগণের উপর পশুর মতাে যে বীভৎস আক্রমণ চালিয়েছে আপনার সরকার যদি তার প্রতিবাদ না করে তবে বিশ্ববাসীর এই ধারণাই হবে। যে, আপনি অত্যাচারিত জনগণের বন্ধু নন। বাংলাদেশের নিরাপরাধ জনগণের উপর।

কূটনৈতিক দৃষ্টিতে এই বিবৃতি ছিল মুজিবনগর সরকারের প্রতি সরাসরি রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থান।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাপ ও তার ছাত্র সংগঠন ভারত সরকারের সক্রিয় সহযােগিতা পায়নি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে বিশ্ব পরিসরে কূটনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত করতে সমর্থ হয়। প্রধানমন্ত্রীর অনুরােধে তিনি পরাশক্তি-রাষ্ট্র, জাতিসংঘ বিশেষকরে চীনের প্রতি পত্র লেখেন। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এটা ছিল বিশেষ কার্যকর ও ফলপ্রসূ। তিনি ৭১ সালের ২১শে এপ্রিল বিশ্বের নেতাদের কাছে আবেদন জানান। এই নেতারা হচ্ছেন, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, প্রেসিডেন্ট মাও, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, ইউ,এস,এস, আর,-এর সেক্রেটারি জেনারেল ব্রেজনেভ, প্রেসিডেন্ট পােগনি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, যুগােশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত প্রমুখ। | ক, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে মওলানা ভাসানীর লিখিত পত্রে বলা হয়, সাড়ে সাতকোটি মানুষের পক্ষ থেকে আমি আবেদন জানাচ্ছি সামরিক বাহিনী ডিক্টেটর জেনারেল ইয়াহিয়া খান নিরীহ, নিরস্ত্র এবং অসহায় বর্ণ, ধর্ম, সম্প্রদায়, নারী, শিশু এমনকি সদ্যজাত শিশুকে হত্যা করছে, এই বর্বর নৃশংস কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আপনি কার্যকর ভূমিকা নেবেন। বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভাগ্য নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার ব্যবস্থা নেন। একই দিনে মওলানা ভাসানী চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের দাবি জানান। ভারত সরকার তার এই সমস্ত চিঠিপত্র-তারবার্তা যথাস্থানে পাঠাবার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন।
খ, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিকট বাংলাদেশের এই প্রবীণ নেতার আবেদন, “চীনের ও আপনাদের দেওয়া সামরিক সম্ভার দিয়ে স্বৈরাচারী একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া ‘বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ নিরীহ নরনারী শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। আপনি অবিলম্বে পাকিস্তানকে নতুন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করুন। বাংলাদেশ’ প্রজাতন্ত্রকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন। তাদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করুন।” | গ, চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুংকে মওলানা ভাসানী এক আবেগময় পত্র লেখেন। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রের আদর্শ হচ্ছে অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা। একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক চক্র বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর যে বর্বর অত্যাচার চালিয়েছে তা থেকে তাদের বাঁচাবার জন্য আমি আপনার নিকট আবেদন করছি। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থের সাহায্যে সামরিকচক্র বাংলাদেশের অত্যাচারিত জনগণের উপর পশুর মতাে যে বীভৎস আক্রমণ চালিয়েছে আপনার সরকার যদি তার প্রতিবাদ না করে তবে বিশ্ববাসীর এই ধারণাই হবে। যে, আপনি অত্যাচারিত জনগণের বন্ধু নন। বাংলাদেশের নিরাপরাধ জনগণের উপর সামরিকচক্র যে নির্যাতন চালিয়েছে তার তুলনা আপনার দেশে চিয়াং কাইশেকের, রাশিয়ার জারের এবং স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনকালেও পাওয়া যাবে না। তিনি বলেছেন, “আপনি ভালভাবেই জানেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের পেছনে যে প্রকাশ্য জনসমর্থন রয়েছে, কম্বােডিয়ার সিহানুক সরকারের পিছনেও ততােখানি সমর্থন নেই। তাই আপনার নিকট আমার সনির্বন্ধ অনুরােধ, বাংলাদেশের স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক সরকারকে আপনি সমর্থন করুন, স্বীকৃতি দিন ও সর্বপ্রকারে সাহায্য করুন। বর্তমানে আমি ৮৯ বছরের বৃদ্ধ। আমার ৮৯ বছর বয়সে ইয়াহিয়া খানের বর্বর সৈন্যরা আমার সামান্য বাসগৃহ পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত আমার মূল্যবান বইগুলিও তারা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার বাড়িতে আগুন লাগাবার পর আমার পরিবারবর্গের ভাগ্যে কী ঘটেছে আমি জানি না।” ঘ. ২৫শে এপ্রিলের আনন্দবাজারে ‘রুশ নেতাদের কাছে ভাসানীর তারবার্তা’ শিরােনামে আর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অসহায় মানুষের উপর ইয়াহিয়া খানের ফৌজের বর্বরােচিত অত্যাচার বন্ধের জন্য ন্যাশনাল আওয়ামী দলের নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সােভিয়েট রাশিয়াকে আরাে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরােধ জানিয়েছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট পদগনী বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে-কথা বলেছেন, মওলানা ভাসানী তাকে স্বাগত জানিয়ে একটি বিবৃতিতে বলেন, ‘শুধু এই কথাতেই সব হল না, অবিলম্বে বসে একটি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।” 

ঙ, ১৫ই মে। বিশ্বের সকল রাষ্ট্র এবং বিশেষ করে ইয়াহিয়া খাঁর প্রতি মওলানা ভাসানীর চ্যালেঞ্জ, “যদি কারাে মনে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবি সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকে তা হলে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে গণভােটের ব্যবস্থা করতে পারেন। দেখবেন বাংলার শতকরা ৯৯ জনের বেশি লােক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। এই সময় ভাসানীর ‘পিকিংপন্থিত্বর ওপর জোর দেওয়ার কারণও রয়েছে। চীন পাকিস্তানকে সমর্থন দিচ্ছিল তার ভৌগােলিক অখণ্ড ও সংহতি রক্ষার স্বার্থে।” অন্যদিকে, চীনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার একজন অবিচল অনুরাগী মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থানকারী চীনপন্থি কয়েকটি কমিউনিস্ট উপদলও পাকিস্তানদের পক্ষেই কাজ করছিল, অন্যদিকে চীনপন্থি কোনাে কোনাে উপদল গড়ে তুলেছিল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ। চীন ও মাওবাদীদের বিরুদ্ধে নানা লেখালেখি ও গুজব চলছিল। ‘চীনের কূটনৈতিক লক্ষ্য এবং বাংলাদেশের প্রশ্নে মাওবাদীরা দ্বিধাবিভক্ত। এ পরিপ্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানীর বিবৃতি মুজিবনগর সরকারের নিকট ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও এর ছাত্র-কৃষক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে মুজিবনগর সরকারকে সমর্থন করে। এর কারণ হিসেবে পাঁচটি যুক্তি উত্থাপন করে। যুক্তিগুলাে হলাে ‘; এক, মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতি দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে। দুই, সাম্রাজ্যবাদ দুর্বল হবে। তিন, সাম্প্রদায়িকতা হ্রাস পাবে। চার, প্রতিবেশি

দেশসমূহের সাথে সুসম্পর্ক দৃঢ়তর হবে এবং পাঁচ, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের সাথে। বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি হবে। মুক্তিযুদ্ধ সফল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি স্পেশাল গেরিলা বাহিনী গঠন করে এবং একটি দলকে সােভিয়েত ইউনিয়নে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করেছিল। শুধু তাই নয়, পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি পৃথিবীর সকল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা করার আহ্বান জানান এবং শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে ইয়াহিয়া খানকে বাধ্য করার জন্য চাপ। সৃষ্টি করতে অনুরােধ জানান।
পিকিং পস্থির ভূমিকা
পিকিংপন্থির উপদলীয় লাইন নিয়ে বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, “এপ্রিলের ১৪ তারিখে সন্ধ্যায় রেডিও পাকিস্তানের এক খবরে শুনলাম চৌ এন লাই, চীনা প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তান সরকারের কাছে এক পাঠানাে বাণীতে বলেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সুখসমৃদ্ধি পাকিস্তানের অখণ্ডতার উপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়, যারা পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে তারা হল মুষ্টিমেয় লােক। রেডিও পাকিস্তান প্রচারিত এই সংবাদ শুনে আমি শুধু স্তম্ভিতই হলাম না, খুব ভীতও হলাম। কারণ, আমি আমাদের পার্টি নেতৃত্বের মেরুদণ্ডহীনতা এবং চীনের প্রতিটি বক্তব্য জো হুজুরি মনােবৃত্তি নিয়ে মেনে চলার কথা জানতাম। এ বিষয় পার্টি মুখপাত্র সাপ্তাহিক গণশক্তির সম্পাদক হিসেবে তাদের সাথে মাঝে মাঝেই আমার মতবিরােধ হত। কাজেই চৌ এন লাই-এর বক্তব্য শােনার পর আমি পরদিনই ভােরে যশাের থেকে ঢাকায় ফিরে যা দেখলাম এবং সুখেন্দু দস্তিদার ও অন্যদের যে বক্তব্য শুনলাম তার থেকে স্পষ্ট বােঝা গেল যে, আমাদের সর্বনাশ হয়েছে। নিজেরা দেশের সুনির্দিষ্ট বাস্তব পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে পাটি নেতারা চীনের বক্তব্য অনুযায়ী রাতারাতি এমন অবস্থান গ্রহণ করলেন যাতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তানি সরকার ও সেনাবাহিনীর পারস্পরিক সংঘর্ষ তাদের লাইন অনুযায়ী হয়ে দাঁড়াল দুই কুকুরের যুদ্ধ। চীনের বক্তব্য শুনে ও চারু মজুমদারের সন্ত্রাসী লাইনকে মুক্তিযুদ্ধের লাইনের সাথে যুক্ত করে এক উদ্ভট তত্ত্ব খাড়া করায় অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন এলাকায় বিপর্যয় দেখা দিল এবং সেই সাথে পার্টির মধ্যে নানা ধরনের চক্রান্তমূলক তৎপরতাও বৃদ্ধি পেল।’ পাকিস্তান সরকার আমাদের জনগণের ওপর যে আক্রমণ করেছিল, সে আক্রমণ প্রতিহত করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপকতম ঐক্য গঠনের পরিবর্তে তারা পাকিস্তান সরকারের সাথে আওয়ামী লীগকেও ঐ পরিস্থিতিতে কুকুর হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের পারস্পরিক যুদ্ধকে দুই কুকুরের বিরুদ্ধে লড়াই বলে আখ্যায়িত করে তাদের উভয়কেই বিরােধিতা করার মতাে এক নির্বোধ লাইন ধারণ। করেন। এছাড়া একাজ করতে গিয়ে তারা আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে এক করে দেখে, সকলেরই বিরােধিতা করতে নিযুক্ত হন। যেখানে অন্য কোনাে বিকল্পের অভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদেরকে এক করার।
পরিণাম বা আওয়ামী লীগই নয়, সাধারণ জনগণ দ্বারা ধাবিত হয়েই অনেক ক্ষেত্রে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
৭. কূটনৈতিক কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন
১. মুজিবনগর সরকারের প্রচেষ্টা ছিল প্রতিবেশী ভারতকে কূটনৈতিকভাবে অধিকতর সক্রিয় করে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা,
২. ভারত কর্তৃক সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা এবং ভারতবাংলাদেশের মধ্যে সার্বক্ষণিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন,
৩. অন্য কোনাে তৃতীয় দেশ যুদ্ধে যাতে জড়িত না হতে পারে সে লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানাে,
৪. যুদ্ধ পক্ষকালের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা,
৫, যুদ্ধকালীন ভারতের মাধ্যমে অন্য কোনাে পরাশক্তির হুমকি মােকাবেলা করার পরিকল্পনা গ্রহণ,
৬. যুক্তিযুক্ত শর্তে রাজনৈতিক সমাধান ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সুদৃঢ়করণে ভারতের আন্তরিক ও কার্যকর সমর্থন আদায়,
৭. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির লক্ষ্যে ভারতীয় নেতৃত্বকে বিশেষভাবে সক্রিয়করণ,
৮, শরণার্থীদের সম্মানজনকভাবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা,
৯, ভারত-সােভিয়েত বলয়ের শক্তি সমাবেশের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীকে দুর্বল করা,
১০, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা, জাপান এবং অন্যান্য গুরুত্ত্বপূর্ণ দেশ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক জনমত গঠনে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা এবং তাদের নিরপেক্ষ রাখা বা আগ্রাসী মনােভাব হ্রাস করার পরিকল্পনা গ্রহণ, ১১, ইসলামাবাদের সামরিক জান্তার উপর চাপ সৃষ্টি করা যেন তারা অবিলম্বে বিশ্বজনমতের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়, এবং  ১২, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখল থেকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে মুক্ত করা এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
৭. ক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবকাঠামাে গঠন সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাকলেও বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হত। সকল প্রকার বৈদেশিক নীতি প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঠিক করে দিতেন। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের কারণে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরকারের ভ্রান্ত নীতি অবলম্বনের ফলে সে সময় পৃথিবীর রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতির প্রতি প্রধানমন্ত্রী প্রখর দৃষ্টি রেখেছিলেন। এমনকি তিনি বিশ্ব পরিসরের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, কার্যকরণ ঘটনাবলী ও স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে বৈদেশিক প্রচার বিভাগকে পরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এর কাঠামোগত ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট ছকে গ্রথিত করেছিলেন। 
 
