You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইতিহাস  সচেতন বিশিষ্ট ব্যক্তি, গবেষক এবং বুদ্ধিজীবীদের নিকট সহজেই প্রতীয়মান হবে যে, বহু বিচিত্র জটিল আবর্তের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অভিতি হয়েছে। সামরিক যুদ্ধে বিজয় লাভের পূর্বশর্ত হিসেবে কূটনৈতিক যুদ্ধে বিজয়ী না হতে পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মাত্র নয় মাসে অর্জিত হতাে কিনা সন্দেহ। এই গ্রন্থে নিরপেক্ষভাবে এই বিশাল ও জটিল প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বিভিন্ন অধ্যায় সন্নিবেশিত হয়েছে। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও জাতিসংঘ স্বীকৃত এবং পরাশক্তি সমর্থিত রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে পৃথক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন সহজসাধ্য নয়, বলতে গেলে দুরূহ ব্যাপার। পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার ভেতরে কী নিদারুণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বৈরী অবস্থায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে তা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি ঐক্যবদ্ধ জনশক্তির আকাঙক্ষা যে অপ্রতিরােধ্য তা প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিক চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে বাংলাদেশ নামে একটি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ইতিহাসে গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সশস্ত্র-যুদ্ধের পাশাপাশি কুটনৈতিক তৎপরতা এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল যা কুটনৈতিক যুদ্ধের বিশ্বরূপ পরিগ্রহ করে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গােপন দলিলপত্র যা পঁচিশ বছর পর সাধারণ্যে ছাড় করা হয়েছে, সে সব গােপন তথ্য, ঘটনা, কৌশল, চাতুর্যপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতার নির্মোহ পর্যালােচনায় দেখা যাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু সামরিক যুদ্ধের বিজয় নয়, এর নেপথ্যে রয়েছে এক গভীর, জটিল এবং নিরবচ্ছিন্ন কূটনৈতিক যুদ্ধ। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে কূটনৈতিক যুদ্ধের বিজয় এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছে। যার বিস্তৃত ও গভীরতর পর্যালােচনা আজো অসম্পূর্ণ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা কটনৈতিক যুদ্ধ বিজয়ের সম্পূরক। বৈশ্বিক পরিসরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে কূটনৈতিক যুদ্ধে। পর্যবসিত হয়েছিল তা পর্যালােচনা ও গবেষণা করতে গেলে সেই সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কৌশলগত কূটনৈতিক দিকসমূহ বিশ্লেষণ জরুরি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ, আন্তর্জাতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং সেই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন রাষ্ট্র বিশেষকরে পরাশক্তি-রাষ্ট্রগুলাের ভূমিকা, পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতা, দায়বদ্ধতা, নিরাপত্তা ও কৌশলগত বাধ্যবাধকতার কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কূটনৈতিক যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ ও নিয়ামক ভূমিকার প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে কূটনীতির ব্যবহার রাষ্ট্র ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এ সম্পর্ক জাতীয় বীযর্থ পুরণ সংহতকরণ কিংবা জাতীয় উন্নয়ন ও নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই লক্ষ্যে কুটনীতিকে একটি বহুমাত্রিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই কৌশল প্রয়ােগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের অনুকূলে কিংবা ভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে মিত্রতা, বৈরীতা, আচরণগত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন যা কখনও কখনও পরােক্ষ নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে চলে আসে। অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ সমুন্নত রাখার পাশাপাশি আদর্শগত বা তত্ত্বগত মূল্যবােধও ব্যবহৃত হয় কূটনৈতিক নীতি নির্ধারণে। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার বিরাজমান সংকট হচ্ছে এ অঞ্চলে দু’টি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জন্মগত বিরােধ, বিভেদ, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আদর্শিক দ্বন্দ্ব যার ফলে উপমহাদেশে নিরবিচ্ছিন্ন উত্তেজনা এবং আঞ্চলিক বা বিশ্বব্যাপী ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার বিস্তৃতি লক্ষ্যণীয়।  এই প্রেক্ষাপট সামনে রেখে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কূটনৈতিক অবস্থান কীভাবে আবর্তিত, পরিবর্তিত বা কৌশলগত মােড় নিয়েছে তা ব্যাখ্যা করা প্রয়ােজন, যা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে নৃশংস সামরিক অভিযান (Operation Searchlight) পরিচালনা করে। এ ঘটনায় বিশ্বের তিনটি প্রধান শক্তি প্রত্যক্ষ কিংবা পরােক্ষভাবে বাংলাদেশ সংকটে জড়িয়ে পড়ে। এমন নয় যে, বিশ্বের নীতিনির্ধারক শক্তিগুলি বাংলাদেশ সংকট সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিল। সংকট সৃষ্টির প্রথম থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ঘটনাপ্রবাহের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখে। বাংলাদেশ যে। অনিবার্যভাবে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত হচ্ছে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের বক্তব্যে তা প্রতীয়মান। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে ‘ন্যায্য তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমের উপর বিধি-নিষেধ আরােপের কারণেও উদ্বেগ ব্যক্ত হয়। স্বাভাবিক কারণে আগ্রাসনের শিকার পূর্ব পাকিস্তানের বিক্ষুব্ধ ও আন্দোলনরত জনগণের জন্য জনগণের যথেষ্ট সহানুভূতি পরিলক্ষিত হলেও নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের পক্ষে থাকে। পাশাপাশি মানবিক কারণে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত ও ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে। আশ্রিত লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশীর জন্য মার্কিন খাদ্যসাহায্যে মার্কিন জনগণের সহানুভূতি প্রকাশ পায়। পক্ষান্তরে বেইজিং-এর প্রতিক্রিয়া ছিল কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির, যদিও তা ছিল কম্যুনিস্ট কূটনীতির চিরাচরিত ভাবধারার সঙ্গে সামঞ্জপূর্ণ। কার্যত, বেইজিং সরকার বাংলাদেশ সংকটকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট হিসেবে বিবেচনা করে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে স্পষ্টভাবে বিঘঘাষিত নীতির পরিপূরক হিসেবে ভারতকে প্রচ্ছন্ন হুমকি প্রদান করে। বাংলাদেশের সংকটকালে দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের নীতি নির্ধারণে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গ যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে; কিন্তু কিছু গবেষক ও বিশ্লেষক এসব শক্তির প্রতিপত্তিকে পাশ কাটাতে চায় বা অতিরঞ্জিত করে দেখাতে প্রয়াসী হয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বাঙালির আশা-আকাক্ষার প্রতি অবজ্ঞার ভাব প্রদর্শন করে পাকিস্তানি নৃশংস সামরিক জান্তার প্রতি অব্যাহত সমর্থন প্রদানের দায়ে দোষী সাব্যস্তকে কঠিন বলে মনে করেন না। তেমনি নীতিবিবর্জিত ও পাকিস্তানপন্থি অবস্থান গ্রহণের দায়ে চীনের বাংলাদেশ বিরােধী ভূমিকাকে নানাভাবে বিশ্লেষণে তৎপর।

এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, বৃহৎ শক্তিবর্গ ইচ্ছা করলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে রােধ করতে বা সহায়ক ভূমিকা পালন করে দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধান বিধানে ক্ষম হতাে কিনা? কিন্তু এ ধরনের দায়িত্ব সম্পাদন করার সাধ্য বা সদিচ্ছা কি তাদের দল? ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মার্কিন প্রেসিডেন্ট 1•ক্সনকে আপাত জিজ্ঞাসার আড়ালে প্রশ্ন উত্থাপন করেন বাংলাদেশের বিষয়টি শেখ মুজিবের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝােতার চেয়ে একটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া কি অধিক লংসাত্মক ছিল? অর্থাৎ একথা দ্বারা শ্রীমতী গান্ধী যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক দুরভিসন্ধিকে •গ্নভাবে তুলে ধরেছেন। পরাশক্তিবর্গ বিশ্বরাজনীতির শক্তিদ্বন্দ্বে মেরুকরণ প্রক্রিয়ায় এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিল যা থেকে তাদের শান্তি কিংবা সহিংসতা অথবা রাজনৈতিক সমাধানের স্বাভাবিক অভিন্ন অভিলাষ বা কর্মপরিকল্পনা অনুপস্থিত ছিল। বাংলাদেশ সংকট শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসিত হলে তা হতাে এক শক্তিজোটের জন্য স্বস্তির বিষয়, পক্ষান্তরে বিরােধী জোটের পাল্টা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির অবকাশ দৃশ্যমান হয়ে পড়ে। কোনাে কোনাে বিশ্লেষকের এ অভিমত অনুযায়ী, পাকিস্তানের ভাঙন ও স্বাধীন বাংলাদেশের ওভ্যুদয় ছিল আন্তর্জাতিক শক্তি-রাজনীতির ফসল। এ ধরনের বক্তব্য প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও মরণজয়ী ভূমিকাকে গৌণ করে দেখার অন্তরালে পাকিস্তানি সরকারের নৃশংসতা ও গণহত্যাকে চাপা দিয়ে বাঙালির আত্মত্যাগ ও তিতিক্ষার ইতিহাসকে লক্ষ লাশের কূপে ঢেকে দেওয়ার অর্বাচীন অপপ্রয়াস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সংগ্রাম।
এই সংগ্রামে বিজয়ী হওয়া ব্যতীত অন্য কোনাে বিকল্প ছিল না। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা যেভাবে পাকিস্তান সামরিক শক্তিকে সমর্থন ও লােকচক্ষুর অন্তরালে বস্তুগত সহযােগিতা করেছে তা কোনােভাবেই নিরপেক্ষতার মানদণ্ডে বিচার করা সমীচীন হবে না।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন পরাশক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাদের পারস্পরিক নিরাপত্তা প্রভাব বলয় বিস্তারের সঙ্গে সম্পর্কিত অথবা ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে স্ব-স্ব দেশের জাতীয় স্বার্থের অন্বেষার প্রয়াস। সেই বিবেচনায় তারা তাদের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবার ঘুটি অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে পরিচালনা করেছে।
সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের দলিল-প্রমাণাদি ও গবেষণাকর্ম থেকে এরূপ দৃঢ় প্রত্যয় জন্মায় যে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বৃহৎ শক্তিবর্গের কর্মকাণ্ড মার্চের স্বাধীনতা ঘােষণার পর্যায় থেকে কালক্রমিক মুক্তিযুদ্ধ জোরালাে হয়ে ওঠার পেছনে ভারত ব্যতীত কোনাে বৃহৎ শক্তি বাংলাদেশের পক্ষে নীতিগতভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে এগিয়ে আসেনি। কেবল ভারতবর্ষের সাহায্য সহযােগিতায় অভ্যন্তরীণ প্রতিরােধ ও মুক্তিযুদ্ধ সুসংহত অবস্থায় এগিয়ে যেতে থাকলে সােভিয়েত রাশিয়া জুলাই মাসে। পরিবর্তিত নীতি ও কৌশল, বস্তুগত সহযােগিতায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে তােলে।
ফলে এ অঞ্চলে তাদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তৎকালীন দু’টি পরাশক্তির ঐ সময়কার পরিবর্তনমুখী পররাষ্ট্র নীতি সূক্ষ্ম ও পরােক্ষভাবে একই সময়ে চীনকেও এ অঞ্চলের প্রতি তার ভূমিকা ও ‘নীতি পুনর্নির্ধারণে প্ররােচিত করে। বিশ্বপরিমণ্ডলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পরিবর্তন ছিল লক্ষণীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সে দৃষ্টিভঙ্গিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত নীতির ক্ষেত্রে তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। এসব সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় ঐতিহ্যগত মার্কিন কৌশলগত নীতির ধারায় এমন একটি ভাব বিদ্যমান ছিল, যাতে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টির কোনাে কারণ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়নি। বলে যারা বিবেচনা বা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ একটি দেশের জন্মগত কৌশল হিসেবে মনে করেন সাম্প্রতিক প্রকাশিত মার্কিন গােপন ডকুমেন্টসগুলাে তাদের সেই ধারণাকে। অসার প্রমাণিত করবে। দেশি এবং বিদেশি গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক অবদান রাখে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী, বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা-সহ বিভিন্ন ইলেকট্রোনিক ও প্রিন্ট মাধ্যম জনমত গঠনে যে ভূমিকা পালন করেছিল তা যেমন ছিল মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে সর্বদা উজ্জীবিত রাখা এবং একই সাথে বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক যুদ্ধের এক অমােঘ অস্ত্র। একইসাথে একথা বিস্মৃত হলে চলবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম, বিশ্বপরিসরে কূটনৈতিক প্রতিনিধি প্রেরণ, পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকবৃন্দের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা, প্রবাসী বাঙালিদের বিশ্বব্যাপী অহর্নিশ তৎপরতা এবং বিদেশি জনপ্রতিনিধিবৃন্দের সক্রিয় ভূমিকা কূটনৈতিকভাবে বিশ্বব্যাপী গণমানসের সামনে বাংলাদেশের উপস্থিতিকে আড়াল হতে দেয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ছিল জটিল। বৃহৎ শক্তিবর্গের পররাষ্ট্র নীতি, নিরাপত্তা নীতি ও কৌশলগত বাধ্যবাধকতার জটিল সংশ্লেষ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সামরিক যুদ্ধকে কূটনৈতিক যুদ্ধে রূপান্তরিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় প্রধানত কূটনৈতিক যুদ্ধের বিজয়কে অপরিহার্য করে তােলে।
সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বাংলাদেশের ঘটনাপঞ্জিকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বব্যাপী যে কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে তা পর্যালােচনা ও মূল্যায়ন করা আবশ্যক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় এ দিকটি বেশি গুরুত্ব লাভ করেনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রায় তিন হাজার গ্রন্থ রচিত হলেও মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে সৃষ্ট কূটনৈতিক যুদ্ধ নিয়ে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্ম হয়নি বললেই চলে। আবু সাঈদ চৌধুরী প্রণীত ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’, আব্দুল মতিনের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি’, মােহাম্মদ সেলিম রচিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের রাজনৈতিক দল’, খন্দকার মােশাররফ হােসেন-এর ‘একাত্তরের স্মৃতি: মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান’ প্রভৃতি গ্রন্থে কূটনৈতিক যুদ্ধের একটা ধারণা পাওয়া গেলেও কোনাে গ্রন্থেই মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক কার্যক্রমের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই শূন্যতা পূরণ করার জন্যই আলােচ্য গবেষণাকর্ম সম্পাদন করি।
গবেষণাকর্মটিকে আমি মােট ৯টি অধ্যায়ে বিভক্ত করে উপস্থাপন করেছি। প্রথম অধ্যায়ে গবেষণার যৌক্তিকতা ব্যক্ত করার পাশাপাশি ১৯৪৭-৭১ সময়কালে পাকিস্তানের কূটনৈতিক বিভিন্ন পর্যায় এবং উপমহাদেশকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের কূটনীতি পর্যালােচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার বিশ্লেষণ, তৃতীয় অধ্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা , চতুর্থ অধ্যায়ে বন্দি শেখ মুজিবকে ঘিরে বিশ্ব কূটনৈতিক তৎপরতা, পঞ্চম অধ্যায়ে ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকা, ষষ্ঠ অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম দেশগুলির কূটনৈতিক তৎপরতা, সপ্তম অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতিসংঘ এবং অষ্টম অধ্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে চতুর্ভূজ কূটনৈতিক যুদ্ধ বিষয়ে আলােচিত হয়েছে। নবম অধ্যায়টি গ্রন্থের উপসংহার ।  দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করার পূর্বে ১৯৪৭-৭১ সময়কালে পাকিস্তানের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং উপমহাদেশকে ঘিরে বিশ্ব কূটনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে আলােচনা করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। সেই সঙ্গে বিভিন্ন অধ্যায় পরিচিতিও উল্লেখ করা হলাে।

 
পাকিস্তান কূটনীতির বিভিন্ন পর্যায় : ১৯৪৭-৭১
 
পাকিস্তান জন্মলগ্ন হতেই ধমীয় স্লোগান, প্রকৃত অর্থে ধর্মীয় উন্মাদনা এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আবরণে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে দ্বিজাতি তত্ত্বের যথার্থতা প্রমাণে রাষ্ট্র। পরিচালনায় ধর্মীয় ভাবধারা এবং প্রভাব বিস্তারে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের মােড়ল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। জাতীয় অখণ্ডতা, সংহতি ও নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের স্বার্থে একদিকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে দ্রুত গতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র ঝুঁকে পড়েছে। পাকিস্তান কূটনীতির মূল লক্ষ্যই ভারত বিরােধিতা এবং ভারত বিরােধিতার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে ধর্মকে। অন্যদিকে, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও নির্জোট নীতি গ্রহণ। করে। এই নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কূটনীতিক নীতি হিসেবে পঞ্চশীলা, গ্রহণ করে। পাকিস্তান ও ভারত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরস্পর বিরােধী রাষ্ট্রীয় ও কূটনীতি। পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে দেশ দু’টিকে সব সময়ই পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে হয়েছে। প্রতিপাদ্য এভাবে দাঁড়ায় যে, পাকিস্তান যখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, ভারত তখন ভিন্ন দিকে মিত্র সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছে। এর অন্তর্নিহিত বাস্তব কারণ সর্বদাই দু’দেশকে দু’দিকে ঠেলে দিয়েছে। পাকিস্তানের জন্মের সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র ভৌগলিক স্ট্যাটেজিক স্থান হিসেবে পাকিস্তানকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করার মনােভাব প্রকাশ করেছে। পাকিস্তান অতি দ্রুততার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রসারিত হাতকে শক্তভাবে চেপে ধরার চেষ্টা চালিয়েছে এবং পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রদত্ত প্রথম গণপরিষদ ভাষণেই তা প্রতীয়মান হয়েছে। একই সাথে কাশির প্রশ্নে যখন ভারত এবং পাকিস্তান পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় তখন পাকিস্তানের কূটনীতি মার্কিনীদের কজায় গিয়ে পড়ে।’
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ, বিশেষকরে রাষ্ট্রীয় গঠন প্রক্রিয়া সুসংহতকরণের আদর্শিক ও আর্থ-সামাজিক শর্তসমূহের মীমাংসা করতে নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হয়। যার ফলে নব রাষ্ট্রের নাজুক পরিস্থিতি বিদেশ নীতিতে দুর্বলতা হিসেবে উপস্থিত হয়। ১৯৫১ সালে ইরানে তেল জাতীয়করণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মােকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি নতুন সম্পর্ক স্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।  মার্কিন সামরিক প্রভাব বলয়ে পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্লু প্রিন্টকে সামনে রেখে মার্কিনী মিত্র গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ ও সেনাবাহিনী প্রধান চক্রান্ত করে গণপরিষদে সংখ্যগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন, কিন্তু দুর্বলচিত্ত প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনকে হটিয়ে দেওয়া হয়। চরম অসাংবিধানিকভাবে গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভাকে বাতিল করে দেন। নাজিমুদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণের বড়াে তূণটিই ছিল আসন্ন খাদ্য সংকটের। ১৯৫৩ সালে ফসল ভালাে হয়নি পেন্টাগনের বিশেষজ্ঞ দ্বারা একটানা প্রচারিত হবার ফলে খাদ্য সংকটের আশংকায় ব্যাপকভাবে মজুতদারি বেড়ে যায়। খাদ্যসহ জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন অত্যন্ত মরিয়া হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিকট খাদ্য প্রার্থনা করেন। যুক্তরাষ্ট্র এক সপ্তাহের মধ্যে খাদ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিলেও খাজা নাজিমুদ্দিনের অপসারণ এবং মার্কিনীদের বিশ্বস্ত বশংবদ বগুড়ার মােহাম্মদ আলীর প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল না করা পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার খাদ্য প্রেরণ বিলম্বিত করেন।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই কীভাবে হস্তক্ষেপ করেছে এটি তার একটি উদাহরণ। ১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সেবা করার ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার মত মানসিক শক্তি দুর্বলচিত্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ছিল না।” খাজা নাজিমুদ্দিনের বিদায় গ্রহণের পর ১৯৫৩ সালের মে মাসে জন ফস্টার ডালেস পাকিস্তান সফরে আসন এবং এর পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিরক্ষা সচিব ইস্কান্দার মীর্জা ও প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান ন্যাটোর ঘাঁটি তুরস্ক এবং তুরস্ক থেকে সামরিক শক্তিসমূহের পারস্পরিক সমঝােতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। পরবর্তী কালে লক্ষণীয় এ দুজনই মােহাম্মদ আলীর ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে উঠে যে শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান ও প্রথাসমূহকে আমলাচক্র থােড়াই পরােয়া করে। অত্যন্ত অন্যায়, অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মােহাদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রীসভার কে কে সদস্য হবেন, তাদের কী কী দায়িত্ব দেওয়া হবে তাও গভর্নর জেনারেল ঠিক করে দেন। এভাবে পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র অপ্রতিরােধ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে। গণতন্ত্রহীনতা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ, নব্য ধনিক, বণিক, ভূস্বামী ও সামরিকতন্ত্রের নগ্ন চক্রান্ত ও খেলায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠার দাবি-দাওয়া রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠী পূর্ববঙ্গের অধিবাসী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে এ অঞ্চলের মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান ও পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিল। কারণ গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের মৌলিক নীতিমালা বাঙালির জন্য অধিকার গঠন রক্ষা কবজ হিসেবে কার্যকর থাকবে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে মুসলিম jয়তাবাদের বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় প্রবাহমানতায় বাঙালির মনন ও চিন্তা-চেতনা আচ্ছন্ন ছিল। লেই কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র পরিচালনায় শাসকচক্রের চতুর ও চক্রান্তমূলক পদক্ষেপগুলাে তার। মাহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে সামগ্রিকভাবে ধরা পড়েনি। ধর্মীয় উন্মাদনা ও চেতনা বাঙালির আত্মপরিচয় ” সত্তাকে বিভ্রান্তি ও বিস্মৃতির চোরাবালিতে ঠেলে দেয়। বাঙালিরাই পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে বাঙালিকে তার বাঙালি ছুড়ে ফেলে দিয়ে মনে প্রাণে কেবল একজন পাকিস্তানি করার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু হয়। এই মনােভাব থেকে সে তার নিজস্ব বাঙালি স্বাথও একে একে পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে কুষ্ঠিত হয়নি। কারণ বাঙালি ভেবেছিল সবাই যখন পাকিস্তানি, মুসলিম এবং ভাই ভাই তখন সর্বক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানি ও পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। সেজন্য ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ভাষার দাবিতে ঢাকায় ছাত্রদের প্রথম শােভাযাত্রায় স্থানীয় অধিবাসীদের পাকিস্তান জিন্দাবাদ ও ইসলাম রক্ষার ধ্বনি ও সশস্ত্র আক্রমণ লক্ষণীয়। ১৯৫০ সালে কেন্দ্রীয় শাসক গােষ্ঠীর উস্কানিতে দাঙ্গা সংঘটিত করতেও তার উৎসাহের অভাব ছিল। বাঙালির মানস চেতনার এই পশ্চাদপদতা ও ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তি অপসারণ ব্যতীত গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক শােষণের প্রতিকার দাবি ‘শত্ৰুচক্র’ পক্ষের কাজ বলে পূর্ববঙ্গের জনগােষ্ঠীর নিকটও ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে। মূলত মাতৃভাষার উপর আক্রমণই বাঙালির আত্মসচেতনতাকে ফিরিয়ে আনতে মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে। ধীরে ধীরে জাতীয় চেতনা ও বাঙালির বােধশক্তি জাগ্রত হয়। বাঙালি জাতি উপলব্ধি করতে পারে ধর্ম, মুসলমান এবং ইসলামি স্লোগানের আড়ালে কী নিদারুণভাবে তাদের শােষণ করা হচ্ছে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক ও শােষকগােষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মায়ের ভাষা বাংলার পরিবর্তে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে পূর্ব বাংলার ধর্মপ্রাণ সরল মুসলিম জনতার কাছে উর্দুকে কোরআনের ভাষা বা লিসানুল কোরআন’ বলে তুলে ধরে। দেশের মধ্যে অভিজাত ও বুদ্ধিজীবী দালাল। শ্রেণি মুসলিম জাতীয়তার ধুয়া তুলে স্কুলপাঠ্য বাংলা বইয়ে নতুন করে উর্দু শব্দের অনুপ্রবেশ ও গাঁথুনি দিয়ে সৃষ্টি করে এক বিচিত্র বাংলা ভাষার। মােল্লা মৌলানাদের একটি শ্রেণিও সরকারি আনুকূল্যে বাংলা ভাষা ইসলামিকরণের জিগির তােলে।
