You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ১৫ই মে, বুধবার, ১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

অপুষ্টির অভিশাপ

পঙ্গুত্ব, রোগজীর্ণ অবয়ব উন্নতিশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহে এক সাধারন ছবি। সুস্থ সবল মানুষের চেহারা সেখানে বৈচিত্র আনে। আমাদের দেশেও অলি-গলি- রাজপথে এমনই নানা মুখ, নানা চেহারা। জন্ডিসে আক্রান্ত হলদে চোখ, রোগজীর্ণ বিষন্ন মুখাবয়ব, হাড়জিরজিরে মানুষের ছবি। সভ্যতার বিকাশের মুখে এ পঙ্গুত্ব, এ রুগ্নতা নিদারুণ চপেটাঘাতের মত। দিনে দিনে সে অভিশাপ বাড়ছে, ইতিমধ্যে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যাপক রুগ্নতা ও পঙ্গুত্বের অনুসন্ধান করে জানা গেছে অপুষ্টিজনিত কারণে ক্রমবর্ধমানহারে মানুষ এই অভিশাপের শিকার হচ্ছে। উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশের বিত্তবান এবং বিত্তহীন উভয় শ্রেণীর লোকেরাই অপুষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বিত্তবানরা ভেজালের দৌরাত্মে এবং বিত্তহীনেরা খাদ্যাভাবে নানা অখাদ্য-কুখাদ্য গ্রহণ করার ফলেই অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগ নর-নারী শিশু অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ অপুষ্টিজনিত কারণে তাদের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশ্রণ এবং ভিটামিনের অভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, গ্রামাঞ্চলের শতকরা ৮০ ভাগ নারী ও শিশু অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে অপুষ্টিকর শিকারে পরিণত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে তাতে করে আগামী এক বছরে সমাজের চেহারা কি হবে তা কল্পনাও করা যায় না।
অকল্পনীয় কোন অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়ার পূর্বে তার প্রতিরোধ এবং প্রতিষেধকের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। এজন্য যেমন খাদ্যে ভেজাল মেশানোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে তেমনি গ্রামবাংলার অভুক্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেয়ার জন্য ও নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। খাদ্য সমস্যা সারাদেশে যে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে গেছে তাতে করে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করাই অধিকাংশ লোকের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে, পুষ্টিকর আহার গ্ৰহণতো স্বপ্নবিলাস মাত্র। খাদ্যের সংস্থান তাই সর্বনাশা পরিণতি প্রতিরোধে প্রাথমিক শর্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ‘নিউট্রিশন ইনস্টিটিউশন’ গঠনের একটি প্রস্তাব রয়েছে। অপুষ্টিজনিত অবস্থা মোকাবেলায় বিভিন্ন সুপারিশ তারা দেবেন। কিন্তু সে ভবিষ্যতের কথা। বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবিলায় জরুরী ভিত্তিতে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অবিলম্বে ভেজাল মিশ্রণ এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। প্রয়োজনীয় ঔষধাদি বিদেশ থেকে আমদানি করা প্রয়োজন। বিদেশি স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর না করে শিশুদের মধ্যে যথাসম্ভব ভিটামিন ঔষধাদি বিতরণের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সবার উপরে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে জনসাধারণের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে।
সভ্যতার অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা যখন অব্যাহত, উন্নত রাষ্ট্রগুলির বিলাশ এবং মানবধ্বংসী কর্মকাণ্ডে যখন কোটি কোটি ডলার ব্যয়িত হচ্ছে, তখন বিশ শতকের মানুষ অপুষ্টিজনিত কারণে ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হবে তা যেমন অপ্রীতিকর তেমনি দুর্ভাগ্যজনক। উন্নয়নশীল এবং উন্নত রাষ্ট্রে লক্ষ-কোটি মানুষের অমানবিক দুর্ভোগ লাঘবে প্রাচুর্য এবং বরকন্দাজরা সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন না? জাতিসংঘ অবশ্য এ ব্যাপারে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন আর্থিক সাহায্য। সম্পদশালী দেশগুলো এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।