 
বিদেশিদের সহযােগিতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এসব দূতাবাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একাত্তরে নভেম্বর মাসে সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের একটি তালিকা প্রকাশিত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় পরিবেশিত এই সার্কুলার বিদেশে কর্মরত মিশনপ্রধান ও মিশনের ঠিকানা তৎকালে সকল সচিবসহ সংশ্লিষ্টদেরও প্রদান করা হয়।
৭. ঘ, মুজিবনগর সরকার কূটনৈতিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গ ও মুসলিম দেশসমূহের ভূমিকা শীর্ষক একটি পৃথক অধ্যায় প্রণয়ন করা হবে। সুতরাং এই অংশে বিষয়টি খুব সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলাে :
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হতে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য যা করেছে তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য :
১. বর্ষাকালে পূর্ব পাকিস্তানে চলাচলের জন্য কোস্টার কিনতে ৪ মিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রদান। | ২. বিভিন্ন জাহাজে অস্ত্র সরবরাহ। ভারী এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ইরান ও তুরস্কের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে হয়েছে এবং সহায়ক সরঞ্জামগুলাে এবং যন্ত্রাংশ। প্রকাশ্যেও সরাসরি প্রেরণ করা হয়েছে।
৩. ১৮টি কোবরা গানশীপ (বৃহৎ হেলিকপ্টার) ইরান থেকে আনা হয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্র সরবরাহ করেছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
৪. আগস্ট মাসের প্রথম দিকে লস এনজেলস্ টাইম পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছে, মার্কিন সমরাস্ত্র যা ভিয়েতনামে যাচ্ছিল তা পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।  ৫. ভিয়েতনাম যুদ্ধে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কাউন্টার ইনসার্জেন্সি বিশেষজ্ঞদের ঢাকায় মার্কিন অফিসে পাঠানাে হয়।  ৬. পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে সাহায্য করার প্রস্তুতি নিয়েছে।
এসব ঘটনাবলি থেকে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের সংকট সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষভাবে জড়িত ছিল এবং ইয়াহিয়া খানকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। তবে মার্কিন জনমত ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। ২৫শে মার্চ গণহত্যার সংবাদ প্রকাশিত হবার পরে প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন, সেক্রেটারি রজার্স, নিরাপত্তা সহকারী কিসিঞ্জার ও সিনেটে বৈদেশিক কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর ফুলব্রাইট এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে ফ্যাক্স বার্তা পাঠানাে হয়। ২৯শে মার্চ ওয়াশিংটনের এক র্যালী হতে আই.এম.এফ, বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে স্মারকলিপি প্রদান। করা হয়। বাঙালি ছাড়াও ভারতীয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরাও এই র্যালিতে অংশগ্রহণ। করলে মার্কিন গণপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। ৩০শে মার্চ ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকায় সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের রিপাের্টে গণহত্যার লােমহর্ষক বিবরণ ছাপা হয়। মার্কিন মানবতাবাদী মানুষ ও সংস্থাগুলাে সােচ্চার হয়ে ওঠেন। ১লা এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেসে সিনেটর কেনেডি ও সিনেটর হ্যারিস বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যার নিন্দা। জানান এবং নিরীহ মানুষের উপর আক্রমণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মার্কিন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ৬ই এপ্রিল পাকিস্তান দূতাবাসের কাউন্সেলর এ. এম. এ. মুহিত এবং পরবর্তীকালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক বাংলাদেশের অতীত বঞ্চনা ও নারকীয় ঘটনা তুলে ধরলে বাংলাদেশের স্বপক্ষে জনমত গড়ে ওঠে।” এপ্রিল মাসের শেষ দিকে মুজিবনগর সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রেহমান সােবহান যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন এবং বিভিন্ন বক্তব্যে পাকিস্তানের শাসন-শােষণ, বৈষম্য ও বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন এবং মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত প্রচারপত্র বিলি করেন। নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক এ. এইচ. এম. মাহমুদ আলী ও স্থপতি জনাব ফজলুর রহমান খান বাংলাদেশের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা নেন। ২৪শে মে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে এসে নরওয়ে, সৌদি আরব, আলজেরিয়া, লিবিয়া, জর্ডান, মিশর, ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও পশ্চিম ইউরােপের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং বাংলাদেশের স্বপক্ষে ব্যাপক জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। ২৩শে জুন নিউইয়র্কের একটি কনভেনশনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মিশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
মুজিবনগর সরকারের আহ্বানে ছয় জন কূটনীতিকসহ চৌদ্দ জন বাঙালি বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করেন। আগষ্ট মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এই মিশন গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং পাকিস্তান কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে এম.আর. সিদ্দিকী বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে যােগ দেন। মার্কিন পত্রপত্রিকা ও জনপ্রতিনিধিদের আপত্তি সত্ত্বেও নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সামরিক সাহায্য বন্ধ না হলেও কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে পাকিস্তানের ঋণ সহায়তা প্রদান বিবেচিত হয়নি। সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিচারপতি আবু সাঈদের নেতৃত্বে সােল সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কে গমন করে। এই প্রতিনিধিদল বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের উপর অত্যাচারের নির্মম কাহিনি তুলে ধরতে সমর্থ হন। এসময়ে ড, এ, আর, মল্লিক যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করে জনমত গড়ে তােলেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ২রা অক্টোবর দাতাগােষ্ঠীর সভায় কোনাে দাতা দেশ পাকিস্তানকে কোনাে প্রকারের ঋণ প্রদান করেনি। এটা ছিলাে। পাকিস্তানের কূটনৈতিক পরাজয় ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিজয়। ২৯শে অক্টোবর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্রে আগমন করলে বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তাগণ তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এসময়ে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানে অস্ত্রসরবরাহ বন্ধ করে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে গােপনে পাকিস্তানকে অস্ত্র প্রেরণের পথ অন্বেষণ করে। ৩রা ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন নীতি ছিল যুদ্ধবিরতি প্রস্ত বি পাশ করানাে। সােভিয়েত ইউনিয়ন এ ধরনের তিনটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়ােগ করে। ১৬ই ডিসেম্বর মার্কিন নীতি অখণ্ড পাকিস্তানকে অক্ষুন্ন রাখার কূটনৈতিক তৎপরতার পরাজয় ঘটে।
সােভিয়েত ইউনিয়ন : এই উপমহাদেশে বিশেষকরে ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়াকে বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে হয়েছে। রাশিয়া যা করেছে : ১. প্রেসিডেন্ট পদগর্নি কর্তৃক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে একটি পত্র দিয়েছেন। পত্রটিতে কোনাে হুমকি ছিল না বরং পাকিস্তানকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ করা হয়েছে; ২. সােভিয়েত ইউনিয়ন ও পাকিস্তানের মধ্যে বেশ কিছু পত্র বিনিময় হয়েছে যা অপ্রকাশিত, কিন্তু মর্মবস্তু একই ধরনের; ৩, সােভিয়েত-ভারত চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে সমগ্র পাকিস্তানের সন্তুষ্টির মাধ্যমে সমাধানের কথা বলা হয়েছে; ৪. ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরাগান্ধীর মস্কো সফরে সােভিয়েত মনােভাব কিছুটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলেও মূল সংকট সম্পর্কে তাদের অবস্থান ছিল পূর্বের মতােই। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে এ পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই কোসিগিন বলেছেন, প্রতিবেশী ভারতে ৮০ লক্ষ শরণার্থী যাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাদের সম্পত্তি দখল ও আশ্রয়হীন করতে এবং দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে এ অবস্থায় পাকিস্তানের তেমন কিছু অর্জন অসম্ভব। পরের দিন কোসিগিন ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে সােভিয়েতের সমবেদনা রয়েছে কিন্তু ‘ববরতা এবং জঘন্য মানবতা বিরােধী কর্মকাণ্ড সােভিয়েত জনগণের সমর্থন পেতে পারে না। এ সময় সােভিয়েত ইউনিয়ন ‘পূর্ববঙ্গ’ নামটি ব্যবহার করে। কিন্তু ২রা এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট পদগর্নি কর্তৃক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে লিখিত পত্রের মর্মার্থের অগ্রসরতা দৃশ্যমান হয়নি। ভারতসােভিয়েত চুক্তির পর যুক্ত বিবৃতি যা বলা হয়েছিল তা থেকে সােভিয়েত রাশিয়া পিছু সরে এসে বলে “অবিলম্বে সংকট নিরসনে রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হতে হবে, জন্মগত, আইনগতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং “শরণার্থীদের নিরাপদ ও মর্যাদা সহকারে পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে।” এ সময়ও রাশিয়ার টেকনিশিয়ান ও বিশেষজ্ঞগণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উভয় অংশে কর্মরত ছিল। একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, রাশিয়া কোনােভাবেই ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চাচ্ছিল না। বিগত দশ বছর ধরে সােভিয়েত রাশিয়া প্রকৃত সংঘর্ষ হতে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার নীতি অনুসরণ করে চলেছিল। কিন্তু সােভিয়েত রাশিয়া ক্রমশ ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মুজিবনগর সরকার সােভিয়েত রাশিয়া যাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা করে সেজন্য বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদককে মস্কোতে প্রেরণ করে।
চীন: চীন প্রথম থেকেই পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এবং ইয়াহিয়া খানকে। সর্বাত্মক সহযােগিতা করে এসেছে। ডিসেম্বরের পূর্বেই চীন সীমান্তে সােভিয়েত রাশিয়া ৪০ ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করায় চীন সরাসরিভাবে ভারতকে আক্রমণ করার আত্মঘাতী পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকে। কিন্তু পাকিস্তানে ব্যাপক সমরাস্ত্র প্রেরণ, এমনকি বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধ প্রতিহত করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ পাঠায়। চীন ভিন্নভাবে। বাংলাদেশের বিষয়টিকে পর্যবেক্ষণ করেছে। অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে সর্বদাই রাজনৈতিক ও কুটনৈতিকভাবে প্রকাশ্যে ভূমিকা রেখেছে যা গ্রন্থের পঞ্চম ও অষ্টম অধ্যায়ে আলােচনায় উল্লেখিত হবে। 
 
ভারত: পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈরিতার কারণে বাংলাদেশকে সমর্থন করেছে। তার চিরায়িত কূটনৈতিক ও নীতিগত ধারণা ও অবস্থান থেকে। মুজিবনগর সরকার প্রথম থেকেই ভারতের বিষয়গত, বস্তুগত, নীতিগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে ভারতকে বারবার নানাভাবে অনুরােধ জানিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিসগ্রামকে সহযােগিতা করার ক্ষেত্রে ভারত। নানাভাবে কৌশল গ্রহণ করেছে।
প্রথমত, বাংলাদেশ থেকে অগণিত শরণার্থী সমস্যাকে আন্তর্জাতিকীকরণ; দ্বিতীয়ত, শরণার্থী ইস্যুকে সামনে রেখে বাংলাদেশ প্রশ্নে কূটনৈতিক তৎপরতা; তৃতীয়ত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদান এবং চতুর্থত জাতিসংঘে বাংলাদেশ সমস্যাকে উপস্থাপন। গণতন্ত্র, শান্তি, মানবতা এবং আদর্শিক কারণে বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের প্রতি ভালােবাসা ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মনােভাব থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারত সমর্থন করেছে। বাংলাদেশের স্বপক্ষে বিশ্ববাসী জনমত সংগঠিত করার উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ইতিবাচক নীতি পরিলক্ষিত হয়। প্রধানত ভারত-সােভিয়েত চুক্তির পর ভারত শক্তিশালী অবস্থানে চলে আসে। ২৮শে জুন ইয়াহিয়া খানের ভাষণের পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেনি। ইয়াহিয়া খানের ভাষণের পর ভারতীয় নেতৃবৃন্দ বলেন, ইয়াহিয়া খানের কঠোর পদক্ষেপের ফলে রাজনৈতিক সমাধানের কোনাে সুযােগ নেই; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম জোরদার এবং বিশ্ব পরিসরে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতাকে প্রকাশ্য সহযােগিতা করে, এবং তৃতীয়ত, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে দৃঢ় মনােভাব গ্রহণ করে। | যুক্তরাজ্যঃ ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের পরে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে ওঠেন। ২৭শে মার্চ তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ডের সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউমের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বেসরকারি সহযােগিতার সর্বপ্রকার আশ্বাস লাভ করেন। মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণের পরপরই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়ােগ প্রদান করেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের ভিতরে যােগাযােগ ও অনৈক্য ছিল। তার মধ্যস্থতায় যুক্তরাজ্যে ২৪শে এপ্রিল কভেন্ট্রি শহরে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি এবং এটি পরিচালনার জন্য একটি কার্যকরী কমিটি গঠিত হয় এবং কার্যকরী কমিটি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শে পরিচালিত হবে বলে সিন্ধান্ত গ্রহণ করে। ১১ নং গােরিং স্ট্রীটে কার্যকরী কমিটির অফিস স্থাপিত হয় এ অফিসকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতা ও ব্রিটেনের সংবাদ মাধ্যমগুলাের প্রচারণার কারণে ব্রিটেনের অনেক রাজনীতিবিদ বাঙালিদের গণহত্যার প্রতিবাদ জানায়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের জন স্টোনহাউস, ব্রুস ডগলাসম্যান ও পিটার শাের বাংলাদেশের সমর্থনে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়। এই প্রচেষ্টার ফলে প্রায় ৩শ জন পার্লামেন্ট সদস্য বাংলাদেশে। অবিলম্বে রক্তক্ষয় বন্ধে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি জানায়।