যারা বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বাঙালির অধিকার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামাে, স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছে তাদেরকে কাফের, ইসলাম ও পাকিস্তান বিরােধী এবং ভারতীয় এজেন্ট বলে আখ্যায়িত করা হয়। মাতৃভাষার উপর আক্রমণ সাময়িকভাবে আত্মবিস্মৃত জাতিসত্তাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। পাকিস্তানি শাসকচক্র, আমলাচক্র একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে তারই প্রতিবাদে বাংলার ছাত্রসমাজ দেশব্যাপী আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে।”
ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষা সাংস্কৃতি আন্দোলনের মধ্যে পরিবৃত্ত না থেকে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও অসম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, স্বায়ত্তশাসন, শােষণ নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। 
যে সংগ্রাম এতদিন বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবি দাওয়ার ভেতর উচ্চারিত ছিল তা ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামে একীভূত হয়ে পূর্ববঙ্গে এক প্রবল গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা অর্জনের প্রগতিশীল মূলধারার সৃষ্টি করে। এর ফলশ্রুতিতে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট।” ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক নির্বাচনের নাটকীয় ফলাফল গভর্নর জেনারেলের আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করে। নির্বাচনের পরপরই অতি দ্রুত সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীর ইউনিটসমূহকে পূর্ববঙ্গে প্রেরণ করা হয়। অবস্থার গতিধারা নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে ঢাকায় পাঠানাে হল। দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার অজুহাত এবং যুক্তরাষ্ট্রের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে এই অজুহাতে নবগঠিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী সভাকে বরখাস্ত করা হল। মীর্জার নেতৃত্বে গভর্নর শাসন কায়েম হল। ৯২-ক ধারা জারি করে সভা বিচ্ছিন্ন, সমাবেশ মিছিল ঘােষণা করা হয়। শুরু হল। ব্যাপক ধরপাকড়, নিপীড়ন। লক্ষণীয় যুক্তরাষ্ট্রের একুশ দফা ছিল শাসকগােষ্ঠীর। বিরুদ্ধে গণদাবি। সমাজ প্রগতি কর্মসূচির প্রতি গণদাবি মার্কিন কর্তৃপক্ষকে চিন্তিত করে। তােলে।
পূর্ববঙ্গের জনগণের নিরঙ্কুশ ও দ্ব্যর্থহীন রায় পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্যদের সাহসী করে তােলে এবং তারা কর্তৃত্বশালী আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটা স্বাধীন ভূমিকা নিতে সচেষ্ট হয়। ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে তারা গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে। পরিষদে কিছু সাংবিধানিক সংশােধনী প্রস্তাব আনেন। কিন্তু এই সংশােধনী কার্যকরী করার আগেই গভর্নর জেনারেল জরুরি অবস্থা জারি করেন। গণপরিষদ বাতিল করেন এবং পূর্ণ ক্ষমতা কজা করেন। সামরিক-আমলাতন্ত্র চক্রের প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নর জেনারেলের অসীম ক্ষমতা পাকিস্তানের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে অচল ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষুদ্রতম প্রয়াসকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। গভর্নর জেনারেল কর্তৃক সেনাবাহিনীর। সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়ােগ প্রথমবারের মত প্রত্যক্ষভাবে সামরিক আমলাতান্ত্রিক চক্রকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। এ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণপরিষদের স্পিকার উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করেন। এই প্রত্যক্ষ ক্ষমতা দখলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, শশীষণ বৈষম্য ও দুর্ভোগ পরিণতি বৃদ্ধি করে। এই নতুন সরকারের বৈধকরণের আইনানুগ ভিত্তি স্থাপনের জন্য গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ প্রতীকীভাবেই সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালে জেনারেল আইয়ুব সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন এই ভেবে যে সেনাবাহিনীকে প্রতীকী নয়, পুরােপুরিভাবেই ক্ষমতা দখল করতে হবে। 
ইতােপূর্বেই পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তির বৃত্তে ঢুকে পড়ে। ১৯৫৪ সালের ১৯শে মে পাক-মার্কিন সহযােগিতা চুক্তি (সামরিক চুক্তি) স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির প্রধান শর্ত ছিল, পেশোয়ারের কাছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি প্রদান এবং এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ৪০ হাজার সৈন্যের ব্যয়ভার বহন করবে।” ১৯৫৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সাউথ ইস্ট এশিয়া ব্রিটি অর্গানাইজেশন (সংক্ষেপে সিয়াটো) সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষর করে পাকিস্তান মার্কিন জোটভুক্ত হয়। ১৯৫৪ সালের অক্টোবর পাকিস্তান বাগদাদ প্যাক্ট (পরবর্তী নামকরণ করা হয় সেন্টো প্যাক্ট) এ যােগদান করে। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মােট তিনটি সামরিক চুক্তি করে। এর সবগুলিই ছিল পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থবিরােধী চুক্তি। ১৯৫৪ সালের ২৫শে এপ্রিল আওয়ামী লীগের পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিবিরােধী প্রতিবাদ দিবস পালন করে। আওয়ামী লীগ নেতা ১৯৫৬ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি বিশেষকরে পশ্চিমা সামরিক জোটে যােগদানের স্বপক্ষে যুক্তি প্রদান করেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতির। সমর্থক হলেও তিনি একই সাথে চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক গড়ে তােলার উদ্যোগী হন। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ১৯৫৬ সালের ২০-৩০শে ডিসেম্বর পাকিস্তান সফর করেন, এর মধ্যে তিনি ঢাকায় আসেন ২৮৩০ তারিখে। তাকে বিপুল সম্বর্ধনা দেওয়া হয়।” 
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী গৃহীত পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে। জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি ও সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন দেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে ২৫-২৭ তারিখে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। ন্যাপ গঠনের সময় প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়াদী যুক্তরাষ্ট্র। সফর করেন। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী ও আইজেনহাওয়ার যুক্ত ইশতেহার ঘােষিত হয়। ইশতেহারে বলা হয়, স্বাধীন বিশ্বের জন্য আন্তর্জাতিক কমিউনিজম এক বিরাট হুমকি হিসেবে অবস্থান করছে।” ১৯৫৬ সালের ১৭ই জানুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্র, শােষণ, বৈষম্য ও প্রাসাদ চক্রান্তের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি করে বলেন “ভৌগােলিক দিক দিয়ে আমাদের দেশের একটি অংশ অপরটি থেকে বহু দূরে হাজার মাইলেরও বেশি দূরে অবস্থিত। বাইরে থেকে দেখতে এই দুটি অংশের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন, বলতে গেলে দুটি পৃথক দেশেরই চেহারা এদের। কিন্তু তবুও পাকিস্তানের দেশপ্রেমী মানুষ স্বেচ্ছায় একই দেশ হিসেবে এই দুটি অঞ্চলকে মেনে নিয়েছে। অথচ তাই বলে আপনারা যদি পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার না করেন, তাদের অভাব অভিযােগের কোন প্রতিকার না করেন তবে সে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জাগ্রত সচেতন যুবশক্তি হতাশার চরম সীমায় উপনীত হয়ে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চাইলে তখন প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগেরও কিছু করবার থাকবে না। এখনও সময় আছে, আপনারা দেওয়ালের লিখন পড়ার চেষ্টা করুন।
মার্কিন তাবেদার সরকারের নিকট তখন থেকেই শেখ মুজিব থ্রেট হিসেবে চিহ্নিত হন। নানা চক্রান্ত, বাধা-নিষেধ প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে একটি শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে সংখ্যাসাম্য নীতি, সংসদীয় গণতন্ত্র বাস্তবায়িত হবে এই মর্মে পাকিস্তানকে দুটি ইউনিটে বিভক্ত করার বিধান রাখা হয়। গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা শাসনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী প্রথম রাষ্ট্রপতি পদ দখল ও মন্ত্রীসভা গঠন করলেন। আবার বরখাস্ত করলেন। নানারকম রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের সে এক জঘন্যতম ইতিহাস। ১৯৫৭ সালের ১১ই অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সােহরাওয়ার্দীকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, যদিও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপাের্ট অনুযায়ী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী মার্কিন নীতি ও মুক্ত বিশ্ব গঠনের প্রতি বিশ্বস্ত। কিন্তু পেন্টগন বিশ্লেষণ করে দেখেছে আসন্ন নির্বাচনে জনাব সােহওয়াদী বা আব্দুল কাইয়ুম খান বিজয়ী হবেন তারা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক হলেও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চক্রান্তে স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে পারবে কি না সন্দেহ। শুধু তাই নয়, পেন্টাগনের আরাে একটি বিষয় ছিল জনাব সােহরাওয়ার্দী কমিউনিস্ট চীনের দিকে ঝুকে পড়ার নীতি গ্রহণ করেছে এবং সােভিয়েত এর প্রতিও হাত বাড়ানাের চেষ্টা করছে। এর কারণে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে সরিয়ে দেওয়া হলে প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। কিন্তু পরে তা মেনে নেয় ১৮ই অক্টোবর। চুন্দ্রিগড়কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।
১৯৫৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্ত নের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে চুন্দ্রিগড় পদচ্যুত এবং আওয়ামী লীগ ফিরােজ খান নুনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে এই শর্তে সমর্থন দেন যে তিনি অবিলম্বে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেবেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের দিন ঘােষিত হয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এই বিল গৃহীত হলে ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট তাতে সম্মতি স্বাক্ষর করেন। এদিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার চক্রান্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানেও রাজনৈতিক সরকার গঠনকে অস্থিতিশীল করে ফেলেছিল। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশ পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল রাখার জন্য ইস্কান্দার মীর্জা ও জেনারেল আইয়ুব খানের সঙ্গে আতাত রেখেছিলেন।” ১৯৫৮ সালের ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান মন্ত্রীসভার পতন, ২৬ মার্চ আবু হােসেন সরকার পুনরায় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, ১লা এপ্রিল আবু হােসেন সরকার মন্ত্রী সভার পতন, ১লা এপ্রিল পুনরায় আতাউর রহমান খান পুর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী এবং ১৮ই জুন আতাউর রহমান খান মন্ত্রীসভার পতন হয়। পূর্ববঙ্গ পরিষদে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। দেশের শােচনীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, আইন শৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, রাজনৈতিক দলগুলাের উপর দমন পীড়ন, দুনীতি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল জনগণ রাজনীতিবিদদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ২৭শে অক্টোবর সাময়িক আইনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেই রাজনীতিবিদদের উপর নিপীড়ন, অত্যাচারের ও নির্যাতনের চরমপন্থা গ্রহণ করেন।
রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার, নজিরবিহীন অত্যাচারের পাশাপাশি তাদের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার পন্থাসমূহ উদ্ভাবন করা হয়। মার্কিন উপদেষ্টা ও দেশিয় অফিসারগণ সরকারের বেসামরিক প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি করতে তৎপর হলাে। উদ্ভাবিত হল মৌলিক গণতন্ত্র যা ১৯৬২ সালের সংবিধানের ভিত্তি। মৌলিক গণতন্ত্র না ছিল গণতন্ত্র, না ছিল মৌলিক। বরং এটা ছিল সামরিক স্বৈরশাসনকে পাকাপােক্ত করার এক অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা গণতন্ত্রের নামে চাপানাে হয়। এই ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের বাহ্যিক চেহারায় পদ্ধতিগত ব্যবস্থাপনা গ্রামীণ উচ্চশ্রেণিকে সম্পৃক্ত করে। কিন্তু গ্রামীণ জোতদার ও গ্রাম টাউটদের ক্ষমতা গ্রাস ও সীমাহীন দুর্নীতি সর্বমহলেই এই মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা ঘৃণিত বলেই জনসাধারণের নিকট প্রতীয়মান হয়। জেনারেল আইয়ুব খান অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সীমাহীন অত্যাচার, যৌলিক, মানবিক অধিকার এবং পূর্ববঙ্গের রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে পূর্ববঙ্গে সরাসরি এক দালাল গােষ্ঠী সৃষ্টি করে। ঔপনিবেশিক কায়দায় সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শক্তির সাহায্যে স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ব স্থাপনে তিনি উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তান ও বহিঃর্বিশ্ব হতে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন ও অরক্ষিত হয়ে পড়ে। দেশপ্রেমিক বাঙালি জাতি যুদ্ধের মাধ্যমে আত্ম-উপলদ্ধিতে উপনীত হল যে, পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠীর এদেশের প্রতি কোনাে প্রকার দায়দায়িত্ব নেই। পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই বাঙালির নিকট শক্তিশালী কেন্দ্র ও এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার অন্তনিহিত দারুণ বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা এনে দেয়।
জেনারেল আইয়ুবের এতদিনব্যাপী প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী কেন্দ্রের ফর্মুলা প্রকৃত বিপদের দিনে যে তাদের কোনাে কাজে আসবে না এই অভিজ্ঞতাই বাঙালিকে নতুন করে ভাবিত করে। যুদ্ধকালীন এই বিচ্ছিন্নতার কারণে বাঙালি জাতি বুঝতে শিখলাে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও তাঁর দালালগণ যাই বলুক না কেন বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার মতাে মৌলিক বিষয়েও বাঙালির কোনাে অংশীদারিত্ব ও ভূমিকা নেই। দেশরক্ষার ব্যাপারে পূর্ববাংলার প্রতি এতদিনের বঞ্চনা যুদ্ধের মধ্যে বাঙালি। জাতিকে বিক্ষুদ্ধ করে তােলে। | ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধে বাঙালি সেনা-বৈমানিকদের নিপুণতা ও সাহস-‘বাঙালি যােদ্ধা জাতি নয়’ এই প্রচারণার অসারত্ব প্রমাণ করে এবং পরিণতিতে জাতীয় গর্বের আত্মপ্রত্যয়ে জাতীয়তাবাদী মূলচেতনার ধারাকেই শক্তিশালী করে। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার অব্যবহিত পরেই পশ্চিম পাকিস্তানে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্ররােচনায় তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। লাহােরে অনুষ্ঠিত তাসখন্দ চুক্তিবিরােধী এই চক্রের কার্যধারার বিরােধিতা করে শেখ মুজিব স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই জোরদার, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র, প্রত্যক্ষ ভােটাধিকার, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে লাহােরে ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন। ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানে অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের এই পর্যায়কে সুসংহত এবং জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক অর্থনৈতিকসহ রাষ্ট্র পরিচালানার হাতিয়ার হিসেবে সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মকর্তৃত্বের দাবিকে ছয় দফার মধ্যে বঙ্গবন্ধু উপস্থাপন করলেন।
কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত জেনারেল চক্র, আমলাতন্ত্র ও পুঁজিবাদী ধনিক বণিক চক্রের নিকট বেশি করে যন্ত্রণাদায়ক বিষয়টি ছিলাে কেন্দ্রীয় পরিসম্পদে বাঙালিদের ন্যায্য হিসেবের দাবি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কলােনি হিসেবে একযুগ পূর্ববঙ্গের সম্পদ শােষণের প্রবাহধারা শুকিয়ে এলে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ও সাহায্য সংস্থার নিকট থেকে প্রাপ্ত সম্পদে বাঙালিদের অধিকার দাবি তাদের নিকট এক অসহনীয় ও অমার্জনীয় অপরাধ বলেই বিবেচিত হয়েছিল। শেখ মুজিবের দাবি ও সগ্রাম তাদের পরিতুষ্ট হৃৎপিণ্ডে সরাসরি শূলবিদ্ধ করেছিল। শেখ মুজিবের ছয় দফা ছিল তাদের নিকট মারাত্মক বিভীষিকার অস্ত্র। শেখ মুজিব বাঙলার স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক শােষণ বৈষম্যের অবসান, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম, পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্র জুলুমশাহীর নিপীড়ন, অত্যাচার, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্রের বহুবিধ তথ্য ও সত্য উদঘাটন করে, উল্কার মতাে দেশের গ্রাম বাংলা, শহর, গঞ্জ, নগরে ব্যাপক গণসংযােগের মাধ্যমে দ্রুত জনমত গঠনের ক্লান্তিহীন কাজে আত্মনিয়ােগ করেন।” পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, স্বৈরশাসন, শােষণ এবং আঞ্চলিক বৈষম্য প্রতিকার ও প্রতিবিধানের লক্ষ্যে উপস্থাপিত বাংলার মুক্তিসনদ ছয় দফা কর্মসূচির প্রচারকালীন শেখ। মুজিবের উপর যে ধরনের অত্যাচার, হয়রানি ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয় তার নজির সমকালীন ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুলনা হতে ফেরার পথে যশােরে, যশাের থেকে জামিন নিয়ে ঢাকায় এবং ঢাকার দায়রা জজ প্রদত্ত জামিনে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পরপরই পুলিশ বাসা হতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে সিলেটে প্রেরণ করেন, সিলেটের দায়রা জজ কর্তৃক জামিন প্রদানে মুক্ত হবার পূর্বেই জেল হাজতের দরজায় পুনরায় তাকে গ্রেফতার করা। হয় এবং ময়মনসিংহ জেলে প্রেরণ করা হয় এবং ময়মনসিংহ হতে জামিনে মুক্তি লাভ করে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৬৬ সালের এপ্রিলেই এই সকল ধারাবাহিক গ্রেফতার ও হয়রানি চলতে থাকে। গ্রেফতারের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক একই বছরের ৭ জুন বিক্ষুদ্ধ জনতার উপর পুলিশের গুলিতে শ্রমিক মনুমিয়াসহ ১১ জন নিহত হয়। এর পরপরই নেমে আসে আওয়ামী লীগের অনুসারী নেতা কর্মীদের উপর জেল জুলুম গ্রেফতারি পরােয়ানা। আইয়ুব খানের দালাল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মােনেম খান প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতে থাকেন, তিনি যতদিন ক্ষমতাসীন আছেন ততদিন শেখ মুজিবকে দিনের আলাে আর দেখতে হবে না। ২১ মাস কারাগারে বিচ্ছিন্ন কনডেম সেল্ েআটক রাখার পর ১৯৬৮ সালের ১৭/১৮ই জুন রাত্রে কতিপয় সামরিক ব্যক্তি দৈহিক বল প্রয়ােগ করে ঢাকা সেনানিবাসে শেখ মুজিবকে নিয়ে আসে এবং একটি রুদ্ধ কক্ষে আটক রাখে। পাকিস্তান। প্রতিরক্ষা আইনে আটক শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার এই যড়যন্ত্রে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে দায়েরকৃত রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব মামলা সম্পর্কে শেখ মুজিব তার জবানবন্দিতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, “ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন  দাবিসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চাকরির সংখ্যা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ক্ষমতার ন্যায়সঙ্গত। দাবি আদায়ের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করাই ছিল ইহার মূল্য উদ্দেশ্য।” তিনি বলেন, “স্বার্থবাদী। মহল কর্তৃক শােষণ অব্যাহত রাখার যে ষড়যন্ত্রজাল বর্তমান শাসকগােষ্ঠী বিস্তার করিয়াছে। এই মামলা তাহারই বিষময় প্রতিক্রিয়া। পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি দাবাইয়া রাখার জন্যই এই ষড়যন্ত্র মামলা’। স্বৈরাচার আইয়ুব খান ঠিকই বুঝেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি হলাে রাজনৈতিক ডিনামাইট আর ছয় দফা হলাে তার ফিউজ। সেজন্য যে কোনাে উপায়ে এই দাবি বানচাল করতে হবে, দাবি আদায়ের সকল পথ ও প্রচেষ্টাকে রুদ্ধ করতে হবে । 
বাঙালি সেনা অফিসারদের জাতীয়তাবােধ ও জাতিসত্তা বিকাশের আকাঙ্ক্ষাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তৈরি করা হয়। রাজনৈতিকভাবে শেখ মুজিবকে ধ্বংস ও সামরিকভাবে বাঙালি সেনাদের মধ্যে আতঙ্ক, সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে ভবিষ্যতে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে তাদের ভূমিকা খর্ব ও বানচাল করানাের সুচতুর কৌশল হিসেবে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। যার জন্যে। পরবর্তীকালে লক্ষ্য করা গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমম্বিত ও পরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র প্রতিরােধে বাঙালি সেনা অফিসারগণ উদ্যোগী ভূমিকা নিতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। | আইয়ুবের অত্যাচার নিপীড়ন, ষড়যন্ত্র মামলা, শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর হামলা জনজীবনের দুর্ভোগ-এসবকে সামনে রেখে গঠিত হলাে ডেমক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি। ডেমােক্রেটিক একশন কমিটি (ডাক) তে ভুট্টো ও মওলানা ভাসানী যােগদান থেকে বিরত থাকেন। অন্যদিকে, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলাে। বিগত বছরগুলােতে অবিরাম সংগ্রাম, আন্দোলন ও নির্যাতন ভােগের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ স্বৈরতন্ত্র, বৈষম্য ও শােষণমুক্তি এবং গণতন্ত্র, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হলাে। গঠিত হলাে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ছয় দফাকে অন্তর্ভুক্ত করে ঘােষিত হল ১১ দফা। অন্যদিকে, আগরতলা মামলার ষড়যন্ত্র ও শেখ মুজিবের অমলিন সংগ্রামী সত্তার অপপাষহীনতা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলাে। বিক্ষুদ্ধ বাঙালি শেখ মুজিবের মধ্যে তাদের মুক্তির প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। আইয়ুব-মােনায়েম চক্র ও শাসকগােষ্ঠীর নির্ভুল হিসেবে ছিল এই যে, ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া শেখ মুজিবের কার্যক্রম জনগণের মনে শেখ মুজিব সম্পর্কে ধিক্কার এনে দেবে। কিন্তু ঘটনার বাস্তবতায় এর উল্টোই প্রমাণিত হলাে। শেখ মুজিব বাঙালির জাতিসত্তার প্রাণ-প্রতীক হয়ে উঠলেন। বাঙালি জাতি ও শেখ মুজিব একক সত্তায় গ্রথিত হলেন। ডাক ১৭ জানুয়ারি প্রতিবাদ দিবসের ডাক দিল। সমগ্র পাকিস্তানে সাড়া জাগালাে।
২৪ জানুয়ারি প্রতিবাদ দিবস। পাকিস্তানের বহু শহরে কাফু জারি হলাে। শুরু হলাে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভিযাত্রা। পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হলাে। আন্দোলনের তীব্রতা দেখে এবং রক্তাক্ত দমননীতি ব্যর্থ হলে সামরিক স্বৈরাচারী আইয়ুব খান ১০ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিণ্ডিতে একটি গােলটেবিল বৈঠক ডাকলেন। তাতে কেউ সাড়া দিল না। শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হলাে। প্যারােলে মুক্তি কিংবা একাকী মুক্তি পাওয়ার যাবতীয় শর্ত শেখ মুজিবের মানসিক শক্তির নিকট হার মানলে শর্তহীন মুক্ত মানব হিসেবে শেখ মুজিবসহ সকল অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্তি পেলেন। ফাঁসির মঞ্চ থেকে সংগ্রামের নবযাত্রায় উদ্দীপিত এই বীরপুরুষকে জনগণ বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করলাে। বঙ্গবন্ধু গােলটেবিল বৈঠকে যােগ দিলেন এবং ছয় দফা এগারাে দফার পক্ষে বক্তব্য রাখলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বেলিত বাঙালি জাতি ‘তােমার আমার ঠিকানা-পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তুমি কে আমি কে-বাঙালি বাঙালি’ এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগান জাতীয় সত্তার নির্যাস হয়ে বাঙালি অস্তিত্বকে গ্রথিত করে তীক্ষ্ণ সংগ্রামের পথ প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান প্রস্তাবিত ও বহু প্রতীক্ষিত গােলটেবিল বৈঠকের শেষে কয়েকটি পরিবর্তন ঘােষণা করেন : ১, শাসন ক্ষমতা থেকে তিনি অবসর নেবেন। ২. প্রাপ্তবয়স্কের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র। ৩, ফেডারেল শাসনব্যবস্থা। ৪. কেন্দ্রের হস্ত ক্ষেপবিহীন প্রাদেশিক পরিষদ ক্ষমতা। ৫. কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতার এক্তিয়ার শাসনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ থাকবে। সেনাবাহিনীর কাঠামােগত ঐক্য ও ক্ষমতার কর্তৃত্ব ধরে রাখার স্বার্থেই ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। 