তৈল সম্পদ আহরণ

বিশ্বব্যাপী বর্তমানে যতগুলো সংকট নিদারুণ আকার ধারণ করেছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান তেলের সংকট। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় থেকে এই সংকট আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে তেলকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও কোন কোন ক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাস করে তারা তেল আমদানিকারকদের প্রতি সংঘবদ্ধ আঘাত হেনেছে। ধনবাদী দেশ সমূহ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মূল লক্ষ্য ছিল তাদের। কিন্তু আঘাত লেগেছে বিশ্বের সকল দেশের উপরেই। বিশেষ করে যারা দরিদ্র বা উন্নয়নমুখী দেশ তাদের প্রতি আঘাত মর্মান্তিক হয়ে বেজেছে। তেল সংকট সৃষ্টিতে আমেরিকা এবং ইউরোপের বহু দেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হয়েছে। উন্নয়নকামী দেশের উন্নয়ন বাজেটের নিদারুণ আঘাত লেগেছে এই তেল সংকটের কারণে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকেও দুঃসহ সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এবং মূল্যবৃদ্ধিতে প্রায় সকল দরিদ্র দেশের উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করতে হয়েছে। এর থেকে পরিত্রান পাবার জন্য কেউ তেলের বিকল্প ব্যবস্থা, কেউবা নিজস্ব উপকূলীয় অঞ্চলে তেলের অনুসন্ধান কাজ চালাতে তৎপর হয়েছে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এবারের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের কারণে তেল উৎপাদনকারী দেশ সমূহ কর্তৃক যে মর্মান্তিক মার খেয়েছে তার উপশম এখনো হয়নি। মরিয়া হয়ে সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একটা আপোষ-রফার। ইতিমধ্যে আমেরিকার বৈজ্ঞানিকরা তেল এর বিকল্প জ্বালানি আবিষ্কারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলো এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে। স্থায়ীভাবে তেলের সংকট উত্তরণের জন্য সবাই আজ সচেষ্ট। বেশ কিছুদিন ধরে ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে তেলের অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত মহাসাগরের উপকূলে তেলের অনুসন্ধান পাওয়া যাবে বলেও তাদের বিশ্বাস রয়েছে। সর্বোপরি এই উপমহাদেশের বিভিন্ন উপকূলীয় ও পাহাড়িয়া অঞ্চলে যদি ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো যায় তাহলে তেল-গ্যাস-কয়লা প্রভৃতি সম্পদের সন্ধান লাভ করা যাবে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলের দেশসমূহকে এ ব্যাপারে পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে জরিপ চালানো উচিত।
আমাদের স্বাধীনতার পূর্বকালেও তেলের অনুসন্ধান লাভ করার জন্য মাঝেমধ্যে প্রচেষ্টা চালানোর কথা শোনা যেত। কিন্তু এদেশের মাটির নিচের সম্পদ আহরণের জন্য সেদিনের সরকার যথার্থ অর্থে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। যার দরুন বগুড়ায় কয়লা সম্পদের প্রশ্নটিও সেদিন চাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ্য করেছি। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের মাটির নিচের সম্পদ আহরণের উদ্যোগের কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি। বেশ কিছুদিন পূর্বে আমাদের বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক সম্পদ দপ্তরের মন্ত্রী ‘ইরাক আমাদের তেল দেবে’ এই সংবাদ ঘোষণা দানের প্রাক্কালে উল্লেখ করেছিলেন যে–আমাদের দেশের উপকূলীয় জেলা ও অঞ্চলেও তেলের অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। এতদঞ্চলের তেলের অনুসন্ধান পাওয়া যেতে পারে বলেও তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন। জানা গেছে সরকার বরিশালের মুলাদী থানা ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানা তেলের অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছেন। এই দুটি অঞ্চলে তেলের খনি পাওয়া যেতে পারে বলে কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে অথবা গভীর সাগরে তেলের সন্ধান লাভের আশায় অনতিবিলম্বে একটি ব্যাপক জরিপ কাজ শুরু হবে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত এক সংবাদে জানা গেছে। সাতটি দেশের তেল কোম্পানি এ ব্যাপারে শীঘ্রই একটি চুক্তির অধীনে কাজ শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দিল্লি বৈঠক শেষে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে বলেও সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে যে সকল দেশ চালাবে তারা হল–আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া, জাপান এবং সিঙ্গাপুর।
আমরাও আশাবাদী, এই ভেবে যে, যদি সরকার গভীর সাগর, উপকূলীয় অঞ্চল ও জেলা, পাহাড়িয়া অঞ্চল প্রভৃতি জায়গায় ব্যাপক জরিপ চালান তাহলে তেলের অনুসন্ধান লাভ করতেও পারেন। অতীতের পাকিস্তান আমলের ন্যায় জরিপ কাজ নয় বরং সত্যিকার অর্থে এ অনুসন্ধান চালাতে হবে। এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য ব্যাপক সরকারি কার্যক্রম নিয়োজিত করতে হবে। বাংলার মাটিতে যেমন সোনা ফলাতে হবে তেমনি বাংলার মাটির অভ্যন্তরে যে সম্পদ রয়েছে তাও খুঁজে বের করে জাতীয় প্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!