ফলে ১৪ই মে পার্লামেন্টে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলােচনা হয়। ডানপন্থি নেতা স্যার জেরাল্ড নেবারাে ও রেভারেন্ড ইয়ান পেইসলি ও বামপন্থি নেতা ইয়ান মিকার্গো ও এ ফাউলস বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।” দক্ষিণপন্থি ও বামপন্থি নেতাদের সমর্থন থাকায় এটি পূর্ণাঙ্গ আলােচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়। সরকার যদিও বার বার বলে আসছিল বিষয়টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার তারপরেও মানবিক কারণে তারা যথেষ্ট সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করে। এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেক ডগলাস হিউম আলােচনার এক পর্যায়ে বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষে দুরত্বের কারণে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর নির্যাতন। চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এটা ছিল মুজিবনগর সরকারের জন্য প্রবাসে প্রাথমিক কটনৈতিক বিজয়।” মুজিবনগর সরকার পাকিস্তান যেন দাতাদের সাহায্য না পায় তার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রফেসর রেহমান সােবহানকে লন্ডন ও যুক্তরাষ্ট্রে যেতে অনুরােধ করেন। সেখানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎ দিয়ে তিনি পাকিস্তানের গণহত্যা, ধর্ষণ ও মানবতা বিরােধী কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্য এম,পি, দের সঙ্গে যােগাযােগ করে পাকিস্তান যেন আর্থিক সাহায্য না পায় তার জোর প্রচেষ্টা চালান। যুক্তরাজ্যে রক্ষণশীল দলের নেতা জেমস রেমসটেন ও টবিজেসেল এবং শ্রমিকদলের আর্থার বটমূলী ও রেজিনাল্ড প্রিন্টিঙ্গ ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের দুর্দশা পর্যবেক্ষণ করে যে রিপাের্ট প্রদান করেন তাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বর চিত্র প্রতিফলিত হয়। লন্ডন থেকে রেহমান সােবহান ৭ই জুন প্যারিসে গমন করেন সেখানে পাকিস্তান এইড কনসাের্টিয়ামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ছিল। সেই বৈঠকে পাকিস্তান যাতে আর্থিক সাহায্য না পায় সেজন্য তার নেতৃত্বে জোর প্রচেষ্টা চালানাে হয়। বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার কারগিল পাকিস্তান সফর করে একটি বাস্তব রির্পোট কনসাের্টিয়ামে উপস্থিত করলে পাকিস্তানের অস্থিতিশীল এই পরিবেশে উন্নয়ন-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে’ এই অজুহাতে কনসাের্টিয়াম পাকিস্তানকে প্রতিশ্রুত সাহায্য স্থগিত রাখে। এই বৈঠকের ফলাফল পাকিস্তানের জন্য ছিল এক ধাক্কা এবং আন্তর্জাতিক জনমতকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সারা বিশ্বেরই প্রাথমিকভাবে একটি সমর্থন আদায় করা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কূটনৈতিক বিজয়।* পলকানেটের নেতৃত্বাধীন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশের উদ্যোগে ১লা আগষ্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারের সভায় পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। ১১ই আগস্ট লন্ডনের হাইড পার্কের এক জনসভায় পররাষ্ট্র দপ্তরের লুৎফুল মতিন ও ফজলুল হক চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করেন। এটা ছিল ব্রিটেনের বাঙালিদের বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। ২৭শে আগস্ট লন্ডনের ২৪ নং প্রেমব্রিজ গার্ডেনে বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যম ও জনগণের সামনে বাংলাদেশের দূতাবাস উদ্বোধন করা হয়। মে মাসে ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’-এর চেয়ারম্যান ডােনাল্ড চেওয়ার্থ মুজিব সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সে সময়ে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন সম্পর্কে তারা আলােচনা করেন। তার উদ্যোগে ২৪ নম্বর প্রেব্রিজ গার্ডেন্সের বাড়িতে অবস্থিত টক্ এইচ, হােস্টেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে রুমগুলি নামমাত্র ভাড়ায় বাংলাদেশ মিশনকে

ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। লন্ডন মিশনকে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমতি না দিলেও এই মিশন ছিল বহির্বিশ্বের সঙ্গে যােগাযােগের মূল কেন্দ্র। এটিই ছিল ভারতের বাইরে প্রথম বাংলাদেশ মিশন। মুজিবনগর সরকার বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা ও সমন্বয় সাধন করার উদ্দেশ্যে লন্ডনে এই মিশন স্থাপনের অনুমােদন দান করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে লন্ডনের মিশনের প্রধান নিয়ােগ করা হয়। মিশনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশের উজ্জ্বল উপস্থিতি। এটা ছিল কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য। তাছাড়া জনমতের চাপে ব্রিটিশ সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণে বাধ্য হয়। এটা ছিল মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য। ১৯শে নভেম্বর ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে বাংলাদেশের সমর্থনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ স্টুডেন্টস-এর আঞ্চলিক সভাপতি জেফ হ্যারিস। বাংলাদেশের ছাত্রদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কবীর আহম্মদ। সভার প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ণ স্বাধীনতাই হচ্ছে বাংলাদেশের সমস্যার একমাত্র সমাধান। ব্রিটেনের তথাকথিত নিরপেক্ষতা ত্যাগ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে আহ্বান জানানাে হয়। একই দিন (১৯ নভেম্বর) কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ইউনিয়ন এক সভা আহ্বান করে। সভার সভাপতিত্ব করেন কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ইউনিয়নের সভাপতি ওয়ার উইক। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাবেকমন্ত্রী টেড বােলেন, সাবেক এম, পি, গুয়েভার এভেন্স এবং বাঙালিদের পক্ষে ডা. নুরুল হােসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং পূর্ব বঙ্গের’ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দানের জন্য দাবি করা হয়।
এভাবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ যেমনি সাফল্যের পথে অগ্রসর হচ্ছিল তেমনি আন্ত জাতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি এবং কূটনৈতিক সাফল্য অর্জিত হচ্ছিল। স্টিয়ারিং কমিটি প্রকাশিত বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা ১২ই নভেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাঙালি কূটনীতিকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অংশগ্রহণের খবর পরিবেশন করে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি দ্বিতীয় সচিব জনাব ওয়ালিউর রহমান পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সুইজারল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। এছাড়া নেপালের পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস এটাচি এসএম মাসউম এবং টোকিও দূতাবাসের তৃতীয় সচিব আবদুর রহিম পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যােগদান করেন। এসকল সম্পর্কচ্ছেদের। ঘটনা বিলম্বে হলেও গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করেছে। বাংলাদেশে আর যে পাকিস্তানের শাসন চালানাে সম্ভব নয় তার নগ্ন প্রকাশ উপযুক্ত সম্পর্ক ছিন্ন ঘটনার মাধ্যমে আন্ত র্জাতিকভাবে প্রচার লাভ করে। ৩০শে নভেম্বর যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গ্রান্ড কমিটি রুমে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি গউস খানের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন ব্রিটিশ এম. পি. পিটার শাের, রেজিনান্ড প্রেনটিস, ক্রস ডগলাস-ম্যান ও জুলিয়াস সিলভার ম্যান এবং বাংলাদেশ। দূতাবাসের রেজাউল করিম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বক্তাগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবি জানান।”

এছাড়াও ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিদের কর্যক্রম পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচিত হবে।

ডেনমার্ক: ১৪ই সেপ্টেম্বর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ডেনমার্কে গিয়ে বাংলাদেশ। অ্যাকশন কমিটির আহ্বায়ক কিস্টেন ওয়েস্টগার্ড ও তাঁর সহকর্মীরা বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে যে বুলেটিন প্রকাশ করেন তার জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানান। উল্লেখ্য যে, ওয়েস্টগার্ড ২৫শে মার্চ ঢাকায় অবস্থানকালে পাকিস্তানিদের গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেছে। ডেনমার্কে তিনি পার্লামেন্ট প্রতিনিধি, স্পিকার ও বৈদেশিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে অনুরােধ করেন ডেনিস প্রতিনিধিদল যেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করেন।
ফ্রান্স বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের সংবাদ পেয়ে সাবেক ফরাসি সংস্কৃতিমন্ত্রী ও নােবেলবিজয়ী আঁন্দ্রে মালরাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের ঘােষণায় সারাবিশ্ব আলােড়িত হয়। তিনি বলেন, “একটি রাষ্ট্র যখন সবকিছুর বিনিময়ে বিচ্ছিন্নতাকে অসম্ভব করে তােলার চেষ্টা করে তখন একটি দেশের অর্ধেক ভূখণ্ডকে দখলকৃত দেশ হিসেবে না দেখাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। বিদ্রোহ যখন শুরু হল তখন থেকে ইসলামাবাদের সৈন্যরা পূর্ববাংলার কাছে আর স্বদেশবাদী বা ধর্মীয় থাকল না, তারা দখলদার বাহিনীতে পরিণত হল।” ১ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টের স্পিকারদের নেতৃত্বে প্রায় সাতশত জন সংসদ সদস্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা, গণহত্যা এবং শরণার্থী শিবিরের করুণ অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে অবগত করার সুযােগ গ্রহণ করার জন্য যুক্তরাজ্যস্থ ছাত্র সংগ্রাম কমিটি একটি প্রতিনিধিদল প্যারিসে প্রেরণ করে। ছাত্র। প্রতিনিধিরা প্যারিসে বিভিন্ন রকম প্রচারপত্র, বুকলেট, বিশ্বব্যাংকের রিপাের্ট, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে বিরাট অবদান রাখে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, প্যারিসে পাকিস্তানকে প্রতিশ্রুত সাহায্য স্থগিত রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল সাফল্য অর্জন করেছিল।

৭, ঙ, কূটনৈতিক দূত প্রেরণ লেবানন-সিরিয়া : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মধ্যপ্রাচ্যের জনমত গঠন এবং দেশসমূহের সহযােগিতা লাভের উদ্দেশ্যে মুজিবনগর সরকার মােল্লা জালালউদ্দিন এম.পি. এ.’র নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সিরিয়া-লেবাননে প্রেরিত হয়। এর অপর সদস্য ছিলেন ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী। মধ্যপ্রাচ্যে পাকিস্তান প্রচার করেছিল। বাংলাদেশের জনগণ অধিকাংশ হিন্দু ও অমুসলিম। সে জন্য তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। প্রতিনিধি দল লেবাননে ‘আল হিউম’ ও ‘আল নাহার’ দুটি পত্রিকায় এক সাক্ষাতকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও পাকিস্তানিদের নির্মম নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন। লেবাননের রাজনৈতিক নেতা কামাল জুনবালাত, মারুফছার ও রশিদ কারামি প্রমুখের সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের ফলপ্রসূ আলােচনা হয়। সাংবাদিক খায়রুলাহ ও বিশিষ্ট মহিলাচিকিৎসক হিতাব আবদেল ছামাদ বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের সহায়তা করেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ওমর আবু