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করার পরই ১৯৬৯ সালের ২৬ মার্চ এক বেতার ভাষণে শাসনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার উপযােগী পরিবেশ ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘােষণা করে বলেন, তার সরকারের ভূমিকা হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ ইয়াহিয়া খান আইনগত কাঠামাে আদেশ জারি করেন। এই আদেশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, পাকিস্তানের ২৩ বছর ধরে চলে আসা অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বহাল রাখার সূক্ষ্ম কৌশল। গণতন্ত্রবিরােধী এবং মৌলনীতির পরিপন্থি আইনগত কাঠামাে আদেশে প্রেসিডেন্টের হাতে যথেচ্ছ ক্ষমতা প্রদানের ফলে প্রস্তাবিত সংসদ এবং তার দ্বারা প্রণীত শাসনতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়বে। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ পুঁজি সামরিক বেসামরিক আমলা চক্রের এবং জেনারেল ইয়াহিয়ার ব্যক্তি স্বার্থে আটঘাট বেঁধেই এল,এফ,ও. জারি করা হয়। শেখ মুজিবসহ অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দ এল.এফ.ও.-র বিরুদ্ধে তীব্র সমালােচনা করেন।
এর অগণতান্ত্রিক দিকগুলিও বাতিল করার দাবি উত্থাপন করেন। সামরিক চক্র কর্তৃক ঘােষিত এল,এফ,ও-কে ইস্যু করে আন্দোলনের পথে না গিয়ে শেখ মুজিব | নির্বাচনে যাবার কথা ঘােষণা করলেন। এল, এফ, ও, দ্বারা শেখ মুজিবের হাত পা বেঁধে। ফেলা হয়েছে। মূলত এটি ছিল ছয় দফা কনসেপ্টের পরিপন্থি। শেখ মুজিবের এর। ধরনের ঘােষণা সামরিক চক্রের পূর্ব পরিকল্পিত ব্লু-প্রিন্টকে অকেজো করে তােলে।  পাকিস্তান গােয়েন্দা বাহিনীর রিপাের্ট ও মুজিবের চরিত্র বিশ্লেষণের সঙ্গে শেখ মুজিবের এই ঘােষণা শাসক চক্রকে হতবাক করে তােলে। শেখ মুজিবের কৌশল ছিল | গণতান্ত্রিক পথে সামরিক চক্রের পরিকল্পিত চক্রান্তকে তিনি মােকাবিলা করবেন। কেননা জনগণের ঐক্য ও শক্তি সম্পর্কে শেখ মুজিবের হিসেব ছিল নির্ভুল। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হতে পারলে জনগণের শক্তি নিয়ে এল.এফ.ও, কে ছুঁড়ে ফেলতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কোনাে তােয়াক্কা করবেন না। অভ্যন্তরীণ এই অবস্থার পাশাপাশি দুই পরাশক্তির সক্রিয় কূটনৈতিক টানাপােড়নের ক্ষেত্র হিসেবে এবং বৃহৎ শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান দক্ষিণ-এশীয় কূটনৈতিক ত্রিভুজকে।  আরাে জটিলতা প্রদান করে। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলটি সামরিকভাবে না হলেও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। চীনের প্রথম দিকে সােভিয়েত রাশিয়ার সহযােগিতা এবং তৎপরবর্তী চীন-সােভিয়েত বিবাদ, যার ফলে অঞ্চলটি মস্কো ও পিকিং এর কাছে সামরিক দিক দিয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের বিশ্ব-পরিকল্পনা এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিবাদ, বিসংবাদ ও আঞ্চলিক উত্তেজনা। ওতপ্রােতভাবে জড়িত। এভাবে দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাঁচটি। জনবহুল দেশ ‘পারস্পরিক গুতােগুতি ও ধাক্কাধাক্কি করছিল বিভ্রান্তিকর পারস্পরিক সম্পর্কের কারণে।”  দক্ষিণ এশিয়ায় বহিঃশক্তির উপস্থিতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার আঞ্চলিক । বিবাদের ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিল। পারস্পরিক অসমাপ্তিকর বিবাদে বাংলাদেশ সংকট যখন। ঘনীভূত ও উত্তপ্ত ইস্যুতে পরিণত হয় তখনও বিদ্যমান বিচ্ছিন্ন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে। জনগণের নতুন অখণ্ড পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি অর্জন এবং ভৌগােলিকভাবে বিচ্ছিন্ন একটি সত্যিকারের ফেডারেল বা কনফেডারেল ইউনিয়নে বসবাসের উপযুক্ত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা বের করতে ব্যর্থতার ফলশ্রুতিতেই নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে সবদিক থেকে বঞ্চিত করা, শােষণ ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নগ্নভাবে লুণ্ঠন ও শাসন করার পেছনে সাম্রাজ্যবাদী ইঙ্গ-মার্কিন । শক্তিবলয়ের নেপথ্য কার্যকর দৃশ্যমান বিষয়টি কূটনৈতিক পটভূমিকায় বিধৃত করা হয়েছে।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের হােয়াইট হাউসে আসা অবধি। যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় তার ভূমিকা নিম্ন পর্যায়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাে। ১৯৬৯ সালের। আগস্ট মাসে বিশ্ব সফরের প্রাক্কালে যখন তিনি ভারত ও পাকিস্তানসহ পাঁচটি এশীয় দেশ সফর করেন তখন পর্যন্ত নিক্সন এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা যদিও যথাযথভাবে তার চুক্তিবদ্ধ প্রতিশ্রুতি পালন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একই সঙ্গে সে সেরকম নীতিমালাও। পরিহার করে চলবে যা এশীয় দেশগুলােতে যুক্তরাষ্ট্রের উপর এতটা নির্ভরশীল করে। তুলবে না যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধের ন্যায় এমন সংঘর্ষে জড়িয়ে যেতে পারে। নিক্সন এটা স্বীকার করেন যে, এ নীতিমালা অনুসরণ শক্ত, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এটা এমন এক নীতিমালা যা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নত করা যেতে পারে। নিক্সন ১৯৬৪ সালে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ড বা সে রকম যে কোনাে এশীয় দেশ যা অভ্যন্তরীণ ধ্বংসের মােকাবিলা করেছে- সেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হওয়া উচিৎ তাদের পক্ষে সে লক্ষ্যে কূটনৈতিক নীতিমালায় মৌলিক পরিবর্তন আনেন। যুদ্ধ করে দেওয়ার বদলে তাদেরও যুদ্ধে সাহায্য করা। নিক্সন এটাকে একটি উত্তম মূলনীতি ভেবেছিলেন। নিক্সন মতবাদের অধীন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া মূলনীতি ছিল প্রকাশ্য তৎপরতা নিম্ন পর্যায়ে রাখা। ইত্যবসরে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৫ সালের ধ্বংসাত্মক পাক-ভারত যুদ্ধের পর হতে উপমহাদেশের ব্যাপারে জড়িয়ে না পড়ার নীতি শুরু করেছিল; ভারত ও পাকিস্তান উভয়কে সামরিক সাহায্য প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হয়, অর্থনৈতিক সাহায্য চালু থাকে, যদিও তার পরিমাণ হ্রাস পায়। নতুন মার্কিনী নীতিমালার অধীনে দক্ষিণ এশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় কম অগ্রাধিকার প্রাপ্ত এলাকায় পরিণত হলেও যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে পূর্বে গৃহীত কূটনৈতিক তৎপরতা থেকে সরে আসেনি বা সম্পূর্ণভাবে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের জন্য ছেড়ে দিতে চায়নি।
নিকট প্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী প্রতিরক্ষা সচিব। জেমস্, এইচ, নয়েস ১৯৭৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতিমালা ব্যাখ্যা করে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনাে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা স্বার্থ নেই । উপমহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যে সব স্বার্থ রয়েছে তা প্রথমত রাজনৈতিক। তা হচ্ছে এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতায় মৌলিক আগ্রহ এবং কোনাে বহিশক্তি কোনাে একটি আঞ্চলিক রাষ্ট্রের উপর যাতে প্রাধান্য বিস্তার না করে তা নিশ্চিত করা।
সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চীনের প্রাথমিক বিরােধ আদর্শিক প্রতীয়মান হলেও প্রকৃত পক্ষে তা ছিল দু’টি দেশের প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযােগিতা। কিন্তু সােভিয়েত ইউনিয়ন চীনের সঙ্গে তার ক্রমবর্ধমান বিবাদের কারণে সম্প্রসারণবাদী পথ অনুসরণ করে চলে আপাতদৃষ্টিতে উপমহাদেশে রাশিয়ার ঐতিহ্যগত স্বার্থানুসারে, লর্ড কার্জন মানসপটে দেখতে পেয়েছিলেন ১৯০০ সালের দিকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আটককৃত সােভিয়েত নাজী দলিলাদিতে প্রকাশ পেয়েছে “সােভিয়েত সরকার পারস্য উপসাগর ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার স্বার্থ অনুসন্ধানে পুরানাে জার আমলের নীতিরই অনুসারী। ক্রেমলিন নেতৃবৃন্দ ১৯৬৯ এবং ১৯৭০ সালব্যাপী। নিরবচ্ছিন্নভাবে কূটনৈতিক তৎপরতায় নিয়েজিত ছিল চীনকে ঘিরে ফেলার নীতিতে, যার পূণঙ্গি পরিকল্পনা ছিলো এশিয়ায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক বলয় তৈরি করা। ব্রেজনেভ পরিকল্পনা নতুন সােভিয়েত পদক্ষেপসমূহের প্রধান উদ্দেশ্য চীনকে বিচ্ছিন্ন ও ঘিরে ফেলার সাথে সাথে এ অঞ্চলে তার বৃহৎশক্তিসুলভ আশা আকাঙ্ক্ষারও চরিতার্থ সাধন। সােভিয়েত-চীন বৈরিতার ক্রমবর্ধমানতায় প্রতিফলিত হয় ১৯৬৯ এবং ১৯৭০ সালে সােভিয়েত ইউনিয়নের কূটনৈতিক পদক্ষেপসমূহে। পঞ্চাশ বছরেরও অধিককাল ধরে সামরিক চুক্তির বিরােধিতা করে রুশ নেতৃবৃন্দ উল্কর্ষতা দেখতে পান ‘ডালেসবাদ-এ’ ফিরে যান। যার মূল কথা ছিল “we took strong action” কারণ চীনের বিরুদ্ধে তাদের জাতীয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। বিশেষত ডামনেস্কি দ্বীপ ও উসুরী নদীর পূর্বতীর পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করে। ১৯৬৯ সালে জুন মাসে মস্কোতে বিশ্ব কমিউনিস্ট সম্মেলনে ৭৫টি দেশের পার্টি প্রতিনিধিদের সামনে সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি ব্রেজনেভ চীনের কঠোর সমালােচনা করেন।  সােভিয়েত ইউনিয়নের পদক্ষেপসমূহের প্রতি সাড়া দিতে পাকিস্তানের বিশেষ অসুবিধা ও উভয় সংকট ছিলাে। কারণ, সে বুঝতে পেরেছিল যে, কোসিগিনের আঞ্চলিক অর্থনেতিক গােষ্ঠীবদ্ধকরণ পরিকল্পনা এবং ব্রেজনেভের এশীয় সম্মিলিত প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা উভয়ই তার ঘনিষ্ঠতম মিত্র চীনের বিরুদ্ধে তাক করা, যে চীন ভারত ও পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞার পরও দেশটি পাকিস্তানে প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারীতে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান ও চীন এবং সােভিয়েত প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার বৈপরীত্য এবং পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের বিনিময়ে মস্কোর সম্পর্কের অন্বেষণে অনেক কাঠখড় পােড়ানাের দরকার ছিল।
কিন্তু ১৯৭০ সালের শুরু হতেই সােভিয়েত পত্র-পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যম পুরানাে পাকিস্তানবিরােধী নিন্দাদের অভিযানে ফিরে যায়। উদাহরণস্বরূপ নিউ টাইমস্ পত্রিকা ১৯৭০ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের উপর এক দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করে যা ছিলাে সমালােচনা ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যে পরিপূর্ণ। এমন সময়ে তা করা হয় যখন পাকিস্ত নি সরকার মােকাবিলা এড়াতে এবং পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানের মধ্যে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলােচনায় রত ছিল। নিউ টাইমস পত্রিকার নিবন্ধ এ সময়ে পাকিস্তানের প্রতি কঠোরতর সােভিয়েত মনােভাবকেই প্রতিফলিত করে; মস্কোতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতও ক্রমবর্ধমান চাপ’ এবং কঠোর মনােভাব এর খবর পাঠাতে থাকেন। বাংলাদেশ সংকটের প্রাক্কালে পাকিস্তানের প্রতি সােভিয়েত মনােভাব ও নীতি এবং “বাংলাদেশর দুর্গত মানবতা’র জন্য সােভিয়েত উদ্বেগ অনুধাবন করার দূরবর্তী সিগন্যাল মাত্র। সােভিয়েত রাশিয়া কেবল বাংলাদেশে দুর্গত মানবতার কারণেই বিচলিত এমনটি নয়। বরং এক্ষেত্রে উপমহাদেশে বিশেষকরে ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টিও প্রাধান্য পেয়েছে।  চীনও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যে ছিলাে যা আইয়ুবের মনে চীনা সাহায্যের ব্যাপারে ভয়ের সৃষ্টি করেছিল, মওলানা ভাসানী চীনা বিপ্লবের অনুসরণে লালটুপি বাহিনী তৈরি করে এবং মাও সেতুং-এর নির্দেশে দীর্ঘ দিন ‘আইয়ুবকে। বিরক্ত না করার’ নীতি আঁকড়ে ধরে থাকলেও ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে এসে দেশের বিরাজমান অবস্থা বিবেচনায় আইয়ুব খানের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করতে মওলানা ভাসানী বাধ্য হন ,” চীন ১৯৬৭-৬৮ সালে পাকিস্তানে অস্ত্রের চালান অব্যাহত রাখে। ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান যখন নিক্সনের দেওয়া বিরাট দায়িত্ব ওয়াশিংটন ও পিকিং এর মধ্যে ‘দূত’ হিসেবে কাজ শুরু করেন তখন চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আবারাে ঘনিষ্ঠ হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভূমিকা ওয়াশিংটনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নত করে যেহেতু পাক-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে উপ-মহাদেশের বাস্তবতা ও গতিশীলতার ব্যাপারে নিক্সনের উত্তম উপলদ্ধি ছিলাে।
১৯৭০ সালের নভেম্বরে ইয়াহিয়া খান যখন পিকিং সফর করেন, তখন চীন পূর্ব-পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতা আন্দোলনের জন্য সক্রিয় বহিঃশক্তির ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। পাকিস্তানের গােয়েন্দা সংস্থাসমূহ, বেসামরিক এবং সামরিক উভয়ই ১৯৭০ সালে পাকিস্তান যখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে একটি টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্বেষণ করছিল তখন পূর্বপাকিস্তানে সক্রিয় বহিঃশক্তিসমূহের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে খবর দিয়েছিল। এ হচ্ছে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব দক্ষিণ এশীয় বহুমাত্রিক কূটনীণিতক চিত্র । সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল এবং অন্যান্য চীনবিরােধী পদক্ষেপে যােগ দিতে তার অস্বীকৃতির কারণে। পাক-চীন এবং পাক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ছিল আন্তরিক এবং নিক্সনের নয়া চীন নীতির প্রেক্ষাপটে যাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তা আরাে উন্নত হয়। মস্কোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যার পশ্চাতে ছিল পনের বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস তা চীনের প্রভাব খর্ব করার ক্ষেত্রে দেশ আরাে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে। পাকিস্তান সামরিক জান্তা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর নানা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত এবং হীন কৌশল গ্রহণ করে। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন তার মূল শক্তির কেন্দ্রবিন্দু পশ্চিম পাকিস্তান এবং সামরিক বাহিনী। মূল শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ তার পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং ইচ্ছাও ছিল না। তিনি তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য জুলফিকার আলী ভূট্টোকে উস্কে দিলেন যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভূট্টোর মধ্যে কোনাে রাজনৈতিক সমঝােতা না হয়। ভূট্টো ও সামরিক জান্তার পরামর্শে তিনি ৩রা মার্চ আহুত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। স্থগিত ঘােষণার ফলে বাঙালি জাতির নিকট পরিষ্কার হয়ে গেল যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা দেবে না।
এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিরাজমান অবস্থা ও তার পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে অবগত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কদের মতে এসব ষড়যন্ত্রকে মােকাবেলা করার জন্য শান্তিপূর্ণ হরতাল ও অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি তিন ধরনের কৌশল গ্রহণ করলেন ক, শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলনের মাধ্যমে সমস্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা, খ, আলােচনার পথকে রুদ্ধ না করে বিশ্বকে দেখাতে চাইলেন তিনি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পথকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন ও গ, অসহযােগ আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) শাসনভার সহস্তে তুলে নিলেন। তার নির্দেশ মতােই শাসন, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের কার্যক্রম চলতে থাকে, সামরিক শাসকদের সমস্ত নির্দেশ অচল ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। অসহযােগ আন্দোলনকে সশস্ত্রকরণের গােপন কৌশল গ্রহণ করেন। ১৫ই মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে আলােচনার জন্য আগমন করলে তাকে ‘অতিথি হিসেবে অভিহিত করেন। একথাটির সহজ অর্থ। বাংলাদেশ তখন প্রকৃত অর্থেই যেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ইয়াহিয়া খান আলােচনা করলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো এলেন। আলােচনা ব্যর্থ হলাে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় গােপনে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পূর্বে সামরিক আক্রমণের নির্দেশ দিলেন যার ব্লুপ্রিন্ট ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পূর্বেই প্রস্তুত ও অনুমােদিত ছিল। ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জাতি ও বাঙালি সেনা অফিসার, ইপিআর, পুলিশ বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে আলােকপাত বিশেষ গুরুত্ব বহন করে যা সামগ্রিক কূটনৈতিক যুদ্ধকে সমৃদ্ধ করেছে। | নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি কর্তৃক স্বাধীনতার সনদ প্রণীত, সমর্থন এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘােষিত স্বাধীনতা ঘােষণার অনুমােদন, বাঙালি জাতির ন্যায়সঙ্গত আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় মুজিবনগর সরকার গঠন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘােষণার প্রায় অনুরূপ।
বাংলাদেশে মাটিতে বসে প্রতিবেশী ভারতীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা প্রাপ্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করা দুরূহ ছিল বলেই বঙ্গবন্ধু ব্রিটেনে এ-সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। তার ফলশ্রুতিতে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সহজ হয়। দিল্লিতে ৪ঠা এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারি বাসভবনে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎ হয়। তাজউদ্দীন আহমেদ ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র এবং অন্যান্য সামরিক উপকরণ, সহযােগিতা এবং সংশ্লিষ্ট সাহায্যাদি প্রয়ােজন।” ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনার পর তাজউদ্দীন আহমেদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রয়ােজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। কারণ ইন্দিরা। গান্ধীর নিকট তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন এবং ২৬শে মার্চেই শেখ মুজিব হাইকমান্ডারদের নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন বলে ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়েছিলেন। এই অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তাজউদ্দীন আনুষ্ঠানিক ঘােষণায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ ১৭ই এপ্রিল। মুজিবনগরে স্বাধীনতার সনদ ঘােষণা করেন। ঘােষণাপত্রে বলা হয়, “বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদান করেন। উক্ত ঘােষণায় আরাে বলা হয়, “বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত। কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।
ঘােষণা করিলাম, এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতিপূর্বে ঘােষিত স্বাধীনতা। দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমােদন করা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন, এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক।” এবং অন্যান্য মন্ত্রী নিয়ােগ করবেন। নির্বাহী, আইন প্রণয়ন, করারােপ, অর্থব্যয়ন এবং বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মন্ত্ৰাতিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় অন্যান্য সকল কার্য। সম্পাদন করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার ঘােষণায় (Proclamation of Independence) জাতিসংঘ সনদ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রদত্ত ১০ই এপ্রিল। ভাষণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা তুলে ধরেন। ভারত সরকারের নিকট বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে সাহায্য সহযােগিতার অনুরোধ, বিশ্বব্যাপী সুসংগঠিতভাবে প্রচার, বিশ্বজনমত বাংলাদেশের স্বপক্ষে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা, পাকিস্তানে কর্মরত কূটনৈতিকবৃন্দের পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক বার্তা হিসেবেই। গুরুত্বপূর্ণ। ১৮ই এপ্রিল কলকাতায় পাকিস্তানের দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলী প্রথম বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তপূর্বে ৮ই এপ্রিল নতুন দিল্লি দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তা কে,এম, শাহাবুদ্দিন এবং আমজাদুল হক পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে ভারত সরকারের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। পর্যায়ক্রমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অধীন কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন ও সুইডেনে দূতাবাস গড়ে তােলা হয় এবং সেখান থেকে পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্ব ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধি নিয়ােগ প্রদান করে। তিনি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন এবং ইউরােপের দেশসমূহে স্বাধীনতার স্বপক্ষে যৌক্তিক, বস্তুগত ও বিষয়ীগত দিকগুলাে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। মুজিবনগর সরকার শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখেনি। পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতি এবং পাকিস্তানকে সামরিক ক্ষেত্রে সহায়তা বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান সামরিক প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম, এম, আহমেদ যখন ওয়াশিংটন দাতা দেশগুলাের কনসাের্টিয়ামে যাচ্ছিলেন সাহায্য অব্যাহত রাখার আবেদন নিয়ে তখন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নির্দেশে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সােবহান তার পিছু নিয়ে লন্ডন ও ওয়াশিংটনে রওনা হন। রেহমান সােবহান-এর সঙ্গে প্রথম যােগাযােগ ঘটে এক ইংরেজের সঙ্গে যার নাম আইপি কারগিল । বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার সঙ্গে তিনি সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন। বাংলাদেশের সমস্যার মানবিক দিকগুলাে তাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। তিনি পাকিস্তানে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৃশংসতার উপরে একটি মানবিক বিপর্যয়’-এর প্রতিবেদন পেশ করলে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সাহায্যকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত কনসাের্টিয়াম পাকিস্তান নতুন সাহায্য দানের কোনাে আশ্বাস দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কনসাের্টিয়াম বৈঠকের ফলাফল পাকিস্ত েিনর জন্য ছিল এক বিরাট ধাক্কা। | ভারতের অভ্যন্তরে জনমত গঠন, রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের পদক্ষেপ গ্রহণ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ এবং সরকারের অভ্যন্তরে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ, মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে রূপ দেবার লক্ষ্যে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন উল্লেখযােগ্য সিদ্ধান্ত। যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন এবং ভারতসহ বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের নিকট মুজিবনগর সরকার গণহত্যা বন্ধ, বাংলাদেশের মাটি হতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর

প্রত্যাহার এবং সর্বোপরি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বহুমাত্রিক কূটনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনীর প্রশিক্ষণ শক্তিশালী করা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গণমাধ্যমে দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্যাপক প্রচার প্রপাগান্ডা ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় পরিকল্পিত কার্যোদ্যগ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। 
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতীয় লােকসভায় বক্তৃতা করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের অনুরােধ জানান। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বিভিন্ন সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতে বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১৫ই অক্টোবর, ১৫ নভেম্বর ও ২৩শে নভেম্বর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে এ প্রসঙ্গে স্বীকৃতি দেবার অনুরােধ জানিয়ে ৩টি চিঠি লেখেন।” বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার অনুরােধ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এনে ভারত সরকার ১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ইতােমধ্যে ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে সামরিক হামলা চালায়। এ আক্রমণও ভারতের জন্য। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। স্বীকৃতির পরই পাকিস্তানিদের উপর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর তীব্র হামলা শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাকিস্ত নি বাহিনী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত হতে থাকে এবং যুদ্ধের এক পর্যায়ে পর্যুদস্ত হয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সহায়তা, প্রবাসী সরকারকে ভারতের সার্বিক সাহায্য প্রদান ও শরণার্থীদের পুনর্বাসনে ভারত সরকারের উদ্যোগ মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যের পরিচায়ক। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুজিবনগর সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একদিকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, অন্যদিকে কূটনৈতিক যুদ্ধের কৌশলগত ভূমিকা যথাযথভাবেই পালন করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