রিশ যিনি পূর্বে ভারতে ছিলেন তার সহযােগিতায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল সিরিয়া গমন করেন। প্রতিনিধি দলটি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ও আইনজীবী সমিতির প্রধানের সাথে এবং প্রাক্তন ফরাসি কাল লুই সেকুতুবিচও’-র সঙ্গে বৈঠক করেন। রাজনৈতিক নেতা তাকিয়া দিনসলের সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের বৈঠক হলে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার সরকারের প্রভাব বিস্তার করবেন বলে আশ্বাস দেন। এভাবে মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকার মধ্যপ্রাচ্যের জনমত গঠনে উদ্যোগ নেন। আফগানিস্তান-ইরান : আফগানিস্তানের সরকারকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করানাে ও আফগান জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার আফগানিস্তানেও একটা কূটনৈতিক মিশন প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭১ সালে ২৯ জন পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম (চাষী) মােহাম্মদ আব্দুস সামাদ (আজাদ)কে এ বিষয়ে একটা পত্র প্রেরণ করেন। এ প্রতিনিধিদলে অন্য সদস্যগণ ছিলেন সর্বজনাব আশরাফ আলী চৌধুরী এম, এন, এ, মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশােরী ও এডভােকেট নুরুল কাদের। ২৭শে আগস্ট আব্দুস সামাদ আজাদ ও নুরুল কাদের কাবুলে পৌছান। আফগানিস্তানে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে, এল, মেহতা ও কূটনীতিক সালমান হায়দার ও এইচ. কে. লাল আফগানিস্তানে প্রচারকার্যে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনকে সার্বিকভাবে সহায়তা করেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা আফগানিস্তানে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ‘ডায়েরি অন বাংলাদেশ ও ‘রিফিউজি’ ৭১ নামে দু’টো ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানি নির্যাতন তুলে ধরা হয়। অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কাটিং প্রদর্শন করা হয়। প্রতিনিধিদল আফগানিস্তানের রাজা জহির শাহ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা শফিক ও প্রাক্তন নেতা আবদুল গাফফার খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সহযােগিতা কামনা করেন। বাঙালি কূটনীতিকরা বৈরী অবস্থায় সুদূর প্রবাসে থেকেও পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি যে আনুগত্য দেখিয়েছেন এবং যেভাবে বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন তা ছিল কূটনৈতিক যুদ্ধের এক প্রশংসনীয় অধ্যায়। নয়াদিল্লি : ২৫শে মে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল। নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং নয়াদিল্লিতে তারা ভারতীয় পার্লামেন্টের বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের সাথে উভয় দেশের সাধারণ স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলােচনা করেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ফণীভূষণ মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত উক্ত প্রতিনিধি দলের অপর সদস্যদ্বয় হলেন আওয়ামী লীগের মহিলা শাখার সাধারণ সম্পাদিকা ও জাতীয় পরিষদ সদস্য বেগম নূরজাহান মাের্শেদ এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন। প্রতিনিধি দলটি ভারতের কতিপয় প্রদেশ সফর করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। সপ্তাহব্যাপী সফর শেষে তারা মুজিবনগর প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সফর সম্পর্কে এক রিপাের্ট পেশ করেন।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া: মুজিবনগর সরকার গণপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক তৎপরতার লক্ষ্যে প্রেরণ করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কূটনৈতিক তৎপরতার
 
 
মাধ্যমে মূল্যবান গােপনীয় তথ্যাদি পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রেরিত বাংলাদেশ। প্রতিনিধিদলের দলনেতা ফকির শাহাবুদ্দিনের নিকট থেকে প্রাপ্ত চিঠির কপি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অবলােকন ও অবগতির জন্য পাঠানাে হয়। এই চিঠিতে দলনেতা বিস্তারিত এক বিবরণ পাঠান। বিবরণে তিনি জ্যোতিপাল মহাথেরাের সঙ্গে এবং স্থানীয় বাঙালি ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলােচিত বিষয় সম্বন্ধে জানান। মহাথেরাের মতে জানা যায়, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লােকজন কোনাে ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহ। বােধ করে না। ফকির শাহাবুদ্দিন আশঙ্কা ব্যক্ত করে জানান যে, পাকিস্তান দূতাবাসের কড়া নজরদারির মধ্যে তথাকার দু’তিন জন বাঙালিকে কাজ করতে হচ্ছে। এজন্য তাঁরা।
সতর্কতা অবলম্বন করেছে। এমন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে মহাথেরােকে তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও পদ্ধতিতে বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কাজ করার প্রস্তাব দেন। ব্যাংককে পাকিস্তানি নৃশংসতার বিরুদ্ধে মহাথেরাের আবেদন যাতে ব্যাপক প্রচার পায় সে সম্বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে দলনেতা জানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ইয়াহিয়া খান এখানকার বাজার থেকে গােপনে অস্ত্র ক্রয় করে পি.আই.এ, বিমানযােগে বহন করছে। দলনেতা আরাে জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত লাওসে গমন করে মার্কিন সহযােগিতায় হয়তাে অস্ত্রসংগ্রহ করে থাকতে পারে। সেখানকার কালােবাজার থেকে বাংলাদেশের জন্যেও সস্তায় অস্ত্র ক্রয় করা যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন এবং এর মূল্য অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ পাওয়ার পর পরিশােধ করার সুবিধা। পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান। | ‘ওয়ার্ল্ড বুদ্ধিস্ট ফেলােশিপ’ নামক প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট রাজকুমারী পুনের সাথে তিনি দেখা করেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। দলনেতা ফকির শাহাবুদ্দিন পরামর্শ দিয়ে জানান যে, বাংলাদেশ সরকারের প্রয়ােজন থাই-সরকারের নিকট স্বীকৃতির জন্য আবেদন জানানাে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের আহ্বানে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তাকর্মচারী পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠানে যােগদান করেননি। বন্ধুরা তাদের ক্ষতির আশঙ্কা থেকে প্রয়ােজনে সহযােগিতা দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দলনেতা ফকির শাহাবুদ্দিনের এই প্রতিবেদন থেকে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের কর্মতৎপরতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর পাওয়া যায়।

৭. চ, কূটনৈতিক পত্র প্রেরণ ১৯৭১ সালের ২৪শে এপ্রিলে ভারত সরকার বরাবর পাঠানাে পত্রের সূত্র ধরে মুজিবনগর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যৌথ স্বাক্ষরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ৯টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত একটি পত্র লেখেন। উক্ত পত্রে ১ম অনুচ্ছেদে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, গণরায়, গণতান্ত্রিক ও মৌলিক মানবিক অধিকারসমূহ পদদলিত করে ২৫শে মার্চ ৭১ পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নৃশংসভাবে আক্রমণ করায় ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাক্ষার প্রতিফলন হিসেবে স্বাধীনতা ঘােষণা ও স্বাধীনতার সনদ, সরকার গঠন এবং শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে আলােচনার বিষয়টি উল্লেখিত আছে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বাঙালি জাতির উপর পশ্চিম পাকিস্তান কায়েমি চক্র।

কর্তৃক অর্থনেতিক শােষন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষ্যমের নিপীড়নের কথা বিবৃতি করে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে সরকার গঠিত হয় যা ২৪শে এপ্রিলের ‘৭১-এর পত্রে উল্লেখিত হয়েছে। তৃতীয় অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত, উস্কানির মুখেও জনগণ শাক্তিপূর্ণ অসহযােগ এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ২৪শে মার্চ পর্যন্ত ‘৭১ পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে আলােচনা চালানাে হয়েছে। চতুর্থ অনুচ্ছেদে ২৫শে মার্চ রাত্রিতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী নিরস্ত্র জনগণের উপর আক্রমণ চালায়, তারা নারী শিশু বুদ্ধিজীবী নেতাকর্মী কৃষক, সাধারণ মানুষ ও ছাত্রদের হত্যা করে। এই পরিণতিতে বাংলাদেশের জনগণকে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য করে। পঞ্চম অনুচ্ছেদে ১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ এবং অন্যান্য প্যারামিলিটারি সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানি কলােনিয়াল নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত হবার কথা বর্ণিত হয়।
ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে পাকিস্তান সামরিক জান্তা বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে হত্যা খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগের মত জঘন্য ঘটনা অব্যাহত রেখেছে সে কারণে ভারতে শরণার্থী হিসেবে তারা আশ্রয় নিয়েছে। সপ্তম অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা ও প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে গােপন আদালতে বিচার করে মৃত্যু সেলে রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সামরিক জান্তা বাংলাদেশের ৭৯জন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সদস্যপদের অযােগ্য ঘােষণা করেছে এবং ৭০-এর নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীদের নিয়ে একটি তথাকথিত বেসামরিক সরকার গঠন করছে। এ সকল কর্মকান্ড সাড়ে সাত কোটি মানুষকে প্রতারিত করতে পারবে না। বরং তা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথকে দৃঢ়তর করবে। অষ্টম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সরকার আনন্দের সঙ্গে জানাতে চায় মুক্তিবাহিনী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং দেশের অর্ধেকাংশ। তারা ঘেরাও করেছে সেখানে বেসামরিক প্রশাসন ভালােভাবেই পরিচালিত হচ্ছে এবং জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সর্বোতভাবে সাহায্য, সহযােগিতা ও সমর্থন করে যাচ্ছে। নবম অনুচ্ছেদ বাংলাদেশে স্বীকৃতির আবেদন জানিয়ে বলা হয়, এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রচন্ডভাবে উজ্জীবিত করবে। এই স্বীকৃতি পৃথিবীর বিভিন্ন স্বাধীনতা ও শান্তি প্রিয় দেশকে এগিয়ে আসতে গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা দেবে।
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ২৪শে জুন ‘৭১ ইসলামিক কনফারেন্স জেদ্দা সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল টেংকু আবদুর রহমান বরাবর এক টেলিগ্রাম বার্তায় অবিলম্বে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের জন্য প্রভাব ও কর্তৃত্ব ব্যবহার করার আবেদন জানান। টেলিগ্রামের অনুলিপি সকল মেম্বার সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার অনুরােধ জানান। ইউ.এন.আই. বার্তায় বলা হয়, উক্ত টেলিগ্রামে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরা হয়। বার্তায় বলা হয়, পবিত্র ইসলামের নাম ব্যবহার করে পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক জান্তা এসব জঘন্য কর্মকাণ্ড ও অপরাধ সংঘটিত করেছে। ২৩শে জুন ‘৭১ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন বরাবর একটি টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন। উক্ত টেলিগ্রামে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে গভীরভাবে আহত ও মর্মাহত। টেলিগ্রামে তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তানে এই অস্ত্র ও ত্রাণকার্য সরবরাহ গণহত্যার উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হবে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবেদন জানাচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থেই এই গণহত্যার গণ উদ্দেশ্য এবং মূল্যবান সম্পদ ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকার আবেদন জানাচ্ছি।” বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘এইসব অস্ত্র সরবরাহ বাংলাদেশের রক্তঝরা মানুষদের উপর এক কঠিন আঘাত’ তবু একথাও ঘােষণা করতে চাই যে, পাকিস্তানকে যাই সাহায্য করা হােক না কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অব্যাহতভাবে এগিয়ে যাবে। যদিও সামরিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ ইতিমধ্যে পাকিস্তানে পাঠানাে হয়েছে।” 

বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে মুক্ত বিশ্ব থেকে বিছিন্ন হওয়ার ধারণা দেবে। বিশেষকরে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে। “মার্কিন সরকারের কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা প্রিয় জনগণের মধ্যে অতীব অশ্রদ্ধা জানাবে এবং পৃথিবীর অন্যান্য অংশ বাংলাদেশে বিদেশি হানাদার বাহিনী কর্তৃক রক্তাক্ত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।” মুখপাত্র , “যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্যের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫১ সাল হতে ১৯৬৯ পর্যন্ত পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়েছে তিন হাজার মিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হতে ১৯৬৪ সালে দেড় হাজার মিলিয়ন ডলার এবং ১৯৬৫ সালে দুই হাজার মিলিয়ন ডলার সামরিক সাহায্য পেয়েছে। এই ব্যাপক সামরিক সাহায্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে।” মুখপাত্র আরাে বলেন, “সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে তিনশত আর্মাড় পার্সোন্যাল ক্যারিয়ার, চারটি শত্রু পক্ষের নৌ অবস্থান নির্ণয়ে বিমান, ছয়টি এফ-১০৪ জেট যুদ্ধ বিমান এবং সাতটি বি-৫৭ বােমারু বিমান সরবরাহ করছে।” মুখপাত্র বলেন, ‘বর্তমানে এসব সমরাস্ত্র সরবরাহ একথাই প্রতিষ্ঠিত করে যে, বর্তমানে যে সকল অস্ত্র পাকিস্তানকে প্রদান করা হচ্ছে তা বাংলাদেশের যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের নিকট আবেদন জানাচ্ছে, অস্ত্র সরবরাহকারী। জাহাজগুলি ফিরিয়ে নেবে এবং আরাে অস্ত্র দেয়া এবং যে সকল অস্ত্র-শস্ত্র ও সরঞ্জাম পাকিস্তানকে দেয়া হয়েছে তা যাতে ব্যবহৃত না হয় তার ব্যবস্থা নেবে।” এই পরিকল্পনাকে সামনে নিয়ে মুজিবনগর সরকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরাবর যে পত্র প্রেরণ করেন যা কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই পত্রে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে ভারতকে প্রভাবিত করার যৌক্তিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। (পত্রটি পরিশিষ্ট ২ ক, এ উল্লিখিত হলাে) পত্রটির মূল্যায়ন, তথ্যমূলক বর্ণনা ইত্যাদি পরিদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর

অনুক্ত কথাগুলােই ব্যক্ত করেছেন যা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে অগ্রসরমান। অভিব্যক্তি। যদিও তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ভারত সরকার বিরাজমান বাংলাদেশসংকট প্রশ্নে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে আর দ্বিধান্বিত নয়। বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণে দৃশ্যমান ছিল ইতােমধ্যেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশ সীমান্তের অভ্যন্তরে শুরু হয়েছে।
৭, ছ, আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়ােজন
দেশের বুদ্ধিজীবীগণের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে তৎপরতা চালানাের জন্য ১৫ ও ১৬ই আগস্ট ১৯৭১ সালে নয়াদিল্লিতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই আন্ত র্জাতিক সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বিশ্ব জনমত গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। | ৭. জ, সমন্বিত প্রচার-পরিকল্পনা  ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বহির্বিশ্বে প্রচারের জন্য পররাষ্ট্র ও বহির্বিশ্ব সেল এক সভা আহ্বান করে। এই বৈঠকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভারতের জাতিসংঘের ডেস্কের পরিচালক, ডি.জি. অল ইন্ডিয়া রেডিও, ডিরেক্টর পাবলিসিটি বিভাগ, ডিরেক্টর টেলিভিশন বিভাগ, ভারত সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা, ডেপুটি ডিরেক্টর পিআইবি, কলকাতা, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব, বাংলাদেশ মিশন। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সরকারের পাবলিসিটি ডিভিশনের উপদেষ্টা। সমগ্র বিশ্বে জনমত সৃষ্টির জন্য শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের কীভাবে বিশ্বজনমত গঠনে কাজে লাগানাে যায় তার উপর ব্যাপক আলােচনা হয়। কতিপয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; যথা: ১. ক. সকল প্রকার সংবাদ বুলেটিন বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ইস্যু করবে, স্থানীয়ভাবে। প্রচারের পূর্বে তা দিল্লিতে টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে পাঠানাে হবে; খ. খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে। এসব বুলেটিন পরের দিন প্রচার করা হবে; গ, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এম, মাকসুদ আলী এ বিষয়ে ভারতের পিআইবি প্রধানের সঙ্গে যােগাযােগ রাখবে। ২. বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘে প্রেরিত প্রতিনিধিদের জন্য দীক্ষিত বিস্তারিত প্রতিবেদন-নিবন্ধ তৈরি। করতে সহৃদয় সম্মতি দেন। মি: দীক্ষিত পরামর্শ দেন যে, বাংলাদেশের প্রতিনিধিবর্গ। নিম্নোক্ত বিষয়াদি সঙ্গে নিয়ে যাবে। তা হলাে: ক, নেতৃবৃন্দের রেকর্ড কৃত ভাষণ; খ, ১৯৭০ মার্চ – ১৯৭১ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলি; গ. এসব ডকুমেন্টস্ যুক্তিগ্রাহ্য করার। জন্য বিগত ২৩ বছর পাকিস্তান যে বাঙালিদের ন্যায্য অধিকারসমূহ অস্বীকার করে। এসেছে বিশ্লেষণপূর্বক তার মৌলিক দিক উপস্থাপন; ঘ, শরণার্থীদের টেপে রেকর্ড করা। সাক্ষাৎকার; ঙ, গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি ব্যক্তিদের বাছাইকৃত সাক্ষাৎকার; চ, গণহত্যার উপর। প্রামাণ্য ফিল্ম; ছ. জহির রায়হান কর্তৃক নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র যথাযথ সম্পাদনাপূর্বক। প্রদর্শন; জ, পাঠানদের ব্যক্তিগত ফিল্ম সাক্ষাৎকার, অল ইন্ডিয়া রেডিও-এর ডিজি এ সকল টেপ তৈরি করার লক্ষ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রলয়ের সঙ্গে যুক্ত মওদুদ আহমদকে সাহায্য করার জন্য একজন প্রকৌশলী সংশ্লিষ্ট করেছেন। তিনি আরাে নিশ্চয়তা দেন যে, স্টেশন। ডিরেক্টর ডি, কে, সেনগুপ্ত সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য ও সহযােগিতা করবে। ৩, বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের পুনর্বাসন ও তাদের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমে নিয়ােজিত করার বিষয়টি পূর্ণাঙ্গভাবে আলােচনা করা হয়। আলােচনার শেষে নিম্নোক্ত।
বিষয় সভায় উপস্থাপন করা হয়; যথা-ক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন মােট পাঁচটি, খ, এই বিভক্তির কারণ বিশ্লেষণ করে বলা হয় যেহেতু শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের কোনাে সম্মানী পাচ্ছেন না সেজন্য তাদের নিজেদের উদ্যোগে তারা ভরণপােষণের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রামের কাজ করছে, গ. শিল্পী-সাহিত্যিকদের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব থাকলেও মূল লক্ষ্য দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে তারা কাজ করছে। এ সব সমস্যা সমাধান করে তাদের মেধাকে কীভাবে কাজে লাগানাে যায় সে ব্যাপারে নিম্নোক্ত পরামর্শ গ্রহণ করা। এসকল শিল্পী সাহিত্যিককে কাজে লাগানাের জন্য : ক, একটি গ্রুপকে যুব ক্যাম্প ও শরণার্থী ক্যাম্পে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া, খ, একটি গ্রুপকে সেনাবাহিনী ও গেরিলা ছাউনিতে গিয়ে তাদের উজ্জীবিত করার দায়িত্ব দেওয়া, গ, একটি গ্রুপকে সমগ্র ভারতবর্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি তুলে দেয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়, ঘ, একটি গ্রুপকে বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা, ও, একটি গ্রুপকে বাংলাদেশের স্বপক্ষে বিদেশে প্রচার ও প্রচারণা করার জন্য নিয়ােজিত করা হয়। সর্বোপরি তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়।
এই কাজ করার আগে নিম্নোক্ত পরামর্শ গৃহীত হয় : ক, সকল শিল্পীকে বাংলাদেশ সরকারের তালিকাভুক্তকরণ, খ, এসব বিষয় বাস্তবায়নের জন্য তথ্য প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সভায় একথা উথাপিত হয় পাকিস্তান বেতার প্রচারিত সকল অনুষ্ঠান পরিবীক্ষণ করে বাংলাদেশ প্রতিনিধির নিকট উপস্থাপন করা। যে কোনাে যুদ্ধের কৌশলী প্রচার-প্রচারণা একদিকে যেমন যুদ্ধরত সৈনিক ও জনগণকে উদ্বীপ্ত, উজ্জীবিত এবং শত্রুকে পরজিত করার দুর্জয় সাহস যােগায়, তেমনি মনস্তাত্ত্বিকভাবে শত্রুপক্ষের মানসিক অভিঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে দুর্বল করে ফেলে। স্বাধীন। বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধে এমনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল যার ফলে সমগ্র  বাঙালি জাতি এক সাগর রক্ত ও মৃত্যুর ভয়ঙ্কর নির্মমতাকে অতিক্রম করে শক্র হননে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলাে। অশ্রুর মাঝেও এনে ছিল গভীর বিশ্বাস এবং বিজয়ের আলােকিত আশ্বাস। এই বেতার কেন্দ্র থেকেই বার বার প্রচারিত হয়েছে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার অস্তিত্ব এবং বিশ্ব স্বীকৃতির আহ্বান। নরঘাতক ইয়াহিয়া খানের বিজয় দম্ভকে প্রতিরােধের আগুনে স্নান করে দিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইথার তরঙ্গের বজ্রকণ্ঠ এবং পাকিস্তানের বেপরােয়া মিথ্যাচারের লাগসই জবাব। অনুষ্ঠানসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা-ইংরেজি সংবাদ, অগ্নিশিখা, যুদ্ধসংগীত, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বজ্র কণ্ঠ, বিশ্ব জনমত, দর্পণ, প্রতিনিধির কণ্ঠ, রণাঙ্গন ঘুরে এলাম, সূর্য শপথ, দৃষ্টিপাত, সংবাদ পর্যালােচনা, নাটক ইত্যাদি। মুজিবনগর সরকারের অনুরােধে ২৫শে মে ভারত সরকার ৫০ কিলােওয়াট মধ্যম তরঙ্গ-শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার সরবরাহ করে সেই থেকে নব পর্যায়ে, নবােদ্যমে, উৎসাহে চালু হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নবযাত্রা। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একদিকে যেমন রণাঙ্গনের ২য় ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করেছে, অন্যদিকে বিশ্ব পরিসরে কূটনৈতিক মাধ্যম হিসেবে কৃতিত্বের সঙ্গে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছে যথার্থভাবে।”

মুজিবনগর সরকারের বহির্বিশ্ব প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা শীর্ষক বস্তুনিষ্ঠ ঘটনাবলি, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর

মানবতাবিরােধী ঘৃণ্য কার্যক্রম, গণহত্যা এবং গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রকাশিত বই, পুস্তক ও প্রামাণ্যচিত্র, বিশ্বব্যাপী প্রচার করার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে প্রেরণ করা হয়। | ৭, ঝ, বন্ধুরাষ্ট্রের পরামর্শে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশ সরকারের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নামে হিসাব খােলা হয়। এছাড়াও অন্য আরাে বাঙালির ব্যক্তিগত নামে। সরকারের পক্ষে হিসাব খােলার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। মূলত বিদেশে মুজিবনগর সরকারের। কূটনৈতিক তৎপরতার সুবিধার্থে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনাে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে এসব হিসাব বন্ধ হয়ে গেলে তা বাংলাদেশের জনগণের ব্যবহারের জন্য। বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
৭. ঞ. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করার লক্ষ্যে কূটনৈতিক কার্যক্রম | বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের কাছে অনুরােধ জানানাে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মুক্তিযােদ্ধাদের মানসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে সর্বদা উপস্থিত ছিলেন। তাঁর অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হয় । মুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য। বৃহৎ শক্তিগুলাের মাধ্যমে পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়ােগ করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী। প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ২১শে জুলাই বিশ্বের ৭টি রাষ্ট্রের সরকার প্রধান ও জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলকে তারবার্তা প্রেরণ করেন। তারবার্তায় বিষয়বস্তু ছিল নিম্নরূপ:৭৫
I wish to draw the attention of your Excellency to the reported decision of Yahya Khan to stage a trial of Sheikh Mujibur Rahman, the Head of State of the People’s Republic of Bangladesh. As your Excellency is aware, the ruthless killing of nearly one million people and the driving out of more than seven million people has failed bring about the much desired ‘normalcy. On the contrary, the sagging morale of the West Pakistani army, now needs to be bolstered up by a desperate act- the execution of the Sheikh after a farcical trial.
The grave consequences of any such farcical trial and execution of the Sheikh can cause repercussions which will engulf the whole area in no time.
I, therefore, appeal to you, on behalf of the seventy five million people of Bangladesh, to use your good offices to stop this distardly act and secure the release of the Sheikh and his family.
১০ই আগস্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম পুনরায় বৃহৎশক্তিবর্গের নিকট বঙ্গবন্ধু মুক্তির লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানিয়ে এক বিবৃতি প্রচার করেন:

We feel alarmingly concerned at the reported trial of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman tomorrow by the Army Junta of Islamabad. This

gruesome farce in the name of trial is going to be one of the greatest tragedies of civilisation.
Vindication of animalism and animosity of this nature does call for immediate and prompt intervention by the United Nations and all the peaceloving powers of the world. We want to clearly convey to all nations of the world that any attempt to try and execute Sheikh Mujibur Rahman will enjoin an obligation unto death on every man, woman and child of Bangladesh to avenge his murder. The situation is bound to escalate and engulf this area of the world into the eruptions of the volcano.
In the name of civilisation, democracy, humanity, justice and fair play! urge upon all Heads of states of the world and the U.N. Secretary General to intervene and get unconditional release of the Sheikh and his family to pave the way towards peace.
৮, আন্তর্জাতিক সহযােগিতা ও প্রতিবন্ধকতা।
সােভিয়েত ইউনিয়ন এ সময় শেখ মুজিবের বিচার ও বাঙালিদের ক্ষেত্রে যেন মানবাধিকার লঙ্গন করা না হয় সে ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করে। সােভিয়েত ইউনিয়ন মার্চ-এপ্রিলের প্রথম থেকেই রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক এবং মানবিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ও ভারতের ঘটনাবলি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র জনগণের উপর নির্মম আক্রমণ, গণহত্যা, ধর্ষণ ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নিন্দা করে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের অবিলম্বে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে বলেছে। গণহত্যা বন্ধ এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসন কল্পে পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীকে চাপ প্রয়ােগ করে। বিরাজমান পরিস্থিতিতে সােভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্ব ও আঞ্চলিক পর্যায়ে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্কের সংশ্লিষ্টতায় বৃহৎশক্তি বর্গের মধ্যে একমাত্র সােভিয়েত ইউনিয়ন এর পক্ষেই রক্তক্ষয় ও নির্মম আক্রমণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের অনুকূলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা সম্ভব হয়েছিল।
সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগনী ২রা এপ্রিল ১৯৭১ সালে পাকিস্ত েিনর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে চিঠি লেখেন। পরবর্তীকালে সােভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়ভাবে সহযােগিতা করে। | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে কারও কোনাে সংশয় ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বিশ্বস্ত। বন্ধু।” এ সত্ত্বেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা খন্দকার মােশতাক বা তার প্রতিনিধি কেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যােগাযােগ রাখতেন তা অনুমেয়। যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের সাথেও যোগাযােগ রক্ষা করতেন। জহিরুল কাইয়ুম কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের এক দূতাবাস কর্মকর্তাকে প্রদত্ত বক্তব্যে এমন ধারণা পাওয়া যায়। কাইয়ুম বলেন যে, ” পাকিস্তানের। সাথে একটা আপােষরফা করার ব্যাপারে মােশতাকের প্রতিনিধি হিসেবে কাইউম যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৯৭১ সালের ১৯শে আগস্ট মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তার সাথে অন্য এক বৈঠকে কাইয়ুম বলেন যে, “Mujib’s life is more valuable than independence.৮% কিন্তু তখন বাংলাদেশের জনগণ শেখ মুজিবের মুক্তি ও স্বাধীনতা দু’টো আদায়ের ব্যাপারেই বদ্ধপরিকর ছিলেন। জহিরুল কাইয়ুম এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে বলেন যে, “If Mujib is alive there is hope for compromise, if he is killed there is no hope.” যুক্তরাষ্ট্রের গােপন দলিলপত্রে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে ১লা মার্চেই তারা অনুধাবন করেছিল বাংলাদেশ সম্ভবত দ্রুততার দিকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান বর্তমান পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে যেতে চায়। কিন্তু মার্কিন নীতি হলাে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে। ৬ মার্চ হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, শেখ মুজিব বাংলাদেশের পৃথক করার স্বীকৃতি চাইলে ঢাকায় আমাদের মিশনের কেউ যেন এ সম্পর্কে কোনাে কথা না বলে তা ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দেয়। উক্ত বৈঠকে কিসিঞ্জার স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা ক্রিস্টোফার ভ্যান হেলেনকে জিজ্ঞাস করেন, বাংলাদেশ নিজস্ব কোন বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করবে কি না? এর উত্তরে ভ্যান হেলেন জানান, “বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত।”৮৩ মার্কিন সিক্রেট ডকুমেন্টে ১৫ই মার্চের আলােচ্য বিষয় ছিল মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, “মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের ৩৫টি নির্দেশনামা জারি করেছে এবং সরাসরি ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, কিন্তু একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কে সতর্ক থেকে শেখ মুজিব জনগণের নির্বাচিত নেতা হিসেবে গণতন্ত্রের ভাষায় তা প্রকাশ করছে।””” ২৬শে মার্চে হেনরি এ. কিসিঞ্জার-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান বিষয়ে আলােচনার সার সংক্ষেপে পুনরায় লক্ষণীয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে অনুরােধ আসলে তা বিলম্ব করা হবে। 
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে উপস্থাপন এবং বিভিন্ন দেশ থেকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায়ের পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের সিক্রেট ডকুমেন্ট থেকে পরিলক্ষিত হয়। ১৩ই এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় ব্রিটেনের ডেপুটি হাই কমিশনার এবং মার্কিন কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠকে আগ্রহ প্রকাশ করলে প্রথম দিকে ব্রিটেনের পক্ষে সম্মতি জানানাে হয়। কিন্তু ঢাকা থেকে মার্কিন কর্তৃপক্ষ কলকাতায় কনসুলারের সঙ্গে বৈঠকে অস্বীকৃতি জানায়। ঢাকা থেকে মনে করা হয়, এই বৈঠক বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে বলে ধারণা করা হতে পারে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টে ক্রিস্টোফার ভ্যান হেলেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে যে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে তার কোনাে প্রতিনিধি যেন মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করতে না পারে তার জন্য বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। | এর পূর্বেই ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসুল জেনারেল আর্চার কে, ব্লাড ঢাকা থেকে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ওয়াশিংটন বরাবর এক টেলিগ্রাম প্রেরণ করেছিলেন। সেখানে মার্কিন নীতির তীব্র সমালােচনা করে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিঘােষিত নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। না। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সামরিক জান্তার বর্বরােচিত ও অমানবিক আক্রমণের বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং দেউলিয়াত্বের প্রমাণ দিয়েছেন। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষিপ্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন, ঢাকার কনসাল জেনারেল আর্চার, কে, ব্লাডকে ঢাকা থেকে অবিলম্বে বদলি করেন। বলা বাহুল্য আর্চার কে. ব্লাড পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের উপরে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজ ও ধর্ষণের অভিযােগ উত্থাপন করেন।

কূটনৈতিক ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার সাফল্য অর্জন করেন কলকাতায় পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্থাপন যা কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানের জন্য চপেটাঘাত। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলােচনা করে ১৮ই এপ্রিল কলিকাতাস্থ পাকিস্তানি ডেপুটি কমিশনার হােসেন আলী। এবং আরাে ৫জন অফিসার এবং ৬৫ জন বাঙালি স্টাফসহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ৩০জন স্টাফ এবং কর্মকর্তা বরখাস্ত করেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সকল ঘটনা, সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে পাকিস্তানি সরকার বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে গণহত্যা করে চলেছে, এই অবস্থায় পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব নয়। ১৬শ শব্দের এক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক রায় পাকিস্তান সরকার কীভাবে নসাৎ করে বাঙালি জাতিকে পদানত ও ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছে তা আজ স্পষ্ট। পাকিস্ত নি সরকার বিষয়টি পূর্বাহে অবগত থাকায় মিশনের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অবিলম্বে ইসলামাবাদে ডেকে পাঠানাে হয়। তার পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার মেহেদি মাসুদকে কলকাতাস্থ ডেপুটি হাইকমিশনার পদে নিয়ােগ দেন। কিন্তু তিনি হাইকমিশনার হিসেবে কলকাতায় যােগদান করতে ব্যর্থ হন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কর্তৃক নিষ্ঠুর আক্রমণ, গণহত্যা, এবং জীবনের নিরাপত্তার লক্ষ্যে জনস্রোতের মতাে বিপুল সংখ্যক বাঙালির সীমান্ত অতিক্রম, শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বিচলিত ও উদ্বিগ্ন করে তােলে। একই সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধ বিশ্বের সকল প্রচারমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ভারতীয় সামরিক বাহিনী, প্রাক্তন জেনারেলগণ, পার্লামেন্ট সদস্য, এমনকি মন্ত্রী পরিষদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ও অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি, চ্যবন অবিলম্বে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। দেশ-বিদেশের প্রতিক্রিয়া দেশি-বিদেশি প্রচারমাধ্যম এবং ক্রমবর্ধমান জনমতের চাপে ২৭শে মার্চ ভারতের। পার্লামেন্টে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিমালা এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি। শেখ মুজিবের প্রণীত নীতির সঙ্গে ভারতীয় নীতি ও আর্দশের মিল ইত্যাদি বিষয়ে ইন্ধিরা গান্ধী উপস্থাপন করে ভারতীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পৰ্কীয় বির্তকে হস্তক্ষেপ করেন। তিনি বাংলাদেশে সংঘটিত নিষ্ঠুর গণহত্যা, জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা, নিরস্ত্র। জনগণের প্রতিরােধ এবং স্বাধীনতার অদম্য আকাক্ষা বিশ্লেষণ করে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করেননি। ৩১শে মার্চ পার্লামেন্টের এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক উত্থাপিত এক প্রস্তাবে সর্বাত্মক সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদানের অঙ্গীকার ঘােষিত হয়। ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বিভিন্ন ধরনের সমর্থন, সাহায্য-সহযােগিতা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এসব সহায়তা হলাে : ১. প্রাথমিকভাবে

বি.এস,এফ, কর্তৃক সীমান্তে অস্ত্র দ্বারা প্রতিরােধ যুদ্ধে সহায়তা, ২. গেরিলাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদান, ৩, শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া এবং ৪. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সর্বাত্মক কূটনৈতিক সমর্থন, বাংলাদেশ সংকটকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা। | ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ভারতের রাষ্ট্রপতি বরাবর এক পত্রে অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানান এবং অবগত করেন যে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের বৈধ সরকারের নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যগত সম্পর্ক বিদ্যমান থাকায় অবিলম্বে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অনুরােধ জানান।
জুন-জুলাই মাসে বাংলাদেশ প্রশ্নে রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি নিক্সন প্রশাসনের পক্ষ হতে স্পষ্টতই প্রচারিত হতে থাকে। ১লা জুলাই মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব হেনরি কিসিঞ্জার নয়াদিল্লিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানকে যে অস্ত্র সরবরাহ করছি তা ২৫শে মার্চের পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী। এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।” ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ঐ সাক্ষাতকারের সময় ছিল মাত্র ১৫ মিনিট। ৬ জুলাই ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত সেক্রেটারি পি.এন, হাকসার তার আলােচনায়
স্পষ্ট করেই কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন, “I did not want to go to war but did not know how not to go to war”, পরবর্তীকালে কিসিঞ্জার ইন্দিরা গান্ধীর মনােভাব সম্পর্কে বলেছেন, তিনি যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছেন।”৯০
প্রকৃতপক্ষে ইন্দিরা গান্ধী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, যুদ্ধ ব্যতীত উপমহাদেশের এই মানবিক বিপর্যয় থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নয়। তদুপূর্বে বিশ্বজনমত ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার কৌশল গ্রহণ করেন। সেই লক্ষ্যেই তিনি ৯ই আগস্ট সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযােগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ঐ চুক্তির ৮ ও ৯ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ ছিল চুক্তিবদ্ধ দু’টি দেশের মধ্যে কেউ আক্রান্ত হলে পরস্পর পরস্পরকে সার্বিক সহযােগিতা করবে। পাকিস্তানি সামরিক চক্রের বু প্রিন্টকে কার্যকরী করার মার্কিন কূটনৈতিক প্রয়াস প্রথমবারের মতাে সরাসরি বাধার সম্মুখীন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিকট এই চুক্তির প্রতিক্রিয়া ছিল বিরাট আঘাত। ৯, কুটনৈতিক যুদ্ধে অগ্রযাত্রা। ২৪শে অক্টোবর থেকে ১৯ দিনের জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিম ইউরােপ ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের পূর্বে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। দিল্লিতে আলােচনাকালে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশ-সংকট নিরসনে তিনি শেষবারের মতাে সংশ্লিষ্ট সরকারসমূহের সঙ্গে আলােচনা করবেন, ব্যর্থ হলে পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের পথ বেছে নেবেন।”
 বিদেশ সফরে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, আন্তর্জাতিক শক্তি মূল সংকট নিরসনে আগ্রহী বা আন্তরিক নয়। দেশে ফিরে ১৫ই নভেম্বর তিনি ঘােষণা করেন, “বাংলাদেশ টিকে থাকার জন্য এসেছে। দুনিয়ার কোনাে শক্তি নেই এই অবস্থান থেকে কেউ নড়াতে পারে।”

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর এই বক্তব্য ছিল ইয়াহিয়া খানকে উস্কে দেওয়ার একটি ফাঁদ। সেই ফাঁদে পা দিয়ে রাগান্বিতভাবে চীনা মন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান

ঘােষণা করেন, “তিনি দশ দিনের মধ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন।” বাস্তব অর্থেই তা ছিল দ্ব্যর্থহীন ঘােষণা।
যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এম. এ. জি. ওসমানী অবিলম্বে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের পক্ষে ব্যর্থতা প্রকাশ
করেন।৯৫
| মুজিবনগর সরকারের পক্ষ হতে ভারত সরকারের নিকট প্রস্তাবগুলাে ছিল : ১. ভারত সরকার কর্তৃক অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক ও আইনানুগ স্বীকৃতি প্রদান; ২. ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী সমন্বয়ে যৌথ কমান্ড গঠিত হবে এবং অবিলম্বে যুদ্ধের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবে; ৩. জাতিসংঘের উদ্যোগকে শ্লথ। করতে হবে এবং জাতিসংঘ যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনাে আপােষ বা হস্তক্ষেপ না করতে পারে সে ব্যবস্থা ভারতকে নিতে হবে। বলা বাহুল্য, শ্রীমতী গান্ধী এই বিষয়গুলােতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
১৬ই নভেম্বর ইন্ধিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে সাক্ষাৎ করলে সফর সম্পর্কে তিনি দেশসমূহের অভিজ্ঞতার বর্ণনা। দেন। কলকাতায় ১ ও ৩ ডিসেম্বর যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী। ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ডি, পি, ধর যৌথ কমান্ড গঠনে সমর্থ হন। সিদ্ধান্ত হয়, যৌথ কমান্ডে ইস্টনি কমান্ডের জগৎ সিং অরােরা ও মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল (অব.) এম. এ. জি, ওসমানী কাউন্টার-পার্ট দিবসে দায়িত্ব পালন করবেন।
ভারতীয় সমরবিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেন, মুক্তিবাহিনীর সার্বিক সহযােগিতা ব্যতীত এত দ্রুত ঢাকার পতন ঘটতাে না।” | ৩রা ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তান ভারতের উপর আক্রমণ চালায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্ধিরা গান্ধী বরাবরে ৪ঠা ডিসেম্বর লিখিত এক পত্রে বলেন, “আমরা এই মুহূর্তে গভীর দুঃখের সঙ্গে জানতে পারলাম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ৩রা ডিসেম্বর অপরাহ্নে আপনার দেশের উপরে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়েছে। ইয়াহিয়া খান আন্তর্জাতিক নিয়মাবলিকে ভঙ্গ করে হঠকারি আক্রমণ চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করেছে, পাকিস্তানের এই আক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ ভূমিকা আরাে জোরদার হবে যদি আমরা আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হই।

১০. উপসংহার মুক্তিযুদ্ধকালে বৈদেশিক সম্পর্ক বিভিন্ন ভাবে গড়ে ওঠে। বহু প্রতিকূলতার মধ্যে সংগঠিত বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও প্রতিনিধিবৃন্দের সঙ্গে বিদেশিরা যােগাযােগ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে। আমেরিকান কংগ্রেসের স্বনামধন্য অনেক সদস্য যেমন এডওয়ার্ড কেনেডি, ফ্রাঙ্ক চার্চ প্রমুখ, যুক্তরাজ্য থেকে পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের, জন স্টোনহাউস, রেজিনাল প্রেনিটি, ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিবৃন্দ প্রতিনিধি এবং আরও অনেকে ক্রমাগতই ভারতে আসছিলেন, মূলত 

সরেজমিনে অবস্থা পরিদর্শন করতে। তারা মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাতও করতেন। কোনাে কোনাে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকতেন।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভারত-সরকারের সাথে যােগাযােগ তিন ভাবে হতাে। নীতি-নির্ধারণ বিষয় অথবা যুদ্ধের বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যােগাযােগের প্রয়ােজন হলে প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান সেনাপতি; কূটনৈতিক বিষয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা মন্ত্রণালয় আর দৈনন্দিন রুটিন কর্মনীতি হলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ের মাধ্যমে যােগাযােগ হতাে। কঠোর গােপনীয়তার মধ্যে ভারতসরকারের প্রতিনিধি ও কর্মকর্তাবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক হতাে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সন্দেহজনক কার্যকলাপের কারণে তাকে বৈঠকের বাইরেই রাখা হতাে। তবে এই ব্যবস্থার কথা তাকে কখনই জানতে দেওয়া হয়নি। এমনকি ভারতের তরফ থেকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষার্থে নিরাপত্তাজনিত কারণ প্রদর্শন করা হতাে।১০০ | বস্তুত ভারত-সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে যােগাযােগের কয়েকটি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতের পক্ষে তারা কলকাতায় বিদেশমন্ত্রকের একটি আবাসিক অফিস স্থাপন করেন যার প্রধান ছিলেন এ. কে রায়, আর সহকারী মিস অরুন্ধতি ঘােষ। ঘােষ ব্যক্তিগতভাবেও বাংলাদেশ সরকারকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি মমত্ববােধ এবং তার নিজস্ব দায়িত্ববােধ একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাজকর্মের, বিশেষকরে পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি দেখার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনােয়ারুল করিম চৌধুরী কর্তৃক প্রদত্ত এক প্রজ্ঞাপনে প্রমাণিত হয় একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম ও কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালিত হচ্ছিল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তা, বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যঘােষণাকারী বিদেশে কর্মরত কর্মকর্তা, বিশ্বপরিসরে ব্যাপৃত দেশপ্রেমিক বিভিন্ন শ্রেণিপেশার কর্মকর্তা, কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী, প্রশিক্ষণার্থী ও অধ্যয়নরত ছাত্র-শিক্ষকদের অবদান উল্লেখ্য। মুজিবনগর সরকারের অক্লান্ত পরিশ্রমে ও পরিকল্পনায় প্রবাসী বাঙালিরা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রচার প্রচারণায় যুক্ত হয় এবং বাঙালি জাতির স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রত্যয়দীপ্ত শপথ নিয়ে কাজ করেছে। তাদের নিঃস্বার্থ কর্মউদ্দীপনা মুজিবনগর সরকারকে যেমন সহায়তা করেছে, তেমনি উজ্জীবিত করেছে।
মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৎকালে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে বিদেশে কূটনৈতিক দূতাবাস স্থাপন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ-প্রাথমিকভাবে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও স্টকহােমে মিশন স্থাপন ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিশেষ সাফল্য। এসব দূতাবাসে বিশেষকরে লন্ডনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন স্বাধীন হিসেবে বাংলাদেশের পৃথক অস্তিত্ব সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জাতিসংঘে প্রতিনিধিদল প্রেরণ; আফগানিস্তান, সিরিয়া ও লেবাননে প্রতিনিধিদল প্রেরণ; নেপালে প্রতিনিধিদল প্রেরণ এবং শ্রীলংকা বার্মা ও অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব দেশে প্রতিনিধিদল প্রেরণ এবং এই তৎপরতায় আশানুরূপ ফললাভ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের এক অভূতপূর্ব সাফল্য বললে অত্যুক্তি হবে না। 
সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় বিদেশে আরাে যেসব সাফল্য অর্জিত হয় সেগুলি তুলে ধরা যেতে পারে ।
ক. বাংলাদেশি নাগরিক এবং সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান ও অন্যান্য কয়েকটি দেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হয় এবং তাতে অনেক কর্মসফলতা অর্জিত হয়।
খ, বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানি শাসকবৃন্দের অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন, আর হত্যাকাণ্ডের বিশদ খবর শিরােনামে প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়।
গ, পাকিস্তান বর্বর বাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশ থেকে পার্শ্ববর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বিতাড়িত বাঙালি শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহে উল্লেখযােগ্য সাফল্য লক্ষণীয়। | ঘ. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসমূহে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকগণ বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশপূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন ছিলাে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সফলতার দৃশ্যমান এক নিদর্শন। বিদেশে কর্মরত যে সব দেশে কূটনীতিকগণ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন, সেসব দেশের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল ইরাক, ফিলিপাইন ও আর্জেন্টিনা, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল ও থাইল্যান্ড এসব কর্মরত উচ্চপদস্থ কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের আনুগত্য লাভের বিষয়টিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত। . ঙ. বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণরত সরকারি কর্মকর্তাদের স্বতঃপ্রণােদিত আনুগত্য প্রকাশ ছিল সরকারের কর্মতৎপরতার এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর। যুদ্ধকালে এঁদের আনুগত্য পাকিস্তানি। সরকারের মনােবল যেমন দুর্বল করে দেয়, তেমনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনােবলকে প্রবলভাবে আশান্বিত ও উজ্জীবিত করে। এসব প্রশিক্ষণার্থী বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছিলেন।
চ, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা জোরদার করার লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন বহিঃপ্রচার ও প্রকাশনা বিভাগকে জোরদার করা হয়েছিল।”  ছ, মুক্তিযুদ্ধকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে জাতিসংঘের প্রতিনিধি। প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান মুজিবনগরের মুক্তাঞ্চলে শরণার্থীদের দুর্দশা দেখতে। এসেছিলেন। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে বিপুল সাহায্যসামগ্রীসহ রেডক্রস দলের বাংলাদেশে আগমন পররাষ্ট্র বিষয়ক এক বিরাট সাফল্য।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী লােকসভায় এক বক্তব্যে পাকিস্তান বাহিনীর বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ এবং বাংলাদেশ স্বীকৃতির ব্যাপারে এক ঘােষণা দেন। তিনি বলেন, “আমরা আশা করি ও বিশ্বাস করি যে, এই নতুন দেশের জাতির পিতা শেখ। মুজিবুর রহমান তার জনগণের মধ্যে যথাযােগ্য স্থান গ্রহণ করে বাংলাদেশকে শান্তি ও সম্প্রীতির পথে নিয়ে যাবেন। সােনার বাংলায় একটি সার্থকতাপূর্ণ ভবিষ্যৎ সুষ্টির উদ্দেশ্যে আত্মনিয়ােগ করার জন্য বাংলাদেশের জনগণের সময় এসেছে তাদের জন্য * আমাদের শুভেচ্ছা রইলাে। তাদের এই বিজয় শুধু তাদের একার নয়। যে সব জাতি মানবিক চেতনার মূল্য দিয়ে থাকে সে সব দেশ এ বিজয়কে মুক্তির সন্ধানে মানুষের বিরাট সাফল্য হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।”১০৫ মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা হাজারাে কুটিল, জটিল আবর্ত ও ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, ভারত, জাপান, শ্রীলঙ্কা, বার্মা, পূর্ব জার্মানি, থাইল্যান্ড, পােল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে সফল হয়। মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির লক্ষ্যে বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে তারবার্তা প্রেরণ করেন। মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সদস্য সহ বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন। মার্কিন বার এসােসিয়েশনের সদস্যবৃন্দ, সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্য এবং বিশ্বের বিভিন্ন মানবতাবাদী সংস্থার কাছে বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে তথ্যাদি প্রেরণ ও প্রচার করে জনমত গঠন মুজিবনগর সরকারের সাফল্য।  মুজিবনগর সরকার প্রেরিত প্রতিনিধিবৃন্দ প্রবাসী বাঙালিদের সহযােগিতায় বিশ্ব শান্তি। সম্মেলন, বাংলাদেশের বন্ধু সমিতি, বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম ও সাক্ষাতকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনিবার্যতা তুলে ধরেন। পাশাপাশি সভা, মিছিল এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একদিকে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর জন্য অর্থ ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তঃইউনিয়ন কনফারেন্সসহ বিভিন্ন সম্মেলনে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি প্রেরণ করে এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কূটনৈতিক যুদ্ধে অবর্তীণ হয়েছিলেন যার সার্থক ফলাফল মুজিবনগর সরকারের প্রজ্ঞা, মেধা, দূরদৃষ্টি ও দেশপ্রেমের অনন্যসাধারণ অবদান। বৈদেশিক প্রচার বিভাগ পরিকল্পিতভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা যথার্থভাবে সমন্বয় ও সম্প্রচারের লক্ষ্যে কাঠামােগত পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলাে। এই পদক্ষেপগুলাে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত ও কার্যকর হওয়ার চলতি পথেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে ওতােপ্রতভাবে উজ্জ্বল চেহারা ও অনমনীয় মনােভাব নিয়ে কার্যকরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন প্রবাসী বাঙালিসমাজ যা ইতিহাসে উল্লিখিত, এ বিষয়গুলাে। পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচিত হবে।
পরিশিষ্ট ২ক ২৩শে নভেম্বর, ১৯৭১ সাল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যৌথভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্ধিরা গান্ধী বরাবর পত্র প্রেরণ করেন। পত্রটি প্রকৃতপক্ষে কৌশলগত পরিকল্পনার মূল্যায়ন “ইউরােপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সফরে যাওয়ার পূর্বে আমরা ১৫ই অক্টোবর আপনার বরাবর যে পত্র লিখেছিলাম আশা করছি সে সম্পর্কে আপনার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। উক্ত পত্রে আমাদের মূল অনুরােধ শুধুমাত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টিই ছিল না তার সঙ্গে আমরা আশা করেছি আমাদের গভীর অনুভূতি এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম যে দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে সে সম্পর্কে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতকালে তুলে ধরা সহজ হয়। আপনার আলােচনা ও বিবৃতি যা আমরা জানতে পেরেছি তা থেকে আমাদের মনে এ আশা জাগ্রত হয়েছে যে, আপনি রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সংকট নিরসনে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনা করার বিষয়ে বিশ্ব নেতাদের প্ররােচিত করেছেন। এমনকি আপনি যখন বিদেশে বর্তমানের বাস্তব পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী রাজনৈতিক সমাধানের উপর গুরুত্ব আরােপ করছিলেন তখনও আমরা দেখলাম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তাদের অত্যাচার নিপীড়নের নীতি যা তারা গ্রহণ করেছে তা অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের জনগণের উপর চালিয়ে যাচ্ছে। ১২ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতির পর পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের উপর আরাে অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সমাধানের যে দাবী উঠেছে সে প্রস্তাবসমূহ তারা প্রত্যাখ্যান করে। চলেছে যা আমাদের ধারণা ও মূল্যায়নের যথার্থকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিগত দু সপ্তাহে এটাই পরিদৃষ্ট হয়ে উঠেছে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কোন যুক্তিপূর্ণ পথ উন্মুক্ত রাখেনি এবং যাতে বিরাজমান বাস্তব অবস্থার মুখােমুখি হতে হয়। ইতােমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের সরাসরি পরিণতিতে বাংলাদেশ থেকে আরাে অগণিত শরণার্থী ভারতে চলে আসছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নিপীড়ন অব্যাহত রেখেই তথাকথিত স্বাভাবিক অবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ একটি প্রতারণাপূর্ণ নীতি। সাম্প্রতিককালে তাদের অত্যাচার ও ধ্বংসযজ্ঞ নতুন ও অভাবনীয় মাত্রায় উপনীত হয়েছে। গত একপক্ষ কাল ধরে আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন কারফিউ জারী করে গ্রেফতার, পােড়ামাটি নীতি গ্রহণ এবং ভিটেমাটি থেকে জনগণকে উচ্ছেদ করে চলেছে। সমগ্র গ্রামকে মাটিতে। মিশিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অধিবাসীদের হত্যা করা হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি পর্যাক্রমিকভাবে এই নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে যার ফলে আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ আশ্রয়হীন এবং অন্নহীন অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। আমাদের নিরূপণে কমপক্ষে ৫০ লক্ষাধিক নাগরিক নির্মম ট্রাজেডির ভেতরে অবস্থান করছে যারা কোন রকম সাহায্য ও রিলিফ হতে বঞ্চিত। এটা ভারতে যে এক কোটি লােক চলে এসেছে তার বহির্ভূত হিসাব এবং প্রতিদিনই এর সংখ্যা বৃদ্ধি হয়ে চলেছে। এ সমস্ত ঘটনাবলী আমাদের এই সূত্রে উপনীত করে যে, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তাদের মিথ্যাচারের পূর্ব পরিকল্পনা হতে সরে আসেনি এবং আমাদের জাতিসত্তাকে পরিকল্পিত ধ্বংস করার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়নি, বাংলাদেশ সরকারের শর্তে আলাপ আলােচনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে শুধু বাংলাদেশ নয় পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে ইয়াহিয়া খান সামরিক জাভার উন্মত্ততা প্রকাশিত হচ্ছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানের জনগণ যেভাবে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে যার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের এ দুটো প্রদেশে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নির্বাচনের যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল সে পাটিকে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছে।