তৃতীয় অধ্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা সম্পর্কে  আলােকপাত করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংগঠনসমূহের নিকট স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের যৌক্তিকতা তুলে ধরা, সমর্থন ও স্বীকৃতি আদায়, গণহত্যা বন্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অর্থ ও অস্ত্র সগ্রহের উদ্যোগ, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ-স্বপক্ষে জনমত গঠন, | জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার সহযােগিতা কামনা, শরণার্থীদের দুর্দশা লাঘবের জন্য বিভিন্ন রকম তৎপরতা এই অধ্যায়ের আলােচিত বিষয়। এর সঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিদেশি | জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যমকে সার্থকভাবে জড়িয়ে ফেলার কূটনৈতিক তৎপরতা। | ১৩ই সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী সুইডেন থেকে ফিনল্যান্ড গিয়ে ফিনিশ টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেন এবং পার্লামেন্ট ভবনে কতিপয় পার্লামেন্ট সদস্যের সাথে বাংলাদেশ ওস্টেগার্ড ও তাঁর সহকর্মীরা বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে একটা বুলেটিন প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এভাবে তিনি একনাগাড়ে ৭-১৬ই সেপ্টেম্বর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলাে সফর করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সফরে সংশ্লিষ্ট দেশগুলাের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভে সক্ষম হয়।
১-১০ই সেপ্টেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের বার্ষিক সভায় লন্ডনের বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির একটা প্রতিনিধি দল গমন করেন। প্রতিনিধি দলটি বিভিন্ন দেশ থেকে আগত জনপ্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশ পাকিস্তানি গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণ কয়েকটি মুসলিম দেশ বিশেষকরে মিশর ও জর্ডানের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যায় সফল হন। প্রবাসী বাঙালিরা বিদেশে এক একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে উদ্যোগে কাজ করে বিশ্বজনমত গঠনে অবিস্মরণীয় তৎপরতা চালান। ২৫শে মার্চ হত্যাযজ্ঞের খবর প্রকাশিত হবার পরই বাঙালিদের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের কাছে এর প্রতিবাদ জানাবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন, সেক্রেটারি রজার্স, নিরাপত্তা সহকারী কিসিঞ্জার ও সিনেটে বৈদেশিক কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর ফুলব্রাইটের কাছে কয়েকটি ফ্যাক্স বার্তা পাঠানাে হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট ও নিরাপত্তা পরিষদের কাছেও অনুরূপ বার্তা যায়।” | ১লা এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেসে সিনেটর কেনেডি ও সিনেটর হ্যারিস বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যার নিন্দা জানান এবং নিরীহ মানুষের উপর পাকিস্তানিদের আক্রমণ। বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেবার জন্য মার্কিন সরকারকে আহ্বান জানান। মার্কিন প্রবাসী। বাঙালিগণ এ দুই সিনেটনের বক্তব্যে উৎসাহিত হন।” এভাবে ক্রমান্বয়ে মার্কিন সমাজে বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতি জাগ্রত হয়। এপ্রিল মাসেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডীন রবার্ট মেসন, রবার্ট ডর্ফম্যান ও স্টিফেন মার্গলিন বাংলাদেশের অতীত বঞ্চনা ও সংঘটিত নারকীয় ঘটনার উপর ভিত্তি করে একটা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তা সরকারের কাছে তুলে ধরেন এবং পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক সাহায্য বন্ধের সুপারিশ করেন।
এ সুপারিশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে মার্কিন জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ৭২ ১২ই এপ্রিল ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব ইউনিভার্সিটি ইমারজেন্সি (ICUE) বাংলাদেশে শিক্ষক ও ছাত্র হত্যার নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে অনেক নােবেল বিজয়ী পণ্ডিত ও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষক স্বাক্ষর করেন। ২৯শে এপ্রিল  ‘আমেরিকান সােসাইটি অব ইন্টারন্যাশনাল ল’ এর বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় স্টেটলার হিলটন হােটেলে। এ সম্মেলনে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গর্ডন গটলিয়ের মানবাধিকারের উপর বক্তৃতায় বাংলাদেশের গণহত্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরােপের দাবি জানান। তাঁর এ বক্তব্য মুক্তিসংগ্রামী মানুষকে নাড়া দিতে সমর্থ হয়। এপ্রিল মাসের শেষদিকে বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রেহমান সােবহান যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। তিনি বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতির কিছু চিত্র তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানের বর্বরতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি তাজউদ্দীন আহমদের ১৭ই এপ্রিলের ভাষণের লিখিত কপি প্রচারের ব্যবস্থা করেন। তিনি ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক বাঙালি কূটনীতিকদের নিয়ে একটা বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের উদ্যোগ নেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সংস্থা ও সংগঠন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করে। বেঙ্গল স্টাডিজ কনফারেন্স, কমিটি অব কনসার্নড এশিয়ান স্কলারস, বেঙ্গল ক্রাইসিস কমিটি ও আমেরিকান এনথ্রোপােলজিক্যাল সােসাইটি নামক সংগঠনগুলাে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করে। নিউইয়র্কের মেডিসিন স্কোয়ার গার্ডেনে ১ আগস্ট জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ কনসার্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পণ্ডিত রবিশংকের প্রচেষ্টায় এ অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানের উপার্জিত অর্থ ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পাঠানাে হয়।* এফ.আর, খানের প্রচেষ্টায় মে মাসেই শিকাগােতে বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ গঠিত হয়। ৬ই জুন শিকাগােতে সকল বাঙালি সমিতির প্রতিনিধিদের এফ.আর. খান শিকাগােতে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে আলােচনা হয়।
২৩শে জুন নিউইয়র্কে একটি কনভেনশন হয়। এ কনভেনশনে যুক্তরাষ্ট্রে একটি বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মুজিবনগর সরকারের প্রচেষ্টায় ৪ঠা আগস্ট ছয়জন কূটনীতিকসহ ১৪ জন। বাঙালি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতেই আগস্ট মাসে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসংশ্লিষ্ট এ ঘটনাগুলাে যুক্তরাষ্ট্রে সাড়া জাগায় এবং পাকিস্তান কূটনৈতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এম, আর, সিদ্দিকী ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান। হিসেবে যােগ দেন। এ সময় আনুষ্ঠানিক ভাবে ১২২৩, কানেকটিকাট এভিনিউতে মিশন। স্থাপিত হয়। এম, আর, সিদ্দিকী মিশন প্রধান হিসেবে যােগদানের পর মিশন গতিশীল হয়। তিনি কানাডার টরেন্টো ও যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসসহ বেশ কিছু জায়গায় সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যােগদানের জন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশ সরকার নিইউয়র্কে পাঠায়। এ প্রতিনিধি দল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করে। বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি বর্বরতার বর্ণনা দেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেন। সাংবাদিক জে.কে, ব্যানার্জির অতিথি হিসেবে এ প্রতিনিধি দল জাতিসংঘ ভবনে যাতায়াত করতেন।” বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের প্রচারমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিগণ বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের পটভূমি জানতে পারে এবং অনেক দেশই সহমর্মিতা জ্ঞাপন করে। উল্লেখ্য যে, এ সময় বাঙালি হয়েও শাহ আজিজুর রহমান, রাজিয়া ফয়েজ ও মাহমুদ আলী পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালানাের জন্য নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন।” বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণ জাতিসংঘ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন স্থানে। জনসংযােগ করেন। প্রফেসর এ, আর, মল্লিক আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন।
২৭শে সেপ্টেম্বর-১লা অক্টোবর ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর যৌথসভা ছিল। এতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হন। ড. নুরুল ইসলাম, রেহমান সােবহান ও এ, এম, এ. মুহিত এখানে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার কাজ চালান। এবং পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালান। বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণ চিলি, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরেন। ২রা অক্টোবর কনসাের্টিয়ামের সভায় কোনাে দাতা দেশ পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার ঋণ প্রদান করেনি। এক্ষেত্রে পাকিস্তান কূটনৈতিকভাবে চরম পরাজয় বরণ করে এবং বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়। সিনেটর কেনেডি ২৩শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহায়তার জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ চেয়ে একটা বিল উত্থাপন করেন। এরপর অক্টোবর মাসে মার্কিন সিনেটে স্যাক্সবি চার্চ সংশােধনী উত্থাপিত হয়। এতে পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য বন্ধের প্রস্তাব ছিল। অন্যদিকে, সিনেটর ফুস্প্রাইট উত্থাপিত ভিন্ন একটা বিলে বাংলাদেশের। শরণার্থীদের জন্য ২৫০ মিলিয়ন ডলার ত্রাণ সাহায্য বরাদ্দ করা হয়। স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য মার্কিন সিনেটে এ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণাদায়ক। বাংলাদেশের। কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞগণ সিনেটের এসব অধিবেশনকালে সদস্যদের সাথে যােগাযােগ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে স্নায়ুযুদ্ধ বিরাজমান থাকায় যে কোনাে আন্তর্জাতিক সংকটে যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়ন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। এজন্য বাংলাদেশ কমিউনিস্টভুক্ত দেশগুলাের সাথে যােগাযােগ রক্ষার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে। এরই অংশ হিসেবে হাঙ্গেরীর বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে (১৬-২৪ মে, ১৯৭১) বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন আব্দুস। সামাদ আজাদ, ডা, সারােয়ার আলী ও দেওয়ান মাহবুব আলী।” আবদুস সামাদ আজাদ এ সম্মেলন থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের কাছে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত। রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের অনেক চিঠি পােস্ট করেন। বুদাপেস্ট থেকে আব্দুস সামাদ আজাদ পূর্ব জার্মানি যান। পূর্ব জার্মান সরকার বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে সরকারি মর্যাদা দেন। অতঃপর এখান থেকে তিনি চেকোশ্লোভাকিয়া, পােল্যান্ড ও বুলগেরিয়া গমন করেন। সামগ্রিক বিচারে মুজিবনগর সরকারের উদ্যোগে, প্রেরণায় বিদেশি বাঙালিরা বলতে গেলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সার্বিকভাবে যে সাহায্য-সহযােগিতা, বিশ্বজনমত গঠন, বিদেশে জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যমকে বাংলাদেশের স্বপক্ষে সক্রিয় করা এবং রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য।