এ সবগুলাে আমাদের পূর্বের মৌলিক ধারণাকে সমর্থন করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গত কয়েক মাসের ঘােষণা ও কার্যকারণ সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, সামরিক জান্তার চক্রান্তের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ সম্পৃক্ত নয়, এটা শুধু এই নির্দেশই 

করে যে, বাংলাদেশের মানুষের শুধু নয় সমগ্র পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়কে ধ্বংস করতে সামরিক জান্তা সংকল্পবদ্ধ।
| ১৫ই অক্টোবরে পত্রে আপনাকে অবগত করেছিলাম মুক্তিবাহিনীর অপারেশন কার্যক্রম ক্রমশই জোরদার হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের সর্বজন সমর্থনে মুক্তিবাহিনী বিজয় অর্জন করে চলেছে এবং সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে দেশমাতৃকার এক বিপুল অংশ তারা কার্যকর প্রশাসিনকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, বর্তমানে আমরা বাংলাদেশের দুই তৃতীয়াংশ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছি। ১৫ই অক্টোবরের পত্রে আমরা বলেছিলাম বাংলাদেশের অর্ধেক অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করেছি। আমরা শুধু এসব অঞ্চল মুক্তই করিনি আমরা ক্রমাগতভাবে এসব মুক্ত অঞ্চলে আমাদের কর্তৃত্ব ও বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করেছি। এমনকি বাকি অঞ্চলসমূহে জনগণের সমর্থনে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী শুধুমাত্র নিজের কয়েকটি দুর্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের সাফল্যের পাশাপাশি সময়ের পরিসরে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বুঝতে সক্ষম হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের উপর জোরপূর্বক কতত্ত্ব ও নিয়ন্ত্রণ চালাচ্ছে। এটা শুধু আমাদের দেশমাতৃকাকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করার অঙ্গীকার এবং আমাদের লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় প্রত্যয়। হাজার হাজার দেশপ্রেমিক যুবক প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীকে স্ফীতকায় করে তুলছে এবং তারা বাংলাদেশ থেকে চিরদিনের জন্য উপনিবেশিক শৃঙ্খলের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য উৎসর্গকৃত। এটা আমাদের স্থিরকৃত ইচ্ছা দীর্ঘ দু-দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষ যে নিপীড়ন ও মর্মান্তিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিন যাপন করেছে এবং ২৫শে মার্চের ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরবর্তী ঘটনাসমূহ সংঘঠিত হয়েছে তার মূল শিকড় তুলে ফেলব।
তাদের শােষণ ও দাসত্বের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এটা আমাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম। এটা আমাদের বিশ্বাস আমাদের এ সংগ্রাম অচিরেই বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট থেকে যথাযােগ্য সমর্থন লাভ করবে, বিশেষ করে আমাদের মহান প্রতিবেশী ভারতের নিকট থেকে। আমাদের এই প্রত্যাশার পেছনে ভারতের পার্লামেন্টের ৩১শে মার্চের দ্ব্যর্থহীন। প্রস্তাব গ্রহণ যা বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত রয়েছে তার প্রতি সমবেদনা এবং সম্মতি জ্ঞাপন। ইতােমধ্যে ৮ মাস অতিক্রম হয়েছে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা, আন্তর্জাতিক চাপ, পরামর্শ বাংলাদেশের মহান এবং নির্বাচিত অবিসংবাদিত নেতা প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানে আলাপ আলােচনা করতে অপারগতা অথবা আপনারা যে অসীম ধৈর্য এবং গঠনমূলক কার্যক্রম ও সহিষ্ণুতার দিকে চলেছেন তাকে উপেক্ষা করেছে। পক্ষান্তরে তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী সারা বিশ্বকে মূল সমস্যাকে পাস কাটিয়ে এই অবস্থাকে ভারতপাকিস্তানের বিরােধ হিসেবে চিহ্নিত করতে আন্তর্জাতিকভাবে এই ইস্যুকে তুলে ধরছে। আমরা এ সম্পর্কে সচেতন যে, আপনার সরকার যথাযথ প্রেক্ষিত তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রকৃত অবস্থার প্রতি সরাসরি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এ সমস্ত শান্তিপূর্ণ মীমাংসার উদ্যোগ বাংলাদেশের জনগণ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার মধ্যে শান্তিপূর্ণ।  সমাধানের উপনীত হতে ব্যর্থ হয়েছে। এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক ঘােষণা এবং কার্যকলাপ প্রমাণ করে রাজনৈতিক সমাধানের সামান্যতম সুযােগ নেই। এই প্রেক্ষিতে আমাদের আশ্চর্য এবং ব্ৰিত করে যে, ভারত এখন পর্যন্ত সতর্কতা ও সংযত নীতি গ্রহণ করে চলেছে একটি পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিপক্ষে। * বাংলাদেশের জনগণ অবগত আছে যে, আফ্রো-এশিয়া অঞ্চল হতে উপনিবেশিক দাসত্ব দূর করার জন্য ভারত অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের অত্যাচারিত জনগণের স্বপক্ষে উপনিবেশ মুক্তকরণের লক্ষ্যে ভারত সবসময়ই নিরবচ্ছিন্নভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং সােচ্চার হয়েছে।
আপনার সরকার ও জনগণ সর্বদা মানবিক মর্যাদা, সাম্য ও স্বাধীনতা যেখানে বিপন্ন হয়েছে সেখানেই তারা সােচ্চার হয়েছে। বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে আপনি অব্যাহতভাবে তাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করে এসেছেন। ভারত সবসময়ই মৌলিক অধিকার এবং মুক্তির সংগ্রামকে সমর্থন দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আপনি সর্বদাই গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জোট নিরপেক্ষ বিদেশ নীতির প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদ এবং সরকার এই সমস্ত মহান আদর্শ ও প্রত্যাশার প্রতি ইতােপূর্বে সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। এখানে আমরা পুনর্বার বলতে চাই ইতােমধ্যেই আমরা আমাদের রাষ্ট্রের নীতিমালা ঘােষণা করেছি, যেখানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্ম, বর্ণ, গােত্র এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জন্য সমধিকার ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে আমরা দৃঢ়ভাবে জোট নিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে এবং উপনেবিশবাদ, বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ যে কোন ভাবেই থাকুক বা প্রকাশিত হােক না কেন তার বিপক্ষে। এ সকল আদর্শ ও নীতিসমূহের অঙ্গীকার ঘােষণার প্রেক্ষাপটে আমরা বুঝতে পারছি না ভারত সরকার কেন আমাদের স্বীকৃতি বিষয়ে অনুকূল সাড়া দিচ্ছে না? | আমরা এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক যে, বাংলাদেশের অগণিত নাগরিক নির্মম অত্যাচারের প্রেক্ষিতে শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, আমরা এ বিষয়ে অত্যন্ত। উদ্বিগ্ন এ সকল হাজার হাজার শরণার্থীদের ভারতে আগমন কীভাবে আপনাকে উদ্বিগ্ন। করে তুলেছে । ভারত ও বাংলাদেশ সরকার আমাদের দুদেশের একই ধরনের উদ্বিগ্নতা রয়েছে যে, এই হাজার হাজার শরণার্থীদের আগমন অর্থনৈতিক বােঝা এবং সামাজিক রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। আমরা যে সমস্ত এলাকায় প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছি এবং তা ব্যতীত ২৫শে মার্চ ৭১ সালে যে নির্মম ধ্বংস, গণহত্যার মাধ্যমে। আমাদের দেশের নাগরিকগণকে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আপনি যে উদার মনােভাব নিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন আমরা যথাশীঘ সম্ভব তাদের দেশে ফিরিয়ে নেব। আমরা এখন আমাদের দেশে তাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও সম্মানজনক অবস্থায় তাদের পুনর্বাসন করার। পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি। শীতের আগমনের প্রেক্ষিতে তাদের অস্তিত্ব, তাদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বিশেষকরে নারী, শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি এদের নিরাপত্তার একমাত্র উপায় হল যদি তাদের অবিলম্বে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা হয়। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে আমরা সর্বাত্মক সহযােগিতা। করব। আমরা সময়ের প্রয়ােজনে ব্যর্থ হব না।
দীর্ঘ ৮ মাস ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ যে উদ্বেগ ও যন্ত্রণার ভেতরে আছে তা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রাথমিক প্রয়ােজন হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান। আমাদের উভয়ের লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য শুধুমাত্র নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থনই যথেষ্ট নয় তার সঙ্গে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বস্তুগত এবং মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য করা। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এবং প্রয়ােজনীয় পারস্পরিক সাহায্য সহযােগিতায় কেবলমাত্র বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের পথ। আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন এবং এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তার জন্য। আমরা অনুভব করি যে, বর্তমান সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক সমর্থন যাতে আমাদের মুক্তির সংগ্রামকে তড়িৎ গতিতে সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং আমাদের মুক্ত সমাজের অস্তিত্বে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির মাধ্যমে আপনাদের স্বীকৃতি আমাদের মধ্যে নতুন উদ্যোগ এনে দেবে এবং আমাদের স্বাধীন অস্তিত্ব ও আশা-আকাক্ষার সনাক্তকরণ করবে। আমরা গভীরভাবে অনুধাবন করেছি ভারত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতি এই মুহূর্তে প্রয়ােজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা শুধু উপমহাদেশেই স্থিতিবস্থা সৃষ্টি করবে না বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে আসবে। ১৫ই অক্টোবর আমরা আপনার বরাবর যে পত্র লিখেছিলাম তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আবেদন অবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।

সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কূটনৈতিক যুদ্ধ – আবু সাইয়িদ

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!