চতুর্থ অধ্যায়ে বন্দি শেখ মুজিবকে ঘিরে বিশ্ব কূটনৈতিক তৎপরতা পর্যালােচনা করা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, পাকিস্তান কারাগার হতে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান, পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সামরিক ট্রাইব্যুনালে তার বিচার কার্য বন্ধ এবং নিঃশর্ত মুক্তির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং সােভিয়েত রাশিয়া ও ব্রিটেনসহ বিশ্ব রাষ্ট্রসমূহের প্রতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পত্র প্রেরণ, কার্যক্রম ও উদ্যোগ মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার এক বিশেষ অধ্যায়। পঞ্চম অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম দেশগুলির কূটনৈতিক তৎপরতা আলােচনা করা হয়েছে। সপ্তম অধ্যায়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের বহুমাত্রিক ভূমিকা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ পর্যায়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘর্য এবং জাতিসংঘের কার্যক্রম সম্পর্কে এই অধ্যায়ে আলােচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব উদ্বেগ প্রকাশ করলেও পাকিস্তান সামরিক জান্তার নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক বক্তব্য প্রদানে বিরত থাকেন। তবে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য সাহায্য-সহযােগিতার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ইতিবাচক ভূমিকা লক্ষণীয়। কিন্তু শরণার্থী প্রশ্নে মূল স্থায়ী সমস্যা নিরসনে যে রাজনৈতিক প্রশ্ন জড়িত জাতিসংঘ সে ক্ষেত্রে অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়নি। জাতিসংঘের অভ্যন্তরে অথবা বাইরে পরাশক্তিগুলাের পারস্পরিক স্বার্থ সমন্বিত করার কোনাে উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যায়নি। নিরাপত্তা ও সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে জাতিসংঘ কেবল দীর্ঘ বিতর্কের অঙ্গন হিসেবেই বিবেচিত হয়। তবে লক্ষণীয় ৪ঠা ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশনের পূর্বাহ্নে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের পক্ষে বক্তব্য রাখার জন্য মৌলিক পত্র পেশের আবেদন জানান। তার পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। সে বিতর্কে বাংলাদেশের প্রতিনিধি আবু সাঈদ চৌধুরীকে পরিষদে বক্তব্য রাখার সুযােগ না দিলেও নিরাপত্তা। পরিষদে পত্রটি বিলি করার অনুমতির মাধ্যমে তা জাতিসংঘে অফিসিয়াল ডকুমেন্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এটা ছিল একটি কূটনৈতিক বিজয়। 
নিরাপত্তা পরিষদে চীন-মার্কিন উদ্যোগ অকেজো হয়ে যায় প্রধানত সােভিয়েত ভেটোর কারণে। পাশাপাশি ফ্রান্স ও ব্রিটেনের নিরপেক্ষ অবস্থান বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করে। সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার পক্ষে ১০৪টি দেশ ভােট প্রদান করে, বিপক্ষে ১১টি এবং ভােটদানে বিরত থাকে ১৬টি দেশ। কিন্তু, ততদিনে বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিশ্চিত হয়ে গেছে। ফলে সাধারণ পরিষদের বৈঠকের ফলাফল কার্যত কোনাে কাজে আসেনি। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বহুমাত্রিক কূটনীতি, আগ্রাসন এবং মুসলিম দেশগুলাে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিলেও কূটনৈতিক বিজয়ের। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে সামরিক বিজয় বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে। শত কূটিল বৈরীতা ও প্রতিকূলতার মাঝেও প্রতিষ্ঠিত হয়। অষ্টম অধ্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে চতুর্ভূজ কূটনৈতিক যুদ্ধ বিষয়ে আলােচিত হয়েছে। ১৯৪৭-১৯৭১ সালের জাতীয়-আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘটনা, পটভূমি ও ভূমিকা প্রথম অধ্যায়ে বিস্তারিত না হলেও মােটামােটিভাবে তুলে ধরার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। তকালীন বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং পুজিবাদী রাষ্ট্র বিশেষকরে পশ্চিমা দেশের মধ্যেকার স্নায়ুযুদ্ধ বিশ্বকে দুই শিবিরে বিভক্ত করে রেখেছিল। পূর্ব ইউরােপের মতাে দেশ ওয়ারশ চুক্তির মাধ্যমে সােভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শিক আনুগত্যের বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ইউরােপের একাধিক দেশকে নিয়ে ন্যাটো জোট গঠন করতে সমর্থ হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক ও পুজিবাদী গণতান্ত্রিক ধাচের জোটবদ্ধ রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে এইসব দ্বন্দ্ব বিস্তৃত হয়েছিল। জন্মলগ্ন হতেই পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের কূটনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণে মূল শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল ভারত। ভারত বিভক্তির পর পরই কাশ্মীরকে নিয়ে যে যুদ্ধ হয় সেই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কজায় গিয়ে পড়ে।
ফলে সিয়াটো ও সেন্টো দুটি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং তার সদস্যভুক্ত হয়, যা ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও তাদের স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গণ-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করার লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান মার্কিনীদের প্রত্যক্ষ সম্মতিতে ক্ষমতা দখল করে এবং সামরিক শাসন জারি করে। এর ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক এবং শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিরােধী শক্তি হিসেবে সসাভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলাে তাদের প্রভাব বলয়, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রচার প্রচারণা এবং ক্ষেত্র বিশেষে সম্প্রসারণ মনােভাব দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্ব বিশ্বকে দুই কূটনৈতিক শিবিরে বিভক্ত করে। ১৯৪৯ সালে সােভিয়েত রাশিয়ার সমর্থনে সমাজতান্ত্রিক চীনের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে প্রথম দিকে প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক সহযােগিতা চুক্তি সম্পাদিত হলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৬০ দশক থেকে এ দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরীতা সৃষ্টি হয়। ফলে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক শিবির বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং বিশ্বব্যাপী একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়। ব্রেজনেভ মতবাদ ১৯৬৯ সালের জুনে ঘােষিত হলে চীন পর্যবেক্ষণ করে যে, এর অন্তরালে রয়েছে চীন-সােভিয়েত সীমান্ত সংঘর্ষের ফলশ্রুতিতে এশিয়ায় সােভিয়েত যৌথ নিরাপত্তাব্যবস্থা। এ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সােভিয়েতের লক্ষ্য ছিল দ্বিমুখী। চীনকে ঘিরে ফেলা এবং এশিয়ার দেশসমূহের উপরে সােভিয়েতের প্রাধান্য বিস্তার। চীন স্পষ্টতই প্রত্যক্ষ করে সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে কাছে টানার। উদ্যোগ নিয়েছে এবং এই উদ্যোগ ছিল চীন-ভারত দ্বন্দ্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।” যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের পারস্পরিক শত্রুতার প্রেক্ষিতে চীনের নিজস্ব স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নমনীয়তা যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্কে স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন চীন-মার্কিন দুই দেশ পারস্পরিকভাবে মৈত্রী বন্ধনে অগ্রসর হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় পররাষ্ট্রনীতিতে চীনের আদর্শগত ভিত ছিল না, নিজস্ব স্বার্থগত অবস্থান তাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। চীন নিজস্ব কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করেছে পাকিস্তানের মতাে একটি মিত্র দেশ দুর্বল হয়ে পড়লে তা অভিন্ন শত্রু ভারত শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
সেজন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীন যে ভূমিকা গ্রহণ করে তা ছিল স্বীকৃত পঞ্চশীলা নীতির পরিপন্থি, কেননা পঞ্চশীলা নীতির মর্মকথাই হলাে শান্তি পূর্ণ সহবস্থান। ১৯৪৯ সালে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ শক্তি হিসেবে ভারতের প্রতি চীনের মনােভাব ছিল প্রায় বন্ধুত্বসূলভ। ভারত প্রথম থেকেই নিজোট পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করার ফলে কোরিয়া এবং তিব্বতের মতাে চীনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ভারতের নিরপেক্ষ। দৃষ্টিভঙ্গির ফলে ভারতের প্রতি চীনের মনােভাবের পরিবর্তন ঘটে। এশিয়া বিষয়ে দুই দেশই যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপমূলক নীতি সীমিতকরণ বিষয়ে ঐকমত্য প্রবণতা দেখা যায়। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত দুই প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে সংলাপ সহযােগিতা এবং ১৯৫৪ সালে তিব্বত চুক্তি সম্পাদন করে। এছাড়াও এ চুক্তিতে পঞ্চশীলা নীতি গৃহীত হয়, যে নীতিতে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ সময়ে ভারত বান্দুং নীতির ধারক বাহক হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এশিয়াআফ্রিকায় নব স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশসমূহের মুখপাত্র হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে প্রয়াসী হয়। চীনও ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে এবং পঞ্চশীলা নীতিমালার আলােকে অনেক আফ্রো-এশীয় দেশসমূহের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ভারতের সঙ্গে চীন সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলার প্রয়াস চালায়। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে দুই দেশের সীমান্তের অধিকার ও কর্তৃত্ব নিয়ে ভারত-চীন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৬২ সালে চীন ভারত সীমান্তে স্বল্পকালীন অথচ এক তীব্র যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়ন দুই পরাশক্তি ভারতকে কূটনৈতিক সমর্থন এবং সামরিক সহযােগিতা প্রদান করে। এতে চীনের ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, ভারত বান্দুং নীতিমালা পরিত্যাগ করেছে, জোটনিরপেক্ষ নীতিমালা বিসর্জন দিয়েছে এবং সােভিয়েত এবং ভারত সম্পর্কের অন্তরালে পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। 
চীন তার নিজস্ব নীতিমালার আলােকে ভারতের বৈরী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের মাধ্যমে চীন পাকিস্তানের পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান গ্রহণ করায় চীন এবং ভারতের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং সােভিয়েত রাশিয়ার ভূমিকা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বিষয়টি উল্লেখ্য। আদর্শিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত এবং পাকিস্তান দুই প্রতিযােগী শক্তিকে কমিউনিস্ট বহির্ভূত রাষ্ট্র হিসেবে কাঠামােগত ব্যবস্থার মধ্যে আবদ্ধ করতে সচেষ্ট ছিল। যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি ও আঞ্চলিক শক্তিদ্বয়ের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখেই তাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৫০-এর দশকে ভারত মার্কিন সৃষ্ট সামরিক জোটে যােগ না দেওয়ার ফলে পাকিস্তানকে দিয়েছে সামরিক সরবরাহ। একই সাথে ভারতকে হাতে রাখার নীতি হিসেবে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করে একটি ভারসাম্যমূলক নীতি গ্রহণ করেছে। যা ভারত সর্বদা যুক্তরাষ্ট্রের এই ভারসাম্যমূলক নীতিকে পাকিস্তানপন্থি হিসেবেই বিবেচনা করে। ১৯৬২ সালে দক্ষিণ এশিয়া মার্কিন নীতির কৌশলগত পরিবর্তনকে পাকিস্তান মৈত্রী সম্পর্কের অবনতি হিসেবে ধরে নেয়। ঐ। সময় চীন-ভারত যুদ্ধে মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম ভারতে প্রেরণ পাকিস্তানকে বিক্ষুদ্ধ করে। তুলে। পক্ষান্তরে, ১৯৭১ সালে চীনের প্রতি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ভারত তার। কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখে। সােভিয়েত ইউনিয়ন পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি দক্ষিণ এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মৈত্রী চুক্তিকে সােভিয়েতবিরােধী বেষ্টনী সৃষ্টির প্রয়াস হিসেবে মনে করে। সােভিয়েত রাশিয়া কৌশলগত স্বার্থ অন্বেষায় দক্ষিণ এশিয়ায়। ভারতের সঙ্গে বন্ধুপ্রতিম সম্পর্ক গড়ে তুলে।
সােভিয়েত ইউনিয়নের দক্ষিণ এশিয়ায় গৃহীত নীতির সঙ্গে ভারতের সমর্থন প্রায় সর্বদায় একীভূত হয়ে থাকে। ভারত এবং সােভিয়েত-এর সম্পর্ককে দৃষ্টান্ত হিসেবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলাের মধ্যে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে প্রযুক্তি ও শিল্পখাতে ভারতের ক্রমবর্ধমান শক্তি সঞ্চয় সােভিয়েত নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এরূপ একটি বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এবং অন্যদিকে ভারত এবং সােভিয়েত রাশিয়ার পারস্পরিক বিরােধী চতুর্ভুজ কূটনীতির। দ্বান্দ্বিক জটিলতা বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে বিশ্বযুদ্ধের অনুক্ত ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কূটনৈতিক যুদ্ধ – আবু সাইয়িদ

 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!